ইলাহী বিধান ঃ
﴿الَّذِينَ يَأْكُلُونَ الرِّبا لا يَقُومُونَ إِلَّا كَمَا يَقُومُ الَّذِي يَتَخَبَّطُهُ الشَّيْطَانُ مِنَ الْمَسِّ ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ قَالُوا إِنَّمَا الْبَيْعُ مِثْلُ الرِّبا وَأَحَلَّ اللهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبا﴾
অর্থাৎ, যারা সুদ খায় তারা (কিয়ামতের দিন) সেই অবস্থায় উঠবে যে অবস্থা হয় একজন শয়তান (জিন) পাওয়া লোকের। তাদের উক্তরূপ হাশর হওয়ার কারণ এই যে, তারা বলে, ব্যবসা তো সুদের মতই! অথচ আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম।[1]
﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَذَرُوا مَا بَقِيَ مِنَ الرِّبا إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ (278) فَإِنْ لَمْ تَفْعَلُوا فَأْذَنُوا بِحَرْبٍ مِنَ اللهِ وَرَسُولِهِ وَإِنْ تُبْتُمْ فَلَكُمْ رُؤُوسُ أَمْوَالِكُمْ لا تَظْلِمُونَ وَلا تُظْلَمُونَ﴾
অর্থাৎ, হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং (লোকদের নিকট) তোমাদের সুদের যা বকেয়া আছে তা ছেড়ে দাও যদি তোমরা ঈমানদার হও। আর যদি তোমরা এরূপ না কর (সুদ না ছাড়) তবে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের তরফ থেকে যুদ্ধ ঘোষণা কবুল করে নাও। কিন্তু যদি তোমরা তোওবা কর, তবে তোমাদের মূলধন তোমাদেরই। তোমরা কারো উপর অত্যাচার করবে না এবং নিজেরাও অত্যাচারিত হবে না।[2]
নববী বিধান
হযরত জাবের (রাঃ) হতে বর্ণিত, আল্লাহর রসূল (ﷺ) সুদখোর, সুদদাতা, সুদের লেখক এবং তার উপর সাক্ষীদ্বয়কে অভিশাপ করেছেন, আর বলেছেন, ‘‘ওরা সকলেই সমান।’’[3]
[2] (সূরা বাক্বারাহ ২৭৮ ২৭৯ আয়াত)
[3] (মুসলিম ১৫৯৭নং মিশকাত ২৪৪ পৃঃ)
চকচক করলেই সোনা হয় না। সোনা চেনা দায়। সোনা চিনতে কষ্টিপাথর কিনে তাতেও যদি ভেজাল থাকে তাহলে আরো বড় দায়। কুরআন-হাদীসের কষ্টিপাথরে ভুল বুঝ ও ব্যাখ্যার ভেজাল থাকলে সত্যই যে সংকটাবর্তের সৃষ্টি হয় তা ফিৎনা ছাড়া আর কি? ব্যবসা মাত্রেই হালাল নয়। হারাম বস্ত্তর ব্যবসা, হারাম মিশ্রিত বা সন্দিগ্ধ ব্যবসা তথা হারাম উপায়ে ব্যবসা অবশ্যই হারাম। আর যা হারাম তার সহায়তা করাও হারাম।
আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
﴿وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى وَلا تَعَاوَنُوا عَلَى الْأِثْمِ وَالْعُدْوَانِ﴾
অর্থাৎ, তোমরা সৎ ও আল্লাহভীরুতার কাজে একে অন্যের সহায়তা কর এবং পাপ ও অন্যায় কাজে পরস্পরকে সাহায্য করো না। (সূরা মাইদাহ ২ আয়াত) আর আল্লাহর রসূল (ﷺ) যেমন মদখোর ও সূদখোরকে অভিশাপ করেছেন তেমনি অভিশাপ করেছেন তার কোন প্রকার সহায়ককেও।
সুতরাং হারাম ব্যবসায় পুঁজিবিনিয়োগ করাও হারাম। যেহেতু ব্যাংকের ব্যবসা সূদী ব্যবসা; না মানলেও সন্দিগ্ধ ব্যবসা নিশ্চয়ই। ব্যাংক প্রত্যক্ষভাবে শোষণ না করলেও পরোক্ষভাবে করে। সকলের জানতে না করলেও অজানতে করে।
মুশরিকদের নিকট কিছু বৈধ জিনিস ক্রয় করা বা উপঢৌকন গ্রহণ করা বৈধ হলেও তাদের নিকট থেকে হারাম জিনিস যেমন মদ, শুকরের মাংস তাদের যবেহকৃত মাংস প্রভৃতি ক্রয় করা বা উপঢৌকন গ্রহণ করা অবশ্যই হালাল নয়।
স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সন্তষ্টিচিত্তে কেউ যদি অবৈধ মাল বা চুরির মাল দেয়, তবে জেনেশুনে তা গ্রহণ করা কি বৈধ? একদা হযরত আবু বকর (রাঃ) এর এক ক্রীতদাস তার জাহেলিয়াতে ভাগ্যগণনার বাকী থাকা পারিশ্রমিক আদায় পেলে তা থেকে আবু বকর (রাঃ) ভক্ষণ করে ফেললেন এবং পরে জানতে পেরে তিনি সমস্ত খাদ্য বমি করে ফেললেন।[1]
কারণ, নবী (ﷺ) বলেন,
كُلُّ لَحْمٍ نَبَتَ مِنْ سُحْتٍ فَالنَّارُ أَوْلَى بِهِ.
‘‘যে মাংস হারাম খাদ্য দ্বারা তৈরী হয় তার জন্য জাহান্নামই উপযুক্ত।’’ অতএব কেউ খুশী করে দিলেও হারাম বা সন্দিগ্ধ মাল ভক্ষণ না করা প্রত্যেক মুসলিমের কর্তব্য নয় কি? আল্লাহর বাণী ‘‘আর তোমরা পাপ ও অন্যায় কর্মে পরস্পরকে সহায়তা করো না।’’ অতএব এই বাণী মাথায় নিয়ে জেনে শুনে হারাম ব্যবসায়ীকে ঋণ দেওয়া নিশ্চয় বৈধ হবে না। আর বাধ্য হয়ে দিতে হলেও সেই ঋণের টাকায় ব্যবসাকৃত লাভ (?) এর ভাগ নেওয়া বৈধ কি রূপে হতে পারে? তা ছাড়া সাধারণ দান এবং ঋণদানের উপর কিছুর প্রতিদান দেওয়ার মাঝে বড় পার্থক্য আছে। ব্যাংকের দেওয়া সূদ যদি সাধারণ দানের পর্যায়ভুক্ত হয় তাহলে শতশত গরীব-দুঃস্থ, অনাহারে ধূলালুণ্ঠিত পথের ভিখারীদেরকে ব্যাংক কেন তার সেই এহসানী প্রদর্শন ক’রে অনুদান প্রদান করে না? কেন কেবল মাত্র ‘তেলো মাথায় ঢালে তেল আর রুখু মাথায় ভাঙ্গে বেল?’ কেন এ এহসানীর অনুদান কেবলমাত্র তাদেরকেই দেয় যারা তাকে টাকা ঋণ দেয়? পক্ষান্তরে বিদিত যে, এই অনুদানের টাকা আসে সরাসরি শর্তারোপিত সূদভিত্তিক ঋণের কারণেই। আবার যে অনুদান ব্যাংক দেয় তাও কত শোষণ, কত সূদ এবং কত হারাম ব্যবসার লভ্যাংশ (?) থেকেই দেয়, কোন পবিত্র বাপুত্তি মাল থেকে নয়। সুতরাং সে অনুদান যে অনুদান নয়; বরং ‘গরু মেরে জুতো দান’ তা বলাই বাহুল্য।
মুসলমানদের উন্নতির বহু পথ খোলা। নাই বা অবলম্বন করল ঐ অলস অকর্মণ্যদের অসৎ পথ। অবৈধ ও অসৎ অর্থ-ব্যবস্থা প্রণয়ন করে যারা উন্নত নাইবা তাকালো তারা তাদের দিকে?
আল্লাহ যে বলেন,
﴿وَلا تَمُدَّنَ عَيْنَيْكَ إِلَى مَا مَتَّعْنَا بِهِ أَزْوَاجاً مِنْهُمْ زَهْرَةَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا لِنَفْتِنَهُمْ فِيهِ وَرِزْقُ رَبِّكَ خَيْرٌ وَأَبْقَى﴾
‘‘আমি অবিশ্বাসীদের কতককে পরীক্ষা করার জন্য পার্থিব জীবনের সৌন্দর্যস্বরূপ ভোগবিলাসের যে উপকরণ দিয়েছি তার প্রতি তুমি কখনো দৃক্পাত করো না। তোমার প্রতিপালক প্রদত্ত জীবনোপকরণ হল উৎকৃষ্ট ও অধিক স্থায়ী।’’[2]
তাদের নবী (ﷺ) যে বলেন,
الرِّبَا وَإِنْ كَثُرَ فَإِنَّ عَاقِبَتَهُ تَصِيرُ إِلَى قُلٍّ.
‘‘সূদের (উন্নতির) পরিমাণ যত বেশীই হোকনা কেন পরিণামে তা কম হতে বাধ্য।’’ (আহমদ১/৩৯৫, ইবনে মাজাহ ২২৭৯ নং)
তাছাড়া মুসলিমদের প্রধান লক্ষ্য আখেরাত। সুতরাং যে পার্থিব উন্নয়নে আখেরাত বরবাদ হয় তা কি প্রকৃত উন্নতি না অবনতি?
ইসলাম মানুষের সার্বিক কল্যাণের জন্য আল্লাহর এক অনুগ্রহ। তাতে রয়েছে পুঁজিবাদ ও কম্যুনিজামের মধ্যবর্তী এক ভারসাম্যপূর্ণ শাশ্বত অর্থব্যবস্থা। এরই অনুসরণে আছে মানুষের চির মঙ্গল।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
﴿يَا أَيُّهَا النَّاسُ كُلُوا مِمَّا فِي الْأَرْضِ حَلالاً طَيِّباً وَلا تَتَّبِعُوا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُبِينٌ (168) إِنَّمَا يَأْمُرُكُمْ بِالسُّوءِ وَالْفَحْشَاءِ وَأَنْ تَقُولُوا عَلَى اللهِ مَا لا تَعْلَمُونَ﴾
‘‘হে মানবমন্ডলী! পৃথিবীর বুকে যা কিছু বৈধ ও পবিত্র খাদ্যবস্ত্ত রয়েছে তা হতে তোমরা আহার কর এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। কারণ, সে নিঃসন্দেহে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। সে তো কেবল তোমাদেরকে মন্দ ও অশ্লীল কাজের নির্দেশ দেয় এবং সে চায় যে, তোমরা আল্লাহ সম্বন্ধে যা জানো না তা বল।’’[3]
প্রিয় নবী (ﷺ) বলেন, আল্লাহ পবিত্র, তিনি পবিত্র বস্ত্তই গ্রহণ করেন। তিনি মুমিনদেরকে সেই আদেশ করেছেন যে আদেশ করেছেন আমিবয়াগণকে; তিনি বলেছেন,
﴿يَا أَيُّهَا الرُّسُلُ كُلُوا مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَاعْمَلُوا صَالِحاً إِنِّي بِمَا تَعْمَلُونَ عَلِيمٌ﴾
‘‘হে রসূলগণ! তোমরা হালাল খাদ্য ভক্ষণ কর এবং সৎকর্ম কর।’’[4]
আর বলেছেন,
﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُلُوا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ﴾
‘‘হে ঈমানদারগণ! আমি তোমাদেরকে যে রুজী দান করেছি, তা থেকে হালাল বস্ত্ত আহার কর।’’[5]
অতঃপর নবী (ﷺ) এমন লোকের কথা উল্লেখ করে বলেন, যে (ইবাদতের উদ্দেশ্যে) লম্বা সফর করে তার অবস্থা আলুথালু এবং ধূলিমলিন। সে আকাশ দিকে তার হাত দুটিকে তুলে দুআ করে, ‘হে আমার প্রতিপালক! হে আমার প্রভু!--’ অথচ তার আহার্য হারাম, তার পানীয় হারাম তার পরিধেয় বস্ত্র হারাম, তার দেহের রক্ত-মাংস হারাম। সুতরাং তার দুআ আর কিরূপে কখন কবুল হতে পারে?[6]
ব্যাংকের সূদকে যদি সূদ মনে করেন ও বলে থাকেন, তবে আপনার নিকট তো সন্দেহই থাকে না। কিন্তু সন্দেহের মেঘমালা যদি আপনার মনের আকাশে ভিঁড় করে তাহলেই সমস্যা। সূদ না বলে যদি আপনি নিজের তরফ থেকে ‘লভ্যাংশ, অনুদান উপহার, এহসানী’ প্রভৃতি বলেন, অথচ ব্যাংকাররা তথা সারা দুনিয়ার লোকেরা তাকে সূদ বলে ও চেনে তাহলেই ইজতিহাদবাজীর দরজা খোলা যায় এ ব্যাপারে। তবে একথা সত্য যে, হালাল ভাবলেও আপনার মনের মাঝে অবশ্যই একটা ‘কিন্তু’ বা জিজ্ঞাসাচিহ্ন থেকেই যায়। কারণ অধিক সংখ্যক এবং সমস্ত গণ্যমান্য ওলামাগণ সর্বসম্মতভাবে তাকে হারাম বলেন। সুতরাং সন্দেহের মেঘে আপনার চলার পথ অন্ধকার নিশ্চয়ই। অতএব পথ উজ্জ্বল করতে নবী (ﷺ) এর নির্দেশ শুনুনঃ-
إِنَّ الْحَلَالَ بَيِّنٌ وَالْحَرَامَ بَيِّنٌ وَبَيْنَهُمَا مُشْتَبِهَاتٌ لَا يَعْلَمُهَا كَثِيرٌ مِنْ النَّاسِ فَمَنْ اتَّقَى الشُّبُهَاتِ اسْتَبْرَأَ فِيهِ لِدِينِهِ وَعِرْضِهِ وَمَنْ وَاقَعَهَا وَاقَعَ الْحَرَامَ.
‘‘(কুরআন হাদীসে) হালাল কি তা স্পষ্ট এবং হারাম যা তাও স্পষ্ট। কিন্তু এ উভয়ের মাঝে রয়েছে বহু সন্দিগ্ধ বিষয়াদি। যা বহু লোকেই চেনে না। অতএব যে ব্যক্তি ঐ সকল সন্দিগ্ধ বিষয়াদি থেকে বাঁচতে পারে, সে তার দ্বীন ও সম্ভ্রমকেও বাঁচিয়ে নেয়। আর যে ব্যক্তি সন্দিগ্ধ বিষয়াবলীতে আপতিত হয় সে হারামে আপতিত হয়---।’’[7]
دَعْ مَا يَرِيبُكَ إِلَى مَا لاَ يَرِيبُكَ.
‘‘সে জিনিস বর্জন কর যা তোমাকে সন্দেহে ফেলে এবং তা অবলম্বন কর যা তোমাকে সন্দেহে ফেলে না।’’[8]
ব্যাংক সম্বন্ধে আপনার মনে যে বিভ্রান্তি ও সন্দেহের কালো মেঘ ঘনীভূত আছে---আশা করি তা এই পুস্তিকার ঝড়ে উড়ে গিয়ে আপনার হৃদয়গগন স্বচ্ছ হয়ে উঠবে। আর এই আশাতেই অনুবাদের এই পদক্ষেপ। আশা পূর্ণ হলে শ্রম সার্থক হবে।
মূল বইটি উর্দূ ভাষায় লিখিত। লেখক বানারসের সালাফিয়্যাহ ইউনিভার্সিটি থেকে পাস করে বিভিন্ন স্থানে শিক্ষকতা করার পর মদীনা নববিয়্যায় কর্মরত। তিনি আরো কয়েকখানি পুস্তক-প্রণেতা। সরাসরি তাঁরই কথামতে এই পুস্তিকা বাংলায় রূপদান করে বাংলাভাষী ভাইদেরকে উপহার দিতে পেরে আমি আনন্দবোধ করছি। আল্লাহ আমাদের এই নগণ্য খিদমতকে কবুল করে মুসলিম সমাজকে সুপথ প্রদর্শন করুন। আমীন।
দ্বীনের খাদেম
আব্দুল হামীদ আলমাজমাআহ ১২/১২/৯৭
[2] (সূরা ত্বা-হা ১৩১ আয়াত)
[3] (সূরা বাকারাহ ১৬৮-১৬৯ আয়াত)
[4] (সূরা মুমিনূন ৫১ আয়াত)
[5] (সূরা বাক্বারাহ ১৭২ আয়াত)
[6] (মুসলিম, মিশকাত ২৭৬০নং)
[7] (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ২৭৬২নং)
[8] (আহমদ, তিরমিযী, নাসাঈ, দারেমী, মিশকাত ২৭৭৩নং)
إن الحمد لله نحمده ونستعينه ونستغفره ونعوذ بالله من شرور أنفسنا ومن سيئات أعمالنا، من يهده الله فلا مضل له ومن يضلل فلا هادي له، وأشهد أن لا إله إلا الله وحده لا شريك له وأشهد أن محمداً عبده ورسوله، أما بعد :
ইসলাম বিশ্বজনীন ও কালজয়ী ধর্ম। এর আহকাম ও নির্দেশাবলী ন্যায় ও ইনসাফপূর্ণ। ইসলাম শান্তি, সন্ধি ও নিরাপত্তার ধর্ম। ইসলাম ভ্রাতৃত্ববোধ সম্প্রীতি, মিলন, সহানুভূতি ও সমবেদনার ধর্ম। ইসলাম উন্নয়ন ও বদান্যতার ধর্ম। যার আহকাম ও নীতিমালায় রয়েছে সরলতা ও উদারতা।
