কর্মভেদে মানুষ দু’শ্রেণীতে বিভক্ত। তাদের মধ্যে প্রথম প্রকার হচ্ছে, কাফের-যারা দুনিয়ার চেষ্টায় মৃত্যু পর্যন্ত ব্যস্ত থাকে। দ্বিতীয় প্রকার হচ্ছে, মুমিন- যারা মৃত্যু পর্যন্ত আখেরাতের চেষ্টায় ব্যস্ত থাকে। আখেরাতের চেষ্টায় নিয়োজিত মুমিনরা আবার দু’প্রকার:
প্রথম প্রকারঃ এ প্রকার মুমিন শুধুমাত্র ইবাদত নিয়ে ব্যস্ত থাকে। ফলে, মৃত্যুর সাথে সাথে তাদের আমল বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, আর তাদের আমলনামাও বন্ধ হয়ে যায়।
দ্বিতীয় প্রকারঃ এ প্রকার মুমিন শুধু ইবাদত নিয়ে ব্যস্ত থাকে না; বরং তারা আল্লাহর দিকে আহবান করে, সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করে, দ্বীন শিক্ষা করে ও অন্যকে দ্বীন শিক্ষা দেয়, সৃষ্টির প্রতি সদয় হয়। এ শ্রেণীর মুমিন সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী এবং মৃত্যুর পরও তাদের আমল চালু থাকে। আর প্রত্যহ তাদের আমলনামা নেকী দ্বারা পূর্ণ হতে থাকে।
১। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(أَجَعَلْتُمْ سِقَايَةَ الْحَاجِّ وَعِمَارَةَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ كَمَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَجَاهَدَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ لَا يَسْتَوُونَ عِنْدَ اللَّهِ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ (19) الَّذِينَ آمَنُوا وَهَاجَرُوا وَجَاهَدُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ أَعْظَمُ دَرَجَةً عِنْدَ اللَّهِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْفَائِزُونَ (20) يُبَشِّرُهُمْ رَبُّهُمْ بِرَحْمَةٍ مِنْهُ وَرِضْوَانٍ وَجَنَّاتٍ لَهُمْ فِيهَا نَعِيمٌ مُقِيمٌ (21) خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا إِنَّ اللَّهَ عِنْدَهُ أَجْرٌ عَظِيمٌ (22)) ... [التوبة: 19 - 22]
‘তোমরা কি হাজীদের পানি পান করানো ও মসজিদুল হারাম আবাদ করাকে ঐ ব্যক্তির মত বিবেচনা কর, যে আল্লাহ ও শেষ দিবসের প্রতি ঈমান এনেছে এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করেছে। তারা আল্লাহর নিকট বরাবর নয়। আর আল্লাহ যালিম সম্প্রদায়কে হেদায়াত দেন না। (১৯) যারা ঈমান এনেছে, হিজরত করেছে আর আল্লাহর পথে নিজেদের মাল ও জান দিয়ে জিহাদ করেছে, আল্লাহর কাছে তারা বড়ই মর্যাদাবান আর তারাই সফলকাম। (২০) তাদের প্রতিপালক তাদেরকে নিজের পক্ষ হতে সুসংবাদ দিচ্ছেন রহমত ও সন্তুষ্টির এবং এমন জান্নাতসমূহের, যাতে রয়েছে তাদের জন্য স্থায়ী নেয়ামত। (২১) তথায় তারা থাকবে চিরকাল। নিশ্চয় আল্লাহর নিকট রয়েছে মহা পুরস্কার’ (সূরা আত-তাওবা: ১৯-২২)।
وَعَنْ أَبِي مَسْعُودٍ الأَنْصَارِيّ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ: جَاءَ رَجُلٌ إلَى النّبِيّ - صلى الله عليه وسلم -فَقَالَ: إنّي أُبْدِعَ بِي فَاحْمِلْنِي، فَقَالَ: «مَا عِنْدِي» فَقَالَ رَجُلٌ: يَا رَسُولَ الله أَنَا أَدُلّهُ عَلَىَ مَنْ يَحْمِلُهُ، فَقَالَ رَسُولُ اللهِ - صلى الله عليه وسلم -: «مَنْ دَلّ علىَ خَيْرٍ فَلَهُ مِثْلُ أَجْرِ فَاعِلِهِ» أخرجه مسلم برقم (1893)
২। আবু মাস‘ঊদ আনছারী (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা এক লোক নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর কাছে উপস্থিত হয়ে বললেন, আমার বাহন নষ্ট হয়ে গেছে, আপনি আমাকে একটি বাহন দিন। তিনি বললেন: আমার কাছে তো তা নেই। সে সময় এক ব্যক্তি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি এমন এক ব্যক্তির সন্ধান তাকে দিচ্ছি, যে তাকে বাহন দিতে পারবে। রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন: যে ব্যক্তি কোন ভাল আমলের পথ প্রদর্শন করে, তার জন্য আমলকারীর সমান ছওয়াব রয়েছে’ (ছহীহ মুসলিম, হা/১৮৩৯)।
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ أَنَّ رَسُولَ اللهِ - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «مَنْ دَعَا إِلَى هُدى كَانَ لَهُ مِنَ الأَجْرِ مِثْلُ أُجُورِ مَنْ تَبِعَهُ، لاَ يَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ أُجُورِهِمْ شَيْئاً، وَمَنْ دَعَا إِلَى ضَلاَلَةٍ، كَانَ عَلَيْهِ مِنَ الإِثْمِ مِثْلُ آثَامِ مَنْ تَبِعَهُ لاَ يَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ آثَامِهِمْ شَيْئاً». أخرجه مسلم برقم (2674)
৩। আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত। রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন: যে ব্যক্তি হেদায়াতের দিকে ডাকে, তার জন্য সে পথের অনুসারীদের প্রতিদানের সমান প্রতিদান রয়েছে। এতে তাদের প্রতিদান হতে সামান্য ঘাটতি হবে না। পক্ষান্তরে, যে ব্যক্তি পথভ্রষ্টতার দিকে ডাকে, তার উপর সে রাস্তার অনুসারীদের পাপের অনুরূপ পাপ বর্তাবে। এতে তাদের পাপরাশি সামান্য হালকাও হবে না’ (ছহীহ মুসলিম, হা/২৬৭৪)।
সমগ্র মুসলিম জাতির উপর কর্তব্য হলো, আল্লাহর দিকে দা‘ওয়াত দেওয়া। অমুসলিমদেরকে আল্লাহর দিকে দা‘ওয়াত দেওয়া সমস্ত মুসলিমের উপর ওয়াজিব। কেননা, আল্লাহর দিকে দা‘ওয়াতের মাধ্যমে সবচেয়ে বড় গিরা খুলে যায়। আর মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বড় গিরা হচ্ছে কুফর এবং শিরকের গিরা। আর যখনই এ গিরাটি খুলে যায়, তখনই অন্যান্য সব গিরা খুলে যায়।
