ইহুদি-খ্রিষ্টান পণ্ডিতরা দাবি করেন যে, বিশ্বের বুকে সংঘঠিত অনেক ঘটনার বিষয়েই ভবিষ্যদ্বাণী বাইবেলের মধ্যে লিখিত আছে। কিন্তু মুহাম্মাদ (ﷺ) বিষয়ক কোনো ভবিষ্যদ্বাণী এতে নেই। এর বিপরীতে মুসলিম গবেষকরা, বিশেষত ইহুদি ও খ্রিষ্টধর্ম থেকে ইসলাম গ্রহণকারী পণ্ডিতরা দাবি করেন যে, বাইবেলের মধ্যে মানবীয় বিকৃতির সাথে বেশ কিছু ঐশ্বরিক বাণীও সংমিশ্রিত রয়েছে। আর এগুলোর মধ্যে মুহাম্মাদ (ﷺ) বিষয়ক কিছু ভবিষ্যদ্বাণীও বিদ্যমান। তারা বাইবেলের যে সকল বক্তব্যকে তাদের মতের পক্ষে পেশ করেন ইহুদি-খ্রিষ্টান পণ্ডিতরা সেগুলোকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেন।
বিষয়টা যীশু বিষয়ক ভবিষ্যদ্বাণী প্রসঙ্গে ইহুদি-খ্রিষ্টান বিরোধের মতই। খ্রিষ্টানরা দাবি করেন যে, পুরাতন নিয়মের মধ্যে যীশু বিষয়ক অনেক ভবিষ্যদ্বাণী বিদ্যমান। ইহুদি পণ্ডিতরা বিষয়টা পুরোপুরিই অস্বীকার করেন। ইঞ্জিল লেখক বা খ্রিষ্টান প্রচারকদের দাবি-দাওয়াকে তারা বাইবেলের অপব্যাখ্যা বা বিকৃতি বলে দাবি করেন। ইহুদিরা বলেন, খ্রিষ্টান প্রচারকরা বাইবেলের কিছু বক্তব্য পূর্বাপর থেকে বিচ্ছিন্ন করে এবং কখনো অর্থ পরিবর্তন করে অপ্রাসঙ্গিকভাবে যীশু বিষয়ক ভবিষ্যদ্বাণী বলে দাবি করেন। এ বিষয়ক কিছু নমুনা আমরা দেখেছি। ইহুদি পণ্ডিত রাবিব স্টুয়ার্ট ফেডেরো (Rabbi Stuart Federow) পরিচালিত what jews believe নামক ওয়েবসাইটের ‘খ্রিষ্টীয় প্রমাণাদি এবং ইহুদীয় প্রত্যুত্তর (Christian Prooftexts and the Jewish Response) প্রবন্ধ থেকে (http://www. whatjewsbelieve.org/prooftext.html) পাঠক এ বিষয়ে আরো অনেক কিছু জানতে পারবেন।
অনুধাবনের জন্য একটা ভবিষ্যদ্বাণী উল্লেখ করা যায়। আমরা দেখেছি, যিশাইয় ৭/১৪ নিম্নরূপ: ‘‘অতএব প্রভু নিজে তোমাদেরকে একটি চিহ্ন দেবেন; দেখ, এক জন কুমারী কন্যা গর্ভবতী হয়ে পুত্র প্রসব করবে ও তাঁর নাম ইম্মানূয়েল রাখবে’’ (মো.-১৩)। এ বক্তব্যটাকে যীশু বিষয়ক ভবিষ্যদ্বাণী বলে দাবি করে মথি লেখেছেন: ‘‘এ সব ঘটলো, যেন নবীর মধ্য দিয়ে প্রভুর এই যে কালাম নাজেল হয়েছিল, তা পূর্ণ হয়, ‘দেখ সেই কন্যা গর্ভবতী হবে এবং পুত্র প্রসব করবে, আর তার নাম ইম্মানূয়েল রাখা হবে।’’ (মথি ১/২২-২৩, মো.-১৩)
পঞ্চম অধ্যায়ে আমরা যিশাইয়ের বক্তব্যের অর্থ পরিবর্তন বিষয়টা দেখেছি। আমরা আরো দেখেছি যে, যিশাইয় পুস্তকে এ ভবিষ্যদ্বাণীটা মসীহ প্রসঙ্গে বলা হয়নি, বরং সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা ঘটনার আলামত হিসেবে বলা হয়েছে। সর্বোপরি যীশুর নাম কেউ কখনো ‘ইম্মানুয়েল’ রাখেননি। ইম্মানুয়েল শব্দটার অর্থ ‘আমাদের সাথে ঈশ্বর’। আমরা জানি যে, যীশু নিজে কখনো নিজেকে ঈশ্বর বলে দাবি করেননি, তবে খ্রিষ্টধর্মীয় বিশ্বাসে যীশু ঈশ্বর। এ অর্থের দিকে লক্ষ্য রেখে খ্রিষ্টানরা এ ভবিষ্যদ্বাণীকে যীশুর আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী বলে দাবি করেছেন।
উইকিপিডিয়ায় ‘Muhammad in the Bible’ প্রবন্ধের আলোকে বাইবেলের এ বিষয়ক কিছু বক্তব্য নিম্নে উদ্ধৃত করছি (https://en.wikipedia.org/wiki/Muhammad_in_the_Bible)।
বাইবেলের প্রথম পুস্তক Genesis। বাংলায় আদিপুস্তক বা পয়দায়েশ। এ পুস্তকের ১৭ অধ্যায়ের ২০ শ্লোকের বর্ণনায় ঈশ্বর আব্রাহামকে বলেন:
‘‘আর ইসমাইলের বিষয়েও তোমার মুনাজাত শুনলাম; দেখ, আমি তাকে দোয়া করলাম (KJV: I have blessed him, RSV: I will bless him) এবং তাকে ফলবান করে তার অতিশয় বংশবৃদ্ধি করব (will multiply him exceedingly); তা থেকে বার জন বাদশাহ উৎপন্ন হবে ও আমি তাকে বড় জাতি করব (I will make him a great nation)।’’ (মো.-১৩)
মুসলিম পণ্ডিতরা তৌরাতের এ বক্তব্যকে মুহাম্মাদ (ﷺ) বিষয়ক অন্যতম ভবিষ্যদ্বাণী বলে গণ্য করেন। হিব্রু ভাষায় ‘বড় জাতি’ বোঝাতে ‘লুগাই গাদূল’ এবং ‘অতিশয়’ বলতে ‘বিমাদমাদ’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। উভয় শব্দের সাংখ্যিক মান ‘মুহাম্মাদ’ শব্দের সাংখ্যিক মানের সমান। ইহুদী পন্ডিতরা পুরাতন নিয়মের অনেক ভবিষ্যদ্বাণীর অর্থ অক্ষরগুলোর সাংখ্যিক মান দিয়ে নির্ণয় করতেন। এজন্য অনেক ইহূদী পন্ডিত ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পরে জানিয়েছেন যে, তাওরাতের এ কথাটা মুহাম্মাদ (ﷺ) বিষয়ক ভবিষ্যদ্বাণী বলে তাঁরা নিশ্চিত জানতেন। স্যামুয়েল (Samau'al al-Maghribi) বা সামাওআল বিন ইয়াহিয়া (৫৭০ হি/ ১১৭৫ খ্রি) ছিলেন ৬ষ্ঠ হিজরী/ দ্বাদশ খ্রিষ্টীয় শতকের প্রসিদ্ধ ইহুদি বিজ্ঞানী, গণিতবিদ ও জ্যেতির্বিদ (https://en.wikipedia.org/wiki/Al-Samawal_al-Maghribi)। তিনি তাঁর রচিত ‘ইফহামুল ইয়াহুদ’ নামক পুস্তকে বিষয়টা আলোচনা করেছেন।[1]
উপরের বিষয়টা বাদ দিলেও আক্ষরিকভাবেই বাইবেলের উপর্যুক্ত বক্তব্য মুহাম্মাদ (ﷺ) -এর আগমনের সুসংবাদ। কারণ এখানে ইসমাঈলের (আ) প্রশংসা ও মর্যাদা বৃদ্ধির সুসংবাদ দিয়ে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তাকে অতিশয় বৃদ্ধি করবেন এবং বড় জাতি করবেন। এদ্বারা কখনোই স্বাভাবিক বংশবৃদ্ধি বোঝানো হয়নি। কারণ স্বাভাবিক বংশবৃদ্ধিতে কোনো মর্যাদা নেই। সকল মানুষেরই বংশবৃদ্ধি হয়। নিঃসন্দেহে এখানে বিশেষ মর্যাদাময় বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে। ইসমাঈল (আ)-এর উত্তরপুরুষ মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর আগে ইসমাঈলের বংশধর ইতিহাসে বা মানব সভ্যতায় কোনো বিশেষ বৃদ্ধি বা ‘বড় জাতি’ হিসেবে প্রসার লাভ করেননি। মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর মাধ্যমেই এ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হয়েছে। তাঁর মাধ্যমেই ইসমাঈলের (আ) বংশ ‘অতিশয় বৃদ্ধি’ পেয়েছে এবং বিশ্ব সভ্যতায় ‘বড় জাতি’ (great nation) হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
আদিপুস্তকের ৪৯ অধ্যায়ে ইয়াকুব (যাকোব) তাঁর মৃত্যুর পূর্বে তাঁর পুত্রদেরকে একত্রিত করে তাদের জন্য দুআ করেন এবং ভবিষ্যতে তাদের প্রতি কি ঘটবে তা বলেন। এ প্রসঙ্গে ৪৯/১০ শ্লোকে তিনি বলেন: ‘‘এহুদা থেকে রাজদ- যাবে না, তার চরণযুগলের মধ্য থেকে বিচারদ- যাবে না, যে পর্যন্ত শীলো (Shiloh) না আসেন; সমস্ত জাতি তাঁরই অধীনতা স্বীকার করবে।’’ (মো.-১৩)
উইকলিফ বাইবেল (WYC: Wycliffe Bible)-এর শ্লোকটা নিম্নরূপ: ‘‘The sceptre shall not be taken away from Judah, and a duke (out) of his hip (nor a ruler from between his hips, or out of his loins), till he come that shall be sent, and he shall be the abiding of heathen men.” অর্থ: ‘‘এহুদা থেকে রাজদ- যাবে না, এবং তার চরণযুগলের মধ্য থেকে একজন শাসক, যে পর্যন্ত তিনি না আসেন যিনি প্রেরিত হবেন, এবং অ-ইহুদি/ অখ্রিষ্টান বা অবিশ্বাসীদের অবস্থানস্থল-মান্যবর হবেন তিনিই।’’[1]
এ থেকে জানা যায় যে, শীলোহের আগমনের পর অ-ইহুদি সকল জাতি তাঁর আনুগত্য করবে এবং এর মাধ্যমে এহুদার মর্যাদার পরিসমাপ্তি ঘটবে। মুসলিম পণ্ডিতরা দাবি করেন যে, এটা মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর আগমন বিষয়ক ভবিষ্যদ্বাণী। উপরের ভবিষ্যদ্বাণীতে ইসমাইল বিষয়ক যে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে, এখানে সেটাই পরিষ্ফুটিত হয়েছে। অর্থাৎ শীলোহের আগমনের মাধ্যমে ইসমাইলের বংশধর মহাজাতিতে পরিণত হবে এবং অ-ইহুদি সকল জাতি তাঁর অধীনতা গ্রহণ করবে।
প্রফেসর রেভারেন্ড ডেভিড বেঞ্জামিন (Rev. David Benjamin Keldani) আরমেনীয়ার একজন বিশপ ছিলেন। তিনি খৃস্টধর্মের উপরে সর্বোচ্চ লেখাপড়া করেন এবং গ্রীক, ল্যাটিন, সিরিয়ান, আরামাইক, হিব্রু, কালডীয়ান ইত্যাদি ভাষায় সুপন্ডিত ছিলেন। ১৯০০ সালের দিকে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং আব্দুল আহাদ দাউদ (Abdu’l Ahad Dawud) নাম গ্রহণ করেন । তাঁর রচিত একটা পুস্তক (Muhammad in the Bibble)। এ পুস্তকে তিনি বাইবেল ও হিব্রু ভাষার ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন যে, শীলোহ বলতে মুহাম্মাদ (ﷺ)-কেই বোঝানো হয়েছে।[2]
এ প্রসঙ্গে উইকিপিডিয়া ‘Muhammad in the Bible’ প্রবন্ধে লেখেছে:
“This prophecy is often read in the light of Qur'an 3:81 as a prophecy of Muhammad. Some writers, like David Benjamin, believe that the Hebrew word Shiloh is actually a distortion of the Hebrew word ‘Shaluh’ which means ‘Apostle/Messenger/ One to be sent’ or of the Hebrew word ‘Shiluah’ which means ‘Apostle of God’. The Latin Vulgate also translates the word to ‘He ... that is to be sent’.”
‘‘এ ভবিষ্যদ্বাণীকে অনেক সময় কুরআনের ৩য় সূরার ৮১ আয়াতের আলোকে মুহাম্মাদ (ﷺ) বিষয়ক ভবিষ্যদ্বাণী হিসেবে পড়া হয়। ডেভিড বেঞ্জামিনের মত কতিপয় লেখক বিশ্বাস করেন যে, হিব্রু ‘শীলোহ’ শব্দটা প্রকৃতপক্ষে হিব্রু ‘শালূহ’ শব্দের বিকৃত রূপ, যার অর্থ ‘রাসূল, প্রেরিত/ যাকে প্রেরণ করা হবে’। অথবা ‘শীলোহ’ শব্দটা হিব্রু ‘শীলুআহ’ শব্দ থেকে বিকৃত হয়েছে, যার অর্থ ‘রাসূলুল্লাহ’। ল্যটিন বাইবেলে শীলোহ অর্থ লেখা হয়েছে; ‘‘তিনি... যিনি প্রেরিত হবেন।’’
[2] Dawud, Abdul Ahad (Keldani, David Benjamin), 1992, Muhammad in the Bible, Abul Qasim Publishing House, Jeddah. P-41-47u
বাইবেলের পঞ্চম পুস্তক দ্বিতীয় বিবরণ ১৮/১৭-২০ বলছে:
‘‘তখন মাবুদ আমাকে বললেন, ‘ওরা ভালই বলেছে। আমি ওদের জন্য ওদের ভাইদের মধ্য থেকে তোমার মত এক জন নবী (a Prophet from among their brethren, like unto thee) উৎপন্ন করব। ও তার মুখে আমার কালাম দেব; আর আমি তাঁকে যা যা হুকুম করব তা তিনি ওদেরকে বলবেন। আর আমার নামে তিনি আমার যে সব কালাম বলবেন, আমার সেই কথা যদি কেউ না শোনে তবে আমি সেই লোককে দায়ী করব। কিন্তু আমি যে কালাম বলতে হুকুম করিনি, আমার নামে যে কোন নবী দুঃসাহসপূর্বক তা বলে কিংবা অন্য দেবতাদের নামে যে কেউ কথা বলে সেই নবীকে মরতে হবে। (মো.-১৩)
মুসলিম পণ্ডিতরা দাবি করেন যে, এখানে বনি-ইসরাইলের ভাতৃগণ বনি-ইসমাইল বা ইসমাইল বংশে মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে মূসা (আ)-এর মত একজন নবী হিসেবে প্রেরণের ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে। ইহুদি-খ্রিষ্টান পণ্ডিতরা এ দাবি অস্বীকার করেন। কোনো কোনো ইহুদি পণ্ডিত দাবি করেন যে, এ ভবিষ্যদ্বাণীতে মূসা (আ)-এর পরবর্তী নবী ইউসাকে বোঝানো হয়েছে। আর খ্রিষ্টান পণ্ডিতরা দাবি করেন যে, এখানে যীশু খ্রিষ্টকে বোঝানো হয়েছে। খ্রিষ্টীয় ধর্মবিশ্বাসে তিনি নিজেই ঈশ্বর ছিলেন, ঈশ্বরের পুত্রও ছিলেন, ঈশ্বরের নবীও ছিলেন এবং ঈশ্বরের মসীহও ছিলেন।
মুসলিম পণ্ডিতরা বাইবেলের বিভিন্ন বক্তব্য দ্বারা ইহুদি ও খ্রিষ্টান পণ্ডিতদের দাবি খণ্ডনের চেষ্টা করেছেন। যোহন বা ইউহোন্না তাঁর ইঞ্জিলের প্রথম অধ্যায়ে লেখেছেন: ‘‘আর ইয়াহিয়ার সাক্ষ্য এই- যখন ইহুদীরা কয়েক জন ইমাম ও লেবীয়কে দিয়ে জেরুসালেম থেকে তাঁর কাছে এই কথা জিজ্ঞাসা করে পাঠালো, ‘ধাপনি কে?’ তখন তিনি স্বীকার করলেন, অস্বীকার করলেন না, তিনি স্বীকার করে বললেন, ‘আমি সেই মসীহ নই।’ তারা তাঁকে জিজ্ঞাসা করলো, তবে আপনি কে? আপনি কি ইলিয়াস? তিনি বললেন, আমি নই। আপনি কি সেই নবী? জবাবে তিনি বললেন, না। ... তারা তাঁকে জিজ্ঞসা করলো, আপনি যদি সেই মসীহ্ নন, ইলিয়াসও নন, সেই নবীও নন, তবে বাপ্তিস্ম দিচ্ছেন কেন?’’ (ইউহোন্না ১/১৯-২৫, মো.-১৩)
এ বক্তব্য থেকে জানা যায় যে, ইহুদিরা বিশ্বাস করতেন যে, প্রতিশ্রুত নবীর আগমন তখনো হয়নি এবং ‘সেই নবী’ ও ‘মসীহ’ দু’ ব্যক্তি হবেন, এক ব্যক্তি নন। ইউহোন্না অন্যত্র লেখেছেন: ‘‘সে সব কথা শুনে লোকদের মধ্যে কেউ কেউ বললো, ইনি সত্যিই সেই নবী। আর কেউ কেউ বলল, ইনি সেই মসীহ।’’ (ইউহোন্না ৭/৪০-৪১)। এ থেকেও জানা যায় যে, ‘মসীহ’ ও ‘সেই নবী’ পৃথক ব্যক্তি হবেন।
মুসলিম পণ্ডিতরা আরো দাবি করেন যে, উপরের ভবিষ্যদ্বাণীর বক্তবও প্রমাণ করে যে, মুহাম্মাদই (ﷺ) প্রতিশ্রুত নবী। কারণ তিনি মূসার মত বা সদৃশ (like unto thee) ছিলেন। যেমন তাঁরা উভয়ে আল্লাহর বান্দা ও রাসূল, পিতা-মাতার সন্তান, বিবাহিত ও সন্তান-সন্ততির পিতা, উভয়েই নতুন শরীয়ত দিয়েছেন, উভয়ের শরীয়তেই রাষ্ট্র, সমাজ, জিহাদ, যুদ্ধ, বিচার, শাস্তি ইত্যাদি বিধান বিদ্যমান, উভয়েই ত্রিত্ববাদ মুক্ত বিশুদ্ধ তাওহীদ বা একত্ববাদের শিক্ষা ও নির্দেশ দিয়েছেন, উভয়েই স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেছেন, তাঁরা কেউ অনুসারীদের জন্য শাপগ্রস্ত হননি ইত্যাদি। তাঁদের উভয়ের জীবন ও ধর্ম-ব্যবস্থা (শরীয়ত) তুলনা করলে এরূপ আরো অনেক সাদৃশ্য ও মিল আমরা দেখতে পাই। এ সকল কোনো বিষয়েই ঈসা মাসীহের সাথে মূসার (আ) কোনো মিল নেই। তিনি কোনোভাবেই মূসার সদৃশ ছিলেন না। এছাড়া বাইবেল বলছে: ‘‘মূসার মত কোন নবী ইসরাইলের মধ্যে আর উৎপন্ন হয়নি।’’ (দ্বিতীয় বিবরণ ৩৪/১০, মো.-১৩)
এ প্রসঙ্গে উইকিপিডিয়া ‘Muhammad in the Bible’ প্রবন্ধে লেখেছে:
“Samau'al al-Maghribi, a Jewish mathematician who converted to Islam, pointed to Deuteronomy 18:18 in his book Convincing the Jews as a prophecy fulfilled by Muhammad. Samau'al argued in his book that since the children of Esau are described in Deuteronomy 2:4-6 [and in Numbers 20:14 as well] as the brethren of the children of Israel, the children of Ishmael can also be described the same way.... Some Muslim writers... interpreted Qur'an 46:10 as a reference to Deuteronomy 18:18. The witness from among the Children of Israel is thought to be Moses, and the one like him is believed to be Muhammad. Qur'an 73:15 was also interpreted by some Muslim writers... as a reference to Deuteronomy 18:18. Similarly, Qur'an 53:3-4, where it has been stated that "Nor does he (Muhammad) speak of his own desire. It is but an Inspiration that is inspired [unto him]", was further interpreted by Muslim writers, as a reference to Deuteronomy 18:18. John 1:20-21 was also cited by Muslims as a proof from the canonical gospels that Deuteronomy 18:18 is not a prophecy of the Christ.”
‘‘ইহুদি গণিতবিদ সামাওয়াল মাগরিবী যিনি ইসলাম গ্রহণ করেন, তার ‘ইহুদিদেরকে বোঝানো’ নামক পুস্তকে দ্বিতীয় বিবরণকে ১৮/১৮ মুহাম্মাদের (ﷺ) আগমনের মাধ্যমে পূর্ণতার ভবিষ্যদ্বাণী হিসাবে ইঙ্গিত করেছেন। সামাওয়াল যুক্তি দিয়েছেন যে, দ্বিতীয় বিবরণ ২/৪-৬ (এবং গণনা ২০/১৪) শ্লোকে ইস-এর বংশধরদেরকে বনি-ইসরাইলের ‘ভ্রাতৃগণ’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এজন্য ইসমাইলের বংশধরগণও একইভাবে বনি-ইসরাইলের ‘ভ্রাতৃগণ’ বলে আখ্যায়িত হতে পারেন। ... কোনো কোনো মুসলিম লেখক কুরআনের ৪৬ সূরার (আহকাফ) ১০ আয়াতকে দ্বিতীয় বিবরণ ১৮/১৮ উদ্ধৃতি বলে ব্যাখ্যা করেছেন। এ আয়াতে বনি-ইসরাইলের সাক্ষী বলতে মূসা (আ) এবং ‘তাঁর মত একজনের’ বলতে মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে বোঝানো হয়েছে। কুরআনের ৭৩ সূরার (মুযাম্মিল) ১৫ আয়াতকেও কোনো কোনো মুসলিম লেখক দ্বিতীয় বিবরণের এ বক্তব্যের প্রতি ইঙ্গিত বলে গণ্য করেছেন। অনুরূপভাবে কুরআনের ৫৩ সূরা (নাজম) ৩-৪ আয়াত বলছে: ‘‘তিনি (মুহাম্মাদ) নিজের ইচ্ছা থেকে কথা বলেন না, তাঁর কথা ওহী ভিন্ন কিছুই নয়, যা তাকে প্রত্যাদেশ করা হয়।’’ এ বক্তব্যকেও কোনো কোনো মুসলিম লেখক দ্বিতীয় বিবরণ ১৮/১৮-এর উল্লেখ বলে গণ্য করেছেন। মুসলিমগণ স্বীকৃত ইঞ্জিল যোহন ১/২০-১২ উদ্ধৃত করে প্রমাণ করেন যে, দ্বিতীয় বিবরণ ১৮/১৮ খ্রিষ্টের আগমন বিষয়ক ভবিষ্যদ্বাণী নয়।’’
বনি-ইসরাইলদের মুর্তিপূজা, অনাচার ইত্যাদির কারণে ঈশ্বরের প্রতিক্রিয়ার ভবিষ্যদ্বাণী করে বাইবেল বলছে: ‘‘যারা আল্লাহ্ নয় এমন দেবতার দ্বারা ওরা আমার অন্তর্জ্বালা জন্মালো, নিজ নিজ অসার বস্ত্ত দ্বারা আমাকে অসন্তষ্ট করলো; আমিও ন-জাতি (those which are not a people) দ্বারা ওদের অন্তর্জ্বালা জন্মাবো, মূঢ় জাতি (a foolish nation) দ্বারা ওদেরকে অসন্তষ্ট করবো। (মো.-১৩)
কিতাবুল মোকাদ্দস-২০০৬: ‘‘আল্লাহ নয় এমন দেবতার পূজা করে তারা আমার পাওনা এবাদতের আগ্রহে আগুন লাগিয়েছে; অসার মূর্তির পূজা করে তারা আমার রাগ জাগিয়ে তুলেছে। জাতিই নয় এমন জাতির হাতে ফেলে আমিও তাদের অন্তরে আগুন জ্বালাব; একটা অবুঝ জাতির হাতে ফেলে তাদের রাগ জাগাব।’’
এ ভবিষ্যদ্বাণীর মর্ম আরো সুস্পষ্ট হয় যিশাইয় ৬৫/১-৬ শ্লোক দ্বারা: ‘‘যারা জিজ্ঞাসা করেনি, আমি তাদেরকে আমার সন্ধান করতে দিয়েছি; যারা আমার খোঁজ করেনি, আমি তাদেরকে আমার উদ্দেশ পেতে দিয়েছি; যে জাতি আমার নামে আখ্যাত হয়নি, তাকে আমি বললাম, ‘দেখ, এই আমি, দেখ এই আমি’। আমি সমস্ত দিন বিদ্রোহী লোকবৃন্দের (কেরি: প্রজাবৃন্দের) প্রতি আমার দু’হাত বাড়িয়েই রয়েছি; তারা নিজ নিজ কল্পনার অনুসরণ করে কুপথে গমন করে। সেই লোকেরা আমার সাক্ষাতে অনবরত আমাকে অসন্তষ্ট করে, বাগানের মধ্যে কোরবানী করে, ইটের উপরে সুগন্ধিদ্রব্য জ্বালায়। তারা কবরস্থানে বসে, গুপ্ত স্থানে রাত যাপন করে; তারা শুকরের গোশ্ত ভোজন করে ও তাদের পাত্রে ঘৃণিত মাংসের ঝোল থাকে; তারা বলে, স্বস্থানে থাক, আমার কাছে এসো না, কেননা তোমার চেয়ে আমি পবিত্র। এরা আমার নাসিকার ধোঁয়া, সমস্ত দিন জ্বলতে থাকা আগুন। দেখ, আমার সম্মুখে এই কথা লেখা আছে; আমি নীরব থাকব না, প্রতিফল দেব; এদের কোলেই প্রতিফল দেব।’’ ইশাইয়া ৬৫/১-৬ (মো.-১৩)
মুসলিম পণ্ডিতরা এ বক্তব্যটাকে মুহাম্মাদ (ﷺ) বিষয়ক ভবিষ্যদ্বাণী বলে গণ্য করেন। এখানে মূঢ় (আরবী বাইবেলে: জাহিল) জাতি বলতে আরবদেরকে বোঝানো হয়েছে, যাদেরকে উম্মী বা নিরক্ষর ও জাহিল বা মূঢ় বলা হতো। দাসী হাজেরার পুত্র ইসমাইলের বংশধর হওয়ার কারণে এবং ধর্মবিষয়ক অজ্ঞতার কারণে ইহূদিরা তাদেরকে ঘৃণা করতেন। ইহূদীরা ইবরাহীমের স্বাধীন স্ত্রীর সন্তান, আল্লাহর আশীর্বাদ-প্রাপ্ত, নবীদের বংশধর, আসমানী কিতাব ও শরীয়তের অনুসারী হিসেবে নিজেদেরকে উন্নত জাতি বলে মনে করতেন। কিন্তু তারা প্রতিমা পূজা ও বহুবিধ শিরক ও পাপাচারে লিপ্ত হন। শাস্তি হিসেবে মহান আল্লাহ তাদের নিয়ামত ও মর্যাদা ছিনিয়ে নিয়ে তাদের কাছে ঘৃণিত ও জাতি হিসেবে ‘অগণ্য’ আরব জাতি বা বনি-ইসমাইলকে প্রদান করে বনি-ইসরাইলের জন্য চিরস্থায়ী মনোকষ্টের ব্যবস্থা করেন।
বাইবেলের পুরাতন নিয়ম অধ্যয়ন করলে পাঠক নিশ্চিত হবেন যে, ঈশ্বরের একত্ববাদ বা একমাত্র ঈশ্বরের ইবাদত করা ও অন্য কোনো মানুষ, দেবতা, প্রতিমা বা বস্ত্তর ইবাদত না করাই বাইবেলের মূল নির্দেশ। ইহূদীরা একত্ববাদ বিনষ্ট করে আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে। এর বিপরীতে একটা মুঢ় জাতিকে প্রকৃত একত্ববাদ প্রদান করে তাদের মাধ্যমে আল্লাহ ইহূদীদেরকে অসন্তুষ্ট করেন। আর এজন্যই মুসলিমদের প্রতি ইহূদীদের অন্তর্জ্বালা ও অসন্তুষ্টি চিরন্তন। তাত্ত্বিকভাবে তারা স্বীকার করতে বাধ্য যে, খ্রীষ্টধর্ম, হিন্দুধর্ম ইত্যাদি অত্যন্ত বিকৃত, ঘৃণ্য ও ঈশ্বরের অবমাননাকর বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত। পক্ষান্তরে ইসলামী একত্ববাদ, মুর্তিপূজার বিরোধিতা, ইবাদত-বন্দেগি, শুচিতা-অশুচিতা ইত্যাদি সবই বিশুদ্ধ একত্ববাদের উপর প্রতিষ্ঠিত ও ইহূদী ধর্ম-ব্যবস্থার কাছাকাছি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মুসলিমদের প্রতি তাদের অসন্তুষ্টি এতই বেশি ও চিরস্থায়ী যে, এদের বিরুদ্ধে তারা যে কোনো মুর্তিপূজক, ত্রিত্ববাদী বা বহু-ঈশ্বরবাদী জাতির সাথে জোটবদ্ধ হতে প্রস্তুত।
যে সকল জাতি দ্বারা আল্লাহ ইস্রায়েলীয়গণকে অসন্তুষ্ট করেছেন তাদের অন্যতম ব্যাবিলনীয় জাতি, গ্রীক-রোমান জাতি ও আরব জাতি। এদের মধ্যে আরবরাই ছিল মূঢ় বা জাহিল হিসেবে সুপ্রসিদ্ধ। অন্যান্যরা শিক্ষা, সভ্যতা ও জ্ঞান-দর্শনে ইস্রায়েলীদের সমপর্যায়ের বা তার চেয়েও অধিক উন্নত ছিল। কোনো প্রাজ্ঞ গবেষকই দাবি বা স্বীকার করবেন না যে, ব্যাবিলনীয়রা বা গ্রীকরা মুর্খ জাতি বা তারা আরব বা ইহূদীদের তুলনায় মুর্খ ছিল। খৃস্টীয় ৬ষ্ঠ শতকে মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর আবির্ভাব পর্যন্ত আরবরা ছাড়া অন্য কোনো জাতি এরূপ মূঢ় বা জাহিলী জাতি বলে প্রসিদ্ধি লাভ করেনি। এভাবে আমরা দেখতে পাই যে, এ ভবিষ্যদ্বাণীটা আক্ষরিকভাবে আরব জাতির মধ্যে এক মহান নবীর আবির্ভাবের কথা বলেছে, যার আবির্ভাব পৌত্তলিকতা, প্রতিমাপূজা, শূকরের মাংস ভক্ষণ ও অন্যান্য পাপাচারে লিপ্ত ইহূদী জাতির স্থায়ী মনোকষ্ট ও অন্তর্জ্বালা সৃষ্টি করবে।
এছাড়া আমরা দেখেছি যে, অসন্তুষ্টির মূল বিষয় অসার দেবদেবীর উপাসনা বনাম প্রকৃত একত্ববাদ লাভ। এ দিক থেকে মুসলিমগণ ছাড়া অন্য কোনো জাতি তাদেরকে অসন্তুষ্ট করে নি। সর্বোপরি এরূপ চিরন্তুন অসন্তুষ্টি আর কোনো জাতির প্রতি তাদের নেই। খৃস্টানগণ তো বনি-ইসরাইলেরই অন্তুর্ভুক্ত এবং তাদের দ্বারাই প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত। কাজেই তাদেরকে ভিন্ন জাতি বা মূঢ় জাতি বলে গণ্য করার কোনো উপায় নেই।
এছাড়া ইহূদীদের অন্তর্জ্বালার সবচেয়ে বড় বিষয় ফিলিস্তিন অধিকার। এখানেও আল্লাহ আরবজাতিকে তাদের স্থায়ী অন্তর্জ্বালার উৎস বানিয়েছেন। ইতিহাসের যে কোনো পাঠক জানেন যে, বিগত দেড় হাজার বছর ধরে ইহূদীরা ইউরোপসহ সারা পৃথিবীতে অত্যাচারিত হয়েছেন এবং একমাত্র আরব ও মুসলিম দেশগুলোতেই পরিপূর্ণ নিরাপত্তা ও শান্তিতে অবস্থান করেছেন। কিন্তু ইহূদীদেরকে প্রশ্ন করলে দেখবেন, তাদের অন্তর্জ্বালা অত্যাচারীদের প্রতি তত নয়, যতটা আরব ও মুসলিমদের প্রতি।
মূসা (আ) মৃত্যুর পূর্বে বনি-ইসরাইলের জন্য যে দুআ করেন তাতে বলেন: ‘‘মাবুদ সিনাই (Sinai) থেকে আসলেন, সেয়ীর (Seir) থেকে তাদের প্রতি উদিত হলেন; পারণ পর্বত (mount Paran) থেকে তাঁর তেজ প্রকাশ করলেন, ওযুত ওযুত পবিত্র লোকদের কাছ থেকে আসলেন (মূল ইংরেজি: and he came with ten thousands of saints: এবং তিনি দশ হাজার সাধু পুরুষের সাথে আগমন করলেন); তাদের জন্য তাঁর ডান হাতে অগ্নিময় শরীয়ত (a fiery law) ছিল।’’ (দ্বিতীয় বিবরণ ৩৩/১-২, মো.-১৩)
মুসলিমরা দাবি করেন যে, এখানে ‘সীনয় হইতে আগমনের’ অর্থ মূসা (আ)-কে তাওরাত প্রদান করা এবং ‘সেয়ীর হইতে উদিত হওয়ার’ অর্থ যীশুকে ইনজীল প্রদান করা। আর পারণ পর্বত থেকে আপন তেজ প্রকাশ করার অর্থ মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর উপর কুরআন অবতীর্ণ করা। কারণ ‘পারণ পর্বত’ মক্কার একটা পর্বত। আদিপস্তক ২১/২১ শ্লোকে ইসমাঈল (আ)-এর বিষয়ে বলা হয়েছে: ‘‘সে পারণ মরুপ্রান্তরে বাস করতে লাগল (in the wilderness of Paran)।’’
এখানে আরো লক্ষণীয় যে, দশ সহস্র পবিত্র ব্যক্তিসহ (with ten thousands of saints) আগমন এবং দক্ষিণ হস্তে অগ্নিময় শরীয়ত (from his right hand went a fiery law for them) মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। মক্কা বিজয়ের সময় তিনি দশ সহস্র সাথী সহ মক্কায় আগমন করেন।
বাইবেলের অন্যতম পুস্তক Psalms, বাংলায় গীতসংহিতা, সামসঙ্গীত বা জবুর। এটা ইহুদি বাইবেলে ২৭ নং প্রটেস্ট্যান্ট বাইবেলে ১৯ নং এবং ক্যাথলিক বাইবেলে ২৩ নং পুস্তক। এ পুস্তকের ৪৫ গীতের শুরুতে দাউদ বলেন: ‘‘আমার হৃদয়ে শুভকথা উথলে উঠছে; আমি বাদশাহ্র বিষয়ে আমার রচনা বিবৃত করবো; আমার জিহবা দক্ষ লেখকের লেখনীস্বরূপ।’’ (জবুর ৪৫/১)। অনেক মুসলিম গবেষক দাবি করেন যে, দাউদের এ বর্ণনা মুহাম্মাদ (ﷺ) বিষয়ক ভবিষ্যদ্বাণী। বাদশাহ দাউদের মুখের এ ভবিষ্যদ্বাণী মুহাম্মাদ (ﷺ) ছাড়া আর কোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে না। উইকিপিডিয়া এ প্রসঙ্গে লেখেছে: “Psalm 45:1-17 is a prophecy and a song of praise for the king. Several Muslim writers raised the argument that it is describing no one other than Muhammad for the following reasons...”
‘‘জবুর ৪৫/১-১৭ একটা ভবিষ্যদ্বাণী ও বাদশাহের প্রশংসার একটা গীত। অনেক মুসলিম লেখক যুক্তি প্রদান করেছেন যে, এ গীতে যার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে তিনি মুহাম্মাদ (ﷺ) ছাড়া আর কেউ নন। তাদের যুক্তিগুলো নিম্নরূপ:....
(ক) বাদশাহর প্রশংসায় সৌন্দর্য ও রহমতের সমন্বয় প্রসঙ্গে বলা হয়েছে: ‘‘তুমি মানুষের চেয়ে পরম সুন্দর; তোমার ওষ্ঠাধর থেকে রহমত ঝরে পড়ে। এজন্য আল্লাহ্ চিরকালের জন্য তোমাকে দোয়া করেছেন।’’ (জবুর ৪৫/২, মো.-১৩)। লক্ষণীয় যে, নবী ও ধর্মপ্রবর্তকদের মধ্যে একমাত্র মুহাম্মাদের অনুসারীরাই সর্বদা তাঁর নামের সাথে ‘সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’, অর্থাৎ ‘আল্লাহর দোয়া ও শান্তি তাঁর উপর’ বলেন। এভাবে তাঁর জন্য আল্লাহ চিরস্থায়ী দোয়ার ব্যবস্থা করেছেন।
(খ) এরপর জিহাদ, ধার্মিকতা ও বিনম্রতার সমন্বয় বিষয়ে বলা হয়েছে: ‘‘হে বীর, তোমার তলোয়ার কোমরে বাঁধ, তোমার গৌরব ও মহিমা গ্রহণ কর। আর স্বীয় প্রতাপে কৃতকার্য হও, বাহনে চড়ে যাও, সত্যের ও ধামির্কতাযুক্ত নম্রতার পক্ষে, তাতে তোমার ডান হাত তোমাকে ভয়াবহ কাজ শেখাবে। তোমার সমস্ত তীর ধারালো, জাতিরা তোমার পদতলে পতিত হয়, বাদাশাহ্র দুশমনদের অন্তর বিদ্ধ হয়।’’ (জবুর ৪৫/৩-৫, মো.-১৩)
(গ) বাদশাহর অনেক স্ত্রী থাকবেন এবং তাদের মধ্যে শাহজাদীরা থাকবেন: ‘‘তোমার মহিলারত্নদের মধ্যে শাহ্জাদীরা আছেন, তোমার ডান দিকে দাঁড়িয়ে আছেন রাণী, ওফীরের সোনা দিয়ে সেজে আছেন’’ (জবুর ৪৫/৯, মো.-১৩)।
আয়েশা (রা) ও হাফসা (রা) ছিলেন পরবর্তী দু বাদশাহ আবু বকর (রা) ও উমারের (রা) কন্যা। আর সাফিয়্যাহ বিনত হুআই (রা) ছিলেন খাইবারের ইহুদি শাসক হুআই ইবন আখতাবের কন্যা।
(ঘ) বাদশাহ দাউদ এ গীতে তাঁর নিজের কন্যাকে সম্বোধন করে যা বলেছেন তা খাইবারের ইহুদি শাসক হুআই ইবনু আখতাবের কন্যা সাফিয়্যাহর ক্ষেত্রে হুবহু প্রযোজ্য: ‘‘বৎস, শোন, দেখ, কান দাও; তোমার জাতি ও তোমার পিতৃকুল ভুলে যাও। তাতে বাদশাহ্ তোমার সৌন্দর্য বাসনা করবেন; কেননা তিনিই তোমার প্রভু, তুমি তাঁর কাছে সেজ্দা কর।’’ (জবুর ৪৫/১০-১১, মো.-১৩)।
কিতাবুল মোকাদ্দস-২০০৬-এর অনুবাদ: ‘‘হে কন্যা, শোন, মন দাও, কান খাড়া কর। তোমার লোকদের তুমি ভুলে যাও, ভুলে যাও তোমার পিতার বাড়ির কথা। তাহলে বাদশাহ তোমার সৌন্দর্যে ধরা দেবেন, তিনিই তোমার প্রভু, তাঁকে পায়ে ধরে সালাম কর।’’
(ঙ) দাউদ বলেছেন যে, এ বাদশাহকে দূরের বাদশাহ হাদিয়া পাঠাবেন: ‘‘টায়ার-কন্যা উপঢৌকন নিয়ে আসবেন, ধনী লোকেরা তোমার কাছে ফরিয়াদ করবেন।’’ (জবুর ৪৫/১২, মো.-১৩)। মিসরের শাসক মুকাওকিস মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে উপহার প্রেরণ করেছিলেন।
(চ) গীতটার শেষে বলা হয়েছে যে, তিনি ‘মহা-প্রশংসিত’ হবেন: ‘‘আমি তোমার নাম সমস্ত বংশ পরম্পরায় স্মরণ করাব, এজন্য জাতিরা যুগে যুগে চিরকাল তোমার প্রশংসা করবে।’’ (জবুর ৪৫/১৭, মো.-১৩)। এটি সুস্পষ্টভাবে ‘মুহাম্মাদ’ নামের প্রতি ইঙ্গিত করছে, যার অর্থ ‘অতি-প্রশংসিত’ বা ‘মহা-প্রশংসিত’।
‘‘তিনি এক সমুদ্র থেকে অপর সমুদ্র পর্যন্ত, ঐ নদী থেকে দুনিয়ার প্রান্ত পর্যন্ত কর্তৃত্ব করবেন। তাঁর সম্মুখে মরুনিবাসীরা নত হবে, তাঁর দুশমনেরা ধুলা চাটবে। তর্শীশ ও দ্বীপগুলোর বাদশাহরা নৈবেদ্য আনবেন। সবা ও সবা দেশের বাদশাহরা (Kings of Sheba and Seba) উপহার দেবেন। হ্যাঁ, সমস্ত বাদশাহ তাঁর কাছে মাথা নত করবেন। সমস্ত জাতি তাঁর গোলাম হবে। কেননা তিনি আর্তনাদকারী দরিদ্রকে, এবং দুঃখী ও অসহায়কে উদ্ধার করবেন। তিনি দীনহীন ও দরিদ্রর প্রতি রহম করবেন, তিনি দরিদ্রদের প্রাণ নিস্তার করবেন। তিনি চাতুরী ও দৌরাত্ন থেকে তাদের প্রান মুক্ত করবেন, তাঁর দৃষ্টিতে তাদের রক্ত বহুমূল্য হবে। আর তারা জীবিত থাকবে ও তাঁকে সাবা দেশের সোনা দান করা যাবে, লোকে তাঁর জন্য নিরন্তর মুনাজাত করবে, সমস্ত দিন তাঁর শুকরিয়া করবে (তার জন্য নিয়মিত দুআ করা হবে এবং প্রতিদিন তিনি প্রশংসিত হবেন: prayer also shall be made for him continually; and daily shall he be praised)।’’ (গীতসংহিতা/ জবুর ৭২/ ৮-১৫, মো-১৩)
এ কথাও বাহ্যত মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর বিষয়ে বলা হয়েছে। তিনি নিজে জীবিত থাকতেই লোহিত সাগর থেকে পারস্য সাগর ও আরব সাগর পর্যন্ত, মধ্যপ্রাচ্যের সর্বদক্ষিণ প্রান্ত পর্যন্ত তিনি নিজে কর্তৃত্ব করেন। এরপর তাঁর উম্মাত সমুদ্র থেকে সমুদ্র পর্যন্ত ও পৃথিবীর প্রান্ত পর্যন্ত রাজত্ব লাভ করেন। একমাত্র তাঁর সামনেই মরুনিবাসীরা নত হয় এবং বিভিন্ন রাজ্যের রাজারা বশ্যতা স্বীকার করে। তিনিই দরিদ্র ও অসহায়দের রক্ষার জন্য সর্বজনীন আইন প্রদান করেন ও কল্যাণমুখি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। কেবলমাত্র ইসলাম ধর্মেই নিয়মিত ও আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁর উপর সালাত-সালাম পাঠের ব্যবস্থা রয়েছে। সর্বোপরি তিনি ‘প্রশংসিত’: মুহাম্মাদ (ﷺ)।
“A Psalm of David. The LORD said to my lord: "Sit at My right, Until I make thine enemies thy footstool.” ‘‘হযরত দাউদের কাওয়ালী। মাবুদ আমার প্রভুকে বলেন, তুমি আমার ডান দিকে বস, যতদিন আমি তোমার দুশমনদেরকে তোমার পাদপীঠ না করি।’’ (মো.-১৩)
কতিপয় গবেষক এ বক্তব্যটাকে মুহাম্মাদ (ﷺ) বিষয়ক ভবিষ্যদ্বাণী হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এতে মিরাজের মাধ্যমে আল্লাহর সান্নিধ্যে গমন ও মিরাজের পরে ক্রমান্বয়ে তাঁর শত্রুদের পতনের বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে। উইকিপিডিয়া ‘Muhammad in the Bible’ প্রবন্ধে এ প্রসঙ্গে লেখা হয়েছে:
“Several Muslim writers, like Afzal-ur-Rahman and David Benjamin Keldani, raised the argument that Psalm 110:1 is also a prophecy of Muhammad and his ascension to the Throne of God during the journey of al-Isra and al-Miraj.”
’’আফযালুর রহমান, ডেভিড বেনজামিন কেলদানী ও অনুরূপ কতিপয় মুসলিম লেখক যুক্তি পেশ করেছেন যে, জবুর ১১০/১ মুহাম্মাদ (ﷺ) এবং ইসরা ও মিরাজের মাধ্যমে তাঁর আল্লাহর আরশে গমনের বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী।’’
ইহুদি বাইবেলের ৩০ নং পুস্তক, প্রটেস্ট্যান্ট বাইবেলের ২২ নং এবং ক্যাথলিক বাইবেলের ২৬ নং পুস্তক ‘Song of Songs’ বা ‘Song of Solomon’। বাংলায় পরমগীত বা সোলায়মানের গজল। এ পুস্তকের ৫ অধ্যায়ের ১৬ শ্লোক নিম্নরূপ: ‘‘তাঁর কথা অতীব মধুর; হ্যা, তিনি সর্বোতভাবে মনোহর (KSV: he is altogether lovely; RSV: he is altogether desirable)। অয়ি জেরুশালেমর কন্যারা! এই আমার প্রিয়, এই আমার সখা।’’ (মো.-১৩)
মুসলিমরা দাবি করেন যে, এ শ্লোকটা মুহাম্মাদ (ﷺ) বিষয়ক সুস্পষ্ট ভবিষ্যদ্বাণী। এ শ্লোকে ‘সর্বোতভাবে মনোহর’ কথাটা ইংরেজিতে ‘altogether lovely’ বা ‘altogether desirable’। হিব্রুতে এ শব্দটা ‘মেহমাদিম’ বা ‘মুহাম্মাদ’। অর্থাৎ এখানে বলা হয়েছে: ‘‘তাঁর কথা অতীব মধুর, তিনি মুহাম্মাদ, ... তিনিই আমার প্রিয় এবং তিনিই আমার বন্ধু।’’ এ প্রসঙ্গে উইকিপিডিয় লেখেছে:
“The Hebrew word מחמדים (Mhmdim, read as Mehmadim) appears once in the Hebrew Bible, at Song of Songs 5:16, where it is translated into English as ‘altogether desirable’ or ‘altogether lovely’. The word ‘mehmadim’ means: ‘delights’ or ‘pleasuring’ in Hebrew. Some Muslim scholars treat this verse as a prophecy of the coming of Muhammed. Muslims including Zakir Naik claim that "In the Hebrew language im is added for respect. Similarely im is added after the name of Muhammad to make it Muhammadim. In English translation they have even translated the name of Muhammad as ‘altogether lovely’, but in the Old Testament in Hebrew, the name of Muhammad is yet present.”
‘‘হিব্রু (מחמדים) শব্দটা ইংরেজি প্রতিবর্ণায়নে ‘Mhmdim’, যা হিব্রু উচ্চারণে ‘মেহমাদিম’ পড়া হয়। শব্দটা হিব্রু বাইবেলে মাত্র একটা স্থানে বিদ্যমান: সেলাইমানের গজল বা পরমগীত ৫/১৬। ইংরেজিতে শব্দটার অর্থ লেখা হয়েছে: ‘সর্বোতভাবে আকাঙ্খানীয়’ বা ‘সর্বোতভাবে প্রেমযোগ্য’ বা ‘সর্বোতভাবে মনোহর’। হিব্রু ভাষায় ‘মেহমাদিম’ শব্দটার অর্থ ফুর্তি বা আনন্দদায়ক। কতিপয় মুসলিম গবেষক এ শ্লোকটাকে মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর আগমন বিষয়ক ভবিষ্যদ্বাণী হিসেবে গণ্য করেন। জাকির নায়েক ও অন্যান্য মুসলিম দাবি করেন যে, ‘হিব্রু ভাষায় সম্মান বোঝানোর জন্য শব্দের শেষে ‘ইম’ সংযোগ করা হয়। এ কারণেই ‘মুহাম্মাদ’ নামের সাথে ‘ইম’ সংযুক্ত কর হয়েছে ফলে শব্দটা ‘মেহমাদিম’ বা ‘মুহাম্মাদিম’-এ পরিণত হয়েছে। ইংরেজি অনুবাদে অনুবাদকরা মুহাম্মাদ নামটার অনুবাদ করেছেন ‘সর্বোতভাবে মনোহর’। কিন্তু হিব্রু ভাষার পুরাতন নিয়মে ‘মুহাম্মাদ’ শব্দ এভাবে এখনো বিদ্যমান।’’