উমরা

বাংলাদেশী হাজীদের অধিকাংশই তামাত্তু হজ করে থাকেন। আর তামাত্তু হজের প্রথম কাজ উমরা আদায় করা। তাই নিম্নে উমরা আদায়ের পদ্ধতি বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

উমরার পরিচয় :

ইহরাম বাঁধা, তাওয়াফ করা, দুই পর্বতের মধ্যবর্তী স্থানে দৌড়ানো এবং মাথার চুল মুণ্ডানো বা ছোট করা- এই ইবাদত সমষ্টির নাম উমরা। এসবের বিস্তারিত বিবরণ নিম্নরূপ :

প্রথম. ইহরাম :

যেভাবে ফরয গোসল করা হয় মীকাতে পৌঁছার পর সেভাবে গোসল করা সুন্নত। যায়েদ ইবন সাবিত রা. বর্ণিত হাদীসে যেমন উল্লিখিত হয়েছে :

«أَنَّهُ رَأَى النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم تَجَرَّدَ لإِهْلاَلِهِ وَاغْتَسَلَ».

তিনি দেখেন, ‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইহরামের জন্য আলাদা হলেন এবং গোসল করলেন।’[1]

ইহরাম-পূর্ব এই গোসল পুরুষ-মহিলা সবার জন্য এমনকি হায়েয ও নিফাসবতী মহিলার জন্যও সুন্নত। কারণ, বিদায় হজের সময় যখন আসমা বিনতে উমাইস রা.-এর পুত্র মুহাম্মদ ইবন আবূ বকর জন্ম গ্রহণ করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার উদ্দেশ্যে বলেন,

«اغْتَسِلِى وَاسْتَثْفِرِى بِثَوْبٍ وَأَحْرِمِى».

‘তুমি গোসল করো, কাপড় দিয়ে রক্ত আটকাও এবং ইহরাম বেঁধে নাও।’[2]

অতপর নিজের কাছে থাকা সর্বোত্তম সুগন্ধি মাথা ও দাড়িতে ব্যবহার করবেন। ইহরামের পর এর সুবাস অবশিষ্ট থাকলেও তাতে কোন সমস্যা নেই। আয়েশা সিদ্দিকা রা. কর্তৃক বর্ণিত হাদীস থেকে যেমনটি জানা যায়, তিনি বলেন,

«كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم إِذَا أَرَادَ أَنْ يُحْرِمَ يَتَطَيَّبُ بِأَطْيَبِ مَا يَجِدُ ثُمَّ أَرَى وَبِيصَ الدُّهْنِ فِى رَأْسِهِ وَلِحْيَتِهِ بَعْدَ ذَلِكَ».

‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইহরামের প্রস্তুতিকালে তাঁর কাছে থাকা উত্তম সুগন্ধি ব্যবহার করতেন। ইহরামের পরও আমি তাঁর চুল ও দাড়িতে এর তেলের উজ্জ্বলতা দেখতে পেতাম।’[3]

প্রয়োজন মনে করলে এ সময় বগল ও নাভীর নিচের পশম পরিষ্কার করবেন; নখ ও গোঁফ কর্তন করবেন। ইহরামের পর যাতে এসবের প্রয়োজন না হয়- যা তখন নিষিদ্ধ থাকবে। এসব কাজ সরাসরি সুন্নত নয়। ইবাদতের পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে এসব করা উচিত। ইহরাম বাঁধার অল্পকাল আগে যদি এসব কাজ করে ফেলা হয় তাহলে ইহরাম অবস্থায় আর এসব করতে হবে না। এ থেকে আবার অনেকে ইহরামের আগে মাথার চুল ছোট করাও সুন্নত মনে করেন। ধারণাটি ভুল। আর এ উপলক্ষে দাড়ি কাটার তো প্রশ্নই ওঠে না। কারণ, দাড়ি কাটা সবসময়ই হারাম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«خَالِفُوا الْمُشْرِكِينَ وَفِّرُوا اللِّحَى وَأَحْفُوا الشَّوَارِبَ».

‘তোমরা মুশরিকদের বিরুদ্ধাচারণ করো। দাড়ি লম্বা করো এবং গোঁফ ছোট করো।’[4]

গোসল, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও সুগন্ধি ব্যবহার-এসব পর্ব সমাপ্ত করার পর ইহরামের পোশাক পরবেন। সম্ভব হলে কোন নামাজের পর এটি পরিধান করবেন। যদি এসময় কোন ফরয সালাত থাকে তাহলে তা আদায় করে ইহরাম বাঁধবেন। যেমনটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করেছেন। নয়তো দু’রাকা‘আত ‘তাহিয়্যাতুল উযু’ সালাত পড়ে ইহরামের কাপড় পরিধান করবেন।

জেনে নেয়া ভালো, পুরুষদের ইহরামের পোশাক হলো, চাদর ও লুঙ্গি। তবে কাপড় দু’টি সাদা ও পরিষ্কার হওয়া মুস্তাহাব। পক্ষান্তরে মহিলারা ইহরামের পোশাক হিসেবে যা ইচ্ছে তা পরতে পারবেন। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে পোশাকটি যেন ছেলেদের পোশাক সদৃশ না হয় এবং তাতে মহিলাদের সৌন্দর্যও প্রস্ফূটিত না হয়। অনুরূপভাবে তারা নেকাব দ্বারা চেহারা আবৃত করবেন না। হাত মোজাও পরবেন না। তবে পর পুরুষের মুখোমুখি হলে চেহারায় কাপড় টেনে দেবেন। ইহরাম অবস্থায় জুতোও পরতে পারবেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«وَلْيُحْرِمْ أَحَدُكُمْ فِي إِزَارٍ وَرِدَاءٍ ، وَنَعْلَيْنِ ، فَإِنْ لَمْ يَجِدْ نَعْلَيْنِ فَلْيَلْبَسْ خُفَّيْنِ ، وَلْيَقْطَعْهُمَا حَتَّى يَكُونَا أَسْفَلَ مِنَ الْعَقِبَيْنِ».

‘তোমাদের প্রত্যেকে যেন একটি লুঙ্গি, একটি চাদর ও একজোড়া জুতো পরে ইহরাম বাঁধে। যদি জুতা না থাকে তাহলে মোজা পরবে। আর মোজা জোড়া একটু কেটে নেবে যেন তা পায়ের গোড়ালীর চেয়ে নিচু হয়।’[5]

উল্লিখিত সবগুলো কাজ শেষ হবার পর অন্তর থেকে উমরা শুরুর নিয়ত করবেন। আর বলবেন, لَبَّيْكَ عُمْرَةً (‘লাব্বাইকা উমরাতান’) অথবা لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ عُمْرَةً (‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা উমরাতান’)। উত্তম হলো, বাহনে চড়ার পর ইহরাম বাঁধা ও তালবিয়া পড়া। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মীকাত থেকে রওনা হবার উদ্দেশ্যে বাহনে চড়ে বসেছেন তারপর সেটি নড়ে উঠলে তিনি তালবিয়া পড়া শুরু করেছেন।

আর যে ব্যক্তি উমরার উদ্দেশ্যে ইহরাম বাঁধবে সে যদি রোগ বা অন্য কিছুর আশংকা করেন, যা তার উমরার কাজ সম্পাদনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে, তাহলে উমরা শুরুর প্রাক্কালে এভাবে নিয়ত করবেন,

«اللَّهُمَّ مَحِلِّي حَيْثُ حَبَسْتَنِي».

(আল্লাহুম্মা মাহাল্লী হায়ছু হাবাসতানী।)

‘হে আল্লাহ, আপনি আমাকে যেখানে আটকে দেবেন, সেখানেই আমি হালাল হয়ে যাব।’[6] অথবা বলবেন,

«لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ لَبَّيْكَ ، وَمَحِلِّي مِنَ الأَرْضِ حَيْثُ تَحْبِسُنِي».

(লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, ওয়া মাহাল্লী মিনাল আরদি হায়ছু তাহবিসুনী)

‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক। আর যেখানে আপনি আমাকে আটকে দেবেন, সেখানেই আমি হালাল হয়ে যাব।’[7] কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুবা‘আ বিনতে জুবায়ের রা. কে এমনই শিক্ষা দিয়েছেন।

এসব কাজ সম্পন্ন করার পর অধিকহারে তালবিয়া পড়তে থাকুন। কারণ তালবিয়া হজের শব্দগত নিদর্শন। বিশেষত স্থান, সময় ও অবস্থার পরিবর্তনকালে বেশি বেশি তালবিয়া পড়বেন। যেমন : উচ্চস্থানে আরোহন বা নিম্নস্থানে অবতরণের সময়, রাত ও দিনের পরিবর্তনের সময় (সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তকালে), কোন অন্যায় বা অনুচিত কাজ হয়ে গেলে এবং সালাত শেষে- ইত্যাদি সময়ে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তালবিয়া পড়তেন এভাবে :[8]

«لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ لَبَّيْكَ لَبَّيْكَ لاَ شَرِيكَ لَكَ لَبَّيْكَ إِنَّ الْحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكَ لاَ شَرِيكَ لَك».

(লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারীকা লাকা লাব্বাইকা, ইন্নাল হামদা ওয়ান নি‘মাতা লাকা ওয়াল মুল্ক, লা শারীকা লাক।) কখনো এর সাথে একটু যোগ করে এভাবেও পড়তেন :[9]

لَبَّيْكَ إِلَهَ الْحَقِّ ، لَبَّيْكَ.

