আল-ফিকহুল আকবর মহান আল্লাহর বিশেষণ, তাকদীর ইত্যাদি ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.)
২. ৫. ওহী বনাম ওহীর ব্যাখ্যা

কোনো বক্তব্যের ব্যাখ্যা দু পর্যায়ের হতে পারে: (১) বাহ্যিক ও সরল অর্থ এবং (২) বাহ্যিক অর্থের ব্যতিক্রম বা অতিরিক্ত কোনো অর্থ যা বাহ্যিক অর্থ থেকে বুঝা যায় না। প্রথম পর্যায়ের ব্যাখ্যা মূলত ওহীরই অর্থ। দ্বিতীয় পর্যায়ের ব্যাখ্যা ওহী অনুধাবনের বিভিন্ন ব্যক্তির মত। আমরা ব্যাখ্যা বলতে দ্বিতীয় পর্যায়ের ব্যাখ্যা বুঝাচ্ছি। বিভ্রান্ত সকল গোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য ওহীর এরূপ ব্যাখ্যাকে ওহীর সমতূল্য মনে করা। তাদের আকীদার ভিত্তিই ‘‘তাফসীর’’। একটি নমুনা দেখুন। আল্লাহ বলেছেন:


إِنَّمَا وَلِيُّكُمُ اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَالَّذِينَ آَمَنُوا الَّذِينَ يُقِيمُونَ الصَّلاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَهُمْ رَاكِعُونَ


‘‘তোমাদের অভিভাবক-বন্ধু তো আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং যারা ঈমান গ্রহণ করেছে, যারা সালাত কায়েম করে এবং যাকাত প্রদান করে এবং তারা রুকু-রত।’’[1]

ইবন আব্বাস (রা), আলী (রা), আম্মার (রা), মুজাহিদ ইবন জাব্র প্রমুখ সাহাবী ও তাবিয়ী থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, এ আয়াতটি আলী (রা)-এর সম্পর্কে অবতীর্ণ। এ বিষয়ক বর্ণনাগুলোর অধিকাংশ সনদ অত্যন্ত দুর্বল। এ বর্ণনাগুলোর সার সংক্ষেপ এই যে, একজন ভিক্ষুক মসজিদের মধ্যে ভিক্ষা চান। কেউ তাকে কোনো ভিক্ষা প্রদান করেন না। আলী (রা) তখন মসজিদের মধ্যে নফল সালাত আদায়ে রত ছিলেন। তিনি এ সময় রুকুরত অবস্থায় ছিলেন। এ অবস্থাতেই তিনি ইশারায় ভিক্ষুককে ডাকেন এবং নিজের হাতের আংটি খুলে ভিক্ষুককে প্রদান করেন। ভিক্ষুক রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট আগমন করে বিষয়টি জানান। তখন মহান আল্লাহ এ আয়াত নাযিল করেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আয়াতটি পাঠ করে বলেন, ‘‘আমি যার বন্ধু আলীও তার বন্ধু। হে আল্লাহ, আলীকে যে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে তাকে আপনি বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করুন এবং আলীর সাথে যে শত্রুতা করে আপনি তার সাথে শত্রুতা করুন।’’[2]

এ শানে নুযূল ও তাফসীরকে শীয়াগণ তাদের আকীদার ভিত্তি বানিয়েছেন। তারা বলেন, এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত যে, আলীকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করা বা তাঁর দলভুক্ত হওয়া ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কাজেই সাহাবীগণ ও তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল সকল মুসলিমই আল্লাহর দুশমন। আলীকে রাষ্ট্রক্ষমতা প্রদান না করে, তাঁর বিরোধিতা করে বা তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আবূ বকর, উমার, উসমান, মুআবিয়া (রাঃ) ও অন্যান্য সাহাবী আল্লাহর দুশমন হয়েছেন। আর তাঁদের সমর্থকগণও আল্লাহর দুশমন। তাঁরা সকলেই কুরআনের নির্দেশ অস্বীকার করার কারণে কাফির-মুরতাদ বলে গণ্য (নাউযূ বিল্লাহ!)।

কুরআন ও তাফসীরের মধ্যে পার্থক্য লক্ষ্য করুন। কুরআনের নির্দেশ: মুমিনদের অবশ্যই আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ)-কে এবং সালাত কায়েমকারী ও যাকাত প্রদানকারী মুমিনগণকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। আলী (রা) ও সকল সাহাবী ও অন্যান্য মুমিন এর অন্তর্ভুক্ত। এক্ষেত্রে আলী (রা)-এর বিশেষত্ব কুরআন দ্বারা প্রমাণিত নয় বরং দুর্বল বা ‘আহাদ’ পর্যায়ের হাদীসে বর্ণিত এবং কোনো কোনো মুফাস্সিরের মত। এ সকল মত দ্বারা আলী (রা)-এর মর্যাদা জানা যায়, তবে অন্যান্য সাহাবীর অবমূল্যায়ন জানা যায় না। সর্বোপরি কখনোই বিষয়টিকে আকীদার অংশ বানানো যায় না। যে কোনোভাবে আল্লাহ বা তাঁর রাসূলের (ﷺ) বিরোধিতা বা বিদ্বেষেপোষণ ঈমান বিনষ্টকারী। কিন্তু জাগতিক বা ইজতিহাদী কারণে আলী (রা)-এর বিরোধিতা করা তদ্রূপ নয়। কিন্তু শীয়াগণ তাফসীরকে বিশ্বাসের ভিত্তি বানিয়েছেন। আমরা দেখব যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও আলী-বংশের ইমামগণের নূর (আলো) থেকে সৃষ্টি, তাদের গাইবী ইলম ইতাদি আকীদার ক্ষেত্রেও শীয়াগণ এরূপ তাফসীরের উপরেই নির্ভর করেন।

[1] সূরা (৫) মায়িদা: ৫৫ আয়াত।

[2] তাবারী, তাফসীর ৬/২৮৮-২৮৯; ইবনু কাসীর, তাফসীর ২/৭২।