জাহমিয়া, মুতাযিলা ও অন্যান্য ফিরকার বিভ্রান্তির কারণ ছিল ‘আকলী দলীল’, অর্থাৎ বুদ্ধিবৃত্তিক বা দার্শনিক যুক্তি-প্রমাণকে ওহীর উপরে স্থান দেওয়া। তাদের মতে আকীদার সত্য জানার জন্য ‘আকল’ই সুনিশ্চিত পথ। ‘আকলী দলীল’-এর নির্দেশনা ‘একীনী’ অর্থাৎ ‘সুনিশ্চিত’। পক্ষান্তরে ‘নকলী দলীল’ বা কুরআন-হাদীসের নির্দেশনা ‘যান্নী’, অর্থাৎ ‘অস্পষ্ট’ বা ‘ধারণা প্রদানকারী’। ওহীর নির্দেশনা ‘আকলসম্মত’ হলে তা গ্রহণ করতে হবে। আর তা আকলসম্মত না হলে ব্যাখ্যা করে প্রত্যাখ্যান করতে হবে।
ইসলাম ‘আকল’, ‘আকলী দলীল’ ও যৌক্তিকতাকে গুরুত্ব প্রদান করেছে। কখনোই ধর্মের নামে মানবীয় জ্ঞান, যুক্তি বা ‘আকলী দলীলের’ সাথে সাংঘর্ষিক কিছু বিশ্বাস করতে শেখানো হয় নি। ‘আহলুস সুন্নাত’ ‘আকল’-এর গুরুত্ব স্বীকার করেন। কিন্তু আকীদা প্রমাণের ক্ষেত্রে আকলী দলীলকে ওহীর ঊর্ধ্বে স্থান দেন না। মানবীয় প্রকৃতি ও সহজাত অনুভূতির নিকট গ্রহণযোগ্য ও বুদ্ধিগ্রাহ্য ওহী নির্দেশিত বিশ্বাসকে ‘আকলী দলীলের’ নামে প্রত্যাখ্যানের নিন্দা করেন তাঁরা। মানবীয় জ্ঞান-বুদ্ধি আল্লাহর অন্যতম নিয়ামত। আল্লাহ মানুষকে এ নিয়ামত দিয়েই সর্বোচ্চ মর্যাদা প্রদান করেছেন। যেহেতু আকল ও ওহী দুটিই আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত নিয়ামত সেহেতু এ দুয়ের মধ্যে কোনো বৈপরীত্য থাকতে পারে না। তবে এ দুয়ের বিচরণ ক্ষেত্র পৃথক। গাইবী বিষয়ে ‘আকলী দলীল’ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিতে অক্ষম। এক্ষেত্রে ওহীই নিশ্চিত জ্ঞান প্রদান করে।
ওহীপ্রাপ্ত জাতিগুলোর বিভ্রান্তির বড় কারণ ওহীর বিপরীতে ‘আকলী দলীল’ বা ‘দার্শনিক যুক্তি’ পেশ করা। প্রচলিত খৃস্টধর্মের প্রতিষ্ঠাতা সাধু পল ও তার অনুসারীগণ ত্রিত্ববাদ, যীশুর ঈশ্বরত্ব, মহান আল্লাহর মানবীয় দেহধারণ, আদিপাপ, প্রায়শ্চিত্ববাদ ইত্যাদি ওহী বিরোধী ও ঈসা মাসীহের বক্তব্য বিরোধী বিশ্বাসগুলোর পক্ষে ‘আকলী দলীল’ নামে যে সকল দলীল প্রদান করেছেন সেগুলো পর্যালোচনা করলে যে কেউ বুঝবেন যে, কত উদ্ভট কথা ‘আকলী দলীল’ নামে অগণিত আদম সমত্মান গ্রহণ করছেন।
সর্বোপরি, মানবীয় বুদ্ধি-বিবেক অস্থিতিশীল ও অনিশ্চিত। একজনের কাছে যা যৌক্তিক বা ‘নিশ্চিত আকলী দলীল’ অন্যের কাছে তা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও জ্ঞান-বিরুদ্ধ। আবার একই ব্যক্তির বুদ্ধি, বিবেক ও যুক্তি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত দেয়। দেবতার জন্য নরবলি প্রদানের পক্ষে অনেকে ‘আকলী দলীল’ প্রদান করছেন। আবার মানুষের জন্য মাংস ভক্ষণকে অনেকে মানবতা বিরোধী বলে ‘আকলী দলীল’ পেশ করছেন।
ধর্মের নামে যদি বলা হয় স্রষ্টা জন্ম, বর্ণ বা বংশের কারণে তাঁর কোনো সৃষ্টিকে ঘৃণা বা হেয় করেন, তিনি মানুষের বেশ ধরে পৃথিবীতে আসেন, তিনি একজনের পাপে অন্যজনকে শাস্তি দেন ... তবে তা ‘ওহী’ নয় বলে প্রমাণিত হবে। কারণ এ সকল বিষয় সহজাত বিবেকে ও জ্ঞানবুদ্ধির সাথে সাংঘর্ষিক। পক্ষান্তরে যদি বলা হয় যে, আল্লাহ ক্ষমাশীল-করুণাময় এবং তিনি ন্যায়বিচারক-শাস্তিদাতা তবে উভয় বিষয়ই মানবীয় বিবেকসম্মত ও যৌক্তিক। আকীদা বিষয়ে কুরআন-সুন্নাহর সকল নির্দেশনাই এরূপ মানবীয় বিবেকসম্মত ও বুদ্ধিগ্রাহ্য। এরূপ বিষয়ে যদি কেউ নিজের বুদ্ধি দিয়ে উভয় বিশেষণের মধ্যে বৈপরীত্য অনুভব করেন এবং বিভিন্ন যুক্তি বা দর্শন নির্ভর বক্তব্যকে ‘আকলী দলীল’ নাম দিয়ে ওহীর শিক্ষা বাতিল বা ব্যাখ্যা করেন তবে তা বিভ্রান্তি।