(লাব্বাইক ইলাহাল হাক্ক লাব্বাইক)।

ইহরাম পরিধানকারী যদি لَبَّيْكَ ذَا الْمَعَارِجِ (লাব্বাইকা যাল মা‘আরিজ) তালবিয়ায় যোগ করেন, তাও উত্তম। বিদায় হজে সাহাবীরা তালবিয়ায় নানা শব্দ সংযোজন করছিলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেসব শুনেও তাঁদের কিছু বলেননি।[10]

যদি তালবিয়ায় এভাবে সংযোজন করে :

لَبَّيْكَ لَبَّيْكَ وَسَعْدَيْكَ وَالْخَيْرُ بِيَدَيْكَ لَبَّيكَ وَالرَّغْبَاءُ إِلَيْكَ وَالْعَمَلُ.

(লাব্বাইক, লাব্বাইকা ওয়া সা‘দাইকা ওয়াল খইরা বিইয়াদাইকা, লাব্বাইকা ওয়ার রগবাউ ইলাইকা ওয়াল আমাল)। তবে তাতেও কোন অসুবিধে নেই। কারণ উমর রা. ও তাঁর পুত্র আবদুল্লাহ রা. থেকে এ ধরনের বাক্য সংযোজনের প্রমাণ রয়েছে।[11]

পুরুষদের জন্য তালবিয়া উচ্চস্বরে বলা সুন্নত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«أَتَانِى جِبْرِيلُ فَأَمَرَنِى أَنْ آمُرَ أَصْحَابِى وَمَنْ مَعِى أَنْ يَرْفَعُوا أَصْوَاتَهُمْ .بِالإِهْلاَلِ - أَوْ قَالَ – بِالتَّلْبِيَةِ».

‘আমার কাছে জিবরীল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এলেন। তিনি আমাকে (উচ্চস্বরে তালবিয়া পড়তে) নির্দেশ দিলেন এবং এ মর্মে আমার সাহাবী ও সঙ্গীদের নির্দেশ দিতে বললেন যে, তারা যেন ইহলাল অথবা তিনি বলেছেন তালবিয়া উঁচু গলায় উচ্চারণ করে।[12]

তাছাড়া তালবিয়া জোরে উচ্চারণের মাধ্যমে আল্লাহর নিদর্শনের প্রকাশ ঘটে, একত্ববাদের দীপ্ত ঘোষণা হয় এবং শিরক থেকে পবিত্রতা প্রকাশ করা হয়। পক্ষান্তরে মহিলাদের জন্য সকল আলেমের ঐকমত্যে তালবিয়া, যিকির ও দো‘আ ইত্যাদি শাব্দিক ইবাদতে স্বর উঁচু না করা সুন্নত। এটাই পর্দা রক্ষা এবং ফিতনা দমনে সহায়ক।

[1]. তিরমিযী : ৮৩০; ইবন খুযাইমা : ২৫৯৫; বাইহাকী : ৮৭২৬।

[2]. প্রাগুক্ত।

[3]. বুখারী : ৫৯২৩; মুসলিম : ১১৭০।

[4]. বুখারী : ৫৮৯২; মুসলিম : ২৯৫।

[5]. মুসনাদ আহমাদ : ৯৯৮৪; ইবন খুযাইমা : ১০৬২।

[6]. বুখারী : ৫০৮৯; মুসলিম : ১২০৭।

[7]. নাসায়ি : ২৭৬৬।

[8]. বুখারী : ১৫৭৪; মুসলিম : ১২১৮।

[9]. ইবন মাজাহ্‌ : ২৯২০।

[10]. মুসনাদ : ১৪৪৪০।

[11]. বুখারী : ১৫৪৯, মুসলিম : ১১৮৪।

[12]. আবু দাউদ : ১৮১৪।
ইহরামের আগে ও পরে হজ-উমরাকারীরা যেসব ভুল করে থাকেন

১. সমুদ্র বা আকাশ পথে মীকাতের সমান্তরাল হলে ইহরাম না বেঁধে বিমান অবতরণ করা পর্যন্ত দেরি করা। এটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএর বাণীর পরিপন্থী। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«هُنَّ لَهُنَّ وَلِمَنْ أَتَى عَلَيْهِنَّ مِنْ غَيْرِهِنَّ مِمَّنْ أَرَادَ الْحَجَّ وَالْعُمْرَةَ.»

‘এই মীকাতগুলো এসবের অধিবাসী এবং এসব স্থানে পদার্পণকারী বহিরাগত প্রতিটি হজ ও উমরাকারীর জন্য ইহরাম বাঁধার স্থান।’[1]

অতএব বিমানে বা জাহাজে আগমনকারীর কর্তব্য হলো, মীকাতে পৌঁছার আগেই ইহরামের পোশাক পরে নেবে কিংবা ইহরামের কাপড় হাতে নিয়ে রাখবে, যাতে মীকাতে পৌঁছামাত্র তা পরে নিতে পারে। যে বিমানে ইহরামের পোশাক পরার কথা ভুলে যায় কিংবা তার পক্ষে ব্যাগ থেকে কাপড় বের করা সম্ভব না হয়, সে তার পরিধেয় বস্ত্র খুলে একটি চাদর ও একটি লুঙ্গি পরে নেবে। যদি লুঙ্গি পরার সুযোগ না পায় তাহলে আপাতত পাজামা বা প্যান্ট পরেই লজ্জাস্থান ঢাকবে। তারপর যখন সুযোগ পাবে, পাজামা খুলে ইহরামের কাপড় পরে নেবে। এ জন্য তাকে কোন ক্ষতিপূরণ দিতে হবে না। কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :

«مَنْ لَمْ يَجِدْ إِزَارًا فَلْيَلْبَسِ السَّرَاوِيلَ.»

‘যার লুঙ্গি নাই সে পাজামা পরে নেবে।’[2]

২. অনেক মহিলা ধারণা করেন, ইহরামের জন্য কালো, সবুজ বা সাদা এ জাতীয় বিশেষ পোশাক রয়েছে। এর কোন ভিত্তি নেই। মহিলারা যেকোনো কাপড় পরিধান করতে পারবেন। তবে পোশাকটি সৌন্দর্য প্রদর্শনে সহায়ক কিংবা পুরুষ বা অমুসলিমদের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হতে পারবে না।

৩. অনেকের ধারণা, ইহরামের পোশাক ময়লা হলে বা ছিঁড়ে গেলেও পরিবর্তন করা যায় না। এটা ঠিক নয়। সঠিক হল, মুহরিমের জন্য ইহরামের পোশাক খোলা এবং যখন ইচ্ছা পরিবর্তন করার অনুমতি রয়েছে।

৪. অনেক মহিলা তার চেহারা ও নেকাবের মধ্যস্থানে কাঠ বা এ জাতীয় কিছু রাখেন। যাতে নেকাব তার চেহারা স্পর্শ না করে। এও এক ভিত্তিহীন লৌকিকতা। ইসলামের সূচনা যুগের কোন মুসলিম মহিলা এমন করেননি; বরং মহিলারা পরপুরুষ সামনে এলে মুখে নেকাব না দিয়ে ওড়না ঝুলিয়ে চেহারা আড়াল করবে। পরপুরুষ না থাকলে মুখ খোলা রাখবেন। ওড়না তার চেহারা স্পর্শ করলেও কোন সমস্যা নেই।

৫. উমরা বা হজ করার নিয়ত করেও অনেক মহিলা হায়েয বা নিফাস অবস্থায় মীকাত থেকে ইহরাম বাঁধেন না। এ এক প্রকাশ্য ভুল। নিফাস বা হায়েযবতী মহিলার জন্যও মীকাত থেকে ইহরাম বাঁধা ফরয। উপরন্তু নিফাস বা হায়েযবিহীন স্বাভাবিক মহিলাদের মতো তাদের জন্যও গোসল ও পবিত্রতা অর্জন করার বিধান রাখা হয়েছে। নিফাস ও হায়েযবতী মহিলারা অন্যসব হজ ও উমরাকারীর ন্যায় সবই করতে পারবেন। কেবল পবিত্র হওয়ার আগ পর্যন্ত বাইতুল্লাহ্‌র তাওয়াফ করতে পারবেন না। কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসমা বিনতে উমাইসকে মীকাতে (বাচ্চা প্রসব করার পর) নিফাস শুরু হলে বলেন,

«اغْتَسِلِى وَاسْتَثْفِرِى بِثَوْبٍ وَأَحْرِمِى.»

‘গোসল করো, কাপড় দিয়ে রক্ত আটকাও আর ইহরাম বেঁধে নাও।’[3] আর ইহরাম অবস্থায় আয়েশা রা.-এর ঋতুস্রাব শুরু হলে তাঁর উদ্দেশ্যে তিনি বলেন,

«إِنَّ هَذَا أَمْرٌ كَتَبَهُ اللَّهُ عَلَى بَنَاتِ آدَمَ فَاقْضِي مَا يَقْضِي الْحَاجُّ غَيْرَ أَنْ لاَ تَطُوفِي بِالْبَيْتِ».

