মুযদালিফায় অবস্থানকারী হাজীগণ দু‘আ ও যিকির সম্পূর্ণ করে সূর্য উদয় হওয়ার পূবেই মিনার উদ্দেশ্যে রওনা হবে। অতঃপর মিনা পৌঁছে নিম্নে উল্লিখিত কাজগুলি সম্পাদন করবে:
১। জামরা আকাবায় কংকর মারা অর্থাৎ বড় জামরায় যা মক্কার পথে মিনার শেষ দিকে অবস্থিত, কংকর নিক্ষেপ করা।
সুতরাং মুযদালিফা থেকে মিনা যাওয়ার পথে যে কোন স্থান থেকে সাতটি ছোলা দানার চাইতে সামান্য বড় ছোট ছোট কংকর কুড়িয়ে নিবে। অতঃপর এক একটি করে পাথর জামরায় নিক্ষেপ করবে। আর সম্ভব হলে কা‘বা ঘরকে বামে এবং মিনাকে ডানে রেখে বাতনুল ওয়াদী (উপত্যকার মধ্যভাগ) থেকে কংকর নিক্ষেপ করবে।
কারণ, আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বড় জামরায় পৌঁছে বায়তুল্লাহকে বামে এবং মিনাকে ডানে রেখে সাতটি কংকর নিক্ষেপ করলেন। এবং তিনি বললেন, এইভাবে সেই নাবী (সা.) কংকর নিক্ষেপ করেছেন যার প্রতি সূরাহ্ বাক্কারা নাযিল হয়েছে।[1]
আর প্রত্যেকটি কংকর নিক্ষেপের সময় “আল্লাহু আকবার” বলবে।[2] আর মনে রাখবেন যে, বড় পাথর, জুতো, স্যান্ডেল এবং এধরণের বস্ত্ত দ্বারা জামরায় রামী (নিক্ষেপ) করা জায়েয নয়।
আর মহান আল্লাহর মহত্ত্ব ঘোষণার (তাকবীর) সাথে বিনয়ী ও শান্ত হয়ে কংকর নিক্ষেপ করবে। অনেক মূর্খরা যেমন হৈ হুল্লুড় ও গালী-গালাজ করে তাদের মত করবে না। কেননা জামরায় কংকর নিক্ষেপ করা আল্লাহর নিদর্শনসমূহের অমর্ত্মভূক্ত। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন:
ذَلِكَ وَمَن يُعَظِّمْ شَعَائِرَ اللَّهِ فَإِنَّهَا مِن تَقْوَى الْقُلُوبِ
যে কেউ আল্লাহর নিদর্শনগুলোকে সম্মান করবে সে তো তার অন্তরস্থিত আল্লাহ-ভীতি থেকেই তা করবে।[3]
আর হাদীসে নাবী (সা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন:
إِنَّمَا جُعِلَ الطَّوَافُ بِالْبَيْتِ وَبَيْنَ الصَّفَا وَالْمَرْوَةِ وَرَمْيُ الْجِمَارِ لِإِقَامَةِ ذِكْرِ اللَّهِ
নিশ্চয়ই বায়তুল্লাহর তাওয়াফ, সাফা ও মারওয়ার সাঈ এবং জামরাগুলিতে কংকর নিক্ষেপ করা আল্লাহর যিকির (স্মরণ) প্রতিষ্ঠার উদ্দেশে বিধি-বদ্ধ করা হয়েছে।[4]
আর জামরার উদ্দেশে শক্তি প্রদশন করে ঝাপিয়ে আসবে না, কেননা ইহাতে মুসলিম ভাইদের কষ্ট দেয়া হবে অথবা ক্ষতি সাধন হবে।
২। কুরবানী করা। দশ তারীখে জামরায় কংকর নিক্ষেপ করার পর সঙ্গে হাদী (কুরবানীর পশু) থাকলে তা যবহ করবে, তা না হলে ক্রয় করে তা যবহ করবে। এর পূর্বে হাদীর আবশ্যক ধরণ, গুণাবলী, কুরবানীর পশু যবহ করার স্থান ও সময় এবং তা যবহ করার নিয়মাবলী বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে। অতএব তা দেখে নিন।
