আর الجهة (দিক) শব্দটি দ্বারা কখনো অস্তিত্বশীল জিনিস বুঝায়। আবার কখনো তা দ্বারা অস্তিত্বহীন জিনিস বুঝানো হয়। বিবেক-বুদ্ধির দলীল দ্বারা সুসাব্যস্ত যে, অস্তিত্বশীল জিনিস মাত্র দু’টি। স্রষ্টা ও সৃষ্টি। ‘দিক’ বলতে যদি আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া অন্য কোনো অস্তিত্বশীল জিনিস বুঝায়, তাহলে তা মাখলুকের অন্তর্ভুক্ত হবে। কোনো সৃষ্টির পক্ষেই আল্লাহ তা‘আলাকে সীমায়িত করা সম্ভব নয়। কোনো সৃষ্টিই আল্লাহ তা‘আলাকে পরিবেষ্টন করতে সক্ষম নয়। আল্লাহ তা‘আলা এরূপ চিন্তার বহু উর্ধ্বে। কিয়ামতের দিন যে মহান সত্তা সমগ্র সৃষ্টিজগতকে এক আঙ্গুলে রাখবেন, কোনো সৃষ্টির পক্ষে তাকে সীমায়িত ও সীমাবদ্ধ করার ধারণা যাদের মাথায় আসে, তারা আল্লাহর যথাযথ বড়ত্ব উপলব্ধি করতে পারেনি।
আর যদি তা দ্বারা কোনো অস্তিত্বহীন বিষয় বুঝায়, তাহলে তা হবে সৃষ্টিজগতের সম্পূর্ণ বাইরে। অর্থাৎ ‘দিক’ নামে কোনো সৃষ্টির অস্তিবতই নেই। সুতরাং যখন বলা হবে, আল্লাহ উপরের দিকে রয়েছেন, অর্থাৎ সৃষ্টি জগতের সম্পূর্ণ বাইরে তাহলে ঠিক আছে। এর অর্থ হলো তিনি সৃষ্টি জগতের সম্পূর্ণ বাইরে ও সম্পূর্ণ উপরে। সৃষ্টিজগতের বাইরে একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলাই রয়েছেন। সুতরাং তিনি সৃষ্টিজগতের সম্পূর্ণ বাইরে এবং সকল সৃষ্টির উপরে সমুন্নত।
আর যারা আল্লাহ তা‘আলার শানে الجهة ‘দিক’ শব্দটি ব্যবহার করে সৃষ্টির উপর আল্লাহ তা‘আলার সমুন্নত হওয়াকে নাকোচ করতে চায়, তারা তাদের মতের সপক্ষে দলীল হিসাবে উল্লেখ করে যে, সকল দিকই সৃষ্টি। আর আল্লাহ তা‘আলা ‘দিক’ সৃষ্টি করার পূর্ব থেকেই আছেন। তারা আরো বলে, যারা বলবে, আল্লাহ তা‘আলা কোনো দিকে রয়েছেন, তাদের কথা থেকে সৃষ্টির কোনো কোনো জিনিস চিরন্তন ও অবিনশ্বর হওয়া আবশ্যক হয়। এতে আরো আবশ্যক হয় যে, প্রথমে তিনি দিকের প্রতি অমুখাপেক্ষী ছিলেন। পরে দিকের মধ্যে ঢুকে পড়েছেন। নাউযুবিল্লাহ।
আসল কথা হলো ইমাম ত্বহাবী উপরোক্ত শব্দগুলো ব্যবহার করে বুঝাতে চেয়েছেন যে, আল্লাহ তা‘আলা কোনো সৃষ্টির ভিতরে নন। সেটিকে ‘দিক’ হিসাবে নাম দেয়া হোক বা না হোক। এটিই সঠিক। সঠিক কথা হলো ‘দিক’ কোনো স্বনির্ভর অস্তিত্বশীল সৃষ্টি নয়। অন্যের প্রতি সম্বন্ধ করা ব্যতীত এটির অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। নিঃসন্দেহে দিকের কোনো শেষ বা প্রান্তসীমা নেই। সীমাহীন কোনো সৃষ্টির অস্তিত্ব নেই। সুতরাং অসীমকে সসীম জিনিসের দ্বারা সীমায়িত করার ধারণা বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়। আর আমরা আল্লাহ তা‘আলার জন্য যেই ‘দিক’ সাব্যস্ত করি, তা কোনো সৃষ্টি নয়। তাহলো সৃষ্টির উপরের ‘দিক’। কিন্তু কুরআন ও সুন্নায় আল্লাহ তা‘আলার সিফাতের ক্ষেত্রে ‘দিক’ শব্দটি আসে নেই। এটি আল্লাহ তা‘আলার জন্য সাব্যস্ত করা হয়নি। নাকোচও করা হয়নি। তাই আমরা এ থেকে দূরে থাকাই উচিত মনে করি।
তবে কেউ যদি বলে, আল্লাহর কোনো ‘দিক’ ও সীমা নেই, তাকে আমরা বলবো, এ কথার মাধ্যমে আপনার উদ্দেশ্য কী? সে যদি বলে, আমার উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহ তা‘আলাকে কোনো কিছুই পরিবেষ্টন করতে পারে না, তিনি সবকিছুর উর্ধ্বে, সবচেয়ে বড় এবং সবকিছুকে পরিবেষ্টনকারী, তাহলে আমরা তাকে বলবো, তোমার উদ্দেশ্য সঠিক। তবে যারা সৃষ্টির উপর আল্লাহর সমুন্নত হওয়াকে অস্বীকার করে, তারাই বলে আল্লাহ তা‘আলার কোনো ‘দিক’ ও সীমা নেই।[1] তারা বলে ليس لله جهة ‘‘অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার কোনো ‘দিক’ নেই। তাদের কথার উদ্দেশ্য হলো আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টির উপরে নয়। তাই আল্লাহ তা‘আলার শানে এ ধরণের শব্দ ব্যবহার করা ঠিক নয়। যেসব শব্দ হক ও বাতিলের সম্ভাবনা রাখে তা ব্যবহার না করে শরীয়ত সম্মত শব্দ ব্যবহার করাই উত্তম।
ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ বলেন, لَا تَحْوِيهِ الْجِهَاتُ السِّتُّ كَسَائِرِ الْمُبْتَدَعَاتِ ‘‘সকল সৃষ্ট বস্তুকে যেমন ছয়টি দিক পরিবেষ্টন করে রাখে, দিকসমূহ সেভাবে তাকে পরিবেষ্টন করতে পারে না’’। ইমামের এ কথা সঠিক। এ দৃষ্টিকোন থেকে কথাটি সঠিক যে, সৃষ্টিজগতের কিছুই তাকে পরিবেষ্টন করে রাখতে পারে না। বরং তিনিই সবকিছুকে পরিবেষ্টন করে রয়েছেন এবং রয়েছেন সবকিছুর উপরে। শাইখ এখানে এ অর্থই উদ্দেশ্য করেছেন। কেননা এ বিষয়ে শাইখের উক্তি: أَنَّهُ تَعَالَى مُحِيطٌ بِكُلِّ شَيْءٍ وَفَوْقَهُ ‘‘তিনিই সবকিছুকে পরিবেষ্টন করে রয়েছেন’’ এবং তিনি রয়েছেন সবকিছুর উপরে, শাইখের এ কথা সামনে আসছে।
শাইখের কথা: সকল সৃষ্ট বস্তুকে যেমন ছয়টি দিক পরিবেষ্টন করে রাখে, দিকসমূহ তাকে সেভাবে পরিবেষ্টন করে রাখতে পারে না এবং ‘‘তিনিই সবকিছুকে পরিবেষ্টন করে রয়েছেন’’ এ দুই কথাকে যখন একত্র করা হবে, তখন বুঝা যাবে যে, আল্লাহ তা‘আলাকে সীমায়িত করা এবং পরিবেষ্টন করা কোনো সৃষ্টির পক্ষেই সম্ভব নয়। যেমন পরিবেষ্টন ও সীমায়িত করা সম্ভব হয় আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্টিকে। মোটকথা, আল্লাহ তা‘আলাই সবকিছুকে পরিবেষ্টনকারী, তিনিই সবকিছুর উপরে সমুন্নত।
শাইখের বক্তব্যের মধ্যে দু’টি বিষয় বাকী রয়ে গেছে। প্রথম বিষয়টি হলো এ জাতিয় শব্দের মধ্যে যেহেতু অস্পষ্টতা এবং বাতিল অর্থের সম্ভাবনা রয়েছে, তাই এ জাতিয় শব্দ পরিহার করাই উত্তম ছিল। এ ধরণের শব্দ পরিহার না করার কারণে শাইখের কথা থেকে ভুল বুঝার সম্ভাবনা রয়ে গেছে। সেই সঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা যে সবকিছুকে পরিবেষ্টন করে রয়েছেন এবং তিনি যে সবকিছুর উপরে, -তার কথা থেকে এটি সাব্যস্ত করার সাথে সাথে তিনি উপরের দিকে থাকার বিষয়টি নাকোচ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও রয়ে গেছে। যদিও এ সন্দেহের জবাবে ইতিপূর্বে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলাকে কোনো সৃষ্টি পরিবেষ্টন করতে পারে, -ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ তার কথার মাধ্যমে কেবল এ ধারণাকে নাকোচ করেছেন। উপরের দিক নাকোচ করেননি। এ জন্যই আল্লাহ তা‘আলার সিফাতের ক্ষেত্রে শরীয়ত সম্মত শব্দগুলো ব্যবহার করাই উত্তম।
দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, তার কথা: كَسَائِرِ الْمُبْتَدَعَاتِ ‘‘সকল সৃষ্ট বস্তুকে যেমন ছয়টি দিক পরিবেষ্টন করে রাখে, দিকসমূহ সেভাবে তাকে পরিবেষ্টন করতে পারে না’’। এখান থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, প্রত্যেক সৃষ্টিই অন্য সৃষ্টি দ্বারা বেষ্টিত!! শাইখের এ কথার মধ্যে আপত্তি রয়েছে। শাইখ যদি উদ্দেশ্য করে থাকেন যে, প্রত্যেক সৃষ্টি অন্য একটি অস্তিত্বশীল সৃষ্টি দ্বারা আবদ্ধ তাহলে এ কথা ঠিক নয়। কেননা গোটা সৃষ্টি জগৎ আরেকটি সৃষ্টিজগতের ভিতরে আবদ্ধ নয়। এমনটি হলে তাসালসুল তথা প্রারম্ভ ও অন্তহীন সৃষ্টির ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকা আবশ্যক হয়। অথচ এটি অসম্ভব।
আর যদি উদ্দেশ্য হয় যে, প্রত্যেক সৃষ্টি অন্য একটি অস্তিত্বহীন বিষয়ের ভিতরে আবদ্ধ, তাহলে এ কথাও ঠিক নয়। কেননা প্রত্যেক সৃষ্ট বস্তুই অস্তিত্বহীন বস্তুর মধ্যে আবদ্ধ নয়। বরং সৃষ্টির কিছু কিছু জিনিস অন্য সৃষ্টির দ্বারা আবদ্ধ ও পরিবেষ্টিত। যেমন আসমান ও যমীন এবং তার মধ্যস্ত সৃষ্টিসমূহ আল্লাহ তা‘আলার কুরসী দ্বারা পরিবেষ্টিত। আর কিছু কিছু সৃষ্টি আছে যা রয়েছে সৃষ্টিসমূহের শেষ প্রামেত্ম। তার পরে আর কোনো সৃষ্টি নেই। যেমন আল্লাহ তা‘আলার আরশ। আরশের পরে ও উপরে আর কোনো সৃষ্টি নেই। আরশের পরে শুধু আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া আর কিছুই নেই।[2]
সুতরাং আরশের ছাদ অন্য কোনো সৃষ্টির দ্বারা পরিবেষ্টিত ও আবদ্ধ নয়। প্রারম্ভ ও অন্তহীন সৃষ্টির ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকার ধারণাকে কেটে দেয়ার জন্য এ বিশ্বাস করা আবশ্যক। যেমনটি ইতিপূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছে।
উপরোক্ত আপত্তির জবাব এভাবেও দেয়া যেতে পারে যে, এখানে سائر (সকল) শব্দটি بقية (অবশিষ্ট) অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। جميع সকল অর্থে ব্যবহৃত হয়নি। সুতরাং سائر এর মূল অর্থ হলো অবশিষ্ট। এখান থেকেই السؤر শব্দটি এসেছে। পানকারী পান করার পাত্রে যা রেখে দেয়, তাকে السؤر বলা হয়। সুতরাং শাইখের উদ্দেশ্য মোতাবেক سائر المبتدعات অর্থ হলো অধিকাংশ সৃষ্টি; সকল সৃষ্টি নয়। তাই আমরা বলতে পারি سائر শব্দটির অর্থ সকল হওয়ার চেয়ে অধিকাংশ হওয়াই অধিক সুস্পষ্ট।
সুতরাং সব মিলিয়ে শাইখের কথার অর্থ হলো আল্লাহ তা‘আলা কোনো কিছু দ্বারাই পরিবেষ্টিত নন। যেমন অধিকাংশ মাখলুকই অন্য আরেকটি মাখলুক দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে থাকে। বরং তিনি কোনো কিছু দ্বারাই পরিবেষ্টিত নন। আল্লাহ তা‘আলা এরূপ ধারণার বহু উর্ধ্বে। আমরা মনে করি না যে, ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ ঐসব লোকদের অন্তর্ভুক্ত, যারা বলে আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টিজগতের ভিতরে নয়; বাইরেও নয়। আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টিজগতের ভিতরে কিংবা বাইরে, -এর কোনো একটি নির্দিষ্ট করাকে তারা নাকোচ করে থাকে। কতক ব্যাখ্যাকার ধারণা করে থাকে যে, ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহর উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টিজগতের ভিতরে নন; বাইরেও নন। তাদের এ ধারণা সঠিক নয়; বরং শাইখের উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহ তা‘আলা কোনো সৃষ্টির দ্বারা পরিবেষ্টিত হওয়ার বহু উর্ধ্বে। এমনি তিনি কোনো সৃষ্টির প্রতি মুখাপেক্ষী হওয়ারও বহু উর্ধ্বে। তিনি আরশের প্রতি মুখাপেক্ষী হয়ে তার উপর সমুন্নত হননি। এমনি তিনি অন্য কোনো সৃষ্টির প্রতিও মুখাপেক্ষী নন।
আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টিজগতের ভিতরে নন; বাইরেও নন, - ইমাম আবু হানীফা রহিমাহুল্লাহ থেকে এ কথা বিশুদ্ধে সূত্রে বর্ণিত হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ আছে। কেননা তার প্রতিপক্ষগণ এর চেয়ে ছোট-খাটো বিষয়ে তার প্রতিবাদ করেছেন। তার থেকে যদি প্রতি পক্ষগণ এ কথা শুনতেন, তাহলে তারা সুস্পষ্ট ভাষায় প্রতিবাদ করতেন এবং সেই প্রতিবাদ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তো।
আবু মুতী আল-বলখী ইমাম আবু হানীফা রহিমাহুল্লাহ থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি আল্লাহ তা‘আলার জন্য উলু বা উপর সাব্যস্ত করতেন। অচিরেই ইনশাআল্লাহ এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা সামনে আসছে।
ইমাম আবু হানীফা রহিমাহুল্লাহর প্রকাশ্য বক্তব্য প্রমাণ করে যে, তিনি তা বলেননি। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টিজগতের ভিতরেও নন, বাহিরেও নন, এ কথা তিনি বলেননি। আল্লাহ তা‘আলার কিতাব এবং রাসূলের সুন্নাতেও এ কথা আসেনি। এ জন্যই আমি বলছি, ইমামের পক্ষ হতে এ কথা বর্ণিত হওয়ার মধ্যে সন্দেহ আছে। উত্তম হলো এ জাতীয় কথা পরিহার করে চলা। কেননা আল্লাহ তা‘আলার ব্যাপারে এ ধরণের কথা খুবই ক্ষতিকর। শরীয়াতে যেসব শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, তার মাধ্যমে কথা বলাই উত্তম। যেমন আল্লাহ আরশের উপরে আল্লাহ তা‘আলার সমুন্নত হওয়া ও দুনিয়ার আসমানে নেমে আসা এবং অনুরূপ অন্যান্য বিষয়ের উদাহরণ পেশ করা যেতে পারে।
যেসব মূর্খ লোক মনে করে, আল্লাহ তা‘আলা যখন দুনিয়ার আসমানে নামেন তখন আরশ তার উপরে থাকে এবং তিনি দু’টি সৃষ্টির মাঝখানে পরিবেষ্টিত থাকেন, তাদের কথা আল্লাহর কিতাব, রাসূলের সুন্নাত এবং সালাফদের ইজমার পরিপন্থী। আমরা যেখানে বিশ্বাস করেছি ألله أكبر অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা সবচেয়ে বড়, তখন এ ধারণা কিভাবে হতে পারে যে, যদি বলা হয় আল্লাহ তা‘আলা আরশের উপরে, তাহলে তাকে সৃষ্টির মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হলো এবং যদি বলা হয়, আল্লাহ দুনিয়ার আসমানে নামে, তাহলে বাকী আসমানগুলো তার উপরে থাকে এবং তিনি নীচে চলে যান? আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলার শানে এ জাতিয় কিয়াস ও যুক্তি অচল-বাতিল। সেই সঙ্গে বেআদবীও বটে।[3]
আপনার মানিব্যাগের মধ্যে টাকা ঢুকে, মানি ব্যাগ পকেটে ঢুকে। কারণ টাকা মানিব্যাগের চেয়ে ছোট, মানিব্যাগ পকেটের চেয়ে ছোট। কিন্তু মানিব্যাগ টাকার মধ্যে এবং পকেট মানিব্যাগের মধ্যে প্রবেশ করে না। কারণ মানিব্যাগ টাকার চেয়ে বড় এবং পকেট মানিব্যাগের চেয়ে বড়। আপনি গাড়িতে আরোহন করেন, কারণ গাড়ি আপনার চেয়ে বড়। তাই আপনার উপর গাড়ি আরোহন করা এবং টাকার মধ্যে পকেট প্রবেশ করা অসম্ভব।
আপনাকে ঘিরে আছে ছয়টি দিক ও অন্যান্য সৃষ্টি। অন্যান্য সৃষ্টিকে ঘিরে আছে বাকীসব সৃষ্টি। সুতরাং দেখা যাচ্ছে এক সৃষ্টিকে ঘিরে আছে অন্য সৃষ্টি। আসমান-যমীন এবং এতোদুভয়ের মধ্যকার সকল সৃষ্টিকে ঘিরে আছে কুরসী। আর কুরসীকে ঘিরে আছে আল্লাহ তা‘আলার সর্ববৃহৎ সৃষ্টি আরশ। আরশ পর্যন্ত গিয়ে এক সৃষ্টি অন্য সৃষ্টি দ্বারা আবদ্ধ হওয়ার ধারাবাহিকতা শেষ। আরশকে কোনো কিছুই ঘিরে রাখতে পারে না। কারণ আরশ সবচেয়ে বড় সৃষ্টি। যেমন আপনি গাড়িতে ঢুকতে পারেন, কিন্তু গাড়ি আপনার মধ্যে ঢুকতে পারে না। কারণ গাড়ি আপনার চেয়ে অনেক বড়, পকেটে টাকা ঢুকে, কিন্তু টাকার মধ্যে পকেট ঢুকতে পারে না।
সুতরাং আল্লাহ যেহেতু সবচেয়ে বড়, তাই তিনি আসমানে ঢুকেন কিভাবে? আরশে ঢুকেন কিভাবে? ছয়টি দিক তাকে পরিবেষ্টন করে কিভাবে? তিনি সর্বত্র বিরাজমান হন কিভাবে? মুমিনের অন্তর আল্লাহর আরশ হয় কিভাবে? তবে আল্লাহ আরশের উপরে, এ বিশ্বাস ঠিক রেখে যদি বলা হয় মুমিনের অন্তরে আল্লাহর ভয়, ভালোবাসা ও মর্যাদা আছে, তাহলে তাদের কথা ঠিক আছে। তবে এ জাতিয় কথা যেহেতু কুরআন-হাদীছের কথা নয়, তাই তা পরিহার করে চলাই উত্তম।[4]
শাইখুল ইসলাম আবু উছমান ইসমাঈল বিন আব্দুর রাহমান আস্ সাবুনী রহিমাহুল্লাহ বলেন, আমি উস্তাদ আবু মানসুর বিন হাম্মাদকে বলতে শুনেছি, তিনি নুযলে ইলাহীর হাদীছ বর্ণনা করার পর বলেছেন, ইমাম আবু হানীফা রহিমাহুল্লাহকে রাতের শেষ প্রহরে দুনিয়ার আসমানে আল্লাহ তা‘আলার নুযুল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেছেন, তিনি নামে, তবে এর কোনো ধরণ আমাদের জানা নেই।
কেউ কেউ সৃষ্টির উপরে আল্লাহ তা‘আলার সমুন্নত হওয়ার বিষয়টি নাকোচ করা থেকে বিরত রয়েছেন। যেমন বিরত রয়েছেন তা সাব্যস্ত করা থেকে। কুরআন, সুন্নাহ এবং সালাফে সালেহীনদের উক্তি সম্পর্কে তাদের জ্ঞানের স্বল্পতার কারণেই তারা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়েছেন। তাদের কেউ কেউ আরশের উপর আল্লাহ তা‘আলার সমুন্নত হওয়াকে অস্বীকার করে থাকেন। তারা বলে তিনি সৃষ্টি থেকে পৃথক নন এবং দূরেও নন এবং সৃষ্টিজগতের ভিতরে নন এবং বাইরেও নন। তারা আল্লাহ তা‘আলাকে অসম্ভব ও অস্তিত্বহীন বিষয় দ্বারা বিশেষিত করে থাকে। আল্লাহ তা‘আলা তার নিজের সত্তাকে আরশের উপর সমুন্নত হওয়ার যে বিশেষণে বিশেষিত করেছেন, তারা তাকে তা দ্বারা বিশেষিত করেনা।
ঐদিকে বিদ‘আতীদের কেউ কেউ বলে থাকে, আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক সৃষ্টির মধ্যে অবতরণ করেন অথবা তারা বলে থাকে প্রত্যেক সৃষ্টির অস্তিত্বই তার অস্তিত্ব। এমনি তাদের কেউ কেউ বলে থাকে, الله في كل مكان অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক স্থানেই বিরাজমান। আল্লাহ তা‘আলা যালেমদের কথার বহু উর্ধ্বে।আল্লাহর উলু সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা সামনে আসছে। এ বিষয়ে শাইখের উক্তি: أَنَّهُ تَعَالَى مُحِيطٌ بِكُلِّ شَيْءٍ وَفَوْقَهُ ‘‘তিনিই সবকিছুকে পরিবেষ্টন করে রয়েছেন’’ এবং ‘‘তিনি রয়েছেন সবকিছুর উপরে’’। ইনশাআল্লাহ শাইখের এ কথার ব্যাখ্যা করার সময় এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা সামনে আসছে।
[2]. আরশের উপর রয়েছেন আল্লাহ তা‘আলা। এ থেকে এমন ধারণা করা ঠিক নয় যে, আল্লাহ তা‘আলা আরশের উপর মিশে আছেন কিংবা লেগে আছেন অথবা আরশের প্রতি তিনি মুখাপেÿী হিসাবে এর উপর সমুন্নত হয়েছে। তিনি এমন ধারণার বহু উর্ধ্বে। সৃষ্টির কোনো কিছুর প্রতিই তার কোনো প্রয়োজন নেই।
[3]. কোনো শিশু যদি জন্মের পরেই জেল খানায় থেকে বড় হয় কিংবা জেলখানায় জন্মলাভ করে, সে তাতে হয়তবা পীপড়া, তেলাপোকা ও ঈদুরের চেয়ে বড় আর কোনো প্রাণী ও জীব-জন্তু দেখবেনা। বন্দীশালা থেকে বের হয়ে সে যখন তার পিতার কাছে হাতী, উট বা ঘোড়ার কথা শুনবে, সে তার পিতাকে জিজ্ঞাসা করবে, হে আমার পিতা! হাতী ঈদুরের চেয়ে বড় না কি পীপড়ার মতই? এমনি মানুষের বিবেক-বুদ্ধি ও জ্ঞান সীমিত ও জেলখানায় বন্দী। যখন আমরা বলি, ينزل ربنا إِلَى السماء الدنيا ‘‘আমাদের রব দুনিয়ার আসমানে নামেন’’ তখন বিদ‘আতীরা প্রশ্ন করেন তাহলে কি আল্লাহ তাআলা দুনিয়ার আসমান ও তার উপরের আসমানের মাঝখানে হয়ে যান না কি? এরপর আরেকটি প্রশ্ন তারা খুব দ্রম্নত করে ফেলে, তাহলে কি আরশ খালি হয়ে যায় না কি? এই প্রশ্নগুলো যারা করে তাদের জ্ঞান একদম সামান্য ও দুর্বল।
ঈমান ও গায়েবী বিষয়গুলোতে মুমিনদের সর্বপ্রথম ও সর্ববৃহৎ বৈশিষ্ট হলো, ﴿الَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِالْغَيْبِ﴾ ‘‘তারা গায়েবের প্রতি ঈমান রাখে’’। সুতরাং আমরা গায়েবে বিশ্বাস করি। আমরা বিশ্বাস করি আল্লাহ তাআলা যা বলেছেন, তাতে তিনি সত্যবাদী এবং রসূল যা বলেছেন, তাতেও তিনি সত্যবাদী। আমাদের বিবেক-বুদ্ধি গায়েবী বিষয়গুলো পুরোপুরি উপলব্ধি করতে অক্ষম ও দুর্বল। বিবেক-বুদ্ধির উপর আবশ্যক হলো আল্লাহ এবং তার রসূল যা বলেছেন, তা বিশ্বাস করা। গায়েবী বিষয়গুলোর হাকীকত ও ধরণ বুঝতে সক্ষম হোক বা না হোক। মানুষ যখন এগুলো নিয়ে ঝগড়া করবে, বিশ্বাস করতে টালবাহানা করবে এবং এগুলোর বিকৃত ব্যাখ্যা করবে, তখন তারা গায়েবে বিশ্বাসকারী হিসাবে গণ্য হবে না।
[4]. আল্লাহ তা‘আলা সকল সৃষ্টির উপরে, তিনি আরশের উপরে সমুন্নত। এটি কুরআনের বহু আয়াত, অনেক সহীহ হাদীছ, বিবেক-বুদ্ধির দলীল, সৃষ্টিগত ও জন্মগত স্বভাব এবং মুসলিম আলেম-উলামাদের ইজমা দ্বারা সাব্যস্ত। সুতরাং কুরআন ও হাদীছের দলীল দ্বারা সাব্যস্ত যে আল্লাহর যাত বা সত্তা আরশের উপর সমুন্নত। শুধু তাই নয়; কুরআন-সুন্নাহর দলীল আসার আগেই সৃষ্টি স্বীকার করে নিয়েছে যে, আল্লাহ তা‘আলা সমস্ত মাখলুকের উপরে। আমি হিন্দু সম্প্রদায়ের একাধিক লোককে বলতে শুনেছি, মালিক উপরে রয়েছেন, আল্লাহ আছেন উপরে আর আমরা আছি নীচে। জাহেলী কবি আনতারা বিন শাদ্দাদ বলেন,يا عبل أين من المنية مهرب إن كَانَ ربي في السماء قضاها ‘‘হে আবলা! আসমানে আমার রব যেখানে আমার মৃত্যু লিখে রেখেছেন, তাই উহা থেকে পালানোর কোনো পথ আছে কি?
সুতরাং আল্লাহর উপরে সমুন্নত হওয়া সাব্যস্ত হলো। যারা এটিকে অস্বীকার করলো, তারা কুরআনের দলীলকে অস্বীকার করলো, হাদীছের দলীলকেও অস্বীকার করলো। সেই সঙ্গে তারা জন্মগত ও সৃষ্টিগত দলীলকেও অস্বীকার করলো এবং বোধশক্তি ও বিবেক-বুদ্ধির দলীল ও অস্বীকার করলো।