সঙ্কীর্ণতা, কঠিনতা, জটীলতা ও কষ্ট-সমষ্টির নাম ইসলাম নয়। সভ্যতা ও সংস্কৃতির কোন কোণকেই ইসলাম তার অনুসারীদের বিবেকে অগ্রহণযোগ্য বিবেচনা করে না। বৈধ ব্যবসা-বাণিজ্য এবং অর্থ-বিনিয়োগ করার সঠিক পথে কোন প্রতিবন্ধ সৃষ্টি করে না। নিষেধ করে না শিল্প, কারিগরি ও কৃষিকার্যে উৎকর্ষসাধন ও বিশেষ কৃতিত্ব অর্জনকে বরং ইসলাম তো এই ধরনের কর্মসমূহকে মুসলিম জনগণের সাফল্যের সোপান এবং সুখ ও কল্যাণ লাভের উপকরণরূপে নির্ধারণ করেছে। ইসলাম সৎ ও আমানতদার ব্যবসায়ীকে সুস্পষ্টভাবে উৎসাহদান করে এবং এই শিক্ষা দেয় যে, মানুষের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উপার্জন তাই; যা সে নিজ হাত দ্বারা করে থাকে।[1]
কিন্তু বর্তমান যুগে উপার্জনের বিভিন্ন নিত্য-নতুন পদ্ধতি ও প্রণালী আবিষ্কৃত হয়েছে এবং এরই জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, কোম্পানী, ব্যাংক প্রভৃতি; যে সব প্রতিষ্ঠান আজকের সকল অর্থনৈতিক আইন-কানুনের উপর নিজের কবজা ও অধিকার জমিয়ে বসে আছে। এই সকল প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার লেন-দেন ও তার নিয়ম-নীতি সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করাও আমাদের জন্য জরুরী হয়ে গেছে।
ফকীহগণ বলেন, ﻣﻦ جهل بأهل زمانه فهو جاهل
অর্থাৎ, যে ব্যক্তি তার সমসাময়িক যুগের লোকেদের অবস্থা সম্বন্ধে জ্ঞান রাখে না; অর্থাৎ তার নিজের যুগের লোকেদের জীবন-পদ্ধতি, তাদের সাময়িক পরিস্থিতি ও জীবিকানির্বাহের ধারা তথা তাদের প্রকৃতি ও রুচি সম্বন্ধে যে অবগত নয় সে অজ্ঞ ও জাহেল।[2]
একজন আলেমের জন্য যেমন কুরআন ও সুন্নাহর বিভিন্ন আহকাম জানা জরুরী, ঠিক তেমনিই তার সমসাময়িক কালের আচরিত প্রথা ও ট্রেডিশন এবং সমকালীন মানুষের অবস্থা সম্বন্ধে জ্ঞান লাভও জরুরী। এ ছাড়া শরীয়তের বিভিন্ন মাসলা-মাসায়েলের ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্তে তিনি পেঁŠছতে পারেন না। হানাফী মযহাবের ফকীহগণের মধ্যে এক ফকীহ ইমাম মুহাম্মদ রাহিমাহুল্লাহ ফিক্হী মাসায়েল লিপিবদ্ধ করার সময় নিয়মিত বাজারে গিয়ে ব্যবসায়ীদের নিকট বসতেন, তাদের লেন-দেনের রীতিধারা বুঝতেন এবং মার্কেটে কোন্ ধরনের বাণিজ্য-নীতি প্রচলিত তা লক্ষ্য করতেন। কারণ ঐ শ্রেণীর জ্ঞান লাভ একজন আলেমের জন্য এবং বিশেষ করে একজন মুফতীর জন্য ফরয। যাতে করে ঐ শ্রেণীর কোন সমস্যা বা প্রশ্ন তাঁর নিকট এলে তিনি তার প্রেক্ষাপট সম্বন্ধে দস্ত্তরমত অবগত হন। নচেৎ এ ছাড়া তিনি কোন সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতেই পারেন না। পরন্তু এ কথাও বলা হয়েছে যে, যখন কোন সমাজে কোন অবৈধ কাজ-কারবার শুরু হয়, তখন আলেম ও মুফতীর কর্তব্য কেবল সেই কাজ বা কারবার হারাম ও অবৈধ ফতোয়া দেওয়ার সাথে সাথেই শেষ হয়ে যায় না; বরং ইসলামী আহবায়ক হিসাবে তাঁর জরুরী কর্তব্যের মধ্যে ঐ কাজও শামিল যে, তিনি তা অবৈধ চিহ্নিত করার পরপরই তার বিকল্প বৈধ পদ্ধতি ও কারবার কি; তাও বাতলে দেবেন। এবং সেই বিকল্প ব্যবস্থা যেন হয় আমলের যোগ্য এবং শরীয়তের মোতাবিকও।
ইউসুফ আলাইহিস সালামকে যখন স্বপ্নের বৃত্তান্ত জিজ্ঞাসা করা হল, তখন সাত বছর খরা বা অনাবৃষ্টি আসবে ঐ খবর তো পরে বললেন; কিন্তু তার পূর্বেই তিনি ঐ খরার কবল হতে মুক্তি লাভের উপায় বলে দিলেন; বললেন, ঃ
﴿فَمَا حَصَدْتُمْ فَذَرُوهُ فِي سُنْبُلِهِ إِلاَّ قَلِيلاً مِمَّا تَأْكُلُونَ﴾
অর্থাৎ- তোমরা খেতের যে শস্য সংগ্রহ করবে তার মধ্যে যে সামান্য পরিমাণ তোমরা ভক্ষণ করবে তা ব্যতীত বাকী শস্যকে শীষ সমেত রেখে দেবে। (সূরা ইউসুফ ৪৭ আয়াত)
উক্ত আয়াত হতে এ কথাই বুঝা যায় যে, সৎপথের আহবায়কের জন্য কোন হারাম কাজকে কেবল হারাম চিহ্নিত করে দেওয়াই যথেষ্ট নয়; বরং তার সঙ্গে সাধ্যমত ঐ হারাম কাজ থেকে মুক্তি লাভের বিকল্প পথও বলে দেওয়া আবশ্যক। আর সেই পথ তিনি তখনই বলতে পারেন, যখন তিনি ঐ কাজের প্রকৃতত্ব সম্বন্ধে যথাযথ অবগত হবেন।
উক্ত কথার প্রতি লক্ষ্য রেখে একাজ জরুরী মনে করা হয়েছে যে, নব জীবিকানির্বাহ পদ্ধতি এবং বাণিজ্য সম্পর্কিত সেই সকল জ্ঞাতব্য-বিষয় একত্রে সঞ্চিত হোক যার প্রয়োজনীয়তা অনুরূপ কোন সমস্যার সমাধান দানের সময় একজন আলেমের নিকট দেখা দিতে পারে।
যেহেতু ব্যাংক তথা অন্যান্য অর্থ-বিনিয়োগ সংক্রান্ত সংস্থা ও কোম্পানীর ভিত্তিই পুঁজিপতিত্ব ও সুদের উপর সেহেতু সুদের প্রকৃতত্ব ও মূলতত্ত্ব জেনে নেওয়া জরুরী। উদাহরণ স্বরূপ মনে করুন, এক ব্যক্তি নিজের পকেট থেকে মাত্র ১০লাখ টাকা কোন ব্যবসায় লাগাল। আর ৯০লাখ টাকার লোন নিল ব্যাংক থেকে। এভাবে সে এক কোটি টাকা নিয়ে ব্যবসা করল। ধরে নিন্, ঐ ব্যবসায় তার ৫০ শতাংশ লাভ হল এবং এক কোটি টাকা দেড় কোটি টাকায় পরিণত হল। এবারে এ পুঁজিপতি ৫০ লাখ টাকার লাভ থেকে মাত্র ১৫ লাখ টাকা সূদ হিসাবে ব্যাংককে দেবে। যা থেকে ব্যাংক নিজের লাভ রেখে বড় জোর ১০ অথবা ১২ লাখ টাকা সেই শত শত জনগণের মাঝে বন্টন করবে যাদের আমানত তার নিকট জমা (ডিপোজিট) আছে। যার স্পষ্ট পরিণতি এই যে, উক্ত ব্যবসায় যে সমস্ত শত শত লোকের ৯০ লাখের পুঁজি বিনিয়োগ করা ছিল এবং প্রকৃতপক্ষে যাদের পুঁজির বলে এত পরিমাণ লাভ অর্জন সম্ভব হল, তাদের ভাগে এল মাত্র ১০ অথবা ১২ লাখ টাকা। পক্ষান্তরে যে পুঁজিপতি কেবলমাত্র ১০ লাখ টাকার পুঁজি-বিনিয়োগ করেছিল তার ভাগে এ ব্যবসার লাভ স্বরূপ গেল ৩৫ লাখ টাকা! পরন্তু মজার কথা এই যে, উক্ত ১৫ লাখ টাকা যা ব্যাংককে দেওয়া হয়েছে এবং তার মাধ্যমে যে (১০ বা ১২ লাখ) টাকা জনসাধারণের নিকট পৌঁছেছে সেই টাকাকে পুঁজিপতি নিজের উৎপাদন বাবদ মূল খরচের মধ্যে গণ্য করে; আর যে টাকা অবশেষে তার পকেটে পড়ে না বরং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পকেটে পড়ে। কারণ এ ব্যবসায়ে পুঁজিপতি যে সমস্ত পণ্যদ্রব্য উৎপাদন করেছে তার মূল্য নির্ধারণকালে ব্যাংককে প্রদত্ত সূদের অর্থকেও সে এ মূল্যের মধ্যে শামিল করে। আর এইভাবে বাস্তবপক্ষে তার নিজের পকেট থেকে একটি পয়সাও খরচ হয় না। পক্ষান্তরে যদি তার এ ব্যবসা কোন প্রকার প্রাকৃতিক দুর্যোগ অথবা কোন দুর্ঘটনার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে তার ক্ষতিপূরণ বহন করে বীমা কোম্পানী। আর এ বীমা কোম্পানীতেও সঞ্চিত থাকে হাজার হাজার জনসাধারণের অর্থ; যারা মাসিক বা বাৎসরিক হিসাবে নিজেদের উপার্জিত অর্থের কিছু অংশ সেখানে জমা করে থাকে। অথচ না তাদের কোন বাণিজ্যশালায় আগুন লাগে, আর না-ই তারা কোন দুর্ঘটনাগ্রস্ত হয়। সুতরাং সাধারণতঃ তারা অর্থ জমাই করে যায়, ছাড়ানোর পালা খুব কমই পড়ে।
অপর দিকে এমনও পুঁজিপতি আছে, যার ব্যবসায়ে খুব বড় নোকসান ঘটে গেলে সে ব্যাংক থেকে গৃহীত ঋণ পরিশোধ করতে পারে না। যার ফলে সে ব্যাংকের দেউলিয়া হয়ে যায়। এমত পরিস্থিতিতে এ পুঁজিপতিদের তো খুব কম অঙ্কের টাকাই নষ্ট হয়। কিন্তু পূর্ণ নোকসান সেই অর্থ জমাকর্তাদের হয় যাদের অর্থবলে এ পুঁজিপতিরা ব্যবসা করে থাকে। (কারণ ব্যাংক তখন তাদের জমা রাখা টাকা ফেরৎ দিতেও অসমর্থ হয়।)
মোট কথা সুদের এই নীতির কারণেই জাতির সমস্ত পুঁজিকে কেবল কয়েকটি বড়বড় পুঁজিপতি তাদের নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে। আর এর বিনিময়ে জাতিকে প্রত্যর্পণ করে কিঞ্চিৎ পরিমাণ অংশ। পরন্তু এই কিঞ্চিৎ অংশকেও উৎপাদিত পণ্যদ্রব্যের আসল মূল্য গণ্য করে পুনর্বার সাধারণ বিনিয়োগকারীদের নিকট থেকে ওসুল করে নেয় এবং নিজেদের ঘাটতিও পূরণ করে জনসাধারণের সঞ্চিত অর্থ থেকে। (কারণ জনসাধারণ তাদের নির্ধারিত মূল্যেই উক্ত পণ্যদ্রব্য ক্রয় করতে বাধ্য।) এইভাবে সুদের সমষ্টিগত গতিমুখ এই পরিণতির দিকে থাকে যে, জনসাধারণের সঞ্চয়ের কারবার সংক্রান্ত লাভ অধিকাংশ বড় পুঁজিপতিদের নিকট পৌঁছে এবং জনসাধারণ তদ্বারা যথাসম্ভব কম উপকৃত হয়। অতএব এইভাবেই আর্থিক উচ্ছ্বাসের গতিমুখ সর্বদা পুঁজিপতিদের দিকেই থেকে যায়। এ ধরনের পরিণাম ও ফল দেখার পরেও অনেকে ব্যাংকের সুদকে বৈধ করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। অথচ উচিত ছিল, ব্যাংকের সুদকে বৈধ প্রতিপাদন করার পরিবর্তে খোদ ব্যাংককেই ইসলামিক রূপ দান করা। অর্থাৎ ব্যাংকের নিয়মনীতিকে ইসলামী কানুনের ছাঁচে ঢেলে তার উপর আমল করার চেষ্টা করা হত এবং জগতের মানুষকে এ জানিয়ে দেওয়া যেত যে, ইসলামী নীতির উপর আমল করলে এই এই উপকার সাধন হয়। বিশ্ববাসীকে এই ভরসা দেওয়া যেত যে, ইসলামী কানুনের উপর আমলের মাধ্যমেই মানব-জাতি সুখ-সমৃদ্ধি ও সফলতার পথে ধাবমান হতে পারে। হয়তো ঐ শ্রেণীর মানুষদের প্রচেষ্টা ঠিক এ ব্যক্তির মতই; যে চিনির ডিববার উপরে লিখে রাখে ‘এটা লবণের ডিববা।’ তার উদ্দেশ্য থাকে, যাতে পিঁপড়ের দল ধোঁকা খেয়ে চিনির কথা বুঝতে না পারে। কিন্তু ডিববার উপর পরিবর্তিত নাম দেখে পিঁপড়ে ধোকা খায় না। বরং তারা নিজেদের প্রাকৃতিক ইন্দ্রিয় দ্বারা আসল ব্যাপার জেনে চিনি পর্যন্ত পৌঁছেই যায়। তদনুরূপ আপনি ব্যাংকের সুদের নাম যাই রাখুন না কেন; তার নাম ‘মুনাফা’ রাখুন অথবা ‘বোনাস’ (Bonus) ‘লভ্যাংশ’ রাখুন অথবা ‘অনুগ্রহ’, নাম পরিবর্তনে বস্ত্তর আসলত্ব ও প্রকৃতত্ব পরিবর্তিত হয়ে যায় না। মুমিন নিজের ঈমানী অন্তর্দৃষ্টিতে তাকে সুদই বুঝবে।
শ্রদ্ধেয় পাঠকবৃন্দ! আপনাদের দৃষ্টি সম্মুখে এই পুস্তিকায় ব্যাংকের সুদ হারাম হওয়ার ব্যাপারে প্রামাণিক পর্যালোচনা করা হয়েছে। সর্বাগ্রে কুরআন ও হাদীস থেকে সুদের অবৈধতা বর্ণনা করা হয়েছে। অতঃপর সুদ ও ব্যবসার মধ্যে পার্থক্য এবং প্রাক ইসলামী জাহেলিয়াত যুগের সুদের কথা বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। অতঃপর ইসলাম সুদকে ব্যাহত করার যে পদ্ধতি অবলম্বন করেছে সে পদ্ধতির কথা বড় চিত্তাকর্ষক ভঙ্গিমাতে বর্ণনা করা হয়েছে। এর পরে সুদের চারিত্রিক, সামাজিক, আর্থ-সামাজিক তথা জীবন ও জীবিকা-নির্বাহ সংক্রান্ত বিভিন্ন ক্ষতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
অতঃপর কোম্পানী এবং তার লেন-দেন পদ্ধতি, ব্যাংক ও তার এতিহাসিক পটভূমিকা, ব্যাংকের শ্রেণীভেদ এবং তার বিভিন্ন ফাংশন প্রাঞ্জল ভাষায় উল্লেখ করা হয়েছে। তারপর ব্যাংকের সর্বনাশিতা দেখানো হয়েছে।
অতঃপর ব্যাংকের সুদকে বৈধকারীদের দলীলসমূহকে সমালোচনামূলক বিচার-বিবেচনা করা হয়েছে এবং হৃদয়গ্রাহী ভঙ্গিমায় সে সব দলীলের জওয়াব দেওয়া হয়েছে।
অতঃপর ব্যাংকের সুদ হারাম হওয়ার উপর বিভিন্ন কন্ফারেন্স্ ও ফিক্হ একাডেমিতে সবর্ববাদিসম্মতিক্রমে যে রায় পাস হয়েছে তার সিদ্ধান্ত-নামা এবং এই সিদ্ধান্তের সপক্ষে রায়দাতাদের নামের তালিকা পরিবেশিত হয়েছে ।
মিসরের এক মুফতী উক্ত সুদ বৈধ হওয়ার ব্যাপারে যে ফতোয়া দিয়েছেন, তার প্রতিবাদে আযহার ইউনিভার্সিটির উলামায়ে কেরামের একটি টিম মক্কা মুকার্রামায় একটি ইলমী বিবৃতি প্রকাশ ও প্রচার করেন, সেই বিবৃতিপত্রে স্বাক্ষরকারীদের নাম তাঁদের স্বাক্ষর-সহ দেখানো হয়েছে। পরিশেষে ব্যাংকের বিকল্প ব্যবস্থার একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র পেশ করা হয়েছে। অতঃপর আলোচিত হয়েছে বীমার কথা। বীমার বিভিন্ন শ্রেণীসমূহের মধ্য হতে ‘সোশল ও মিউচিউল ইনস্যুরেন্স’ এর বৈধতার উপর মক্কায় যে সর্ববাদিসম্মত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল তার খসড়া পেশ করা হয়েছে; যাতে স্বাক্ষরকারী উলামাদের নামও উল্লেখ করা হয়েছে। উক্ত উলামাবৃন্দ সকল ধরনের ‘কমার্সিয়াল ইনশ্যুরেন্স’কে হারাম ঘোষণা করেছেন।
আর সবশেষে উল্লেখ করা হয়েছে বীমার বিকল্প ব্যবস্থাও।
অনুরূপ বিভিন্ন আলোচনার সাথে পুস্তিকাটি এখন আপনার হাতে। এই পুস্তিকার মূল উদ্দেশ্য হল, ব্যাংকের সুদের ব্যাপারে ইসলামী দৃষ্টিকোণের বিশদ ব্যাখ্যা; কারো সমালোচনা করা নয়। (ব্যাংকের সুদ বৈধকারীদের) বিভিন্ন দলীলসমূহকে বিচার-বিবেচনা করতে গিয়ে যদি কোন ব্যক্তিত্বের সমালোচনা এসে পড়েছে, তবে তা ঠিক সেই পর্যায়ের; যেমন আল্লামা ইবনুল কাইয়েম রাহিমাহুল্লাহ শাইখুল ইসলাম ইসমাঈল আল- হারাবী রাহিমাহুল্লাহ প্রসঙ্গে বলেছিলেন,
شيخ الإسلام حبيب إلينا، ولكن الحق أحب إلينا منه.
