يَسْأَلُهُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ كُلَّ يَوْمٍ هُوَ فِي شَأْنٍ
“আকাশসমূহ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবই তার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে। প্রতি মুহুর্তে তিনি কাজে রত।” (৫৫-সূরা আর রাহমান: আয়াত-২৯)
(যেমন কাউকে সম্মান দান করা, কাউকে অপমানিত করা, নবসৃষ্টির মাধ্যমে কাউকে জীবন দান করা, কাউকেবা মৃত্যু দান করা ইত্যাদি কাজে রত)।
যখন বিক্ষুব্ধ ঝঞা বায়ুতে সমুদ্র উত্তাল-তরঙ্গায়িত থাকে, তখন নৌকার আরোহীগণ আর্তনাদ করে বলে, “হে আল্লাহ!”
যখন মরুভূমিতে উট চালক ও কাফেলা পথ হারিয়ে ফেলে তখন তারা আর্তচিৎকার করে বলে, “হে আল্লাহ!"
যখন বিপর্যয় ও দুর্যোগ দেখা দেয় তখন দুর্দশাগ্রস্তরা বলে উঠে, “হে আল্লাহ!"
দরজা দিয়ে যখন কেউ প্রবেশ করতে চায় আর তার সামনেই দরজা বন্ধ করে দেয়া হয় এবং অভাবীদের সামনে যখন বাধার প্রাচীর নির্মাণ করা হয় তখন তারা চিৎকার দিয়ে বলে, “হে আল্লাহ!"
যখন সকল পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়, সকল আশা ভঙ্গ হয়ে যায় এবং পথ সংকীর্ণ হয়ে যায় তখন ডাক পড়ে, “হে আল্লাহ!"
বিশাল, বিস্তীর্ণ ও প্রশস্ত হওয়া সত্ত্বেও পৃথিবী যখন আপনার কাছে সংকীর্ণ মনে হয়, নিজেকে সংকুচিত ভাবতে পরিস্থিতি বাধ্য করে তখন আপনি ডাক দিয়ে বলুন, “হে আল্লাহ!"
সকল ভালো কথা, একান্ত অনুনয়-বিনয়, নিরপরাধীর আঁখিজল এবং বিপদগ্রস্তের সাহায্য প্রার্থনা-সবই আল্লাহর দরবারে পৌছে। অভাব-অনটন এবং বিপদাপদের সময় দু’হাত ও দু’চোখ তার দিকেই প্রসারিত হয়। জিহ্বা তার নাম সুমধুর কণ্ঠে জপে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'য়ালা কতই না উত্তম ও উৎকৃষ্ট! কতই না মহান যখন আমরা তাকে স্মরণ করি তখন হৃদয় প্রশান্তি লাভ করে, আত্মা স্থিরতা লাভ করে, স্নায়ু বিশ্রাম নেয় আর বোধশক্তি জেগে উঠে।
“আল্লাহ নাম হলো সুন্দরতম নাম, বিশুদ্ধতম বর্ণ-সংযোজন এবং সর্বাধিক মূল্যবান শব্দ।
هَلْ تَعْلَمُ لَهُ سَمِيًّا
“তুমি কি এমন কিছু জান বা চেন যা তার অনুরূপ।” (সূরা-১৯ মারইয়াম: আয়াত-৬৫)
لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ
তার মতো কিছু নেই, আর তিনি হলেন সর্বশ্রোতা, সর্বদ্ৰষ্টা।" (৪২-সূরা-শুরা: আয়াত-১১)
যখন পরম সমৃদ্ধি, শক্তি সত্তা, মর্যাদা ও প্রজ্ঞার কথা মনে আসে তখন ‘আল্লাহ' নাম মনে হয়।
لِمَنِ الْمُلْكُ الْيَوْمَ لِلَّهِ الْوَاحِدِ الْقَهَّارِ
আজ রাজত্ব কার? (আল্লাহ নিজেই নিজের প্রশ্নের উত্তর দিবেন)। আল্লাহর-যিনি একক, মহাপরাক্রমশালী!” (৪০-সূরা আল মু’মিন: আয়াত-১৬)
যখন দয়া, যত্ন, সাহায্য, স্নেহ-মমতা ও অনুকম্পার কথা মনে আসে তখন ‘আল্লাহ' নাম মনে পড়ে।
وَمَا بِكُمْ مِنْ نِعْمَةٍ فَمِنَ اللَّهِ
“আর তোমাদের নিকট যত নিয়ামত রয়েছে সবই আল্লাহর পক্ষ থেকে।” - (১৬-সূরা আন নাহল: আয়াত-৫৩)
আল্লাহ হলেন মর্যাদা, মাহাত্ম্য ও শক্তিমত্তায় অধিকারী। হে আল্লাহ! আরাম-আয়েশকে দুঃখ-কষ্টের স্থান দখল করতে দিন ।
হে আল্লাহ্ ঈমানের শীতলতা দ্বারা হৃদয়ের জ্বালা নিবারণ করুন।
হে আমাদের প্রভু! বিনিদ্র রজনী যাপনকারীকে সুখনিদ্রা দান করুন এবং অসুখী আত্মাকে শান্তি প্রদান করুন।
হে আমাদের প্রতিপালক বিভ্রান্তদেরকে আপনার আলোর এবং পথভ্রষ্টদেরকে আপনার হেদায়েতের পথে পরিচালিত করুন।
হে আল্লাহ! আমাদের অন্তরসমূহ হতে কুমন্ত্রণা দূর করে দিন এবং আমাদের অন্তরসমূহকে আলো দ্বারা পরিপূর্ণ করে দিন, মিথ্যাকে সত্য দ্বারা ধ্বংস করে দিন এবং শয়তানের কুচক্রকে আপনার ফেরেশতা বাহিনী দিয়ে দুমড়ে-মুচড়ে দিন। হে আল্লাহ আমাদের থেকে দারিদ্র্যতা, ক্লেশ ও উদ্বেগ চিরতরে দূর করে দিন। আপনাকে ব্যতীত অন্যকে ভয় করা, আপনাকে ছাড়া অন্যের উপর ভরসা করা, আপনাকে বাদ দিয়ে অন্যের প্রতি আমাদের পূর্ণ আস্থা স্থাপন করা এবং আপনি ছাড়া অন্যের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করা থেকে আমরা আপনার নিকট আশ্রয় চাই। আপনি হলেন সর্বোৎকৃষ্ট পৃষ্ঠপোষক ও পরমোৎকৃষ্ট পালনকর্তা ও রক্ষাকর্তা।
আপনার প্রতি আল্লাহ্ তা'য়ালার অসংখ্য করুণার কথা স্মরণ করুন, কীভাবে সে করুণাসমূহ আপনাকে আপাদমস্তক বেষ্টন করে রেখেছে-আসলে সর্বদিক দিয়েই ঐ করুণাসমূহ আপনাকে ঘিরে রেখেছে।
