রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সীমাহীন ও অতুলনীয় মর্যাদা, ফযীলত, মহত্ব ও গুরুত্ব বর্ণনা করা হয়েছে কুরআন কারীমের অগণিত আয়াতে এবং অগণিত সহীহ হাদীসে। এ সকল আয়াত ও হাদীসের ভাব-গম্ভীর ভাষা, বুদ্ধিবৃত্তিক আবেদন ও আত্মিক অনুপ্রেরণা অনেক মুমিনকে আকৃষ্ট করতে পারে না। এজন্য অধিকাংশ সময়ে আমরা দেখতে পাই যে, এ সকল আয়াত ও সহীহ হাদীস বাদ দিয়ে সাধারণত একেবারে ভিত্তিহীন বা অত্যন্ত দুর্বল হাদীসগুলো আমরা সর্বদা আলোচনা করি, লিখি ও ওয়ায নসীহতে উল্লেখ করি।
আমরা দেখেছি যে, মুসলিম সমাজে প্রচলিত জাল হাদীসের অন্যতম তিনটি ক্ষেত্র: (১) ফাযায়িল বা বিভিন্ন নেক আমলের সাওয়াব বিষয়ক গ্রন্থাদি, (২) পূববর্তী নবীগণ বা কাসাসুল আম্বিয়া জাতীয় গ্রন্থাদি এবং (৩) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জন্ম, জীবনী, মুজিযা বা সীরাতুন্নবী বিষয়ক গ্রন্থাদি। যুগের আবর্তনে ক্রমান্বয়ে এ সকল বিষয়ে জাল ও ভিত্তিহীন কথার প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা ইতোপূর্বে আলোচনা করেছি যে, দশম, একাদশ ও দ্বাদশ হিজরী শতকে সংকলিত সীরাত, দালাইল বা মুজিযা বিষয়ক গ্রন্থাবলিতে অগণিত ভিত্তিহীন ও জাল বর্ণনা স্থান পেয়েছে, যেগুলো পূর্ববর্তী কোনো হাদীসের গ্রন্থ তো দূরের কথা, কোনো সীরাত বা মুজিযা বিষয়ক গ্রন্থেও পাওয়া যায় না।
আল্লামা আবুল কালাম আযাদ তার ‘রাসূলে রহমত’ গ্রন্থে তুলনামূলক আলোচনা ও নিরীক্ষা করে এ জাতীয় কিছু বানোয়াট ও ভিত্তিহীন গল্পের উল্লেখ করেছেন। যেমন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জন্মের পূর্বে আসিয়া (আঃ) ও মরিয়ম (আঃ)-এর শুভাগমন, মাতা আমিনাকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জন্মের সুসংবাদ প্রদান, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর গর্ভধারণের শুরু থেকে জন্মগ্রহণ পর্যন্ত সময়ে হযরত আমিনার কোনোরূপ কষ্টক্লেশ না হওয়া... ইত্যাদি।[1]
কেউ কেউ মনে করেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নামে মিথ্যা দ্বারা আমরা তাঁর মর্যাদা বৃদ্ধি করছি। কত জঘন্য চিন্তা! মনে হয় তাঁর সত্য মর্যাদায় ঘাটতি পড়েছে যে, মিথ্যা দিয়ে তা বাড়াতে হবে!! নাঊযু বিল্লাহ! মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ) সবচেয়ে অসন্তুষ্ট হন মিথ্যায় এবং সবচেয়ে জঘন্য মিথ্য হলো আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর নামে মিথ্যা।
লক্ষণীয় যে, আল্লাহ পূর্ববর্তী নবীগণকে (আঃ) মূর্ত বা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনেক মুজিযা প্রদান করেছিলেন। মুহাম্মাদ ﷺ-কেও তিনি অনেক ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য মুজিযা দিয়েছেন। তবে তাঁর মৌলিক মুজিযা বিমূর্ত বা জ্ঞানবৃত্তিক। ভাষা, সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ের জ্ঞান ও প্রজ্ঞা মানুষকে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর মুজিযা অনুধাবনে সক্ষম করে। অনেক সময় সাধারণ মুর্খ মানুষদের দৃষ্টি আকর্ষণ, অবাক করা ইত্যাদি উদ্দেশ্যে গল্পকার, ওয়ায়িয বা জালিয়াতগণ অনেক মিথ্যা গল্প কাহিনী বানিয়ে হাদীস নামে চালিয়েছেন।
অনেক সময় এ বিষয়ক মিথ্যা হাদীসগুলো চিহ্নিত করাকে অনেকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মর্যাদা ও শানের সাথে বেয়াদবী বলে ভাবতে পারেন। বস্ত্তত তাঁর নামে মিথ্যা বলাই তাঁর সাথে সবচেয়ে বেশি বেয়াদবী ও দুশমনী। যে মিথ্যাকে শয়তানের প্ররোচনায় মিথ্যাবাদী তাঁর মর্যাদার পক্ষে ভাবছে সে মিথ্যা মূলত তাঁর মর্যাদা-হানিকর। মিথ্যার প্রতিরোধ করা, মিথ্যা নির্ণয় করা এবং মিথ্যা থেকে দূরে থাকা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নির্দেশ। এখানে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কেন্দ্রিক কিছু বানোয়াট কথা উল্লেখ করছি।