লগইন করুন
ওফাত প্রাপ্তির পাঁচ দিন পূর্বে বুধবার দিবস দেহের উত্তাপ আরও বৃদ্ধি পায়। এর ফলে রোগযন্ত্রণা আরও বৃদ্ধি পায় এবং তিনি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়তে থাকেন। এ অবস্থায় তিনি বললেন,(هَرِّيْقُوْا عَلَيَّ سَبْعَ قِرَبٍ مِنْ آبَارِ شَتّٰي، حَتّٰى أَخْرُجُ إِلَى النَّاسِ، فَأَعْهَدُ إِلَيْهِمْ) ‘আমার শরীরে বিভিন্ন কূপের সাত মশক পানি ঢাল, যাতে আমি লোকজনদের নিকট গিয়ে উপদেশ দিকে পারি। এ প্রেক্ষিতে নাবী কারীম (ﷺ)-কে একটি বড় পাত্রের মধ্যে বসিয়ে তাঁর উপর এত বেশী পরিমাণ পানি ঢালা হল যে, তিনি নিজেই (حَسْبُكُمْ، حَسْبُكُمْ) ‘ক্ষান্ত হও’, ক্ষান্ত হও’ বলতে থাকলেন।
সে সময় নাবী কারীম (ﷺ)-এর রোগ যন্ত্রণা কিছুটা প্রশমিত হয় এবং তিনি মসজিদে গমন করেন। তখনো তাঁর মাথায় পট্টি বাঁধা ছিল। তিনি মিম্বরের উপর উঠে বসেন এবং ভাষণ প্রদান করেন। সাহাবীগণ (রাঃ) আশপাশে উপবিষ্ট ছিলেন। তিনি বললেন, (لَعْنَةُ اللهِ عَلَى الْيَهُوْدِ وَالنَّصَارٰى، اِتَّخَذُوْا قُبُوْرَ أَنْبِيَائِهِمْ مَسَاجِدَ) ‘ইয়াহুদ ও নাসারাদের উপর আল্লাহর অভিশাপ বর্ষিত হোক এ কারণে যে, তারা তাদের নাবীগণের কবরকে মসজিদ বানিয়ে নিয়েছে। অন্য এক রেওয়াতে রয়েছে
(قَاتَلَ اللهُ الْيَهُوْدَ وَالنَّصَارٰى، اِتَّخَذُوْا قُبُوْرَ أَنْبِيَائِهِمْ مَسَاجِدَ)
ইহুদী ও নাসারাদের প্রতি আল্লাহর শাস্তি যে তারা তাদের নাবীদের কবরকে মসজিদে বানিয়ে নিয়েছেন।[1] তিনি আরও বললেন,(لَا تَتَّخِذُوْا قَبْرِيْ وَثَنًا يُعْبَدُ) ‘তোমরা আমার কবরকে মূর্তি বানিওনা এ কারণে যে তার পূজা করা হবে।[2]
অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) অন্যদের প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য নিজেকে উপস্থাপন করলেন এবং বললেন,
(مَنْ كُنْتُ جَلَدْتُ لَهُ ظَهْرًا فَهٰذَا ظَهْرِيْ فَلْيَسْتَقِدُ مِنْهُ، وَمَنْ كُنْتُ شَتَمْتُ لَهُ عِرْضاً فَهٰذَا عِرْضِيْ فَلْيَسْتَقِدُ مِنْهُ)
‘আমি যদি কারো পিঠে কোড়া মেরে থাকি তাহলে সে যেন এ পিঠে কোড়া মেরে তার প্রতিশোধ গ্রহণ করে নেয়। আর যদি কারো ইজ্জতের উপর কটাক্ষ করে থাকি তাহলে আমি উপস্থিত আছি, সে যেন প্রতিশোধ গ্রহণ করে নেয়।’
এরপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মিম্বর হতে নীচে অবতরণ করলেন এবং যুহরের সালাতে ইমামত করলেন। তারপর আবারও মিম্বরের উপর আরোহণ করলেন এবং হিংসা ও অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে তাঁর পুরাতন কথাবার্তার পুনরাবৃত্তি করলেন। একজন বললেন, ‘আপনার দায়িত্বে আমার তিন দিরহাম অবশিষ্ট আছে। নাবী কারীম (ﷺ) ফযল বিন আব্বাস (রাঃ)-কে বললেন, ‘তাঁকে পরিশোধ করে দাও’। এরপর আনসারদের সম্পর্কে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেন,
(أُوْصِيْكُمْ بِالْأَنْصَارِ، فَإِنَّهُمْ كِرْشِيْ وَعَيْبَتِيْ، وَقَدْ قَضَوْا الَّذِيْ عَلَيْهِمْ وَبَقِيَ الَّذِيْ لَهُمْ، فَاقْبَلُوْا مِنْ مُحْسِنِهِمْ، وَتَجَاوَزُوْا عَنْ مُسِيْئِهِمْ)،
‘আমি তোমাদেরকে আনসারদের সম্পর্কে উপদেশ দিচ্ছি। কারণ, তারা ছিল আমার অন্তর এবং কলিজা। তারা তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছে, কিন্তু তাদের প্রাপ্যসমূহ অবশিষ্ট রয়ে গেছে। অতএব তাদের সৎ লোকদের হতে গ্রহণ করতে হবে এবং খারাপ লোকদের ক্ষমা করবে।’
অন্য এক বর্ণনায় আছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন,
(إِنَّ النَّاسَ يَكْثُرُوْنَ، وَتَقِلُّ الْأَنْصَارُ حَتّٰى يَكُوْنُوْا كَالْمِلْحِ فِي الطَّعَامِ، فَمَنْ وُلِيَ مِنْكُمْ أَمْراً يَضُرُّ فِيْهِ أَحَداً أَوْ يَنْفَعُهُ فَلْيُقْبِلْ مِنْ مُحْسِنِهِمْ، وَيَتَجَاوَزُ عَنْ مُسِيْئِهِمْ).
‘মানুষ বৃদ্ধি পেতে থাকবে, কিন্তু আনসারগণ কমে যেতে থাকবে। এমনকি তারা হয়ে পড়বে খাবারের মধ্যে লবণের ন্যায়। অতএব তোমাদের মধ্য থেকে যে ব্যক্তি কোন লাভ কিংবা ক্ষতি পৌঁছানোর কাজে নিয়োজিত থাকবে তখন সে যেন তাদের মধ্যকার সৎ ব্যক্তিদের নিকট থেকে গ্রহণ করে এবং অসৎ ব্যক্তিদের ক্ষমা করে দেয়।[3]
‘এক ব্যক্তিকে আল্লাহ অধিকার প্রদান করেছেন যে, সে পৃথিবীর চাকচিক্য এক জাঁকজমকের মধ্য থেকে যা ইচ্ছা গ্রহণ করতে পারে তিনি তাকে তা প্রদান করবেন, অথবা সে আল্লাহর নিকট যা কিছু আছে সে পছন্দ করবে, তখন সে বান্দা আল্লাহর নিকট যা কিছু আছে তাই পছন্দ করে নিয়েছে।’ আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ)-এর বর্ণনায় আছে যে, এ কথা শ্রবণ করে আবূ বাকর (রাঃ) কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘আপন পিতামাতাসহ আমরা আপনার জন্য উৎসর্গীকৃত! তাঁর এ আচরণে আমরা আশ্চর্য হলাম।
লোকেরা বলল, ‘এ বুড়োকে দেখ! রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- তো একজন বান্দা সম্পর্কে এ কথা বলছেন যে, আল্লাহ তাঁকে অধিকার প্রদান করেছেন যে, পৃথিবীর চমক দমক এবং জাঁকজমক হতে সে যা চাইবে তিনি তাকে তাই দেবেন অথবা আল্লাহর নিকট যা আছে তা সে পছন্দ করে নেবে। অথচ এ বুড়ো বলছেন যে, যে আপন পিতামাতাসহ আমরা আপনার জন্য উৎসর্গীকৃত। কিন্তু কয়েক দিন পর এটা সুস্পষ্ট হয়ে গেল যে, বান্দাকে সে অধিকার দেয়া হয়েছিল তিনি স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)। আবূ বাকর (রাঃ) ছিলেন আমাদের মধ্যে সব চেয়ে বিজ্ঞ ও বুদ্ধিমান।[4]
এরপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন,
(إِنَّ مْنِ أَمَنِّ النَّاسِ عَلَيَّ فِيْ صُحْبَتِهِ وَمَالِهِ أَبُوْ بَكْرٍ، وَلَوْ كُنْتُ مُتَّخِذاً خَلِيْلاً غَيْرَ رَبِّيْ لَاَتَّخَذْتُ أَبَا بَكْرٍ خَلِيْلاً، وَلٰكِنْ أُخُوَّةَ الْإِسْلَامِ وَمُوَدَّتُهُ، لَا يَبْقِيَنَّ فِي الْمَسْجِدِ بَابٌ إِلاَّ سُدَّ، إِلَّا بَابُ أَبِيْ بَكْرٍ).
অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, ‘স্বীয় সাহচর্য এবং ধন-সম্পদে আমার উপর সর্বাধিক দয়া দাক্ষিণ্যের মালিক ছিলেন আবূ বাকর (রাঃ) এবং আমি যদি আপন প্রভূ ছাড়া অন্য কাউকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করতাম তাহলে আবূ বাকর (রাঃ)-কে গ্রহণ করতাম। কিন্তু তাঁর সঙ্গে আছে ইসলামী ভ্রাতৃত্ব ও ভালবাসার সম্পর্ক। মসজিদে কোন দরজাই অবশিষ্ট রাখা হবে না, বরং তা অবশ্যই বন্ধ করে দেয়া হবে একমাত্র আবূ বাকর (রাঃ)-এর দরজা ছাড়া।[5]
[2] মুওয়াত্তা ইমাম মালিক ৬৫ পৃঃ।
[3] সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ৫৩৬ পৃঃ।
[4] সহীহুল বুখারী, মুসলিম, সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ৫১৬ পৃঃ, মিশকাত ২য় খন্ড ৫৪৯ পৃ: ও ৫৫৪ পৃঃ।
[5] মুসলিম ও বুখারী, মিশকাত ২য় খন্ড ৫৪৬, ৫৫৪, ৬৫৫, সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ৫১৬ পৃঃ।