ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রহঃ) ৫৩৯ টি
ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রহঃ) ৫৩৯ টি
প্রশ্ন: (১) তাওহীদ কাকে বলে? তা কত প্রকার ও কী কী?

উত্তর: তাওহীদ শব্দটি (وحد) ক্রিয়ামূল থেকে উৎপত্তি হয়েছে। এর আভিধানিক অর্থ কোনো জিনিসকে একক হিসেবে নির্ধারণ করা। ‘না’ বাচক ও ‘হ্যাঁ’ বাচক উক্তি ব্যতীত এটির বাস্তবায়ন হওয়া সম্ভব নয়। অর্থাৎ একককৃত বস্তু ব্যতীত অন্য বস্তু হতে কোনো বিধানকে অস্বীকার করে একককৃত বস্তুর জন্য তা সাব্যস্ত করা। উদাহরণস্বরূপ আমরা বলব, “আল্লাহ ছাড়া সত্য কোনো মা‘বূদ নেই” একথার সাক্ষ্য দেওয়া ব্যতীত কোনো ব্যক্তির তাওহীদ পূর্ণ হবে না। যে ব্যক্তি এ সাক্ষ্য প্রদান করবে, সে আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য সকল বস্তু হতে উলুহিয়্যাতকে (ইবাদাত) অস্বীকার করে শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য তা সাব্যস্ত করবে। কারণ, শুধুমাত্র নাফী বা ‘না’ বাচক বাক্যের মাধ্যমে কোনো বস্তুকে গুণাগুণ থেকে মুক্ত করা হয়। আর শুধুমাত্র ‘হ্যাঁ’ বাচক বাক্যের মাধ্যমে কোনো বস্তুর জন্য কোনো বিধান সাব্যস্ত করলে সেই বিধানে অন্যের অংশ গ্রহণকে বাধা প্রদান করে না। যেমন. উদাহরণস্বরূপ যদি আপনি বলেন, ‘অমুক ব্যক্তি দাঁড়ানো’। এ বাক্যে আপনি তার জন্য দণ্ডায়মান হওয়াকে সাব্যস্ত করলেন। তবে আপনি তাকে দণ্ডায়মান গুণের মাধ্যমে একক হিসাবে সাব্যস্ত করলেন না। হতে পারে এ গুণের মাঝে অন্যরাও শরীক আছে। অর্থাৎ অমুক ব্যক্তির সাথে অন্যান্য ব্যক্তিগণও দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। আর যদি বল, “যায়েদ ব্যতীত আর কেউ দাঁড়ানো নেই” তবে আপনি দণ্ডায়মান হওয়াকে শুধুমাত্র যায়েদের সাথে সীমিত করে দিলেন। এ বাক্যে আপনি দন্ডায়মানের মাধ্যমে যায়েদকে একক করে দিলেন এবং দাঁড়ানো গুণটিকে যায়েদ ব্যতীত অন্যের জন্য হওয়াকে অস্বীকার করলেন। এভাবেই তাওহীদের প্রকৃত রূপ বাস্তবায়ন হয়ে থাকে। অর্থাৎ নাফী (না বোধক) ও ইসবাত (হ্যাঁ বোধক) বাক্যের সমন্বয় ব্যতীত তাওহীদ কখনো প্রকৃত তাওহীদ হিসেবে গণ্য হবে না। মুসলিম বিদ্বানগণ তাওহীদকে তিনভাগে বিভক্ত করেছেন:

১. তাওহীদুর রুবূবীয়্যাহ

২. তাওহীদুল উলুহিয়্যাহ

৩. তাওহীদুল আসমা ওয়াস সিফাত

কুরআন ও হাদীস গভীরভাবে গবেষণা করে আলিমগণ এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, তাওহীদ উপরোক্ত তিন প্রকারের মাঝে সীমিত।

প্রথমত: তাওহীদে রুবূবীয়্যার বিস্তারিত পরিচয়

সৃষ্টি, রাজত্ব, কর্তৃত্ব ও পরিচালনায় আল্লাহকে এক হিসাবে বিশ্বাস করার নাম তাওহীদে রুবূবীয়্যাহ।

১- সৃষ্টিতে আল্লাহর একত্ব: আল্লাহ একাই সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা। তিনি ছাড়া অন্য কোনো সৃষ্টিকর্তা নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿هَلۡ مِنۡ خَٰلِقٍ غَيۡرُ ٱللَّهِ يَرۡزُقُكُم مِّنَ ٱلسَّمَآءِ وَٱلۡأَرۡضِۚ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَۖ فَأَنَّىٰ تُؤۡفَكُونَ﴾ [فاطر: ٣]

“আল্লাহ ছাড়া কোনো স্রষ্টা আছে কী? যে তোমাদেরকে আকাশ ও জমিন হতে জীবিকা প্রদান করে। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ ছাড়া সত্য কোনো মা‘বূদ নেই।” [সূরা ফাতির, আয়াত: ৩]

কাফিরদের অন্তসার শুন্য মা‘বূদদেরকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿أَفَمَن يَخۡلُقُ كَمَن لَّا يَخۡلُقُۚ أَفَلَا تَذَكَّرُونَ ١٧﴾ [النحل: ١٧]

“সুতরাং যিনি সৃষ্টি করেন, তিনি কি তারই মতো, যে সৃষ্টি করে না? তবুও কি তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করবে না?” [সূরা আন-নাহল, আয়াত: ১৭]

সুতরাং আল্লাহ তা‘আলাই একমাত্র সৃষ্টিকর্তা। তিনি সকল বস্তু সৃষ্টি করেছেন এবং সুবিন্যস্ত করেছেন। আল্লাহ তা‘আলার কর্ম এবং মাখলুকাতের কর্ম সবই আল্লাহর সৃষ্টির অন্তর্ভুক্ত। তাই আল্লাহ তা‘আলা মানুষের কর্মসমূহও সৃষ্টি করেছেন- একথার ওপর ঈমান আনলেই তাকদীরের ওপর ঈমান আনা পূর্ণতা লাভ করবে। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿وَٱللَّهُ خَلَقَكُمۡ وَمَا تَعۡمَلُونَ ٩٦﴾ [الصافات: ٩٦]

“আল্লাহ তোমাদেরকে এবং তোমাদের কর্মসমূহকেও সৃষ্টি করেছেন।” [সূরা আস-সাফফাত, আয়াত: ৯৬]

মানুষের কাজসমূহ মানুষের গুণের অন্তর্ভুক্ত। আর মানুষ আল্লাহর সৃষ্টি। কোনো জিনিসের স্রষ্টা উক্ত জিনিসের গুণাবলীরও স্রষ্টা।

যদি বলা হয় আল্লাহ ছাড়া অন্যের ক্ষেত্রেও তো সৃষ্টি কথাটি ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿فَتَبَارَكَ ٱللَّهُ أَحۡسَنُ ٱلۡخَٰلِقِينَ﴾ [المؤمنون: ١٤]

“আল্লাহ সৃষ্টিকর্তাদের মধ্যে উত্তম সৃষ্টিকর্তা।” [সূরা আল-মুমিনূন আয়াত: ১৪]

অনুরূপভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “কিয়ামতের দিন ছবি অংকনকারীদেরকে বলা হবে, তোমরা দুনিয়াতে যা সৃষ্টি করেছিলে, তাতে রূহের সঞ্চার কর”।[1]

উপরোক্ত প্রশ্নের উত্তর এই যে, আল্লাহর মতো করে কোনো মানুষ কিছু সৃষ্টি করতে অক্ষম। মানুষের পক্ষে কোনো অস্তিত্বহীনকে অস্তিত্ব দেওয়া সম্ভব নয়। কোনো মৃত প্রাণীকেও জীবন দান করা সম্ভব নয়। আল্লাহ ছাড়া অন্যের তৈরি করার অর্থ হলো, নিছক পরিবর্তন করা এবং এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় রূপান্তরিত করা মাত্র। মূলতঃ তা আল্লাহরই সৃষ্টি। ফটোগ্রাফার যখন কোনো বস্তুর ছবি তুলে, তখন সে সেটাকে সৃষ্টি করে না; বরং বস্তুটিকে এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় পরিবর্তন করে মাত্র। যেমন, মানুষ মাটি দিয়ে পাখির আকৃতি তৈরি করে এবং অন্যান্য জীব-জন্তু বানায়। সাদা কাগজকে রঙ্গীন কাগজে পরিণত করে। এখানে মূল বস্তু তথা কালি, রং ও সাদা কাগজ সবই তো আল্লাহর সৃষ্টি। এখানেই আল্লাহর সৃষ্টি এবং মানুষের সৃষ্টির মধ্যে পার্থক্য সুস্পষ্ট হয়ে উঠে।

২- রাজত্বে আল্লাহর একত্ব:

মহান রাজাধিরাজ একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা। বলেন,

﴿تَبَٰرَكَ ٱلَّذِي بِيَدِهِ ٱلۡمُلۡكُ وَهُوَ عَلَىٰ كُلِّ شَيۡءٖ قَدِيرٌ ١﴾ [الملك: ١]

“সেই মহান সত্বা অতীব বরকতময়, যার হাতে রয়েছে সকল রাজত্ব। আর তিনি প্রতিটি বিষয়ের ওপর ক্ষমতাবান।” [সূরা আল-মুলক, আয়াত: ১]

আল্লাহ আরো বলেন,

﴿قُلۡ مَنۢ بِيَدِهِۦ مَلَكُوتُ كُلِّ شَيۡءٖ وَهُوَ يُجِيرُ وَلَا يُجَارُ عَلَيۡهِ﴾ [المؤمنون: ٨٨]

“হে নবী! আপনি জিজ্ঞাসা করুন, সব কিছুর কর্তৃত্ব কার হাতে? যিনি আশ্রয় দান করেন এবং যার ওপর কোনো আশ্রয় দাতা নেই।” [সূরা আল-মুমিনূন, আয়াত: ৮৮]

সুতরাং সর্ব সাধারণের বাদশাহ একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা। কাউকে বাদশাহ বলা হলে তা সীমিত অর্থে বুঝতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা অন্যের জন্যেও রাজত্ব ও কর্তৃত্ব সাব্যস্ত করেছেন। তবে তা সীমিত অর্থে। যেমন, তিনি বলেন,

﴿أَوۡ مَا مَلَكۡتُم مَّفَاتِحَهُۥٓ﴾ [النور: ٦١]

“অথবা তোমরা যার চাবি-কাঠির (নিয়ন্ত্রনের) মালিক হয়েছো।” [সূরা আন-নূর, আয়াত: ৬১]

আল্লাহ আরো বলেন,

﴿إِلَّا عَلَىٰٓ أَزۡوَٰجِهِمۡ أَوۡ مَا مَلَكَتۡ أَيۡمَٰنُهُمۡ ﴾ [المؤمنون: ٦]

“তবে তোমাদের স্ত্রীগণ অথবা তোমাদের আয়ত্বধীন দাসীগণ ব্যতীত।” [সূরা আল-মুমিনূন, আয়াত: ৬]

আরো অনেক দলীলের মাধ্যমে জানা যায় যে, আল্লাহ ছাড়া অন্যদেরও রাজত্ব রয়েছে। তবে এ রাজত্ব আল্লাহর রাজত্বের মতো নয়। সেটা অসম্পূর্ণ রাজত্ব। তা ব্যাপক রাজত্ব নয়; বরং তা একটা নির্দিষ্ট সীমারেখার ভেতরে। তাই উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, যায়েদের বাড়ীতে রয়েছে একমাত্র যায়েদেরই কর্তৃত্ব ও রাজত্ব। তাতে আমরের হস্তক্ষেপ করার কোনো ক্ষমতা নেই এবং বিপরীত পক্ষে আমরের বাড়ীতে যায়েদও কোনো হস্তক্ষেপ করতে পারে না। তারপরও মানুষ আপন মালিকানাধীন বস্তুর ওপর আল্লাহ প্রদত্ত নির্ধারিত সীমারেখার ভিতরে থেকে তাঁর আইন-কানুন মেনেই রাজত্ব করে থাকে। এজন্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অকারণে সম্পদ বিনষ্ট করতে নিষেধ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَلَا تُؤۡتُواْ ٱلسُّفَهَآءَ أَمۡوَٰلَكُمُ ٱلَّتِي جَعَلَ ٱللَّهُ لَكُمۡ قِيَٰمٗا﴾ [النساء: ٥]

“যে সমস্ত ধন-সম্পদ আল্লাহ তোমাদের জীবন ধারণের উপকরণ স্বরূপ দান করেছেন, তা তোমরা নির্বোধ লোকদের হাতে তুলে দিও না।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৫]

