ইমাম আ’যম আবূ হানীফা নু’মান ইবন সাবিত (রাহ) বলেন:
لاَ يُشْبِهُ شَيْئاً مِنَ الأَشْيَاءِ مِنْ خَلْقِهِ، وَلاَ يُشْبِهُهُ شَيْءٌ مِنْ خَلْقِهِ. لَمْ يَزَلْ وَلاَ يَزَالُ بِأَسْمَائِهِ وَصِفَاتِهِ الذَّاتِيَّةِ وَالْفِعْلِيَّةِ. أَمَّا الذّاتِيَّةُ فَالْحَيَاةُ وَالْقُدْرَةُ وَالْعِلْمُ وَالْكَلاَمُ وَالسَّمْعُ وَالْبَصَرُ وَالإِرَادَةُ، وَأَمَّا الْفِعْلِيَّةُ فَالتَّخْلِيْقُ وَالتَّرْزِيْقُ وَالإِنْشَاءُ وَالإِبْدَاعُ وَالصُّنْعُ وَغَيْرُ ذَلِكَ مِنَ صِفَاتِ الْفِعْلِ. لَمْ يَزَلْ وَلاَ يَزَالُ بِأَسْمَائِهِ وَصِفَاتِهِ لَمْ يَحْدُثْ لَهُ اسْمٌ وَلاَ صِفَةٌ. لَمْ يَزَلْ عَالِماً بِعِلْمِهِ وَالْعِلْمُ صِفَةٌ فِيْ الأَزَلِ، وَقَادِراً بِقُدْرَتِهِ وَالْقُدْرَةُ صِفَةٌ فِيْ الأَزَلِ، وَمُتَكَلِّماً بِكَلاَمِهِ وَالْكَلاَمُ صِفَةٌ فِيْ الأَزَلِ، وَخَالِقاً بِتَخْلِيْقِهِ وَالتَّخْلِيْقُ صِفَةٌ فِيْ الأَزَلِ، وَفَاعِلاً بِفِعْلِهِ وَالْفِعْلُ صِفَةٌ فِيْ الأَزَلِ، وَالْفَاعِلُ هُوَ اللهُ تَعَالَي وَالْفِعْلُ صِفَةٌ فِيْ الأَزَلِ، وَالْمَفْعُوْلُ مَخْلُوْقٌ وَفِعْلُ اللهِ تَعَالَي غَيْرُ مَخْلُوْقٍ. وَصِفَاتُهُ فِيْ الأَزَلِ غَيْرُ مُحْدَثَةٍ وَلاَ مَخْلُوْقَةٍ. وَمَنْ قَالَ إِنَّهَا مَخْلُوْقَةٌ أَوْ مُحْدَثَةٌ أَوْ وَقَفَ أَوْ شَكَّ فِيْهِمَا فَهُوَ كَافِرٌ بِاللهِ تَعَالَي.
وَالْقُرْآنُ كَلاَمُ اللهِ تَعَالَي فِيْ الْمَصَاحِفِ مَكْتُوْبٌ، وَفِيْ الْقُلُوْبِ مَحْفُوْظٌ، وَعَلَي الأَلْسُنِ مَقْرُوْءٌ، وَعَلَي النَّبِيِّ ﷺ مُنَزَّلٌ، وَلَفْظُنَا بِالْقُرْآنِ مَخْلُوْقٌ وَكِتَابَتُنَا لَهُ مَخْلُوْقَةٌ وَقِرَاءَتُنَا لَهُ مَخْلُوْقَةٌ وَالْقُرْآنُ غَيْرُ مَخْلُوْقِ. وَمَا ذَكَرَهُ اللهُ تَعَالَى فِيْ الْقُرْآنِ حِكَايَةً عِنْ مُوْسَي وَغَيْرِهِ مِنَ الأَنْبِيَاءِ عَلَيْهِمُ السَّلاَمُ، وَعَنْ فِرْعَوْنَ وَإِبْلِيْسَ، فَإِنَّ ذَلِكَ كُلَّهُ كَلاَمُ اللهِ تَعَالَي إِخْبَاراً عَنْهُمْ، وَكَلاَمُ اللهِ تَعَالَي غَيْرُ مَخْلُوْقٍ، وَكَلاَمُ مُوْسَي وَغَيْرِهِ مِنَ الْمَخْلُوْقِيْنَ مَخْلُوْقٌ، وَالْقُرْآنُ كَلاَمُ اللهِ تَعَالَي فَهْوَ قَدِيْمٌ، لاَ كَلاَمُهُمْ. وَسَمِعَ مُوْسَي عَلَيْهِ السَّلاَمُ كَلاَمَ اللهِ تَعَالَي كَمَا فِيْ قَوْلِهِ تَعَالَي: "وَكَلَّم َاللهُ مُوْسيَ تَكْلِيْمًا". وَقَدْ كَانَ اللهُ تَعَالَي مُتَكَلِّماً وَلَمْ يَكُنْ كَلَّمَ مُوْسَي عَلَيْهِ السَّلاَمُ، وَقَدْ كَانَ اللهُ تَعَالَي خَالِقاً فِيْ الأَزَلِ وَلَمْ يَخْلُقِِ الْخَلْقَ، لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيْعُ الْبَصِيْرُ. فَلَمَّا كَلَّمَ اللهُ مُوْسَي كَلَّمَهُ بِكَلاَمِهِ الَّذِيْ هُوَ لَهُ صِفَةٌ فِيْ الأَزَلِ.
وَصِفَاتُهُ كُلُّهَا بِخِلاَفِ صِفَاتِ الْمَخْلُوْقِيْنَ. يَعْلَمُ لاَ كَعِلْمِنَا، وَيَقْدِرُ لاَ كَقُدْرَتِنَا، وَيَرَي لاَ كَرُؤْيَتِنَا، وَيَسْمَعُ لاَ كَسَمْعِنَا وَيَتَكَلَّمُ لاَ كَكَلاَمِنَا، وَنَحْنُ نَتَكَلَّمُ بِاْلآلاتِ وَالْحُرُوْفِ وَاللهُ تَعَالَي يَتَكَلَّمُ بِلاَ آلَةٍ وَلاَ حُرُوْفٍ، وَالْحُرُوْفُ مَخْلُوْقَةٌ، وَكَلاَمُ اللهِ تَعَالَي غَيْرُ مَخْلُوْقٍ.
وَهُوَ شَيْءٌ لاَ كَالأَشْيَاءِ وَمَعْنَي الشَّيْءِ إِثْبَاتُهُ بِلاَ جِسْمٍ وَلاَ جَوْهَرٍ وَلاَ عَرْضٍ وَلاَ حَدَّ لَهُ وَلاَ ضِدَّ لَهُ وَلاَ نِدَّ لَهُ "فَلاَ تَجْعَلُوْا للهِ أَنْدَاداً" وَلاَ مِثْلَ لَهُ. وَلَهُ يَدٌ وَوَجْهٌ وَنَفْسٌ فَمَا ذَكَرَهُ اللهُ تَعَالَى فِيْ الْقُرْآنِ مِنْ ذِكْرِ الْوَجْهِ وَالْيَدِ وَالنَّفْسِ فَهُوَ لَهُ صِفَاتٌ بِلاَ كَيْفٍ. وَلاَ يُقَالُ: إِنَّ يَدَهُ قُدْرَتُهُ أَوْ نِعْمَتُهُ؛ لأَنَّ فِيْهِ إِبْطَالَ الصِّفَةِ. وَهُوَ قَوْلُ أَهْلِ الْقَدَرِ وَالاِعْتِزَالِ، وَلَكِنَّ يَدَهُ صِفَتُهُ بِلاَ كَيْفٍ، وَغَضَبُهُ وَرِضَاهُ صِفَتَانِ مِنْ صِفَاتِهِ تَعَالَى بِلاَ كَيْفٍ.
