আরব উপদ্বীপের অবস্থা যখন বহুলাংশে মুসলিমগণের অনুকূলে এসে গেল তখন ইসলামী দাওয়াতের কার্যকারিতা ও বৃহত্তম বিজয়ের বিভিন্ন নিদর্শন ধীরে ধীরে প্রকাশ লাভ করতে থাকল। মুশরিকগণ ছয় বছর যাবত মসজিদুল হারামে মুসলমানদের প্রবেশ বন্ধ করে রেখেছিল সেখানে মুসলিমগণের ইবাদত বন্দেগীর ইতিবাচক দাবীর প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেল।
মদীনায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে স্বপ্নযোগে দেখানো হল যে, তিনি এবং তাঁর সাহাবীগণ মসজিদুল হারামে প্রবেশ লাভ করছেন। তিনি কা‘বা গৃহের চাবি গ্রহণ করে সাহাবীগণসহ আল্লাহর ঘর তাওয়াফ এবং উমরাহ পালন করছেন। অতঃপর কিছু সংখ্যক লোক মস্তক মুন্ডন করেছেন এবং কিছু সংখ্যক লোক চুল কর্তন করাকেই যথেষ্ট মনে করেছেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সাহাবীগণকে এ স্বপ্ন সম্পর্কে অবহিত করলে তাঁরা বড়ই আনন্দিত হন। এর ফলে তাঁরা এটাও ধারণা করতে থাকেন যে, আল্লাহর রহমতে শীঘ্রই তাঁরা মক্কায় প্রবেশাধিকার লাভ করবেন। রাসূলে কারীম (ﷺ) সাহাবীগণকে এ কথাও বললেন যে, তিনি উমরাহ পালনের মনস্থ করেছেন। এ প্রেক্ষিতে সাহাবীগণ সফরের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকলেন।
তাঁর সঙ্গে মক্কা গমনের জন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মদীনা এবং পার্শ্ববর্তী জনবহুল বিভিন্ন অঞ্চলে ঘোষণা দিলেন। কিন্তু অধিকাংশ আরবীগণ যাত্রা শুরু করার ব্যাপারে কিছুটা বিলম্ব করে ফেললেন। এদিকে রাসূলে কারীম (ﷺ) স্বীয় পোশাক পরিচ্ছদ পরিস্কার করে নিলেন। অতঃপর মদীনায় ইবনু উম্মু মাকতুম কিংবা নামীলা লাইসীকে স্বীয় স্থলাভিষিক্ত নিযুক্ত করলেন এবং কাসওয়া নামক নিজ উটের উপর আরোহণ করে ৬ষ্ঠ হিজরীর ১লা যুল ক্বা’দাহ মক্কা অভিমুখে রওয়ানা হলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন উম্মুল মু’মিনীন উম্মু সালামাহ (রাঃ), সঙ্গ নিলেন চৌদ্দশত (মতান্তরে পনের শত) সাহাবী। সফররত অবস্থায় অস্ত্র গ্রহণের নিয়মে কোষাবদ্ধ তলোয়ার ছাড়া পৃথক কোন খোলা অস্ত্রশস্ত্র সঙ্গে নেননি।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এবং সাহাবীগণ (রাঃ) মক্কা অভিমুখে ছিলেন অগ্রসরমান। যখন তাঁরা যুল হোলায়ফায় গিয়ে পৌঁছলেন তখন কুরবানীর পশুকে হার পরিয়ে দিলেন।[1] উটের পিঠের উঁচু জায়গা কেটে চিহ্নিত করলেন এবং উমরাহর জন্য ইহরাম বাঁধলেন। এর প্রত্যক্ষ উদ্দেশ্য ছিল, লোকজনেরা যেন নিশ্চিন্ত থাকে যে যুদ্ধ করবেন না। কুরাইশদের খবরাখবর সংগ্রহের উদ্দেশ্যে খুযা’আহ সম্প্রদায়ের এক গোয়েন্দাকে প্রেরণ করা হল অগ্রভাগে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) দলবলসহ উসফান নামক স্থানে যখন পৌঁছলেন তখন এ গোয়েন্দা ফিরে এসে তাঁকে অবহিত করলেন যে, মুসলিমগণের সঙ্গে মুখোমুখী যুদ্ধ করার জন্য কা‘ব বিন লুওয়ায় সাহায্যকারী আহাবীশ (মিত্র) গোত্রকে সংঘবদ্ধ করছে এবং আরও সৈন্য সংগ্রহ করার চেষ্টা করছে। সে আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করার এবং আল্লাহর ঘর থেকে আপনাকে বিরত রাখার ব্যাপারে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছে।
এ সংবাদ অবগত হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর সাহাবীগণের সঙ্গে এক পরামর্শ বৈঠকে মিলিত হলেন এবং ইরশাদ করলেন,