মানুষের রাজত্ব ও মুলূকিয়ত খুবই সীমিত। আর আল্লাহর মালিকান ও রাজত্ব সর্বব্যাপী এবং সকল বস্তুকে বেষ্টনকারী। তিনি তাঁর রাজত্বে যা ইচ্ছা, তাই করেন। তাঁর কর্মের কৈফিয়ত তলব করার মতো কেউ নেই। অথচ সকল মানুষ তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।

৩- পরিচালনায় আল্লাহর একত্ব:

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এক ও অদ্বিতীয় ব্যবস্থাপক এবং পরিচালক। তিনি সকল মাখলূকাত এবং আসমান-যমিনের সব কিছু পরিচালনা করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿أَلَا لَهُ ٱلۡخَلۡقُ وَٱلۡأَمۡرُۗ تَبَارَكَ ٱللَّهُ رَبُّ ٱلۡعَٰلَمِينَ﴾ [الاعراف: ٥٤]

“সৃষ্টি করা ও আদেশ দানের মালিক একমাত্র তিনি। সৃষ্টকুলের রব আল্লাহ তা‘আলা অতীব বরকতময়।” [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ৫৪]

আল্লাহর এ পরিচালনা সর্বব্যাপী। কোনো শক্তিই আল্লাহর পরিচালনাকে রুখে দিতে পারে না। কোনো কোনো মাখলূকের জন্যও কিছু কিছু পরিচালনার অধিকার থাকে। যেমন, মানুষ তার ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি এবং কর্মচারীদের ওপর কর্তৃত্ব করে থাকে; কিন্তু এ কর্তৃত্ব নির্দিষ্ট একটি সীমার ভিতরে। উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে আমাদের বক্তব্যের সত্যতা প্রমাণিত হলো যে, তাওহীদে রুবূবীয়্যাতের অর্থ সৃষ্টি, রাজত্ব এবং পরিচালনায় আল্লাহকে একক হিসাবে বিশ্বাস করা।

দ্বিতীয়ত: তাওহীদুল উলুহিয়্যাহ

এককভাবে আল্লাহর ইবাদাত করার নাম তাওহীদে উলুহিয়্যাহ। মানুষ যেভাবে আল্লাহর ইবাদাত করে এবং নৈকট্য হাসিলের চেষ্টা করে, অনুরূপ অন্য কাউকে ইবাদাতের জন্য গ্রহণ না করা। তাওহীদে উলুহীয়্যাতের ভিতরেই ছিল আরবের মুশরিকদের গোমরাহী। এ তাওহীদে উলূহিয়াকে কেন্দ্র করেই তাদের সাথে জিহাদ করে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের জান-মাল, ঘরবাড়ী ও জমি-জায়গা হরণ হালাল মনে করেছিলেন। তাদের নারী-শিশুদেরকে দাস-দাসীতে পরিণত করেছিলেন। এ প্রকার তাওহীদ দিয়েই আল্লাহ তা‘আলা রাসূলগণকে প্রেরণ করেছিলেন এবং সমস্ত আসমানী কিতাব নাযিল করেছেন। যদিও তাওহীদে রুবূবিয়্যাত এবং তাওহীদে আসমা ওয়াস্ সিফাতও নবীদের দাওয়াতের বিষয়বস্তু ছিল; কিন্তু অধিকাংশ সময়ই নবীগণ তাদের স্বজাতীয় লোকদেরকে তাওহীদে উলুহীয়্যার প্রতি আহ্বান জানাতেন। মানুষ যাতে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও জন্য ইবাদাতের কোনো অংশই পেশ না করে, সদাসর্বদা রাসূলগণ তাদের উম্মতদেরকে এ আদেশই দিতেন। চাই সে হোক নৈকট্যশীল ফিরিশতা, আল্লাহর প্রেরিত নবী, আল্লাহর সৎকর্মপরায়ণ ওলী বা অন্য কোনো মাখলুক। কেননা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও ইবাদাত করা বৈধ নয়। যে ব্যক্তি এ প্রকার তাওহীদে ত্রুটি করবে, সে কাফির মুশরিক। যদিও সে তাওহীদে রুবূবীয়্যাহ এবং তাওহীদে আসমা ওয়াস সিফাতের স্বীকৃতি প্রদান করে থাকে। সুতরাং কোনো মানুষ যদি এ বিশ্বাস করে যে, আল্লাহই একমাত্র সৃষ্টিকারী, একমাত্র মালিক এবং সব কিছুর পরিচালক, কিন্তু আল্লাহর ইবাদাতে যদি অন্য কাউকে শরীক করে, তবে তার এ স্বীকৃতি ও বিশ্বাস কোনো কাজে আসবে না। যদি ধরে নেওয়া হয় যে, একজন মানুষ তাওহীদে রুবূবীয়্যাতে এবং তাওহীদে আসমা ওয়াস সিফাতে পূর্ণ বিশ্বাস করে; কিন্তু সে কবরের কাছে যায় এবং কবরবাসীর ইবাদাত করে কিংবা তার জন্য কুরবানী পেশ করে বা পশু জবেহ করে তাহলে সে কাফির এবং মুশরিক। মৃত্যুর পর সে হবে চিরস্থায়ী জাহান্নামী। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿إِنَّهُۥ مَن يُشۡرِكۡ بِٱللَّهِ فَقَدۡ حَرَّمَ ٱللَّهُ عَلَيۡهِ ٱلۡجَنَّةَ وَمَأۡوَىٰهُ ٱلنَّارُۖ وَمَا لِلظَّٰلِمِينَ مِنۡ أَنصَارٖ ﴾ [المائ‍دة: ٧٢]

“নিশ্চয় যে ব্যক্তি শির্কে লিপ্ত হবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন। তার ঠিকানা জাহান্নাম। আর যালেমদের জন্য কোনো সাহায্যকারী নেই।” [সূরা আল-মায়েদা, আয়াত: ৭২] কুরআনের প্রতিটি পাঠকই একথা অবগত আছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে সমস্ত কাফিরদের সাথে যুদ্ধ করেছেন, তাদের জান-মাল হালাল মনে করেছেন এবং তাদের নারী-শিশুকে বন্দী করেছেন ও তাদের দেশকে গণীমত হিসেবে দখল করেছেন, তারা সবাই একথা স্বীকার করত যে, আল্লাহই একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ও প্রতিপালক। তারা এতে কোনো সন্দেহ পোষণ করত না; কিন্তু যেহেতু তারা আল্লাহর সাথে অন্যেরও উপাসনা করত, তাই তারা মুশরিক হিসেবে গণ্য হয়েছে এবং তাদের জান-মাল হরণ হালাল বিবেচিত হয়েছে।

তৃতীয়ত: তাওহীদুল আসমা ওয়াস সিফাত

তাওহীদুল আসমা ওয়াস সিফাতের অর্থ হলো, আল্লাহ নিজেকে যে সমস্ত নামে নামকরণ করেছেন এবং তাঁর কিতাবে নিজেকে যে সমস্ত গুণে গুণাম্বিত করেছেন সে সমস্ত নাম ও গুণাবলীতে আল্লাহকে একক ও অদ্বিতীয় হিসেবে মেনে নেওয়া। আল্লাহ নিজের জন্য যা সাব্যস্ত করেছেন, তাতে কোনো পরিবর্তন, পরিবর্ধন, তার ধরণ বর্ণনা এবং কোনো রূপ উদাহরণ পেশ করা ব্যতীত আল্লাহর জন্য তা সাব্যস্ত করার মাধ্যমেই এ তাওহীদ বাস্তবায়ন হতে পারে। সুতরাং আল্লাহ নিজেকে যে নামে পরিচয় দিয়েছেন বা নিজেকে যে গুণাবলীতে গুণান্বিত করেছেন, তাঁর ওপর ঈমান আনয়ন করা আবশ্যক। এ সমস্ত নাম ও গুণাবলীর আসল অর্থ আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করে তার ওপর ঈমান আনতে হবে- কোনো প্রকার ধরণ বর্ণনা করা বা দৃষ্টান্ত পেশ করা যাবে না। এ প্রকারের তাওহীদে আহলে কিবলা তথা মুসলিমদের বিরাট একটি অংশ গোমরাহীতে পতিত হয়েছে। এক শ্রেণির লোক আল্লাহর সিফাতকে অস্বীকারের ক্ষেত্রে এতই বাড়াবাড়ি করেছে যে, এর কারণে তারা ইসলাম থেকে বের হয়ে গেছে। আর এক শ্রেণির লোক মধ্যম পন্থা অবলম্বন করেছে। আর এক শ্রেণির লোক আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের কাছাকাছি; কিন্তু সালাফে সালেহীনের[2] মানহাজ[3] হলো, আল্লাহ নিজের জন্য যে নাম নির্ধারণ করেছেন এবং নিজেকে যে সবগুণে গুণান্বিত করেছেন, সে সব নাম ও গুণাবলীরর ওপর ঈমান আনয়ন করতে হবে।

আল্লাহর কতিপয় নামের দৃষ্টান্ত:

১) (الحي القيوم) আল্লাহ তা‘আলার অন্যতম নাম হচ্ছে, “আল হাইয়্যুল কাইয়্যুম” এ নামের ওপর ঈমান রাখা আমাদের ওপর ওয়াজিব। এ নামটি আল্লাহর একটি বিশেষ গুণেরও প্রমাণ বহন করে। তা হচ্ছে, আল্লাহর পরিপূর্ণ হায়াত। যা কোনো সময় অবর্তমান ছিলনা এবং কোনো দিন শেষও হবে না। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা চিরঞ্জীব। তিনি সবসময় আছেন এবং সমস্ত মাখলুকাত ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরও অবশিষ্ট থাকবেন। তাঁর কোনো ধ্বংস বা ক্ষয় নেই।

২) আল্লাহ নিজেকে السميع (আস-সামীউ‘) শ্রবণকারী নামে অভিহিত করেছেন। তার ওপর ঈমান আনা আবশ্যক। শ্রবণ করা আল্লাহর একটি গুণ। তিনি মাখলুকাতের সকল আওয়াজ শ্রবণ করেন। তা যতই গোপন ও অস্পষ্ট হোক না কেন।

আল্লাহর কতিপয় সিফাতের দৃষ্টান্ত

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَقَالَتِ ٱلۡيَهُودُ يَدُ ٱللَّهِ مَغۡلُولَةٌۚ غُلَّتۡ أَيۡدِيهِمۡ وَلُعِنُواْ بِمَا قَالُواْۘ بَلۡ يَدَاهُ مَبۡسُوطَتَانِ يُنفِقُ كَيۡفَ يَشَآءُۚ﴾ [المائ‍دة: ٦٤]

“ইয়াহূদীরা বলে, আল্লাহর হাত বন্ধ হয়ে গেছে, বরং তাদের হাতই বন্ধ। তাদের উক্তির দরুন তারা আল্লাহর রহমত হতে বঞ্চিত হয়েছে, বরং আল্লাহর উভয় হাত সদা উম্মুক্ত, যেরূপ ইচ্ছা ব্যয় করেন।” [সূরা আল-মায়েদা, আয়াত: ৬৪]

এখানে আল্লাহ তা‘আলা নিজের জন্য দু’টি হাত সাব্যস্ত করেছেন। যা দানের জন্য সদা প্রসারিত। সুতরাং আল্লাহর দু’টি হাত আছে। এর ওপর ঈমান আনতে হবে; কিন্তু আমাদের উচিৎ আমরা যেন অন্তরে আল্লাহর হাত কেমন হবে সে সম্পর্কে কোনো কল্পনা না করি এবং কথার মাধ্যমে যেন তার ধরণ বর্ণনা না করি ও মানুষের হাতের সাথে তুলনা না করি। কেননা আল্লাহ বলেছেন,

﴿لَيۡسَ كَمِثۡلِهِۦ شَيۡءٞۖ وَهُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلۡبَصِيرُ﴾ [الشورا: ١١]

“কোনো কিছুই তাঁর সদৃশ নয়, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।” [সূরা আশ-শূরা, আয়াত: ১১]

আল্লাহ আরো বলেন,

﴿قُلۡ إِنَّمَا حَرَّمَ رَبِّيَ ٱلۡفَوَٰحِشَ مَا ظَهَرَ مِنۡهَا وَمَا بَطَنَ وَٱلۡإِثۡمَ وَٱلۡبَغۡيَ بِغَيۡرِ ٱلۡحَقِّ وَأَن تُشۡرِكُواْ بِٱللَّهِ مَا لَمۡ يُنَزِّلۡ بِهِۦ سُلۡطَٰنٗا وَأَن تَقُولُواْ عَلَى ٱللَّهِ مَا لَا تَعۡلَمُونَ ٣٣﴾ [الاعراف: ٣٣]

