লগইন করুন
১. নিফাসের সংজ্ঞা ও সময়:
বাচ্চা প্রসবের সময় ও তার পরবর্তীতে রেহেম থেকে যে রক্ত বের হয় তাই নিফাস। এগুলো মূলত গর্ভকালীন সময় গর্ভাশয়ে স্তূপ হওয়া রক্ত, বাচ্চা প্রসব হলে অল্পঅল্প তা বের হয়। প্রসবের আলামত শুরু হওয়ার পর যে রক্ত বের হয় তাও নিফাস, যদিও প্রসব বিলম্বে হয়। ফকিহগণ বলেন, প্রসবের দুই দিন বা তিন দিন পূর্বে হলে নিফাস অন্যথায় নিফাস নয়। নিফাসের রক্ত সাধারণত প্রসবের সাথে আরম্ভ হয়। প্রসবের জন্য পরিপূর্ণ বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হওয়া জরুরি, তার পরবর্তী রক্ত নিফাস হিসেবে গণ্য হবে। মায়ের পেটে সর্বনিম্ন একাশি দিন সম্পন্ন হলে বাচ্চার শরীরের গঠন আকৃতি পূর্ণ হয়, যদি তার পূর্বে রেহেম থেকে জমাট বাঁধা কিছু বের হয় এবং সাথে রক্তও আসে, তাহলে তা নিফাস হিসেবে গণ্য হবে না, সালাত ও সিয়াম যথারীতি আদায় করবে, কারণ তা দূষিত রক্ত ও রক্তক্ষরণ হিসেবে নির্গত, তার বিধান মুস্তাহাযা নারীর বিধান।
নিফাসের সর্বাধিক সময় চল্লিশ দিন, যার সূচনা হয় প্রসব থেকে অথবা তার দুই বা তিনদিন পূর্ব থেকে, যা পূর্বে বর্ণিত হয়েছে। উম্মে সালামা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহার হাদীসে এসেছে:
»كانت النفساء تجلس على عهد رسول الله صلى الله عليه وسلم أربعين يوما«
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে নিফাসের নারীরা চল্লিশ দিন বিরতি নিত”।[1]
নিফাসের সর্বোচ্চ মেয়াদ চল্লিশ দিন। এ বিষয়ে সকল আহলে ইলম একমত। ইমাম তিরমিযী প্রমুখগণ আলেমদের এরূপ ঐকমত্য নকল করেছেন। আর যে চল্লিশ দিনের পূর্বে পবিত্র হলো, যেমন তার রক্ত বন্ধ হলো, সে গোসল করবে ও সালাত আদায় করবে। নিফাসের সর্বনিম্ন কোনো মেয়াদ নেই। কারণ তার নির্দিষ্ট মেয়াদ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত হয় নি। যদি চল্লিশ দিন পূর্ণ হওয়ার পরও রক্ত বন্ধ না হয়, তাহলে সেটা যদি হায়েযের সময় হয় হায়েয গণ্য হবে, যদি হায়েযের সময় না হয় ইস্তেহাযাহ গণ্য হবে, তাই চল্লিশ দিন পার হলে ইবাদত ত্যাগ করবে না। যদি রক্ত আসার সময়কাল চল্লিশ দিনের বেশি হয়, কিন্তু বিরতি দিয়ে দিয়ে রক্ত আসে, যার সাথে হায়েযের অভ্যাসের মিল নেই, এটিই ইখতিলাফের বিষয়।
খ. নিফাস সংক্রান্ত বিধান:
নিম্নের অবস্থায় নিফাসের বিধান হায়েযের বিধানের মত:
১. নিফাসের নারীদের সাথে সঙ্গম করা হারাম। যেমন হায়েযের নারীদের সাথে সঙ্গম করা হারাম, তবে সঙ্গম ব্যতীত অন্যান্য পদ্ধতিতে ভোগ করা বৈধ।
২. হায়েযা নারীর ন্যায় নিফাসের নারীদের জন্যও সিয়াম রাখা, সালাত পড়া ও বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করা হারাম।
৩. নিফাসের নারীদের জন্য কুরআন তিলাওয়াত ও স্পর্শ করা হারাম, তবে ভুলে যাওয়ার আশঙ্কা হলে বৈধ। যেমন, হায়েযা নারী।
৪. হায়েযা নারীর মতো নিফাসের নারীর ছুটে যাওয়া সিয়াম কাযা করা ওয়াজিব।
৫ হায়েযা নারীর মতো নিফাসের নারীর নিফাস শেষে গোসল করা ওয়াজিব। দলীল:
১. উম্মে সালামাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:
»كانت النفساء تجلس على عهد رسول الله صلى الله عليه وسلم أربعين يوما«
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে নিফাসের নারীরা চল্লিশ দিন বিরতি নিত”।[2]
‘মুনতাকা’ গ্রন্থে মাজদ ইবন তাইমিয়্যাহ রহ. বলেন: “হাদীসের অর্থ হচ্ছে তাদেরকে চল্লিশ দিন বিরতি নেওয়ার নির্দেশ প্রদান করা হতো। এটিই চূড়ান্ত অর্থ, তাদের সবার নিফাস চল্লিশ দিন পর্যন্ত বিলম্ব হত এ অর্থ কখনো নয়; বরং এ অর্থ করলে বাস্তবতার ক্ষেত্রে হাদীসটি মিথ্যা প্রমাণিত হবে, যেহেতু কোনো যুগে হায়েয বা নিফাসের সময়সীমা সব নারীদের এক হওয়া সম্ভব নয়”।[3]
২. উম্মে সালামাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:
»كانت المرأة من نساء النبي تقعد في النفاس أربعين ليلة لا يأمرها النبي بقضاء صلاة النفاس«
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কতক স্ত্রী নিফাস হলে চল্লিশ দিন বিরতি নিতেন, তিনি তাকে নিফাসের সালাত কাযা করার নির্দেশ দিতেন না”।[4]
চল্লিশ দিনের পূর্বে যদি নিফাসের রক্ত বন্ধ হয়:
জ্ঞাতব্য-১: যদি নিফাসের নারীর চল্লিশ দিন পূর্বে রক্ত বন্ধ হয় এবং সে গোসল শেষে সালাত আদায় করে ও সিয়াম রাখে, অতঃপর চল্লিশ দিন শেষ না হতে পুনরায় রক্ত আসা শুরু হয়, তাহলে বিশুদ্ধ মতে এ সময়কেও নিফাস গণ্য করবে ও বিরতি নিবে। মধ্যবর্তী ইবাদত শুদ্ধ হয়েছে কাযা করার প্রয়োজন নেই।[5]
নিফাসের রক্তের উপলক্ষ সন্তান প্রসব, ইস্তেহাযার রক্ত রোগের ন্যায় সাময়িক, আর হায়েযের রক্ত নারীর স্বভাবজাত রক্ত:
জ্ঞাতব্য-২: শাইখ আব্দুর রহমান ইবন সাদি বলেন: পূর্বের আলোচনা থেকে স্পষ্ট হলো যে, সন্তান প্রসবের কারণে নিফাসের রক্ত প্রবাহিত হয়। আর ইস্তেহাযার রক্ত অসুখ-বিসুখ জনিত হয় যা সাময়িক। হায়েযের রক্ত নারীর নারীত্বের স্বভাবজত প্রকৃত রক্ত। আল্লাহ ভালো জানেন।[6]
বড়ি ব্যবহার করা: শারীরিক ক্ষতি না হলে হায়েয বন্ধকারী বড়ি ব্যবহার করা দোষণীয় নয়। বড়ি ব্যবহারের ফলে রক্ত বন্ধ হলে সিয়াম রাখবে, সালাত পড়বে ও তাওয়াফ করবে। এ সময় তার সকল ইবাদত দুরস্ত, যেমন অন্যান্য পবিত্র নারীদের ইবাদত দুরস্ত।
গর্ভপাত করার হুকুম: হে মুমিন নারী, আল্লাহ তোমার রেহেমে যা সৃষ্টি করেন তার ব্যাপারে তুমি আমানতদার। অতএব, তুমি আমানত গোপন করো না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿وَلَا يَحِلُّ لَهُنَّ أَن يَكۡتُمۡنَ مَا خَلَقَ ٱللَّهُ فِيٓ أَرۡحَامِهِنَّ إِن كُنَّ يُؤۡمِنَّ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِۚ﴾ [البقرة: ٢٢٨]
“এবং তাদের জন্য হালাল হবে না যে, আল্লাহ তাদের গর্ভে যা সৃষ্টি করেছেন, তা তারা গোপন করবে, যদি তারা আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি বিশ্বাস রাখে”। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২২৮]
গর্ভপাত ঘটানো বা যেভাবে হোক তার থেকে নিষ্কৃতি পেতে বাহানা করো না। কারণ, আল্লাহ তোমার জন্য রমযানের পানাহার বৈধ করেছেন যদি সিয়াম তোমার জন্য ক্ষতিকর হয়। যদি গর্ভের বাচ্চায় রূহ সঞ্চার করা হয় এবং গর্ভপাত ঘটানোর ফলে মারা যায়, তাহলে এটা অন্যায় হত্যার শামিল, যা আল্লাহ হারাম করেছেন। গর্ভের বাচ্চা হত্যাকারীকে ক্ষতিপূরণ দিতে হয়, যদিও তার পরিমাণ ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। কতক আহলে ইলম বলেন, কাফফারা দেওয়া ওয়াজিব। অর্থাৎ মুমিন দাসী মুক্ত করা, যদি মুমিন দাসী পাওয়া না যায় লাগাতার দু’মাস সিয়াম রাখবে। কতক আহলে ইলম গর্ভের বাচ্চা হত্যাকে এক প্রকার জ্যান্ত দাফন গণ্য করেছেন। শাইখ মুহাম্মাদ ইবরাহীম রহ. বলেন: “গর্ভে থাকা বাচ্চা ফেলে দেওয়া হালাল নয়, যদি তার মৃত্যু নিশ্চিত না হয়, মৃত্যু নিশ্চিত হলে ফেলে দিবে”।[7]
‘বড় আলেমদের সংস্থা’র সভায়[8] গর্ভপাত ঘটানোর ব্যাপারে নিম্নরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়:
১. শর‘ঈ দু একটি কারণ ব্যতীত গর্ভের কোনো পর্যায়ে বাচ্চা ফেলা বৈধ নয়।
২. গর্ভ যদি প্রথম পর্যায়ে থাকে, যার বয়স চল্লিশ দিন, আর গর্ভপাত করার কারণ যদি হয় সন্তান লালন-পালন করার কষ্ট অথবা তাদের ভরণ-পোষণ করার দুশ্চিন্তা অথবা ভবিষ্যৎ গড়ার চিন্তা অথবা যে সন্তান আছে তাদেরকে যথেষ্ট জ্ঞান করা, তাহলে বৈধ নয়।
৩. জমাট বাঁধা রক্ত অথবা মাংসের টুকরা থাকা অবস্থায় গর্ভপাত ঘটানো বৈধ নয়, হ্যাঁ যদি নির্ভরযোগ্য ডাক্তারি টিম বলে যে, গর্ভ থাকলে মায়ের জীবনের আশঙ্কা আছে তাহলে বৈধ, তবে এটা অবশ্যই গর্ভধারী মাকে শঙ্কামুক্ত করার সকল প্রচেষ্টা প্রয়োগ শেষে হতে হবে।
৪. গর্ভ যদি তৃতীয় স্তর পার করে ও তার চার মাস পূর্ণ হয়, তাহলে গর্ভপাত করা বৈধ নয়, তবে একদল বিশেষজ্ঞ নির্ভরযোগ্য ডাক্তার যদি বলে যে, পেটে বাচ্চা থাকলে মায়ের মৃত্যুর সমূহ আশঙ্কা রয়েছে তাহলে বৈধ। আর অবশ্যই এটা হতে হবে বাচ্চার জীবন রক্ষা করার সকল প্রচেষ্টা ব্যয় শেষে। এ সুযোগ প্রদান করা হয়েছে দু’টি ক্ষতি থেকে ছোট ক্ষতি দূর করা ও দু’টি কল্যাণ থেকে বড় কল্যাণ অর্জন করার স্বার্থে।
আলেমগণ সভায় এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ শেষে আল্লাহর তাকওয়া ও বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করার উপদেশ দিয়েছেন। আল্লাহ একমাত্র তাওফিক দাতা। আমাদের নবী মুহাম্মাদ, তার পরিবার ও সাথীদের ওপর আল্লাহ সালাত ও সালাম প্রেরণ করুন।
‘নারীদের স্বাভাবিক ঋতু সংক্রান্ত পুস্তিকায়’: (পৃ. ৬০) শাইখ মুহাম্মাদ উসাইমীন রহ. বলেন: “যদি গর্ভের বাচ্চায় রূহ আসার পর গর্ভপাত করে সন্তান নষ্ট করা হয় তাহলে নিঃসন্দেহে হারাম। কারণ এটা অন্যায়ভাবে প্রাণ হত্যার শামিল, নির্দোষ প্রাণকে হত্যা করা কুরআন, সুন্নাহ ও উম্মতের ঐকমত্যে হারাম”।
ইবনুল জাওযী রহ. “আহকামুন নিসা”: (পৃ. ১০৮ ও ১০৯) গ্রন্থে বলেন: “বিবাহের উদ্দেশ্য যখন সন্তান হাসিল করা, আর এটাও সত্য যে সকল বীর্য থেকে সন্তান হয় না, অতএব স্ত্রীর পেটে সন্তান আসলে বিবাহের উদ্দেশ্য হাসিল হলো, তারপর গর্ভপাত ঘটানো বিবাহের হিকমত পরিপন্থী। গর্ভপাত যদি গর্ভের বাচ্চায় রূহ সঞ্চার করার পূর্বে হয় বড় পাপ, আর যদি রূহ সঞ্চার করার পর গর্ভপাত করা হয় সেটা হবে মুমিন নফসকে হত্যা করার মতো। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿وَإِذَا ٱلۡمَوۡءُۥدَةُ سُئِلَتۡ ٨ بِأَيِّ ذَنۢبٖ قُتِلَتۡ ٩﴾ [التكوير: ٨، ٩]
“আর যখন জ্যান্ত দাফনকৃত কন্যাকে জিজ্ঞাসা করা হবে, কোন অপরাধে হত্যা করা হয়েছে”। [সূরা আত-তাকওয়ীর, আয়াত: ৮-৯] সমাপ্ত
অতএব, হে মুসলিম নারী আল্লাহকে ভয় কর, যে কোনো উদ্দেশ্যই হোক এ জাতীয় অপরাধে অগ্রসর হয়ো না। পথভ্রষ্টদের প্রচারণা ও পাপাচারীদের অনুসরণ করে ধোঁকায় পতিত হয়ো না, তাদের কর্মের সাথে বিবেক ও দীনের কোনো সম্পর্ক নেই।
[2] তিরমিযী, হাদীস নং ১৩৯; আবু দাউদ, হাদীস নং ৩১২; ইবন মাজাহ, হাদীস নং ৬৪৮; আহমদ: (৬/৩০০); দারেমী, হাদীস নং ৯৫৫
[3] আল-মুনতাকা: (১/১৮৪)
[4] আবু দাউদ, হাদীস নং ৩১২
[5] দেখুন: (১) শাইখ মুহাম্মাদ ইবন ইবরাহীমের ফতোয়া সমগ্র (এখানে তিনি আরেকটি কথা বলেছেন, যার থেকে বুঝে আসে পুনরায় রক্ত আসার পর যে সিয়াম ত্যাগ করেছে সেগুলো কাযা করবে।) : (২/১০২)। (২) শাইখ আব্দুল আযীয ইবন বায রহ.-এর ফতোয়া ‘মাজাল্লালুত দাওয়াহ: (১/৪৪) প্রকাশিত। (৩) ‘যাদ’ গ্রন্থের ব্যাখ্যার: (১/৪০৫) ওপর ইবন কাসিমের টিকা। (৪) ইবন উসাইমিন কর্তৃক রচিত ‘নারীদের স্বাভাবিক ঋতু সংক্রান্ত পুস্তিকা’: (পৃ. ৫৫ ও ৫৬) ও (৫) ফতোয়া সাদিয়াহ: (পৃ. ১৩৭)
[6] ইরশাদু উলিল আবসার ও উলিল আল-বাব: (পৃ. ২৪)
[7] ফতোয়া সমগ্রে: (১১/১৫১)
[8] সভা নং: (১৪০), তারিখ ২০/৬/১৪০৭ হিজরী