আর নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শাফা‘আত সত্য। যা তিনি উম্মতের জন্য সংরক্ষিত রেখেছেন। যেমনটি বিভিন্ন হাদীছে বর্ণিত হয়েছে।

ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ বলেন,

وَالشَّفَاعَةُ الَّتِي ادَّخَرَهَا لَهُمْ حَقٌّ كَمَا رُوِيَ فِي الْأَخْبَارِ

‘‘আর নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শাফা‘আত সত্য। যা তিনি উম্মতের জন্য সংরক্ষিত রেখেছেন। যেমনটি বিভিন্ন হাদীছে বর্ণিত হয়েছে।

.....................................................................

ব্যাখ্যা: শাফা‘আত কয়েক প্রকার। এগুলোর মধ্য থেকে কতিপয় শাফাআতের ব্যাপারে উম্মত ঐকমত্য পোষণ করেছে। আর কতিপয়ের ব্যাপারে মুতাযেলা সম্প্রদায় এবং তাদের অনুরূপ অন্যান্য সম্প্রদায় ভিন্নমত পোষণ করেছে।

প্রথম প্রকার শাফা‘আত বা শাফা‘আতে উযমা (বৃহৎ)

(১) প্রথম প্রকার শাফা‘আত বা শাফা‘আতে উযমা (বৃহৎ): শাফা‘আতে উযমা হবে হাশরের মাঠে। এটি হবে বান্দাদের মধ্যে ফায়ছালা করার জন্যে আল্লাহ্ তা‘আলা যখন হাশরের ময়দানে আগমন করবেন। এটি হবে সমস্ত নাবী-রসূলদের মধ্য থেকে শুধু আমাদের নাবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্যে নির্দিষ্ট। সমস্ত নাবী-রসূলদের উপর আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে শান্তি বর্ষিত হোক। শাফা‘আতের হাদীছগুলো ছহীহ বুখারী, মুসলিম এবং অন্যান্য হাদীছের কিতাবে একদল ছাহাবী থেকে বর্ণিত হয়েছে।

আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা নাবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট মাংস পেশ করা হলো। এ সময় তাকে রানের মাংস দেয়া হলো। তিনি রানের মাংস খুব পছন্দ করতেন। এ থেকে তিনি চাকু দিয়ে কেটে কেটে খেলেন। অতঃপর তিনি বললেন, আমি কিয়ামতের দিন মানুষের সরদার হবো। তোমরা কি জানো কেন আমি সরদার হবো? কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা সমস্ত বনী আদমকে একটি মাটিতে একত্র করবেন। তখন লোকদের একজন অন্যজনকে বলবে, তোমরা কি দেখছো না যে, তোমরা কী অবস্থায় আছো? তোমরা কি দেখছো না তোমাদের কেএ কষ্ট হচ্ছে? তোমরা কি এমন কাউকে খুঁজবে না, যিনি তোমাদের জন্য তোমাদের প্রভুর নিকট সুপারিশ করবেন? তখন লোকদের কেউ কেউ বলবে, তোমাদের পিতা আদম এ কাজ করবেন। এরপর তারা আদমের কাছে যাবে। আদমের কাছে গিয়ে বলবে, হে আদম! আপনি আবুল বাশার। আমাদের জন্য আপনার প্রভুর নিকট সুপারিশ করুন। আপনি কি দেখছেন না, আমরা কী পরিমাণ অসুবিধার মধ্যে রয়েছি? আপনি দেখছেন না, আমাদের কী পরিমাণ কষ্ট হচ্ছে? আদম তখন বলবে,

إِنَّ رَبِّي قَدْ غَضِبَ الْيَوْمَ غَضَبًا لَمْ يَغْضَبْ قَبْلَهُ مِثلَهُ وَلَنْ يَغْضَبَ بَعْدَهُ مِثلَهُ، وَإِنَّهُ قَدْ نَهَانِي عَنِ الشَّجَرَةِ فَعَصَيْتُهُ، نَفْسِي نَفْسِي نَفْسِي، اذْهَبُوا إِلَى غَيْرِي، اذْهَبُوا إِلَى نُوحٍ، فَيَأْتُونَ نُوحًا، فَيَقُولُونَ: يَا نُوحُ، إِنَّكَ أَنْتَ أَوَّلُ الرُّسُلِ إِلَى أَهْلِ الأَرْضِ، وَقَدْ سَمَّاكَ اللَّه:ُ عَبْدًا شَكُورًا، اشْفَعْ لَنَا إِلَى رَبِّكَ، أَلا تَرَى إِلَى مَا نَحْنُ فِيه؟ِ فَيَقُولُ: إِنَّ رَبِّي عَزَّ وَجَلَّ قَدْ غَضِبَ الْيَوْمَ غَضَبًا لَمْ يَغْضَبْ قَبْلَهُ مِثلَهُ وَلَنْ يَغْضَبَ بَعْدَهُ مِثلَهُ، وَإِنَّهُ قَدْ كَانَتْ لِي دَعْوَةٌ دَعَوْتُهَا عَلَى قَوْمِي، نَفْسِي نَفْسِي نَفْسِي، اذْهَبُوا إِلَى غَيْرِي، اذْهَبُوا إِلَى إِبْرَاهِيمَ، فَيَأْتُونَ إِبْرَاهِيمَ، فَيَقُولُونَ: يَا إِبْرَاهِيمُ أَنْتَ نَبِيُّ اللَّهِ وَخَلِيلُهُ مِنْ أَهْلِ الأَرْضِ: اشْفَعْ لَنَا إِلَى رَبِّكَ، أَلاَ تَرَى إِلَى مَا نَحْنُ فِيهِ؟ فَيَقُولُ لَهُمْ: إِنَّ رَبِّي قَدْ غَضِبَ الْيَوْمَ غَضَبًا لَمْ يَغْضَبْ قَبْلَهُ مِثلَهُ وَلَنْ يَغْضَبَ بَعْدَهُ مِثلَهُ، وَإِنِّي قَدْ كُنْتُ كَذَبْتُ ثَلاَثَ كَذِبَاتٍ، نَفْسِي نَفْسِي نَفْسِي، اذْهَبُوا إِلَى غَيْرِي، اذْهَبُوا إِلَى مُوسَى، فَيَأْتُونَ مُوسَى، فَيَقُولُونَ: يَا مُوسَى، أَنْتَ رَسُولُ اللَّهِ، فَضَّلَكَ اللَّهُ بِرِسَالَتِهِ وَبِكَلامِهِ عَلَى النَّاسِ، اشْفَعْ لَنَا إِلَى رَبِّكَ، أَلاَ تَرَى إِلَى مَا نَحْنُ فِيهِ؟ فَيَقُولُ: إِنَّ رَبِّي قَدْ غَضِبَ الْيَوْمَ غَضَبًا لَمْ يَغْضَبْ قَبْلَهُ مِثلَهُ وَلَنْ يَغْضَبَ بَعْدَهُ مِثلَهُ؟ وَإِنِّي قَدْ قَتَلْتُ نَفْسًا لَمْ أُومَرْ بِقَتْلِهَا، نَفْسِي نَفْسِي نَفْسِي، اذْهَبُوا إِلَى غَيْرِي، اذْهَبُوا إِلَى عِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ، فَيَأْتُونَ عِيسَى، فَيَقُولُونَ: يَا عِيسَى، أَنْتَ رَسُولُ اللَّهِ وَكَلِمَتُهُ أَلْقَاهَا إِلَى مَرْيَمَ وَرُوحٌ مِنْهُ، وَكَلَّمْتَ النَّاسَ فِي الْمَهْدِ صَبِيًّا، اشْفَعْ لَنَا إِلَى رَبِّكَ، أَلاَ تَرَى إِلَى مَا نَحْنُ فِيهِ؟ فَيَقُولُ عِيسَى: إِنَّ رَبِّي قَدْ غَضِبَ الْيَوْمَ غَضَبًا لَمْ يَغْضَبْ قَبْلَهُ مِثلَهُ قَطُّ وَلَنْ يَغْضَبَ بَعْدَهُ مِثلَهُ، وَلَمْ يَذْكُرْ ذَنْبًا، نَفْسِي نَفْسِي نَفْسِي، اذْهَبُوا إِلَى غَيْرِي، اذْهَبُوا إِلَى مُحَمَّدٍ، فَيَأْتُونَ مُحَمَّدًا، فَيَقُولُونَ: يَا مُحَمَّدُ، أَنْتَ رَسُولُ اللَّهِ، وَخَاتِمُ الأَنْبِيَاءِ، وَقَدْ غَفَرَ اللَّهُ لَكَ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِكَ وَمَا تَأَخَّرَ، اشْفَعْ لَنَا إِلَى رَبِّكَ، أَلاَ تَرَى إِلَى مَا نَحْنُ فِيهِ؟ فَأَنْطَلِقُ، فَآتِي تَحْتَ الْعَرْشِ، فَأَقَعُ سَاجِدًا لِرَبِّي عَزَّ وَجَلَّ، ثمَّ يَفْتَحُ اللَّهُ عَلَيَّ مِنْ مَحَامِدِهِ وَحُسْنِ الثنَاءِ عَلَيْهِ شَيْئًا لَمْ يَفْتَحْهُ عَلَى أَحَدٍ قَبْلِي، ثمَّ يُقَالُ: يَا مُحَمَّدُ، ارْفَعْ رَأْسَكَ، سَلْ تُعْطَهْ، وَاشْفَعْ تُشَفَّعْ، فَأَرْفَعُ رَأْسِي، فَأَقُولُ: أُمَّتِي يَا رَبّ، أُمَّتِي يَا رَبِّ، أُمَّتِي يَا رَبِّ، فَيُقَالُ: يَا مُحَمَّدُ، أَدْخِلْ مِنْ أُمَّتِكَ مَنْ لا حِسَابَ عَلَيْهِمْ مِنَ الْبَابِ الأَيْمَنِ مِنْ أَبْوَابِ الْجَنَّةِ، وَهُمْ شُرَكَاءُ النَّاسِ فِيمَا سِوَى ذَلِكَ مِنَ الأَبْوَابِ، ثمَّ قَالَ: وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ إِنَّ مَا بَيْنَ الْمِصْرَاعَيْنِ مِنْ مَصَارِيعِ الْجَنَّةِ كَمَا بَيْنَ مَكَّةَ وَحِمْيَرَ أَوْ كَمَا بَيْنَ مَكَّةَ وَبُصْرَى»