“হে মুহাম্মাদ! আপনি বলে দিন যে, আমার রব প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য অশ্লীলতা, পাপ কাজ, অন্যায় ও অসঙ্গত বিদ্রোহ ও বিরোধিতা এবং আল্লাহর সাথে কোনো কিছুকে শরীক করা, যার পক্ষে আল্লাহ কোনো দলীল-প্রমাণ অবতীর্ণ করেন নি, আর আল্লাহ সম্বন্ধে এমন কিছু বলা যে সম্বন্ধে তোমাদের কোনো জ্ঞান নেই, (ইত্যাদি কাজ ও বিষয়সমূহ) হারাম করেছেন।” [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ৩৩]

আল্লাহ আরো বলেন,

﴿وَلَا تَقۡفُ مَا لَيۡسَ لَكَ بِهِۦ عِلۡمٌۚ إِنَّ ٱلسَّمۡعَ وَٱلۡبَصَرَ وَٱلۡفُؤَادَ كُلُّ أُوْلَٰٓئِكَ كَانَ عَنۡهُ مَسۡ‍ُٔولٗا ٣٦﴾ [الاسراء: ٣٦]

“যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, সেই বিষয়ে অনুমান দ্বারা পরিচালিত হয়ো না, নিশ্চয় কর্ণ, চক্ষু, অন্তর ওদের প্রত্যেকের নিকট কৈফিয়ত তলব করা হবে।” [সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ৩৬]

সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহর হাত দু’টিকে মানুষের হাতের সাথে তুলনা করল, সে আল্লাহর বাণী “কোনো কিছুই তাঁর সদৃশ নয়” একথাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করল এবং আল্লাহর বাণী,

﴿ فَلَا تَضۡرِبُواْ لِلَّهِ ٱلۡأَمۡثَالَۚ﴾ [النحل: ٧٤]

“তোমরা আল্লাহর জন্য দৃষ্টান্ত পেশ করো না”। [সূরা আন-নাহল, আয়াত: ৭৪]- এর বিরুদ্ধাচরণ করল। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর গুণাবলীর নির্দিষ্ট কোনো কাইফিয়ত[4] তথা ধরণ বর্ণনা করল, সে আল্লাহর ব্যাপারে বিনা ইলমে কথা বলল এবং এমন বিষয়ের অনুসরণ করল, যে সম্পর্কে তার কোনো জ্ঞান নেই।

আল্লাহর সিফাতের[5] আরেকটি উদাহরণ পেশ করব –তা হলো আল্লাহ ‘আরশের উপরে উঠা। কুরআনের সাতটি স্থানে আল্লাহ তা‘আলা উল্লেখ করেছেন যে, তিনি ‘আরশের উপরে উঠেছেন। প্রত্যেক স্থানেই ‘ইসতাওয়া’ (استوى) আর প্রত্যেক স্থানেই ‘আলাল আরশি’ (على العرش) “আলাল ‘আরশি” শব্দদ্বয় ব্যবহার করেছেন। আমরা যদি আরবী ভাষায় ইসতিওয়া শব্দটি অনুসন্ধান করতে যাই তবে দেখতে পাই যে, (استوى) শব্দটি যখনই (على) অব্যয়ের মাধ্যমে ব্যবহার হয়েছে তখনই তার অর্থ হয়েছে ‘(الارتفاع) বা (العلو) অর্থাৎ ‘উপরে উঠা’। এটা ব্যতীত অন্য কোনো অর্থে তখন তার ব্যবহার হয় না। সুতরাং الرَّحْمَنُ على العَرْشِ استوى এবং এর মতো অন্যান্য আয়াতের মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ তা‘আলা তিনি তাঁর আরশের উপর রয়েছেন বিশেষ একপ্রকার উপরে থাকা, যা তার সৃষ্টি জগতের উপরে সাধারণভাবে উপরে থাকার চেয়ে ভিন্নতর। আর এ উপরে থাকার বিষয়টি হান আল্লাহর জন্য প্রকৃত অর্থেই সাব্যস্ত। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলার জন্য যেমনভাবে উপযুক্ত, সেভাবেই তিনি ‘আরশের উপরে উঠেছেন। আল্লাহর ‘আরশের উপরে হওয়া এবং মানুষের খাট-পালং ও নৌকায় আরোহনের সাথে কোনো সামঞ্জস্যতা নেই। যে আরোহনের কথা আল্লাহ তা‘আলা উল্লেখ করে বলেন,

﴿وَجَعَلَ لَكُم مِّنَ ٱلۡفُلۡكِ وَٱلۡأَنۡعَٰمِ مَا تَرۡكَبُونَ ١٢ لِتَسۡتَوُۥاْ عَلَىٰ ظُهُورِهِۦ ثُمَّ تَذۡكُرُواْ نِعۡمَةَ رَبِّكُمۡ إِذَا ٱسۡتَوَيۡتُمۡ عَلَيۡهِ وَتَقُولُواْ سُبۡحَٰنَ ٱلَّذِي سَخَّرَ لَنَا هَٰذَا وَمَا كُنَّا لَهُۥ مُقۡرِنِينَ ١٣ وَإِنَّآ إِلَىٰ رَبِّنَا لَمُنقَلِبُونَ ١٤﴾ [الزخرف: ١٢، ١٤]

“তিনি তোমাদের আরোহনের জন্য সৃষ্টি করেন নৌযান ও চতুষ্পদ জন্তু; যাতে তোমরা তার উপর আরোহণ করতে পার, তারপর তোমাদের রবের অনুগ্রহ স্মরণ কর যখন তোমরা এর উপর স্থির হয়ে বস এবং বল, পবিত্র ও মহান তিনি, যিনি এদেরকে আমাদের জন্য বশীভূত করেছেন, যদিও আমরা সমর্থ ছিলাম না এদেরকে বশীভূত করতে। আর আমরা আমাদের রবের নিকট প্রত্যাবর্তন করবো।” [সূরা আয-যুখরুফ, আয়াত: ১২-১৪]

সুতরাং মানুষের কোনো জিনিসের উপরে উঠা কোনো ক্রমেই আল্লাহর ‘আরশের উপরে হওয়ার সদৃশ হতে পারে না। কেননা আল্লাহর মতো কোনো কিছু নেই।

যে ব্যক্তি বলে যে, ‘আরশের উপরে আল্লাহর উঠার অর্থ ‘আরশের অধিকারী হয়ে যাওয়া, সে প্রকাশ্য ভুলের মাঝে রয়েছে। কেননা এটা আল্লাহর কালামকে আপন স্থান থেকে পরির্বতন করার শামিল এবং সাহাবী এবং তাবে‘ঈদের ইজমার সম্পূর্ণ বিরোধী। এ ধরণের কথা এমন কিছু বাতিল বিষয়কে আবশ্যক করে, যা কোনো মুমিনের মুখ থেকে উচ্চারিত হওয়া সংগত নয়। কুরআন মাজীদ আরবী ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে। আল্লাহ বলেন,

﴿إِنَّا جَعَلۡنَٰهُ قُرۡءَٰنًا عَرَبِيّٗا لَّعَلَّكُمۡ تَعۡقِلُونَ ٣﴾ [الزخرف: ٣]

“নিশ্চয় আমরা এ কুরআনকে আরবী ভাষায় অবতীর্ণ করেছি যাতে তোমরা বুঝতে পার।” [সূরা আয-যুখরুফ, আয়াত: ৩] আরবী ভাষায় ইসতাওয়া শব্দের অর্থ ‘উপরে ওঠা’ এবং ‘বিরাজমান থাকা’। আর এটাই হলো ইসতিওয়া শব্দের আসল অর্থ। সুতরাং ‘তিনি আরশের উপরে উঠেছেন’ এর অর্থ, তিনি আরশের উপর উঠেছেন, বিশেষ প্রকার উপরে উঠা, আল্লাহর বড়ত্বের শানে ‘আরশের উপর যেভাবে উপরে উঠা’ প্রযোজ্য, সেভাবেই তিনি উপরে উঠেছেন। যদি ইসতিওয়ার (উপরে উঠার) অর্থ ইসতাওলা (অধিকারী) হওয়ার মাধ্যমে করা হয়, তবে তা হবে আল্লাহর কালামকে পরিবর্তন করার শামিল। আর যে ব্যক্তি এরূপ করল, সে কুরআনের ভাষা যে অর্থের উপর প্রমাণ বহণ করে (তা হচ্ছে, উপরে উঠা), তা অস্বীকার করল এবং অন্য একটি বাতিল অর্থ সাব্যস্ত করল।

তাছাড়া “ইসতিওয়া” এর যে অর্থ আমরা বর্ণনা করলাম, তার ওপর সালাফে সালেহীন ঐকমত্য (ইজমা) পোষণ করেছেন। কারণ, উক্ত অর্থের বিপরীত অর্থ তাদের থেকে বর্ণিত হয় নি। কুরআন এবং সুন্নাতে যদি এমন কোনো শব্দ আসে সালাফে সালেহীন থেকে যার প্রকাশ্য অর্থ বিরোধী কোনো ব্যাখ্যা না পাওয়া যায়, তবে সে ক্ষেত্রে মূলনীতি হলো উক্ত শব্দকে তার প্রকাশ্য অর্থের ওপর অবশিষ্ট রাখতে হবে এবং তার মর্মার্থের উপর ঈমান রাখতে হবে।

যদি প্রশ্ন করা হয় যে, সালাফে সালেহীন থেকে কি এমন কোনো কথা বর্ণিত হয়েছে যা প্রমাণ করে যে, “ইসতাওয়া” অর্থ “আলা” (‘আরশের উপরে উঠেছেন)? উত্তরে আমরা বলব হ্যাঁ, অবশ্যই তা বর্ণিত হয়েছে। যদি একথা ধরে নেওয়া হয় যে, তাদের থেকে এ তাফসীর স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয় নি, তাহলেও এ সব ক্ষেত্রে সালাফে সালেহীনের মানহাজ (নীতি) হলো, কুরআন এবং সুন্নাহর শব্দ যে অর্থ নির্দেশ করবে, আরবী ভাষার দাবী অনুযায়ী শব্দের সে অর্থই গ্রহণ করতে হবে।

‘ইসতিওয়া’র অর্থ ইসতাওলা দ্বারা করা হলে যে সব সমস্যা দেখা দেয়

১) ‘ইসতাওলা’ অর্থ কোনো বস্তুর মালিকানা হাসিল করা বা কোনো কিছুর উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। তাই ‘ইসতিওয়া’র অর্থ ইসতাওলার মাধ্যমে করা হলে অর্থ দাঁড়ায়, আকাশ-জমিন সৃষ্টির আগে আল্লাহ ‘আরশের মালিক ছিলেন না, পরে মালিক হয়েছেন। কারণ আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ إِنَّ رَبَّكُمُ ٱللَّهُ ٱلَّذِي خَلَقَ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضَ فِي سِتَّةِ أَيَّامٖ ثُمَّ ٱسۡتَوَىٰ عَلَى ٱلۡعَرۡشِۖ ﴾ [الاعراف: ٥٣]

“নিশ্চয় তোমাদের রব হলেন সেই আল্লাহ যিনি ছয় দিনে আকাশ এবং জমিন সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর ‘আরশের উপরে ‘ইস্তেওয়া’ করলেন।” [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ৫৪] তখন তাদের কথা অনুসারে অর্থ দাঁড়াবে, আসমান সৃষ্টির পূর্বে এবং আসমান যমীন সৃষ্টির প্রাক্কালে তিনি আরশের অধিকারী ছিলেন না। (নাউযুবিল্লাহ)

২) “আর-রাহমানু আলাল ‘আরশিস তাওয়া” অর্থ যদি ‘ইস্তাওলা’র মাধ্যমে করা শুদ্ধ হয় তাহলে এ কথা বলাও শুদ্ধ হতে হয় যে, আল্লাহ তা‘আলা যমীনের কর্তৃত্ববান হলেন, তিনি তার সৃষ্টিকুলের যে কোনো কিছুর উপর কর্তৃত্বশীল হলেন। অথচ এতে কোনো সন্দেহ নেই যে এটা একটি বাতিল অর্থ। এ ধরণের অর্থ মহান আল্লাহর শানে শোভনীয় নয়।[6]