خَلَقَ اللهُ تَعَالَى الأَشْيَاءَ لاَ مِنْ شَيْءٍ، وَكَانَ اللهُ تَعَالَى عَالِماً فِيْ الأَزَلِ بِالأَشْيَاءِ قَبْلَ كَوْنِهَا، وَهُوَ الَّذِيْ قَدَّرَ الأَشْيَاءَ وَقَضَاهَا، أَلاَ يَعْلَمُ مَنْ خَلَقَ وَلاَ يَكُوْنُ فِيْ الدُّنْيَا وَلاَ فِيْ الآَخِرَةِ شَيْءٌ إِلاَّ بِمَشِيْئَتِهِ وَعِلْمِهِ وَقَضَائِهِ وَقَدَرِهِ وَكَتْبِهِ فِيْ اللَّوْحِ الْمَحْفُوْظِ، وَلَكِنَّ كَتْبَهُ بِالْوَصْفِ لاَ بِالْحُكْمِ. وَالْقَضَاءُ وَالْقَدَرُ وَالْمَشِيْئَةُ صِفَاتُهُ فِيْ الأَزَلِ بِلاَ كَيْفٍ. يَعْلَمُ اللهُ تَعَالَى الْمَعْدُوْمَ فِيْ حَالِ عَدَمِهِ مَعْدُوْماً، وَيَعْلَمُ أَنَّهُ كَيْفَ يَكُوْنُ إِذَا أَوْجَدَهُ، وَيَعْلَمُ اللهُ الْمَوْجُوْدَ فِيْ حَالِ وُجُوْدِهِ مَوْجُوْداً، وَيَعْلَمُ أَنَّهُ كَيْفَ يَكُوْنُ فَنَاؤُهُ. وَيَعْلَمُ اللهُ تَعَالَى الْقَائِمَ فِيْ حَالِ قِيَامِهِ قَائِماً، وَإِذَا قَعَدَ قَاعِداً فِيْ حَالِ قُعُوْدِهِ مِنْ غَيْرِ أَنْ يَتَغَيَّرَ عِلْمُهُ أَوْ يَحْدُثَ لَهُ عِلْمٌ وَلَكِنَّ التَّغَيُّرَ اخْتِلاَفُ الأَحْوَالِ يَحْدُثُ فِيْ الْمَخْلُوْقِيْنَ.
خَلَقَ اللهُ تَعَالَى الْخَلْقَ سَلِيْماً مِنَ الْكُفْرِ وَالإِيْمَانِ، ثُمَّ خَاطَبَهُمْ وَأَمَرَهُمْ وَنَهَاهُمْ، فَكَفَرَ مَنْ كَفَرَ بِفِعْلِهِ وَإِنْكَارِهِ وَجُحُوْدِهِ الْحَقَّ بِخُذْلاَنِ اللهِ تَعَالَى إِيَّاهُ، وَآَمَنَ مَنْ آَمَنَ بِفِعْلِهِ وَإِقْرَارِهِ وَتَصْدِيْقِهِ، بِتَوْفِيْقِ اللهِ تَعَالَى إِيَّاهُ وَنُصْرَتِهِ لَهُ. أَخْرَجَ ذُرِّيَّةَ آَدَمَ مِنْ صُلْبِهِ عَلَى صُوَرِ الذَّرِّ، فَجَعَلَهُمْ عُقَلاَءَ فَخَاطَبَهُمْ "أَلَسْتُ بِرَبِّكُمْ؟ قَالُوْا بَلَى" وَأَمَرَهُمْ بِالإِيْمَانِ وَنَهَاهُمْ عَنِ الْكُفْرِ فَأَقَرُّوا لَهُ بِالرُّبُوْبِيَّةِ، فَكَانَ ذَلِكَ مِنْهُمْ إِيْمَاناً فَهُمْ يُوْلَدُوْنَ عَلَى تِلْكَ الْفِطْرَةِ "إِمَّا شَاكِراً وَإِمَّا كَفُوْراً" وَمَنْ كَفَرَ بَعْدَ ذَلِكَ فَقَدْ بَدَّلَ وَغَيَّرَ، وَمَنْ آَمَنَ وَصَدَّقَ فَقَدْ ثَبَتَ عَلَيْهِ وَدَاوَمَ. وَلَمْ يُجْبِرْ أَحَداً مِنْ خَلْقِهِ عَلَى الْكُفْرِ وَلاَ عَلَى الإِيْمَانِ، وَلاَ خَلَقَهُمْ مُؤْمٍناً وَلاَ كَافِراً، وَلَكِنْ خَلَقَهُمْ أَشْخَاصاً، وَالإِيْمَانُ وَالْكُفْرُ مِنْ فِعْلِ الْعِبَادِ. وَيَعْلَمُ اللهُ مَنْ يَكْفُرُ فِيْ حَالِ كُفْرِهِ كَافِراً، فَإِذَا آمَنَ بَعْدَ ذَلِكَ عَلِمَهُ مُؤْمِناً فِيْ حَالِ إِيْمَانِهِ مِنْ غَيْرِ أَنْ يَتَغَيَّرَ عِلْمُهُ وَصِفَتُهُ.
وَجَمِيْعُ أَفْعَالِ الْعِبَادِ مِنَ الْحَرَكَةِ وَالسُّكُوْنِ كَسْبُهُمْ عَلَى الْحَقِيْقَةِ، وَاللهُ تَعَالَى خَالِقُهَا، وَهِيَ كُلُّهَا بِمَشِيْئَتِهِ وَعِلْمِهِ وَقَضَائِهِ وَقَدَرِهِ. وَالطَّاعَاتُ كُلُّهَا كَانَتْ وَاجِبَةً بِأَمْرِ اللهِ تَعَالَى وَبِمَحَبَّتِهِ وَبِرِضَاهُ وَعِلْمِهِ وَمَشِيْئَتِهِ وَقَضَائِهِ وَتَقْدِيْرِهِ. وَالْمَعَاصِيْ كُلُّهَا بِعِلْمِهِ وَقَضَائِهِ وَتَقْدِيْرِهِ وَمَشِيْئَتِهِ، لاَ بِمَحَبَّتِهِ وَلاَ بِرِضَاهُ وَلاَ بِأَمْرِهِ.
বঙ্গানুবাদ
তাঁর সৃষ্টির মধ্যে কোনো কিছুই তাঁর সাথে তুলনীয় নয়। তিনি তাঁর সৃষ্টির কোনো কিছুর মত নন। তিনি অনাদি কাল থেকে অনন্ত কাল বিদ্যমান, তাঁর নামসমূহ এবং তাঁর যাতী (সত্তীয়) ও ফি’লী (কর্মীয়) সিফাত (বিশেষণ)সমূহসহ। তাঁর সত্তীয় বিশেষণসমূহ: হায়াত (জীবন), কুদরাত (ক্ষমতা), ইলম (জ্ঞান), কালাম (কথা), সাম’ (শ্রবণ), বাসার (দর্শন) ও ইরাদা (ইচ্ছা)। আর তাঁর ফি’লী সিফাতসমূহের মধ্যে রয়েছে: সৃষ্টি করা, রিয্ক প্রদান করা, নবসৃষ্টি করা, উদ্ভাবন করা, তৈরি করা এবং অন্যান্য কর্মমূলক সিফাত বা বিশেষণ। তিনি তাঁর গুণাবলি এবং নামসমূহ-সহ অনাদিরূপে বিদ্যমান। তাঁর নাম ও বিশেষণের মধ্যে কোনো নতুনত্ব বা পরিবর্তন ঘটে নি। তিনি অনাদিকাল থেকেই তাঁর জ্ঞানে জ্ঞানী এবং জ্ঞান অনাদিকাল থেকেই তাঁর বিশেষণ। তিনি অনাদিকাল থেকেই ক্ষমতাবান এবং ক্ষমতা অনাদিকাল থেকেই তাঁর বিশেষণ। তিনি অনাদিকাল থেকেই তাঁর কথায় কথা বলেন এবং কথা অনাদিকাল থেকেই তাঁর বিশেষণ। তিনি অনাদিকাল থেকেই সৃষ্টিকর্তা এবং সৃষ্টি করা অনাদিকাল থেকেই তাঁর বিশেষণ। তিনি অনাদিকাল থেকেই তাঁর কর্মে কর্মী, কর্ম অনাদিকাল থেকে তাঁর বিশেষণ। আল্লাহ তাঁর কর্ম দিয়ে যা সৃষ্টি করেন তা সৃষ্ট, তবে আল্লাহর কর্ম সৃষ্ট নয়। তাঁর সিফাত বা বিশেষণাবলি অনাদি। কোনো বিশেষণই নতুন বা সৃষ্ট নয়। যে ব্যক্তি বলে যে, আল্লাহর কোনো সিফাত বা বিশেষণ সৃষ্ট অথবা নতুন, অথবা এ বিষয়ে সে কিছু বলতে অস্বীকার করে, অথবা এ বিষয়ে সে সন্দেহ পোষণ করে, তবে সে আল্লাহর প্রতি ঈমান-বিহীন কাফির।