‘‘আমার প্রভু আজ এমন রাগান্বিত হয়েছেন, যেমন রাগান্বিত আর কখনও হননি। আজকের পরে আর কখনও এমন রাগান্বিত হবেন না। তিনি আমাকে একটি গাছের নিকট যেতে বারণ করেছিলেন। আমি তার আদেশ লঙ্ঘন করেছি। হায়! আমার কি দশা হবে! হায়! আমার কি দশা হবে! হায়! আমার কি দশা হবে! তোমরা অন্য কারও কাছে যাও। তোমরা নূহ (আ.) এর কাছে যাও।

তারা নূহ (আ.) এর কাছে গিয়ে বলবে, হে নূহ! আপনি তো পৃথিবীবাসীর নিকট প্রথম রসূল। আপনাকে আল্লাহ্ তা‘আলা একজন কৃতজ্ঞ বান্দা হিসেবে অবিহিত করেছেন। আপনি আমাদের জন্য আপনার প্রভুর নিকট সুপারিশ করুন। আপনি কি দেখছেন না আমরা কি রকম কষ্টে আছি? তিনি বলবেন, আমার প্রভু আজ এমন রাগান্বিত হয়েছেন, যেমন রাগান্বিত আর কখনও হননি। আজকের পরে আর কখনও এমন রাগান্বিত হবেন না। আর আমাকে একটি দু‘আ করার অধিকার দেয়া হয়েছিল। আমি তা আমার জাতির বিরুদ্ধে করে ফেলেছি। হায়! আমার কি দশা হবে! হায়! আমার কি দশা হবে! হায়! আমার কি দশা হবে! তোমরা অন্য কারও কাছে যাও। তোমরা ইবরাহীমের কাছে যাও।

তারা ইবরাহীম (আ.) এর কাছে গিয়ে বলবে, হে ইবরাহীম! আপনি তো আল্লাহর নাবী এবং পৃথিবীবাসীর মধ্যে আপনিই আল্লাহর বন্ধু। আপনি আমাদের জন্য আপনার প্রভুর নিকট সুপারিশ করুন। আপনি কি দেখছেন না আমরা কি রকম কষ্টে আছি? তিনি বলবেন, আমার প্রভু আজ এমন রাগান্বিত হয়েছেন, যেমন রাগান্বিত আর কখনও হননি। আজকের পরে আর কখনও এমন রাগান্বিত হবেন না। আর ইতিপূর্বে আমি তিনটি মিথ্যা কথা বলে ফেলেছি। হায়! আমার কি দশা হবে! হায়! আমার কি দশা হবে! হায়! আমার কি দশা হবে! তোমরা অন্য কারও কাছে যাও। তোমরা মূসার কাছে যাও।

তারা মূসা (আ.) এর কাছে গিয়ে বলবে, হে মূসা! আপনি তো আল্লাহর রসূল। আল্লাহ্ আপনাকে রিসালাত দিয়ে এবং আপনার সাথে কথা বলে সমগ্র মানুষের মধ্যে আপনাকে বিশেষ মর্যাদায় উন্নীত করেছেন। আপনি আমাদের জন্য আপনার প্রভুর নিকট সুপারিশ করুন। আপনি কি দেখছেন না আমরা কি রকম কষ্টে আছি? তিনি বলবেন, আমার প্রভু আজ এমন রাগান্বিত হয়েছেন, যেমন রাগান্বিত আর কখনও হননি। আজকের পরে আর কখনও এমন রাগান্বিত হবেন না। আর আমি পৃথিবীতে এক ব্যক্তিকে হত্যা করেছিলাম। অথচ তাকে হত্যা করার জন্য আমাকে আদেশ দেয়া হয়নি। হায়! আমার কি দশা হবে! হায়! আমার কি দশা হবে! হায়! আমার কি দশা হবে! তোমরা অন্য কারও কাছে যাও। তোমরা ঈসার কাছে যাও।

তারা ঈসা (আ.) এর কাছে গিয়ে বলবে, হে ঈসা! আপনি আল্লাহর রসূল এবং আপনি হচ্ছেন আল্লাহর সেই কালেমা, যা তিনি মারইয়ামের কাছে পাঠিয়েছেন। আর আপনি হচ্ছেন আল্লাহর রূহ। আপনি শিশুকালে মায়ের কোলে থেকেই মানুষের সাথে কথা বলেছেন। আপনি আমাদের জন্য সুপারিশ করুন। আপনি কি দেখছেন না আমরা কি রকম কষ্টে আছি? তিনি বলবেন, আমার প্রভু আজ এমন রাগান্বিত হয়েছেন, যেমন রাগান্বিত আর কখনও হননি। আজকের পরে আর কখনও এমন রাগান্বিত হবেন না। তিনি পৃথিবীতে থাকা কালে কোন পাপের কথা উল্লেখ করবেন না। তিনি বলবেন, হায়! আমার কি দশা হবে! হায়! আমার কি দশা হবে! হায়! আমার কি দশা হবে! তোমরা অন্য কারও কাছে যাও। তোমরা মুহাম্মাদের কাছে যাও।

তারা মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে গিয়ে বলবে, হে মুহাম্মাদ! আপনি আল্লাহর রসূল এবং সর্বশেষ নাবী। আল্লাহ আপনার আগের ও পরের সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন। আপনি আমাদের জন্য সুপারিশ করুন। আপনি কি দেখছেন না আমরা কি রকম কষ্টে আছি? রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, অতঃপর আমি আরশের নীচে গিয়ে আমার প্রভুর জন্য সিজদায় নত হবো। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা আমার অন্তরে তার এমন কিছু প্রশংসা ও গুণগান ঢেলে দিবেন যা ইতিপূর্বে কাউকে দেন নি। (আমি সেগুলোর মাধ্যমে আল্লাহর প্রশংসা করবো) অতঃপর বলা হবে, হে মুহাম্মাদ! মাথা উঠান। চান, আপনি যা চাইবেন, তাই দেয়া হবে। আপনি সুপারিশ করুন, আপনার সুপারিশ কবুল করা হবে। আমি তখন মাথা উঠিয়ে বলবো, হে আমার প্রভু! আমার উম্মাতকে বাঁচান। আমার উম্মাতকে বাঁচান। অতঃপর বলা হবে, হে মুহাম্মাদ! আপনার উম্মাতের মধ্যে যাদের উপর কোন হিসাব নেই, তাদেরকে জান্নাতের ডান দরজা দিয়ে প্রবেশ করান। তবে তারা চাইলে লোকদের সাথে জান্নাতের অন্যান্য দরজা দিয়েও জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে। অতঃপর তিনি বললেন, ঐ আল্লাহর শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, জান্নাতের একটি দরজার প্রশস্ততা হবে মক্কা ও হিএয়ার অথবা মক্কা ও বুসরার মধ্যকার দূরত্বের সমান’’।[1] হাদীছের মূল অর্থ ছহীহ বুখারী ও মুসলিমে রয়েছে। উপরোক্ত শব্দগুলো ইমাম আহমাদের।

আশ্চর্যের বিষয় হলো ইমামগণ এ হাদীছ বিভিন্ন সনদে বর্ণনা করেছেন ঠিকই; কিন্তু প্রথম প্রকার শাফা‘আত তথা শাফা‘আতে উযমার বিষয়টি কেউ উল্লেখ করেননি। অর্থাৎ হাশরের মাঠে বিচারের জন্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার আগমনের বিষয়টি উল্লেখ করেননি। যেমনটি সিঙ্গায় ফুঁ দেয়ার হাদীছে বর্ণিত হয়েছে। এ স্থানে এ বিষয়টি বর্ণনা করাই উদ্দেশ্য। হাদীছের প্রথমাংশের বর্ণনা প্রসঙ্গের দাবিও এটি।