বিভিন্ন মাসআলা-মাসায়েলে ফাতাওয়া দেওয়ার বিষয়টি আলেমগণের সাথে নির্দিষ্ট। যার ফাতওয়া জানা থাকবে, তিনি ফাতওয়া দিবেন। আর জানা না থাকলে প্রশ্নকারীকে এমন সব আলেমের সন্ধান দিবেন, যাদেরকে আল্লাহ অধিক জ্ঞান, তীক্ষ্ণ বুঝ-শক্তি ও মুখস্থ-শক্তি দ্বারা বিশেষিত করেছেন। এক্ষেত্রে আলেমগণ ভাল কাজের দিক-নির্দেশনাকারী হিসাবে তা পালনকারীর মতই প্রতিদান পাবেন।
ছাহাবীগণের মধ্যে সবাই ফাওওয়া দিতেন না, বরং একজন আরেকজনের কাছে ফাতওয়া ঠেলে দিতেন। তাদের মাঝে খুব কম সংখ্যক মুফতীই ছিলেন। মুফতীগণের মধ্যে আলী, মু‘আয, যায়েদ ইবনে ছাবেত, ইবনে আববাস এবং ইবনে উমার (রা.) অন্যতম। অতএব, সবার জন্য ফাওওয়া দেয়া বৈধ নয়, যাতে মানুষ আল্লাহ তা‘আলার ব্যাপারে (ভুল ফৎওয়ার কারণে) অসত্য কথা বলতে না পারে। সেজন্য আলেম এবং ফক্বীহগণই ফাওওয়া দিবেন। যেমন- আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ (43)) ... [النحل: 43]
‘যদি তোমরা না জান, তবে জ্ঞানীদের জিজ্ঞেস কর’ (সূরা আন-নাহল: ৪৩)।
তবে, দা‘ওয়াতী ক্ষেত্রে প্রত্যেকেই তার জ্ঞান অনুযায়ী এবং কুরআন জানা অনুপাতে দা‘ওয়াত দিবে। আর কুরআন জানার সর্বনিম্ন পরিমাণ হচ্ছে, এক আয়াত। অতএব, এউম্মতের প্রত্যেকের উপর দা‘ওয়াতী কাজ, সৎকাজের আদেশ এবং অসৎকাজে নিষেধ করা ওয়াজিব। ছালাত, যাকাত ইত্যাদির বিধি-বিধান নাযিল হওয়ার পূর্ব থেকেই ছাহাবীগণ আল্লাহর দিকে দা‘ওয়াতী কাজ করতেন। মহান আল্লাহ এ মুসলিম জাতিকে দা‘ওয়াতের জন্য বাছাই করেছেন, যেমনভাবে তিনি তার দিকে আহবানকারী হিসাবে নবীগণকে মনোনীত করেছিলেন। তিনি তাদেরকে মর্যাদা দিয়েছেন এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত আল্লাহর দিকে দা‘ওয়াত দানের দায়িত্ব দিয়েছেন।
১। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ (104)) ... [آل عمران: 104]
‘আর যেন তোমাদের মধ্য থেকে এমন একটি দল হয়, যারা কল্যাণের দিকে আহবান করবে, ভাল কাজের আদেশ দেবে এবং মন্দ কাজ হতে নিষেধ করবে। আর তারাই সফলকাম’ (সূরা আলে ইমরান: ১০৪)।
২। আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
(وَالْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ يَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَيُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَيُطِيعُونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ أُولَئِكَ سَيَرْحَمُهُمُ اللَّهُ إِنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ ) [التوبة: 71]
‘আর মুমিন পুরুষ এবং মুমিন নারীরা একে অপরের বন্ধু, তারা ভাল কাজের আদেশ দেয় আর অন্যায় কাজ থেকে নিষেধ করে, আর তারা ছালাত ক্বায়েম করে, যাকাত প্রদান করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে। এদেরকে আল্লাহ শীঘ্রই দয়া করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়’ (সূরা আত-তাওবা: ৭১)।
৩। আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
(كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَتُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَلَوْ آمَنَ أَهْلُ الْكِتَابِ لَكَانَ خَيْرًا لَهُمْ مِنْهُمُ الْمُؤْمِنُونَ وَأَكْثَرُهُمُ الْفَاسِقُونَ) [آل عمران: 110]
‘তোমরা হলো সর্বোত্তম উম্মত, যাদেরকে মানুষের জন্য বের করা হয়েছে। তোমরা ভাল কাজের আদেশ দেবে এবং মন্দ কাজ থেকে বারণ করবে, আর আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে। আর যদি আহলে কিতাব ঈমান আনত, তবে অবশ্যই তা তাদের জন্য কল্যাণকর হত। তাদের কতক ঈমানদার। আর তাদের অধিকাংশই ফাসিক’ (সূরা আলে ইমরান: ১১০)।
মুসলিম নর-নারীর উপর আবশ্যক কর্তব্য দু’টিঃ
প্রথম কর্তব্য: দ্বীনের আমল করা, একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করা, যার কোন শরীক নেই, আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য করা, আল্লাহ তা‘আলা যা নির্দেশ করেছেন, তা পালন করাআর তিনি যা নিষেধ করেছেন, তা থেকে বিরত থাকা।
১। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَاعْبُدُوا اللَّهَ وَلَا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا) [النساء: 36].
‘তোমরা ইবাদত কর আল্লাহর, তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক করো না’ (সূরা আন-নিসা: ৩৬)।
২। আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
(يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَلَا تَوَلَّوْا عَنْهُ وَأَنْتُمْ تَسْمَعُونَ (20)) ... [الأنفال: 20].
‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর এবং তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিও না, অথচ তোমরা শুনছ’(সূরা আল-আনফাল:২০)।
৩। আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
(وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ (7)) ... [الحشر: 7].
‘রাসূল তোমাদের যা দেন,তা গ্রহণ কর, আর যা থেকে তিনি তোমাদের নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত হও এবং আল্লাহকেই ভয় কর, নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তিদানে কঠোর’(সূরা আল-হাশর: ৭)।
দ্বিতীয় কর্তব্য: আল্লাহর দিকে দা‘ওয়াত দান, সৎকাজের আদেশ এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করা।
১। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ (104)) [آل عمران: 104].
