ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম যাকাত শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রহঃ) ৩৮ টি
প্রশ্ন: (৩৫৪) যাকাত ফরয হওয়ার শর্তাবলী কী কী?

 উত্তর: যাকাত ফরয হওয়ার শর্তাবলী নিম্নরূপ:

ক) ইসলাম

খ) স্বাধীন

গ) নিসাবের মালিক হওয়া ও তা স্থীতিশীল থাকা।

ঘ) বছর পূর্ণ হওয়া।

ইসলাম :কাফিরের ওপর যাকাত ফরয নয়। যাকাতের নামে সে প্রদান করলেও আল্লাহ তা কবুল করবেন না। আল্লাহ বলেন,

﴿وَمَا مَنَعَهُمۡ أَن تُقۡبَلَ مِنۡهُمۡ نَفَقَٰتُهُمۡ إِلَّآ أَنَّهُمۡ كَفَرُواْ بِٱللَّهِ وَبِرَسُولِهِۦ وَلَا يَأۡتُونَ ٱلصَّلَوٰةَ إِلَّا وَهُمۡ كُسَالَىٰ وَلَا يُنفِقُونَ إِلَّا وَهُمۡ كَٰرِهُونَ ٥٤﴾ [التوبة: ٥٤]

“তাদের সম্পদ ব্যয় শুধু মাত্র এ কারণে গ্রহণ করা হবে না যে, তারা আল্লাহ ও তার রাসূলের সাথে কুফুরী করেছে। অলসভঙ্গিতে ছাড়া তারা সালাতে আসে না এবং মনের অসন্তুষ্টি নিয়ে খরচ করে।” [সূরা আত-তাওবা, আয়াত: ৫৪]

কাফিরের ওপর যাকাত ফরয নয় এবং আদায় করলেও গ্রহণ করা হবে না একথার অর্থ এটা নয় যে, পরকালেও তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হবে; বরং তাকে এজন্য শাস্তি দেওয়া হবে। আল্লাহ বলেন,

﴿كُلُّ نَفۡسِۢ بِمَا كَسَبَتۡ رَهِينَةٌ ٣٨ إِلَّآ أَصۡحَٰبَ ٱلۡيَمِينِ ٣٩ فِي جَنَّٰتٖ يَتَسَآءَلُونَ ٤٠ عَنِ ٱلۡمُجۡرِمِينَ ٤١ مَا سَلَكَكُمۡ فِي سَقَرَ ٤٢ قَالُواْ لَمۡ نَكُ مِنَ ٱلۡمُصَلِّينَ ٤٣ وَلَمۡ نَكُ نُطۡعِمُ ٱلۡمِسۡكِينَ ٤٤ وَكُنَّا نَخُوضُ مَعَ ٱلۡخَآئِضِينَ ٤٥ وَكُنَّا نُكَذِّبُ بِيَوۡمِ ٱلدِّينِ ٤٦ حَتَّىٰٓ أَتَىٰنَا ٱلۡيَقِينُ ٤٧ ﴾ [المدثر: ٣٨، ٤٧]

“প্রত্যেক ব্যক্তি তার কৃতকর্মের জন্য দায়ী; কিন্তু ডান দিকস্থরা। তারা থাকবে জান্নাতে এবং পরস্পরে জিজ্ঞাসাবাদ করবে অপরাধীদের সম্পর্কে। বলবে, তোমাদেরকে কিসে জাহান্নামে প্রবেশ করিয়েছে? তারা বলবে, আমরা সালাত পড়তাম না, অভাবগ্রস্তকে আহার্য দিতাম না। আমরা সমালোচকদের সাথে সমালোচনা করতাম এবং আমরা প্রতিফল দিবসকে অস্বীকার করতাম। এমনকি আমাদের মৃত্যু এসে গেছে।” [সূরা মুদ্দাসসির: ৩৮-৪৭] এ থেকে বুঝা যায় ইসলামের বিধি-বিধান না মেনে চলার কারণে কাফিরদেরকে শাস্তি দেওয়া হবে।

স্বাধীনতা: ক্রীতদাসের কোনো সম্পদ নেই। কোনো সম্পদ থাকলেও তা তার মালিকের সম্পদ হিসেবে গণ্য হবে। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,مَنِ ابْتَاعَ عَبْدًا فَمَالُهُ لِلَّذِي بَاعَهُ إِلَّا أَنْ يَشْتَرِطَ الْمُبْتَاع “সম্পদের অধিকারী কোনো ক্রীতদাস যদি কেউ বিক্রয় করে, তবে উক্ত সম্পদের মালিকানা বিক্রেতার থাকবে। কিন্তু যদি ক্রেতা উক্ত সম্পদের শর্তারোপ করে থাকে তবে ভিন্ন কথা।”[1]

নিসাবের মালিক হওয়া: অর্থাৎ তার কাছে এমন পরিমাণ সম্পদ থাকবে, শরী‘আত যা নিসাব হিসেবে নির্ধারণ করেছে। সম্পদের প্রকারভেদ অনুযায়ী এর পরিমাণ বিভিন্নরূপ হয়ে থাকে। অতএব, মানুষের কাছে নিসাব পরিমাণ সম্পদ না থাকলে বা নেসাবের কম সম্পদ থাকলে তাতে যাকাত দিতে হবে না। কেননা তার সম্পদ কম। আর অল্প সম্পদ দ্বারা অন্যের কল্যাণ করা সম্ভব নয়।

চতুষ্পদ জন্তুর নিসাবে শুরু এবং শেষ সংখ্যার খেয়াল রাখতে হবে। কিন্তু অন্যান্য সম্পদে শুধু প্রথমে কত ছিল তার হিসাব ধর্তব্য। পরে যা অতিরিক্ত হবে তার হিসাব করে যাকাত দিতে হবে।

বছর অতিক্রান্ত হওয়া: কেননা বছর পূর্ণ না হওয়া সত্বেও যাকাত আবশ্যক করে দেওয়ার মাধ্যমে সম্পদশালীর প্রতি কঠোরতা আরোপ করা হয়। বছর পূর্তি হওয়ার পরও যাকাত বের না করলে যাকাতের হকদারদের প্রতি অবিচার করা হয়; তাদের ক্ষতি করা হয়। এ কারণে প্রজ্ঞাপূর্ণ শরী‘আত এর জন্য একটি সীমারেখা নির্ধারণ করেছে এবং এর মধ্যে যাকাতের আবশ্যকতা নির্ধারণ করেছে। আর তা হচ্ছে বছরপূর্তি। অতএব, এর মধ্যে সম্পদশালী ও যাকাতের হকদারদের মধ্যে একটি সামঞ্জস্যতা বিধান করা হয়েছে।

এ কারণে বছর পূর্ণ হওয়ার পূর্বে কোনো মানুষ যদি মারা যায় বা তার সম্পদ বিনষ্ট হয়ে যায়, তবে যাকাত রহিত হয়ে যাবে। অবশ্য তিনটি জিনিস এ বিধানের ব্যতিক্রম:

১) ব্যবসার লভ্যাংশ ২) চতুষ্পদ জন্তুর বাচ্চা ৩) উশর।ব্যবসার লভ্যাংশে ব্যবসার মূল সম্পদের সাথে যোগ করে যাকাত দিতে হবে। আর চতুস্পদ জন্তুর ভুমিষ্ট বাচ্চার যাকাত তার মায়ের সাথে মিলিত করে দিতে হবে। আর উশর অর্থাৎ যমীনে উৎপাদিত ফসল ঘরে উঠালেই যাকাত দিতে হবে।

[1] সহীহ বুখারী, কিতাবুল মুসাক্বাত, অনুচ্ছেদ: খেজুরের বাগানে কারো যদি চলার পথ থাকে বা পানির ব্যবস্থা থাকে সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: বেচা-কেনা, অনুচ্ছেদ: ফল সমৃদ্ধ যে ব্যক্তি খেজুর গাছ বিক্রয় করে।
প্রশ্ন: (৩৫৫) প্রতিমাসে প্রাপ্য বেতনের যাকাত কীভাবে প্রদান করতে হবে?

উত্তর: এক্ষেত্রে সুন্দর পন্থা হচ্ছে, প্রথম বেতনের যদি এক বছরপূর্তি হয়; তবে তার সাথে সংশ্লিষ্ট করে সবগুলোর যাকাত আদায় করে দিবে। যে বেতনে বছর পূর্ণ হয়েছে তার যাকাত সময়ের মধ্যেই আদায় করা হল। আর যাতে বছর পূর্ণ হয় নি তার যাকাত অগ্রীম আদায় হয়ে গেল। প্রতিমাসের বেতন আলাদা হিসাব রাখার চাইতে এটাই হচ্ছে সহজ পন্থা। কিন্তু দ্বিতীয় মাসের বেতন আসার আগেই যদি প্রথম মাসের বেতন খরচ হয়ে যায়, তবে তার উপর কোনো যাকাত নেই। কেননা যাকাত ওয়াজিব হওয়ার শর্ত হচ্ছে বছর পূর্ণ হওয়া।

প্রশ্ন: (৩৫৬) শিশু ও পাগলের সম্পদে কি যাকাত ওয়াজিব হবে?

উত্তর: বিষয়টি বিদ্বানদের মধ্যে মতবিরোধপূর্ণ। কেউ বলেন, নাবালেগ ও পাগলের সম্পদে যাকাত ওয়াজিব নয়। কেননা এরা তো শরী‘আতের বিধি-নিষেধ মেনে চলার বাধ্যবাধকতার বাইরে। অতএব, তাদের সম্পদে যাকাত আবশ্যক হবে না।

কোনো কোনো বিদ্বান বলেন, বরং তাদের সম্পদে যাকাত আবশ্যক হবে। আর এটাই বিশুদ্ধ মত। কেননা যাকাত সম্পদের অধিকার। মালিক কে তা দেখার বিষয় নয়। আল্লাহ বলেন, (خُذۡ مِنۡ أَمۡوَٰلِهِمۡ صَدَقَةٗ) “তাদের সম্পদ থেকে যাকাত গ্রহণ করুন।” [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ১০৩] এখানে আবশ্যকতার নির্দেশ সম্পদে করা হয়েছে। তাছাড়া মু‘আয ইবন জাবাল রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইয়ামান প্রেরণ করে বলেছিলেন,

«أَعْلِمْهُمْ أَنَّ اللَّهَ افْتَرَضَ عَلَيْهِمْ صَدَقَةً فِي أَمْوَالِهِمْ تُؤْخَذُ مِنْ أَغْنِيَائِهِمْ وَتُرَدُّ عَلَى فُقَرَائِهِمْ»

“তাদেরকে জানিয়ে দিবে আল্লাহ তাদের সম্পদে যাকাত ফরয করেছেন। ধনীদের থেকে যাকাত গ্রহণ করে তাদের মধ্যে অভাবীদের মাঝে বিতরণ করা হবে।”[1] অতএব, এ ভিত্তিতে নাবালেগ ও পাগলের সম্পদে যাকাত আবশ্যক হবে। তাদের অভিভাবক এ যাকাত বের করার দায়িত্ব পালন করবেন।

[1] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: যাকাত, অনুচ্ছেদ: যাকাত আবশ্যক হওয়া সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: ঈমান, অনুচ্ছেদ: কালেমায়ে শাহাদাত ও ইসলামী শরীয়তের প্রতি আহবান করা।
প্রশ্ন: (৩৫৭) প্রদত্ত ঋণের যাকাত আদায় করার বিধান কী?

উত্তর: সম্পদ যদি ঋণ হিসেবে অন্যের কাছে থাকে, তবে ফিরিয়ে না পাওয়া পর্যন্ত তাতে যাকাত আবশ্যক নয়। কেননা তা তার হাতে নেই। কিন্তু ঋনগ্রস্ত ব্যক্তি যদি সম্পদশালী লোক হয়, তবে প্রতি বছর তাকে (ঋণদাতাকে) যাকাত বের করতে হবে। নিজের অন্যান্য সম্পদের সাথে তার যাকাত আদায় করে দিলে যিম্মামুক্ত হয়ে যাবে। অন্যথায় তা ফেরত পাওয়ার পর হিসেব করে বিগত প্রত্যেক বছরের যাকাত আদায় করতে হবে। কেননা তা সম্পদশালী লোকের হাতে ছিল। আর তা তলব করাও সম্ভব ছিল। সুতরাং ঋণদাতার ইচ্ছাতেই চাইতে দেরী করা হয়েছে।

কিন্তু ঋণ যদি অভাবী লোকের হাতে থাকে। অথবা এমন ধনী লোকের হাতে যার নিকট থেকে উদ্ধার করা কষ্টকর, তবে তার উপর প্রতি বছর যাকাত আবশ্যক হবে না। কেননা তা হাতে পাওয়া তার জন্য অসম্ভব। কারণ আল্লাহ বলেন,

﴿وَإِن كَانَ ذُو عُسۡرَةٖ فَنَظِرَةٌ إِلَىٰ مَيۡسَرَةٖۚ﴾ [البقرة: ٢٨٠]

“যদি অভাবী হয় তবে তাকে সচ্ছলতা পর্যন্ত অবকাশ দিবে।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ২৮০] অতএব, তার জন্য সম্ভব নয় এসম্পদ পূণরুদ্ধার করা এবং তা দ্বারা উপকৃত হওয়া। কিন্তু পূণরুদ্ধার করতে পারলে বিদ্বানদের মধ্যে কেউ বলেন, তখন থেকে নতুন করে বছর গণনা শুরু করবে। আবার কেউ বলেন, বিগত এক বছরের যাকাত বের করবে এবং পরবর্তী বছর আসলে আবার যাকাত আদায় করবে। এটাই অত্যধিক সতর্ক অভিমত।

প্রশ্ন: (৩৫৮) মৃত ব্যক্তির ঋণ কি যাকাত থেকে পরিশোধ করা যাবে?

উত্তর: ইবন আবদুল বার ও আবু উবাইদা বলেন, বিদ্বানদের ইজমা' বা ঐকমত্য হচ্ছে, কোনো সম্পদ রেখে যায় নি এমন অভাবী ঋণগ্রস্ত মৃত ব্যক্তির ঋণ যাকাত দ্বারা পরিশোধ করা যাবে না। কিন্তু আসলে বিষয়টি মতবিরোধপূর্ণ। অবশ্য অধিকাংশ আলিম বলে থাকেন, যাকাত দ্বারা মৃতের ঋণ পরিশোধ করা যাবে না। কেননা মৃত ব্যক্তি তো আখিরাতে পাড়ি জমিয়েছে। ঋণের কারণে জীবিত ব্যক্তি যে ধরণের লাঞ্ছনা ও অবমাননার স্বীকার হয় মৃত ব্যক্তি এরূপ হয় না। তাছাড়া নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মৃতের ঋণ যাকাত থেকে আদায় করতেন না; বরং গনীমতের সম্পদ থেকে উক্ত ঋণ পরিশোধ করতেন। এথেকে বুঝা যায় যাকাত থেকে মৃতের ঋণ পরিশোধ করা বিশুদ্ধ নয়।

বলা হয়, মৃত ব্যক্তি যদি পরিশোধ করার নিয়ত রেখে ঋণ করে থাকে, তবে আল্লাহ তাঁর দয়া ও অনুগ্রহে তার পক্ষ থেকে তা আদায় করে দিবেন। কিন্তু গ্রহণ করার সময় পরিশোধের নিয়ত না থাকলে, অপরাধী হিসেবে তার জিম্মায় তা অবশিষ্ট থাকবে এবং ক্বিয়ামত দিবসে তা পরিশোধ করবে। আমার মতে যাকাত থেকে তার ঋণ পরিশোধ করার মতের চেয়ে এ মতটিই অধিক পছন্দনীয়।

এমনও বলা হয়, প্রয়োজনীয়তার দিকে লক্ষ্য রেখে জীবিত ও মৃতের মধ্যে পার্থক্য করতে হবে। জীবিত লোকদের অভাব, ঋণ, জিহাদ প্রভৃতি ক্ষেত্রে যদি যাকাতের অধিক প্রয়োজনীয়তা থাকে, তবে তাদের বিষয়টি অগ্রগণ্য। কিন্তু তাদের এধরণের কোনো প্রয়োজনীয়তা না থাকলে, সহায়-সম্বলহীন মৃত ব্যক্তির রেখে যাওয়া ঋণ যাকাত দ্বারা পরিশোধ করতে কোনো অসুবিধা নেই। সম্ভবতঃ এটি মধ্যমপন্থী মত।

প্রশ্ন: (৩৫৯) ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির সাদকা করা কি ঠিক হবে? ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি কোন ধরণের শরী‘আতের দাবী থেকে মুক্তি পাবে?

উত্তর: শরী‘আত নির্দেশিত একটি খরচ হচ্ছে দান-সাদকা। সাদকা জায়গা মত দেওয়া হলে তা হবে আল্লাহর বান্দাদের উপর অনুগ্রহ। সাদকাকারী ছাওয়াব পাবে, কিয়ামত দিবসে সদকার ছায়ার নিচে অবস্থান করবে। সাদকা কবূল হওয়ার শর্ত পূর্ণ করে যাকেই দান করা হোক তার দান গ্রহণ করা হবে। চাই দানকারী ঋণগ্রস্ত হোক বা না হোক। ইখলাস বা একনিষ্ঠতার সাথে, হালাল উপার্জন থেকে জায়গা মত দান করলেই শরী‘আতের দলীল অনুযায়ী তার দান কবূল হবে। দানকারী ঋণমুক্ত হতে হবে এমন কোনো শর্ত নেই। কিন্তু কোনো ব্যক্তি যদি এমন ঋণে ডুবে থাকে যা পরিশোধ করার জন্য তার সমস্ত সম্পত্তি দরকার, তবে এটা কোনো যুক্তিসংগত ও বিবেকসম্মত কথা নয় যে, জরুরি ও আবশ্যক ঋণ পরিশোধ না করে সে নফল দান-সাদকা করবে! অতএব, তার উপর আবশ্যক হচ্ছে, প্রথমে ফরয কাজ করা তারপর নফল কাজ করা। তারপরও ঐ অবস্থায় দান করলে তার ব্যাপারে আলিমগণ মতভেদ করেছেন। কেউ বলেন, এরূপ করা জায়েয নয়। কেননা এতে পাওনাদারের ক্ষতি করা হয় এবং নিজের জিম্মায় আবশ্যিক ঋণের বোঝা বহন করে রাখা হয়। আবার কেউ বলেন, দান করা জায়েয আছে কিন্তু উত্তমতার বিপরীত।

মোটকথা, যে ব্যক্তির আপাদমস্তক ঋণে জর্জরিত আর পরিশোধ করার জন্য নিজের সমস্ত সম্পত্তি দরকার, তার পক্ষে দান-সাদকা করা উচিৎ নয়। কেননা নফল কাজের চাইতে ওয়াজিব কাজের গুরুত্ব বেশি এবং তা অগ্রগণ্য।

আর ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি ঋণ মুক্ত হওয়া পর্যন্ত কোন ধরণের শরী‘আতের দাবী থেকে মুক্তি পাবে?

তার মধ্যে একটি হচ্ছে হজ। ঋণ পরিশোধ করা পর্যন্ত ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির ওপর হজের দায়িত্ব নেই বা হজ ফরয নয়।

কিন্তু যাকাতের ব্যাপারে বিদ্বানগণ মতভেদ করেছেন। ঋণগ্রস্তের উপর থেকে যাকাতের আবশ্যকতা রহিত হবে কি হবে না?

একদল আলিম বলেছেন, ঋণ পরিমাণ সম্পদে যাকাতের আবশ্যকতা রহিত হবে। চাই উক্ত সম্পদ প্রকাশ্য হোক বা অপ্রকাশ্য।

আরেক দল আলিম বলেন, তার উপর কোনো সময় যাকাতের আবশ্যকতা রহিত হবে না। হাতে যে সম্পদই থাক না কেন হিসেব করে তার যাকাত বের করতে হবে। যদিও তার উপর এমন ঋণ থাকে যা পরিশোধ করে দিলে অবশিষ্ট সম্পদ নিসাব পরিমাণ হয় না।

অন্যদল আলিম বলেন, বিষয়টি ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। তার সম্পদ যদি অপ্রকাশ্য ধরণের হয় যা প্রত্যক্ষ নয় গোপন থাকে। যেমন, টাকা-পয়সা এবং ব্যবসায়িক পণ্য, তবে তাতে ঋণ পরিমাণ সম্পদে যাকাত রহিত হবে। আর সম্পদ যদি প্রকাশ্য ধরণের হয়। যেমন, পশু, যমীন থেকে উৎপাদিত ফসল ইত্যাদি, তবে তাতে যাকাত রহিত হবে না।

আমার মতে বিশুদ্ধ কথা হচ্ছে: কোনো সময়ই যাকাত রহিত হবে না। চাই সম্পদ প্রকাশ্য হোক বা অপ্রকাশ্য। তার হাতে যে সম্পদ আছে তা যদি যাকাতের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং নিসাব পরিমাণ হয়, তবে তার যাকাত দিতে হবে। যদিও তার উপর ঋণ থাকে। কেননা যাকাত হচ্ছে সম্পদের অধিকার। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿خُذۡ مِنۡ أَمۡوَٰلِهِمۡ صَدَقَةٗ تُطَهِّرُهُمۡ وَتُزَكِّيهِم بِهَا وَصَلِّ عَلَيۡهِمۡۖ إِنَّ صَلَوٰتَكَ سَكَنٞ لَّهُمۡۗ وَٱللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ ١٠٣ ﴾ [التوبة: ١٠٣]

“(হে নবী) আপনি তাদের ধন-সম্পদ থেকে যাকাত গ্রহণ করুন, যা দ্বারা আপনি তাদেরকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করবেন, আর তাদের জন্য দো‘আ করুন। নিঃসন্দেহে আপনার দো‘আ হচ্ছে তাদের জন্য শান্তির কারণ। আর আল্লাহ খুব শোনেন, খুব জানেন।” [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ১০৩] তাছাড়া মু‘আয ইবন জাবাল রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইয়ামান প্রেরণ করে বলেছিলেন,

«أَعْلِمْهُمْ أَنَّ اللَّهَ افْتَرَضَ عَلَيْهِمْ صَدَقَةً فِي أَمْوَالِهِمْ تُؤْخَذُ مِنْ أَغْنِيَائِهِمْ وَتُرَدُّ عَلَى فُقَرَائِهِمْ»

“তাদেরকে জানিয়ে দিবে আল্লাহ তাদের সম্পদে যাকাত ফরয করেছেন। ধনীদের থেকে যাকাত গ্রহণ করে তাদের মধ্যে অভাবীদের মাঝে বিতরণ করা হবে।”[1] কুরআন-সুন্নাহর এ দলীলের ভিত্তিতে বিষয় দু’টি আলাদা হয়ে গেল। অতএব, যাকাত ও ঋণের মাঝে কোনো দ্বন্দ্ব থাকল না। কেননা ঋণ হচ্ছে ব্যক্তির যিম্মায় আবশ্যক। আর যাকাত সম্পদে আবশ্যক। প্রত্যেকটি বিষয় তার নির্দিষ্ট স্থানে আবশ্যক হবে। কেউ কারো স্থলাভিষিক্ত হবে না। অতএব, ঋণ ব্যক্তির যিম্মায় বাকী থাকবে। আর সময় হলে শর্ত পূর্ণ হলে অবশ্যই যাকাত বের করে দিবে।

[1] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: যাকাত, অনুচ্ছেদ: যাকাত আবশ্যক হওয়া সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: ঈমান, অনুচ্ছেদ: কালেমায়ে শাহাদাত ও ইসলামী শরী‘আতের প্রতি আহ্বান করা।
প্রশ্ন: (৩৬০) জনৈক ব্যক্তি চার বছর যাকাত আদায় করে নি। এখন তার করণীয় কী?

উত্তর: যাকাত আদায়ে বিলম্ব করার কারণে এ লোক গুনাহ্গার। কেননা মানুষের ওপর ওয়াজিব হচ্ছে যাকাত ওয়াজিব হওয়ার সাথে সাথে দেরী না করে যাকাত আদায় করে দেওয়া। আবশ্যিক বিষয়ের মূল হচ্ছে, সময় হওয়ার সাথে সাথে দেরী না করে তা সম্পাদন করে ফেলা। এ লোকের উচিৎ আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা, তওবা করা। তার ওপর আবশ্যক হচ্ছে, বছরগুলোর হিসেব করে যাকাত আদায় করে দেওয়া। উক্ত যাকাতের কোনো কিছুই তার থেকে রহিত হবে না। তাকে তওবা করতে হবে এবং দ্রুত যাকাত আদায় করে দিতে হবে। যাতে করে দেরী করার কারণে গুনাহ আরো বাড়তে না থাকে।

প্রশ্ন: (৩৬১) বছরের অর্ধেক সময় পশু চারণ ভূমিতে চরে খেলে তাতে কি যাকাত দিতে হবে?

উত্তর: যে পশু বছরের পূর্ণ অর্ধেক সময় চারণ ভূমিতে চরে খায় তাতে যাকাত দিতে হবে না। কেননা পশু সায়েমা না হলে তাতে যাকাত ওয়াজিব হয় না। সায়েমা সেই পশুকে বলা হয়, যা বছরের পূর্ণ সময় বা বছরের অধিকাংশ সময় মাঠে-ঘাটে চরে বেড়ায় ও তৃণ-লতা খেয়ে বড় হয়। কিন্তু বছরের কিছু সময় বা অর্ধেক সময় চরে খেলে তাতে যাকাত আবশ্যক নয়। অবশ্য যদি উহা ব্যবসার জন্য হয়ে থাকে, তখন তার বিধান ভিন্ন। ব্যবসায়িক পণ্য হিসেবে যাকাত বের করতে হবে। তখন বছর পূর্ণ হলে মূল্য নির্ধারণ করে ২.৫% (আড়াই শতাংশ) হারে যাকাত বের করবে।

প্রশ্ন: (৩৬২) তিন বছর আগে আমি বাড়ী ক্রয় করেছি। (আল-হামদু লিল্লাহ) বাড়ীর সীমানার মধ্যে তিনটি খেজুর গাছ আছে। প্রত্যেক গাছে প্রচুর পরিমাণে খেজুর পাওয়া যায়। এ খেজুরে কি যাকাত দিতে হবে? যাকাত দেওয়া ওয়াজিব হয়ে থাকলে তো এ সম্পর্কে অধিকাংশ মানুষই অজ্ঞ। এখন আমার প্রশ্ন হচ্ছে:
১) খেজুরগুলো নিসাব পরিমাণ হলো কি না তা জানার উপায় কী? আমি তো বিভিন্ন সময় খেজুর পেড়ে থাকি?
২) কীভাবে যাকাতের পরিমাণ নির্ধারণ করতে হবে? প্রত্যেক প্রকার খেজুরের যাকাত কি আলাদাভাবে বের করতে হবে? নাকি সবগুলো একত্রিত করে যে কোনো এক প্রকার থেকে যাকাত দিলেই চলবে?
৩) খেজুর থেকে যাকাত না দিয়ে এর বিনিময় মূল্য দিলে চলবে কী?
৪) বিগত বছরগুলোতে তো যাকাত বের করিনি। এখন আমি কি করব?

উত্তর: বাড়ির আশে পাশে খেজুর গাছে প্রাপ্ত খেজুর থেকে যে যাকাত আবশ্যক হতে পারে এ ব্যাপারে অধিকাংশ মানুষ জ্ঞান রাখে না প্রশ্নকারীর এ কথা সত্য ও সঠিক। কারো বাড়িতে সাতটি কারো দশটি কারো কম বা বেশি সংখ্যার গাছ থাকে। এগুলোর ফল নিসাব পরিমাণও হয়ে যায়। কিন্তু অধিকাংশ লোক জানে না যে এতেও যাকাত দিতে হবে। তাদের ধারণা যে, বাগানের খেজুরেই শুধু যাকাত দেওয়া লাগবে। অথচ খেজুর বৃক্ষ বাগানে হোক বা বাড়ীতে হোক, উৎপাদিত ফসল নিসাব পরিমাণ হলেই তাতে যাকাত দিতে হবে। এ ভিত্তিতে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন একজন মানুষ অনুমান করবে, এ গাছগুলোতে যাকাতের নিসাব পরিমাণ খেজুর আছে কি না? যদি নিসাব পরিমাণ হয় তবে কীভাবে যাকাত দিবে; কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কীভাবে সে যাকাত দিবে সে তো বিভিন্ন সময় ফল পেড়ে খেয়ে থাকে? যেমনটি প্রশ্নকর্তা বলেছে।

আমি মনে করি, এ অবস্থায় খেজুরের মূল্য নির্ধারণ করবে এবং পূর্ণ মূল্যের এক বিশমাংশ যাকাত হিসেবে বের করবে। কেননা এ পদ্ধতি মালিকের জন্য যেমন সহজ তেমনি অভাবীদের জন্যও উপকারী। এতে যাকতের পরিমাণ হবে ৫% (শতকরা পাঁচ) টাকা। কেননা তা হচ্ছে ফসলের যাকাত; ব্যবসায়িক পণ্যের যাকাত নয়। কিন্তু অন্যান্য সম্পদ যদি হয় যেমন- স্বর্ণ-রৌপ্য, টাকা-পয়সা, তবে তাতে যাকাতের পরিমাণ হচ্ছে ২.৫% (শতকরা আড়াই) টাকা।

আর অজ্ঞতাবশতঃ বিগত যে কয় বছরের যাকাত আদায় করে নি, তার জন্য অনুমাণ করে সর্বমোট একটা পরিমাণ নির্ধারণ করবে, তারপর তার যাকাত এখনই আদায় করে দিবে। আর যাকাত আদায় করতে এ দেরীর কারণে তার কোনো গুনাহ হবে না। কেননা সে ছিল অজ্ঞ। কিন্তু বিগত বছরগুলোর যাকাত অবশ্যই আদায় করতে হবে।

প্রশ্ন: (৩৬৩) স্বর্ণ ও রৌপ্যের যাকাতের নিসাব কী? আর কিলোগ্রাম হিসেবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সা‘ এর পরিমাণ কত?

উত্তর: স্বর্ণের নিসাব হচ্ছে, বিশ মিসক্বাল তথা ৮৫ পঁচাশি গ্রাম।

আর রৌপ্যের নিসাব হচ্ছে ১৪০ (একশ চল্লিশ) মিসক্বাল তথা সৌদী আরবের রৌপ্যের দিরহাম অনুযায়ী ৫৬ রিয়াল অর্থাৎ ৫৯৫ গ্রাম।

আর কিলোগ্রাম হিসেবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সা‘ এর পরিমাণ হচ্ছে, দু’কিলো চল্লিশ গ্রাম (২.৪০ কেজি) পাকা পুষ্ট গম।

দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ১০ পর্যন্ত, সর্বমোট ৩৮ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ 1 2 3 4 পরের পাতা »