وَإِنْ تَعُدُّوا نِعْمَتَ اللَّهِ لَا تُحْصُوهَا
“যদি তুমি আল্লাহর নিয়ামতরাজিকে গণনা করতে চাও তবে তা তুমি কখনও গণনা করে শেষ করতে পারবে না।" (১৪-সূরা ইবরাহীম: আয়াত-৩৪)
সুস্থতা, নিরাপত্তা, খাদ্য, বস্ত্র, বায়ু ও পানি ইত্যাদি সবকিছুই দুনিয়াটাকে আপনার বলে ঘোষণা দিচ্ছে-তবুও আপনি বুঝতে পারছেন না। জীবন ধারণের জন্য অপরিহার্য প্রয়োজনীয় যা কিছু থাকতে হয় তার সবকিছুই আপনার আছে- তবুও আপনি অজ্ঞই থেকে গেলেন।
وَأَسْبَغَ عَلَيْكُمْ نِعَمَهُ ظَاهِرَةً وَبَاطِنَةً
“তিনি তোমাদের উপর তার প্রকাশ্য ও গোপন নিয়ামতসমূহ পূর্ণ করে রেখেছেন।" (৩১-সূরা লুকমান: আয়াত-২০) (প্রকাশ্য নিয়ামত হল ইসলামী একত্ববাদ বা তাওহীদ এবং সুস্থতা, সৌন্দর্য ইত্যাদিসহ এ জগতের বৈধ যৌন আমোদপ্রমোদ। আর অপ্রকাশ্য বা গোপন নিয়ামত হল আল্লাহর প্রতি কারো ঈমান, আমলে সালেহ বা সৎকাজের জন্য পথনির্দেশক, কুরআনের উপর ঈমান এবং আখেরাতে বেহেশতের আনন্দ-ফুর্তি ইত্যাদির প্রতি ঈমান।)
নিজের আয়ত্তে আপনার দুটি আঁখি, একটি জিহ্বা, দুটি ঠোট, দুটি হাত আর দুটি পা আছে। (একটু ভেবে দেখুন ও কৃতজ্ঞ হোন -অনুবাদক)
فَبِأَيِّ آلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ
“সুতরাং (হে জ্বীন ও ইনসান জাতি!) তোমরা উভয় জাতি তোমাদের প্রতিপালকের কোন কোন নিয়ামতকে অস্বীকার করবে? (৫৫-সূরা আর রাহমান: আয়াত-১৩)
পা ছাড়া হাটার কথা কল্পনা করতে পারেন কি? আপনি কি এ বিষয়টি হাল্কা করে দেখবেন যে, আপনি সুখে নিদ্রা যাচ্ছেন, অথচ দুঃখ-যাতনা, দুর্দশা ও দুরাবস্থা বহুলোকের নিদ্রার অন্তরায় হয়ে আছে। আপনি একথা কি ভুলে যাবেন যে, আপনি সুস্বাদু খাদ্য ও শীতল পানি উভয়টা দ্বারা নিজের উদর পূর্তি করছেন অথচ রোগ-বালাইয়ের কারণে কিছু লোকের পক্ষে সুখাদ্য ও সুপেয় পানীয়ের মজা উপভোগ করা অসম্ভব হয়ে আছে। আপনার শ্রবণশক্তি ও দর্শনশক্তির কথা ভেবে দেখুন! আপনার সুস্থ ত্বকের দিকে তাকান এবং আপনি যে চর্মরোগ থেকে মুক্ত আছেন এজন্য আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জ্ঞাপন করুন। আপনার বিবেচনা শক্তির কথা গভীরভাবে ভেবে দেখুন ও যারা মানসিক রোগে ভুগছে তাদের কষ্টের কথা একটুখানি মনে করে দেখুন।
উহুদ পাহাড়সমস্বর্ণের বিনিময়ে আপনি কি আপনার শ্রম ও দর্শন ক্ষমতা বিক্রি করে দিবেন নাকি আপনার কথা বলার ক্ষমতা বিশাল বিশাল অট্টালিকার বিনিময়ে বিক্রি করে দিবেন? আপনাকে প্রচুর অনুগ্রহ দান করা হয়েছে, তবুও আপনি না জানার ভান করছেন! টাটকা খাবার, শীতল পানি, সুখপ্রদ নিদ্রা এবং সুস্বাস্থ্য সত্ত্বেও আপনি হতাশ ও বিষগ্ন থাকছেন। আপনার যা নেই তা নিয়ে ভাবছেন এবং যা আপনাকে দান করা হয়েছে তার নিমিত্তে কৃতজ্ঞ হওয়ার পরিবর্তে বরং অকৃতজ্ঞ হচ্ছেন! সম্পদের ক্ষতি নিয়ে আপনি বিব্রত, তথাপি অনেক কল্যাণের চাবিকাঠি আপনার হাতে ন্যস্ত। একটু ভেবে দেখুন এবং কৃতজ্ঞ হন।
وَفِي أَنْفُسِكُمْ أَفَلَا تُبْصِرُونَ
“এবং তোমাদের নিজেদের মধ্যেও (আমার নিদর্শন আছে), তাহলে তোমরা কি (তা) দেখতে পাও না?” (৫১-সূরা যারিয়াত: আয়াত-২১)
আপনার নিজের কথা, আপনার পরিবারের কথা, আপনার বন্ধু-বান্ধবের এবং আপনার চারপাশের গোটা দুনিয়ার কথা গভীরভাবে চিন্তা-গবেষণা করুন।
يَعْرِفُونَ نِعْمَتَ اللَّهِ ثُمَّ يُنكِرُونَهَا وَأَكْثَرُهُمُ الْكَافِرُونَ
তারা আল্লাহর নিয়ামতকে অনুধাবন করতে পারে, তবুও তা তারা অস্বীকার করে তাদের অধিকাংশই কাফের। (১৬-সূরা আন নাহল: আয়াত-৮৩)
কোনো ব্যক্তি অতীতের দুঃখজনক ঘটনাকে কেন্দ্র করে বসে বসে চিন্তা-ভাবনা করে শুধু এক ধরনের পাগলামিই দেখাতে পারে- যে পাগলামি বর্তমান জীবন-যাপন করার বা উপস্থিত মুহুর্তে বেঁচে থাকার দৃঢ় সংকল্পকে ধ্বংস করে দেয়ার মতো এক ধরনের রোগ। যাদের দৃঢ় সংকল্প আছে তারা অতীতের ঘটনাবলিকে ধুয়ে মুছে ফেলে দিয়ে ভুলে গিয়েছে। এ ঘটনাগুলো আর কখনও সত্যের পথে বাধা হয়ে দাড়াবে না।