‘এটি এমন এক বিষয় যা আল্লাহ তা‘আলা আদম কন্যাদের ওপর লিখে দিয়েছেন। (এটা তো হবেই) সুতরাং তুমি অন্য হাজীদের মতো সবই করতে পারবে, কেবল বাইতুল্লাহ্‌র তাওয়াফ করবে না।’[4]

৬. ইহরামের সময় দুই রাকা‘আত সালাত পড়া ওয়াজিব মনে করা।

৭. অনেকে ইহরামের পোশাক পরলেই ইহরামের নিষিদ্ধ কাজগুলো থেকে বিরত থাকতে হবে বলে মনে করেন; কিন্তু সঠিক হল, বান্দা ইহরাম বাঁধার নিয়ত করলেই কেবল ওইসব কাজ নিষিদ্ধ হয়। চাই তিনি তার আগে ইহরামের পোশাক পরুন বা তার পরে।

৮. অনেকে শিশু-কিশোরদের ইহরামের পর তাদেরকে ক্লান্ত দেখে হজ ভেঙ্গে দেয়। এটিও ভুল। বরং শিশুর অভিভাবকের উচিত, তাকে হজের কার্যাদি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে সমর্থন ও সহযোগিতা করা। যেগুলো সে আদায় করতে পারবে না, অভিভাবক তার পক্ষে সেগুলো আদায় করবেন।

৯. সমবেত কণ্ঠে তালবিয়া পড়া শরীয়ত কর্তৃক অনুমোদিত নয়। কারণ, তালবিয়া এমন একটি ইবাদত যা কেবল সেভাবেই করা যায় যেভাবে তা বর্ণিত হয়েছে। আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বা তাঁর সাহাবায়ে কিরাম সমবেতকণ্ঠে তালবিয়া পড়েছেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না।

১০. অনর্থক কথা বা কাজ এবং যা পরে করলেও চলে এমন কাজে লিপ্ত হয়ে তালবিয়া পড়া থেকে বিরত থাকা। এর চেয়েও ভয়ানক ব্যাপার হলো, গীবত, চোগলখোরি কিংবা গান বা অনর্থক কোন কাজে মূল্যবান সময় নষ্ট করা।

[1]. বুখারী : ১৫২৪, মুসলিম : ১১৮১।

[2]. বুখারী : ১৮৪৩, মুসলিম : ১১৭৮।

[3]. প্রাগুক্ত।

[4]. বুখারী : ২৯৪; মুসলিম : ১২১১।

পবিত্র মক্কায় প্রবেশের সময় প্রত্যেক ব্যক্তির উচিত, আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও মাহাত্মের কথা স্মরণ করা। মনকে নরম করা। আল্লাহর কাছে পবিত্র মক্কা যে কত সম্মানিত ও মর্যাদাপূর্ণ তা স্মরণ করা। পবিত্র মক্কায় থাকা অবস্থায় পবিত্র মক্কার যথাযথ মর্যাদা দেয়ার চেষ্টা করা। হজ ও উমরাকারী ব্যক্তির ওপর পবিত্র মক্কায় প্রবেশের পর নিম্নরূপে আমল করা মুস্তাহাব।

১. উপযুক্ত কোন স্থানে বিশ্রাম নেয়া, যাতে তাওয়াফের পূর্বে সফরের ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। শরীরের স্বতস্ফূর্ততা ফিরে আসে। বিশ্রাম নিতে না পারলেও কোন সমস্যা নেই। ইবন উমর রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

«بَاتَ رسول الله صلى الله عليه وسلم بِذِي طُوًى حَتَّى أَصْبَحَ ثُمَّ دَخَلَ مَكَّةَ»

‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (হজের সফরে) যী-তুয়ায় এসে রাত যাপন করলেন। সকাল হওয়ার পর তিনি মক্কায় প্রবেশ করলেন।’[1] ইবন উমর রা. মক্কায় আসলে যী-তুয়ায় রাত যাপন করতেন। ভোর হলে গোসল করতেন। তিনি বলতেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনুরূপ করতেন।[2] বর্তমানে মক্কায় হাজীদের বাসস্থানে গিয়ে গোসল করে নিলেও এ সুন্নত আদায় হয়ে যাবে।

২. মুহরিমের জন্য সবদিক দিয়ে মক্কায় প্রবেশের অবকাশ রয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«وَكُلُّ فِجَاجِ مَكَّةَ طَرِيقٌ».

‘মক্কার প্রতিটি অলিগলিই পথ (প্রবেশের স্থান)।’[3]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাতহার মুয়াল্লার দিক থেকে, যা বর্তমানে হাজূন নামক উঁচু জায়গায় অবস্থিত ‘কাদা’ নামক পথ দিয়ে মক্কায় প্রবেশ করেন এবং নিচু জায়গা অর্থাৎ ‘কুদাই’ নামক পথ দিয়ে বের হন।[4] সুতরাং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএর অনুকরণে কারো পক্ষে মক্কায় প্রবেশ ও প্রস্থান করা সম্ভব হলে তা হবে উত্তম।

কিন্তু বর্তমান-যুগে মোটরযানে করে আপনাকে মক্কায় নেয়া হবে। আপনার বাসস্থানে যাওয়ার সুবিধামত পথেই আপনাকে যেতে হবে। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেদিক থেকে মক্কায় প্রবেশ করেছেন, সেদিন থেকে প্রবেশ করা আপনার জন্য সম্ভব নাও হতে পারে। এতে কোন অসুবিধা নেই। আপনার গাড়ি সুবিধামত যে পথ দিয়ে যাবে, সেপথে দিয়েই আপনি যাবেন। আপনার বাসস্থানে মালপত্র রেখে, বিশ্রাম নিয়ে উমরার প্রস্তুতি নেবেন।

মুহরিম যেকোনো সময় মক্কায় প্রবেশ করতে পারে। তবে দিনের প্রথম প্রহরে প্রবেশ করা উত্তম। ইবন উমর রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘যী-তুয়ায় রাতযাপন করেন। সকাল হলে তিনি মক্কায় প্রবেশ করেন।’[5]

[1]. বুখারী : ১৫৭৪; মুসলিম : ১২৫৯। (বর্তমানে জারওয়াল এলাকায় অবস্থিত প্রসূতি হাসপাতালের জায়গাটির নাম ছিল যী-তুয়া।)

[2]. বুখারী : ৩/৪৩৬; মুসলিম : ২/৯১৯।

[3]. আবূ দাউদ : ১৯৩৭।

[4]. বুখারী : ১৫৭৬।

[5]. প্রাগুক্ত।

বিশ্বের প্রতিটি মুসলিমের অন্তরে রয়েছে পবিত্র মক্কা নগরীর প্রতি গভীর সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ। যিনি হজ বা উমরা করতে চান, অবশ্যই তাকে এ পবিত্র ভূমিতে গমন করতে হবে। তাই এ সম্মানিত শহর সম্পর্কে জানা প্রতিটি মুসলিমের উপর একান্ত কর্তব্য। নিম্নে এই মহান নগরীর কিছু বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হল :

ক. কুরআন কারীমে পবিত্র মক্কা নগরীর কয়েকটি নাম উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন, ১- মক্কা[1]; ২- বাক্কা[2]; ৩- উম্মুল কুরা (প্রধান শহর)[3]; ৪- আল-বালাদুল আমীন (নিরাপদ শহর)[4]। বস্তুত কোন কিছুর নাম বেশি হওয়া তার মাহাত্মের পরিচায়ক।

খ. আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে ওহীর মাধ্যমে হারামের সীমানা নির্ধারিত হয়েছে। জিবরীল আ. কাবাঘরের নির্মাতা ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে হারামের সীমানা দেখিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর দেখানো মতে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তা নির্ধারণ করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএর যুগে হারামের সীমানা সংস্কার করা হয়।[5]

ইমাম নববী রহ. বলেন, হারামের সীমানা সম্পর্কে জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ এর সাথে প্রচুর বিধি-বিধানের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।[6]

গ. মক্কা নগরীতে আল্লাহ তা‘আলার অনেক নিদর্শন রয়েছে: যেমন, আল্লাহ তা‘আলা এ মর্মে বলেন,

﴿ فِيهِ ءَايَٰتُۢ بَيِّنَٰتٞ مَّقَامُ إِبۡرَٰهِيمَۖ ﴾ [ال عمران: ٩٧]

‘তাতে (মক্কা নগরীতে) রয়েছে অনেক সুস্পষ্ট নিদর্শন যেমন মাকামে ইবরাহীম।’[7] কাতাদা ও মুজাহিদ রহ. বলেন, ‘প্রকাশ্য নিদর্শনগুলোর একটি হলো মাকামে ইবরাহীম।’[8]

মূলত মক্কা নগরীর একাধিক নাম, তার সীমারেখা সুনির্ধারিত থাকা, তার প্রাথমিক পর্যায় ও নির্মাণের সূচনা এবং তাকে হারাম ঘোষণার মধ্য দিয়ে এ নগরীর সম্মান ও উঁচু মর্যাদার কথা ফুটে উঠে।

১. আল্লাহ তা‘আলা মক্কা নগরীকে হারাম (সম্মানিত) ঘোষণা করেছেন

আল্লাহ তা‘আলা যেদিন যমীন ও আসমান সৃষ্টি করেছেন সেদিন থেকেই মক্কা ভূমিকে সম্মানিত করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ إِنَّمَآ أُمِرۡتُ أَنۡ أَعۡبُدَ رَبَّ هَٰذِهِ ٱلۡبَلۡدَةِ ٱلَّذِي حَرَّمَهَا﴾ [النمل: ٩١]

‘আমিতো আদিষ্ট হয়েছি এ নগরীর মালিকের ইবাদত করতে যিনি একে সম্মানিত করেছেন।’[9] মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«إِنَّ هَذَا الْبَلَدَ حَرَّمَهُ اللهُ يَوْمَ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضَ فَهُوَ حَرَامٌ بِحُرْمَةِ اللهِ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ».

‘এ শহরটিকে আল্লাহ যমীন ও আসমান সৃষ্টির দিন থেকেই হারাম অর্থাৎ সম্মানিত করেছেন। আল্লাহ কর্তৃক সম্মানিত এ শহরটি কিয়ামত পর্যন্ত সম্মানিত থাকবে।[10]

আল্লাহর খলীল ইবরাহীম আলাইহিস সালাম মক্কাকে হারাম হওয়ার ঘোষণা দেন। আল্লাহর নির্দেশে তিনি আল্লাহর ঘর কা‘বা নির্মাণ করেন এবং একে পবিত্র করেন। অতপর মানুষের উদ্দেশ্যে তিনি হজের ঘোষণা দেন এবং মক্কা নগরীর জন্য দো‘আ করেন। তিনি বলেন,

«إِنَّ إِبْرَاهِيمَ حَرَّمَ مَكَّةَ وَدَعَا لَهَا.»