কিয়ামতের দিন লোকেরা পূর্বোক্ত পাঁচজন থেকে শুরু করে সমস্ত নাবীর কাছেই শাফা‘আত করার অনুরোধ করবে। যাতে করে আল্লাহ তা‘আলা মানুষের মধ্যে দ্রুত ফায়ছালা করেন এবং যাতে তারা হাশরের মাঠের কষ্ট থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে যায়। সকল সনদে উপরোক্ত হাদীছের বর্ণনা প্রসঙ্গ এ কথারই প্রমাণ বহন করে। কিয়ামতের দিন ভালো-মন্দের বিনিময় প্রদানের বিষয়ে তারা যখন আলোচনা করেছেন, কেবল তখন তারা পাপীগণের শাফা‘আতের বিষয় এবং জাহান্নামের আগুন থেকে তাদের বের হওয়া প্রসঙ্গে আলোচনা করেছেন। সালাফদের উদ্দেশ্য ছিল হাদীছ থেকে শুধু এ পরিমাণ অংশের উপর নির্ভর করা। আর তা হলো খারেজী সম্প্রদায় এবং তাদের অনুসারী মুতাযেলা সম্প্রদায়ের প্রতিবাদ করা। কেননা তাদের কথা হলো যারা একবার জাহান্নামে প্রবেশ করবে, তাদের কেউ আর সেখান থেকে বের হবে না।

সুতরাং সালাফগণ কেবল হাদীছের সেই অংশই বর্ণনা করেছেন, যাতে সুস্পষ্টভাবেই খারেজীদের প্রতিবাদ করা হয়েছে। ছহীহ হাদীছের খেলাফে তারা যে বিদ‘আতী মতবাদ প্রকাশ করেছে, সালাফগণ কেবল তার প্রতিবাদ করতে গিয়ে হাদীছের অংশবিশেষ উল্লেখ করেছেন। সিঙ্গায় ফুঁ দেয়ার হাদীছে তা সুস্পষ্ট করেই উল্লেখ করা হয়েছে। দীর্ঘ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা না থাকলে পূর্ণ হাদীছটি উল্লেখ করতাম। তবে হাদীছের সারাংশ হলো, তারা প্রথমে আদম (আ.), অতঃপর নূহ (আ.), অতঃপর ইবরাহীম (আ.), অতঃপর মূসা (আ.), অতঃপর ঈসা আলাইহিস সালামের নিকট আগমন করবে। পরিশেষে আল্লাহর রসূল মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট আগমন করবে। তিনি তখন আরশের নীচে গিয়ে ‘ফাহাস’ নামক একটি স্থানে সিজদায় লুটিয়ে পড়বেন। আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, তোমার কী হয়েছে? অথচ তিনিই এ বিষয়ে সর্বাধিক অবগত রয়েছেন। রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আমি তখন বলবো, হে আমার রব! তুমি আমার শাফা‘আত কবুল করার ওয়াদা করেছো।

সুতরাং এখন তোমার সৃষ্টির ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করো এবং তাদের মাঝে ফায়ছালা করো। আল্লাহ সুবাহানাহু ওয়া তা‘আলা তখন বলবেন, আমি তোমাকে শাফা‘আত করার অনুমতি দিলাম এবং আমি তোমাদের মাঝে আসবো এবং বান্দাদের মাঝে ফায়ছালা করবো। রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, অতঃপর আমি ফিরে এসে মানুষের সাথে দাঁড়াবো। অতঃপর রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আসমানসমূহ বিদীর্ণ হওয়ার এবং মেঘমালার ছায়াতে ফেরেশতাদের অবতরণের বিষয় উল্লেখ করেছেন। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বানদাদের মাঝে ফায়ছালা করার জন্য আগমন করবেন। তখন কারুবীয়া ফেরেশতা এবং আল্লাহর নৈকট্যশীল অন্যান্য ফেরেশতাগণ বিভিন্ন প্রকার তাসবীহ পাঠ করতে থাকবে। নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তার যমীনের যেখানে ইচ্ছা স্বীয় কুরসী স্থাপন করবেন। অতঃপর বলবেন, আমি যেদিন তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি, সেদিন থেকে তোমাদের এ দিন পর্যন্ত চুপ ছিলাম। আমি তোমাদের কথাসমূহ শ্রবণ করতাম, তোমাদের কর্মসমূহ দেখতাম। সুতরাং এ নাও তোমাদের কর্ম এবং আমলনামাসমূহ। আজ তোমাদের জন্য এটি পাঠ করা হবে। তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এতে কল্যাণকর কিছু পাবে, সে যেন আল্লাহর প্রশংসা করে আর যে ব্যক্তি অন্য কিছু পাবে, সে যেন কেবল নিজেকেই দোষারোপ করে।

পরিশেষে জান্নাতীগণ যখন জান্নাতে প্রবেশের জন্য অগ্রসর হবে, তখন তারা বলবে, জান্নাতে প্রবেশের ব্যাপারে কে আমাদের রবের নিকট সুপারিশ করবে? তারা বলবে, তোমাদের পিতা আদম অপেক্ষা এ বিষয়ে কথা বলার জন্য আর কে বেশী অধিকার রাখে। আল্লাহ তা‘আলা তাকে নিজ হাতে সৃষ্টি করেছেন। তার মধ্যে তার নিজের রূহ ফুঁকে দিয়েছেন এবং সরাসরি তার সাথে কথা বলেছেন। অতঃপর তারা আদমের নিকট গিয়ে শাফাআতের আবেদন করবে। বর্ণনাকারী যথাক্রমে নূহ (আ.), ইবরাহীম (আ.), মুসা (আ.), ঈসা আলাইহিস্ সালাম, সর্বশেষে মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে যাওয়ার কথাও উল্লেখ করেছেন। পরিশেষে উল্লেখ করেছেন যে, রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আমি জান্নাতের নিকটবর্তী হয়ে উহার দরজার হাতল ধরবো এবং দরজা খুলতে বলবো। অতঃপর আমার জন্য জান্নাতের দরজা খোলা হবে। আমাকে জান্নাতে স্বাগতম জানানো হবে।

জান্নাতে প্রবেশ করে আমি আমার প্রভুকে দেখে সেজদায় লুটিয়ে পড়বো। এ সময় আমাকে তার এমন কিছু প্রশংসা ও গুণাবলী শিখানো হবে, যা দ্বারা আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা করার জন্য আর কাউকে অনুমতি প্রদান করা হয়নি।অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, হে মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তোমার মাথা উঠাও। সুপারিশ করো। তোমার সুপারিশ কবুল করা হবে। তুমি চাও। তোমাকে প্রদান করা হবে। আমি যখন মাথা উঠাবো, তখন আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, অথচ তিনি সবকিছু অবগত রয়েছেন। তোমার কী হয়েছে? আমি তখন বলবো, হে আমার রব! তুমি আমার শাফা‘আত কবুল করার ওয়াদা করেছো। সুতরাং আমাকে জান্নাতীদের ব্যাপারে শাফা‘আত করার অনুমতি দাও। যাতে তারা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারে। আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, আমি তোমাকে শাফা‘আত করার অনুমতি দিলাম এবং তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশের অনুমতি দিলাম। ইমামগণ এ হাদীছ দুর্বল সূত্রে বর্ণনা করেছেন।[2] তাদের মধ্যে ইবনে জারীর আত্ তাবারী, তাবারানী, আবু ইয়ালা মুসেলী, বায়হাকী এবং অন্যান্য ইমাগণ রয়েছেন।

[1]. বুখারী ও মুসলিমের সনদে ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল রহিমাহুল্লাহ হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। দেখুন: ইমাম আলবানী রাহিমাহুল্লাহুর তাহকীকসহ শারহুল আকীদাহ আত্ তাহাবীয়া, টিকা নং- ১৯৮।

[2]. যঈফ: তাফসীরে তাবারী, তাফসীরে ইবনে কাসীর।

দ্বিতীয় প্রকার শাফা‘আত: কিয়ামতের দিন নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমন বহু সংখ্যক লোকের জন্য শাফা‘আত করবেন, যাদের সৎ আমল এবং খারাপ আমল সমান সমান হবে। তিনি তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করানোর জন্য শাফা‘আত করবেন।

তৃতীয় প্রকার শাফা‘আত: এমনি তিনি আরো এক শ্রেণীর লোকের জন্য শাফা‘আত করবেন, যাদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করার আদেশ করা হয়েছে। তিনি সুপারিশ করবেন, যাতে তাদেরকে জাহান্নামে প্রবেশ না করানো হয়।

চতুর্থ প্রকার শাফা‘আত: জান্নাতে প্রবেশকারী এক শ্রেণীর লোকের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য তিনি আল্লাহর কাছে শাফা‘আত করবেন। তাদের আমল অনুযায়ী যে পরিমাণ ছাওয়াব পাওয়ার হকদার, তিনি তাদেরকে তার চেয়ে বেশী প্রদান করার জন্য শাফা‘আত করবেন। মুতাযেলা সম্প্রদায়ের লোকেরা শুধু এ প্রকার শাফা‘আতকে সাব্যস্ত করে থাকে। এ ছাড়া অন্যান্য প্রকার শাফা‘আতকে তারা অস্বীকার করেছে। যদিও সে ব্যাপারে অনেক ছহীহ হাদীছ রয়েছে।

পঞ্চম প্রকার শাফা‘আত: এক শ্রেণীর লোককে বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করানোর ব্যাপারে তিনি শাফা‘আত করবেন। উক্কাশা বিন মিহসানের হাদীছটি এ শ্রেণীর লোকদের শাফা‘আতের ব্যাপারে সর্বোত্তম দলীল।

حِينَ دَعَا لَهُ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنْ يَجْعَلَهُ مِنَ السَّبْعِينَ أَلْفًا الَّذِينَ يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ بِغَيْرِ حِسَابٍ

উক্কাশার জন্য রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ দু‘আ করেছেন যে, তিনি যেন তাকে ঐ ৭০ হাজারের অন্তর্ভুক্ত করে নেন, যারা বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে।[1] ছহীহ বুখারী ও ছহীহ মুসলিমে হাদীছটি বর্ণিত হয়েছে।

ষষ্ঠ প্রকার শাফা‘আত: যারা জাহান্নামে প্রবেশের হকদার হবে, নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের শাস্তি কমানোর জন্য শাফা‘আত করবেন। তিনি তার চাচা আবু তালেবের শাস্তি কমানোর জন্য আল্লাহর কাছে শাফা‘আত করবেন।[2]

ইমাম কুরতুবী রহিমাহুল্লাহ তাযকিরা নামক কিতাবে এ প্রকার শাফা‘আত সম্পর্কে আলোচনা করার পর বলেন, যে ব্যক্তি বলবে, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, فَمَا تَنفَعُهُمْ شَفَاعَةُ الشَّافِعِينَ ‘‘সে সময় সুপারিশকারীদের সুপারিশ তাদের কোনো কাজে আসবে না’’। (সূরা মুদ্দাছছির: ৪৮)

তার জবাবে বলা হবে, কাফেরদের জাহান্নাম থেকে বের হওয়ার ক্ষেত্রে শাফা‘আত কারীদের কোনো শাফা‘আতই কাজে আসবে না। কিন্তু তাওহীদপন্থী পাপীদের জন্য সুপারিশ কারীদের সুপারিশ কাজে আসবে। তাওহীদপন্থী পাপী মুমিনগণ জাহান্নামে প্রবেশ করবে। অতঃপর জাহান্নাম থেকে বের হয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে।

সপ্তম প্রকার শাফা‘আত: সমস্ত মুমিনদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করার ব্যাপারে নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শাফা‘আত করবেন। যেমনটি ইতিপূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছে। ছহীহ মুসলিমে আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, أَنَا أَوَّلُ شَفِيعٍ فِي الْجَنَّةِ আমি জান্নাতের মধ্যে সর্বপ্রথম সুপারিশকারী হবো।[3]

অষ্টম প্রকার শাফা‘আত: তার উম্মতের কবীরাগুনাহকারী এক শ্রেণীর লোক কিয়ামতের দিন জাহান্নামে যাবে। কিন্তু নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের জন্য শাফা‘আতের কারণে তারা জাহান্নাম থেকে রেহাই পেয়ে যাবে।[4] এ প্রকার শাফা‘আতের ব্যাপারে মুতাওয়াতের সূত্রে অনেক হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। মুতাযেলাদের কাছে এ প্রকার হাদীছগুলো অস্পষ্ট রয়েছে। তাই তারা এ প্রকার শাফা‘আতকে অস্বীকার করেছে। এ ছহীহ হাদীছগুলো সম্পর্কে তাদের অজ্ঞতার কারণেই তারা এ ধরণের মত প্রকাশ করেছে। আর কিছু কিছু লোক এগুলো সম্পর্কে জেনেও তা কবুল করতে অস্বীকার করেছে এবং তারা তাদের বিদ‘আতের উপর অবিচল রয়েছে। ফেরেশতা, নাবীগণ এবং মুমিনগণও এ প্রকার শাফা‘আত করবেন। নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চারবার এ শাফা‘আত করবেন। এ প্রকার শাফা‘আতের পক্ষে যেসব হাদীছ রয়েছে, তার মধ্যে আনাস বিন মালিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর হাদীছ অন্যতম।

রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, «شَفَاعَتِي لِأَهْلِ الْكَبَائِرِ مِنْ أُمَّتِي» ‘‘আমার উম্মতের কবীরাহ গুনাহকারী লোকেরাই কিয়ামতের দিন আমার শাফা‘আত লাভ করে ধন্য হবে’’।[5] ইমাম আহমাদ বিন হান্বাল রহিমাহুল্লাহ হাদীছটি বর্ণনা করেছেন।

ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহ কিতাবুত্ তাওহীদে বলেন, আমাদের কাছে হাদীছ বর্ণনা করেছেন, সুলায়মান বিন হারব্, তিনি বর্ণনা করেন হাম্মাদ বিন যাইদ থেকে, হাম্মাদ বর্ণনা করেছেন, মামাদ বিন হেলাল আনাযী থেকে, তিনি বলেন, আমরা বসরার অধিবাসী একদল লোক আনাস বিন মালিকের নিকট গেলাম। শাফাআতের হাদীছ সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞাসা করার জন্য আমাদের সাথে ছাবিত আল-বুনানীকেও নিয়ে গেলাম। আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু তখন তার গৃহে অবস্থান করছিলেন। সেখানে গিয়ে দেখলাম। তিনি চাশতের ছ্বলাত পড়ছেন। আমরা তার কাছে প্রবেশের অনুমতি চাইলাম। তিনি আমাদেরকে প্রবেশের অনুমতি দিলেন। তখন তিনি স্বীয় বিছানার উপর ছিলেন। আমরা ছাবিতকে বললাম, শাফাআতের হাদীছের পূর্বে তাকে অন্য কিছু সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করো না। ছাবিত তখন বললেন, হে আবু হামযাহ! তোমার এ ভাইয়েরা বসরা থেকে এসেছে। তোমাকে তারা শাফাআতের হাদীছ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবে। আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু তখন বললেন, আমাদের কাছে মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বর্ণনা করেছেন যে, যেদিন কিয়ামত হবে, সেদিন মানুষ দলে দলে পরস্পরের নিকট গমণ করবে। তারা আদম আলাইহি সালামের কাছে গিয়ে বলবে, আমাদের জন্য আপনার প্রভুর নিকট শাফা‘আত করুন। আদম বলবেন, আমি এর যোগ্য নই। তোমরা চলে যাও ইবরাহীম আলাইহিস সালামের কাছে। তিনি হলেন আল্লাহর খলীল। তারা ইবরাহীম আলাইহিস সালামের নিকট যাবে। তিনি বলবেন, আমি এর যোগ্য নই। তোমরা চলে যাও মুসার কাছে। তিনি হলেন কালীমুল্লাহ।

তারা মুসা আলাইহিস সালামের কাছে যাবে। তিনি বলবেন, আমি এর যোগ্য নই। তোমরা ঈসা আলাইহিস সালামের কাছে চলে যাও। তিনি হলেন রূহুল্লাহ এবং আল্লাহর কালেমা। তারা ঈসা আলাইহিস সালামের কাছে যাবে। তিনি বলবেন, আমি এর যোগ্য নই। তোমরা চলে যাও। মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে। নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তারা আমার কাছে আসবে। আমি বলবো, আমি এর যোগ্য। আমি তখন আমার রবের নিকট অনুমতি প্রার্থনা করবো। আমাকে অনুমতি দেয়া হবে। আমাকে এমন কিছু প্রশংসা শিখানো হবে, যা দ্বারা আমি সেদিন আল্লাহর প্রশংসা করবো। এখন সেগুলো আমার মনে পড়ছে না। আমি সেগুলোর দ্বারা আল্লাহর প্রশংসা করবো এবং আল্লাহর জন্য সেজদায় লুটিয়ে পড়বো। তখন আমাকে বলা হবে, হে মুহাম্মাদ! তোমার মাথা উঠাও। কথা বলো। তোমার কথা শ্রবণ করা হবে, শাফা‘আত করো, তোমার শাফা‘আত কবুল করা হবে এবং চাও, তোমাকে দেয়া হবে। আমি তখন বলবো, হে আমার রব! আমার উম্মতকে বাঁচাও, হে আমার রব! আমার উম্মতকে বাঁচাও। অতঃপর বলা হবে, যাও। যার অন্তরে একটি যবের দানা পরিমাণ ঈমান রয়েছে, তাকে জাহান্নাম থেকে বের করো। আমি গিয়ে তাই করবো।

অতঃপর ফিরে এসে ঐ প্রশংসার বাক্যগুলো দিয়েই আবার আল্লাহর প্রশংসা শুরু করবো এবং আল্লাহর জন্য সেজদায় লুটিয়ে পড়বো। তখন আমাকে বলা হবে, হে মুহাম্মাদ! তোমার মাথা উঠাও। কথা বলো। তোমার কথা শ্রবণ করা হবে, শাফা‘আত করো, তোমার শাফা‘আত কবুল করা হবে এবং চাও, তোমাকে দেয়া হবে। তখন আমি বলবো, হে আমার রব! আমার উম্মতকে বাঁচাও, হে আমার রব! আমার উম্মতকে বাঁচাও। অতঃপর বলা হবে, যাও। যার অন্তরে একটি সরিষার দানা পরিমাণ ঈমান রয়েছে, তাকে জাহান্নাম থেকে বের করো। আমি গিয়ে তাই করবো।

অতঃপর ফিরে এসে ঐ প্রশংসার বাক্যগুলো দিয়েই আবার আল্লাহর প্রশংসা শুরু করবো এবং আল্লাহর জন্য সেজদায় লুটিয়ে পড়বো। তখন আমাকে বলা হবে, হে মুহাম্মাদ! তোমার মাথা উঠাও। কথা বলো। তোমার কথা শ্রবণ করা হবে, শাফা‘আত করো, তোমার শাফা‘আত কবুল করা হবে এবং চাও, তোমাকে দেয়া হবে। তখন আমি বলবো, হে আমার রব! আমার উম্মতকে বাঁচাও, হে আমার রব! আমার উম্মতকে বাঁচাও। অতঃপর বলা হবে, যাও। যার অন্তরে সরিষার দানার চেয়েও কম পরিমাণ ঈমান রয়েছে, তাকে জাহান্নাম থেকে বের করো। আমি গিয়ে তাই করবো।

বর্ণনাকারী বলেন, আমরা যখন আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর নিকট থেকে বের হলাম, তখন আমি আমার কতক সাথীকে বললাম, আমরা যদি হাসান বসরী রহিমাহুল্লাহর কাছে যেতাম! অতঃপর আমরা তার কাছে গিয়ে আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এর হাদীছ সম্পর্কে আলোচনা করতাম! তখন তিনি হাজ্জাজের যুলুমের ভয়ে আবু খলীফার বাড়িতে লুকিয়ে ছিলেন। আমরা তার কাছে গিয়ে সালাম দিলাম। তিনি আমাদেরকে প্রবেশের অনুমতি দিলেন। আমরা তাকে বললাম, হে আবু সাঈদ! আমরা তোমার ভাই আনাস বিন মালেকের নিকট থেকে আগমন করেছি। তিনি আমাদের কাছে শাফা‘আত সম্পর্কে যে হাদীছ শুনিয়েছেন, আমরা তা আর কখনো শুনতে পাইনি। তিনি বললেন, সেটি কোন্ হাদীছ? আমরা তাকে হাদীছটি শুনালাম। আমরা যখন হাদীছে বর্ণিত শেষোক্ত তিনটি শাফা‘আত পর্যন্ত বর্ণনা করলাম, তখন তিনি বললেন, এরপর কী? আমরা বললাম, তিনি এর চেয়ে বেশী আর কিছুই বর্ণনা করেনি। অতঃপর তিনি বললেন, আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ২০ বছর আগে যুবক বয়সে আমার কাছে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। আমি আশঙ্কা করছি, তিনি কি তা ভুলে গেছেন? না কি তোমরা আমল ছেড়ে দিয়ে শাফাআতের উপর ভরসা করে বসে থাকবে, এ আশঙ্কায় তিনি পুরো হাদীছটি তোমাদেরকে শুনানো অপছন্দ করছেন। অতঃপর আমরা বললাম, হে আবু সাঈদ! আমাদের কাছে আপনি তা বর্ণনা করুন। এতে তিনি হাসলেন এবং তাদেরকে তাড়াহুড়া করতে দেখে বললেন,

وَكَانَ الْإِنْسَانُ عَجُولًا

‘‘মানুষ বড়ই তাড়াহুড়াকারী’’। (সূরা বানী ইসরাঈল: ১১)

তোমরা আমার কাছে যা বর্ণনা করলে, তা আমি পুনরায় বর্ণনা করতে চাই না। তোমাদেরকে তিনি যেভাবে শুনিয়েছেন, আমাকেও সেভাবে শুনিয়েছেন।

বর্ণনাকারী বলেন, অতঃপর রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, চতুর্থবার আমি গিয়ে আল্লাহ তা‘আলার সেই প্রশংসাগুলো করবো এবং আল্লাহর জন্য সেজদায় লুটিয়ে পড়বো। তখন বলা হবে, হে মুহাম্মাদ মাথা উঠাও। কথা বলো, তোমার কথা শ্রবণ করা হবে। চাও, দেয়া হবে, সুপারিশ করো, তোমার সুপারিশ কবুল করা হবে। আমি তখন বলবো, হে আমার রব! যারা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলবে, তাদের ব্যাপারে সুপারিশ করার জন্য আমাকে অনুমতি দাও। আল্লাহ তা‘আলা তখন বলবেন, আমার বড়ত্ব, মর্যাদা, অহঙ্কার এবং সম্মানের শপথ! যারা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ পাঠ করবে, আমি অবশ্যই তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবো।[6] ইমাম মুসলিম হাদীছটিকে এভাবেই বর্ণনা করেছেন।

হাফেয আবু ইয়ালা উছমান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন যে, নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, কিয়ামতের দিন তিন শ্রেণীর লোক শাফা‘আত করবে। (১) নাবীগণ (২) আলেমগণ (৩) শহীদগণ।[7]

ছহীহ মুসলিমে আবু সাঈদ খুদরী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে মারফু সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, ফেরেশতাগণ সুপারিশ করেছে, নাবীগণ শাফা‘আত করেছে এবং মুমিনগণ শাফা‘আত করেছে। এখন শুধু সর্বাধিক আল্লাহ তা‘আলাই অবশিষ্ট রয়েছে। অতঃপর তিনি জাহান্নাম থেকে এক মুষ্ঠি মানুষ বের করবেন, যারা কোনো আমলই করেনি।[8]

অতঃপর শাফা‘আতের ক্ষেত্রে লোকেরা তিনভাবে বিভক্ত।

(১) মুশরিক, খৃষ্টান এবং যেসব সুফী তাদের শাইখদের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করে, তারা আল্লাহর নিকট তাদের বড়দের শাফা‘আতকে ঠিক দুনিয়ার মানুষের নিকট পরিচিত শাফাআতের মতই মনে করে।

(২) মুতাযেলা সম্প্রদায় এবং খারেজীরা কবীরা গুনাহকারীদের ব্যাপারে আমাদের নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং অন্যদের শাফা‘আতকে অস্বীকার করে।

(৩) আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের লোকেরা কবীরা গুনাহকারীদের ব্যাপারে নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং অন্যদের শাফা‘আতের স্বীকৃতি প্রদান করেন। তবে আল্লাহ তা‘আলা তাকে অনুমতি দেয়ার আগে এবং একটি নির্দিষ্ট সীমা নির্ধারণ করে দেয়ার পূর্বে শাফা‘আত শুরু করবেন না।যেমনটি শাফা‘আতের ছহীহ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে যে, কিয়ামতের দিন লোকেরা সর্বপ্রথম আদম আলাইহিস সালামের নিকট যাবে, অতঃপর নূহ (আ.), ইবরাহীম (আ.), মুসা (আ.) এবং সবশেষে ঈসা আলাইহিস সালামের কাছে গেলে তিনি তাদেরকে বলবেন, তোমরা মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে যাও। কেননা তিনি আল্লাহর এমন একজন বান্দা, যার পূর্বের এবং পরের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়েছে। নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তারা আমার কাছে আসবে। আমি যখন আমার রবকে দেখবো, তখন তার জন্য সেজদায় লুটিয়ে পড়বো। আমাকে আল্লাহ তা‘আলা তখন এমন কিছু প্রশংসা শিখিয়ে দিবেন, যা দ্বারা আমি তার প্রশংসা করবো। এখন আমার সেগুলো মনে পড়ছে না। আল্লাহ তা‘আলা তখন বলবেন, হে মুহাম্মাদ! মাথা উঠাও। কথা বলো, তোমার কথা শ্রবণ করা হবে, শাফা‘আত করো, তোমার শাফা‘আত কবুল করা হবে। আমি তখন মাথা উঠিয়ে বলবো, হে আমার রব! আমার উম্মতকে বাঁচাও। তখন আমাকে নির্দিষ্ট একটি পরিমাণ লোককে জান্নাতে প্রবেশ করানোর অনুমতি দেয়া হবে। আমি তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাবো। অতঃপর আমি পুনরায় গিয়ে সেজদায় লুটিয়ে পড়বো। অতঃপর আমাকে আরেকটি সীমা নির্ধারণ করে দেয়া হবে।[9] নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ কথা মোট তিনবার উল্লেখ করেছেন।

[1]. মুত্তাফাকুন আলাইহি, ছহীহ বুখারী হা/৫৭৫২, ছহীহ মুসলিম হা/২২০।

[2]. ছহীহ মুসলিম হা/২০৯।

[3]. ছহীহ মুসলিম ১৯৬, মুসনাদে আহমাদ।

[4]. শারহুল আকীদাহ আল-ওয়াসেতিয়াহ, পৃষ্ঠা নং- ১৪২।

[5]. মিশকাত ৫৫৯৮-৫৫৯৯। ইমাম আলবানী রহিমাহুল্লাহ হাদীছটিকে সহীহ বলেছেন। দেখুন: শাইখের টিকাসহ শরহুল আকীদাহ আত্ তাহাবীয়া, টিকা নং- ২০৫।

[6]. ছহীহ।

[7]. হাদীছটি বানোয়াট। ইবনে মাজাহ ৪৩১৩।

[8]. ছহীহ: মুসলিম, মুসনাদে আহমাদ।

[9]. মুত্তাফাকুন আলাইহি।
দুনিয়ার জীবনে নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উসীলায় দু‘আ করা

নাবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উসীলায় দু‘আ করার ব্যাপারে বিস্তারিত ব্যাখ্যা রয়েছে। কেননা দু‘আকারী কখনো বলে, হে আল্লাহ! তোমার নাবী বা অমুকের অধিকারের উসীলায় তোমার কাছে দু‘আ করছি। অথবা কোনো সৃষ্টির দোহাই দিয়ে আল্লাহর কাছে কিছু প্রার্থনা করে থাকে। দু’কারণে এরূপ বলা নিষিদ্ধ।

(১) এটি আল্লাহ ছাড়া অন্যের কসম খাওয়ার অন্তর্ভুক্ত।

(২) এটি এমন বিশ্বাসের কারণে হয়ে থাকে যে, আল্লাহ তা‘আলার উপর কারো হক রয়েছে। আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে কসম করা জায়েয নয়। আর আল্লাহ তা‘আলার উপর কারো কোনো হক নেই। তবে তিনি নিজের উপর যা আবশ্যক করেছেন সে কথা ভিন্ন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَكَانَ حَقًّا عَلَيْنَا نَصْرُ الْمُؤْمِنِينَ

‘‘মুমিনদেরকে সাহায্য করা আমার কর্তব্য’’। (সূরা আর রূম: ৫৫)

এমনি ছহীহ বুখারী ও ছহীহ মুসলিমের হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুআয বিন জাবাল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে বলেছেন, (মুআয তখন নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পিছনে একই বাহনে বসা ছিলেন) হে মুআয! তুমি কি জানো বান্দার উপর আল্লাহর হক কী? মুআয বলেন, আমি বললাম, আল্লাহ এবং তার রসূলই এ বিষয়ে সর্বাধিক অবগত। রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেন, বান্দার উপর আল্লাহর হক হলো, তারা একমাত্র তার ইবাদত করবে এবং তার সাথে কাউকে শরীক করবে না। এরপর নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তুমি কি জানো উপরোক্ত কাজ করলে আল্লাহর উপর বান্দার হক কী? মুআয বললেন, আল্লাহ এবং তার রসূলই এ বিষয়ে সর্বাধিক অবগত রয়েছেন। তিনি তখন বললেন, তারা উপরোক্ত কাজটি করলে তাদের জন্য আল্লাহর উপর হক হলো, তাদেরকে শাস্তি না দেয়া। এটি সত্য। আল্লাহ তা‘আলার পরিপূর্ণ কালেমার দাবি এবং তার সত্য ওয়াদার দাবি অনুপাতে এ হক আল্লাহ তা‘আলা নিজের উপর আবশ্যক করে নিয়েছেন। তবে এমনটি নয় যে, বান্দা নিজেই আল্লাহর উপর কোনো কিছু আবশ্যক করে দিয়েছে। যেমন এক মাখলুক অন্য মাখলুকের উপর আবশ্যক করে দেয়। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বান্দাদেরকে সকল প্রকার কল্যাণ প্রদান করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা যেহেতু তার অনুগত বান্দাদেরকে শাস্তি না দেয়ার ওয়াদা করেছেন, তাই সেই ওয়াদা অনুপাতে আল্লাহর উপর তাদের হক সাব্যস্ত হয়েছে। তাদেরকে শাস্তি না দেয়ার অর্থ এ নয় যে, তা দ্বারা কসম খাওয়া যাবে, আল্লাহর কাছে তা দ্বারা কোনো কিছু চাওয়া যাবে এবং উহার উসীলা দিয়ে দুআ করা যাবে। কেননা আল্লাহ তা‘আলা যেসব বিষয়কে নাজাতের মাধ্যম বানিয়েছেন, তাই নাজাতের মাধ্যম হয়েছে। মুসনাদে আহমাদে আবু সাঈদ খুদরী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে যে হাদীছটি বর্ণিত হয়েছে, তার কথাও অনুরূপ। সেখানে ছবলাতের উদ্দেশ্যে গমনকারীর কথা এভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, (أسألك بحق ممشايّ هذا وبحق السائلين عليك) ‘‘হে আল্লাহ! ছ্বলাতের উদ্দেশ্যে আমার এ গমনের উসীলায় এবং তোমার নিকট দু‘আকারীর হকের উসীলায় তোমার কাছে প্রার্থনা করছি।[1] কবি খুব সুন্দর বলেছেন,

مَا لِلْعِبَادِ عَلَيْهِ حَقٌّ وَاجِبٌ+ كَلَّا وَلَا سَعْيٌ لَدَيْهِ ضَائِعُ

إِنْ عُذِّبُوا فَبِعَدْلِهِ، أَوْ نُعِّمُوا+ فَبِفَضْلِهِ وَهُوَ الْكَرِيمُ الوَاسِع

‘‘আল্লাহর উপর বান্দার কোনো হক নেই। এটি হতেই পারে না। তবে তার নিকট কারো আমল বিনষ্ট হয় না। বান্দাদেরকে শাস্তি দেয়া হলে তার ইনসাফের কারণেই দেয়া হবে অথবা যদি তাদেরকে নেয়ামত দেয়া হয়, তাহলে তার ইনসাফের কারণেই। আর আল্লাহ তা‘আলা দয়ালু দাতা ও প্রাচুর্যের অধিকারী।

এখন যদি প্রশ্ন করা হয় দু‘আকারীর কথা, بحق السائلين عليك এবং بحق نبيك এ দুই বাক্যের মধ্যে পার্থক্য কী? এর জবাব হলো بحق السائلين عليك এ কথার অর্থ হলো হে আল্লাহ! তুমি তো দু‘আকারীদের সাথে ওয়াদা করেছো যে, তুমি তাদের দ‘ুআ কবুল করবে। আমি তো সে দু‘আকারীদের দলভুক্ত। সুতরাং আমার দু‘আ কবুল করো। এটি بحق فلان বা অমুকের হকের উসীলায় আমার দু‘আ কবুল করো, এ কথার সম্পূর্ণ বিপরীত। কেননা আল্লাহ তা‘আলার সত্য ওয়াদার কারণে কারো জন্য আল্লাহর উপর হক থাকলেও তার মাঝে এবং দু‘আকারীর দু‘আ কবুলের মাঝে কোনো সম্পর্ক নেই। যে ব্যক্তি দু‘আর মধ্যে অন্যকে উসীলা দেয়, তার কথা এরূপ যে, সে যেন বলছে, হে আল্লাহ! অমুক ব্যক্তি যেহেতু আপনার সৎ বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত, তাই আমার দু‘আ কবুল করো। দু‘আ কবুল করার সাথে এভাবে কোনো ব্যক্তির নাম উল্লেখ করার সম্পর্ক কী? দু‘আর মধ্যে কোনো ব্যক্তির নাম উল্লেখ করলেই দু‘আ কবুল হওয়া আবশ্যক হয় কিভাবে? এটি দু‘আর মধ্যে যুলুম ও সীমালংঘন করার অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

ادْعُوا رَبَّكُمْ تَضَرُّعًا وَخُفْيَةً إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُعْتَدِينَ

‘‘তোমাদের রবকে ডাকো কান্নাজড়িত কণ্ঠে ও চুপে চুপে। অবশ্যই তিনি সীমালংঘন কারীদেরকে পছন্দ করেন না’’। (সূরা আল ‘আরাফ: ৫৫)

এভাবে দু‘আর মধ্যে কারো নাম উল্লেখ করে দু‘আ করা বিদআতী দু‘আর অন্তর্ভুক্ত। নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে এভাবে দু‘আ করার কথা বর্ণিত হয়নি। এমনকি ছাহাবী, তাবেঈ কিংবা কোনো ইমাম থেকেও এভাবে দু‘আ করার কথা বর্ণিত হয়নি। মূর্খ ও সুফীরা তাবীজ -কবজ এবং দর্গা ও মাজারের মধ্যে এগুলো লিখে রাখে। দু‘আ হলো সর্বোত্তম ইবাদত। আর ইবাদতের ক্ষেত্রে মূলনীতি হলো তাতে রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণ করা হবে। বিদ‘আত ও প্রবৃত্তির উপর নির্ভর করে কোনো ইবাদত করা যাবে না।

কারো হকের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে কিছু চাওয়া নিষিদ্ধ। সুতরাং কিভাবে স্রষ্টার উপর কারো হক আছে বলে দাবি করা যেতে পারে? রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, «مَنْ حَلَفَ بِغَيْرِ اللَّهِ فَقَدْ أَشْرَك» ‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে শপথ করল, সে শির্ক করল’’।[2]