‘আর যেন তোমাদের মধ্য থেকে এমন একটি দল হয়, যারা কল্যাণের দিকে আহবান করবে, ভাল কাজের আদেশ দেবে এবং মন্দ কাজ হতে নিষেধ করবে। আর তারাই সফলকাম’ (সূরা আলে ইমরান: ১০৪)।
وَعَنْ عَبْدِاللهِ بْنِ عَمْرو رَضِيَ اللهُ عَنْهُما أنَّ النَّبِيَّ - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «بَلِّغُوا عَنِّي وَلَوْ آيَةً». أخرجه البخاري برقم (3461)
২। আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রা.) হতে বর্ণিত। রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন: আমার পক্ষ থেকে একটি আয়াত (বাক্য) হলেও পৌঁছিয়ে দাও (ছহীহ বুখারী: ৩৪৬১)।
وَعَنْ أبِي سَعِيدٍ الخُدْرِيِّ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ - صلى الله عليه وسلم - يَقُولُ: «مَنْ رَأى مِنْكُمْ مُنْكَراً فَلْيُغَيِّرْهُ بِيَدِهِ، فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِلِسَانِهِ، فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِقَلْبِهِ، وَذَلِكَ أضْعَفُ الإِيمَانِ». أخرجه مسلم برقم (49)
৩। আবু সা‘ঈদ খুদরী (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন: আমি রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন: তোমাদের কেউ গর্হিত কাজ হতে দেখলে সে যেন স্বহস্তে (শক্তি প্রয়োগে) পরিবর্তন করে দেয়, যদি তার সে ক্ষমতা না থাকে, তবে মুখ (বাক্য) দ্বারা এর পরিবর্তন করবে। আর যদি সে সাধ্যও না থাকে, তখন অন্তর দ্বারা করবে, তবে এটা ঈমানের দুর্বলতম পরিচায়ক (ছহীহ মুসলিম: ৪৯)।
আল্লাহর দিকে আহবানকারী দা‘ওয়াতী কাজ করলে তিনি দু’টি অবস্থার মুখোমুখি হনঃ
(ক) মানুষের ব্যাপক সাড়া পাওয়া। যেমনটি নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বেলায় হয়েছিল, যখন মদীনাবাসীরা তাকে সাদরে গ্রহণ করেছিলেন এবং তার আগমনে আনন্দিত হয়েছিলেন।
(খ) জনগণের সরে যাওয়া। যেমনটি নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বেলায় হয়েছিল, যখন তায়েফের নেতারা প্রত্যাখ্যান করেছিল এবং তার বিরুদ্ধে নির্বোধ ও শিশুদেরকে উস্কে দিয়েছিল, এমনকি তারা তাকে পাথর দিয়ে প্রহার করেছিল। মহান আল্লাহ তাঁর অলী-আউলিয়াকে তার শত্রুদের নিকট সমর্পণ করেন না। তবে, সর্বজ্ঞাত, প্রজ্ঞাময় আল্লাহ তা‘আলা কখনো কখনো দাঈকে শিক্ষা দেন এবং কখনও কষনও তার মাধ্যমে অন্যকে শিক্ষা দেন।
মানুষের ব্যাপক সাড়া দাঈর জন্য বেশি কঠিক এবং মারাত্মক। এক্ষেত্রে তার অহংকার আসতে পারে, তাকে পদমর্যাদায় ভূষিত করার প্রস্তাব দেয়া হতে পারে। ফলে, তিনি দুনিয়ার ফিতনার সম্মুখীন হতে পারেন।
আর এগুলি দাঈকে দ্বীনের দা‘ওয়াত দেয়া থেকে বিরত রাখতে এবং দুনিয়া, ধন-সম্পদ, পদমর্যাদা ও বিভিন্ন বিষয়ের মাধ্যমে দ্বীন থেকে অন্যমনস্ক রাখতে শয়তানের অপচেষ্টা মাত্র।
তবে, জনগণ দূরে সরে গেলে এবং দা‘ওয়াত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে তা দাঈর জন্য বেশি উত্তম এবং তার শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে বেশি শক্তিশালী। কেননা, এর মাধ্যমে দাঈ বেশি বেশি আল্লাহমুখী হয়। এর ফলে নেমে আসে আল্লাহর সাহায্য, যেমনটি নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর ক্ষেত্রে ঘটেছিল; যখন তায়েফবাসী তাকে তাড়িয়ে দিয়েছিল, তখন তিনি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলেন এবং আল্লাহ তাকে জিবরীল (আ.) ও পাহাড়ের দায়িত্বে নিয়োজিত ফেরেশতা দ্বারা সাহায্য করেছিলেন। অতঃপর সসম্মানে তার মক্কায় প্রবেশের বিষয়টি তাঁর জন্য সহজ করেছিলেন। অতঃপর ইসরা ও মি‘রাজের মাধ্যমে তাকে সম্মানিত করেছিলেন। তারপর মদীনায় হিজরতের বিষয়টিও তার জন্য সহজ করেছিলেন। অবশেষে, ইসলামের বিজয় এবং যমীনে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার ব্যাপারটিও সহজ করে দিয়েছিলেন।
১। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(أَحَسِبَ النَّاسُ أَنْ يُتْرَكُوا أَنْ يَقُولُوا آمَنَّا وَهُمْ لَا يُفْتَنُونَ (2) وَلَقَدْ فَتَنَّا الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ فَلَيَعْلَمَنَّ اللَّهُ الَّذِينَ صَدَقُوا وَلَيَعْلَمَنَّ الْكَاذِبِينَ (3)) [العنكبوت: 2 - 3]
‘মানুষ কি মনে করে যে, ‘আমরা ঈমান এনেছি’ বললেই তাদের ছেড়ে দেয়া হবে, আর তাদের পরীক্ষা করা হবে না? (২) আর আমি তো তাদের পূর্ববর্তীদের পরীক্ষা করেছি। ফলে,আল্লাহ অবশ্যই জেনে নেবেন যে, কারা সত্য বলে এবং অবশ্যই তিনি জেনে নেবেন, কারা মিথ্যাবাদী’ (সূরা আল-আনকাবূত: ২-৩)।
وَعَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا أَنّهَا قَالَتْ لِرَسُولِ اللهِ - صلى الله عليه وسلم -: يَا رَسُولَ اللهِ! هَلْ أَتَى عَلَيْكَ يَوْمٌ كَانَ أَشَدَّ مِنْ يَوْمِ أُحُدٍ؟ فَقَالَ: «لَقَدْ لَقِيتُ مِنْ قَوْمِكِ، وَكَانَ أَشَدّ مَا لَقِيتُ مِنْهُمْ يَوْمَ العَقَبَةِ، إذْ عَرَضْتُ نَفْسِي عَلَى ابْنِ عَبْدِ يَالِيلَ بْنِ عَبْدِ كُلاَلٍ، فَلَمْ يُجِبْنِي إلَى مَا أَرَدْتُ، فَانْطَلَقْتُ وَأَنَا مَهْمُومٌ عَلَى وَجْهِي، فَلَمْ أَسْتَفِقْ إلاّبِقَرْنِ الثّعَالِبِ.فَرَفَعْتُ رَأْسِي فَإذَا أَنَا بِسَحَابَةٍ قَدْ أَظَلّتْنِي، فَنَظَرْتُ فَإذَا فِيهَا جِبْرِيلُ، فَنَادَانِي. فَقَالَ: إنّ الله عَزّ وَجَلّ قَدْ سَمِعَ قَوْلَ قَوْمِكَ لَكَ وَمَا رَدّوا عَلَيْكَ، وَقَدْ بَعَثَ إلَيْكَ مَلَكَ الجِبَالِ لِتَأْمُرَهُ بِمَا شِئْتَ فِيهِمْ. قَالَ: فَنَادَانِي مَلَكُ الجِبَالِ وَسَلّمَ عَلَيّ. ثُمّ قَالَ: يَا مُحَمّدُ! إنّ الله قَدْ سَمِعَ قَوْلَ قَوْمِكَ لَكَ، وَأَنَا مَلَكُ الجِبَالِ، وَقَدْ بَعَثَنِي رَبّكَ إِلَيْكَ لِتَأْمُرَنِي بِأَمْرِكَ. فَمَا شِئْتَ؟ إنْ شِئْتَ أَنْ أُطْبِقَ عَلَيْهِمُ الأَخْشَبَيْنِ». فَقَالَ لَهُ رَسُولُ اللهِ - صلى الله عليه وسلم -: «بَلْ أَرْجُو أَنْ يُخْرِجَ الله مِنْ أَصْلاَبِهِمْ مَنْ يَعْبُد الله وَحْدَهُ، لاَ يُشْرِكُ بِهِ شَيْئاً». متفق عليه، أخرجه البخاري برقم (3231) , ومسلم برقم (1795)، واللفظ له
২। আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি একদা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে জিজ্ঞেস করলেন: হে আল্লাহর রাসূল! আপনার জীবনে কি উহুদ দিবসের চেয়েও অধিকতর কঠিন কোন দিন এসেছে? তিনি বললেন, তোমার সম্প্রদায়ের হাতে ‘আক্বাবার’ দিন যে নির্যাতনের শিকার হয়েছি, তা এরচেয়েও অধিকতর কঠিন ছিল, যখন আমি (আল্লাহর পানে দা‘ওয়াত দিতে গিয়ে) ইবনু ‘আব্দে ইয়ালীল ইবনু আব্দে কিলালের কাছে নিজেকে পেশ করছিলাম। কিন্তু সে আমার কাঙ্ক্ষিত ডাকে সাড়া দেয়নি। তখন আমি অত্যন্ত বিষণ্ণ অবস্থায় সম্মুখের দিকে চলতে লাগলাম এবং কারনুছ-ছা‘আলিব নামক স্থানে না পৌঁছা পর্যন্ত আমি সংজ্ঞা ফিরে পাইনি। তারপর যখন আমি মাথা উঠালাম, তখন দেখলাম, একখণ্ড মেঘ আমাকে ছায়া দিয়ে রেখেছে এবং এর মধ্যে জিবরীল (আ.) কে দেখতে পেলাম। তিনি আমাকে ডাক দিয়ে বললেন, মহা মহিমান্বিত আল্লাহ আপনার ব্যাপারে আপনার সম্প্রদায়ের উক্তি এবং আপনার বিরুদ্ধে তাদের উত্তরও শুনেছেন এবং তিনি আপনার নিকট পাহাড়ের ফেরেশ্তাকে পাঠিয়েছেন, যেন আপনি আপনার সম্প্রদায়ের লোকজনের ব্যাপারে যেরূপ ইচ্ছা সেরূপ আদেশ করেন। তখন পাহাড়ের ফেরেশ্তাও আমাকে ডাক দিলেন এবং আমাকে সালাম দিলেন। তারপর বললেন, ‘‘হে মুহাম্মাদ! আপনার প্রতি আপনার সম্প্রদায়ের লোকজনের উক্তি আল্লাহ তা‘আলা শুনেছেন। আমি পাহাড়ের দায়িত্বে নিয়োজিত ফেরেশতা, আপনার রব আমাকে আপনার নিকট পাঠিয়েছেন, যেন আপনি আপনার ইচ্ছামত আমাকে নির্দেশ দেন। আপনি কি করতে চান? (আপনি বললে) আমি এ পাহাড় দু’টিকে তাদের উপর চাপা দিয়ে দিব। তখন রাসূল(ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন: আমি বরং আশা করছি যে, আল্লাহ তা‘আলা হয়তো এদের ঔরশ থেকেই এমন ব্যক্তি বের করে আনবেন, যারা তার সঙ্গে কোন কিছুকে শরীক না করে এক আল্লাহর ‘ইবাদত করবে (ছহীহ বুখারী, হা/৩২৩১; ছহীহ মুসলিম, হা/১৭৯৫)।
দ্বীনের মূল ভিত্তি দু’টি। হক্বের (আল্লাহর) উপর পূর্ণ বিশ্বাস, সৃষ্টির প্রতি পূর্ণ দয়া। হকেবর উপর দৃঢ় বিশ্বাসই (ঈমান) দাঈকে সৃষ্টির মন্দ বিষয় থেকে বিরত রাখবে। আর সৃষ্টির প্রতি পূর্ণ দয়াই দাঈকে সৃষ্টির ক্ষতি করা থেকে প্রতিহত করবে। ফলে, ঈমান শক্তিশালী করার মাধ্যমে মানুষের সকল ধরণের ক্ষতি করা থেকে আমরা বিরত থাকবো। অনুরূপভাবে, মন্দ লোকদের প্রতি অতি দয়ার কারণে তারাও দাঈর পক্ষ থেকে নিরাপদে থাকবে। এভাবে হেদায়াত ও কল্যাণ অর্জিত হবে, আর দ্বীনের প্রতি মানুষের হৃদয় ঝুঁকে পড়বে।
১। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمَنْ يَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ فَهُوَ حَسْبُهُ إِنَّ اللَّهَ بَالِغُ أَمْرِهِ قَدْ جَعَلَ اللَّهُ لِكُلِّ شَيْءٍ قَدْرًا (3)) [الطلاق: 3]
‘আর যে আল্লাহরউপর তাওয়াক্কুল করে, আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট। আল্লাহ তাঁর উদ্দেশ্য পূর্ণ করবেনই। নিশ্চয় আল্লাহ প্রত্যেক জিনিসের জন্য একটি সময়-সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন’ (সূরা আত-ত্বলাক: ৩)।
২। আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
(يَاأَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ وَإِنْ لَمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ وَاللَّهُ يَعْصِمُكَ مِنَ النَّاسِ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْكَافِرِينَ (67)) [المائدة: 67]
‘হে রাসূল! তোমার রবের পক্ষ হতে তোমার নিকট যা নাযিল করা হয়েছে, তা পৌঁছে দাও এবং যদি তুমি না কর, তবে তুমি তাঁর রিছালাত পৌঁছালে না। আর আল্লাহ তোমাকে মানুষ থেকে রক্ষা করবেন। নিশ্চয় আল্লাহকাফের সম্প্রদায়কে হেদায়াত করেন না’ (সূরা আল-মায়েদা: ৬৭)।
৩। আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন::
(وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا رَحْمَةً لِلْعَالَمِينَ) ... [الأنبياء: 107]
‘আর আমি তো তোমাকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমত হিসাবেই প্রেরণ করেছি’(সূরা আল-আম্বিয়া:১০৭)।
وَعَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِاللهِ رَضِيَ اللهُ عَنْهما أنَّهُ غَزَا مَعَ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم قِبَلَ نَجْدٍ، فَلَمَّا قَفَلَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَفَلَ مَعَهُ، فَأدْرَكَتْهُمُ القَائِلَةُ فِي وَادٍ كَثِيرِ العِضَاهِ، فَنَزَلَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم وَتَفَرَّقَ النَّاسُ فِي العِضَاهِ يَسْتَظِلُّونَ بِالشَّجَرِ، وَنَزَلَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم تَحْتَ سَمُرَةٍ فَعَلَّقَ بِهَا سَيْفَهُ. قال جَابِرٌ: فَنِمْنَا نَوْمَةً، ثُمَّ إِذَا رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَدْعُونَا فَجِئْنَاهُ، فَإِذَا عِنْدَهُ أعْرَابِيٌّ جَالِسٌ، فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم : «إِنَّ هَذَا اخْتَرَطَ سَيْفِي وَأنَا نَائِمٌ، فَاسْتَيْقَظْتُ وَهُوَ فِي يَدِهِ صَلْتاً، فَقَالَ لِي: مَنْ يَمْنَعُكَ مِنِّي؟ قُلْتُ: اللهُ، فَهَا هُوَ ذَا جَالِسٌ». ثُمَّ لَمْ يُعَاقِبْهُ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم متفق عليه، أخرجه البخاري برقم (4135) , واللفظ له، ومسلم برقم (843)
৪। জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি নাজদ এলাকায় রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। যুদ্ধ শেষে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যাবর্তন করলে তিনিও তার সঙ্গে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। পথিমধ্যে কাটা গাছ ভরা এক উপত্যকায় মধ্যাহ্নের সময় তাদের ভীষণ গরম অনুভূত হলো। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এখানেই অবতরণ করলেন। লোকজন ছায়াদার বৃক্ষের খোঁজে কাঁটাবনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লেন। এদিকে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) একটি বাবলা গাছের নিচে অবস্থান করে তরবারিখানা গাছে ঝুলিয়ে রাখলেন। জাবের (রা.) বলেন, সবেমাত্র আমরা নিদ্রা গিয়েছি। এমন সময় রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমাদেরকে ডাকতে লাগলেন। আমরা তার কাছে উপস্থিত হলাম। তখন তার কাছে এক বেদুঈন বসেছিল। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, আমি নিদ্রিত অবস্থায় ছিলাম, এমতাবস্থায় সে আমার তরবারিখানা হস্তগত করে কোষমুক্ত অবস্থায় তা আমার উপর উচিয়ে ধরলে আমি জেগে যাই। তখন সে আমাকে বলল, এখন তোমাকে আমার হাত থেকে কে বাঁচাবে? আমি বললাম, আল্লাহ। দেখ না, এ-ই তো সে বসে আছে। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাকে কোন প্রকার শাস্তি দিলেন না (ছহীহ বুখারী, হা/৪১৩৫; ছহীহ মুসলিম, হা/৮৪৩)।
রবের প্রতি রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর পূর্ণ বিশ্বাসই আগন্তুককে রাসূলের ক্ষতি করা থেকে বিরত রাখে। রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর দয়াই আগন্তুককে হত্যা করা থেকে বিরত রাখে। আর এ দয়ার কারণেই আগন্তুত ও তার দলবল হেদায়াত লাভ করেন।
দ্বীন ইসলাম বিশ্ববাসীর জন্য রহমত স্বরূপ। আর নিয়্যতানুযায়ী প্রত্যেক দাঈকে প্রতিদান দেয়া হবে। রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আল্লাহর দিকে দা‘ওয়াত দিয়েছেন ও ইবাদত করেছেন। তিনি নিজেকে দিয়েই দা‘ওয়াতী কাজ শুরু করেন, তারপর পর্যায়ক্রমে তার পরিবার, নিকটাত্মীয়, তার জাতি, মক্কাবাসী ও এর চতুষ্পার্শ্বে বসবাসকারী লোকজন, আরববাসী এবং সকল শ্রেণীর মানুষকে আল্লাহর দিকে দা‘ওয়াত দিয়েছেন এই বলে যে, তিনি সমগ্র মানবমণ্ডলীর কাছে আল্লাহর রাসূল হিসাবে এবং সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য রহমত স্বরূপ প্রেরিত হয়েছেন। এর ফলে, মানুষ দলে দলে দ্বীনে প্রবেশ করেছে।
দাঈর নিয়্যতের ৮টি স্তর রয়েছেঃ
১। নিজেকে দিয়ে দা‘ওয়াত শুরু করা (أن يبدأ بنفسه):
আল্লাহ বলেন:
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قُوا أَنْفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا وَقُودُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُعَلَيْهَا مَلَائِكَةٌ غِلَاظٌ شِدَادٌ لَا يَعْصُونَ اللَّهَ مَا أَمَرَهُمْ وَيَفْعَلُونَ مَا يُؤْمَرُونَ
‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে সে অগ্নি থেকে রক্ষা কর, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও প্রস্ত্তর, যেখানে রয়েছে নির্মম ও কঠোর ফেরেশতাকূল, যারা আল্লাহ তাদেরকে যে নির্দেশ দিয়েছেন, সে ব্যাপারে অবাধ্য হয় না। আর তারা তা-ই করে, যা তাদেরকে আদেশ করা হয়’ (সূরা আত-তাহরীম: ৬)।
২। তারপর নিজের পরিবারকে দা‘ওয়াত দেয়া (ثم يدعو أهله):
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
وَأْمُرْ أَهْلَكَ بِالصَّلَاةِ وَاصْطَبِرْ عَلَيْهَا لَا نَسْأَلُكَ رِزْقًا نَحْنُ نَرْزُقُكَ وَالْعَاقِبَةُ لِلتَّقْوَى
‘আর তোমার পরিবার-পরিজনকে ছালাত আদায়ে আদেশ দাও এবং নিজেও তার উপর অবিচল থাক। আমি তোমার কাছে কোন রিযক চাই না। আমিই তোমাকে রিযক দেই আর শুভ পরিণাম তো মুত্তাকীদের জন্য’ (সূরা ত্বহা: ১৩২)।