৩। মাথা মুণ্ডন বা চুল ছোট করা। হাদী যবহ করার পর পুরুষ ব্যক্তি নিজ মাথা মুণ্ডন করবে কিংবা চুল ছোট করবে। তবে মাথা নেড়া করাই উত্তম।
এর প্রথম দলীল এই যে, মহান আল্লাহ এই আয়াতে প্রথম মাথা মুণ্ডনের বিষয়টি উল্লেখ করেছেন:
(مُحَلِّقِينَ رُؤُوسَكُمْ وَمُقَصِّرِينَ )الفتح27
তোমাদের মস্তক মুণ্ডিত অবস্থায় ও চুল কেটে।[5]
মাথা মুণ্ডন উত্তম হওয়ার দ্বিতীয় দলীল নাবী (সা.)-এর পুরো মাথার চুল মুণ্ডন করা।
যেমন আনাস বিন মালিক (রা.) হতে বর্ণিত, নাবী (সা.) মিনা এসে জামরায় কংকর নিক্ষেপ করলেন। অতঃপর মিনায় নিজ তাঁবুতে এসে কুরবানী করলেন, তারপর নাপিতকে বললেন, নাও মাথা মুণ্ডন কর। এবলে মাথার ডান দিকে ইংগিত করলেন। অতঃপর বাম দিক থেকে মুণ্ডন করতে বললেন। তারপর লোকদের মাঝে নিজ মুবারাক চুল বিতরণ করে দিলেন।[6]
মাথা মুণ্ডন উত্তম হওয়ার তৃতীয় দলীল এই যে, নাবী (সা.) মাথা মুণ্ডনকারীদের জন্যে আল্লাহর রহমাত ও ক্ষমার তিনবার করে দুআ করেছেন এবং চুল ছোটকারীদের জন্যে একবার দুআ করেছেন।[7]
আরো একটি যুক্তি হচ্ছে যে, মাথা মুণ্ডনে মহান আল্লাহর অধিক তা’যীম (মহত্ত্ব প্রকাশ) রয়েছে। কেননা তাতে মাথার সমস্ত চুল আল্লাহর জন্য ফেলা হয়। আর মাথা মু-ণ বা চুল খাটো করা পুরো মাথার হবে। কারণ, আল্লাহ তা’আলা বলেছেন:
مُحَلِّقِينَ رُؤُوسَكُمْ وَمُقَصِّرِينَ
তোমাদের মস্তক মুণ্ডিত অবস্থায় ও চুল কেটে। আর যে ক্রিয়া মাথার সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে তা পুরো মাথাকে শামিল। আর মাথার কিছু অংশ বাদ দিয়ে কিছু অংশ মুণ্ডন করা ইসলামী বিধানে নিষিদ্ধ।
যার প্রমাণ সহীহ বুখারী ও মুসলিমে তাবেঈ নাফি’ বর্ণনা করেন আব্দুল্লাহ বিন উমার (রা.) হতে যে, নাবী (সা.) ‘কায‘আ’ হতে নিষেধ করেছেন। তখন নাফি’ (রহঃ)-কে কায‘আর ব্যাখ্যা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, মাথার কিছু অংশ বাদ দিয়ে কিছু অংশ মুণ্ডন করা। তাহলে কোন না জায়েয কাজ দিয়ে আল্লাহর নৈকট্য লাভ হয় না। আর নাবী (সা.) মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পুরো মাথার মুণ্ডন করেছেন। এবং তিনি বলেছেন:
لِتَأْخُذُوا عَنِّيْ مَنَاسِكَكُم
তোমরা আমার নিকট হতে তোমাদের হাজ্জ ও উমরার বিধি-বিধান গ্রহণ কর।[8]
তবে মহিলা নিজ চুলের শেষভাগ থেকে আঙ্গুলের অগ্রভাগ সমান ছোট করবে।
উপরোক্ত কাজগুলি সম্পাদন করা হলেই স্ত্রী সম্ভোগ ছাড়া ইহরামের সমস্ত নিষিদ্ধ কাজগুলি হালাল হয়ে যায়। অতএব এর পরে হাজীর জন্য সুগন্ধি ব্যবহার করা, সেলাইকৃত কাপড় পরিধান করা, চুল কাটা, নখ কাটা ও অন্যান্য নিষিদ্ধ কাজগুলি হালাল হয়ে যাবে। আর এই প্রাথমিক হালাল হওয়ার পরে সুগন্ধি লাগানো সুন্নাত।
কারণ, আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নাবী (সা.)-কে তাঁর ইহরাম করার পূর্বে সুগন্ধি লাগিয়ে দিতাম এবং বায়তুল্লাহর তাওয়াফ ইফাযা করার পূর্বে (প্রাথমিক) হালাল হওয়ার পরেও সুগন্ধি লাগিয়ে দিতাম।[9]
অপর একটি বর্ণনায় আছে, আয়িশা (রা.) বলেন, আমি নাবী (সা.)-কে তাঁর ইহরাম করার পূর্বে মৃগ নাভীর সুগন্ধি লাগিয়ে দিতাম এবং কুরবানীর দিন বায়তুল্লাহর তাওয়াফ ইফাযাহ (যিয়ারাহ্) করার পূর্বে সুগন্ধি লাগিয়ে দিতাম।[10]
তবে প্রাথমিক হালাল হওয়ার জন্য উপরোক্ত সবগুলি কাজ সমাপ্ত করা আবশ্যক নয়, বরং জামরায় কংকর নিক্ষেপ করার পর মাথা মুণ্ডন বা চুল ছোট করা হলেই স্ত্রী সম্ভোগ ছাড়া ইহরামের সমস্ত নিষিদ্ধ কাজগুলি হালাল হয়ে যাবে।
৪। বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করা, যার নাম হচ্ছে তাওয়াফ যিয়ারাহ বা ইফাযাহ। এর প্রমাণ মহান আল্লাহর বাণী:
ثُمَّ لْيَقْضُوا تَفَثَهُمْ وَلْيُوفُوا نُذُورَهُمْ وَلْيَطَّوَّفُوا بِالْبَيْتِ الْعَتِيقِ
অতঃপর তারা যেন তাদের দৈহিক অপরিচ্ছন্নতা দূর করে, তাদের মানত পূর্ণ করে আর প্রাচীন গৃহের তাওয়াফ করে।[11]
আর জাবির (রা.) হতে নাবী (সা.)-এর হাজ্জের বিবরণ সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, অতঃপর নাবী (সা.) বাহনে চেপে (মক্কা পৌঁছে) বায়তুল্লাহর তাওয়াফ ইফাযাহ করলেন, তারপর মক্কাতেই যুহর সলাত আদায় করলেন।[12]
আর আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা আল্লাহর রসূল (সা.)-এর সঙ্গে হাজ্জ করলাম। অতঃপর কুরবানীর দিন আমরা তাওয়াফ ইফাযাহ করলাম।[13]
আর কোন ব্যক্তি যদি হাজ্জে তামাত্তুকারী হয় তাহলে তাওয়াফের পরে সাফা ও মারওয়ার সাঈও করবে। কারণ, তার প্রথম সাঈ উমরার জন্য ছিল। সুতরাং হাজ্জের জন্য আরো একটি সাঈ করা ফরয।
কেননা সহীহ বুখারী ও মুসলিমে আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, অতঃপর যারা উমরার ইহরাম (হাজ্জে তামাত্তু) করেছিল তারা বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করে সাফা ও মারওয়ার সাঈ করল, অতঃপর হালাল হয়ে গেল। তারপর মিনা থেকে ফিরে এসে তাদের হাজ্জের জন্য আরো একটি সাঈ করল। পক্ষান্তরে যারা হাজ্জ ও উমরা একত্রিত করে (হাজ্জে কিরানের) ইহরাম করেছিল তারা মাত্র একটি সাঈ করে।
আর আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহ এমন ব্যক্তির হাজ্জ ও উমরা কবুল করেন না যে সাফা ও মারওয়ার সাঈ করে না।[14]
আর ইবনু আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, অতঃপর আল্লাহর রসূল (সা.) তারবিয়ার দিনের (৮ যিলহজ্জ) বৈকালে আমাদেরকে হাজ্জের ইহরাম করার নির্দেশ দিলেন। তারপর আমরা হাজ্জের কার্যাবলী সমাপ্ত করলে বায়তুল্লাহর তাওয়াফ এবং সাফা ও মারওয়ার সাঈ করি। এরপর আমাদের হাজ্জ সম্পূর্ণ হয়ে যায় এবং আমাদের উপর হাদী (কুরবানী) ওযাজিব হয়ে যায়।[15]
আর যে ব্যক্তি হাজ্জে ইফরাদ বা কিরান করবে, সে যদি তাওয়াফে কুদূমের পরে সাফা ও মারওয়ার সাঈ করে নিয়ে থাকে তাহলে আর সাঈ করার কোন প্রয়োজন নেই। কারণ, সাহাবী জাবির (রা.) বলেন, নাবী (সা.) ও তাঁর সাহাবীগণ সাফা ও মারওয়ার মাঝে প্রথম একটি সাঈর বেশী করেননি।[16]
তবে যদি কোন ব্যক্তি তাওয়াফে কুদূমের পরে সাঈ না করে থাকে তাহলে তার উপর সাঈ করা ফরয। কারণ, সাঈ ব্যতীত হাজ্জ সম্পূর্ণ হয় না, যেমনটি আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, যা উপরে উল্লেখ করা হয়েছে।
আর ইফরাদ বা কিরান হাজ্জ সম্পাদনকারী ব্যক্তি যখন তাওয়াফে ইফাযাহ করে হাজ্জের জন্য তার পরে কিংবা তার পূর্বে সাঈ করে নিবে তখন সে দ্বিতীয় পর্বে (সম্পূর্ণরূপে) হালাল হয়ে যাবে। ফলে তার জন্য ইহরামের অবস্থায় নিষিদ্ধ সমস্ত কাজ হালাল হয়ে যাবে। কেননা আব্দুল্লাহ বিন উমার (রা.) নাবী (সা.)-এর হাজ্জের বিবরণ সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে; তিনি বলেন: নাবী (সা.) কুরবানীর দিন নিজ হাদী (কুরবানীর পশু) যবহ করেন। তারপর মক্কা গিয়ে বায়তুল্লাহর তাওয়াফে ইফাযাহ করেন। অতঃপর ইহরাম অবস্থায় যা কিছুই হারাম ছিল তা হতে হালাল হয়ে যান।[17]
[2]. সহীহ বুখারী ১৭৫০।
[3]. সূরাহ্ আল-হাজ্জঃ ৩২
[4]. সহীহ ইবনে খুযাইমাহ ২৮৮২।
[5]. সূরাহ্ আল-ফাত্হঃ ২৭
[6]. সহীহ মুসলিম ১৩০৫।
[7]. সহীহ বুখারী ১৭২৭-১৭২৮।
[8]. সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম ১২৯৭।
[9]. সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম ১১৮৯।
[10]. সহীহ মুসলিম ১১৯১।
[11]. সূরা আল-হাজ্জ ২২ঃ ২৯
[12]. সহীহ মুসলিম ১২১৮।
[13]. সহীহ বুখারী ১৭৩৩ ও সহীহ মুসলিম।
[14]. সহীহ মুসলিম ১২৭৭।
[15]. সহীহ বুখারী ১৫৭২।
[16]. সহীহ মুসলিম ১২১৫।
[17]. সহীহ বুখারী ১৬৯১, সহীহ মুসলিম ১২২৭।।