ইমাম আবু হানীফা রহিমাহুল্লাহ এবং তার সাথীদ্বয় বলেছেন, দুআকারীর এ কথা বলা মাকরুহ যে, হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে অমুকের হকের উসীলায় প্রার্থনা করছি, তোমার নাবী-রসূলদের হকের উসীলায় প্রার্থনা করছি, পবিত্র কাবা ঘরের সম্মানের উসীলায় প্রার্থনা করছি, পবিত্র স্থানসমূহের হকের উসীলায় প্রার্থনা করছি অথবা অনুরূপ অন্য কিছুর হকের উসীলায় প্রার্থনা করছি। দু‘আর মধ্যে ইত্যাদি কথা বলা মাকরুহ। ইমাম আবু হানীফা এবং মুহাম্মাদ রহিমাহুল্লাহ দু‘আকারীর এ কথা অপছন্দ করেছেন যে, হে আল্লাহ! আমি তোমার আরশের সম্মানের উসীলায় প্রার্থনা করছি। কিন্তু ইমাম আবু ইউসুফ রহিমাহুল্লাহ ইহাকে অপছন্দ করেননি। কারণ এ বিষয়ে হাদীছ রয়েছে।[3]

মুর্খরা কখনো কখনো দু‘আর মধ্যে এভাবে বলে থাকে যে, হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে অমুকের সম্মানের উসীলায় প্রার্থনা করছি। কেউ কেউ বলে থাকে, হে আল্লাহ! আমরা তোমার কাছে তোমার নাবী-রসূলদের এবং অলী-আওলীয়াদের উসীলায় প্রার্থনা করছি। এতে দু‘আকারী যেন বলছে, হে আল্লাহ! অমুক লোক তোমার কাছে অত্যন্ত মর্যাদাবান এবং শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী। সুতরাং তুমি আমার দু‘আ কবুল করো। এভাবে দু‘আ করাও নিষিদ্ধ।

নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবদ্দশায় ছাহাবীগণ যে উসীলা দিতেন, তা যদি হুবহু এ উসীলা হতো, তাহলে তার মৃত্যু বরণের পরও তারা তার উসীলা দিতেন। ছাহাবীগণ নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবদ্দশায় তার দু‘আর উসীলা দিতেন। তারা নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে গিয়ে তাদের জন্য দু‘আ করার আবেদন করতেন। নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দু‘আ করতেন এবং ছাহাবীগণ তার দু‘আয় আমীন বলতেন। যেমন বৃষ্টি প্রার্থনা এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে তা উল্লেখ করা হয়েছে।

রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মৃত্যু বরণ করার পর যখন তারা বৃষ্টি প্রার্থনার জন্য বের হতেন তখন উমার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলতেন,

«اللَّهُمَّ إِنَّا كُنَّا نَتَوَسَّلُ إِلَيْكَ بِنَبِيِّنَا فَتَسْقِيَنَا وَإِنَّا نَتَوَسَّلُ إِلَيْكَ بِعَمِّ نَبِيِّنَا فَاسْقِنَا، قَالَ: فَيُسْقَوْنَ»

‘‘হে আল্লাহ! আমাদের নাবী জীবিত থাকতে আমরা তার মাধ্যমে বৃষ্টি প্রার্থনা করলে তুমি আমাদের জন্য বৃষ্টি বর্ষণ করতে। এখন আপনার নাবীর চাচার মাধ্যমে বৃষ্টি প্রার্থনা করছি। তুমি আমাদের জন্য বৃষ্টি বর্ষণ করো। অতঃপর তাদের জন্য বৃষ্টি বর্ষণ করা হত’’।[4]

এখানে নাবীর মাধ্যমে বা নাবীর চাচার মাধ্যমে বৃষ্টি চাওয়ার অর্থ হল বৃষ্টির জন্য দু’আ করার আবেদন করা এবং তার কাছে সুপারিশ করা ও বৃষ্টি চাওয়ার আবেদন করা। অর্থ এটি নয় যে, আববাসের হকের মাধ্যমে জোর দিয়ে তোমার কাছে বৃষ্টি চাচ্ছি। অথবা তাদের উদ্দেশ্য এটি ছিল না যে, আমরা তোমার নিকট আববাসের সম্মান ও মর্যাদার উসীলা দিয়ে বৃষ্টি প্রার্থনা করছি। এটি যদি উদ্দেশ্য হতো, তাহলে আল্লাহর নিকট আববাসের সম্মান ও মর্যাদার চেয়ে রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সম্মান ও মর্যাদা যেহেতু বেশী, তাই তারা কখনো রসূলকে বাদ দিয়ে আববাসের দিকে যেতেন না। কেননা মৃত্যু বরণের কারণে রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মর্যাদা কমে যায়নি।

দু‘আকারী কখনো বলে থাকে, হে আল্লাহ! আমি তোমার রাসূলের আনুগত্য করি, তাকে ভালোবাসি, তার প্রতি ঈমান এনেছি, তোমার সকল নাবী-রাসূলের প্রতি ঈমান এনেছি, তাদের সকলকে সত্যায়ন করেছি এবং অনুরূপ অন্যান্য কথা বলে থাকে। দু‘আ করা, উসীলা দেয়া এবং শাফা‘আত চাওয়ার মধ্যে এ ধরণের কথা খুবই উত্তম।

কিন্তু কারো ব্যক্তি সত্তার উসীলা দেয়া এবং তার মাধ্যমে দু‘আ করার মধ্যে যথেষ্ট অস্পষ্টতা রয়েছে। এর অর্থ যারা বুঝেনি তারা মারাত্মক ভুল করেছে। কোনো দু‘আকারী যদি অন্য কোনো ব্যক্তিকে দু‘আর মধ্যে উল্লেখ করে এ কারণে যে, সে আল্লাহর নিকট তার জন্য দু‘আ করছে, সুপারিশ করছে আর এটি জীবিত থাকা কালেই সম্ভব অথবা এ জন্য উল্লেখ করে যে, দু‘আকারী সেই ব্যক্তিকে ভালোবাসে, তার আনুগত্য করে এবং তাকে আদর্শ মনে করে, কারণ সে ভালোবাসা পাওয়ার হকদার, আনুগত্যের যোগ্য ও অনুসরণীয়, এমন ব্যক্তির উসীলা দেয়ার অর্থ হলো, তার দু‘আ এবং শাফাআতের উসীলা দেয়া। অথবা তার ভালোবাসা এবং অনুসরণ করার উসীলা দেয়া।

তবে কাউকে দু‘আর মধ্যে উল্লেখ করা দ্বারা যদি তার ব্যক্তিসত্তার উসীলা দেয়া উদ্দেশ্য হয় অথবা আল্লাহর কাছে তার অধিকার আছে বলে জোর দিয়ে দাবি করা হয়, তাহলে এ পদ্ধতিকে আলেমগণ অপছন্দ করেছেন এবং নিষেধ করেছেন। কোনো ভালো কাজের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে কিছু চাওয়া দ্বারা কখনো উক্ত ইবাদতকে উদ্দেশ্য হাসিলের কারণ মনে করা হয়। আবার কখনো দু‘আ করার সময় কোনো জিনিস উল্লেখ করে জোর দাবি জানানো হয়।

প্রথম প্রকারের উদাহরণ স্বরূপ এখানে তিন ব্যক্তির হাদীছকে উল্লেখ করা যেতে পারে। হাদীছটি খুব প্রসিদ্ধ। বুখারী, মুসলিম এবং অন্যান্য কিতাবে হাদীছটি বর্ণিত হয়েছে। তারা যখন গুহায় প্রবেশ করলো, তখন একটি পাথর গুহার মুখ বন্ধ করে দিলো। তারা তাদের খালেস সৎ আমলগুলোর উসীলা দিয়ে আল্লাহর কাছে দু‘আ করলো। তাদের প্রত্যেকেই বলেছিল, হে আল্লাহ! আমি যদি এ আমলটি তোমার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য করে থাকি, তাহলে আমরা যে বিপদে পড়েছি, তা থেকে উদ্ধার করো। এতে করে পাথরটি সরে গেল। তারা গুহা থেকে বের হয়ে এলো। এরা আল্লাহর নিকট সৎ আমল তুলে ধরে দুআ করেছিল। তারা এভাবে দুআ করেনি যে, হে আল্লাহ! অমুক বান্দার হকের মাধ্যমে তোমার কাছে দু‘আ করছি কিংবা তারা এটি বলেনি যে, হে আল্লাহ! আমাদের মাঝে অমুক অমুক অলী ও নেক বান্দা রয়েছে। সুতরাং আমাদেরকে উদ্ধার করো। কেননা আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করার জন্য বান্দার সৎ আমল হলো সর্বোত্তম মাধ্যম। বান্দা সৎআমলের মাধ্যমে আল্লাহর দিকে মনোনিবেশ করবে, তার কাছে প্রার্থনা করবে। কেননা আল্লাহ তা‘আলা ঈমানদার ও সৎ আমলকারীদের সাথে ওয়াদা করেছেন যে, তিনি তাদের ডাকে সাড়া দিবেন এবং নিজের পক্ষ হতে অতিরিক্ত পুরস্কার দান করবেন।