কুরআন আল্লাহ তা‘আলার কালাম, মুসহাফগুলোর মধ্যে লিপিবদ্ধ, হৃদয়গুলোর মধ্যে সংরক্ষিত, জিহবাসমূহ দ্বারা পঠিত এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপরে অবতীর্ণ। কুরআন পাঠে আমাদের জিহবার উচ্চারণ সৃষ্ট, কুরআনের জন্য আমাদের লিখনি সৃষ্ট, আমাদের পাঠ সৃষ্ট, কিন্তু কুরআন সৃষ্ট নয়। মহান আল্লাহ কুরআনের মধ্যে মূসা (আঃ) ও অন্যান্য নবী (আঃ) থেকে এবং ফিরাউন এবং ইবলীস থেকে যা উদ্ধৃত করেছেন তা সবই আল্লাহর কালাম (কথা), তাদের বিষয়ে সংবাদ হিসেবে। আল্লাহর কথা সৃষ্ট নয়, মূসা (আঃ) ও অন্য সকল মাখলূকের কথা সৃষ্ট। কুরআন আল্লাহর কথা কাজেই তা অনাদি, মাখলূকগণের কথা সেরূপ নয়। মূসা (আঃ) আল্লাহর কথা শুনেছিলেন, যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন: ‘‘মূসার সাথে আল্লাহ প্রকৃত বাক্যালাপ করেছিলেন’’[1] মূসা (আঃ)-এর সাথে কথা বলার আগেই- অনাদিকাল থেকেই- মহান আল্লাহ তাঁর কালাম বা কথার বিশেষণে বিশেষিত ছিলেন, যেমন সৃষ্টজগত সৃষ্টি করার পূর্বেই- অনাদিকাল থেকেই- তিনি সৃষ্টিকর্তার বিশেষণে বিশেষিত ছিলেন। ‘‘কোনো কিছুই তাঁর সাথে তুলনীয় নয়, তিনি সর্বশ্রোতা সর্বদ্রষ্টা।’’[2] যখন তিনি মূসা (আঃ)-এর সাথে কথা বলেন তখন তিনি তাঁর সেই অনাদি বিশেষণ কথার বিশেষণ দ্বারা কথা বলেন।
তাঁর সকল বিশেষণই মাখলূকদের বা সৃষ্টপ্রাণীদের বিশেষণের ব্যতিক্রম। তিনি জানেন, তবে তাঁর জানা আমাদের জানার মত নয়। তিনি ক্ষমতা রাখেন, তবে তাঁর ক্ষমতা আমাদের ক্ষমতার মত নয়। তিনি দেখেন, তবে তাঁর দেখা আমাদের দেখার মত নয়। তিনি কথা বলেন, তবে তাঁর কথা বলা আমাদের কথা বলার মত নয়। তিনি শুনেন, তবে তাঁর শোনা আমাদের শোনার মত নয়। আমরা বাগযন্ত্র ও অক্ষরের মাধ্যমে কথা বলি, আর মহান আল্লাহ বাগযন্ত্র এবং অক্ষর ছাড়াই কথা বলেন। অক্ষরগুলি সৃষ্ট। আর আল্লাহর কথা (কালাম) সৃষ্ট নয়।
তিনি ‘শাইউন’: ‘বস্ত্ত’ বা ‘বিদ্যমান অস্তিত্ব’, তবে অন্য কোনো সৃষ্ট ‘বস্ত্ত’ বা ‘বিদ্যমান বিষয়ের’ মত তিনি নন। তাঁর ‘শাইউন’- ‘বস্ত্ত’ হওয়ার অর্থ তিনি বিদ্যমান অস্তিত্ব, কোনো দেহ, কোনো জাওহার (মৌল উপাদান) এবং কোনো ‘আরায’ (অমৌল উপাদান) ব্যতিরেকেই। তাঁর কোনো সীমা নেই, বিপরীত নেই, সমকক্ষ নেই, তুলনা নেই। ‘‘অতএব তোমরা কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ বানাবে না।’’[3] তাঁর ইয়াদ (হস্ত) আছে, ওয়াজহ (মুখমণ্ডল) আছে, নফস (সত্তা) আছে, কারণ আল্লাহ কুরআনে এগুলো উল্লেখ করেছেন। কুরআনে আল্লাহ যা কিছু উল্লেখ করেছেন, যেমন মুখমণ্ডল, হাত, নফস ইত্যাদি সবই তাঁর বিশেষণ, কোনো ‘স্বরূপ’ বা প্রকৃতি নির্ণয় ব্যতিরেকে। এ কথা বলা যাবে না যে, তাঁর হাত অর্থ তাঁর ক্ষমতা অথবা তাঁর নিয়ামত। কারণ এরূপ ব্যাখ্যা করার অর্থ আল্লাহর বিশেষণ বাতিল করা। এরূপ ব্যাখ্যা করা কাদারিয়া ও মু’তাযিলা সম্প্রদায়ের রীতি। বরং তাঁর হাত তাঁর বিশেষণ, কোনো স্বরূপ নির্ণয় ব্যতিরেকে। তাঁর ক্রোধ এবং তাঁর সন্তুষ্টি তাঁর দুটি বিশেষণ, আল্লাহর অন্যান্য বিশেষণের মতই, কোনো ‘কাইফ’ বা ‘কিভাবে’ প্রশ্ন করা ছাড়াই।
মহান আল্লাহ সবকিছু সৃষ্টি করেছেন, অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্ব প্রদান করেছেন। সকল কিছুর সৃষ্টির আগেই অনাদিকাল থেকে তিনি এগুলোর বিষয়ে অবগত ছিলেন। সকল কিছুই তিনি নির্ধারণ করেছেন এবং বিধান দিয়েছেন। দুনিয়ায় ও আখিরাতে কোনো কিছুই তাঁর ইচ্ছা, জ্ঞান, বিধান, নির্ধারণ ও লাওহে মাহফূযে লিপিবদ্ধ-করণ ছাড়া ঘটে না। তাঁর লিখনি বর্ণনামূলক, নির্দেশমূলক নয়। বিধান প্রদান, নির্ধারণ ও ইচ্ছা তাঁর অনাদি বিশেষণ, কোনো স্বরূপ, কিরূপ বা কিভাবে অনুসন্ধান ছাড়া। সিদ্ধান্ত, নির্ধারণ ও ইচ্ছা তাঁর অনাদি-অনন্ত বিশেষণ, কোনো স্বরূপ জিজ্ঞাসা ছাড়া। মহান আল্লাহ অস্তিত্বহীন বিষয়কে অস্তিত্বহীন অবস্থায় অস্তিত্বহীন হিসেবে জানেন, এবং তিনি জানেন যে, তিনি তাকে অস্তিত্ব দিলে তা কিরূপ হবে। আল্লাহ অস্তিত্বশীল বিষয়কে তার অস্তিত্বশীল অবস্থায় জানেন এবং তিনি জানেন যে, তা কিভাবে বিলোপ লাভ করবে। আল্লাহ দন্ডায়মানকে দন্ডায়মান অবস্থায় দন্ডায়মান রূপে জানেন। এবং যখন সে উপবিষ্ট হয় তখন তিনি তাঁকে উপবিষ্ট অবস্থায় উপবিষ্ট জানেন। এরূপ জানায় তাঁর জ্ঞানের মধ্যে কোনোরূপ পরিবর্তন হয় না বা তাঁর জ্ঞানভান্ডারে কোনো নতুনত্ব সংযোজিত হয় না। পরিবর্তন ও নতুনত্ব সবই সৃষ্টজীবদের অবস্থার মধ্যে।
মহান আল্লাহ সৃষ্টজগত সৃষ্টি করেছেন ঈমান ও কুফর থেকে বিমুক্ত অবস্থায়। অতঃপর তিনি তাদেরকে সম্বোধন করেছেন এবং আদেশ ও নিষেধ প্রদান করেছেন। যে ব্যক্তি কুফরী করেছে সে নিজের কর্ম দ্বারা, অস্বীকার করে, সত্যকে অমান্য করে এবং আল্লাহর সাহায্য, রহমত ও তাওফীক থেকে বঞ্চিত হয়ে কুফরী করেছে। আর যে ব্যক্তি ঈমান এনেছে সে তার কর্ম দ্বারা, স্বীকৃতি দ্বারা, সত্য বলে ঘোষণা করে এবং আল্লাহর তাওফীক ও সাহায্য লাভের মাধ্যমে ঈমান এনেছে।
তিনি আদমের পিঠ থেকে তাঁর বংশধরদেরকে পরমাণুর আকৃতিতে বের করে তাদেরকে বোধশক্তি প্রদান করেন এবং তাদেরকে সম্বোধন করেন ‘‘আমি কি তোমাদের প্রতিপালক নই? তারা বলে: হ্যাঁ’’[4]। তিনি তাদেরকে ঈমানের নির্দেশ দেন এবং কুফর থেকে নিষেধ করেন। তারা তাঁর রুবূবিয়্যাতের স্বীকৃতি দিয়েছে। এ ছিল তাদের পক্ষ থেকে ঈমান। আদম সন্তানগণ এই ফিতরাতের উপরেই জন্মলাভ করে। এরপর যে কুফরী করে সে নিজেকে পরিবর্তন ও বিকৃত করে। আর যে ঈমান আনে এবং সত্যতার ঘোষণা দেয় সে তার সহজাত ঈমানের উপরে প্রতিষ্ঠিত থাকে।
তিনি তাঁর সৃষ্টির কাউকে কুফরী করতে বাধ্য করেন নি এবং ঈমান আনতেও বাধ্য করেন নি। তিনি কাউকে মুমিনরূপে বা কাফিররূপে সৃষ্টি করেন নি। তিনি তাদেরকে ব্যক্তিরূপে সৃষ্টি করেছেন। ঈমান ও কুফর বান্দাদের কর্ম। কাফিরকে আল্লাহ তার কুফরী অবস্থায় কাফির হিসেবেই জানেন। যখন সে এরপর ঈমান আনয়ন করে তখন আল্লাহ তাকে তার ঈমানের অবস্থায় মুমিন হিসেবে জানেন এবং ভালবাসেন। আর এতে আল্লাহর জ্ঞান ও বিশেষণে কোনো পরিবর্তন হয় না।
