মুসলিম সমাজের দ্বিতীয় ফিরকা ‘‘শীয়া’’। সাহাবীগণ বর্ণিত হাদীস তারা অস্বীকার করে। তাদের ইমামগণের নামে অগণিত জাল ও মিথ্যা কথা হাদীস নামে তাদের মধ্যে প্রচলিত। তাদের অনেকে কুরআনকেও অস্বীকার করে এবং বিকৃত বলে দাবি করে। তবে স্বীকার বা অস্বীকার এখানে মূল্যহীন। তাদের বিভ্রান্তির মূল কারণ কুরআন-সুন্নাহর বাইরে ‘‘আল্লাহর পক্ষ থেকে জ্ঞান’’ গ্রহণের পথ আছে বলে বিশ্বাস করা। তাদের বিশ্বাসে ঈমান, আকীদা ও দীনের একমাত্র ভিত্তি আলী-বংশের ইমামগণ ও তাঁদের ‘খলীফা’ বা ‘ওলী’-গণের ‘গাইবী’ জ্ঞান। তারা এ গাইবী জ্ঞানকে ‘ওহী’, ‘ইলম লাদুন্নী’, ‘ইলহাম’, ‘ইলম বাতিন’, ‘কাশফ’, ‘ইলকা’ ইত্যাদি নামে আখ্যায়িত করত ও করে। তাদের মতে ইমামগণ, তাঁদের খলীফাগণ বা ওলীগণ আল্লাহর কাছ থেকে এভাবে যে ‘‘ঐশিক’’ বা ‘‘অলৌকিক’’ জ্ঞান লাভ করেন তা-ই আকীদা-বিশ্বাসের ভিত্তি। কুরআন-হাদীস সঠিকভাবে অনুধাবনের ক্ষমতাও তাঁদেরই আছে। তাঁরা মাসূম বা অভ্রান্ত, অর্থাৎ দীন বুঝার ক্ষেত্রে তাদের ভুল হতে পারে না। কুরআন-হাদীসের বক্তব্য গ্রহণ, বর্জন বা ব্যাখ্যা করতে হবে তাদের বক্তব্যের ভিত্তিতে।
ইসলামের প্রথম বরকতময় তিন শতাব্দীর পরে মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র শীয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয় ও সাধারণ ‘‘সুন্নী’’ মুসলিমগণও বিভিন্ন শীয়া আকীদা দ্বারা প্রভাবিত হন। এজন্য আমরা দেখি যে, শীয়াগণ ও শীয়াগণের দ্বারা প্রভাবিত অগণিত ‘‘সুন্নী’’ ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বিভিন্ন গালভরা উপাধিতে ভুষিত করে বিভিন্ন বুজুর্গকে অভ্রান্ত বলে দাবি করে ‘‘শিরক ফিন-নুবুওয়াত’’ বা ‘নুবুওয়াতে শিরকের’’ মধ্যে নিপতিত হয়েছেন। তাঁরা নিজেদের পছন্দমত বিভিন্ন বুজুর্গের নামে গাওস, কুতুব, ইমাম, মুজাদ্দিদ... ইত্যাদি উপাধি ব্যবহার করে তাদেরকে আল্লাহ বা তাঁর রাসূল (ﷺ) থেকে সরাসরি ‘‘ঐশী’’ বা অভ্রান্ত ইলম-প্রাপ্ত বলে দাবি করেছেন। উল্লেখ্য যে, গাওস, কুতুব ইত্যাদি কোনো উপাধি কুরআন-হাদীসে ব্যবহৃত হয় নি। ‘ইমাম’ শব্দটির প্রকৃত অর্থ আমরা পরবর্তীতে আলোচনা করব। উম্মাতের মধ্যে মুজাদ্দিদগণ থাকবেন। তবে কে মুজাদ্দিদ তা নিশ্চিতভাবে কেউই জানেন না। কাউকে মুজাদ্দিদ বলে চিহ্নিত করা একান্তই আন্দায ও অনুমান মাত্র। আর মুজাদ্দিদ দাবিতে কাউকে নির্ভুল মনে করা, মুজাদ্দিদকে ইলহাম বা কাশফ-সম্পন্ন হতে হবে বলে মনে করা বা কাউকে মুজাদ্দিদ বলে দাবি করে তার মতামতকে দলীলের মান দেওয়া সুস্পষ্ট বিভ্রান্তি।[1]
বস্ত্তত কুরআন ও হাদীসের পরে অন্য কিছুকে ভুলের ঊর্ধ্বে বা চূড়ান্ত বলে গণ্য করা, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পরে অন্য কাউকে ভুলের ঊর্ধ্বে বলে গণ্য করা এবং কাশফ, ইলকা, স্বপ্ন ইত্যাদিকে ‘কারামত’ বা ব্যক্তিগত সম্মাননার পর্যায় থেকে বের করে ঈমান, আকীদা বা দীনের হক্ক-বাতিল নির্ণয়ের জন্য ব্যবহার করা আকীদার ক্ষেত্রে বিভ্রান্তির অন্যতম কারণ। ইমামগণ এরূপ প্রবণতার ঘোর আপত্তি করেছেন। ইমাম মালিক (রাহ) বলেন:
كُلُّ أَحَدٍ يُؤْخَذُ مِنْ قَوْلِهِ وَيُتْرَكُ إِلاَّ صَاحِبَ هَذَا الْقَبْرِ ﷺ.
‘‘এ কবরে যিনি শায়িত আছেন-রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ছাড়া অন্য সকল মানুষের ক্ষেত্রেই তার কিছু কথা গ্রহণ ও কিছু কথা বর্জন করতে হয়।।’’[2]
এজন্য আহলুস সুন্নাতের মূলনীতি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পরে কোনো ব্যক্তির নিষ্পাপত্ব, অভ্রান্ততা বা বিশেষ জ্ঞানে বিশ্বাস না করা। তাঁরা কাশফ, ইল্হাম, ইত্যাদির অস্তিত্ব বিশ্বাস করেন এবং এগুলিকে ব্যক্তি মুমিনের জন্য ‘কারামত’ ও নিয়ামত বলে গণ্য করেন। কিন্তু এগুলোকে আকীদার ভিত্তি বা কুরআন-সুন্নাহর ব্যাখ্যার উৎস হিসেবে গ্রহণ করেন না। কোনো আলিম-বজুর্গই ‘মাসূম’ বা অভ্রান্ততার পদমর্যাদা পাবেন না। তার অনেক সঠিক মতের পাশাপাশি কিছু ভুল মত থাকবে এটাই স্বাভাবিক ও সুনিশ্চিত। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পরে আর কারো কথাই নির্বিচারে গ্রহণ করা হয় না, কুরআন-সুন্নাহ দিয়ে বিচার করে গ্রহণ করতে হয়। কারো কথা দিয়ে কুরআন বা সুন্নাহ বিচার করা যায় না বরং কুরআন ও সুন্নাহ দিয়ে প্রত্যেকের কথা বিচার করতে হয়।
আল্লামা উমর ইবন মুহাম্মাদ আন-নাসাফী (৫৩৭ হি) ‘‘আল-আকাইদ আন-নাসাফিয়্যাহ’’ ও আল্লামা সা’দ উদ্দীন মাসঊদ ইবন উমর তাফতাযানী (৭৯১হি) ‘‘শারহুল আকাইদ আন নাসাফিয়্যাহ’’-তে লিখেছেন:
اَلإِلْهَامُ الْمُفَسَّرُ بِإِلْقَاءِ مَعْنًى فِيْ الْقَلْبِ بِطَرِيْقِ الْفَيْضِ لَيْسَ مِنْ أَسْبَابِ الْمَعْرِفَةِ بِصِحَّةِ الشَّيْءِ عِنْدَ أَهْلِ الْحَقِّ.
‘‘হক্কপন্থীগণের নিকট ইলহাম বা ইলকা-ফয়েজ কোনো কিছুর সঠিকত্ব জানার কোনো মাধ্যম নয়।’’[3]
[2] যাহাবী, সিয়ারু আলামিন নুবালা ৮/৯৩।
[3] তাফতাযানী, সাদ উদ্দীন, শারহুল আকাইদ আন নাসাফিয়্যাহ, পৃ: ২২।