‘ইবরাহীম মক্কাকে হারাম ঘোষণা করেন এবং শহরটির জন্য দো‘আ করেন।’[11]

২. আল্লাহ মক্কা নগরীর কসম খেয়ে তাকে সম্মানিত করেছেন

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ وَٱلتِّينِ وَٱلزَّيۡتُونِ ١ وَطُورِ سِينِينَ ٢ وَهَٰذَا ٱلۡبَلَدِ ٱلۡأَمِينِ ٣ ﴾ [التين: ١، ٣]

‘কসম তীন ও যাইতূনের। কসম সিনাই পর্বতের। এবং কসম এ নিরাপদ শহরের।’[12] আয়াতে ‘এই নিরাপদ শহর’ বলে মক্কা নগরী বুঝানো হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿ لَآ أُقۡسِمُ بِهَٰذَا ٱلۡبَلَدِ ١ وَأَنتَ حِلُّۢ بِهَٰذَا ٱلۡبَلَدِ ٢ ﴾ [البلد: ١، ٢]

‘আমি কসম করছি এ শহরের। আর আপনি এ শহরের অধিবাসী।’[13]

৩. মক্কা ও এর অধিবাসীর জন্য ইবরাহীম আ. দো‘আ করেছেন

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ وَإِذۡ قَالَ إِبۡرَٰهِيمُ رَبِّ ٱجۡعَلۡ هَٰذَا ٱلۡبَلَدَ ءَامِنٗا وَٱجۡنُبۡنِي وَبَنِيَّ أَن نَّعۡبُدَ ٱلۡأَصۡنَامَ ٣٥ ﴾ [ابراهيم: ٣٥]

‘আর (স্মরণ করুন) যখন ইবরাহীম বলেছিলেন, হে আমার রব! এ শহরকে নিরাপদ করুন এবং আমাকে ও আমার পুত্রগণকে মূর্তি পূজা হতে দূরে রাখুন।’[14]

৪. মক্কা নগরী রাসূলুল্লাহর প্রিয় শহর

ইবন আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হিজরতের সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা শরীফের উদ্দেশ্যে বলেন,

«مَا أَطْيَبَكِ مِنْ بَلَدٍ وَمَا أَحَبَّكِ إِلَيَّ وَلَوْلاَ أَنَّ قَوْمِك أَخْرَجُونِي مِنْكِ مَا سَكَنْتُ غَيْرَكِ».

‘কতই না পবিত্র শহর তুমি! আমার কাছে কতই না প্রিয় তুমি! যদি তোমার কওম আমাকে তোমার থেকে বের করে না দিত তাহলে তুমি ছাড়া অন্য কোন শহরে আমি বসবাস করতাম না।’[15]

৫. দাজ্জাল এ নগরীতে প্রবেশ করতে পারবে না

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«لَيْسَ مِنْ بَلَدٍ إِلاَّ سَيَطَؤُهُ الدَّجَّالُ إِلاَّ مَكَّةَ وَالْمَدِينَةَ لَيْسَ لَهُ مِنْ نِقَابِهَا نَقْبٌ إِلاَّ عَلَيْهِ الْمَلاَئِكَةُ صَافِّينَ يَحْرُسُونَهَا ثُمَّ تَرْجُفُ الْمَدِينَةُ بِأَهْلِهَا ثَلاَثَ رَجَفَاتٍ فَيُخْرِجُ اللهُ كُلَّ كَافِرٍ وَمُنَافِقٍ».

‘এমন কোন ভূখণ্ড নেই যা দাজ্জালের পদভারে মথিত হবে না। তবে মক্কা ও মদীনায় সে প্রবেশ করতে পারবে না। সেখানকার প্রতিটি গলিতে ফেরেশতাগণ সারিবদ্ধভাবে হেফাযতে নিয়োজিত রয়েছে। এরপর মদীনা তার অধিবাসীসহ তিনটি ঝাঁকুনি খাবে। আল্লাহ (মদীনা থেকে) সকল কাফির ও মুনাফিককে বের করে দেবেন।’

৬. ঈমানের প্রত্যাবর্তন

ইবন উমর রা. হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«إِنَّ الإِسْلاَمَ بَدَأَ غَرِيبًا وَسَيَعُودُ غَرِيبًا كَمَا بَدَأَ وَهُوَ يَأْرِزُ بَيْنَ الْمَسْجِدَيْنِ كَمَا تَأْرِزُ الْحَيَّةُ فِى جُحْرِهَا»

‘ইসলামের সূচনা হয়েছিল অপরিচিত হিসেবে এবং সূচনা কালের মতই আবার তা অপরিচিত অবস্থার দিকে ফিরে যাবে। আর তা পুনরায় দু’টি মসজিদে ফিরে আসবে, যেমন সাপ নিজ গর্তে ফিরে আসে।’[16]

ইমাম নববী রহ. বলেন, ‘দু’টি মসজিদ দ্বারা মক্কা ও মদীনার মসজিদকে বুঝানো হয়েছে।’[17]

৭. মসজিদুল হারামে সালাত আদায়ের সওয়াব

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«صَلاَةٌ فِى مَسْجِدِى هَذَا أَفْضَلُ مِنْ أَلْفِ صَلاَةٍ فِيمَا سِوَاهُ إِلاَّ الْمَسْجِدَ الْحَرَامَ وَصَلاَةٌ فِى الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ أَفْضَلُ مِنْ مِائَةِ أَلْفِ صَلاَةٍ فِيمَا سِوَاهُ».

‘আমার মসজিদে একবার সালাত আদায় মসজিদে হারাম ছাড়া অন্যান্য মসজিদে হাজার বার সালাত আদায়ের চেয়ে বেশি উত্তম। তবে মসজিদুল হারামে একবার সালাত আদায় অন্যান্য মসজিদের তুলনায় এক লক্ষ গুণ বেশি।’[18] মসজিদে হারাম বলতে কেউ কেউ শুধু কা‘বার চতুষ্পার্শ্বস্থ সালাত আদায় করার স্থান বা মসজিদকে বুঝেছেন; কিন্তু অধিকাংশ শরীয়তবিদের মতে, হারামের সীমারেখাভুক্ত পূর্ণ এলাকা মসজিদে হারামের আওতাভুক্ত। প্রসিদ্ধ তাবেঈ ‘আতা ইবন আবী রাবাহ আল-মককী রহ. যিনি মসজিদে হারামের ইমাম ছিলেন। তাঁকে একবার রাবী‘ ইবন সুবাইহ প্রশ্ন করলেন, ‘হে আবূ মুহাম্মাদ! মসজিদে হারাম সম্পর্কে যে ফযীলত বর্ণিত হয়েছে এটা কি কেবল মসজিদের জন্য, না সম্পূর্ণ হারাম এলাকার জন্য?’ জবাবে আতা’ রহ. বললেন, এর দ্বারা সম্পূর্ণ হারাম এলাকাই বুঝানো হয়েছে। কারণ হারাম এলাকার সবটাই মসজিদ বলে গণ্য করা হয়।’[19] অধিকাংশ আলেম এ মতটিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন।[20]

সুতরাং বুঝা যাচ্ছে যে, পবিত্র মক্কা নগরীর হারাম এলাকার যেখানেই সালাত আদায় করা হবে, সেখানেই এক সালাতে এক লক্ষ সালাতের সওয়াব পাওয়া যাবে।

[1]. ফাতহ : ২৪।

[2]. আলে ইমরান : ৯৬।

[3]. শূরা : ৭।

[4]. তীন : ৩।

[5]. আল-ইসাবা : ১/১৮৩।

[6]. তাহযীবুল আসমা ওয়াল লুগাত : ৩/৮২।

[7]. আলে-ইমরান : ৯৭।

[8]. তাফসীরে তাবারী : ৪/৮।

[9]. নামল ৯১।

[10]. মুসলিম ১৩৫৩।

[11]. বুখারী : ১৮৮৩; মুসলিম : ১৩৮৩।

[12]. তীন : ১-৩।

[13]. বালাদ : ১-২।

[14]. ইবরাহীম : ৩৫-৩৭।

[15]. আল-মু‘জামুল কাবীর : ১০৪৭৭।

[16]. সহীহুত-তারগীব ওয়াত-তারহীব : ১১৭৩।

[17]. মুসলিম : ৩৯০।

[18]. মুসনাদে আহমাদ ৩/৩৪৩; ইবন মাজাহ্‌ ১৪০৬; সহীহ ইবন খুযাইমা ১১৫৫।

[19]. মুসনাদুত তায়ালিসী : ১৪৬৪।

[20]. আল-ইখতিয়ারাতুল ফিকহিয়্যা লি ইবন তাইমিয়া : পৃ. ১১৩; ইবনুল কায়্যিম, যাদুল মা‘আদ ৩/৩০৩-৩০৪; মাজমূ‘ ফাতাওয়া ইবন বায : ৪/১৪০।

১. মক্কা নগরীতে কোন পাপের ইচ্ছা করা

মক্কা মুকাররমায় পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার ব্যাপারে কুরআনুল কারীমে কঠোর সাবধানবাণী এসেছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ وَمَن يُرِدۡ فِيهِ بِإِلۡحَادِۢ بِظُلۡمٖ نُّذِقۡهُ مِنۡ عَذَابٍ أَلِيمٖ ٢٥ ﴾ [الحج: ٢٥]

