ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ বলেন,
وَتَعَالَى عَنِ الْحُدُودِ وَالْغَايَاتِ وَالْأَرْكَانِ وَالْأَعْضَاءِ وَالْأَدَوَاتِ، لَا تَحْوِيهِ الْجِهَاتُ السِّتُّ كَسَائِرِ الْمُبْتَدَعَاتِ
আর আল্লাহ তা‘আলা সীমা, পরিধি,[1] অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, সাজ-সরঞ্জাম, উপাদান-উপকরণ ও যন্ত্রপাতির সাহায্য নেয়ার অনেক উর্ধ্বে এবং সকল সৃষ্ট বস্তুকে যেমন ছয়টি দিক পরিবেষ্টন করে রাখে, দিকসমূহ তাকে সেভাবে পরিবেষ্টন করতে পারে না।
...........................................................
ব্যাখ্যা: ইমাম ইবনে আবীল ইয্ রহিমাহুল্লাহ বলেন, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার পবিত্র সত্তা থেকে অপূর্ণতার গুণাবলী নাকোচ করতে গিয়ে ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ এখানে যেসব শব্দ ব্যবহার করেছেন তা বিস্তারিত ব্যাখ্যা করার আগে আমি একটি সংক্ষিপ্ত ভূমিকা পেশ করতে চাই। তা হলো, আল্লাহ তা‘আলার শানে এ শব্দগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে লোকেরা তিন দলে বিভক্ত হয়েছে।
(১) একদল লোক আল্লাহ তা‘আলার পবিত্র সত্তার জন্য এসব শব্দ ব্যবহার করতে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছে।
(২) অন্য একটি দল এগুলো সাব্যস্ত করেছে এবং
(৩) আরেকটি দল এসব শব্দের ব্যাখ্যা করেছে। আর এ শেষোক্ত দলটিই হলো সালাফদের অনুসারী। তারা এগুলোর অর্থ পরিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত নাকোচ করে না এবং এগুলো সাব্যস্তও করে না। এগুলোর মাধ্যমে যা সাব্যস্ত করা হয়েছে, তারা তা কুরআন-সুন্নাহর শব্দের মাধ্যমে সাব্যস্ত করে থাকেন এবং যা নাকোচ করা হয়েছে, তা কুরআন-সুন্নাহর শব্দ দ্বারা নাকোচ করে থাকেন। কেননা পরবর্তীকালের আলেমদের পরিভাষায় আল্লাহ তা‘আলার সুমহান গুণাবলীর ক্ষেত্রে ব্যবহৃত এ শব্দগুলোর মধ্যে সংক্ষিপ্ততা ও অস্পষ্টতা রয়েছে। যেমন অস্পষ্টতা রয়েছে তাদের অন্যান্য পরিভাষার শব্দসমূহে। তাদের প্রত্যেকেই এ শব্দগুলো আভিধানিক দিক থেকে একই অর্থে ব্যবহার করেননি। তাই তারা এ শব্দগুলো নাকোচ করার মাধ্যমে হক ও বাতিল উভয়কেই অস্বীকার করে থাকে এবং যারা এগুলোকে সাব্যস্ত করে, তাদের সম্পর্কে এমন কথা বর্ণনা করে থাকে, যা তারা বলে না। তবে সাব্যস্তকারীদের কেউ কেউ এ শব্দগুলোর ছত্র ছায়ায় আল্লাহ তা‘আলার সুউচ্চ গুণাবলীর মধ্যে বাতিল অর্থও প্রবেশ করিয়ে দেয়। অথচ এ অর্থগুলো সালাফদের কথা এবং আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাতের পরিপন্থী। এ শব্দগুলো নাকোচ করে কিংবা সাব্যস্ত করে কুরআন ও সুন্নাহয় কোনো দলীল আসেনি। ঐদিকে আমাদের জন্য বৈধ নয় যে, আমরা আল্লাহ তা‘আলাকে এমন বিশেষণে বিশেষিত করবো, যা দ্বারা তিনি নিজের সত্তাকে বিশেষিত করেননি এবং তার রসূলও তাকে তা দ্বারা বিশেষিত করেননি। এমনি আমরা আল্লাহ তা‘আলার পবিত্র সত্তা থেকে কোনো কিছু নাকোচ করার ক্ষেত্রেও একই নীতি অবলম্বন করবো। অর্থাৎ আমরা তার পবিত্র সত্তা থেকে এমন কিছু নাকোচ করবো না, যা তিনি তার পবিত্র সত্তা থেকে নাকোচ করেননি কিংবা তার রসূলও তার পবিত্র সত্তা থেকে উহা নাকোচ করেননি। বরং আমরা কুরআন, সুন্নাহ ও সালাফদের অনুসরণ করবো, বিদ‘আত করবো না।
আল্লাহ তা‘আলার সিফাতের ক্ষেত্রে কথা হলো, আল্লাহ তা‘আলা তার নিজের সত্তার জন্য যা সাব্যস্ত করেছেন এবং তার রসূল যা সাব্যস্ত করেছেন, আমরা কেবল তাই সাব্যস্ত করি। আর আল্লাহ তা‘আলা তার পবিত্র সত্তা থেকে অপূর্ণতার যেসব বিশেষণ নাকোচ করেছেন এবং তার রসূল যা নাকোচ করেছেন, আমরা কেবল তাই নাকোচ করি। আর যেসব শব্দের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার জন্য পূর্ণতার গুণাবলী সাব্যস্ত করা হয়েছে কিংবা যেসব শব্দের মাধ্যমে তার থেকে অপূর্ণতার বিশেষণ নাকোচ করা হয়েছে, আমরা কেবল সেই শব্দগুলোই ব্যবহার করি। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা এবং তার রসূল যেসব শব্দ ও অর্থ সাব্যস্ত করেছেন, আমরা তাই সাব্যস্ত করি। আর কালাম শাস্ত্রবিদগণ আল্লাহ তা‘আলার সিফাতের ক্ষেত্রে যেসব অভিনব শব্দ ব্যবহার করেছেন তা নাকোচ কিংবা সাব্যস্ত করার ব্যাপারে আমরা তাড়াহুড়া করি না। বরং আমরা উক্ত শব্দগুলোর প্রবক্তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি। তার কথার মধ্যে যদি সঠিক অর্থ বিদ্যমান থাকে, তাহলে আমরা সেই সঠিক অর্থকে সমর্থন করি। তবে সেই সঠিক অর্থ কুরআন-হাদীছের যে শব্দের মাধ্যমে এসেছে, আমরা সেই শব্দের মাধ্যমে তা প্রকাশ করি। তবে বিনা প্রয়োজনে আমরা এ বিষয়ে মানুষের তৈরী শব্দ ব্যবহার করি না। আর আমরা কেবল এ শব্দগুলো তখনই ব্যবহার করি, যখন তা থেকে এ সঠিক অর্থটি সুস্পষ্ট হওয়ার কোনো আলামত পাওয়া যাবে। শব্দগুলো ব্যবহারের প্রয়োজন কেবল তখনই হতে পারে, যখন উপরোক্ত শব্দগুলো ব্যবহার করা ব্যতীত সম্বোধিত ব্যক্তিকে বুঝানো সম্ভব হয় না। অনুরূপ অন্যান্য প্রয়োজনেও আল্লাহ তা‘আলার সিফাতের ক্ষেত্রে কুরআন-সুন্নাহ বহির্ভূত শব্দ ব্যবহার করা জায়েয আছে।
