৮ যিলহাজ্জ, যাকে তারবিয়ার দিন বলা হয়। এদিন সকাল বেলা নিজ নিজ স্থান থেকে হাজ্জ পালনে ইচ্ছুক ব্যক্তি ইহরাম বাঁধবে। ইহরাম বাঁধার জন্য মসজিদে হারামে বা অন্য কোন মসজিদে যাওয়া সুন্নাতসম্মত নয়। কারণ আমার জানা মতে ইহা নাবী (সা.) থেকে বা তাঁর কোন সাহাবী হতে প্রমাণিত নয়।
জাবির (রা.) হতে বর্ণিত হাদীসে রয়েছে যে, নাবী (সা.) সাহাবীগণকে বলেন: তোমরা তারবিয়ার দিবস পর্যন্ত হালাল অবস্থায় থাক। অতঃপর তোমরা তারবিয়ার দিনে (৮ যিলহাজ্জ) হাজ্জের ইহরাম বাঁধ।[1]
আর জাবির (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন যে, আমরা (উমরা হতে) হালাল হলে আল্লাহর রসূল (সা.) আমাদের নির্দেশ দেন যেন আমরা মিনা গমনের সময় ইহরাম করে নেই। অতএব আমরা আবতাহ নামক স্থান হতে ইহরাম করি।[2] আর তাঁরা আব্তাহ নামক স্থান থেকে এ জন্য ইহরাম করেছেন যে, তা ছিল তাঁদের অবতরণ স্থল।
- আর হাজ্জের ইহরামের সময় সে সমস্ত কাজ করবে যা উমরার ইহরামের সময় করা হয়েছে।
- তাই গোসল করে সুগন্ধি ব্যবহার করবে।
- অতঃপর তাহিইয়্যাতুল উযূর নিয়্যাতে দু’রাক’আত সলাত আদায় করার পরে হাজ্জের ইহরাম বাঁধবে।
- আর হাজ্জের ইহরাম ও তালবিয়ার নিয়মাবলী উমরার ইহরাম ও তালবিয়ার অনুরূপ।
- তবে হাজ্জের ইহরাম করার সময় ‘লাব্বাইকা উমরাতান’ বলার পরিবর্তে ‘লাব্বাইকা হাজ্জান’ বলবে।
- আর যদি হাজ্জের কার্যাবলী সম্পূর্ণ করায় কোন রকম বাধার আশঙ্কা থাকে তাহলে শর্ত করে নিয়ে বলবে:
اللَّهُمَّ مَحِلِّي حَيْثُ حَبَسْتَنِي
[আল্লাহুম্মা মাহিল্লী হাইসু হাবাসতানী] হে আল্লাহ! যেখানে তুমি আমাকে বাধা প্রদান করবে সেখানেই আমি হালাল হয়ে যাব।[3] আর যদি কোন রকম আশঙ্কা না থাকে তাহলে কোন শর্ত উল্লেখ করবে না।
[2]. সহীহ মুসলিম ১২১৪/১৩৯।
[3]. সহীহ বুখারী ৫০৮৯ ও মুসলিম ১২০৭
অতঃপর মিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবে এবং সেখানে যুহর, আসর, মাগরিব, ইশা ও ফজর (পাঁচ ওয়াক্ত) সলাত নিজ নিজ সময়ে কসর করে আদায় করবে। কারণ নাবী (সা.) এভাবেই আদায় করেছেন।
জাবির (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: তারবিয়ার দিন (৮ যিলহাজ্জ) সাহাবীগণ হাজ্জের তালবিয়া পাঠ করতঃ মিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। আর নাবী (সা.) বাহনে চেপে মিনায় গমন করলেন। অতঃপর সেখানে যুহর, আসর, মাগরিব, ইশা ও ফজর সলাত আদায় করলেন।[2]
আর আব্দুল্লাহ বিন উমার (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রসূল (সা.) মিনায় দু’রাক’আত করে সলাত আদায় করেন। আর আবূ বাকর ও উমার (রা.) দু’রাক’আত করে সলাত আদায় করেন এবং উসমান (রা.) তাঁর খেলাফত আমলের প্রথম ভাগে দু’রাক’আত করে সলাত আদায় করেন।[3]
নাবী (সা.) মিনায় যুহর ও আসর অথবা মাগরিব ও ইশা দু’সলাত একত্রিত করে আদায় করতেন না। আর যদি তিনি এমনটি করতেন তাহলে আরাফা ও মুযদালিফায় যেমন তাঁর থেকে দু’সলাত একত্রিত করার বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে তেমনি মিনার ক্ষেত্রেও বর্ণিত হতো।
আর মক্কাবাসী ও অন্যান্য এলাকার লোকেরাও মিনা, আরাফা ও মুযদালিফায় কসর করবে। কারণ, নাবী (সা.) বিদায় হাজ্জে এসব স্থানে অন্যান্য এলাকার হাজীদের সাথে মক্কাবাসীদেরকেও সঙ্গে নিয়ে কসর সলাত আদায় করেছেন।
কিন্তু তিনি মক্কাবাসী হাজীদেরকে চার রাকা’আত সলাত সম্পন্ন করার নির্দেশ দেননি। যদি মক্কাবাসী হাজীদের জন্য (মিনায় অবস্থানকালে) সলাত চার চার রাক‘আত করে আদায় করা ফরয হতো তাহলে তাদেরকে তেমনি আদেশ দিতেন যেমন তিনি মক্কা বিজয়ের বছর তাদের সঙ্গে সলাত আদায় করার পূর্বে এ বলে আদেশ দিয়েছেন:
يَا أَهْلَ مَكَّةَ أَتِمُّوا صَلاَتَكُمْ فَإِنَّا قَوْمٌ سَفْرٌ
হে মক্কাবাসীরা! তোমরা চার রাক’আত সলাত আদায় কর। কারণ, আমরা মুসাফির (দু’রাক‘আত পড়ে সালাম ফিরে দিব)।[4]
>[2]. সহীহ মুসলিম ১২১৮।
[3]. সহীহ বুখারী ১৬৫৫,১৬৫৭।
[4]. সহীহ: সুনানুন কুবরা বাইহাকী ৫৩২৮, আবূ দাউদ তায়ালিসী ৮৭৯, শারহু মা‘আনিল আসার ২৫১৫।
৯ যিলহাজ্জ সূর্য উদয় হয়ে গেলে মিনা হতে আরাফার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবে। অতঃপর সহজসাধ্য হলে মাথার উপর থেকে সূর্য ঢলা পর্যন্ত নামেরাহ নামক স্থানে অবতরণ করবে। আর যদি কষ্টের কারণ হয় তাহলে কোন গোনাহ নেই। কারণ নামেরায় অবস্থান করা সুন্নাত, ইহা ওয়াজিব নয়। তারপর সূর্য ঢলে পড়লে যুহর ও আসর সলাত অগ্রিম একত্রিত (জমা তাকদীম) করে দুই দুই রাক’আত আদায় করবে, যেমন নাবী (সা.) আদায় করেছিলেন।
তাই জাবির (রা.) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন: আল্লাহর রসূল (সা.) নামেরাহ্ নামক স্থানে উনার তাঁবু লাগাতে বললেন। অতঃপর তিনি আরাফায় পৌঁছিলে দেখেন যে, তাঁর জন্য নামেরায় তাঁবু লাগানো হয়েছে, তখন সেখানে অবতরণ করলেন। তারপর সূর্য ঢলে গেলে ‘কাসওয়া’ নামক উষ্ট্রীকে প্রস্ত্তত করতে বললেন, অতঃপর তার পীঠে চেপে আরাফার উপত্যকায় আগমন করলেন এবং সেখানে খুতবা প্রদান করলেন। তারপর আযান ও ইকামাত দিয়ে প্রথমে যুহর সলাত আদায় করলেন, তারপরে ইকামাত দিয়ে আসর সলাত আদায় করলেন। এ দু’সলাতের মাঝে কোন সুন্নাত পড়লেন না। তারপর বাহনে চেপে আরাফার অবস্থানস্থলে আসেন এবং সেখানে কাসওয়া নামক উষ্ট্রীকে বসিয়ে দিয়ে তার পেট পাথর সমূহের (জাবালুর রাহমাহ্) দিকে করে দেন। আর পদচারীদের পাহাড়কে সামনে রেখে কিবলামূখী হোন এবং সূর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করে দু‘আ করতে থাকেন।[1]
আর (হাজ্জের অবস্থায়) কসর করে এবং দু’সলাতকে একত্রিত করে আদায় করার বিধান মক্কাবাসী ও অন্যান্য সমস্ত হাজীদের জন্য।
আর দু’ওয়াক্ত সলাত জমা’ তাকদীম (অগ্রীম একত্রিত) করার বিধানের রহস্য হচ্ছে, যেন হাজীগণ নিজ নিজ ইমামের সাথে সলাত আদায় করে নিয়ে নিজ নিজ স্থানে ফিরে গিয়ে দু‘আর জন্য অবসর হয়ে যেতে পারেন।
কারণ, হাজীদের জন্য সুন্নাত হল যে, তাঁরা আরাফার দিনের শেষ ভাগে দু‘আ, যিকির ও তিলাওয়াতের জন্য অবসর হয়ে যাবেন।
আর নাবী (সা.) থেকে হাদীসে বর্ণিত দু‘আ ও যিকির করার জন্য আগ্রহী হবেন। কারণ, সেগুলি হচ্ছে ব্যাপক অর্থবোধক এবং অধিক উপকারী দু‘আ। যেমন নিম্নের দু’আগুলি (যা বিভিন্ন হাদীস দ্বারা প্রমাণিত) পাঠ করবে:
اللَّهُمّ َاجْعَلْ فِيْ قَلْبِيْ نُوْراً، وَفي سَمْعِيْ نُوْراً وَفي بَصَرِيْ نُوْراً
[আল্লাহুম্মা-জ্আ’ল ফী ক্বালবী নূরা, ওয়া ফী সাম্ঈ নূরা, ওয়া ফী বাসারী নূরা]
হে আল্লাহ্ ! আমার হৃদয়ে জ্যোতি দান কর, আমার শ্রবণশক্তিতে জ্যোতি দান কর এবং আমার দৃষ্টিশক্তিতে জ্যোতি দান কর।[2]
(اللَّهُمّ رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الآخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ)
[আল্লাহুম্মা রাব্বানা আ-তিনা ফিদ্দুনয়্যা হাসানাতান ওয়া ফিল আখিরাতি হাসানাতান ওয়া কিবনা আযাবান্ নার]
হে আল্লাহ্ আমাদের প্রতিপালক! দুনিয়াতে আমাদেরকে কল্যাণ দান কর, আখিরাতেও আমাদেরকে কল্যাণ দান কর এবং আমাদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা কর।[3]
(اللَّهُمّ إنِّيْ أَعُوْذُ بِكَ مِنْ جَهْدِ الْبَلَاءِ، وَمِنْ دَرَكِ الشِّقَاءِ، وَمِنْ سُوْءِ الْقَضَاءِ، وَمِنْ شَمَاتَةِ الْأعْدَاءِ)
[আল্লাহুম্মা ইন্নী আউযু বিকা মিন জাহদিল বালা-ই ওয়া মিন দারাকিশ্ শিকা-ই, ওয়া মিন সুইল কাযা-ই। ওয়া মিন শামাতাতিল আ‘দা-ই]
হে আল্লাহ্ ! আমি তোমার আশ্রয় গ্রহণ করছি বিপদ-আপদের কষ্ট হতে, দুর্ভাগ্য হওয়া থেকে, মন্দ ফায়সালা হতে এবং শত্রুদের খুশী হওয়া থেকে।[4]
اللَّهُمّ إنِّيْ أَعُوْذُ بِكَ مِنَ الْهَمِّ وَالْحَزَنِ، وَالْعَجْزِ وَالْكَسَلِ، وَالْجُبُنِ وَالْبُخْلِ، وَضَلَعِ الدَّيْنِ وَغَلَبَةِ الرِّجَالِ
[আল্লাহুম্মা ইন্নী আউযু বিকা মিনাল হাম্মি ওয়াল হাযানি, ওয়াল আজযি ওয়াল কাসালি, ওয়াল জুবনি ওয়াল বুখ্লি, ওয়া যাল্ইদ্ দায়নি ওয়া গালাবাতির্ রিজাল।]
হে আল্লাহ্! আমি তোমার আশ্রয় গ্রহণ করছি দুশ্চিন্তা থেকে, শোক থেকে, অপারগ হওয়া থেকে, অলসতা থেকে, কাপুরুষতা থেকে, কৃপণতা থেকে, ঋণের বোঝা থেকে এবং মানুষের আধিপত্য থেকে।[5]
اللَّهُمّ إِنِّيْ أَعُوْذُ بِكَ مِنَ الْمَأْثَمِ وَالْمَغْرَمِ، وَمِنْ شَرِّ فِتْنَةِ الْغِنَى، وَأَعُوْذُ بِكَ مِنْ فِتْنَةِ الْفَقْرِ
[আল্লাহুম্মা ইন্নী আউযু বিকা মিনাল্ মা’সামি ওয়াল মাগরাম, ওয়া মিন শাররি ফিতনাতিল গিনা, ওয়া আউযু বিকা মিন ফিতনাতিল ফাকরি]
হে আল্লাহ্! আমি তোমার আশ্রয় গ্রহণ করছি গুনাহ থেকে, ঋণ থেকে এবং সচ্ছলতার ফিতনার অনিষ্ট থেকে, আরো তোমার আশ্রয় গ্রহণ করছি দারিদ্রের ফিতনা থেকে।[6]
اللَّهُمّ اغْسِلْ عَنِّيْ خَطَايَايَ بِمَاءِ الثَّلْجِ وَالْبَرَدِ، وَنَقِّ قَلْبِيْ مِنَ الْخَطَايَا كَمَا نَقَّيْتَ الثَّوْبَ الْأَبْيَضَ مِنَ الدَّنَسِ، وَبَاعِدْ بَيْنِيْ وَبَيْنَ خَطَايَايَ كَمَا بَاعَدْتَّ بَيْنَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ
[আল্লাহুম্মা-গসিল্ আন্নী খাত্বায়্যায়া বি মা-ইস্ সালজি ওয়াল বারাদ। ওয়া নাক্বি কালবী মিনাল্ খাত্বায়্যা কামা নাক্বায়্তাস্ সাওবাল্ আবয়্যাযা মিনাদ্ দানাস, ওয়া বা-ইদ বায়্নী ওয়া বায়্না খাত্বায়্যায়া কামা বা-আদতা বায়্নাল মাশরিক্বি ওয়াল মাগরিব]
হে আল্লাহ্ ! আমার গুনাহসমূহ বরফ ও সীলাবৃষ্টির পানি দ্বারা ধুয়ে দাও। আর আমার হৃদয়কে গুনাহসমূহ থেকে পরিস্কার করে দাও, যেমন তুমি সাদা কাপড়কে ময়লা-আবর্জনা থেকে পরিস্কার করে থাক। আর আমার মাঝে এবং আমার গুনাহসমূহের মাঝে দূরত্ব তৈরি কর যেমন তুমি দূরত্ব করেছ পূর্ব ও পশ্চিমের মাঝে।[7]
আরাফার দিনের দু‘আ হচ্ছে সর্বাধিক উত্তম দু‘আ। নাবী (সা.) বলেছেন:
خَيْرُ الدُّعَاءِ دُعَاءُ يَوْمِ عَرَفَةَ وَخَيْرُ مَا قُلْتُ أَنَا وَالنَّبِيُّونَ مِنْ قَبْلِي لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
সর্বশ্রেষ্ঠ দু‘আ হলো আরাফার দু‘আ। আর সর্বশ্রেষ্ঠ দু‘আ যা আমি বলেছি এবং আমার পূর্বের নাবীরা বলেছেন, তা হলো:
لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
[লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহ্দাহু, লা শারীকা লাহু, লাহুল মুলকু, ওয়া লাহুল হাম্দু, ওয়া হুওয়া আলা কুল্লি শাইয়িন ক্বাদীর]
আল্লাহ্ ব্যতীত সত্য কোন উপাস্য নেই। তিনি এক তাঁর কোন শরীক নেই। রাজত্ব তাঁরই এবং প্রশংসা মাত্রই তাঁর। তিনি সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান।[8]
- আর যদি রসূল (সা.) থেকে বর্ণিত (দু‘আ মাসূরাহ্) কারো না জানা থাকে তাহলে যে কোন বৈধ দু‘আ নিজ ভাষায় করবে।
- অতঃপর যদি ক্লান্তি বোধ হয় তাহলে নিজ সাথী-সঙ্গীদের সাথে লাভজনক কথা-বার্তা, একে অপরকে কু্রআন শুনানো অথবা যে কোন উপকারী বই-পুস্তক পাঠ করা, বিশেষ করে মহান আল্লাহর অনুগ্রহ ও অশেষ দানের কথা আলোচনা করা; যাতে করে আজকের দিনে আল্লাহর নিকট আশার দিকটা মযবুত হয়, এসব কাজ ভাল।
- আবার কিছুক্ষণ পরে আল্লাহর নিকট একগ্রচিত্তে কান্না করে দু‘আ করায় ফিরে আসবে। আর বিশেষ করে এই দিনের শেষভাগে দু‘আ করায় অধিক মনোযোগী হবে।
- আর দু‘আর অবস্থায় কিবলামুখী হওয়া উচিত, যদিও পাহাড় পিছনে হোক কিংবা ডানে হোক বা বামে। কারণ কিবলামুখী হওয়া সুন্নাত।
- অনুরূপ দুই হাত তুলে দু‘আ করবে। তবে যদি কোন একটি হাত উঠাতে বাধা থাকে তাহলে একটি হাত তুলে দু‘আ করবে। কেননা উসামা বিন যায়দ (রা.) থেকে বর্ণিত হাদীসে রয়েছে, তিনি বলেন, আমি আরাফায় নাবী (সা.) এর বাহনের পিছনে বসা ছিলাম, তখন তিনি (সা.) উভয় হাত উত্তোলন করে দু‘আ করছিলেন। হঠাৎ করে তাঁর উষ্ট্রি কাত হয়ে গেলে তার লাগামের রশীটি পড়ে যায়, তখন তিনি এক হাতে রশীটি উঠিয়ে নেন এবং অপর হাতটি উঠিয়ে দু‘আ করতে থাকেন।[9]
আর দু‘আই মহান আল্লাহর নিকটে নিজ প্রয়োজন ও শোচনীয়তা প্রকাশ করবে এবং বার-বার করে একগ্রচিত্তে দু‘আ করবে। আর দু‘আ কবুল হওয়ার ব্যাপারে তাড়া-হোঁড়া করবে না এবং দু‘আয় সীমা লঙ্ঘনও করবে না। যেমন, এমন কিছু চাওয়া যা ইসলামী শরিয়তে জায়েয নয় অথবা সৃষ্টিগতভাবে যা সম্ভব নয়। কারণ, আল্লাহ তা’আলা বলেন:
(ادْعُواْ رَبَّكُمْ تَضَرُّعاً وَخُفْيَةً إِنَّهُ لاَ يُحِبُّ الْمُعْتَدِينَ )الأعراف55
তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে বিনয়ের সঙ্গে এবং গোপনে আহবান কর, তিনি সীমালঙ্ঘনকারীদেরকে পছন্দ করেন না।[10]
আর হারাম ভক্ষণ থেকে বেঁচে থাকবে। কারণ, ইহা দু‘আ কবুল হওয়ার সর্বাধিক বড় বাধা। আবূ হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত আছে, নাবী (সা.) বলেছেন:
(أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّ اللَّهَ طَيِّبٌ لَا يَقْبَلُ إِلَّا طَيِّبًا وَإِنَّ اللَّهَ أَمَرَ الْمُؤْمِنِينَ بِمَا أَمَرَ بِهِ الْمُرْسَلِينَ فَقَالَ: (يَا أَيُّهَا الرُّسُلُ كُلُوا مِنْ الطَّيِّبَاتِ وَاعْمَلُوا صَالِحًا إِنِّي بِمَا تَعْمَلُونَ عَلِيمٌ) وَقَالَ: (يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُلُوا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ) ثُمَّ ذَكَرَ الرَّجُلَ يُطِيلُ السَّفَرَ أَشْعَثَ أَغْبَرَ يَمُدُّ يَدَيْهِ إِلَى السَّمَاءِ يَا رَبِّ يَا رَبِّ وَمَطْعَمُهُ حَرَامٌ وَمَشْرَبُهُ حَرَامٌ وَمَلْبَسُهُ حَرَامٌ وَغُذِيَ بِالْحَرَامِ فَأَنَّى يُسْتَجَابُ لِذَلِكَ)