‘আর এখানে যে সামান্যতম পাপাচারের ইচ্ছে পোষণ করবে তাকে আমি অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি প্রদান করব।’[1]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তিন ধরনের লোক আল্লাহর কাছে বেশি ঘৃণিত। হারাম শরীফের মধ্যে অন্যায়কারী, ইসলামের ভেতরে জাহিলি রীতি-নীতি অন্তর্ভুক্তকারী এবং অন্যায়ভাবে কোন ব্যক্তিকে হত্যাকারী।’[2]

এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, কুরআনের উল্লেখিত আয়াতে অন্যায় কর্মের নিছক ইচ্ছা পোষণ করার জন্য কঠিন শাস্তির হুমকি প্রদর্শন করা হয়েছে যদিও সে বাস্তবে সে ইচ্ছা পূরণ করেনি। তাহলে যে বাস্তবে অন্যায় করবে তার অবস্থা কেমন হবে? তাই আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেছেন, ইয়ামানে অবস্থিত এডেন শহরে বসবাসকারী কোন ব্যক্তি যদি হারামে কোন ধরনের অন্যায়ের ইচ্ছা পোষণ করে তাহলে আল্লাহ তাকে কঠিন শাস্তি প্রদান করবেন![3]

২. মক্কাবাসিদের কষ্ট দেয়া ও সেখানে যুদ্ধ-বিগ্রহ করা

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ وَإِذۡ جَعَلۡنَا ٱلۡبَيۡتَ مَثَابَةٗ لِّلنَّاسِ وَأَمۡنٗا ﴾ [البقرة: ١٢٥]

‘আর স্মরণ করুন, যখন আমি কা‘বা ঘরকে মানুষের জন্য মিলনকেন্দ্র এবং শান্তির আলোয় করলাম।’[4] তিনি আরো বলেন,

﴿ وَٱلتِّينِ وَٱلزَّيۡتُونِ ١ وَطُورِ سِينِينَ ٢ وَهَٰذَا ٱلۡبَلَدِ ٱلۡأَمِينِ ٣ ﴾ [التين: ١، ٣]

‘তীন, যাইতুন, তূর পর্বত এবং এ নিরাপদ শহরের শপথ।’[5] আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿ أَوَ لَمۡ يَرَوۡاْ أَنَّا جَعَلۡنَا حَرَمًا ءَامِنٗا وَيُتَخَطَّفُ ٱلنَّاسُ مِنۡ حَوۡلِهِمۡۚ أَفَبِٱلۡبَٰطِلِ يُؤۡمِنُونَ وَبِنِعۡمَةِ ٱللَّهِ يَكۡفُرُونَ ٦٧ ﴾ [العنكبوت: ٦٧]

‘তারা কি দেখে না যে, আমি (মক্কাকে) নিরাপদ পবিত্র অঞ্চল বানিয়েছি, অথচ তাদের আশপাশ থেকে মানুষদেরকে ছিনিয়ে নেয়া হয়? তাহলে কি তারা অসত্যেই বিশ্বাস করবে এবং আল্লাহর নিআমতকে অস্বীকার করবে?’[6] এ কারণেই মক্কা নগরীতে বিনা প্রয়োজনে অস্ত্রধারণ করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«لاَ يَحِلُّ لأَحَدٍ أَنْ يَحْمِلَ السِّلاَحَ بِمَكَّةَ».

‘মক্কা নগরীতে কারো জন্য অস্ত্র বহন করা বৈধ নয়।’[7]

অতএব হারাম শরীফে অবস্থানকারী ও আগমনকারী সকলকে সাবধান থাকতে হবে যে, হারাম শরীফের পবিত্রতা যেন নষ্ট না হয়, আর এখানকার কোন লোকের কষ্ট ও যেন না হয়। এমনকি কোন ধরনের ভীতি প্রদর্শনও অবৈধ। এগুলো জঘন্য অপরাধের অন্তর্ভুক্ত।

৩. মক্কা নগরীতে কাফের ও মুশরিকদের প্রবেশ করা

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ إِنَّمَا ٱلۡمُشۡرِكُونَ نَجَسٞ فَلَا يَقۡرَبُواْ ٱلۡمَسۡجِدَ ٱلۡحَرَامَ بَعۡدَ عَامِهِمۡ هَٰذَاۚ وَإِنۡ خِفۡتُمۡ عَيۡلَةٗ فَسَوۡفَ يُغۡنِيكُمُ ٱللَّهُ مِن فَضۡلِهِۦٓ إِن شَآءَۚ إِنَّ ٱللَّهَ عَلِيمٌ حَكِيمٞ ٢٨ ﴾ [التوبة: ٢٨]

‘হে ঈমানদারগণ, নিশ্চয় মুশরিকরা নাপাক, সুতরাং তারা যেন মসজিদুল হারামের নিকটবর্তী না হয় তাদের এ বছরের পর। আর যদি তোমরা দারিদ্র্যকে ভয় কর, তবে আল্লাহ চাইলে নিজ অনুগ্রহে তোমাদের অভাবমুক্ত করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়।’[8]

মহান আল্লাহর এ নির্দেশটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবম হিজরী সালে আবূ বকর রা. কে মক্কায় পাঠালেন এ ঘোষণা দেয়ার জন্যে যে,

«أَنْ لاَ يَحُجُّ بَعْدَ الْعَامِ مُشْرِكٌ وَلاَ يَطُوفُ بِالْبَيْتِ عُرْيَانٌ».

‘এ বছরের পর কোন মুশরিক হজ করতে পারবে না এবং কেউ উলঙ্গাবস্থায় আল্লাহর ঘর তাওয়াফ করতে পারবে না।’[9]

৪. হারাম এলাকায় শিকার করা, গাছ কাটা বা পড়ে থাকা জিনিস উঠানো

মক্কা বিজয়ের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জনতার সামনে বক্তব্য রাখলেন। প্রথমে তিনি আল্লাহর হাম্দ ও সানা বর্ণনা করেন, অতঃপর বললেন,

«إِنَّ اللهَ حَبَسَ عَنْ مَكَّةَ الْفِيلَ وَسَلَّطَ عَلَيْهَا رَسُولَهُ وَالْمُؤْمِنِينَ وَإِنَّهَا لَنْ تَحِلَّ لِأَحَدٍ كَانَ قَبْلِي وَإِنَّهَا أُحِلَّتْ لِي سَاعَةً مِنْ نَهَارٍ وَإِنَّهَا لَنْ تَحِلَّ لِأَحَدٍ بَعْدِي فَلاَ يُنَفَّرُ صَيْدُهَا وَلاَ يُخْتَلَى شَوْكُهَا وَلاَ تَحِلُّ سَاقِطَتُهَا إِلاَّ لِمُنْشِدٍ ....»

‘আল্লাহ হস্তির দল থেকে মক্কাকে রক্ষা করেছেন এবং সে মক্কার ওপর তাঁর রাসূল ও মু’মিনদের বিজয় দান করেছেন। এ মক্কা আমার আগে কারো জন্য কখনো হালাল (লড়াই করার অনুমতি) ছিল না, তবে আজ একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তাকে আমার জন্য হালাল করা হয়েছে (এতে লড়াই করার অনুমতি প্রদান করা হয়েছে) এবং আজকের পর আর কখনো এটাকে কারো জন্য হালাল করা হবে না। অতএব এখানকার কোন পশুকে তাড়ানো যাবে না, এখানকার কোন কাঁটা তোলা যাবে না। এখানকার পড়ে থাকা কোন জিনিস হালাল হবে না। তবে ঘোষণাকারী (সঠিক মালিকের কাছে পৌঁছাবার লক্ষ্যে) ঘোষণা দেয়ার জন্য সেটা উঠাতে পারে।’[10]

তবে কষ্টদায়ক জীব হত্যা করা বৈধ করা হয়েছে। তা হারাম এলাকায় হোক অথবা হারাম এলাকার বাইরে যমীনের যে কোন জায়গায় হোক। এ প্রসঙ্গে স্পষ্ট হাদীস রয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«خَمْسٌ مِنْ الدَّوَابِّ كُلُّهُنَّ فَاسِقٌ يَقْتُلُهُنَّ فِي الْحَرَمِ الْغُرَابُ وَالْحِدَأَةُ وَالْعَقْرَبُ وَالْفَأْرَةُ وَالْكَلْبُ الْعَقُورُ».

‘পাঁচ ধরনের প্রাণীর সবগুলোই ক্ষতিকারক, যেগুলোকে হারামেও হত্যা করা যাবে : কাক, চিল, বিচ্ছু, ইঁদুর ও হিংস্র কুকুর।’[11]

আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«خَمْسٌ فَوَاسِقُ يُقْتَلْنَ فِي الْحِلِّ وَالْحَرَمِ الْحَيَّةُ وَالْغُرَابُ الْأَبْقَعُ وَالْفَأْرَةُ وَالْكَلْبُ الْعَقُورُ وَالْحُدَيَّا».

