প্রশ্ন: সূদানের মুতাওয়াক্কিল ইবনে মোস্তফা নামের এক ব্যক্তি বলেন, আমাদের সূদানে একটি জামা‘আত আছে, যারা মানুষকে সালাফী দা‘ওয়াত দেয়। তবে তাদের একজন প্রধান আমীর ও অনেকগুলি সাধারণ আমীর রয়েছেন এবং তারা তাদের সদস্যদেরকে প্রধান আমীরের অনুসরণ করতে বাধ্য করে। এমনকি ইজতেহাদী বিষয়েও তাদেরকে তার অনুসরণে বাধ্য করা হয়। এ বিষয়ে আপনার মতামত জানিয়ে বাধিত করবেন।

উত্তর: এমন সংগঠন বা দা‘ওয়াতী কাজের এমন পদ্ধতির কোনো শরঈ ভিত্তি আছে বলে আমার জানা নেই। প্রশ্নে ইমারত বা নেতৃত্বের যে কথাটি বলা হয়েছে, তা শুধুমাত্র মুসলিম সরকারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য; সৎকাজে যার অনুসরণ করতে হবে, অসৎকাজে নয়। কোনো দল কর্তৃক কাউকে আমীর বানিয়ে তার অনুসরণ করা মারাত্মক ভুল। কাউকে সৎকাজে ছাড়া অনুসরণ করা যাবে না। কোনো বিষয়ে মুসলিমদের মধ্যে বিবাদ সৃষ্টি হলে বিবাদীয় বিষয় কুরআন ও সুন্নাহ্‌র দিকে ফিরিয়ে দিতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন,

﴿فَإِن تَنَٰزَعۡتُمۡ فِي شَيۡءٖ فَرُدُّوهُ إِلَى ٱللَّهِ وَٱلرَّسُولِ إِن كُنتُمۡ تُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِۚ ﴾ [النساء: ٥٩]

‘অতঃপর যদি তোমরা কোন বিষয়ে বিবাদে জড়িয়ে পড়, তাহলে তা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও, যদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাক’ (আন-নিসা ৫৯)। সুতরাং বিভিন্ন জামা‘আত ও মাযহাবের অনুসারীদের উচিৎ বিবাদীয় যে কোনো বিষয়কে কুরআন ও সুন্নাহ্‌র দিকে ফিরিয়ে দেওয়া। কারো জন্য বৈধ নয় যে, সে কাউকে ফায়ছালাকারী নিযুক্ত করে হক-বাতিল সবকিছুতে তার অনুসরণ করে চলবে; বরং কুরআন ও সুন্নাহকে চূড়ান্ত ফায়ছালাকারী হিসাবে গ্রহণ করতে হবে।([1])

([1]) ‘শায়খ ইবনে বাযের সাথে মুতাওয়াক্কিলের সাক্ষাৎ’ ক্যাসেট থেকে সংগৃহীত।
প্রশ্ন: মুতাওয়াক্কিল বলেন, বর্তমান মুসলিম দেশসমূহে বিভিন্ন জামা‘আত ও সংগঠনের ছড়াছড়ি দেখা যাচ্ছে এবং তাদের পরস্পরের মধ্যে মতভেদ ও অমিলেরও কমতি নেই। এমনকি এক পক্ষ অপর পক্ষকে পথভ্রষ্ট ভাবতেও দ্বিধা করে না। এমতাবস্থায় উলামায়ে কেরামের ভূমিকা কি হতে পারে? হক তুলে ধরার জন্য এই বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করা কি আপনি যথোপযুক্ত মনে করেন না? কারণ মুসলিম জাতির জন্য এসব মতভেদ ও বিভক্তির ভয়াবহ পরিণতি অপেক্ষা করছে।

উত্তর: উলামায়ে কেরামের উচিৎ আসল বাস্তবতা তুলে ধরা, প্রত্যেকটি জামা‘আত ও সংগঠনের সাথে আলোচনা করা এবং সবাইকে আল্লাহ নির্দেশিত ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রদর্শিত সরল পথে চলার নছীহত করা। যে ব্যক্তি সীমালঙ্ঘন করবে এবং ব্যক্তি স্বার্থে বা অন্য কোনো কারণে নিজের একগুঁয়েমি বজায় রাখবে, তার বিষয়টি জনগণের সামনে প্রকাশ করে দেওয়া এবং তাদেরকে তার থেকে সতর্ক করা অপরিহার্য। তাহলে যারা তার সম্পর্কে জানে না, তারা তার থেকে দূরে থাকতে পারবে। ফলে সে কাউকে আল্লাহ নির্দেশিত সরল পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারবে না।([1])

([1]) মাজমূউ ফাতাওয়া ইবনে বায, ৪/১৩৬-১৩৭।
প্রশ্ন: বিভ্রান্ত দলগুলির ক্ষেত্রে দা‘ঈদের ভূমিকা বিষয়ে আপনার নছীহত কি? যেসব যুবক দ্বীনী দল হিসাবে পরিচিত বিভিন্ন দলে যোগদানের মন্ত্রে প্রভাবিত, তাদের ব্যাপারে আপনার বিশেষ নছীহত কামনা করছি।