হে লোকেরা! নিশ্চয়ই আল্লাহ্ পবিত্র, তিনি পবিত্র ছাড়া অন্য কিছু গ্রহণ করনে না। আর তিনি মু’মিনদের তাই নির্দেশ দিয়েছেন যা রসূলগণকে নির্দেশ দিয়েছেন; তাই তিনি ইরশাদ করেছেন: হে রসূলগণ ! তোমরা পবিত্র বস্ত্ত আহার কর, আর সৎ কাজ কর, তোমরা যা কর সে সম্পর্কে আমি পূর্ণরূপে অবগত। (সূরাহ্ মু’মিনূনঃ ৫১) আর আল্লাহ তা’আলা মু’মিনদেরকে বলেন: হে মু’মিনগণ! আমার দেয়া পবিত্র বস্ত্তগুলি খেতে থাক [সূরা বাক্বারা ২ঃ ১৭২]। "তারপর রসূল (সা.) এমন ব্যক্তির কথা আলোচনা করলেন, যে দীর্ঘ সময় ধরে সফর করে, তার মাথার চুল বিক্ষিপ্ত এবং ধুলো ধুসরিত, সে নিজ হস্তদ্বয় আকাশের দিকে উঠিয়ে দু‘আ করে আর বার-বার করে বলে, হে আমার প্রতিপালক! হে আমার প্রতিপালক! অথচ তার খাদ্যবস্ত্ত হারাম, তার পানীয় হারাম, তার পোষাক হারাম এবং তার আহারও হারাম,। এ অবস্থায় তার দু‘আ কেমন করে কাবুল হবে?"[11]
তাহলে নাবী (সা.) এমন ব্যক্তি দু‘আ কবুল হওয়াকে অসম্ভব মনে করলেন যার আহার ও বস্ত্র হারাম, অথচ তার দু‘আ কাবূল হওয়ার অন্যান্য কারণগুলি বিদ্যমান ছিল। (যা উক্ত হাদীসে নাবী (সা.) উল্লেখ করেছেন।) এর একমাত্র কারণ হচ্ছে হারাম বস্ত্ত ভক্ষণ করা।
আর যেখানে নাবী (সা.) আরাফায় অবস্থান করেছিলেন সেখানে অবস্থান করা সহজসাধ্য হলে তা উত্তম। তা না হলে আরাফার যেখানে অবস্থান করা সহজসাধ্য হবে সেখানে অবস্থান করবে। কেননা জাবির (রা.) হতে বর্ণিত, নাবী (সা.) বলেন:
نَحَرْتُ هَاهُنَا وَمِنًى كُلُّهَا مَنْحَرٌ فَانْحَرُوا فِي رِحَالِكُمْ وَوَقَفْتُ هَاهُنَا وَعَرَفَةُ كُلُّهَا مَوْقِفٌ وَوَقَفْتُ هَاهُنَا وَجَمْعٌ كُلُّهَا مَوْقِفٌ
আমি এখানে কুরবানী করলাম, তবে মিনার সব জায়গায় হচ্ছে কুরবানীর স্থান। সুতরাং তোমরা নিজ নিজ অবস্থান স্থলে কুরবানী কর। আর আমি এখানে (আরাফায়) অবস্থান করলাম। তবে আরাফার সব জায়গায় হচ্ছে অবস্থান স্থল। আর আমি (মুযদালিফায়) এখানে অবস্থান করলাম। তবে মুযদালিফার সব জায়গায় হচ্ছে অবস্থান স্থল।[12]
আর আরাফায় অবস্থানকারীর (হাজীর) জন্য তার সীমানা সম্পর্কে নিশ্চিৎ হওয়া আবশ্যক। আরাফার চতুর্দিকের সীমানায় বেশ কিছু চিহ্ন দেয়া আছে যা সন্ধান করলে সহজেই পেয়ে যাবে। কারণ, অনেক হাজীরা এ ব্যাপারে অবহেলা করে, ফলে তারা অজ্ঞতা বশতঃ এবং অন্ধ অনুকরণের কারণে আরাফার সীমানার বাইরে অবস্থান করে। মনে রাখবে যে, যারা আরাফার সীমানার বাইরে অবস্থান করবে তাদের হাজ্জ হবে না। কারণ, হাজ্জ হচ্ছে আরাফায় অবস্থানের নাম।
যার দলীল আব্দুল্লাহ বিন ইয়া‘মুর বর্ণিত হাদীস; তিনি বলেন, নাজদের অধিবাসী কতিপয় লোকেরা আল্লাহর রাসূল (সা.) এর নিকট তাঁর আরাফায় অবস্থানকালে এসে তাঁকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। তখন তিনি একজন ঘোষনাকারীকে একথা ঘোষনা করে দেয়ার জন্য নির্দেশ দেন:
الْحَجُّ عَرَفَةُ مَنْ جَاءَ لَيْلَةَ جَمْعٍ قَبْلَ طُلُوعِ الْفَجْرِ فَقَدْ أَدْرَكَ الْحَجَّ أَيَّامُ مِنًى ثَلَاثَةٌ فَمَنْ تَعَجَّلَ فِي يَوْمَيْنِ فَلَا إِثْمَ عَلَيْهِ وَمَنْ تَأَخَّرَ فَلَا إِثْمَ عَلَيْهِ
হাজ্জ হচ্ছে আরাফায় অবস্থানের নাম। সুতরাং যে ব্যক্তি মুযদালিফার রাত্রে ফজর হওয়ার পূর্বে (আরাফায়) এসে পৌঁছাবে সে হাজ্জ পেয়ে গেল। মিনায় অবস্থানের দিন হচ্ছে তিন দিন। তবে যে ব্যক্তি দুই দিনে তাড়াতাড়ি করবে তার কোন গোনাহ্ নেই। আর যে (তিন দিন পর্যন্ত) বিলম্ব করবে তারও কোন গোনাহ্ নেই।[13]
তাই আরাফার সীমানা সম্পর্কে হাজীদের সজাগ থাকা আবশ্যক, যাতে করে তার সীমানার ভিতরে আছে কি না এ বিষয়ে নিশ্চিৎ হয়ে যায়।
আর যারা আরাফায় দিনে অবস্থান করবে তাদের সেখানে সূর্য অস্ত হওয়া পর্যন্ত অবস্থান করা ওয়াজিব। কারণ, নাবী (সা.) সূর্য অস্ত হওয়া পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করেছেন এবং তিনি একথার নির্দেশ দিয়েছেন:
لِتَأْخُذُوا عَنِّيْ مَنَاسِكَكُم
তোমরা আমার নিকট হতে তোমাদের হাজ্জ ও উমরার বিধি-বিধান গ্রহণ কর।[14]
আর একারণে যে, সূর্য অস্ত যাওয়ার পূর্বে আরাফা থেকে প্রস্থান করা জাহিলী যুগের প্রথা ছিল, ইসলামে যার বিরোধিতা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তবে আরাফায় অবস্থানের শেষ সময় হচ্ছে ঈদুল আয্হার দিন ফজর হওয়া পর্যন্ত।
কারণ, নাবী (সা.) বলেছেন:
(مَنْ جَاءَ لَيْلَةَ جَمْعٍ قَبْلَ طُلُوعِ الْفَجْرِ فَقَدْ أَدْرَكَ الْحَجَّ)
যে ব্যক্তি মুযদালিফার রাত্রে ফজর হওয়ার পূর্বে (আরাফায়) এসে পৌঁছাবে সে হাজ্জ পেয়ে যাবে।[15]
অতএব কোন ব্যক্তির আরাফায় অবস্থানের পূর্বেই যদি ফজর হয়ে যায় তাহলে তার হাজ্জ ছুটে যাবে। সুতরাং এ ব্যক্তি যদি তার ইহরামের শুরুতে এ বলে শর্ত করে থাকে যে, "হে আল্লাহ! যদি আমাকে কোন কিছু হাজ্জ সম্পূর্ণ করতে বাধা প্রদান করে, তাহলে আমি সেখানেই হালাল হয়ে যাব" তাহলে সে নিজ ইহরাম থেকে হালাল হয়ে যাবে, তাতে তার প্রতি কোন দাম (কুরবানী) ওয়াজিব হবে না।
আর যদি কোন শর্ত না করে থাকে তাহলে সে মক্কাহ্ গিয়ে কা‘বা ঘরের তাওয়াফ ও সাফা মারওয়ার সাঈ এবং মাথা মুণ্ডনের মাধ্যমে উমরাহ্ করে হালাল হয়ে যাবে। তার সঙ্গে যদি হাদীর (কুরবানী) পশু থাকে তবে তাকে যবহ করে দিবে, অতঃপর আগামি বছর তার ছুটে যাওয়া হাজ্জের কাযা করবে এবং কুরবানী করবে। আর যদি কুরবানী করতে না পারে তাহলে দশটি সিয়াম পালন করবে। তার মধ্যে তিনটি সিয়াম হাজ্জের সফরেই এবং সাতটি নিজ পরিবারে ফিরে আসার পরে রাখবে।[16]
[2]. সহীহ মুসলিম ৭৬৩।
[3]. সূরা বাক্বারা আয়াত নং ২০১, সহীহ বুখারী ৪৫২২
[4]. সহীহ বুখারী ৬৬১৬।
[5]. সহীহ বুখারী ২৮৯৩।
[6]. সহীহ বুখারী ৬৩৬৮।
[7]. সহীহ বুখারী ৬৩৬৮, সহীহ মুসলিম ৫৮৯।
[8]. তিরমিযী ৩৫৮৫, হাদীসটি হাসান।
[9]. সহীহ: নাসাঈ ৩০১১।
[10]. সূরাহ্ আল-আ‘রাফঃ ৫৫
[11]. সহীহ মুসলিম ১০১৫।
[12]. সহীহ মুসলিম ১২১৮।
[13]. সহীহ: তিরিমিযী ৮৮৯, নাসাঈ ৩০৪৪, সহীহ ইবনে খুযাইমাহ ২৮২২।
[14]. সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম ১২৯৭
[15]. আহমাদ, আবূ দাউদ, নাসাঈ, তিরিমিযী ও ইবনু মাজাহ
[16]. সূরা বাকারা ২:১৯৬।
৯ যিলহাজ্জ সূর্য অস্তমিত হওয়ার পরে আরাফায় অবস্থানকারী হাজী মুযদালিফার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবে। অতঃপর সেখানে মাগরিব ও ইশা (জমা তা’খীর) বিলম্বে একত্রিত করে আদায় করবে। মাগরিব তিন রাকা‘আত এবং ইশা দুই রাকা‘আত কসর করে আদায় করবে।
উসামাহ্ বিন যায়দ (রা.) থেকে বর্ণিত হাদীস, তিনি বলেন, নাবী (সা.) আরাফা হতে (মুযদালিফার উদ্দেশ্যে) রওয়ানা হলেন, অতঃপর এক ঘাঁটিতে নেমে পেশাব করলেন তারপর মুখ হাত ধৌত করলেন। তখন আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! সলাত আদায় করবেন না? তিনি বললেন, সলাত আরো সামনে গিয়ে আদায় করব।[1]
অতঃপর মুযদালিফা এসে পূর্ণরূপে উযূ করলেন তারপর সলাতের ইকামাত দেয়া হলে মাগরিবের সলাত আদায় করেন। তারপর প্রত্যেকে নিজ নিজ সাওয়ারীর উঁট তাঁবুর নিকটেই বসিয়ে দিল অতঃপর ইশার ইকামাত দেয়া হলে সলাত আদায় করেন।[2]
তাই হাজীর জন্য মুযদালিফায় গিয়ে মাগরিব ও ইশার সলাত আদায় করা সুন্নাত। তবে অর্ধেক রাত অতিবাহিত হয়ে ইশার সময় পার হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা হলে সময় শেষ হওয়ার পূর্বে পথে যে কোন স্থানে সলাত আদায় করে নেয়া ওয়াজিব। তারপর মুযদালিফায় রাত যাপণ করবে কিন্তু সেখানে নফল সলাত বা অন্য কোন আমলের মাধ্যমে রাত জাগরণ করবে না। কারণ, নাবী (সা.) এখানে তা করেননি।
আব্দুল্লাহ বিন উমার (রা.) হতে বর্ণিত, নাবী (সা.) মুযদালিফায় মাগরিব ও ইশার সলাত একত্রিত করেছেন। তবে এ দুই সলাতের মাঝে বা পরে কোন সুন্নাত সলাত আদায় করেননি।[3]
আর জাবির (রা.) হতে বর্ণিত রয়েছে যে, নাবী (সা.) মুযদালিফায় এসে সেখানে এক আযান এবং দুই ইকামাতে মাগরিব ও ইশার সলাত আদায় করলেন। তবে এর মাঝে কোন সুন্নাত বা নফল পড়লেন না। তারপর ফজর হওয়া পর্যন্ত শুয়ে রইলেন।[4]
আর দুর্বল পুরুষ ও নারীদের জন্য রাতের শেষভাগে মুযদালিফা থেকে প্রস্থান করা জায়েয। কারণ ইবনু আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূল (সা.) আমাকে তাঁর পরিবারের দুর্বল সদস্যদের সঙ্গে মুযদালিফা থেকে ভোর রাত্রেই পঠিয়ে দেন।[5]
আর আব্দুল্লাহ বিন উমার (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি নিজ পরিবারের দুর্বলদের সময়ের পূর্বেই পাঠিয়ে দিতেন। অতঃপর মাশআরুল হারামের নিকট (মুযদালিফা) রাত্রে অবস্থান করতেন এবং সেখানে যথাসাধ্য মহান আল্লাহর যিকির ও দু‘আ করতেন। অতঃপর সেখান থেকে (শেষ রাত্রে) রওয়ানা হয়ে যেতেন। যার ফলে কেউ কেউ ফজরের সলাতেই মিনা পৌঁছে যেতেন, আবার কেউ তার কিছু পরে পৌঁছাতেন। তারা মিনা পৌঁছে (বড়) জামরায় কংকর নিক্ষেপ করে নিতেন।[6]
আর আব্দুল্লাহ বিন উমার (রা.) বলতেন এধরণের দুর্বলদের ক্ষেত্রে আল্লাহর রসূল (সা.) ছাড় দিয়েছেন।[7] তবে যারা দুর্বলও নয় এবং দুর্বলের সঙ্গীও নয় তারা রসূল (সা.) এর সুন্নাত মুতাবেক ফজর সলাত আদায় করা পর্যন্ত মুযদলিফায় অবস্থান করবে।
আর আয়িশা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল (সা.) এর নিকট সাওদাহ্ (রা.) মুযদালিফার রাতে লোকজনের ভীড় থেকে বাঁচার জন্য নাবী (সা.) এর রওনা হওয়ার আগেই মিনা চলে যাওয়ার অনুমতি চাইলেন, কারণ, তিনি মোটা মানুষ ছিলেন। তখন নাবী (সা.) তাঁকে অনুমতি দিয়ে দেন। আর আমরা সকাল পর্যন্ত মুযদালিফাতেই থেকে গেলাম, অতঃপর নবী (সা.) এর সঙ্গে মিনার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। তবে আমি যদি সাওদাহ্ (রা.)-এর মতই আল্লাহর রাসূল (সা.) এর নিকট অনুমতি নিয়ে রাত্রেই মিনা চলে যেতাম তাহলে তা যে কোন খুশীর চাইতে প্রিয় হত।[8]
অপর একটি বর্ণনায় আছে, সাওদাহ্ (রা.) যেমন নাবী (সা.) এর নিকট অনুমতি নিয়ে রাত্রেই মিনা চলে গিয়েছিলেন তাঁর মত আমিও যদি তাঁর নিকট অনুমতি নিয়ে চলে যেতাম তা কতই না ভাল হত।[9]
অতঃপর ফজর সলাত সমাপ্ত হলে মাশ‘আরে হারামে এসে ক্বিবলামুখী হয়ে আল্লাহর একত্ব ঘোষণা করবে, তাকবীর পাঠ করবে, কালিমা তাওহীদ পাঠ করবে এবং পূর্ব আকাশ ফর্সা হওয়া পর্যন্ত নিজ পছন্দ মত দু‘আ করতে থাকবে। তবে যদি কেউ মাশ‘আরে হারামে যেতে না পারে তাহলে নিজ স্থানেই দু‘আ করতে থাকবে। কারণ, নাবী (সা.) বলেছেন:
وَوَقَفْتُ هَاهُنَا وَجَمْعٌ كُلُّهَا مَوْقِفٌ
আর আমি (মুযদালিফায়) এখানে অবস্থান করলাম। তবে মুযদালিফার সব জায়গায় হচ্ছে অবস্থান স্থল।[10]
[2]. সহীহ বুখারী ১৬৭২
[3]. সহীহ বুখারী ১৬৭৩
[4]. সহীহ মুসলিম ১২১৮
[5]. সহীহ মুসলিম ১২৯৩
[6]. সহীহ বুখারী ১৬৭৬
[7]. সহীহ বুখারী ১৬৭৬
[8]. সহীহ মুসলিম ১২৯০।
[9]. সহীহ মুসলিম ১২৯০।
[10]. মুসনাদে আহমাদ ও সহীহ মুসলিম ১২১৮।
মুযদালিফায় অবস্থানকারী হাজীগণ দু‘আ ও যিকির সম্পূর্ণ করে সূর্য উদয় হওয়ার পূবেই মিনার উদ্দেশ্যে রওনা হবে। অতঃপর মিনা পৌঁছে নিম্নে উল্লিখিত কাজগুলি সম্পাদন করবে:
১। জামরা আকাবায় কংকর মারা অর্থাৎ বড় জামরায় যা মক্কার পথে মিনার শেষ দিকে অবস্থিত, কংকর নিক্ষেপ করা।
সুতরাং মুযদালিফা থেকে মিনা যাওয়ার পথে যে কোন স্থান থেকে সাতটি ছোলা দানার চাইতে সামান্য বড় ছোট ছোট কংকর কুড়িয়ে নিবে। অতঃপর এক একটি করে পাথর জামরায় নিক্ষেপ করবে। আর সম্ভব হলে কা‘বা ঘরকে বামে এবং মিনাকে ডানে রেখে বাতনুল ওয়াদী (উপত্যকার মধ্যভাগ) থেকে কংকর নিক্ষেপ করবে।
কারণ, আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বড় জামরায় পৌঁছে বায়তুল্লাহকে বামে এবং মিনাকে ডানে রেখে সাতটি কংকর নিক্ষেপ করলেন। এবং তিনি বললেন, এইভাবে সেই নাবী (সা.) কংকর নিক্ষেপ করেছেন যার প্রতি সূরাহ্ বাক্কারা নাযিল হয়েছে।[1]
আর প্রত্যেকটি কংকর নিক্ষেপের সময় “আল্লাহু আকবার” বলবে।[2] আর মনে রাখবেন যে, বড় পাথর, জুতো, স্যান্ডেল এবং এধরণের বস্ত্ত দ্বারা জামরায় রামী (নিক্ষেপ) করা জায়েয নয়।
আর মহান আল্লাহর মহত্ত্ব ঘোষণার (তাকবীর) সাথে বিনয়ী ও শান্ত হয়ে কংকর নিক্ষেপ করবে। অনেক মূর্খরা যেমন হৈ হুল্লুড় ও গালী-গালাজ করে তাদের মত করবে না। কেননা জামরায় কংকর নিক্ষেপ করা আল্লাহর নিদর্শনসমূহের অমর্ত্মভূক্ত। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন:
ذَلِكَ وَمَن يُعَظِّمْ شَعَائِرَ اللَّهِ فَإِنَّهَا مِن تَقْوَى الْقُلُوبِ
যে কেউ আল্লাহর নিদর্শনগুলোকে সম্মান করবে সে তো তার অন্তরস্থিত আল্লাহ-ভীতি থেকেই তা করবে।[3]
আর হাদীসে নাবী (সা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন:
إِنَّمَا جُعِلَ الطَّوَافُ بِالْبَيْتِ وَبَيْنَ الصَّفَا وَالْمَرْوَةِ وَرَمْيُ الْجِمَارِ لِإِقَامَةِ ذِكْرِ اللَّهِ
নিশ্চয়ই বায়তুল্লাহর তাওয়াফ, সাফা ও মারওয়ার সাঈ এবং জামরাগুলিতে কংকর নিক্ষেপ করা আল্লাহর যিকির (স্মরণ) প্রতিষ্ঠার উদ্দেশে বিধি-বদ্ধ করা হয়েছে।[4]
আর জামরার উদ্দেশে শক্তি প্রদশন করে ঝাপিয়ে আসবে না, কেননা ইহাতে মুসলিম ভাইদের কষ্ট দেয়া হবে অথবা ক্ষতি সাধন হবে।
২। কুরবানী করা। দশ তারীখে জামরায় কংকর নিক্ষেপ করার পর সঙ্গে হাদী (কুরবানীর পশু) থাকলে তা যবহ করবে, তা না হলে ক্রয় করে তা যবহ করবে। এর পূর্বে হাদীর আবশ্যক ধরণ, গুণাবলী, কুরবানীর পশু যবহ করার স্থান ও সময় এবং তা যবহ করার নিয়মাবলী বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে। অতএব তা দেখে নিন।
৩। মাথা মুণ্ডন বা চুল ছোট করা। হাদী যবহ করার পর পুরুষ ব্যক্তি নিজ মাথা মুণ্ডন করবে কিংবা চুল ছোট করবে। তবে মাথা নেড়া করাই উত্তম।
এর প্রথম দলীল এই যে, মহান আল্লাহ এই আয়াতে প্রথম মাথা মুণ্ডনের বিষয়টি উল্লেখ করেছেন:
(مُحَلِّقِينَ رُؤُوسَكُمْ وَمُقَصِّرِينَ )الفتح27
তোমাদের মস্তক মুণ্ডিত অবস্থায় ও চুল কেটে।[5]
মাথা মুণ্ডন উত্তম হওয়ার দ্বিতীয় দলীল নাবী (সা.)-এর পুরো মাথার চুল মুণ্ডন করা।
যেমন আনাস বিন মালিক (রা.) হতে বর্ণিত, নাবী (সা.) মিনা এসে জামরায় কংকর নিক্ষেপ করলেন। অতঃপর মিনায় নিজ তাঁবুতে এসে কুরবানী করলেন, তারপর নাপিতকে বললেন, নাও মাথা মুণ্ডন কর। এবলে মাথার ডান দিকে ইংগিত করলেন। অতঃপর বাম দিক থেকে মুণ্ডন করতে বললেন। তারপর লোকদের মাঝে নিজ মুবারাক চুল বিতরণ করে দিলেন।[6]
মাথা মুণ্ডন উত্তম হওয়ার তৃতীয় দলীল এই যে, নাবী (সা.) মাথা মুণ্ডনকারীদের জন্যে আল্লাহর রহমাত ও ক্ষমার তিনবার করে দুআ করেছেন এবং চুল ছোটকারীদের জন্যে একবার দুআ করেছেন।[7]
আরো একটি যুক্তি হচ্ছে যে, মাথা মুণ্ডনে মহান আল্লাহর অধিক তা’যীম (মহত্ত্ব প্রকাশ) রয়েছে। কেননা তাতে মাথার সমস্ত চুল আল্লাহর জন্য ফেলা হয়। আর মাথা মু-ণ বা চুল খাটো করা পুরো মাথার হবে। কারণ, আল্লাহ তা’আলা বলেছেন:
مُحَلِّقِينَ رُؤُوسَكُمْ وَمُقَصِّرِينَ
তোমাদের মস্তক মুণ্ডিত অবস্থায় ও চুল কেটে। আর যে ক্রিয়া মাথার সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে তা পুরো মাথাকে শামিল। আর মাথার কিছু অংশ বাদ দিয়ে কিছু অংশ মুণ্ডন করা ইসলামী বিধানে নিষিদ্ধ।
যার প্রমাণ সহীহ বুখারী ও মুসলিমে তাবেঈ নাফি’ বর্ণনা করেন আব্দুল্লাহ বিন উমার (রা.) হতে যে, নাবী (সা.) ‘কায‘আ’ হতে নিষেধ করেছেন। তখন নাফি’ (রহঃ)-কে কায‘আর ব্যাখ্যা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, মাথার কিছু অংশ বাদ দিয়ে কিছু অংশ মুণ্ডন করা। তাহলে কোন না জায়েয কাজ দিয়ে আল্লাহর নৈকট্য লাভ হয় না। আর নাবী (সা.) মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পুরো মাথার মুণ্ডন করেছেন। এবং তিনি বলেছেন:
لِتَأْخُذُوا عَنِّيْ مَنَاسِكَكُم
তোমরা আমার নিকট হতে তোমাদের হাজ্জ ও উমরার বিধি-বিধান গ্রহণ কর।[8]
তবে মহিলা নিজ চুলের শেষভাগ থেকে আঙ্গুলের অগ্রভাগ সমান ছোট করবে।
উপরোক্ত কাজগুলি সম্পাদন করা হলেই স্ত্রী সম্ভোগ ছাড়া ইহরামের সমস্ত নিষিদ্ধ কাজগুলি হালাল হয়ে যায়। অতএব এর পরে হাজীর জন্য সুগন্ধি ব্যবহার করা, সেলাইকৃত কাপড় পরিধান করা, চুল কাটা, নখ কাটা ও অন্যান্য নিষিদ্ধ কাজগুলি হালাল হয়ে যাবে। আর এই প্রাথমিক হালাল হওয়ার পরে সুগন্ধি লাগানো সুন্নাত।
কারণ, আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নাবী (সা.)-কে তাঁর ইহরাম করার পূর্বে সুগন্ধি লাগিয়ে দিতাম এবং বায়তুল্লাহর তাওয়াফ ইফাযা করার পূর্বে (প্রাথমিক) হালাল হওয়ার পরেও সুগন্ধি লাগিয়ে দিতাম।[9]
অপর একটি বর্ণনায় আছে, আয়িশা (রা.) বলেন, আমি নাবী (সা.)-কে তাঁর ইহরাম করার পূর্বে মৃগ নাভীর সুগন্ধি লাগিয়ে দিতাম এবং কুরবানীর দিন বায়তুল্লাহর তাওয়াফ ইফাযাহ (যিয়ারাহ্) করার পূর্বে সুগন্ধি লাগিয়ে দিতাম।[10]
তবে প্রাথমিক হালাল হওয়ার জন্য উপরোক্ত সবগুলি কাজ সমাপ্ত করা আবশ্যক নয়, বরং জামরায় কংকর নিক্ষেপ করার পর মাথা মুণ্ডন বা চুল ছোট করা হলেই স্ত্রী সম্ভোগ ছাড়া ইহরামের সমস্ত নিষিদ্ধ কাজগুলি হালাল হয়ে যাবে।
৪। বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করা, যার নাম হচ্ছে তাওয়াফ যিয়ারাহ বা ইফাযাহ। এর প্রমাণ মহান আল্লাহর বাণী:
ثُمَّ لْيَقْضُوا تَفَثَهُمْ وَلْيُوفُوا نُذُورَهُمْ وَلْيَطَّوَّفُوا بِالْبَيْتِ الْعَتِيقِ
অতঃপর তারা যেন তাদের দৈহিক অপরিচ্ছন্নতা দূর করে, তাদের মানত পূর্ণ করে আর প্রাচীন গৃহের তাওয়াফ করে।[11]
আর জাবির (রা.) হতে নাবী (সা.)-এর হাজ্জের বিবরণ সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, অতঃপর নাবী (সা.) বাহনে চেপে (মক্কা পৌঁছে) বায়তুল্লাহর তাওয়াফ ইফাযাহ করলেন, তারপর মক্কাতেই যুহর সলাত আদায় করলেন।[12]
আর আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা আল্লাহর রসূল (সা.)-এর সঙ্গে হাজ্জ করলাম। অতঃপর কুরবানীর দিন আমরা তাওয়াফ ইফাযাহ করলাম।[13]
আর কোন ব্যক্তি যদি হাজ্জে তামাত্তুকারী হয় তাহলে তাওয়াফের পরে সাফা ও মারওয়ার সাঈও করবে। কারণ, তার প্রথম সাঈ উমরার জন্য ছিল। সুতরাং হাজ্জের জন্য আরো একটি সাঈ করা ফরয।
কেননা সহীহ বুখারী ও মুসলিমে আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, অতঃপর যারা উমরার ইহরাম (হাজ্জে তামাত্তু) করেছিল তারা বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করে সাফা ও মারওয়ার সাঈ করল, অতঃপর হালাল হয়ে গেল। তারপর মিনা থেকে ফিরে এসে তাদের হাজ্জের জন্য আরো একটি সাঈ করল। পক্ষান্তরে যারা হাজ্জ ও উমরা একত্রিত করে (হাজ্জে কিরানের) ইহরাম করেছিল তারা মাত্র একটি সাঈ করে।
আর আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহ এমন ব্যক্তির হাজ্জ ও উমরা কবুল করেন না যে সাফা ও মারওয়ার সাঈ করে না।[14]
আর ইবনু আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, অতঃপর আল্লাহর রসূল (সা.) তারবিয়ার দিনের (৮ যিলহজ্জ) বৈকালে আমাদেরকে হাজ্জের ইহরাম করার নির্দেশ দিলেন। তারপর আমরা হাজ্জের কার্যাবলী সমাপ্ত করলে বায়তুল্লাহর তাওয়াফ এবং সাফা ও মারওয়ার সাঈ করি। এরপর আমাদের হাজ্জ সম্পূর্ণ হয়ে যায় এবং আমাদের উপর হাদী (কুরবানী) ওযাজিব হয়ে যায়।[15]
আর যে ব্যক্তি হাজ্জে ইফরাদ বা কিরান করবে, সে যদি তাওয়াফে কুদূমের পরে সাফা ও মারওয়ার সাঈ করে নিয়ে থাকে তাহলে আর সাঈ করার কোন প্রয়োজন নেই। কারণ, সাহাবী জাবির (রা.) বলেন, নাবী (সা.) ও তাঁর সাহাবীগণ সাফা ও মারওয়ার মাঝে প্রথম একটি সাঈর বেশী করেননি।[16]
তবে যদি কোন ব্যক্তি তাওয়াফে কুদূমের পরে সাঈ না করে থাকে তাহলে তার উপর সাঈ করা ফরয। কারণ, সাঈ ব্যতীত হাজ্জ সম্পূর্ণ হয় না, যেমনটি আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, যা উপরে উল্লেখ করা হয়েছে।
আর ইফরাদ বা কিরান হাজ্জ সম্পাদনকারী ব্যক্তি যখন তাওয়াফে ইফাযাহ করে হাজ্জের জন্য তার পরে কিংবা তার পূর্বে সাঈ করে নিবে তখন সে দ্বিতীয় পর্বে (সম্পূর্ণরূপে) হালাল হয়ে যাবে। ফলে তার জন্য ইহরামের অবস্থায় নিষিদ্ধ সমস্ত কাজ হালাল হয়ে যাবে। কেননা আব্দুল্লাহ বিন উমার (রা.) নাবী (সা.)-এর হাজ্জের বিবরণ সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে; তিনি বলেন: নাবী (সা.) কুরবানীর দিন নিজ হাদী (কুরবানীর পশু) যবহ করেন। তারপর মক্কা গিয়ে বায়তুল্লাহর তাওয়াফে ইফাযাহ করেন। অতঃপর ইহরাম অবস্থায় যা কিছুই হারাম ছিল তা হতে হালাল হয়ে যান।[17]
[2]. সহীহ বুখারী ১৭৫০।
[3]. সূরাহ্ আল-হাজ্জঃ ৩২
[4]. সহীহ ইবনে খুযাইমাহ ২৮৮২।
[5]. সূরাহ্ আল-ফাত্হঃ ২৭
[6]. সহীহ মুসলিম ১৩০৫।
[7]. সহীহ বুখারী ১৭২৭-১৭২৮।
[8]. সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম ১২৯৭।
[9]. সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম ১১৮৯।
[10]. সহীহ মুসলিম ১১৯১।
[11]. সূরা আল-হাজ্জ ২২ঃ ২৯
[12]. সহীহ মুসলিম ১২১৮।
[13]. সহীহ বুখারী ১৭৩৩ ও সহীহ মুসলিম।
[14]. সহীহ মুসলিম ১২৭৭।
[15]. সহীহ বুখারী ১৫৭২।
[16]. সহীহ মুসলিম ১২১৫।
[17]. সহীহ বুখারী ১৬৯১, সহীহ মুসলিম ১২২৭।।
১। জামরায়ে আকাবায় কংকর নিক্ষেপ করা।
২। হাদী (কুরবানীর পশু) যবহ করা।
৩। মাথা মুণ্ডন বা চুল খাটো করা।
৪। কাবা ঘরের তাওয়াফ করা।
৫। হাজ্জে তামাত্তুকারীর সাঈ করা। অনুরূপ হাজ্জে ইফরাদ বা কিরানকারী যদি তাওয়াফে কুদূমের সাথে সাফা ও মারওয়ার সাঈ না করে থাকে তাহলে সাঈ করা।
কারণ, নাবী (সা.) এ রকম ধারাবাহিকভাবে একাজগুলো সম্পাদন করেছেন এবং তিনি (সা.) বলেছেন:
لِتَأْخُذُوا عَنِّيْ مَنَاسِكَكُم
তোমরা আমার নিকট হতে তোমাদের হাজ্জ ও উমরার বিধি-বিধান গ্রহণ কর।[1]
তবে আগে পরে করে পালন করলে কোন অসুবিধা নেই। কারণ, ইবনু আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, নাবী (সা.)-কে যবহ, মাথা মুণ্ডন এবং কংকর নিক্ষেপ আগে পরে করা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি (সা.) উত্তরে বলেন: কোন অসুবিধা নেই।[2]
আর ইবনু আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নাবী (সা.)-কে কুরবানীর দিন মিনায় উপরোক্ত কাজগুলি আগে-পরে সম্পাদন করা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি জবাবে বলেন: কোন অসুবিধা নেই। সেই সময় জনৈক ব্যক্তি নাবী (সা.)-কে জিজ্ঞেস করল, আমি যবহ্ করার পূর্বে মাথা মুণ্ডন করে ফেলেছি? তখন তিনি বললেন: যবহ্ কর তাতে কোন অসুবিধা নেই। অপর এক ব্যক্তি বলল, আমি সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ার পর কংকর নিক্ষেপ করেছি? তখন উত্তরে তিনি (সা.) বললেন: কোন অসুবিধা নেই।[3]
আরো আব্দুল্লাহ বিন আমর (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে: তিনি বলেন যে, নাবী (সা.)-কে কংকর নিক্ষেপের পূর্বে মাথা মুণ্ডন ও কংকর নিক্ষেপের পূর্বে যবহ্ করা এবং কংকর নিক্ষেপের পূর্বে তাওয়াফে ইফাযাহ করা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি (সা.) উত্তরে বলেন: কংকর মার, তাতে কোন অসুবিধা নেই।[4]
আব্দুল্লাহ বিন আমর (রা.) বলেন, সেই দিন তাঁকে কোন কিছু আগে-পরে করা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি এক কথায় বলেন: (افعلوا ولا حرج) অর্থাৎ তোমরা (আজকের হাজ্জের কার্যাবলী আগে-পরে যেভাবে হোক) সম্পাদন কর, তাতে কোন অসুবিধা নেই। আর যদি কোন ব্যক্তি ঈদের দিনে তাওয়াফে ইফাযা সমাপ্ত করতে সক্ষম না হয় তাহলে বিলম্ব করা জায়েয। তবে কোন বিশেষ অসুবিধা যেমন, ব্যধি, হায়য বা নিফাস ছাড়া তাশ্রীকের দিনগুলি (১১, ১২ ও ১৩ যিলহাজ্জ) পার করে দেয়া ভাল নয়।
>[2]. সহীহ বুখারী ১৭৩৪, সহীহ মুসলিম ১৩০৭।
[3]. সহীহ বুখারী ১৭৩৫ ও মুসলিম ১৩০৬।
[4]. সহীহ মুসলিম ১৩০৬।
হাজীগণ ঈদের দিন তাওয়াফ ও সাঈ করার পরে মিনায় ফিরে আসবে। অতঃপর সেখানে ঈদের দিনের অবশিষ্ট অংশ এবং তাশ্রীকের দিন-রাত্রিগুলি (১১, ১২ ও ১৩ যিলহাজ্জ) পর্যন্ত অবস্থান করবে। কারণ, নাবী (সা.) এ দিন ও রাতগুলি এখানেই অবস্থান করেছেন। তবে মিনায় এগারো, বারো তারীখের রাত এবং বিলম্ব করতে চাইলে তেরো তারীখের রাতও যাপন করা ওয়াজিব।
কারণ, নাবী (সা.) এ রাতগুলি মিনায় যাপন করেছেন এবং তিনি আমাদেরকে এ বলে নির্দেশ প্রদান করেছেন:
لِتَأْخُذُوا عَنِّيْ مَنَاسِكَكُم
তোমরা আমার নিকট হতে তোমাদের হাজ্জ ও উমরার বিধি-বিধান গ্রহণ কর।[1]
আর এমন কোন ওজর যা হাজ্জ বা হাজীদের সাথে সর্ম্পকিত হলে মিনার বাইরে রাত কাটানো জায়েয।
কারণ, আব্দুল্লাহ বিন উমর (রা.) হতে বর্ণিত যে, আব্বাস বিন আব্দুল মুত্তালিব নাবী (সা.)-এর নিকট হাজীদেরকে যমযমের পানি পান করাবার উদ্দেশ্যে মিনার রাতগুলি মক্কায় যাপনের জন্য অনুমতি চাইলেন, তখন নাবী (সা.) তাঁকে এর অনুমতি দিলেন।[2]
আসিম বিন আদী (রা.) হতে বর্ণিত, রসূল (সা.) উঁটের রাখালদেরকে মিনার বাইরে রাত কাটাবার অনুমতি দিয়েছেন।[3]
আর তাশরীকের দিনগুলিতে (১১, ১২ ও ১৩ যিলহজ্জ) প্রত্যেক দিন মাথার উপর থেকে সূর্য ঢলে যাওয়ার পর তিনটি জামরাকে পরস্পর সাতটি করে পাথর মারবে।
আর প্রত্যেকটি পাথর নিক্ষেপের সময় তাকবীর (আল্লাহু আকবার) পাঠ করবে।
সর্বপ্রথম মসজিদে খায়্ফের দিকে অবস্থিত প্রথম জামরাকে পাথর মারবে, অতঃপর সামনে এগিয়ে কিবলামুখী হয়ে দাঁড়িয়ে দীর্ঘক্ষণ হস্তদ্বয় তুলে দু‘আ করবে।
তারপর মধ্য জামরাকে পাথর মারবে অতঃপর বাম দিকে এগিয়ে কিবলামুখী হয়ে দাঁড়িয়ে দীর্ঘক্ষণ হস্তদ্বয় তুলে দু‘আ করবে।
তারপর জামরা আক্বাবায় পাথর মেরে সেখান থেকে ফিরে আসবে। সেখানে দু‘আ করবে না। এভাবে ইমাম বুখারী (রহঃ) আব্দুল্লাহ বিন উমার (রা.) হতে বর্ণনা করেন যে, নাবী (সা.) এরকমই করতেন।[4]
আর যদি জামরাতগুলিতে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে দু‘আ করা সম্ভব না হয় তাহলে যতক্ষণ সম্ভব দাঁড়িয়ে দু‘আ করবে, যাতে করে এই সুন্নাতকে জীবিত করা হয় যা অধিকাংশ লোকেরা হয় অজ্ঞতা বশতঃ বা এ সুন্নাতকে অবহেলা করে পরিত্যাগ করেছে। অতএব এই সুন্নাত বিনষ্ট করা উচিৎ নয়। আর মনে রাখবেন যখনই কোন সুন্নাত উঠে যায় তখন সুন্নাতের প্রতি আমলের ফযীলত হাসিল করা এবং জনসাধারণের মাঝে তার প্রসার ও প্রচার করার উদ্দেশ্যে তার প্রতি আমল করার গুরুত্ব বেড়ে যায়।
আর তাশরীকের দিনগুলিতে (১১, ১২ ও ১৩ যিলহজ্জ) সূর্য ঢলে যাওয়ার পূর্বে কংকর নিক্ষেপ করা জায়েয নয়। কারণ, নাবী (সা.) পশ্চিমে সূর্য ঢলার পূর্বে কংকর নিক্ষেপ করেননি। আর তিনি একথাও বলেছেন:
لِتَأْخُذُوا عَنِّيْ مَنَاسِكَكُم
তোমরা আমার নিকট হতে তোমাদের হজ্জ ও উমরার বিধি-বিধান গ্রহণ কর।[5]
আর জাবির হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নাবী (সা.) কুরবানীর দিন সকাল বেলা জামরায় পাথর মারেন। কিন্তু তার পরের দিনগুলিতে সূর্য মাথার উপর থেকে ঢলে যাওয়ার পরে পাথর মারেন।[6]
আর সাহাবীগণ অনুরূপ আমল করতেন। যেমন আব্দুল্লাহ বিন উমার (রা.)-কে জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করেন, আমি কখন পাথর মারব? তিনি উত্তরে বলেন: আমরা অপেক্ষা করতে থাকতাম, অতঃপর সূর্য ঢলে পড়লে আমরা পাথর মারতাম।[7]
আর বারই যিলহাজ্জ জামরাগুলিকে পাথর মারা হলেই হাজ্জের ওয়াজিব কাজ সমাপ্ত হয়ে যায়। তারপর ইচ্ছা হলে মিনায় তেরো যিলহাজ্জ পর্যন্ত অবস্থান করবে এবং সূর্য ঢলে যাওয়ার পর জামরাগুলিকে পাথর মারবে। আর মন চাইলে মিনা থেকে বারই যিলহাজ্জ জামরাগুলিকে পাথর মেরেই বেরিয়ে পড়বে। এর প্রমাণ মহান আল্লাহর বাণী:
فَمَن تَعَجَّلَ فِي يَوْمَيْنِ فَلاَ إِثْمَ عَلَيْهِ وَمَن تَأَخَّرَ فَلا إِثْمَ عَلَيْهِ لِمَنِ اتَّقَى
অতঃপর যে ব্যক্তি তাড়াতাড়ি করে দু’দিনে চলে যায় তার প্রতি কোন গুনাহ্ নেই এবং যে ব্যক্তি অধিক সময় পর্যন্ত বিলম্ব করবে, তার প্রতিও গুনাহ্ নেই, এটা তার জন্য যে ব্যক্তি তাকওয়া অবলম্বন করবে।[8]
তবে বিলম্ব করা উত্তম। কারণ, ইহা নাবী (সা.)-এর আমল। এ ছাড়া এতে নেক আমলও বেশী হবে, যেহেতু তেরই যিলহাজ্জ মিনায় রাত্রী যাপন করা এবং সে দিনের কংকর মারাও হবে।
তবে যদি বারই যিলহাজ্জ মিনা থেকে রওনা হওয়ার পূর্বে সর্য অস্ত হয়ে যায় তাহলে সেদিন আর মিনা থেকে বের হতে পারবে না। কারণ, মহান আল্লাহ বলেন:
﴿فَمَن تَعَجَّلَ فِي يَوْمَيْنِ فَلاَ إِثْمَ عَلَيْهِ﴾
অতঃপর যে ব্যক্তি তাড়াতাড়ি করে দু’দিনে চলে যায় তার প্রতি কোন গুনাহ্ নেই।[9]
মহান আল্লাহ এ আয়াতে দুই দিনের কথা বলেছেন, তাই দুই দিন পেরিয়ে গেলেই তাড়াতাড়ি করে মিনা থেকে চলে যাওয়ার সময় শেষ হয়ে যায়। আর ইহা সর্বজন বিদিত যে, সূর্য অস্তমিত হওয়ার সাথেই প্রতিটি দিন শেষ হয়ে যায়।
এছাড়া ইমাম মালিক (রহঃ)-এর সংকলিত মুআত্তা নামক হাদীস গ্রন্থে তাবেঈ নাফি’ (রহঃ) থেকে বর্ণিত যে, প্রখ্যাত সাহাবী আব্দুল্লাহ্ বিন উমার (রা.) বলতেন: যে ব্যক্তির তাশরীকের মধ্য দিবসে (বারই যিলহাজ্জ) মিনায় অবস্থানকালে সূর্য অস্ত হয়ে যায় সে আগামি দিনের (তেরই যিলহাজ্জ) জামরাতগুলিতে পাথর না মেরে বিদায় হতে পারবে না। কিন্তু যদি কোন হাজীর অনিচ্ছিাকৃত সূর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত মিনায় বিলম্ব হয়ে যায়; যেমন, মিনা হতে বের হওয়ার জন্য সে ব্যক্তিগতভাবে প্রস্ত্তত কিন্তু গাড়ীর ভীড়ের কারণে বা এধরণের যে কোন কারণে মিনা থেকে বের হতে বিলম্ব হয়ে গেল, এমতাবস্থায় মিনা থেকে বের হওয়ার পূর্বে সূর্য অস্ত গেলেও সেখান থেকে রওনা হয়ে যাবে, এতে কোন দোষ নেই।
>[2]. সহীহ বুখারী ১৭৪৫, সহীহ মুসলিম ১৩১৫।
[3]. সহীহ: মুসনাদে আহমাদ ২৩৭৭৫, আবূ দাউদ ১৯৭৫, তিরমিযী ৯৫৫ ও ইবনু মাজাহ ৩০৩৭।
[4]. সহীহ বুখারী ১৭৫৩।
[5]. সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম ১২৯৭।
[6]. সহীহ বুখারী ১৭৪৬, সহীহ মুসলিম ১২৯৯।
[7]. সহীহ বুখারী ১৭৪৬।
[8] সূরা আল-বাক্বারা ২ঃ ২০৩
[9] সূরা আল-বাক্বারা ২:২০৩
জামরাতে পাথর নিক্ষেপ করা হাজ্জের কার্যাবলীর একটি অন্যতম ইবাদাত এবং তা একটি অংশ। তাই সম্ভবপর হলে একাজ হাজীর নিজেই সম্পাদন করা ওয়াজিব, তার এ হাজ্জ ফরয হোক কিংবা নফল। কারণ, আল্লাহ তা’আলা বলেন:
وَأَتِمُّواْ الْحَجَّ وَالْعُمْرَةَ لِلّهِ
তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে হাজ্জ ও উমরা সম্পূর্ণ কর।[1]
অতএব কোন ব্যক্তি হাজ্জ ও উমরায় প্রবেশ করলে তা নফল হলেও সম্পূর্ণ করা ফরয। আর কোন হাজী যতক্ষণ কোন ব্যধি, বার্ধক্য বা অপ্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া কিংবা অন্য কোন কারণে কংকর নিজেই নিক্ষেপ করতে অক্ষম না হবে ততক্ষণ তার জন্য অন্য কোন ব্যক্তিকে উকীল নিযুক্ত করা জায়েয হবে না।
তবে প্রয়োজনে কংকর নিক্ষেপ করার জন্য এমন ব্যক্তিকে উকীল বানাবে যার আকীদা ও আমল ভাল। আর এ কংকর হাজী নিজেই কুড়িয়ে উকীলকে দিয়ে দিক অথবা উকীল নিজেই কংকর কুড়িয়ে নিয়ে অন্যের পক্ষ থেকে কংকর নিক্ষেপ করুক। আর উকীলের কংকর মারার পদ্ধতি হচ্ছে যে, উকীল প্রথম নিজের সাতটি কংকর মেরে নিয়ে অন্যের পক্ষ থেকে কংকর নিক্ষেপ করবে এবং যার পক্ষ হতে কংকর মারবে তার নাম উচ্চারণ করে বা মনে মনে নিয়্যাত করবে।
আর একই স্থানে দাঁড়িয়ে নিজের কংকর এবং অন্যের কংকর নিক্ষেপ করায় কোন বাধা নেই। কেননা নিজের তিনটি জামারাতে পাথর মারা সম্পূর্ণ করা তারপরে অন্যের পক্ষ থেকে পাথর নিক্ষেপ করা আবশ্যক নয়; কারণ, এর আবশ্যকতার কোন দলীল নেই।
">হাজীগণ হাজ্জের যাবতীয় কাজ সম্পাদন করার পরে মিনা থেকে রওনা হয়ে নিজ ঘরে ফিরার ইচ্ছা করলে বায়তুল্লাহর সাত চক্কর (বিদায়ী তাওয়াফ) না করে বিদায় হবে না। কারণ, নাবী (সা.) হাজ্জের শেষে বিদায়ী তাওয়াফ করেছেন এবং তিনি বলেছেন:
لِتَأْخُذُوا عَنِّيْ مَنَاسِكَكُم
তোমরা আমার নিকট হতে তোমাদের হাজ্জ ও উমরার বিধি-বিধান গ্রহণ কর।[1]
আর এ তাওয়াফ মক্কা থেকে বিদায়ের পূর্বে সর্বশেষ কাজ হওয়া আবশ্যক। কারণ, আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত হাদীসে আছে, তিনি বলেন, লোকেরা হাজ্জের শেষে যে যেখান থেকে ইচছা রওনা হয়ে যেত। তখন নাবী (সা.) বলেন:
لَا يَنْفِرَنَّ أَحَدٌ حَتَّى يَكُونَ آخِرُ عَهْدِهِ بِالْبَيْتِ
তোমাদের কোন ব্যক্তি যেন বায়তুল্লাহর শেষ সাক্ষাৎ (তাওয়াফ) না করা পর্যন্ত হাজ্জ শেষে বিদায় না হয়।[2]
সুতরাং বিদায়ী তাওয়াফের পরে মক্কায় অবস্থান করা জায়েয নয়। অনুরূপ বিদায়ী তাওয়াফের পরে সফরের প্রস্ত্ততি ছাড়া যেমন, মাল-সামান যানবাহনে উঠানো বা সাথী-সঙ্গীর অপেক্ষা করা কিংবা গাড়ীর অপেক্ষা করা- অন্য কোন কাজে ব্যস্ত হওয়াও জায়েয নয়। তাই যদি কেউ সফরের প্রস্ত্ততি ব্যতীত অন্য কোন উদ্দেশ্যে মক্কায় বিলম্ব করে তাহলে তার পুনঃরায় তাওয়াফ করা আবশ্যক হয়ে পড়বে, যাতে করে তার শেষ কাজ কা’বা ঘরের তাওয়াফ হতে পারে।
আর বিদায় তাওয়াফ হায়য এবং নিফাস অবস্থায় থাকা মহিলাদের প্রতি ওয়াজিব নয়। এর দলীল আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত হাদীস, তিনি বলেন:
أُمِرَ النَّاسُ أَنْ يَكُونَ آخِرُ عَهْدِهِمْ بِالْبَيْتِ إِلَّا أَنَّهُ خُفِّفَ عَنْ الْحَائِضِ
লোকদেরকে (নাবী (সা.)-এর পক্ষ হতে) নির্দেশ দেয়া হল যে, তাদের শেষ সাক্ষাৎ যেন বায়তুল্লাহর সাথে হয়। তবে হায়য অবস্থায় থাকা মহিলাকে ছাড় দেয়া হয়েছে।[3]
আরো আয়িশা (রা.) বর্ণিত, তিনি বলেন, হুয়াইয়ের মেয়ে সাফিয়া (রা.)-এর তাওয়াফে ইফাযাহ সম্পূর্ণ করার পর হায়য (মাসিক ঋতু) শুরু হয়ে যায়। আয়িশা (রা.) বলেন: তখন আমি তার হায়যের বিষয়টি রসূল (সা.)-এর নিকট আলোচনা করি। তিনি (সা.) বলেন, তাহলে কি সে আমাদেরকে বিদায়ে বিলম্ব করতে বাধ্য করবে? তখন আমি বললাম, হে আল্লাহর রসূল! সে তো কা’বা ঘরের তাওয়াফে ইফাযাহ করে নেয়ার পর তার হায়য (মাসিক ঋতু) এসেছে। তখন নাবী (সা.) বললেন, তাহলে সে মক্কা হতে প্রস্থান করতে পারবে।[4] আর নিফাস (সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার পরের রক্তক্ষরণ) অবস্থায় থাকা মহিলার বিধান ঋুতুবতী মহিলার অনুরূপ। কারণ, যেমন হায়য অবস্থায় তাওয়াফ শুদ্ধ হয় না ঠিক তেমনি নিফাস অবস্থায়ও তাওয়াফ জায়েয নয়।
>[2]. সহীহ মুসলিম ১৩২৭।
[3]. সহীহ বুখারী ১৭৫৫ ও সহীহ মুসলিম ১৩২৮।
[4]. সহীহ বুখারী ১৭৩৩, সহীহ মুসলিম ১২১১।
প্রথম দিনের কার্যাবলী, তা হচ্ছে ৮ যিলহাজ্জ
১। হাজীগণ নিজ নিজ স্থান থেকে হাজ্জের ইহরাম বাঁধবে: তা এভাবে যে, সর্বপ্রথম গোসল করবে, শরীরে সুগন্ধি ব্যবহার করবে এবং পুরুষরা সেলাই বিহীন ইহরামের কাপড় পরবে।
তারপর বলবে: “লাব্বাইক হাজ্জান” অর্থাৎ হে আল্লাহ! আপনার নিকট হাজির হয়েছি। অতঃপর অধিক পরিমানে তালবিয়া পাঠ করবে।
لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ لَبَّيْكَ لَبَّيْكَ لَا شَرِيكَ لَكَ لَبَّيْكَ إِنَّ الْحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكَ لَا شَرِيكَ لَكَ
[লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারীকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হাম্দা ওয়ান্নি’মাতা লাকা ওয়ালমুলক, লা শারীকা লাকা]
তোমার নিকট আমি হাজির হয়েছি, হে আল্লাহ ! আমি হাজির হয়েছি, আমি হাজির হয়েছি, তোমার কোন অংশীদার নেই। আমি হাজির হয়েছি, নিশ্চয়ই সমস্ত প্রশংসা, নিয়ামাত এবং রাজত্ব তোমারই। তোমার কোন অংশী নেই।[1]
২। তারপর মিনার উদ্দেশ্যে রওনা হবে এবং সেখানে ৯ যিলহাজ্জ সূর্য উদয় হওয়া পর্যন্ত অবস্থান করবে। সেখানে যুহর, আসর, মাগরিব, ইশা ও ফজর সলাত নিজ নিজ সময়ে কসর করে আদায় করবে। [তবে দু’ওয়াক্তের সলাত একত্রে জমা করে আদায় করবে না]
দ্বিতীয় দিনের কার্যাবলী তা হচ্ছে ৯ যিলহাজ্জ
১। নয় যিলহাজ্জ সূর্য উদয় হওয়ার পর আরাফার উদ্দেশ্যে রওনা হবে। সেখানে গিয়ে যুহর ও আসর সলাত কসর (দুই-দুই রাক‘আত) এবং অগ্রীম একত্রিত করে আদায় করবে। আর সম্ভব হলে সূর্য মাথার উপর থেকে গড়ার পূর্ব পর্যন্ত নামেরাহ্ নামক স্থানে (যেখানে বর্তমান আরাফার মাসজিদ অবস্থিত) অবস্থান করবেন।
২। সলাত আদায়ের পর থেকে সূর্য অস্তমিত হওয়া পর্যন্ত দু’হাত উত্তোলন করে কিবলামুখী হয়ে যিকির ও দু‘আয় মনোনিবেশ করবেন।
৩। সূর্য অস্ত যাওয়ার পর মুযদালিফার উদ্দেশ্যে রওনা হবে এবং সেখানে গিয়ে মাগরিব তিন রাক‘আত এবং ইশার সলাত দুই রাক‘আত আদায় করবে। তারপর সেখানে ফজর পর্যন্ত রাত্রি যাপন করবে।
৪। ফজরের সময় হওয়ার পর ফজর সলাত আদায় করবে। অতঃপর পুরোপুরি পূর্ব আকাশ ফর্সা হওয়া পর্যন্ত যিকির ও দু‘আয় ব্যস্ত থাকবে।
৫। সূর্য উদীত হওয়ার পূর্বেই মিনার উদ্দেশ্যে রওনা হবে।
তৃতীয় দিনের কার্যাবলী তা হচ্ছে ১০ যিলহাজ্জ ঈদের দিন
১। মিনা পৌঁছে জামরা আক্বাবায় যাবে। অতঃপর সেখানে পরপর সাতটি কংকর মারবে এবং প্রত্যেকটি কংকর নিক্ষেপের সময় তাকবীর (আল্লাহু আকবার) পাঠ করবে।
২। কুরবানী থাকলে নিজ কুরবানী করবেন।
৩। মাথা মুণ্ডন বা চুল ছোট করবে। এর মাধ্যমে প্রাথমিক হালাল হয়ে যাবে। তারপর নিজ সেলাইকৃত কাপড় পরিধান করতে পারবে, সুগন্ধি লাগাবে এবং তার জন্য স্ত্রী সম্ভোগ ব্যতীত ইহরামের যাবতীয় নিষিদ্ধ কাজ হালাল হয়ে যাবে।
৪। তারপর মক্কায় এসে বায়তুল্লাহর ‘তাওয়াফে ইফাযাহ’ করবে। ইহাই হচ্ছে হাজ্জের ফরয তাওয়াফ।
অতঃপর হাজ্জে তামাত্তুকারী হলে হাজ্জের জন্য সাফা ও মারওয়ার সাঈ করবে।
অনুরূপ কোন ব্যক্তি যদি হাজ্জে কিরান বা ইফরাদ করে কিন্তু তাওয়াফে কুদূমের পরে সাঈ না করে থাকে তাহলে তার সাঈ সম্পূর্ণ করবে। এর মাধ্যমে দ্বিতীয় পর্যায়ের হালাল (সম্পূর্ণরূপে হালাল) হয়ে যাবে। এরপরে ইহরামের সমস্ত নিষিদ্ধ কাজ এমনকি স্ত্রীও হালাল হয়ে যাবে।
৫। তারপর হাজীগণ মিনায় ফিরে যাবেন এবং সেখানে গিয়ে ১১ই যিলহাজ্জের রাত্রীযাপন করবেন।
চতুর্থ দিনের কার্যাবলী তা হচ্ছে ১১ই যিলহাজ্জ
১। মাথার উপর থেকে সূর্য ঢলে যাওয়ার পর তিনটি জামরাকে পাথর মারবেন।[2] কারণ এর পূর্বে পাথর নিক্ষেপ করা জায়েয নয়। সর্বপ্রথম ছোট জামরাকে (যা মিনা থেকে মক্কার দিকে যেতে প্রথমে অবস্থিত এজন্য ইহাকে প্রথম জামরাও বলা হয়) তারপর মধ্য জামরাকে পাথর মারবেন। সর্বশেষে জামরা আকাবাকে (বড় জামরা) পাথর মারবেন।
প্রত্যেকটি জামরায় সাতটি করে পরস্পর পাথর নিক্ষেপ করবে এবং প্রত্যেকটি পাথর মারার সময় তাকবীর (আল্লাহু আকবার) পাঠ করবে। আর প্রথম জামরা এবং মধ্য জামরায় পাথর নিক্ষেপ করার পর দাঁড়িয়ে দু’হাত উঠিয়ে দু‘আ করবে।
২। মিনায় ১২ যিলহাজ্জেও রাত্রীযাপন করবে।
৫ম দিনের কার্যাবলী তা হচ্ছে ১২ যিলহাজ্জ
১। তিনটি জামরায় ১১ই যিলহাজ্জের মতই পাথর মারবেন।
২। আজকের দিনে মিনা থেকে রওনা হতে চাইলে সূর্য অস্তমিত হওয়ার পূর্বেই মিনার এলাকা থেকে বের হয়ে পড়বেন। আর যদি ১৩ যিলহাজ্জ পর্যন্ত বিলম্ব করতে চায় তাহলে মিনায় রাত্রীযাপন করবেন।
ষষ্ঠ দিনের কার্যাবলী তা হচ্ছে ১৩ যিলহাজ্জ
এদিনের কাজগুলি ঐসব হাজীর জন্য, যারা মিনায় বিলম্ব করবে, তারা নিম্নের কাজগুলি সম্পাদন করবে:
১। তিনটি জামরায় ১১ ও ১২ই যিলহাজ্জের মতই পাথর মারবে।
২। এরপরে মিনা থেকে রওনা হয়ে মক্কায় যাবেন। ৩। তারপর সর্বশেষ কাজ মক্কা হতে বিদায় হওয়ার পূর্বে ‘বিদায়ী তাওয়াফ’ করবেন। মহান আল্লাহই অধিক জ্ঞানী।
>[2]. সহীহ বুখারী ১৭৪৬।