কেননা, সেগুলো বিস্মৃতির অতল গহ্বরে তলিয়ে গেছে। অতীতের উপাখ্যান শেষ হয়ে গেছে; দুঃখ ওগুলোর ক্ষতিপূরণ করতে পারে না, বিষন্নতা সেগুলোকে সংশোধন করতে পারে না, আর হতাশা কখনও অতীতকে পুনরুজ্জীবন দান করতে পারবে না। কেননা, অতীত চিরকাল অতীত— তা অস্তিত্বহীন। অতীতের দুঃস্বপ্ন দেখবেন না বা যা আপনি হারিয়েছেন তার মিছে আশা করবেন না। অতীতের ভূতের আবির্ভাব হতে নিজেকে রক্ষা করুন। আপনি কি মনে করেন যে, আপনি সূর্যকে তার উদয়স্থলে, শিশুকে তার মায়ের জঠরে, দুধকে পশুর ওলানে অথবা অশ্রুকে আঁখিতে ফিরিয়ে দিতে পারবেন? অতীত ও অতীতের ঘটনাবলি নিয়ে অনবরত চিন্তা-ভাবনা করে আপনি নিজেকে এক অতি ভয়ংকর ও শোচনীয় মানসিক অবস্থায় উপনীত করবেন।
অতীত নিয়ে অতিরিক্ত গবেষণা বর্তমানের অপচয় মাত্র। পূর্ববতী জাতিদের কার্যকলাপ উল্লেখপূর্বক মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন-
تِلْكَ أُمَّةٌ قَدْ خَلَتْ
এটা ছিল এমনই এক জাতি যা অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে। (২-সূরা বাকারা: আয়াত-১৩৪)
অতীতের দিনগুলো চলে গেছে ও শেষ হয়ে গেছে, আর ইতিহাসের চাকা উল্টোদিকে বা পিছন দিকে ঘুরিয়ে তাদের ময়না তদন্ত করে আপনার কোনো লাভ হবে না।
যে লোক অতীতের চিন্তায় বিভোর থাকে, সে তো ঐ লোকের মতো যে লোক কাঠের গুড়াকে করাত দিয়ে চেরাই করতে চায়। যে ব্যক্তি অতীত নিয়ে কান্না-কাটি, হা-হুতাশ ও দুঃখ করত এমন ব্যক্তিকে প্রাচীনকালে বলা হতো- "মৃতদেরকে তাদের কবর থেকে তুলিও না।"
আমাদের দুঃখজনক ব্যাপার এই যে, আমরা বর্তমানের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করতে পারি না; আমাদের সুন্দর সুন্দর প্রাসাদকে অবহেলা করে আমরা ধ্বংস দালানকোঠার জন্য হাউ মাউ করে কান্না-কাটি করি। সকল জ্বীন ও ইনসান একত্রে অতীতকে ফিরিয়ে আনতে চাইলেও তারা অতি নিশ্চিতভাবেই ব্যর্থ হবে। পৃথিবীর সবকিছুই সন্মুখপানে এগিয়ে চলছে, একটি নতুন ঋতুর জন্য প্রস্তুত হচ্ছে-আপনাকেও তাই করতে হবে। (অর্থাৎ আপনাকেও একটি নতুন জীবনের জন্য প্রস্তুত হতে হবে ও সামনে এগিয়ে চলতে হবে। -অনুবাদক)
আপনি যখন প্রত্যুষে জেগে উঠবেন তখন সন্ধ্যাকে প্রত্যক্ষ করার আশা করবেন না বরং এমনভাবে জীবনযাপন করুন যেন আজই আপনার শেষ সকাল। গতকাল ভালোয় আর মন্দে কেটে গেছে, আর আগামীকালতো এখনও আসেনি। আপনার জীবনকাল মাত্র একদিন, আপনি যেন আজই জন্মগ্রহন করেছেন আর দিনের শেষ মারা যাবেন। এ মনোভাব থাকলে আপনি অতীতের সকল দুশ্চিন্তা ও ভবিষ্যতের সকল অনিশ্চিত আশার নেশায় ব্যস্ত হয়ে থাকবেন না। কেবল আজকের দিনটির জন্যই যেন বেঁচে থাকবেন; সারাটা দিন আপনার উচিত জাগ্রত হৃদয়ে প্রার্থনা করা, বুঝে-শুনে কুরআন তিলাওয়াত করা, মহান আল্লাহ্কে অধিক পরিমাণে স্মরণ করা। প্রতিটি দিনেই আপনার কাজকর্মে ভারসাম্যতা বজায় রাখা, তাক্বদীরের প্রতি সন্তুষ্ট থাকা এবং আপনার স্বাস্থ্য ও বাহ্যাকৃতি তথা সাজসজ্জা, রূপচর্চা, বেশভূষা, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ও পোশাক পরিচ্ছদ সম্বন্ধে সতর্ক থাকা উচিত।
নোটঃ যারা কুরআন তিলাওয়াত করার সময় পান না তাদের জন্য একটি পরামর্শ হচ্ছে- পুরুষগণ প্রতিদিন প্রতি ওয়াক্ত জামাতের কিছু সময় আগে মসজিদে চলে যান ও জামাতের পূর্বেকার অতিরিক্ত সময়টুকু কুরআন তিলাওয়াতে অতিবাহিত করুন আর মহিলারা প্রতিদিন প্রতি ওয়াক্ত সালাতের পর কিছু সময় সালাতের জায়গায় বসে কুরআন তিলাওয়াত করুন – মোঃ রফিকুল ইসলাম।
দিনের প্রতিটি মুহূর্তকে সঠিকভাবে পরিচালিত করুন বা যথাযথভাবে কাজে লাগান, যাতে করে আপনি কয়েক মিনিটে কয়েক বছরের ফায়দা এবং কয়েক সেকেন্ডে কয়েক মাসের ফায়দা হাসিল করতে পারেন। আপনার প্রভুর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করুন, তাঁর জিকির করুন, এ ধরাধাম (দুনিয়া) থেকে শেষ বিদায়ের জন্য প্রস্তুত থাকুন এবং অবশিষ্ট সময়টুকুতে সুখ-শান্তিতে বেঁচে থাকুন। আপনার রিযিক, আপনার স্ত্রী, আপনার সন্তানাদি, আপনার কাজ, আপনার গৃহ এবং আপনার জীবনযাপনের উপর সন্তুষ্ট থাকুন।
فَخُذْ مَا آتَيْتُكَ وَكُنْ مِنَ الشَّاكِرِينَ
আমি আপনাকে যা দান করেছি তা গ্রহণ করুন এবং কৃতজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত হোন। (৭-সূরা আল আ'রাফ: আয়াত-১৪৪)
আজকের দিনটি দুঃখ-বেদনা, বিরক্তি, ক্রোধ ও হিংসা-বিদ্বেষমুক্ত অবস্থায় কাটান। আপনার হৃদয়ের মণিকোঠায় একটি কথা সোনার হরফে খোদাই করে লিখে রাখুন, আর সেটা হচ্ছে- “আজই আমার একমাত্র দিন।"
আজ যদি আপনি টাটকা খাবার খেয়ে থাকেন তবে গতকালের বাসী খাবার ও আগামীকালের প্রত্যাশিত খাবারে তেমন কী আসে যায়?
