বিশ্বের প্রতিটি মুসলিমের অন্তরে রয়েছে পবিত্র মক্কা নগরীর প্রতি গভীর সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ। যিনি হজ বা উমরা করতে চান, অবশ্যই তাকে এ পবিত্র ভূমিতে গমন করতে হবে। তাই এ সম্মানিত শহর সম্পর্কে জানা প্রতিটি মুসলিমের উপর একান্ত কর্তব্য। নিম্নে এই মহান নগরীর কিছু বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হল :
ক. কুরআন কারীমে পবিত্র মক্কা নগরীর কয়েকটি নাম উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন, ১- মক্কা[1]; ২- বাক্কা[2]; ৩- উম্মুল কুরা (প্রধান শহর)[3]; ৪- আল-বালাদুল আমীন (নিরাপদ শহর)[4]। বস্তুত কোন কিছুর নাম বেশি হওয়া তার মাহাত্মের পরিচায়ক।
খ. আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে ওহীর মাধ্যমে হারামের সীমানা নির্ধারিত হয়েছে। জিবরীল আ. কাবাঘরের নির্মাতা ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে হারামের সীমানা দেখিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর দেখানো মতে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তা নির্ধারণ করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএর যুগে হারামের সীমানা সংস্কার করা হয়।[5]
ইমাম নববী রহ. বলেন, হারামের সীমানা সম্পর্কে জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ এর সাথে প্রচুর বিধি-বিধানের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।[6]
গ. মক্কা নগরীতে আল্লাহ তা‘আলার অনেক নিদর্শন রয়েছে: যেমন, আল্লাহ তা‘আলা এ মর্মে বলেন,
﴿ فِيهِ ءَايَٰتُۢ بَيِّنَٰتٞ مَّقَامُ إِبۡرَٰهِيمَۖ ﴾ [ال عمران: ٩٧]
‘তাতে (মক্কা নগরীতে) রয়েছে অনেক সুস্পষ্ট নিদর্শন যেমন মাকামে ইবরাহীম।’[7] কাতাদা ও মুজাহিদ রহ. বলেন, ‘প্রকাশ্য নিদর্শনগুলোর একটি হলো মাকামে ইবরাহীম।’[8]
মূলত মক্কা নগরীর একাধিক নাম, তার সীমারেখা সুনির্ধারিত থাকা, তার প্রাথমিক পর্যায় ও নির্মাণের সূচনা এবং তাকে হারাম ঘোষণার মধ্য দিয়ে এ নগরীর সম্মান ও উঁচু মর্যাদার কথা ফুটে উঠে।
১. আল্লাহ তা‘আলা মক্কা নগরীকে হারাম (সম্মানিত) ঘোষণা করেছেন
আল্লাহ তা‘আলা যেদিন যমীন ও আসমান সৃষ্টি করেছেন সেদিন থেকেই মক্কা ভূমিকে সম্মানিত করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ إِنَّمَآ أُمِرۡتُ أَنۡ أَعۡبُدَ رَبَّ هَٰذِهِ ٱلۡبَلۡدَةِ ٱلَّذِي حَرَّمَهَا﴾ [النمل: ٩١]
‘আমিতো আদিষ্ট হয়েছি এ নগরীর মালিকের ইবাদত করতে যিনি একে সম্মানিত করেছেন।’[9] মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إِنَّ هَذَا الْبَلَدَ حَرَّمَهُ اللهُ يَوْمَ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضَ فَهُوَ حَرَامٌ بِحُرْمَةِ اللهِ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ».
‘এ শহরটিকে আল্লাহ যমীন ও আসমান সৃষ্টির দিন থেকেই হারাম অর্থাৎ সম্মানিত করেছেন। আল্লাহ কর্তৃক সম্মানিত এ শহরটি কিয়ামত পর্যন্ত সম্মানিত থাকবে।[10]
আল্লাহর খলীল ইবরাহীম আলাইহিস সালাম মক্কাকে হারাম হওয়ার ঘোষণা দেন। আল্লাহর নির্দেশে তিনি আল্লাহর ঘর কা‘বা নির্মাণ করেন এবং একে পবিত্র করেন। অতপর মানুষের উদ্দেশ্যে তিনি হজের ঘোষণা দেন এবং মক্কা নগরীর জন্য দো‘আ করেন। তিনি বলেন,
«إِنَّ إِبْرَاهِيمَ حَرَّمَ مَكَّةَ وَدَعَا لَهَا.»
