আল্লাহর রাজ্যের দৃষ্টান্ত বর্ণনায় যীশু বলেন: ‘‘আর একটি দৃষ্টান্ত শোন; এক জন গৃহকর্তা ছিলেন, তিনি আঙ্গুরের ক্ষেত প্রস্তুত করে তার চারিদিকে বেড়া দিলেন ও তার মধ্যে আঙ্গুর-কু- খনন করলেন এবং উঁচু পাহারা-ঘর নির্মাণ করলেন; পরে কৃষকদেরকে তা জমা দিয়ে অন্য দেশে চলে গেলেন। আর ফলের সময় সন্নিকট হলে তিনি নিজের ফল গ্রহণ করার জন্য কৃষকদের কাছে তাঁর গোলামদেরকে প্রেরণ করলেন। তখন কৃষকরা তার গোলামদেরকে ধরে এক জনকে প্রহার করল, অন্য এক জনকে খুন করলো, আরেকজনকে পাথর মারলো। আবার তিনি প্রথম বারের চেয়ে আরও বেশী গোলাম প্রেরণ করলেন; তাদের প্রতিও তারা সেই মত ব্যবহার করলো। অবশেষে তিনি তাঁর পুত্রকে তাদের কাছে প্রেরণ করলেন, বললেন, তারা আমার পুত্রকে দেখে সম্মান করবে। কিন্তু কৃষকরা পুত্রকে দেখে পরস্পর বললো, এই ব্যক্তিই উত্তরাধিকারী, এসো, আমরা একে হত্যা করে এর অধিকার হস্তগত করি। পরে তারা তাঁকে ধরে আঙ্গুর-ক্ষেতের বাইরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করলো। অতএব আঙ্গুর-ক্ষেতের মালিক যখন আসবেন, তখন সেই কৃষকদেরকে কি করবেন? তারা তাঁকে বললো, সেই দুষ্টদেরকে নিদারুণভাবে বিনষ্ট করবেন এবং সেই ক্ষেত এমন অন্য কৃষকদেরকে জমা দেবেন, যারা ফলের সময়ে তাঁকে ফল দেবেন। ঈসা তাদেরকে বললেন, তোমরা কি কখনও পাক-কিতাবে পাঠ করনি, ‘‘যে পাথরটি রাজমিস্ত্রিরা অগ্রাহ্য করেছে তা-ই কোণের প্রধান পাথর হয়ে উঠলো; তা প্রভু থেকেই হয়েছে আর তা  আমাদের দৃষ্টিতে  অদ্ভুত লাগে’’? এজন্য আমি তোমাদেরকে বলছি, তোমাদের কাছ থেকে আল্লাহর রাজ্য কেড়ে নেওয়া যাবে এবং এমন এক জাতিকে দেওয়া হবে, যে জাতি তার ফল দেবে। আর এই পাথরের উপরে যে পড়বে, সে ভেঙ্গে যাবে; কিন্তু এই পাথর যার উপরে পড়বে, তাকে চুরমার করে ফেলবে।’’ (মো.-১৩; আরো দেখুন: মার্ক ১২/১-১২, লূক ২০/৯-১৮।

মুসলিম লেখকরা এ ‘আল্লাহর রাজ্য’ স্থানান্তরের এ দৃষ্টান্তকে মুহাম্মাদ (ﷺ) বিষয়ক ভবিষ্যদ্বাণী বলে গণ্য করেছেন। দৃষ্টান্তটার বিবরণ নিম্নরূপ: (১) আঙুর ক্ষেত: আল্লাহর রাজ্য, (২) কৃষকগণ: আল্লাহর প্রজা বনি-ইসরাইলগণ, (৩) গোলামগণ: আল্লাহর বান্দা নবীগণ, (৪) পুত্র: ঈসা মাসীহ।

মহান আল্লাহ মানব জাতিকে ধার্মিকতা ও সততার পথে নেতৃত্ব দিতে বা আল্লাহর রাজ্য পরিচালনা করে ফল প্রদান করতে বনি-ইসরাইলকে দায়িত্ব প্রদান করেন। তাদের নেতৃত্বকে ফলদায়ক করার জন্য তিনি তাদের কাছে তাঁর বান্দা ও গোলাম  নবীদেরকে প্রেরণ করেন। বনি-ইসরাইলরা নবীদেরকে হত্যা ও নির্যাতন করে। এরপর আল্লাহ ঈসা মাসীহকে প্রেরণ করেন। আমরা দেখেছি হিব্রু পরিভাষায় বিশেষ বান্দা হিসেবে যীশুকে ঈশ্বরের পুত্র বলা হত। কিন্তু বনি-ইসরাইলরা তাঁকেও হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। যীশু জানালেন যে, এ পর্যায়ে ‘আল্লাহর রাজ্য’ বনি-ইসরাইলদের নিকট থেকে কেড়ে নিয়ে অন্য জাতিকে প্রদান করা হবে যারা মানব সভ্যতাকে মানবতা, ভ্রাতৃত্ব ও নৈতিকতা শিক্ষা দিয়ে আল্লাহর রাজ্যকে ফলদায়ক করবে। আর এ জাতিই বনি-ইসমাইল বা মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর জাতি।