(أَتَرَوْنَ نَمِيْل إِلٰى ذَرَارِيْ هٰؤُلَاءِ الَّذِيْنَ أَعَانُوْهُمْ فَنَصِيْبَهُمْ؟ فَإِنْ قَعَدُوْا قَعَدُوْا مُوْتُوْرِيْنَ مَحْزُوْنِيْنَ، وَإِنْ نَجَوْا يَكُنْ عُنُقٌ قَطَعَهَا اللهُ، أَمْ تُرِيْدُوْنَ أَنْ نَؤمَ هٰذَا الْبَيْتِ فَمَنْ صَدَّنَا عَنْهُ قَاتَلْنَاهُ؟)
‘আপনাদের অভিমত কি এটা যে, যে সকল লোক আমাদের বিরুদ্ধে কুরাইশদের সাহায্য করার প্রস্তুতি নিচ্ছে আমরা তাদের পরিবারবর্গের উপর আক্রমণ চালিয়ে সে সব দখল করে নেই। এর পর যদি তারা চুপচাপ বসে পড়ে তাহলে সেটা হবে মঙ্গলজনক। এতে আমরা ধারণা করব যে, যুদ্ধের ক্ষয় ক্ষতি, চিন্তা ভাবনা এবং দুঃখ-কষ্ট ভোগ করেই তারা বসে পড়েছে। আর যদি তারা পলায়ন করে তাতেও তাদের এমন এক অবস্থার মধ্যে দেখব যে আল্লাহ তাদের গর্দান কেটে দিয়েছেন অথবা আপনারা এ অভিমত পোষণ করছেন যে আমরা কা‘বা গৃহ অভিমুখে অগ্রসর হতে থাকি। আমাদের যাত্রাপথে কেউ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলে আমরা তার সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হব।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কথার পরিপ্রেক্ষিতে আবূ বাকর সিদ্দীক (রাঃ) আরয করলেন যে, ‘কী করতে হবে তা আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূল (ﷺ) ভাল জানেন, তবে আমরা এসেছি উমরাহ পালন করতে, যুদ্ধ করতে নয়। অবশ্য কেউ যদি আমাদের এবং আল্লাহর ঘরের মধ্যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, তাহলে আমরা তাদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হতে বাধ্য হব।’
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, ‘ভাল কথা, চল তোমরা সামনের দিকে অসগ্রসর হতে থাক।’ কাজেই সকলে যাত্রা শুরু করলেন।
এদিকে কুরাইশগণ যখন মুসলিমগণের আগমন সম্পর্কে অবহিত হল তখন তারা একটি পরামর্শ বৈঠকে মিলিত হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, যে প্রকারেই হোক আল্লাহর ঘর হতে মুসলিমগণকে নিবৃত্ত করতেই হবে। এমনি এক অবস্থার প্রেক্ষাপটে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কুরাইশগণের সাহায্যকারী লোকজন অধ্যূষিত জনপদের পার্শ্ববর্তী পথ দিয়ে অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখলেন। এ সময় বনু কা‘ব গোত্রের এক লোক এসে নাবী কারীম (ﷺ)-কে অবহিত করল যে, কুরাইশগণ যী’তাওয় নামক স্থানে শিবির স্থাপন করেছে এবং খালিদ বিন ওয়ালিদ দু’ শত ঘোড়সওয়ার সৈন্য দল নিয়ে কোরাউলগামীমে প্রস্তুত রয়েছে। (কুরাউল গামীম মক্কা যাওয়ার পথে মধ্যস্থলে এবং যাতায়াতের মহা সড়কের উপর অবস্থিত।) খালিদ মুসলিমগণকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করল।
খালিদ এমন এক স্থানে ঘোড়সওয়ারদের মোতায়েন করল যেখান থেকে উভয় দলই পরস্পর পরস্পরকে দেখতে পাচ্ছিল। যুহর সালাতের সময় খালিদ প্রত্যক্ষ করল যে, মুসলিমগণ সালাতের মধ্যে রুকু সিজদাহহ করছে। এতে তার ধারণা হল যে, সালাতের মধ্যে যখন তারা বহির্জগত সম্পর্কে গাফেল অবস্থায় থাকে তখন আক্রমণ চালালে সহজেই তাদের পরাভূত করা সম্ভব হতে পারে। তার এ ধারণার প্রেক্ষিতে সে স্থির করল যে, আসর সালাতের সময় তার বাহিনী নিয়ে সে আকস্মিকভাবে তাদের উপর আক্রমণ চালাবে। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা ঠিক সেই সময়েই খাওফের সালাতের (যুদ্ধাস্থার বিশেষ সালাত) আয়াত নাযিল করলেন। ফলে খালিদের সে সুযোগ লাভ সম্ভব হল না।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কুরাউল গামীমের প্রধান পথ পরিহার করে আঁকাবাঁকা অন্য এক পথ ধরে অগ্রসর হতে থাকলেন। এ পথটি ছিল একটি পাহাড়ী পথ, প্রধান সড়কটি বাম পাশে রেখে ডান দিকে ঘুরে হিমসের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে এমন পথ ধরলেন, যে পথ সানিয়াতুল মারারের উপর দিয়ে চলে গেছে। সানিয়াতুল মারার হতে হুদায়বিয়াহতে নেমেছে। হুদায়বিয়াহ মক্কার নিম্ন অঞ্চলে অবস্থিত। পরিবর্তিত পথ ধরে অগ্রসর হওয়ার সুবিধা হল, কোরাউল গামীমের সে প্রধান সড়ক যা তানঈম হতে হারাম শরীফ পর্যন্ত গিয়েছে এবং যেখানে খালিদ বিন ওয়ালিদের সৈন্য বাহিনী মোতায়েন ছিল তাকে বাম দিকে রেখে এগিয়ে যাওয়ার ফলে সংঘর্ষের ঝুঁকিটা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল। মুসলিমগণের পথ চলার ফলে বাতাসে যে ধূলোবালির আভাষ প্রকাশ যাচ্ছিল তা প্রত্যক্ষ করে খালিদ এটা অনুধাবন করতে সক্ষম হল যে, তারা পথ পরিবর্তন করেছে। তখন সে পরিবর্তিত পরিস্থিতি সম্পর্কে কুরাইশগণকে অবহিত করার জন্য তার ঘোড়াকে যতটুকু সম্ভব উত্তেজিত করল এবং অত্যন্ত ক্ষিপ্র গতিতে মক্কা অভিমুখে ছুটে চলল।
এদিকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যথারীতি সফর অব্যাহত রাখলেন এবং যখন সানিয়াতুল মারারে এসে পৌঁছলেন তখন উট বসে পড়ল। লোকজনেরা বললেন, ‘বসলে কেন চল।’ কিন্তু সে বসেই রইল। লোকেরা বললেন, ‘ক্বাসওয়া (হুজুরের (ﷺ) উটের নাম) বেঁকে বসেছে।’
নাবী কারীম (ﷺ) বললেন,(مَا خَلَأَتِ الْقَصْوَاءُ، وَمَا ذَاكَ لَهَا بِخُلُقٍ، وَلٰكِنْ حَبَسَهَا حَابِسُ الْفِيْلِ) ‘ক্বাসওয়া থামেনি এবং এটা তার স্বভাব কিংবা অভ্যাসও নয়। কিন্তু একে সেই সত্তাই বিরত রেখেছেন যে সত্তা হাতীকে বাধা দিয়ে রেখেছিলেন।
অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করলেন,وَالَّذِيْ نَفْسِيْ بِيَدِهِ لاَ يَسْأَلُوْنِيْ خُطَّةً يُعَظِّمُوْنَ فِيْهَا حُرُمَاتِ اللهِ إِلاَّ أَعْطِيْتُهُمْ إِيَّاهَا ‘ঐ সত্তার কসম! যাঁর হাতে রয়েছে আমার আত্মা, এরা এমন কোন বিষয়ের দাবী করলে যার মধ্যে আল্লাহর নিষিদ্ধবস্তুর সম্মান প্রদর্শিত হয় আমি অবশ্যই তা স্বীকার করে নিব।
এরপর নাবী (ﷺ) উটকে ধমক দিলেন। তখন সে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। রাসূলে কারীম (ﷺ) পথের সামান্য পরিবর্তন করে অগ্রসর হলেন এবং হুদায়বিয়াহর শেষ প্রান্তে একটি ঝর্ণার নিকট অবতরণ করলেন। সেখানে সামান্য পরিমাণ পানি ছিল এবং লোকেরা অল্প করে তা নিচ্ছিলেন। কাজেই, কিছুক্ষণের মধ্যেই পানি নিঃশেষ হয়ে গেল।
পিপাসার্ত লোকজন যখন রাসূলে কারীম (ﷺ)-এর খেদমতে পানির জন্য আরয করলেন তখন তিনি শরাধার থেকে একটি শর বা তীর বাহির করে দিয়ে তা তাদের হাতে দিলেন এবং সেটিকে ঝর্ণায় নিক্ষেপ করার পরামর্শ দান করলেন। ঝর্ণায় তীর নিক্ষেপ করার সঙ্গে সঙ্গে ঝর্ণায় এত পরিমাণ পানি প্রবাহিত হল যে সকলেই পূর্ণ পরিতৃপ্তির সঙ্গে পানি পান করে প্রত্যাবর্তন করলেন।
