التقليد এর সংজ্ঞা: التقليد এর আভিধানিক অর্থ- ঘাড়ে কোন কিছু বেষ্টন করে দেয়া। যেমন: মালা। পরিভাষায়:
اتباع من ليس قوله حجة
‘‘যার কথা শরীয়াতে হুজ্জত বা দলীল নয়, তাকে অনুসরণ করাকে তাক্বলীদ বলে।’’
সুতরাং আমাদের বক্তব্য: من ليس قوله حجة (যার কথা শরীয়াতে হুজ্জত বা দলীল নয়) এ অংশ দ্বারা তাক্বলীদ বিলুপ্ত হয়েছে। ফলে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, ইজমাকারী, মুজতাহিদ ও ছাহাবীদের অনুসরণ ও তাদের কথা দলীল হিসাবে গণ্য হয়েছে।
সুতরাং উপরোক্ত কারো অনুসরণকেই তাক্বলীদ হিসাবে অভিহিত করা হবে না। কেননা, এটা দলীলের অনুসরণ। তবে কোন কোন সময় রূপকভাবে এবং ব্যাপকতার দিক বিবেচনা করে এদের অনুসরণকেও তাক্বলীদ হিসাবে অভিহিত করা হয়।
দু’ক্ষেত্রে তাক্বলীদ করা হয়-
প্রথম: মুকাল্লিদ ব্যক্তি একেবারেই সাধারণ মানুষ, যিনি নিজে নিজে শারঈ হুকুম জানতে পারেন না। সুতরাং তার জন্য আবশ্যক হলো তাক্বলীদ করা। আল্লাহ বলেছেন,
فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ
‘‘যদি তোমরা না জানো, তবে জ্ঞানীদের থেকে জেনে নাও (সূরা আন-নাহল ১৬:৪৩)।’’
এব্যাপারে তিনি ইলম ও আল্লাহভীরুতার দিক দিয়ে যাকে শ্রেষ্ঠ পাবেন, তার অনুসরণ করবেন। এক্ষেত্রে যদি দু’জন ব্যক্তি সমপর্যায়ের হয়, তাহলে তাদের যে কারো অনুসরণ করার মাঝে তার স্বাধীনতা থাকবে।
দ্বিতীয়: মুজতাহিদের নিকট এমন কিছু ঘটবে, যা তাৎক্ষণিকভাবে সমাধানযোগ্য। এ ক্ষেত্রে যখন তার চিন্তা-ভাবনার অবকাশ থাকে না। এ অবস্থায় অন্যের তাক্বলীদ করা বিধেয় হবে।
তাক্বলীদ জায়েয হওয়ার জন্য কেউ কেউ এটাও শর্ত করেছেন যে, বিষয়টি দীনের এমন মৌলিক বিষয় হবে না, যা বিশ্বাস করা ওয়াজিব। কেননা, আক্বীদাগত বিষয়সমূহের ব্যাপারে ব্যক্তিকে দৃঢ় বিশ্বাসী হতে হয়। অথচ তাক্বলীদ শুধুমাত্র প্রবল ধারণার উপকারে আসে। কিন্তু অগ্রাধিকারযোগ্য অভিমত হলো, এটা শর্ত নয়। কেননা, আল্লাহ তা‘আলা ব্যাপকভাবে বলেছেন,
فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ
‘‘যদি তোমরা না জানো, তবে জ্ঞানীদের থেকে জেনে নাও (সূরা আন-নাহল ১৬:৪৩)।’’
আয়াতটি রিসালাতকে সাব্যস্ত করার প্রেক্ষাপটে অবতীর্ণ হয়েছে। অথচ রিসালাত দীনের মৌলিক বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত। উপরন্তু সাধারণ মানুষ দলীলের মাধ্যমে হক্ব জানতে সক্ষম হয় না। তাই যখন নিজে নিজে হক্ব জানা অসম্ভব হবে, তখন তাক্বলীদ করা ছাড়া কোন উপায় থাকে না। আল্লাহর বাণী:
فَاتَّقُوا اللَّهَ مَا اسْتَطَعْتُمْ
‘‘তোমরা তোমাদের সাধ্য অনুসারে আল্লাহকে ভয় করো (সূরা আত-ত্বাগাবুন ৬৪:১৬)।’’
তাক্বলীদ দু’প্রকার:
১. العام (ব্যাপক তাক্বলীদ) ২. الخاص (নির্দিষ্ট তাক্বলীদ)