৩। তারপর নিকটাত্নীয়কে দা‘ওয়াত দেয়া (ثم يدعو عشيرته الأقربين)
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
وَأَنْذِرْ عَشِيرَتَكَ الْأَقْرَبِينَ
‘আর তুমি তোমার নিকটাত্মীয়দেরকে সতর্ক কর’ (সূরা আশ-শু‘আরা: ২১৪)।
৪। তারপর নিজ ক্বওমের মানুষকে আল্লাহর দিকে দা‘ওয়াত দেয়া (ثم يدعو قومه إلى الله): আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
لِتُنْذِرَ قَوْمًا مَا أَتَاهُمْ مِنْ نَذِيرٍ مِنْ قَبْلِكَ لَعَلَّهُمْ يَهْتَدُونَ
‘যাতে আপনি এমন এক সম্প্রদায়কে সতর্ক করেন, যাদের কাছে তোমার পূর্বে কোন সতর্ককারী আসেনি। হয়তো তারা হেদায়াত লাভ করবে’(সূরা আস-সাজদা: ৩)।
৫। তারপর নিজ অঞ্চল ও তার চার পার্শ্বের লোকজনকে দা‘ওয়াত দেয়া (ثم يدعو أهل بلده وما حولها): আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
لِتُنْذِرَ أُمَّ الْقُرَى وَمَنْ حَوْلَهَا وَتُنْذِرَ يَوْمَ الْجَمْعِ لَا رَيْبَ فِيهِ فَرِيقٌ فِي الْجَنَّةِ وَفَرِيقٌ فِي السَّعِيرِ
‘যাতে আপনি মূল জনপদ ও তার আশপাশের বাসিন্দাদেরকে সতর্ক করতে পারেন, আর যাতে ‘একত্রিত হওয়ার দিন’-এর ব্যাপারে সতর্ক করতে পারেন, যাতে কোন সন্দেহ নেই, সেদিন একদল থাকবে জান্নাতে আরেক দল যাবে জ্বলন্ত আগুনে’ (সূরা আশ-শুরা: ৭)।
৬। তারপর আরবের বা নিজ দেশের সবাইকে দা‘ওয়াত দেয়া (ثم يدعو العرب قاطبة)
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
هُوَ الَّذِي بَعَثَ فِي الْأُمِّيِّينَ رَسُولًا مِنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِنْ كَانُوا مِنْ قَبْلُ لَفِي ضَلَالٍ مُبِينٍ
‘তিনিই নিরক্ষরদের মাঝে একজন রাসূল পাঠিয়েছেন তাদের মধ্য থেকে, যিনি তাদের কাছে তেলাওয়াত করেন তাঁর আয়াতসমূহ, তাদেরকে পবিত্র করেন এবং তাদেরকে শিক্ষা দেন কিতাব ও হিকমাত। যদিও ইতঃপূর্বে তারা স্পষ্ট গোমরাহীতে ছিল’ (সূরা আল-জুমু‘আ: ২)।
৭। তারপর ব্যাপকভাবে সব মানুষকে দা‘ওয়াত দেয়া (ثم يدعو الناس كافة)
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا كَافَّةً لِلنَّاسِ بَشِيرًا وَنَذِيرًا وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ
‘আর আমি তো কেবল তোমাকে সমগ্র মানবজাতির জন্য সুসংবাদ দাতা ও সতর্ককারী হিসাবে প্রেরণ করেছি; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না’ (সূরা সাবা: ২৮)।
৮। তারপর পৃথিবীর সব মানুষকে দা‘ওয়াত দেয়া। এমনকি জিন জাতি দাঈর কাছে আসলে তাদেরকেও দা‘ওয়াত দেয়া (ثم يدعو العالم كله من الناس، والجن إن حضروا لديه)
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا رَحْمَةً لِلْعَالَمِينَ
‘আর আমি তো তোমাকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমত হিসাবেই প্রেরণ করেছি’(সূরা আম্বিয়া: ১০৭)। আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
قُلْ أُوحِيَ إِلَيَّ أَنَّهُ اسْتَمَعَ نَفَرٌ مِنَ الْجِنِّ فَقَالُوا إِنَّا سَمِعْنَا قُرْآنًا عَجَبًا (*) يَهْدِي إِلَى الرُّشْدِ فَآمَنَّا بِهِ وَلَنْ نُشْرِكَ بِرَبِّنَا أَحَدًا
‘বল, ‘আমার প্রতি অহী করা হয়েছে যে, নিশ্চয় জিনদের একটি দল মনযোগ সহকারে শুনেছে। অতঃপর বলেছে- ‘আমরাতো এক বিস্ময়কর কুরআন শুনেছি, (১) যা সত্যের দিকে হেদায়াত করে; ফলে আমরা তাতে ঈমান এনেছি। আর আমরা কক্ষনো আমাদের রবের সাথে কাউকে শরীক করব না’ (সূরা আল-জিন: ১-২)।
মহান আল্লাহ মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে চারটি বিষয়ে নির্দেশ দান করেন:
(১) অহীর জ্ঞান শিক্ষা করা (أن يتعلم الوحي)
(২) অহীর জ্ঞানানুসারে আমল করা (وأن يعمل به)
(৩) মানুষকে অহীর জ্ঞান শিক্ষা দেয়া (وأن يعلِّمه الناس)
(ঘ) মানুষকে অহীর জ্ঞানের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখা (وأن يقيم الناس عليه)
নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর মৃত্যুর পর এ করণীয় বিষয়সমূহ আমাদের মুসলিমদের কাছে স্থানান্তরিত হয়েছে। সেজন্য, দ্বীনের ধাপ দু’টিঃ
১। ইবাদত করা।
২। আল্লাহর দিকে দা‘ওয়াত দেয়া।
আর নিজে সংশোধন হওয়ার প্রচেষ্টা করা এবং অন্যকে সংশোধন করারও চেষ্টা করা। এবিষয়ে আল্লাহ তা‘আলা যাকে চান, তাকে অনুগ্রহ করেন।
মুসলিমদের জন্য আবশ্যকীয় শিক্ষণীয় বিষয় দু’টিঃ
(ক) নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর প্রচেষ্টা। আর তা হচ্ছে, দা‘ওয়াত ।
(খ) নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর জীবনাদর্শ। আর এটাই হচ্ছে, পরিপূর্ণ দ্বীন।
নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর জীবনাদর্শ অনুসরণ না করে জাতির মাঝে দা‘ওয়াত চালু থাকলে সে দা‘ওয়াতে কল্যাণ ও মুক্তি নেই, তাতে হেদায়াত লাভ হবে না এবং আল্লাহর সাহায্যও আসবে না। কর্তৃত্ব, রাজত্বও খিলাফত ক্বায়েম হবে না এবং সম্মান ও নিরাপত্তাথাকবে না। নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তার ছাহাবীগণের ব্যাপারে এমন প্রচেষ্টা চালান, যাতে তাদের মধ্যে দু’টি বিষয়ের সৃষ্টি হয়ঃ
১। ছাহাবীগণের নিজেদের জীবনে দ্বীন প্রতিষ্ঠা করা (إقامة الدين في حياتهم)
২। সকল মানুষের মাঝে দ্বীন প্রতিষ্ঠা করা (وإقامة الدين في حياة الناس)
প্রত্যেক মুসলিমকে তাদের ব্যক্তিগত আমল তথা ইবাদত এবং সামষ্টিক আমল তথা আল্লাহর দিকে দা‘ওয়াত সম্পর্কে আল্লাহর নিকট অচিরেই হিসাব দিতে হবে। দাঈ ও দা‘ওয়াতপ্রাপ্ত ব্যক্তি উভয়কে আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়াবী কাজ-কর্ম সম্পর্কে ক্বিয়ামতের দিন জিজ্ঞেস করবেন।
১। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فَلَنَسْأَلَنَّ الَّذِينَ أُرْسِلَ إِلَيْهِمْ وَلَنَسْأَلَنَّ الْمُرْسَلِينَ (6) فَلَنَقُصَّنَّ عَلَيْهِمْ بِعِلْمٍ وَمَا كُنَّا غَائِبِينَ (7) وَالْوَزْنُ يَوْمَئِذٍ الْحَقُّ فَمَنْ ثَقُلَتْ مَوَازِينُهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ (8) وَمَنْ خَفَّتْ مَوَازِينُهُ فَأُولَئِكَ الَّذِينَ خَسِرُوا أَنْفُسَهُمْ بِمَا كَانُوا بِآيَاتِنَا يَظْلِمُونَ (9)) .. [الأعراف: 6 - 9]
‘সুতরাং আমি অবশ্যই তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করব, যাদের নিকট রাসূল প্রেরিত হয়েছিলেন এবং অবশ্যই আমি প্রেরিতদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করব। (৬) অতঃপর অবশ্যই আমি তাদের নিকট জেনে শুনে বর্ণনা করব। আর আমি তো অনুপস্থিত ছিলাম না। (৭) আর সেদিন পরিমাপ হবে যথাযথ। সুতরাং যাদের পাল্লা ভারি হবে, তারাই হবে সফলকাম। (৮) আর যাদের পাল্লা হালকা হবে, তারাই হবে সেই সব লোক, যারা নিজেদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। কারণ তারা আমার আয়াতসমূহের প্রতি (অস্বীকার করার মাধ্যমে) যুলম করত’ (সূরা আল-আ‘রাফ: ৬-৯)।
২। আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
(وَالْعَصْرِ (1) إِنَّ الْإِنْسَانَ لَفِي خُسْرٍ (2) إِلَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَتَوَاصَوْا بِالْحَقِّ وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ (3)) [العصر: 1 - 3].
‘মহাকালের শপথ, (১) মানুষ অবশ্যই ক্ষতিতে আছে। (২) তবে তারা ব্যতীত, যারা ঈমান আনে, সৎকাজ করে, পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দেয় এবং পরস্পরকে ধৈর্যের উপদেশ দেয়’ (সূরা আল-আছর: ১-৩)।
দাঈর প্রচেষ্টা দু’প্রকার:
(ক) নিজের জন্যই চেষ্টা করা। আর তা হলো, মৃত্যু পর্যন্ত আল্লাহর আনুগত্যে নিজেকে নিয়োজিত করা এবং তার ইবাদতে প্রতিষ্ঠিত রাখা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَالَّذِينَ جَاهَدُوا فِينَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا وَإِنَّ اللَّهَ لَمَعَ الْمُحْسِنِينَ ) [العنكبوت: 69]
‘আর যারা আমার পথে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়, তাদেরকে আমি অবশ্যই আমার পথে পরিচালিত করব। আর নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মশীলদের সাথেই আছেন’ (সূরা আল-আনকাবূত: ৬৯)।
(খ) অন্যদের জন্য প্রচেষ্টা করা। আর তা তিন প্রকার:
১। কাফেরদের জন্য চেষ্টা করা, হতে পারে তারা হেদায়াত লাভ করবে। যেমন আল্লাহ বলেন:
(أَمْ يَقُولُونَ افْتَرَاهُ بَلْ هُوَ الْحَقُّ مِنْ رَبِّكَ لِتُنْذِرَ قَوْمًا مَا أَتَاهُمْ مِنْ نَذِيرٍ مِنْ قَبْلِكَ لَعَلَّهُمْ يَهْتَدُونَ (3)) ... [السجدة: 3].
‘নাকি তারা বলে, ‘সে তা রচনা করেছে?’ বরং তা তোমার রবের পক্ষ থেকে সত্য, যাতে তুমি এমন কওমকে সতর্ক করতে পার, যাদের কাছে তোমার পূর্বে কোন সতর্ককারী আসেনি। হয়তো তারা হেদায়াত লাভ করবে’ (সূরা আস-সাজদা: ৩)।
২। অবাধ্য ও পাপীদের জন্য চেষ্টা করা, যাতে তারা আনুগত্যশীল হয় এবং অজ্ঞদের নিয়েও চেষ্টা করা, যাতে তারা দ্বীন বুঝে এবং উদাসীনদের নিয়েও কাজ করা, যাতে তারাও দ্বীনের কাজে নিয়োজিত থাকে। যেমন আল্লাহ বলেন:
(وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ (104)) [آل عمران: 104]
‘আর যেন তোমাদের মধ্য থেকে এমন একটি দল হয়, যারা কল্যাণের দিকে আহবান করবে, ভাল কাজের আদেশ দেবে এবং মন্দ কাজ হতে নিষেধ করবে। আর তারাই সফলকাম’ (সূরা আলে ইমরান: ১০৪)।
৩। সৎলোকদের জন্যও চেষ্টা করা, যাতে তারা অন্যকে সংশোধন করতে পারেন আলেমদের জন্যও চেষ্টা করা, যাতে তারা দ্বীন শিক্ষা দিতে পারেন এবং উপদেশ দাতাদের জন্যও চেষ্টা করা, যাতে তারাও অন্যকে আরো বেশি উপদেশ দিতে পারেন। আল্লাহ বলেন:
(وَالْعَصْرِ (1) إِنَّ الْإِنْسَانَ لَفِي خُسْرٍ (2) إِلَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَتَوَاصَوْا بِالْحَقِّ وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ (3)) [العصر: 1 - 3]
‘মহাকালের শপথ, (১) মানুষ অবশ্যই ক্ষতিতে আছে। (২) তবে তারা ব্যতীত, যারা ঈমান আনে, সৎকাজ করে, পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দেয় এবং পরস্পরকে ধৈর্যের উপদেশ দেয়’ (সূরা আল-আছর: ১-৩)।
আল্লাহ আরো বলেন:
(فَذَكِّرْ إِنَّمَا أَنْتَ مُذَكِّرٌ (21)) ... [الغاشية: 21]
‘অতএব, তুমি উপদেশ দাও, তুমি তো একজন উপদেশদাতা মাত্র’ (সূরা আল-গাশিয়াহ: ২১)।
নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর যুগে মানুষ গুরুত্বপূর্ণ কিছু কারণে প্রভাবিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করতেন। যেমন:
