ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ বলেন,
وَهُوَ الْمَبْعُوثُ إِلَى عَامَّةِ الْجِنِّ وَكَافَّةِ الْوَرَى بِالْحَقِّ وَالْهُدَى وَبِالنُّورِ وَالضِّيَاءِ
তিনি সত্য, হেদায়াত, নূর ও জ্যোতি সহকারে সমস্ত জিন ও মানুষের প্রতি প্রেরিত হয়েছেন।
..............................................................
ব্যাখ্যা: রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিন জাতির প্রতিও প্রেরিত হয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা জিনদের উক্তি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন,
يَا قَوْمَنَا أَجِيبُوا دَاعِيَ اللَّهِ وَآمِنُوا بِهِ يَغْفِرْ لَكُم مِّن ذُنُوبِكُمْ وَيُجِرْكُم مِّنْ عَذَابٍ أَلِيمٍ
‘‘হে আমাদের কওমের লোকেরা, আল্লাহর প্রতি আহবানকারীর আহবানে সাড়া দাও এবং তার প্রতি ঈমান আনো। আল্লাহ তোমাদের গোনাহ মাফ করবেন এবং কষ্টদায়ক আযাব থেকে রক্ষা করবেন’’। (সূরা আহকাফ: ৩১)
এমনি সূরা জিনে আল্লাহ বলেছেন যে, তাদের কাছেও নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রেরিত হয়েছেন। মুকাতিল বলেন, আল্লাহ তা‘আলা মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পূর্বে কোনো রসূলকেই জিন ও ইনসানের জন্য পাঠাননি। এ কথা সঠিক নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
يَا مَعْشَرَ الْجِنِّ وَالْإِنسِ أَلَمْ يَأْتِكُمْ رُسُلٌ مِّنكُمْ يَقُصُّونَ عَلَيْكُمْ آيَاتِي وَيُنذِرُونَكُمْ لِقَاءَ يَوْمِكُمْ هَٰذَا
‘‘হে জিন ও মানব সম্প্রদায়! তোমাদের কাছে তোমাদের মধ্য থেকে কি রসূলগণ আসেনি, যারা তোমাদেরকে আমার আয়াত শোনাতো এবং এ দিনটির সাক্ষাৎ সম্পর্কে তোমাদেরকে সর্তক করতো?’’ (সূরা আনআম: ১৩০)
এতে বুঝা যাচ্ছে যে, রসূল পাঠানো হয়েছে শুধু বনী আদম থেকে। জিনদের মধ্যে কোনো রসূল ছিল না। মুজাহিদ এবং অন্যান্য সালাফ ও খালাফ-পরবর্তী থেকে এ কথাই বর্ণিত হয়েছে। ইবনে আববাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, বনী আদম থেকে হয়েছে রসূল এবং জিনদের থেকে হয়েছেন সতর্ককারী। জিনদের উক্তি উল্লেখ করে বলেন, তারা বলেছিল,
يَا قَوْمَنَا إِنَّا سَمِعْنَا كِتَابًا أُنزِلَ مِن بَعْدِ مُوسَىٰ
‘‘হে আমাদের কওমের লোকজন! আমরা এমন কিতাব শুনেছি যা মূসার পরে নাযিল করা হয়েছে’’। (সূরা আহকাফ: ৩০)
এ আয়াতও প্রমাণ করে যে, মুসা আলাইহিস সালামও জিনদের প্রতি প্রেরিত হয়েছিলেন। আল্লাহ তা‘আলাই সর্বাধিক অবগত রয়েছেন।
যাহ্হাক থেকে ইমাম ইবনে জারীর বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, জিনদের মধ্যেও রসূল রয়েছে। তিনি এ আয়াত দিয়ে দলীল পেশ করেছেন, ‘‘হে জিন ও মানব সম্প্রদায়! তোমাদের কাছে তোমাদের মধ্য থেকে কি রাসূলেরা আসেনি? এ আয়াত দিয়ে জিনদের মধ্য থেকে রসূল থাকার দলীল গ্রহণ করার মধ্যে সন্দেহ রয়েছে। কেননা এ আয়াত দ্বারা দলীল গ্রহণ করা সম্ভব; কিন্তু এটি অকাট্য ও সুস্পষ্ট দলীল নয়। এটি সূরা আর রাহমানের ২২ নং আয়াতের মতই। যেখানে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
يَخْرُجُ مِنْهُمَا اللُّؤْلُؤُ وَالْمَرْجَانُ
‘‘এ উভয় সমুদ্র থেকেই মুক্তা ও প্রবাল পাওয়া যায়’’। এখানে উদ্দেশ্য হলো উভয়টিই এক।
আর নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমগ্র মানব জাতির জন্য রসূল হিসাবে প্রেরিত হওয়ার দলীল হলো আল্লাহ তা‘আলার বাণী,
وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا كَافَّةً لِّلنَّاسِ بَشِيرًا وَنَذِيرًا وَلَٰكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ
‘‘আর আমি তোমাকে সমগ্র মানব জাতির জন্য সুসংবাদ দাতা ও ভীতি প্রদর্শনকারী রূপে পাঠিয়েছি। কিন্তু বেশীর ভাগ লোক জানে না’’। (সূরা সাবা: ২৮) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
قُلْ يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنِّي رَسُولُ اللَّهِ إِلَيْكُمْ جَمِيعًا
‘‘বলে দাও, হে মানব সম্প্রদায়, আমি তোমাদের সকলের জন্য আল্লাহর রসূল হিসেবে এসেছি’’। (সূরা আরাফ: ১৫৮) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
وَأُوحِيَ إِلَيَّ هَٰذَا الْقُرْآنُ لِأُنذِرَكُم بِهِ وَمَن بَلَغَ
‘‘আর এ কুরআন আমার কাছে পাঠানো হয়েছে অহীর মাধ্যমে, যাতে তোমাদের এবং যাদের কাছে এটি পৌঁছে যায় তাদের সবাইকে আমি সতর্ক করি’’। (সূরা আনআম: ১৯) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
وَأَرْسَلْنَاكَ لِلنَّاسِ رَسُولًا وَكَفَىٰ بِاللَّهِ شَهِيدًا
‘‘হে নাবী! আমি তোমাকে মানব জাতির জন্য রসূল বানিয়ে পাঠিয়েছি এবং এরপর আল্লাহর সাক্ষ্যই যথেষ্ট’’। (সূরা নিসা: ৭৯) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
أَكَانَ لِلنَّاسِ عَجَبًا أَنْ أَوْحَيْنَا إِلَىٰ رَجُلٍ مِّنْهُمْ أَنْ أَنذِرِ النَّاسَ وَبَشِّرِ الَّذِينَ آمَنُوا أَنَّ لَهُمْ قَدَمَ صِدْقٍ عِندَ رَبِّهِمْ
‘‘মানুষের জন্য এটা কি একটা আশ্চর্যের ব্যাপার হয়ে গেছে যে, আমি তাদের মধ্য থেকে একজনকে নির্দেশ দিয়েছি লোকদেরকে সজাগ করে দাও এবং যারা ঈমান আনয়ন করবে তাদেরকে এ মর্মে সুসংবাদ দাও যে, তাদের জন্য রয়েছে তাদের রবের কাছে যথার্থ সম্মান?’’। (সূরা ইউনুস: ২) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
تَبَارَكَ الَّذِي نَزَّلَ الْفُرْقَانَ عَلَىٰ عَبْدِهِ لِيَكُونَ لِلْعَالَمِينَ نَذِيرًا
‘‘বরকত সম্পন্ন তিনি, যিনি তারঁ বান্দার উপর নাযিল করেছেন এ ফুরকান। যাতে তিনি সারা সমগ্র সৃষ্টির জন্য সতর্ককারী হন’’। (সূরা ফুরকান: ১)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
وَقُل لِّلَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ وَالْأُمِّيِّينَ أَأَسْلَمْتُمْ فَإِنْ أَسْلَمُوا فَقَدِ اهْتَدَوا وَّإِن تَوَلَّوْا فَإِنَّمَا عَلَيْكَ الْبَلَاغُ وَاللَّهُ بَصِيرٌ بِالْعِبَادِ
‘‘হে নাবী! তুমি কিতাব ওয়ালা এবং কিতাব বিহীন উভয়কে জিজ্ঞাসা করো, তোমরাও কি তার নিকট আত্মসমর্পন করেছো? যদি করে থাকে তাহলে তারা সত্যের পথ লাভ করেছে। আর যদি তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে থাকে, তাহলে তোমার উপর কেবল পয়গাম পেঁŠছিয়ে দেবার দায়িত্বই অর্পিত হয়েছে। আল্লাহ বান্দাদের প্রতি দৃষ্টি রাখেন’’। (সূরা আলে-ইমরান: ২০)
রসূলুল্লাহ্ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
(أُعْطِيتُ خَمْسًا لَمْ يُعْطَهُنَّ أَحَدٌ من الأنبياء قَبْلِي نُصِرْتُ بِالرُّعْبِ مَسِيرَةَ شَهْرٍ وَجُعِلَتْ لِيَ الأَرْضُ مَسْجِدًا وَطَهُورًا فَأَيُّمَا رَجُلٍ مِنْ أُمَّتِي أَدْرَكَتْهُ الصَّلاَةُ فَلْيُصَلِّ وَأُحِلَّتْ لِيَ الْمَغَانِمُ وَلَمْ تَحِلَّ لأَحَدٍ قَبْلِي وَأُعْطِيتُ الشَّفَاعَةَ وَكَانَ النَّبِيُّ يُبْعَثُ إِلَى قَوْمِهِ خَاصَّةً وَبُعِثْتُ إِلَى النَّاسِ عَامَّةً)
‘‘আমাকে এমন পাঁচটি জিনিস প্রদান করা হয়েছে, যা পূর্বের কোন নাবীকে দেয়া হয়নি। (১) এক মাসের দূরত্ব পর্যন্ত শত্রুর বিরুদ্ধে ভয়ের মাধ্যমে আমাকে সাহায্য করা হয়েছে। (২) সমগ্র যমীনের মাটি আমার জন্য পবিত্র এবং মসজিদ স্বরূপ করা হয়েছে। অতএব আমার উম্মতের কোন ব্যক্তির নিকট যদি ছলাতের সময় উপস্থিত হয়, তবে সে যেন তা আদায় করে নেয়। (৩) আমার জন্য গণীমতের মাল হালাল করা হয়েছে। আমার পূর্বে কারো জন্য তা হালাল করা হয়নি। (৪) আমাকে শাফাআতের অধিকার দেয়া হয়েছে। (৫) আমার পূর্বেকার নাবীগণ প্রেরিত হতেন তাদের গোত্রের লোকদের নিকট। আর আমি প্রেরিত হয়েছি সমগ্র মানব জাতির জন্য’’।[1] ইমাম বুখারী ও মুসলিম হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন,
(لاَ يَسْمَعُ بِي أَحَدٌ مِنْ هَذِهِ الأُمَّةِ يَهُودِيٌّ وَلاَ نَصْرَانِيٌّ ثُمَّ لا يُؤْمِنُ بِي إِلاَّ دخل النَّارِ)
‘‘এ উম্মতের যে কোনো ব্যক্তি আমার ব্যাপারে শুনবে, চাই সে ইহুদী হোক বা নাসারা হোক, অতঃপর সে যদি আমার প্রতি ঈমান না এনে মৃত্যু বরণ করে, তাহলে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে’’।[2] ইমাম মুসলিম হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। সমগ্র মানব জাতির জন্য তার প্রেরিত হওয়ার বিষয়টি কারো অজানা নয়।
আর খৃষ্টানদের মধ্য থেকে যারা বলে থাকে, তিনি কেবল আরবদের জন্য রসূল হিসাবে প্রেরিত হয়েছেন, তাদের কথা সম্পূর্ণ বাতিল। কেননা তারা যখন নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রেসালাতে ঈমান আনয়ন করেছে, তখন তাদের উপর আবশ্যক হলো, তিনি যেসব সংবাদ দিয়েছেন, তার প্রত্যেকটি সংবাদই বিশ্বাস করবে। তিনি নিজেই বলেছেন যে, তিনি সমগ্র মানব জাতির প্রতি রসূল হিসাবে প্রেরিত হয়েছেন। আর রসূলগণ কখনো মিথ্যা বলেন না। সুতরাং রসূলদের কথা সত্য বলে বিশ্বাস করা আবশ্যক। নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দূত এবং পত্র পাঠিয়েছেন। তিনি পারস্য সম্রাট কেসরা, রোমক সম্রাট কায়সার, আবিসিনিয়ার রাজা নাজ্জাশী, মুকাওকিস এবং তৎকালীন সকল অঞ্চলের রাজা-বাদশাহদের নিকটই পত্র পাঠিয়ে তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন।
আর ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহর কথা وكافة الورى এর মধ্যকার كافة শব্দটিতে জের পড়া সঠিক নয়। কারণ আরবদের ভাষায় كافة শব্দটি শুধু حال হিসাবেই ব্যবহৃত হয়। তার উপর যবর দিয়ে পড়া উচিত। আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا كَافَّةً لِّلنَّاسِ
‘‘আর আমি তোমাকে সমগ্র মানব জাতির জন্য-এর মধ্যকার كافة এর ইরাব সম্পর্কে তিনটি মত পাওয়া যায়।
(১) এটি أرسلناك-এর كاف থেকে হাল হয়েছে। আর كافة শব্দটি اسم فاعل। অর্থের আধিক্য বুঝানোর জন্য ইহাতে ة যোগ করা হয়েছে। অর্থাৎ মানুষকে ভুল পথ থেকে ফেরানোর জন্যই আপনাকে রসূল হিসাবে প্রেরণ করা হয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন كافة শব্দটি كف এর মাসদার كفا হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। মূল বাক্যটি হবে এরূপ, إلا أن تكف الناس كفا। আরবী ভাষায় মাসদার বা ক্রিয়ামূল হাল হিসাবে অহরহ ব্যবহার হয়ে থাকে।
(২) كافة শব্দটি الناس থেকে হাল হয়েছে। এ মতের প্রতিবাদে বলা হয়েছে যে, অধিকাংশ নাহুবিদদের মতে মাজরুরের হাল তার পূর্বে আনয়ন করা ঠিক নয়। এ কথার জবাবে বলা হয়েছে যে, আরবদের থেকে মাজরুরের হালকে তার পূর্বে উল্লেখ করার বহু নযীর রয়েছে। সুতরাং তা মেনে নেয়া আবশ্যক। নাহুবিদ ইবনে মালেক রহিমাহুল্লাহ এ মতকেই পছন্দ করেছেন। মূল বাক্যটি এরূপ হবে, وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا لِلنَّاسِ كَافَّةً
(৩) এটি একটি উহ্য মাসদারের সিফাত। মূল বাক্যটি হবে এরূপ: إِرْسَالَةً كَافَّةً। এর জবাবে বলা হয়েছে যে, তা কেবল حال (হাল্) হিসাবেই ব্যবহৃত হয়।
ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ বলেন, بِالْحَقِّ وَالْهُدَى وَبِالنُّورِ وَالضِّيَاءِ ‘‘তিনি সত্য, হেদায়াত, নূর ও জ্যোতি সহকারে প্রেরিত হয়েছেন’’।
রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরআন-সুন্নাহর উজ্জ্বল দলীল-প্রমাণ দ্বারা সমর্থিত যে দ্বীন ও শরীয়াত নিয়ে এসেছেন, এগুলো হচ্ছে সে শরীয়াতের বৈশিষ্ট্য। الضياء (জ্যোতি) النور (আলো) থেকে অধিক পরিপূর্ণ ও শক্তিশালী। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
هُوَ الَّذِي جَعَلَ الشَّمْسَ ضِيَاءً وَالْقَمَرَ نُورً ا
তিনিই সূর্যকে করেছেন জ্যোতির্ময় ও চন্দ্রকে করেছেন আলোকময় (সূরা ইউনুস: ৫)।
[2]. ছহীহ মুসলিম, অধ্যায়: কিতাবুল ঈমান।