بِسْمِ الله الرَّحْمَنِ الرَّحِيْم
الْحَمْدُ لله [نَحْمَدُهُ ، وَ] نَسْتَعِينُهُ وَنَسْتَغْفِرُهُ، وَنَعُوذُ بِاللَّهِ مِنْ شُرُورِ أَنْفُسِنَا وَمِنْ سَيِّئَاتِ أَعْمَالِنَا، مَنْ يَهْدِهِ اللَّهُ فَلَا مُضِلَّ لَهُ، وَمَنْ يُضْلِلِ فَلَا هَادِيَ لَهُ. وَأَشْهَدُ أن لا إله إلا الله وحده لا شَرِيكَ لَهُ، وَأَشْهَدُ أَنَّ سَيِّدَنَا مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ، صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَعَلَى آلِهِ وَصَحْبِهِ وَسَلَّمَ تَسْلِيمًا كَثِيرًا.
সমস্ত ইলমের মধ্যে দীনের মূলনীতি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করাই সর্বোত্তম ইলম। কারণ যে বিষয় সম্পর্কে ইলম অর্জন করা হয়, সে বিষয়ের মর্যাদা অনুপাতেই সে সম্পর্কে অর্জিত ইলমের মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ অন্যান্য বিষয়ের তুলনায় দীনের মূলনীতির গুরুত্ব ও মর্যাদা যেহেতু সর্বাধিক, তাই সে সম্পর্কে অর্জিত ইলমও সর্বোত্তম। দীনের শাখা-মাস‘আলা সম্পর্কিত ফিক্বহ এর জ্ঞানার্জনের তুলনায় তার মূলনীতি সম্পর্কে ইলম অর্জন করাই হচ্ছে ফিকহুল আকবার। এ জন্যই ইমাম আবু হানীফা রহিমাহুল্লাহ দীনের মূলনীতিগুলো একত্র করে যে কিতাব লিখেছেন, তার নাম দিয়েছেন الفقه الأكبر আল-ফিকহুল আকবার।
মানুষের যত প্রয়োজন রয়েছে, তার মধ্যে সঠিক আক্বীদা গ্রহণের প্রয়োজনই সর্বাধিক। তাই তাদের প্রয়োজনাদির উপর দীনের মৌলিক বিষয়গুলো সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করাকেই প্রাধান্য দেয়া আবশ্যক। কেননা মানুষের অন্তর ততোক্ষণ পর্যন্ত জীবিত হয় না এবং তা পরিপূর্ণ প্রশান্তি ও স্বস্তি লাভ করে না, যতক্ষণ না সে তার মাবুদের পরিচয় লাভ করে এবং তার স্রষ্টার সুন্দরতম নামসমূহ, সুউচ্চ গুণাবলী ও তার সকল কর্মসহ চিনতে পারে। সে সাথে উপরোক্ত বিষয়গুলো বান্দার অন্তরে সর্বাধিক প্রিয় হওয়া জরুরী। আর বান্দা এ-প্রাণ উজাড় করে কেবল ঐসব আমল করার প্রচেষ্টা চালাবে, যা সকল সৃষ্টির পরিবর্তে তাকে তার রবের সান্নিধ্যে পৌঁছিয়ে দিবে।
মানুষ তার বিবেক ও বোধশক্তির দ্বারা তার প্রভুর অতি সুন্দর নাম, তার সুউচ্চ গুণাবলী ও ক্রিয়া-কর্মসমূহ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জ্ঞান অর্জন করতে সম্পূর্ণ অক্ষম।[1] এ জন্যই দয়াবান ও পরাক্রমশালী আল্লাহ তা‘আলার হিকমতের দাবি অনুসারে যুগে যুগে অনেক নাবী-রসূল প্রেরিত হয়েছেন। তারা সকল সৃষ্টিকে তাদের প্রভুর পরিচয় সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জানিয়ে দিয়েছেন এবং তাদের মাবুদের ইবাদতের দিকেই আহবান করেছেন। যারা নাবী-রসূলদের ডাকে সাড়া দিয়েছে, তারা তাদেরকে জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন। আর যারা তাদের দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করেছে, তাদেরকে তারা জাহান্নামের শাস্তির ভীতি প্রদর্শন করেছেন।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা তার অতি সুন্দর নাম, সুউচ্চ গুণাবলী ও কার্যাদির পরিচয় লাভ এবং তার তাওহীদ বাস্তবায়ন করাকেই নাবী-রসূলগণের দাওয়াতের চাবিকাঠি ও মূল বিষয় হিসাবে নির্ধারণ করেছেন। প্রভুর পরিচয় সম্পর্কে জানিয়ে দেয়া ও তার তাওহীদকে যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করার আহবানই ছিল শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সকল নাবী-রাসূলের রিসালাতের একমাত্র উদ্দেশ্য। এ লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের মাধ্যমেই বান্দাদের পক্ষে তাদের প্রভুর সান্নিধ্যে পৌঁছা সম্ভব।
উপরোক্ত লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করার জন্য আল্লাহ তা‘আলা নাবী-রসূলদের মাধ্যমে মানুষকে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি প্রদান করেছেন।
(১) সৃষ্টিকে আল্লাহ তা‘আলা তার সান্নিধ্য ও সন্তুষ্টি অর্জনের পথের সন্ধান দিয়েছেন। এটিই হলো আল্লাহ তা‘আলার ঐ শরী‘আত, যাতে রয়েছে তার আদেশ ও নিষেধসমূহ এবং যা বাস্তবায়নের মাধ্যমেই তারা আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌঁছাতে পারবে।
(২) যারা এ শরী‘আতের পথ অনুসরণ করার মাধ্যমে আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জন করতে সক্ষম হবে, তাদের জন্য আখেরাতে কী পরিমাণ চিরস্থায়ী ও চক্ষু শীতলকারী নিয়ামত রয়েছে, তাও বলে দিয়েছেন।
সুতরাং যারা আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জনের পথ অনুসরণ করে তারাই আল্লাহ তা‘আলার পরিচয় সম্পর্কে সর্বাধিক অবগত এবং তার সান্নিধ্য লাভকারীদের অবস্থা সম্পর্কে সর্বাধিক অবগত। এ জন্যই নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপর অবতীর্ণ অহীকে রূহ বা প্রকৃত জীবন বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। কেননা অহীর জ্ঞানার্জন করার উপরই প্রকৃত ও শান্তিময় জীবন লাভ নির্ভরশীল। সে সাথে তিনি তার নাবীর উপর অবতীর্ণ শরী‘আতকে নূর হিসাবে উল্লেখ করেছেন। কারণ সে অহী ও শরী‘আতের অনুসরণ ব্যতীত হিদায়াতের আলো অর্জন করা অসম্ভব। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿رَفِيعُ الدَّرَجَاتِ ذُو الْعَرْشِ يُلْقِي الرُّوحَ مِنْ أَمْرِهِ عَلَىٰ مَنْ يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ لِيُنْذِرَ يَوْمَ التَّلَاقِ﴾
‘‘তিনি মর্যাদা উন্নীতকারী, আরশের অধিপতি। তার বান্দাদের মধ্য থেকে যার কাছে ইচ্ছা নিজের হুকুমে রূহ নাযিল করেন যাতে সে সাক্ষাতের দিন সম্পর্কে সাবধান করে দেয়’’ (সূরা গাফের: ১৫)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿وَكَذَٰلِكَ أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ رُوحًا مِنْ أَمْرِنَا مَا كُنْتَ تَدْرِي مَا الْكِتَابُ وَلَا الْإِيمَانُ وَلَٰكِنْ جَعَلْنَاهُ نُورًا نَهْدِي بِهِ مَنْ نَشَاءُ مِنْ عِبَادِنَا وَإِنَّكَ لَتَهْدِي إِلَىٰ صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ صِرَاطِ اللَّهِ الَّذِي لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ أَلَا إِلَى اللَّهِ تَصِيرُ الْأُمُورُ﴾
‘‘এভাবেই আমি আমার নির্দেশে তোমার কাছে এক রূহ অহী করেছি। তুমি আদৌ জানতে না কিতাব এবং ঈমান কী? কিন্তু সে রূহকে আমি একটি আলো বানিয়েছি যা দিয়ে আমি আমার বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা পথ দেখিয়ে থাকি। নিশ্চয় আমি তোমাকে সোজা পথের নির্দেশনা প্রদান করেছি। সেই আল্লাহর পথের দিকে যিনি যমীন ও আসমানের সব কিছুর মালিক। সাবধান! সবকিছু আল্লাহর দিকেই ফিরে যায়’’ (সূরা শুরা: ৫২-৫৩)।
সুতরাং রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা নিয়ে এসেছেন, তাতেই রূহের প্রকৃত জীবন, শান্তি এবং তা আলোকিত হওয়াতেই প্রকৃত আলো।
এমনি নাবী-রসূলদের প্রতি প্রেরিত অহীকে আল্লাহ তা‘আলা শিফা বা আরোগ্য লাভের মাধ্যম হিসাবেও নামকরণ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿قُلْ هُوَ لِلَّذِينَ آمَنُوا هُدًى وَشِفَاءٌ﴾
বলো, এ কুরআন মুমিনদের জন্য হেদায়াত ও শিফা স্বরূপ (সূরা ফুসসিলাত: ৪৪)।
কুরআন সকলের জন্য হেদায়াত ও শিফা হলেও এর দ্বারা কেবল যেহেতু মুমিনরাই উপকৃত হয়, তাই আল্লাহ তা‘আলা তাদের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা তার রসূলকে হিদায়াত ও সত্য দীনসহ প্রেরণ করেছেন। সুতরাং তিনি যা নিয়ে এসেছেন, তা ব্যতীত অন্য কিছুতে হেদায়াত নেই।
রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে সত্য দীন নিয়ে আগমন করেছেন, সে দীনের সকল বিষয়ের প্রতি প্রত্যেক মানুষের ঈমান আনয়ন করা ওয়াজিব। আর দীনের খুটিনাটি সকল বিষয় বিস্তারিতভাবে জানা উম্মতের সকলের উপর ফরযে আইন নয়; বরং তা ফরযে কিফায়া, যা কিছু লোক আদায় করলে অন্যদের পক্ষ হতে আদায় হয়ে যায়।
সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা তার রসূলকে যা দিয়ে পাঠিয়েছেন, তা প্রচার করা, কুরআন নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করা, বোধশক্তি দিয়ে তা উপলব্ধি করা, ভালভাবে উহা বুঝা, কিতাব ও হিকমাতের জ্ঞান অর্জন করা, তার হেফাযত করা, কল্যাণের দিকে আহবান করা, সৎ কাজের আদেশ করা, অন্যায় কাজ থেকে নিষেধ করা, হিকমাত ও উত্তম উপদেশের মাধ্যমে প্রভুর পথে আহবান করা এবং উত্তম পদ্ধতিতে তর্ক-বিতর্ক করা ফরযে কেফায়ার অন্তর্ভুক্ত। এগুলো ঐসব বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত, যা আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদের উপর ওয়াজিব করেছেন। তবে এটি বিস্তারিতভাবে বুঝা এবং তার সকল শাখার জ্ঞান অর্জন করা উম্মাতের লোকদের উপর ফরযে কিফায়া হিসাবে নির্ধারণ করেছেন। যা কতিপয় লোক আদায় করলে অন্যদের পক্ষ হতে আদায় হয়ে যাবে।
আর তাদের প্রত্যেক ব্যক্তির উপর যা আবশ্যক ও উম্মতের প্রত্যেক ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট করে যেসব আদেশ করা হয়েছে, ক্ষমতা, সামর্থ, প্রয়োজন এবং জ্ঞান-বুদ্ধি অনুযায়ী বিভিন্ন জনের ক্ষেত্রে তা বিভিন্ন রকম হতে পারে। ইসলামী জ্ঞানের কিছু অংশ শ্রবণ করতে কিংবা উহার সুক্ষ্ম বিষয়গুলো বুঝতে যারা অক্ষম, তাদের উপর তা আবশ্যক নয়। কিন্তু যারা তা বুঝতে ও শিখতে সক্ষম তাদের উপরই কেবল তা আবশ্যক। ঠিক এমনি যে ব্যক্তি শরী‘আতের দলীল-প্রমাণ বিস্তারিতভাবে শুনতে পায় এবং তা বুঝতে সক্ষম হয় তার উপর তা থেকে এমন কিছু আবশ্যক হয়, যা ঐসব লোকদের উপর আবশ্যক নয়, যারা তা শুনতে পায়নি। সে সাথে মুফতী, মুহাদ্দিছ এবং বিচারক-শাসকের উপর যা আবশ্যক, অন্যদের উপর তা আবশ্যক নয়।
এখানে জেনে রাখা আবশ্যক যে, দীনের সঠিক জ্ঞান অর্জন করতে যারা ব্যর্থ হয়েছে অথবা যারা তা থেকে মূল সত্যটি জানতে অক্ষম হয়েছে রাসূলের দীনের অনুসরণের ক্ষেত্রে শৈথিল্য প্রদর্শন করা, দীন নিয়ে চিন্তা-গবেষণা পরিত্যাগ করা এবং সত্যের প্রতি নির্দেশক দলীল-প্রমাণ সংগ্রহ না করাই তাদের ব্যর্থতার প্রধান কারণ। তারা যখন আল্লাহর কিতাব থেকে বিমুখ হয়েছে, তখনই তারা পথভ্রষ্ট হয়েছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿فَإِمَّا يَأْتِيَنَّكُم مِّنِّي هُدًى فَمَنِ اتَّبَعَ هُدَايَ فَلَا يَضِلُّ وَلَا يَشْقَىٰ وَمَنْ أَعْرَضَ عَن ذِكْرِي فَإِنَّ لَهُ مَعِيشَةً ضَنكًا وَنَحْشُرُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَعْمَىٰ قَالَ رَبِّ لِمَ حَشَرْتَنِي أَعْمَى وَقَدْ كُنْتُ بَصِيرًا قَالَ كَذَٰلِكَ أَتَتْكَ آيَاتُنَا فَنَسِيتَهَا وَكَذَٰلِكَ الْيَوْمَ تُنسَىٰ﴾
‘‘আমার পক্ষ হতে তোমাদের কাছে সৎপথের নির্দেশ আসলে যে ব্যক্তি আমার সে নির্দেশ মেনে চলবে সে বিভ্রান্ত হবে না এবং দুঃখ কষ্ট পাবে না। আর যে ব্যক্তি আমার যিকির থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে তার জন্য হবে দুনিয়ায় সংকীর্ণ জীবন এবং ক্বিয়ামতের দিন আমি তাকে উঠাবো অন্ধ অবস্থায়। সে বলবে, হে আমার রব! কেন আমাকে অন্ধ অবস্থায় উঠালেন? দুনিয়ায় আমি তো ছিলাম চক্ষুষ্মান। তিনি বলবেন, এভাবেই তো আমার আয়াত তোমার কাছে এসেছিল। কিন্তু তুমি তা ভুলে গিয়েছিলে। এভাবেই আজ তোমাকেও ভুলে যাওয়া হচ্ছে’’। (সূরা ত্বহা: ১২৩-১২৬) আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন,
تَكَفَّلَ اللَّهُ لِمَنْ قَرَأَ الْقُرْآنَ وَعَمِلَ بِمَا فِيهِ، [أَنْ] لَا يَضِلَّ فِي الدُّنْيَا، وَلَا يشقى في الآخرة ثم قرأ هذه الآيات
যে ব্যক্তি কুরআন পড়বে এবং কুরআন অনুযায়ী আমল করবে, তার ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা যিম্মাদার হয়েছেন যে, সে দুনিয়াতে বিভ্রান্ত হবে না এবং আখেরাতে হতভাগ্য হবে না। অতঃপর ইবনে আববাস উপরোক্ত আয়াতগুলো পাঠ করলেন।
আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে ইমাম তিরমিযী এবং অন্যরা যে হাদীছ বর্ণনা করেছেন, তাতে রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
"إِنَّهَا سَتَكُونُ فِتَنٌ" قُلْتُ: فَمَا الْمَخْرَجُ مِنْهَا يَا رَسُولَ اللَّهِ؟ قَالَ: "كِتَابُ اللَّهِ، فِيهِ نَبَأُ مَا قَبْلَكُمْ، وَخَبَرُ مَا بَعْدَكُمْ، وَحُكْمُ مَا بَيْنَكُمْ، هُوَ الْفَصْلُ، لَيْسَ بِالْهَزْلِ، مَنْ تَرَكَهُ مِنْ جَبَّارٍ قَصَمَهُ اللَّهُ، وَمَنِ ابْتَغَى الْهُدَى فِي غَيْرِهِ أَضَلَّهُ اللَّهُ، وَهُوَ حَبْلُ اللَّهِ الْمَتِينُ، وَهُوَ الذِّكْرُ الْحَكِيمُ، وَهُوَ الصِّرَاطُ الْمُسْتَقِيمُ، وهو الذي لا تزيع بِهِ الْأَهْوَاءُ، وَلَا تَلْتَبِسُ بِهِ الْأَلْسُنُ، وَلَا تنقضي عجائبه، ولا تشبع مِنْهُ الْعُلَمَاءُ، مَنْ قَالَ بِهِ صَدَقَ، وَمَنْ عَمِلَ بِهِ أُجِرَ، وَمَنْ حَكَمَ بِهِ عَدَلَ، وَمَنْ دَعَا إِلَيْهِ هُدِيَ إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ"
অচিরেই বড় বড় অনেক ফিতনার আবির্ভাব হবে। আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ইয়া রসূলাল্লাহ! এ থেকে বাঁচার উপায় কী? তিনি বললেন, আল্লাহর কিতাবকে আকঁড়ে ধরার মাধ্যমে এ থেকে বাঁচা সম্ভব। কেননা তাতে রয়েছে তোমাদের পূর্ববর্তী এবং পরবর্তীদের খবর। ইহাই তোমাদের মধ্যে ফায়ছালাকারী এবং সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়কারী। এটি কোনো হাসি-ঠাট্টার বিষয় নয়। যে ব্যক্তি অহংকার বশতঃ এ কুরআনের উপর আমল বর্জন করবে, আল্লাহ তা‘আলা তাকে ধ্বংস করবেন। যে ব্যক্তি এর বাইরে অন্য কিছুতে হিদায়াত অন্বেষণ করবে, আল্লাহ তা‘আলা তাকে পথভ্রষ্ট করবেন। এটি আল্লাহর মজবুত রশি, প্রজ্ঞাপূর্ণ উপদেশ এবং সীরাতুল মুস্তাকীম। এটি এমন সত্য কিতাব, যার অনুসারীকে নফসের প্রবৃত্তি সত্য থেকে বিচ্যুত করতে পারে না। মুমিনদের জবান দ্বারা তা পাঠ করাতে মোটেই কষ্ট অনুভব হয় না। এর বিস্ময়কর বিষয়গুলোর পরিসমাপ্তি ঘটবে না এবং আলেমগণ এ থেকে জ্ঞান অর্জন করে পরিতৃপ্ত হবে না। যে ব্যক্তি কুরআন দ্বারা কথা বলবে, তার কথা সত্য হবে, যে কুরআন অনুযায়ী আমল করবে, সে বিনিময় পাবে, কুরআন দিয়ে যে বিচারক মানুষের মাঝে ফায়ছালা করবে, সে ন্যায় বিচার করতে সক্ষম হবে এবং যে ব্যক্তি কুরআনের দিকে আহবান করবে, সে সীরাতুল মুস্তাকীমের সন্ধান পাবে।[2] এ ছাড়াও এ বিষয়ে আরো অনেক আয়াত ও হাদীছ রয়েছে।
আল্লাহ তা‘আলা তার নাবী-রসূলদের মাধ্যমে মানব জাতির জন্য যে সত্য-সঠিক দ্বীন নির্ধারণ করেছেন, তা ব্যতীত পূর্ববর্তী ও পরবর্তীদের থেকে এমন কোনো দ্বীন তিনি কবুল করবেন না, যার দ্বারা তারা আল্লাহর ইবাদত করতে পারে।
আর রসূলগণ আল্লাহ তা‘আলাকে যেসব সুউচ্চ গুণে গুণান্বিত করেছেন, তা ব্যতীত মানুষেরা আল্লাহ তা‘আলাকে যেসব বিশেষণে বিশেষিত করে, তিনি নিজের সত্তাকে তা থেকে পবিত্র করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿سُبْحَانَ رَبِّكَ رَبِّ الْعِزَّةِ عَمَّا يَصِفُونَ وَسَلامٌ عَلَى الْمُرْسَلِينَ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ﴾
‘‘কাফের-মুশরেকরা তোমার রব সম্পর্কে যেসব কথা তৈরি করছে তা থেকে তোমার রব পবিত্র, তিনি ক্ষমতা ও মর্যাদার অধিকারী। আর সালাম আল্লাহর রসূলদের প্রতি এবং সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ রাববুল আলামীনের জন্যই’’। (সূরা সাফফাত: ১৮০-১৮২)
সুতরাং কাফেররা আল্লাহ তা‘আলা সম্পর্কে যেসব অশোভনীয় কথা বলেছে, তা থেকে তিনি নিজেকে সম্পূর্ণ পবিত্র বলে ঘোষণা করেছেন। সে সাথে রসূলদের উপরও তিনি সালাম পেশ করেছেন। কেননা রসূলগণ আল্লাহ তা‘আলার যেসব সুউচ্চ গুণাবলী বর্ণনা করেছেন, তা সকল প্রকার দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত ও পবিত্র। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তার ঐসব গুণাবলীর কারণে নিজের সত্তার প্রশংসা করেছেন, যা দ্বারা কেবল তিনি একাই বিশেষিত এবং যার কারণে তিনি পূর্ণ প্রশংসা পাওয়ার হকদার।
রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দ্বীনের যে মূলনীতির উপর ছিলেন, তারই উপর ছিলেন এ উম্মতের সর্বোত্তম ব্যক্তিগণ। তারা হলেন ছাহাবী এবং উত্তমভাবে তাদের অনুসারীগণ। তাদের একজন অন্যজনকে এরই উপদেশ দিতেন এবং উত্তরসূরীগণ পূর্বসূরীদের অনুসরণ করতেন। এর মাধ্যমে তারা সকলেই তাদের নাবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হুবহু অনুসরণ করতেন এবং তার দেখানো পথেই চলতেন। আল্লাহ তা‘আলা তার কিতাবে বলেন,
﴿قُلْ هَذِهِ سَبِيلِي أَدْعُو إِلَى اللَّهِ عَلَى بَصِيرَةٍ أَنَا وَمَنِ اتَّبَعَنِي وَسُبْحَانَ اللَّهِ وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ﴾
‘‘তুমি বলো, এটিই আমার পথ। পূর্ণ প্রজ্ঞার সাথে আমি আল্লাহর দিকে আহবান জানাই আমি এবং আমার অনুসারীরা। আল্লাহ্ পবিত্র। আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই’’। (সূরা ইউসুফ: ১০৮)
এ আয়াতে وَمَنِ اتَّبَعَنِي বাক্যটিকে যদি أدعو এর মধ্যকার أنا সর্বনামের উপর সম্পর্ক করা হয়, তাহলে এতে দলীল রয়েছে যে, নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ছাহাবীগণও ছিলেন আল্লাহর দ্বীনের দাঈ। আর যদি তাকে ضمير منفصل এর উপর অর্থাৎ أنا যমীরের উপর সম্পর্ক করা হয়, তাহলে এ কথা সুস্পষ্ট যে, রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে যে সত্য দীন নিয়ে এসেছেন, তিনি এবং তার ছাহাবীগণই ছিলেন সে সম্পর্কে অন্যদের তুলনায় অধিক প্রজ্ঞাবান। তবে উভয় অর্থই যথাযথ।
রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুস্পষ্ট করেই আল্লাহর দীনের প্রচার করেছেন এবং সত্যান্বেষীদের জন্য তার দলীল-প্রমাণগুলো সুস্পষ্ট করে বর্ণনা করেছেন। তার উম্মতের সর্বোত্তম মানুষগুলো এ সুস্পষ্ট দীনের উপর অটল থেকেই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন।
অতঃপর এমনসব অপদার্থরা আগমন করলো, যারা প্রবৃত্তির অনুসরণ করেছে এবং বহুদলে বিভক্ত হয়েছে। পরবর্তী যুগসমূহে দীনের মূলনীতিগুলোর ব্যাপারে যখন লোকেরা মতভেদ শুরু করলো তখন আল্লাহ তা‘আলা এ উম্মতের জন্য এমনসব লোক পাঠালেন, যারা সে মূলনীতিগুলোকে সংরক্ষণ করেছেন। রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
«لاَ تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِي ظاهرين عَلَى الْحَقِّ لاَ يَضُرُّهُم مَنْ خَذَلَهُمْ»
‘‘আমার উম্মাতের একটি দল সবসময় হকের উপর বিজয়ী থাকবে। যেসব লোক তাদের বিরোধীতা করবে কিংবা তাদেরকে পরিত্যাগ করবে তারা সে দলটির কোনো ক্ষতি করতে পারবে না’’।[3]
যুগে যুগে যেসব আলেম দীনের মূলনীতিগুলোর সংরক্ষণ এবং তার প্রচার ও প্রসারের পথে আত্মনিয়োগ করেছেন, তাদের মধ্যে দু’শত হিজরীর পরে জন্ম গ্রহণকারী আল্লামা ইমাম আবু জা’ফর আহমাদ ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে সালামা আল আযদী আত্ ত্বহাবী অন্যতম। তিনি ২৩৯ হিজরী সনে জন্ম গ্রহণ করেন এবং ৩২১ হিজরী সনে ৮২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। হে আল্লাহ! তোমার রহমত দ্বারা তাকে আচ্ছাদিত করো। আমীন
উম্মতের সালাফে সালেহীনগণ দীনের যেসব মূলনীতির উপর ছিলেন, ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ সে সম্পর্কে আমাদেরকে সংবাদ দিয়েছেন। ইমাম আবু হানীফা নু’মান বিন ছাবিত আল-কুফী এবং তার দু’সুযোগ্য শিষ্য আবু ইউসুফ ইয়াকুব ইবনে ইবরাহীম আল-হিময়ারী আল আনসারী ও মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান আশ-শায়বানী রহিমাহুমুল্লাহ দীনের মূলনীতিগুলোর ক্ষেত্রে যে সুদৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করতেন ও যেসব মূলনীতির মাধ্যমে তারা আল্লাহ রাববুল আলামীনের সন্তুষ্টি কামনা করতেন, ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ সেগুলো বর্ণনা করেছেন।
তবে নবুওয়াতে মুহাম্মাদীর যুগ এবং পরবর্তী যুগসমূহের মধ্যে দীর্ঘ ব্যবধানের সাথে সাথে দীনের মূলনীতিগুলোর মধ্যে বহু বিদ‘আতের অনুপ্রবেশ ঘটেছে এবং এমন বিকৃতি ঢুকে পড়েছে, যাকে এর উদ্ভাবনকারীরা তাবীল (অপব্যাখ্যা) হিসাবে নাম দিয়েছে, যাতে সাধারণ লোকেরা এগুলোকে সহজেই গ্রহণ করে। তাদের তাহরীফ (বিকৃতি) ও তাবীলের মধ্যে খুব কম সংখ্যক লোকই পার্থক্য করতে সক্ষম। কেননা কখনো কখনো শব্দকে তার বাহ্যিক অর্থ থেকে সরিয়ে অন্য এমন এক সম্ভাব্য অর্থের দিকে ফিরিয়ে নেয়াকে তাবীল বলা হয়, যে সম্ভাব্য অর্থে ঐ শব্দটি ব্যবহৃত হওয়ার সম্ভাবনা রাখে। যদিও সম্ভাব্য অর্থে শব্দটি ব্যবহৃত হওয়ার কোনো লক্ষণ ও দলীল না থাকে। বিনা কারণে ও বিনা দলীলে শব্দকে আসল অর্থ থেকে অন্য অর্থে ব্যবহার করা থেকেই দীনের মূলনীতির ক্ষেত্রে বিভ্রান্তির সূচনা হয়েছে। অতঃপর যখন তারা দীনের মূলনীতি ও আল্লাহ তা‘আলার সিফাত সংক্রান্ত আয়াতগুলোর বিকৃতি করে ব্যাখ্যা হিসাবে তার নাম দিলো, তখন তা গৃহীত হলো এবং যেসব মুসলিম তাহরীফ ও তাবীলের মধ্যে পার্থক্য করতে সক্ষম নয়, তাদের মধ্যে তার প্রসার ঘটলো।
এরপর থেকেই মুসলিমগণ দীনের মূলনীতি সংক্রান্ত আয়াতগুলোর ব্যাখ্যা করা এবং তার উপর উত্থাপিত সন্দেহগুলো দূর করার প্রয়োজন অনুভব করলো। এতে করে অনেক তর্ক-বিতর্ক ও শোরগোল হলো। বাতিলপন্থীদের সন্দেহগুলোর প্রতি মুসলিমদের কর্ণপাত করা, তর্কশাস্ত্রবিদদের নিকৃষ্ট যুক্তি-তর্কের পিছনে পড়াই ছিল এর একমাত্র কারণ। অথচ সালাফগণ এ কালাম শাস্ত্রের যথেষ্ট দোষারোপ করেছেন এবং তার প্রতি দৃষ্টি দেয়া, তা নিয়ে মশগুল হওয়া ও তার প্রতি কর্ণপাত করতে নিষেধ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলার আদেশ পালন করতে গিয়েই তারা তা করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَإِذَا رَأَيْتَ الَّذِينَ يَخُوضُونَ فِي آيَاتِنَا فَأَعْرِضْ عَنْهُمْ حَتَّىٰ يَخُوضُوا فِي حَدِيثٍ غَيْرِهِ وَإِمَّا يُنسِيَنَّكَ الشَّيْطَانُ فَلَا تَقْعُدْ بَعْدَ الذِّكْرَىٰ مَعَ الْقَوْمِ الظَّالِمِينَ﴾
‘‘তুমি যখন দেখবে, লোকেরা আমার আয়াতের মধ্যে দোষ খুঁজে বেড়াচ্ছে তখন তাদের কাছ থেকে দূরে সরে যাও, যে পর্যন্ত না তারা এ আলোচনা বাদ দিয়ে অন্য প্রসংঙ্গে লিপ্ত হয়। আর শয়তান কখনো যদি তোমাকে ভুলিয়ে দেয়, তাহলে স্মরণ হওয়ার পর এ যালেম সম্প্রদায়ের কাছে বসো না’’ (সূরা আল আনআম: ৬৮)। আয়াতের মর্মার্থ কালাম শাস্ত্রবিদদেরকেও শামিল করে।
আল্লাহর কালাম বিকৃত করা এবং তা থেকে বিচ্যুত হওয়ার একাধিক স্তর রয়েছে। কখনো তা কুফরীর স্তরে পৌঁছতে পারে, কখনো পাপাচার আবার কখনো সীমা লংঘন আবার কখনো ভুল করার কারণেও আল্লাহর কালামের তাহরীফ (বিকৃতি) ও বিচ্যুতি হয়ে যেতে পারে।
[2]. হাদীছের অর্থ সুন্দর, তবে সনদ যঈফ।
[3]. ছহীহ বুখারী ও ছহীহ মুসলিম হা/১৯২০।