বান্দাদের সকল কর্ম ও নিষ্কর্মতা- অবস্থান ও সঞ্চলন সবই প্রকৃত অর্থেই তাদের উপার্জন, আল্লাহ তা‘আলা সে সবের স্রষ্টা। এ সবই তাঁর ইচ্ছায়, জ্ঞানে, ফয়সালায় ও নির্ধারণে। আল্লাহর আনুগত্যের সকল কর্ম আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে জরুরী এবং তা আল্লাহর মহববত, সন্তুষ্টি, জ্ঞান, ইচ্ছা, ফয়সালা ও নির্ধারণ অনুসারে। সকল পাপকর্ম আল্লাহর জ্ঞান, ফয়সালা, নির্ধারণ ও ইচ্ছার মধ্যে সংঘটিত, তবে তা আল্লাহর মহববত, সন্তুষ্টি এবং আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে সংঘটিত নয়।
[2] সূরা (৪২) শূরা: ১১ আয়াত।
[3] সূরা (২) বাকারা: ২২ আয়াত।
[4] সূরা (৭) আ’রাফ: ১৭২ আয়াত।
তাওহীদ ও শিরকের মূলনীতি উল্লেখ করার পর ইমাম আবূ হানীফা আকীদা বিষয়ক বিভ্রান্তিগুলো খন্ডন শুরু করলেন। বস্ত্তত বিভ্রান্তি দূর করে বিশুদ্ধ আকীদা প্রচারই ‘আল-ফিকহুল আকবার’ রচনার মূল উদ্দেশ্য। আমরা দেখেছি যে, ঈমানের ক্ষেত্রে মুমিনের দায়িত্ব কুরআন ও সুন্নাহর নির্দেশনা সহজ-সরল অর্থে বিশ্বাস করা ও সাহাবীগণের অনুসরণ করা। ঈমান-আকীদার বিষয়বস্ত্ত যেহেতু অপরিবর্তনীয় সেহেতু এ বিষয়ে ইজতিহাদ বা যুক্তি-কিয়াসের সুযোগ নেই। তবে উম্মাতের মধ্যে আকীদা বিষয়ক নতুন কোনো মত বা বিশ্বাসের উন্মেষ ঘটলে কুরআন, সুন্নাহ এবং সাহাবী-তাবিয়ীগণের বিশ্বাস ও বক্তব্যের আলোকে সেগুলির পর্যালোচনা করা ও সঠিক বিশ্বাসের দিক নির্দেশনা দেওয়ার দায়িত্ব ইমাম, ফকীহ ও আলিমগণের উপর বর্তায়।
এ দায়িত্ব পালনের জন্যই কলম ধরেন ইমাম আযম আবূ হানীফা। তিনি ছিলেন উম্মাতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফকীহ। তিনি তাঁর ফিকহী মাযহাব নিজে সংকলন করেন নি, কিন্তু আকীদার বিষয়ে তাঁর মাযহাব নিজের হাতে সংকলন করতে সচেষ্ট হয়েছেন। তাওহীদ ও শিরক-এর মৌলিক বিষয়ে তেমন কোনো বিভ্রান্তি ইমাম আবূ হানীফার যুগে প্রকাশ পায় নি। এজন্য এ বিষয়টি তিনি সংক্ষেপে উল্লেখ করেছেন। এরপর তাঁর যুগে প্রকাশিত বিভ্রান্তিগুলোর ক্ষেত্রে সঠিক আকীদা বর্ণনা শুরু করলেন।
ইমাম আবূ হানীফার যুগে, অর্থাৎ হিজরী প্রথম শতকের শেষ ভাগ থেকে দ্বিতীয় শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত সময়ে মুসলিম সমাজে ইসলামী আকীদা বিষয়ে বিভিন্ন বিভ্রান্তির উন্মেষ ঘটে। এ সময়ে বিদ্যমান আকীদা ভিত্তিক দল-উপদলের মধ্যে অন্যতম ছিল: (১) খারিজী, (২) শীয়া, (৩) জাহমিয়া, (৪) জাবারিয়া, (৫) কাদারিয়া, (৬) মুতাযিলা, (৬) মুশাবিবহা ও (৭) মুরজিয়া ফিরকা। ইসলামী বিশ্বাস বিষয়ক প্রথম বিভ্রান্তির উন্মেষ ঘটে আলী (রা)-এর সময়ে (৩৫-৪০ হি)। এ সময়ে খারিজী ও শীয়া দুটি দলের উৎপত্তি ঘটে। এ দুটি ফিরকা ছিল মূলত রাজনৈতিক। এরপর প্রথম হিজরী শতকের শেষভাগ ও দ্বিতীয় হিজরী শতকের প্রথমাংশে অবশিষ্ট বিভ্রান্ত ফিরকাগুলোর জন্ম হয়। এদের বিভ্রান্তি মূলত দার্শনিক মতবাদ নির্ভর এবং আল্লাহর বিশেষণাদি (attribute) কেন্দ্রিক। রাজনৈতিক ও দার্শনিক সকল ফিরকার বিভ্রান্তির মূল কারণ ‘‘আকীদার উৎস’’ নির্ধারণে বিভ্রান্তি। এজন্য এ সকল ফিরকার বিভ্রান্তি অপনোদনে ইমাম আবূ হানীফার বক্তব্য হৃদয়ঙ্গম করার পূর্বশর্ত হিসেবে আমরা ইসলামী আকীদার ভিত্তি ও উৎস বিষয়টি পর্যালোচনা করতে চাই।
২. ১. আকীদার উৎস ওহী
বস্ত্তত আকীদা বিষয়ক সকল বিভক্তি ও বিভ্রান্তির মূল কারণ ‘‘আকীদা’’ বা ‘‘বিশ্বাস’’-এর উৎস নির্ধারণে বিভ্রান্তি, অস্পষ্টতা বা মতভেদ। এজন্য মোল্লা আলী কারী ‘‘আল-ফিকহুল আকবার’’ গ্রন্থের ব্যাখ্যায় আকীদা বা তাওহীদ-জ্ঞানের উৎস প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন, যা আমরা একটু পরে উল্লেখ করব, ইনশা আল্লাহ।
সাহাবীগণ, তাঁদের অনুসারী তাবিয়ীগণ, চার ইমাম ও আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মতে আকীদার একমাত্র উৎস ওহী। কারণ আকীদা বা বিশ্বাস অদৃশ্যের সাথে সম্পৃক্ত। আর অদৃশ্য বিষয়ে চূড়ান্ত ও সঠিক সত্য শুধু আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত ওহীর মাধ্যমেই জানা যায়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি দু প্রকারের ওহী প্রেরিত হয়েছে এবং দু ভাবে সংরক্ষিত হয়েছে: কিতাব বা কুরআন ও হিকমাহ বা হাদীস।[1]
কুরআন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপর যেভাবে অবতীর্ণ হয়েছে আক্ষরিকভাবে সেভাবেই তিনি ও সাহাবীগণ মুখস্থ করেছেন, প্রতিদিন সালাতে পাঠ করেছেন, রাতের সালাতে এবং নিয়মিত তিলাওয়াতে খতম করেছেন। এভাবে সাহাবীগণের যুগ থেকে অগণিত অসংখ্য মুসলিম কুরআন মুখস্থ ও তিলাওয়াতের মাধ্যমে সংরÿণ করেছেন। কুরআনই ঈমান, বিশ্বাস বা আকীদার মূল ভিত্তি।
আমরা পরবর্তীতে দেখব যে, কুরআনের বিষয়ে সাহাবী-তাবিয়ী ও তাঁদের অনুসারী আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মূলনীতি দুটি: (১) কুরআনের বক্তব্য সরল ও বাহ্যিক অর্থে গ্রহণ করা। কোনোরূপ ঘোরপ্যঁাচ বা তাফসীর-ব্যাখ্যার নামে আক্ষরিক ও সরল অর্থ পরিত্যাগ না করা। (২) কুরআনের সকল বক্তব্য সমানভাবে গ্রহণ ও বিশ্বাস করা। একটি বক্তব্যের অজুহাতে অন্য বক্তব্যকে ব্যাখ্যার নামে অর্থহীন না করা। বরং দুটি বক্তব্যই যথাসম্ভব সরল ও আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করা। শীয়া, খারিজী, মুতাযিলী ও অন্যান্য সম্প্রদায় এক্ষেত্রে তাফসীরের নামে সরল অর্থ ত্যাগ করেছে এবং একটি বক্তব্যের অজুহাতে অন্য বক্তব্য বাতিল করেছে।
আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অন্য মূলনীতি কুরআনের অর্থ ও ব্যাখ্যা অনুধাবনের ক্ষেত্রে সমস্যা হলে সাহাবীগণের অনুসরণ করা। তাঁরা যা বলেন নি তা আকীদার মধ্যে সংযোজন না করা।
দ্বিতীয় প্রকারের ওহী ‘‘আল-হিকমাহ’’ বা প্রজ্ঞা। কুরআনের ব্যাখ্যা ও প্রায়োগিক বিষয়ে ওহীর মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর রাসূল (ﷺ)-কে যে শিক্ষা, তথ্য ও জ্ঞান প্রদান করেন তিনি তা নিজের ভাষায় সাহাবীগণকে শিক্ষা দেন। তাঁর এ শিক্ষা ‘‘হাদীস’’ নামে সংকলিত হয়েছে। হাদীসই ইসলামী আকীদার দ্বিতীয় ভিত্তি ও উৎস।
সাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে যে কথা বা হাদীস শুনতেন তা অন্যদেরকে শোনাতেন। কেউ তা লিখে রাখতেন এবং কেউ মনে রাখতেন এবং প্রয়োজনে বলতেন। দ্বিতীয় প্রজন্মের মুসলিমগণ সাহাবীগণ থেকে হাদীস শিখতেন এবং লিপিবদ্ধ করতেন। দ্বিতীয় হিজরী শতকের শুরু থেকে হাদীস গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করা হয়।
হাদীসের বিষয়ে সাহাবীগণ ও পরবর্তী ইমামগণের মুলনীতি হাদীস নামে প্রচারিত বক্তব্য গ্রহণের আগে যাচাই করা। কেবলমাত্র ‘‘সহীহ’’ হাদীস গ্রহণ করা। অনির্ভরযোগ্য হাদীস বর্জন করা এবং হাদীসের নামে জালিয়াতির সর্বাত্মক বিরোধিতা করা। দুর্বল বা জাল হাদীস নিজেদের মতের পক্ষে হলেও তা বর্জন করে তার জালিয়াতি বা দুর্বলতা বর্ণনা করা এবং সহীহ হাদীস নিজেদের মতের বিরুদ্ধে হলেও তার বিশুদ্ধতা স্বীকার করে তার আলোকে নিজেদের মত সংশোধন ও সমন্বয় করা। সাহাবীগণ, তাবিয়ীগণ এবং চার ইমাম এ বিষয়ে অনেক নির্দেশনা দিয়েছেন। ইমাম আযমের কিছু বক্তব্য আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি। পাশাপাশি তাদের মূলনীতি হলো, সহীহ হাদীস বাহ্যিক ও সরল অর্থে গ্রহণ করা, ব্যাখ্যার নামে বিকৃত না করা এবং সকল সহীহ হাদীস যথাসম্ভব সমন্বিতভাবে গ্রহণ করা।
খারিজী, শীয়া, মুতাযিলা ও অন্যান্য গোষ্ঠী হাদীস বিষয়ে অনেক বিভ্রান্তি ও বৈপরীত্যের মধ্যে নিপতিত হয়েছে। সেগুলির অন্যতম:
(১) হাদীস গ্রহণ না করা। শীয়াগণের মতে সাহাবীগণ বিশ্বস্ত ছিলেন না (নাউযূ বিল্লাহ); কাজেই তাঁদের বর্ণিত হাদীস গ্রহণযোগ্য নয়। মুতাযিলীগণ হাদীসের বর্ণনায় ভুল থাকতে পারে অজুহাতে, কুরআন দিয়ে অথবা বুদ্ধি-বিবেক দিয়ে হাদীস যাচাইয়ের নামে হাদীস প্রত্যাখ্যান করে।
(২) সনদ যাচাই নয়, বরং পছন্দ অনুসারে হাদীস গ্রহণ করা। তারা বিশুদ্ধতা যাচাই করে হাদীস গ্রহণ করেন না। বরং যে হাদীস তাদের মতের পক্ষে তা তারা গ্রহণ করেন ও প্রমাণ হিসেবে পেশ করেন। আর যে হাদীস তাদের মতের বিপক্ষে তা নানা অজুহাতে অগ্রহণযোগ্য বলে দাবি করেন।
(৩) হাদীসের নামে মিথ্যা বলা বা জাল হাদীস প্রচার ও গ্রহণ করা। এ বিষয়ে শীয়াগণ অগ্রগামী ছিলেন। এছাড়া ‘‘আহলুস সুন্নাত’’ নামে পরিচয় দানকারী ‘‘কার্রামিয়া’’ ও অন্যান্য সম্প্রদায়ও নিজেদের মতের পক্ষে হাদীস জাল করা ও জাল হাদীস প্রচার করায় অগ্রণী ছিলেন। উপরন্তু আহলুস সুন্নাতের ইমামগণ যখন সনদ-বিচার করে সেগুলোর জালিয়াতি উদ্ঘাটন করতেন তখন তারা সনদ-প্রমাণের দিকে না যেয়ে তাঁদেরকে ‘নবীর (ﷺ) দুশমন’, ‘‘আলী-বংশের শত্রু’’, ‘‘এযিদের দালাল’’ ইত্যাদি বলে আখ্যায়িত করতেন। এভাবে তারা সরলপ্রাণ সাধারণ মুসলিমদের মধ্যে তাদের জালিয়াতির গ্রহণযোগ্যতা ও মুহাদ্দিসগণের যাচাইয়ের প্রতি বিরূপ মানসিকতা তৈরি করতেন। অন্যান্য ফিরকা নিজেরা জালিয়াতির ক্ষেত্রে অতটা অগ্রসর না হলেও নিজেদের পক্ষের জাল হাদীস গ্রহণ ও প্রচার করতেন।
(৪) ব্যাখ্যার নামে সরল অর্থ বিকৃত করা। হাদীসের ক্ষেত্রেও ব্যাখ্যার নামে হাদীসের সরল অর্থ বিকৃত করা এ সকল বিভ্রান্ত গোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য।
যে হাদীস সাহাবীগণের যুগ থেকেই বহু সনদে বর্ণিত তাকে ‘‘মুতাওয়াতির’’ (recurrent; frequent) বা বহুমুখে বর্ণিত হাদীস বলা হয়। মূলত কুরআনের পাশাপাশি এরূপ হাদীসই আকীদার ভিত্তি। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর উম্মাতকে বিশুদ্ধতম আকীদা ও আমল শিখিয়ে গিয়েছেন। আমলের ক্ষেত্রে বিকল্প আছে। সব মুসলিমের উপর ফরয কিছু কাজ ব্যতীত বিভিন্ন ফযীলতমূলক নেক কর্ম একটি না করলে অন্যটি করা যায়। কিন্তু আকীদার ক্ষেত্রে কোনো বিকল্প নেই। আকীদা সবার জন্য একই রূপে সর্বপ্রথম ফরয। যে বিষয়টি বিশ্বাস করা মুমিনের জন্য প্রয়োজন সে বিষয়টি অবশ্যই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর সকল সাহাবীকে সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষাতে জানিয়েছেন এবং সাহাবীগণও এভাবে তাবিয়ীগণকে জানিয়েছেন। এতে আমরা বুঝতে পারি যে, আকীদার বিষয় সুস্পষ্টভাবে কুরআনে অথবা মুতাওয়াতির হাদীসে বর্ণিত।
দু-একজন সাহাবী থেকে বর্ণিত হাদীসকে ‘আহাদ’ বা ‘‘খাবারুল ওয়াহিদ’’ অর্থাৎ একক হাদীস বলা হয়। ইমাম আবূ হানীফাসহ প্রথম দু শতাব্দীর সকল ইমাম, ফকীহ ও মুহাদ্দিসের দৃষ্টিতে ‘মুতাওয়াতির’ ও ‘আহাদ’ উভয় প্রকার সহীহ হাদীসই আকীদার ভিত্তি ও উৎস হিসেবে গৃহীত। এ বিষয়ে ইমাম আবূ হানীফার একাধিক বক্তব্য আমরা দেখেছি এবং আরো দেখব। এক্ষেত্রে পার্থক্য হলো, মুতাওয়াতির হাদীস দ্বারা প্রমাণিত বিষয় অস্বীকার করলে তা কুফর বলে গণ্য আর ‘আহাদ’ পর্যায়ের হাদীস দ্বারা প্রমাণিত বিষয় অস্বীকার করা বিভ্রান্তি ও পথভ্রষ্টতা বলে গণ্য করা হয়।
আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মতে কুরআনে ও হাদীসে যা বিশ্বাস করতে বলা হয়েছে তা সরলভাবে বিশ্বাস করা ইসলামী আকীদার মূল ভিত্তি। কুরআন ও হাদীসের বাণী অত্যন্ত সুস্পষ্ট। আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের (ﷺ) শিক্ষার মধ্যে কোনো জটিলতা, গোপনীয়তা বা স্ববিরোধিতা নেই। তারপরও কখনো জ্ঞানের দুর্বলতার কারণে কুরআন-হাদীস অনুধাবন বা ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে মতপার্থক্য বা দ্বিধা সৃষ্টি হলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাহাবীগণ এবং পরবর্তী দু প্রজন্ম ‘তাবিয়ী’ ও ‘তাবি-তাবিয়ীগণের’ ব্যাখ্যা ও মতামতই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে। বিশেষত তাঁদের ইজমা বা ঐকমত্য আকীদার প্রমাণ হিসেবে গণ্য। কুরআন ও হাদীসই তাঁদের বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করেছে। আমরা পরবর্তী আলোচনায় এ বিষয়ক কিছু আয়াত ও হাদীস দেখব, ইনশা আল্লাহ।
মুসলিম সমাজের প্রথম বিভ্রান্ত ফিরকা ‘‘খারিজীগণ’’ কুরআন ও হাদীসকে ইসলামী শরীয়ত ও আকীদার উৎস বলে স্বীকার করত। তাদের বিভ্রান্তির শুরু ‘‘জ্ঞানের অহঙ্কার’’ থেকে। ওহী অনুধাবনের জন্য সাহাবীগণের মতামত ও ব্যাখ্যার গুরুত্ব তারা অস্বীকার করত। এছাড়া ‘‘সুন্নাত’’-এর গুরুত্বও অস্বীকার করত। অর্থাৎ তাঁরা কুরআনের আয়াত বা হাদীস দিয়ে যে মতটি গ্রহণ করছে সে মত রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কর্মধারা বা রীতির মধ্যে বা প্রায়োগিক সুন্নাতের মধ্যে আছে কিনা তা বিবেচনা করত না। সর্বোপরি তারা কুরআন ও হাদীসের কিছু বক্তব্যের ভিত্তিতে নিজেদের মত গ্রহণ করত। এর বিপরীতে কুরআন-হাদীসের অন্যান্য বক্তব্য ব্যাখ্যা করে বাতিল করে দিত। এভাবে আমরা দেখছি যে, খারিজীগণের বিভ্রান্তির উৎস (১) সুন্নাতের গুরুত্ব অস্বীকার, (২) সাহাবীগণের মতামত অস্বীকার ও (৩) ‘‘পছন্দ’’ অনুসারে কুরআন-হাদীসের কিছু বক্তব্য গ্রহণ ও কিছু ব্যাখ্যার নামে বাতিল করা।
মুসলিম সমাজের দ্বিতীয় ফিরকা ‘‘শীয়া’’। সাহাবীগণ বর্ণিত হাদীস তারা অস্বীকার করে। তাদের ইমামগণের নামে অগণিত জাল ও মিথ্যা কথা হাদীস নামে তাদের মধ্যে প্রচলিত। তাদের অনেকে কুরআনকেও অস্বীকার করে এবং বিকৃত বলে দাবি করে। তবে স্বীকার বা অস্বীকার এখানে মূল্যহীন। তাদের বিভ্রান্তির মূল কারণ কুরআন-সুন্নাহর বাইরে ‘‘আল্লাহর পক্ষ থেকে জ্ঞান’’ গ্রহণের পথ আছে বলে বিশ্বাস করা। তাদের বিশ্বাসে ঈমান, আকীদা ও দীনের একমাত্র ভিত্তি আলী-বংশের ইমামগণ ও তাঁদের ‘খলীফা’ বা ‘ওলী’-গণের ‘গাইবী’ জ্ঞান। তারা এ গাইবী জ্ঞানকে ‘ওহী’, ‘ইলম লাদুন্নী’, ‘ইলহাম’, ‘ইলম বাতিন’, ‘কাশফ’, ‘ইলকা’ ইত্যাদি নামে আখ্যায়িত করত ও করে। তাদের মতে ইমামগণ, তাঁদের খলীফাগণ বা ওলীগণ আল্লাহর কাছ থেকে এভাবে যে ‘‘ঐশিক’’ বা ‘‘অলৌকিক’’ জ্ঞান লাভ করেন তা-ই আকীদা-বিশ্বাসের ভিত্তি। কুরআন-হাদীস সঠিকভাবে অনুধাবনের ক্ষমতাও তাঁদেরই আছে। তাঁরা মাসূম বা অভ্রান্ত, অর্থাৎ দীন বুঝার ক্ষেত্রে তাদের ভুল হতে পারে না। কুরআন-হাদীসের বক্তব্য গ্রহণ, বর্জন বা ব্যাখ্যা করতে হবে তাদের বক্তব্যের ভিত্তিতে।
ইসলামের প্রথম বরকতময় তিন শতাব্দীর পরে মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র শীয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয় ও সাধারণ ‘‘সুন্নী’’ মুসলিমগণও বিভিন্ন শীয়া আকীদা দ্বারা প্রভাবিত হন। এজন্য আমরা দেখি যে, শীয়াগণ ও শীয়াগণের দ্বারা প্রভাবিত অগণিত ‘‘সুন্নী’’ ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বিভিন্ন গালভরা উপাধিতে ভুষিত করে বিভিন্ন বুজুর্গকে অভ্রান্ত বলে দাবি করে ‘‘শিরক ফিন-নুবুওয়াত’’ বা ‘নুবুওয়াতে শিরকের’’ মধ্যে নিপতিত হয়েছেন। তাঁরা নিজেদের পছন্দমত বিভিন্ন বুজুর্গের নামে গাওস, কুতুব, ইমাম, মুজাদ্দিদ... ইত্যাদি উপাধি ব্যবহার করে তাদেরকে আল্লাহ বা তাঁর রাসূল (ﷺ) থেকে সরাসরি ‘‘ঐশী’’ বা অভ্রান্ত ইলম-প্রাপ্ত বলে দাবি করেছেন। উল্লেখ্য যে, গাওস, কুতুব ইত্যাদি কোনো উপাধি কুরআন-হাদীসে ব্যবহৃত হয় নি। ‘ইমাম’ শব্দটির প্রকৃত অর্থ আমরা পরবর্তীতে আলোচনা করব। উম্মাতের মধ্যে মুজাদ্দিদগণ থাকবেন। তবে কে মুজাদ্দিদ তা নিশ্চিতভাবে কেউই জানেন না। কাউকে মুজাদ্দিদ বলে চিহ্নিত করা একান্তই আন্দায ও অনুমান মাত্র। আর মুজাদ্দিদ দাবিতে কাউকে নির্ভুল মনে করা, মুজাদ্দিদকে ইলহাম বা কাশফ-সম্পন্ন হতে হবে বলে মনে করা বা কাউকে মুজাদ্দিদ বলে দাবি করে তার মতামতকে দলীলের মান দেওয়া সুস্পষ্ট বিভ্রান্তি।[1]
বস্ত্তত কুরআন ও হাদীসের পরে অন্য কিছুকে ভুলের ঊর্ধ্বে বা চূড়ান্ত বলে গণ্য করা, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পরে অন্য কাউকে ভুলের ঊর্ধ্বে বলে গণ্য করা এবং কাশফ, ইলকা, স্বপ্ন ইত্যাদিকে ‘কারামত’ বা ব্যক্তিগত সম্মাননার পর্যায় থেকে বের করে ঈমান, আকীদা বা দীনের হক্ক-বাতিল নির্ণয়ের জন্য ব্যবহার করা আকীদার ক্ষেত্রে বিভ্রান্তির অন্যতম কারণ। ইমামগণ এরূপ প্রবণতার ঘোর আপত্তি করেছেন। ইমাম মালিক (রাহ) বলেন:
كُلُّ أَحَدٍ يُؤْخَذُ مِنْ قَوْلِهِ وَيُتْرَكُ إِلاَّ صَاحِبَ هَذَا الْقَبْرِ ﷺ.