৩) এটি আল্লাহর কালামকে তার আপন স্থান থেকে সরিয়ে দেওয়ার শামিল।

৪) এ ধরণের অর্থ করা সালাফে সালেহীনের ইজমার পরিপন্থী।তাওহীদুল আসমা ওয়াস সিফাতের ক্ষেত্রে সারকথা এই যে, আল্লাহ নিজের জন্য যে সমস্ত নাম ও গুণাবলী সাব্যস্ত করেছেন, কোনো পরিবর্তন, বাতিল বা ধরণ-গঠন কিংবা দৃষ্টান্ত পেশ করা ছাড়াই তার প্রকৃত অর্থের ওপর ঈমান আনয়ন করা আমাদের ওপর ওয়াজিব।

[1] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: কিতাবুল বুয়ূ‘।

[2] এ কিতাবের যেখানেই ‘‘সালাফে সালেহীন’’ বা শুধু ‘‘সালাফ’’ কথাটি উল্লেখ হবে তার দ্বারা উদ্দেশ্য হবে সাহাবী, তাবেঈ এবং তাবে তাবেঈগণ।

[3] মানহাজ বলতে আকীদা ও আমলের ক্ষেত্রে সালাফে সালেহীনের গৃহীত নির্ভেজাল নীতিকে বুঝানো হয়েছে।

[4] আল্লাহর গুনাবলীর বিশেষ কোনো ধরণ, গঠণ বা পদ্ধতি বর্ণনা করাকে ‘‘তাকয়ীফ’’ বা ‘‘কাইফিয়াত’’ বলা হয়। যেমন, কেউ বলল ‘আল্লাহর হাত এরকম এ রকম’এভাবে আল্লাহর সিফাতসমূহের কাইফিয়াত (ধরণ-গঠন) বর্ণনা করা হারাম।

[5] আল্লাহর গুণাবলী এবং আল্লাহর কর্মসমূহকে আল্লাহর সিফাত বলে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

* আল্লাহ তা‘আলা সকল কিছুর সৃষ্টিকর্তা এবং সকল বস্তুর তিনি একমাত্র মালিক। সূচনা থেকেই সকল বস্তুর ওপর তাঁর মালিকানা প্রতিষ্ঠিত এবং সকল বস্তু বিলীন হয়ে যাওয়ার পরও আল্লাহ এবং তাঁর মালিকানা বহাল থাকবে। আল্লাহর ক্ষেত্রে এমন বিশ্বাস পোষণ করা ঠিক হবে না যে, আল্লাহ পূর্বে অমুক বস্তুর মালিক ছিলেন না। পরে মালিক হয়ে গেলেন। এ ধরণের অর্থ গ্রহণ করা হলে, আল্লাহ যে মহান ক্ষমতাবান তাতে বিশ্বাস পরিপূর্ণ হবে না এবং মহান আল্লাহকে মানুষের সাথে তুলনা করা হবে। (নাউযুবিল্লাহ)
প্রশ্ন: (২) যাদের কাছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রেরণ করা হয়েছিল, তাদের শির্ক কী ধরণের ছিল?

উত্তর: যাদের নিকট নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রেরণ করা হয়েছিল, তারা তাওহীদে রুবূবিয়্যাতে আল্লাহর সাথে কাউকে শির্ক করত না। কুরআনে কারীমের ভাষ্য অনুযায়ী জানা যায় যে, তারা কেবল তাওহীদে উলুহিয়্যাতে আল্লাহর সাথে শির্ক করত।

রুবূবিয়্যাতের ক্ষেত্রে তাদের বিশ্বাস ছিল যে, আল্লাহই একমাত্র রব আর তিনিই বিপদগ্রস্তের আহ্বানে সাড়াদানকারী, আর তিনিই বিপদাপদ দূরকারী; ইত্যাদি যে সব বিষয় আল্লাহ তা‘আলা তাদের থেকে জানিয়েছেন যে, তারা সেগুলোর রুবুবিয়্যাত কেবল আল্লাহর জন্য স্বীকৃতি দিত।

কিন্তু তারা ইবাদাতের ক্ষেত্রে আল্লাহর সাথে শরীক করত, আল্লাহর সাথে অন্যের ইবাদতও করত। এ ধরণের শির্ক মুসলিমকে ইসলাম থেকে বের করে দেয়। কেননা তাওহীদের শাব্দিক অর্থ হলো, কোনো কিছু একক করে নির্দিষ্ট করা। আর আল্লাহ তা‘আলার কতিপয় নির্দিষ্ট হক রয়েছে, যা এককভাবে আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট করা ওয়াজিব। এ হকগুলো তিন প্রকার:

১. মালিকানা ও কর্তৃত্বের অধিকার

২. ইবাদাত পাওয়ার অধিকার

৩. নাম ও গুণাবলীর অধিকার

এজন্যই আলেমগণ তাওহীদকে তিনভাগে বিভক্ত করেছেন। তাওহীদুর রুবূবীয়্যাহ, তাওহীদুল আসমা ওয়াস সিফাত এবং তাওহীদুল উলুহিয়্যাহ।

আরবের মুশরিকরা কেবল ইবাদত অংশেই আল্লাহর সাথে শরীক করত, তারা আল্লাহর সাথে অন্যেরও ইবাদত করত। আর এ জন্যেই আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ ۞وَٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ وَلَا تُشۡرِكُواْ بِهِۦ شَيۡ‍ٔٗاۖ﴾ [النساء: ٣٦]

“তোমরা আল্লাহর ইবাদাত কর এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক করো না।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৩৬] অর্থাৎ তাঁর ইবাদতে কাউকে শরীক করবে না।

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,

﴿إِنَّهُۥ مَن يُشۡرِكۡ بِٱللَّهِ فَقَدۡ حَرَّمَ ٱللَّهُ عَلَيۡهِ ٱلۡجَنَّةَ وَمَأۡوَىٰهُ ٱلنَّارُۖ وَمَا لِلظَّٰلِمِينَ مِنۡ أَنصَارٖ﴾ [المائ‍دة: ٧٢]

“যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে শরীক করবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতকে হারাম করে দিয়েছেন, তার ঠিকানা হবে জাহান্নাম এবং যালেমদের জন্য কোনো সাহায্যকারী থাকবে না।” [সূরা আল-মায়েদা, আয়াত: ৭২]

আল্লাহ আরো বলেন,

﴿إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَغۡفِرُ أَن يُشۡرَكَ بِهِۦ وَيَغۡفِرُ مَا دُونَ ذَٰلِكَ لِمَن يَشَآءُۚ﴾ [النساء: ٤٨]

“নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সাথে শির্ক করাকে ক্ষমা করেন না। তবে এর চেয়ে নিম্ন পর্যায়ের গুনাহ যাকে ইচ্ছা তিনি ক্ষমা করে দেন।” (সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৪৮]

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿وَقَالَ رَبُّكُمُ ٱدۡعُونِيٓ أَسۡتَجِبۡ لَكُمۡۚ إِنَّ ٱلَّذِينَ يَسۡتَكۡبِرُونَ عَنۡ عِبَادَتِي سَيَدۡخُلُونَ جَهَنَّمَ دَاخِرِينَ ٦٠﴾ [غافر: ٦٠]

“এবং তোমাদের রব বলেন, তোমরা আমাকে ডাক, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দিব। নিশ্চয় যারা আমার ইবাদাত করতে অহংকার করবে, তারা অচিরেই অপমানিত অবস্থায় জাহান্নামে প্রবেশ করবে।” [সূরা গাফির, আয়াত: ৬০]

আল্লাহ তা‘আলা ইখলাস বা নিষ্ঠার সূরায় বলেন,

﴿قُلۡ يَٰٓأَيُّهَا ٱلۡكَٰفِرُونَ ١ لَآ أَعۡبُدُ مَا تَعۡبُدُونَ ٢ وَلَآ أَنتُمۡ عَٰبِدُونَ مَآ أَعۡبُدُ ٣ وَلَآ أَنَا۠ عَابِدٞ مَّا عَبَدتُّمۡ ٤ وَلَآ أَنتُمۡ عَٰبِدُونَ مَآ أَعۡبُدُ ٥﴾ [الكافرون: ١، ٥]

“বলুন, হে কাফিররা! আমি তার ইবাদাত করি না, যার ইবাদাত তোমরা কর, এবং তোমরাও তার ইবাদাতকারী নও, যার ইবাদাত আমি করি এবং আমি ইবাদাতকারী নই তার, যার ইবাদাত তোমরা করে আসছো।” [সূরা কাফিরূন, আয়াত: ১-৫]

লক্ষ্য করুন, এখানে আমি সূরা আল-কাফিরূনকে সূরা ইখলাস নাম দিয়েছি। কারণ এ সূরা আমল বা কর্মে ইখলাস শিক্ষা দেয়। যদিও সূরাটির নাম সূরা আল-কাফিরূন। কিন্তু এ সূরাটি আমলি ইখলাসের সূরা, যেমনটি সূরা ‘কুল হুওয়াল্লাহু আহাদ’ ইলমি বা আকীদা বিষয়ক ইখলাসের সূরা।

আল্লাহই হচ্ছেন সত্যিকারের তাওফীকদাতা।

প্রশ্ন: (৩) আকীদা ও অন্যান্য দীনি বিষয়ের ক্ষেত্রে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মূলনীতিগুলো কী কী?

উত্তর: আকীদা ও দীনের অন্যান্য বিষয়ে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মূলনীতি হলো আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাত এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের আদর্শ ও সুন্নাতকে পরিপূর্ণরূপে আঁকড়ে ধরা। কারণ আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿قُلۡ إِن كُنتُمۡ تُحِبُّونَ ٱللَّهَ فَٱتَّبِعُونِي يُحۡبِبۡكُمُ ٱللَّهُ﴾ [ال عمران: ٣١]

“হে নবী! আপনি বলুন যে, তোমরা যদি আল্লাহর ভালোবাসা পেতে চাও, তাহলে আমার অনুসরণ কর। তবেই আল্লাহ তোমাদেরকে ভালোবাসবেন।”[সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৩১]

তাছাড়া আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿مَّن يُطِعِ ٱلرَّسُولَ فَقَدۡ أَطَاعَ ٱللَّهَۖ وَمَن تَوَلَّىٰ فَمَآ أَرۡسَلۡنَٰكَ عَلَيۡهِمۡ حَفِيظٗا ٨٠﴾ [النساء: ٨٠]

“যে ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ করল সে স্বয়ং আল্লাহর অনুসরণ করল। আর যারা মুখ ফিরিয়ে নিবে, আমি তাদের জন্য আপনাকে সংরক্ষণকারী হিসাবে প্রেরণ করি নি।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৮০]

আল্লাহ আরো বলেন,

﴿وَمَآ ءَاتَىٰكُمُ ٱلرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَىٰكُمۡ عَنۡهُ فَٱنتَهُواْۚ﴾ [الحشر: ٧]

“এবং আল্লাহর রাসূল তোমাদেরকে যা প্রদান করেন, তা তোমরা গ্রহণ কর আর যা থেকে তোমাদেরকে নিষেধ করেন, তা থেকে তোমরা বিরত থাক।” [সূরা ­আল-হাশর, আয়াত: ৭] যদিও আয়াতটি গণীমতের মাল বন্টনের ক্ষেত্রে নাযিল হয়েছে, তবে শরী‘আতের অন্যান্য মাসায়েলের ক্ষেত্রেও উত্তমভাবে প্রযোজ্য হবে।

তাছাড়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুমু‘আর সালাতের খুৎবায় বলতেন,

«أَمَّا بَعْدُ فَإِنَّ خَيْرَ الْحَدِيثِ كِتَابُ اللَّهِ وَخَيْرُ الْهُدَى هُدَى مُحَمَّدٍ eوَشَرُّ الْأُمُورِ مُحْدَثَاتُهَا وَكُلُّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ وكل ضلالة فى النار»

“অতঃপর সর্বোত্তম বাণী হচ্ছে আল্লাহর কিতাব, সর্বোত্তম নির্দেশনা হচ্ছে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশনা। সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিষয় হচ্ছে দীনের ভিতরে নতুন বিষয় আবিষ্কার করা। প্রতিটি বিদ‘আতই গোমরাহী। আর প্রতিটি গোমরাহীর পরিণাম জাহান্নাম।”[1]

অনুরূপভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«عَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الْمَهْدِيِّينَ الرَّاشِدِينَ تَمَسَّكُوا بِهَا وَعَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الْأُمُورِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ»

“তোমরা আমার সুন্নাত এবং আমার পরে হিদায়াত প্রাপ্ত খোলাফায়ে রাশেদার সুন্নাতের অনুসরণ করবে এবং সেটাকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরবে। আর তোমরা দীনের বিষয়ে নতুন আবিস্কৃত বিষয় থেকে সাবধান থাকবে। কারণ, প্রতিটি নব আবিস্কৃত বিষয়ই বিদ‘আত আর প্রতিটি বিদ‘আতই গোমরাহী।”[2] এ সম্পর্কে আরো অসংখ্য দলীল-প্রমাণ রয়েছে।