আপনার নিজের উপর যদি আপনার আস্থা থেকে থাকে এবং আপনার যদি একটা দৃঢ়, বলিষ্ঠ, অনড় ও স্থির সংকল্প থেকে থাকে তবে আপনি নিজেই সন্দেহাতীতভাবে পরবর্তী কথাটির উপর দৃঢ় প্রত্যয় উৎপাদন করতে পারবেন: (কথাটি হল) “আজই আমার জীবনের শেষ দিন।”
যখন আপনি এই মনোভাব অর্জন করতে পারবেন তখন আপনি আপনার ব্যক্তিত্বকে উন্নত করে, আপনার ক্ষমতা ও দক্ষতা বাড়িয়ে এবং আপনার কাজকর্মকে পরিশুদ্ধ করে আপনার দিনের প্রতিটি মুহুর্ত হতেই মুনাফা অর্জন করতে পারবেন। তারপর আপনি মনে মনে বলুন আজ আমি আমার কথাবার্তাকে পরিশুদ্ধ করব এবং কোনোরূপ মন্দ ও অশ্লীল কথা উচ্চারণ থেকে বিরত থাকব। আমি কারো গীবতও করব না। আজ আমি ঘর ও অফিস গুছাবো। সেগুলো অগোছালো ও এলোমেলো থাকবে না, বরং গোছালো ও ফিটফাট থাকবে।
আজ আমি আমার শরীরের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও বাইরের ঠাঁট সম্বন্ধে বিশেষ যত্নবান হব। আমি আমার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও পবিত্রতা সম্বন্ধে অতিশয় সতর্ক হব এবং আমার চলাফেরা, কথাবার্তা ও কাজকর্মে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান বজায় রাখব।
আজ আমি আমার প্রতিপালকের প্রতি অনুগত থাকতে, সম্ভাব্য সর্বোত্তম পদ্ধতিতে সালাত আদায় করতে, অধিক নফল ইবাদত করতে, কুরআন তিলাওয়াত করতে এবং উপকারী বই-পুস্তক ও ভালো কিতাবাদি পড়তে আপ্রাণ চেষ্টা করব। আজ আমি আমার অন্তরে ভালো কাজের বীজ বপন করব এবং অহংকার, হিংসা-বিদ্বেষ, ভণ্ডামি, কপটতা ও মোনাফেকির মতো মন্দ কাজের মূলোৎপাটন করব।
আজ আমি অন্যদেরকে সাহায্য করার (তথা রোগী দেখতে যাবার, জানাযার সালাতে উপস্থিত হবার, পথহারাকে পথ দেখানোর এবং ক্ষুধার্তকে খাবার খাওয়ানোর) চেষ্টা করব। আজ আমি মজলুমের পাশে দাঁড়াব। আমি বিজ্ঞ জনকে (জ্ঞানীকে বা আলেমকে) সম্মান প্রদর্শন করব, দয়াৰ্দ্ৰ হব আর বৃদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হব।
হে অতীত! তুমিতো বিদায় হয়ে চলে গিয়েছ, আমি তোমাকে নিয়ে কাঁদব না। তোমাকে স্মরণ করলে বা তোমার কথা মনে করলে তুমিতো আমাকে আর দেখতে আসবে না, এমননি এক মুহুর্তের জন্যও না, কেননা, তুমিতো আমাকে ছেড়ে চিরদিনের মতো বিদায় হয়ে চলে গিয়েছ।
হে ভবিষ্যৎ তুমিতো অজ্ঞাত, অজানা ও অদৃশ্য জগতে আছ, সুতরাং আমি তোমার কল্পনায় বিভোর হব না। আমি ভবিষ্যৎ নিয়ে আগেভাগেই মাথা ঘামাব না। কেননা, ভবিষ্যৎ কিছুই না এবং এমনকি তা এখনও সৃষ্টিই হয়নি।
যারা পরিপূর্ণ জাকজমক ও চমৎকারভাবে জীবনযাপন করতে চায় তাদের জন্য সুখের অভিধানে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ কথা হল “আজই আমার শেষ দিন।"
أَتَىٰ أَمْرُ اللَّهِ فَلَا تَسْتَعْجِلُوهُ
“আল্লাহর আদেশ আসবেই, সুতরাং তোমরা এর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড় না।” (সূরা-১৬ আন নাহল: আয়াত-১) (আল্লাহর আদেশ বলতে কিয়ামত অথবা কাফের ও মুশরিকদের শাস্তি অথবা ইসলামী আইন বুঝায়।)
যা এখনো ঘটেনি তা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হবেন না, আপনি কি ফল পাকার আগেই তা ছিড়ে ফেলাকে বুদ্ধিমানের কাজ মনে করেন? আজ আগামী দিনের কোনো বাস্তবতা নেই, তাই তা অস্তিত্বহীন। অতএব, আপনি তা নিয়ে ব্যস্ত হবেন কেন? ভবিষ্যৎ বিপর্যয় সম্বন্ধে কেন আপনার আশঙ্কা থাকতেই হবে? ভবিষ্যৎ দুর্বিপাকের দুর্ভাবনা নিয়ে আপনাকে কেন বিভোর থাকতেই হবে? বিশেষ করে যখন আপনি জানেন না যে, আপনি আগামী দিনের সুখটাই শুধু দেখতে পারবেন কিনা?
যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি জানতে হবে তা এই যে, আগামী দিন অদৃশ্য জগতের এমন এক সেতু যা আমাদের সামনে না আসা পর্যন্ত আমরা তা অতিক্রম করতে পারি না। কে জানে, হয়তোবা আমরা কখনো সে সেতুর কাছে না-ও পৌছতে পারি, অথবা আমরা সেটার কাছে পৌঁছার পূর্বেই ওটা ধ্বসে যেতে পারে, অথবা আমরা হয়তো সে সেতুতে পৌছে তা নিরাপদে পার হব?
ভবিষ্যতের আশঙ্কায় বিভোর হওয়া আমাদের পক্ষে ধর্মকে অবজ্ঞা করার মতো; কেননা, ঐ আশঙ্কা এ জগতের সাথে আমাদের এক দীর্ঘকালীন সম্পর্ক থাকার কথা মনে করিয়ে দেয়, যে সম্পর্ককে একজন প্রকৃত মু’মিন পরিহার করে। এ পৃথিবীর বহু লোকই ভবিষ্যৎ দারিদ্র্য, ক্ষুধা, পীড়া ও দুর্যোগের ভয়ে অযৌক্তিকভাবে ভীত। এ ধরনের চিন্তা-ভাবনা শয়তানের ধোকা মাত্র।
الشَّيْطَانُ يَعِدُكُمُ الْفَقْرَ وَيَأْمُرُكُمْ بِالْفَحْشَاءِ وَاللَّهُ يَعِدُكُمْ مَغْفِرَةً مِنْهُ وَفَضْلًا
শয়তান তোমাদেরকে দারিদ্র্যের ভয় দেখায় ও অশ্লীল কাজ করার আদেশ করে, অথচ আল্লাহ তার পক্ষ থেকে তোমাদেরকে ক্ষমা ও দানের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন।" (২-সূরা বাকারা: আয়াত-২৬৮)
অনেকেই এমন আছে যে, তারা নিজেদেরকে আগামী দিনের বুভুক্ষু (ক্ষুধার্ত) ভেবে, একমাস পরের রোগী ভেবে অথবা একশত বছর পর পৃথিবী শেষ হয়ে যাবে এই কল্পিত ভয়ে কান্না করে। যে ব্যক্তি জানেনা কখন সে মরবে (অথচ আমাদের সবাইকে মরতে হবে), যে ব্যক্তির কাছে তার মৃত্যুর সময়ের কোনো ইঙ্গিত নেই- সে ব্যক্তির উচিৎ নয় নিজেকে এ ধরনের চিন্তা-ভাবনায় নিমগ্ন রাখা। যেহেতু আপনি আজকের কর্ম নিয়ে ব্যস্ত আছেন তাই ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তা পরিহার করুন। এ পৃথিবীর ভাবী কল্পিতদৃশ্য নিয়ে অযৌক্তিকভাবে ব্যাপৃত (নিয়োজিত) হওয়া থেকে সাবধান হন।
যারা অজ্ঞ ও মূর্খ তারা সকল সৃষ্টির স্রষ্টা মহান আল্লাহকেও গালি দিয়েছে, সুতরাং আমরা সাধারণ লোকজনের কাছ থেকে কী আশা করতে পারি? আমরাতো ভুল-ভ্রান্তিতে নিমজ্জিত। আপনাকে সর্বদাই এমন তীব্র সমালোচনা ও নিন্দার অসমাপনীয় ঝড়ের মুখে পড়তে হবে- যার তীব্র আক্রমণ অন্তহীন যুদ্ধের মতো।
যখন আপনি উন্নতি করবেন, নিজেকে প্রকাশিত করবেন, নিজেকে উদ্ভাসিত করবেন এবং অন্যের উপর প্রভাব বিস্তার করবেন, তখনই অগ্রাহ্য, অবজ্ঞা ও নিন্দা আপনার ভাগ্যে বরাদ্দ হবে, যে পর্যন্ত না আপনি ভূ-গর্ভস্থ সুরঙ্গ পথে বা আকাশচুম্বী মইয়ে চড়ে জনগণ থেকে পালিয়ে যাবেন, সে পর্যন্ত তারা আপনার নিন্দা ও আপনার চরিত্রে দোষ-ক্রটি খোঁজা থেকে বিরত হবে না। সে কারণেই, যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি মর্ত্যবাসী (অর্থাৎ যতদিন আপনি এ পৃথিবীতে বেঁচে থাকবেন), ততক্ষণ পর্যন্ত আহত হওয়ার, (অর্থাৎ মানসিক আঘাত পাওয়ার) অপমানিত হওয়ার ও নিন্দিত হওয়ার প্রত্যাশা করুন। একটি বিষয় আপনাকে গভীরভাবে দেখতে হবে, আর তাহল- মাটিতে বসে আছে এমন ব্যক্তি মাটিতে পড়ে যায় না। মানুষেরা মৃত কুকুরকে লাথি মারতে যায় না।
অতএব, ধাৰ্মিকতায়, বিদ্যা-বুদ্ধিতে, আচার-আচরণে ও ধন-সম্পদে উৎকর্ষতায় আপনি তাদেরকে ছাড়িয়ে যাওয়াতেই আপনার প্রতি তাদের ক্রোধ। যদি না আপনি আপনার সকল প্রতিভাকে বিসর্জন দিয়ে এবং নিজেকে সকল প্রশংসা যোগ্য গুণ হতে বঞ্চিত করে- নির্বোধ, অথর্ব, তুচ্ছ, নগণ্য, মূল্যহীন ও তাদের নিকট নির্বিঘ্ন, অনুপকারী, অক্ষতিকর ও গোবেচারা হয়ে যান তবে তাদের দৃষ্টিতে আপনি এমন এক সীমালঙ্ঘনকারী ও পাপী -যার ভুলের ও পাপের প্রায়শ্চিত্ত করা যায় না। তারা আপনার জন্য ঠিক এ সমাধানই আকাঙ্ক্ষা করে।
তাই তাদের অপমান ও নিন্দার মুখে ধৈর্যশীল হয়ে থাকুন। যদি আপনি তাদের কথায় মর্মাহত হন এবং তাদেরকে আপনার উপর প্রভাব বিস্তার করতে সুযোগ দেন, তবে আপনার জন্য তারা কী চায় তা আপনি বুঝতে পারবেন (তাদের কথায় আপনি আহত, বিব্রত ও রাগান্বিত হলে আপনারই ক্ষতি হবে। আর তারা এটাই চায় যে, আপনি ক্রুদ্ধ, রুষ্ট ও ব্যথিত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হোন। -অনুবাদক) তার বদলে (রাগান্বিত না হয়ে), তাদের প্রতি সবচেয়ে সুন্দর আচরণ প্রদর্শনের মাধ্যমে আপনি তাদেরকে ক্ষমা করে দিন। তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিন এবং তাদের ফন্দির (চক্রান্তের) কারণে যাতনাবোধ করবেন না। আপনার প্রতি তাদের অবজ্ঞা শুধুমাত্র আপনার মূল্য ও গুণই বৃদ্ধি করে।
আপনি অবশ্যই তাদের মুখ বন্ধ করতে পারবেন না, কিন্তু তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে তাদের যা বলার আছে তা অগ্রাহ্য করে তাদের নিন্দা ও সমালোচনাকে আপনি কবর দিতে (স্মৃতির পাতা হতে মুছে ফেলতে বা ভুলে যেতে) পারবেন। কুরআনের ভাষায়-
قُلْ مُوتُوا بِغَيْظِكُمْ
বলুন, তোমাদের আক্রোশে তোমরাই মর। (৩-সূরা আলে ইমরান: আয়াত-১১৯)
প্রকৃতপক্ষে, আপনার গুণাবলিকে বাড়িয়ে এবং আপনার প্রতিভাকে উন্নত করে আপনি তাদের ক্রোধকে বর্ধিত করতে সক্ষম হবেন। (আপনি উন্নত হলে তারা ক্রুব্ধ হবে, ফলে তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে; আর এভাবেই—নিজেকে উন্নত করে তাদেরকে ক্রুব্ধ পরিণামে ক্ষতিগ্রস্ত করে-আপনি তাদের প্রতিশোধ নিতে পারেন। -অনুবাদক) আপনি যদি সকলের নিকট গৃহীত হতে চান ও সকলের ভালোবাসা পেতে চান, তবে আপনি এমন জিনিস পেতে চান যা পাওয়া অসম্ভব। (সকলের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা পেতে চাইলেও তা আপনি পাবেন না। -অনুবাদক)
সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ তায়ালা তার বান্দাদেরকে তার জিকির (স্মরণ) করার জন্য সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি তাদেরকে এজন্য রিযিক দিয়েছেন যে, তারা তার শুকরিয়া আদায় করবে। এতদসত্ত্বেও অনেকে তাকে বাদ দিয়ে অন্যের ইবাদাত করছে। অধিকাংশ লোকই তার প্রতি কৃতজ্ঞশীল নয়, কেননা, মানবজাতির মধ্যে অকৃতজ্ঞতার বৈশিষ্ট্য খুবই জোরালো। অতএব, আপনি যখন দেখবেন যে, অন্যেরা আপনার করুণাসমূহকে ভুলে যাচ্ছে ও আপনার সদয় আচরণসমূহকে অবজ্ঞা করছে তখন হতাশ হবেন না। কিছু লোকতো আপনাকে এমনকি ঘৃণার সাথেও দেখতে পারে এবং আপনি যে তাদের প্রতি দয়া দেখিয়েছেন শুধুমাত্র একারণেই আপনাকে শক্র ভাবতে পারে।
وَمَا نَقَمُوا إِلَّا أَنْ أَغْنَاهُمُ اللَّهُ وَرَسُولُهُ مِنْ فَضْلِهِ
“আল্লাহ্ ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে নিজ গুণে সম্পদশালী করেছিলেন, শুধুমাত্র এ কারণ ছাড়া তারা আক্রোশ-পোষণ করার অন্য কোনো কারণ খুঁজে পায়নি।” (৯-সূরা তাওবা: আয়াত-৭৪)
ইতিহাসের পাতায় এরূপ যে ঘটনা সর্বাপেক্ষা বেশি ঘটে তা হল পিতা-পুত্রের ঘটনা। পিতা-পুত্রকে বড় করে তোলে, প্রতিষ্ঠিত করে, পুত্রের মুখে খাবার তুলে দেয়, তার পোশাক পরিচ্ছদের ব্যবস্থা করে এবং তাকে উত্তম শিক্ষা দেয়, পিতা রাতকে রাত বিনিদ্র অবস্থায় কাটায় যাতে করে তাঁর পুত্র আরামে ঘুমোতে পারে, পুত্রের খাবারের জন্য নিজে না খেয়ে থাকে এবং পুত্রের আরামের জন্য নিজে কঠোর পরিশ্রম করে। আর যখন ছেলে বড় হয় ও শক্তিশালী হয় তখন পিতাকে অবাধ্যতা, অসম্মান ও অবজ্ঞার মাধ্যমে পুরস্কৃত করে! সুতরাং আপনি যে ভালো কাজ করেছেন তার বিনিময় যদি আপনাকে অকৃতজ্ঞতার মাধ্যমে দেয়া হয় তবে আপনি শান্ত থাকুন। একথা জেনে আনন্দিত হবেন যে, যার অধিকারে সীমাহীন সম্পদ আছে তিনিই আপনাকে পুরস্কৃত করবেন।
একথা বলবেন না যে, অন্যের প্রতি দয়া প্রদর্শন করা থেকে আপনার বিরত থাকা উচিত। বরং আসল কথা হল অকৃতজ্ঞতা পাবার জন্যই দান করুন। কেননা, এ মনোভাব থাকলেই আপনি নিশ্চিতভাবে সফল হবেন। অকৃতজ্ঞ লোকেরা আসলে আপনার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। এজন্য আপনি আল্লাহর প্রশংসা করুন যে, সে লোক সীমালংঘনকারী আর আপনি অনুগত বান্দা। একথাও মনে রাখুন যে, দান গ্রহণকারীর চেয়ে দানকারী উত্তম।
إِنَّمَا نُطْعِمُكُمْ لِوَجْهِ اللَّهِ لَا نُرِيدُ مِنْكُمْ جَزَاءً وَلَا شُكُورًا
আমরাতো শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যই তোমাদেরকে খাদ্য খাওয়াই। আমরা তোমাদের নিকট না কোনো পুরস্কার আশা করি, আর না কোনো ধন্যবাদ।" (৭৬-সূরা আদ দাহর বা ইনসান: আয়াত-৯)
অনেকেই অন্যের অকৃতজ্ঞতায় মর্মাহত হন, যেন তারা কখনও (নিম্নোক্ত) এই আয়াত বা এমন অন্যান্য আয়াত দেখেনি, আর তা হল –
وَإِذَا مَسَّ الْإِنْسَانَ الضُّرُّ دَعَانَا لِجَنْبِهِ أَوْ قَاعِدًا أَوْ قَائِمًا فَلَمَّا كَشَفْنَا عَنْهُ ضُرَّهُ مَرَّ كَأَنْ لَمْ يَدْعُنَا إِلَىٰ ضُرٍّ مَسَّهُ
আর যখন মানুষকে কোনো মুসিবত (বিপদ) পেয়ে বসে তখন সে শুয়ে, বসে ও দাঁড়ানো অবস্থায় আমার নিকট আকুল আবেদন করে, কিন্তু আমি যখন তার থেকে মুসিবত দূর করে দিই তখন সে এমনভাবে চলে যেন সে কখনও তার উপর আপতিত মুসিবতের জন্য আমার নিকট প্রার্থনা করেনি।” (১০-সূরা ইউনুস: আয়াত-১২)
এ কারণেই, যদি আপনি কাউকে উপহারস্বরূপ একটি কলম দেন আর সে এটাকে আপনার জন্য বিদ্রুপের বিষয় বানায় অথবা আপনি যদি কাউকে ভর দিয়ে হাটার জন্য একটি লাঠি দেন আর সে এ লাঠি দিয়ে আপনাকে প্রহার করে তবে আপনি রাগাম্বিত হবেন না। অধিকাংশ মানুষই তাদের করে এটাই প্রতিপালকের প্রতিই অকৃতজ্ঞ। যেমনটি আমি পূর্বেই উল্লেখ করেছিলাম। সুতরাং আপনি ও আমি কী ধরনের আচরণ আশা করতে পারি?
