لَا تَحْسَبُوهُ شَرًّا لَّكُم بَلْ هُوَ خَيْرٌ لَّكُمْ
“এটাকে তোমাদের জন্য ক্ষতিকর মনে করিও না, বরং এটা তোমাদের জন্য কল্যাণকর।” (২৪-সূরা আন নূরঃ আয়াত-১১)
এমন অনেক লোক আছেন যাদেরকে তাদের মাহাত্ম্যের কারণে বর্তমানে স্মরণ করা হয়। এসব মনীষীদেরকে তাদের চলার পথে বহু বাধা অতিক্রম করতে হয়েছে। তাদের অধ্যবসায় বা ধৈর্য ছিল নাছোর বান্দার মতো। তাদের কোনও এক বিষয়ে দুর্বলতা ছিল যা অন্য গুণ দ্বারা পূরণ হওয়ার দরকার ছিল (এবং তা হয়েছিলও বটে)। আতা, সাঈদ ইবনে যুবাইর, কাতাদা, বুখারী, তিরমিয়ী ও আবু হানীফা (রহঃ) এদের মতো ইসলামের অনেক বড় বড় আলেমগণ প্রকৃতপক্ষে আযাদকৃত গোলাম ছিলেন।
অনেক ইসলামী পণ্ডিত যাদের জ্ঞানের বিশালতা মহাসাগরসমূহের মতো ছিল তারা অন্ধ ছিলেন। তাদের মধ্যে থেকে মাত্র কয়েকজনের নাম উল্লেখ করছি। যেমন- ইবনে আব্বাস (রাঃ), কাতাদা, ইবনে উম্মে মাকতুম (রাঃ), আল আ’মাশ ও ইয়াজীদ ইবনে হারূন।
আধুনিক আলেমদের মধ্যে শাইখ মুহাম্মদ ইবনে ইব্রাহীম আলে শাইখ, শাইখ আব্দুল্লাহ ইবনে হুমাইদ এবং শাইখ আব্দুল্লাহ ইবনে বায এরা সবাই অন্ধ। অনেক বড় বড় আলেমগণ কোন না কোনভাবে প্রতিবন্ধী ছিলেন, কেউ কেউ ছিলেন অন্ধ, কেউ কেউ ছিলেন বধির, আবার অনেকে ছিলেন অঙ্গহীন। এসব প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও তারা পরবর্তী প্রজন্মকে প্রভাবিত করেছিলেন এবং তারা মানব জাতির জন্য অবদান রাখতে পেরেছিলেন।
“তিনি তোমাদেরকে আলো দান করবেন যার সাহায্যে তোমরা (সোজা পথে) হাটবে।” (৫৭-সূরা আল হাদীদঃ আয়াত-২৮)
একটি নামকরা বা বিখ্যাত ইউনিভার্সিটির ডিপ্লোমা ডিগ্রিই সব কিছুই নয়। কোন ইউনিভার্সিটি থেকে ডিগ্রি অর্জন করতে পারেননি বলে হতাশ হবেন না। এমনকি কোনরূপ ডিগ্রি অর্জন না করেই আপনি প্রতিষ্ঠিত হতে পারবেন এবং মানব জাতির জন্য বিশাল অবদান রাখতে পারবেন। অনেক বিখ্যাত ও প্রসিদ্ধ লোক আছেন যাদের কোন ডিগ্রি নেই। তারা তাদের জীবন চলার পথ করে নিয়েছেন এবং লৌহ দৃঢ় মনোবল ও শক্ত প্রতিজ্ঞার মাধ্যমে তারা দুর্লঙ্ঘনীয় বাধা-বিপত্তি লঙ্ঘন বা অতিক্রম করেছেন।
বর্তমান কালের আলেমদের কথা বলতে গেলে বলতে হয় যে, ডিগ্রি ছাড়া অনেক অনেক বিশিষ্ট ও বিখ্যাত ব্যক্তি রয়েছেন। শাইখ ইবনে বায, মালিক ইবনে নাবি, আল আক্কাদ, আত তানত্বাভী, আবি যাহরাহ, আবুল আ'লা মওদূদী, আন্নাদাভী এদের সবারই প্রসঙ্গ উদাহরণস্বরূপ মনে পড়ে; এরা ছাড়াও আরো অনেকে এমন রয়েছেন।
অপর পক্ষে ইসলামী বিশ্বে হাজার হাজার PHD ডিগ্রিধারী পণ্ডিত রয়েছেন যারা অজ্ঞাতই রয়েছেন এবং সমাজে যাদের কোন প্রভাব ও নেই।
“(হে মুহাম্মদ!) আপনি কি তাদের কাউকে খুঁজে পান বা তাদের ফিসফিসানি শুনতে পান?” (১৯-সূরা মারইয়ামঃ আয়াত-৯৮)
যে ব্যক্তি যে কোন পরিস্থিতিতে সন্তুষ্ট থাকে আপনি যদি তার মতো হয়ে থাকেন তবে আপনার এক বিশাল ধন-ভাণ্ডার আছে।
একটি সহীহ হাদীসে বর্ণিত আছে যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
وَارْضَ بِما قَسَمَ الله لَكَ تَكُنْ أَغْنَى النّاسِ
“আল্লাহ তোমার ভাগে যা বণ্টন করে দিয়েছেন তাতে সন্তুষ্ট থাক, তাহলেই তুমি সবচেয়ে ধনী মানুষ হবে।”
আপনার পরিবার, আয়-রোজগার ও কাজের প্রতি সন্তুষ্ট থাকুন। আপনি যদি এসবের প্রতি সন্তুষ্ট থাকেন তবে আপনি সুখ-শান্তি পাবেন। অন্য একটি সহীহ হাদীসে বর্ণিত আছে যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