‘ইবরাহীম মক্কাকে হারাম ঘোষণা করেন এবং শহরটির জন্য দো‘আ করেন।’[11]
২. আল্লাহ মক্কা নগরীর কসম খেয়ে তাকে সম্মানিত করেছেন
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ وَٱلتِّينِ وَٱلزَّيۡتُونِ ١ وَطُورِ سِينِينَ ٢ وَهَٰذَا ٱلۡبَلَدِ ٱلۡأَمِينِ ٣ ﴾ [التين: ١، ٣]
‘কসম তীন ও যাইতূনের। কসম সিনাই পর্বতের। এবং কসম এ নিরাপদ শহরের।’[12] আয়াতে ‘এই নিরাপদ শহর’ বলে মক্কা নগরী বুঝানো হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿ لَآ أُقۡسِمُ بِهَٰذَا ٱلۡبَلَدِ ١ وَأَنتَ حِلُّۢ بِهَٰذَا ٱلۡبَلَدِ ٢ ﴾ [البلد: ١، ٢]
‘আমি কসম করছি এ শহরের। আর আপনি এ শহরের অধিবাসী।’[13]
৩. মক্কা ও এর অধিবাসীর জন্য ইবরাহীম আ. দো‘আ করেছেন
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ وَإِذۡ قَالَ إِبۡرَٰهِيمُ رَبِّ ٱجۡعَلۡ هَٰذَا ٱلۡبَلَدَ ءَامِنٗا وَٱجۡنُبۡنِي وَبَنِيَّ أَن نَّعۡبُدَ ٱلۡأَصۡنَامَ ٣٥ ﴾ [ابراهيم: ٣٥]
‘আর (স্মরণ করুন) যখন ইবরাহীম বলেছিলেন, হে আমার রব! এ শহরকে নিরাপদ করুন এবং আমাকে ও আমার পুত্রগণকে মূর্তি পূজা হতে দূরে রাখুন।’[14]
৪. মক্কা নগরী রাসূলুল্লাহর প্রিয় শহর
ইবন আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হিজরতের সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা শরীফের উদ্দেশ্যে বলেন,
«مَا أَطْيَبَكِ مِنْ بَلَدٍ وَمَا أَحَبَّكِ إِلَيَّ وَلَوْلاَ أَنَّ قَوْمِك أَخْرَجُونِي مِنْكِ مَا سَكَنْتُ غَيْرَكِ».
‘কতই না পবিত্র শহর তুমি! আমার কাছে কতই না প্রিয় তুমি! যদি তোমার কওম আমাকে তোমার থেকে বের করে না দিত তাহলে তুমি ছাড়া অন্য কোন শহরে আমি বসবাস করতাম না।’[15]
৫. দাজ্জাল এ নগরীতে প্রবেশ করতে পারবে না
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«لَيْسَ مِنْ بَلَدٍ إِلاَّ سَيَطَؤُهُ الدَّجَّالُ إِلاَّ مَكَّةَ وَالْمَدِينَةَ لَيْسَ لَهُ مِنْ نِقَابِهَا نَقْبٌ إِلاَّ عَلَيْهِ الْمَلاَئِكَةُ صَافِّينَ يَحْرُسُونَهَا ثُمَّ تَرْجُفُ الْمَدِينَةُ بِأَهْلِهَا ثَلاَثَ رَجَفَاتٍ فَيُخْرِجُ اللهُ كُلَّ كَافِرٍ وَمُنَافِقٍ».
