بِسْمِ الله الرَّحْمَنِ الرَّحِيْم
الْحَمْدُ لله [نَحْمَدُهُ ، وَ] نَسْتَعِينُهُ وَنَسْتَغْفِرُهُ، وَنَعُوذُ بِاللَّهِ مِنْ شُرُورِ أَنْفُسِنَا وَمِنْ سَيِّئَاتِ أَعْمَالِنَا، مَنْ يَهْدِهِ اللَّهُ فَلَا مُضِلَّ لَهُ، وَمَنْ يُضْلِلِ فَلَا هَادِيَ لَهُ. وَأَشْهَدُ أن لا إله إلا الله وحده لا شَرِيكَ لَهُ، وَأَشْهَدُ أَنَّ سَيِّدَنَا مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ، صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَعَلَى آلِهِ وَصَحْبِهِ وَسَلَّمَ تَسْلِيمًا كَثِيرًا.
সমস্ত ইলমের মধ্যে দীনের মূলনীতি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করাই সর্বোত্তম ইলম। কারণ যে বিষয় সম্পর্কে ইলম অর্জন করা হয়, সে বিষয়ের মর্যাদা অনুপাতেই সে সম্পর্কে অর্জিত ইলমের মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ অন্যান্য বিষয়ের তুলনায় দীনের মূলনীতির গুরুত্ব ও মর্যাদা যেহেতু সর্বাধিক, তাই সে সম্পর্কে অর্জিত ইলমও সর্বোত্তম। দীনের শাখা-মাস‘আলা সম্পর্কিত ফিক্বহ এর জ্ঞানার্জনের তুলনায় তার মূলনীতি সম্পর্কে ইলম অর্জন করাই হচ্ছে ফিকহুল আকবার। এ জন্যই ইমাম আবু হানীফা রহিমাহুল্লাহ দীনের মূলনীতিগুলো একত্র করে যে কিতাব লিখেছেন, তার নাম দিয়েছেন الفقه الأكبر আল-ফিকহুল আকবার।
মানুষের যত প্রয়োজন রয়েছে, তার মধ্যে সঠিক আক্বীদা গ্রহণের প্রয়োজনই সর্বাধিক। তাই তাদের প্রয়োজনাদির উপর দীনের মৌলিক বিষয়গুলো সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করাকেই প্রাধান্য দেয়া আবশ্যক। কেননা মানুষের অন্তর ততোক্ষণ পর্যন্ত জীবিত হয় না এবং তা পরিপূর্ণ প্রশান্তি ও স্বস্তি লাভ করে না, যতক্ষণ না সে তার মাবুদের পরিচয় লাভ করে এবং তার স্রষ্টার সুন্দরতম নামসমূহ, সুউচ্চ গুণাবলী ও তার সকল কর্মসহ চিনতে পারে। সে সাথে উপরোক্ত বিষয়গুলো বান্দার অন্তরে সর্বাধিক প্রিয় হওয়া জরুরী। আর বান্দা এ-প্রাণ উজাড় করে কেবল ঐসব আমল করার প্রচেষ্টা চালাবে, যা সকল সৃষ্টির পরিবর্তে তাকে তার রবের সান্নিধ্যে পৌঁছিয়ে দিবে।
মানুষ তার বিবেক ও বোধশক্তির দ্বারা তার প্রভুর অতি সুন্দর নাম, তার সুউচ্চ গুণাবলী ও ক্রিয়া-কর্মসমূহ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জ্ঞান অর্জন করতে সম্পূর্ণ অক্ষম।[1] এ জন্যই দয়াবান ও পরাক্রমশালী আল্লাহ তা‘আলার হিকমতের দাবি অনুসারে যুগে যুগে অনেক নাবী-রসূল প্রেরিত হয়েছেন। তারা সকল সৃষ্টিকে তাদের প্রভুর পরিচয় সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জানিয়ে দিয়েছেন এবং তাদের মাবুদের ইবাদতের দিকেই আহবান করেছেন। যারা নাবী-রসূলদের ডাকে সাড়া দিয়েছে, তারা তাদেরকে জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন। আর যারা তাদের দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করেছে, তাদেরকে তারা জাহান্নামের শাস্তির ভীতি প্রদর্শন করেছেন।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা তার অতি সুন্দর নাম, সুউচ্চ গুণাবলী ও কার্যাদির পরিচয় লাভ এবং তার তাওহীদ বাস্তবায়ন করাকেই নাবী-রসূলগণের দাওয়াতের চাবিকাঠি ও মূল বিষয় হিসাবে নির্ধারণ করেছেন। প্রভুর পরিচয় সম্পর্কে জানিয়ে দেয়া ও তার তাওহীদকে যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করার আহবানই ছিল শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সকল নাবী-রাসূলের রিসালাতের একমাত্র উদ্দেশ্য। এ লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের মাধ্যমেই বান্দাদের পক্ষে তাদের প্রভুর সান্নিধ্যে পৌঁছা সম্ভব।
উপরোক্ত লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করার জন্য আল্লাহ তা‘আলা নাবী-রসূলদের মাধ্যমে মানুষকে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি প্রদান করেছেন।
(১) সৃষ্টিকে আল্লাহ তা‘আলা তার সান্নিধ্য ও সন্তুষ্টি অর্জনের পথের সন্ধান দিয়েছেন। এটিই হলো আল্লাহ তা‘আলার ঐ শরী‘আত, যাতে রয়েছে তার আদেশ ও নিষেধসমূহ এবং যা বাস্তবায়নের মাধ্যমেই তারা আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌঁছাতে পারবে।
(২) যারা এ শরী‘আতের পথ অনুসরণ করার মাধ্যমে আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জন করতে সক্ষম হবে, তাদের জন্য আখেরাতে কী পরিমাণ চিরস্থায়ী ও চক্ষু শীতলকারী নিয়ামত রয়েছে, তাও বলে দিয়েছেন।
সুতরাং যারা আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জনের পথ অনুসরণ করে তারাই আল্লাহ তা‘আলার পরিচয় সম্পর্কে সর্বাধিক অবগত এবং তার সান্নিধ্য লাভকারীদের অবস্থা সম্পর্কে সর্বাধিক অবগত। এ জন্যই নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপর অবতীর্ণ অহীকে রূহ বা প্রকৃত জীবন বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। কেননা অহীর জ্ঞানার্জন করার উপরই প্রকৃত ও শান্তিময় জীবন লাভ নির্ভরশীল। সে সাথে তিনি তার নাবীর উপর অবতীর্ণ শরী‘আতকে নূর হিসাবে উল্লেখ করেছেন। কারণ সে অহী ও শরী‘আতের অনুসরণ ব্যতীত হিদায়াতের আলো অর্জন করা অসম্ভব। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿رَفِيعُ الدَّرَجَاتِ ذُو الْعَرْشِ يُلْقِي الرُّوحَ مِنْ أَمْرِهِ عَلَىٰ مَنْ يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ لِيُنْذِرَ يَوْمَ التَّلَاقِ﴾
‘‘তিনি মর্যাদা উন্নীতকারী, আরশের অধিপতি। তার বান্দাদের মধ্য থেকে যার কাছে ইচ্ছা নিজের হুকুমে রূহ নাযিল করেন যাতে সে সাক্ষাতের দিন সম্পর্কে সাবধান করে দেয়’’ (সূরা গাফের: ১৫)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿وَكَذَٰلِكَ أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ رُوحًا مِنْ أَمْرِنَا مَا كُنْتَ تَدْرِي مَا الْكِتَابُ وَلَا الْإِيمَانُ وَلَٰكِنْ جَعَلْنَاهُ نُورًا نَهْدِي بِهِ مَنْ نَشَاءُ مِنْ عِبَادِنَا وَإِنَّكَ لَتَهْدِي إِلَىٰ صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ صِرَاطِ اللَّهِ الَّذِي لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ أَلَا إِلَى اللَّهِ تَصِيرُ الْأُمُورُ﴾
‘‘এভাবেই আমি আমার নির্দেশে তোমার কাছে এক রূহ অহী করেছি। তুমি আদৌ জানতে না কিতাব এবং ঈমান কী? কিন্তু সে রূহকে আমি একটি আলো বানিয়েছি যা দিয়ে আমি আমার বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা পথ দেখিয়ে থাকি। নিশ্চয় আমি তোমাকে সোজা পথের নির্দেশনা প্রদান করেছি। সেই আল্লাহর পথের দিকে যিনি যমীন ও আসমানের সব কিছুর মালিক। সাবধান! সবকিছু আল্লাহর দিকেই ফিরে যায়’’ (সূরা শুরা: ৫২-৫৩)।
সুতরাং রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা নিয়ে এসেছেন, তাতেই রূহের প্রকৃত জীবন, শান্তি এবং তা আলোকিত হওয়াতেই প্রকৃত আলো।
এমনি নাবী-রসূলদের প্রতি প্রেরিত অহীকে আল্লাহ তা‘আলা শিফা বা আরোগ্য লাভের মাধ্যম হিসাবেও নামকরণ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿قُلْ هُوَ لِلَّذِينَ آمَنُوا هُدًى وَشِفَاءٌ﴾
বলো, এ কুরআন মুমিনদের জন্য হেদায়াত ও শিফা স্বরূপ (সূরা ফুসসিলাত: ৪৪)।
কুরআন সকলের জন্য হেদায়াত ও শিফা হলেও এর দ্বারা কেবল যেহেতু মুমিনরাই উপকৃত হয়, তাই আল্লাহ তা‘আলা তাদের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা তার রসূলকে হিদায়াত ও সত্য দীনসহ প্রেরণ করেছেন। সুতরাং তিনি যা নিয়ে এসেছেন, তা ব্যতীত অন্য কিছুতে হেদায়াত নেই।
রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে সত্য দীন নিয়ে আগমন করেছেন, সে দীনের সকল বিষয়ের প্রতি প্রত্যেক মানুষের ঈমান আনয়ন করা ওয়াজিব। আর দীনের খুটিনাটি সকল বিষয় বিস্তারিতভাবে জানা উম্মতের সকলের উপর ফরযে আইন নয়; বরং তা ফরযে কিফায়া, যা কিছু লোক আদায় করলে অন্যদের পক্ষ হতে আদায় হয়ে যায়।
সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা তার রসূলকে যা দিয়ে পাঠিয়েছেন, তা প্রচার করা, কুরআন নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করা, বোধশক্তি দিয়ে তা উপলব্ধি করা, ভালভাবে উহা বুঝা, কিতাব ও হিকমাতের জ্ঞান অর্জন করা, তার হেফাযত করা, কল্যাণের দিকে আহবান করা, সৎ কাজের আদেশ করা, অন্যায় কাজ থেকে নিষেধ করা, হিকমাত ও উত্তম উপদেশের মাধ্যমে প্রভুর পথে আহবান করা এবং উত্তম পদ্ধতিতে তর্ক-বিতর্ক করা ফরযে কেফায়ার অন্তর্ভুক্ত। এগুলো ঐসব বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত, যা আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদের উপর ওয়াজিব করেছেন। তবে এটি বিস্তারিতভাবে বুঝা এবং তার সকল শাখার জ্ঞান অর্জন করা উম্মাতের লোকদের উপর ফরযে কিফায়া হিসাবে নির্ধারণ করেছেন। যা কতিপয় লোক আদায় করলে অন্যদের পক্ষ হতে আদায় হয়ে যাবে।
আর তাদের প্রত্যেক ব্যক্তির উপর যা আবশ্যক ও উম্মতের প্রত্যেক ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট করে যেসব আদেশ করা হয়েছে, ক্ষমতা, সামর্থ, প্রয়োজন এবং জ্ঞান-বুদ্ধি অনুযায়ী বিভিন্ন জনের ক্ষেত্রে তা বিভিন্ন রকম হতে পারে। ইসলামী জ্ঞানের কিছু অংশ শ্রবণ করতে কিংবা উহার সুক্ষ্ম বিষয়গুলো বুঝতে যারা অক্ষম, তাদের উপর তা আবশ্যক নয়। কিন্তু যারা তা বুঝতে ও শিখতে সক্ষম তাদের উপরই কেবল তা আবশ্যক। ঠিক এমনি যে ব্যক্তি শরী‘আতের দলীল-প্রমাণ বিস্তারিতভাবে শুনতে পায় এবং তা বুঝতে সক্ষম হয় তার উপর তা থেকে এমন কিছু আবশ্যক হয়, যা ঐসব লোকদের উপর আবশ্যক নয়, যারা তা শুনতে পায়নি। সে সাথে মুফতী, মুহাদ্দিছ এবং বিচারক-শাসকের উপর যা আবশ্যক, অন্যদের উপর তা আবশ্যক নয়।
এখানে জেনে রাখা আবশ্যক যে, দীনের সঠিক জ্ঞান অর্জন করতে যারা ব্যর্থ হয়েছে অথবা যারা তা থেকে মূল সত্যটি জানতে অক্ষম হয়েছে রাসূলের দীনের অনুসরণের ক্ষেত্রে শৈথিল্য প্রদর্শন করা, দীন নিয়ে চিন্তা-গবেষণা পরিত্যাগ করা এবং সত্যের প্রতি নির্দেশক দলীল-প্রমাণ সংগ্রহ না করাই তাদের ব্যর্থতার প্রধান কারণ। তারা যখন আল্লাহর কিতাব থেকে বিমুখ হয়েছে, তখনই তারা পথভ্রষ্ট হয়েছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿فَإِمَّا يَأْتِيَنَّكُم مِّنِّي هُدًى فَمَنِ اتَّبَعَ هُدَايَ فَلَا يَضِلُّ وَلَا يَشْقَىٰ وَمَنْ أَعْرَضَ عَن ذِكْرِي فَإِنَّ لَهُ مَعِيشَةً ضَنكًا وَنَحْشُرُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَعْمَىٰ قَالَ رَبِّ لِمَ حَشَرْتَنِي أَعْمَى وَقَدْ كُنْتُ بَصِيرًا قَالَ كَذَٰلِكَ أَتَتْكَ آيَاتُنَا فَنَسِيتَهَا وَكَذَٰلِكَ الْيَوْمَ تُنسَىٰ﴾
‘‘আমার পক্ষ হতে তোমাদের কাছে সৎপথের নির্দেশ আসলে যে ব্যক্তি আমার সে নির্দেশ মেনে চলবে সে বিভ্রান্ত হবে না এবং দুঃখ কষ্ট পাবে না। আর যে ব্যক্তি আমার যিকির থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে তার জন্য হবে দুনিয়ায় সংকীর্ণ জীবন এবং ক্বিয়ামতের দিন আমি তাকে উঠাবো অন্ধ অবস্থায়। সে বলবে, হে আমার রব! কেন আমাকে অন্ধ অবস্থায় উঠালেন? দুনিয়ায় আমি তো ছিলাম চক্ষুষ্মান। তিনি বলবেন, এভাবেই তো আমার আয়াত তোমার কাছে এসেছিল। কিন্তু তুমি তা ভুলে গিয়েছিলে। এভাবেই আজ তোমাকেও ভুলে যাওয়া হচ্ছে’’। (সূরা ত্বহা: ১২৩-১২৬) আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন,
تَكَفَّلَ اللَّهُ لِمَنْ قَرَأَ الْقُرْآنَ وَعَمِلَ بِمَا فِيهِ، [أَنْ] لَا يَضِلَّ فِي الدُّنْيَا، وَلَا يشقى في الآخرة ثم قرأ هذه الآيات
যে ব্যক্তি কুরআন পড়বে এবং কুরআন অনুযায়ী আমল করবে, তার ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা যিম্মাদার হয়েছেন যে, সে দুনিয়াতে বিভ্রান্ত হবে না এবং আখেরাতে হতভাগ্য হবে না। অতঃপর ইবনে আববাস উপরোক্ত আয়াতগুলো পাঠ করলেন।
আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে ইমাম তিরমিযী এবং অন্যরা যে হাদীছ বর্ণনা করেছেন, তাতে রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
"إِنَّهَا سَتَكُونُ فِتَنٌ" قُلْتُ: فَمَا الْمَخْرَجُ مِنْهَا يَا رَسُولَ اللَّهِ؟ قَالَ: "كِتَابُ اللَّهِ، فِيهِ نَبَأُ مَا قَبْلَكُمْ، وَخَبَرُ مَا بَعْدَكُمْ، وَحُكْمُ مَا بَيْنَكُمْ، هُوَ الْفَصْلُ، لَيْسَ بِالْهَزْلِ، مَنْ تَرَكَهُ مِنْ جَبَّارٍ قَصَمَهُ اللَّهُ، وَمَنِ ابْتَغَى الْهُدَى فِي غَيْرِهِ أَضَلَّهُ اللَّهُ، وَهُوَ حَبْلُ اللَّهِ الْمَتِينُ، وَهُوَ الذِّكْرُ الْحَكِيمُ، وَهُوَ الصِّرَاطُ الْمُسْتَقِيمُ، وهو الذي لا تزيع بِهِ الْأَهْوَاءُ، وَلَا تَلْتَبِسُ بِهِ الْأَلْسُنُ، وَلَا تنقضي عجائبه، ولا تشبع مِنْهُ الْعُلَمَاءُ، مَنْ قَالَ بِهِ صَدَقَ، وَمَنْ عَمِلَ بِهِ أُجِرَ، وَمَنْ حَكَمَ بِهِ عَدَلَ، وَمَنْ دَعَا إِلَيْهِ هُدِيَ إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ"
অচিরেই বড় বড় অনেক ফিতনার আবির্ভাব হবে। আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ইয়া রসূলাল্লাহ! এ থেকে বাঁচার উপায় কী? তিনি বললেন, আল্লাহর কিতাবকে আকঁড়ে ধরার মাধ্যমে এ থেকে বাঁচা সম্ভব। কেননা তাতে রয়েছে তোমাদের পূর্ববর্তী এবং পরবর্তীদের খবর। ইহাই তোমাদের মধ্যে ফায়ছালাকারী এবং সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়কারী। এটি কোনো হাসি-ঠাট্টার বিষয় নয়। যে ব্যক্তি অহংকার বশতঃ এ কুরআনের উপর আমল বর্জন করবে, আল্লাহ তা‘আলা তাকে ধ্বংস করবেন। যে ব্যক্তি এর বাইরে অন্য কিছুতে হিদায়াত অন্বেষণ করবে, আল্লাহ তা‘আলা তাকে পথভ্রষ্ট করবেন। এটি আল্লাহর মজবুত রশি, প্রজ্ঞাপূর্ণ উপদেশ এবং সীরাতুল মুস্তাকীম। এটি এমন সত্য কিতাব, যার অনুসারীকে নফসের প্রবৃত্তি সত্য থেকে বিচ্যুত করতে পারে না। মুমিনদের জবান দ্বারা তা পাঠ করাতে মোটেই কষ্ট অনুভব হয় না। এর বিস্ময়কর বিষয়গুলোর পরিসমাপ্তি ঘটবে না এবং আলেমগণ এ থেকে জ্ঞান অর্জন করে পরিতৃপ্ত হবে না। যে ব্যক্তি কুরআন দ্বারা কথা বলবে, তার কথা সত্য হবে, যে কুরআন অনুযায়ী আমল করবে, সে বিনিময় পাবে, কুরআন দিয়ে যে বিচারক মানুষের মাঝে ফায়ছালা করবে, সে ন্যায় বিচার করতে সক্ষম হবে এবং যে ব্যক্তি কুরআনের দিকে আহবান করবে, সে সীরাতুল মুস্তাকীমের সন্ধান পাবে।[2] এ ছাড়াও এ বিষয়ে আরো অনেক আয়াত ও হাদীছ রয়েছে।
আল্লাহ তা‘আলা তার নাবী-রসূলদের মাধ্যমে মানব জাতির জন্য যে সত্য-সঠিক দ্বীন নির্ধারণ করেছেন, তা ব্যতীত পূর্ববর্তী ও পরবর্তীদের থেকে এমন কোনো দ্বীন তিনি কবুল করবেন না, যার দ্বারা তারা আল্লাহর ইবাদত করতে পারে।
আর রসূলগণ আল্লাহ তা‘আলাকে যেসব সুউচ্চ গুণে গুণান্বিত করেছেন, তা ব্যতীত মানুষেরা আল্লাহ তা‘আলাকে যেসব বিশেষণে বিশেষিত করে, তিনি নিজের সত্তাকে তা থেকে পবিত্র করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿سُبْحَانَ رَبِّكَ رَبِّ الْعِزَّةِ عَمَّا يَصِفُونَ وَسَلامٌ عَلَى الْمُرْسَلِينَ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ﴾
‘‘কাফের-মুশরেকরা তোমার রব সম্পর্কে যেসব কথা তৈরি করছে তা থেকে তোমার রব পবিত্র, তিনি ক্ষমতা ও মর্যাদার অধিকারী। আর সালাম আল্লাহর রসূলদের প্রতি এবং সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ রাববুল আলামীনের জন্যই’’। (সূরা সাফফাত: ১৮০-১৮২)
সুতরাং কাফেররা আল্লাহ তা‘আলা সম্পর্কে যেসব অশোভনীয় কথা বলেছে, তা থেকে তিনি নিজেকে সম্পূর্ণ পবিত্র বলে ঘোষণা করেছেন। সে সাথে রসূলদের উপরও তিনি সালাম পেশ করেছেন। কেননা রসূলগণ আল্লাহ তা‘আলার যেসব সুউচ্চ গুণাবলী বর্ণনা করেছেন, তা সকল প্রকার দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত ও পবিত্র। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তার ঐসব গুণাবলীর কারণে নিজের সত্তার প্রশংসা করেছেন, যা দ্বারা কেবল তিনি একাই বিশেষিত এবং যার কারণে তিনি পূর্ণ প্রশংসা পাওয়ার হকদার।
রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দ্বীনের যে মূলনীতির উপর ছিলেন, তারই উপর ছিলেন এ উম্মতের সর্বোত্তম ব্যক্তিগণ। তারা হলেন ছাহাবী এবং উত্তমভাবে তাদের অনুসারীগণ। তাদের একজন অন্যজনকে এরই উপদেশ দিতেন এবং উত্তরসূরীগণ পূর্বসূরীদের অনুসরণ করতেন। এর মাধ্যমে তারা সকলেই তাদের নাবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হুবহু অনুসরণ করতেন এবং তার দেখানো পথেই চলতেন। আল্লাহ তা‘আলা তার কিতাবে বলেন,
﴿قُلْ هَذِهِ سَبِيلِي أَدْعُو إِلَى اللَّهِ عَلَى بَصِيرَةٍ أَنَا وَمَنِ اتَّبَعَنِي وَسُبْحَانَ اللَّهِ وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ﴾
‘‘তুমি বলো, এটিই আমার পথ। পূর্ণ প্রজ্ঞার সাথে আমি আল্লাহর দিকে আহবান জানাই আমি এবং আমার অনুসারীরা। আল্লাহ্ পবিত্র। আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই’’। (সূরা ইউসুফ: ১০৮)
এ আয়াতে وَمَنِ اتَّبَعَنِي বাক্যটিকে যদি أدعو এর মধ্যকার أنا সর্বনামের উপর সম্পর্ক করা হয়, তাহলে এতে দলীল রয়েছে যে, নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ছাহাবীগণও ছিলেন আল্লাহর দ্বীনের দাঈ। আর যদি তাকে ضمير منفصل এর উপর অর্থাৎ أنا যমীরের উপর সম্পর্ক করা হয়, তাহলে এ কথা সুস্পষ্ট যে, রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে যে সত্য দীন নিয়ে এসেছেন, তিনি এবং তার ছাহাবীগণই ছিলেন সে সম্পর্কে অন্যদের তুলনায় অধিক প্রজ্ঞাবান। তবে উভয় অর্থই যথাযথ।
রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুস্পষ্ট করেই আল্লাহর দীনের প্রচার করেছেন এবং সত্যান্বেষীদের জন্য তার দলীল-প্রমাণগুলো সুস্পষ্ট করে বর্ণনা করেছেন। তার উম্মতের সর্বোত্তম মানুষগুলো এ সুস্পষ্ট দীনের উপর অটল থেকেই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন।
অতঃপর এমনসব অপদার্থরা আগমন করলো, যারা প্রবৃত্তির অনুসরণ করেছে এবং বহুদলে বিভক্ত হয়েছে। পরবর্তী যুগসমূহে দীনের মূলনীতিগুলোর ব্যাপারে যখন লোকেরা মতভেদ শুরু করলো তখন আল্লাহ তা‘আলা এ উম্মতের জন্য এমনসব লোক পাঠালেন, যারা সে মূলনীতিগুলোকে সংরক্ষণ করেছেন। রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
«لاَ تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِي ظاهرين عَلَى الْحَقِّ لاَ يَضُرُّهُم مَنْ خَذَلَهُمْ»
‘‘আমার উম্মাতের একটি দল সবসময় হকের উপর বিজয়ী থাকবে। যেসব লোক তাদের বিরোধীতা করবে কিংবা তাদেরকে পরিত্যাগ করবে তারা সে দলটির কোনো ক্ষতি করতে পারবে না’’।[3]
যুগে যুগে যেসব আলেম দীনের মূলনীতিগুলোর সংরক্ষণ এবং তার প্রচার ও প্রসারের পথে আত্মনিয়োগ করেছেন, তাদের মধ্যে দু’শত হিজরীর পরে জন্ম গ্রহণকারী আল্লামা ইমাম আবু জা’ফর আহমাদ ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে সালামা আল আযদী আত্ ত্বহাবী অন্যতম। তিনি ২৩৯ হিজরী সনে জন্ম গ্রহণ করেন এবং ৩২১ হিজরী সনে ৮২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। হে আল্লাহ! তোমার রহমত দ্বারা তাকে আচ্ছাদিত করো। আমীন
উম্মতের সালাফে সালেহীনগণ দীনের যেসব মূলনীতির উপর ছিলেন, ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ সে সম্পর্কে আমাদেরকে সংবাদ দিয়েছেন। ইমাম আবু হানীফা নু’মান বিন ছাবিত আল-কুফী এবং তার দু’সুযোগ্য শিষ্য আবু ইউসুফ ইয়াকুব ইবনে ইবরাহীম আল-হিময়ারী আল আনসারী ও মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান আশ-শায়বানী রহিমাহুমুল্লাহ দীনের মূলনীতিগুলোর ক্ষেত্রে যে সুদৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করতেন ও যেসব মূলনীতির মাধ্যমে তারা আল্লাহ রাববুল আলামীনের সন্তুষ্টি কামনা করতেন, ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ সেগুলো বর্ণনা করেছেন।
তবে নবুওয়াতে মুহাম্মাদীর যুগ এবং পরবর্তী যুগসমূহের মধ্যে দীর্ঘ ব্যবধানের সাথে সাথে দীনের মূলনীতিগুলোর মধ্যে বহু বিদ‘আতের অনুপ্রবেশ ঘটেছে এবং এমন বিকৃতি ঢুকে পড়েছে, যাকে এর উদ্ভাবনকারীরা তাবীল (অপব্যাখ্যা) হিসাবে নাম দিয়েছে, যাতে সাধারণ লোকেরা এগুলোকে সহজেই গ্রহণ করে। তাদের তাহরীফ (বিকৃতি) ও তাবীলের মধ্যে খুব কম সংখ্যক লোকই পার্থক্য করতে সক্ষম। কেননা কখনো কখনো শব্দকে তার বাহ্যিক অর্থ থেকে সরিয়ে অন্য এমন এক সম্ভাব্য অর্থের দিকে ফিরিয়ে নেয়াকে তাবীল বলা হয়, যে সম্ভাব্য অর্থে ঐ শব্দটি ব্যবহৃত হওয়ার সম্ভাবনা রাখে। যদিও সম্ভাব্য অর্থে শব্দটি ব্যবহৃত হওয়ার কোনো লক্ষণ ও দলীল না থাকে। বিনা কারণে ও বিনা দলীলে শব্দকে আসল অর্থ থেকে অন্য অর্থে ব্যবহার করা থেকেই দীনের মূলনীতির ক্ষেত্রে বিভ্রান্তির সূচনা হয়েছে। অতঃপর যখন তারা দীনের মূলনীতি ও আল্লাহ তা‘আলার সিফাত সংক্রান্ত আয়াতগুলোর বিকৃতি করে ব্যাখ্যা হিসাবে তার নাম দিলো, তখন তা গৃহীত হলো এবং যেসব মুসলিম তাহরীফ ও তাবীলের মধ্যে পার্থক্য করতে সক্ষম নয়, তাদের মধ্যে তার প্রসার ঘটলো।
এরপর থেকেই মুসলিমগণ দীনের মূলনীতি সংক্রান্ত আয়াতগুলোর ব্যাখ্যা করা এবং তার উপর উত্থাপিত সন্দেহগুলো দূর করার প্রয়োজন অনুভব করলো। এতে করে অনেক তর্ক-বিতর্ক ও শোরগোল হলো। বাতিলপন্থীদের সন্দেহগুলোর প্রতি মুসলিমদের কর্ণপাত করা, তর্কশাস্ত্রবিদদের নিকৃষ্ট যুক্তি-তর্কের পিছনে পড়াই ছিল এর একমাত্র কারণ। অথচ সালাফগণ এ কালাম শাস্ত্রের যথেষ্ট দোষারোপ করেছেন এবং তার প্রতি দৃষ্টি দেয়া, তা নিয়ে মশগুল হওয়া ও তার প্রতি কর্ণপাত করতে নিষেধ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলার আদেশ পালন করতে গিয়েই তারা তা করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَإِذَا رَأَيْتَ الَّذِينَ يَخُوضُونَ فِي آيَاتِنَا فَأَعْرِضْ عَنْهُمْ حَتَّىٰ يَخُوضُوا فِي حَدِيثٍ غَيْرِهِ وَإِمَّا يُنسِيَنَّكَ الشَّيْطَانُ فَلَا تَقْعُدْ بَعْدَ الذِّكْرَىٰ مَعَ الْقَوْمِ الظَّالِمِينَ﴾
‘‘তুমি যখন দেখবে, লোকেরা আমার আয়াতের মধ্যে দোষ খুঁজে বেড়াচ্ছে তখন তাদের কাছ থেকে দূরে সরে যাও, যে পর্যন্ত না তারা এ আলোচনা বাদ দিয়ে অন্য প্রসংঙ্গে লিপ্ত হয়। আর শয়তান কখনো যদি তোমাকে ভুলিয়ে দেয়, তাহলে স্মরণ হওয়ার পর এ যালেম সম্প্রদায়ের কাছে বসো না’’ (সূরা আল আনআম: ৬৮)। আয়াতের মর্মার্থ কালাম শাস্ত্রবিদদেরকেও শামিল করে।
আল্লাহর কালাম বিকৃত করা এবং তা থেকে বিচ্যুত হওয়ার একাধিক স্তর রয়েছে। কখনো তা কুফরীর স্তরে পৌঁছতে পারে, কখনো পাপাচার আবার কখনো সীমা লংঘন আবার কখনো ভুল করার কারণেও আল্লাহর কালামের তাহরীফ (বিকৃতি) ও বিচ্যুতি হয়ে যেতে পারে।
[2]. হাদীছের অর্থ সুন্দর, তবে সনদ যঈফ।
[3]. ছহীহ বুখারী ও ছহীহ মুসলিম হা/১৯২০।
আল্লাহ তা‘আলা মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মাধ্যমে নাবী-রসূলদের আগমনের পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছেন এবং তাকে আখেরী নাবী হিসাবে মনোনিত করেছেন। তার উপর অবতীর্ণ কিতাবকে পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবসমূহের সংরক্ষণকারী হিসাবে নির্ধারণ করেছেন।
আল্লাহ তা‘আলা তার সর্বশেষ নাবীর উপর কিতাব ও হিকমাত নাযিল করেছেন এবং তার দাওয়াতকে কবুল করা মানুষ ও জিন সকলের জন্য আবশ্যক করেছেন। তার দাওয়াত কিয়ামত পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকবে। এ দাওয়াতের মাধ্যমে আল্লাহর উপর মানুষের পক্ষ হতে নাবী-রসূল ও দলীল-প্রমাণ না পাঠানোর অভিযোগ পেশ করার সুযোগ নিঃশেষ হয়েছে।
আল্লাহ তা‘আলা এ উম্মতের জন্য নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাধ্যমে সবকিছুই বর্ণনা করেছেন ও সমগ্র উম্মতের জন্য দ্বীনের সমস্ত সংবাদ ও হুকুম-আহকাম পূর্ণ করেছেন।
আল্লাহ তা‘আলা তার নাবীর আনুগত্য করা তারই আনুগত্য এবং নাবীর নাফরমানীকে তারই নাফরমানী হিসাবে গণ্য করেছেন।
তিনি নিজে কসম করে বলেছেন, তারা তাদের নিজেদের পারস্পরিক বিবাদের ক্ষেত্রে তাকে একমাত্র ফায়ছালাকারী হিসাবে মেনে না নেয়া পর্যন্ত ঈমানদার হতে পারবে না।
তিনি আরো সংবাদ দিয়েছেন যে, মুনাফেকরা তাকে বাদ দিয়ে অন্যকে ফায়ছালাকারী বানাতে চায়। আর তাদেরকে যখন আল্লাহ, তার রসূল, তার কিতাব এবং রসূলের সুন্নাতের দিকে আহবান করা হয়, তখন মুনাফেকরা আল্লাহ এবং তার রসূল থেকে মুখ ফিরিয়ে পাশ কাটিয়ে যায়। তারা আরো দাবি করে যে, তাদের কার্যকলাপের পিছনে সৎ উদ্দেশ্য এবং সমন্বয় সাধনই লক্ষ্য ছিল।
অনেক তর্কশাস্ত্রবিদ, দার্শনিক এবং অন্যরা মুনাফেকদের মতোই বলে থাকে। তারা বলে, আমরা কেবল বিষয়গুলোর আসল অবস্থা উপলব্ধি করতে চাই। অর্থাৎ ভালভাবে আয়ত্ত করা ও জানার ইচ্ছা পোষণ করি। যেগুলোকে তারা আকলী বা জ্ঞানগত দলীল হিসাবে নাম দিয়েছে, যদিও সেগুলো জাহেলিয়াত ছাড়া আর কিছু নয়, সেগুলো এবং রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে যেসব দলীল এসেছে, দার্শনিক ও কালামশাস্ত্রবিদরা উভয় বিষয়ের ক্ষেত্রে বলে যে, আমরা শরী‘আত ও দর্শনের মধ্যে সমন্বয় করতে চাই।[1]
অনুরূপ অনেক বিদ‘আতী, সন্ন্যাসী ও সূফী বলে যে, আমরা আমলগুলোকে সুন্দর করতে চাই। আর শরী‘আত এবং যে বাতিলের দিকে তারা আহবান করে উভয়ের মাঝে সমন্বয় সাধন করতে চায়। এসব বাতিল বিষয়কে তারা হাকীকত (বাস্তবসম্মত) বলে দাবী করে, সেগুলো প্রকৃত পক্ষে মুর্খতা ও ভ্রষ্টতা ছাড়া আর কিছু নয়।
অনুরূপ অনেক কালামশাস্ত্রবিদ এবং তাদের দ্বারা প্রভাবিত অনেক লোক বলে থাকে আমরা কার্যাবলীকে অতি সুন্দর করতে চাই এবং শরী‘আত ও রাজনীতির মধ্যে সমন্বয় করতে চাই। এমনি তারা আরো অনেক কথাই বলে থাকে।
>সুতরাং যে ব্যক্তিই দীনের কোনো বিষয়াদিতে রাসূলের আনীত বিষয়কে বাদ দিয়ে অন্য কিছুকে ফায়ছালাকারী বানাতে চাইবে ও ধারণা করবে সেটিই উত্তম এবং মনে করবে, এতেই রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আনীত বিধান এবং তার বিরোধী বিষয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধন হবে, সে বিভ্রান্ত ও মূর্খ হিসাবে গণ্য হবে।
রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা নিয়ে এসেছেন, তা পরিপূর্ণ এবং উম্মতের জন্য তা যথেষ্ট। তাতেই রয়েছে সকল সত্য বিষয়।
রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে সত্য দ্বীন নিয়ে আগমন করেছেন, যারা নিজেদেরকে তার এ সত্য দ্বীনের অনুসারী বলে দাবি করেছে তাদের অনেকের দ্বারাই ত্রুটি-বিচ্যুতি ও ভুল-ভ্রান্তি হয়েছে। তিনি দ্বীনের যেসব মূলনীতি আনয়ন করেছেন, যেসব বিষয়কে ইবাদত হিসাবে সাব্যস্ত করেছেন এবং যেসব রাজনৈতিক নের্তৃত্বের বিষয় নিয়ে এসেছেন, তারা সেগুলোর অনেকাংশই জানতে ও বুঝতে পারেনি। অথবা তারা ধারণার বশবর্তী হয়ে ও অন্যের অন্ধ অনুসরণ করে রাসূলের শরীয়াতের মধ্যে এমন কিছু বৃদ্ধি করেছে, যা শরীয়তের অন্তর্ভুক্ত নয় এবং তা থেকে এমন অনেক কিছু বের করে দিয়েছে, যা তার শরীয়তের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সুতরাং এসব লোকের অজ্ঞতা, গোমরাহী ও শৈথিল্যের কারণেই এবং ঐসব লোকের সীমালংঘন, মূর্খতা ও নিফাকের কারণে বহু নিফাকীর উৎপত্তি হয়েছে এবং নাবী-রসূলদের রেসালাতের অনেকাংশই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
সুতরাং রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে সত্য দ্বীন নিয়ে এসেছেন, তার পরিপূর্ণ অনুসন্ধান করা উচিত, তাতে সুক্ষ্ম দৃষ্টি দেয়া আবশ্যক এবং তা অর্জনে প্রচুর পরিশ্রম করা আবশ্যক। যাতে করে তা অবগত হওয়া যায়, তাতে বিশ্বাস পোষণ করা যায় এবং প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে সে অনুযায়ী আমলও করা যায়। এর মাধ্যমে রাসূলের উপর অবতীর্ণ কিতাবের যথাযথ তেলাওয়াত করা সম্ভব হবে এবং তার কোন কিছুর প্রতিই অবহেলা করা হবে না।
রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা নিয়ে এসেছেন, তার কিছু অংশ জানতে অথবা তার প্রতি আমল করতে যদি কেউ অপারগ হয়, তাহলে সে অপারগ ব্যক্তি অন্যকে তার প্রতি আমল করতে নিষেধ করবে না; বরং তার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, অপারগতার কারণে নিজে আমল না করতে পারলে তাকে দোষারোপ করা হবে না। তবে অন্যরা সে অনুযায়ী আমল করার কারণে তার খুশি হওয়া উচিত। সে সাথে সে নিজে তা পালন করার আকাঙ্খা করবে। এমনটি যেন না হয় যে, সে রাসূলের দ্বীনের কিছু অংশে বিশ্বাস করবে এবং তার কিয়দাংশ বর্জন করবে। বরং সম্পূর্ণ কিতাবের উপর বিশ্বাস করবে এবং তার সাথে এমন কোনো বর্ণনা অথবা মতামত সংযোজন করা হতে দূরে থাকবে, যা তার অন্তর্ভুক্ত নয়।
অথবা আক্বীদা ও আমলের ক্ষেত্রে সে এমন কিছুর অনুসরণ করা থেকে দূরে থাকবে, যা আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে আগত নয়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿وَلَا تَلْبِسُوا الْحَقَّ بِالْبَاطِلِ وَتَكْتُمُوا الْحَقَّ وَأَنتُمْ تَعْلَمُونَ﴾
তোমরা মিথ্যার সাথে সত্যকে মিলিয়ে সত্যকে সন্দেহযুক্ত করো না এবং জেনে বুঝে সত্যকে গোপন করো না। (সূরা আল বাকারা: ৪২)
এ ছিল সর্বপ্রথম ইসলাম কবুলকারী ছাহাবীদের তরীকা বা পথ। এটিই কিয়ামত দিবস পর্যন্ত উত্তমভাবে ছাহাবীদের অনুসরণকারীগণের পদ্ধতি হওয়া চাই। প্রথম শ্রেণীর তাবেঈগণই ছাহাবীদের অনুসরণ করার ক্ষেত্রে অগ্রণী ছিলেন। অতঃপর যারা তাবেঈদের পরে আগমন করেছেন। এদের মধ্যেই রয়েছেন দ্বীনের ঐসব সম্মানিত ইমামগণ, যারা মধ্যমপন্থী উম্মতের নিকট ইমাম হিসাবে স্বীকৃত।
ইমাম আবু ইউসুফ রহিমাহুল্লাহ থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি মুতাযেলা ইমাম বিশর আল-মুরাইসীকে একদা বলেছিলেন, কালামশাস্ত্র সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করাই হলো প্রকৃত মূর্খতা এবং তা সম্পর্কে অজ্ঞতাই হলো প্রকৃত ইলম। কোনো মানুষ যখন কালামশাস্ত্রে সর্বোচ্চ পান্ডিত্য অর্জন করবে, সে নাস্তিকে পরিণত হবে অথবা তার উপর নাস্তিক্যের অভিযোগ উত্থাপিত হবে। এখানে কালামশাস্ত্র সম্পর্কে অজ্ঞতা অর্থ হলো তা বিশুদ্ধ না হওয়ার আক্বীদাহ রাখা। এটিই উপকারী ইলম। অথবা তা দ্বারা উদ্দেশ্য হলো কালামশাস্ত্র থেকে সম্পূর্ণরূপে মুখ ফিরিয়ে নেয়া অথবা তার প্রতি দৃষ্টি না দেয়া। এতে করেই মানুষের জ্ঞান ও বোধশক্তি সংরক্ষিত হবে। এ দৃষ্টিকোন থেকে ইলমে কালাম সম্পর্কে অজ্ঞতাকেই ইলম হিসাবে সাব্যস্ত করা হয়েছে। আল্লাহই সর্বাধিক অবগত রয়েছেন।
ইমাম আবু ইউসুফ রহিমাহুল্লাহ থেকে আরো বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন, যে ব্যক্তি কালামশাস্ত্র সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করবে সে নাস্তিকে পরিণত হবে, যে ব্যক্তি মাটিকে স্বর্ণ বানিয়ে ধনী হওয়ার চেষ্টা করবে, সে হবে সর্বহারা এবং যে ব্যক্তি বিরল ও বিস্ময়কর ঘটনা অনুসন্ধান করতে যাবে, সে মিথ্যুকে পরিণত হবে।
ইমাম শাফেঈ রহিমাহুল্লাহ বলেছেন, কালামশাস্ত্রবিদদের ব্যাপারে আমার মত হলো তাদেরকে খেজুর গাছের ডাল ও জুতা দিয়ে পেটানো হবে, মহল্লায় মহল্লায় তাদেরকে ঘুরানো হবে এবং বলা হবে, এ হলো ঐসব লোকদের শাস্তি যারা আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাত পরিহার করে কালামশাস্ত্রের প্রতি ঝুকে পড়ে।
ইমাম শাফেঈ রহিমাহুল্লাহ কবিতা আকারে আরো বলেন,
كُلُّ الْعُلُومِ سِوَى الْقُرْآنِ مَشْغَلَةٌ ... إِلَّا الْحَدِيثَ وَإِلَّا الْفِقْهَ فِي الدِّينِ
الْعِلْمُ مَا كَانَ فِيهِ قَالَ حَدَّثَنَا ... وَمَا سِوَى ذَاكَ وَسْوَاسُ الشَّيَاطِينِ
কুরআন, হাদীছ এবং দ্বীনের গভীর জ্ঞান ব্যতীত যতো ইলম রয়েছে, তা সবই মূল্যহীন। রাসূলের হাদীছেই রয়েছে প্রকৃত ইলম। এ ছাড়া যতো ইলম রয়েছে, তার সবই শয়তানের কুমন্ত্রনা ছাড়া অন্য কিছু নয়।
আলেমগণ ফতোয়ায় বলেছেন, রাষ্ট্রপ্রধান বা রাষ্ট্রের আওকাফ মন্ত্রনালয়ের দায়িত্বশীল যদি শহরের আলেমদের জন্য ধন-সম্পদ বন্টন করার ফরমান জারী করে তাহলে উক্ত শহরে বসবাসকারী কালামশাস্ত্রবিদরা তা থেকে কিছুই পাবে না।[1]
এমনিভাবে কোনো আলেম যদি অসীয়ত করে, তার কিতাবগুলো থেকে দ্বীনি কিতাবগুলো যেন ওয়াক্ফ করে দেয়া হয়, তাহলে সালাফগণের ফতোয়া রয়েছে যে, তার মধ্যকার কালামশাস্ত্রীয় কিতাবগুলো বিক্রি করে দিতে হবে। অনুরূপ কথা যাহেরীয়া ফতোয়াতেও উল্লেখিত হয়েছে।
সুতরাং ব্যাপারটি যেহেতু এরকম, তাই রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণ করা ব্যতীত দ্বীনের মূলনীতিগুলোর জ্ঞান কিভাবে অর্জন করা যেতে পারে! কবি কতই না সুন্দর বলেছেন,
أَيُّهَا الْمُغْتَدِي لِيَطْلُبَ عِلْمًا ... كُلُّ عِلْمٍ عَبْدٌ لِعِلْمِ الرَّسُولِ
تَطْلُبُ الْفَرْعَ كَيْ تُصَحِّحَ أَصْلًا ... كَيْفَ أَغْفَلْتَ عِلْمَ أَصْلِ الْأُصُولِ
ওহে জ্ঞানার্জনের পথে প্রত্যুষে গমণকারী! জেনে রাখো! সমস্ত ইলম রাসূলের ইলমের অনুগত। তুমি দ্বীনের মাসায়েল সম্পর্কে ইলম অর্জন করবে, যাতে তার মূলনীতিকে ঠিক করতে পারো? সকল মূলনীতির মূল সম্পর্কে তুমি উদাসীন হলে কিভাবে?
নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এমন বাণী প্রদান করা হয়েছে, যাতে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সমস্ত কালামের সুন্দর সূচনা ও সর্বোত্তম পরিসমাপ্তি ঘটেছে। সে সাথে তাকে দেয়া হয়েছে এমন সংক্ষিপ্ত কালাম, যার শব্দ কম, কিন্তু তার ব্যাখ্যা অত্যন্ত ব্যাপক, পরিপূর্ণ, সংক্ষিপ্ত এবং উত্তম পদ্ধতিতে পূর্ববতী ও পরবর্তীদের সকল প্রকার ইলমসহ নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রেরণ করা হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীকালে বিদ‘আতীরা যখনই একটি বিদআত তৈরী করেছে, আলেমগণ বিস্তারিতভাবে তার জবাব দিয়েছেন। এ জন্যই পরবর্তী যুগের আলেমদের বক্তব্য হয়েছে অনেক দীর্ঘ, কিন্তু তাতে বরকত হয়েছে কম। কিন্তু পূর্ববর্তীদের কথা ছিল তার বিপরীত। তাদের কথা ছিল অল্প, কিন্তু তাতে বরকত হয়েছে প্রচুর।
কালামশাস্ত্রবিদদের বিভ্রান্ত ও মূর্খদের কথা এর সম্পূর্ণ বিপরীত। তারা বলে থাকে সালাফদের পথ ও পদ্ধতি অধিক নিরাপদ। আর আমাদের পদ্ধতি হচ্ছে অধিক শক্তিশালী এবং অধিক প্রজ্ঞা ভিত্তিক!! পরবর্তীদের মধ্য হতে যারা নিজেদেরকে ফকীহ বলে দাবি করে, তাদের কথাও এর বিপরীত। তারা বলে থাকে ছাহাবীগণ যেহেতু জিহাদ এবং ইসলামী সাম্রাজ্যের সীমানা পাহারা দেয়ার কাজে ব্যস্ত ছিলেন, তাই তারা কুরআন ও হাদীছ থেকে ফিকহী মাসায়েল নির্গত করা, তার মূলনীতি ও হুকুম-আহকাম সংরক্ষণ করার সুযোগ পাননি। আর পরবর্তীরা যেহেতু সে কাজের সুযোগ পেয়েছেন, তাই তারা ফিকহী মাসায়েলের ক্ষেত্রে ছাহাবীদের তুলনায় অধিক জ্ঞানী হতে পেরেছেন![2]
সালাফদের মর্যাদার পরিমাণ, তাদের ইলমের গভীরতা, গুরুত্বহীন কাজের প্রতি তাদের আগ্রহের স্বল্পতা এবং তাদের পরিপূর্ণ দূরদর্শিতা ও বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে এ লোকেরা অবগত নয়। আল্লাহর কসম! পূর্ববর্তীদের তুলনায় পরবর্তীদের বৈশিষ্ট্য শুধু এখানেই যে, তারা কেবল গুরুত্বহীন কাজে শ্রম ব্যয় করেছে এবং এমনসব দিকে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, যার মূলনীতিগুলোর প্রতি যত্মবান হওয়া, নিয়ম-কানুন সংরক্ষণ করা এবং তার বন্ধনকে মজবুত করার কাজেই সালাফগণ ব্যস্ত ছিলেন। প্রত্যেক বিষয়ের সুউচ্চ চূড়ায় পৌঁছে যাওয়াই ছিল সালাফদের একমাত্র প্রচেষ্টা। সুতরাং পরবর্তীরা ব্যস্ত হয়েছে একটি বিষয় নিয়ে এবং পূর্ববর্তীরা ব্যস্ত ছিলেন অন্য একটি বিষয় নিয়ে। আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক জিনিসের জন্য একটি পরিমাণ নির্ধারণ করেছেন।
আল্লামা ইমাম ইবনে আবীল ইয রহিমাহুল্লাহ বলেন, আমার পূর্বে অনেকেই আল-আকীদাতুত্ ত্বহাবীয়াহ এর ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু দেখেছি যে, তাদের কতিপয় ব্যাখ্যাকারী এর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কালামশাস্ত্রবিদদের নিন্দনীয় কথার প্রতি কর্ণপাত করেছেন, তাদের থেকে শিক্ষা নিয়েছেন এবং তাদের পরিভাষাগুলো ব্যবহার করেছে। সালাফগণ জাওহার, জিসিম, আরায এবং সঠিক অর্থে অনুরূপ অন্যান্য নতুন পরিভাষা ব্যবহার করে কথা বলা অপছন্দ করতেন। যেমন সঠিক ইলমকে ব্যাখ্যা করার জন্য বিভিন্ন পরিভাষা ব্যবহার করা হয়। ঠিক তেমনি সত্যের উপর ঐ শব্দগুলোর নির্দেশনা প্রদান এবং বাতিলপন্থীদের সাথে তর্ক-বিতর্ক করার সময় ঐ শব্দগুলো ব্যবহার করতেন না। কিন্তু এ শব্দগুলো মিথ্যা, বানোয়াট ও সত্যের বিপরীত বিষয় সাব্যস্ত করার জন্য ব্যবহার করাকেই অপছন্দ করেছেন। তাদের শব্দগুলো আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাহয় ব্যবহার না হওয়াও তাদের অপছন্দের অন্যতম কারণ। এ জন্যই আপনি সাধারণ মুমিনগণ, বিশেষ করে আলেমদের নিকট যে সুদৃঢ় ইয়াকীন, ঈমান ও মারেফত উপলব্ধি করবেন, কালামশাস্ত্র বিদদের নিকট তা খুঁজে পাবেন না।
কালামশাস্ত্র বিদরা যেসব পরিভাষা ও ভূমিকা পেশ করেছে, তাতে হক-বাতিলের সংমিশ্রণের কারণে অনেক তর্ক-বিতর্ক হয়েছে, অন্যায় ঝগড়া-বিবাদ হয়েছে এবং অহেতুক সমালোচনা ও অর্থহীন কথা-বার্তা ছড়িয়ে পড়েছে। এর ফলে তারা নির্ভেজাল শরীয়াত ও সুস্পষ্ট বোধশক্তির বিপরীত এমন সব কথার উৎপত্তি করেছে, যা এ সংক্ষিপ্ত কিতাবে বর্ণনা করা সম্ভব নয়।
ইমাম ত্বহাবীর উক্তি, فَمَنْ رَامَ عِلْمَ مَا حُظِرَ عَنْهُ عِلْمُه...الخ এ অংশের ব্যাখ্যা করার সময় উপরোক্ত বিষয়ে আরো বিস্তারিত আলোচনা করা হবে, ইনশা-আল্লাহ। সালাফদের পথ অনুসরণ করে এবং তাদের বক্তব্য দ্বারাই আমি এ কিতাবটি ব্যাখ্যা করতে চাই। এর মাধ্যমে আমি তাদের পথের পথিক এবং তাদের কাতারে শামিল হতে চাই। যদিও আমাকে তাদের সাথে যোগদান করার আহবান করা হয়নি। আমি ঐসব লোকদের মধ্যে শামিল হতে চাই এবং ঐসব লোকদের সাথে হাশরের দিন উপস্থিত হতে চাই, যাদের সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿وَمَنْ يُطِعِ اللَّهَ وَالرَّسُولَ فَأُولَئِكَ مَعَ الَّذِينَ أَنْعَمَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ مِنَ النَّبِيِّينَ وَالصِّدِّيقِينَ وَالشُّهَدَاءِ وَالصَّالِحِينَ وَحَسُنَ أُولَئِكَ رَفِيقًا﴾
আর যারা আল্লাহ্ ও রাসূলের আনুগত্য করে, তারা ঐ সমস্ত লোকের সাথে থাকবে, যাদের উপর আল্লাহ্ অনুগ্রহ করেছেন; তারা হলেন নাবীগণ, সত্যবাদীগণ, শহীদগণ এবং সৎ কর্মশীলগণ। কতই না উত্তম বন্ধু তারা (সূরা আন নিসা, ৪:৬৯)।
এসব লোকদের দলে থাকার সুবাদে আমি পরকালীন সৌভাগ্য অর্জন করতে চাই। মানুষের মনে সংক্ষিপ্ত বিষয়ের প্রতিই আগ্রহ বেশি, এটা আমার দৃষ্টিগোচর হলো, তাই এর ব্যাখ্যা লম্বা না করে সংক্ষিপ্ত করাকেই আমি প্রাধান্য দিলাম।
﴿ وَمَا تَوْفِيقِي إِلَّا بِاللَّهِ عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ وَإِلَيْهِ أُنِيبُ﴾
‘‘যা কিছু আমি করতে চাই তা সবই আল্লাহর তাওফীকের উপর নির্ভর করে। তার উপর আমি ভরসা করেছি এবং সব ব্যাপারে তার দিকেই প্রত্যাবর্তন করছি’’ (সূরা হুদ ১১:৮৮)। আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট এবং তিনি সর্বোত্তম কার্য সম্পাদনকারী।
[হুজ্জাতুল ইসলাম আল্লামা আবু জাফর ওয়ার্রাক আত্-ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ মিসরে অবস্থানকালে বলেছেন:
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ
‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্য, যিনি সৃষ্টিকুলের রব’।
هَذَا ذِكْرُ بَيَانِ عَقِيدَةِ أَهْلِ السُّنَّةِ وَالْجَمَاعَةِ عَلَى مَذْهَبِ فُقَهَاءِ الْمِلَّةِ: أَبِي حَنِيفَةَ النُّعْمَانِ بْنِ ثَابِتٍ الْكُوفِيِّ وَأَبِي يُوسُفَ يَعْقُوبَ بْنِ إِبْرَاهِيمَ الْأَنْصَارِيِّ، وَأَبِي عَبْدِ اللَّهِ مُحَمَّدِ بْنِ الْحَسَنِ الشَّيْبَانِيِّ رِضْوَانُ اللَّهِ عَلَيْهِمْ أَجْمَعِينَ وَمَا يَعْتَقِدُونَ مِنْ أُصُولِ الدِّينِ وَيَدِينُونَ بِهِ رَبَّ الْعَالَمِينَ
ফুকাহায়ে মিল্লাত আবূ হানীফা নুমান বিন সাবেত আল কুফী, আবু ইউসুফ ইয়াকুব ইবনে ইবরাহীম আল-আনসারী এবং আবু আব্দুল্লাহ ইবনুল হাসান শায়বানীর মাযহাব অনুসারে এ পুস্তিকায় আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আক্বীদাহসমূহ বর্ণনা করা হয়েছে (আল্লাহ তা‘আলা তাদের সকলের উপর সন্তুষ্ট থাকুন)। দ্বীনের মূলনীতিসমূহের ক্ষেত্রে তারা যে সুদৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করতেন ও যেসব মূলনীতির মাধ্যমে তারা আল্লাহ রাববুল আলামীনের সন্তুষ্টি কামনা করতেন, তা এ কিতাবে উল্লেখ করা হয়েছে।]
>[2]. কোনো কোনো ফিকহী মাযহাবের মুকাল্লিদগণ বলে থাকেন, ছাহাবীদের মধ্যে অনেকেই মুহাদ্দিছ ছিলেন ঠিকই; কিন্তু তারা ফকীহ ছিলেন না। তাদের মাযহাবের যেসব কথা হাদীছের বিপরীত হয়, ঐ হাদীছের রাবী (ছাহাবী) সম্পর্কে তারা বলে যে, তিনি ফকীহ ছিলেন না! তাই এ মাস‘আলায় তার থেকে বর্ণিত হাদীছ গ্রহণযোগ্য নয়; তাদের ইমাম যেহেতু ফকীহ ছিলেন, তাই হাদীছের বিপরীত হলেও ইমামের কথাই আমলযোগ্য। উদাহরণ স্বরূপ তারা আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর ব্যাপারে বলে থাকে যে, তিনি ফকীহ ছিলেন না!! তাই তারা তাদের কতিপয় মাস‘আলা আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীছের বিপরীত হলেও মাযহাবের কথাকেই প্রাধান্য দেয়। মাযহাবী গোঁড়ামির কারণেই তারা এমনটি করে থাকে বলে আমরা মনে করি।
ছাহাবীদের প্রতি পরবর্তীদের এরূপ ধারণা করা ঠিক নয়। ছাহাবীরাই ছিলেন পরবর্তীদের তুলনায় জ্ঞানে ও আমলে সর্বাধিক পরিপূর্ণ। কুরআন ও হাদীছে এর যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছাহাবীদের ইলম ও আমলের প্রশংসা করেছেন এবং তাদের পথে চলার উপদেশ দিয়েছেন। সুতরাং পরবর্তীতে যত আলেম ও ফকীহ আগমন করবেন, তাদের কেউই ইলম, ফিকহ এবং অন্যান্য গুণাবলীতে ছাহাবীদের ধারেকাছেও পৌঁছতে পারবে না। আল্লাহ তা‘আলাই সর্বাধিক অবগত।