ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ বলেন,
وَلَا يَصِحُّ الْإِيمَانُ بِالرُّؤْيَةِ لِأَهْلِ دَارِ السَّلَامِ لِمَنِ اعْتَبَرَهَا مِنْهُمْ بِوَهْمٍ أَوْ تَأَوَّلَهَا بِفَهْمٍ إِذْ كَانَ تَأْوِيلُ الرُّؤْيَةِ، وَتَأْوِيلُ كُلِّ مَعْنًى يُضَافُ إِلَى الرُّبُوبِيَّةِ بِتَرْكِ التَّأْوِيلِ وَلُزُومَ التَّسْلِيمِ وَعَلَيْهِ دِينُ الْمُسْلِمِينَ، وَمَنْ لَمْ يَتَوَقَّ النَّفْيَ وَالتَّشْبِيهَ، زَلَّ وَلَمْ يُصِبِ التَّنْزِيهَ
জান্নাতীদের জন্য আল্লাহ তা‘আলার সাক্ষাৎ লাভের উপর ঐ ব্যক্তির ঈমান আনয়ন বিশুদ্ধ হবে না, যে কোনো ধারণার বশবর্তী হবে, অথবা নিজের বুঝ অনুসারে সাক্ষাতের তাবীল করবে বা ভুল ব্যাখ্যা দিবে। কারণ আল্লাহকে দেখার বিষয়টি এবং রবের অন্যান্য গুণাবলীর বিষয়ের ব্যাপারে প্রকৃত কথা হচ্ছে ঐগুলোর কোনোরূপ তাবীল করার অপচেষ্টা না করে যেভাবে এসেছে সেভাবেই অবিকৃতভাবে মেনে নিতে। এটাই হচ্ছে মুসলিমদের দ্বীন। যে ব্যক্তি রবের জন্য সুসাব্যস্ত গুণাবলীকে অস্বীকার করা এবং সৃষ্টির গুণাবলীর সাথে তার সাদৃশ্য বর্ণনা করা থেকে বিরত থাকবে না, তার নিশ্চিত পদস্খলন ঘটবে ও সে সঠিকভাবে আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণায় ব্যর্থ হবে।
..............................................................
ব্যাখ্যা: মুতাযেলা এবং তাদের মত অন্যান্য যেসব সম্প্রদায় কিয়ামতের দিন মুমিনদের জন্য আল্লাহর দিদারকে অস্বীকার করে, শাইখ এখানে তাদের প্রতিবাদ করেছেন। সে সঙ্গে যারা আল্লাহকে সৃষ্টির কোনো বিষয়ের সাথে তুলনা করে, তাদেরও প্রতিবাদ করেছেন। নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
«إِنَّكُمْ سَتَرَوْنَ رَبَّكُمْ كَمَا تَرَوْنَ القمر ليلة البدر»
‘‘তোমরা অচিরেই স্বচক্ষে তোমাদের রবকে দেখতে পাবে। যেমন কোনো রকম অসুবিধা ছাড়াই পূর্ণিমার রাতে তোমরা চন্দ্রকে দেখতে পাও’’।[1]
এখানে তাশবীহ এর জন্য ব্যবহৃত كاف - বর্ণকে মাসদার অথবা মাওসুলের অর্থ প্রদানকারী ما-এর সাথে যুক্ত করে ترون ফেলকে মাসদারের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। অর্থাৎ এখানে ترون ফেলকে الرؤية মাসদারের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করতে হবে। এতে করে তাশবীহ তথা আল্লাহর দিদারকে পূর্ণিমার রাতে চাঁদ দেখার সাথে তুলনা করা উদ্দেশ্য হবে। এখানে আল্লাহর দিদারকে পূর্ণিমার রাতের মেঘহীন আকাশে চাঁদ দেখার সাথে তুলনা করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলাকে চাঁদের সাথে তুলনা করা হয়নি। কেননা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার সদৃশ আর কিছুই নেই। জোর দিয়ে আল্লাহর প্রকৃত দিদারকে সত্য হিসাবে সাব্যস্ত করা এবং তার দ্বারা রূপকার্থের সন্দেহ দূর করার বিষয়টি এখানে খুবই সুস্পষ্ট। এত সুস্পষ্ট ব্বিরণ আসার পরও যারা সত্য কবুল করা থেকে দূরে থাকে, তাদের নসীবে গোমরাহী ছাড়া আর কিছু জোটবে কি?
এ ধরণের সুস্পষ্ট কথার সুস্পষ্ট অর্থ বাদ দিয়ে যদি অন্য অর্থ গ্রহণ করা হয়, তাহলে এমন কোনো দলীল খুuঁজ পাওয়া যাবে কি, যার ব্যাপারে আমরা বলতে পারবো যে এটি একটি অকাট্য দলীল, এতে কোনো অস্পষ্টতা নেই? সুতরাং যেখানে রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমরা অচিরেই তোমাদের রবকে দেখতে পাবে, যেমন তোমরা পূর্ণিমার রাতে চন্দ্রকে দেখতে পাও, সেখানে কিভাবে এ ব্যাখ্যা করা যেতে পারে যে, তোমরা তোমাদের রবকে সেভাবেই জানতে পারবে, যেভাবে তোমরা পূর্ণিমার রাতে চন্দ্রকে জানতে পারো? মোট কথা মুতাযেলারা ‘আল্লাহকে দেখা যাবে’ এ কথার ব্যাখ্যায় বলেছে যে, আল্লাহ তা‘আলা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা যাবে। এ অপব্যাখ্যার পক্ষে তারা কুরআন মজীদের সূরা ফীলের ১নং আয়াতকে দলীল হিসাবে উল্লেখ করেছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
أَلَمْ تَرَ كَيْفَ فَعَلَ رَبُّكَ بِأَصْحَابِ الْفِيلِ
হে নাবী! তুমি কি দেখোনি যে, তোমার প্রতিপালক হসত্মী-অধিপতিদের সাথে কিরূপ আচরণ করেছিলেন? এরূপ অন্যান্য যেসব আয়াতে رأى শব্দ এসেছে, তা দ্বারা দলীল পেশ করে তারা বলে থাকে যে, এসব رأى আফআলে কুলুবের অন্তর্ভুক্ত। তবে কোনো সন্দেহ নেই যে, দেখা কখনো কখনো কপালের চোখ দিয়ে হয়ে থাকে, কখনো কখনো অন্তরের চোখ দিয়ে হয়ে থাকে আবার কখনো স্বপ্নের মাধ্যমেও হয় এবং অন্যান্য অর্থেও দেখা কথাটি ব্যবহৃত হয়। তবে মানুষের সব ধরণের কথার মধ্যেই এমন আলামত থাকে, যা বক্তব্যের একাধিক অর্থের মধ্য থেকে যে কোনো একটি অর্থকে নির্দিষ্ট করে দেয়। আর বক্তার কথার একাধিক অর্থ থেকে কোনো একটি অর্থকে নির্দিষ্টকারী আলামত না থাকলে তার সমস্ত কথাই অস্পষ্ট থেকে যাবে; তার কোনো কথার অর্থই সুষ্পষ্ট হবে না।
নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী:
«إِنَّكُمْ سَتَرَوْنَ رَبَّكُمْ عيانا كَمَا تَرَوْنَ الشمس في الظهيرة ليس دونها سحاب»
‘‘নিশ্চয়ই তোমরা অচিরেই স্বচক্ষে তোমাদের রবকে দেখতে পাবে। যেমন মেঘহীন আকাশে দুপুর বেলা কোনো রকম অসুবিধা ছাড়াই সূর্য দেখতে পাও’’।[2]
এ সুস্পষ্ট বাণীর চেয়ে অধিক সুস্পষ্ট বর্ণনা আছে কি? এ সুস্পষ্ট বক্তব্যের মাধ্যমে কি চোখের দেখা সাব্যস্ত হয়? না কি এর মাধ্যমে অন্তরের দেখা সাব্যস্ত হয়? যার অন্তরকে আল্লাহ তা‘আলা অন্ধ করে দিয়েছেন, সে ব্যতীত এ রকম দলীল আর কার নিকট অস্পষ্ট থাকতে পারে?
মুতাযেলারা যদি বলে, বিবেক-বুদ্ধির দলীল আমাদেরকে এ তাবীল করতে বাধ্য করেছে। তারা বলেছে, বিবেক ও বোধশক্তির দাবি হলো, আল্লাহকে দেখা অসম্ভব। এটি বাস্তবায়ন হওয়া অসম্ভব।তাদের কথার জবাব হলো, এটি তোমাদের মুখের দাবি মাত্র। অধিকাংশ বিবেকবান লোক তোমাদের সাথে একমত নয়। বিবেক ও বোধশক্তি আল্লাহর দিদারকে অসম্ভবও মনে করে না। বরং বিবেক-বুদ্ধির কাছে যখন এমন অস্তিত্বশীল স্বয়ং সম্পূর্ণ জিনিস পেশ করা হয়, যা দেখা যায় না, তখন বিবেকের ফায়ছালাতেই তার অস্তিত্ব অসম্ভব বলে সাব্যস্ত হয়।
[2]. ছহীহ বুখারী হা/৫৫৪ ও ছহীহ মুসলিম হা/৬৩৩।
ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহর কথা, لِمَنِ اعْتَبَرَهَا مِنْهُمْ بِوَهْمٍ যে ব্যক্তি ধারণার বশবর্তী হয়ে আল্লাহর দিদারকে কল্পনা করবে। অর্থাৎ এ ধারণা করবে যে, আল্লাহ তা‘আলাকে এভাবে দেখা যাবে, এ ভেবে তার জন্য কোনো একটি সাদৃশ্য নির্ধারণ করবে, সে আল্লাহ তা‘আলার জন্য সদৃশ নির্ধারণকারী হিসাবে গণ্য হবে। আর যে ব্যক্তি সৃষ্টির সাথে আল্লাহর তুলনা হয়ে যাওয়ার ভয়ে আল্লাহর দিদারকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করবে, সে আল্লাহর সিফাতকে অস্বীকারকারী এবং বাতিলকারী হিসাবে গণ্য হবে। সুতরাং আল্লাহর সিফাত সম্পর্কে ধারণার বশবতী হয়ে কথা বলা থেকে দূরে থাকা আবশ্যক। আল্লাহর সদৃশ নফী করতে গিয়ে সে যেন হক ও বাতিল উভয়কেই নাকোচ না করে দেয়। এতে করে বাতিলের প্রতিবাদ করতে গিয়ে হকও নাকোচ হয়ে যায়। বরং আবশ্যক হলো আল্লাহ তা‘আলার অতি সুন্দর নাম ও সুউচ্চ গুণাবলীর মধ্যে বাতিল কিছু সাব্যস্ত করার প্রতিবাদ করা এবং তাতে যা কিছু সত্য তা সাব্যস্ত করা।
শাইখ এ দিকে ইঙ্গিত করেই বলেছেন, وَمَنْ لَمْ يَتَوَقَّ النَّفْيَ وَالتَّشْبِيهَ، زَلَّ وَلَمْ يُصِبِ التَّنْزِيهَ যে ব্যক্তি রবের জন্য সুসাব্যস্ত গুণাবলীকে অস্বীকার করা এবং সৃষ্টির গুণাবলীর সাথে তার সাদৃশ্য বর্ণনা করা থেকে বিরত থাকবে না, তার নিশ্চিত পদস্খলন ঘটবে ও সে সঠিকভাবে আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণায় ব্যর্থ হবে।
মুতাযেলারা মনে করে, আল্লাহর সুউচ্চ সিফাতসমূহ নাকোচ করার মাধ্যমে তারা তাকে সকল প্রকার দোষ-ত্রুটি থেকে পবিত্র করে থাকে। এখন প্রশ্ন হলো, যেসব গুণাবলী আল্লাহ তা‘আলার পূর্ণতার প্রমাণ বহন করে, তা নাকোচ করার মাধ্যমে কিভাবে তার পবিত্রতা সাব্যস্ত হবে? আল্লাহর দিদারকে নফী করার মাধ্যমে তার কামালিয়াত সাব্যস্ত হয় না। কেননা অস্তিত্বহীন জিনিসই কেবল দেখা যায় না। যার অস্তিত্ব রয়েছে, তাকে দেখা সম্ভব। বরং আল্লাহ তা‘আলার দিদার সাব্যস্ত করার মধ্যেই এবং দর্শকের দ্বারা আল্লাহ তা‘আলাকে পরিপূর্ণ আয়ত্ত করা নাকোচ করার মধ্যেই তার পরিপূর্ণ কামালিয়াত সাব্যস্ত হয়। আল্লাহ তা‘আলা সম্পর্কে বান্দার ইলমের ব্যাপারেও একই কথা। তার সম্পর্কে ইলম নাকোচ করার মাধ্যমে কামালিয়াত সাব্যস্ত হয় না। বরং ইলম সাব্যস্ত করা এবং ইলমের মাধ্যমে তঁকে সম্পূর্ণ রূপে আয়ত্ত ও পরিবেষ্টন করা নাকোচ করার মধ্যেই তার কামালিয়াত সাব্যস্ত হয়। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলাকে দেখার মাধ্যমে পরিপূর্ণ রূপে আয়ত্ত করা সম্ভব নয়। ঠিক তেমনি ইলমের মাধ্যমে তাকে পরিপূর্ণ রূপে আয়ত্ত ও পরিবেষ্টন করা অসম্ভব।[1]
ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ বলেন, أَوْ تَأَوَّلَهَا بِفَهْمٍ অথবা নিজের বুঝ অনুসারে সেই দিদারের তাবীল করবে বা ভুল ব্যাখ্যা দিবে। অর্থাৎ সে দাবি করলো যে, সে শরীয়তের দলীলের এমন একটি তাবীল বা ব্যাখ্যা জানতে পেরেছে, যা আয়াতের বাহ্যিক অর্থের পরিপন্থী এবং আরবী ভাষায় পারদর্শী প্রত্যেক লোক সে সম্পর্কে অবগত নয়। আর পরবর্তী যুগের আলেমদের পরিভাষায় তাবীলের অর্থ সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, শব্দকে তার বাহ্যিক অর্থ থেকে সরিয়ে সম্ভাব্য অন্য অর্থের দিকে ফিরিয়ে নেয়া। এ অযুহাতেই তাহরীফকারীরা শরীয়তের দলীলের উপর আক্রমণ করেছে। তারা বলেছে, যেসব আয়াত আমাদের মতের বিপরীত হবে, সেগুলোকে আমরা তাবীল করবো। এর মাধ্যমে তারা তাহরীফকেই সাজিয়ে-গুছিয়ে ও সুন্দর করে তাবীল হিসাবে নামকরণ করেছে। যাতে করে লোকেরা এটিকে সহজেই গ্রহণ করে নেয়। যারা বাতিলের বাহ্যিক শোভা বৃদ্ধি করে তাকে চাকচিক্যময় করে, আল্লাহ তা‘আলা তাদের নিন্দা করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَكَذَلِكَ جَعَلْنَا لِكُلِّ نَبِيٍّ عَدُوًّا شَيَاطِينَ الْإِنْسِ وَالْجِنِّ يُوحِي بَعْضُهُمْ إِلَى بَعْضٍ زُخْرُفَ الْقَوْلِ غُرُورًا وَلَوْ شَاءَ رَبُّكَ مَا فَعَلُوهُ فَذَرْهُمْ وَمَا يَفْتَرُونَ
‘‘আর এভাবেই আমি মনুষ্য শয়তান ও জিন শয়তানদেরকে প্রত্যেক নাবীর দুশমনে পরিণত করেছি। তারা ধোঁকা ও প্রতারণার ছলে পরস্পরকে চমকপ্রদ কথা বলতো৷ তোমার রব চাইলে তারা এমনটি কখনো করতো না। কাজেই তাদের অবস্থার উপর ছেড়ে দাও’’। (সূরা আনআম: ১১২)
আসলে বাক্যের অর্থটিই মূল উদ্দেশ্য ও গ্রহণযোগ্য। শব্দমালা মূল উদ্দেশ্য নয়। অনেক বাতিল জিনিসকে সুশোভিত করে সত্যের বিরোধীতা করা হয়েছে।
সুতরাং শাইখের উক্তি: لِمَنِ اعْتَبَرَهَا مِنْهُمْ بِوَهْمٍ যে ব্যক্তি ধারণার বশবর্তী হয়ে আল্লাহর দিদারকে কল্পনা করবে, -তার অবস্থা পূর্বোক্ত কথার মতই। সেখানে তিনি বলেছেন, لَا نَدْخُلُ فِي ذَلِكَ مُتَأَوِّلِينَ بِآرَائِنَا وَلَا مُتَوَهِّمِينَ بِأَهْوَائِنَا ‘‘এতে আমরা আমাদের নিজস্ব মতের উপর নির্ভর করে কোনো অপব্যাখ্যা করবো না এবং আমাদের প্রবৃত্তির প্ররোচনায় তাড়িত হয়ে কোনো অযাচিত ধারণার বশবর্তী হবো না।
অতঃপর শাইখ তার কথাকে অধিকতর শক্তিশালী করতে গিয়ে বলেন, আল্লাহকে দেখার বিষয়টি এবং রবের অন্যান্য যাবতীয় গুণাবলীর বিষয়ের প্রকৃত কথা হচ্ছে ঐগুলোর কোনোরূপ তাবীল করার অপচেষ্টা না করে যেভাবে এসেছে সেভাবেই অবিকৃতভাবে মেনে নেয়া। এটাই হচ্ছে মুসলিমদের দ্বীন। এখানে তাবীল বর্জন করার অর্থ হলো, বিদআতীরা যে তাহরীফকে তাবীল নাম দিয়েছে, তা উদ্দেশ্য। কিন্তু ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ হিকমত, বিচক্ষণতা, উত্তম পদ্ধতি এবং অত্যন্ত আদবের সাথে ভিন্নমত পোষণকারীদের সাথে বিতর্ক করেছেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
ادْعُ إِلَىٰ سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُم بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ بِمَن ضَلَّ عَن سَبِيلِهِ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِينَ
‘‘হে নাবী! হেকমত এবং উত্তম উপদেশ সহকারে তোমার রবের পথের দিকে দাওয়াত দাও এবং লোকদের সাথে বিতর্ক করো সর্বোত্তম পদ্ধতিতে। তোমার রবই বেশী ভালো জানেন কে তার পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে আছে এবং কে আছে সঠিক পথে’’। (সূরা আন নাহল: ১২৫)[2]
সকল প্রকার তাবীল বর্জন করতে হবে, শাইখের উদ্দেশ্য এটি নয় এবং কোনো কোনো মানুষের কথার বিপরীত হওয়ার কারণে কুরআন-সুন্নাহর বাহ্যিক দলীল দ্বারা সাব্যস্ত জিনিসকে বর্জন করাও উদ্দেশ্য নয়। বরং শাইখের উদ্দেশ্য হলো ঐসব তাবীল বর্জন করা, যা সালাফে সালেহীনের মাজহাবের বিপরীত এবং কুরআন-সুন্নাহর দলীল যেগুলো ভ্রান্ত হিসাবে সাব্যস্ত করেছে। সেই সঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা সম্পর্কে না জেনে কথা বলাও বর্জন করা আবশ্যক।
আর ভ্রান্ত তাবীলের মধ্যে গণ্য হলো, আল্লাহ তা‘আলাকে দেখার দলীলগুলোর তাবীল করা, আল্লাহ তা‘আলা উপরে সমুন্নত হওয়ার দলীলগুলোর তাবীল করা ও এ কথা বলা যে, আল্লাহ তা‘আলা মুসার সাথে কথা বলেননি এবং তিনি ইবরাহীম আলাইহিস সালামের সাথে কথা বলেননি।
আর التأويل শব্দটি অনেক সময় তার আসল অর্থ বাদ দিয়ে অন্য অর্থে ব্যবহৃত হয়। আর আল্লাহ তা‘আলার কিতাব ও রাসূলের সুন্নাতের পরিভাষায় তাবীল দ্বারা সেই প্রকৃত অর্থ, বাস্তব রূপ এবং পরিণাম উদ্দেশ্য, যার দিকে কালামকে ফিরিয়ে নেয়া হয়। সুতরাং খবরের তাবীল বলতে হুবহু খবরকেই বুঝায়। আদেশের তাবীল বলতে আদিষ্ট কাজ সম্পাদন করাকেই বুঝায়। যেমন আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত হয়েছে, নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রুকুতে কখনও এ দু’আটির সাথে পড়তেন,
سُبْحَانك اللَّهُمَّ رَبَّنَا وَبِحَمْدِك اللَّهُمَّ اِغْفِرْ لِي
‘‘হে আল্লাহ! আমাদের প্রভু। তোমার প্রশংসার সহিত তোমার পবিত্রতা ঘোষণা করছি। হে আল্লাহ! তুমি আমাকে ক্ষমা করো’’।[3] এর মাধ্যমে তিনি কুরআনের তাবীল করতেন। অর্থাৎ তার আদেশ বাস্তবায়ন করতেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
هَلْ يَنظُرُونَ إِلَّا تَأْوِيلَهُ يَوْمَ يَأْتِي تَأْوِيلُهُ يَقُولُ الَّذِينَ نَسُوهُ مِن قَبْلُ قَدْ جَاءَتْ رُسُلُ رَبِّنَا بِالْحَقِّ
‘‘আর তারা কোনো কিছুর অপেক্ষা করছে না, শুধুমাত্র ওর সর্বশেষ পরিণতির প্রতীক্ষায় আছে? যেদিন এর সর্বশেষ পরিণতি উপস্থিত হবে সেদিন যারা এর আগমনের কথা ভুলে গিয়েছিল তারা বলবে, বাস্তবিকই কি আমাদের রবের রসূলগণ সত্য নিয়ে এসেছিলেন?’’। (সূরা আল ‘আরাফ: ৫৩)
স্বপ্নের ব্যাখ্যা করাকেও তাবীল বলা হয়। সেই সঙ্গে কাজ-কর্মের ব্যাখ্যাকেও তাবীল বলা হয়। আল্লাহ তা‘আলা ইউসুফ আলাইহিস সালামের উক্তি নকল করে বলেন,
هَٰذَا تَأْوِيلُ رُؤْيَايَ مِن قَبْلُ قَدْ جَعَلَهَا رَبِّي حَقًّا
‘‘আমি ইতিপূর্বে যে স্বপ্ন দেখেছিলাম এ হচ্ছে তার ব্যাখ্যা। আমার রব তাকে সত্যে পরিণত করেছেন’’ (সূরা ইফসুফ: ১০০)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
وَيُعَلِّمُكَ مِن تَأْوِيلِ الْأَحَادِيثِ
‘‘এবং তোমাকে স্বপ্নের ব্যাখ্যা শিক্ষা দিবেন’’। (সূরা ইউসুফ: ৬) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا
‘‘এটিই উত্তম এবং পরিণামে উৎকৃষ্টতর’’। (সূরা আন নিসা: ৫৯) আর কাজের ব্যাখ্যাকেও তাবীল বলা হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
سَأُنَبِّئُكَ بِتَأْوِيلِ مَا لَمْ تَسْتَطِع عَّلَيْهِ صَبْرًا أَمَّا السَّفِينَةُ فَكَانَتْ لِمَسَاكِينَ يَعْمَلُونَ فِي الْبَحْرِ فَأَرَدتُّ أَنْ أَعِيبَهَا وَكَانَ وَرَاءَهُم مَّلِكٌ يَأْخُذُ كُلَّ سَفِينَةٍ غَصْبًا وَأَمَّا الْغُلَامُ فَكَانَ أَبَوَاهُ مُؤْمِنَيْنِ فَخَشِينَا أَن يُرْهِقَهُمَا طُغْيَانًا وَكُفْرًا فَأَرَدْنَا أَن يُبْدِلَهُمَا رَبُّهُمَا خَيْرًا مِّنْهُ زَكَاةً وَأَقْرَبَ رُحْمًا وَأَمَّا الْجِدَارُ فَكَانَ لِغُلَامَيْنِ يَتِيمَيْنِ فِي الْمَدِينَةِ وَكَانَ تَحْتَهُ كَنزٌ لَّهُمَا وَكَانَ أَبُوهُمَا صَالِحًا فَأَرَادَ رَبُّكَ أَن يَبْلُغَا أَشُدَّهُمَا وَيَسْتَخْرِجَا كَنزَهُمَا رَحْمَةً مِّن رَّبِّكَ ۚ وَمَا فَعَلْتُهُ عَنْ أَمْرِي ۚ ذَٰلِكَ تَأْوِيلُ مَا لَمْ تَسْطِع عَّلَيْهِ صَبْرًا
‘‘যে বিষয়ে তুমি ধৈর্য ধরতে পারনি, আমি সেগুলোর তাৎপর্য ব্যাখ্যা করছি। নৌকাটির ব্যাপারে কথা হলো, ওটা ছিল কতিপয় দরিদ্র ব্যক্তির। তারা সমুদ্রে কাজ করতো। আমি ইচ্ছা করলাম নৌকাটিকে ত্রুটিযুক্ত করে দেই, কারণ ওদের সম্মুখে ছিল এক রাজা, যে বল প্রয়োগে সকল নিখুত নৌকা ছিনিয়ে নিতো। আর বালকটির কথা এ যে, তার পিতা-মাতা ছিল ঈমানদার, আমি আশঙ্কা করলাম যে, সে বিদ্রোহাচরণ ও কুফুরী দ্বারা তাদেরকে বিব্রত করবে। অতঃপর আমি চাইলাম যে, তাদের প্রতিপালক যেন তাদেরকে তার পরিবর্তে এমন এক সন্তান দান করেন; যে হবে পবিত্রতায় মহত্তর ও ভক্তি-ভালোবাসায় ঘনিষ্ঠতর। আর ঐ প্রাচীরটির কথা এ যে, ওটা ছিল নগরবাসী দুই ইয়াতীম বালকের, ওর নীচে আছে তাদের গুপ্তধন এবং তাদের পিতা ছিল একজন সৎ লোক। সুতরাং তোমার প্রতিপালক দয়াপূর্বক ইচ্ছা করলেন যে, তারা বয়োপ্রাপ্ত হোক এবং তারা তাদের ধনভান্ডার উদ্ধার করুক; আমি নিজের তরফ থেকে এসব করিনি। তুমি যে বিষয়ে ধৈর্যধারণে অপারগ হয়েছিলে, এটাই তার ব্যাখ্যা’’। (সূরা কাহাফ: ৭৮-৮২)
সুতরাং এ ধরণের ব্যাখ্যা এবং আদেশ-নিষেধ সম্পর্কিত জ্ঞানকে কেউ কি অস্বীকার করতে পারে? আর যেসব আয়াত খবর সম্পর্কিত, যাতে আল্লাহর নাম, তার সত্তা, তার সিফাত এবং আখেরাত দিবসের বিভিন্ন খবর রয়েছে, সেগুলোর ব্যাখ্যা জানা সম্ভব নয়। অর্থাৎ গায়েবী বিষয়গুলোর হাকীকত জানা সম্ভব নয়। কেননা খবরের মাধ্যমে এগুলোর হাকীকত জানা যায়নি। আসল কথা হলো সম্বোধিত ব্যক্তি যদি সংবাদের মাধ্যমে অবগত জিনিসটি কল্পনা করতে না পারে অথবা সম্বোধনের পূর্বে থেকেই যদি সেটি সম্পর্কে পরিচিত না থাকে, তাহলে সম্বোধিত ব্যক্তি খবরের মাধ্যমে কখনো ঐ জিনিসের হাকীকত সম্পর্কে জানতে পারবে না। আর এ হাকীকতটির নাএ হলো তাবীল। আল্লাহ ছাড়া এ তাবীল সম্পর্কে অন্য কেউ অবগত নয়। তবে কোনো বস্তুর হাকীকত বা প্রকৃত রূপ না জানার অর্থ এ নয় যে, সম্বোধনকারী সম্বোধিত ব্যক্তিকে যা বুঝাতে চাচ্ছে, সে সম্পর্কে মোটেই অবগত হবে না। কুরআনে যত আয়াত রয়েছে, তার সবগুলো নিয়েই আল্লাহ তা‘আলা চিন্তা-গবেষণা করার আদেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা যেসব আয়াত নাযিল করেছেন, তাতে তিনি পছন্দ করেন যে, তার সবগুলো সম্পর্কেই মানুষ অবগত হোক। যদিও তা এমন তাবীলের অন্তর্ভুক্ত হয়, যার প্রকৃত তাৎপর্য আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ জানে না। কুরআন, সুন্নাহ ও সালাফদের কথার মধ্যে যে তাবীল শব্দটি বর্ণিত হয়েছে, তার অর্থ এটিই। যদিও এ তাবীল বাহ্যিক বক্তব্যের সাথে সংগতিপূর্ণ হয় কিংবা বাহ্যিক অর্থের বিপরীত হয়।
[2]. সত্য প্রকাশের জন্য ভিন্ন মতাবলম্বীর সাথে বিতর্কের কিছু আদব: এটি যেন নিছক বিতর্ক, বুদ্ধির লড়াই ও মানসিক ব্যায়াম পর্যায়ের না হয়। আলোচনায় পেঁচিয়ে কথা বলা, মিথ্যা দোষারোপ ও রূঢ় বাক্য দ্বারা প্রতিপক্ষকে বিদ্ধ করার প্রবণতা যেন না থাকে। প্রতিপক্ষকে চুপ করিয়ে দিয়ে নিজের গলাবাজী করে যেতে থাকা এর উদ্দেশ্য হবে না। বরং এ বিতর্ক আলোচনায় মধুর বাক্য ব্যবহার করতে হবে। উন্নত পর্যায়ের ভদ্র আচরণ করতে হবে। যুক্তি-প্রমাণ হতে হবে ন্যায়সংগত ও হৃদয়গ্রাহী। যাকে উদ্দেশ্য করে বলা হচ্ছে তার মনে যেন জিদ, একগুঁয়েমী এবং কথার প্যাঁচ সৃষ্টি হবার অবকাশ না দেখা দেয়। সোজাসুজি তাকে কথা বুঝাবার চেষ্টা করতে হবে এবং যখন মনে হবে যে, প্রতিপক্ষ কূটতর্কে লিপ্ত হওয়াকে উদ্দেশ্য বানিয়ে নিয়েছে তখন তাকে তার অবস্থার উপর ছেড়ে দিতে হবে। যাতে সে শিক্ষা গ্রহণ করার সুযোগ পায় আর না হয় তার ভ্রষ্টতা দ্বারা অন্যরা প্রভাবিত না হয়।
[3]. ছহীহ মুসলিম ৪৮৪, ছহীহ বুখারী ৭৯৪, আবূদাউদ ৮৭৭, নাসাঈ ১১২৩।
অনেক মুফাস্সিরের মতে التأويل শব্দটি তাফসীর অর্থেই ব্যবহৃত হয়। ইমাম ইবনে জারীর এবং অনুরূপ অন্যান্য মুফাসসির তাবীল শব্দটি ব্যবহার করেন কালামের ব্যাখ্যা এবং তার অর্থ বর্ণনা করার উদ্দেশ্যে। চাই সে ব্যাখ্যা কালামের বাহ্যিক অর্থের সাথে সংগতিপূর্ণ হোক কিংবা বাহ্যিক অর্থের বিপরীত হোক। এটি একটি বহু প্রচলিত পরিভাষা। এ তাবীল তাফসীরের মতই। তাবীলের যে অংশ সত্যের অনুরূপ হবে, তা গ্রহণ করা হবে এবং যে অংশ বাতিল হবে তা প্রত্যাখ্যাত হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَمَا يَعْلَمُ تَأْوِيلَهُ إِلَّا اللَّهُ وَالرَّاسِخُونَ فِي الْعِلْمِ
সেগুলোর আসল অর্থ আল্লাহ এবং পরিপক্ক জ্ঞানের অধিকারীরা ছাড়া অন্য কেউ জানে না’’। (সূরা আলে-ইমরান: ৭)
এ আয়াতাংশের মধ্যে দু’টি কিরা‘আত রয়েছে। কোনো কোনো কারী إلا الله এর পরে ওয়াক্ফ করে থাকেন। আবার কোনো কোনো কারী إلا الله এর পরে ওয়াক্ফ করেন না। উভয় কিরাতই সঠিক। প্রথম কিরাআত অনুযায়ী আয়াতের অর্থ হলো, যে আয়াতগুলো প্রকৃতপক্ষেই মুতাশাবেহা, তার অর্থ কেবল আল্লাহ তা‘আলাই অবগত রয়েছেন। আর দ্বিতীয় কিরাআত অনুযায়ী আয়াতের অর্থ হলো, মুতাশাবেহা আয়াতগুলোর অর্থ অস্পষ্ট হওয়ার বিষয়টি আপেক্ষিক। অর্থাৎ এগুলোর অর্থ কেবল জ্ঞানে পরিপক্করাই জানেন; অন্যরা এগুলোর ব্যাখ্যা জানেন না। যারা إلا الله এর পরে ওয়াক্ফ করে থাকেন, তারা তাবীল এবং তাফসীরকে সমার্থবোধক শব্দ হিসাবে গণ্য করেন না। এ কথার অর্থ হলো আল্লাহ তা‘আলা তার রাসূলের উপর এমন কিছু আয়াতও নাযিল করেছেন, যার অর্থ উম্মতের কোনো লোকই জানে না এবং স্বয়ং রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও জানতেন না। সেই সঙ্গে জ্ঞানে যারা পরিপক্ক, মুতাশাবেহার অর্থ সম্পর্কে তাদেরও কোনো ধারণা নেই। তারাও শুধু এটি বলবে, (آَمَنَّا بِهِ كُلٌّ مِنْ عِنْدِ رَبِّنَا) ‘‘আমরা এসব বিশ্বাস করি। সবই আমাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে আগত’’। (সূরা আলে ইমরান:৭) এটি তো মুমিনদের মধ্যে যারা জ্ঞানে অপরিপক্ক তারাও বলে থাকে।
তবে জ্ঞানে যারা পরিপক্ক, সাধারণ মুমিনদের মধ্য থেকে মুতাশাবেহা আয়াতগুলোর ব্যাপারে তাদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য থাকা আবশ্যক। আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা বলেছেন, আমি ঐসব সুবিজ্ঞ আলেমদের অন্তর্ভুক্ত, যারা মুতাশাবেহা আয়াতগুলোর তাবীল সম্পর্কেও অবগত রয়েছেন। তিনি সত্যই বলেছেন। কেননা নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর জন্য দুআ করতে গিয়ে বলেছেন,
أللهم فَقِّهْهُ فِي الدِّينِ وعلمه التأويل
‘‘হে আল্লাহ! তুমি তাকে দ্বীনের জ্ঞান দান করো এবং তাকে কুরআনের ব্যাখ্যার জ্ঞান দান করো’’।[1] ইমাম বুখারী এবং অন্যান্য ইমামগণ হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। আর নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুস্তাজাবুদ দাওয়াত। অর্থাৎ তার কোনো দু‘আই আল্লাহ তা‘আলা ফিরিয়ে দিতেন না।
প্রখ্যাত তাবেঈ মুজাহিদ রহিমাহুল্লাহ বলেন, আমি আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রাদ্বিয়াল্লাহুর নিকট কুরআন মজীদের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পেশ করেছি। প্রত্যেকটি আয়াত পাঠ করেই আমি থেমেছি এবং তাকে তার ব্যাখ্যা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছি। মুতাওয়াতের সূত্রে আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি কুরআনের সমস্ত আয়াতের অর্থের ব্যাপারেই কথা বলেছেন। তিনি কোনো আয়াতের ব্যাপারেই বলেননি যে, এটি মুতাশাবেহার অন্তর্ভুক্ত, যার অর্থ আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া অন্য কেউ জানে না।
আমাদের হানাফী মাযহাবের ইমামগণ উসূলের কিতাবসমূহে বলেছেন, কুরআন মজীদের সূরাসমূহের শুরুতে উল্লেখিত বিচ্ছিন্ন বর্ণগুলোকে মুতাশাবেহা বলা হয়।
আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে এটি বর্ণনা করা হয়েছে। অথচ কুরআনের অধিকাংশ ব্যাখ্যাকার এ অক্ষরগুলোর অর্থ সম্পর্কে তাদের মতামত ব্যক্ত করেছেন। এ অক্ষরগুলোর অর্থ যদি আলেমদের নিকট পরিচিত থাকে, তাহলে মুতাশাবেহা আয়াতসমূহের অর্থও জানা যাবে। আর যদি এগুলোর অর্থ জানা না যায়, তাহলে এগুলোও মুতাশাবেহার অন্তর্ভুক্ত। এ ছাড়া অন্যান্য আয়াতগুলোর অর্থ বোধগম্য। যে আয়াতসমূহের অর্থ আমরা জানতে পারবো, সেগুলোই আমাদের মূল উদ্দেশ্য। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
هُوَ الَّذِي أَنْزَلَ عَلَيْكَ الْكِتَابَ مِنْهُ آيَاتٌ مُحْكَمَاتٌ هُنَّ أُمُّ الْكِتَابِ وَأُخَرُ مُتَشَابِهَاتٌ
‘‘তিনিই তোমার প্রতি কিতাব নাযিল করেছেন। তাতে কিছু আয়াত রয়েছে মুহকাম (সুস্পষ্ট), সেগুলোই কিতাবের আসল অংশ। আর অন্যগুলো মুতাশাবেহ (অস্পষ্ট)’’। (সূরা আলে-ইমরান:৭) আর সূরার শুরুর দিকে উল্লেখিত অক্ষরগুলো অধিকাংশ আলেমের মতে আলাদা আয়াত নয়।
পরবর্তীকালের ফকীহ এবং মুতাকাল্লিমীনদের পরিভাষায় বিশেষ কোনো নিদর্শন পাওয়া গেলে শব্দকে প্রাধান্যযোগ্য সম্ভাব্য অর্থ থেকে সরিয়ে অপ্রাধান্যযোগ্য সম্ভাব্য অর্থের দিকে নিয়ে যাওয়াকে তাবীল বলা হয়। সংবাদ কিংবা আদেশ-নিষেধ সম্পর্কিত অনেক ব্যাপারেই এ তাবীল নিয়ে আলেমগণ মতভেদ করেছেন। সঠিক তাবীল তাই, যা কুরআন ও ছহীহ হাদীছের দলীলের সাথে সংগতিপূর্ণ হয়। আর যে তাবীল কুরআন ও ছহীহ হাদীছের দলীলের বিরোধী হবে, তা ভ্রান্ত তাবীল বলে গণ্য হবে। যথাস্থানে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
আবু ইসহাক ইবরাহীম বিন আলী সিরাজী রহিমাহুল্লাহ তার ‘তাবসিরা’ নামক কিতাবে নুসাইর বিন ইয়াহইয়া বালখী আমর বিন ইসমাঈল রহিমাহুল্লাহ থেকে বর্ণনা করেন যে, তাকে আল্লাহ তা‘আলার সিফাত সংক্রান্ত আয়াত ও হাদীছগুলো সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলো, এগুলোর বাহ্যিক অর্থ আল্লাহ তা‘আলার জন্য সাব্যস্ত করা হলে কি সৃষ্টির সাথে আল্লাহর তাশবীহ হয়ে যায় না? জবাবে তিনি বললেন, এগুলো যেভাবে এসেছে, সেভাবেই রেখে দিবো এবং তাতে বিশ্বাস করবো। আমরা বলবো না যে এগুলোর ধরণ কী?
জেনে রাখা আবশ্যক যে, কুরআন-সুন্নাহর যেসব দলীলের বাহ্যিক দাবি মোতাবেক আল্লাহ তা‘আলার জন্য সিফাত সাব্যস্ত হয়েছে, তা সাব্যস্ত করা বাতিল বা কুফুরী নয়; বরং যে ব্যক্তি তা সাব্যস্ত করাকে কুফুরী মনে করবে, তার বুঝ এবং ইলমের মধ্যে ত্রুটি রয়েছে। কবি বলেছেন,
وَكَمْ مِنْ عَائِبٍ قَوْلًا صَحِيحًا... وَآفَتُهُ مِنَ الْفَهْمِ السَّقِيمِ
অনেক লোক রয়েছে, যারা সঠিক কথাকে দোষারোপ করে। আসলে দোষিত বুঝশক্তিই এ মসীবতের একমাত্র কারণ। অন্য এক কবি বলেন,
عَلَيَّ نَحْتُ الْقَوَافِي مِنْ مَعادنها... وَمَا عَلَيَّ إذا لَمْ تَفْهَمِ الْبَقَرُ
‘‘আমার উপর আবশ্যক হলো, শব্দমালার ভান্ডার থেকে উচ্চাঙ্গের শব্দ প্রয়োগ করবো। গরুর দল (নির্বোধ লোকেরা) তা যদি না বুঝে, তাতে আমার কিছু করণীয় নেই।[2]
যেক্ষেত্রে আল্লাহর কিতাব হলো সর্বাধিক সত্য, তার বাণী হলো সর্বোত্তম বাণী এবং তা এমন কিতাব, যার আয়াতগুলো মজবুত (সুবিন্যাস্ত) করা হয়েছে, অতঃপর বিশদভাবে বর্ণনা করা হয়েছে:
أُحْكِمَتْ آَيَاتُهُ ثُمَّ فُصِّلَتْ مِنْ لَدُنْ حَكِيمٍ خَبِيرٍ
এ কিতাব প্রজ্ঞাময়, সর্বজ্ঞের নিকট হতে, এর আয়াতসমূহ সুস্পষ্ট, সুবিন্যস্ত ও পরে বিশদভাকে বিবৃত (সূরা হুদ:১)।
সেখানে কিভাবে এ কথা বলা যেতে পারে যে, কুরআন মজীদের আয়াতগুলোর মধ্যে এমন কোনো সুস্পষ্ট বর্ণনা নেই, যা থেকে আক্বীদাহ গ্রহণ করা যেতে পারে? তারা আরো বলেছে যে, কুরআনে তাওহীদের কোনো বর্ণনা নেই এবং তাতে আল্লাহ তা‘আলার যথাযথ পবিত্রতাও বর্ণনা করা হয়নি। নাউযুবিল্লাহ। এ হলো কুরআনের অপব্যাখ্যাকারীদের কথার প্রকৃত অবস্থা। তাদের কথার প্রকৃত অর্থ হলো কুরআন ও হাদীছের বাহ্যিক দলীলগুলোর মধ্যে বাতিল অর্থ রয়েছে, নাউযুবিল্লাহ। অথচ সত্য কথা হলো, কুরআন ও হাদীছের দলীলগুলো দ্বারা যা সাব্যস্ত হয়েছে, তাই প্রকৃত সত্য। কুরআনের কোনো দলীলই বাতিল কিছু সাব্যস্ত করেনি। কিন্তু বাতিলপন্থীরা দাবি করে যে, কুরআনের আয়াত ও হাদীছের দলীল এমন বাতিল কথা সাব্যস্ত করে, যা প্রত্যাখ্যান করা জরুরী।
তাদের জবাবে বলা হবে যে, তোমরা আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাতের দলীলগুলোর বাহ্যিক অর্থের তাবীল করার যে দ্বার উন্মুক্ত করেছো, এর মাধ্যমে তোমাদের ধারণায় কিছু কিছু অস্পষ্ট ক্ষেত্রে তোমাদের মুমিন ভাইদের উপর জয়লাভ করতে পারলেও তোমরা কেবল মুশরিক ও বিদ‘আতীদের জন্য তোমাদের দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছো।[3] এ দরজা তোমরা কখনো বন্ধ করতে সক্ষম হবে না। তোমরা যদি কুরআনের দলীল থেকে বোধগম্য অর্থকে শরীয়তের অন্য কোনো দলীল ছাড়াই পরিবর্তন করে ফেলতে চাও, তাহলে তোমাদের কাছে এমন কোনো মূলনীতি আছে কি, যার মাধ্যমে তোমরা নির্ধারণ করে থাকো যে, অমুক আয়াতের তাবীল করা বৈধ এবং অমুক আয়াতের তাবীল করা বৈধ নয়?
এখন তোমরা যদি বলো, বিবেক-বুদ্ধির অকাট্য দলীল যে আয়াতের মর্মার্থ কবুল করে নেয়াকে অসম্ভব মনে করে, আমরা তার তাবীল করবো। আর যদি অসম্ভব মনে না করে, তাহলে আমরা সেই বক্তব্যকে কবুল করে নিবো, তাহলে তোমাদেরকে বলা হবে, কোন্ আকলী দলীলের মাধ্যমে আমরা বিবেক-বুদ্ধির অকাট্য দলীলকে ওজন করবো? কেননা বাতেনী সম্প্রদায়ের ইমাম কিরমিতের মতে বিবেক-বুদ্ধির অকাট্য দলীল শরীয়াতের বাহ্যিক হুকুম-আহকাম ও বিধি-বিধান বাতিল করে দেয়, দার্শনিকরা মনে করে বিবেক-বুদ্ধির অকাট্য দলীল মানুষের দেহের পুনরুত্থানকে বাতিল করে, মুতাযেলারা মনে করে বিবেক-বুদ্ধির অকাট্য দলীল মোতাবেক আল্লাহকে দেখা অসম্ভব। এমনি তাদের বিবেক-বুদ্ধি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার ইলম, কালাম এবং রহমতকে অস্বীকার করে। বিবেক-বুদ্ধির উপর নির্ভর করে আল্লাহ তা‘আলার সিফাত সংক্রান্ত আয়াতগুলোর তাবীল করাকে ওয়াজিব মনে করে, তাদের সমস্ত কথা এ সংক্ষিপ্ত কিতাবে আলোচনা করে শেষ করা যাবে না। বিবেক-বুদ্ধির মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার কালামের তাবীল করতে গেলে দু’টি বড় ধরণের সমস্যায় পড়তে হবে।
(১) অনেক দীর্ঘ আলোচনা করা ব্যতীত আমরা কুরআন ও সুন্নাহর কোনো কিছুই সাব্যস্ত করতে পারবো না। এভাবে দীর্ঘ আলোচনা ও অনুসন্ধানের মাধ্যমে জেনে নিতে হবে যে, বিবেক-বুদ্ধির মাধ্যমে তা সাব্যস্ত করা সম্ভব কি না? আল্লাহর কিতাবের ব্যাপারে মতভেদকারী প্রত্যেক দলই দাবি করে যে, তাদের মাযহাবই বিবেক-বুদ্ধির দলীল দ্বারা সমর্থিত। এতে করে দ্বীনের মূলনীতির বিষয়ে লোকেরা দিশেহারা হবে, যা আকীদার মাসআলাসমূহে সম্পূর্ণ নিষেধ।
(২) আল্লাহর বাণীর তাবীল করা হলে গায়েবী বিষয়সমূহে রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেসব সংবাদ দিয়েছেন অন্তর থেকে সেসব বিষয়ের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস উঠে যাবে। ফলে অনেকেই দৃঢ়তার সাথে এ বিশ্বাস করবে না যে, এখানে বাহ্যিক অর্থ উদ্দেশ্য। ঐদিকে তাবীলগুলো তো বিভিন্ন রকম। এতে করে আল্লাহ তা‘আলা তার বান্দাদেরকে যে সংবাদ দিয়েছেন, তার নির্দেশনা থেকে কুরআন ও সুন্নাহকে দূরে সরিয়ে ফেলা আবশ্যক হবে। النبي শব্দটি الإنباء থেকে গৃহীত। অর্থাৎ সংবাদ প্রদান করা থেকে নেয়া হয়েছে। সুতরাং নাবীর কাজ হলো সংবাদ প্রদান করা। ঐদিকে কুরআনে রয়েছে মহা সংবাদ। তাবীলকারীরা কুরআন ও সুন্নাহর দলীলগুলো কেবল সমর্থন স্বরূপ উল্লেখ করে থাকে; স্বতন্ত্র দলীল হিসাবে উল্লেখ করে না। কুরআন ও সুন্নাহর দলীলগুলো তাদের দাবি মোতাবেক হলে তারা বলে বিবেক-বুদ্ধি এটি সমর্থন করে এবং তারা উহা গ্রহণ করে নেয়। আর কুরআন-সুন্নাহর দলীল তাদের বিবেক-বুদ্ধির খেলাফ হলে তারা শরীয়তের দলীলগুলোর তাবীল করে। এতে করে নাস্তিকদের দ্বার উন্মুক্ত হয়। আমরা আল্লাহ তা‘আলার কাছে এর কুফল থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।
[2]. ইমাম ইবনে আবীল ইয্ রহিমাহুল্লাহ এখানে সৃষ্টির সিফাতের সাথে তাশবীহ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় যারা উহাকে অস্বীকার করেছে, তাদের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন।
[3]. আশায়েরা, মুতাযেলা এবং মাতুরীদিরা আল্লাহ তা‘আলার নাম ও সিফাতগুলোকে তাবীলের মাধ্যমে বিদ‘আতীদের জন্য কুফুরী ও নাস্তিক্যবাদের দরজা খুলে দিয়েছে। যদিও তারা মনে করেছে যে, তারা তাদের আকলী যুক্তির মাধ্যমে কিছু কিছু সাধারণ মুমিনদের উপর জয়লাভ করেছে। মাতুরীদি ও আশায়েরাগণ যখন আরশের উপর আল্লাহর সমুন্নত হওয়ার তাবীল করেছে, তখন দার্শনিকগণ ও বাতেনী সম্প্রদায়ের লোকেরা এ কথা বলার সুযোগ পেয়ে গেছে যে, তোমরা কেন বলছো যে, তোমাদের তাবীল সঠিক এবং আমাদের তাবীল সঠিক নয়? শত শত দলীল থাকা সত্ত্বেও তোমরা সৃষ্টির উপর আল্লাহ তা‘আলার সমুন্নত হওয়ার তাবীল করছো। আর আমরা রূহের পুনরুত্থানের তাবীল করছি। সুতরাং আমাদের মাঝে এবং তোমাদের মাঝে পার্থক্য কোথায়? তোমরা কুরআনের আয়াতের তাবীল-ব্যাখ্যা করছো, আমরাও তাবীল-ব্যাখ্যা করছি। তোমাদের কাছে অকাট্য আকলী দলীল রয়েছে, আমাদের কাছেও অকাট্য আকলী দলীল রয়েছে।
সুতরাং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের কথা হলো, আমাদের কাছে এমন মূলনীতি থাকা আবশ্যক, যা সকলেই মানতে বাধ্য থাকবে। সেটি হলো কুরআনের ব্যাখ্যা কুরআনের মাধ্যমেই করা কিংবা রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাতের মাধ্যমে উহার ব্যাখ্যা করা। নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এভাবেই কুরআনের ব্যাখ্যা করেছেন। ছাহাবীগণ উহা বুঝে নিয়েছেন। এটিই সালাফে সালেহীনদের নীতি। এ ছাড়া যারাই অন্য পদ্ধতিতে কুরআনের ব্যাখ্যা করতে যাবে, তারা বিদআতী বলে গণ্য হবে। এই বিদআত কখনো কুফুরী, কখনো গোমরাহী এবং কখনো ভুল হিসাবে গণ্য হবে।