রাসূলে কারীম (ﷺ) যখন একটু স্বস্তি বোধ করলেন তখন বুদাইল বিন ওয়ারাক্বা (রাঃ) খুযায়ী আপন খুযা’আহ গোত্রের কয়েক জন লোক সহ তাঁর খেদমতে উপস্থিত হলেন। তুহামার অধিবাসীগণের মধ্যে এ গোত্রই (খুযা’আহ) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’র মঙ্গলকাঙ্ক্ষী ছিল। বুদাইল বলল, ‘আমি কা‘ব বিন লুওয়ায়কে দেখে আসছি যে, সে হুদায়বিয়াহর পর্যাপ্ত পানির আশ্রয়ের উপর শিবির স্থাপন করেছে। তাদের সঙ্গে শিশু এবং মহিলাগণও রয়েছে। আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করা এবং আল্লাহর ঘর হতে আপনাদের নিবৃত্ত রাখার ব্যাপারে তারা বদ্ধ-পরিকর।’
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন,
(إِنَّا لَمْ نَجِئ لِقِتَالِ أَحَدٍ، وَلٰكِنَّا جِئْنَا مُعْتَمِرِيْنَ، وَإِنَّ قُرَيْشاً قَدْ نَهَكَتْهُمْ الْحَرْبُ وَأَضَرَّتْ بِهِمْ، فَإِنْ شَاءُوْا مَادَدْتُّهُمْ، وَيَخْلُوْا بَيْنِيْ وَبَيْنَ النَّاسِ، وَإِنْ شَاءُوْا أَنْ يَّدْخُلُوْا فِيْمَا دَخَلَ فِيْهِ النَّاسُ فَعَلُوْا، وِإِلَّا فَقَدْ جَمُّوْا ، وَإِنْ هُمْ أَبَوْا إِلَّا الْقِتَالَ فَوَالَّذِيْ نَفْسِيْ بِيَدِهِ لَأُقَاتِلَنَّهُمْ عَلٰى أَمْرِيْ هٰذَا حَتّٰى تَنْفَرِدُ سَالفتي، أَوْ لَيَنْفِذَنَّ اللهُ أَمْرَهُ)
‘কারো সঙ্গে যুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে আমরা এখানে আগমন করি নি। অতীতের যুদ্ধসমূহ কুরাইশগণকে সম্পূর্ণরূপে পর্যুদস্ত ও তছ্নছ্ করে ফেলেছে। এতে তাদের ক্ষতিও হয়েছে অসামান্য। তাই যদি তারা চায় তাহলে আমি তাদের সঙ্গে একটি সময় নির্ধারণ করব যে সময় তারা আমার ও বিপক্ষীয় লোকজনের পথ থেকে সরে দাঁড়াবে। এতে বড় আকারের ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো সম্ভব হবে। অন্যথায় যদি তারা যুদ্ধ চায় তাহলে তাদের ঔদ্ধত্য জনিত কৃতকার্যের শাস্তি অবশ্যই ভোগ করতে হবে।
আর যুদ্ধই যদি তাদের একমাত্র কাম্য হয়ে থাকে, তবে সেই সত্তার কসম! যাঁর হাতে রয়েছে আমার জীবন আমি আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে তাদের সঙ্গে ঐ সময় পর্যন্ত যুদ্ধ করে যাব যতক্ষণ পর্যন্ত আমার শরীরে আত্মা থাকে, কিংবা যতক্ষণ আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় দ্বীনের ব্যাপারে একটা চূড়ান্ত ফয়সালা করে না দেন।
বুদাইল বলল, ‘আপনি যা বললেন আমি তা কুরাইশগণকে অবহিত করব।’
অতঃপর সে কুরাইশগণের নিকট গিয়ে বলল, ‘আমি মদীনার ঐ নাবী সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাত করে এসেছি। আমি তাঁর নিকট একটা কথা শুনেছি, যদি তোমরা চাও তাহলে আমি তোমাদের নিকট তা উপস্থাপন করব।’
এ কথার প্রেক্ষিতে নির্বোধ এবং স্বল্পবুদ্ধিসম্পন্ন লোকেরা বলল, ‘আমাদের এমন কোন প্রয়োজন নেই যে, তুমি কোন কথা আমাদের নিকট বর্ণনা কর।’
কিন্তু যারা বুদ্ধিমান ও প্রজ্ঞাসম্পন্ন ছিল তারা বলল, ‘তুমি তাঁর কাছ থেকে কী শুনেছ তা আমাদের শুনতে দাও।’
বুদাইলের নিকট রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যে সকল কথা বলেছিলেন সে তাদের নিকট তা বর্ণনা করল। এ প্রেক্ষিতে কুরাইশরা মিকরায বিন হাফসকে তাঁর নিকট প্রেরণ করল। তাকে দেখে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, ‘এ ব্যক্তি অঙ্গীকার ভঙ্গকারী।’
কিন্তু যখন সে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট অগ্রসর হয়ে আলাপ আলোচনা করল তখন তিনি তাকে সেই সব কথাই বললেন যা বুদাইল এবং তাঁর সঙ্গীসাথীদের নিকট বলেছিলেন। অতঃপর সে মক্কা ফিরে এসে কুরাইশগণকে তার আলাপ আলোচনার বিষয়াদি অবহিত করল।