মোটকথা আল্লাহর নিকট সুপারিশ করা এক মানুষের নিকট অন্য মানুষের সুপারিশ করার মত নয়। কেননা মানুষের নিকট সুপারিশকারী, সুপারিশ প্রার্থী এবং সুপারিশকে নিজের সাথে যুক্ত করে নেয়। অর্থাৎ সুপারিশ প্রার্থী প্রথমে থাকে একা বা বেজোড়। এখন তার সাথে আরেকজন যোগদান করার মাধ্যমে দুই বা জোড়ে পরিণত হয়েছে। এখন সুপারিশকারী ও তার সুপারিশ প্রার্থী একই বস্তু প্রার্থনা করছে। অর্থাৎ শাফা‘আত তলবকারী এবং শাফা‘আতকারী উভয়ে মিলে জোড় সংখ্যায় পরিণত হয়েছে। আর আল্লাহ তা‘আলা বেজোড়। কেউ তাকে জোড় করতে পারে না। কোনো মানুষ যখন রাজা-বাদশাহর নিকট থেকে প্রয়োজন পুরণ করতে চায়, তখন রাজা-বাদশাহদের সাথে তার পরিচয় না থাকার কারণে সে একটি শক্তিশালী মাধ্যম বা সুপারিশকারী খুuঁজ। এভাবে মানুষ দুইজনের মাধ্যমে প্রয়োজন পুরণ করে। শাফা‘আতকারী এবং যার নিকট শাফা‘আত করা হয়। কোনো অবস্থাতেই আল্লাহ তা‘আলার নিকট এ পদ্ধতি প্রযোজ্য নয়। আল্লাহ তা‘আলা একাই সৃষ্টি করা, আদেশ দেয়া, রিযিক দেয়া, কল্যাণ-অকল্যাণ এবং সমস্ত ভান্ডারের মালিক। আল্লাহ তা‘আলার অনুমতি ছাড়া কেউ তার নিকট সুপারিশ করতে পারে না। সমস্ত বিষয়ের মালিক একমাত্র তিনি। কোনো অবস্থাতেই তার কোনো শরীক নেই।

শাফা‘আতকারীদের সর্দার কিয়ামতের দিন যখন সেজদায় লুটিয়ে পড়বেন এবং আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা করবেন, তখন তিনি তাকে বলবেন, হে মুহাম্মাদ! মাথা উঠাও। কথা বলো, তোমার কথা শ্রবণ করা হবে। তুমি চাও, তোমাকে প্রদান করা হবে এবং সুপারিশ করো। তোমার সুপারিশ কবুল করা হবে। অতঃপর তার জন্য একটি পরিমাণ নির্দিষ্ট করে দেয়া হবে। তিনি তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, সবকিছুই আল্লাহর মালিকানাধীন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

قُلْ إِنَّ الْأَمْرَ كُلَّهُ لِلَّهِ

‘‘তাদেরকে বলে দাও, সমস্ত বিষয়ের অধিকার রয়েছে একমাত্র আল্লাহর হাতে’’। (সূরা আলে-ইমরান: ১৫৪) আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

ليس لك من الأمر شيئ

‘‘এ বিষয়ে তোমার কিছুই করার নেই’’। (সূরা আলে-ইমরান: ১২৮) আল্লাহ তা‘আলা সূরা আরাফের ৫৪ নং আয়াতে আরো বলেন,

أَلَا لَهُ الْخَلْقُ وَالْأَمْرُ تَبَارَكَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ

‘‘সৃষ্টি জগতের প্রতিপালক মহান আল্লাহরই রয়েছে সৃষ্টি করা ও হুকুম করার ক্ষমতা’’।

আল্লাহ তা‘আলার অনুমতি ছাড়া তার নিকট কেউ সুপারিশ করতে পারবে না। তিনি যাকে এবং যার জন্য সুপারিশ করার অনুমতি দিবেন, তিনি কেবল তার জন্যই আল্লাহর নিকট সুপারিশ করতে পারবেন। তবে আল্লাহ তা‘আলা শাফা‘আতকারীর শাফা‘আত কবুল করার মাধ্যমে সম্মানিত করবেন। যেমন নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

«اشْفَعُوا تُؤْجَرُوا وَيَقْضِي اللَّهُ عَلَى لِسَانِ نَبِيِّهِ مَا يَشَاءُ»

‘‘তোমরা শাফা‘আত করো, তোমাদেরকে এর বিনিময় প্রদান করা হবে। আল্লাহ তা‘আলা তার নাবীর জবানের মাধ্যমে যা ইচ্ছা ফায়ছালা করেন’’।[5]


ছহীহ বুখারীতে নাবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

يَا بَنِي عَبْدِ مَنَافٍ لاأملك لكم من الله شيئا أُغْنِي عَنْكُمْ مِنَ اللَّهِ شَيْئًا وَيَا صَفِيَّةُ عَمَّةَ رَسُولِ اللَّهِ لا أملك لك مِنَ اللَّهِ شَيْئًا يَا عَبَّاسُ عم رسول الله لا أملك لك مِنَ اللَّهِ شَيْئًا

‘‘হে বনী আবদে মানাফ! আমি তোমাদেরকে আল্লাহর আযাব হতে রক্ষা করতে পারব না। হে রাসূলের ফুফু সাফীয়া! আমি তোমাকে আল্লাহর আযাব হতে রক্ষা করতে পারবো না। হে রাসূলের চাচা আববাস! আমি তোমাকে আল্লাহর আযাব হতে রক্ষা করতে পারবো না’’।[6] ছহীহ বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে, নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

لا أُلْفِيَنَّ أَحَدَكُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَلَى رَقَبَتِهِ بَعِيرٌ لَهُ رُغَاءٌ، شَاةٌ لَهَا يعار أو رقاع تخفق فيَقُولُ: أَغِثنِي أغثني فَأَقُولُ: قد أبلغت لَا أَمْلِكُ لَكَ من الله من شَيْئٍ

আমি কিয়ামতের দিন তোমাদের কাউকে এমন অবস্থায় দেখতে চাইনা যে, সে তার ঘাড়ে একটি চিৎকাররত উট রয়েছে অথবা সে চিৎকাররত ছাগল কিংবা ঘোড়া বহন করছে। সে আমাকে ডেকে বলছে, হে আল্লাহর রসূল! আমাকে এ বিপদ থেকে রক্ষা করুন!! আমাকে এ বিপদ থেকে রক্ষা করুন। তখন আমি বলবো: আমি আমার দায়িত্ব পৌঁছিয়ে দিয়েছি। আজ আমি আল্লাহর পক্ষ হতে তোমার কোন উপকার করতে পারবো না’’।[7]

সৃষ্টির সেরা মানব এবং সর্বোত্তম শাফা‘আতকারী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার নিকটতম মানুষকে যেখানে উপরোক্ত কথা বলেছেন যে, তিনি তাদেরকে আল্লাহর আযাব থেকে রক্ষা করতে পারবেন না, তাহলে অন্যদের ক্ষেত্রে কিভাবে এ ধারণা করা যেতে পারে যে, তারা কিয়ামতের দিন মানুষের বিপদা-পদ দূর করতে সক্ষম হবেন?দু‘আকারী যখন আল্লাহর নিকট দুআ করে, শাফা‘আতকারী যখন তার নিকট শাফা‘আত করে, তখন আল্লাহ তা‘আলা দু‘আ শ্রবণ করেন এবং সুপারিশ কবুল করেন। তবে দু‘আ এবং শাফা‘আত আল্লাহ তা‘আলার মধ্যে কোনো প্রভাব খাটাতে পারে না। যেমন এক মাখলুক অন্য মাখলুকের উপর প্রভাব খাটাতে পারে। কেননা আল্লাহ তা‘আলাই কাউকে দু‘আ করার তাওফীক দেন এবং তিনিই শাফা‘আত করার প্রতি অনুপ্রেরণা জাগান। তিনিই বান্দাদের কর্মের স্রষ্টা। তিনিই বান্দাকে তাওবা করার তাওফীক দেন, তিনিই তাওবা কবুল করেন। তিনিই তাদেরকে আমল করার তাওফীক দেন। অতঃপর তিনিই ছাওয়াব দান করেন। তিনিই দু‘আ করার তাওফীক দেন এবং তিনিই তা কবুল করেন। তাকদীরের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনকারী আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মূলনীতি অনুসারে এটিই সঠিক কথা। আল্লাহ তা‘আলাই সবকিছুর স্রষ্টা।

[1]. হাদীছটি যঈফ। দেখুন: শাইখ আলবানী রহিমাহুল্লাহর টিকাসহ শারহুল আকীদাহ আত্ তাহাবীয়া, টিকা নং- ২১২।

[2]. ছহীহ: আবূ দাউদ হা/৩২৫১, মুসনাদে আহমাদ হা/৬০৭৩।

[3]. ইমাম আলবানী রহিমাহুল্লাহ বলেন, হাদীছটি বানোয়াট। দেখুন শাইখ আলবানী রহিমাহুল্লাহর টিকাসহ শারহুল আকীদাহ আত্ তাহাবীয়া, টিকা নং- ২১৪।

[4]. ছহীহ বুখারী হা/১০১০।

[5]. ছহীহ বুখারী হা/ ১৪৩২।

[6]. ছহীহ বুখারী হা/২৭৫৩, ছহীহ মুসলিম হা/২০৬।

[7]. ছহীহ বুখারী হা/৩০৭৩, ছহীহ মুসলিম হা/১৮৩১।
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ৪ পর্যন্ত, সর্বমোট ৪ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে