রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সীমাহীন ও অতুলনীয় মর্যাদা, ফযীলত, মহত্ব ও গুরুত্ব বর্ণনা করা হয়েছে কুরআন কারীমের অগণিত আয়াতে এবং অগণিত সহীহ হাদীসে। এ সকল আয়াত ও হাদীসের ভাব-গম্ভীর ভাষা, বুদ্ধিবৃত্তিক আবেদন ও আত্মিক অনুপ্রেরণা অনেক মুমিনকে আকৃষ্ট করতে পারে না। এজন্য অধিকাংশ সময়ে আমরা দেখতে পাই যে, এ সকল আয়াত ও সহীহ হাদীস বাদ দিয়ে সাধারণত একেবারে ভিত্তিহীন বা অত্যন্ত দুর্বল হাদীসগুলো আমরা সর্বদা আলোচনা করি, লিখি ও ওয়ায নসীহতে উল্লেখ করি।
আমরা দেখেছি যে, মুসলিম সমাজে প্রচলিত জাল হাদীসের অন্যতম তিনটি ক্ষেত্র: (১) ফাযায়িল বা বিভিন্ন নেক আমলের সাওয়াব বিষয়ক গ্রন্থাদি, (২) পূববর্তী নবীগণ বা কাসাসুল আম্বিয়া জাতীয় গ্রন্থাদি এবং (৩) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জন্ম, জীবনী, মুজিযা বা সীরাতুন্নবী বিষয়ক গ্রন্থাদি। যুগের আবর্তনে ক্রমান্বয়ে এ সকল বিষয়ে জাল ও ভিত্তিহীন কথার প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা ইতোপূর্বে আলোচনা করেছি যে, দশম, একাদশ ও দ্বাদশ হিজরী শতকে সংকলিত সীরাত, দালাইল বা মুজিযা বিষয়ক গ্রন্থাবলিতে অগণিত ভিত্তিহীন ও জাল বর্ণনা স্থান পেয়েছে, যেগুলো পূর্ববর্তী কোনো হাদীসের গ্রন্থ তো দূরের কথা, কোনো সীরাত বা মুজিযা বিষয়ক গ্রন্থেও পাওয়া যায় না।
আল্লামা আবুল কালাম আযাদ তার ‘রাসূলে রহমত’ গ্রন্থে তুলনামূলক আলোচনা ও নিরীক্ষা করে এ জাতীয় কিছু বানোয়াট ও ভিত্তিহীন গল্পের উল্লেখ করেছেন। যেমন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জন্মের পূর্বে আসিয়া (আঃ) ও মরিয়ম (আঃ)-এর শুভাগমন, মাতা আমিনাকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জন্মের সুসংবাদ প্রদান, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর গর্ভধারণের শুরু থেকে জন্মগ্রহণ পর্যন্ত সময়ে হযরত আমিনার কোনোরূপ কষ্টক্লেশ না হওয়া... ইত্যাদি।[1]
কেউ কেউ মনে করেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নামে মিথ্যা দ্বারা আমরা তাঁর মর্যাদা বৃদ্ধি করছি। কত জঘন্য চিন্তা! মনে হয় তাঁর সত্য মর্যাদায় ঘাটতি পড়েছে যে, মিথ্যা দিয়ে তা বাড়াতে হবে!! নাঊযু বিল্লাহ! মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ) সবচেয়ে অসন্তুষ্ট হন মিথ্যায় এবং সবচেয়ে জঘন্য মিথ্য হলো আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর নামে মিথ্যা।
লক্ষণীয় যে, আল্লাহ পূর্ববর্তী নবীগণকে (আঃ) মূর্ত বা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনেক মুজিযা প্রদান করেছিলেন। মুহাম্মাদ ﷺ-কেও তিনি অনেক ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য মুজিযা দিয়েছেন। তবে তাঁর মৌলিক মুজিযা বিমূর্ত বা জ্ঞানবৃত্তিক। ভাষা, সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ের জ্ঞান ও প্রজ্ঞা মানুষকে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর মুজিযা অনুধাবনে সক্ষম করে। অনেক সময় সাধারণ মুর্খ মানুষদের দৃষ্টি আকর্ষণ, অবাক করা ইত্যাদি উদ্দেশ্যে গল্পকার, ওয়ায়িয বা জালিয়াতগণ অনেক মিথ্যা গল্প কাহিনী বানিয়ে হাদীস নামে চালিয়েছেন।
অনেক সময় এ বিষয়ক মিথ্যা হাদীসগুলো চিহ্নিত করাকে অনেকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মর্যাদা ও শানের সাথে বেয়াদবী বলে ভাবতে পারেন। বস্ত্তত তাঁর নামে মিথ্যা বলাই তাঁর সাথে সবচেয়ে বেশি বেয়াদবী ও দুশমনী। যে মিথ্যাকে শয়তানের প্ররোচনায় মিথ্যাবাদী তাঁর মর্যাদার পক্ষে ভাবছে সে মিথ্যা মূলত তাঁর মর্যাদা-হানিকর। মিথ্যার প্রতিরোধ করা, মিথ্যা নির্ণয় করা এবং মিথ্যা থেকে দূরে থাকা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নির্দেশ। এখানে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কেন্দ্রিক কিছু বানোয়াট কথা উল্লেখ করছি।
রাসূলুল্লাহ ﷺ অলৌকিকভাবে মাতৃগর্ভে স্থান নেন এবং মাতৃগর্ভ থেকে অলৌকিকভাবে বের হয়ে আসেন মর্মে নানা রকমের গল্প প্রচলিত। এগুলি সবই সনদবিহীন, দলীলবিহীন ও মনগড়া মিথ্যা। বিশ্বের কোনো গ্রন্থে এ মর্মে সনদ-সহ কোনো সহীহ বা যয়ীফ হাদীস পাওয়া যায় না।
এখানে একটি কথা বোধ হয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না। আমাদের মধ্যে অনেকেই আবেগতাড়িত হয়ে বা অজ্ঞতাবশত মনে করেন, অলৌকিকত্ব সম্ভবত মর্যাদার মাপকাঠি। এ ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল। এ ভুল ধারণাকে পূঁজি করে খৃস্টান মিশনারিগণ আমাদের দেশের বিভিন্ন স্থানে অপপ্রচার চালান। তাদের একটি লিফলেটে বলা হয়েছে: কে বেশি বড়: হযরত মুহাম্মাদ ﷺ না ঈসা মসীহ? ঈসা মসীহ বিনা পিতায় জন্মলাভ করেছেন আর মুহাম্মাদ ﷺ-এর পিতা ছিল। ঈসা মসীহ মৃতকে জীবিত করতেন কিন্তু মুহাম্মাদ ﷺ করতেন না। ঈসা মসীহ মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করেন নি কিন্তু মুহাম্মাদ ﷺ মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করেছেন।... এভাবে মুসলিম আকীদার কিছু বিষয়কে বিকৃত করে এবং প্রচলিত ভুল ধারণাকে পূঁজি করে তারা মুসলিম জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে।
অলৌকিকত্ব কখনোই মর্যাদার মাপকাঠি নয়। নবীদেরকে আল্লাহ অলৌকিকত্ব বা মুজিযা প্রদান করেন হেদায়েতের প্রয়োজন অনুসারে, মর্যাদা অনুসারে নয়। মর্যাদার মানদন্ড আল্লাহর ঘোষণা। এছাড়া দুনিয়ার ফলাফল আমরা পর্যালোচনা করতে পারি। মিশনারি প্রতারণার একটি দিক দেখুন:
ঈসা (আঃ)-এর জন্ম অলৌকিক। এছাড়া মৃতকে জীবিত করা, অন্ধকে বা কুষ্ঠ রোগীকে সুস্থ করা ইত্যাদি মুজিযা তাকে প্রদান করা হয়েছিল। কিন্তু তাঁর মর্যাদা আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বেশি নয়। কারণ প্রথমত আল্লাহর ঘোষণা। দ্বিতীয়ত জাগতিক ফলাফলও তা প্রমাণ করে। প্রচলিত বাইবেল থেকে বিচার করলে বলতে হবে যে, হেদায়েতের ক্ষেত্রে ঈসা (আঃ)-এর দাওয়াতের ফল সবচেয়ে কম। আল্লাহর হুকুমে তিনি রুগীকে সুস্থ করেছেন ও মৃতকে জীবিত করেছেন। বরং বাইবেল পড়লে মনে হয় জিনভুত ছাড়ানো ছাড়া আর কোনো বিশেষ কাজই তাঁর ছিল না। কিন্তু তিনি অনেক অবিশ্বাসীকে বিশ্বাসী করতে বা অনেক মৃত হৃদয়কে জীবিত করেতে পারেন নি। আল্লাহর হুকুমে তিনি অন্ধকে দৃষ্টিশক্তি দিয়েছেন, কিন্তু বিশ্বাসে অন্ধকে চক্ষু দান করতে পারেন নি। মাত্র ১২ জন বিশেষ শিষ্যের বিশ্বাসও এত দুর্বল ছিল যে, একজন তাঁকে কয়েকটি টাকার বিনিময়ে পুলিশের হাতে সোপর্দ করল এবং তাঁর প্রধান শিষ্য তাঁর গ্রেফতারের পর পুলিশের ভয়ে তাঁকে অস্বীকার করেন ও গালি দেন! [1] কিতাবুল মোকাদ্দস, ইঞ্জিল শরীফ ও ঈসায়ী ধর্ম বইটি পড়ে বিস্তারিত জানুন।
পক্ষান্তরে মহান আল্লাহ তাঁর সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-কে অনেক অলৌকিকত্ব প্রদান করেছেন। তাঁর সবচেয়ে বড় অলৌকিকত্ব হলো লক্ষাধিক মানুষকে বিভ্রান্তির অন্ধত্ব থেকে বিশ্বাসের আলোক প্রদান করা ও লক্ষাধিক মৃত হৃদয়কে জীবন দান করা। কাজেই অলৌকিকত্ব সম্পর্কে মিথ্যা, দুর্বল বা অনির্ভরযোগ্য কথাবার্তাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা, সেগুলোকে রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-এর মর্যাদার মাপকাঠি বা নবুয়তের প্রমাণ মনে করা ইসলামের মূল চেতনার বিপরীত। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর মর্যাদা, নুবুওয়াত ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে কুরআনই যথেষ্ট। এর পাশাপাশি সহীহ হাদীসগুলির উপর আমরা নির্ভর করব। আমাদের মানবীয় বুদ্ধি, আবেগ বা যুক্তি দিয়ে কিছু বাড়ানো বা কমানোর কোনো প্রয়োজন আল্লাহর দীনের নেই।
আব্দুল হাই লাখনবী বলেন, রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে একটি জাল কথা:
كَانَ ﷺ عَالِماً بِالْقُرْآنِ بِتَمَامِهِ وَتَالِيًا لَهُ مِنْ حِيْنِ وَلاَدَتِهِ
‘‘তিনি জন্মলগ্ন থেকেই পুরো কুরআন জানতেন এবং পাঠ করতেন।’’[1]
এ কথা শুধু মিথ্যাই নয়, কুরআন কারীমের বিভিন্ন আয়াতের সুস্পষ্ট বিরোধী। আল্লাহ বলেন: ‘‘আপনি তো জানতেন না যে, কিতাব কি এবং ঈমান কি...’’[2] অন্যত্র বলেন: ‘‘আপনি আশা করেন নি যে, আপনার প্রতি কিতাব অবতীর্ণ হবে। এ তো কেবল আপনার প্রতিপালকের অনুগ্রহ।’’[3]
[2] সূরা (৪২) শূরা: ৫২ আয়াত।
[3] সূরা (২৮) কাসাস: ৮৬ আয়াত।
আব্দুল হাই লাখনবী বলেন: ওয়ায়িজদের মিথ্যাচারের একটি নমুনা:
لَمْ يَكُنْ ﷺ أُمِّيًّا بَلْ كَانَ قَادِراً عَلَى الْكِتَابَةِ وَالتِّلاَوَةِ مِنِ ابْتِدَاءِ الْفِطْرَةِ
‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) উম্মী বা নিরক্ষর ছিলেন না। তিনি প্রকৃতিগতভাবে শুরু থেকেই লিখতে ও পড়তে সক্ষম ছিলেন।’’
এ কথাটিও ভিত্তিহীন মিথ্যা এবং তা কুরআনের সুস্পষ্ট বিরোধী। আল্লাহ বলেন: ‘‘আপনি তো এর পূর্বে কোনো পুস্তক পাঠ করেন নি এবং নিজ হাতে কোনো পুস্তক লিখেন নি যে, মিথ্যাচারীরা সন্দেহ পোষণ করবে।’’[1]
এ ধরনের বানোয়াট কথগুলোর একটি:
لَوْلاَكَ لَمَا خَلَقْتُ الأَفْلاَكَ
‘‘আপনি না হলে আমি আসমান যমিন বা মহাবিশ্ব সৃষ্টি করতাম না।’’
আল্লামা সাগানী, মোল্লা আলী কারী, আব্দুল হাই লাখনবী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস একবাক্যে কথাটিকে ভিত্তিহীন বলে উল্লেখ করেছেন। কারণ এ শব্দে এ বাক্য কোনো হাদীসের গ্রন্থে কোনো প্রকার সনদে বর্ণিত হয় নি।[1]
এখানে উল্লেখ্য যে, এ শব্দে নয়, তবে এ অর্থে দুর্বল বা মাওযূ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। এখানে কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করছি।
উমার (রা)-এর সূত্রে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ বলেন,
لَمَّا اقْتَرَفَ آَدَمُ الْخَطِيْئَةَ قَالَ: يَا رَبِّ، أَسْأَلُكَ بِحَقِّ مُحَمَّدٍ لَمَّا غَفَرْتَ لِيْ. فَقَالَ اللهُ: يَا آَدَمُ، وَكَيْفَ عَرَفْتَ مُحَمَّداً وَلَمْ أَخْلُقْهُ؟ قَالَ: يَا رَبِّ، لأَنَّكَ لَمَّا خَلَقْتَنِيْ بِيَدِكَ وَنَفَخْتَ فِيَّ مِنْ رُوْحِكَ رَفَعْتُ رَأْسِيْ فَرَأَيْتُ عَلَى قَوَائِمِ الْعَرْشِ مَكْتُوْباً لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ مُحَمَّدٌ رَسُوْلُ اللهِ فَعَلِمْتُ أَنَّكَ لَمْ تُضِفْ إِلَى اسْمِكَ إِلاَّ أَحَبَّ الْخَلْقِ إِلَيْكَ. فَقَالَ اللهُ: صَدَقْتَ يَا آَدَمُ، إِنَّهُ لأحَبُّ الْخَلْقِ إِلَيَّ، ادْعُنِيْ بِحَقِّهِ فَقَدْ غَفَرْتُ لَكَ، وَلَوْلاَ مُحَمَّدٌ مَا خَلَقْتُكَ.
‘‘আদম (আঃ) যখন (নিষিদ্ধ গাছের ফল খেয়ে) ভুল করে ফেলেন, তখন তিনি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে বলেন: হে প্রভু, আমি মুহাম্মাদের হক্ক (অধিকার) দিয়ে আপনার কাছে প্রার্থনা করছি যে আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। তখন আল্লাহ বলেন, হে আদম, তুমি কিভাবে মুহাম্মাদকে (ﷺ) চিনলে, আমি তো এখনো তাঁকে সৃষ্টিই করি নি? তিনি বলেন, হে প্রভু, আপনি যখন নিজ হাতে আমাকে সৃষ্টি করেন এবং আমার মধ্যে আপনার রূহ ফুঁ দিয়ে প্রবেশ করান, তখন আমি মাথা তুলে দেখলাম আরশের খুঁটি সমূহের উপর লিখা রয়েছে: ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’। এতে আমি জানতে পারলাম যে, আপনার সবচেয়ে প্রিয় সৃষ্টি বলেই আপনি আপনার নামের সাথে তাঁর নামকে সংযুক্ত করেছেন। তখন আল্লাহ বলেন, হে আদম, তুমি ঠিকই বলেছ। তিনিই আমার সবচেয়ে প্রিয় সৃষ্টি। তুমি আমার কাছে তার হক্ক (অধিকার) দিয়ে চাও, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম। মুহাম্মাদ ﷺ না হলে আমি তোমাকে সৃষ্টি করতাম না।’’[1]
ইমাম হাকিম নাইসাপূরী হাদীসটি সংকলিত করে একে সহীহ বলেছেন। কিন্তু সকল মুহাদ্দিস একমত যে হাদীসটি যয়ীফ। তবে মাউযূ কিনা তাতে তাঁরা মতভেদ করেছেন। ইমাম হাকিম নিজেই অন্যত্র এ হাদীসের বর্ণনাকারীকে মিথ্যা হাদীস বর্ণনাকারী বলে উল্লেখ করেছেন। আমরা দেখেছি যে, হাকিম অনেক যয়ীফ ও মাউযূ হাদীসকে সহীহ বলেছেন এবং ইবনুল জাওযী অনেক সহীহ বা হাসান হাদীসকে মাউযূ বলেছেন। এজন্য তাদের একক মতামত মুহাদ্দিসগণের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়, বরং তাঁদের মতামত তাঁরা পুনর্বিচার ও নিরীক্ষা করেছেন।
এ হাদীসটির সনদের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে সনদটি খুবই দুর্বল, যে কারণে অনেক মুহাদ্দিস একে মাউযূ হাদীস বলে গণ্য করেছেন। হাদীসটির একটিই সনদ: আবুল হারিস আব্দুল্লাহ ইবনু মুসলিম আল-ফিহরী নামক এক ব্যক্তি দাবী করেন, ইসমাঈল ইবনু মাসলামা নামক একব্যক্তি তাকে বলেছেন, আব্দুর রাহমান ইবনু যাইদ ইবনু আসলাম তার পিতা, তার দাদা থেকে উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন।
বর্ণনাকারী আবুল হারিস একজন অত্যন্ত দুর্বল রাবী। এছাড়া আব্দুর রাহমান ইবনু যাইদ ইবনু আসলাম (১৮২ হি) খুবই দুর্বল ও অনির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারী ছিলেন। মুহাদ্দিসগণ তাঁর বর্ণিত হাদীস গ্রহণ করেন নি। কারণ তিনি কোনো হাদীস ঠিকমত বলতে পারতেন না, সব উল্টোপাল্টা বর্ণনা করতেন। ইমাম হাকিম নিজেই তার ‘মাদখাল ইলাস সহীহ’ গ্রন্থে বলেছেন:
عبد الرحمن بن زيد بن أسلم روى عن أبيه أحاديث موضوعة لا يخفى على من تأملها من أهل الصنعة أن الحمل فيها عليه
‘‘আব্দুর রাহমান ইবনু যাইদ ইবনু আসলাম তার পিতার সূত্রে কিছু মাউযূ বা জাল হাদীস বর্ণনা করেছেন। হাদীস শাস্ত্রে যাদের অভিজ্ঞতা আছে, তারা একটু চিন্তা করলেই বুঝবেন যে, এ সকল হাদীসের জালিয়াতির অভিযোগ আব্দুর রাহমানের উপরেই বর্তায়।’’[2]
এ হাদীসটি উমার (রা) থেকে অন্য কোন তাবিয়ী বলেন নি, আসলাম থেকেও তাঁর কোন ছাত্র তা বর্ণনা করেন নি। যাইদ ইবনু আসলাম প্রসিদ্ধ আলিম ছিলেন। তাঁর অনেক ছাত্র ছিল। তাঁর কোন ছাত্র এ হাদীসটি বর্ণনা করেন নি। শুধুমাত্র আব্দুর রহমান দাবী করেছেন যে তিনি এ হাদীসটি তাঁর পিতার কাছে শুনেছেন। তাঁর বর্ণিত সকল হাদীসের তুলনামূলক নিরীক্ষা করে ইমামগণ দেখেছেন তাঁর বর্ণিত অনেক হাদীসই ভিত্তিহীন ও মিথ্যা পর্যায়ের। এজন্য ইমাম যাহাবী, ইবনু হাজার ও অন্যান্য মুহাদ্দিস হাদীসটিকে মাউযূ বলে চিহ্নিত করেছেন। ইমাম বাইহাকী হাদীসটি অত্যন্ত দুর্বল বলে মন্তব্য করেছেন। কোনো কোনো মুহাদ্দিস বলেছেন যে, এ কথাটি মূলত ইহূদী-খৃস্টানদের মধ্যে প্রচলিত শেষ নবী বিষয়ক কথা; যা কোনো কোনো সাহাবী বলেছেন। অন্য একটি দুর্বল সনদে এ কথাটি উমার (রা) এর নিজের কথা হিসাবে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু আব্দুর রহমান অন্যান্য অনেক হাদীসের মত এ হাদীসেও সাহাবীর কথাকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর কথা হিসাবে বর্ণনা করেছেন।[3]
এ মর্মে আরেকটি যয়ীফ হাদীস আব্দুল্লাহ ইবনু আববাসের কথা হিসাবে হাকিম সংকলন করেছেন। তিনি জানদাল ইবনু ওয়ালিক এর সূত্রে বলেন, তাকে আমর্ ইবনু আউস আনসারী নামক দ্বিতীয় শতকের এক ব্যক্তি বলেছেন, তাকে তাবি-তাবিয়ী সাঈদ ইবনু আবূ আরূবাহ (১৫৭ হি) বলেছেন, তাকে তাবিয়ী কাতাদা ইবনু দিআমাহ আস-সাদূসী (১১৫ হি) বলেছেন, তাকে তাবিয়ী সাঈদ ইবনুল মুসাইয়াব (৯১হি) বলেছেন, তাকে ইবনু আববাস (রা) বলেছেন:
أَوْحَى اللهُ إِلَى عِيْسَى يَا عِيْسَى آَمِنْ بِمُحَمَّدٍ وَأْمُرْ مَنْ أَدْرَكَهُ مِنْ أُمَّتِكَ أَنْ يُؤْمِنُوْا بِهِ فَلَوْلاَ مُحَمَّدٌ مَا خَلَقْتُ آَدَمَ وَلَوْلاَ مُحَمَّدٌ مَا خَلَقْتُ الْجَنَّةَ وَلاَ النَّارَ وَلَقَدْ خَلَقْتُ الْعَرْشَ عَلَى الْمَاءِ فَاضْطَرَبَ فَكَتَبْتُ عَلَيْهِ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ مُحَمَّدٌ رَسُوْلُ اللهِ فَسَكَنَ.
‘‘মহান আল্লাহ ঈসা (আঃ)-এর প্রতি ওহী প্রেরণ করে বলেন, তুমি মুহাম্মাদের উপরে ঈমান আনয়ন কর এবং তোমার উম্মাতের যারা তাঁকে পাবে তাদেরকে তাঁর প্রতি ঈমান আনয়নের নির্দেশ প্রদান কর। মুহাম্মাদ (ﷺ) না হলে আদমকে সৃষ্টি করতাম না। মুহাম্মাদ (ﷺ) না হলে জান্নাত ও জাহান্নামও সৃষ্টি করতাম না। আমি পানির উপরে আরশ সৃষ্টি করেছিলাম। তখন আরশ কাঁপতে শুরু করে। তখন আমি তার উপরে লিখলাম: ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’; ফলে তা শান্ত হয়ে যায়।’’[4]
ইমাম হাকিম হাদীসটি উল্লেখ করে বলেন, হাদীসটির সনদ সহীহ। ইমাম যাহাবী প্রতিবাদ করে বলেন, ‘‘বরং হাদীসটি মাউযূ বলেই প্রতীয়মান হয়।’’ কারণ এর একমাত্র বর্ণনাকারী এ ‘আমর্ ইবনু আউস আল-আনসারী’ নামক ব্যক্তি। সে প্রসিদ্ধ কয়েকজন মুহাদ্দিসের নামে হাদীসটি বর্ণনা করেছে। অথচ তাঁদের অন্য কোনো ছাত্র এ হাদীসটি তাঁদের থেকে বর্ণনা করে নি। এ লোকটি মূলত একজন অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি। তার কোনো পরিচয় পাওয়া যায় না। এ জানদাল ইবনু ওয়ালিক ছাড়া অন্য কোনো রাবী তার নাম বলেন নি বা তার কোনো পরিচয়ও জানা যায় না। এজন্য যাহাবী ও ইবনু হাজার আসকালানী বলেন, এটি ইবনু আববাসের নামে বানানো জাল হাদীস।[5]
এ অর্থে আরো জাল হাদীস মুহাদ্দিসগণ উল্লেখ করেছেন।[6]
[2] হাকিম, আল-মাদখাল, পৃ. ১৫৪; ইবনু আর্রাক, তানযীহুশ শারীয়াহ ১/২৫০; আলবানী, সিলসিলাতুয যায়ীফাহ ১/৯০।
[3] তাবারানী, আল-মুজামুল আউসাত ৬/৩১৩-৩১৪; আল-মু‘জামুস সাগীর ২/১৮২; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ২/৬৭২; ইবন কাসির, তারীখ ২/৩২৩; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৮/২৫৩; আলবানী, সিলসিলাতু যায়ীফাহ ১/৮৮-৯৯; খাল্লাল, আস-সুন্নাহ ১/২৩৭, আজলূনী, কাশফুল খাফা ১/৪৬, ২/২১৪, মোল্লা আলী কারী, আল-আসরার পৃ: ১৯৪, আল-মাসনূ‘য়, পৃ: ১১৬; দাইলামী, আল-ফিরদাউস ৫/২২৭।
[4] হাকিম, আল-মুসতাদরাক ২/৬৭১।
[5] যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ৫/২৯৯; ইবনু হাজার, লিসানুল মীযান ৪/৩৫৪।
[6] যাহাবী, তারতীবু মাউদূ‘আত, পৃ ৭৭; ইবনু আর্রাক, তানযীহুশ শারীয়াহ ১/২৪৪-২৪৫, ৩২৫।
প্রচলিত একটি হাদীসে বলা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:
اِتَّخَذَ اللهُ إِبْرَاهِيْمَ خَلِيْلاً وَمُوْسَى نَجِيًّا وَاتَّخَذَنِيْ حَبِيْباً ثُمَّ قَالَ وَعِزَّتِيْ وَجَلاَلِيْ لأُوْثِرَنَّ حَبِيْبِيْ عَلَى خَلِيْلِيْ وَنَجِيِّيْ
‘‘আল্লাহ ইবরাহীমকে (আঃ) খালীল (অন্তরঙ্গ বন্ধু) হিসাবে গ্রহণ করেছেন, মূসাকে (আঃ) নাজীই (একান্ত আলাপের বন্ধু) হিসাবে গ্রহণ করেছেন এবং আমাকে হাবীব (প্রেমাস্পদ) হিসাবে গ্রহণ করেছেন। অতঃপর আল্লাহ বলেছেন, আমার মর্যাদা ও মহিমার শপথ, আমি আমার হাবীবকে আমার খালীল ও নাজীই-এর উপরে অগ্রাধিকার প্রদান করব।’’
হাদীসটি ইমাম বাইহাকী ‘শু‘আবুল ঈমান’ গ্রন্থে সংকলন করেছেন। তিনি তাঁর সনদে বলেন, দ্বিতীয় হিজরী শতকের রাবী মাসলামা ইবনু আলী আল-খুশানী (১৯০হি) বলেন, আমাকে যাইদ ইবনু ওয়াকি, কাসিম ইবনু মুখাইমিরা থেকে, আবূ হুরাইরা থেকে বলেন...।’’ হাদীসটি উদ্ধৃত করে বাইহাকী বলেন, ‘‘এ ‘মাসলামা ইবনু আলী’ মুহাদ্দিসগণের কাছে দুর্বল।’’[1]
মাসলামা ইবনু আলী নামক এ রাবীকে মুহাদ্দিসগণ অত্যন্ত দুর্বল বলে উল্লেখ করেছেন। আবূ যুর‘আ, বুখারী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস তাকে ‘মুনকার’ বা আপত্তিকর বলেছেন। নাসাঈ, দারাকুতনী প্রমুখ মুহাদ্দিস তাকে ‘মাতরূক’ বা পরিত্যক্ত বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁরা মিথ্যায় অভিযুক্ত রাবীকেই মাতরূক বলেন। হাকিম তাকে জাল হাদীস বর্ণনাকারী বলে উল্লেখ করেছেন।[2] এজন্য অনেক মুহাদ্দিস এ হাদীসটিকে জাল বলে গণ্য করেছেন; কারণ একমাত্র এ পরিত্যক্ত রাবী ছাড়া কেউ এ হাদীসটি বলেন নি। অপরপক্ষে কোনো কোনো মুহাদ্দিস এ হাদীসটিকে ‘দুর্বল’ বলে গণ্য করেছেন।[3]
এর বিপরীতে বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য মুহাদ্দিস সংকলিত সহীহ হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মহান আল্লাহ তাঁর সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- কেও ‘‘খালীল’’ হিসাবে গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেন:
إِنَّ اللهَ تَعَالى قَدْ اتَّخَذَنِيْ خَلِيْلاً كَمَا اتَّخَذَ إبراهيم خليلا
‘‘মহান আল্লাহ আমাকে খালীল (অন্তরঙ্গ বন্ধু) হিসেবে গ্রহণ করেছেন, যেরূপ তিনি ইবরাহীমকে খালীল হিসেবে গ্রহণ করেছেন।’’[4]
[2] নাসাঈ, আদ-দু‘আফা, পৃ. ৯৭; ইবনুল জাওযী, আদ-দু‘আফা ৩/১২০; ইবনু হিববান, আল-মাজরূহীন ৩/৩৩-৩৫; ইবনু হাজার, তাহযীব ১০/১৩২-১৩৩; তাকরীব, পৃ. ৫৩১।
[3] ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূ‘আত ১/২১১-২১৪; সুয়ূতী, আল-লাআলী ১/২৭২; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ১/৩৩৩; দরবেশ হূত, আসনাল মাতালিব,পৃ.১৫-১৬; আলবানী, যায়ীফুল জামি, পৃ. ১৫।
[4] মুসলিম, আস-সহীহ ১/৩৭৭। আরো দেখুন, বুখারী, আস-সহীহ ৩/১৩৩৭।
জালিয়াতদের তৈরী একটি জঘন্য মিথ্যা কথা:
أَنَا خَاتِمُ النَّبِيِّيْنَ، لاَ نَبِيَّ بَعْدِيْ إِلاَّ أَنْ يَشَاءَ اللهُ ...
‘‘আমি শেষ নবী, আমার পরে নবী নেই, তবে আল্লাহ যদি চান।’’
কুরআন কারীমে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে শেষ নবী বলে ঘোষণা করা হয়েছে। সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম সহ সকল হাদীস-গ্রন্থে বিশুদ্ধতম সনদে সংকলিত অসংখ্য সাহাবী থেকে বর্ণিত অগণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন যে, তাঁর পরে কোনো নবী হবে না। তিনিই নবীদের অট্টালিকার সর্বশেষ ইট। তিনিই নবীদের সর্বশেষ। তাঁর মাধ্যমে নবুওতের পরিসমাপ্তি।
কিন্তু এত কিছুর পরেও পথভ্রষ্টদের ষড়যন্ত্র থেমে থাকে নি। মুহাম্মাদ ইবনু সাঈদ নামক দ্বিতীয় হিজরী শতকের এক যিনদীক বলে, তাকে হুমাইদ বলেছেন, তাকে আনাস ইবনু মালিক বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘‘আমি শেষ নবী, আমার পরে নবী নেই, তবে আল্লাহ যদি চান।’’[1]
এ যিনদীক ছাড়া কেউই এ অতিরিক্ত বাক্যটি ‘‘তবে আল্লাহ যদি চান’’ বলেন নি। কোনো হাদীসের গ্রন্থেও এ বাক্যটি পাওয়া যায় না। শুধু এ যিনদীকের জীবনীতে ও মিথ্যা হাদীসের গ্রন্থে মিথ্যাচারের উদাহরণ হিসাবে এ মিথ্যা কথাটি উল্লেখ করা হয়। তা সত্ত্বেও কাদীয়ানী বা অন্যান্য বিভ্রান্ত সম্প্রদায় এ মিথ্যা কথাটি তাদের বিভ্রান্তির প্রমাণ হিসাবে পেশ করতে চায়।
সুপথপ্রাপ্ত মুসলিমের চিহ্ন যে, তাঁর পছন্দ-অপছন্দ ও অভিরুচি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ﷺ-এর কাছে সমর্পিত। এরই নাম ইসলাম। মুসলিম যখন হাদীসের কথা শুনেন তখন তাঁর একটি মাত্র বিবেচ্য: হাদীসটি বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত হয়েছে কিনা। হাদীসের অর্থ তাঁর মতের বিপরীত বা পক্ষে তা নিয়ে তিনি চিন্তা করেন না বরং নিজের মতকে হাদীসের অনুগত করে নেন। আর পথভ্রষ্টদের পরিচয় যে, তারা নিজেদের অভিরুচি অনুসারে কোনো কথাকে গ্রহণ করে। এর বিপরীতে সকল কথা ব্যাখ্যা করে। এরা কোনো কথা শুনলে তার অর্থ নিজের পক্ষে কিনা তা দেখে। এরপর বিভিন্ন বাতুল যুক্তিতর্ক দিয়ে তা সমর্থন করে। কোনো কথা তার মতের বিপক্ষে হলে তা যত সহীহ বা কুরআনের স্পষ্ট নির্দেশই হোক তারা তা বিভিন্ন ব্যাখ্য করে বিকৃত করে।
আরবী ভাষায় ‘নূর’ (نور) শব্দের অর্থ আলো, আলোকচ্ছটা, উজ্জ্বলতা (light, ray of light, brightness) ইত্যাদি। আরবী, বাংলা ও সকল ভাষাতেই নূর, আলো বা লাইট যেমন জড় ‘আলো’ অর্থে ব্যবহৃত হয়, তেমনি আত্মিক, আধ্যাত্মিক ও আদর্শিক আলো বা পথ প্রদর্শকের অর্থেও ব্যবহৃত হয়। এ প্রসঙ্গে আল্লামা কুরতুবী বলেন, ‘‘আরবী ভাষায় নূর ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বা দৃষ্টিগ্রাহ্য আলো বা জ্যোতিকে বলা হয়। অনুরূপভাবে রূপকার্থে সকল সঠিক ও আলোকজ্জ্বল অর্থকে ‘নূর’ বলা হয়। বলা হয়, অমূকের কথার মধ্যে নূর রয়েছে। অমুক ব্যক্তি দেশের নূর, যূগের সূর্য বা যুগের চাঁদ...।’’[1]
নূর মুহাম্মাদী বিষয়টি বর্তমান মুসলিম সমাজে, বিশেষত ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম সমাজে বিতর্ক ও হানাহানির অন্যতম বিষয়। রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে নূরের তৈরি বলে বিশ্বাস করা অনেক দীনদার আলিম ও মুমিনের দৃষ্টিতে ঈমানের অন্যতম শর্ত। যারা তা বিশ্বাস করেন না তাঁদেরকে তাঁরা কাফির বা কাফিরের ন্যায় বিভ্রান্ত ও রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর দুশমন বলে গণ্য করেন। এর বিপরীতে অন্য অনেক আলিম ও দীনদার মুমিন রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে নূরের তৈরি বলে মনে করাকে ভিত্তিহীন বলে গণ্য করেন। বিশেষত, তাঁকে মহান আল্লাহর ‘যাত’ অর্থাৎ সত্ত্বার নূর অথবা সিফাত অর্থাৎ বিশেষণের নূর-এর অংশ বলে বিশ্বাস করাকে তারা শিরক বলে গণ্য করেন। এ বিষয়ক হাদীসগুলি আলোচনার পূর্বে নিম্নের বিষয়গুলির প্রতি সহৃদয় পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি:
(১) ‘রাসূলুল্লাহ ﷺ নূর দ্বারা সৃষ্ট’- এরূপ কোনো কথা কুরআন কারীমে নেই। কুরআনের কোনো কোনো আয়াতে ব্যবহৃত ‘নূর’ শব্দের ব্যাখ্যায় কোনো কোনো মুফাস্সির বলেছেন যে, নূর বলতে মুহাম্মাদ ﷺ- কে বুঝানো হয়েছে। বিষয়টি আমরা বিস্তারিত আলোচনা করব, ইনশা আল্লাহ।
(২) ‘রাসূলুল্লাহ ﷺ নূর দ্বারা সৃষ্ট’- এ অর্থে প্রচলিত কিছু হাদীস আমরা আলোচনা করব। তবে লক্ষণীয় যে, মুসলিম উম্মাহর প্রসিদ্ধ হাদীসগ্রন্থগুলিতে এ বিষয়ে একটি হাদীসও পাওয়া যায় না। সুপ্রসিদ্ধ সিহাহ-সিত্তা, মুসনাদ আবী হানীফা, মুআত্তা মালিক, মুসনাদ শাফিয়ী, মুসনাদ আহমাদ ইত্যাদি প্রসিদ্ধ হাদীসগ্রন্থগুলির মধ্যে এ বিষয়ে কোনো হাদীসই পাওয়া যায় না।
(৩) রাসূলুল্লাহ ﷺ সম্পর্কিত যে কোনো একটি হাদীস অনেক হাদীস গ্রন্থে সংকলিত। বিশেষত ঈমান-আকীদা ও দীনের প্রয়োজনীয় হাদীসগুলো মূলত সকল গ্রন্থেই সংকলিত। এমনকি রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর প্রাকৃতিক কর্ম, পারিবারিক সম্পর্ক বা তাঁর জীবনের অতি সামান্য বিষয়ের একটি হাদীস আমরা সিহাহ-সিত্তা সহ প্রায় সকল গ্রন্থে দেখতে পাই। অথচ নূর মুহাম্মাদী বিষয়ক কোনো হাদীস এ সকল গ্রন্থের একটি গ্রন্থেও পাওয়া যায় না।
(৪) হাদীস সংকলকগণ হাদীস গ্রন্থগুলিতে ঈমান, আকীদা, শারীয়াহ, আহকাম, পরিবার, প্রকৃতি ইত্যাদি সকল বিষয়ের শিরোনাম দিয়ে অধ্যায়, পরিচ্ছেদ ও অনুচ্ছেদ উল্লেখ করেছেন। ‘নূর মুহাম্মাদ’ বিষয়ক একটি অধ্যায়, পরিচ্ছেদ বা অনুচ্ছেদ কোনো হাদীসের গ্রন্থে নেই।
(৫) উম্মাতের ইমাম ও বুজুর্গগণ আকীদা ও ফিকহের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলি তাদের গ্রন্থগুলিতে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু প্রসিদ্ধ তাবিয়ী, তাবি-তাবিয়ী, চার ইমাম-সহ ইসলামের প্রথম অর্ধ-সহস্র বৎসরের মধ্যে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের ইমাম ও বুজুর্গগণ রচিত প্রসিদ্ধ গ্রন্থগুলিতে ‘নূর মুহাম্মাদী’ বিষয়ক কোনো আলোচনা পাওয়া যায় না। শুধু ৪র্থ/৫ম হিজরী শতক থেকে শীয়াগণের গ্রন্থে ‘নূর মুহাম্মাদী’ বিষয়ক বক্তব্য পাওয়া যায়।
(৬) শীয়াগণের মধ্যে প্রকাশিত নূর মুহাম্মাদী বিষয়ক বক্তব্যগুলি ৬ষ্ঠ-৭ম হিজরী শতক থেকে সাধারণ মুসলিম আলিমগণের মধ্যেও প্রচারিত হতে থাকে। পরবর্তী ৫০০ বৎসর এ বিষয়ক হাদীসগুলি ‘ফযীলত’ বিষয়ক আলোচনায় সীমাবদ্ধ থাকে। শীয়াগণ ছাড়া অন্য কেউ একে আকীদার অন্তর্ভূক্ত করেন নি।
(৭) ইমাম আযম আবূ হানীফা-সহ প্রসিদ্ধ চার ইমাম থেকে শুরু করে পরবর্তী প্রায় হাজার বৎসর যাবৎ আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আলিমগণ আকীদা বিষয়ে অগণিত গ্রন্থ রচনা করেছেন। আকীদার খুটিনাটি অতি সামান্য বিষয়ও তারা বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। কিন্তু ‘মুহাম্মাদ ﷺ নূরের তৈরি’ বলে বিশ্বাস করাকে আকীদার বিষয় বলে কেউ উল্লেখ করেন নি।
(৮) কুরআন-হাদীসে বারংবার বলা হয়েছে যে, মানুষ মাটির তৈরি। সৃষ্টির উপাদান বলতে মূলত প্রথম সৃষ্টিকেই বুঝানো হয়। এরপর তার বংশধররেরা বংশ-পরম্পরায় সে উপাদান ধারণ করে। কুরআনে আদম (আঃ)-কে মাটি থেকে সৃষ্টি করার বর্ণনা প্রদান করা হয়েছে। পরবর্তী প্রজন্মের মানুষ জাগতিক প্রক্রিয়ায় জন্মগ্রহণ করে। কাউকেই নতুন করে ‘মাটি’ দিয়ে তৈরি করা হয় না। তবে সকল মানুষকেই মাটির তৈরি বলা হয়। আল্লাহ বলেন:
وَإِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلائِكَةِ إِنِّي خَالِقٌ بَشَرًا مِنْ صَلْصَالٍ مِنْ حَمَإٍ مَسْنُونٍ
‘‘যখন তোমার রবব ফিরিশতাগণকে বললেন, আমি ‘বাশার’ (মানুষ) সৃষ্টি করছি গন্ধযুক্ত কাদার শুস্ক ঠন্ঠনে মাটি হতে।’’[2]
আয়েশা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন:
خُلِقَتِ الْمَلاَئِكَةُ مِنْ نُورٍ وَخُلِقَ الْجَانُّ مِنْ مَارِجٍ مِنْ نَارٍ وَخُلِقَ آدَمُ مِمَّا وُصِفَ لَكُمْ
‘‘ফিরিশতাগণকে নূর থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে, জিনকে সৃষ্টি করা নির্ধুম আগুনের শিখা থেকে, আর আদমকে কী থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে তা তো তোমাদের বলা হয়েছে।’’[3]
অর্থাৎ শুধু ফিরিশতাগণই নুর থেকে সৃষ্ট; কোনো মানুষ বা জিন নয়।
(৯) কুরআন-হাদীসে বারংবার রাসুলুল্লাহ ﷺ-কে ‘বাশার’ বা মানুষ বলা হয়েছে। কুরআন-হাদীসে ‘বাশার’ শব্দ অন্য কোনো অর্থে ব্যবহৃত হয় নি। কুরআন ও হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এবং অন্যান্য নবী-রাসূলের মানুষ হওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বারংবার বলা হয়েছে। কাফিরগণ নবীগণের নুবুওয়াত অস্বীকার করত এ কথা বলে যে, ‘তোমরা আমাদের মতই মানুষ’। এর প্রতিবাদে আল্লাহ বারংবার বলেছেন, হ্যাঁ, নবীগণ তোমাদের মতই মানুষ, তবে তাঁরা আল্লাহর ওহীপ্রাপ্ত মানুষ।[4]
রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর বাশারিয়্যাত বা মানুষ হওয়া সম্পর্কে আল্লাহ বলেন:
قُلْ إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ يُوحَى إِلَيَّ أَنَّمَا إِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ
‘‘বলুন, আমি তোমাদের মত মানুষ মাত্র; আমার কাছে ওহী প্রেরিত হয়েছে যে, তোমাদের মাবুদ এক মাবুদ।’’[5]
অন্যত্র আল্লাহ বলেন:
قُلْ سُبْحَانَ رَبِّي هَلْ كُنْتُ إِلَّا بَشَرًا رَسُولا
‘‘বলুন: সুবহানাল্লাহ! আমি তো একজন মানুষ রাসূল বৈ কিছুই নই।’’[6]
বিভিন্ন হাদীসেও রাসূলুল্লাহ ﷺ বারংবার বলেছেন, আমি মানুষ মাত্র, আমি তোমাদের মতই মানুষ...। কুরআন ও হাদীসের এ সকল বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান যে, মানুষ হিসেবে রাসূলুল্লাহ ﷺ মাটির উপাদান থেকেই সৃষ্ট। এখন প্রশ্ন হলো, এ সকল বক্তব্যের বিপরীতে কুরআন-হাদীসে অন্য কোনো বক্তব্য দ্বারা কি ব্যতিক্রম কিছু প্রমাণিত হয়? আমরা এখানে বিষয়টি আলোচনা করব।
[2] সূরা (১৫): হিজর: ২৮ আয়াত। আরো দেখুন: সূরা (৩৮) সাদ: ৭১ আয়াত।
[3] মুসলিম, আস-সহীহ ৪/২২৯৪, নং ২৯৯৬।
[4] সূরা (১১) হূদ: ২৭; সূরা (১৪) ইবরাহীম: ১০-১১; সূরা (১৭) ইসরা/বানী ইসরাইল: ৯৩-৯৪; সূরা (১৮) কাহাফ: ১১০; সূরা (২১) আম্বিয়া: ৩; সূরা (২৩) মুমিনুন: ২৪, ৩৩-৩৪; সূরা (২৬) শুআরা: ১৫৪; ১৮৬; সূরা (৩৬) ইয়াসীন: ১৫; সূরা (৪১) ফুস্সিলাত: ৬।
[5] সূরা (১৮) কাহাফ: ১১০ আয়াত এবং সূরা (৪১) ফুস্সিলাত: ৬ আয়াত।
[6] সূরা (১৭) ইসরা/বনী ইসরাঈল: ৯৩।
মহান আল্লাহ কুরআন কারীমে নিজেকে ‘নূর’ বলেছেন:
اللهُ نُورُ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ ...