উত্তর: আমরা আমাদের সকল ভাইকে প্রজ্ঞা, সদুপদেশ এবং সদ্ভাবে তর্কের মাধ্যমে আল্লাহ্‌র পথে দা‘ওয়াতী কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার নছীহত করছি। দা‘ওয়াতী এই সার্বজনীন পদ্ধতি বিদ‘আতী ও বিভ্রান্ত দলের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। সুতরাং মুমিন ব্যক্তি কোনো বিদ‘আত দেখলে অবশ্যই সে সাধ্যানুযায়ী শরঈ পদ্ধতিতে তার বিরোধিতা করবে। আর দ্বীনের ভেতরে মানুষ যেসব নতুন নতুন বিষয়ের সৃষ্টি করে দ্বীনের সাথে মিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে, সেগুলোই বিদ‘আত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমাদের দ্বীনের মধ্যে এমন কিছু নতুন সৃষ্টি করে, যা তার মধ্যে নেই, তা-ই প্রত্যাখ্যাত’। তিনি অন্যত্র বলেন, ‘যে ব্যক্তি এমন কোনো আমল করল, যার প্রতি আমাদের নির্দেশনা নেই, তা-ই প্রত্যাখ্যাত’। বিদ‘আতের কিছু উদাহরণ হচ্ছে: রাফেযী মতবাদ, মু‘তাযিলা মতবাদ, মুরজিয়া মতবাদ, খারেজী মতবাদ, মীলাদুন্নবী অনুষ্ঠান উদযাপন, কবরের উপর ঘর-বাড়ি-গম্বুজ ইত্যাদি নির্মাণ, কবরের উপরে মসজিদ নির্মাণ। যাহোক, যারা বিদ‘আত করবে, তাদেরকে নছীহত করতে হবে, কল্যাণের পথে তাদেরকে আহ্বান করতে হবে এবং শর‘ঈ দলীল-প্রমাণ দিয়ে তাদের সৃষ্ট বিদ‘আতের বিরোধিতা করতে হবে। সাথে সাথে তাদের অজানা হকের কথাটি তাদেরকে বিনম্রভাবে, সুন্দর পদ্ধতিতে এবং স্পষ্ট প্রমাণাদি দ্বারা শিখিয়ে দিতে হবে। তা হলে তারা হয়তো হক কবূল করবে।

বর্তমানে সৃষ্ট বিভিন্ন নতুন দলে যোগদানের বিষয়ে আমার বক্তব্য হচ্ছে, এসব দলাদলি পরিহার করে কুরআন ও সুন্নাহ্‌র পথে পরিচালিত হওয়া সবার জন্য যরূরী। এক্ষেত্রে সবাই পরস্পরকে একনিষ্ঠভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করবে। আর এ পদ্ধতিতে তারা আল্লাহ্‌র দলের অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে। মহান আল্লাহ বলেন,

﴿ أَلَآ إِنَّ حِزۡبَ ٱللَّهِ هُمُ ٱلۡمُفۡلِحُونَ ٢٢ ﴾ [المجادلة: ٢٢]

‘জেনে রাখ, আল্লাহর দলই সফলকাম’ (আল-মুজাদালাহ ২২)। তিনি তাদের বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী তুলে ধরে বলেন,

﴿ لَّا تَجِدُ قَوۡمٗا يُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِ يُوَآدُّونَ مَنۡ حَآدَّ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ ﴾ [المجادلة: ٢٢]

‘যারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে, তাদেরকে আপনি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধাচরণকারীদের সাথে বন্ধুত্ব করতে দেখবেন না’ (আল-মুজাদালাহ ২২)। অন্যত্র তিনি আরো বলেন,

﴿ إِنَّ ٱلۡمُتَّقِينَ فِي جَنَّٰتٖ وَعُيُونٍ ١٥ ءَاخِذِينَ مَآ ءَاتَىٰهُمۡ رَبُّهُمۡۚ إِنَّهُمۡ كَانُواْ قَبۡلَ ذَٰلِكَ مُحۡسِنِينَ ١٦ كَانُواْ قَلِيلٗا مِّنَ ٱلَّيۡلِ مَا يَهۡجَعُونَ ١٧ وَبِٱلۡأَسۡحَارِ هُمۡ يَسۡتَغۡفِرُونَ ١٨ وَفِيٓ أَمۡوَٰلِهِمۡ حَقّٞ لِّلسَّآئِلِ وَٱلۡمَحۡرُومِ ١٩ ﴾ [الذاريات: ١٥، ١٩]

