যখন দ্বীনের দাওয়াত পুরোপুরি পূর্ণতা লাভ করল, আরবের পুরো নিয়ন্ত্রণ মুসলিমগণের আয়ত্বে এসে গেল, তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আবেগ ও অনুভূতি, প্রবণতা ও প্রতিক্রিয়া এবং কথাবার্তা ও আচার-আচরণ হতে এমন কতগুলো আলামত প্রকাশ পেতে থাকল যাতে এটা ক্রমেই স্পষ্ট হতে লাগল যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এ অস্থায়ী জীবন থেকে বিদায় নিতে এবং এ অস্থায়ী দুনিয়ার অধিবাসীদেরকে বিদায় সম্ভাষণ জানাতে যাচ্ছেন। উদাহরণস্বরূপ এখানে তাঁর ই'তেকাফের প্রসঙ্গটি উল্লেখ করা যেতে পারে। সাধারণভাবে রমাযান মাসে তিনি শেষ দশ দিন ই’তিক্বাফ করতেন। কিন্তু ১০ম হিজরীতে তিনি ই’তিক্বাফ করেন বিশ দিন।
অধিকন্তু জিবরাঈল (আঃ) এ বছর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে দু’ বার কুরআন পুনঃপাঠ করিয়েছিলেন যেক্ষেত্রে অন্যান্য বছরগুলোতে মাত্র একবার কুরআন পুনঃপাঠ করিয়েছিলেন। তাছাড়া নাবী কারীম (ﷺ) বিদায় হজ্জে বলেছিলেন,
(إِنِّيْ لَا أَدْرِيْ لَعَلِّيْ لَا أَلْقَاكُمْ بَعْدَ عَامِيْ هٰذَا بِهٰذَا الْمَوْقِفِ أَبَداً)
‘আমি জানিনা এ বছর পর এ স্থানে তোমাদের সঙ্গে আর মিলিত হতে পারব কিনা’। জামরায়ে ‘আক্বাবাহর নিকট বলেছিলেন,
(خُذُوْا عَنِّيْ مَنَاسَكَكُمْ، فَلَعَلِّيْ لَا أَحُجُّ بَعْدِ عَامِيْ هٰذَا)
‘আমার নিকট থেকে হজ্জের নিয়ম কানুনগুলো শিখে নাও। কারণ, এ বছর পর সম্ভবতঃ আমার পক্ষে আর হজ্জ করা সম্ভব হবে না। আইয়ামে তাশরীক্বের মধ্যভাগে নাবী কারীম (ﷺ)-এর নিকট সূরাহ ‘নাসর’ অবতীর্ণ হয় এবং এর মাধ্যমে নাবী কারীম (ﷺ) উপলব্ধি করেন যে, পৃথিবী থেকে তাঁর যাওয়ার সময় সমাগত প্রায়।
একাদশ হিজরী সফর মাসের প্রথম দিকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) উহুদ প্রান্তে গমন করে আল্লাহ তা‘আলার সমীপে শহীদদের জন্য এমনভাবে দু‘আ করেন যেন তিনি জীবিত এবং মৃত সকলের নিকট থেকেই বিদায় গ্রহণ করছেন। অতঃপর সেখান থেকে ফিরে এসে তিনি মিম্বরের উপর দাঁড়িয়ে বলেন,
(إِنِّيْ فُرُطٌ لَّكُمْ، وَأَنَا شَهِيْدٌ عَلَيْكُمْ، وَإِنِّيْ وَاللهِ لَأَنْظُرُ إِِلٰى حَوْضِيْ الْآنَ، وَإِنِّيْ أُعْطِيْتُ مَفَاتِيْحُ خَزَائِنِ الْأَرْضِ، أَوْ مَفَاتِيْحُ الْأَرْضِ، وَإِنِّيْ وَاللهَ مَا أَخَافُ عَلَيْكُمْ أَنْ تُشْرِكُوْا بَعْدِيْ، وَلٰكِنِّيْ أَخَافُ عَلَيْكُمْ أَنْ تَنَافَسُوْا فِيْهَا).
