স্থান অথবা কালের সীমারেখাকে মীকাত বলে। অর্থাৎ এহরাম ব্যতীত যে স্থান অতিক্রম করা যায় না, অথবা যে সময়ের পূর্বে হজ্জের এহরাম বাঁধা যায় না সেটাই হল মীকাত।
স্থান বিষয়ক মীকাত (মীকাতে মাকানি)
বেশ দূর থেকে এহরাম বেঁধে রওয়ানা হওয়া আল্লাহর পানে ছুটে যাওয়ার ইচ্ছা-আগ্রহকে আরো মজবুত, আরো পরিপক্ব করে তোলে। নিজের ঈমানি জোশ-জযবাকে শতগুণ বাড়িয়ে ধীরে ধীরে বায়তুল্লাহ শরীফের দিকে এগিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে আল্লাহর সাথে বান্দার সম্পর্ককে বহুগুণে দৃঢ় করে দেয় এ ধরনের প্রস্ত্ততি। এ জন্যই, হয়তো, হজে মীকাতের নিয়ম রাখা হয়েছে। মীকাত সম্পর্কে হাদিসে এসেছে, ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ)সীমানা বেঁধে দিয়েছেন—মদিনাবাসীদের জন্য যুল হুলায়ফা, শামবাসীদের জন্য জুহফাহ, নাজদবাসীদের জন্য কারনুল মানাযিল, ইয়েমেনবাসীদের জন্য য়ালামলাম, এগুলো তাদের জন্য এবং যারা অন্যত্র থেকে ওই পথে আসে হজ্জ ও উমরা আদায়ের ইচ্ছা নিয়ে তাদের জন্য। আর যারা এ সীমার অভ্যন্তরে বসবাস করবে তাদের স্বস্থানই তাদের এহরামের জায়গা। তদ্রূপভাবে মক্কাবাসী মক্কা থেকে।[1] অন্য এক হাদিসে ইরাকবাসীদের মীকাত যাতু ইর্ক নির্ধারণ করা হয়েছে।[2]
মক্কা থেকে মীকাতসমূহের দূরত্ব
যুল হুলায়ফা: মক্কা থেকে ৪২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। বর্তমানে আবয়ারে আলী বলে জায়গাটি পরিচিত। মদিনাবাসী এবং ওই পথ হয়ে যারা আসেন যুল হুলায়ফা তাদের মীকাত।
জুহফাহ: এই জায়গাটি বর্তমানে পরিত্যক্ত হওয়ায় রাবেগ থেকে মানুষেরা এহরাম বাঁধে। মক্কা থেকে রাবেগের দূরত্ব ১৮৬ কিলোমিটার। সৌদি আরবের উত্তরাঞ্চলীয় এলাকার লোকজন, পশ্চিম ও উত্তর আফ্রিকার লোকজন, লেবানন, সিরিয়া, জর্ডান ও ফিলিস্তিনবাসীরা এই জায়গা হতে এহরাম বাঁধেন।
কারনুল মানাযেল: এই জায়গার অন্য নাম আস্সাইলুল কাবির। মক্কা থেকে এর দূরত্ব ৭৮ কিলোমিটার। ইরাক ইরান ও অন্যান্য উপসাগরীয় অঞ্চলের লোকদের মীকাত হল এই কারনুল মানাযেল।
য়ালামলাম: মক্কা থেকে এর দূরত্ব ১২০ কিলোমিটার। ইয়েমেনবাসী ও পাক-ভারত-বাংলাসহ প্রাচ্য ও দূর প্রাচ্য হতে আগমনকারীদের জন্য মীকাত হল এই য়ালামলাম।
যাতু ইরক: মক্কা থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। বর্তমানে এই মীকাতটি পরিত্যক্ত। কেননা ওই পথ হয়ে বর্তমানে কোনো রাস্তা নেই। স্থল পথে আসা পূর্বাঞ্চলীয় হাজিরা বর্তমানে সাইল অথবা যুল-হুলায়ফা থেকে এহরাম বাঁধেন।
হাদিস অনুযায়ী মীকাতের বাইরে থেকে আসা হাজিদের জন্য মীকাত থেকে এহরাম বাঁধা ওয়াজিব। তবে যারা মীকাতের সীমানার অভ্যন্তরে বসবাস করেন তাদের অবস্থানের জায়গাটাই হল তাদের মীকাত। অর্থাৎ যে যেখানে আছে সেখান থেকেই হজ্জের এহরাম বাঁধবে। তবে মক্কার হারাম এরিয়ার ভেতরে বসবাসকারী ব্যক্তি যদি উমরা করতে চায় তা হলে তাকে হারাম এরিয়ার বাইরে- যেমন তানয়ীম তথা আয়শা মসজিদে গিয়ে এহরাম বাঁধতে হবে।
মীকাতে মাকানি বিষয়ে কিছু সমস্যার সমাধান
যদি কারও পথে দুটি মীকাত পড়ে তাহলে প্রথম মীকাত থেকেই এহরাম বাঁধা উত্তম। তবে দ্বিতীয় মীকাত থেকেও এহরাম বাঁধা চলে। বাংলাদেশ থেকে মদিনা হয়ে মক্কায় গমনকারী হাজিগণ এই মাসআলার আওতায় পড়েন। অতঃপর তারা জেদ্দা বিমান বন্দরের পূর্বে যে মীকাত আসে সেখান থেকে এহরাম না বেঁধে মদিনা থেকে মক্কা যাওয়ার পথে যে মীকাত পড়ে—যুল হুলায়ফা—সেখান থেকে এহরাম বাঁধেন।
যদি কোনো ব্যক্তি এহরাম না বেঁধে মীকাত অতিক্রম করত: ভেতরে চলে আসে তার উচিৎ হবে মীকাতে ফিরে গিয়ে এহরাম বাঁধা। এমতাবস্থায় তার ওপর ক্ষতিপূরণ হিসেবে ‘দম’ দেয়া ওয়াজিব হবে না। মীকাতে ফিরে না গিয়ে যেখানে আছে সেখান থেকে এহরাম বাঁধলে হজ্জ-উমরা হয়ে যাবে বটে তবে ‘দম’ দেয়া ওয়াজিব হবে। স্মরণ করিয়ে দেওয়া ভাল যে, এহরাম না বেঁধে মীকাত অতিক্রম করে ফেললে ভেতরে ঢুকে মসজিদে আয়শায় গিয়ে হজ্জের এহরাম বাঁধলে চলবে না, কেননা মসজিদে আয়শা হেরেম এলাকার অভ্যন্তরে বসবাসকারীদের উমরার মীকাত।
কাল বিষয়ক মীকাত (মীকাতে যামানি)
পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘হজ্জ হয় নির্দিষ্ট কয়েকটি মাসে’।[3]
এ নির্দিষ্ট মাসগুলো হল—শাওয়াল, যিলকদ ও জিলহজ্জ মাসের ১০ তারিখ পর্যন্ত। কারও কারও মতে জিলহজ্জ মাসের পুরোটাই হজ্জের মাস।
শাওয়াল মাস থেকে যেহেতু হজ্জের মাস শুরু হয় তাই শাওয়াল মাসের পূর্বে হজ্জের এহরাম বাঁধা উচিৎ হবে না। তা বরং খেলাফে সুন্নত ও মাকরুহে তাহরীমি হবে।
[2] - أن رسول الله وقت لأهل العراق ذات عرق (মুসলিম : ২/৮৪১)
[3] - الْحَجُّ أَشْهُرٌ مَعْلُومَاتٌ (সূরা বাকারা : ১৯৭)
এহরামের মাধ্যমে হজ্জের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। এহরাম শব্দের আভিধানিক অর্থ হারাম করা। হাজি সাহেবগণ হজ্জ অথবা উমরা অথবা উভয়টা পালনের উদ্দেশ্যে নিয়ত করে তালবিয়া পাঠ করেন তখন তাদের উপর কতিপয় হালাল ও জায়েয বস্ত্তও হারাম হয়ে যায়। একারণেই এ-প্রক্রিয়াটিকে এহরাম বলা হয়।