সুতরাং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের পথ হলো, আল্লাহর কিতাব, রাসূলের সুন্নাত এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের পথকে আকঁড়ে ধরা। তাছাড়া তাদের পথের অন্যতম দিক হলো, তারা সদাসর্বদা দীন কায়েমের প্রচেষ্টা করেন, এর ভিতর বিভেদ সৃষ্টি করেন না। এর মাধ্যমে তারা আল্লাহর নিম্নোক্ত নির্দেশনা পালন করে থাকেন,

﴿شَرَعَ لَكُم مِّنَ ٱلدِّينِ مَا وَصَّىٰ بِهِۦ نُوحٗا وَٱلَّذِيٓ أَوۡحَيۡنَآ إِلَيۡكَ وَمَا وَصَّيۡنَا بِهِۦٓ إِبۡرَٰهِيمَ وَمُوسَىٰ وَعِيسَىٰٓۖ أَنۡ أَقِيمُواْ ٱلدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُواْ فِيهِۚ﴾ [الشورا: ١٣]

“তিনি তোমাদের জন্য বিধিবদ্ধ করেছেন এমন দীনকে, যার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি নূহকে আর যা আমি অহী করেছিলাম তোমাকে এবং যার নির্দেশ দিয়েছিলাম ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকে এই বলে যে, তোমরা দীনকে প্রতিষ্ঠিত কর এবং ওতে বিভেদ সৃষ্টি করো না।” [সূরা আশ-শূরা, আয়াত: ১৩] আর তাদের মাঝে কখনো মতবিরোধ হয়ে থাকলে তা হয়েছে কেবল এমন ক্ষেত্রে, যাতে ইজতেহাদ[3] করা বৈধ আছে। এ ধরণের মতবিরোধ অন্তরে বিভেদ সৃষ্টি করে না। ইজতেহাদী বিষয়ে আলিমদের মাঝে মতবিরোধ হওয়া সত্বেও আপনি তাদের মাঝে একতা এবং একে অপরের প্রতি ভালোবাসা দেখতে পাবেন।

>
[1] সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: সালাতুল জুমু‘আ

[2] আবু দাউদ, অধ্যায়: কিতাবুস সুন্নাহ।

[3] কুরআন ও সুন্নাহ থেকে মাসআলা বের করার জন্য প্রচেষ্টা চালানোকে ইজতেহাদ বলে। আর যে আলেম ইজতেহাদ করার যোগ্য, তাঁকে মুজতাহেদ বলা হয়।
প্রশ্ন: (৪) আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত কারা?

উত্তর: আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত তারাই, যারা আকীদা ও আমলের ক্ষেত্রে সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরে এবং তার ওপর ঐক্যবদ্ধ থাকে এবং অন্য কোনো দিকে দৃষ্টি দেয় না। এ কারণেই তাদেরকে আহলে সুন্নাত রূপে নামকরণ করা হয়েছে। কেননা তারা সুন্নাহর ধারক ও বাহক। তাদেরকে আহলে জামা‘আতও বলা হয়। কারণ, তাঁরা সুন্নাহর উপর জামাতবদ্ধ বা ঐক্যবদ্ধ।

অপরদিকে আপনি যদি বিদ‘আতীদের অবস্থার প্রতি দৃষ্টিপাত করেন, তবে দেখতে পাবেন যে, তারা আকীদা ও আমলের ক্ষেত্রে বিভিন্ন দলে বিভক্ত। তাদের এ অবস্থা এটাই প্রমাণ করে যে, তারা যে পরিমাণ বিদ‘আত তৈরি করেছে সে পরিমাণ সুন্নাত থেকে দূরে সরে গেছে।

প্রশ্ন: (৫) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভবিষ্যৎ বাণী করে গেছেন যে, তাঁর মৃত্যুর পর উম্মত বিভিন্ন দলে বিভক্ত হবে। সম্মানিত শাইখের কাছে এর ব্যাখ্যা জানতে চাই।

উত্তর: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সহীহ হাদীসের[1] মাধ্যমে সংবাদ দিয়েছেন যে, ইয়াহূদীরা ৭১ দলে বিভক্ত হয়েছে, নাসারারা বিভক্ত হয়েছে ৭২ দলে, আর এ উম্মাতে মুহাম্মাদী বিভক্ত হবে ৭৩ দলে। একটি দল ব্যতীত সমস্ত দলই জাহান্নামে প্রবেশ করবে। এটি হলো সেই দল, যারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর সাহাবীগণের সুন্নাহর ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে। এ দলটি দুনিয়াতে বিদ‘আতে লিপ্ত হওয়া থেকে সুরক্ষিত থাকবে এবং পরকালে জাহান্নামের শাস্তি থেকে মুক্তি পাবে। এটিই হলো সাহায্যপ্রাপ্ত দল, যা কিয়ামত পর্যন্ত হকের ওপর বিজয়ী থাকবে।

এ তিয়াত্তর ফের্কার মধ্যে কবেল একটিই হকের ওপর রয়েছে, বাকীরা সবাই বাতিল পথে রয়েছে। কোনো কোনো আলিম এ জাহান্নামী ৭২ ফিরকার পরিচয় নির্ধারণ করার প্রয়াস পেয়েছেন। প্রথমত: বিদ‘আতীদেরকে পাঁচভাগে ভাগ করেছেন এবং প্রত্যেক ভাগ থেকে শাখা-প্রশাখা বের করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক ঘোষিত ৭২ টি ফিরকা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। কিছু কিছু আলিম ফিরকাগুলো নির্ধারণ না করাই উত্তম মনে করেছেন। কারণ, যারা গণনা করেছেন তাদের গণনাকৃত ফিরকার বাইরেও বহু ফিরকা রয়েছে যারা পূর্বে পথভ্রষ্ট হওয়া লোকদের থেকেও বেশি পথভ্রষ্ট হয়েছেন। আর এ বাহাত্তর ফিরকা গণনার পরেও অনেক ফিরকার উৎপত্তি হয়েছে। তারা আরও বলেন, এ সংখ্যা শেষ হবার নয়।

বরং শেষ যামানায় কিয়ামত প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে এর সর্বশেষ সংখ্যা সম্পর্কে জানা সম্ভব নয়। সুতরাং উত্তম হলো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণনা করেছেন, তা সংক্ষিপ্তভাবেই রাখা। আমরা এভাবে বলব যে, এ উম্মত ৭৩ দলে বিভক্ত হবে। ৭২ দল জাহান্নামে যাবে এবং মাত্র একদল জান্নাতে যাবে। অতঃপর বলব, যে দলটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর সাহাবীদের সুন্নাহর বিরোধিতা করবে, সে এ ৭২ দলের অন্তর্ভুক্ত হবে। হয়ত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এতদসংক্রান্ত এমন কিছু মূলনীতির দিকে ইঙ্গিত করেছেন তন্মধ্যে আমরা কেবল দশটিই জানি। আবার হতে পারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন কিছু মূলনীতির প্রতি ইঙ্গিত করেছেন যার সাথে বহু শাখা-প্রশাখা জড়িত; যা কারও কারও মত হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন।

>
[1] আবু দাউদ, কিতাবুস সুন্নাহ, তিরমিযী, কিতাবুল ঈমান, ইবন মাজাহ, কিতাবুল ফিতান।
প্রশ্ন: (৬) নাজাত প্রাপ্ত দলের বৈশিষ্ট্য কী? কোনো ব্যক্তির মাঝে উক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহের কোনো একটি অবর্তমান থাকলে সে ব্যক্তি কি নাজাত প্রাপ্ত দল হতে বের হয়ে যাবে?

উত্তর: নাজাতপ্রাপ্ত দলের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, আকীদা, ইবাদাত, চরিত্র ও আচার ব্যবহারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতকে আকঁড়ে ধরা।

আপনি দেখতে পাবেন যে, আকীদার ক্ষেত্রে তারা আল্লাহর কিতাব এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহর অনুসারী। উলুহিয়্যাত, রুবূবিয়্যাত এবং আসমা ওয়াস সিফাতের[1] ক্ষেত্রে তারা কুরআন-সুন্নাহর আলোকে সঠিক বিশ্বাস পোষণ করে থাকেন।

ইবাদাতের ক্ষেত্রে আপনি দেখতে পাবেন যে, তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহর পরিপূর্ণ বাস্তবায়নকারী। ইবাদাতের প্রকার, পদ্ধতি, পরিমাণ, সময়, স্থান এবং ইবাদাতের কারণ ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহর অনুসরণ করাই তাদের বৈশিষ্ট্য। আপনি তাদের নিকট দীনের ব্যাপারে কোনো বিদ‘আত খুঁজে পাবেন না। তারা আল্লাহ এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সর্বোচ্চ আদব রক্ষা করে চলেন। আল্লাহ অনুমতি দেন নি, ইবাদাতের ক্ষেত্রে এমন বিষয়ের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে তারা আল্লাহ এবং রাসূলের অগ্রণী হয় না।

আখলাক-চরিত্রের ক্ষেত্রেও আপনি তাদেরকে অন্যদের চেয়ে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী দেখতে পাবেন। মুসলিমদের কল্যাণ কামনা করা, অপরের জন্য উদার মনের পরিচয় দেওয়া, মানুষের সাথে হাসি মুখে কথা বলা, উত্তম কথা বলা, বদান্যতা, বীরত্ব এবং অন্যান্য মহান গুণাবলী তাদের চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

দুনিয়াবী লেনদেনের বিষয়াদিতে আপনি তাদেরকে দেখতে পাবেন যে, তারা সততার সাথে সকল প্রকার লেন-দেন সম্পন্ন করে থাকেন। কাউকে ধোকা দেন না। ক্রয়-বিক্রয়ের সময় তারা দ্রব্যের আসল অবস্থা বর্ণনা করে দেন। এদিকে ইঙ্গিত করেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«الْبَيِّعَانِ بِالْخِيَارِ مَا لَمْ يَتَفَرَّقَا فَإِنْ صَدَقَا وَبَيَّنَا بُورِكَ لَهُمَا فِي بَيْعِهِمَا وَإِنْ كَتَمَا وَكَذَبَا مُحِقَتْ بَرَكَةُ بَيْعِهِمَا»

“পৃথক হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েরই ক্রয়-বিক্রয় বাতিল করার অধিকার রয়েছে। যদি তারা উভয়েই সত্য বলে এবং দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করে, আল্লাহ তাদের বেচা-কেনায় বরকত দান করেন। আর যদি মিথ্যা বলে এবং দোষ-ত্রুটি গোপন করে, তবে তাদের ক্রয়-বিক্রয়ের ভিতর থেকে বরকত উঠিয়ে নেওয়া হয়”।[2]

উপরে যে সমস্ত গুণাবলীর আলোচনা করা হলো, কোনো ব্যক্তির মাঝে উক্ত গুণাবলীর কোনো বৈশিষ্ট্য অবর্তমান থাকলে এ কথা বলা যাবে না যে, সে নাজাত প্রাপ্ত দল হতে বের হয়ে গেছে। প্রত্যেকেই আপন আপন আমল অনুযায়ী মর্যাদা লাভ করবে। তবে তাওহীদের ক্ষেত্রে ত্রুটি করলে নাজাত প্রাপ্ত দল হতে বের হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিদ‘আতের বিষয়টিও অনুরূপ। কিছু কিছু বিদ‘আত এমন আছে, যা মানুষকে নাজাতপ্রাপ্ত দল থেকে বের করে দেয়। তবে চরিত্র ও লেন-দেনের ভিতরে কেউ ত্রুটি করলে সে নাজাত প্রাপ্ত দল থেকে বের হবে না, বরং মর্যাদা কমিয়ে দিবে।

সম্ভবত আখলাকের বিষয়টি একটু দীর্ঘ করে বর্ণনা করা দরকার। চরিত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো পরস্পরে একতাবদ্ধ থাকা যায় এবং আল্লাহ তা‘আলা যে হকের ওপর ঐক্যবদ্ধ থাকার আদেশ দিয়েছেন, তার ওপর অটুট থাকা বাস্তবায়িত হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿شَرَعَ لَكُم مِّنَ ٱلدِّينِ مَا وَصَّىٰ بِهِۦ نُوحٗا وَٱلَّذِيٓ أَوۡحَيۡنَآ إِلَيۡكَ وَمَا وَصَّيۡنَا بِهِۦٓ إِبۡرَٰهِيمَ وَمُوسَىٰ وَعِيسَىٰٓۖ أَنۡ أَقِيمُواْ ٱلدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُواْ فِيهِۚ﴾ [الشورى: ١٣]