‘আমি তোমাদের যাত্রীদলের প্রধান এবং তোমাদের উপর সাক্ষী, আল্লাহর কসম! আমি এখন আপন ‘হাউযে কাওসার’ দেখছি। আমাকে পৃথিবী এবং পৃথিবীর খাজানাসমূহের চাবি দেয়া হয়েছে। আল্লাহর কসম! আমার এ ভয় হয় না যে, আমার পর তোমরা শিরক করবে। কিন্তু আমার আশঙ্কা হচ্ছে পৃথিবী সম্পর্কে তোমরা এক অপরের সাথে প্রতিযোগিতায় নামবে।[1]
এ সময় একদা মধ্য রাত্রে তিনি ‘জান্নাতুল বাকী’ কবরস্থান গমন করলেন এবং কবরবাসীদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। বললেন,
(السَّلَامُ عَلَيْكُـمْ يـَا أَهْلَ الْمَقَابِرِ، لِيَهْنَ لَكُمْ مَا أَصْبَحْتُمْ فِيْهِ بِمَا أَصْبَحَ النَّاسُ فِيْهِ، أَقْبَلَتْ الْفِتَنُ كَقَطْعِ اللَّيْلِ الْمُظْلِمِ، يَتَّبِعُ آخِرُهَا أُوْلَهَا، وَالْآخِرَةُ شَرٌّ مِنْ الْأَوْلٰي)،
‘ওহে কবরবাসীগণ! তোমাদের উপর সালাম বর্ষিত হোক! দুনিয়ার মানুষ যে অবস্থায় আছে তার তুলনায় তোমাদের সে অবস্থানই ধন্য হোক যার মধ্যে তোমরা রয়েছ। অন্ধকার রাত্রির অংশের ন্যায় অনিষ্টতা একটির পর একটি চলে আসছে। ভবিষ্যত প্রজন্ম অতীত প্রজন্মের তুলনায় অধিক খারাপ।’ এরপর এ বলে কবরবাসীদের শুভ সংবাদ প্রদান করলেন যে,
(إِنَّا بِكُمْ لَلَاحِقُوْنَ)
‘তোমাদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য আমরাও আগমন করছি।’
একাদশ হিজরীর ২৯শে সফর সোমবার দিবস রাসূলুল্লাহ (ﷺ) একটি জানাযার উদ্দেশ্যে বাকী'তে গমন করেন। সেখান থেকে ফেরার পথেই তাঁর মাথা ব্যথা শুরু হয়ে যায় এবং উত্তাপ এতই বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় যে, মাথায় বাঁধা পট্টির উপরেও তাপ অনুভূত হতে থাকে। এ অসুস্থতাই ছিল তাঁর ওফাতকালীন রোগ ভোগের সূচনা। এ অসুস্থ অবস্থাতেই তিনি এগার দিন পর্যন্ত সালাতে ইমামত করেন। এ অসুস্থ অবস্থায় তিনি ১৩ কিংবা ১৪ দিন অতিবাহিত করেন।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর শারীরিক অবস্থা ক্রমেই অবনতির দিকে যেতে থাকে। এ সময়ের মধ্যে তিনি তাঁর পবিত্র পত্নীগণকে জিজ্ঞাসা করতে থাকেন যে, (أَيْنَ أَنَا غَدًا؟ أَيْنَ أَنَا غَدًا؟) ‘আমি আগামী কাল কোথায় থাকব, আমি আগামী কাল কোথায় থাকব?’
এ জিজ্ঞাসার কারণ অনুধাবন করতে পেরে বিবিগণ বললেন, ‘আপনার যেখানে ইচ্ছা সেখানে থাকতে পারবেন।’’ বিবিগণের কথার প্রেক্ষিতে নাবী কারীম (ﷺ) স্থান পরিবর্তন করে আয়িশার গৃহে গমন করেন। স্থান পরিবর্তনের সময় তিনি ফযল বিন আব্বাস (রাঃ) এবং আলী বিন আবূ ত্বালীবের কাঁধে ভর দিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁর মাথায় পট্টি বাঁধা ছিল এবং পা মাটিতে হেঁচড়িয়ে তিন চলছিলেন। এ অবস্থার মধ্য দিয়ে নাবী কারীম (ﷺ) আয়িশা (রাঃ)-এর ঘরে গমন করেন এবং জীবনের শেষ সপ্তাহটি সেখানেই অতিবাহিত করেন।
আয়িশা (রাঃ) সূরাহ নাস ও ফালাক্ব এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কর্তৃক মুখস্থকৃত দু‘আ পড়ে নাবী কারীম (ﷺ)-কে ঝাঁড় ফুঁক করতে থাকেন এবং বরকতের আশায় নাবী কারীম (ﷺ)-এর হাত তাঁর পবিত্র শরীরে বুলিয়ে দিতে থাকেন।
ওফাত প্রাপ্তির পাঁচ দিন পূর্বে বুধবার দিবস দেহের উত্তাপ আরও বৃদ্ধি পায়। এর ফলে রোগযন্ত্রণা আরও বৃদ্ধি পায় এবং তিনি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়তে থাকেন। এ অবস্থায় তিনি বললেন,(هَرِّيْقُوْا عَلَيَّ سَبْعَ قِرَبٍ مِنْ آبَارِ شَتّٰي، حَتّٰى أَخْرُجُ إِلَى النَّاسِ، فَأَعْهَدُ إِلَيْهِمْ) ‘আমার শরীরে বিভিন্ন কূপের সাত মশক পানি ঢাল, যাতে আমি লোকজনদের নিকট গিয়ে উপদেশ দিকে পারি। এ প্রেক্ষিতে নাবী কারীম (ﷺ)-কে একটি বড় পাত্রের মধ্যে বসিয়ে তাঁর উপর এত বেশী পরিমাণ পানি ঢালা হল যে, তিনি নিজেই (حَسْبُكُمْ، حَسْبُكُمْ) ‘ক্ষান্ত হও’, ক্ষান্ত হও’ বলতে থাকলেন।
সে সময় নাবী কারীম (ﷺ)-এর রোগ যন্ত্রণা কিছুটা প্রশমিত হয় এবং তিনি মসজিদে গমন করেন। তখনো তাঁর মাথায় পট্টি বাঁধা ছিল। তিনি মিম্বরের উপর উঠে বসেন এবং ভাষণ প্রদান করেন। সাহাবীগণ (রাঃ) আশপাশে উপবিষ্ট ছিলেন। তিনি বললেন, (لَعْنَةُ اللهِ عَلَى الْيَهُوْدِ وَالنَّصَارٰى، اِتَّخَذُوْا قُبُوْرَ أَنْبِيَائِهِمْ مَسَاجِدَ) ‘ইয়াহুদ ও নাসারাদের উপর আল্লাহর অভিশাপ বর্ষিত হোক এ কারণে যে, তারা তাদের নাবীগণের কবরকে মসজিদ বানিয়ে নিয়েছে। অন্য এক রেওয়াতে রয়েছে
(قَاتَلَ اللهُ الْيَهُوْدَ وَالنَّصَارٰى، اِتَّخَذُوْا قُبُوْرَ أَنْبِيَائِهِمْ مَسَاجِدَ)
ইহুদী ও নাসারাদের প্রতি আল্লাহর শাস্তি যে তারা তাদের নাবীদের কবরকে মসজিদে বানিয়ে নিয়েছেন।[1] তিনি আরও বললেন,(لَا تَتَّخِذُوْا قَبْرِيْ وَثَنًا يُعْبَدُ) ‘তোমরা আমার কবরকে মূর্তি বানিওনা এ কারণে যে তার পূজা করা হবে।[2]
অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) অন্যদের প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য নিজেকে উপস্থাপন করলেন এবং বললেন,
(مَنْ كُنْتُ جَلَدْتُ لَهُ ظَهْرًا فَهٰذَا ظَهْرِيْ فَلْيَسْتَقِدُ مِنْهُ، وَمَنْ كُنْتُ شَتَمْتُ لَهُ عِرْضاً فَهٰذَا عِرْضِيْ فَلْيَسْتَقِدُ مِنْهُ)
‘আমি যদি কারো পিঠে কোড়া মেরে থাকি তাহলে সে যেন এ পিঠে কোড়া মেরে তার প্রতিশোধ গ্রহণ করে নেয়। আর যদি কারো ইজ্জতের উপর কটাক্ষ করে থাকি তাহলে আমি উপস্থিত আছি, সে যেন প্রতিশোধ গ্রহণ করে নেয়।’
এরপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মিম্বর হতে নীচে অবতরণ করলেন এবং যুহরের সালাতে ইমামত করলেন। তারপর আবারও মিম্বরের উপর আরোহণ করলেন এবং হিংসা ও অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে তাঁর পুরাতন কথাবার্তার পুনরাবৃত্তি করলেন। একজন বললেন, ‘আপনার দায়িত্বে আমার তিন দিরহাম অবশিষ্ট আছে। নাবী কারীম (ﷺ) ফযল বিন আব্বাস (রাঃ)-কে বললেন, ‘তাঁকে পরিশোধ করে দাও’। এরপর আনসারদের সম্পর্কে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেন,
(أُوْصِيْكُمْ بِالْأَنْصَارِ، فَإِنَّهُمْ كِرْشِيْ وَعَيْبَتِيْ، وَقَدْ قَضَوْا الَّذِيْ عَلَيْهِمْ وَبَقِيَ الَّذِيْ لَهُمْ، فَاقْبَلُوْا مِنْ مُحْسِنِهِمْ، وَتَجَاوَزُوْا عَنْ مُسِيْئِهِمْ)،
‘আমি তোমাদেরকে আনসারদের সম্পর্কে উপদেশ দিচ্ছি। কারণ, তারা ছিল আমার অন্তর এবং কলিজা। তারা তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছে, কিন্তু তাদের প্রাপ্যসমূহ অবশিষ্ট রয়ে গেছে। অতএব তাদের সৎ লোকদের হতে গ্রহণ করতে হবে এবং খারাপ লোকদের ক্ষমা করবে।’
অন্য এক বর্ণনায় আছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন,
(إِنَّ النَّاسَ يَكْثُرُوْنَ، وَتَقِلُّ الْأَنْصَارُ حَتّٰى يَكُوْنُوْا كَالْمِلْحِ فِي الطَّعَامِ، فَمَنْ وُلِيَ مِنْكُمْ أَمْراً يَضُرُّ فِيْهِ أَحَداً أَوْ يَنْفَعُهُ فَلْيُقْبِلْ مِنْ مُحْسِنِهِمْ، وَيَتَجَاوَزُ عَنْ مُسِيْئِهِمْ).
‘মানুষ বৃদ্ধি পেতে থাকবে, কিন্তু আনসারগণ কমে যেতে থাকবে। এমনকি তারা হয়ে পড়বে খাবারের মধ্যে লবণের ন্যায়। অতএব তোমাদের মধ্য থেকে যে ব্যক্তি কোন লাভ কিংবা ক্ষতি পৌঁছানোর কাজে নিয়োজিত থাকবে তখন সে যেন তাদের মধ্যকার সৎ ব্যক্তিদের নিকট থেকে গ্রহণ করে এবং অসৎ ব্যক্তিদের ক্ষমা করে দেয়।[3]
‘এক ব্যক্তিকে আল্লাহ অধিকার প্রদান করেছেন যে, সে পৃথিবীর চাকচিক্য এক জাঁকজমকের মধ্য থেকে যা ইচ্ছা গ্রহণ করতে পারে তিনি তাকে তা প্রদান করবেন, অথবা সে আল্লাহর নিকট যা কিছু আছে সে পছন্দ করবে, তখন সে বান্দা আল্লাহর নিকট যা কিছু আছে তাই পছন্দ করে নিয়েছে।’ আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ)-এর বর্ণনায় আছে যে, এ কথা শ্রবণ করে আবূ বাকর (রাঃ) কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘আপন পিতামাতাসহ আমরা আপনার জন্য উৎসর্গীকৃত! তাঁর এ আচরণে আমরা আশ্চর্য হলাম।
লোকেরা বলল, ‘এ বুড়োকে দেখ! রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- তো একজন বান্দা সম্পর্কে এ কথা বলছেন যে, আল্লাহ তাঁকে অধিকার প্রদান করেছেন যে, পৃথিবীর চমক দমক এবং জাঁকজমক হতে সে যা চাইবে তিনি তাকে তাই দেবেন অথবা আল্লাহর নিকট যা আছে তা সে পছন্দ করে নেবে। অথচ এ বুড়ো বলছেন যে, যে আপন পিতামাতাসহ আমরা আপনার জন্য উৎসর্গীকৃত। কিন্তু কয়েক দিন পর এটা সুস্পষ্ট হয়ে গেল যে, বান্দাকে সে অধিকার দেয়া হয়েছিল তিনি স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)। আবূ বাকর (রাঃ) ছিলেন আমাদের মধ্যে সব চেয়ে বিজ্ঞ ও বুদ্ধিমান।[4]
এরপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন,
(إِنَّ مْنِ أَمَنِّ النَّاسِ عَلَيَّ فِيْ صُحْبَتِهِ وَمَالِهِ أَبُوْ بَكْرٍ، وَلَوْ كُنْتُ مُتَّخِذاً خَلِيْلاً غَيْرَ رَبِّيْ لَاَتَّخَذْتُ أَبَا بَكْرٍ خَلِيْلاً، وَلٰكِنْ أُخُوَّةَ الْإِسْلَامِ وَمُوَدَّتُهُ، لَا يَبْقِيَنَّ فِي الْمَسْجِدِ بَابٌ إِلاَّ سُدَّ، إِلَّا بَابُ أَبِيْ بَكْرٍ).
অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, ‘স্বীয় সাহচর্য এবং ধন-সম্পদে আমার উপর সর্বাধিক দয়া দাক্ষিণ্যের মালিক ছিলেন আবূ বাকর (রাঃ) এবং আমি যদি আপন প্রভূ ছাড়া অন্য কাউকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করতাম তাহলে আবূ বাকর (রাঃ)-কে গ্রহণ করতাম। কিন্তু তাঁর সঙ্গে আছে ইসলামী ভ্রাতৃত্ব ও ভালবাসার সম্পর্ক। মসজিদে কোন দরজাই অবশিষ্ট রাখা হবে না, বরং তা অবশ্যই বন্ধ করে দেয়া হবে একমাত্র আবূ বাকর (রাঃ)-এর দরজা ছাড়া।[5]
[2] মুওয়াত্তা ইমাম মালিক ৬৫ পৃঃ।
[3] সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ৫৩৬ পৃঃ।
[4] সহীহুল বুখারী, মুসলিম, সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ৫১৬ পৃঃ, মিশকাত ২য় খন্ড ৫৪৯ পৃ: ও ৫৫৪ পৃঃ।
[5] মুসলিম ও বুখারী, মিশকাত ২য় খন্ড ৫৪৬, ৫৫৪, ৬৫৫, সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ৫১৬ পৃঃ।
ওফাত প্রাপ্তির চার দিনে পূর্বে বৃহস্পতিবার যখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কঠিন রোগযন্ত্রণার সম্মুখীন হলেন তখন বললেন,
(هَلُمُّوْا أَكْتُبُ لَكُمْ كِتَاباً لَنْ تَضِلُّوْا بَعْدَهُ)
‘তোমরা আমার নিকট কাগজ কলম নিয়ে এসো, আমি তোমাদের জন্য একটি নোট লিখে দেই যাতে তোমরা আমার পরে কোন দিনই পথভ্রষ্ট হবে না’।
ঐ সময় ঘরে কয়েক ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন যার মধ্যে অন্যতম ছিলেন উমার (রাঃ), তিনি বললেন, ‘আপনার উপর রোগ যন্ত্রণার প্রাধান্য রয়েছে এবং আমাদের নিকট আল্লাহর কিতাব কুরআন রয়েছে। আল্লাহর কিতাব কুরআন আমাদের জন্য যথেষ্ট’- এ নিয়ে কথা কাটাকাটি করতে লাগলেন। কেউ কেউ বললেন, ‘কাগজ কলম আনা হোক এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যা বলবেন তা লিখে নেয়া হোক।’ অন্যেরা উমার (রাঃ)-এর মত সমর্থন করলেন। লোকজনদের মধ্যে যখন এভাবে কথা কাটাকাটি চলতে থাকল তখন নাবী কারীম (ﷺ) বললেন, (قُوْمُوْا عَنِّيْ) ‘আমার নিকট থেকে তোমরা উঠে যাও’।[1]
অতঃপর নাবী কারীম (ﷺ) সে দিনটিতে উপদেশ প্রদান করলেন। এর প্রথমটি হচ্ছে,‘ইহুদী, নাসারা এবং মুশরিকদেরকে আরব উপদ্বীপ হতে বহিস্কার করবে। দ্বিতীয়টি হল, ‘প্রতিনিধিদলের সে ভাবেই আপ্যায়ণ করবে যেমনটি (আমার আমলে) করা হতো।’ তৃতীয় উপদেশটি বর্ণনাকারী ভুলে গিয়েছিলেন। তবে সম্ভবত সেটি ছিল আল্লাহর কিতাব ও সুন্নাহকে দৃঢ়ভাবে ধরে থাকার উপদেশ, অথবা তা ছিল উসামা (রাঃ)-এর বাহিনী কার্যক্রম বাস্তবায়নের উপদেশ, অথবা তা ছিল (الصَّلَاةُ وَمَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ) ‘সালাত’ এবং তোমাদের অধীনস্থ অর্থাৎ দাসদাসীদের প্রতি মনোযোগী হওয়ার উপদেশ। কঠিন অসুস্থতা সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ঐ দিন (অর্থাৎ ওফাত প্রাপ্তির চার দিন পূর্বের বৃহস্পতিবার) পর্যন্ত সকল সালাতেই ইমামত করেন। এ দিবস মাগরিবের সালাতেও তিনি ইমামতি করেন এবং সূরাহ ‘ওয়াল মুরসালাতে উরফা’ পাঠ করেন।[2]
কিন্তু এশা সালাতের সময় অসুস্থতা এতই বৃদ্ধি পেল যে, মসজিদে যাওয়ার মতো শক্তি সামর্থ্য আর তাঁর রইল না। আয়িশা (রাঃ) বলেছেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জিজ্ঞাসা করলেন যে, (أصَلَّى النَّاسُ؟) ‘লোকজনেরা সালাত আদায় করে নিয়েছে? আমি উত্তর দিলাম, ‘না’, হে আল্লাহর রাসূল! তাঁরা আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।’ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, (ضَعُّوْا لِيْ مَاءً فِي الْمِخْضَبِ) ‘আমার জন্য বড় পাত্রে পানি দাও।’ তাঁর চাহিদা মোতাবেক পানি দেয়া হলে তিনি গোসল করলেন। অতঃপর দাঁড়াতে চাইলেন, কিন্তু পারলেন না, অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। জ্ঞান ফিরে পেলে তিনি পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, (أَصَلَّى النَّاسُ؟) ‘লোকেরা কি সালাত আদায় করেছে? উত্তর দিলাম, ‘না’, হে আল্লাহর রাসূল! তাঁরা আপনার জন্য অপেক্ষামান রয়েছেন।’
অতঃপর দ্বিতীয় ও তৃতীয় বারেও তিনি একইরূপ করলেন, যেমনটি প্রথমবার করেছিলেন, অর্থাৎ গোসল করলেন এবং দাঁড়াতে চাইলেন কিন্তু পারলেন না।, অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন। অবশেষে তিনি আবূ বাকর (রাঃ)-কে বলে পাঠালেন সালাতে ইমামত করার জন্য। এ প্রেক্ষিতে আবূ বাকর (রাঃ) ঐ দিনগুলোতে সালাতে ইমামত করেন।[3] নাবী কারীম (ﷺ)-এর পবিত্র জীবদ্দশায় আবূ বাকর (ﷺ)-এর ইমামতে সালাতে সংখ্যা ছিল সতের ওয়াক্ত।
আয়িশাহ (রাঃ) তাঁর পিতা আবূ বাকর (রাঃ)-এর পরিবর্তে অন্য কারো উপর ইমামতের দায়িত্ব অর্পণের জন্য নাবী কারীম (ﷺ)-এর নিকট তিন কিংবা চারবার অনুরোধ জানিয়েছেন। তাঁর এ অনুরোধের উদ্দেশ্য ছিল লোকেরা যেন তাঁর পিতা সম্পর্কে কোন প্রকার খারাপ ধারণা পোষণের কোন অবকাশ বা সুযোগ না পায়। কিন্তু নাবী কারীম (ﷺ) প্রত্যেকবারই তা অস্বীকার করে বললেন, (إِنَّكُنَّ لَأَنْتُنَّ صَوَاحِبَ يُوْسُفَ، مُرُّوْا أَبَا بَكْرٍ فَلْيُصَلِّ بِالنَّاسِ) ‘তোমরা সকলেই ইউসুফ (আঃ)-এর সঙ্গীসাথীদের মতোই হয়ে গিয়েছ।[4] সালাতে ইমামতি করার জন্য আবূ বাকর (রাঃ)-কে নির্দেশ দাও।’[5]
[2] সহীহুল বুখারী উম্মুল ফযল হতে নাবী (সাঃ)-এর অসুখ অধ্যায় ২য় খন্ড ৬৩৭ পৃঃ।
[3] বুখারী ও মুসলিমের সম্মিলিত বর্ণনা, মিশকাত ১ম খন্ড ১০২ পৃঃ।
[4] ইউসুফ (আঃ)-এর ব্যাপারে যে মহিলাগণ আযীয মিসরের স্ত্রীকে ভাল মন্দ বলেছিল যা প্রকাশ্যে তার নিন্দনীয় কাজ কর্মের রূপ প্রকাশ করছিল। কিন্তু ইউসুফ (আঃ)-কে দেখে যখন তারা নিজ নিজ আঙ্গুল কাটল তখন বুঝা গেল যে, মুখে বললেও প্রকৃতপক্ষে মনে মনে তারাও তাঁর প্রতি আসক্ত হয়েছে। এর অনুরূপ ব্যাপার এখানেও ছিল। রাসূলে কারীম (সাঃ)-কে প্রকাশ্যে বলা হচ্ছিল যে, আবূ বকর (রাঃ) নরম অন্তকরণের মানুষ, আপনার স্থানে যখন দাঁড়াবেন তখন তাঁর পক্ষে কেরাত করা সম্ভব হবে না, কিন্তু তাঁদের অন্তরে একথা নিহিত ছিল যে, (আল্লাহ না করুন) এ অসুখের কারণে যদি নাবী কারীম (সাঃ)-এর পবিত্র জিন্দেগীর পরিসমাপ্তি ঘটে তাহলে আবূ বকর (রাঃ) সম্পর্কে মানুষের অন্তরে অমঙ্গলজনক এবং অশুভ ধারণার সৃষ্টি হতে পারে। কারণ, আয়িশা (রাঃ)-এর অনুরোধের কণ্ঠের সঙ্গে অন্যান্য বিবিগণের কণ্ঠও মিলিত ছিল। এ কারণেই নাবী কারীম (সাঃ) বললেন, তোমরা সকলেই আযীযে মিসরের স্ত্রী ও তার সহচরীবৃন্দের মতই বলছ। অর্থাৎ তোমাদের অন্তরে রয়েছে এক কথা কিন্তু প্রকাশ করছ অন্য কথা।
[5] সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ৯৯ পৃঃ।
জাবির (রাঃ) বলেন, আমি নাবী (ﷺ)-কে তাঁর ওফাতের তিন দিন পূর্বে বলতে শুনেছি, তোমাদের কেউ যেন আল্লাহর প্রতি সুধারণা না নিয়ে মৃত্যুবরণ না করে।
قَالَ جَابَرٌ: سَمِعْتُ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم قَبْلَ مَوْتِهِ بِثَلَاثٍ وَهُوَ يَقُوْلُ: (أَلَا لَا يَمُوْتُ أَحَدٌ مِّنْكُمْ إَلَّا وَهُوَ يُحْسِنُّ الظَّـنَّ بِاللهِ)
শনিবার কিংবা রবিবারে নাবী কারীম (ﷺ) কিছুটা সুস্থতা বোধ করেন। কাজেই, দুই ব্যক্তির কাঁধে ভর দিয়ে যুহর সালাতের উদ্দেশ্যে মসজিদে গমন করেন। সেই সময় সাহাবীগণ (রাযি আল্লাহু ‘আনহুম)-এর সালাতের জামাতে ইমামত করছিলেন আবূ বাকর (রাঃ)। তিনি নাবী কারীম (ﷺ)-এর আগমনের আভাস পেয়ে পিছনের সারিতে আসার চেষ্টা করলে তিনি তাঁকে ইশারায় পিছনে আসতে নিষেধ করে সামনেই থাকতে বললেন এবং নিজেকে তাঁর ডান পাশে বসিয়ে দেয়ার জন্য সাহায্যকারীদ্বয়কে নির্দেশ দিলেন। এ প্রেক্ষিতে আবূ বাকর (রাঃ)-এর ডান পাশে তাঁকে বসিয়ে দেয়া হল। এরপর আবূ বাকর (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সালাতের অনুকরণ করছিলেন এবং সাহাবীগণ (রাযি.)-কে তাকবীর শোনাচ্ছিলেন।[1]
ওফাত প্রাপ্তির পূর্বের দিবস রবিবার তিনি তাঁর দাসদের মুক্ত করে দেন। তাঁর নিকটে সাতটি স্বর্ণ মুদ্রা ছিল তা সাদকা করে দেন। নিজ অস্ত্রগুলো মুসলিমগণকে হিবা করে দেন। রাত্রিবেলা গৃহে বাতি জ্বালানোর জন্য আয়িশাহ (রাঃ) প্রতিবেশীর নিকট থেকে তেল ধার করে আনেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর একটি লৌহবর্ম ত্রিশ ‘সা’ (৭৫ কেজি) যবের পরিবর্তে এক ইহুদীর নিকট বন্ধক রাখা ছিল।
আনাস (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে, সোমবার দিবস ফজর ওয়াক্তে আবূ বাকর (রাঃ)-এর ইমামতে সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) যখন সালাতরত ছিলেন এমন সময় নাবী কারীম (ﷺ) আয়িশা (রাঃ)-এর ঘরের পর্দা সরিয়ে সালাতরত সাহাবীগণ (রাঃ)-এর প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। অতঃপর মৃদু হাসলেন। এদিকে আবূ বাকর (রাঃ) নিজ পায়ের পিছনে ভর দিয়ে পিছনে দিকে সরে গেলেন এবং কাতারে সামিল হলেন। তিনি ধারণা করেছিলেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সালাতে শরীক হওয়ার জন্য ইচ্ছা করছেন। আনাস (রাঃ) আরও বর্ণনা করেছেন যে, (হঠাৎ নাবী কারীম (ﷺ) সম্মুখ ভাগে প্রকাশিত হওয়ায়) সালাতরতগণ এতই আনন্দিত হয়েছিলেন যে, সালাতের মধ্যেই একটি পরীক্ষায় নিপতিত হওয়ার উপক্রম হয়েছিল (অর্থাৎ নাবী কারীম (ﷺ)-কে তাঁর শারীরিক অবস্থাদি জিজ্ঞাসার জন্য সালাত ভঙ্গ করে দেয়ার উপক্রম হয়েছিল। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হাতের ইশারায় সালাত সম্পূর্ণ করে নিতে বলেন এবং ঘরের ভিতরে প্রবেশ করে পর্দা নামিয়ে ফেলেন।[1]
এরপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কোন ওয়াক্ত সালাতের জামাতে শরীক হতে পারেন নি। সকাল গড়িয়ে যখন চাশতের সময় হল তখন নাবী কারীম (ﷺ) তাঁর কন্যা ফাত্বিমাহ (রাঃ)-কে ডেকে নিয়ে তাঁর কানে কানে কিছু কথা বললেন। পিতার কথা শুনে কন্যা কাঁদতে লাগলেন। এরপর তিনি আবারও কন্যার কানে কানে কিছু কথা বললেন, পিতার কথায় কন্যা এবার হাসতে লাগলেন। আয়িশা (রাঃ)-এর বর্ণনা আছে যে, পরে আমাদের অনুরোধের প্রেক্ষিতে ফাত্বিমাহ (রাঃ) বললেন যে, নাবী কারীম (ﷺ) আমাকে প্রথমবার কানে কানে বললেন যে, এ অসুখেই তাঁর ওফাত প্রাপ্তি ঘটবে। এ জন্যেই আমি কাঁদলাম। দ্বিতীয়বার তিনি আমাকে কানে কানে বললেন যে, নাবী কারীম (ﷺ)-এর পরিবারবর্গের মধ্য থেকে সর্বপ্রথম আমি তাঁর অনুসরণ করব। এ কারণে আমি হাসলাম।[2]
অধিকন্তু নাবী কারীম (ﷺ) ফাত্বিমাহ (রাঃ)-কে এ শুভ সংবাদও প্রদান করেন যে, তুমি হবে মহিলা জগতের নেত্রী।[3]
ওই সময় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যে কষ্টকর অবস্থার সম্মুখীন হয়েছিলেন তা দেখে ফাত্বিমাহ (রাঃ) কোন চিন্তা ভাবন না করেই চিৎকার করে উঠলেন ‘হায় আব্বাজানের কষ্ট! নাবী কারীম (ﷺ) বললেন, আজকের পরে তোমার আববার আর কোন কষ্ট নেই।[4]
নাবী কারীম (ﷺ) হাসান ও হুসাইন (রাঃ)-কে ডেকে নিয়ে চুম্বন করলেন এবং তাঁদের সম্পর্কে ভাল উপদেশ দিলেন। পবিত্র বিবিগণকে আহবান জানালেন এবং ওযায ও নসীহত করলেন।
এদিকে প্রত্যেক মুহূর্তে রোগ যন্ত্রণা বৃদ্ধি পেয়ে চলছিল এবং সে বিষের প্রতিক্রিয়াও প্রকাশ পেতে আরম্ভ করেছিল যা তাঁকে খায়বারে খাওয়ানো হয়েছিল। সে সময় তিনি আয়িশা (রাঃ)-কে সম্বোধন করে বললেন,
(يَا عَائِشَةُ، مَا أَزَالُ أَجِدُ أَلَمَ الطَّعَامِ الَّذِيْ أَكَلْتُ بِخَيْبَرَ، فَهٰذَا أَوَانٌ وَجَدْتُ اِنْقِطَاعَ أبْهَرِيْ مِنْ ذٰلِكَ السَّمِّ)
‘হে আয়িশা! খায়বারে যে খাদ্য আমি খেয়েছিলাম তার যন্ত্রণা এখন আমি সামনে উপলব্ধি করছি। এ মুহূর্তে আমি উপলব্ধি করছি যে, এ বিষের প্রভাবে আমার শিরা উপশিরা সমূহের জীবন কর্তিত হচ্ছে।[5]
তখন তাঁর চেহারার উপর চাদর ফেলে দেয়া হল। যখন তাঁর পেরেশানী দূর হলো তখন তার চেহারা মুবারক থেকে তা সরিয়ে নিলেন। তারপর তিনি বললেন, এরূপই হয়। এটি ছিল তাঁর সর্বশেষ কথা ও মানুষের জন্য অসীয়ত : (তিনি বললেন), (لَعْنَةُ اللهِ عَلَى الْيَهُوْدِ وَالَّنصَارٰى، اِتَّخَذُوْا قُبُوْرَ أَنْبِيَائِهِمْ مَسَاجِدَ ـ يَحْذِرُ مَا صَنَعُوْا ـ لَا يَبْقِيَنَّ دِيْنَانِ بِأَرْضِ الْعَرَبِ) আল্লাহর অভিসম্পাত ইয়াহূদ ও নাসারাদের প্রতি। তারা তাদের নাবীগণের কবরসমূহকে মসজিদ হিসেবে গ্রহণ করেছে। তারা যা তৈরি করেছে। তাত্থেকে লোকেরা যেন সতর্কতা অবলম্বন করে। আরব ভূখন্ডে আর কখনো এ দু’টি ধর্ম অবশিষ্ট থাকবে না।
অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সাহাবীগণ (রাঃ)-কে উপদেশ প্রদান করে বললেন,(الصَّلَاةُ، الصَّلَاةُ، وَمَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ)
অর্থ : সালাত, সালাত এবং তোমাদের অধীনস্থ (অর্থাৎ দাসদাসী)! এ শব্দগুলো নাবী কারীম (ﷺ) বারবার পুনরাবৃত্তি করেন।[6]
[2] বুখারী ২য় খন্ড ৬৩৮ পৃঃ।
[3] কতকগুলো বর্ণনা সূত্রে জানা যায় যে, কথাবার্তা এবং শুভ সংবাদ দেওয়ার এ ঘটনা পবিত্র জীবনের শেষ দিনের নয় বরং শেষ সপ্তাহের মধ্যে ঘটেছিল। দ্র: রহামাতুল্লিল আলামীন ১ম খন্ড ২৮২ পৃঃ।
[4] সহীহুল বুখারী ২য় খন্ড ৬৪১ পৃঃ।
[5] সহীহুল বুখারী ২য় খন্ড ৬৩৭ পৃঃ।
[6] সহীহুল বুখারী ২য় খন্ড ৬৩৭ পৃঃ।
অতঃপর শুরু হল মৃত্যু যন্ত্রণা। আয়িশা (রাঃ) নাবী কারীম (ﷺ)-কে নিজ দেহের উপর ভর করিয়ে থেমে রইলেন। তাঁর এক বর্ণনা সূত্রে জানা যায়, তিনি বলেছেন, ‘আমার প্রতি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ হচ্ছে নাবী কারীম (ﷺ) আমার ঘরে, আমার বিছানায়, আমার গ্রীবা ও বক্ষের মাঝে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর সময় আল্লাহ তা‘আলাভ আমার লালা এবং তাঁর লালাকে একত্রিত করে দিয়েছেন। ঘটনাটি ছিল এ রকম যে, আব্দুর রহমান বিন আবূ বাকর (রাঃ) নাবী কারীম (ﷺ)-এর নিকট আগমন করলেন। তাঁর হাতে ছিল মিসওয়াক। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমার শরীরে হেলান অবস্থায় ভর করেছিলেন। আমি দেখলাম যে, নাবী কারীম (ﷺ) মিসওয়াকের প্রতি লক্ষ্য করছেন। অতএব, আমি বুঝে নিলাম যে তিনি মিসওয়াক চাচ্ছেন। আমি বললাম, ‘আপনার জন্য কি মিসওয়াক নিব?’ তিনি মাথা নেড়ে তা নেয়ার জন্য ইঙ্গিত করলেন। অতঃপর একটি মিসওয়াক নিয়ে নাবী কারীম (ﷺ)-কে দিলাম। তিনি ইঙ্গিতে বললেন, ‘হ্যাঁ’। আমি মিসওয়াক খানা নরম করে দিলে খুব সুন্দরভাবে তিনি মিসওয়াক করলেন। সম্মুখেই ছিল পানির পাত্র। পানিতে দু’ হাত ডুবিয়ে তিনি মুখমণ্ডল মুছতে মুছতে বলছিলেন, (لَا إِلٰهَ إِلَّا اللهُ، إِنَّ لِلْمَوْتِ سَكَرَاتٌ....) ‘লা-ইলাহা-ইল্লাল্লাহ’ ‘আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই, মৃত্যু যন্ত্রণা একটি অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার।[1]
মিসওয়াক থেকে ফারেগ হয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হাত অথবা আঙ্গুল উত্তোলন করলেন এবং ছাদের দিকে দৃষ্টি তুলে ধরলেন। তাঁর ঠোঁট দুটি একটু নড়ে উঠল। আয়িশা (রাঃ) কান পেতে শ্রবণ করলেন, তিনি বলছিলেন,
(مَعَ الَّذِيْنَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ مِنْ النَّبِيِّيْنَ وَالصِّدِّيْقِيْنَ وَالشُّهَدَاءِ وَالصَّالِحِيْنَ، اللهم اغْفِرْ لِيْ وَارْحَمْنِيْ، وَأَلْحِقْنِيْ بِالرَّفِيْقِ الْأَعْلٰي. اللهم، الرَّفِيْقُ الْأَعْلٰي).
‘হে আল্লাহ! নাবীগণ, সিদ্দীকগণ, শহীদগণ এবং সৎ ব্যক্তিগণ যাঁদের তুমি পুরস্কৃত করেছ আমাকে তাদের দলভূক্ত কর এবং আমাকে ক্ষমা করে দাও এবং আমার প্রতি তুমি অনুগ্রহ কর। হে আল্লাহ! আমাকে রফীকে আ’লায় পৌঁছে দাও। হে আল্লাহ! রফীক্বে আ’লা।[2]
এ ঘটনা সংঘটিত হয় একাদশ হিজরীর ১২ রবিউল আওয়াল সোমবার সূর্য্যের উত্তপ্ত হওয়ার সময়। সে সময় নাবী কারীম (ﷺ)-এর বয়স হয়েছিল তেষট্টি বছর চার দিন।
[2] সহীহুল বুখারী, নাবী কারীম (সাঃ)-এর অসুস্থতা অধ্যায় এবং শেষ কথোপকথন অথ্যায় ২য় খন্ড ৬৩৮-৬৪১ পৃঃ।