হজ্জ অথবা উমরার উদ্দেশ্যে সৌদি আরব গমন করলে এহরাম ব্যতীত নির্দিষ্ট সীমারেখা—মীকাত—পার হওয়া যায় না, এ বিষয়ে আগেই আলোচনা হয়েছে বাংলাদেশ থেকে হজে যাওয়ার সময় বিমানে থাকা অবস্থাতেই মীকাত এসে যায়। মীকাত নিকটবর্তী হলে বিমানে কর্তব্যরত ব্যক্তিরা হাজি সাহেবদেরকে এ ব্যাপারে ঘোষণা দিয়ে জানিয়ে দেন। সে সময়ই এহরামের নিয়ত করা উত্তম। কেননা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)মীকাতের পূর্বে এহরামের নিয়ত করেননি।[1] তবে বিমানে আরোহণের পূর্বেই এহরামের যাবতীয় প্রস্ত্ততি সম্পন্ন করে নেবেন। শুধুমাত্র নিয়তটা বাকি রাখবেন। বিমানে আরোহণের পূর্বেও এহরামের নিয়ত করতে পারেন, তবে তা খেলাফে সুন্নত হওয়ায় কেউ কেউ মাকরুহ বলেছেন।[2] আপনি যদি প্রথমে মদিনায় যাওয়ার নিয়ত করে থাকেন তাহলে এসময় এহরামের নিয়ত করার দরকার নেই। কেননা মদিনা থেকে মক্কায় আসার পথে আরেকটি মীকাত পড়বে, সেখান থেকে এহরাম বাঁধলেই চলবে।
[2] - দেখুন : সাইয়েদ সাবেক : ফিকহুস্সুন্নাহ , খন্ড ১, পৃ:৬৫৩
বাংলাদেশ থেকে যারা হজ্জ করতে যান তাদের অধিকাংশই তামাত্তু হজ্জ করে থাকেন। তামাত্তু হজ্জের জন্য দু’বার এহরাম বাঁধতে হয়। প্রথমবার শুধু উমরার নিয়ত করে মীকাত থেকে। দ্বিতীয়বার ৮ জিলহজ্জ তারিখে মক্কা শরীফে যে জায়গায় আপনি আছেন সে জায়গা থেকে। উভয় এহরাম সম্পর্কে বিস্তারিত নিয়ম-কানুন নীচে উল্লেখ করা হল।
শুরুতে আপনি ক্ষৌরকর্ম অর্থাৎ বগল ও নাভির নীচের চুল পরিষ্কার করুন। নখ কাটুন। মাথার চুল ছোট না করে যেভাবে আছে সেভাবেই রেখে দিন, কেননা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)ও সাহাবায়ে কেরাম এহরামের পূর্বে মাথার চুল কেটেছেন বা মাথা মুন্ডন করেছেন বলে কোনো বর্ণনায় পাওয়া যায় না। ধুলো-বালি লেগে অতিমাত্রায় উসকোখুসকো হওয়ার আশঙ্কা থাকলে— বর্তমান যুগের যন্ত্র-চালিত সফরে এ ধরনের আশঙ্কা নেই বললেই চলে—বিশেষ পদার্থ ব্যবহার করে চুলকে স্থিরকৃত আকারে রাখার জন্য হাদিসে ‘তালবিদ’ করার কথা আছে।[1] তবে এহরামের পূর্বে মাথা মুন্ডন করে ফেলা বা চুল ছোট করে ফেলার কথা নেই।
ক্ষৌরকর্ম সেরে সাবান মাখিয়ে গোসল করুন। গোসল করা সম্ভব না হলে ওজু করুন। ওজু-গোসল কোনটাই যদি করার সুযোগ না থাকে তাহলেও কোনো সমস্যা নেই। এক্ষেত্রে তায়াম্মুম করতে হবে না। এরপর শরীরে, মাথায় ও দাঁড়িতে উত্তম সুগন্ধি মাখুন।[2] স্বাভাবিক সেলাই করা কাপড় পরে এহরামের কাপড় আলাদা একটি ব্যাগে ঢুকিয়ে হজ্জ ক্যাম্প অথবা বিমান বন্দরে চলে যান। আপনার ফ্লাইটের সময়সূচি জেনে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম সেরে গাড়িতে ওঠার আগে এহরামের কাপড় পরে নিন। ফরজ নামাজের সময় হলে এহরাম পরার পর নামাজ আদায় করুন। আর ফরজ সালাতের সময় না হলে তাহিয়াতুল ওজুর দু’রাকাত সালাত আদায় করুন। সালাতের পর এহরামের নিয়ত না করে বিমানে আরোহণ করুন। যেহেতু নিয়ত করেননি তাই তালবিয়া পাঠ করা থেকেও বিরত থাকুন। জেদ্দা বিমান বন্দরে পৌঁছার পূর্বে যখন মীকাতের ব্যাপারে ঘোষণা হবে তখন মনে মনে উমরার নিয়ত করুন ও মুখে বলুন لَبَّيْكَ عُمْرةً (লাববাইকা উমরাতান্), এরপর পুরা তালবিয়া-
لَبَّيْكَ اَللّهُمَّ لّبَّيْكْ ، لَبَّيْكّ لا شَرِيْكَ لَكَ لَبَّيْكْ ، ِإنَّ الْحّمْدّ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكْ، لا شَرِيْكَ لَكْ
—পড়ে নিন। মাথায় টুপি থাকলে নিয়ত করার পূর্বেই তা সরিয়ে নিন।
সালাতের পর এহরাম বাধা মুস্তাহাব। যদি ফরজ সালাতের পর এহরাম বাধা হয়, তাহলে স্বতন্ত্র নামাজের প্রয়োজন নেই। অন্য সময় এহরাম বাধলে দু রাকাত সালাত আদায় করে নিবে। এ আদায়কৃত নামাজ কি এহরামের নামাজ না তাহিয়্যাতুল ওজুর—এ ব্যাপারে উলামাদের মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ একে এহরামের নামাজ বলেছেন। তবে বিশুদ্ধতম মত হল, এটি তাহিয়্যাতুল ওজু হিসেবে আদায় করা হবে। বিমানের ভেতরে এহরামের নিয়ত করা যদি ঝামেলা মনে করেন তাহলে বিমানে ওঠার পূর্বেই ফরজ সালাত অথবা দু’রাকাত তাহিয়াতুল ওজুর সালাত আদায় করে সালাম ফেরানোর পর মাথায় টুপি থাকলে তা খুলে উপরে যেভাবে বলা হয়েছে সেভাবে উমরার নিয়ত করুন ও তালবিয়া পাঠ করুন। এহরামের আলাদা কোনো সালাত নেই। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)ফরজ সালাতের পর এহরামের নিয়ত করেছিলেন।
এহরামে প্রবেশের পর বেশি বেশি তালবিয়া পড়ুন ও জিকির আযকারে ব্যস্ত থাকুন। এহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ সকল জিনিস থেকে বিরত থাকুন যার বিস্তারিত বর্ণনা একটু পরে আসছে।
[2] - আয়েশা (র) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে এসেছে, তিনি বলেন,‘ রাসূলুল্লাহ (স) কে আমার এই দু’হাত দিয়ে সুগন্ধিত করেছি, যখন তিনি ইহরাম বেঁধেছেন ও যখন তিনি হালাল হয়েছেন - طيبت رسول الله صلى الله عليه وسلم بيدي هاتين حين أحرم و لحله حين أحل (বোখারি : হাদিস নং ১৬৩৫)
মক্কা শরীফ যাওয়ার পর উমরা আদায়ের পর মাথার চুল খাটো করে অথবা মাথা মুন্ডন করে এহরাম খুলে ফেলে স্বাভাবিক পোশাক-আশাক পরে ইবাদত বন্দেগিতে মশগুল থাকুন ও যত বেশি সম্ভব বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করুন। ৮ জিলহজ্জ আবার আপনাকে এহরাম বাঁধতে হবে। এবারের এহরাম হবে হজ্জের নিয়তে। এ এহরামের জন্য কোথাও যেতে হবে না। আপনি যে বাসায় বা হোটেলে আছেন সেখান থেকেই এহরাম বাঁধুন।[1] পূর্বের ন্যায় ক্ষৌরকর্ম সেরে নিয়ে গোসল করে নিন। শরীরে, দাড়িতে ও মাথায় আতর মাখুন। এহরামের কাপড় পড়ে নিন। ফরজ সালাতের সময় হলে ফরজ সালাত আদায় করুন। অন্যথায় তাহিয়াতুল ওজুর দু’রাকাত সালাত আদায় করুন। এরপর মনে মনে হজ্জের নিয়ত করুন, ও মুখে বলুন لَبَّيْكَ حَجًّا (লাববাইকা হাজ্জান) এরপর পুরা তালবিয়া পড়ে নিন।
- এহরাম বাধার পর গভীর মনোনিবেশের সাথে আল্লাহর আজমত- বড়োত্ব, রহমত-মাগফিরাত ইত্যাদির কথা ক্ষণে ক্ষণে স্মরণ করুন। বেশি বেশি দোয়া-দরুদ পড়ুন। তালবিয়া পড়ুন।[1] তালবিয়া কোনো উঁচু জায়গায় ওঠার সময়, নিচু জায়গায় নামার সময়, বসা থেকে উঠে দাঁড়ানোর সময়, দাঁড়ানো অবস্থা থেকে বসার সময়, কারও কাছে বেড়াতে গেলে সশব্দে তালবিয়া পড়ুন। কুরআন তিলাওয়াত করুন। হজ্জ-উমরা বিষয়ক বই-পুস্তক পড়ুন। কোনো হক্কানি আলেম আলোচনা করতে থাকলে মনোযোগ দিয়ে শুনুন।
- পাঁচ ওয়াক্ত সালাত জামাতের সাথে আদায় করুন। বিমানে আরোহণরত অবস্থায় সালাতের সময় হলে একাকীই সালাত আদায় করে নিন। ওজু না থাকলে তায়াম্মুম করুন। সালাত কাজা করার অপেক্ষায় থাকবেন না।
- ৮ জিলহজ্জ এহরাম বাধার পর যেহেতু মূল হজ্জ শুরু হবে তাই এহরাম খোলা পর্যন্ত নিজেকে কঠিনভাবে নিয়ন্ত্রণ করুণ। অন্যান্য হাজিদেরকেও নসিহত করুন, যেন সবাই তাওবা ইস্তিগফারের মধ্যে সময় কাটায়। যারা হজ্জের কার্যক্রম সম্পর্কে অজ্ঞ তাদেরকে আপনি যতটুকু জানেন সেইটুকু বলুন। হজ্জ পালনের জন্য সহিহ-শুদ্ধ কোনো বই সাথে থাকলে তা পড়ে শুনান। এভাবে পুরা সময়টাকে ঈমানি ভাবগাম্ভীর্যের আওতায় কাটান।
তালবিয়ার মাধ্যমেই কার্যত হজ্জ ও উমরায় প্রবেশের ঘোষণা দেয়া হয়। সে হিসেবে তালবিয়াকে হজ্জের স্লোগান বলা হয়েছে[1] তালবিয়ার শব্দমালা নিম্নরূপ—
لَبَّيْكَ اللّهُمَّ لَبَّيْكْ، لَبَّيْكَ لا شَرِيْكَ لَكَ لَبَّيْكْ ، إِنَّ الْحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكْ ، لا شَرِيْكَ لَكْ
‘আমি হাজির, হে আল্লাহ! আমি হাজির। তোমার কোনো শরিক নেই। নিশ্চয়ই প্রশংসা ও নেয়ামত তোমার এবং রাজতবও, তোমার কোনো শরিক নেই।’[2] ইবনে ওমর বলেন: ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ)এ-শব্দমালায় আর কিছু বাড়াতেন না’ আবু হুরায়রা (রাঃ) এর বর্ণনা মতে তালবিয়ায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)বলেছেন لَبَّيْكَ إِلهَ اْلَحقِّ لَبَّيْكَ ‘আমি হাজির সত্য ইলাহ আমি হাজির’।[3]
এক আল্লাহর সান্নিধ্যে হাজিরা দেয়া, ও তাঁর লা-শরিক হওয়ার ঘোষণা বার বার উচ্চারিত হয় তালবিয়ার শব্দমালায়। তালবিয়া যেন সকল পৌত্তলিকতা, প্রতিমা-পূজা, অথবা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন সত্তার সমীপে হীনতা দ্বীনতা প্রকাশের বিরুদ্ধে এক অমোঘ ঘোষণা যা নবী-রাসূল পাঠানোর পিছনে প্রধান উদ্দেশ্য হিসেবে বিবেচিত। যে ঘোষণার সার্থক রূপায়ণ ঘটতে দেখা যায় রাসূলুল্লাহর (ﷺ)শিরক ও মুশরিকদের সকল কর্মকান্ড থেকে দায়-মুক্তি ও তাদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা পড়ে শোনানোর মাধ্যমে।
শুধু তালবিয়া নয় বরং অন্যান্য হজ্জকর্মেও তাওহীদ চর্চা প্রচন্ডভাবে দৃশ্যমান। তাওয়াফ শেষে যে দু’রাকাত সালাত আদায় করতে হয় সেখানেও তাওহীদ চর্চার বিষয়টি প্রকাশমান। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)এ দু রাকাত সালাত আদায়ের সময় ‘সূরা ইখলাস’ ও ‘সূরা আল-কাফিরুন’ পাঠ করেছেন,[4] এ দুটি সূরাতে তাওহীদের বাণী স্পষ্ট আকারে উচ্চারিত হয়েছে। জাবের (রা) বলেন: ‘‘তিনি (ﷺ)এ-দু’রাকাতে তাওহীদভিত্তিক সূরা ও ‘কুল য়্যা আইয়ুহাল কাফিরুন’ তিলাওয়াত করলেন’’।[5] অন্য এক বর্ণনায় তিনি ইখলাসের দুই সূরা ‘‘কুল য়্যা আইয়ুহাল কাফিরুন’ ও ‘কুল হুআল্লাহু আহাদ’, তিলাওয়াত করেন’’।[6]
সাফা ও মারওয়ায় তাওহীদনির্ভর দোয়া একত্ববাদের সাথে হজ্জের অচ্ছেদ্য সম্পর্ককে নির্দেশ করে। জাবেরের (রাঃ) এক বর্ণনায় এসেছে, তিনি বলেন, ‘অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)সাফায় আরোহণ করলেন, কাবা দৃষ্টিগ্রাহ্য হল, তিনি কেবলামুখী হয়ে আল্লাহর একত্বের কথা বললেন, তাঁর বড়োত্বের ঘোষণা দিলেন। তিনি বললেন—
لَا إِلهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيْكَ لَهُ ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ اْلَحمْدُ وَهَوُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ، لَا إِلهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيْكَ لَهُ، أَنْجَزَ وَعْدَهُ ، وَنَصَرَ عَبْدَهُ ، وَهَزَمَ الْأَحْزَابَ وَحْدَهُ.
আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। তিনি একক, তাঁর কোনো শরিক নেই। রাজত্ব তাঁরই। প্রশংসাও তাঁর। তিনি সকল বিষয়ের ওপর ক্ষমতাবান। আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, তিনি একক, তাঁর কোনো শরিক নেই। তিনি তাঁর অঙ্গীকার পূরণ করেছেন, তাঁর বান্দাকে সাহায্য করেছেন, ও শত্রু দলকে একাই পরাভূত করেছেন।’ মারওয়াতে গিয়েও তিনি অনুরূপ করলেন।[7]
আরাফার দোয়া ও রিজিকসমূহেও তাওহীদের বাণী উচ্চারিত হয়েছে। হাদিসে এসেছে, ‘উত্তম দোয়া আরাফা দিবসের দোয়া, আর আমি ও আমার পূর্ববর্তী নবীদের সর্বোত্তম কথাটি হলো:
لَا إِلهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيْكَ لَهُ ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ اْلَحمْدُ وَهَوُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ.
‘আল্লাহ ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই, তিনি একক, তাঁর কোনো শরিক নেই। রাজত্ব তাঁরই। প্রশংসাও তাঁর। তিনি সকল বিষয়ের ওপর ক্ষমতাবান।[8]
হজ্জকারীদের—এমন কি ব্যাপকার্থে—মুসলমানদের অবস্থার প্রতি দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে বিচিত্র ধরনের বেদআত, কুসংস্কার ও শিরকের ধূম্রজালে জড়িয়ে রয়েছে অনেকেই। এই জন্য ওলামা ও আল্লাহর পথে আহবায়কদের উচিৎ তালবিয়ার ভাব ও আদর্শ হাজি সাহেবদেরকে বেশি বেশি বলা। তালবিয়ার ঘোষণা অনুযায়ী সবাইকে জীবন গড়তে উৎসাহিত করা।
[2] - বোখারি : হাদিস নং ৫৪৬০
[3] - ইবনে মাযাহ : হাদিস নং ২৯২০
[4] - আবু দাউদ : হদীস নং ১৯০৯
[5] - আবু দাউদ : হাদিস নং ১৯১৯
[6] - তিরমিযী : হাদিস নং ৮৬৯
[7] - মুসলিম : হাদিস নং ১২১৮
[8] - তিরমিযি, হাদিস নং ৩৫৮৫, মুহাদ্দীস আলবানী এ হাদিসটিকে হাসান বলেছেন, দ্রঃ সহিহ সুনানুত তিরমিযি, হাদিস নং ২৮৩৭
তালবিয়া হজ্জের স্লোগান। তাই তালবিয়া পাঠের কোনো বিকল্প নেই। তালবিয়া পাঠ ফরজ না ওয়াজিব না সুন্নত এই নিয়ে ফেকাহবিদদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। হানাফি মাজহাব অনুযায়ী এহরাম বাধার সময় তালবিয়া অথবা অন্য কোনো জিকির একবার পাঠ করা ফরজ, এবং একাধিকবার পাঠ করা সুন্নত।
উমরার ক্ষেত্রে তালবিয়ার শুরু এহরামের নিয়ত করার সময় থেকে এবং শেষ বায়তুল্লাহর তাওয়াফ শুরু করার সময়ে। আর হজ্জের ক্ষেত্রে এহরামের নিয়ত করার সময় থেকে ১০ জিলহজ্জ বড় জামরায় কঙ্কর নিক্ষেপের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)থেকে বর্ণিত আরবি শব্দমালা ব্যবহার করে তালবিয়া পড়া সুন্নত। তবে যদি কেউ আল্লাহর আজমত ও বড়োত্ব প্রকাশক আরো কিছু শব্দ এর সাথে যুক্ত করতে চায় তাহলে তা জায়েয হবে। যেমনটি করেছেন ওমর (রাঃ)। তিনি উল্লেখিত তালবিয়ার শব্দমালা পড়ার পর বলতেন।[1]
لَبَّيْكَ اْللَّهُمَّ لَبَّيْكَ، لَبَّيْكَ وَسَعْدَيْكَ، وَالَخيْرَ فِيْ يَدَيْكَ، وَالرَّغْبَاءُ إِلَيْكَ وَالْعَمَلُ.
‘আমি হাজির হে আল্লাহ আমি হাজির, আমি হাজির একমাত্র তোমারই সন্তুষ্টি কল্পে। কল্যাণ তোমার হাতে, আমল ও প্রেরণা তোমারই কাছে সমর্পিত।’
তবে আমাদের উচিৎ হবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)ও সাহাবাদের ব্যবহৃত শব্দমালার বাইরে না যাওয়া।
যদি কেউ আরবি তালবিয়া আদৌ উচ্চারণ করতে না পারে, তাহলে বাংলা ভাষায় তালবিয়ার অনুবাদ মুখস্থ করে পড়লেও দায়িত্ব আদায় হয়ে যাবে। তবে যেহেতু আরবি তালবিয়াটিই হজ্জের শেয়া’র বা স্লোগান তাই হজ্জ পালনেচ্ছু ব্যক্তিমাত্রেরই উচিৎ হবে মেহনত করে শুদ্ধভাবে আরবি তালবিয়াটি শিখে নেয়া।
তালবিয়া মুখে উচ্চারণ করা জরুরি। যদি কেউ মনে মনে তালবিয়া পড়ে, তবে তা যথেষ্ট হবে না। কেননা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)ও সাহাবাগণ মুখে উচ্চারণ করে উচ্চ স্বরে তালবিয়া পড়েছেন। হাদিসে এসেছে, ‘আমরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)এর সাথে বের হলাম হজ্জের তালবিয়া চিৎকার করে বলে বলে। [2] আর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)হজ্জ বিষয়ে নির্দেশ করে বলেছেন, ‘لِـتَأْخُذُوْا عَنِّىْ مَنَاسِكَكُم - আমার কাছ থেকে তোমরা যেন তোমাদের হজ্জকর্মসমূহ জেনে নাও।’ তালবিয়ার ক্ষেত্রে সশব্দে উচ্চারণ করে পড়া ব্যতীত অন্য কোনো পদ্ধতি আমাদের জানা নেই, তাই সশব্দে উচ্চারণ করে তালবিয়া না পড়লে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)এর আদর্শের অনুসরণ হবে না।
বর্তমানে দেখা যায় যে হাজি সাহেবদের মধ্যে একজন প্রথমে তালবিয়ার কিছু শব্দ উচ্চারণ করেন, পরে অন্যান্য হাজিগণ তাকে অনুসরণ করে সমস্বরে তালবিয়া পড়েন। এভাবে একবার তালবিয়া শেষ হলে আবার শুরু করেন। এরূপ করা সুন্নতের বিপরীত। তালবিয়া পাঠের সময় সুন্নত তরিকা হল প্রত্যেকেই আলাদা আলাদা তালবিয়া পাঠ করবে। হাঁ যদি তালবিয়া শেখানোর প্রয়োজনে সাময়িকভাবে তালকিন করা হয়, তবে তার অনুমতি রয়েছে।
নারীদের জন্য জোরে তালবিয়া পড়া নিষিদ্ধ। নারীরা এতটুকু শব্দে তালবিয়া পাঠ করবেন যাতে পাশে থাকা সঙ্গিনী কেবল শুনতে পান। কোন বেগানা পুরুষ শুনতে পায় এমন উচ্চারণে নারীদের তালবিয়া পাঠ অবৈধ।
তালবিয়া বেশি বেশি পড়া মুস্তাহাব। দাঁড়িয়ে, বসে, শুয়ে, চলন্ত অবস্থায়, ওজু ও বে-ওজু—সর্বাবস্থায় তালবিয়া পড়া যায়। বিশেষ করে ব্যক্তির অবস্থা পরিবর্তনের সময় তালবিয়া পড়া মুস্তাহাব। যেমন দাঁড়ানো অবস্থা থেকে বসার সময়, বসা থেকে উঠে দাঁড়ানোর সময়, ঘর থেকে বের হওয়ার সময়, ঘরে প্রবেশের সময়, গাড়িতে উঠার সময়, গাড়ি থেকে নামার সময় তালবিয়া পড়া মুস্তাহাব। মসজিদুল হারাম, মিনার মসজিদে খাইফ, আরাফার মসজিদে নামিরায় তালবিয়া পড়া মুস্তাহাব। তবে মসজিদে নিচু স্বরে তালবিয়া পাঠ বাঞ্ছনীয়।
[2] - خرجنا مع رسول الله صلى الله عليه وسلم نصرخ بالحج صراخا (মুসলিম : হাদিস নং ২১৯০)