‘‘আল্লাহ আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর নূর (জ্যোতি)..... ’’[1]
ইমাম তাবারী বলেন: ‘আল্লাহ আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর নূর’ একথা বলতে আল্লাহ বুঝাচ্ছেন যে, তিনি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর মধ্যকার সকলের হাদী বা পথ প্রদর্শক। তাঁরই নূরেই তাঁরা সত্যের দিকে সুপথপ্রাপ্ত হয়।... ইবনু আববাস থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন: ‘আল্লাহ আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর নূর’ অর্থ তিনি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর অধিবাসীদের হাদী বা পথ-প্রদর্শক।... আনাস থেকে বর্ণিত, আল্লাহ বলছেন, আমার হেদায়াতই আমার নূর...।’’[2]
আল্লাহ বারবার দ্ব্যার্থহীনভাবে কুরআনকে নূর বলেছেন। তিনি বলেন:
الَّذِينَ يَتَّبِعُونَ الرَّسُولَ النَّبِيَّ الأُمِّيَّ ... فَالَّذِينَ آمَنُوا بِهِ وَعَزَّرُوهُ وَنَصَرُوهُ وَاتَّبَعُوا النُّورَ الَّذِي أُنزِلَ مَعَهُ أُوْلَئِكَ هُمْ الْمُفْلِحُونَ
‘‘যারা অনুসরণ করে বার্তাবাহক এ উম্মী নবীর...যারা তাঁর উপর ঈমান আনে, তাকে সম্মান করে, তাকে সাহায্য করে এবং তাঁর সাথে যে নূর (কুরআন) অবতীর্ণ হয়েছে তার অনুসরণ করে তারাই সফলকাম।’’[3]
অন্যত্র কুরআনকে ‘রূহ’ ও ‘নূর’ বলা হয়েছে:
وَكَذَلِكَ أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ رُوحًا مِنْ أَمْـرِنَا مَا كُنْتَ تَدْرِي مَا الْكِتَابُ وَلا الإِيمَانُ وَلَكِنْ جَعَلْنَاهُ نُورًا نَهْدِي بِهِ مَنْ نَشَاءُ مِنْ عِبَادِنَا
‘‘এভাবে আমি আপনার প্রতি প্রত্যাদেশ করেছি রূহ (আত্মা), আমার নির্দেশ থেকে, আপনি তো জানতেন না যে, কিতাব কি এবং ঈমান কি! কিন্তু আমি একে (এ রূহ বা আল-কুরআনকে) নূর বানিয়ে দিয়েছি, যা দিয়ে আমি আমার বানদাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা পর্থ-নির্দেশ করি...।’’[4]
অন্যত্র মূসা (আঃ) এর উপর অবর্তীণ তাওরাতকেও নূর বলা হয়েছে:
قُلْ مَنْ أَنْزَلَ الْكِتَابَ الَّذِي جَاءَ بِهِ مُوسَى نُورًا وَهُدًى لِلنَّاسِ
‘‘বলুন, তবে কে নাযিল করেছিল মূসার আনীত কিতাব, যা মানুষের জন্য নূর (আলো) ও হেদায়াত (পথ-প্রদর্শন) ছিল।’’[5]
অন্যত্র বলা হয়েছে যে, তাওরাত ও ইনজীলের মধ্যে নূর ছিল:
إِنَّا أَنزَلْنَا التَّوْرَاةَ فِيهَا هُدًى وَنُورٌ...وَآتَيْنَاهُ الْإِنجِيلَ فِيهِ هُدًى وَنُورٌ
‘‘আমি অবতীর্ণ করেছি তাওরাত, যার মধ্যে হেদায়াত ও নূর ... আমি তাকে (ঈসাকে) প্রদান করেছি ইনজীল যার মধ্যে হেদায়াত ও নূর...।[6]
কুরআনে আরো কয়েকটি স্থানে ‘নূর’ বা ‘আল্লাহর নূর’ শব্দ বা বাক্যাংশ ব্যবহৃত। যেমন এক স্থানে বলেছেন:
يُرِيدُونَ لِيُطْفِئُوا نُورَ اللَّهِ بِأَفْوَاهِهِمْ وَاللَّهُ مُتِمُّ نُورِهِ وَلَوْ كَرِهَ الْكَافِرُونَ
‘‘তারা ‘আল্লাহর নূর’ ফুৎকারে নিভিয়ে দিতে চায়; কিন্তু আল্লাহ ‘তাঁর নূর’ পূর্ণ করবেন, যদিও কাফিররা তা অপছন্দ করে।’’[7]
এখানে ‘আল্লাহর নূর’ বলতে কি বুঝানো হয়েছে সে বিষয়ে মুফাস্সিরগণের বিভিন্ন মত রয়েছে। আল্লামা কুরতুবী বলেন: এখানে ‘আল্লাহর নূরের’ ব্যাখ্যায় ৫টি মত রয়েছে: (১) আল্লাহর নূর অর্থ আল-কুরআন, কাফিররা কথার দ্বারা তা বাতিল করতে ও মিথ্যা প্রমাণ করতে চায়। ইবনু আববাস ও ইবনু যাইদ ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। (২) আল্লাহর নূর অর্থ ইসলাম, কাফিররা কথাবার্তার মাধ্যমে তাকে প্রতিরোধ করতে চায়। সুদ্দী এ কথা বলেছেন। (৩) আল্লাহর নূর অর্থ মুহাম্মাদ (ﷺ), কাফিররা অপপ্রচার ও নিন্দাচারের মাধ্যমে তাঁর ধ্বংস চায়। দাহ্হাক এ কথা বলেছেন। (৪) আল্লাহর নূর অর্থ আল্লাহর দলীল-প্রমাণাদি, কাফিররা সেগুলো অস্বীকার করে মিটিয়ে দিতে চায়। ইবনু বাহর এ কথা বলেছেন। (৫) আল্লাহর নূর অর্থ সূর্য। অর্থাৎ ফুৎকারে সূর্যকে নেভানোর চেষ্টা করার মত বাতুল ও অসম্ভব কাজে তারা লিপ্ত। ইবনু ঈসা এ কথা বলেছেন।[8]
كِتَابٌ أَنزَلْنَاهُ إِلَيْكَ لِتُخْرِجَ النَّاسَ مِنْ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ
‘‘এ কিতাব। আমি তা আপনার প্রতি নাযিল করেছি, যাতে আপনি মানব জাতিকে অন্ধকার থেকে আলোতে বের করে আনেন...।’’[9]
এখানে স্বভাবতই অন্ধকার ও আলো বলতে ‘জড়’ কিছু বুঝানো হয় নি। এখানে অন্ধকার বলতে অবিশ্বাসের অন্ধকার এবং আলো বলতে আল-কুরআন অথবা ইসলামকে বুঝানো হয়েছে। অন্যান্য আয়াতেও ‘নূর’ বা ‘আল্লাহর নূর’ বলতে ‘কুরআন’, ‘ইসলাম’ বা ‘মুহাম্মাদ ﷺ’ অর্থ গ্রহণ করেছেন মুফাস্সিরগণ[10]। এ ধরনের একটি আয়াত:
يَا أَهْلَ الْكِتَابِ قَدْ جَاءَكُمْ رَسُولُنَا يُبَيِّنُ لَكُمْ كَثِيرًا مِمَّا كُنْتُمْ تُخْفُونَ مِنَ الْكِتَابِ وَيَعْفُو عَنْ كَثِيرٍ قَدْ جَاءَكُمْ مِنَ اللَّهِ نُورٌ وَكِتَابٌ مُبِينٌ. يَهْدِي بِهِ اللَّهُ مَنِ اتَّبَعَ رِضْوَانَهُ سُبُلَ السَّلامِ وَيُخْرِجُهُمْ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ بِإِذْنِهِ وَيَهْدِيهِمْ إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ.
‘‘হে কিতাবীগণ, আমার রাসূল তোমাদের কাছে এসেছেন, তোমরা কিতাবের যা গোপন করতে তিনি তার অনেক কিছু তোমাদের কাছে প্রকাশ করেন এবং অনেক কিছু উপেক্ষা করেন। তোমাদের কাছে এসেছে আল্লাহর কাছ থেকে এক নূর ও সুস্পষ্ট কিতাব। হেদায়াত করেন আল্লাহ তদ্বারা যে তাঁর সন্তুষ্টির অনুসরণ করে তাকে শান্তির পথে এবং বের করেন তাদেরকে অন্ধকার থেকে নূরের দিকে তাঁর অনুমতিতে এবং হেদায়াত করেন তাদের সঠিক পথে।’’[11]
এ আয়াতে ‘নূর’ বলতে কি বুঝানো হয়েছে সে বিষয়ে মুফাস্সিরগণ মতভেদ করেছেন। কেউ বলেছেন, নূর অর্থ কুরআন, কেউ বলেছেন, ইসলাম, কেউ বলেছেন, মুহাম্মাদ ﷺ। এ তিন ব্যাখ্যার মধ্যে কোনো বৈপরীত্য নেই। সবাই সঠিক পথের আলোক বর্তিকা বা হেদায়াতের নূর বুঝিয়েছেন।[12]