‘আল্লাহভীরুরা জান্নাতে ও প্রস্রবণে থাকবে। এমতাবস্থায় যে, তাদের পালনকর্তা যা তাদেরকে দেবেন, তারা তা গ্রহণ করবে। নিশ্চয়ই ইতিপূর্বে তারা ছিল সৎকর্মপরায়ণ, তারা রাতের খুব সামান্য অংশে ঘুমাত, রাতের শেষ প্রহরে তারা ক্ষমা প্রার্থনা করত এবং তাদের ধন-সম্পদে যাচনাকারী ও বঞ্চিতের অধিকার ছিল’ (আয-যারিয়াত ১৫-১৯)। এগুলিই হচ্ছে আল্লাহ্‌র দলের সদস্যদের বৈশিষ্ট্য; তারা কুরআন-সুন্নাহ ছাড়া অন্য কারো পক্ষাবলম্বন করে না। কুরআন-সুন্নাহ্‌র দিকে মানুষকে দা‘ওয়াত দেওয়া এবং ছাহাবায়ে কেরাম, সালাফে ছালেহীন ও তাদের অনুসারীদের পথে চলা ছাড়া তারা অন্য কোনো দলে যোগদান করে না।

আল্লাহ্‌র দলের লোকেরা অন্যান্য সকল দল ও সংগঠনের লোকদেরকে নছীহত করে এবং তারা তাদেরকে কিতাব ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এবং তাদের মধ্যে বিবাদীয় বিষয়কে এতদুভয়ের দিকে ফিরিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানায়। তারা বলে কুরআন-সুন্নাহ উভয়ের সাথে অথবা যে কোনো একটির সাথে যা মিলে যাবে, তা-ই হক। পক্ষান্তরে যা মিলবে না, তা পরিহার করা অপরিহার্য। এই শাশ্বত মূলনীতি জামা‘আতুল ইখওয়ান, আনছারুস-সুন্নাহ, জাম্‌ইয়াহ শারইয়াহ, তাবলীগ জামা‘আত অথবা ইসলামের দিকে সম্বন্ধিত অন্য যে কোনো দল বা সংগঠনের ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য। উপরিউক্ত মূলনীতির মাধ্যমে সবার সংঘবদ্ধ এবং একক দলে পরিণত হওয়া সম্ভব, যে একক দল আল্লাহ্‌র দল তথা ‘আহলুস-সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আত’-এর পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলবে। মনে রাখতে হবে, শরী‘আত বিরোধী বিষয়ে কোনো দল বা সংগঠনের অন্ধভক্তি দেখানো বৈধ নয়।([1])

([1]) প্রাগুক্ত, ৭/১৭৬-১৭৮।
প্রশ্ন: যুবকদের ইসলামের উপর প্রশিক্ষিত করে তোলার জন্য মুসলিম দেশসমূহে যেসব ইসলামী দল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেগুলোকে কি ইতিবাচক গণ্য করা যাবে?

উত্তর: ইসলামী দলগুলিতে মুসলিমদের জন্য কল্যাণ আছে। তবে প্রত্যেকটি দলকে দলীলসহ হক প্রকাশের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করতে হবে এবং পরস্পরে বিরোধপূর্ণ আচরণ পরিহার করতে হবে; বরং সবাইকে পারস্পরিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে এবং একে অপরকে ভালবাসতে হবে। অনুরূপভাবে একে অপরকে নছীহত করবে এবং অপরের ভাল দিকগুলি প্রচার করতে হবে আর মন্দ দিকগুলি পরিহারের প্রতি যত্নশীল হতে হবে। কুরআন ও হাদীছের দিকে দা‘ওয়াত দেওয়ার শর্তে এসব ইসলামী দল থাকতে কোনো বাধা নেই।([1])

([1]) প্রাগুক্ত, ৫/২৭২।
প্রশ্ন: বিভিন্ন দলে দলভুক্ত যুবকদের ব্যাপারে আপনার নছীহত কি?

উত্তর: এসব যুবকের হকের পথ তালাশ করা এবং তদ্‌নুযায়ী চলা উচিৎ। যেসব বিষয়ে তাদের সমস্যা হবে, সেসব বিষয়ে উলামায়ে কেরামকে জিজ্ঞেস করে সমাধান জেনে নিবে। অনুরূপভাবে মুসলিমদের উপকার সাধিত হবে এমন বিষয়ে শর‘ঈ দলীলের ভেতরে থেকে অন্যান্য দলের সাথে পারস্পরিক সহযোগিতার হাত প্রসারিত করা উচিৎ। পারস্পরির সহযোগিতা হতে হবে সুন্দর কথা ও উত্তম পদ্ধতিতে; কঠোরতা ও ঠাট্টা-বিদ্রুপের মাধ্যমে নয়। যুবকদেরকে আমি আরো বলব, সালাফে ছালেহীন তথা ছাহাবায়ে কেরাম ও তাঁদের অনুসারীগণ যেন তাদের আদর্শ হন এবং হক যেন হয় তাদের দলীল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর ছাহাবায়ে কেরাম যে আক্বীদার উপর চলেছেন, তা যেন হয় তাদের ব্রতী।([1])

([1]) প্রাগুক্ত, ৫/২৭২।
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ৫ পর্যন্ত, সর্বমোট ৫ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে