উত্তর: পবিত্র কুরআনের নিম্ন লিখিত আয়াত পাঠ করলেই আমরা জানতে পারি সিয়াম ফরয হওয়ার হিকমত কী? আর তা হচ্ছে তাক্বওয়া বা আল্লাহ ভীতি অর্জন করা ও আল্লাহর ইবাদত করা। আল্লাহ বলেন,
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ كُتِبَ عَلَيكُمُ ٱلصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى ٱلَّذِينَ مِن قَبلِكُم لَعَلَّكُم تَتَّقُونَ ﴾ [البقرة: ١٨٣]
“হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেমন ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। যাতে করে তোমরা তাক্বওয়া অর্জন করতে পার।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ১৮৩] তাক্বওয়া হচ্ছে হারাম কাজ পরিত্যাগ করা। ব্যাপক অর্থে তাক্বওয়া হচ্ছে, আল্লাহর নির্দেশিত বিষয় বাস্তবায়ন করা, তাঁর নিষেধ থেকে দূরে থাকা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَنْ لَمْ يَدَعْ قَوْلَ الزُّورِ وَالْعَمَلَ بِهِ والْجَهْلَ فَلَيْسَ لِلَّهِ حَاجَةٌ فِي أَنْ يَدَعَ طَعَامَهُ وَشَرَابَهُ»
“যে ব্যক্তি (সাওম রেখে) মিথ্যা কথা, মিথ্যার কারবার ও মূর্খতা পরিত্যাগ করল না, তার খানা-পিনা পরিহার করার মাঝে আল্লাহর কোনো দরকার নেই।”[1]
অতএব, এ কথা নিশ্চিত হয়ে গেল যে, সাওম আদায়কারী যাবতীয় ওয়াজিব বিষয় বাস্তবায়ন করবে এবং সবধরণের হারাম থেকে দূরে থাকবে। মানুষের গীবত করবে না, মিথ্যা বলবে না, চুগলখোরী করবে না, হারাম বেচা-কেনা করবে না, ধোঁকাবাজী করবে না।
মোটকথা: চরিত্র ধ্বংসকারী অন্যায় ও অশ্লীলতা বলতে যা বুঝায় সকল প্রকার হারাম থেকে বিরত থাকবে। আর একমাস এভাবে চলতে পারলে বছরের অবশিষ্ট সময় সঠিক পথে পরিচালিত হবে ইনশাআল্লাহ্। কিন্তু আফসোসের বিষয় অধিকাংশ সাওম আদায়কারী রামাযানের সাথে অন্য মাসের কোনো পার্থক্য করে না। অভ্যাস অনুযায়ী ফরয কাজে উদাসীনতা প্রদর্শন করে, হালাল-হারামে কোনো পার্থক্য নেই। তাকে দেখলে বুঝা যাবে না তার মধ্যে সিয়ামের মর্যাদার কোনো মূল্য আছে। অবশ্য এ সমস্ত বিষয় সিয়ামকে ভঙ্গ করে দিবে না। কিন্তু নিঃসন্দেহে তার ছাওয়াব বিনষ্ট করে দিবে।
>উত্তর: বিষয়টি মহাকাশ গবেষণার দিক থেকে অসম্ভব। ইমাম ইবন তাইমিয়া রহ. বলেন, চন্দ্র উদয়ের স্থান বিভিন্ন হয়ে থাকে। এ বিষয়ে অভিজ্ঞ বিদ্বানগণ ঐকমত্য। আর এ বিভিন্নতার দাবী হচ্ছে প্রত্যেক এলাকায় ভিন্ন রকম বিধান হবে। একথার সপক্ষে দলীল কুরআন হাদীস ও সাধারণ যুক্তি।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,فَمَن شَهِدَ مِنكُمُ ٱلشَّهۡرَ فَلۡيَصُمۡهُۖ “অতএব তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এ মাসে উপস্থিত হবে, সে যেন সিয়াম পালন করে।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ১৮৫] যদি পৃথিবীর শেষ সীমান্তের লোকেরা এ মাসে উপস্থিত না হয় অর্থাৎ চাঁদ না দেখে আর মক্কার লোকেরা চাঁদ দেখে, তবে কীভাবে এ আয়াত তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে যারা কিনা চাঁদই দেখে নি। আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, صُومُوا لِرُؤْيَتِهِ وَأَفْطِرُوا لِرُؤْيَتِهِ “তোমরা চাঁদ দেখে সাওম রাখ, চাঁদ দেখে সাওম ভঙ্গ কর।”[1] মক্কার অধিবাসীগণ যদি চাঁদ দেখে তবে পাকিস্তান এবং তার পূর্ববর্তী এলাকার অধিবাসীদের কীভাবে আমরা বাধ্য করতে পারি যে তারাও সিয়াম পালন করবে? অথচ আমরা জানি যে, তাদের আকাশে চাঁদ দেখা যায় নি। আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিয়ামের বিষয়টি চাঁদের সাথে সংশ্লিষ্ট করে দিয়েছেন।
যুক্তিগত দলীল হচ্ছে, বিশুদ্ধ ক্বিয়াস; যার বিরোধিতা করার অবকাশ নেই। আমরা ভালোভাবে অবগত যে, পশ্চিম এলাকার অধিবাসীদের আগেই পূর্ব এলাকার অধিবাসীদের নিকট ফজর উদিত হয়। এখন পূর্ব এলাকায় ফজর উদিত হলে কি আমরা পশ্চিম এলাকার লোকদের বাধ্য করব একই সাথে খানা-পিনা থেকে বিরত হতে? অথচ তাদের ওখানে এখনও রাতের অনেক অংশ বাকী আছে? উত্তর: কখনই না। সূর্য যখন পূর্ব এলাকার অধিবাসীদের আকাশে অস্তমিত হয়, তখন পশ্চিম এলাকার দিগন্তে তো সূর্য দেখাই যাচ্ছে তাদেরকে কি আমরা ইফতার করতে বাধ্য করব? উত্তর: অবশ্যই না। অতএব, চন্দ্রও সম্পূর্ণরূপে সূর্যের মতই। চন্দ্রের হিসাব মাসের সাথে সংশ্লিষ্ট। আর সূর্যের হিসাব দিনের সাথে সংশ্লিষ্ট। আল্লাহ বলেছেন,
أُحِلَّ لَكُمۡ لَيۡلَةَ ٱلصِّيَامِ ٱلرَّفَثُ إِلَىٰ نِسَآئِكُمۡۚ هُنَّ لِبَاسٞ لَّكُمۡ وَأَنتُمۡ لِبَاسٞ لَّهُنَّۗ عَلِمَ ٱللَّهُ أَنَّكُمۡ كُنتُمۡ تَخۡتَانُونَ أَنفُسَكُمۡ فَتَابَ عَلَيۡكُمۡ وَعَفَا عَنكُمۡۖ فَٱلۡـَٰٔنَ بَٰشِرُوهُنَّ وَٱبۡتَغُواْ مَا كَتَبَ ٱللَّهُ لَكُمۡۚ وَكُلُواْ وَٱشۡرَبُواْ حَتَّىٰ يَتَبَيَّنَ لَكُمُ ٱلۡخَيۡطُ ٱلۡأَبۡيَضُ مِنَ ٱلۡخَيۡطِ ٱلۡأَسۡوَدِ مِنَ ٱلۡفَجۡرِۖ ثُمَّ أَتِمُّواْ ٱلصِّيَامَ إِلَى ٱلَّيۡلِۚ وَلَا تُبَٰشِرُوهُنَّ وَأَنتُمۡ عَٰكِفُونَ فِي ٱلۡمَسَٰجِدِۗ تِلۡكَ حُدُودُ ٱللَّهِ فَلَا تَقۡرَبُوهَاۗ كَذَٰلِكَ يُبَيِّنُ ٱللَّهُ ءَايَٰتِهِۦ لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمۡ يَتَّقُونَ [البقرة: ١٨٧]
“সিয়ামের রাতে স্ত্রীর সাথে সহবাস করা তোমাদের জন্য বৈধ করা হয়েছে; তারা তোমাদের জন্য আবরণ এবং তোমরা তাদের জন্য আবরণ। তোমরা যে নিজেদের খিয়ানত করছিলে, আল্লাহ তা পরিজ্ঞাত আছেন। এ জন্যে তিনি তোমাদেরকে ক্ষমা করলেন এবং তোমাদের (ভার) লাঘব করে দিলেন। অতএব, এক্ষণে তোমরা (সিয়ামের রাত্রেও) তাদের সাথে সহবাসে লিপ্ত হতে পার এবং আল্লাহ তোমাদের জন্য যা লিপিবদ্ধ করেছেন তা অনুসন্ধান কর এবং প্রত্যুষে (রাতের) কালো রেখা হতে (ফজরের) সাদা রেখা প্রকাশিত হওয়া পর্যন্ত তোমরা খাও ও পান কর; অতঃপর রাত্রি সমাগম পর্যন্ত তোমরা সাওম পূর্ণ কর। তোমরা মসজিদে ই‘তিকাফ করার সময় (স্ত্রীদের) সাথে সহবাস করবে না; এটাই আল্লাহর সীমা। অতএব, তোমরা তার নিকটেও যাবে না। এভাবে আল্লাহ মানবমন্ডলীর জন্যে তাঁর নিদর্শনসমূহ বিবৃত করেন, যেন তারা সংযত হয়।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ১৮৭]
সেই আল্লাহই বলেন, فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمْ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ “অতএব তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এ মাসে উপস্থিত হবে, সে যেন সিয়াম পালন করে।” অতএব, যুক্তি ও দলীলের নিরীখে সিয়াম ও ইফতারের ক্ষেত্রে প্রত্যেক স্থানের জন্য আলাদা বিধান হবে। যার সম্পর্ক হবে বাহ্যিক আলামত বা চিহ্ন দ্বারা যা আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সুন্নাতে নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আর তা হচ্ছে চাঁদ প্রত্যক্ষ করা এবং সূর্য বা ফজর প্রত্যক্ষ করা।
উত্তর: কোনো মানুষ যদি এক ইসলামী রাষ্ট্র থেকে অপর ইসলামী রাষ্ট্রে গমণ করে আর উক্ত রাষ্ট্রে সিয়াম ভঙ্গের সময় না হয়ে থাকে, তবে সে তাদের সাথে সিয়াম চালিয়ে যাবে, যে পর্যন্ত না তারা সিয়াম ভঙ্গ করে। কেননা মানুষ যখন সাওম রাখে তখন সাওম রাখতে হবে, মানুষ যখন সাওম ভঙ্গ করে তখন সাওম ভঙ্গ করতে হবে। মানুষ যেদিন কুরবানীর ঈদ করে সেদিন কুরবানীর ঈদ করবে। যদিও তার একদিন বা দু’দিন বেশি হয়ে যায় তার জন্য এ বিধান প্রযোজ্য হবে। যেমন, কোনো লোক সাওম রেখে পশ্চিম দিকের কোনো দেশে ভ্রমণে শুরু করল। সেখানে সূর্য অস্ত যেতে দেরী হচ্ছে। তখন সে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবশ্যই দেরী করবে। যদিও সময় সাধারণ দিনের চেয়ে দু’ঘন্টা বা তিন ঘন্টা বা তার চাইতে বেশি হয়।
দ্বিতীয় শহরে সে যখন পৌঁছেছে তখন সেখানে ঈদের চাঁদ দেখা যায় নি। অতএব, সে অপেক্ষা করবে। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে চাঁদ না দেখে সাওম রাখতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন,صُومُوا لِرُؤْيَتِهِ وَأَفْطِرُوا لِرُؤْيَتِه “তোমরা চাঁদ দেখে সাওম রাখ, চাঁদ দেখে সাওম ভঙ্গ কর।”[1]
এর বিপরীত কেউ যদি এমন দেশে সফর করে যেখানে নিজের দেশের পূর্বে চাঁদ দেখা গেছে (যেমন, কেউ বাংলাদেশ থেকে সঊদী আরব সফর করে) তবে সে ঐ দেশের হিসাব অনুযায়ী সাওম ভঙ্গ করবে এবং ঈদের সালাত পড়ে নিবে। আর যে কটা সিয়াম বাকী থাকবে তা রামাযান শেষে কাযা আদায় করে নিবে। চাই একদিন হোক বা দু‘দিন। কেননা আরবী মাস ২৯ দিনের কম হবে না বা ৩০ দিনের বেশি হবে না। ২৯ দিন পূর্ণ না হলেও সাওম ভঙ্গ করবে এজন্য যে, চাঁদ দেখা গেছে। আর চাঁদ দেখা গেলে তো সাওম ভঙ্গ করা আবশ্যক। কিন্তু যেহেতু একটি সাওম কম হলো তাই রামাযান শেষে তা কাযা করতে হবে। কেননা মাস ২৮ দিনে হয় না।
কিন্তু পূর্বের মাসআলাটি এর বিপরীত। নতুন চাঁদ না দেখা পর্যন্ত সাওম ভঙ্গ করা জায়েয নয়। কেননা নতুন চাঁদ না উঠা পর্যন্ত রামাযান মাস বহাল। যদিও দু‘একদিন বেশি হয়ে যায় তাতে কোনো অসুবিধা নেই। সেটা এক দিনে কয়েক ঘন্টা বৃদ্ধি হওয়ার মত। (অতিরিক্ত সাওম নফল হিসেবে গণ্য হবে।)
উত্তর: আমি যেটা মনে করি, কাজ করার কারণে সাওম ভঙ্গ করা জায়েয নয়, হারাম। সাওম রেখে কাজ করা যদি সম্ভব না হয়, তবে রামাযান মাসে ছুটি নিবে অথবা কাজ কমিয়ে দিবে, যাতে করে রামাযানের সিয়াম পালন করা সম্ভব হয়। কেননা রামাযানের সিয়াম ইসলামের অন্যতম একটি রুকন। যার মধ্যে শিথীলতা করা জায়েয নয়।
উত্তর: তার ওপর আবশ্যক হচ্ছে, ঋতু অবস্থায় যে কয়দিনের সিয়াম আদায় করেছে সেগুলোর কাযা আদায় করা। কেননা ঋতু অবস্থায় সিয়াম পালন করলে বিশুদ্ধ হবে না এবং গ্রহণীয় হবে না। যদিও তা অজ্ঞতাবশতঃ হয়ে থাকে। তাছাড়া পরবর্তীতে যে কোনো সময় তা কাযা করা সম্ভব। কাযা আদায় করার জন্য নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই।
এর বিপরীত আরেকটি মাসআলা হচ্ছে, অল্প বয়সে জনৈক বালিকা ঋতুবতী হয়ে গেছে। কিন্তু লজ্জার কারণে বিষয়টি কারো সামনে প্রকাশ করে নি এবং তার সিয়ামও পালন করে নি। এর ওপর ওয়াজিব হচ্ছে, উক্ত মাসের সিয়াম কাযা আদায় করা। কেননা নারী ঋতুবতী হয়ে গেলেই প্রাপ্ত বয়স্ক হয়ে যায় এবং শরী‘আতের যাবতীয় বিধি-বিধান পালন করা তার ওপর ফরয হয়ে যায়।
উত্তর: যে ব্যক্তি রামাযানের সিয়াম পরিত্যাগ করে এ যুক্তিতে যে, সে নিজের এবং পরিবারের জীবিকা উপার্জনে ব্যস্ত। সে যদি এ তা’বীল বা ব্যাখ্যা করে যে, অসুস্থ ব্যক্তি যেমন সাওম ভঙ্গ না করলে বেঁচে থাকতে অক্ষম তেমনি আমিও তো দরিদ্র অভাবী, জীবিকা উপার্জন করতে হলে আমাকে সাওম ভঙ্গ করতে হবে, তবে এ যুক্তি খোঁড়া এবং নিঃসন্দেহে এ ব্যক্তি মূর্খ। অতএব, অজ্ঞতার কারণে এবং অপব্যাখ্যার কারণে সে উক্ত সময়ের কাযা আদায় করবে যদি সে জীবিত থাকে। জীবিত না থাকলে তার পরিবার তার পক্ষ থেকে কাযা আদায় করে দিবে। কেউ কাযা আদায় না করলে তার পক্ষ থেকে প্রতিদিনের বিনিময়ে একজন করে মিসকীনকে খাদ্য খাওয়াবে।