অর্থাৎ, শায়খুল ইসলাম আমাদের প্রিয় পাত্র; কিন্তু আমাদের নিকট ‘হক’ হল তাঁর চেয়েও অধিক প্রিয়।
এর সাথে সাথে আমি সেই বন্ধু ও সঙ্গীদের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি যাঁরা এই পুস্তিকার পান্ডুলিপি প্রস্ত্তত করার সময় বিভিন্ন প্রকার পরামর্শ দিয়ে, বিভিন্ন বই-পুস্তক সংগ্রহ করে, হাওয়ালাসহ হাদীস উদ্ধৃত করে অথবা অন্য কোন প্রকার প্রয়োজনে আমার সহায়তা করেছেন।
আল্লাহ তাআলার নিকট প্রার্থনা করি যে, তিনি আমাকে হক কথা বলতে, লিখতে এবং হক কথার তবলীগ ও প্রচার করতে তওফীক ও প্রেরণা দিন।
এই নগণ্য আমল ও কর্মকে তাঁর সন্তুষ্টি ও প্রসন্নতার অসীলা বানিয়ে নিন, এই পুস্তিকা দ্বারা মুসলিম জনগণকে উপকৃত করুন এবং তাদের জন্য হেদায়েতের অসীলা করুন, আর যাদের জীবন ভুল পথে পরিচালিত---বিশেষ করে ব্যাংকের সুদের ব্যাপারে যারা ভুল রাস্তা অবলম্বন করেছে তাদেরকে সরল পথের দিকে ফিরে আসার তওফীক দান করুন। আমীন।
এই পুস্তিকা পাঠ করার পর যদি একটি মুসলিম ভাইও ব্যাংকের সুদ খাওয়া থেকে তওবা করার তওফীক লাভ করেন তাহলে আমরা জানব যে, আমাদের শ্রম সার্থক হয়েছে। আর প্রকৃত হেদায়েতের মালিক আল্লাহ।
তিনিই প্রার্থনা শ্রবণ ও মঞ্জুরকারী।
يا مقلب القلوب ثبت قلوبا على دينك، وصل اللهم وسلم وبارك على نبيك محمد وعلى آله وصحبه أجمعين، يا رب العالمين.
ইসলাম ও মুসলিমদের খাদেম
মুশ্তাক আহমদ কারীমী
মদীনা ত্বাইয়্যিবা, সউদী আরব
তারীখ ২৩/৩/ ১৯৯৭ ঈসায়ী
রবিবার ১৪/১১/১৪১৭হিঃ
[2] (শরহে উকূদি রসমিল মুফতী ৯৮ পৃঃ)
আল্লাহ তাআলা সুদকে সর্বতোভাবে কঠোররূপে হারাম গণ্য করেছেন এবং সুদখোরদের বিরুদ্ধে তিনি ও তাঁর রসূলের তরফ থেকে যুদ্ধ ঘোষণা করে মানবজাতিকে ভীতিপ্রদর্শন করেছেন।
তিনি বলেন:
﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَذَرُوا مَا بَقِيَ مِنَ الرِّبا إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ (278) فَإِنْ لَمْ تَفْعَلُوا فَأْذَنُوا بِحَرْبٍ مِنَ اللهِ وَرَسُولِهِ وَإِنْ تُبْتُمْ فَلَكُمْ رُؤُوسُ أَمْوَالِكُمْ لا تَظْلِمُونَ وَلا تُظْلَمُونَ﴾
অর্থাৎ, হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং (লোকদের নিকট) তোমাদের সুদের যা বকেয়া আছে, তা ছেড়ে দাও--- যদি তোমরা ঈমানদার হও। আর যদি তোমরা এরূপ না কর (সুদ না ছাড়) তবে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের তরফ থেকে যুদ্ধ ঘোষণা কবুল করে নাও। কিন্তু যদি তোমরা তওবা কর, তবে তোমাদের মূলধন তোমাদেরই। তোমরা কারো উপর অত্যাচার করবে না এবং নিজেরাও অত্যাচারিত হবে না।[1]
আবু হুরাইরা রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত; নবী করীম (ﷺ) বলেছেন,
الربا سبعون جزءا أيسرها أن ينكح الرجل أمه.
‘‘সুদ (পাপের দিক থেকে) ৭০ প্রকার। এর মধ্যে সবচেয়ে ছোট (পাপের) সুদ হল মায়ের সঙ্গে ব্যভিচার করা! (অর্থাৎ সুদ খাওয়ার গোনাহ মায়ের সাথে ব্যভিচার করার চেয়ে ৭০ গুণ বেশী।)[2]
ফিরিশতার হাতে গোসল লাভকারী সাহাবী হানযালার পুত্র আব্দুল্লাহ হতে বর্ণিত, নবী (ﷺ) বলেছেন,
درهم ربا يأكله الرجل وهو يعلم أشد عند الله من ستة وثلاثين زنية.
অর্থাৎ জেনে শুনে এক দিরহাম পরিমাণ সুদ খাওয়ার গোনাহ আল্লাহর নিকট ৩৬ বার ব্যভিচার করার চেয়েও বড়।[3]
[2] (ইবনে মাজাহ ২২৭৪ নং, হাকেম ২/৩৭, মিশকাত ২৪৬ পৃঃ)
[3] (মুসনাদে আহমদ ৫/২২৫, দারাকুত্বনী ২৯৫ নং, সিলসিলাহ সহীহাহ ১০৩৩ নং, মিশকাত ২৪৬ পৃঃ)
আল্লাহ তাআলা বলেন:
﴿الَّذِينَ يَأْكُلُونَ الرِّبا لا يَقُومُونَ إِلَّا كَمَا يَقُومُ الَّذِي يَتَخَبَّطُهُ الشَّيْطَانُ مِنَ الْمَسِّ ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ قَالُوا إِنَّمَا الْبَيْعُ مِثْلُ الرِّبا وَأَحَلَّ اللَّهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا﴾
অর্থাৎ, যারা সুদ খায় তারা (কিয়ামতের দিন) সেই অবস্থায় উঠবে যে অবস্থা হয় একজন শয়তান (জিবন) পাওয়া লোকের। তাদের উক্তরূপ হাশর হওয়ার কারণ এই যে, তারা বলে, ব্যবসা তো সুদের মতই! অথচ আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম। (সূরা বাক্বারাহ ২৭৫ আয়াত)
হযরত জাবের রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত,
لَعَنَ رَسُولُ اللهِ ﷺ آكل الربا وموكله وكاتبه وشاهديه، وقال : هم سواء.
অর্থাৎ, আল্লাহর রসূল (ﷺ) সুদখোর, সুদদাতা, সুদের লেখক এবং তার উপর সাক্ষীদ্বয়কে অভিশাপ করেছেন, আর বলেছেন, ‘‘ওরা সকলেই সমান।’’ (মুসলিম ১৫৯৭নং মিশকাত ২৪৪ পৃঃ)
প্রিয় ভাই মুসলিম!