‘‘এ কবরে যিনি শায়িত আছেন-রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ছাড়া অন্য সকল মানুষের ক্ষেত্রেই তার কিছু কথা গ্রহণ ও কিছু কথা বর্জন করতে হয়।।’’[2]
এজন্য আহলুস সুন্নাতের মূলনীতি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পরে কোনো ব্যক্তির নিষ্পাপত্ব, অভ্রান্ততা বা বিশেষ জ্ঞানে বিশ্বাস না করা। তাঁরা কাশফ, ইল্হাম, ইত্যাদির অস্তিত্ব বিশ্বাস করেন এবং এগুলিকে ব্যক্তি মুমিনের জন্য ‘কারামত’ ও নিয়ামত বলে গণ্য করেন। কিন্তু এগুলোকে আকীদার ভিত্তি বা কুরআন-সুন্নাহর ব্যাখ্যার উৎস হিসেবে গ্রহণ করেন না। কোনো আলিম-বজুর্গই ‘মাসূম’ বা অভ্রান্ততার পদমর্যাদা পাবেন না। তার অনেক সঠিক মতের পাশাপাশি কিছু ভুল মত থাকবে এটাই স্বাভাবিক ও সুনিশ্চিত। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পরে আর কারো কথাই নির্বিচারে গ্রহণ করা হয় না, কুরআন-সুন্নাহ দিয়ে বিচার করে গ্রহণ করতে হয়। কারো কথা দিয়ে কুরআন বা সুন্নাহ বিচার করা যায় না বরং কুরআন ও সুন্নাহ দিয়ে প্রত্যেকের কথা বিচার করতে হয়।
আল্লামা উমর ইবন মুহাম্মাদ আন-নাসাফী (৫৩৭ হি) ‘‘আল-আকাইদ আন-নাসাফিয়্যাহ’’ ও আল্লামা সা’দ উদ্দীন মাসঊদ ইবন উমর তাফতাযানী (৭৯১হি) ‘‘শারহুল আকাইদ আন নাসাফিয়্যাহ’’-তে লিখেছেন:
اَلإِلْهَامُ الْمُفَسَّرُ بِإِلْقَاءِ مَعْنًى فِيْ الْقَلْبِ بِطَرِيْقِ الْفَيْضِ لَيْسَ مِنْ أَسْبَابِ الْمَعْرِفَةِ بِصِحَّةِ الشَّيْءِ عِنْدَ أَهْلِ الْحَقِّ.
‘‘হক্কপন্থীগণের নিকট ইলহাম বা ইলকা-ফয়েজ কোনো কিছুর সঠিকত্ব জানার কোনো মাধ্যম নয়।’’[3]
[2] যাহাবী, সিয়ারু আলামিন নুবালা ৮/৯৩।
[3] তাফতাযানী, সাদ উদ্দীন, শারহুল আকাইদ আন নাসাফিয়্যাহ, পৃ: ২২।
জাহমিয়া, মুতাযিলা ও অন্যান্য ফিরকার বিভ্রান্তির কারণ ছিল ‘আকলী দলীল’, অর্থাৎ বুদ্ধিবৃত্তিক বা দার্শনিক যুক্তি-প্রমাণকে ওহীর উপরে স্থান দেওয়া। তাদের মতে আকীদার সত্য জানার জন্য ‘আকল’ই সুনিশ্চিত পথ। ‘আকলী দলীল’-এর নির্দেশনা ‘একীনী’ অর্থাৎ ‘সুনিশ্চিত’। পক্ষান্তরে ‘নকলী দলীল’ বা কুরআন-হাদীসের নির্দেশনা ‘যান্নী’, অর্থাৎ ‘অস্পষ্ট’ বা ‘ধারণা প্রদানকারী’। ওহীর নির্দেশনা ‘আকলসম্মত’ হলে তা গ্রহণ করতে হবে। আর তা আকলসম্মত না হলে ব্যাখ্যা করে প্রত্যাখ্যান করতে হবে।
ইসলাম ‘আকল’, ‘আকলী দলীল’ ও যৌক্তিকতাকে গুরুত্ব প্রদান করেছে। কখনোই ধর্মের নামে মানবীয় জ্ঞান, যুক্তি বা ‘আকলী দলীলের’ সাথে সাংঘর্ষিক কিছু বিশ্বাস করতে শেখানো হয় নি। ‘আহলুস সুন্নাত’ ‘আকল’-এর গুরুত্ব স্বীকার করেন। কিন্তু আকীদা প্রমাণের ক্ষেত্রে আকলী দলীলকে ওহীর ঊর্ধ্বে স্থান দেন না। মানবীয় প্রকৃতি ও সহজাত অনুভূতির নিকট গ্রহণযোগ্য ও বুদ্ধিগ্রাহ্য ওহী নির্দেশিত বিশ্বাসকে ‘আকলী দলীলের’ নামে প্রত্যাখ্যানের নিন্দা করেন তাঁরা। মানবীয় জ্ঞান-বুদ্ধি আল্লাহর অন্যতম নিয়ামত। আল্লাহ মানুষকে এ নিয়ামত দিয়েই সর্বোচ্চ মর্যাদা প্রদান করেছেন। যেহেতু আকল ও ওহী দুটিই আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত নিয়ামত সেহেতু এ দুয়ের মধ্যে কোনো বৈপরীত্য থাকতে পারে না। তবে এ দুয়ের বিচরণ ক্ষেত্র পৃথক। গাইবী বিষয়ে ‘আকলী দলীল’ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিতে অক্ষম। এক্ষেত্রে ওহীই নিশ্চিত জ্ঞান প্রদান করে।
ওহীপ্রাপ্ত জাতিগুলোর বিভ্রান্তির বড় কারণ ওহীর বিপরীতে ‘আকলী দলীল’ বা ‘দার্শনিক যুক্তি’ পেশ করা। প্রচলিত খৃস্টধর্মের প্রতিষ্ঠাতা সাধু পল ও তার অনুসারীগণ ত্রিত্ববাদ, যীশুর ঈশ্বরত্ব, মহান আল্লাহর মানবীয় দেহধারণ, আদিপাপ, প্রায়শ্চিত্ববাদ ইত্যাদি ওহী বিরোধী ও ঈসা মাসীহের বক্তব্য বিরোধী বিশ্বাসগুলোর পক্ষে ‘আকলী দলীল’ নামে যে সকল দলীল প্রদান করেছেন সেগুলো পর্যালোচনা করলে যে কেউ বুঝবেন যে, কত উদ্ভট কথা ‘আকলী দলীল’ নামে অগণিত আদম সমত্মান গ্রহণ করছেন।
সর্বোপরি, মানবীয় বুদ্ধি-বিবেক অস্থিতিশীল ও অনিশ্চিত। একজনের কাছে যা যৌক্তিক বা ‘নিশ্চিত আকলী দলীল’ অন্যের কাছে তা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও জ্ঞান-বিরুদ্ধ। আবার একই ব্যক্তির বুদ্ধি, বিবেক ও যুক্তি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত দেয়। দেবতার জন্য নরবলি প্রদানের পক্ষে অনেকে ‘আকলী দলীল’ প্রদান করছেন। আবার মানুষের জন্য মাংস ভক্ষণকে অনেকে মানবতা বিরোধী বলে ‘আকলী দলীল’ পেশ করছেন।