‘এমন কোন ভূখণ্ড নেই যা দাজ্জালের পদভারে মথিত হবে না। তবে মক্কা ও মদীনায় সে প্রবেশ করতে পারবে না। সেখানকার প্রতিটি গলিতে ফেরেশতাগণ সারিবদ্ধভাবে হেফাযতে নিয়োজিত রয়েছে। এরপর মদীনা তার অধিবাসীসহ তিনটি ঝাঁকুনি খাবে। আল্লাহ (মদীনা থেকে) সকল কাফির ও মুনাফিককে বের করে দেবেন।’
৬. ঈমানের প্রত্যাবর্তন
ইবন উমর রা. হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إِنَّ الإِسْلاَمَ بَدَأَ غَرِيبًا وَسَيَعُودُ غَرِيبًا كَمَا بَدَأَ وَهُوَ يَأْرِزُ بَيْنَ الْمَسْجِدَيْنِ كَمَا تَأْرِزُ الْحَيَّةُ فِى جُحْرِهَا»
‘ইসলামের সূচনা হয়েছিল অপরিচিত হিসেবে এবং সূচনা কালের মতই আবার তা অপরিচিত অবস্থার দিকে ফিরে যাবে। আর তা পুনরায় দু’টি মসজিদে ফিরে আসবে, যেমন সাপ নিজ গর্তে ফিরে আসে।’[16]
ইমাম নববী রহ. বলেন, ‘দু’টি মসজিদ দ্বারা মক্কা ও মদীনার মসজিদকে বুঝানো হয়েছে।’[17]
৭. মসজিদুল হারামে সালাত আদায়ের সওয়াব
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«صَلاَةٌ فِى مَسْجِدِى هَذَا أَفْضَلُ مِنْ أَلْفِ صَلاَةٍ فِيمَا سِوَاهُ إِلاَّ الْمَسْجِدَ الْحَرَامَ وَصَلاَةٌ فِى الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ أَفْضَلُ مِنْ مِائَةِ أَلْفِ صَلاَةٍ فِيمَا سِوَاهُ».
‘আমার মসজিদে একবার সালাত আদায় মসজিদে হারাম ছাড়া অন্যান্য মসজিদে হাজার বার সালাত আদায়ের চেয়ে বেশি উত্তম। তবে মসজিদুল হারামে একবার সালাত আদায় অন্যান্য মসজিদের তুলনায় এক লক্ষ গুণ বেশি।’[18] মসজিদে হারাম বলতে কেউ কেউ শুধু কা‘বার চতুষ্পার্শ্বস্থ সালাত আদায় করার স্থান বা মসজিদকে বুঝেছেন; কিন্তু অধিকাংশ শরীয়তবিদের মতে, হারামের সীমারেখাভুক্ত পূর্ণ এলাকা মসজিদে হারামের আওতাভুক্ত। প্রসিদ্ধ তাবেঈ ‘আতা ইবন আবী রাবাহ আল-মককী রহ. যিনি মসজিদে হারামের ইমাম ছিলেন। তাঁকে একবার রাবী‘ ইবন সুবাইহ প্রশ্ন করলেন, ‘হে আবূ মুহাম্মাদ! মসজিদে হারাম সম্পর্কে যে ফযীলত বর্ণিত হয়েছে এটা কি কেবল মসজিদের জন্য, না সম্পূর্ণ হারাম এলাকার জন্য?’ জবাবে আতা’ রহ. বললেন, এর দ্বারা সম্পূর্ণ হারাম এলাকাই বুঝানো হয়েছে। কারণ হারাম এলাকার সবটাই মসজিদ বলে গণ্য করা হয়।’[19] অধিকাংশ আলেম এ মতটিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন।[20]
সুতরাং বুঝা যাচ্ছে যে, পবিত্র মক্কা নগরীর হারাম এলাকার যেখানেই সালাত আদায় করা হবে, সেখানেই এক সালাতে এক লক্ষ সালাতের সওয়াব পাওয়া যাবে।
[2]. আলে ইমরান : ৯৬।
[3]. শূরা : ৭।
[4]. তীন : ৩।
[5]. আল-ইসাবা : ১/১৮৩।
[6]. তাহযীবুল আসমা ওয়াল লুগাত : ৩/৮২।
[7]. আলে-ইমরান : ৯৭।
[8]. তাফসীরে তাবারী : ৪/৮।
[9]. নামল ৯১।
[10]. মুসলিম ১৩৫৩।
[11]. বুখারী : ১৮৮৩; মুসলিম : ১৩৮৩।
[12]. তীন : ১-৩।
[13]. বালাদ : ১-২।
[14]. ইবরাহীম : ৩৫-৩৭।
[15]. আল-মু‘জামুল কাবীর : ১০৪৭৭।
[16]. সহীহুত-তারগীব ওয়াত-তারহীব : ১১৭৩।
[17]. মুসলিম : ৩৯০।
[18]. মুসনাদে আহমাদ ৩/৩৪৩; ইবন মাজাহ্ ১৪০৬; সহীহ ইবন খুযাইমা ১১৫৫।
[19]. মুসনাদুত তায়ালিসী : ১৪৬৪।
[20]. আল-ইখতিয়ারাতুল ফিকহিয়্যা লি ইবন তাইমিয়া : পৃ. ১১৩; ইবনুল কায়্যিম, যাদুল মা‘আদ ৩/৩০৩-৩০৪; মাজমূ‘ ফাতাওয়া ইবন বায : ৪/১৪০।