‘পাঁচটি প্রাণী ক্ষতিকারক। হিল্ল (মীকাত ও হারামের মধ্যবর্তী স্থান) অথবা হারামে যেখানেই পাওয়া যাবে সেগুলো হত্যা করা যাবে : সাপ, কাক, ইঁদুর, হিংস্র কুকুর ও চিল।’[12]

আলিমগণ বলেন, উল্লিখিত হাদীসসমূহে যেসব প্রাণীর নাম বলা হয়েছে। তাছাড়াও অন্যান্য ক্ষতিকারক প্রাণীও এর অন্তর্ভুক্ত হবে।

[1]. হজ : ২৫।

[2]. বুখারী : ৬৮৮২।

[3]. মুসনাদে আহমাদ ২/৪২৮; তাবারী : ১৭/১০৪।

[4]. বাকারা ১২৫।

[5]. তীন : ১-৪।

[6]. আনকাবূত : ৬৭।

[7]. সহীহ ইবন হিববান : ৩৭১৪।

[8]. তওবা : ২৮।

[9]. বুখারী : ১৬২২।

[10]. বুখারী : ......; মুসলিম : ........।

[11]. বুখারী : ১৮২৯; মুসলিম : ১১৯৮।

[12]. মুসলিম : ১১৯৮।
মক্কায় প্রবেশের সময় হাজীগণ যেসব ভুল করেন
  • এ সময় অনেক হাজী সাহেব অপরের সমালোচনা ও দোষ চর্চা করেন, এমন পবিত্র স্থানে যা একেবারেই পরিত্যাজ্য।
  • অনেক হাজী সাহেব মক্কায় প্রবেশের পূর্বে তালবিয়া পাঠ করতে ভুলে যান। অথচ তখনি বেশি বেশি করে তালবিয়া পাঠ করার সময়।
  • অনেক হাজী সাহেব একসাথে সমস্বরে তালবিয়া পাঠ করতে থাকেন। এটি সুন্নত পরিপন্থী কাজ। কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কিরাম ভিন্ন ভিন্নভাবে তালবিয়া পাঠ করেছেন।
  • অনেক হাজী সাহেব মক্কায় প্রবেশের জন্য নির্দিষ্ট দো‘আ পড়ে থাকেন। মক্কা প্রবেশের জন্য নির্দিষ্ট দো‘আ নেই।

তালবিয়া পড়তে পড়তে পবিত্র কা‘বার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবেন। যেকোনো দরজা দিয়ে ডান পা দিয়ে, বিনয়-নম্রতা ও আল্লাহর মাহাত্মের কথা স্মরণ করে এবং হজের উদ্দেশ্যে বাইতুল্লাহ পর্যন্ত নিরাপদে পৌঁছার তাওফীক দান করায় আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে, মসজিদুল হারামে প্রবেশ করবেন। প্রবেশের সময় আল্লাহ যেন তাঁর রহমতের সকল দরজা খুলে দেন সে আকুতি নিয়ে রাসূলল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএর ওপর দরূদ ও সালাম প্রেরণ সম্বলিত নিম্নের দো‘আটি পড়বেন :[1]

«أَعُوذُ بِاللَّهِ الْعَظِيمِ وَبِوَجْهِهِ الْكَرِيمِ وَسُلْطَانِهِ الْقَدِيمِ مِنْ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ بِسْمِ اللهِ وَالصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلى رَسُوْلِ اللهِ، اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِيْ ذُنُوْبِيْ، وَافْتَحْ لِيْ أَبْوَابَ رَحْمَتِكَ».

(আউযুবিল্লাহিল আযীম ওয়া ওয়াজহিহিল কারীম ওয়া সুলতানিহিল কাদীমি মিনাশ শায়তানির রাজীম। বিসমিল্লাহ ওয়াস্সালাতু ওয়াস্সালামু আলা রাসূলিল্লাহ, আল্লাহুম্মাগফির লি যুনুবী ওয়াফতাহ লি আবওয়াবা রাহমাতিক।)

‘আমি মহান আল্লাহর, তাঁর সম্মানিত চেহারার এবং তাঁর চিরন্তন কর্তৃত্বের মাধ্যমে বিতাড়িত শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আল্লাহর নামে আরম্ভ করছি। সালাত ও সালাম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএর ওপর। হে আল্লাহ! আপনি আমার গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দিন এবং আমার জন্য আপনার রহমতের সকল দরজা খুলে দিন।’

[1]. অন্যান্য দু‘আর সাথে এ দু‘আ বিভিন্ন হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। আর দরূদ পড়ার কথা এসেছে। হাকেম : ১/৩২৫; আবু দাউদ : ৪৬৫।
মসজিদে হারামে প্রবেশের সময় হাজী সাহেব যেসব ভুল করেন
  • অনেকে মনে করে, বাবুস সালাম বা অন্য কোন নির্দিষ্ট দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে হবে। এটা নিছক ভুল ধারণা। কেননা মসজিদুল হারামের প্রতিটি দরজাই পরবর্তীযুগে বানানো হয়েছে। তাই নির্দিষ্ট দরজা দিয়ে প্রবেশ করা মুস্তাহাব বা সুন্নত হতে পারে না।
  • মসজিদে হারামে প্রবেশের সময় সুনির্দিষ্ট কোন দো‘আ নির্ধারণ করা। অথচ মসজিদে হারামে প্রবেশের সময় সুনির্দিষ্ট কোন দো‘আ নেই। বরং ওপরে যে দো‘আটি বর্ণিত হয়েছে, তা মসজিদে হারামসহ সব মসজিদে প্রবেশের দো‘আ।

তাওয়াফের ফযীলত :

তাওয়াফের ফযীলত সম্পর্কে বহু হাদীস এসেছে। যেমন :

  • আল্লাহ তা‘আলা তাওয়াফকারির প্রতিটি পদক্ষেপের বিনিময়ে একটি করে নেকি লিখবেন এবং একটি করে গুনাহ মাফ করবেন। আবদুল্লাহ ইবন উমর রা. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি,

«مَنْ طَافَ بِالْبَيْتِ كَتَبَ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ لَهُ بِكُلِّ خُطْوَةٍ حَسَنَةٍ وَمَحَا عَنْهُ سَيِّئَةٍ».

‘যে ব্যক্তি আল্লাহর ঘরের তওয়াফ করবে, আল্লাহ তা‘আলা তার প্রতিটি পদক্ষেপের বিনিময়ে একটি নেকি লিখবেন এবং একটি গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন।’[1]

  • তাওয়াফকারী শিশুর মত নিষ্পাপ হয়ে যায়। ইবন উমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«فَإِذَا طُفْتَ بِالْبَيْتِ خَرَجْتَ مِنْ ذُنُوبِكَ كَيَوْمِ وَلَدَتْكَ أُمُّكَ».

‘তুমি যখন বাইতুল্লাহ্‌র তাওয়াফ করলে, তখন পাপ থেকে এমনভাবে বের হয়ে গেলে যেন আজই তোমার মা তোমাকে জন্ম দিয়েছে।’[2]

  • তাওয়াফকারী দাসমুক্ত করার ন্যায় সওয়াব পায়। আবদুল্লাহ ইবন উমর রা. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি,

«مَنْ طَافَ سَبْعًا فَهُوَ كَعِدْلِ رَقَبَةٍ».

‘যে ব্যক্তি কাবাঘরের সাত চক্কর তাওয়াফ করবে সে একজন দাসমু্ক্ত করার সওয়াব পাবে।’[3]

  • ফেরেশতার পক্ষ থেকে তাওয়াফকারী ব্যক্তি নিষ্পাপ হওয়ার ঘোষণা আসে। আনাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«وَأَمَّا طَوَافُكَ بِالْبَيْتِ بَعْدَ ذَلِكَ فَإِنَّكَ تَطُوفُ وَلَا ذَنْبَ لَكَ، يَأْتِي مَلَكٌ حَتَّى يَضَعَ يَدَهُ بَيْنَ كَتِفَيْكَ ثُمَّ يَقُولُ اعْمَلْ لِمَا تُسْتَقْبَلُ فَقَدْ غُفِرَ لَكَ مَا مَضَى».

‘আর যখন তুমি বাইতুল্লাহর তাওয়াফ (তাওয়াফে ইফাযা বা তাওয়াফে বিদা) করবে, তখন তুমি তো নিষ্পাপ। তোমার কাছে একজন ফেরেশতা এসে তোমার দুই কাঁধের মাঝখানে হাত রেখে বলবেন, তুমি ভবিষ্যতের জন্য (নেক) আমল কর; তোমার অতীতের সব গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে।’[4]

[1]. তিরমিযী ৯৫৯; আল-হাকিম : ১/৪৮৯।

[2]. মুসান্নাফ আবদুররায্যাক : ৫/১৬ হাদীস নং ৮৮৩০; মু‘জামুল কাবীর ১২/৪২৫; সহীহুল জামে‘: ১৩৬০।

[3] সুনান আন-নাসাঈ : ২২১/৫। দাসমুক্ত করার সাওয়াব অন্য হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে কেউ কোন মুমিন দাস-দাসীকে মুক্ত করবে, সেটা তার জন্য জাহান্নাম থেকে মুক্তির কারণ হবে। [আবূ দাউদ : ৩৪৫৩] অন্য হাদীসে এসেছে, কেউ কোন দাসমুক্ত করলে আল্লাহ দাসের প্রতিটি অঙ্গের বিনিময়ে তার প্রতিটি অঙ্গ জাহান্নাম থেকে মুক্ত করবেন। [তিরমিযী : ১৪৬১]

[4]. সহীহুত-তারগীব ওয়াত-তারহীব:১১১২।
সঠিকভাবে তাওয়াফ করতে নিচের কথাগুলো অনুসরণ করুন

১. সকল প্রকার নাপাকি থেকে পবিত্র হয়ে উযু করুন তারপর মসজিদুল হারামে প্রবেশ করে কা‘বা শরীফের দিকে এগিয়ে যান।[1]

যদি আপনি তখনই তাওয়াফের ইচ্ছা করেন তাহলে দু’ রাক‘আত তাহিয়্যাতুল মসজিদ পড়া ছাড়াই তাওয়াফ শুরু করতে যাবেন। কেননা, বাইতুল্লাহ্‌র তাওয়াফই আপনার জন্য তাহিয়্যাতুল মসজিদ হিসেবে পরিগণিত হবে। আর যিনি সালাত বা অন্য কোন উদ্দেশ্যে মসজিদে হারামে প্রবেশ করছেন, তিনি বসার আগেই দুই রাকা‘আত তাহিয়্যাতুল মসজিদ পড়ে নেবেন। যেমন অন্য মসজিদে প্রবেশের পর পড়তে হয়। এরপর তাওয়াফের জন্য হাজরে আসওয়াদের দিকে যান। মনে রাখবেন:

উমরাকারী বা তামাত্তু হজকারীর জন্য এ তাওয়াফটি উমরার তাওয়াফ। কিরান ও ইফরাদ হজকারীর জন্য এটি তাওয়াফে কুদূম বা আগমনী তাওয়াফ।

মুহরিম ব্যক্তি অন্তরে তাওয়াফের নিয়ত করে তাওয়াফ শুরু করবে। কেননা, অন্তরই নিয়তের স্থান। উমরাকারী কিংবা তামাত্তুকারী হলে তাওয়াফ শুরু করার পূর্ব মুহূর্ত থেকে তালবিয়া পাঠ বন্ধ করে দেবে।

তাওয়াফের জন্য হাজরে আসওয়াদের কাছে পৌঁছার পর সেখানকার আমলগুলো নিম্নরূপে করার চেষ্টা করবেন।

ক. ভিড় না থাকলে হাজরে আসওয়াদের কাছে গিয়ে তা চুম্বন করে তাওয়াফ শুরু করবেন। হাজরে আসওয়াদ চুম্বনের পদ্ধতি হল, হাজরে আসওয়াদের ওপর দু’হাত রাখবেন। ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলে আলতোভাবে চুম্বন করবেন।[2] কিন্তু অন্তরে বিশ্বাস রাখতে হবে, হাজরে আসওয়াদ উপকারও করতে পারে না, অপকারও করতে পারে না। লাভ ও ক্ষতি করার মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা। উমর ইবন খাত্তাব রা. হাজরে আসওয়াদের কাছে গিয়ে তা চুমো খেয়ে বলেন,

وَإِنِّي لأَعْلَمُ أَنَّكَ حَجَرٌ لاَ تَضُرُّ وَلاَ تَنْفَعُ ، وَلَوْلاَ أَنِّي رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يُقَبِّلُكَ ، مَا قَبَّلْتُكَ.

‘আমি নিশ্চিত জানি, তুমি কেবল একটি পাথর। তুমি ক্ষতি করতে পার না এবং উপকারও করতে পার না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যদি তোমায় চুম্বন করতে না দেখতাম, তাহলে আমি তোমায় চুম্বন করতাম না।[3]

হাজরে আসওয়াদে চুমো দেয়ার সময় اللَّهُ أَكْبَرُ (আল্লাহু আকবার) বলবেন[4] অথবা بِسْمِ اللَّهِ وَاللَّهُ أَكْبَرُ (বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার) বলবেন। ইবন উমর রা. থেকে এরকম বর্ণিত আছে।[5]

খ. হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করা কষ্টকর হলে ডান হাত দিয়ে তা স্পর্শ করবেন এবং হাতের যে অংশ দিয়ে স্পর্শ করেছেন সে অংশ চুম্বন করবেন। নাফে রহ. বলেন, ‘আমি ইবন উমর রা. কে দেখেছি, তিনি নিজ হাতে হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ করলেন তারপর তাতে চুমো দিলেন এবং বললেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এভাবে করতে দেখার পর থেকে আমি কখনো তা পরিত্যাগ করি নি।’[6]

গ. যদি হাত দিয়ে হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ করা সম্ভব না হয়, লাঠি দিয়ে তা স্পর্শ করবেন এবং লাঠির যে অংশ দিয়ে স্পর্শ করেছেন সে অংশ চুম্বন করবেন। ইবন আব্বাস রা. বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায় হজে উটের পিঠে বসে তাওয়াফ করেন, তিনি বাঁকা লাঠি দিয়ে হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ করলেন।’[7]

ঘ. হজের সময়ে বর্তমানে হাজরে আসওয়াদ চুম্বন ও স্পর্শ করা উভয়টাই অত্যন্ত কঠিন এবং অনেকের পক্ষেই দুঃসাধ্য। তাই এমতাবস্থায় হাজরে আসওয়াদের বরাবর এসে দূরে দাঁড়িয়ে তার দিকে মুখ ফিরিয়ে ডান হাত উঁচু করে, اللَّهُ أَكْبَر (আল্লাহু আকবার) বা بِسْمِ اللَّهِ َاللَّهُ أَكْبَر ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ (আল্লাহু আকবার) বলে ইশারা করবেন। পূর্বে হাজরে আসওয়াদ বরাবর যমীনে একটি খয়েরি রেখা ছিল বর্তমানে তা উঠিয়ে দেয়া হয়েছে। তাই হাজরে আসওয়াদ বরাবর মসজিদুল হারামের কার্নিশে থাকা সবুজ বাতি দেখে হাজরে আসওয়াদ বরাবর এসেছেন কি-না তা নির্ণয় করবেন। আর যেহেতু হাত দিয়ে হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ করা সম্ভব হয়নি তাই হাতে চুম্বনও করবেন না। ইবন আব্বাস রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উটের পিঠে বসে তাওয়াফ করলেন। যখন তিনি রুকন অর্থাৎ হাজরে আসওয়াদের বরাবর হলেন তখন এর দিকে ইশারা করলেন এবং তাকবীর দিলেন।[8] অপর বর্ণনায় রয়েছে, ‘যখন তিনি হাজরে আসওয়াদের কাছে আসলেন তখন তাঁর হাতের বস্তুটি দিয়ে এর দিকে ইশারা করে তাকবীর দিলেন।[9] তারপর যখনই এর বরাবর হলেন অনুরূপ করলেন। সুতরাং যদি স্পর্শ করা সম্ভব না হয়, তাহলে হাজরে আসওয়াদের দিকে ইশারা করে তাকবীর দেবেন। হাত চুম্বন করবেন না।

ঙ. প্রচণ্ড ভিড়ের কারণে যদি পাথরটিকে চুমো দেয়া বা হাতে স্পর্শ করা সম্ভব না হয়, তাহলে মানুষকে কষ্ট দিয়ে এ কাজ করতে যাবেন না। এতে খুশূ তথা বিনয়ভাব নষ্ট হয়ে যায় এবং তাওয়াফের উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। এটাকে কেন্দ্র করে কখনো কখনো ঝগড়া-বিবাদ এমনকি মারামারি পর্যন্ত শুরু হয়ে যায়। তাই এ ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।

ইবন উমর রা. সহ বেশ কিছু সাহাবী তাওয়াফের শুরুতে বলতেন,[10]

اللَّهُمَّ إيمَانًا بِكَ وَتَصْدِيقًا بِكِتَابِكَ وَوَفَاءً بِعَهْدِكَ وَاتِّبَاعًا لِسُنَّةِ نَبِيِّكَ مُحَمَّدٍ.

(আল্লহুম্মা ঈমানাম বিকা, ওয়া তাছদীকাম বিকিতাবিকা, ওয়া ওয়াফায়াম বি‘আহদিকা, ওয়াত- তিবা‘আন লিসুন্নাতি নাবিয়্যিকা মুহাম্মাদিন।)

‘আল্লাহ, আপনার ওপর ঈমানের কারণে, আপনার কিতাবে সত্যায়ন, আপনার সাথে কৃত অঙ্গীকার বাস্তবায়ন এবং আপনার নবী মুহাম্মদের সুন্নতের অনুসরণ করে তাওয়াফ শুরু করছি।’

সুতরাং কেউ যদি সাহাবীদের থেকে বর্ণিত হওয়ার কারণে তাওয়াফের সূচনায় এই দো‘আটি পড়েন, তবে তাও উত্তম।

২. হাজরে আসওয়াদ চুম্বন, স্পর্শ অথবা ইশারা করার পর কা‘বা শরীফ হাতের বাঁয়ে রেখে তাওয়াফ শুরু করবেন। তাওয়াফের আসল লক্ষ্য আল্লাহর আনুগত্য ও তাঁর প্রতি মুখাপেক্ষিতা প্রকাশ করা এবং তাঁরই সামনে নিজকে সমর্পন করা। তাওয়াফের সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আচরণে বিনয়-নম্রতা ও হীনতা-দীনতা প্রকাশ পেত। চেহারায় ফুটে উঠত আত্মসমর্পনের আবহ। পুরুষদের জন্য এই তাওয়াফের প্রতিটি চক্করে ইযতিবা এবং প্রথম তিন চক্করে রমল করা সুন্নত। ইবন আব্বাস রা. বর্ণিত হাদীসে এসেছে,

اضْطَبَعَ فَاسْتَلَمَ وَكَبَّرَ ثُمَّ رَمَلَ ثَلاَثَةَ أَطْوَافٍ.

‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইযতিবা করলেন, হাজরে আসওয়াদে চুম্বন করলেন এবং তাকবীর প্রদান করলেন। আর প্রথম তিন চক্করে রমল করলেন।’[11]

ইযতিবা হলো, গায়ের চাদরের মধ্যভাগ ডান বগলের নিচে রেখে ডান কাঁধ খালি রাখা এবং চাদরের উভয় মাথা বাম কাঁধের ওপর রাখা।

আর রমল হলো, ঘনঘন পা ফেলে কাঁধ হেলিয়ে বীর-বিক্রমে দ্রুত চলা। কা‘বার কাছাকাছি স্থানে রমল করা সম্ভব না হলে দূরে থেকেই রমল করা উচিত।

৩. রুকনে ইয়ামানী অর্থাৎ হাজরে আসওয়াদের আগের কোণের বরাবর এলে সম্ভব হলে তা ডান হাতে স্পর্শ করবেন।[12] প্রতি চক্করেই এর বরাবর এসে সম্ভব হলে এরকম করবেন।

 

৪. হাজরে আসওয়াদ ও রুকনে ইয়ামানী কেন্দ্রিক আমলসমূহ প্রত্যেক চক্করে করবেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনই করেছেন। রুকনে ইয়ামানী থেকে হাজরে আসওয়াদ পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পড়তেন,

﴿رَبَّنَآ ءَاتِنَا فِي ٱلدُّنۡيَا حَسَنَةٗ وَفِي ٱلۡأٓخِرَةِ حَسَنَةٗ وَقِنَا عَذَابَ ٱلنَّارِ ٢٠١ ﴾ [البقرة: ٢٠١]

(রববানা আতিনা ফিদ্ দুনইয়া হাসানাতাও ওয়া ফিল-আখিরাতি হাসানাতাও ওয়াকিনা ‘আযাবান নার।) [সূরা আল-বাকারাহ: ২০১]

‘হে আমাদের রব, আমাদেরকে দুনিয়াতে কল্যাণ দিন। আর আখিরাতেও কল্যাণ দিন এবং আমাদেরকে আগুনের আযাব থেকে রক্ষা করুন।’[13] সুতরাং এদুই রুকনের মধ্যবর্তী স্থানে প্রত্যেক চক্করে উক্ত দো‘আটি পড়া সুন্নত।

তাওয়াফের অবশিষ্ট সময়ে বেশি বেশি করে দো‘আ করবেন। আল্লাহর প্রশংসা করবেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএর ওপর সালাত ও সালাম পড়বেন। কুরআন তিলাওয়াতও করতে পারেন। মোটকথা, যে ভাষা আপনি ভাল করে বোঝেন, আপনার মনের আকুতি যে ভাষায় সুন্দরভাবে প্রকাশ পায় সে ভাষাতেই দো‘আ করবেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«إِنَّمَا جُعِلَ الطَّوَافُ بِالْبَيْتِ وَبَيْنَ الصَّفَا وَالْمَرْوَةِ وَرَمْىُ الْجِمَارِ لإِقَامَةِ ذِكْرِ اللَّه»

‘বাইতুল্লাহর তাওয়াফ, সাফা-মারওয়ার মধ্যে সাঈ ও জামারায় পাথর নিক্ষেপের বিধান আল্লাহর যিক্‌র কায়েমের উদ্দেশ্যে করা হয়েছে।’[14] দো‘আ ও যিক্‌র অনুচ্চ স্বরে হওয়া শরীয়তসম্মত।

৫. কা‘বা ঘরের নিকট দিয়ে তাওয়াফ করা উত্তম। তা সম্ভব না হলে দূর দিয়ে তাওয়াফ করবে। কেননা, মসজিদে হারাম পুরোটাই তাওয়াফের স্থান। সাত চক্কর শেষ হলে, ডান কাঁধ ঢেকে ফেলুন, যা ইতিপূর্বে খোলা রেখেছিলেন। মনে রাখবেন, শুধু তাওয়াফে কুদূম ও উমরার তাওয়াফেই ইযতিবার বিধান রয়েছে। অন্য কোন তাওয়াফে ইযতিবা নেই, রমলও নেই।

৬. সাত চক্কর তাওয়াফ শেষ করে মাকামে ইবরাহীমের দিকে অগ্রসর হবেন,

﴿وَٱتَّخِذُواْ مِن مَّقَامِ إِبۡرَٰهِ‍ۧمَ مُصَلّٗىۖ﴾ [البقرة: ١٢٥]

(ওয়াত্তাখিযূ মিম মাকামি ইব্রাহীমা মুসল্লা।)

‘মাকামে ইবরাহীমকে তোমরা সালাতের স্থল বানাও।’[15] মাকামে ইবরাহীমকে নিজের ও বাইতুল্লাহ্‌র মাঝখানে রাখবেন। হোক না তা দূর থেকে। তারপর সালাতের নিষিদ্ধ সময় না হলে দু’ রাকা‘আত সালাত আদায় করবেন।[16]

মাকামে ইবরাহীমে জায়গা না পেলে মসজিদুল হারামের যে কোনো স্থানে এমনকি এর বাইরে পড়লেও চলবে।[17] তবুও মানুষকে কষ্ট দেওয়া যাবে না। পথে-ঘাটে যেখানে- সেখানে সালাত আদায় করা যাবে না। মাকরূহ সময় হলে এ দু’রাকা‘আত সালাত পরে আদায় করে নিন। সালাতের পর হাত উঠিয়ে দো‘আ করার বিধান নেই।

৭. সালাত শেষ করে পুনরায় হাজরে আসওয়াদের কাছে এসে ডান হাতে তা স্পর্শ করুন। এটা সুন্নত। স্পর্শ করা সম্ভব না হলে ইশারা করবেন না। হজের সময়ে এরকম করা প্রায় অসম্ভব। জাবের রা. বলেন,

«ثُمَّ رَجَعَ فَاسْتَلَمَ الرُّكْنَ، ثُمَّ رَجَعَ إِلَى الصَّفَا»

অতঃপর আবার ফিরে এসে রুকন (হাজরে আসওয়াদ) স্পর্শ করলেন। তারপর গেলেন সাফা অভিমুখে।’[18]

৮. এরপর যমযমের কাছে যাওয়া, তার পানি পান করা ও মাথায় ঢালা সুন্নত। জাবির রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

«ثُمَّ ذَهَبَ إِلَى زَمْزَمَ فَشَرِبَ مِنْهَا، وَصَبَّ عَلَى رَأْسِهِ».

‘তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যমযমের কাছে গেলেন। যমযমের পানি পান করলেন এবং তা মাথায় ঢেলে দিলেন।[19]

[1]. মনে রাখবেন, কাবা শরীফ দেখার সময় সুনির্দিষ্ট কোনো দু‘আ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত নেই। তবে উমর রা. যখন বাইতুল্লাহর দিকে তাকাতেন তখন নীচের দু‘আটি পড়তেন-

اَللّهُمَّ أنْتَ السَّلامُ وَمِنْكَ السَّلامُ فَحَيِّنَا رَبَّنَا بِالسَّلامِ.

(আল্লহুম্মা আন্তাস সালাম ওয়া মিন্কাস সালাম ফাহায়্যিনা রববানা বিস সালাম।) ‘হে আল্লাহ, আপনিই সালাম (শান্তি), সালাম (শান্তি) আপনার কাছ থেকেই আসে। সুতরাং আপনি আমাদেরকে সালাম (শান্তি)-এর মাধ্যমে সাদর সম্ভাষণ জানান।’ দ্র. বাইহাকী, সুনানে কুবরা : ৫/৭৩; আলবানী, মানাসিকুল হজ্জি ওয়াল উমরা : ১৯। সুতরাং কেউ সাহাবীর অনুসরণে দু‘আটি পড়লে কোনো অসুবিধা নেই।

[2]. বুখারী : ৩/৪৭৫। তাছাড়া আল্লাহকে সম্মান প্রদর্শন ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অনুসরণে সম্ভব হলে হাজরে আসওয়াদের ওপর সিজদাও করতে পারেন। যেমনটি বিভিন্ন সহীহ বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত। দ্র. মুসনাদ আত-তায়ালিসী : ১/২১৫-২১৬।

[3]. ফাতহুল বারী : ৩/৪৬৩।

[4]. বুখারী : ৩/৪৭৬।

[5]. আত-তালখিসুল হাবীর : ২/২৪৭।

[6]. বুখারী : ১৬০৬; মুসলিম : ১২৬৮।

[7]. বুখারী : ১৬০৮।

[8]. বুখারী : ৫২৯৩।

[9]. বুখারী : ১৬৩২।

[10]. তাবরানী : ৫৮৪৩; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ : ৩/২৪০। [তবে এর সনদ দুর্বল]

[11]. বুখারী : ৭৯৫১।

[12]. রুকনে ইয়ামানী স্পর্শ করার সময় بِسْمِ اللَّهِ وَاللَّهُ أَكْبَرُ (বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবর) বলা ভালো। কারণ, ইবন উমর রা. থেকে এটি সহীহভাবে বর্ণিত হয়েছে। দ্র. বাইহাকী : ৫/৭৯; ইবন হাজর, তালখীসুল হাবীর : ২/২৪৭।

[13]. আবূ দাউদ : ১৮৯২।

[14]. তিরমিযী : ৯০২, জামেউল উমূল : ১৫০৫।

[15]. বাকারা : ১২৫।

[16]. এ সালাতের প্রথম রাকা‘আতে সূরা ফাতেহার পর সূরা ‘কাফিরূন’ - قُلْ يَا أَيُّهَا الْكَافِرُونَ - ও দ্বিতীয় রাকা‘আতে সূরা ফাতেহার পর সূরা ইখলাস -قُلْ هُوَ اللهُ أحَدٌ - পড়া সুন্নত। (তিরমিযী : ৮৬৯।) এ দুই রাক‘আত সালাতের সওয়াব সম্পর্কে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। যেমন, ইবন উমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

وأما ركعتاك بعد الطواف كعتق رقبة من بني إسماعيل عليه السلام

‘তুমি যখন তাওয়াফের পর দুই রাক‘আত সালাত আদায় করবে, তা ইসমাঈল আলাইহিস সালামের বংশের একজন গোলাম আযাদ করার সমতুল্য গণ্য হবে।’ দ্র. সহীহুত-তারগীব ওয়াত-তারহীব : ১১১২।

[17]. এই সালাতটি হানাফী মাযহাবে ওয়াজিব, অন্যান্য মাযহাবে সুন্নত।

[18]. মুসনাদে আহমদ : ৩/৩৯৪; মুসলিম : ১২১৮ ও ১২৬২।

[19]. মুসনাদে আহমদ : ৩/৩৯৪; মুসলিম : ১২১৮ ও ১২৬২।
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ১০ পর্যন্ত, সর্বমোট ২১ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ 1 2 3 পরের পাতা »