“তিনি (আল্লাহ) তোমাদের জন্য বিধিবদ্ধ করেছেন এমন দীনকে, যার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি নূহকে। আর যা আমরা অহী করেছিলাম তোমাকে এবং যার নির্দেশ দিয়েছিলাম ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকে এই বলে যে, তোমরা দীনকে প্রতিষ্ঠিত কর এবং তাতে মতভেদ করো না।” [সূরা আশ-শূরা, আয়াত: ১৩] আল্লাহ তা‘আলা সংবাদ দিয়েছেন যে, যারা নিজেদের দীনকে বিভক্ত করেছে এবং বিভিন্ন দলে উপদলে বিভক্ত হয়েছে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। আল্লাহ বলেন,

﴿إِنَّ ٱلَّذِينَ فَرَّقُواْ دِينَهُمۡ وَكَانُواْ شِيَعٗا لَّسۡتَ مِنۡهُمۡ فِي شَيۡءٍۚ﴾ [الانعام: ١٥٩]

“নিশ্চয় যারা দীনকে বিভক্ত করেছে এবং বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে আপনি কোনো ব্যাপারেই তাদের অন্তর্ভুক্ত নন।” [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ১৫৯]

সুতরাং ঐক্যবদ্ধ থাকা নাজী ফিরকার (আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের) অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। তাদের মাঝে কোনো ইজতেহাদী বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দিলে তাদের এ মতবিরোধ পরস্পরের মাঝে হিংসা-বিদ্বেষ এবং শত্রুতার সৃষ্টি করে না; বরং তারা বিশ্বাস করে যে, তারা পরস্পরে ভাই। যদিও তাদের মাঝে এ মতভেদের সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি তাদের একজন এমন ইমামের পিছনেও সালাত আদায় করে থাকে, তার দৃষ্টিতে সেই ইমাম অযু বিহীন। আর ইমাম বিশ্বাস করে যে, সে অযু অবস্থায় রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের লোকেরা উটের মাংস খেয়ে অযু করে নি এমন ইমামের পিছনেও সালাত আদায় করে থাকে। ইমাম মনে করে যে, উটের মাংস খেলে অযু ভঙ্গ হয় না। আর মুক্তাদী মনে করে যে, অযু ভঙ্গ হয়ে যায়। তা সত্বেও সে মনে করে উক্ত ইমামের পিছনে সালাত আদায় করা জায়েয আছে।

এমনটি তারা এ জন্যই করে যে, যেখানে ইজতেহাদের সুযোগ রয়েছে সেখানে ইজতেহাদের কারণে যে সকল মতভেদ সৃষ্টি হয়, তা প্রকৃতপক্ষে মতভেদ নয়। কেননা প্রত্যেকেই আপন আপন দলীলের অনুসরণ করে থাকে, যে সব দলীলের অনুসরণ করা তিনি আবশ্যক মনে করে থাকেন এবং যে দলীল থেকে বিমুখ হওয়া তিনি জায়েয মনে করেন না। তারা মনে করেন তাদের কোনো দীনি ভাই দলীলের অনুসরণ করতে গিয়ে যদি কোনো আমলে তাদের বিরোধিতা করেন প্রকৃতপক্ষে তারা বিরোধিতা করেন নি; বরং তাদের অনুরূপই করেছেন। কারণ, তারাও দলীলের অনুসরণ করার প্রতি আহ্বান জানান। যেখানেই তা পাওয়া যাক না কেন। সুতরাং তিনি যদি তার কাছে থাকা কোনো দলীল অনুযায়ী আমল করার কারণে তাদের বিরোধিতাও করেন তবুন তিনি প্রকৃতপক্ষে তাদের সাথে একাত্মতাই পোষণ করলেন। কেননা তিনি তো সে পথেই চললেন যে পথের দিকে তারা আহ্বান করে এবং পথনির্দেশ করে, আর তা হচ্ছে আল্লাহর কিতাব ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতকে ফয়সালাকারী হিসেবে গ্রহণ করা।

অধিকাংশ আলিমের কাছে এ বিষয়টি অস্পষ্ট নয় যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে সাহাবীগণের ভিতরে এরকম অনেক বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দিয়েছিল। তিনি কাউকে ধমক দেন নি বা কারও ওপর কঠোরতা আরোপ করেন নি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন খন্দকের যুদ্ধ হতে ফেরত আসলেন, তখন জিবরীল আলাইহিস সালাম এসে অঙ্গীকার ভঙ্গকারী বানু কুরায়যায় অভিযান পরিচালনার প্রতি ইঙ্গিত করলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীগণকে বললেন, তোমাদের কেউ যেন বানু কুরায়যায় না গিয়ে আসরের সালাত না পড়ে।[3]

সাহাবীগণ এ কথা শুনে মদীনা হতে বের হয়ে বানু কুরায়যার দিকে রওনা দিলেন। পথিমধ্যে আসরের সালাতের সময় হয়ে গেল। তাদের কেউ সালাত না পড়েই বানু কুরায়যায় পৌঁছে গেলেন। এদিকে সালাতের সময় শেষ হয়ে গেল। তারা বললেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আসরের সালাত অবশ্যই বানী কুরায়যায় গিয়ে পড়তে হবে। তাদের কেউ সালাত ঠিক সময়েই পড়ে নিল। তাদের কথা হলো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে তাড়াতাড়ি বের হতে বলেছেন। তাঁর কথার অর্থ এটা নয় যে, আমরা সময় মত সালাত না পড়ে পিছিয়ে নিব। এরাই সঠিক ছিল। তদুপরি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দু’দলের কাউকে ধমক দেন নি। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বক্তব্য বুঝার ক্ষেত্রে ভিন্নমত হওয়া সত্বেও তাদের মাঝে বিদ্বেষ সৃষ্টি হয় নি।

এ হাদীসটি বুঝতে গিয়ে যে মতভেদের সূচনা হয়েছিল, তার কারণে তাদের মধ্যে শত্রুতা বা দলাদলির সৃষ্টি হয় নি। আর সেজন্য আমি মনে করি দলীলের ভিত্তিতে ইজতেহাদী কোনো মাসআলায় মতভেদ হওয়া সত্বেও, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অনুসারীদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া উচিৎ। তাদের মধ্যে দলাদলি থাকবে না। এমন হবে না যে তাদের একদল অমুকের দিকে সম্পর্কযুক্ত, দ্বিতীয়দল অন্যের দিকে সম্পর্কযুক্ত হবে আর তৃতীয়দল অন্যের দিকে নিজেকে সম্পর্কযুক্ত করবে, পরস্পর হানাহানিতে, বাকযুদ্ধে লিপ্ত হবে, পরস্পর শত্রুতা পোষণ করবে, হিংসা-বিদ্বেষ করবে এমনসব বিষয়ে যেখানে ইজতিহাদ করা গ্রহণযোগ্য। এখানে আমি বিভিন্ন গোষ্ঠীকে বিশেষ করে নাম ধরে বলার দরকার মনে করছি না, কিন্তু বিবেকবান মাত্রই সহজে বুঝতে পারবে এবং তার তার জন্য তা স্পষ্ট হবে।

সুতরাং আমার মত হচ্ছে, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের ওপর কর্তব্য হচ্ছে ঐক্যবদ্ধ থাকা, এমনকি যদিও কোনো বিষয়ে কুরআন ও হাদীসের ভাষ্য বুঝার ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে মতভেদ হয়েও যায়। কারণ আল্লাহর জন্যই সকল প্রশংসা এটি এমন এক বিষয়, যাতে ব্যাপক উদারতা রয়েছে। সুতরাং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, মুসলিমদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া। আর এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, ইসলাম ও মুসলিমদের শত্রুরা চায় যে, মুসলিমগণ পরস্পরে বিভক্ত হোক। তাদের কারও শত্রুতা প্রকাশিত, আবার তাদের কেউ কেউ ইসলাম ও মুসলিমদের বন্ধুত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে থাকে, অথচ তারা প্রকৃতই শত্রু। সুতরাং আমাদের ওপর কতর্ব্য হবে ‘নাজী ফির্কা’ তথা নাজাতপ্রাপ্ত গোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হয়ে হকের ওপর ঐক্যবদ্ধ থাকা।

>
[1] সকল প্রকার ইবাদাত এককভাবে আল্লাহর জন্য নির্ধারণ করাকে তাওহীদুল উলুহিয়্যাহ বলা হয়। আল্লাহর সৃষ্টি, রাজত্ব, কর্তৃত্ব ও পরিচালনায় আল্লাহকে একক হিসাবে বিশ্বাস করার নাম তাওহীদুর রুবূবীয়্যাহ। আর কুরআন ও সুন্নায় আল্লাহর যে সমস্ত নাম ও গুণাবলীর বর্ণনা রয়েছে, সেগুলোর প্রতি বিশ্বাস করাকে তাওহীদুল আসমা ওয়াস সিফাত বলা হয়।

[2] সহীহ বুখারী ও মুসলিম, অধ্যায়: কিতাবুল বুয়ূ‘ (ক্রয়-বিক্রয়)।

[3] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: কিতাবুল খাওফ।
প্রশ্ন: (৭) দীনের ভিতরে ‘মধ্যমপন্থা’ বলতে কী বুঝায়?

উত্তর: দীনের ভিতরে মধ্যম পন্থা অবলম্বনের অর্থ এই যে, মানুষ দীনের মধ্যে কোনো কিছু বাড়াবে না; যাতে সে আল্লাহর নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করে ফেলে। এমনিভাবে দীনের কোনো অংশ কমাবে না; যাতে সে আল্লাহর নির্ধারিত দীনের কিছু অংশ বিলুপ্ত করে দেয়।

দীনের মধ্যে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করার অর্থ হচ্ছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনী অনুসরণ করা। তাঁর জীবনাদর্শ অতিক্রম করা দীনের ভিতরে অতিরঞ্জনের শামিল। তাঁর জীবন চরিতের পূর্ণ অনুসরণ না করা তাতে কমতি করার শামিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, একলোক বলল আমি আজীবন রাত্রি জেগে তাহাজ্জুদের সালাত পড়ব। রাত্রিতে কখনই নিদ্রা যাব না। কারণ, সালাত অন্যতম উত্তম ইবাদাত। তাই সালাতের মাধ্যমে বাকী জীবনের রাত্রিগুলো জাগরণ করতে চাই। আমরা তার উত্তরে বলব যে, এ ব্যক্তি দীনের মাঝে অতিরঞ্জনকারী। সে হকের উপর নয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে এরকম হয়েছিল। তিনজন লোক একত্রিত হয়ে একজন বলল, আমি সারা রাত্রি সালাত আদায় করবো, ঘুমাবো না। অন্যজন বলল আমি সারা বছর সাওম রাখবো এবং কখনো তা ছাড়ব না। তৃতীয়জন বলল আমি বিয়েই করবো না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এ সংবাদ পৌঁছলে তিনি বললেন “একদল লোকের কি হলো তারা এ রকম কথা বলে থাকে? অথচ আমি সাওম রাখি এবং কখনো সাওম থেকে বিরত থাকি। রাত্রির কিয়াম করি ও ঘুমাই। স্ত্রীদের সাথেও মিলিত হই। এটি আমার সুন্নাত। সুতরাং যে ব্যক্তি আমার সুন্নাহ থেকে বিমুখ থাকবে সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।” এ লোকেরা দীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করার কারণে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্নতার কথা ঘোষণা করলেন। কেননা তারা সাওম রাখা না রাখা, রাত্রি জাগরণ করা, ঘুমানো এবং বিয়ে করার ক্ষেত্রে তাঁর সুন্নাতকে প্রত্যাখ্যান করতে চেয়েছিল।

আর দীনী বিষয়ে কমতিকারী, সে হচ্ছে এমন ব্যক্তি যে বলে, আমার নফল ইবাদাতের দরকার নেই। শুধু ফরয ইবাদতগুলোই পালন করব। কখনও কখনও সে ব্যক্তি ফরয আমলেও ত্রুটি করে থাকে। সে অবশ্যই ত্রুটিকারী।

আর মধ্যম পথের অনুসারী হলো সেই ব্যক্তি, যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং খোলাফায়ে রাশেদার সুন্নাহর উপর চলবে।

অন্য একটি দৃষ্টান্ত হলো, মনে করুন তিনজন ভালো লোকের পাশে রয়েছে একজন ফাসিক ব্যক্তি। তিনজনের একজন বলল, আমি এ ফাসিককে সালাম দিব না। তার থেকে দূরে থাকব এবং তার সাথে কথা বলব না।

অপর জন বলল, আমি এর সাথে চলব, তাকে সালাম দিব, হাসি মুখে তার সাথে কথা বলব, তাকে দাওয়াত দিব এবং তার দাওয়াতে আমিও শরীক হব। আমার নিকট সে অন্যান্য সৎ লোকের মতই।

তৃতীয়জন বলল, আমি এ ফাসিক ব্যক্তিকে তার পাপাচারিতার কারণে ঘৃণা করি। তার ভিতরে ঈমান থাকার কারণে আমি তাকে ভালোবাসি। তার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করব না। তবে তাকে সংশোধনের কারণে বর্জন করা হলে তা ভিন্ন কথা। তাকে বর্জন করলে যদি তার পাপাচারিতা আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা হয়, তবে আমি তাকে বর্জন করব না। এ তিনজনের প্রথম ব্যক্তি বেশি বাড়াবাড়ি করল। দ্বিতীয়জন ত্রুটি করল এবং তৃতীয়জন মধ্যম পন্থা ও সঠিক পথের অনুসরণ করল।

অন্যান্য সকল ইবাদাত ও মানুষের মু‘আমালাতের[1] ক্ষেত্রেও অনুরূপটি ঘটে থাকে। মানুষ এতে ত্রুটিকারী, বাড়াবাড়িকারী ও মধ্যম পন্থা অবলম্বনকারী হয়ে থাকে।

তৃতীয় আরেকটি উদাহরণ, মনে করুন একজন লোক তার স্ত্রীর কথায় চলে। তার স্ত্রী তাকে যেখানে পাঠায় সেখানে যায়। সে তার স্ত্রীকে অন্যায় কাজ হতে বাধা প্রদান করে না এবং স্ত্রীকে কোনো ভালো কাজে উৎসাহ দেয় না। সকল ক্ষেত্রেই স্ত্রী তার উপর কর্তৃত্ব করছে এবং তার মালিক হয়ে বসেছে।

আরেক ব্যক্তি তার স্ত্রীর কোনো ব্যাপারেই গুরুত্ব দেয়না। তার স্ত্রীর সাথে অহংকার করে চলে। যেন তার স্ত্রী তার কাছে চাকরানীর চেয়ে অবহেলিত।

অন্য ব্যক্তি মধ্যম পন্থা অবলম্বন করে এবং আল্লাহ ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রদত্ব সীমা অনুযায়ী স্ত্রীর সাথে আচরণ করে থাকে। আল্লাহ বলেন,

﴿وَلَهُنَّ مِثۡلُ ٱلَّذِي عَلَيۡهِنَّ بِٱلۡمَعۡرُوفِۚ﴾ [البقرة: ٢٢٨]

“তাদের (স্ত্রীদের) জন্য তোমাদের ওপর হক রয়েছে, যেমন তাদের ওপর তোমাদের হক রয়েছে।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২২৮] কোনো পুরুষ তার স্ত্রীকে হেয় প্রতিপন্ন করবে না। স্ত্রীর কোনো একটি চরিত্রকে অপছন্দ করলে হয়ত অন্য একটি গুণ দেখে সে সন্তুষ্ট হয়ে যাবে।[2] শেষ ব্যক্তি মধ্যম পন্থা অবলম্বনকারী, প্রথম ব্যক্তি স্ত্রীর সাথে ব্যবহারের ক্ষেত্রে অতিমাত্রায় শিথিল এবং দ্বিতীয় ব্যক্তি ত্রুটিকারী (অবহেলাকারী ও অবজ্ঞাকারী)। হে প্রিয় পাঠক! আপনি সকল ইবাদাত ও আচার-আচরণকে উক্ত উদাহরণগুলোর উপরে অনুমান করুন।

>
[1] মানুষ পরস্পরে যে লেন-দেন, বেচা-কেনা, চুক্তি, ওয়াদা-অঙ্গীকার ও পার্থিব ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অন্যান্য দুনিয়াবী কাজ-কর্ম করে থাকে, তাকে ইসলামের পরিভাষায় মু‘আমালাত বলা হয়। এসবের সাথে ইবাদতের কোনো সম্পর্ক নেই। তবে এগুলো যদি ইসলামী নীতিমালার ভিতরে হয় এবং তাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করা হয়, তবে তাও ইবাদাতে পরিণত হয়।

[2] সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: কিতাবুর রাদা।
প্রশ্ন: (৮) আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের নিকট ঈমান অর্থ কী? ঈমান কি বাড়ে এবং কমে?

উত্তর: আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মতে ঈমান হচ্ছে, অন্তরের স্বীকৃতি, মৌখিক উচ্চারণ এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মাধ্যমে কর্মে আনয়ন। সুতরাং ঈমান তিনটি বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করে,

১- অন্তরের স্বীকৃতি,

২- মৌখিক উচ্চারণ এবং

৩- অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আমল।

যেহেতু উক্ত বিষয়সমূহের সমষ্টির নাম ঈমান, সে হিসাবে তা বাড়বে এবং কমবে এটিই স্বাভাবিক। কারণ, অন্তরের স্বীকৃতির তারতম্য হয়ে থাকে। অতএব, সংবাদ শুনে কোনো কিছু স্বীকার করা আর আপন চোখে দেখে স্বীকার করা এক কথা নয়। অনুরূপভাবে একজনের দেওয়া সংবাদ স্বীকার করা আর দু’জনের সংবাদ স্বীকার করে নেওয়া এক কথা নয়। এ জন্যই ইবরাহীম আলাইহিস সালাম বলেছিলেন,

﴿رَبِّ أَرِنِي كَيۡفَ تُحۡيِ ٱلۡمَوۡتَىٰۖ قَالَ أَوَ لَمۡ تُؤۡمِنۖ قَالَ بَلَىٰ وَلَٰكِن لِّيَطۡمَئِنَّ قَلۡبِيۖ﴾ [البقرة: ٢٦٠]

“হে আমার রব! আমাকে দেখান আপনি কীভাবে মৃতকে জীবিত করেন। আল্লাহ বললেন, তুমি কি ঈমান আন নি? ইবরাহীম বললেন, ঈমান তো অবশ্যই এনেছি, কিন্তু আমার অন্তর যাতে পরিতৃপ্ত হয় এজন্য আমি স্বচক্ষে দেখতে চাই।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৬০]

কাজেই অন্তরের স্বীকৃতি এবং তার স্থীরতা ও প্রশান্তির দিক থেকে ঈমান বৃদ্ধি পায়। মানুষ তার অন্তরে তা সহজেই অনুভব করে থাকে। সে যখন ইসলামী অনুষ্ঠান বা ওয়াজ মাহফিলে উপস্থিত হয়ে নসীহত শুনে বা জান্নাত ও জাহান্নামের আলোচনা শুনে, তখন তার ঈমান বৃদ্ধি পায়। এমন কি সে যেন জান্নাত- জাহান্নাম স্বচক্ষে দেখতে পাচ্ছে। অতঃপর যখন গাফিলতি চলে আসে এবং যখন মজলিস থেকে উঠে যায়, তখন তার অন্তরে সে দৃঢ়বিশ্বাস হালকা হয়ে যায়।

এমনিভাবে মুখের আমলের (যিকির) কারণেও ঈমান বৃদ্ধি পায়। কেননা যে ব্যক্তি দশবার আল্লাহর যিকির করল, সে একশতবার যিকিরকারীর সমান নয়। দ্বিতীয় ব্যক্তির আমল প্রথম ব্যক্তির আমলের চেয়ে অনেক বেশি। বেশি হওয়াই স্বাভাবিক।

এমনিভাবে যে ব্যক্তি পরিপূর্ণভাবে ইবাদাত সম্পন্ন করবে আর যে ব্যক্তি ত্রুটিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করবে- উভয়ে সমান নয়।

এমনিভাবে আমলের মাধ্যমেও ঈমান বাড়ে। যে ব্যক্তি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে বেশি আমল করে তার ঈমান কম আমলকারীর চেয়ে বেশি। বেশি-কম হওয়ার ব্যাপারে যথেষ্ট দলীল-প্রমাণ রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَمَا جَعَلۡنَآ أَصۡحَٰبَ ٱلنَّارِ إِلَّا مَلَٰٓئِكَةٗۖ وَمَا جَعَلۡنَا عِدَّتَهُمۡ إِلَّا فِتۡنَةٗ لِّلَّذِينَ كَفَرُواْ لِيَسۡتَيۡقِنَ ٱلَّذِينَ أُوتُواْ ٱلۡكِتَٰبَ وَيَزۡدَادَ ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ إِيمَٰنٗا﴾ [المدثر: ٣١]

“আমরা জাহান্নামের তত্বাবধায়ক হিসেবে ফিরিশতাগণকেই রেখেছি। আমরা কাফিরদেরকে পরীক্ষা করার জন্যই তাদের এ সংখ্যা নির্ধারণ করেছি, যাতে কিতাবধারীরা দৃঢ় বিশ্বাসী হয় এবং মুমিনদের ঈমান বৃদ্ধি পায়।” [সূরা আল-মুদ্দাসসির, আয়াত: ৩১]

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿وَإِذَا مَآ أُنزِلَتۡ سُورَةٞ فَمِنۡهُم مَّن يَقُولُ أَيُّكُمۡ زَادَتۡهُ هَٰذِهِۦٓ إِيمَٰنٗاۚ فَأَمَّا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ فَزَادَتۡهُمۡ إِيمَٰنٗا وَهُمۡ يَسۡتَبۡشِرُونَ ١٢٤ وَأَمَّا ٱلَّذِينَ فِي قُلُوبِهِم مَّرَضٞ فَزَادَتۡهُمۡ رِجۡسًا إِلَىٰ رِجۡسِهِمۡ وَمَاتُواْ وَهُمۡ كَٰفِرُونَ ١٢٥﴾ [التوبة: ١٢٤، ١٢٥]

“আর যখন কোনো সূরা অবতীর্ণ হয়, তখন তাদের কেউ কেউ বলে, এ সূরা তোমাদের মধ্যে কার ঈমান কতটা বৃদ্ধি করল? তবে যারা ঈমানদার, এ সূরা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করেছে এবং তারা আনন্দিত হয়েছে। বস্তুতঃ যাদের অন্তরে ব্যাধি রয়েছে এটি তাদের অন্তরে কলুষের সাথে আরো কলুষ বৃদ্ধি করেছে এবং তারা কাফির অবস্থায়ই মৃত্যু করল।” [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ১২৪-২৫]

সহীহ হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত আছে,

«مَا رَأَيْتُ مِنْ نَاقِصَاتِ عَقْلٍ وَدِينٍ أَذْهَبَ لِلُبِّ الرَّجُلِ الْحَازِمِ مِنْ إِحْدَاكُنَّ»

“দীন ও জ্ঞানে অপূর্ণ হওয়া সত্বেও জ্ঞানী পুরুষদের জ্ঞানকে তোমাদের চেয়ে অধিক হরণকারী আর কাউকে দেখি নি।”[1] সুতরাং ঈমান বাড়ে এবং কমে। কিন্তু প্রশ্ন হলো ঈমান বাড়ার কারণ কী?

ঈমান বৃদ্ধি হওয়ার উপায়সমূহ

প্রথম উপায়: আল্লাহর সমস্ত নাম ও গুণাবলীসহ আল্লাহ তা‘আলার পরিচয় সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা। আল্লাহ তা‘আলা এবং তাঁর নাম ও গুণাবলী সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান যতই বৃদ্ধি পাবে, নিঃসন্দেহে তার ঈমানও তত বৃদ্ধি পাবে। এ জন্যই যে সমস্ত আলিম আল্লাহর নাম ও গুণাবলী সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন তারা এ সম্পর্কে জ্ঞানহীন আলিমদের চেয়ে ঈমানের দিক থেকে অধিক শক্তিশালী।

দ্বিতীয় উপায়: সৃষ্টির ভিতরে আল্লাহর নিদর্শনসমূহ সম্পর্কে গবেষণা করা এবং আল্লাহ মানব জাতিকে যে জীবন বিধান দিয়েছেন, তার ভিতরে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করা। মানুষ আল্লাহর সৃষ্টিরাজি নিয়ে যতই চিন্তা করবে, ততই তার ঈমান বৃদ্ধি পাবে। আল্লাহ তাআলা বলেন,

﴿ وَفِي ٱلۡأَرۡضِ ءَايَٰتٞ لِّلۡمُوقِنِينَ ٢٠ وَفِيٓ أَنفُسِكُمۡۚ أَفَلَا تُبۡصِرُونَ ٢١﴾ [الذاريات: ٢٠، ٢١]

“দৃঢ়বিশ্বাসীদের জন্য পৃথিবীতে নিদর্শনাবলী রয়েছে এবং তোমাদের নিজেদের মধ্যেও, তোমরা কি চক্ষুষ্মান হবে না?” [সূরা আয-যারিয়াত, আয়াত: ২০-২১] আল্লাহর সৃষ্টিরাজির মধ্যে চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণা করলে যে ঈমান বৃদ্ধি পায়, এ মর্মে অনেক দলীল-প্রমাণ রয়েছে।

তৃতীয় উপায়: বেশি বেশি সৎ কাজ সম্পাদন করা। সৎ আমল যতই বৃদ্ধি পাবে, ঈমান ততই বৃদ্ধি পাবে। এ সৎ আমল মুখের কথার মাধ্যমে হোক, কিংবা কাজের মাধ্যমে হোক যেমন যিকর আযকার, সালাত, সাওম এবং হজ্জ। এসব কিছুই ঈমান বৃদ্ধির মাধ্যম।

ঈমান কমে যাওয়ার কারণসমূহ

প্রথম কারণ: আল্লাহর নাম ও গুণাবলী সম্পর্কে অজ্ঞ থাকা ঈমান কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ। কেননা আল্লাহর নাম ও গুণাবলী সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান যতই কমবে, ঈমানও তত কমতে থাকবে।

দ্বিতীয় কারণ: সৃষ্টিতে ও শরী‘আতে আল্লাহর আয়াত সম্পর্কে গবেষণা করা থেকে বিরত থাকা। কেননা আল্লাহর সৃষ্টিতে চিন্তা-ভাবনা না করা ঈমানের ঘাটতি হওয়ার অন্যতম কারণ।

তৃতীয় কারণ: গুনাহের কাজে লিপ্ত হওয়া। কেননা গুনাহের কাজ করলে অন্তরে এবং ঈমানের উপর বিরাট প্রভাব পড়ে। এ জন্যই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«لَا يَزْنِي الزَّانِي حِينَ يَزْنِي وَهُوَ مُؤْمِنٌ»

“ব্যভিচারী ঈমান থাকা অবস্থায় ব্যভিচারে লিপ্ত হতে পারে না।”[2] চতুর্থ কারণ: সৎ আমল না করা ঈমান হ্রাস পাওয়ার অন্যতম কারণ। কিন্তু যদি বিনা কারণে কোনো ওয়াজিব কাজ ছেড়ে দেয় তাহলে ঈমান কমার সাথে সাথে সে তিরস্কার ও শাস্তির সম্মুখীন হবে। অবশ্য গ্রহণযোগ্য কারণে ওয়াজিব ছেড়ে দিলে অথবা ওয়াজিব নয় এমন কাজ ছেড়ে দিলে ঈমানের ঘাটতি হবে, কিন্তু তিরস্কারের সম্মুখীন হবে না। এ জন্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মহিলাদেরকে জ্ঞান ও দীনের ক্ষেত্রে অপূর্ণ বলেছেন। এর কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, তাদের যখন মাসিকের রক্ত বের হয়, তখন তারা সালাত-সাওম থেকে বিরত থাকে। অথচ মাসিক অবস্থায় সালাত-সাওম থেকে বিরত থাকার কারণে তাদেরকে দোষারোপ করা হয় না; বরং তা থেকে বিরত থাকার আদেশ দেওয়া হয়েছে; কিন্তু যেহেতু পুরুষদের তুলনায় তাদের আমল কম হয়ে গেল, সে হিসেবে তারা পুরুষের চেয়ে কম ঈমানের অধিকারী।

>
[1] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: কিতাবুল হাঈদ।

[2] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: কিতাবুল হুদূদ; সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: কিতাবুল ঈমান।
প্রশ্ন: (৯) হাদীসে জিবরীলে ঈমানের ব্যাখ্যায় রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ঈমান হলো ‘আল্লাহর উপর ঈমান রাখা, তাঁর ফিরিশতা, আসমানী কিতাব এবং তাঁর রাসূলগণের উপর বিশ্বাস রাখা, পরকালের প্রতি বিশ্বাস এবং ভাগ্যের ভালো-মন্দের ওপর বিশ্বাস রাখার নাম’। অথচ আবদুল কায়েস গোত্রের প্রতিনিধি দলের হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈমানের ব্যাখ্যায় বলেছেন, ঈমান হলো ‘আল্লাহ ছাড়া সত্য কোনো উপাস্য নেই তিনি এক ও অদ্বিতীয়, একথার সাক্ষ্য দেওয়া, সালাত কায়েম করা, যাকাত দেওয়া এবং গণীমতের মালের এক পঞ্চমাংশ প্রদান করা।’ উপরের উভয় হাদীসের মধ্যে আমরা কীভাবে সমন্বয় করব?

উত্তর: এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার পূর্বে আমি বলতে চাই যে, আল্লাহর কিতাব এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহর ভিতরে কোনো পারস্পরিক দ্বন্দ্ব নেই। কুরআনের এক অংশ অন্য অংশের বিরোধী নয়। এমনিভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহর ক্ষেত্রেও একই কথা। কুরআন ও সুন্নাতে পরস্পর বিরোধী কোনো জিনিস নেই। এ মূলনীতিটি মনে রাখলে কুরআন-হাদীস বুঝার অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿أَفَلَا يَتَدَبَّرُونَ ٱلۡقُرۡءَانَۚ وَلَوۡ كَانَ مِنۡ عِندِ غَيۡرِ ٱللَّهِ لَوَجَدُواْ فِيهِ ٱخۡتِلَٰفٗا كَثِيرٗا ٨٢﴾ [النساء: ٨٢]

“তারা কি কুরআন গবেষণা করে না? এটি যদি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও নিকট থেকে হত, তাহলে তারা উহাতে অনেক মতভেদ দেখতে পেত।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৮২]

কুরআনের ভিতরে যেহেতু মতবিরোধ নেই, রাসূলের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীসের ক্ষেত্রেও তাই। এক হাদীস অন্য হাদীসের বিরোধী নয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যদি এক স্থানে ঈমানকে একভাবে ব্যাখ্যা করেন এবং অন্য স্থানে অন্যভাবে ব্যাখ্যা করেন, যা আপনার দৃষ্টিতে প্রথম ব্যাখ্যার বিরোধী মনে হয়, কিন্তু আপনি যদি গভীরভাবে চিন্তা করেন, তাহলে আপনি কোনো দ্বন্দ্ব পাবেন না।

হাদীসে জিবরীলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দীনকে ইসলাম, ঈমান, ইহসান এ তিনভাগে ভাগ করেছেন। আর আবদুল কায়েস গোত্রের প্রতিনিধি দলের হাদীসে শুধুমাত্র দীনের একটি মাত্র প্রকার তথা ইসলামের কথা উল্লেখ করেছেন। যেখানে শুধুমাত্র ইসলামের কথা উল্লেখ হবে, সেখানে ঈমানকেও অন্তর্ভুক্ত করা হবে। কারণ, মুমিন হওয়া ব্যতীত ইসলামের যাবতীয় বিধি-বিধান পালন করা সম্ভব নয়। আবার যেখানে শুধুমাত্র ঈমানের আলোচনা হবে, সেখানে ইসলামও অন্তর্ভুক্ত হবে। কারণ, প্রত্যেক মুমিনকে ইসলামের বিধি-বিধান মেনে চলতে হবে। আর যেখানে ঈমান ও ইসলাম একই সাথে উল্লেখ হবে, সেখানে ঈমান দ্বারা উদ্দেশ্য হবে অন্তরের বিষয়সমূহ। আর ইসলাম দ্বারা উদ্দেশ্য হবে বাহ্যিক আমলসমূহ। ইলম অর্জনকারীদের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মাসআলা। শুধুমাত্র ইসলামের আলোচনা আসলে ঈমানও তার ভিতরে প্রবেশ করবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿إِنَّ ٱلدِّينَ عِندَ ٱللَّهِ ٱلۡإِسۡلَٰمُۗ﴾ [ال عمران: ١٩]

“ইসলামই আল্লাহর কাছে একমাত্র মনোনীত দীন”। [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৯]

আর এটা জানা বিষয় যে, ইসলাম আকীদা, ঈমান ও বাহ্যিক আমলের সমষ্টি। এককভাবে ঈমানের উল্লেখ হলে ইসলামকে তার ভিতরে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। দু’টি একসাথে উল্লেখ হলে ঈমানের অর্থ হবে অন্তরে বিশ্বাস করার বিষয়সমূহ আর ইসলামের অর্থ হবে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বাহ্যিক আমলসমূহ। এ জন্যই পূর্ববর্তী যুগের কোনো কোনো আলিম বলেছেন, ইসলাম প্রকাশ্য বিষয় এবং ঈমান গোপনীয় বিষয়। কারণ, তা অন্তরের সাথে সংশ্লিষ্ট। আপনি কখনো দেখতে পাবেন যে, মুনাফিক ব্যক্তি সালাত পড়ছে, সাওম রাখছে এবং সাদকা করছে। এ ব্যক্তি প্রকাশ্যভাবে মুসলিম কিন্তু মুমিন নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَمِنَ ٱلنَّاسِ مَن يَقُولُ ءَامَنَّا بِٱللَّهِ وَبِٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِ وَمَا هُم بِمُؤۡمِنِينَ ٨﴾ [البقرة: ٨]

“মানুষের মধ্যে কিছু মানুষ এমন আছে, যারা বলে আমরা আল্লাহর ওপর এবং পরকালের ওপর ঈমান আনয়ন করেছি, অথচ তারা মুমিন নয়”। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ৮]

প্রশ্ন: (১০) রাসূল (ﷺ) হাদীসে জিবরাঈলে বলেছেন, ঈমান হলো আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, ফিরিশতাদের প্রতি বিশ্বাস, আল্লাহর কিতাবের ওপর বিশ্বাস, রাসূলদের ওপর বিশ্বাস, পরকালের ওপর বিশ্বাস এবং ভাগ্যের ভালো-মন্দের ওপর বিশ্বাস স্থাপন। অন্য হাদীসে রয়েছে, ঈমানের সত্তরের অধিক শাখা-প্রশাখা রয়েছে। উভয় হাদীসের মধ্যে আমরা কীভাবে সমন্বয় করব?

উত্তর: যে ঈমানের মাধ্যমে আকীদাহ[1] উদ্দেশ্য, তার রুকন মোট ছয়টি। সেগুলো হাদীসে জিবরীলে উল্লেখ হয়েছে। জিবরীল আলাইহিস সালাম যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ঈমান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন, উত্তরে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ঈমান হলো তুমি বিশ্বাস করবে আল্লাহর প্রতি, ফিরিশতাদের প্রতি, আসমানী কিতাবসমূহের প্রতি, রাসূলগণের প্রতি, পরকালের প্রতি এবং ভাগ্যের ভালো-মন্দের প্রতি। অপর পক্ষে যেখানে ঈমানের সত্তরের অধিক শাখা-প্রশাখা থাকার কথা বলা হয়েছে, সেখানে ঈমানের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকার সৎ আমল উদ্দেশ্য। এ জন্য সালাতকে ঈমানের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন,

﴿وَمَا كَانَ ٱللَّهُ لِيُضِيعَ إِيمَٰنَكُمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ بِٱلنَّاسِ لَرَءُوفٞ رَّحِيمٞ﴾ [البقرة: ١٤٣]

“আল্লাহ তোমাদের ঈমানকে বিনষ্ট করবেন না। নিশ্চয় আল্লাহ মানুষের প্রতি অতীব দয়ালু”। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৪৩]তাফসীরকারকগণ বলেছেন, এখানে ঈমান দ্বারা বায়তুল মাকদাসের দিকে ফিরে আদায় করা সালাত উদ্দেশ্য। কেননা সাহাবীগণ কা‘বার দিকে মুখ করে সালাত আদায়ের পূর্বে বাইতুল মাকদাসের দিকে ফিরে সালাত আদায় করতেন।

[1] ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস সম্পর্কিত বিষয়গুলিকে আকীদা বলা হয়। যেমন, আল্লাহর সত্বা ও গুণাবলীতে বিশ্বাস নবী-রাসূলদের ওপর বিশ্বাস ও অন্যান্য বিষয়সমূহ।
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ১০ পর্যন্ত, সর্বমোট ৫৩৯ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ 1 2 3 4 5 6 · · · 51 52 53 54 পরের পাতা »