الْغِنَى غِنَى النَّفْسِ
“আত্মার ধনাঢ্যতাই (প্রকৃত) ধনাঢ্যতা”
“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, হে আল্লাহ্! তার অন্তরে তার সম্পদ বা ধনাঢ্যতা সৃষ্টি করে দিন।”
এক লোক বলেছেন যে, একবার তিনি এয়ারপোর্টে এক টেক্সীতে উঠে ড্রাইভারকে বললেন যে তাকে শহরে নিয়ে যেতে। তিনি বলেন- “আমি লক্ষ্য করলাম যে, ড্রাইভারটি সুখী ও খোশ মেজাজী ছিল। সে সর্বদা আল্লাহর প্রশংসা করছিল, তার শোকরিয়া আদায় করছিল ও তার জিকির করছিল। আমি তাকে তার পরিবার সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন যে, তাকে দু পরিবারের খোরাক যোগাতে হয়। অথচ তার মাসিক বেতন হলো ৮০০ (আটশত) রিয়ালের মতো যা এক নগণ্য অঙ্ক । তিনি ও তার পরিবারকে একটি ভাঙা দালানে বাস করতে হয়। তবুও তার মনে শান্তি ছিল। কেননা, আল্লাহ তার জন্য যা বরাদ্দ করেছেন তার জন্য তিনি কৃতজ্ঞ।”
আমি এক ধনকুবেরকে চিনতাম যার শত শত মিলিয়ন রিয়াল ছিল ও অনেকগুলো প্রাসাদ ছিল । তিনি তার আত্মীয়তার সম্পর্কে শোচনীয় ছিলেন। সর্বদা রাগে টগবগ করতেন ও হতাশায় বুদ হয়ে থাকতেন। তিনি তার পরিবার হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে (দূরে কোথাও) মারা যান। আল্লাহ তাকে যা দিয়েছিলেন তাতে তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না বিধায় তিনি এসব দুর্ভোগ পোহাতে ছিলেন।
“অতপর সে আশা করে যে আমি তাকে আরো দিই। কক্ষনো নয়; নিশ্চয়ই সে আয়াতসমূহের উদ্ধত বিরুদ্ধাচারী বা বিরোধিতাকারী।” (৭৪-সূরা আল মুদদাছছিরঃ আয়াত-১৫, ১৬)
শত শত বছর আগে আরবের মানুষ মরুভূমিতে নিরালায় শান্তি খুঁজে পেত। শান্তি খুঁজে পেত মরু ভূমিতে ও মানবীয় কাজ কারবার থেকে বহুদূরে। একজন (আরব) কবি বলেছেন-
عَوى الذِئبُ فَاِستَأنَستُ بِالذِئبِ إِذا عَوى
وَصَوَّتَ إِنسانٌ فَكِدتُ أَطيرُ
“নেকড়ে বাঘ ডাকে আর আমার সে ডাক ভালো লাগে, কিন্তু মানুষ আওয়ায করে, সে আওয়ায শুনে (ঘৃণায়) আমি পালাবার উপক্রম করি।”
তৎকালীন পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস সুফিয়ান সাওরী (রহঃ) বলেছেন- “আমার মনে চায় কোন এক অজ্ঞাত উপত্যকায় থাকি যেন কেউ আমাকে চিনতে না পারে।”
একটি হাদীসে বর্ণিত আছে যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- “অচিরেই মুসলমানের উত্তম সম্পদ হবে ছাগল-ভেড়া যা নিয়ে সে ফেতনার ভয়ে তার দ্বীন (ধর্ম) রক্ষাকল্পে বৃষ্টি বহুল এলাকায় ও পাহাড়ের চূড়ায় চূড়ায় পালিয়ে বেড়াবে”। মুসলমানদের নিজেদের মাঝে ফেতনা ফাসাদের সময় একজন মুসলমানের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ প্রস্তাব (কাজ) হলো তাদের থেকে দূরে থাকা। যখন উমর (রাঃ)-কে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়েছিল তখন ইবনে উমর (রাঃ), উসামা ইবনে যায়েদ (রাঃ) ও মুহাম্মদ ইবনে মুসলিমাহ আসন্ন ফিতনা থেকে দূরে ছিলেন।