ধর্মের নামে যদি বলা হয় স্রষ্টা জন্ম, বর্ণ বা বংশের কারণে তাঁর কোনো সৃষ্টিকে ঘৃণা বা হেয় করেন, তিনি মানুষের বেশ ধরে পৃথিবীতে আসেন, তিনি একজনের পাপে অন্যজনকে শাস্তি দেন ... তবে তা ‘ওহী’ নয় বলে প্রমাণিত হবে। কারণ এ সকল বিষয় সহজাত বিবেকে ও জ্ঞানবুদ্ধির সাথে সাংঘর্ষিক। পক্ষান্তরে যদি বলা হয় যে, আল্লাহ ক্ষমাশীল-করুণাময় এবং তিনি ন্যায়বিচারক-শাস্তিদাতা তবে উভয় বিষয়ই মানবীয় বিবেকসম্মত ও যৌক্তিক। আকীদা বিষয়ে কুরআন-সুন্নাহর সকল নির্দেশনাই এরূপ মানবীয় বিবেকসম্মত ও বুদ্ধিগ্রাহ্য। এরূপ বিষয়ে যদি কেউ নিজের বুদ্ধি দিয়ে উভয় বিশেষণের মধ্যে বৈপরীত্য অনুভব করেন এবং বিভিন্ন যুক্তি বা দর্শন নির্ভর বক্তব্যকে ‘আকলী দলীল’ নাম দিয়ে ওহীর শিক্ষা বাতিল বা ব্যাখ্যা করেন তবে তা বিভ্রান্তি।
কোনো বক্তব্যের ব্যাখ্যা দু পর্যায়ের হতে পারে: (১) বাহ্যিক ও সরল অর্থ এবং (২) বাহ্যিক অর্থের ব্যতিক্রম বা অতিরিক্ত কোনো অর্থ যা বাহ্যিক অর্থ থেকে বুঝা যায় না। প্রথম পর্যায়ের ব্যাখ্যা মূলত ওহীরই অর্থ। দ্বিতীয় পর্যায়ের ব্যাখ্যা ওহী অনুধাবনের বিভিন্ন ব্যক্তির মত। আমরা ব্যাখ্যা বলতে দ্বিতীয় পর্যায়ের ব্যাখ্যা বুঝাচ্ছি। বিভ্রান্ত সকল গোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য ওহীর এরূপ ব্যাখ্যাকে ওহীর সমতূল্য মনে করা। তাদের আকীদার ভিত্তিই ‘‘তাফসীর’’। একটি নমুনা দেখুন। আল্লাহ বলেছেন:
إِنَّمَا وَلِيُّكُمُ اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَالَّذِينَ آَمَنُوا الَّذِينَ يُقِيمُونَ الصَّلاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَهُمْ رَاكِعُونَ
‘‘তোমাদের অভিভাবক-বন্ধু তো আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং যারা ঈমান গ্রহণ করেছে, যারা সালাত কায়েম করে এবং যাকাত প্রদান করে এবং তারা রুকু-রত।’’[1]
ইবন আব্বাস (রা), আলী (রা), আম্মার (রা), মুজাহিদ ইবন জাব্র প্রমুখ সাহাবী ও তাবিয়ী থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, এ আয়াতটি আলী (রা)-এর সম্পর্কে অবতীর্ণ। এ বিষয়ক বর্ণনাগুলোর অধিকাংশ সনদ অত্যন্ত দুর্বল। এ বর্ণনাগুলোর সার সংক্ষেপ এই যে, একজন ভিক্ষুক মসজিদের মধ্যে ভিক্ষা চান। কেউ তাকে কোনো ভিক্ষা প্রদান করেন না। আলী (রা) তখন মসজিদের মধ্যে নফল সালাত আদায়ে রত ছিলেন। তিনি এ সময় রুকুরত অবস্থায় ছিলেন। এ অবস্থাতেই তিনি ইশারায় ভিক্ষুককে ডাকেন এবং নিজের হাতের আংটি খুলে ভিক্ষুককে প্রদান করেন। ভিক্ষুক রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট আগমন করে বিষয়টি জানান। তখন মহান আল্লাহ এ আয়াত নাযিল করেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আয়াতটি পাঠ করে বলেন, ‘‘আমি যার বন্ধু আলীও তার বন্ধু। হে আল্লাহ, আলীকে যে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে তাকে আপনি বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করুন এবং আলীর সাথে যে শত্রুতা করে আপনি তার সাথে শত্রুতা করুন।’’[2]
এ শানে নুযূল ও তাফসীরকে শীয়াগণ তাদের আকীদার ভিত্তি বানিয়েছেন। তারা বলেন, এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত যে, আলীকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করা বা তাঁর দলভুক্ত হওয়া ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কাজেই সাহাবীগণ ও তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল সকল মুসলিমই আল্লাহর দুশমন। আলীকে রাষ্ট্রক্ষমতা প্রদান না করে, তাঁর বিরোধিতা করে বা তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আবূ বকর, উমার, উসমান, মুআবিয়া (রাঃ) ও অন্যান্য সাহাবী আল্লাহর দুশমন হয়েছেন। আর তাঁদের সমর্থকগণও আল্লাহর দুশমন। তাঁরা সকলেই কুরআনের নির্দেশ অস্বীকার করার কারণে কাফির-মুরতাদ বলে গণ্য (নাউযূ বিল্লাহ!)।
কুরআন ও তাফসীরের মধ্যে পার্থক্য লক্ষ্য করুন। কুরআনের নির্দেশ: মুমিনদের অবশ্যই আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ)-কে এবং সালাত কায়েমকারী ও যাকাত প্রদানকারী মুমিনগণকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। আলী (রা) ও সকল সাহাবী ও অন্যান্য মুমিন এর অন্তর্ভুক্ত। এক্ষেত্রে আলী (রা)-এর বিশেষত্ব কুরআন দ্বারা প্রমাণিত নয় বরং দুর্বল বা ‘আহাদ’ পর্যায়ের হাদীসে বর্ণিত এবং কোনো কোনো মুফাস্সিরের মত। এ সকল মত দ্বারা আলী (রা)-এর মর্যাদা জানা যায়, তবে অন্যান্য সাহাবীর অবমূল্যায়ন জানা যায় না। সর্বোপরি কখনোই বিষয়টিকে আকীদার অংশ বানানো যায় না। যে কোনোভাবে আল্লাহ বা তাঁর রাসূলের (ﷺ) বিরোধিতা বা বিদ্বেষেপোষণ ঈমান বিনষ্টকারী। কিন্তু জাগতিক বা ইজতিহাদী কারণে আলী (রা)-এর বিরোধিতা করা তদ্রূপ নয়। কিন্তু শীয়াগণ তাফসীরকে বিশ্বাসের ভিত্তি বানিয়েছেন। আমরা দেখব যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও আলী-বংশের ইমামগণের নূর (আলো) থেকে সৃষ্টি, তাদের গাইবী ইলম ইতাদি আকীদার ক্ষেত্রেও শীয়াগণ এরূপ তাফসীরের উপরেই নির্ভর করেন।
[2] তাবারী, তাফসীর ৬/২৮৮-২৮৯; ইবনু কাসীর, তাফসীর ২/৭২।