যে লোক কাউকে দান করে তার উপকার করে সে (দানকারী) নিজেই নিজের উপকার করে। নিজের মাঝে পরিবর্তন দেখে, নিজের আচরণে পরিবর্তন দেখে শান্তি লাভ করে এবং অন্যের মুখে হাসি দেখে পরোপকারী নিজেই আত্মতৃপ্তি লাভ করে।
যদি আপনি নিজেকে সঙ্কটাপন্ন ও দুঃখে জর্জরিত দেখতে পান তবে অন্যের প্রতি করুণা প্রদর্শন করুন; তাহলে আপনি নিজেই প্রথমে শান্ত্বনা লাভ করবেন। অভাবীকে দান করুন, মজলুমকে রক্ষা করুন, যাতনাগ্রস্তদেরকে সাহায্য করুন আর রোগী দেখতে যান, তবেই আপনি দেখতে পাবেন যে, সুখ সবদিক থেকে আপনাকে ঘিরে রেখেছে। দানকর্ম প্রসাধনীর মতো এটা ব্যবহারকারী, বিক্রেতা ও ক্রেতাকে উপকার করে। (সুগন্ধি বা আতর যেমন যার সংস্পর্শেই আসে তাকেই সুবাসিত করে। -অনুবাদক)
অধিকন্তু, অন্যেকে সাহায্য করে কেউ যদি মানসিক উপকার লাভ করে তা সত্যিই মহান। যদি আপনি বিষন্নতায় ভুগতে থাকেন তবে একটি দানকর্ম আপনার অসুস্থতার উপর সবচেয়ে ভালো ঔষুধের চেয়েও বেশি কার্যকর প্রভাব ফেলবে।
এমনকি আপনি যখন অন্যের সাথে সাক্ষাৎকালে প্রসন্ন হাসি দেন, (প্রকৃতপক্ষে) আপনি তখন দানই করেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: কাউকে অকিঞ্চিৎকর (নগণ্য) ভেবে কোনরূপ দানকর্ম বন্ধ করে দিও না, এমনকি তোমার ভাইয়ের সাথে হাসি মুখে সাক্ষাৎ করাও বন্ধ করিও না। কেননা, সে কাজটাও তোমার আমলনামায় নেকীর পাল্লায় খুবই ভারী হতে পারে।
অপরপক্ষে, অন্যের সাথে সাক্ষাৎকালে আপনি যখন ভ্রুকুটি করেন (ভুরু কোঁচকান) তখন আপনি শক্রতার এমন এক ধরনের চিহ্ন প্রকাশ করেন যা ভ্রাতৃত্ববোধের জন্য এতটাই ক্ষতিকর যে একমাত্র আল্লাহই জানেন যে, এর ক্ষতির পরিধি কত বেশি। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে জানিয়েছেন যে, এক বেশ্যা একবার এক কুকুরকে এক অঞ্জলি পানি পান করানোতে আল্লাহ তাকে এত বড় এক জান্নাত পুরস্কার হিসেবে দান করেন যে, তার প্রশস্ততা সমগ্র আকাশমণ্ডলী ও ভূমণ্ডলের মতো। কেননা পুরস্কারদাতা হলেন ক্ষমাশীল, ধনী ও প্রশংসাযোগ্য।
হে দুর্দশার ভয়ে ভীতরা! অন্যের উপকারার্থেই ভয় ও বিষন্নতা আপনাদেরকে পেয়ে বসে। অন্যকে দান, আতিথেয়তা সহমর্মিতা ও সমর্থন ইত্যাদি বিভিন্নভাবে সাহায্য করুন। আর এমন কাজ করেই আপনার কাঙ্ক্ষিত সকল সুখ পাবেন।
الَّذِي يُؤْتِي مَالَهُ يَتَزَكَّىٰ وَمَا لِأَحَدٍ عِنْدَهُ مِنْ نِعْمَةٍ تُجْزَىٰ إِلَّا ابْتِغَاءَ وَجْهِ رَبِّهِ الْأَعْلَىٰ إِلَّا ابْتِغَاءَ وَجْهِ رَبِّهِ الْأَعْلَىٰ
“যে পরিশুদ্ধ হওয়ার জন্য তার সম্পদ দান করে ও কারো কাছে প্রতিদান আশা করে না, শুধুমাত্র তার মহিমাময় প্রভুর সন্তুষ্টি লাভের জন্যই সে দান করে। এবং অচিরেই সে (জান্নাতে প্রবেশ করে) সন্তুষ্ট হবে।” (৯২-সূরা আল লাইল: আয়াত-১৮-২১)
যাদের জীবনে কোন কাজ করতে হয় না তারাই গুজব ও মিথ্যা কথা ছড়ানোর মাধ্যমে তাদের অধিকাংশ সময় নষ্ট করে। বিশেষ করে কল্যাণ-চিন্তাহীন মানসিকতার কারণেই তারা এমনটি করে থাকে।
رَضُوا بِأَنْ يَكُونُوا مَعَ الْخَوَالِفِ وَطُبِعَ عَلَىٰ قُلُوبِهِمْ فَهُمْ لَا يَفْقَهُونَ
“পেছনে পড়ে থাকা লোকদের সাথে থাকতে পারাতে তারা আনন্দিত এবং তাদের অন্তরে মোহর এঁটে দেয়া হয়েছে, তাই তারা বুঝতে পারে না।” (৯-সূরা তাওবা: আয়াত-৮৭)
যখন আপনি নিজকে অলস মনে করবেন তখন বিষন্নতা ও হতাশাবোধ করবেন। কেননা, অলসতা অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের যত সব মুসিবতের কথা ভাবার মাধ্যমই হয়। সুতরাং আপনার প্রতি আমার আন্তরিক উপদেশ এই যে, অলস না থেকে ফলপ্রসূ কাজ সম্পাদন করুন। কেননা, অলসতা হল ধীর ও ছদ্মবেশী আত্মহত্যা। অর্থাৎ অলসতার কারণে ধীরে ধীরে ও অজান্তে আত্মহত্যার ইচ্ছা মনে জাগ্রত হয়।
চীনদেশে কয়েদিদেরকে যে ধরনের ধীর অত্যাচার করা হয় বা শাস্তি দেয়া হয় অলসতা হল সে ধরনের নিপীড়ন (আর তা হল):
তাদেরকে এমন এক টেপের (পানির কলের) নিচে রাখা হয় যে টেপ থেকে এক ঘণ্টা পর পর মাত্র এক ফোটা পানি পড়ে। কয়েক ফোটা পানির জন্য যে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয় ততক্ষণে অনেকের মাথা খারাপ হয়ে যায় আর তাতে অনেকে পাগল হয়ে যায়।
অকৰ্মা হওয়া মানে নিজের দায়িত্বের অবহেলা প্রদর্শন করা। অলসতা এক দক্ষ চোর আর আপনার মন হল এর বলি বা শিকার। সুতরাং ক্ষণকাল বিলম্ব না করে এখনই উঠে পড়ুন ও প্রার্থনা করুন বা একটি ভালো বই পড়ুন, আপনার প্রভুর প্রশংসা করুন, লেখা-পড়া করুন। আপনার পাঠাগারকে সাজিয়ে-গুছিয়ে পরিপাটি করে রাখুন। আপনার বাড়িতে কোন কিছু এটে দিন, অথবা অন্যের উপকার করুন যাতে করে আপনি আপনার অকৰ্মণ্যতাকে শেষ করে দিতে পারেন বা কাটিয়ে উঠতে পারেন। আমি আন্তরিকভাবে আপনার কল্যাণ কামনা করি বিধায় আমি একথা বলছি। কাজ করে করে একঘেয়েমি জনিত বিরক্তি বিনাশ করে দিন। আপনি যখন শুধুমাত্র এ সাধারণ নীতি কথাটাই মানবেন তখন আপনি কমপক্ষে পঞ্চাশভাগ সুখের পথ পাড়ি দিলেন। কৃষক, কাঠমিস্ত্রি ও রুটি প্রস্তুতকারীকে দেখুন এবং ভালভাবে লক্ষ্য করুন তাড়া কাজের সময় কীভাবে পাখির মতো সুরেলা কণ্ঠে গান গেয়ে যায়, কারণ তারা পরিতৃপ্ত। তারপরে নিজের অবস্থা ভালোভাবে বিবেচনা করুন যে, সর্বদা নিজেকে নিপীড়ন করে, সর্বদা অত্যন্ত শোচনীয়ভাবে চোখের পানি মুছতে মুছতে কীভাবে আপনার বিছানার উপর গড়াগড়ি খাচ্ছেন।
নিজেকে অন্য মানুষে রূপান্তরিত করবেন না, অন্যের অনুকরণ করবেন না। নিজেদের কন্ঠস্বর, চালচলন, আচার-আচারণ, স্বভাব ও অভ্যাসকে ভুলে যাওয়ার ভান করে। এর যে সমস্ত কুফল দেখা দেয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- কৃত্রিমতা, অশান্তি ও নিজের স্বতন্ত্র সত্তার বিনাশ।
আদম (আঃ) থেকে সর্বশেষ জন্মগ্রহণকারী শিশু পর্যন্ত কোন দুটি মানুষই দেখতে হুবহু একই রকম নয়। তবে কেন তাদেরকে অভ্যাস ও রুচিতে একই রকম হতে হবে?
আপনি অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ- অতীতে কেউই আপনার মতো হয়নি আর ভবিষ্যতেও কেউই আপনার মতো হবেন না। যদু বা মধু থেকে আপনি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। সুতরাং অন্যকে অনুকরণ ও নকল করার প্রবণতা নিজের উপর জোর করে চাপিয়ে দিবেন না। নিজের স্বভাব ও ঝোঁক অনুসারেই সামনে এগিয়ে চলুন। (এখানে নিজের স্বভাব ও ঝোক বলতে নিজের সৎ স্বভাব ও ভালো ঝোঁকের কথাই বলা হয়েছে। পক্ষান্তরে অনুকরণ না করা বলতে অন্যের কৃত্রিম ও কপট আচরণ তথা যেগুলো স্বভাবজাত না হওয়ার কারণে অনুকরণ করতে কষ্ট হয় সেগুলো অনুকরণ করতে নিষেধ করা হয়েছে। কেননা ইসলামের নীতি ও আদর্শের অনুকরণ ও অনুসরণ জরুরী -অনুবাদক ।)
قَدْ عَلِمَ كُلُّ أُنَاسٍ مَشْرَبَهُمْ
"প্রতিটি (দলের) লোকই নিজ নিজ পানির ঘাট চিনে নিয়েছিল”। (২-সূরা বাকারা: আয়াত-৬০)
وَلِكُلٍّ وِجْهَةٌ هُوَ مُوَلِّيهَا فَاسْتَبِقُوا الْخَيْرَاتِ
প্রত্যেক জাতিরই একটি কেবলা আছে, যে দিকে সে অভিমুখী হয়, সুতরাং সৎকাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ুন। (২-সূরা বাকারা: আয়াত ১৪৮)
আপনাকে যেভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে সেভাবেই থাকুন এবং আপনার কণ্ঠস্বর পরিবর্তন করবেন না অথবা আপনাকে বদলাবেন না। কুরআন হাদীসে যা পাওয়া যায় তার অনুসরণ করে আপনার ব্যক্তিত্বের বিকাশ সাধন করুন।
অন্যদেরকে অনুকরণ করে ও নিজের স্বতন্ত্র অস্তিত্বের অধিকার বঞ্চিত করে নিজের অস্তিত্বকে শূন্য করে দিবেন না।
আপনার রুচি ও পছন্দ একান্ত আপনারই এবং আমরাও চাই যে আপনি যেমন আছেন তেমনই থাকুন, বিশেষ করে এজন্য যে, ওভাবেই আপনাকে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং আমরাও আপনাকে ওরকম বলেই জানি।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আর তোমাদের কেউ যেন অন্যের অনুকরণকারী না হয়।
চরিত্র, ধর্ম ও গুণের সংজ্ঞায় (পরিচয় দিতে গেলে) বলতে হয় যে, মানুষেরা গাছ-পালার মতো : টক-মিষ্টি, লম্বা-খাটো ইত্যাদি।
(অথাৎ গাছ-পালা যেমন কোনটি লম্বা হয় আবার কোনটি খাট হয়, মানুষও কেউ লম্বা হয় কেউ খাট হয়। গাছপালা (এর ফল-পাতা, ছাল-বাকল বা শিকড়) যেমন কোনটি মিষ্টি আবার কোনটি টক। মানুষও কেউ মিষ্টি পছন্দ করে আবার কেউ টক পছন্দ করে। সুতরাং আপনি খাট তাই লম্বা হওয়ার চেষ্টা করা অস্বাভাবিক ও তাই কষ্টকর। অনুরূপভাবে আপনি মিষ্টি খেতে ভালোবাসেন কিন্তু অন্যের অনুকরণে টক খেতে অভ্যস্ত হতে চাওয়া অস্বাভাবিক ও আপনার জন্য কষ্টদায়ক। -অনুবাদ)
আপনার সৌন্দর্য ও ব্যঞ্জনা আপনার স্বাভাবিক অবস্থা বজায় রাখছে। (সুতরাং অন্যের অনুকরণ করে অন্যের মতো হতে চেয়ে এগুলোর বিকৃতি সাধন করে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না। -অনুবাদক।) আমাদের বিভিন্ন বর্ণ, ভাষা, মেধা ও যোগ্যতা আমাদের শক্তিমান মহান স্রষ্টারই নিদর্শন; তাই ঐগুলোকে অস্বীকার করবেন না (অর্থাৎ ঐগুলোর স্বাভাবিকতাকে অস্বীকার করে অন্যের মতো হওয়ার জন্য অন্যের অনুকরণ করে নিজের ক্ষতি করবেন না। -অনুবাদক)