এবার চিন্তার বিষয় এই যে, সেটা কি এমন জিনিস যার ব্যাপারে এত বড় ধমক ও তিরস্কার শুনানো হয়েছে। তার প্রকৃতত্ব কি? তা কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে ও জিনিসে হয়ে থাকে? তা এবং ব্যবসার মধ্যে পার্থক্য কি? জাহেলিয়াতের যুগে কি কি প্রকার সুদী কারবার হত; যা কুরআন ও সুন্নাহতে নিষিদ্ধ হয়েছে? এ সকল বিষয়ে অবগত হওয়া একান্ত জরুরী; যাতে মুসলিম সে সব থেকে দূরে থাকতে পারে।
কুরআন ও হাদীসের পরিভাষায় সুদকে (ربا) ‘রিবা’ বলা হয়। এই শব্দের মূল ধাতু হল (ر ب و ) যার আভিধানিক অর্থ হল, বাড়, বৃদ্ধি, আধিক্য, স্ফীতি প্রভৃতি। رَبَاঅর্থাৎ বেড়েছে বা বৃদ্ধি পেয়েছে। ربا السويق অর্থাৎ ছাতু ঘোলার পর ফেঁপে উঠেছে। ربا في حجره অর্থাৎ সে তার কোলে প্রতিপালিত (বড়) হয়েছে। أربى الشيء সে জিনিসটাকে বাড়িয়েছে ইত্যাদি অর্থ অভিধানে উল্লেখ করা হয়েছে।
কুরআন মাজীদেও উক্ত শব্দ ‘বৃদ্ধি’র অর্থে ব্যবহূত হয়েছে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন:
﴿يَمْحَقُ اللهُ الرِّبا وَيُرْبِي الصَّدَقَاتِ﴾
অর্থাৎ, আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং সদকাহকে বৃদ্ধি দেন।[1]
শরীয়তের ফিক্হবিদ্দের পরিভাষায় সুদের সংজ্ঞা হল,
هو زيادة أحد البدلين المتجانسين من غير أن يقابل هذه الزيادة عوض.
অর্থাৎ, একই শ্রেণীভুক্ত দুটি জিনিসের পরস্পর আদান-প্রদান করার সময় একজনের অপরজনের নিকট এমন বেশী নেওয়া যাতে এ বেশী অংশের বিনিময়ে কোন জিনিস থাকে না। (আল বুনূকুল ইসলামিয়্যাহ বাইনান নাযারিয়্যাতি অত্তাত্ববীক্ব ৪৪ পৃঃ)
ফতোয়া আলামগীরীতে সুদের নিম্নরূপ সংজ্ঞা করা হয়েছে;
الربا عبارة عن فضل مال لا يقابله عوض في معاوضة ما بمال.
অর্থাৎ, এক মালের বদলে অন্য মালের আদান-প্রদানকালে সেই অতিরিক্ত (নেওয়া) মালকে সূদ বলা হয়; যার কোন বিনিমেয় থাকে না।
হেদায়াতে সুদের সংজ্ঞা এইভাবে করা হয়েছে;
الربا هو الفض المستحق لأحد المتعاقدين في المعاوضة الخالي من عوض شرط فيه
অর্থাৎ, লেন-দেন করার সময় সেই অতিরিক্ত মালকে সুদ বলা হয়; যা কোন একপক্ষ শর্ত অনুসারে কোন বিনিময় ছাড়াই লাভ করে থাকে।
বুঝা এই গেল যে, মূল থেকে যে পরিমাণ অংশ বেশী নেওয়া বা দেওয়া হবে সেটাকেই সুদ বলা হবে। সুতরাং সুদের সংজ্ঞা হল এইরূপ; ‘‘ঋণে দেওয়া মূল অর্থের চেয়ে সময়ের বিনিময়ে যে অতিরিক্ত অর্থ শর্ত ও নির্দিষ্টরূপে নেওয়া হয় তার নাম হল সুদ।’’
মূল অর্থ থেকে কিছু বৃদ্ধি, সময়ের দৈর্ঘ্য অনুসারে বৃদ্ধির পরিমাণ নির্ধারণ এবং এই লেন-দেনে বৃদ্ধি শর্ত হওয়া---এই তিন উপাদানে গঠিত বস্ত্তর নাম সুদ হবে। আর প্রত্যেক সেই ঋণের আদান-প্রদান যার মধ্যে উক্ত তিন প্রকার উপাদান পাওয়া যাবে তাকে সুদী আদান-প্রদান বা কারবার বলা হবে। এখানে দেখার বিষয় এ নয় যে, সে ঋণ ব্যবসার জন্য নেওয়া হয়েছে অথবা ব্যক্তিগত প্রয়োজন বা অভাব পূরণ করার উদ্দেশ্যে নেওয়া হয়েছে। এবং সেই ঋণ-গ্রহীতা ব্যক্তি গরীব নাকি ধনী, কোম্পানী নাকি সরকার। সে যাই হোক না কেন অনুরূপ ঋণের কারবার সুদের কারবার।
এবারে আসুন, আমরা দেখি, জাহেলিয়াতের সুদ কেমন ছিল; যে সুদের অবৈধতার উপর কুরআনের আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে এবং যে ব্যাপারে নবী (ﷺ) এর রয়েছে কঠোর নিষেধাজ্ঞা।
জাহেলিয়াতের যুগে কারবারের যে পদ্ধতিকে ‘রিবা’ বা সুদ বলা হত তার বিভিন্ন ধরন একাধিক বর্ণনায় পাওয়া যায়।
কারবারের একটি ধরন এরূপ ছিল;
হযরত কাতাদাহ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘জাহেলিয়াত যুগের সুদ ছিল এই যে, এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে কোন মাল বিক্রয় করত এবং দাম মিটাবার জন্য একটি সময় নির্ধারিত করত। এবারে সেই নির্দিষ্ট সময় ও মেয়াদ পূরণ হওয়ার পর যদি ক্রেতার নিকট দাম মিটাবার মত অর্থ না হত, তাহলে বিক্রেতা তার (ক্রেতার) উপর অতিরিক্ত অর্থ চাপিয়ে দিত এবং (দাম মিটাবার) সময় আরো বাড়িয়ে দিত।’[1]
মুজাহিদ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘জাহেলিয়াতের সুদ এই ছিল যে, এক ব্যক্তি কারো নিকট ঋণ করত এবং বলত, যদি তুমি আমাকে ঋণ পরিশোধে এতটা সময় দাও, তাহলে আমি তোমাকে এত এত বেশী দেব।’[2]
আবু বাকার জাসসাস (রাহিমাহুল্লাহ)-এর প্রতিপাদন অনুসারে জাহেলিয়াত যুগের প্রচলিত সুদ ছিল এই যে, ‘তারা একে অন্যের নিকট ঋণ গ্রহণ করত এবং আপোসে এই চুক্তি করে নিত যে, এত সময় (ঋণ রাখলে) আসল ছাড়া আরো এত টাকা বাড়তি আদায় করতে হবে।’ (আহকামুল কুরআন, ১ম খন্ড)
ইমাম ফখরুদ্দীন রাযীর প্রতিপাদন মতে, জাহেলিয়াত যুগের লোকেদের মধ্যে এই রীতি ছিল যে, ‘এক ব্যক্তি কোন ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য টাকা ধার দিত, অতঃপর সে তার (ঋণগ্রহীতার) নিকট থেকে মাসিক হারে সুদ হিসাবে নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা ওসুল করত। এর পর যখন ঋণ পরিশোধের নির্দিষ্ট সময়কাল শেষ হয়ে যেত, তখন ঋণগ্রহীতার নিকট থেকে আসল টাকা চাওয়া হত। সে সময় পরিশোধ করতে না পারলে তাকে পুনরায় অতিরিক্ত সময় অবকাশ দেওয়া হত এবং সেই সঙ্গে সুদের পরিমাণও দেওয়া হত বাড়িয়ে। (তফসীরে কাবীর ২/৩৫১)
উপরে উল্লিখিত সুদের সংজ্ঞার্থ এবং জাহেলিয়াত যুগের প্রচলিত সুদী কারবার নিয়ে যদি একটু চিন্তা-ভাবনা করেন, তাহলে বুঝতে পারবেন যে, বর্তমান যুগে ব্যাংকসমূহে যে সুদী কারবার চলছে, তা হুবহু জাহেলিয়াত যুগে প্রচলিত সুদী কারবার সমূহের অন্যতম; যার অবৈধতার ব্যাপারে সারা মুসলিম উম্মাহ একমত।[3]
জাহেলিয়াত যুগে উক্ত প্রকার সুদী কারবার প্রচলিত ছিল। যাকে আরববাসিগণ সুদ বলত। সেই কারবারকেই কুরআন মাজীদে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু তারা উক্ত সুদী কারবারকে ব্যবসার মত বৈধ ও জায়েয মনে করত; যেমন বর্তমান জাহেলিয়াত যুগেও তাই মনে করা হয়।
ইসলাম আমাদেরকে এই শিক্ষা দিয়েছে যে, ব্যবসার ফলে মূলধনে যে অতিরিক্ত অর্থ বৃদ্ধি পায় সেই অর্থ এ অর্থ থেকে ভিন্নতর যা সূদী কারবারে বৃদ্ধি পায়। প্রথম প্রকার অতিরিক্ত অর্থ হালাল। পক্ষান্তরে দ্বিতীয় প্রকার অতিরিক্ত অর্থ হারাম।
আল্লাহ তাআলা জাহেলিয়াত যুগের এ লোকদের ধারণাকে খন্ডন করে বলেন:
﴿ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ قَالُوا إِنَّمَا الْبَيْعُ مِثْلُ الرِّبا وَأَحَلَّ اللهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبا ﴾
অর্থাৎ তা এই জন্য যে, তারা বলে ব্যবসা তো সুদের মতই। অথচ আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম। (সূরা বাক্বারাহ ২৭৫ আয়াত) এ ব্যাপারে মুসলিমের জন্য আবশ্যক এই যে, সে ব্যবসা এবং সুদী কারবারের মধ্যে পার্থক্য জানবে, সুদের বৈশিষ্ট্য চিনবে এবং তার সর্বনাশিতার ব্যাপারে সম্যক্ জ্ঞান লাভ করবে। তাহলেই সে জানতে পারবে, ইসলাম কোন্ ভিত্তিতে তা হারাম নিরূপণ করেছে।
[2] (&ঐ ৩/৬২)
[3] জাহেলিয়াতের যুগেও যে ব্যবসার উদ্দেশ্যে সুদের উপর ঋণ নেওয়া-দেওয়া হত, তা বিশেষভাবে প্রতিপাদিত করেছেন মওলানা মওদূদী। দেখুন, সুদ ও আধুনিক ব্যাংকিং ১৭২-১৮০ পৃঃ, আরো দেখুন, ডক্টর ইউসূফ কারযবীর ফাওয়াইদুল বুনূক ৩০-৩১ পৃঃ - অনুবাদক।
ব্যবসা বা ক্রয়-বিক্রয় এই যে, বিক্রেতা কোন জিনিসকে বিক্রয় করার জন্য পেশ করে। বিক্রেতা ও ক্রেতার মাঝে সেই জিনিসের দাম কত তা নির্দিষ্ট ও নিষ্পত্তি হয়। অতঃপর সেই দাম বা মূল্যের বিনিময়ে ক্রেতা সেই জিনিসটাকে বিক্রেতার নিকট থেকে গ্রহণ করে।
পক্ষান্তরে সুদ এই যে, কোন ব্যক্তি তার মূলধন কোন অপর এক ব্যক্তিকে ধার দেয় এবং এই শর্ত আরোপ করে যে, ‘এত সময়ের মধ্যে আসলের উপর এত টাকা বেশী নেব।’ আসল টাকা ছাড়া এ বাড়তি টাকার নামই হল সুদ। যা কোন জিনিসের মূল্য নয় বরং তা হল কেবল (ঋণ গ্রহীতাকে তার ঋণ পরিশোধে) কিছু সময় ও অবকাশ দেওয়ার বিনিময়।
অতএব ব্যবসা এবং সুদ এই উভয় প্রকার লেন-দেন নিয়ে একটু চিন্তা-ভাবনার পর নিম্নোক্ত পার্থক্য পরিদৃষ্ট হয়ঃ-
১- ব্যবসায় ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়েরই মুনাফা বিনিময় সমানভাবে হয়ে থাকে; কারণ ক্রেতা এ ক্রীত বস্ত্ত বিক্রেতার নিকট থেকে ক্রয় করে তার দ্বারা উপকৃত হয়। এবং বিক্রেতাও তার সেই শ্রম, বুদ্ধি এবং সময়ের মূল্য গ্রহণ করে; যা সে ক্রেতার জন্য এ জিনিস প্রস্ত্তত ও সরবরাহ করার পথে ব্যয় করেছে।
পক্ষান্তরে সুদী কারবারে দুই পক্ষের মুনাফা বিনিময় সমানভাবে হয় না। সুদগ্রহীতা তো এক নির্দিষ্ট পরিমাণে অর্থ নিয়ে নেয়; ফলে সে নিশ্চিতরূপে উপকৃত হয়। কিন্তু সুদদাতার জন্য কেবল (ঋণ পরিশোধে) অবকাশ মিলে; যাতে সে উপকৃত হয় কি না তা অনিশ্চিত। কারণ ঋণ গ্রহীতা যদি ব্যক্তিগত প্রয়োজন বা অভাব মিটাবার উদ্দেশ্যে ঋণ গ্রহণ করে থাকে তবে নিঃসন্দেহে এ অবকাশ অপকারী। আর যদি সে ব্যবসা করার জন্য নিয়ে থাকে, তাহলে অবকাশে যেমন তার উপকার বা লাভ হওয়ার সম্ভাবনা আছে তেমনি আছে অপকার বা ক্ষতি হওয়ারও আশঙ্কা। কিন্তু ঋণদাতা সর্বাবস্থায় তার মুনাফার (সুদের) একটা নির্দিষ্ট অংশ গ্রহণ করে থাকে; তাতে ঋণগ্রহীতার কারবারে লাভ হোক চাই না হোক। সুতরাং এ কথা স্পষ্ট হল যে, সুদী কারবার কেবল একপক্ষের লাভ এবং অপর পক্ষের ক্ষতি, অথবা একপক্ষের নিশ্চিত ও নির্দিষ্ট লাভ এবং অপর পক্ষের অনিশ্চিত ও অনির্দিষ্ট লাভের মাধ্যমেই হয়ে থাকে।
২- ক্রয়-বিক্রয় বা ব্যবসার ক্ষেত্রে বিক্রেতা ক্রেতার নিকট থেকে যত পরিমাণেই লাভ গ্রহণ করুক না কেন, গ্রহণ করে সে মাত্র একবার। পক্ষান্তরে সুদী কারবারে অর্থ লগ্নিকারী তার অর্থের উপর ধারাবাহিকভাবে বারংবার মুনাফা বা সূদ গ্রহণ করতে থাকে এবং সময়ের গতি (লমবা হয়ে) বাড়ার সাথে সাথে তার সুদের অঙ্কও বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। ঋণগ্রহীতা এ অর্থ দ্বারা যতই উপকৃত হোক না কেন, তার এ উপকার এক নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। কিন্তু এর বিপরীত পক্ষে ঋণদাতা যে উপকার ও লাভ অর্জন করে থাকে, তার কোন নির্দিষ্ট সীমা নেই।
৩- ক্রয়-বিক্রয় বা ব্যবসায় পণ্য-দ্রব্য ও তার মূল্য বিনিময় হওয়ার সাথে সাথেই আদান-প্রদানের ব্যাপার শেষ হয়ে যায়। এর পরে ক্রেতা স্বাচ্ছন্দ্য লাভ করে এবং বিক্রেতাকে কোন জিনিস ফেরৎ দিতে (বা নতুন ভাবে দিতে) হয় না। পক্ষান্তরে সুদী কারবারে ঋণগ্রহীতা টাকা নিয়ে খরচ করে ফেলে। অতঃপর সেই খরচ-করা টাকা যোগাড় করে বাড়তি সুদ-সহ ফেরৎ দিতে হয়।
৪- ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যাপারে মানুষ নিজের মেহনত ও বুদ্ধি ব্যয় করে এবং তারই পারিশ্রমিক গ্রহণ করে। পক্ষান্তরে সুদী কারবারে সুদখোর কেবলমাত্র তার প্রয়োজনের অতিরিক্ত মাল দিয়ে বিনা মেহনত ও কষ্টে অপরের কামাই ও উপার্জনে অংশীদার হয়ে বসে।
এছাড়া সুদ মানুষের মাঝে কার্পণ্য, স্বার্থপরতা, নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা, নির্দয়তা, অর্থলোলুপতা ও ধনপূজার মত প্রভৃতি গুণ সৃষ্টি করে। দুই জাতির মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ আনয়ন করে। জাতির ব্যক্তিবর্গের মাঝে সহানুভূতি ও পরস্পরকে সহায়তা করার নৈতিক সম্পর্ক নিশ্চিহ্ন করে ফেলে। সমাজের ধন-দৌলতের স্বাধীন আবর্তনকে ব্যাহত করে, বরং এ ধন-সম্পদের গতিমুখ নির্ধনদের নিকট থেকে ধনপতিদের দিকে ফিরিয়ে দেয়। যার ফলশ্রুতিতে জনসাধারণের মালধন গুটিয়ে কেবল একশ্রেণীর নিকট গিয়ে একত্রিত ও স্ত্তপীকৃত হতে থাকে। পরিশেষে তা পুরো সমাজেরই ধ্বংস ও বরবাদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর এসব তিক্ত-অভিজ্ঞতার কথা জীবন-জীবিকা ও অর্থনীতি বিষয়ে দূরদর্শীদের নিকট অবশ্যই অবিদিত নয়। সুদের এ সকল মন্দ প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া নিশ্চয়ই অনস্বীকার্য।
আমরা প্রথমেই একথা আলোচনা করেছি যে, সুদ অতিরিক্ত ও বাড়তি কিছুর নাম। পক্ষান্তরে মজুরীর আভিধানিক অর্থ হল ‘সেবার বিনিময়ে দেয় পরিবর্ত বা অর্থ।’ আর ভাড়া বলে (সাময়িক ব্যবহারের বিনিময়ে নির্দিষ্ট কালান্তরে দেয় অর্থ। অর্থাৎ) সেই নির্দিষ্ট মুনাফার মূল্যকে ভাড়া বলা হয়, যার উপর উভয়পক্ষ (ভাড়াদাতা ও গ্রহীতা) আপোসে চুক্তি করে নেয়। বুঝা গেল যে, মজুরী বা ভাড়া এবং মুনাফা (উপকার লাভ) এর মাঝে রয়েছে ঘনিষ্ট সম্পর্ক। আল্লামা ইবনে কুদামা (রাহিমাহুল্লাহু) বলেন, ‘ইজারাহ’ ‘আজ্র’ মূলধাতু থেকে উৎপত্তি। যার অর্থ হল বিনিময় বা পরিবর্ত। এই অর্থেই সওয়াব বা নেকীকে ‘আজ্র’ বলা হয়। যেহেতু আল্লাহ তাআলা বান্দাকে তাঁর আনুগত্যের বিনিময়ে বদলা বা মজুরী দান করেন।
এ থেকে পরিষ্কার হল যে, মজুরী বা ভাড়া সেই বিনিমেয় অর্থকে বলা হয়, যা বৈধ মুনাফা বা উপকার লাভের পরিবর্তে দেওয়া হয়। অবশ্য সে মুনাফা বা উপকার কোন ব্যক্তির সেবা বা পরিশ্রমের মাধ্যমে লাভ হবে অথবা এমন কোন ভোগ্য বা ব্যবহার্য জিনিসের মাধ্যমে লাভ হতে পারে যা ব্যবহার করে উপকৃত হওয়া সম্ভব; পরন্তু ব্যবহারের পর এ জিনিসের আসল অবশ্যই বাকী থেকে যায়। এই দ্বিতীয় অর্থ থেকেই গৃহীত হয়েছে সুদকে বৈধ করার মতবাদ। এর সমর্থকরা এইভাবে প্রমাণ করে যে, সুদ হল ঋণগ্রহীতাকে দেওয়া টাকার ভাড়া, যে টাকা দ্বারা সে মুনাফা বা উপকার লাভ করে থাকে।
(অতএব বাড়ি বা অন্য কিছু ভাড়া দিয়ে যেমন তার ভাড়া বা কেরায়া খাওয়া বৈধ অনুরূপ টাকা খাটিয়ে তার সুদ গ্রহণও বৈধ।) সুতরাং সুদ ও ভাড়ার মাঝে নীতিগত পার্থক্য জানা আবশ্যিক। নিম্নলিখিত বিষয়সমূহে সুদ ভাড়া বা মজুরী থেকে যে স্বতন্ত্রতা স্পষ্ট হয়ে যায়।
১- মজুরী বা ভাড়া এবং সুদী ঋণের মধ্যে পার্থক্য এই যে, প্রথমটির ক্ষেত্রে ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতার কোন সম্পর্ক থাকে না বরং তাতে থাকে মজুর ও যে মজুর খাটায় এই উভয়েই সম্পর্ক। অনুরূপ মজুরী এবং বাণিজ্যিক সুদের মাঝে পার্থক্য এটাও যে, মজুরীতে দু’টি মালের পরস্পর বিনিময় হয় না; বরং তাতে মাল অর্থাৎ মজুরী ও কাজ তথা মুনাফা বা উপকার বিনিময় হয়। (পক্ষান্তরে সুদে হয় মাল দিয়ে মালের বিনিময়।)
২- কোন জিনিস ব্যবহার করে উপকৃত হওয়া এবং তার জন্য ভাড়া দেওয়ার শর্ত হল এই যে, ব্যবহার করার পর তার মূল ও আসল যেন নষ্ট হয়ে না যায়। যেমন আলোর জন্য মোমবাতি ভাড়া দেওয়া এবং তার উপর ভাড়া নেওয়া বৈধ নয়। আর দেওয়া টাকার মূল বা আসল (উপাদান) ঋণে অবশিষ্ট থাকে না। অবশ্য তার মূল্য অবশিষ্ট থাকে কিন্তু তার আসল (উপাদান) নষ্ট হয়ে যায়।[1]
ফিক্হবিদগণ إيداع ‘ঈদা’ শব্দের সংজ্ঞা এরূপ করেছেন,
تسليط الغير على حفظ ماله.
অর্থাৎ নিজের মাল হিফাযতে রাখার উদ্দেশ্যে অপরকে ভারার্পণ করা।
আর وديعة (আমানত) সেই মালকে বলা হয় যা আমানতদারের নিকট (গচ্ছিত) রাখা হয়। বর্তমান কালের ব্যাংকে ডিপোজিট্ রাখা টাকা শরয়ী অর্থে আমানত এই হিসাবে বলা হয় যে, ব্যাংকে টাকা জমাকর্তা এই উদ্দেশ্যে জমা করে, যাতে তার টাকা হিফাযতে থাকে এবং প্রয়োজন সময়ে তা চাইবা মাত্র ফিরে পাওয়া যায়।
কিন্তু তা আমানত বললেও ব্যাংক তা ব্যবহার করে এবং নিজের অন্যান্য টাকার সাথে মিলিয়ে মুনাফা অর্জন করে; যা এক প্রকার তাসার্রুফ। আর এই তাসার্রুফের কারণেই আমানত তার শরয়ী অর্থ থেকে বের হয়ে যায় এবং ঋণ বা ‘লোন্’এর পজিশনে অবস্থান্তরিত হয়। কারণ ঋণগ্রহীতার জন্য তার ঋণে গৃহীত অর্থে তাসার্রুফ করায় অধিকার আছে। যেমন সে অর্থ তার নিকট কোন প্রকারে নষ্ট হয়ে গেলেও সে তা আদায়ের জামিন থাকে।
সুতরাং বুঝা গেল যে, আমানতকে ঋণে পরিবর্তিত করা বৈধ। যেমন করতেন যুবাইর বিন আওয়াম (রাযিয়াল্লাহ আনহু)। তাঁর নিকট যখন কোন লোক নিজের মাল আমানত রাখতে আসত তখন তিনি বলতেন, ‘আমানত নয়, বরং ধার হিসাবে আমি রেখে নিচ্ছি। কারণ এ মাল নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করি।’[1]
সহীহুল বুখারী উক্ত ঘটনা থেকে বুঝা যায় যে, যুবাইর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) আমানতের অর্থকে ঋণে পরিবর্তন করে নিতেন। আর তাঁর এই কর্মের উপর কোন সাহাবীও কোন প্রকার আপত্তি উত্থাপন করেন নি। কারণ তিনি এ মালওয়ালার অনুমতিক্রমেই সেই মাল বিনিয়োগ করে বৃদ্ধি করতেন।
বলাই বাহুল্য যে, ব্যাংকও টাকা আমানতকারীদের পুঁজি নিয়ে এ একই ধরনের আচরণ করে থাকে।[2]
আল্লামা মুহাম্মদ আমীন শানক্বীত্বী বলেন, ‘ফিক্হ বিদ্গণের নিকট আমানত রাখার অর্থ হল, মাল হিফাযত ও রক্ষণা-বেক্ষণের জন্য কোন অপর ব্যক্তিকে প্রতিনিধি বানিয়ে (দায়িত্বভার) দেওয়া। এবারে মালওয়ালার তরফ থেকে যদি এ প্রতিনিধির জন্য তা ব্যবহার করার অনুমতি থাকে, তবে তার দুই অবস্থা হতে পারে;
প্রথমতঃ এই যে, ব্যবহারের ফলে এ মালের আসল (উপাদান) নষ্ট হয়ে যায়। এবং দ্বিতীয়তঃ এই যে, ব্যবহারের ফলে এ মালের আসল (উপাদান) নষ্ট হয়ে যায় না। সুতরাং ব্যবহারের ফলে যদি মালের আসল (উপাদান) নষ্ট না হয়, তবে তাকে عارية (বা সাময়িক ব্যবহার করতে) ধার বলে। পক্ষান্তরে যদি ব্যবহারের কারণে তার মূল (উপাদান) নষ্ট হয়ে যায়; যেমন টাকা পয়সা ইত্যাদি, তাহলে এই অবস্থায় প্রতিনিধির নিকট রাখা এ আমানতের মাল কর্জ বা ঋণে পরিবর্তিত হয়ে যায়।
অতএব ব্যাংকে জমা রাখা আমানত যে ঋণে দেওয়া টাকায় পরিণত হয়ে যায় তা পরিষ্কার হল। আর একথাও স্পষ্ট হল যে, আমানত ছাড়া যে অতিরিক্ত টাকা ব্যাংক জমাকর্তাকে দেয়, তা সূদ রূপে পরিগণিত।’[3]
এবারে আমরা পাঠকের খিদমতে এখানে ‘ঋণ’ কাকে বলে? ঋণের সংজ্ঞার্থ কি? এবং ঋণ কোন্ উদ্দেশ্যে নেওয়া-দেওয়া হয় তা পেশ করব। যাতে এ বিষয়ে সম্পূর্ণ জ্ঞান ও পরিচিতি লাভ সম্ভব হয়।
[2] (বুনূক তিজারিয়্যাহ বিদূনি রিবা ১৮৪-১৮৫ পৃঃ)
[3] (দিরাসাহ শারইয়্যাহ ২৭১-২৭২ পৃঃ)