আসলে ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ তার বক্তব্যের মাধ্যমে দাউদ আলজাওয়ারেবী এবং অন্যান্য মুশাবেবহা সম্প্রদায়ের প্রতিবাদ করতে চেয়েছেন। তারা বলে থাকে আল্লাহর শরীর আছে, দেহ আছে। তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এবং অন্যান্য জিনিসও আছে। আল্লাহ তা‘আলা তাদের কথার বহু উর্ধ্বে। শাইখ এখানে যে অর্থের নফী করতে চেয়েছেন, তা নফী করা ঠিক আছে। কিন্তু শাইখের পরে যারা আগমন করেছেন তারা তার সাধারণ নফীর মধ্যে হক ও বাতিল উভয়ই ঢুকিয়ে দিয়েছে। সুতরাং তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদান করা জরুরী।
সালাফগণের ঐক্যমতে কোনো মানুষের পক্ষেই আল্লাহ তা‘আলার সীমা, ধরণ-কায়া-আকৃতি সম্পর্কে অবগত হওয়া সম্ভব নয়। তারা আল্লাহ তা‘আলার সিফাতেরও কোনো সীমা ও ধরণ নির্ধারণ করেন না। ইমাম আবু দাউদ আত্-তায়ালেসী রহিমাহুল্লাহ বলেন, সুফিয়ান, শু’বা, হাম্মাদ বিন যায়েদ, হাম্মাদ বিন সালামা, শুরাইক এবং আবু আওয়ানা রহিমাহুল্লাহ আল্লাহ তা‘আলার কাইফিয়্যাত-সীমা বর্ণনা করতেন না, আল্লাহ তা‘আলার সদৃশ বর্ণনা করতেন না এবং তার পবিত্র সত্তার উপমাও পেশ করতেন না। তারা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার সুউচ্চ সিফাতের হাদীছগুলো বর্ণনা করতেন। কিন্তু তারা كيف তথা কিভাবে শব্দটি উচ্চারণ করতেন না। এ ব্যাপারে কেউ জিজ্ঞাসা করলে, তারা হাদীছ ও ছাহাবীদের উক্তি পেশ করতেন। শাইখের উক্তি, قد أعجز خلقه عن الإحاطة به ‘‘তার সৃষ্টি তাকে জ্ঞানের মাধ্যমে পুরোপুরি আয়ত্ত করতে অক্ষম’’ -এ কথার ব্যাখ্যা করার সময় এ বিষয়ে আরো বিস্তারিত আলোচনা সামনে আসছে।
সুতরাং ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ এর কথা থেকে আমরা জানতে পারলাম যে, কারো পক্ষে আল্লাহ তা‘আলাকে সীমায়িত করা অসম্ভব এবং তার প্রকৃত অবস্থা ও স্বরূপ বর্ণনা করাও সম্ভব নয়। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার সিফাত তার সৃষ্টির সিফাতের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন, তিনি সৃষ্টি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এবং তার সৃষ্টিও তার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।[2]
আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক রহিমাহুল্লাহকে একদা জিজ্ঞাসা করা হলো, আমরা আমাদের প্রভুকে কিভাবে চিনতে পারবো? জবাবে তিনি বললেন, আমাদের প্রভু আরশের উপরে এবং তিনি তার সৃষ্টি থেকে আলাদা। তাকে বলা হলো, তার কোনো সীমা বা ধরণ আছে কি? তিনি বললেন, হ্যাঁ অবশ্যই আছে। আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারকের কথা এখানেই শেষ।
আর এটি জানা কথা যে, এক জিনিস থেকে অন্য জিনিসকে যা দ্বারা আলাদা করা হয় এবং যেসব গুণাবলী দ্বারা এক বস্তুকে অন্য বস্তু থেকে পৃথক করা হয়, তাকে সীমা বলা হয়। আল্লাহ তা‘আলা তার কোনো সৃষ্টির মধ্যে অবতরণ করেন না এবং কোনো সৃষ্টির সাহায্যে তিনি প্রতিষ্ঠিত নন; বরং তিনি অবিনশ্বর, চিরন্তন, নিজে নিজেই প্রতিষ্ঠিত এবং তিনি ব্যতীত অন্যান্য সকল বস্তুকে প্রতিষ্ঠাকারী। সুতরাং যখন الحد বা সীমার এ অর্থ জানা গেল, তখন এ ব্যাপারে কোনো মতভেদ করা মোটেই বৈধ হবে না। সুতরাং আল্লাহর হদ্দ বা কাইফিয়্যাত নেই, এ কথার অর্থ হলো আল্লাহ নেই এবং তার কোনো হাকীকতও নেই। (নাউযুবিল্লাহ) বস্তুত আল্লাহ তা‘আলার সীমা বা ধরন-কায়া-আকৃতি আছে; কিন্তু আমাদের তা জানা নেই। বান্দারা এ ব্যাপারে কথা বলতে অক্ষম। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের ঐক্যমতে আল্লাহ তা‘আলার কায়া-আকৃতি-হাকীকত ও ধরন কোনো সৃষ্টির জানা নেই।
আবুল কাসেম আল-কুসাইরী রহিমাহুল্লাহ তার পুস্তিকায় বলেন, আমি আবু আব্দুর রাহমান আস-সুলামীকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, আমি আবু মানসুর বিন আব্দুল্লাহকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, আমি আবুল হাসান আল-আনবারীকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, আমি সাহল বিন আব্দুল্লাহকে বলতে শুনেছি, তাকে যখন আল্লাহর যাত বা সত্তা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলো, জবাবে তিনি বলেছেন আল্লাহ তা‘আলার সত্তা পূর্ণতার বিশেষণ দ্বারা বিশেষিত, জ্ঞানের মাধ্যমে কোনো সৃষ্টির পক্ষে আয়ত্ত করা অসম্ভব, দুনিয়াতে কপালের চোখ দিয়ে তাকে কেউ দেখেনি। কেনো সৃষ্টি তার ধরণ, আকৃতি-কায়া, সীমা সম্পর্কে জানতে পারেনি। কোনো সৃষ্টির পক্ষে তাকে জ্ঞানের মাধ্যমে পরিবেষ্টন করা সম্ভব নয় এবং তিনি কোনো সৃষ্টির মধ্যে প্রবেশ করেন না। আখেরাতে মানুষ চোখ দিয়ে তাকে দেখবে। তিনি স্বীয় কুদরত ও নির্দশনের মাধ্যমে সৃষ্টির নিকট প্রকাশ্য। সৃষ্টি তার সত্তা ও বিশেষণের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে অজ্ঞ। আল্লাহ তা‘আলা অসংখ্য নিদর্শনের মাধ্যমে তার বান্দাদেরকে তাওহীদের প্রতি পথ প্রদর্শন করেছেন। সৃষ্টির অন্তরসমূহ তাকে চিনতে পারে; কিন্তু তাদের চোখ তাকে আয়ত্ত করতে পারে না। মুমিনগণ জান্নাতে তার দিকে তাকিয়ে থাকবে; কিন্তু পরিপূর্ণরূপে পরিবেষ্টন করতে পারবে না এবং তাকে চূড়ান্তভাবে আয়ত্ত করতে পারবে না।
ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহর কথা, ‘‘তিনি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, সাজ-সরঞ্জাম, উপাদান-উপকরণ ও যন্ত্রপাতির সাহায্য নেয়ার বহু উর্ধ্বে’’ এ শব্দগুলোর ছত্রছায়ায় আল্লাহ তা‘আলার সিফাতে অবিশ্বাসীরা কুরআন-সুন্নার অকাট্য দলীল দ্বারা সুসাব্যস্ত কতিপয় সিফাতকে অস্বীকার করে থাকে। যেমন হাত ও চেহারা বা মুখমণ্ডল।
ইমাম আবু হানীফা রহিমাহুল্লাহ ফিকহুল আকবারে বলেন, আল্লাহ তা‘আলার হাত, চেহারা ও নফস্ রয়েছে। কেননা কুরআনে আল্লাহ তা‘আলার হাত, চেহারা ও নফস্ থাকার কথা উল্লেখ রয়েছে। হাত আল্লাহর সিফাত। তবে এর ধরণ আমরা জানি না। হাত বলতে আল্লাহর কুদরত ও নেয়ামতকে বুঝানো হয়েছে, -এ কথা বলা ঠিক নয়। এতে আল্লাহ তা‘আলার সিফাতকে বাতিল করা হয়। ইমাম আবু হানীফা রহিমাহুল্লাহর কথা এখানেই শেষ।
আল্লাহ তা‘আলার সিফাতের ক্ষেত্রে ইমাম আবু হানীফা রহিমাহুল্লাহ এর এ কথা অকাট্য দলীল দ্বারা সাব্যস্ত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
قَالَ يَاإِبْلِيسُ مَا مَنَعَكَ أَنْ تَسْجُدَ لِمَا خَلَقْتُ بِيَدَيَّ أَاسْتَكْبَرْتَ أَمْ كُنتَ مِنْ الْعَالِينَ
‘‘আল্লাহ বললেন, হে ইবলীস! যাকে আমি নিজের দুই হাত দ্বারা সৃষ্টি করেছি তার সম্মুখে সেজদা করতে তোমাকে কিসে বাধা দিল? তুমি কি অহংকার করলে? না তুমি তার চেয়ে উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন?’’ (সূরা ছবদ: ৭৫) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
وَمَا قَدَرُوا اللَّهَ حَقَّ قَدْرِهِ وَالْأَرْضُ جَمِيعًا قَبْضَتُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَالسَّماوَاتُ مَطْوِيَّاتٌ بِيَمِينِهِ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى عَمَّا يُشْرِكُونَ
‘‘তারা আল্লাহর মর্যাদা ও ক্ষমতা মোতাবেক কদর করেনি। কিয়ামতের দিন গোটা পৃথিবী থাকবে তার হাতের মুঠোয় এবং আসমানসমূহ ভাঁজ করা অবস্থায় থাকবে তার ডান হাতে। তিনি পবিত্র। আর এরা যাকে শরীক করে, তা থেকে তিনি অনেক উর্ধ্বে’’। (সূরা আয যুমার: ৬৭) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
كُلُّ شَيْءٍ هَالِكٌ إِلَّاوَجْهَهُ
‘‘তার চেহারা ব্যতীত সবকিছুই ধ্বংস হবে’’। (সূরা কাসাস: ৮৮)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
كُلُّ مَنْ عَلَيْهَا فَانٍ وَيَبْقَى وَجْهُ رَبِّكَ ذُو الْجَلَالِ وَالْإِكْرَامِ
‘‘ভূপৃষ্ঠের সবকিছুই ধ্বংস হবে। একমাত্র তোমার সেই রবের চেহারাই অবশিষ্ট থাকবে, যিনি মহিয়ান ও দয়াবান। (সূরা আর্ রাহমান: ২৬-২৭) আল্লাহ তা‘আলা সূরা মায়িদার ১১৬ নং আয়াতে আরো বলেন,
تَعْلَمُ مَا فِي نَفْسِي وَلَا أَعْلَمُ مَا فِي نَفْسِكَ إِنَّكَ أَنتَ عَلَّامُ الْغُيُوبِ
‘‘আমার অন্তরে যা আছে তা তুমি জানো। কিন্তু তোমার অন্তরে যা আছে আমি তা জানি না, তুমি তো গায়েবের সমস্ত জ্ঞান রাখো’’। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
كَتَبَ رَبُّكُمْ عَلَىٰ نَفْسِهِ الرَّحْمَةَ أَنَّهُ مَنْ عَمِلَ مِنكُمْ سُوءًا بِجَهَالَةٍ ثُمَّ تَابَ مِن بَعْدِهِ وَأَصْلَحَ فَأَنَّهُ غَفُورٌ رَّحِيمٌ
‘‘তোমাদের প্রতিপালক রহমত করাকে নিজের উপর আবশ্যক করে নিয়েছেন। নিশ্চয়ই তোমাদের কেউ যদি অজ্ঞতা বশত কোন খারাপ কাজ করে বসে, তারপর তাওবা করে এবং নিজেকে সংশোধন করে নেয়, তাহলে তিনি তাকে মাফ করে দেন এবং তার প্রতি দয়া করেন’’। (সূরা আনআম: ৫৪)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, وَاصْطَنَعْتُكَ لِنَفْسِي ‘‘আমি তোমাকে আমার নফ্সের জন্য তৈরী করে নিয়েছি’’। (সূরা ত্বহা: ৪১)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, وَيُحَذِّرُكُمُ اللَّهُ نَفْسَهُ ‘‘আল্লাহ তোমাদেরকে তার নফসের ভয় দেখাচ্ছেন’’। (সূরা আলে-ইমরান: ২৮)
শাফা‘আতের হাদীছে এসেছে, নাবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
«لَمَّا يَأْتِي النَّاسُ آدَمَ فَيَقُولُونَ لَهُ: خَلَقَكَ اللَّهُ بِيَدِهِ وَأَسْجَدَ لَكَ مَلَائِكَتَهُ وَعَلَّمَكَ أَسْمَاءَ كُلِّ شَيْءٍ»
‘‘কিয়ামতের দিন যখন মানুষ আদম আলাইহিস সালামের নিকট এসে বলবে, আল্লাহ তা‘আলা আপনাকে স্বীয় হাত দ্বারা সৃষ্টি করেছেন, তার ফেরেশতাকে দিয়ে আপনাকে সিজদা করিয়েছেন এবং আপনাকে সব জিনিসের নাম শিখিয়েছেন’’।[3]
যারা আল্লাহ তা‘আলার হাতকে কুদরত দ্বারা তাবীল করে, তাদের কথা সঠিক নয়। আল্লাহ তা‘আলার বাণী, (لِمَا خَلَقْتُ بِيَدَيَّ) [ص: 75] ‘‘যাকে আমি আমার দুই হাত দ্বারা সৃষ্টি করেছি’’ (সূরা ছবদ:৭৫)
এখানে يد শব্দের দ্বি-বচন يدين কে قدرتين (দু’টি কুদরত) দ্বারা তাবীল করা ছহীহ নয়। কেননা আল্লাহ তা‘আলার কুদরত মাত্র দু’টি নয়। হাত দ্বারা যদি কুদরত উদ্দেশ্য হতো, তাহলে ইবলীসের জন্যও এ কথা বলার সুযোগ থাকতো যে, আমাকেও তো তোমার দুই হাত দ্বারা সৃষ্টি করেছো। সুতরাং এ কারণে আমার উপর আদমের কোনো মর্যাদা থাকতে পারে না। তাই দেখা যাচ্ছে যে, ইবলীস কাফের হওয়া সত্তেও তার রব সম্পর্কে জাহমীয়াদের চেয়েও অধিক অবগত ছিল। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
أَوَلَمْ يَرَوْا أَنَّا خَلَقْنَا لَهُم مِّمَّا عَمِلَتْ أَيْدِينَا أَنْعَامًا فَهُمْ لَهَا مَالِكُونَ
‘‘এরা কি দেখে না, আমি নিজের হাতে তৈরী জিনিসের মধ্য থেকে এদের জন্য সৃষ্টি করেছি গবাদি পশু এবং এখন এরা তার মালিক’’। (সূরা ইয়াসীন: ৭১)
এখানে يد শব্দের বহুবচন أيد ব্যবহার করার মধ্যে আল্লাহ তা‘আলার প্রকৃত হাত অস্বীকার করার কোনো দলীল নেই। অর্থাৎ তারা বলে থাকে হাত দ্বারা যদি প্রকৃত হাত উদ্দেশ্য হতো, তাহলে এখানে হাত বহুবচন হিসাবে ব্যবহৃত হতো না। হাত শব্দটি যেহেতু কখনো একবচন, কখনো দ্বি-বচন আবার কখনো বহুবচন হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে, তাই বুঝা যাচ্ছে হাত দ্বারা আল্লাহ তা‘আলার কুদরত উদ্দেশ্য।
আমরা তাদের জবাবে বলবো যে, এখানে যেহেতু يد কে বহুবচনের যমীরের দিকে সম্বন্ধ করা হয়েছে, তাই আরবী ব্যাকরণের নিয়ম অনুসারে يد কেও বহুবচন أيد হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। কেননা দ্বি-বচনের শব্দকে যখন বহুবচনের যমীরের দিক ইযাফত করা হয়, তখন আরবী গ্রামারের নিয়ম অনুসারে সেই দ্বি-বচনকে বহুবচন হিসাবে ব্যবহার করা আবশ্যক। আর এখানে আল্লাহ তা‘আলার রাজত্ব ও সম্মান-মর্যাদা বুঝানোর জন্য শব্দ দু’টিকে বহুবচন হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। ঐদিকে لِمَا خَلَقْتُ بِيَدَيَّ ‘‘যাকে আমি আমার দুই হাত দ্বারা সৃষ্টি করেছি’’ -এর মধ্যে হাতকে বহুবচন ব্যবহার করার মাধ্যমে একবচনের যমীরের দিকে সম্বন্ধ করে أَيْدِيَّ বলেন নি এবং يد কে দ্বি-বচন হিসাবে ব্যবহার করে বহুবচনের যমীরের দিকে সম্বন্ধ يَدَيْنَا বলেননি।
এর কারণ হলো আল্লাহ তা‘আলার বাণী, مِّمَّا عَمِلَتْ أَيْدِينَا ‘‘আমি নিজের হাতে তৈরী করেছি’’ এবং لِمَا خَلَقْتُ بِيَدَيَّ ‘‘যাকে আমি নিজের দু’হাত দ্বারা সৃষ্টি করেছি’’ এ উভয় বাক্যের উদ্দেশ্য এক নয়।
অতঃপর শাইখ আল্লাহ তা‘আলার চেহারা সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, আবু মূসা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ তা‘আলার চেহারা সম্পর্কে বলেন,
(حِجَابُهُ النُّورُ لَوْ كَشَفَهُ لَأَحْرَقَتْ سُبُحَاتُ وَجْهِهِ مَا انْتَهَى إِلَيْهِ بَصَرُهُ مِنْ خَلْقِهِ)
‘‘তার পর্দা হচ্ছে নূর। তিনি যদি তা উন্মুক্ত করেন, তবে তার চোখের দৃষ্টি যতদূর যাবে, ততোদূর পর্যন্ত সকল মাখলুক তার চেহারার আলোতে জ্বলে যাবে’’।[4]
তবে আল্লাহ তা‘আলার এ সিফাতগুলো সম্পর্কে বলা যাবে না যে, এগুলো তার কাজ করা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কিংবা তার কাজ করার হাতিয়ার বা তার রুকন। কেননা কোনো জিনিসের অংশকে তার রুকন বলা হয়। আল্লাহ তা‘আলা একক ও অমূখাপেক্ষী। আল্লাহ তা‘আলার কোনো অংশ হয় না। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্যে অংশ বিশেষ ও খন্ড-বিখন্ড হওয়ার অর্থ বিদ্যমান থাকে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা এসবের অনেক উর্ধ্বে। এ অর্থেই আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
الَّذِينَ جَعَلُوا الْقُرْآنَ عِضِينَ
‘‘যারা নিজেদের কুরআনকে খন্ডবিখন্ড করে ফেলে’’। (সূরা হিজর: ৯১)অঙ্গ-প্রতঙ্গের মধ্যে রয়েছে অর্জন-উপার্জন এবং উপকৃত হওয়ার অর্থ। এমনি যন্ত্রপাতি সাধারণত কল্যাণ অর্জন এবং অকল্যাণ দূর করার জন্য ব্যবহার করা হয়। এসব অর্থ আল্লাহ তা‘আলার ক্ষেত্রে অকল্পনীয়। এ জন্যই আল্লাহ তা‘আলার সিফাতের ক্ষেত্রে এ শব্দগুলো কুরআন-হাদীছে ব্যবহৃত হয়নি। আল্লাহ তা‘আলার সিফাতের ক্ষেত্রে কুরআন-হাদীছে যেসব শব্দমালা ব্যবহার হয়েছে সেগুলোর অর্থই সঠিক এবং বাতিল অর্থের সম্ভাবনা থেকে মুক্ত। আল্লাহ তা‘আলার পূর্ণতার সিফাত সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে এবং তার পবিত্র সত্তা থেকে অপূর্ণতার বিশেষণ নাকোচ করার ব্যাপারে কখনো কুরআন-হাদীছের বাইরে যাওয়া যাবে না। এতেই বাতিল অর্থ সাব্যস্ত করা থেকে বাঁচা যাবে এবং সঠিক অর্থ নাকোচ হওয়া থেকেও নিরাপদ থাকা যাবে। উপরে যেসব সংক্ষিপ্ত শব্দ উল্লেখ করা হয়েছে, তার সবগুলোর মধ্যেই হক ও বাতিল থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
সালাফে সালেহীন তথা পূণ্যবান পূর্বসূরীগণের মধ্যে যারা আরশের উপর আরোহণ ইত্যাদি সংক্রান্ত সীমা বর্ণনা করেছেন, সেখানে সীমা দ্বারা তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে এমন সীমা-পরিসীমার কথা যা আল্লাহ তা‘আলা জানেন, বান্দার জানা কোনো সীমা নয়। গ্রন্থকারের অন্য কথা, আল্লাহ তা‘আলা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও সাজ-সরঞ্জাম থেকে মুক্ত, এর দ্বারাও তার উদ্দেশ্য হচ্ছে মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলাকে তার প্রজ্ঞা ও সত্তার সাথে সম্পৃক্ত গুণাবলী, যেমন চেহারা, হাত, পা ইত্যাদিতে সৃষ্টির সাথে সামঞ্জস্য বিধান করা থেকে পবিত্র করা। তবে মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা চেহারা, হাত, পা ইত্যাদি গুণাগুণে গুণান্বিত, যদিও তার কোনো গুণ সৃষ্টিকুলের গুণের মত নয়; আর আল্লাহ ব্যতীত অপর কেউ তার এ গুণের ধরণ সম্পর্কে অবহিত নয়। বিদ‘আতীরা এ ধরণের শব্দ ব্যবহার করে থাকে যাতে করে এর দ্বারা আল্লাহর গুণাবলী অস্বীকার করতে পারে। আর সে উদ্দেশ্যে তারা এমন সব শব্দ ব্যবহার করে যেগুলো আল্লাহ তা‘আলা নিজে বলেননি এবং নিজের জন্য সাব্যস্ত করেননি; যাতে করে তাদের ষড়যন্ত্র প্রকাশিত হয়ে না পড়ে এবং হকপন্থীরা তাদের উপর দোষ না দিতে পারে। গ্রন্থকার অবশ্য বিদ‘আতীদের মত উদ্দেশ্য নেননি। কারণ তিনি আহলে সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত, যারা আল্লাহর গুণাবলী সাব্যস্তকারী। এ আক্বীদায় তার কথা-বার্তার একাংশ অপর অংশের ব্যাখ্যা করে, একাংশ অপর অংশের সত্যায়ণ করে এবং সন্দেহযুক্ত অংশকে সন্দেহমুক্ত অংশে ব্যাখ্যা করে। অনুরূপভাবে গ্রন্থকারের কথা অন্যান্য সৃষ্ট বস্তুর ন্যায় ষষ্ঠ দিক তাকে বেষ্টন করে রাখতে পারে না, -এর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে, সৃষ্টিগত ছয়টি দিক। এর দ্বারা মহান আল্লাহর উচ্চে থাকা ও আরশের উপর তাঁর আরোহন করার বিষয়টি অস্বীকার করা উদ্দেশ্য নয়। কারণ এটি সৃষ্ট ছয় দিকের অভ্যন্তরে নয়। কারণ তিনি সৃষ্টিজগতের উপরে এবং সৃষ্টিজগতকে পরিবেষ্টন করে আছেন। মহান আল্লাহ সুউচ্চে থাকার বিষয়টির উপর ঈমান থাকা তিনি তাঁর বান্দাদের ফিতরাত তথা অন্তরে স্বাভাবিকভাবে গেঁথে দিয়েছেন। তাদের স্বাভাবিক অন্তরের কথা হচ্ছে যে, তিনি উপরের দিকে। এ বিষয়ে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত তথা নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ছাহাবী এবং সুন্দরভাবে তাদের অনুসারী তাবেঈগণও এর উপর একমত হয়েছেন। কুরআনে কারীম ও সহীহ মুতাওয়াতির সুন্নাহ স্পষ্ট প্রমাণ দিচ্ছে যে, তিনি উপরে রয়েছেন। হে প্রিয় পাঠক এ বিষয়টি সম্পর্কে ভালোভাবে সাবধান থাকুন এবং জেনে রাখুন যে এটাই সত্য, এটা ব্যতীত অন্য কিছু বাতিল। আর আল্লাহই তাওফীক দেওয়ার মালিক।
[2]. আক্বীদাহর কিতাবসমূহে আলেমগণ বলেছেন, الله تعالى مستوٍ على عرشه بائن من خلقه ‘‘আল্লাহ তা‘আলা আরশের উপর সমুন্নত এবং তার সৃষ্টি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা’’। আল্লাহ তাআলার সত্তা আরশের সাথে লেগে ও মিশে থাকার ধারণাকে নাকোচ করার জন্যই আলেমগণ এ বাক্যটি ব্যবহার করে থাকেন।
[3]. ছহীহ বুখারী হা/৪৪৭৬, মুসনাদে আহমাদ হা/১৩৫৬২।
[4]. ছহীহ মুসলিম হা/১৭৯, অধ্যায়: কিতাবুল ঈমান।
আর الجهة (দিক) শব্দটি দ্বারা কখনো অস্তিত্বশীল জিনিস বুঝায়। আবার কখনো তা দ্বারা অস্তিত্বহীন জিনিস বুঝানো হয়। বিবেক-বুদ্ধির দলীল দ্বারা সুসাব্যস্ত যে, অস্তিত্বশীল জিনিস মাত্র দু’টি। স্রষ্টা ও সৃষ্টি। ‘দিক’ বলতে যদি আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া অন্য কোনো অস্তিত্বশীল জিনিস বুঝায়, তাহলে তা মাখলুকের অন্তর্ভুক্ত হবে। কোনো সৃষ্টির পক্ষেই আল্লাহ তা‘আলাকে সীমায়িত করা সম্ভব নয়। কোনো সৃষ্টিই আল্লাহ তা‘আলাকে পরিবেষ্টন করতে সক্ষম নয়। আল্লাহ তা‘আলা এরূপ চিন্তার বহু উর্ধ্বে। কিয়ামতের দিন যে মহান সত্তা সমগ্র সৃষ্টিজগতকে এক আঙ্গুলে রাখবেন, কোনো সৃষ্টির পক্ষে তাকে সীমায়িত ও সীমাবদ্ধ করার ধারণা যাদের মাথায় আসে, তারা আল্লাহর যথাযথ বড়ত্ব উপলব্ধি করতে পারেনি।
আর যদি তা দ্বারা কোনো অস্তিত্বহীন বিষয় বুঝায়, তাহলে তা হবে সৃষ্টিজগতের সম্পূর্ণ বাইরে। অর্থাৎ ‘দিক’ নামে কোনো সৃষ্টির অস্তিবতই নেই। সুতরাং যখন বলা হবে, আল্লাহ উপরের দিকে রয়েছেন, অর্থাৎ সৃষ্টি জগতের সম্পূর্ণ বাইরে তাহলে ঠিক আছে। এর অর্থ হলো তিনি সৃষ্টি জগতের সম্পূর্ণ বাইরে ও সম্পূর্ণ উপরে। সৃষ্টিজগতের বাইরে একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলাই রয়েছেন। সুতরাং তিনি সৃষ্টিজগতের সম্পূর্ণ বাইরে এবং সকল সৃষ্টির উপরে সমুন্নত।
আর যারা আল্লাহ তা‘আলার শানে الجهة ‘দিক’ শব্দটি ব্যবহার করে সৃষ্টির উপর আল্লাহ তা‘আলার সমুন্নত হওয়াকে নাকোচ করতে চায়, তারা তাদের মতের সপক্ষে দলীল হিসাবে উল্লেখ করে যে, সকল দিকই সৃষ্টি। আর আল্লাহ তা‘আলা ‘দিক’ সৃষ্টি করার পূর্ব থেকেই আছেন। তারা আরো বলে, যারা বলবে, আল্লাহ তা‘আলা কোনো দিকে রয়েছেন, তাদের কথা থেকে সৃষ্টির কোনো কোনো জিনিস চিরন্তন ও অবিনশ্বর হওয়া আবশ্যক হয়। এতে আরো আবশ্যক হয় যে, প্রথমে তিনি দিকের প্রতি অমুখাপেক্ষী ছিলেন। পরে দিকের মধ্যে ঢুকে পড়েছেন। নাউযুবিল্লাহ।
আসল কথা হলো ইমাম ত্বহাবী উপরোক্ত শব্দগুলো ব্যবহার করে বুঝাতে চেয়েছেন যে, আল্লাহ তা‘আলা কোনো সৃষ্টির ভিতরে নন। সেটিকে ‘দিক’ হিসাবে নাম দেয়া হোক বা না হোক। এটিই সঠিক। সঠিক কথা হলো ‘দিক’ কোনো স্বনির্ভর অস্তিত্বশীল সৃষ্টি নয়। অন্যের প্রতি সম্বন্ধ করা ব্যতীত এটির অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। নিঃসন্দেহে দিকের কোনো শেষ বা প্রান্তসীমা নেই। সীমাহীন কোনো সৃষ্টির অস্তিত্ব নেই। সুতরাং অসীমকে সসীম জিনিসের দ্বারা সীমায়িত করার ধারণা বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়। আর আমরা আল্লাহ তা‘আলার জন্য যেই ‘দিক’ সাব্যস্ত করি, তা কোনো সৃষ্টি নয়। তাহলো সৃষ্টির উপরের ‘দিক’। কিন্তু কুরআন ও সুন্নায় আল্লাহ তা‘আলার সিফাতের ক্ষেত্রে ‘দিক’ শব্দটি আসে নেই। এটি আল্লাহ তা‘আলার জন্য সাব্যস্ত করা হয়নি। নাকোচও করা হয়নি। তাই আমরা এ থেকে দূরে থাকাই উচিত মনে করি।
তবে কেউ যদি বলে, আল্লাহর কোনো ‘দিক’ ও সীমা নেই, তাকে আমরা বলবো, এ কথার মাধ্যমে আপনার উদ্দেশ্য কী? সে যদি বলে, আমার উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহ তা‘আলাকে কোনো কিছুই পরিবেষ্টন করতে পারে না, তিনি সবকিছুর উর্ধ্বে, সবচেয়ে বড় এবং সবকিছুকে পরিবেষ্টনকারী, তাহলে আমরা তাকে বলবো, তোমার উদ্দেশ্য সঠিক। তবে যারা সৃষ্টির উপর আল্লাহর সমুন্নত হওয়াকে অস্বীকার করে, তারাই বলে আল্লাহ তা‘আলার কোনো ‘দিক’ ও সীমা নেই।[1] তারা বলে ليس لله جهة ‘‘অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার কোনো ‘দিক’ নেই। তাদের কথার উদ্দেশ্য হলো আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টির উপরে নয়। তাই আল্লাহ তা‘আলার শানে এ ধরণের শব্দ ব্যবহার করা ঠিক নয়। যেসব শব্দ হক ও বাতিলের সম্ভাবনা রাখে তা ব্যবহার না করে শরীয়ত সম্মত শব্দ ব্যবহার করাই উত্তম।
ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ বলেন, لَا تَحْوِيهِ الْجِهَاتُ السِّتُّ كَسَائِرِ الْمُبْتَدَعَاتِ ‘‘সকল সৃষ্ট বস্তুকে যেমন ছয়টি দিক পরিবেষ্টন করে রাখে, দিকসমূহ সেভাবে তাকে পরিবেষ্টন করতে পারে না’’। ইমামের এ কথা সঠিক। এ দৃষ্টিকোন থেকে কথাটি সঠিক যে, সৃষ্টিজগতের কিছুই তাকে পরিবেষ্টন করে রাখতে পারে না। বরং তিনিই সবকিছুকে পরিবেষ্টন করে রয়েছেন এবং রয়েছেন সবকিছুর উপরে। শাইখ এখানে এ অর্থই উদ্দেশ্য করেছেন। কেননা এ বিষয়ে শাইখের উক্তি: أَنَّهُ تَعَالَى مُحِيطٌ بِكُلِّ شَيْءٍ وَفَوْقَهُ ‘‘তিনিই সবকিছুকে পরিবেষ্টন করে রয়েছেন’’ এবং তিনি রয়েছেন সবকিছুর উপরে, শাইখের এ কথা সামনে আসছে।
শাইখের কথা: সকল সৃষ্ট বস্তুকে যেমন ছয়টি দিক পরিবেষ্টন করে রাখে, দিকসমূহ তাকে সেভাবে পরিবেষ্টন করে রাখতে পারে না এবং ‘‘তিনিই সবকিছুকে পরিবেষ্টন করে রয়েছেন’’ এ দুই কথাকে যখন একত্র করা হবে, তখন বুঝা যাবে যে, আল্লাহ তা‘আলাকে সীমায়িত করা এবং পরিবেষ্টন করা কোনো সৃষ্টির পক্ষেই সম্ভব নয়। যেমন পরিবেষ্টন ও সীমায়িত করা সম্ভব হয় আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্টিকে। মোটকথা, আল্লাহ তা‘আলাই সবকিছুকে পরিবেষ্টনকারী, তিনিই সবকিছুর উপরে সমুন্নত।
শাইখের বক্তব্যের মধ্যে দু’টি বিষয় বাকী রয়ে গেছে। প্রথম বিষয়টি হলো এ জাতিয় শব্দের মধ্যে যেহেতু অস্পষ্টতা এবং বাতিল অর্থের সম্ভাবনা রয়েছে, তাই এ জাতিয় শব্দ পরিহার করাই উত্তম ছিল। এ ধরণের শব্দ পরিহার না করার কারণে শাইখের কথা থেকে ভুল বুঝার সম্ভাবনা রয়ে গেছে। সেই সঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা যে সবকিছুকে পরিবেষ্টন করে রয়েছেন এবং তিনি যে সবকিছুর উপরে, -তার কথা থেকে এটি সাব্যস্ত করার সাথে সাথে তিনি উপরের দিকে থাকার বিষয়টি নাকোচ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও রয়ে গেছে। যদিও এ সন্দেহের জবাবে ইতিপূর্বে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলাকে কোনো সৃষ্টি পরিবেষ্টন করতে পারে, -ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ তার কথার মাধ্যমে কেবল এ ধারণাকে নাকোচ করেছেন। উপরের দিক নাকোচ করেননি। এ জন্যই আল্লাহ তা‘আলার সিফাতের ক্ষেত্রে শরীয়ত সম্মত শব্দগুলো ব্যবহার করাই উত্তম।
দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, তার কথা: كَسَائِرِ الْمُبْتَدَعَاتِ ‘‘সকল সৃষ্ট বস্তুকে যেমন ছয়টি দিক পরিবেষ্টন করে রাখে, দিকসমূহ সেভাবে তাকে পরিবেষ্টন করতে পারে না’’। এখান থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, প্রত্যেক সৃষ্টিই অন্য সৃষ্টি দ্বারা বেষ্টিত!! শাইখের এ কথার মধ্যে আপত্তি রয়েছে। শাইখ যদি উদ্দেশ্য করে থাকেন যে, প্রত্যেক সৃষ্টি অন্য একটি অস্তিত্বশীল সৃষ্টি দ্বারা আবদ্ধ তাহলে এ কথা ঠিক নয়। কেননা গোটা সৃষ্টি জগৎ আরেকটি সৃষ্টিজগতের ভিতরে আবদ্ধ নয়। এমনটি হলে তাসালসুল তথা প্রারম্ভ ও অন্তহীন সৃষ্টির ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকা আবশ্যক হয়। অথচ এটি অসম্ভব।
আর যদি উদ্দেশ্য হয় যে, প্রত্যেক সৃষ্টি অন্য একটি অস্তিত্বহীন বিষয়ের ভিতরে আবদ্ধ, তাহলে এ কথাও ঠিক নয়। কেননা প্রত্যেক সৃষ্ট বস্তুই অস্তিত্বহীন বস্তুর মধ্যে আবদ্ধ নয়। বরং সৃষ্টির কিছু কিছু জিনিস অন্য সৃষ্টির দ্বারা আবদ্ধ ও পরিবেষ্টিত। যেমন আসমান ও যমীন এবং তার মধ্যস্ত সৃষ্টিসমূহ আল্লাহ তা‘আলার কুরসী দ্বারা পরিবেষ্টিত। আর কিছু কিছু সৃষ্টি আছে যা রয়েছে সৃষ্টিসমূহের শেষ প্রামেত্ম। তার পরে আর কোনো সৃষ্টি নেই। যেমন আল্লাহ তা‘আলার আরশ। আরশের পরে ও উপরে আর কোনো সৃষ্টি নেই। আরশের পরে শুধু আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া আর কিছুই নেই।[2]
সুতরাং আরশের ছাদ অন্য কোনো সৃষ্টির দ্বারা পরিবেষ্টিত ও আবদ্ধ নয়। প্রারম্ভ ও অন্তহীন সৃষ্টির ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকার ধারণাকে কেটে দেয়ার জন্য এ বিশ্বাস করা আবশ্যক। যেমনটি ইতিপূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছে।
উপরোক্ত আপত্তির জবাব এভাবেও দেয়া যেতে পারে যে, এখানে سائر (সকল) শব্দটি بقية (অবশিষ্ট) অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। جميع সকল অর্থে ব্যবহৃত হয়নি। সুতরাং سائر এর মূল অর্থ হলো অবশিষ্ট। এখান থেকেই السؤر শব্দটি এসেছে। পানকারী পান করার পাত্রে যা রেখে দেয়, তাকে السؤر বলা হয়। সুতরাং শাইখের উদ্দেশ্য মোতাবেক سائر المبتدعات অর্থ হলো অধিকাংশ সৃষ্টি; সকল সৃষ্টি নয়। তাই আমরা বলতে পারি سائر শব্দটির অর্থ সকল হওয়ার চেয়ে অধিকাংশ হওয়াই অধিক সুস্পষ্ট।
সুতরাং সব মিলিয়ে শাইখের কথার অর্থ হলো আল্লাহ তা‘আলা কোনো কিছু দ্বারাই পরিবেষ্টিত নন। যেমন অধিকাংশ মাখলুকই অন্য আরেকটি মাখলুক দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে থাকে। বরং তিনি কোনো কিছু দ্বারাই পরিবেষ্টিত নন। আল্লাহ তা‘আলা এরূপ ধারণার বহু উর্ধ্বে। আমরা মনে করি না যে, ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ ঐসব লোকদের অন্তর্ভুক্ত, যারা বলে আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টিজগতের ভিতরে নয়; বাইরেও নয়। আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টিজগতের ভিতরে কিংবা বাইরে, -এর কোনো একটি নির্দিষ্ট করাকে তারা নাকোচ করে থাকে। কতক ব্যাখ্যাকার ধারণা করে থাকে যে, ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহর উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টিজগতের ভিতরে নন; বাইরেও নন। তাদের এ ধারণা সঠিক নয়; বরং শাইখের উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহ তা‘আলা কোনো সৃষ্টির দ্বারা পরিবেষ্টিত হওয়ার বহু উর্ধ্বে। এমনি তিনি কোনো সৃষ্টির প্রতি মুখাপেক্ষী হওয়ারও বহু উর্ধ্বে। তিনি আরশের প্রতি মুখাপেক্ষী হয়ে তার উপর সমুন্নত হননি। এমনি তিনি অন্য কোনো সৃষ্টির প্রতিও মুখাপেক্ষী নন।
আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টিজগতের ভিতরে নন; বাইরেও নন, - ইমাম আবু হানীফা রহিমাহুল্লাহ থেকে এ কথা বিশুদ্ধে সূত্রে বর্ণিত হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ আছে। কেননা তার প্রতিপক্ষগণ এর চেয়ে ছোট-খাটো বিষয়ে তার প্রতিবাদ করেছেন। তার থেকে যদি প্রতি পক্ষগণ এ কথা শুনতেন, তাহলে তারা সুস্পষ্ট ভাষায় প্রতিবাদ করতেন এবং সেই প্রতিবাদ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তো।
আবু মুতী আল-বলখী ইমাম আবু হানীফা রহিমাহুল্লাহ থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি আল্লাহ তা‘আলার জন্য উলু বা উপর সাব্যস্ত করতেন। অচিরেই ইনশাআল্লাহ এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা সামনে আসছে।
ইমাম আবু হানীফা রহিমাহুল্লাহর প্রকাশ্য বক্তব্য প্রমাণ করে যে, তিনি তা বলেননি। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টিজগতের ভিতরেও নন, বাহিরেও নন, এ কথা তিনি বলেননি। আল্লাহ তা‘আলার কিতাব এবং রাসূলের সুন্নাতেও এ কথা আসেনি। এ জন্যই আমি বলছি, ইমামের পক্ষ হতে এ কথা বর্ণিত হওয়ার মধ্যে সন্দেহ আছে। উত্তম হলো এ জাতীয় কথা পরিহার করে চলা। কেননা আল্লাহ তা‘আলার ব্যাপারে এ ধরণের কথা খুবই ক্ষতিকর। শরীয়াতে যেসব শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, তার মাধ্যমে কথা বলাই উত্তম। যেমন আল্লাহ আরশের উপরে আল্লাহ তা‘আলার সমুন্নত হওয়া ও দুনিয়ার আসমানে নেমে আসা এবং অনুরূপ অন্যান্য বিষয়ের উদাহরণ পেশ করা যেতে পারে।
যেসব মূর্খ লোক মনে করে, আল্লাহ তা‘আলা যখন দুনিয়ার আসমানে নামেন তখন আরশ তার উপরে থাকে এবং তিনি দু’টি সৃষ্টির মাঝখানে পরিবেষ্টিত থাকেন, তাদের কথা আল্লাহর কিতাব, রাসূলের সুন্নাত এবং সালাফদের ইজমার পরিপন্থী। আমরা যেখানে বিশ্বাস করেছি ألله أكبر অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা সবচেয়ে বড়, তখন এ ধারণা কিভাবে হতে পারে যে, যদি বলা হয় আল্লাহ তা‘আলা আরশের উপরে, তাহলে তাকে সৃষ্টির মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হলো এবং যদি বলা হয়, আল্লাহ দুনিয়ার আসমানে নামে, তাহলে বাকী আসমানগুলো তার উপরে থাকে এবং তিনি নীচে চলে যান? আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলার শানে এ জাতিয় কিয়াস ও যুক্তি অচল-বাতিল। সেই সঙ্গে বেআদবীও বটে।[3]
আপনার মানিব্যাগের মধ্যে টাকা ঢুকে, মানি ব্যাগ পকেটে ঢুকে। কারণ টাকা মানিব্যাগের চেয়ে ছোট, মানিব্যাগ পকেটের চেয়ে ছোট। কিন্তু মানিব্যাগ টাকার মধ্যে এবং পকেট মানিব্যাগের মধ্যে প্রবেশ করে না। কারণ মানিব্যাগ টাকার চেয়ে বড় এবং পকেট মানিব্যাগের চেয়ে বড়। আপনি গাড়িতে আরোহন করেন, কারণ গাড়ি আপনার চেয়ে বড়। তাই আপনার উপর গাড়ি আরোহন করা এবং টাকার মধ্যে পকেট প্রবেশ করা অসম্ভব।
আপনাকে ঘিরে আছে ছয়টি দিক ও অন্যান্য সৃষ্টি। অন্যান্য সৃষ্টিকে ঘিরে আছে বাকীসব সৃষ্টি। সুতরাং দেখা যাচ্ছে এক সৃষ্টিকে ঘিরে আছে অন্য সৃষ্টি। আসমান-যমীন এবং এতোদুভয়ের মধ্যকার সকল সৃষ্টিকে ঘিরে আছে কুরসী। আর কুরসীকে ঘিরে আছে আল্লাহ তা‘আলার সর্ববৃহৎ সৃষ্টি আরশ। আরশ পর্যন্ত গিয়ে এক সৃষ্টি অন্য সৃষ্টি দ্বারা আবদ্ধ হওয়ার ধারাবাহিকতা শেষ। আরশকে কোনো কিছুই ঘিরে রাখতে পারে না। কারণ আরশ সবচেয়ে বড় সৃষ্টি। যেমন আপনি গাড়িতে ঢুকতে পারেন, কিন্তু গাড়ি আপনার মধ্যে ঢুকতে পারে না। কারণ গাড়ি আপনার চেয়ে অনেক বড়, পকেটে টাকা ঢুকে, কিন্তু টাকার মধ্যে পকেট ঢুকতে পারে না।
সুতরাং আল্লাহ যেহেতু সবচেয়ে বড়, তাই তিনি আসমানে ঢুকেন কিভাবে? আরশে ঢুকেন কিভাবে? ছয়টি দিক তাকে পরিবেষ্টন করে কিভাবে? তিনি সর্বত্র বিরাজমান হন কিভাবে? মুমিনের অন্তর আল্লাহর আরশ হয় কিভাবে? তবে আল্লাহ আরশের উপরে, এ বিশ্বাস ঠিক রেখে যদি বলা হয় মুমিনের অন্তরে আল্লাহর ভয়, ভালোবাসা ও মর্যাদা আছে, তাহলে তাদের কথা ঠিক আছে। তবে এ জাতিয় কথা যেহেতু কুরআন-হাদীছের কথা নয়, তাই তা পরিহার করে চলাই উত্তম।[4]
শাইখুল ইসলাম আবু উছমান ইসমাঈল বিন আব্দুর রাহমান আস্ সাবুনী রহিমাহুল্লাহ বলেন, আমি উস্তাদ আবু মানসুর বিন হাম্মাদকে বলতে শুনেছি, তিনি নুযলে ইলাহীর হাদীছ বর্ণনা করার পর বলেছেন, ইমাম আবু হানীফা রহিমাহুল্লাহকে রাতের শেষ প্রহরে দুনিয়ার আসমানে আল্লাহ তা‘আলার নুযুল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেছেন, তিনি নামে, তবে এর কোনো ধরণ আমাদের জানা নেই।
কেউ কেউ সৃষ্টির উপরে আল্লাহ তা‘আলার সমুন্নত হওয়ার বিষয়টি নাকোচ করা থেকে বিরত রয়েছেন। যেমন বিরত রয়েছেন তা সাব্যস্ত করা থেকে। কুরআন, সুন্নাহ এবং সালাফে সালেহীনদের উক্তি সম্পর্কে তাদের জ্ঞানের স্বল্পতার কারণেই তারা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়েছেন। তাদের কেউ কেউ আরশের উপর আল্লাহ তা‘আলার সমুন্নত হওয়াকে অস্বীকার করে থাকেন। তারা বলে তিনি সৃষ্টি থেকে পৃথক নন এবং দূরেও নন এবং সৃষ্টিজগতের ভিতরে নন এবং বাইরেও নন। তারা আল্লাহ তা‘আলাকে অসম্ভব ও অস্তিত্বহীন বিষয় দ্বারা বিশেষিত করে থাকে। আল্লাহ তা‘আলা তার নিজের সত্তাকে আরশের উপর সমুন্নত হওয়ার যে বিশেষণে বিশেষিত করেছেন, তারা তাকে তা দ্বারা বিশেষিত করেনা।
ঐদিকে বিদ‘আতীদের কেউ কেউ বলে থাকে, আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক সৃষ্টির মধ্যে অবতরণ করেন অথবা তারা বলে থাকে প্রত্যেক সৃষ্টির অস্তিত্বই তার অস্তিত্ব। এমনি তাদের কেউ কেউ বলে থাকে, الله في كل مكان অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক স্থানেই বিরাজমান। আল্লাহ তা‘আলা যালেমদের কথার বহু উর্ধ্বে।আল্লাহর উলু সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা সামনে আসছে। এ বিষয়ে শাইখের উক্তি: أَنَّهُ تَعَالَى مُحِيطٌ بِكُلِّ شَيْءٍ وَفَوْقَهُ ‘‘তিনিই সবকিছুকে পরিবেষ্টন করে রয়েছেন’’ এবং ‘‘তিনি রয়েছেন সবকিছুর উপরে’’। ইনশাআল্লাহ শাইখের এ কথার ব্যাখ্যা করার সময় এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা সামনে আসছে।
[2]. আরশের উপর রয়েছেন আল্লাহ তা‘আলা। এ থেকে এমন ধারণা করা ঠিক নয় যে, আল্লাহ তা‘আলা আরশের উপর মিশে আছেন কিংবা লেগে আছেন অথবা আরশের প্রতি তিনি মুখাপেÿী হিসাবে এর উপর সমুন্নত হয়েছে। তিনি এমন ধারণার বহু উর্ধ্বে। সৃষ্টির কোনো কিছুর প্রতিই তার কোনো প্রয়োজন নেই।
[3]. কোনো শিশু যদি জন্মের পরেই জেল খানায় থেকে বড় হয় কিংবা জেলখানায় জন্মলাভ করে, সে তাতে হয়তবা পীপড়া, তেলাপোকা ও ঈদুরের চেয়ে বড় আর কোনো প্রাণী ও জীব-জন্তু দেখবেনা। বন্দীশালা থেকে বের হয়ে সে যখন তার পিতার কাছে হাতী, উট বা ঘোড়ার কথা শুনবে, সে তার পিতাকে জিজ্ঞাসা করবে, হে আমার পিতা! হাতী ঈদুরের চেয়ে বড় না কি পীপড়ার মতই? এমনি মানুষের বিবেক-বুদ্ধি ও জ্ঞান সীমিত ও জেলখানায় বন্দী। যখন আমরা বলি, ينزل ربنا إِلَى السماء الدنيا ‘‘আমাদের রব দুনিয়ার আসমানে নামেন’’ তখন বিদ‘আতীরা প্রশ্ন করেন তাহলে কি আল্লাহ তাআলা দুনিয়ার আসমান ও তার উপরের আসমানের মাঝখানে হয়ে যান না কি? এরপর আরেকটি প্রশ্ন তারা খুব দ্রম্নত করে ফেলে, তাহলে কি আরশ খালি হয়ে যায় না কি? এই প্রশ্নগুলো যারা করে তাদের জ্ঞান একদম সামান্য ও দুর্বল।
ঈমান ও গায়েবী বিষয়গুলোতে মুমিনদের সর্বপ্রথম ও সর্ববৃহৎ বৈশিষ্ট হলো, ﴿الَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِالْغَيْبِ﴾ ‘‘তারা গায়েবের প্রতি ঈমান রাখে’’। সুতরাং আমরা গায়েবে বিশ্বাস করি। আমরা বিশ্বাস করি আল্লাহ তাআলা যা বলেছেন, তাতে তিনি সত্যবাদী এবং রসূল যা বলেছেন, তাতেও তিনি সত্যবাদী। আমাদের বিবেক-বুদ্ধি গায়েবী বিষয়গুলো পুরোপুরি উপলব্ধি করতে অক্ষম ও দুর্বল। বিবেক-বুদ্ধির উপর আবশ্যক হলো আল্লাহ এবং তার রসূল যা বলেছেন, তা বিশ্বাস করা। গায়েবী বিষয়গুলোর হাকীকত ও ধরণ বুঝতে সক্ষম হোক বা না হোক। মানুষ যখন এগুলো নিয়ে ঝগড়া করবে, বিশ্বাস করতে টালবাহানা করবে এবং এগুলোর বিকৃত ব্যাখ্যা করবে, তখন তারা গায়েবে বিশ্বাসকারী হিসাবে গণ্য হবে না।
[4]. আল্লাহ তা‘আলা সকল সৃষ্টির উপরে, তিনি আরশের উপরে সমুন্নত। এটি কুরআনের বহু আয়াত, অনেক সহীহ হাদীছ, বিবেক-বুদ্ধির দলীল, সৃষ্টিগত ও জন্মগত স্বভাব এবং মুসলিম আলেম-উলামাদের ইজমা দ্বারা সাব্যস্ত। সুতরাং কুরআন ও হাদীছের দলীল দ্বারা সাব্যস্ত যে আল্লাহর যাত বা সত্তা আরশের উপর সমুন্নত। শুধু তাই নয়; কুরআন-সুন্নাহর দলীল আসার আগেই সৃষ্টি স্বীকার করে নিয়েছে যে, আল্লাহ তা‘আলা সমস্ত মাখলুকের উপরে। আমি হিন্দু সম্প্রদায়ের একাধিক লোককে বলতে শুনেছি, মালিক উপরে রয়েছেন, আল্লাহ আছেন উপরে আর আমরা আছি নীচে। জাহেলী কবি আনতারা বিন শাদ্দাদ বলেন,يا عبل أين من المنية مهرب إن كَانَ ربي في السماء قضاها ‘‘হে আবলা! আসমানে আমার রব যেখানে আমার মৃত্যু লিখে রেখেছেন, তাই উহা থেকে পালানোর কোনো পথ আছে কি?
সুতরাং আল্লাহর উপরে সমুন্নত হওয়া সাব্যস্ত হলো। যারা এটিকে অস্বীকার করলো, তারা কুরআনের দলীলকে অস্বীকার করলো, হাদীছের দলীলকেও অস্বীকার করলো। সেই সঙ্গে তারা জন্মগত ও সৃষ্টিগত দলীলকেও অস্বীকার করলো এবং বোধশক্তি ও বিবেক-বুদ্ধির দলীল ও অস্বীকার করলো।