আমি এমন কিছু লোককে চিনি যারা অভাব, দুর্দশা ও হতাশাগ্রস্ত। তাদের প্রত্যেকের পতনের কারণ হলো তারা আল্লাহ থেকে অনেক দূরে। আপনি দেখবেন যে, তাদের একজন ধনী, সুখী ও সুস্থ। কিন্তু পরে সে তার প্রভুর আনুগত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল। সে সালাত আদায় করতে অবহেলা করতে শুরু করল ও পরে সে বড় বড় পাপ কাজ করতে লাগল। অতএব সর্বশক্তিমান আল্লাহ তার স্বাস্থ্য ও সম্পদ ছিনিয়ে নিলেন এবং তার বদলে দিলেন সংকট, অভাব, দুশ্চিন্তা ও দুর্ভাবনা। সে দুর্দশা থেকে দুর্দশায় পড়ল ও নিম্নপর্যায় থেকে আরো নিম্নপর্যায়ে চলে গেল।
“আর যে ব্যক্তিই আমার জিকির থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তার জন্য রয়েছে সংকটময় জীবন।” (২০-সূরা ত্বাহাঃ আয়াত-১২৪)
“তা এ কারণে যে, আল্লাহ কোন জাতিকে যে নেয়ামত দান করেছেন তা ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি পরিবর্তন করবেন না যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন করে। (৮-সূরা আনফালঃ আয়াত-৫৩)
وَمَا أَصَابَكُم مِّن مُّصِيبَةٍ فَبِمَا كَسَبَتْ أَيْدِيكُمْ وَيَعْفُو عَن كَثِيرٍ
“এবং তোমাদের উপর যে সব বিপদ আসে তা তোমাদের নিজ হাতে কৃতকর্মের ফলেই আসে এবং তিনি অনেক কিছুই ক্ষমা করে দেন।” (৪২-সূরা আশ শুরাঃ আয়াত-৩০)
“আর তারা যদি সত্য পথে প্রতিষ্ঠিত থাকতো তবে আমি প্রচুর বৃষ্টি দান করে তাদের সমৃদ্ধ করতাম।” (৭২-সূরা আল জ্বীনঃ আয়াত-১৬)
আমার যদি যাদু করার ক্ষমতা থাকতো তবে আমি আপনার সমস্যা ও দুঃখ দূর করে দিতাম। যা হোক আমার সে ক্ষমতা না থাকার কারণে আপনার জন্য এমন একটি চিকিৎসা সংক্রান্ত প্রেশক্রিপশন দেয়াই আমার জন্য যথেষ্ট হবে যে প্রেসক্রিপশান মুসলিম আলেমগণ দিয়েছেন। তা হলো কোন শরীক সাব্যস্ত না করে আল্লাহর ইবাদত করা, আপনার রিযিকের প্রতি সন্তুষ্ট থাকা, সংযমী থাকা ও এ দুনিয়ার জন্য আপনার আশা আকাঙ্ক্ষাকে কমানো।
বিখ্যাত আমেরিকান মনোবিজ্ঞানী উইলিয়াম জেমসের নিম্নোক্ত কথাগুলো আমার মনোযোগ আকর্ষণ করে-
“আমরা মানব জাতি আমাদের যা নেই তার চিন্তায় বিভোর হয়ে থাকি এবং আমাদের যা আছে তার জন্য আমরা আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই না। আমরা সর্বদা আমাদের জীবনের দুঃখজনক দিক নিয়ে ভাবি কিন্তু আমরা আমাদের জীবনের আলোকিত দিকটির দিকে তাকিয়ে দেখি না। আমাদের জীবনে আমরা যা হারিয়েছি তার জন্য আমরা অনুতাপ করি কিন্তু আমাদের জীবনে যা আছে তা নিয়ে আমরা সুখী নই।”
“তোমরা যদি (আমার) শুকরিয়া আদায় কর তবে আমি অবশ্যই তোমাদেরকে আরো অধিক (নিয়ামত) দান করব।” (১৪-সূরা ইবরাহীমঃ আয়াত-৭)
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দোয়া করেছেন-
أَعُوذُ بِكَ مِنْ نَفْسٍ لاَ تَشْبَعُ
“এবং আমি আল্লাহর নিকট এমন আত্মা থেকে পানাহ চাই যা তৃপ্ত হয় না।”
যখন কারো প্রধান চিন্তা হয় পরকাল তখন আল্লাহ তার সব কিছু ভালো করে দেন এবং তার অন্তরে ধনাঢ্যতা দান করেন এবং দুনিয়া অপদস্থ হয়ে তার নিকট আগমন করে। আর যার প্রধান চিন্তা হয় দুনিয়া আল্লাহ তার কাজকর্মকে এলোমেলো করে দেন এবং তার চোখের সামনে অভাবকে প্রকট করে দেন। আর তার ভাগ্যে যা লিখিত আছে তা ছাড়া দুনিয়া থেকে অতিরিক্ত কিছু তার নিকট আসবে না।
আপনি যদি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করেন, “কে আসমানসমূহ ও পৃথিবীকে সৃষ্টি করেছে এবং সূর্য ও চন্দ্রকে বশীভূত করেছে? তারা অবশ্যই উত্তর দিবে, ‘আল্লাহ’ তবে তারা কোথায় ফিরে যাচ্ছে?” (২৯-সূরা আল আনকাবূতঃ আয়াত-৬১)