১। উত্তম চরিত্র (حسن الأخلاق): আল্লাহ বলেন:
وَإِنَّكَ لَعَلَى خُلُقٍ عَظِيمٍ
‘অবশ্যই তুমি মহান চরিত্রের উপর অধিষ্ঠিত’(সূরা আল-ক্বলাম:৪)।
২। উত্তম কথার মাধ্যমে দা‘ওয়াত দেয়া (الدعوة باللسان)।
যেমনটি নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আবূ বকর (রা.), খাদীজা (রা.), আলী (রা.) এবং অন্যকে সুন্দর কথার মাধ্যমে দা‘ওয়াত দিয়েছিলেন। ফলে, তারা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। আল্লাহ বলেন:
وَمَنْ أَحْسَنُ قَوْلًا مِمَّنْ دَعَا إِلَى اللَّهِ وَعَمِلَ صَالِحًا وَقَالَ إِنَّنِي مِنَ الْمُسْلِمِينَ
‘আর তার চেয়ে কার কথা উত্তম,যিনি আল্লাহর দিকে দা‘ওয়াত দেন, সৎকর্ম করেন এবং বলেন যে, অবশ্যই ‘আমি মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত’(সূরা হা-মীম সাজদা: ৩৩)।
৩। দ্বীন শিক্ষা দেয়া (التعليم):
যেমনটি কতিপয় ছাহাবী মক্কার দারুল আরক্বামে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। অনুরূপভাবে, উসাইদ ইবনে হুযাইর (রা.), সা‘দ ইবনু মু‘আয মদীনায় মুছ‘আব ইবনে উমাইর (রা.)-এর প্রতিষ্ঠিত দ্বীন শিক্ষার মজলিস থেকে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।
৪। ইবাদতের মাধ্যমে দা‘ওয়াত (العبادة):
যেমন-হিনদ বিনতে উতবাহ (রা.) মক্কা বিজয়ের বছর মসজিদে হারামে মুসলিমদের ছালাত আদায় করতে দেখে ইসলাম গ্রহণ করেন। ছুমামা ইবনে উছাল আল-হানাফী (রা.) মসজিদে নববীতে নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর চরিত্র ও ইবাদতেপ্রভাবিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন।
৫। ব্যয় ও দান করা (البذل والعطاء)।
মক্কা বিজয়ের বছর নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ছাফওয়ান ইবনে উমাইয়াহ (রা.) ও মু‘আবিয়াহ ইবনে আবু সুফইয়ান (রা.) কে কিছু ছাগল দান করলে তারা ইসলাম গ্রহণ করেন। এভাবে রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এক ব্যক্তিকে অনেকগুলি ছাগল উপহার দেন, এতে তিনি ও তার দলবল ইসলাম গ্রহণ করেন। এরকম আরো কারণ রয়েছে, যেগুলিকে আল্লাহ হেদায়াতের কারণ হিসাবে নির্ধারণ করেছেন।
দা‘ওয়াতী কাজে অংশগ্রহণকারীরা চার ধরনেরঃ
প্রথম: দাঈদের চারিত্রিক সৌন্দর্যে প্রভাবিত হয়ে কতিপয় মানুষ দা‘ওয়াতী কাজে অংশ নেয়। কিন্তু কোন দাঈর সাথে তার কোন সমস্যা সৃষ্টি হলে সে দা‘ওয়াতী কার্যক্রম ছেড়ে দেয় এবং দাঈদের সাথে শত্রুতা করে। এই ধরনের দাঈর ত্রুটিপূর্ণ উদ্দেশ্যের কারণে আল্লাহ তা‘আলা তাকে অন্য পথে পরিচালিত করেন।
দ্বিতীয়: কিছু দাঈ এমন আছে, যারা দা‘ওয়াতের মধ্যে তাদের সমস্যার সমাধান এবং চাহিদা পূরণের পথ খুঁজে পায়। যখনই তাদের অবস্থার উন্নতি ঘটে এবং দুনিয়াবী প্রভাব-প্রতিপত্তি ও ধন-সম্পদ বেড়ে যায়, তখনই দা‘ওয়াতী কার্যক্রম থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। এ ব্যক্তিকেও আল্লাহ তা‘আলা অন্য পথে ফিরিয়ে দেন। কেননা, সে ত্রুটিপূর্ণ উদ্দেশ্য নিয়ে দা‘ওয়াতী কাজে প্রবেশ করেছে।
তৃতীয়: কিছু দাঈ এমন আছে, যারা পূণ্য ও প্রতিদানের আশায় দা‘ওয়াতী কাজ করে। তারা শুধু নেকী হাছিল করতে চায়। তাদের উদ্দেশ্য তাদের নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এই প্রকার দাঈ যখন দা‘ওয়াতী কাজ ব্যতীত অন্য কাজে অপেক্ষাকৃত সহজে নেকী পায়, তখন দা‘ওয়াতী কাজ ছেড়ে দেয়।
চতুর্থ: যারা দা‘ওয়াতী কাজ করে এ কারণে যে, আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক মুসলিমের উপর দা‘ওয়াত দেয়া ফরয করেছেন। তারা ইবাদত করে, কারণ তা আল্লাহর নির্দেশ এবং দা‘ওয়াতী কাজ করে, কারণ তাও আল্লাহর নির্দেশ। এই প্রকার দাঈর উদ্দেশ্য পরিপূর্ণ। তাদের বিশুদ্ধ নিয়্যত ও বুঝের কারণে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে সাহায্য করেন এবং দা‘ওয়াতী কাজ ও আল্লাহর নির্দেশ বাস্তবায়নের জন্য সুযোগ করে দেন। এ শ্রেণীর দাঈগণ সর্বোচ্চ মর্যাদা ও সম্মানের অধিকারী। তার নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর পক্ষ থেকে প্রতিনিধি হিসাবে মুসলিম জাতির জন্য কাজ করে। মহান আল্লাহর নিকট প্রার্থন করি, তিনি যেন আমাদের সকলকে এ শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত করেন, যারা নবীগণের উত্তরাধিকারী। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمَنْ أَحْسَنُ قَوْلًا مِمَّنْ دَعَا إِلَى اللَّهِ وَعَمِلَ صَالِحًا وَقَالَ إِنَّنِي مِنَ الْمُسْلِمِينَ (33)) [فصلت: 33]
‘আর তার চেয়ে কার কথা উত্তম, যিনি আল্লাহর দিকে দা‘ওয়াত দেন, সৎকর্ম করেন এবং বলেন যে, অবশ্যই ‘আমি মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত’ (সূরা হা-মীম সাজদা: ৩৩)।
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو اللَّهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللَّهَ كَثِيرًا (21)) [الأحزاب: 21]
‘অবশ্যই তোমাদের জন্য রাসূলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ তাদের জন্য, যারা আল্লাহ ও পরকাল প্রত্যাশা করে এবং আল্লাহর অনেক যিকর করে’ (সূরা আল-আহযাব: ২১)।