হায়েযের আভিধানিক অর্থ প্রবাহিত হওয়া। শরী‘আতের পরিভাষায় নির্দিষ্ট সময় নারীর রেহেমের গভীর থেকে কোনো অসুখ ও আঘাত ব্যতীত যে রক্ত প্রবাহিত হয় তা-ই হায়েয। হায়েয মনুষ্য স্বভাব ও প্রকৃতি, যার ওপর আল্লাহ আদমের মেয়েদের সৃষ্টি করেছেন। তাদের গর্ভাশয়ে আল্লাহ এ রক্ত সৃষ্টি করেন যেন গর্ভে থাকা বাচ্চা তা খাবার হিসেবে গ্রহণ করে। প্রসবের পর এ রক্তই দুধ হিসেবে রূপান্তর হয়। নারী গর্ভবতী বা দুগ্ধ দানকারীনী না হলে গর্ভাশয়ে সৃষ্ট রক্ত ব্যবহৃত হওয়ার কোনো স্থান থাকে না, তাই তা নির্দিষ্ট সময় জরায়ু দিয়ে নির্গত হয়, যার নাম ঋতু, রজঃস্রাব, মাসিক ও পিরিয়ড ইত্যাদি।
নারীরা ন্যূনতম নয় বছরে ঋতুমতী হয়, পঞ্চাশ বছর পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿وَٱلَّٰٓـِٔي يَئِسۡنَ مِنَ ٱلۡمَحِيضِ مِن نِّسَآئِكُمۡ إِنِ ٱرۡتَبۡتُمۡ فَعِدَّتُهُنَّ ثَلَٰثَةُ أَشۡهُرٖ وَٱلَّٰٓـِٔي لَمۡ يَحِضۡنَۚ﴾ [الطلاق: ٤]
“তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে যারা ঋতুমতী হওয়ার ফলে কাল অতিক্রম করে গেছে, তাদের ইদ্দত সম্পর্কে তোমরা যদি সংশয়ে থাক এবং যারা এখনও ঋতুর বয়সে পৌঁছে নি তাদের ইদ্দত কালও হবে তিন মাস”। [সূরা আত-ত্বালাক, আয়াত:৪]
এখানে ঋতুমতীর ইদ্দতকাল অতিক্রম করার অর্থ পঞ্চাশ বছরে উপনীত হওয়া। আর ঋতুর বয়সে পৌঁছে নি অর্থ যে মেয়েরা এখনো ছোট, নয় বছরও হয় নি যাদের।
ক. হায়েয অবস্থায় সামনের রাস্তা দিয়ে স্ত্রীগমন করা হারাম:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ وَيَسَۡٔلُونَكَ عَنِ ٱلۡمَحِيضِۖ قُلۡ هُوَ أَذٗى فَٱعۡتَزِلُواْ ٱلنِّسَآءَ فِي ٱلۡمَحِيضِ وَلَا تَقۡرَبُوهُنَّ حَتَّىٰ يَطۡهُرۡنَۖ فَإِذَا تَطَهَّرۡنَ فَأۡتُوهُنَّ مِنۡ حَيۡثُ أَمَرَكُمُ ٱللَّهُۚ إِنَّ ٱللَّهَ يُحِبُّ ٱلتَّوَّٰبِينَ وَيُحِبُّ ٱلۡمُتَطَهِّرِينَ ٢٢٢ ﴾ [البقرة: ٢٢٢]
“আর তারা তোমাকে হায়েয সম্পর্কে প্রশ্ন করে। বল, তা অপরিচ্ছন্নতা। সুতরাং তোমরা হায়েয কালে স্ত্রীদের থেকে দূরে থাক এবং তারা পবিত্র না হওয়া পর্যন্ত তাদের নিকটবর্তী হয়ো না। অতঃপর যখন তারা পবিত্র হবে তখন তাদের নিকট আস, যেভাবে আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন। নিশ্চয় আল্লাহ তওবাকারীদের ভালোবাসেন এবং ভালোবাসেন অধিক পবিত্রতা অর্জনকারীদের”। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২২২]
নারীর রক্ত বন্ধ হওয়া ও তার গোসল করার আগ পর্যন্ত স্ত্রীগমনের নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকে। কারণ, আল্লাহ বলেছেন:
﴿وَلَا تَقۡرَبُوهُنَّ حَتَّىٰ يَطۡهُرۡنَۖ فَإِذَا تَطَهَّرۡنَ فَأۡتُوهُنَّ مِنۡ حَيۡثُ أَمَرَكُمُ ٱللَّهُۚ ﴾ [البقرة: ٢٢٢]
“তারা পবিত্র না হওয়া পর্যন্ত তাদের নিকটবর্তী হয়ো না। অতঃপর যখন তারা পবিত্র হবে তখন তাদের নিকট আস, যেভাবে আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন”। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২২২]
ঋতুমতীর স্বামী সামনের রাস্তা ব্যতীত যেভাবে ইচ্ছা তার থেকে উপকৃত হবে। কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
»اصنعوا كل شيء إلا النكاح«
“স্ত্রীগমন ব্যতীত সব কিছু কর”।[1]
খ. ঋতুমতী ঋতুকালীন সময় সালাত ও সিয়াম ত্যাগ করবে:
ঋতুমতীর পক্ষে সালাত পড়া ও সিয়াম রাখা হারাম, তাদের সালাত ও সিয়াম শুদ্ধ নয়। কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
»أليس إذا حاضت المرأة لم تصل ولم تصم؟«
“এমন কি নয় যে, ঋতুকালীন সময়ে নারী সালাত পড়ে না ও সিয়াম রাখে না”?[2]
ঋতুমতী নারী পাক হলে শুধু সিয়াম কাযা করবে, সালাত কাযা করবে না। কারণ, আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বলেন:
»كنا نحيض على عهد رسول الله صلى الله عليه وسلم فكنا نؤمر بقضاء الصوم، ولا نؤمر بقضاء الصلاة«
“আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে ঋতুমতী হতাম, আমাদেরকে তখন সিয়াম কাযা করার নির্দেশ প্রদান করা হত; কিন্তু সালাত কাযা করার নির্দেশ প্রদান করা হত না”।[3]
কী কারণে সিয়াম কাযা করবে, সালাত কাযা করবে না -তা আল্লাহ ভালো জানেন, তবে আমাদের মনে হয় সালাত কাযা করা নারীর জন্য কষ্টকর। কারণ, প্রতিদিন তা বারবার আসে, যে কষ্ট সিয়ামে নেই, তাই সিয়াম কাযা করার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে, সালাত কাযা করার নির্দেশ প্রদান করা হয় নি।
গ. ঋতুমতী নারীর পক্ষে পর্দা ব্যতীত মুসহাফ/কুরআন স্পর্শ করা হারাম:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿لَّايَمَسُّهُۥٓإِلَّاٱلۡمُطَهَّرُونَ٧٩﴾ [الواقعة: ٧٩]
“পবিত্রগণ ব্যতীত কেউ তা স্পর্শ করবে না”। [সূরা আল-ওয়াকি‘আহ, আয়াত: ৭৯]
দ্বিতীয়ত: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমর ইবন হাযমকে যে পত্র লিখেছেন, তাতে ছিল:
»لا يمس المصحف إلا طاهر«
“পবিত্র ব্যতীত কেউ মুসহাফ স্পর্শ করবে না”।[4] হাদীসটি মুতাওয়াতির মর্তবার, কারণ সবাই তা মেনে নিয়েছে। শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ রহ. বলেন: চার ইমামের মাযহাব হচ্ছে পবিত্রতা অর্জন করা ব্যতীত কেউ মুসহাফ স্পর্শ করবে না।
ঋতুমতী নারী কুরআনুল কারীম তিলাওয়াত করবে কি-না আহলে ইলমদের মাঝে মতবিরোধ রয়েছে। প্রয়োজন ব্যতীত তিলাওয়াত না করাই সতর্কতা। যেমন, ভুলে যাওয়ার আশঙ্কা একটি প্রয়োজন। আল্লাহ তা‘আলা ভালো জানেন।
ঘ. ঋতুমতী নারীর বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করা হারাম:
কারণ, আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা যখন ঋতুমতী হন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলেন:
»افعلي ما يفعل الحاج، غير ألا تطوفي بالبيت حتى تطهري«
“হাজীগণ যা করে তুমি তাই কর, তবে পবিত্র হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করো না”।[5]
ঙ. ঋতুমতী নারীর মসজিদে অবস্থান করা হারাম:
ঋতুমতীর মসজিদে অবস্থান করা হারাম, কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
»إني لا أحل المسجد لحائض ولا لجنب«
“আমি ঋতুমতী নারী ও জুনুব তথা গোসল ফরয হওয়া ব্যক্তির জন্য মসজিদ হালাল করি না”।[6]
অপর বর্ণনায় তিনি বলেন:
»إن المسجد لا يحل لحائض ولا جنب«
“ঋতুমতী ও জুনুবি ব্যক্তির জন্য মসজিদ হালাল নয়”।[7]
তবে অবস্থান করা ব্যতীত মসজিদ দিয়ে অতিক্রম করা ঋতুমতীর জন্য বৈধ। কারণ, আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, মসজিদ থেকে আমাকে বিছানাটি দাও, আমি বললাম: আমি ঋতুমতী, তিনি বললেন: তোমার হাতে তোমার ঋতু নয়”।[8]
ঋতুমতী নারী শর‘ঈ যিকিরগুলো সম্পাদন করবে। যেমন, লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার, সুবহানাল্লাহ ও অন্যান্য দো‘আ। অনুরূপ সকাল-সন্ধ্যা এবং ঘুমানো ও ঘুম থেকে উঠার মাসনুন দো‘আগুলো পড়া কোনো সমস্যা নয়। অনুরূপ তাফসীর, হাদীস ও ফিকহের কিতাব পড়াতে দোষ নেই।
[2] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২৯৮; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৮০
[3] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৩১৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৩৩৫; তিরমিযী, হাদীস নং ১৩০); নাসাঈ, হাদীস নং ২৩১৮; আবু দাউদ, হাদীস নং ২৬২; ইবন মাজাহ, হাদীস নং ৬৩১; আহমদ: (৬/২৩২); দারেমী, হাদীস নং ৯৮৬
[4] ইমাম মালিক, হাদীস নং ৪৬৮
[5] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২৯৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১২১১; নাসাঈ, হাদীস নং ২৭৬৩; আবু দাউদ, হাদীস নং ১৭৭৮; ইবন মাজাহ, হাদীস নং ৩০০০; আহমদ: (৬/২৭৩); মালিক, হাদীস নং ৯৪১; দারেমী, হাদীস নং ১৮৪৬
[6] আবু দাউদ, হাদীস নং ২৩২
[7] ইবনে মাজাহ, হাদীস নং ৬৪৫
[8] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৯৮; তিরমিযী, হাদীস নং ১৩৪, নাসাঈ, হাদীস নং ৩৮৪; আবু দাউদ, হাদীস নং ৩৬১; ইবন মাজাহ, হাদীস নং ৬৩২; আহমদ: (৬/১০৬); দারেমী, হাদীস নং ১০৬৫
‘সুফরাহ’ বা হলুদ বর্ণ: সুফরাহ হচ্ছে নারীর রেহেম থেকে নির্গত পুঁজের ন্যায় তরল পদার্থ, যার উপর হলুদ বর্ণ অধিক প্রতিভাত হয়। আর ‘কুদরাহ’ হচ্ছে নারীর রেহেম থেকে নির্গত মেটে বর্ণের ন্যায় তরল পদার্থ। ঋতুকালীন সময় নারীর রেহেম থেকে সুফরাহ অথবা কুদরাহ বের হলে হায়েয গণ্য হবে এবং তার জন্য হায়েযের হুকুম প্রযোজ্য হবে। এ জাতীয় পদার্থ ঋতুকালীন সময় ব্যতীত অন্য সময় বের হলে হায়েয গণ্য হবে না, বরং তখন নারী নিজেকে পবিত্র জ্ঞান করবে। কারণ, উম্মে ‘আতিয়্যাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বলেন: “আমরা পবিত্র হওয়ার পর ‘সুফরাহ’ ও ‘কুদরাহ’কে কিছুই গণ্য করতাম না”। হাদীসটি আবু দাউদ বর্ণনা করেছেন। ইমাম বুখারীও বর্ণনা করেছেন, তবে তিনি (পবিত্র হওয়ার পর) বাক্যটি বর্ণনা করেন নি। এ জাতীয় হাদীসকে মারফু‘ হাদীস বলা হয়। কারণ, এতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সমর্থন বুঝা যায়। উম্মে ‘আতিয়্যার কথার অর্থ হায়েয অবস্থায় বা হায়েযের নির্দিষ্ট সময় যদি সুফরাহ বা কুদরাহ নির্গত হয় হায়েয হিসেবে গণ্য হবে এবং তার বিধানও হবে হায়েযের বিধান।
উত্তর: রক্ত বন্ধ হলেই বুঝবে হায়েয শেষ। এর দু’টি আলামত:
প্রথম আলামত: হায়েযের পর সাদা পানি বের হওয়া, যা সাধারণত হায়েযের পরই বের হয়, অনেকটা চুনের পানির মত। কখনো তার রঙ হয় না, আবার নারীদের স্বভাব অনুসারে তার রঙ বিভিন্ন হয়।
দ্বিতীয় আলামত: শুষ্ক পদ্ধতি, অর্থাৎ নারী তার যোনি পথে কাপড়ের টুকরো অথবা তুলা দাখিল করবে, অতঃপর বের করলে যদি শুষ্ক বের হয়, তার উপর রক্ত, কুদরাহ ও সুফরার আলামত না থাকে, বুঝবে হায়েয শেষ।
ঋতুমতী নারীর ঋতু শেষে গোসল করা জরুরি, অর্থাৎ পবিত্র হওয়ার নিয়তে সমস্ত শরীরে পানি প্রবাহিত করা। কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
»فإذا أقبلت حيضتك فدعي الصلاة، وإذا أدبرت فاغتسلي وصلي«
“যখন তোমার রজঃস্রাব শুরু হয় তখন সালাত ত্যাগ কর, আর যখন বিদায় নেয় গোসল কর ও সালাত পড়”।[1]
ফরয গোসল করার নিয়ম: নাপাক দূর করা অথবা সালাত বা এ জাতীয় ইবাদতের নিয়ত করে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে সমস্ত শরীরে পানি পৌঁছানো। বিশেষভাবে মাথার চুলের গোঁড়ায় পানি পৌঁছানো, চুলে খোঁপা বাঁধা থাকলে খোলা জরুরি নয়, তবে চুলের গোঁড়ায় অবশ্যই পানি পৌঁছানো জরুরি, যদি বড়ই অথবা পরিচ্ছন্নকারী কোনো বস্তু যেমন, সাবান ইত্যাদি ব্যবহার করা হয় খুব ভালো। গোসলের পর সুগন্ধি জাতীয় তুলা অথবা কোনো সুগন্ধি বস্তু যোনীতে ব্যবহার করা মুস্তাহাব। কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসমা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহাকে অনুরূপ নির্দেশ প্রদান করেছেন। [মুসলিম]
নারী যদি সূর্যাস্তের পূর্বে ঋতু থেকে পবিত্র হয়, তার ওপর যোহর ও আসর সালাত পড়া জরুরি, আর যে সুবহে সাদিকের পূর্বে পবিত্র হবে তার ওপর মাগরিব ও এশার সালাত পড়া জরুরি। কারণ, অপারগতার সময় পরবর্তী সালাতের সময়কে পূর্ববর্তী সালাতের সময় গণ্য করা হয়। অর্থাৎ আসরের সময়কে যোহরের সময় ও এশার সময়কে মাগরিবের সময় গণ্য করা হয়।
শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ রহ. বলেন: “এ জন্যই জমহুর আলেম যেমন মালিক,শাফে‘ঈ শাফে‘ঈ ও আহমদ রহ. বলেন, ঋতুমতী নারী যদি দিনের শেষে পবিত্র হয় তখন যোহর ও আসর উভয় সালাত পড়বে, আর যদি রাতের শেষে পবিত্র তাহলে হয় মাগরিব ও এশা উভয় সালাত পড়বে। আব্দুর রহমান ইবন ‘আউফ, আবু হুরায়রা ও ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম থেকে এরূপ বর্ণিত। কারণ, অপারগতার সময় আসর যোহরের ওয়াক্তকে এবং এশা মাগরিবের ওয়াক্তকে শামিল করে। অতএব, যদি দিনের শেষে সূর্যাস্তের পূর্বে পাক হয় তাহলে যোহরের সময় বাকি আছে, সুতরাং আসরের পূর্বে তা পড়ে নিবে। আর যদি রাতের শেষে পাক হয়, তাহলে মাগরিবের সময় বাকি আছে, সুতরাং এশার পূর্বে তা পড়ে নিবে। কারণ, এটা অপারগতার মুহূর্ত”।[1]
আর যদি নারীর সালাতের ওয়াক্ত শুরু হয়েছে কিন্তু এখনো সে সালাত আদায় করে নি এমতাবস্থায় যদি তার ঋতু বা নিফাস আরম্ভ হয় তাহলে বিশুদ্ধ মতে উক্ত সালাত তার কাযা করতে হবে না।
শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ রহ. বলেন: “আবু হানিফা ও মালিকের মাযহাব হচ্ছে এ জাতীয় নারীর তাদের সালাত কাযা করতে হবে না, দলীলের বিবেচনায় এটিই মজবুত। কারণ, কাযা ওয়াজিব হয় নতুনভাবে ওয়াজিব হওয়ার কারণ পাওয়া গেলে, এখানে সে কারণ নেই। দ্বিতীয়ত ঋতুমতী যদিও কিছু সময় বিলম্ব করেছে তবে সেটা ছিল তার বৈধ সময়ের মধ্যে তাই সে সীমালঙ্ঘনকারী নয়। অনুরূপ ঘুমন্ত ও বিস্মৃত ব্যক্তি সীমালঙ্ঘনকারী নয়, তবে তাদের সালাত কাযা হিসেবে নয় আদায় হিসেবে ধর্তব্য হবে, কারণ তারা যখন জাগ্রত হয় ও যখন তাদের স্মরণ হয় তখন তাদের সালাতের ওয়াক্ত হয়”।[2] সমাপ্ত।
[2] মাজমুউল ফতোয়া: (২৩/৩৩৫)
১. ইস্তেহাযার হুকুম:
ইস্তেহাযার সংজ্ঞা: মাসিক আসার নির্দিষ্ট সময় ছাড়া ‘আযেল’ নামক কোনো রগ থেকে যে রক্তক্ষরণ হয় তাই ইস্তেহাযাহ। ইস্তেহাযার বিষয়টি জটিল, কারণ হায়েযের রক্তের সাথে তার রক্ত সাদৃশ্যপূর্ণ।
যদি নারীর লাগাতার অথবা অধিকাংশ সময় রক্ত প্রবাহিত হয় তাহলে কতটুকু হায়েয হিসেবে ধরা হবে আর কতটুকু ইস্তেহাযা হিসেবে ধরা হবে যার সাথে সিয়াম ও সালাত আদায় করা ছাড়া যাবে না, তা জানা জরুরি। কারণ, মুস্তাহাযাহ নারী স্বাভাবিক নারীর মতো পবিত্র।
মুস্তাহাযাহ নারীর তিনটি অবস্থা:
প্রথম অবস্থা: ইস্তেহাযায় আক্রান্ত হওয়ার পূর্বে তার নির্দিষ্ট অভ্যাস থাকবে, যেমন ইস্তেহাযার পূর্বে মাসের শুরুতে অথবা মাঝখানে পাঁচ দিন অথবা আট দিন রীতিমত হায়েয আসা। এ জাতীয় নারী ইস্তেহাযায় আক্রান্ত হলে তাদের ঋতুস্রাবের দিন-সংখ্যা ও সময় জানা সহজ, সে তার পূর্বের অভ্যাস মোতাবেক হায়েযের দিনগুলোতে বিরতি নিবে ও সালাত, সিয়াম ত্যাগ করবে। এ সময়টা তার হায়েয। হায়েয শেষে গোসল করে সালাত আদায় করবে এবং অবশিষ্ট রক্তকে ইস্তেহাযার রক্ত গণনা করবে। কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মে হাবিবাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহাকে বলেন:
»امكثي قدر ما كانت تحبسك حيضتك، ثم اغتسلي وصلي«
“পূর্বে তোমার হায়েয যত দিন তোমাকে বিরত রাখত সে পরিমাণ তুমি বিরতি নাও, অতঃপর গোসল কর ও সালাত পড়”।[1]
অধিকন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফাতিমা বিনতে আবী হুবাইশকে বলেন:
»إنما ذلك عرق، وليس بحيض، فإذا أقبلت حيضتك فدعي الصلاة«
“সেটি রক্তক্ষরণ, হায়েয নয়, যখন তোমার হায়েয আসে সালাত ত্যাগ কর”।[2]
দ্বিতীয় অবস্থা: ঋতুমতী নারীর নির্দিষ্ট অভ্যাস নেই তবে তার হায়েযের রক্ত বুঝা ও চেনা যায়। যেমন, ঋতুমতীর কিছু রক্ত হায়েযের রক্তের ন্যায় কালো অথবা ঘন অথবা বিশেষ গন্ধযুক্ত, যা ঋতু বা হায়েয হিসেবে সহজে চিহ্নিত করা যায়, কিন্তু তার অবশিষ্ট রক্ত এরূপ নয়, উদাহরণত লাল কোনো গন্ধ নেই, ঘনও নয়। এ অবস্থায় যে ক’দিন তার হায়েযের মতো রক্ত আসে সে ক’দিন সে বিরতি নিবে এবং সালাত ও সিয়াম ত্যাগ করবে, অবশিষ্ট রক্তকে ইস্তেহাযাহ গণনা করবে। হায়েযের আলামত যুক্ত রক্ত বন্ধ হলে গোসল করে সালাত ও সিয়াম আদায় করবে। এখন সে পবিত্র। কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফাতিমা বিনতে আবী হুবাইশকে বলেন:
»إذا كان الحيض فإنه أسود يعرف، فأمسكي عن الصلاة، فإذا كان الآخر فتوضئي وصلي«
“যদি হায়েয হয় অবশ্যই কালো হবে যা চিনা যায়। অতএব, সালাত থেকে বিরত থাক। অতঃপর যখন অন্য রক্ত শুরু হয় অযু কর ও সালাত আদায় কর”।[3]
এ থেকে জানা যায় যে, মুস্তাহাযা নারী রক্তের নির্দিষ্ট অবস্থাকে আলামত হিসেবে গণ্য করবে এবং তার ভিত্তিতে হায়েয ও ইস্তেহাযাহ চিহ্নিত করবে।
তৃতীয় অবস্থা: মুস্তাহাযাহ নারীর যদি নির্দিষ্ট অভ্যাস এবং হায়েযকে ইস্তেহাযা থেকে পৃথক করার বিশেষ আলামত না থাকে, তাহলে সে প্রতি মাস হায়েযের সাধারণ সংখ্যা ছয় অথবা সাত দিন বিরতি নিবে। কারণ, এটিই নারীদের ঋতুস্রাবের সাধারণ নিয়ম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হামনাহ বিনতে জাহাশকে বলেন:
»إنما هي ركضة من الشيطان، فتحيضي ستة أيام أو سبعة أيام، ثم اغتسلي، فإذا استنقأت فصلي أربعة وعشرين أو ثلاثة وعشرين، وصومي وصلي، فإن ذلك يجزئك، وكذلك فافعلي كما تحيض النساء«
“এটা শয়তানের আঘাত, তুমি ছয় অথবা সাত দিন হায়েয গণনা কর, অতঃপর গোসল কর, যখন তুমি পাক হবে চব্বিশ অথবা তেইশ দিন সালাত পড়, সিয়াম রাখ ও সালাত পড়। কারণ, তোমার জন্য এটিই যথেষ্ট। সাধারণ নারীরা যেরূপ ঋতুমতী হয় তুমি সেরূপ কর”।[4]
পূর্বের আলোচনার সারাংশ: যে মুস্তাহাযা নারীর অভ্যাস আছে সে তার অভ্যাস মোতাবেক হায়েয গণনা করবে। আর যার অভ্যাস নেই, কিন্তু তার হায়েযের রক্তের নির্দিষ্ট আলামত রয়েছে সে আলামত মোতাবেক হায়েয গণনা করবে। আর যার দু’টি থেকে কোনো আলামত নেই সে প্রতি মাসে ছয় অথবা সাত দিন হায়েয গণনা করবে। এ ব্যাখ্যা মোতাবেক মুস্তাহাযা নারীর জন্য বর্ণিত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তিনটি হাদীসের মাঝে সমন্বয় হয়।
শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ রহ. বলেন: মুস্তাহাযাহ নারীর ছয়টি আলামত বলা হয়:
১. অভ্যাস: এটিই শক্ত ও মজবুত আলামত। কারণ, তার সুস্থাবস্থায় এ সময়টায় হায়েয আসত, তাই এগুলো তার হায়েযের নির্ধারিত দিনক্ষণ ব্যতীত কিছু নয়।
২. রক্তের নির্দিষ্ট আলামত: কারণ হায়েযের রক্ত কালো, ঘন ও দুর্গন্ধযুক্ত বেশি হয়, সাধারণত লাল হয় না।
৩. স্বাভাবিক নারীদের সাধারণ অভ্যাস: কারণ মুস্তাহাযাহ নারীর ব্যতিক্রম অভ্যাসকে অপরাপর নারীর সাধারণ অভ্যাসের সাথে তুলনা করাই যুক্তিযুক্ত। মুস্তাহাযাহ নারীর হায়েয চিহ্নিত করার এ তিনটি আলামত সুন্নত দ্বারা প্রমাণিত। অতঃপর তিনি অন্যান্য আলামত উল্লেখ করেন। শেষে বলেন সঠিক মত হচ্ছে হাদীসের আলামত গ্রহণ করা ও অন্যান্য আলামত ত্যাগ করা”।
২. মুস্তাহাযাহ নারীর পবিত্র অবস্থায় করণীয়:
ক. পূর্বের বর্ণনা মোতাবেক মুস্তাহাযাহ নারীর হায়েয শেষে গোসল করা ওয়াজিব।
খ. প্রত্যেক সালাতের সময় যোনিপথ থেকে নির্গত ময়লা দূরীভূত করার জন্য লজ্জাস্থান ধৌত করা। নির্গত রক্ত যেন বাহিরে প্রবাহিত না হয় বা গড়িয়ে না পড়ে সে জন্য যোনি পথের বহির্মুখে তুলা বা অনুরূপ বস্তু ব্যবহার করবে এবং তা বেঁধে দিবে যেন খসে না পড়ে। অতঃপর প্রত্যেক সালাতের সময় ওযু করবে। কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুস্তাহাযা নারীর ক্ষেত্রে বলেন:
»تدع الصلاة أيام أقرائها، ثم تغتسل وتتوضأ عند كل صلاة«
“মুস্তাহাযাহ নারী তার হায়েযের দিনগুলোয় সালাত ত্যাগ করবে, অতঃপর গোসল করবে ও প্রত্যেক সালাতের জন্য ওযু করবে”।[5]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন:
»أنعت لك الكرسف تحشين به المكان«
“তুমি নিজের জন্য কুরসুফ (সুতি কাপড়) বানিয়ে নাও এবং তার দ্বারা স্থানটি ঢেকে নাও”।[6]
ডাক্তারি গবেষণায় তৈরি ন্যাপকিন ব্যবহার করাও বৈধ।
[2] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২২৬; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৩৩৩; তিরমিযী, হাদীস নং ১২৫; নাসাঈ, হাদীস নং ৩৬৪; আবু দাউদ, হাদীস নং ২৮২; ইবন মাজাহ, হাদীস নং ৬২৪; আহমদ: (৬/২০৪); মালিক, হাদীস নং ১৩৭; দারেমী, হাদীস নং ৭৭৪
[3] নাসাঈ, হাদীস নং ২১৫; আবু দাউদ, হাদীস নং ২৮০; ইবন মাজাহ, হাদীস নং ৬২০; আহমদ: (৬/৪৬৪), হাকিম ও ইবন হিব্বান হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।
[4] তিরমিযি, হাদীস নং ১২৮; আবু দাউদ, হাদীস নং ২৮৭; ইবন মাজাহ, হাদীস নং ৬২৭; আহমদ: (৬/৪৩৯)
[5] তিরমিযি, হাদীস নং ১২৬; আবু দাউদ, হাদীস নং ২৯৭; ইবন মাজাহ, হাদীস নং ৬২৫; দারেমী, হাদীস নং ৭৯৩
[6] তিরমিযি, হাদীস নং ১২৮; আবু দাউদ, হাদীস নং ২৮৭; ইবন মাজাহ, হাদীস নং ৬২২; আহমদ: (৬/৪৩৯)
১. নিফাসের সংজ্ঞা ও সময়:
বাচ্চা প্রসবের সময় ও তার পরবর্তীতে রেহেম থেকে যে রক্ত বের হয় তাই নিফাস। এগুলো মূলত গর্ভকালীন সময় গর্ভাশয়ে স্তূপ হওয়া রক্ত, বাচ্চা প্রসব হলে অল্পঅল্প তা বের হয়। প্রসবের আলামত শুরু হওয়ার পর যে রক্ত বের হয় তাও নিফাস, যদিও প্রসব বিলম্বে হয়। ফকিহগণ বলেন, প্রসবের দুই দিন বা তিন দিন পূর্বে হলে নিফাস অন্যথায় নিফাস নয়। নিফাসের রক্ত সাধারণত প্রসবের সাথে আরম্ভ হয়। প্রসবের জন্য পরিপূর্ণ বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হওয়া জরুরি, তার পরবর্তী রক্ত নিফাস হিসেবে গণ্য হবে। মায়ের পেটে সর্বনিম্ন একাশি দিন সম্পন্ন হলে বাচ্চার শরীরের গঠন আকৃতি পূর্ণ হয়, যদি তার পূর্বে রেহেম থেকে জমাট বাঁধা কিছু বের হয় এবং সাথে রক্তও আসে, তাহলে তা নিফাস হিসেবে গণ্য হবে না, সালাত ও সিয়াম যথারীতি আদায় করবে, কারণ তা দূষিত রক্ত ও রক্তক্ষরণ হিসেবে নির্গত, তার বিধান মুস্তাহাযা নারীর বিধান।
নিফাসের সর্বাধিক সময় চল্লিশ দিন, যার সূচনা হয় প্রসব থেকে অথবা তার দুই বা তিনদিন পূর্ব থেকে, যা পূর্বে বর্ণিত হয়েছে। উম্মে সালামা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহার হাদীসে এসেছে:
»كانت النفساء تجلس على عهد رسول الله صلى الله عليه وسلم أربعين يوما«
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে নিফাসের নারীরা চল্লিশ দিন বিরতি নিত”।[1]
নিফাসের সর্বোচ্চ মেয়াদ চল্লিশ দিন। এ বিষয়ে সকল আহলে ইলম একমত। ইমাম তিরমিযী প্রমুখগণ আলেমদের এরূপ ঐকমত্য নকল করেছেন। আর যে চল্লিশ দিনের পূর্বে পবিত্র হলো, যেমন তার রক্ত বন্ধ হলো, সে গোসল করবে ও সালাত আদায় করবে। নিফাসের সর্বনিম্ন কোনো মেয়াদ নেই। কারণ তার নির্দিষ্ট মেয়াদ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত হয় নি। যদি চল্লিশ দিন পূর্ণ হওয়ার পরও রক্ত বন্ধ না হয়, তাহলে সেটা যদি হায়েযের সময় হয় হায়েয গণ্য হবে, যদি হায়েযের সময় না হয় ইস্তেহাযাহ গণ্য হবে, তাই চল্লিশ দিন পার হলে ইবাদত ত্যাগ করবে না। যদি রক্ত আসার সময়কাল চল্লিশ দিনের বেশি হয়, কিন্তু বিরতি দিয়ে দিয়ে রক্ত আসে, যার সাথে হায়েযের অভ্যাসের মিল নেই, এটিই ইখতিলাফের বিষয়।
খ. নিফাস সংক্রান্ত বিধান:
নিম্নের অবস্থায় নিফাসের বিধান হায়েযের বিধানের মত:
১. নিফাসের নারীদের সাথে সঙ্গম করা হারাম। যেমন হায়েযের নারীদের সাথে সঙ্গম করা হারাম, তবে সঙ্গম ব্যতীত অন্যান্য পদ্ধতিতে ভোগ করা বৈধ।
২. হায়েযা নারীর ন্যায় নিফাসের নারীদের জন্যও সিয়াম রাখা, সালাত পড়া ও বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করা হারাম।
৩. নিফাসের নারীদের জন্য কুরআন তিলাওয়াত ও স্পর্শ করা হারাম, তবে ভুলে যাওয়ার আশঙ্কা হলে বৈধ। যেমন, হায়েযা নারী।
৪. হায়েযা নারীর মতো নিফাসের নারীর ছুটে যাওয়া সিয়াম কাযা করা ওয়াজিব।
৫ হায়েযা নারীর মতো নিফাসের নারীর নিফাস শেষে গোসল করা ওয়াজিব। দলীল:
১. উম্মে সালামাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:
»كانت النفساء تجلس على عهد رسول الله صلى الله عليه وسلم أربعين يوما«
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে নিফাসের নারীরা চল্লিশ দিন বিরতি নিত”।[2]
‘মুনতাকা’ গ্রন্থে মাজদ ইবন তাইমিয়্যাহ রহ. বলেন: “হাদীসের অর্থ হচ্ছে তাদেরকে চল্লিশ দিন বিরতি নেওয়ার নির্দেশ প্রদান করা হতো। এটিই চূড়ান্ত অর্থ, তাদের সবার নিফাস চল্লিশ দিন পর্যন্ত বিলম্ব হত এ অর্থ কখনো নয়; বরং এ অর্থ করলে বাস্তবতার ক্ষেত্রে হাদীসটি মিথ্যা প্রমাণিত হবে, যেহেতু কোনো যুগে হায়েয বা নিফাসের সময়সীমা সব নারীদের এক হওয়া সম্ভব নয়”।[3]
২. উম্মে সালামাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:
»كانت المرأة من نساء النبي تقعد في النفاس أربعين ليلة لا يأمرها النبي بقضاء صلاة النفاس«
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কতক স্ত্রী নিফাস হলে চল্লিশ দিন বিরতি নিতেন, তিনি তাকে নিফাসের সালাত কাযা করার নির্দেশ দিতেন না”।[4]
চল্লিশ দিনের পূর্বে যদি নিফাসের রক্ত বন্ধ হয়:
জ্ঞাতব্য-১: যদি নিফাসের নারীর চল্লিশ দিন পূর্বে রক্ত বন্ধ হয় এবং সে গোসল শেষে সালাত আদায় করে ও সিয়াম রাখে, অতঃপর চল্লিশ দিন শেষ না হতে পুনরায় রক্ত আসা শুরু হয়, তাহলে বিশুদ্ধ মতে এ সময়কেও নিফাস গণ্য করবে ও বিরতি নিবে। মধ্যবর্তী ইবাদত শুদ্ধ হয়েছে কাযা করার প্রয়োজন নেই।[5]
নিফাসের রক্তের উপলক্ষ সন্তান প্রসব, ইস্তেহাযার রক্ত রোগের ন্যায় সাময়িক, আর হায়েযের রক্ত নারীর স্বভাবজাত রক্ত:
জ্ঞাতব্য-২: শাইখ আব্দুর রহমান ইবন সাদি বলেন: পূর্বের আলোচনা থেকে স্পষ্ট হলো যে, সন্তান প্রসবের কারণে নিফাসের রক্ত প্রবাহিত হয়। আর ইস্তেহাযার রক্ত অসুখ-বিসুখ জনিত হয় যা সাময়িক। হায়েযের রক্ত নারীর নারীত্বের স্বভাবজত প্রকৃত রক্ত। আল্লাহ ভালো জানেন।[6]
বড়ি ব্যবহার করা: শারীরিক ক্ষতি না হলে হায়েয বন্ধকারী বড়ি ব্যবহার করা দোষণীয় নয়। বড়ি ব্যবহারের ফলে রক্ত বন্ধ হলে সিয়াম রাখবে, সালাত পড়বে ও তাওয়াফ করবে। এ সময় তার সকল ইবাদত দুরস্ত, যেমন অন্যান্য পবিত্র নারীদের ইবাদত দুরস্ত।
গর্ভপাত করার হুকুম: হে মুমিন নারী, আল্লাহ তোমার রেহেমে যা সৃষ্টি করেন তার ব্যাপারে তুমি আমানতদার। অতএব, তুমি আমানত গোপন করো না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿وَلَا يَحِلُّ لَهُنَّ أَن يَكۡتُمۡنَ مَا خَلَقَ ٱللَّهُ فِيٓ أَرۡحَامِهِنَّ إِن كُنَّ يُؤۡمِنَّ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِۚ﴾ [البقرة: ٢٢٨]
“এবং তাদের জন্য হালাল হবে না যে, আল্লাহ তাদের গর্ভে যা সৃষ্টি করেছেন, তা তারা গোপন করবে, যদি তারা আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি বিশ্বাস রাখে”। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২২৮]
গর্ভপাত ঘটানো বা যেভাবে হোক তার থেকে নিষ্কৃতি পেতে বাহানা করো না। কারণ, আল্লাহ তোমার জন্য রমযানের পানাহার বৈধ করেছেন যদি সিয়াম তোমার জন্য ক্ষতিকর হয়। যদি গর্ভের বাচ্চায় রূহ সঞ্চার করা হয় এবং গর্ভপাত ঘটানোর ফলে মারা যায়, তাহলে এটা অন্যায় হত্যার শামিল, যা আল্লাহ হারাম করেছেন। গর্ভের বাচ্চা হত্যাকারীকে ক্ষতিপূরণ দিতে হয়, যদিও তার পরিমাণ ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। কতক আহলে ইলম বলেন, কাফফারা দেওয়া ওয়াজিব। অর্থাৎ মুমিন দাসী মুক্ত করা, যদি মুমিন দাসী পাওয়া না যায় লাগাতার দু’মাস সিয়াম রাখবে। কতক আহলে ইলম গর্ভের বাচ্চা হত্যাকে এক প্রকার জ্যান্ত দাফন গণ্য করেছেন। শাইখ মুহাম্মাদ ইবরাহীম রহ. বলেন: “গর্ভে থাকা বাচ্চা ফেলে দেওয়া হালাল নয়, যদি তার মৃত্যু নিশ্চিত না হয়, মৃত্যু নিশ্চিত হলে ফেলে দিবে”।[7]
‘বড় আলেমদের সংস্থা’র সভায়[8] গর্ভপাত ঘটানোর ব্যাপারে নিম্নরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়:
১. শর‘ঈ দু একটি কারণ ব্যতীত গর্ভের কোনো পর্যায়ে বাচ্চা ফেলা বৈধ নয়।
২. গর্ভ যদি প্রথম পর্যায়ে থাকে, যার বয়স চল্লিশ দিন, আর গর্ভপাত করার কারণ যদি হয় সন্তান লালন-পালন করার কষ্ট অথবা তাদের ভরণ-পোষণ করার দুশ্চিন্তা অথবা ভবিষ্যৎ গড়ার চিন্তা অথবা যে সন্তান আছে তাদেরকে যথেষ্ট জ্ঞান করা, তাহলে বৈধ নয়।
৩. জমাট বাঁধা রক্ত অথবা মাংসের টুকরা থাকা অবস্থায় গর্ভপাত ঘটানো বৈধ নয়, হ্যাঁ যদি নির্ভরযোগ্য ডাক্তারি টিম বলে যে, গর্ভ থাকলে মায়ের জীবনের আশঙ্কা আছে তাহলে বৈধ, তবে এটা অবশ্যই গর্ভধারী মাকে শঙ্কামুক্ত করার সকল প্রচেষ্টা প্রয়োগ শেষে হতে হবে।
৪. গর্ভ যদি তৃতীয় স্তর পার করে ও তার চার মাস পূর্ণ হয়, তাহলে গর্ভপাত করা বৈধ নয়, তবে একদল বিশেষজ্ঞ নির্ভরযোগ্য ডাক্তার যদি বলে যে, পেটে বাচ্চা থাকলে মায়ের মৃত্যুর সমূহ আশঙ্কা রয়েছে তাহলে বৈধ। আর অবশ্যই এটা হতে হবে বাচ্চার জীবন রক্ষা করার সকল প্রচেষ্টা ব্যয় শেষে। এ সুযোগ প্রদান করা হয়েছে দু’টি ক্ষতি থেকে ছোট ক্ষতি দূর করা ও দু’টি কল্যাণ থেকে বড় কল্যাণ অর্জন করার স্বার্থে।
আলেমগণ সভায় এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ শেষে আল্লাহর তাকওয়া ও বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করার উপদেশ দিয়েছেন। আল্লাহ একমাত্র তাওফিক দাতা। আমাদের নবী মুহাম্মাদ, তার পরিবার ও সাথীদের ওপর আল্লাহ সালাত ও সালাম প্রেরণ করুন।
‘নারীদের স্বাভাবিক ঋতু সংক্রান্ত পুস্তিকায়’: (পৃ. ৬০) শাইখ মুহাম্মাদ উসাইমীন রহ. বলেন: “যদি গর্ভের বাচ্চায় রূহ আসার পর গর্ভপাত করে সন্তান নষ্ট করা হয় তাহলে নিঃসন্দেহে হারাম। কারণ এটা অন্যায়ভাবে প্রাণ হত্যার শামিল, নির্দোষ প্রাণকে হত্যা করা কুরআন, সুন্নাহ ও উম্মতের ঐকমত্যে হারাম”।
ইবনুল জাওযী রহ. “আহকামুন নিসা”: (পৃ. ১০৮ ও ১০৯) গ্রন্থে বলেন: “বিবাহের উদ্দেশ্য যখন সন্তান হাসিল করা, আর এটাও সত্য যে সকল বীর্য থেকে সন্তান হয় না, অতএব স্ত্রীর পেটে সন্তান আসলে বিবাহের উদ্দেশ্য হাসিল হলো, তারপর গর্ভপাত ঘটানো বিবাহের হিকমত পরিপন্থী। গর্ভপাত যদি গর্ভের বাচ্চায় রূহ সঞ্চার করার পূর্বে হয় বড় পাপ, আর যদি রূহ সঞ্চার করার পর গর্ভপাত করা হয় সেটা হবে মুমিন নফসকে হত্যা করার মতো। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿وَإِذَا ٱلۡمَوۡءُۥدَةُ سُئِلَتۡ ٨ بِأَيِّ ذَنۢبٖ قُتِلَتۡ ٩﴾ [التكوير: ٨، ٩]
“আর যখন জ্যান্ত দাফনকৃত কন্যাকে জিজ্ঞাসা করা হবে, কোন অপরাধে হত্যা করা হয়েছে”। [সূরা আত-তাকওয়ীর, আয়াত: ৮-৯] সমাপ্ত
অতএব, হে মুসলিম নারী আল্লাহকে ভয় কর, যে কোনো উদ্দেশ্যই হোক এ জাতীয় অপরাধে অগ্রসর হয়ো না। পথভ্রষ্টদের প্রচারণা ও পাপাচারীদের অনুসরণ করে ধোঁকায় পতিত হয়ো না, তাদের কর্মের সাথে বিবেক ও দীনের কোনো সম্পর্ক নেই।
[2] তিরমিযী, হাদীস নং ১৩৯; আবু দাউদ, হাদীস নং ৩১২; ইবন মাজাহ, হাদীস নং ৬৪৮; আহমদ: (৬/৩০০); দারেমী, হাদীস নং ৯৫৫
[3] আল-মুনতাকা: (১/১৮৪)
[4] আবু দাউদ, হাদীস নং ৩১২
[5] দেখুন: (১) শাইখ মুহাম্মাদ ইবন ইবরাহীমের ফতোয়া সমগ্র (এখানে তিনি আরেকটি কথা বলেছেন, যার থেকে বুঝে আসে পুনরায় রক্ত আসার পর যে সিয়াম ত্যাগ করেছে সেগুলো কাযা করবে।) : (২/১০২)। (২) শাইখ আব্দুল আযীয ইবন বায রহ.-এর ফতোয়া ‘মাজাল্লালুত দাওয়াহ: (১/৪৪) প্রকাশিত। (৩) ‘যাদ’ গ্রন্থের ব্যাখ্যার: (১/৪০৫) ওপর ইবন কাসিমের টিকা। (৪) ইবন উসাইমিন কর্তৃক রচিত ‘নারীদের স্বাভাবিক ঋতু সংক্রান্ত পুস্তিকা’: (পৃ. ৫৫ ও ৫৬) ও (৫) ফতোয়া সাদিয়াহ: (পৃ. ১৩৭)
[6] ইরশাদু উলিল আবসার ও উলিল আল-বাব: (পৃ. ২৪)
[7] ফতোয়া সমগ্রে: (১১/১৫১)
[8] সভা নং: (১৪০), তারিখ ২০/৬/১৪০৭ হিজরী