কিন্তু যদি কোনো ধরণের ব্যাখ্যা না করে ইচ্ছাকৃতভাবে সিয়াম পরিত্যাগ করে থাকে, তবে বিদ্বানদের মতামতসমূহের মধ্যে থেকে বিশুদ্ধ মত হচ্ছে, সময়ের সাথে সংশ্লিষ্ট ইবাদতসমূহ বিনা ওযরে ইচ্ছাকৃতভাবে সময় অতিবাহিত করে আদায় করলে তা কবূল হবে না। তাই এ লোকের ওপর আবশ্যক হচ্ছে, আল্লাহর কাছে তওবা করা, নেক আমল ও নফল ইবাদতসমূহ বেশি বেশি সম্পাদন করা ও ইস্তেগফার করা। এর দলীল হচ্ছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,مَنْ عَمِلَ عَمَلًا لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدّ “যে ব্যক্তি এমন আমল করবে যাতে আমাদের নির্দেশনা নেই। তবে তা প্রত্যাখ্যাত।”[1] সময়ের সাথে নির্দিষ্ট ইবাদতসমূহ যেমন সময়ের পূর্বে আদায় করলে কবূল হবে না। অনুরূপভাবে সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পরও তা গ্রহণীয় হবে না। কিন্তু যদি অজ্ঞতা বা ভুলের কোনো ওযর থাকে, তবে ভুল সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَنْ نَسِيَ صَلَاةً أو نام عنها فَلْيُصَلِّهَا إِذَا ذَكَرَهَا لَا كَفَّارَةَ لَهَا إِلَّا ذَلِكَ»
“যে ব্যক্তি সালাত আদায় না করে ঘুমিয়ে থাকে বা ভুলে যায়, তবে স্মরণ হলেই সে তা আদায় করবে। এটাই তার কাফফারা।”[2]
[2] সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: মসজিদ ও সালাতের স্থান, অনুচ্ছেদ: ছুটে যাওয়া সালাত কাযা আদায় করা।
উত্তর: সাওম ভঙ্গের কারণসমূহ হচ্ছেঃ
১) অসুস্থতা, ২) সফর। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ বলেন,
﴿فَمَن كَانَ مِنكُم مَّرِيضًا أَوۡ عَلَىٰ سَفَرٖ فَعِدَّةٞ مِّنۡ أَيَّامٍ أُخَرَۚ﴾ [البقرة: ١٨٤]
“আর যে ব্যক্তি অসুস্থ হবে অথবা সফরে থাকবে (সে সাওম ভঙ্গ করে) অন্য দিনে তা কাযা আদায় করে নিবে।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ১৮৫]
৩) গর্ভবতী নারীর নিজের বা শিশুর জীবনের আশংকা করলে সাওম ভঙ্গ করবে।
৪) সন্তানকে দুগ্ধদানকারীনী নারী যদি সাওম রাখলে নিজের বা সন্তানের জীবনের আশংকা করে তবে সাওম ভঙ্গ করবে।
৫) কোনো বিপদগ্রস্ত মানুষকে বাঁচাতে গিয়ে সাওম ভঙ্গ করা: যেমন পানিতে ডুবন্ত ব্যক্তিকে উদ্ধার, আগুন থেকে বাঁচাতে গিয়ে দরকার হলে সাওম ভঙ্গ করা।
৬) আল্লাহর পথে জিহাদে থাকার সময় শরীরে শক্তি বজায় রাখার জন্য সাওম ভঙ্গ করা। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা বিজয়ের সময় সাহাবীগণকে বলেছিলেন,إِنَّكُمْ مُصَبِّحُو عَدُوِّكُمْ وَالْفِطْرُ أَقْوَى لَكُمْ فَأَفْطِرُوا “আগামীকাল তোমরা শত্রুর মোকাবেলা করবে, সাওম ভঙ্গ করলে তোমরা অধিক শক্তিশালী থাকবে, তাই তোমরা সাওম ভঙ্গ কর।”[1]
বৈধ কোনো কারণে সাওম ভঙ্গ করলে দিনের বাকী অংশ সাওম অবস্থায় থাকা আবশ্যক নয়। কেননা সে তো গ্রহণযোগ্য ওযরের কারণেই সাওম ভঙ্গ করেছে। এজন্য এ মাসআলায় বিশুদ্ধ কথা হচ্ছেঃ কোনো রুগী যদি অসুস্থতার কারণে দিনে সাওম ভঙ্গ করে আর দিন শেষ হওয়ার আগেই সুস্থ হয়ে যায়, তবে দিনের বাকী অংশ সাওম অবস্থায় থাকার কোনো আবশ্যকতা নেই। কোনো মুসাফির যদি সাওম ভঙ্গ অবস্থায় দিন থাকতেই সফর থেকে ফিরে আসে তারও দিনের বাকী অংশ সাওম অবস্থায় থাকার আবশ্যকতা নেই। অনুরূপ বিধান ঋতুবতী নারীর। কেননা এরা সবাই বৈধ কারণে সাওম ভঙ্গ করেছে। তাই ঐ দিবস তাদের জন্যই। তাতে তাদের প্রতি সিয়ামের আবশ্যকতা নেই। কেননা শরী‘আত তাদেরকে সাওম ভঙ্গের অনুমতি প্রদান করে আবার তা আবশ্যক করবে না।এর বিপরীত মাসআলা হচ্ছে, রামাযান মাসের চাঁদ দেখা গেছে একথা যদি দিনের বেলায় প্রমাণিত হয়, তবে খবর পাওয়ার সাথে সাথে সাওমের নিয়ত করে নিতে হবে এবং দিনের বাকী সময় সাওম অবস্থায় কাটাতে হবে। উভয় মাসআলায় পার্থক্য সুস্পষ্ট। কেননা যখন কিনা দিনের বেলায় রামাযান মাস শুরু হওয়ার কথা প্রমাণিত হয়েছে, তখন তাদের ওপর সে দিনের সিয়াম পালন করা ওয়াজিব হয়ে গেছে। কিন্তু না জানার কারণে তাদের ওযর গ্রহণযোগ্য এবং তাদের সিয়াম বিশুদ্ধ। এ কারণে তারা যদি জানতে পারত যে আজ রামাযান শুরু হয়েছে, তবে সাওম রাখা তাদের জন্য আবশ্যক হত।
>উত্তর: যখন সে জানতে পারবে তখনই সিয়ামের নিয়ত করে ফেলবে এবং সিয়াম পালন করবে। অধিকাংশ বিদ্বানের মতে এ দিনটির সিয়াম পরে সে কাযা আদায় করবে। তবে ইমাম ইবন তায়মিয়া রহ. এতে বিরোধিতা করেছেন। তিনি বলেন, জানার সাথে নিয়তের সম্পর্ক। এ লোক তো জানতেই পারেনি। অতএব, তার ওযর গ্রহণযোগ্য। সে জানতে পারলে রাতে কখনই সিয়ামের নিয়ত করা ছাড়তো না, কিন্তু সে তো ছিল অজ্ঞ। আর অজ্ঞ ব্যক্তির ওযর গ্রহণযোগ্য। অতএব, জানার পর যদি সাওমের নিয়ত করে ফেলে তবে সিয়াম বিশুদ্ধ। তাকে কাযা আদায় করতে হবে না।
অধিকাংশ বিদ্বান বলেন, তাকে উক্ত দিনের সাওম রাখা আবশ্যক এবং তার কাযা আদায় করাও আবশ্যক। এর কারণ হিসেবে বলেন, এ লোকের দিনের একটি অংশ নিয়ত ছাড়া অতিবাহিত হয়েছে। তাই তাকে কাযা আদায় করতে হবে। আমি মনে করি, সতর্কতাবশতঃ উক্ত দিনের সাওম কাযা করে নেওয়াই উচিৎ।
উত্তর: না, দিনের বাকী অংশ সিয়াম অবস্থায় থাকা আবশ্যক নয়। তবে রামাযান শেষে উক্ত দিবসের কাযা তাকে আদায় করতে হবে। কেননা শরী‘আত অনুমদিত কারণেই সে সিয়াম ভঙ্গ করেছে। উদাহরণস্বরূপ অসুস্থ ব্যক্তির অপারগতার কারণে শরী‘আত তাকে ঔষুধ সেবনের অনুমতি দিয়েছে। ঔষুধ সেবন করা মানেই সাওম ভঙ্গ। অতএব, পূর্ণ এ দিনটির সিয়াম তার ওপর আবশ্যক নয়। দিনের বাকী অংশ সাওম অবস্থায় থাকার অবশ্যকতায় শরী‘আতসম্মত কোনো ফায়েদা নেই। যেখানে কোনো উপকার নেই তা আবশ্যক করাও চলে না।
উদাহরণস্বরূপ জনৈক ব্যক্তি দেখল একজন লোক পানিতে ডুবে যাচ্ছে। সে বলছে আমি যদি পানি পান করি তবে এ ব্যক্তিকে উদ্ধার করতে পারব। পানি পান না করলে তাকে বাঁচানো আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। এ অবস্থায় সে পানি পান করবে এবং তাকে পানিতে ডুবা থেকে উদ্ধার করবে। অতঃপর দিনের অবশিষ্ট অংশ খানা-পিনা করবে। এ দিনের সম্মান তার জন্য আর নেই। কেননা শরী‘আতের দাবী অনুযায়ীই সাওম ভঙ্গ করা তার জন্য বৈধ হয়েছে। তাই দিনের বাকী অংশ সাওম রাখা আবশ্যক নয়।
যদি কোনো লোক অসুস্থ থাকে তাকে কি আমরা বলব, ক্ষুধার্ত না হলে খানা খাবে না? পিপাসিত না হলে পানি পান করবে না? অর্থাৎ প্রয়োজন না হলে খানা-পিনা করবে না? না, এরূপ বলব না। কেননা এ লোককে তো সাওম ভঙ্গের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। অতএব, শর‘ঈ দলীলের ভিত্তিতে রামাযানের সাওম ভঙ্গকারী প্রত্যেক ব্যক্তির দিনের অবশিষ্ট অংশ সাওম অবস্থায় অতিবাহিত করা আবশ্যক নয়।
এর বিপরীত মাসআলায় বিপরীত সমাধান। অর্থাৎ বিনা ওযরে যদি সাওম ভঙ্গ করে তবে তাকে দিনের অবশিষ্ট অংশ সাওম অবস্থায় থাকতে হবে। কেননা সাওম ভঙ্গ করা তার জন্য বৈধ ছিল না। শরী‘আতের অনুমতি ছাড়াই সে এদিনের সম্মান নষ্ট করেছে। অতএব, দিনের বাকী অংশ সিয়াম পালন করা যেমন আবশ্যক তেমনি কাযা আদায় করাও যরূরী।
উত্তর: আল্লাহ বলেন,
﴿شَهۡرُ رَمَضَانَ ٱلَّذِيٓ أُنزِلَ فِيهِ ٱلۡقُرۡءَانُ هُدٗى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَٰتٖ مِّنَ ٱلۡهُدَىٰ وَٱلۡفُرۡقَانِۚ فَمَن شَهِدَ مِنكُمُ ٱلشَّهۡرَ فَلۡيَصُمۡهُۖ وَمَن كَانَ مَرِيضًا أَوۡ عَلَىٰ سَفَرٖ فَعِدَّةٞ مِّنۡ أَيَّامٍ أُخَرَۗ يُرِيدُ ٱللَّهُ بِكُمُ ٱلۡيُسۡرَ وَلَا يُرِيدُ بِكُمُ ٱلۡعُسۡرَ﴾ [البقرة: ١٨٥]
“রামাযান হচ্ছে সেই মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে কুরআন, যা মানুষের জন্য হিদায়াত এবং সত্যপথ যাত্রীদের জন্য সুস্পষ্ট পথনির্দেশ। আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে, সে এ মাসের সাওম রাখবে। আর যে লোক অসুস্থ অথবা মুসাফির অবস্থায় থাকবে, সে অন্য দিনে গণনা পূরণ করে নিবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান; তোমাদের জন্য কঠিন কামনা করেন না।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ১৮৫]
মানুষ যদি এমন রোগে আক্রান্ত হয় যা থেকে সুস্থ হওয়ার কোনো আশা নেই। তবে প্রতিদিনের বিনিময়ে একজন করে মিসকীনকে খাদ্য খাওয়াবে। খাদ্য দেওয়ার পদ্ধতি হচ্ছে, মিসকীনকে পরিমাণমত চাউল প্রদান করা এবং সাথে মাংস ইত্যাদি তরকারী হিসেবে দেওয়া উত্তম। অথবা দুপুরে বা রাতে তাকে একবার খেতে দিবে। এটা হচ্ছে ঐ রুগীর ক্ষেত্রে যার সুস্থ হওয়ার কোনো সম্ভবনা নেই। আর নারী এ ধরণের রোগে আক্রান্ত। তাই আবশ্যক হচ্ছে সে প্রতিদিনের জন্য একজন করে মিসকীনকে খাদ্য প্রদান করবে।