(ক) العام (ব্যাপক তাক্বলীদ): তাক্বলীদে ‘আম বা ব্যাপক তাক্বলীদ হলো, নির্দিষ্ট একটি মাযহাবকে আঁকড়ে ধরা, দীনের সব বিষয়ে মুকাল্লিদ উক্ত মাযহাবের রুখসাত (নমনীয়-সাধারণ) ও আযীমাত (শরীয়াতের আবশ্যিক) গুলো গ্রহণ করে।[1]
এ তাক্বলীদের ব্যাপারে আলিমগণ মতভেদ করেছেন। পরবর্তী লোকদের দ্বারা ইজতিহাদ করা সম্ভবপর না হবার কারণে কেউ কেউ এটাকে ওয়াজিব বলেছেন।[2] আবার কতিপয় বিদ্বান এটাকে হারাম বলেছেন -যেহেতু এতে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যতীত অন্যের অনুসরণের ক্ষেত্রে শর্তহীন বাধ্য-বাধকতা রয়েছে। শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়াহ (রহঃ) বলেছেন,
"إن في القول بوجوب طاعة غير النبي صلي الله عليه وسلم في كل أمره ونهيه، وهو خلاف الاجماع وجوازه فيه ما فيه..."
‘‘আল্লাহর নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাড়া কারো আদেশ ও নিষেধের ক্ষেত্রে তার অনুসরণ করা আবশ্যকতার মতটি ইজমা বিরোধী। এটি জায়েয হওয়ার মধ্যে ত্রম্নটি রয়েছে।[3]
তিনি আরো বলেছেন, ‘‘যে ব্যক্তি নির্দিষ্ট কোন মাযহাবকে আঁকড়ে ধরে, অতঃপর উক্ত মাযহাবের বিপরীত কোন আমল করে, কোন কারণ ছাড়াই অন্য কোন আলিমের ফাতাওয়ার কারণে ঐ মাযহাবের অনুসরণ করেছে এমন নয়, মাযহাবের বিপরীত আমলের দাবি রাখে এমন কোন দলীলও তার কাছে নেই অথবা তার কর্মের বৈধতা দাবি করে এমন কোন শারঈ ওজরও নেই, তবে সে ব্যক্তি শারঈ কোন ওজর ছাড়াই হারাম সম্পাদনকারী ও তার প্রবৃত্তির পূজারী হিসাবে বিবেচিত হবে। এটি অবশ্যই গর্হিত কর্ম।
কিন্তু যখন তার নিকট সুস্পষ্ট হয়ে যায় এমন বিষয়, যা এক মতের উপর আরেক মতকে অগ্রাধিকার দেয়াকে অবধারিত করে, এটি হতে পারে বিস্তারিত দলীল প্রমাণের মাধ্যমে, যদি সে উক্ত দলীল-প্রমাণ জানতে ও বুঝতে পারে অথবা দু’জনের মধ্যে একজনকে উক্ত মাসআ‘লার বিষয়ে অধিক জ্ঞাত মনে করে এবং সে ব্যক্তি তার বক্তব্যের ব্যাপারে আল্লাহকে অধিক ভয় করে, এমতাবস্থায় সে যদি এক অভিমত থেকে অন্য অভিমতের দিকে ফিরে যায়, তবে এটি জায়েয। বরং ওয়াজিব। এ ব্যাপারে ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল সুস্পষ্ট বক্তব্য দিয়েছেন।’’[4]
২. الخاص (নির্দিষ্ট তাক্বলীদ): নির্দিষ্ট কোন বিষয়ে নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তির অভিমত গ্রহণ করাকে তাক্বলীদে خاص বলে। যখন কোন ব্যক্তি ইজতিহাদের মাধ্যমে হক্ব জানতে অপারগ হবে, তখন এটি জায়েয। চাই সে ইজতেহাদ করতে প্রকৃত অর্থেই অপারগ হোক অথবা খুব কষ্ট করে ইজতিহাদ করতে সক্ষম হোক।
[2]. এটা খুবই বাজে মত। কেননা, কুরআন-হাদীছের নছ বহাল থাকার পরেও, পরবর্তী যুগের লোকদের জন্য ইজতিহাদের দরজা বন্ধ করে তাকলীদ অবধারিত করে দেয়া মোটেও সঠিক কথা নয়।
[3]. ফাতাওয়া আল কুবরা ৪/৬২৫
[4]. শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়া (রহঃ) এর বক্তব্য অত্যন্ত ভারসাম্যপূর্ণ। এ জন্য বলা হয় যে, শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়া (রহঃ) এর কথায় সব সময় নূর থাকে। যদি মুকাল্লিদ ভাইয়েরা এমন ভারসাম্যপূর্ণ নীতি অবলম্বন করতো, তবে মুসলিম উম্মাহ মাযহাবীয় গোঁড়ামী ও অনেক অনেক বিবাদ-বিতর্ক থেকে রক্ষা পেতো। আল্লাহর কাছেই তাওফীক চাচ্ছি।
আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
فَاسْأَلوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لا تَعْلَمُونَ
‘‘যদি তোমরা না জানো, তবে জ্ঞানীদের থেকে জেনে নাও।’’ (সূরা নাহল ১৬:৪৩)
এখানে أَهْلَ الذِّكْرِ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো أهل العلم বা বিদ্বান। আর মুকাল্লিদ أهل العلم বা বিদ্বান নয়। বরং সে নিজেই অন্যের অনুগামী।
আবু উমার বিন আব্দুল বার ও অন্যান্য বিদ্বান বলেছেন,
أجمع الناس علي أن المقلد ليس معدودا من اهل العلم. وأن العلم معرفة الحق بدليله
‘‘সমস্ত মানুষ একমত যে, মুকাল্লিদ أهل العلم দের পর্যায়ভুক্ত নয়। অথচ علم হলো দলীলসহ হক্ব জানা।’’
ইবনুল কাইয়ুম (রহঃ) তেমনই বলেছেন, যেমনটা আবু আমর বলেছেন, নিশ্চয় বিষয়টি মূলতঃ তেমনই। কেননা, বিদ্বানগণের মাঝে এ ব্যাপারে কারো কোন দ্বিমত নেই যে, ইলম হলো দলীল থেকে অর্জিত জ্ঞান। পক্ষান্তরে দলীল ছাড়া জ্ঞান হলো তাক্বলীদ।
তারপর ইবনুল কাইয়ুম (রহঃ) তাক্বলীদের মাধ্যমে ফাতাওয়া দেয়া জায়েয় হওয়ার ব্যাপারে তিনটি অভিমত বর্ণনা করেছেন।
প্রথম: তাক্বলীদের মাধ্যমে ফাতাওয়া দেয়া জায়েয নেই। কেননা, তাক্বলীদ কোন ইলম নয়। আর ইলম ছাড়া ফাতাওয়া দেয়া হারাম। এটিই হলো অধিকাংশ হাম্বলী অনুসারী ও অধিকাংশ শাফেয়ীদের অভিমত।
দ্বিতীয়: এটি নিজের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জায়েয। আর যে বিষয়ে সে নিজেই অন্যকে ফাতাওয়া দেয়, সে বিষয়ে তার জন্য অন্যের তাক্বলীদ করা জায়েয নেই।
তৃতীয়: প্রয়োজন সাপেক্ষে এবং মুজতাহিদ আলিমের অনুপস্থিতির কারণে তা জায়েয। এটিই হলো অধিকতর বিশুদ্ধ অভিমত এবং এর উপর বিদ্বানদের আমল রয়েছে।[1] এখানে তার কথা সমাপ্ত হলো।
এ সংক্ষিপ্ত আলোচনায় আমরা যা লিখতে চেয়েছিলাম, তা এর মাধ্যমেই পরিসমাপ্তি ঘটছে। আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি যে, তিনি যেন আমাদের কথা ও কাজে ‘সঠিকতা’ ঢেলে দেন, আমাদের কর্মগুলোকে সফলতার মুকুট পরিয়ে দেন। নিশ্চয় তিনি দানশীল, মহানুভব। আল্লাহ তা‘য়ালা রহমত ও শান্তির ধারা বর্ষণ করুন আমাদের নাবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি ও তার পরিবার পরিজনের প্রতি।