এ নতুন জাতির বৈশিষ্ট্য বোঝাতে যীশু বললেন: ‘‘যে পাথরটি রাজমিস্ত্রিরা অগ্রাহ্য করেছে তা-ই কোণের প্রধান পাথর হয়ে উঠলো’’। অর্থাৎ ইবরাহিম (আ)-এর মাধ্যমে মানব জাতির জন্য পাওয়া আশীর্বাদ ও ধার্মিকতা প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব প্রায় দু হাজার বছর ধরে তাঁর ছোট ছেলে ইসহাকের বংশের মধ্যেই ছিল। তাঁর বড় ছেলে ইসমাইল (আ) নবুওয়াত ও আশীর্বদের এ ধারা থেকে এতদিন অগ্রাহ্য হয়ে ছিলেন। ঈসা মাসীহের প্রতি অবিশ্বাসের মধ্য দিয়ে বনি-ইসরাইলের প্রতি আশীর্বাদ এবার কেড়ে নিয়ে বনি-ইসমাইলের উপর অর্পিত হলো।

খ্রিষ্টানরা দাবি করেন যে, যীশু এখানে বনি-ইসরাইলগণ কর্তৃক যীশুকে অস্বীকার করার কথা বলছেন। কিন্তু সমস্যা হলো, যীশুকে তো অগ্রাহ্য করেছিল কৃষকরা বা বনি-ইসরাইলরা, রাজমিস্ত্রিরা নয়।

অগ্রাহ্য থাকা এ পাথরটার বিশেষণে যীশু বলেছেন: ‘‘তা  আমাদের দৃষ্টিতে  অদ্ভুত লাগে।’’ কিতাবুল মোকাদ্দস-০৬: ‘‘তা আমাদের চোখে খুব আশ্চার্য লাগে।’’ ইংরেজিতে ‘wonderful/ marvelous’।

আমরা জানি, যীশু খ্রিষ্ট ও তাঁর শিষ্যদের ভাষা ছিল হিব্রু-আরামাইক, কিন্তু  প্রচলিত ইঞ্জিলগুলো প্রায় শতবর্ষ বা তারও পরে গ্রীক ভাষায় রচিত। এখানে যীশু হিব্রু বা আরামাইকে কী বলেছিলেন তা জানার কোনো উপায় নেই। তবে এখানে মূল গ্রীক শব্দটা হল: (θαυμαστὴ), উচ্চারণ: ‘থমাসটস’ (Thaumastos)। নতুন নিয়মের গ্রীক অভিধান: কিং জেমস ভারশন (the New Testament Greek Lexicon - King James Version) শব্দটার অনুবাদে লেখেছে: ‘worthy of pious admiration’, অর্থাৎ ‘পবিত্র প্রশংসার যোগ্য’।[1] আমরা জানি যে, মুহাম্মাদ অর্থ ‘বিশেষভাবে প্রশংশিত বা প্রশংসাযোগ্য। এভাবে আমরা দেখছি যে, এ শব্দটা ‘মুহাম্মাদ’ শব্দটার সমার্থক।

আমরা আগেই বলেছি মুহাম্মাদ ও আহমদ নাম মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর পূর্বে কেউ রেখেছেন বলে জানা যায় না। মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর পরিবার ও আত্মীয়-স্বজন ইহুদি ধর্ম, হিব্রু ভাষা ও বাইবেলর জ্ঞান থেকে সম্পূর্ণ অজ্ঞ ছিলেন। নতুন নবীর আগমন বিষয়ক ভবিষ্যদ্বাণীর কিছুই তাঁরা জানতেন না। একান্তই অলৌকিকভাবে এ নামটা তাঁরা রেখেছিলেন। এ বিষয়ক ভবিষ্যদ্বাণীগুলো পূর্ণ করার জন্যই এ নামটাকে আল্লাহ সংরক্ষণ করেন। অলৌকিক প্রেরণার মাধ্যমেই মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর মাতা ও দাদা তাঁর জন্য এ নামটি নির্বাচন করেন।[2]

[1] http://www.biblestudytools.com/lexicons/greek/kjv/thaumastos.html
[2] Dawud, Abdul Ahad (Keldani, David Benjamin), 1992, Muhammad in the Bible, Abul Qasim Publishing House, Jeddah. P-117