যারা এখানে নূর অর্থ কুরআন বুঝিয়েছেন, তাঁদের যুক্তিগুলি নিম্নরূপ: (১) এ আয়াতের প্রথমে যেহেতু রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর কথা বলা হয়েছে, সেহেতু শেষে ‘নূর’ ও ‘সুস্পষ্ট কিতাব’ বলতে ‘কুরআনকে’ বুঝানো হয়েছে। (২) কুরআনে বিভিন্ন স্থানে কুরআনকে ব্যাখ্যাতীতভাবে ‘নূর’ এবং ‘সুস্পষ্ট কিতাব’ বলা হয়েছে। কাজেই এখানেও দুটি বিশেষণ দ্বারা কুরআনকেই বুঝানো হয়েছে। (৩) দুটি শব্দ দ্বারা একই বিষয় বুঝানো কুরআনের একটি রীতি। যেমন আল্লাহ বলেন: ‘আমি মূসাকে কিতাব ও ফুরকান প্রদান করি’[13]। এখানে কিতাব ও ফুরকান বলতে একই কিতাব ‘তাওরাত’ বুঝানো হয়েছে। অনুরূপভাবে উপরের আয়াতেও ‘নূর’ ও ‘সুস্পষ্ট কিতাব’ বলতে একই কিতাব ‘কুরআন’-কে বুঝানো হয়েছে। (৪) পরের আয়াতে এ দুটি বিষয়ের জন্য এক বচনের সর্বনাম ব্যবহার করে আল্লাহ বলেছেন: ‘হেদায়াত করেন আল্লাহ যদ্বারা’। এ থেকে বুঝা যায় যে, এখানে ‘নূর’ ও ‘সুস্পষ্ট কিতাব’ বলতে একই জিনিস বুঝানো হয়েছে যদ্বারা আল্লাহ যাকে চান হেদায়াত করেন। ‘নূর’ ও ‘সুস্পষ্ট কিতাব’ উভয়কে বুঝাতে ‘‘একবচনের’’ সর্বনাম ব্যবহার নিশ্চিত প্রমাণ যে, এখানে উভয় বিশেষণ দ্বারা একটি বিষয় নির্দেশ করা হয়েছে। (৫) এখানে আল্লাহ বলেছেন: ‘হেদায়াত করেন আল্লাহ যাহা দ্বারা’: কুরআনের পরিভাষায় এ কথাটি রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়; বরং কুরআনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কুরআনে আল্লাহ বলেন নি যে, তিনি মুহাম্মাদ ﷺ-কে দিয়ে কাউকে হেদায়াত করেন; বরং বলেছেন যে, তিনি কুরআন দিয়ে যাকে ইচ্ছা হেদায়াত করেন।[14]
যারা ‘নূর’ অর্থ ইসলাম বলেছেন, তাঁদের বক্তব্য: এ আয়াতে প্রথমে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর কথা এবং শেষে কিতাব বা কুরআনের কথা বলা হয়েছে। কাজেই মাঝে নূর বলতে ইসলামকে বুঝানো স্বাভাবিক। এ ছাড়া কুরআনে অনেক স্থানে ‘নূর’ বলতে ইসলাম বুঝানো হয়েছে। আরবীতে ‘আলো’ বুঝাতে দুটি শব্দ রয়েছে: ‘দিয়া (ضياء) ও নূর (نور)। প্রথম আলোর মধ্যে উত্তাপ রয়েছে, আর দ্বিতীয় আলো স্নিগ্ধতাপূর্ণ আলো। পূর্ববর্তী শরীয়াতগুলোর বিধানের মধ্যে কাঠিন্য ছিল। পক্ষান্তরে ইসলামী শরীয়তের সকল বিধিবিধান সহজ ও জীবনমুখী। এজন্য ইসলামী শরীয়তকে নূর বলা হয়েছে।[15]
যারা এখানে ‘নূর’ অর্থ ‘মুহাম্মাদ (ﷺ) বুঝিয়েছেন, তাঁরা দেখেছেন যে, ‘সুস্পষ্ট কিতাব’ বলতে কুরআনকে বুঝানো হয়েছে। কাজেই ‘নূর’ বলতে মুহাম্মাদ ﷺ-কে বুঝানো সম্ভব। এ বিষয়ে ইমাম তাবারী বলেন:
يَعْنِيْ بِالنُّوْرِ مُحَمَّداً ﷺ الَّذِيْ أَنَارَ اللهُ بِهِ الْحَقَّ وَأَظْهَرَ بِهِ الإِسْلاَمَ وَمَحَقَ بِهِ الشِّرْكَ فَهُوَ نُوْرٌ لِمَنِ اسْتَنَارَ بِهِ يُبَيِّنُ الْحَقَّ وَمِنْ إِنَارَتِهِ الْحَقَّ تَبْيِيْنُهُ لِلْيَهُوْدِ كَثِيْراً مِمَّا كَانُوا يُخْفُوْنَ مِنَ الْكِتَابِ.
‘‘নূর (আলো) বলতে এখানে ‘মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে বুঝানো হয়েছে, যাঁর দ্বারা আল্লাহ হক্ক বা সত্যকে আলোকিত করেছেন, ইসলামকে বিজয়ী করেছেন এবং শির্ককে মিটিয়ে দিয়েছেন। কাজেই যে ব্যক্তি তাঁর দ্বারা আলোকিত হতে চায় তার জন্য তিনি আলো। তিনি হক্ক বা সত্য প্রকাশ করেন। তাঁর হক্ককে আলোকিত করার একটি দিক হলো যে, ইহূদীরা আল্লাহর কিতাবের যে সকল বিষয় গোপন করত তার অনেক কিছু তিনি প্রকাশ করেছেন।’’[16]
এছাড়া কুরআনে রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে ‘নূর-প্রদানকারী প্রদীপ’ বলা হয়েছে:
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ شَاهِدًا وَمُبَشِّرًا وَنَذِيرًا وَدَاعِيًا إِلَى اللَّهِ بِإِذْنِهِ وَسِرَاجًا مُنِيرًا
‘‘হে নবী, আমি আপনাকে পাঠিয়েছি সাক্ষীরূপে এবং সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে, আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাঁর দিকে আহবানকারীরূপে এবং আলোকোজ্জ্বল (নূর-প্রদানকারী) প্রদীপরূপে।’’[17]
এভাবে আমরা দেখলাম যে, কুরআনে সঠিক পথের নির্দেশক হিসেবে কুরআনকে ‘নূর’ বলা হয়েছে। অনুরূপভাবে কোনো কোনো আয়াতে ‘নূর’ শব্দের ব্যাখ্যায় কোনো কোনো মুফাস্সির রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বা ইসলামকে বুঝানো হয়েছে বলে মত প্রকাশ করেছেন। কুরআনের এ সকল বর্ণনা থেকে বুঝা যায় না যে, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ﷺ, কুরআন বা ইসলাম নূরের তৈরী বা নূর থেকে সৃষ্ট। আমরা বুঝতে পারি যে, এখানে কোনো সৃষ্ট, জড় বা মূর্ত নূর বা আলো বুঝানো হয় নি। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ﷺ, ইসলাম ও কুরআন কোনো জাগতিক, ‘জড়’, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বা মূর্ত ‘আলো’ নয়। এ হলো বিমূর্ত, আত্মিক, আদর্শিক ও সত্যের আলোকবর্তিকা, যা মানুষের হৃদয়কে বিভ্রান্তি ও অবিশ্বাসের অন্ধকার থেকে বিশ্বাস, সত্য ও সুপথের আলোয় জ্যোতির্ময় করে।
[2] তাবারী, তাফসীর ১৮/১৩৫। আরো দেখুন, ইবন কাসীর, তাফসীর ৩/২৯০।
[3] সূরা (৭) আ’রাফ: ১৫৭ আয়াত।
[4] সূরা (৪২) শূরা: ৫২ আয়াত।
[5] সূরা (৬) আন্‘আম: ৯১ আয়াত।
[6] সূরা (৫) মায়িদা: ৪৪ ও ৪৬ আয়াত।
[7] সূরা (৬১) সাফ: ৮ আয়াত। পুনশ্চ, সূরা (৯) তাওবা: ৩২ আয়াত।
[8] কুরতুবী, তাফসীর ১৮/৮৫।
[9] সূরা (১৪) ইবরাহীম: ১ আয়াত।
[10] সূরা (২) বাকারা: ২৫৭; সূরা (৪) নিসা: ১৭৪; সূরা (৫) মায়িদা: ১৬; সূরা (৬) আন‘আম: ১২২; সূরা (১৪) ইবরাহীম: ৫; সূরা (৩৩) আহযাব: ৪৩; সূরা (৫৭) হাদীদ: ২৮ আয়াত ...।
[11] সূরা (৫) মায়িদা: ১৫-১৬ আয়াত।
[12] তাবারী, তাফসীর ৬/১৬১; কুরতুবী, তাফসীর ৬/১১৮; ইবনু কাসীর, তাফসীর ২/৩৫।
[13] সূরা (২) বাকারা: ৫৩ আয়াত।
[14] ইবনু কাসীর, তাফসীর ২/৩৫।
[15] ইবনু রাজাব, জামিউল উলূম ওয়াল হিকাম ১/২১৯।
[16] তাবারী, তাফসীর ৬/১৬১।
[17] সূরা (৩৩) আহযাব: ৪৫-৪৬ আয়াত।