আলাপ আলোচনার বিষয়াদি অবহিত হয়ে বনু কিনানাহ গোত্রের হুলাইস বিন আলকামা বলল, ‘আমাকে তাঁর নিকট যেতে দাও।’ লোকজনেরা বলল, ‘বেশ তবে যাও।’
যখন সে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দরবারে উপস্থিত হল তখন নাবী কারীম (ﷺ) সাহাবীগণ (রাঃ)-কে লক্ষ্য করে বললেন, (هٰذَا فُلاَنٌ، وَهُوَ مِنْ قَوْمٍ يُعَظِّمُوْنَ الْبُدْنَ، فَابْعَثُوْهَا) ‘এ ব্যক্তি এমন এক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্কিত যারা হাদ্য়ীর পশুকে অনেক সম্মান করে। অতএব পশুগুলোকে দাঁড় করে দাও।’
সাহাবীগণ (রাযি.) পশুগুলোকে দাঁড় করে দিলেন এবং নিজেরাও লাববায়েক বলে তাকে খুশ আহমেদ জানালেন। এ অবস্থা প্রত্যক্ষ করে সে ব্যক্তি আনন্দে বিভোর হয়ে বলে উঠল, ‘সুবহানাল্লাহ! এ সকল লোককে আল্লাহর ঘর হতে বিরত রাখা কোন মতেই সমীচীন হবে না।’ এ কথা বলেই সে তার সঙ্গীদের নিকট ফিরে গেল।
ফিরে গিয়ে সে কুরাইশগণের নিকট বলল, ‘আমি হাদয়ীর পশু দেখে এলাম যাদের গলায় হার দেওয়া আছে এবং পৃষ্ঠদেশ চিরে দেওয়া হয়েছে। এ জন্য আল্লাহর ঘর থেকে তাদের নিবৃত্ত রাখা আমি সমীচীন মনে করছি না।’ তার এ সকল কথার প্রেক্ষাপটে কুরাইশ লোকজন ও তার মধ্যে এমন কিছু বাক্য বিনিময় হয়ে গেল যার ফলে সে খুবই উত্তেজিত হয়ে পড়ল।
এমন সময় উরওয়া বিন মাসউদ সাক্বাফী হস্তক্ষেপ করল এবং বলল, ‘ঐ ব্যক্তি (মুহাম্মাদ (ﷺ)) তোমাদের নিকট একটি ভাল প্রস্তাব দিয়েছে। তোমরা তাঁর প্রস্তাব গ্রহণ করে নাও এবং আমাকে তাঁর নিকট যেতে দাও।’’
লোকজনেরা তাকে যাওয়ার অনুমতি দিলে সে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দরবারে উপস্থিত হয়ে কথোপকথন আরম্ভ করল। আলোচনায় নাবী কারীম (ﷺ) তাকে সে সব কথাই বললেন, যা তিনি বুদাইলকে বলেছিলেন। প্রত্যুত্তরে উরওয়া বলল, ‘হে মুহাম্মাদ (ﷺ)! যদি আপনি নিজ জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দেন তবে কি আপনার পূর্বের কোন আরব সম্পর্কে শুনেছেন যে, সে নিজ জাতিকে সমূলে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে? আর যদি দ্বিতীয় অবস্থা ঘটে যায় তবে আল্লাহর কসম! আমি এমন কতগুলো মূর্খ ও লম্পট দেখছি যারা আপনাকে ছেড়ে পলায়ন করবে।’
এ কথা শুনে আবূ বাকর (রাঃ) বললেন, ‘লাতের লজ্জাস্থানের ঝুলন্ত চর্ম চুষতে থাক, আমরা নাবী (ﷺ)-কে ছেড়ে পলায়ন করব?
উরওয়া বলল, ‘এ লোকটি কে?’
লোকজনেরা বলল, ‘তিনি আবূ বাকর।’
সে আবূ বাকরকে সম্বোধন করে বলল, ‘দেখ, সেই সত্তার কসম! যাঁর হাতে রয়েছে আমার জীবন যদি এমন ব্যাপার না হতো যে, তুমি আমার একটি উপকার করেছিলে এবং আমি তার প্রতিদান দিতে পারি নি, তবে অবশ্যই এর জবাব আমি দিয়ে দিতাম।’
এরপর উরওয়া পুনরায় নাবী কারীম (ﷺ)-এর সঙ্গে কথোপকথন শুরু করল এবং আলাপ-আলোচনা চলা অবস্থায় বার বার নাবী কারীম (ﷺ)-এর দাড়ি মুবারক ধরে নিচ্ছিল। মুগীরা বিন শো‘বা নাবী কারীম (ﷺ)-এর মাথার পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর হাতে ছিল একটি তরবারী। আলোচনার সময় উরওয়া যখন নাবী কারীম (ﷺ)-এর দাড়ি মুবারকের দিকে হাত বাড়াত তখন তিনি তরবারীর হাতল দ্বারা তার হাতে আঘাত করতেন এবং বলতেন, নাবী কারীম (ﷺ)-এর দাড়ি মুবারক হতে হাত দূরে রাখ।’
অবশেষে উরওয়া নিজ মস্তক উত্তোলন করে বলল, ‘এ লোকটি কে?’
লোকেরা বলল, মুগীরাহ বিন শো‘বা। তাতে সে বলল, ‘অঙ্গীকার ভঙ্গকারী! আমি কি তোমার অঙ্গীকার ভঙ্গের ব্যাপারে দৌঁড় ঝাঁপ করছিনা?’’
প্রকৃত ঘটনাটি হচ্ছে জাহেলীয়াত যুগে মুগীরা (রাঃ) কিছু সংখ্যক লোকের সঙ্গে ছিলেন। কোন এক অবস্থায় তিনি সঙ্গী সাথীদের হত্যা করেন এবং তাদের ধন সম্পদ নিয়ে পলায়ন করেন। অতঃপর ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নাবী কারীম (ﷺ) বলেছিলেন,أَمَّا الْإِسْلاَمُ فَأَقْبَلُ، وَأَمَّا الْمَالُ فَلَسْتَ مِنْـُهُ فِـْي شَيْءٍ وَكَانَ الْمُغِيْرَةُ اِبْنُ أَخِيْ عُرْوَةَ ‘তুমি তো ইসলাম গ্রহণ করছ কিন্তু তোমার ধন সম্পদের সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক থাকবে না। এ ব্যাপারে উরওয়ার দৌঁড় ঝাঁপ করার কারণ ছিল, মুগীরাহ (রাঃ) ছিলেন তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র।
এরপর উরওয়া নাবী কারীম (ﷺ)-এর সঙ্গে সাহাবায়ে কেরামের সম্পর্ক সৌকর্যের ক্ষেত্রে আন্তরিকতার দৃশ্য প্রত্যক্ষ করতে থাকল। অতঃপর সে স্বগোত্রীয় লোকজনদের নিকট ফিরে এসে বলল, ‘হে গোত্রীয় ভ্রাতৃবর্গ! আল্লাহর কসম! আমি কায়সার ও কিসরা এবং নাজ্জাসীদের সম্রাটের দরবারে গিয়েছি, আল্লাহর কসম! আমি কোন সম্রাটকে দেখি নি যে, তাঁর অনুসারী বা সঙ্গীসাথীগণ তাঁর এতটুকু সম্মান করছে মুহাম্মাদ (ﷺ)- কে তাঁর সাহাবাবর্গ যত বেশী সম্মান করছে। আল্লাহর কসম! তিনি যখন থু-থু ফেলছেন তখন যে কেউ তা হাতে নিয়ে আপন মুখমণ্ডলে কিংবা শরীরে তা মেখে নিচ্ছেন। যখন তিনি কোন কাজের নির্দেশ প্রদান করছেন তখন তা বাস্তবায়নের জন্য সকলের মধ্যেই তৎপরতা শুরু হয়ে যাচ্ছে। যখন তিনি অযু করছেন তখন মনে হচ্ছে যেন তাঁর ব্যবহৃত পানির জন্য লোকেরা যুদ্ধ শুরু করে দেবে। যখন তিনি কোন কথা বলছেন তখন সকলের কণ্ঠস্বর নীচু হয়ে যাচ্ছে। তাঁর সম্মানের খাতিরে সাহাবীগণ কখনই তাঁর প্রতি পূর্ণভাবে দৃষ্টিপাত করেন না। নিশ্চয়ই তাঁর মধ্যে এমন গুণাবলীর সমাবেশ ঘটেছে যার ফলে সাহাবীগণ তাঁকে এতটা শ্রদ্ধা করছেন। তিনি তোমাদের জন্য একটি উত্তম প্রস্তাব দিয়েছেন। তোমাদের উচিত তা গ্রহণ করে নেয়া।’
যখন কুরাইশগণের যুদ্ধবাজ ও যুদ্ধোন্মাদ যুবকগণ দেখল যে তাদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগণ সন্ধির পক্ষপাতি, তখন তারা নেতৃস্থানীয়দের এড়িয়ে স্বতন্ত্রভাবে একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল যে, রাত্রিরে অন্ধকার এখান থেকে বেরিয়ে গিয়ে তারা মুসলিমগণের শিবিরে প্রবেশ করবে এবং এমন ভাবে গন্ডগোল পাকিয়ে তুলবে যাতে আপনা থেকেই যুদ্ধের আগুন জ্বলে ওঠে।
অতঃপর তাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ সম্পাদনের লক্ষ্যে রাতের আঁধারে সত্তর কিংবা আশি জন যুবক তানঈম পর্বতে অবতরণ করে মুসলিমগণের শিবিরে প্রবেশের চেষ্টা করে। কিন্তু মুসলিম শিবির প্রহরীদের পরিচালক মুহাম্মাদ বিন মাসলামা তাদের সকলকে বন্দী করেন। কিন্তু সন্ধিচুক্তির খাতিরে নাবী কারীম (ﷺ) সকলকে ক্ষমা প্রদর্শন ক’রে মুক্ত করে দেন। সে সম্পর্কেই আল্লাহর তরফ থেকে তখন আয়াত নাযিল হয়:
(وَهُوَ الَّذِيْ كَفَّ أَيْدِيَهُمْ عَنْكُمْ وَأَيْدِيَكُمْ عَنْهُم بِبَطْنِ مَكَّةَ مِن بَعْدِ أَنْ أَظْفَرَكُمْ عَلَيْهِمْ) [الفتح: 24]
‘তিনি সেই সত্তা যিনি তোমাদের উপর হতে তাদের হাতকে নিবৃত্ত করলেন মক্কা প্রান্তরে এবং তোমাদের হাতকে তাদের হতে। এর পূর্বেই তিনি তাদেরকে তোমাদের আয়ত্বে এনে দিয়েছিলেন।’ [আল-ফাতহ (৪৮) : ২৪]
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) চিন্তা করলেন যে, এ সময় কুরাইশদের নিকট এমন একজন দূত প্রেরণ করা প্রয়োজন যিনি বর্তমান ভ্রমণের উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্য সম্পর্কে জোরালোভাবে বক্তব্য উপস্থাপন করতে সক্ষম হবেন। রাসূল্লাহ (ﷺ) প্রথম উমার (রাঃ)-কে এ কাজের জন্য আহবান জানালে তিনি এ বলে ক্ষমাপ্রার্থী হলেন যে, ‘হে আল্লাহর রাসূল! সেখানে যদি আমাকে কষ্ট দেয়া হয় তাহলে মক্কায় বনু কা‘ব গোত্রের এমন একজন লোকও নেই যে আমার সাহায্যের জন্য উদ্বু্দ্ধ হবে। আপনি বরং উসমান বিন আফফান (রাঃ)-কে এ উদ্দেশ্যে প্রেরণ করুন। তাঁর আত্মীয় এবং গোত্রীয় লোকজনদের অনেকেই এখনো মক্কায় রয়েছেন। তিনি আপনার বার্তা খুব ভালভাবেই পৌঁছে দিতে সক্ষম হবেন।
অতঃপর রাসূলে কারীম (ﷺ) উসমান (রাঃ)-কে আহবান জানিয়ে কুরাইশগণের নিকট গমনের নির্দেশ দিলেন এবং বললেন, ‘তুমি গিয়ে তাদেরকে বলে দাও যে যুদ্ধ করার জন্য আমরা আসি নি। আমরা এসেছি উমরাহ পালনের জন্য। তাছাড়া তাদের নিকট ইসলামের দাওয়াত পেশ কর।’
অধিকন্তু, তিনি উসমান (রাঃ)-কে এ নির্দেশ দিলেন যে, ‘তুমি মক্কায় ঈমানদার পুরুষ ও মহিলাগণের নিকট গিয়ে অদূর ভবিষ্যতে মুসলিমগণের মক্কা বিজয়ের শুভ সংবাদ শুনিয়ে দেবে এবং এ কথাও বলে দেবে যে আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় দ্বীনকে শীঘ্রই মক্কায় প্রকাশিত ও প্রতিষ্ঠিত করবেন। কাজেই, আল্লাহর দ্বীনে বিশ্বাস স্থাপনের জন্য কাউকেও আত্মগোপন করে থাকার প্রয়োজন হবে না।’
উসমান (রাঃ) নাবী কারীম (ﷺ)-এর বার্তা নিয়ে মক্কা গমন করলেন। বালদাহ নামক স্থানে কুরাইশগণের নিকট দিয়ে যখন তিনি পথ চলছিলেন তখন তারা জিজ্ঞেস করল, কী উদ্দেশ্যে কোথায় এ যাত্রা? তিনি বললেন, ‘একটি বার্তাসহ আল্লাহর নাবী মুহাম্মাদ (ﷺ) আমাকে এ স্থানে প্রেরণ করেছেন।’
তারা বলল, ‘আমরা মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর কথা শুনেছি, আপনি নিজ কাজে চলে যান।’
অন্য দিকে সাঈদ বিন আস উঠে এসে ‘মারহাবা’ বলে তাঁকে খুশ আমদেদ জানালেন। অতঃপর তিনি নিজ ঘোড়ার উপর জিন চাপিয়ে তাতে আরোহণ করলেন এবং উসমান (রাঃ)-কে সঙ্গে বসিয়ে নিয়ে মক্কায় নিজ বাসস্থানে নিয়ে গেলেন। সেখানে গিয়ে উসমান (রাঃ) নেতৃস্থানীয় কুরাইশগণের নিকট রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বার্তা শোনালেন। বার্তা পৌঁছানোর মাধ্যমে যখন তিনি আরোপিত দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি লাভ করলেন তখন কুরইশগণ প্রস্তাব করল যে, তিনি যেন আল্লাহর ঘর তাওয়াফ করেন। কিন্তু রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-এর তাওয়াফের পূর্বে তাওয়াফ করা সমীচীন মনে না করায় তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন।
উসমান (রাঃ) তাঁর উপর আরোপিত দৌত-মহোদ্যম সম্পূর্ণ করলেন কিন্তু কুরাইশগণ তাঁকে আটকাবস্থায় রাখলেন। সম্ভবত উদ্ভূত পরিস্থিতির ব্যাপারে সঠিক কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে না পারার কারণেই এবং কিছুটা বিলম্বে হলেও তাঁর মাধ্যমে তারা তাদের সিদ্ধান্ত সঠিক রেখেছিল। যেহেতু ব্যাপারটি ছিল তাদের জন্য অত্যন্ত বিতর্কমূলক এবং এ ব্যাপারে তাদের আরও সলা-পরামর্শের প্রয়োজন ছিল সেহেতু তারা উসমান (রাঃ)-এর প্রত্যাবর্তন বিলম্বিত করতে চেয়েছিল।
কিন্তু উসমান (রাঃ)-এর পত্যাবর্তনে অস্বাভাবিক বিলম্ব হওয়ার কারণে মুসলিমগণের মধ্যে একটি গুজব ছড়িয়ে পড়ল যে, উসমান (রাঃ)-কে হত্যা করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন এ সংবাদ অবগত হলেন, তখন ঘোষণা দিলেন যে,(لاَ نَبْرَحُ حَتّٰى نُنَاجِزَ الْقَوْمَ) যুদ্ধের মাধ্যমে যতক্ষণ একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না হচ্ছে ততক্ষণ আমরা এ জায়গা পরিত্যাগ করব না। অতঃপর নাবী কারীম (ﷺ) সাহাবীগণকে অঙ্গীকারাবদ্ধ হওয়ার আহবান জানালেন। সাহাবা কেরামের একটি দলকে কিছুটা ভেঙ্গে পড়ার মতো মনে হল। অবশ্য, তাঁরা অঙ্গীকারাবদ্ধ হলেন যে, তারা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করবেন না। অন্য এক দল মৃত্যুবরণ করার জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ হলেন, অর্থাৎ মৃত্যুবরণ করতে হলেও তাঁরা যুদ্ধক্ষেত্র পরিত্যাগ করবে না। সর্ব প্রথম অঙ্গীকারাবদ্ধ হলেন আবূ সেনান আসাদী। সালাম বিন আকওয়া তিন দফা অঙ্গীকারে করলেন। প্রথমে, মধ্যে ও শেষে। রাসূলে কারীম (ﷺ) স্বয়ং নিজ হাত ধরে বললেন,(هٰذِهِ يَدُ عُثْمَانَ) ‘এ হচ্ছে উসমানের হাত।’ ইতোমধ্যে যখন অঙ্গীকার গ্রহণ পর্ব সম্পন্ন হয়ে গেল তখন উসমান (রাঃ) প্রত্যাবর্তন করলেন এবং তিনিও অঙ্গীকারাবদ্ধ হলেন। এ অঙ্গীকার পর্বে মাত্র একজন অংশ গ্রহণ করে নি। সে ছিল মুনাফিক্ব। তার নাম ছিল জুদ বিন ক্বায়স।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এ অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন একটি বৃক্ষের তলদেশে। উমার (রাঃ) পবিত্র হাতকে উত্তোলিত অবস্থায় রেখেছিলেন এবং মাকাল বিন ইয়াসার (রাঃ) বৃক্ষের কতগুলো শাখা ধরে রাসূলে কারীম (ﷺ)-এর উপর থেকে সরিয়ে রেখেছিলেন। এ অঙ্গীকারের নাম হচ্ছে বাইয়াত রিযওয়ান। এ বাইয়াত সম্পর্কে কুরআনে ইরশাদ হয়েছে :
(لَقَدْ رَضِيَ اللهُ عَنِ الْمُؤْمِنِيْنَ إِذْ يُبَايِعُوْنَكَ تَحْتَ الشَّجَرَةِ)الآية [الفتح: 18]
‘মু’মিনদের প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট হলেন যখন তারা (হুদাইবিয়ায়) গাছের তলে তোমার কাছে বায়‘আত নিল।’ [আল-ফাতহ (৪৮) : ১৮]