আকীদার ক্ষেত্রে মুসলিম উম্মাহর বিভক্তি ও ফিরকাসমূহের আলোচনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিভ্রান্ত ফিরকাসমূহের বিভ্রান্তির কারণ ও স্বরূপ না জানলে এরূপ বিভ্রান্তির মধ্যে নিপতিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। আর বিভক্তি ও ফিরকার আলোচনার পূর্বে বিদ‘আতের আলোচনা অত্যাবশ্যক, কারণ বিদ‘আতই বিভক্তির একমাত্র কারণ। এখানে উল্লেখ্য যে, বিদ‘আতের পরিচিতি, প্রকারভেদ, উৎপত্তি, কারণ ও কর্মবিষয়ক বিদ‘আতগুলি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি ‘এহইয়াউস সুনান’ গ্রন্থে। এখানে প্রসঙ্গত বিদ‘আতের পরিচয় আলোচনার পরে আকীদা বিষয়ক বিদ‘আত প্রসঙ্গে আলোচনা সীমিত রাখার চেষ্টা করব। মহান আল্লাহর তাওফীক ও কবুল্যিত প্রাথনা করছি।
৬. ১. বিদ‘আতের পরিচয় | ৬. ১. ১. অভিধানে বিদ‘আত
বিদ’আত শব্দটি আরবী ‘বাদা‘আ’ (بَدَعَ) ক্রিয়া থেকে গৃহীত ইসম। বাদ‘আ অর্থ নব-উদ্ভাবন বা অনাস্তিত্ব থেকে অস্তিত্ব প্রদান (Innovation)। বিদ‘আত অর্থ নব-উদ্ভাবিত বিষয়।[1] ৪র্থ হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ ভাষাবিদ ইবনু দুরাইদ (৩২১ হি) বলেন, ‘‘বাদা‘আ অর্থ কোনো কিছু শুরু করা বা উদ্ভাবন করা। আল্লাহর আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর ‘বাদী’, অর্থাৎ উদ্ভাবক ও অনাস্তিত্ব থেকে অস্তিত্ব-দাতা বা সৃষ্টিকর্তা। যে ব্যক্তি কোনো বিষয় নতুন উদ্ভাবন বা আবিষ্কার করে সে তার বিদ‘আত-কারী বা উদ্ভাবক। ইসম ‘বিদ‘আত’।’’[2]
প্রসিদ্ধ ভাষাবিদ ইসমাঈল ইবনু হাম্মাদ আল-জাওহারী (৩৯৩ হি) বলেন:
والبِدْعَةُ: الحَدَثُ في الدين بعد الإكْمال.
‘‘আল-বিদ‘আত অর্থ পূর্ণতার পরে দীনের মধ্যে নব-উদ্ভাবন।’’[3]
ফাইরোয-আবাদী (৮১৭ হি) বলেন:
والبِدْعَةُ بالكسر: الحَدَثُ في الدين بعدَ الإِكْمَالِ، أو ما اسْتُحْدِثَ بعد النبيِّ (ﷺ) من الأَهْواءِ والأَعْمالِ
‘বিদ‘আত: পূর্ণতার পরে দীনের মধ্যে নব-উদ্ভাবন, অথবা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পরে যে মতবাদ বা কর্ম উদ্ভাবিত হয়েছে।’’[4] ইবনু মানযূরও অনুরূপ বলেছেন।[5]
আল্লামা ইবনু নুজাইম (৭৯০ হি) আল-বাহরুর রায়েক গ্রন্থে বলেন:
الْبِدْعَةِ وَهِيَ كَمَا فِي الْمُغْرِبِ اسْمٌ مِنْ ابْتَدَعَ الْأَمْرَ إذَا ابْتَدَأَهُ وَأَحْدَثَهُ ثُمَّ غَلَبَتْ عَلَى مَا هُوَ زِيَادَةٌ فِي الدِّينِ أَوْ نُقْصَانٌ مِنْهُ. وَعَرَّفَهَا الشُّمُنِّيُّ بِأَنَّهَا مَا أُحْدِثَ عَلَى خِلافِ الْحَقِّ الْمُتَلَقَّى عَنْ رَسُولِ اللَّهِ (ﷺ) مِنْ عِلْمٍ أَوْ عَمَلٍ أَوْ حَالٍ بِنَوْعِ شُبْهَةٍ وَاسْتِحْسَانٍ وَجُعِلَ دِينًا قَوِيمًا وَصِرَاطًا مُسْتَقِيمًا.
‘‘আল-মুগরিব গ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘বিদ‘আত শব্দটি ‘ইবতাদ‘আ’ ফি’ল থেকে গৃহীত ইসম। ফিলটির অর্থ শুরু করা বা উদ্ভাবন করা। অতঃপর দীনের মধ্যে সংযোজন বা বিয়োজন অর্থে বিদ‘আত শব্দটির ব্যবহার প্রাধান্য লাভ করে।’ শুম্মানী বিদ‘আতের সংজ্ঞায় বলেন: ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে গৃহীত সত্যের ব্যতিক্রম যে জ্ঞান-মত, কর্ম বা অবস্থা কুরআন-সুন্নাহর বক্তব্য ভুল বুঝার কারণে এবং ভাল মনে করে উদ্ভাবন করা হয়েছে এবং যাকে সঠিক দীন ও সিরাতে মুস্তাকীম বানিয়ে দেওয়া হয়েছে তাই বিদ‘আত’।’’[6]
আল্লামা ইবরাহীম ইবনু মূসা আশ-শাতিবী (৭৯০ হি) বলেন:
فالبدعة إذا عبارة عن طريقة في الدين مُخْتَرَعَةٍ تُضَاهِي الشَّرْعِيَّةَ، يقصد بالسلوك عليها البمالغة في التعبد لله سبحانه
‘‘বিদ‘আত বলতে বুঝায় দীনের মধ্যে শরীয়তের পদ্ধতির তুল্য কোনো নব-আবিষ্কৃত- উদ্ভাবিত তরীকা বা পদ্ধতি মহান আল্লাহর অতিরিক্ত ইবাদতের আশায় যে পদ্ধতির অনুসরণ করা হয়।’’[7]
আল্লামা মুহাম্মাদ ইবনু আলী আলাউদ্দীন হাসকাফী (১০৮৮ হি) তাঁর আদ-দুর্রুল মুখতার গ্রন্থে বিদ‘আতের পরিচয়ে বলেন:
وَهِيَ اعْتِقَادُ خِلافِ الْمَعْرُوفِ عَنْ الرَّسُولِ لا بِمُعَانَدَةٍ بَلْ بِنَوْعِ شُبْهَةٍ
‘‘বিদ‘আত হলো, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে সুপরিজ্ঞাত বিষয়ের ব্যতিক্রম কোনো বিশ্বাস, যে ব্যতিক্রমের কারণ ইচ্ছাকৃত বিরোধিতা নয়, বরং কুরআন-সুন্নাহর প্রমাণ বুঝতে অস্পষ্টতা বা ভুল বুঝা।’’[8]
[2] ইবনু দুরাইদ, জামহারাতুল লুগাত ১/১২৭।
[3] জাওহারী, আস-সিহাহ ৩/১১৮৪।
[4] ফাইরোযাবাদী, আল-কামূসুল মুহীত ২/২৫২।
[5] ইবনু মানযূর, লিসানুল আরব ৮/৬।
[6] ইবনু নুজাইম, আল-বাহরুর রায়িক শারহু কান্যুদ-দাকাইক ১/৬১১।
[7] শাতিবী, আল-ই’তিসাম ১/৫০।
[8] ইবনু আবেদীন, রাদ্দুল মুহতার ১/৫৬০।
কুরআন কারীম থেকে আমরা জানতে পারি যে, বিদ‘আত হচ্ছে এরূপ কর্ম যা করতে আল্লাহ নির্দেশ দেন নি, তবে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ধার্মিক মানুষ তা উদ্ভাবন করে। আর বিদ‘আতের প্রকৃতি এই যে, মানুষ যদিও ইবাদতের আগ্রহ নিয়েই তা উদ্ভাবন করে, কিন্তু তা সঠিকভাবে পালন করতে পারে না। কারণ কোন কর্ম কতটুকু মানুষ সহজে পালন করতে পারবে তা মহান আল্লাহই ভাল জানেন। তিনি সেভাবেই বিধান দেন। ধার্মিক মানুষ ধর্মের সাধারণ নির্দেশনার আলোকে আরো বেশি ভাল কাজ করার আগ্রহে কিছু নতুন কর্ম বা রীতি বানিয়ে নেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা পালন করতে পারেন না। মহান আল্লাহ খৃস্টানদের বিষয়ে বলেন:
وَرَهْبَانِيَّةً ابْتَدَعُوهَا مَا كَتَبْنَاهَا عَلَيْهِمْ إِلا ابْتِغَاءَ رِضْوَانِ اللَّهِ فَمَا رَعَوْهَا حَقَّ رِعَايَتِهَا
‘‘কিন্তু সন্ন্যাসবাদ- এতো তারা নিজেরাই আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য উদ্ভাবন করেছিল, আমি তাদেরকে এর বিধান দেই নি, অথচ তাও তারা যথাযথভাবে পালন করে নি।’’[1]
খৃস্টধর্মে ও অন্যান্য সকল আসমানী ধর্মেই পার্থিব লোভ, লালসা ও ভোগবিলাস ত্যাগ করে আখিরাতমুখি হওয়ার জন্য উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ ভোগবিলাস বাদ দিতে বলেছেন, তবে সন্ন্যাসী হতে বলেন নি। আবার খৃস্টধর্মে সন্ন্যাসী হতে বা বিবাহশাদি না করে সংসার-বিরাগী হতে কোনো নিষেধও ছিল না। ধার্মিক খৃস্টানগণ অনুভব করেন যে, বিবাহ ও ঘর সংসার করে দুনিয়া মুখিতা ও ভোগবিলাস থেকে পরিপূর্ণ মুক্ত হওয়া যায় না। এজন্য তারা বেশি আখেরাতমুখিতা অর্জন করার জন্য তারা ‘রাহবানিয়্যাহ’ বা সন্ন্যাসবাদ (monasticism, to become a monk) রীতি উদ্ভাবন করে। তবে তা ছিল আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভের জন্য মানবীয় বুদ্ধি বিবেক খাটিয়ে রীতি আবিষ্কার করা। ফলে তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিপরীত ফল দিয়েছে। মধ্যযুগের খৃস্টান মঠগুলির ইতিহাস পড়লেই আমরা তা জানতে পারি।
আমরা দেখেছি যে, আভিধানিক অর্থে বিদ‘আত অর্থ খারাপ কিছু নয়; নব-উদ্ভাবিত বিষয় ভাল বা খারপ হতে পারে। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ধর্মের বিষয়ে নব-উদ্ভাবন বা বিদ‘আত নিন্দনীয় বলে জানিয়েছেন।
আমরা ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, মানুষ প্রকৃতিগতভাবে মানবীয় বিবেক, বুদ্ধি ও জ্ঞানের মাধ্যমেই মহান স্রষ্টার অস্তিত্ব অনুভব করতে পারে। কিন্তু শুধু মানবীয় জ্ঞানের উপর নির্ভর করে মহান স্রষ্টার কর্ম ও বিশেষণের প্রকৃতি, তাঁর সন্তুষ্টির পথ, তাঁর ইবাদতের পদ্ধতি ইত্যাদি সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। এজন্য এ সকল বিষয়ে ওহীর উপর নির্ভর করতে হয়। আর এ জন্যই মহান আল্লাহ নবী-রাসূলগণকে প্রেরণ করেন এবং তাঁদেরকে কিতাব প্রদান করেন। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ওহীর বাইরে কোনো ধর্মীয় মতামত তৈরি করা, ধর্মীয় আচার, অনুষ্ঠান বা কর্ম উদ্ভাবন করা ধার্মিক মানুষের জন্য শয়তানের প্রবঞ্চনার দরজা খুলে দেয়। এজন্য বিভিন্ন হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) উম্মাতকে বিদ‘আত থেকে সতর্ক করেছেন।
ইতোপূর্বে একাধিক হাদীসে আমরা দেখেছি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বিদ‘আতকে সুন্নাতের বিপরীতে উল্লেখ করেছেন এবং তা ধ্বংসের কারণ বলে উল্লেখ করেছেন। এ অর্থে আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ)-এর হাদীসে দেখেছি যে, আব্দুল্লাহ (রাঃ) দুটি নেককর্মে পদ্ধতিগতভাবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ব্যতিক্রম করতেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) রাতের কিছু অংশ তাহাজ্জুদ আদায় করতেন এবং মাসের কিছু দিনে সিয়াম পালন করতেন, পক্ষান্তরে আব্দুল্লাহ সারারাত তাহাজ্জুদ আদায় এবং সারামাস নফল সিয়াম আদায় করতেন। বিষয়টির প্রতি আপত্তি প্রকাশ করে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন: ‘‘যে ব্যক্তি আমার সুন্নাতকে অপছন্দ করল আমার সাথে তার সম্পর্ক থাকবে না।... এরপর তিনি বলেন : প্রত্যেক আবেদের কর্মের উদ্দীপনার জোয়ার ভাটা আছে। ইবাদতের উদ্দীপনা কখনো তীব্র হয় আবার এই তীব্রতা এক সময় থেমে যায়, কখনো সুন্নাতের দিকে, কখনো বিদ‘আতের দিকে। যার প্রশান্তি সুন্নাতের প্রতি হবে সে হেদায়েত প্রাপ্ত হবে। আর যার প্রশান্তি অন্য কিছুর দিকে হবে সে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে।’’
এখানে আমরা কয়েকটি বিষয় লক্ষ্য করছি:
(১) তাহাজ্জুদ ও নফল সিয়াম ইসলামে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। বিভিন্ন হাদীসে এ ইবাদত বেশি বেশি পালন করতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। এ সকল হাদীস থেকে বুঝা যায় যে, এ ইবাদত যত বেশি পালন করা যাবে তত বেশি সাওয়াব হবে। কাজেই অর্ধেক রাতের চেয়ে সারারাত তাহাজ্জুদে সাওয়াব বেশি হওয়ার কথা। অনুরূপভাবে মাসের কয়েকদিন সিয়াম পালনের চেয়ে পুরো মাস সিয়াম পালনে বেশি সাওয়াব হওয়ার কথা।
(২) সারারাত তাহাজ্জুদ বা নিষিদ্ধ দিনগুলি বাদ দিয়ে সারা মাস সিয়াম পালন মূলত নিষিদ্ধ নয়। তবে তা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পদ্ধতির বাইরে।
(৩) এরূপ করাকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর সুন্নাত বা পদ্ধতি অপছন্দ করার নামান্তর বলে বারংবার উল্লেখ করেছেন।
(৪) তিনি আরো বলেছেন যে, কোনো আবিদ যদি কর্মের উদ্দীপনায় সাময়িকভাবে অতিরিক্ত কিছু করে তবে তা ধ্বংসাত্মক নয়। তবে তার স্থিতি যদি সুন্নাতের ব্যতিক্রম হয় তবে তা ধ্বংসাত্মক হবে।
(৫) তিনি তাঁর সুন্নাতের ব্যতিক্রম ইবাদতকে বিদ‘আত বলেছেন।
অন্যান্য অনেক হাদীসে এভাবে বিদ‘আতকে সুন্নাতের বিপরীতে উল্লেখ করা হয়েছে এবং ‘নব-উদ্ভাবন’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। প্রথম অধ্যায়ে আকীদার বিষয়ে সাহাবীগণের মতামত ও ব্যাখ্যার গুরুত্ব আলোচনাকালে এ অর্থের অন্য হাদীসে আমরা দেখেছি যে, রাসূলুল্লাহ(ﷺ) বলেছেন: ‘‘আমার পরে তোমরা যারা বেঁচে থাকবে তাঁরা অনেক মতবিরোধ ও দলাদলি দেখতে পাবে। কাজেই তোমার দৃঢ়ভাবে আমার সুন্নাত এবং আমার পরের খুলাফায়ে রাশেদীনদের সুন্নাত আঁকড়ে ধরে থাকবে, অনুসরণ করবে। আর খবরদার! নব উদ্ভাবিত কর্মাদি থেকে সাবধান থাকবে; কারণ সকল নব উদ্ভাবিত বিষয়ই ‘‘বিদ‘আত’’ এবং সকল ‘‘বিদ‘আত’’-ই পথভ্রষ্ঠতা বা গোমরাহী।’’
অন্য হাদীসে জাবির (রাঃ) বলেন, নবী করীম (ﷺ) বলেছেন :
إِنَّ أَصْدَقَ الْحَدِيثِ كِتَابُ اللَّهِ وَأَحْسَنَ الْهَدْيِ هَدْيُ مُحَمَّدٍ وَشَرُّ الأُمُورِ مُحْدَثَاتُهَا وَكُلُّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلُّ بِدْعَةٍ ضَلالَةٌ وَكُلُّ ضَلالَةٍ فِي النَّارِ.
‘‘সত্যতম বাণী আল্লাহর কিতাব, আর সর্বোত্তম আদর্শ মুহম্মদের (ﷺ) আদর্শ, সবচেয়ে খারাপ বিষয় হলো নতুন উদ্ভাবিত বিষয়, প্রতিটি নতুন উদ্ভাবিত বিষয়ই ‘‘বিদ‘আত’’ আর প্রতিটি ‘‘বিদ‘আত’’-ই পথভ্রষ্ঠতা এবং সকল পথভ্রষ্ঠতা জাহান্নামের মধ্যে।’’[1]
আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
إِنَّمَا هُمَا اثْنَتَانِ الْكَلامُ وَالْهَدْيُ فَأَحْسَنُ الْكَلامِ كَلامُ اللَّهِ وَأَحْسَنُ الْهَدْيِ هَدْيُ مُحَمَّدٍ أَلا وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدِثَاتِ الأُمُورِ فَإِنَّ شَرَّ الأُمُورِ مُحْدَثَاتُهَا وَكُلُّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلُّ بِدْعَةٍ ضَلالَةٌ
‘‘বিষয় শুধুমাত্র দুটি : বাণী ও আদর্শ। সর্বোত্তম বাণী হলো আল্লাহর বাণী এবং সর্বোত্তম আদর্শ ও পথ হলো মুহম্মদ (ﷺ) -এর আদর্শ ও পথ। সাবধান! তোমরা নব উদ্ভাবিত বিষয়াবলী থেকে সতর্ক ও সাবধান থাকবে; কারণ সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিষয় হলো নবউদ্ভাবিত বিষয়। আর সকল নবউদ্ভাবিত বিষয়ই ‘‘বিদ‘আত’’ এবং সকল ‘‘বিদ‘আত’’ই বিভ্রান্তি বা পথভ্রষ্টতা।’’[2]
আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
مَنْ أَحْدَثَ فِي أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ فِيهِ فَهُوَ رَدٌّ
‘‘আমাদের (রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও তাঁর যুগের মুসলমানদের: সাহাবীদের) এ কাজের (ধর্মীয় কর্মকান্ডের) মধ্যে যে নতুন কোনো বিষয় উদ্ভাবন করবে তার নতুন উদ্ভাবিত কাজটি প্রত্যাখ্যান করা হবে।’’
সহীহ মুসলিমের দ্বিতীয় বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
مَنْ عَمِلَ عَمَلا لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدٌّ
‘‘আমাদের কর্ম যা নয় এমন কোনো কর্ম যদি কোনো মানুষ করে তাহলে তার কর্ম প্রত্যাখ্যাত হবে (আল্লাহর নিকট কবুল হবে না)।’’[3]
তাবেয়ী হাসান বসরী (রাহ.) বলেন : রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন :
عَمَلٌ قَلِيْلٌ فِيْ سُنَّةٍ خَيْرٌ مِنْ عَمَلٍ كَثِيْرٍ فِيْ بِدْعَةٍ وَمَنِ اسْتَنَّ بِيْ فَهُوَ مِنِّيْ وَمَنْ رَغِبَ عَنْ سُنَّتِيْ فَلَيْسَ مِنِّيْ
‘‘সুন্নাতের মধ্যে অল্প আমল করা বিদ‘আতের মধ্যে অনেক আমল করার চেয়ে উত্তম। যে আমার পদ্ধতির অনুসরণ করবে সে আমার উম্মত, আমার সাথে সম্পর্কিত। আর যে আমার পদ্ধতি (সুন্নাত) অপছন্দ করবে তার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।’’[4]
বিদ‘আত বিষয়ক রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হাদীসগুলি পর্যালোচনা করলে আমরা নিম্নের বিষয়গুলি দেখতে পাই:
(১) আভিধানিকভাবে সকল নতুন উদ্ভাবিত বিষয়কেই বিদ‘আত বলা হয়, তবে হাদীসে নববীতে ‘আমাদের কর্মের মধ্যে’ বা ‘দীনের মধ্যে’ ‘নব উদ্ভাবিত বিষয়’-কে বিদ‘আত বলা হয়েছে।
(২) বিদ‘আতকে ‘সুন্নাতের’ বিপরীতে উল্লেখ করা হয়েছে এবং তাকওয়া, আল্লাহর ভয় ও ইবাদতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সুন্নাতকেই সর্বোচ্চ আদর্শ বলে গ্রহণ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ থেকে জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ব্যতিক্রম বা অতিরিক্ত কোনো মত, কথা, কর্ম বা রীতিকে তাকওয়া, বুজুর্গী বা ইবাদত বলে গণ্য করাই বিদ‘আত।
(৩) বিদ‘আত মূলত বর্জনের সুন্নাতের সাথেই সংশ্লিষ্ট। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যা করেন নি বা বলেন নি, অর্থাৎ তিনি যা করা বা বলা বর্জন করেছেন তা ইবাদতের উদ্দীপনায় করা বা বলা বা তাকে ইবাদত, কামালাত বা বুজুর্গি মনে করাকে বিদ‘আত বলা হয়েছে।
(৪) ইবাদতের উদ্দীপনাতেই বিদ‘আতের উৎপত্তি। ইবাদতের উদ্দীপনায় নেককার ব্যক্তি ইবাদতের ক্ষেত্রে কোনো পদ্ধতি, প্রকার বা রীতিতে সুন্নাতের ব্যতিক্রম করলে তা বিদ‘আতে পরিণত হয়।
(৫) কবুলিয়্যাত বা সাওয়াবের আশাতেই বিদ‘আত করা হয়, এজন্য বিদ‘আত কবুল হবে না বলে বারংবার হাদীসে বলা হয়েছে এবং বিদ‘আত পদ্ধতিতে বেশি ইবাদতের চেয়ে সুন্নাত পদ্ধতিতে অল্প ইবাদত বেশি গ্রহণযোগ্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
(৬) আভিধানিকভাবে বিদ‘আত নিন্দনীয় নয়, বরং তা ভাল বা মন্দ হতে পারে। তবে হাদীসে নববীতে বিদ‘আত সর্বদা নিন্দনীয় এবং সকল বিদ‘আতই পথভ্রষ্টতা। এর কারণ যেখানে অপূর্ণতা আছে সেখানে নতুনত্ব প্রশংসনীয়। আর যেখানে পরিপূর্ণ পূর্ণতা বিদ্যমান সেখানে পূর্ণতার অতিরিক্ত কোনো সংযোজনীর প্রয়োজন আছে মনে করার অর্থই পূর্ণকে অপূর্ণ মনে করা।
[2] ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ১/১৮।
[3] বুখারী, আস-সহীহ ২/৯৫৯; মুসলিম, আস-সহীহ ৩/১৩৪৩।
[4] আব্দুর রাজ্জাক সানআনী, আল-মুসানণাফ ১১/২৯১, নং ২০৫৬৮। হাসান বসরী পর্যন্ত হাদীসটির সনদ মুরসালরূপে সহীহ। এ ছাড়া বিভিনণ সনদের আলোকে মুত্তাসিল হিসাবে হাদীসটি গ্রহণযোগ্য। দেখুন: শাতেবী, আল-ইতিসাম ১/১০৮।
তাবিয়ী আব্দুর রাহমান ইবনু আব্দ্ আলকারী বলেন:
خَرَجْتُ مَعَ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ لَيْلَةً فِي رَمَضَانَ إِلَى الْمَسْجِدِ فَإِذَا النَّاسُ أَوْزَاعٌ مُتَفَرِّقُونَ يُصَلِّي الرَّجُلُ لِنَفْسِهِ وَيُصَلِّي الرَّجُلُ فَيُصَلِّي بِصَلاتِهِ الرَّهْطُ فَقَالَ عُمَرُ إِنِّي أَرَى لَوْ جَمَعْتُ هَؤُلاءِ عَلَى قَارِئٍ وَاحِدٍ لَكَانَ أَمْثَلَ ثُمَّ عَزَمَ فَجَمَعَهُمْ عَلَى أُبَيِّ بْنِ كَعْبٍ ثُمَّ خَرَجْتُ مَعَهُ لَيْلَةً أُخْرَى وَالنَّاسُ يُصَلُّونَ بِصَلاةِ قَارِئِهِمْ قَالَ عُمَرُ نِعْمَ الْبِدْعَةُ هَذِهِ وَالَّتِي يَنَامُونَ عَنْهَا أَفْضَلُ مِنِ الَّتِي يَقُومُونَ يُرِيدُ آخِرَ اللَّيْلِ وَكَانَ النَّاسُ يَقُومُونَ أَوَّلَهُ.
‘‘একদিন আমি উমার ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর সাথে রমযান মাসে মসজিদে গেলাম। সেখানে দেখলাম মানুষেরা ছোট ছোট দলে বিভক্ত। কোথাও একব্যক্তি একা (তারাবীহ বা রাতের) সালাত আদায় করছে। কোথাও কয়েকজনে মিলে ছোট্ট একটি জামাতে সালাত আদায় করছে। এ দেখে উমার বললেন: আমার মনে হয় এ সকল মানুষের জন্য একজন ইমাম নিযুক্ত করে দেওয়া ভালো হবে। এরপর তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। তিনি উবাই ইবনু কা’বকে ইমাম নিযুক্ত করে একত্রে (তারবীহের) সালাতের ব্যবস্থা করে দিলেন। এরপর অন্য এক রাতে যখন আমি তাঁর সাথে বের হয়েছি তখন আমরা দেখলাম সকল মানুষ একত্রে ইমামের পিছে জামাতে সালাত (তারাবীহ) আদায় করছে। এ দৃশ্য দেখে উমার বললেন: এটি একটি ভালো বিদ‘আত, তবে যা থেকে এরা ঘুমিয়ে থাকে তা বেশি উত্তম। তিনি বুঝালেন যে, এ সকল মানুষ প্রথম রাতে তারাবীহ আদায় করছে, শেষ রাতে ঘুমিয়ে পড়ছে, কিন্তু শেষ রাতে তারাবীহ পড়লে তা বেশি ভালো হতো।’’[1]
কিয়ামুল্লাইল অর্থাৎ রাতের সালাত বা তারাবীহের নিয়মিত জামাত রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর যুগে না থাকতে উমার তাকে ‘বিদ‘আত’ বলেছেন। স্বভাবতই একান্তই আভিধানিক অর্থে তা ‘বিদ‘আত’ বা নতুন বিষয়, কারণ দীনের মধ্যে তা নতুন নয়। এখানে আমরা কয়েকটি বিষয় লক্ষ্য করি:
(১) রামাদানের রত্রিতে কিয়ামুল্লাইল গুরুত্বপূর্ণ মাসনূন ইবাদত।
(২) কিয়ামুল্লাইলে কুরআন পাঠ ও খতম সুন্নাত-সম্মত ইবাদত।
(৩) এ জন্য জামা‘আত সুন্নাত-সম্মত। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কয়েকবার জামা‘আতে তা আদায় করেছেন। তবে ফরয হওয়ার আশংকায় নিয়মিত জামাতে আদায় করেন নি।
(৪) রামাদানের কিয়ামুল্লাইল, কিয়ামুল্লাইলে কুরআন খতম ও মাঝে মাঝে জামাতে আদায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সুন্নাত। তা নিয়মিত জামাতে আদায়ের রীতি তাঁর সময়ে ছিল না। এজন্য উমার (রাঃ) একে বিদ‘আত বলেছেন। তিনি একে ভাল বিদ‘আত বলেছেন।
এখানে এ প্রশ্ন হতে পারে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সকল বিদ‘আতকে বিভ্রান্তি বললেন, অথচ উমার কিভাবে একটি বিদ‘আতকে ভাল বিদ‘আত বললেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি আভিধানিক অর্থেই এ কর্মকে বিদ‘আত বলেছেন এবং সে অর্থে একে ভাল বিদ‘আত বলেছেন। পরবর্তী আলোচনায় আমরা দেখব যে, সুন্নাতের ব্যাখ্যা ও প্রায়োগিক ব্যতিক্রমের অধিকার রাসূলুল্লাহ (ﷺ) খুলাফায়ে রাশেদীন ও সাহাবীগণকে দিয়েছেন এবং এরূপ কর্মকে তাঁদের সুন্নাত বলে আখ্যায়িত করেছেন। বস্ত্তত তাঁরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সুন্না্ত সবচেয়ে ভাল বুঝেছেন। কোন্ কাজটি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বিশেষ কারণে করেন নি, তবে তাঁর পরে করা যেতে পারে, তাও তাঁরা সঠিকভাবে বুঝতেন। এ জ্ঞানের আলোকেই উমার (রাঃ) নিয়মিত কিয়ামুল্লাইলের জামা‘আতকে ‘ভাল বিদ‘আত’ বলেছেন।
সুন্নাতের আলোকে খুলাফায়ে রাশেদীনের এরূপ কর্ম এবং জাগতিক, সাংসারিক, প্রশাসনিক ইত্যাদি বিষয়ের ক্ষেত্রে নতুনত্ব ছাড়া ইবাদত বন্দেগির ক্ষেত্রে সাহাবীগণ সুন্নাতের সামান্যতম ব্যতিক্রমকে বিদ‘আত বলে নিন্দা করেছেন। তাঁদের বিভিন্ন বক্তব্য থেকে আমরা জানতে পারি যে, সুন্নাতের ব্যতিক্রম সকল প্রকার ইবাদত, বন্দেগি, নেককর্ম, মতামত, বিশ্বাস সবই বিদ‘আত। তাঁরা সর্বদা ‘সুন্নাতে’র বিপরীতে ‘বিদ‘আত’ এবং ‘ইত্তিবা’ বা অনুসরণের বিপরীতে ‘ইবতিদা’ বা উদ্ভাবন উল্লেখ করেছেন। ইতোপূর্বে এ অর্থে কয়েকটি হাদীস আমরা দেখেছি। এক হাদীসে ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন :
فَعَلَيْكُمْ بِالْعِلْمِ وَإِيَّاكُمْ وَالتَّبَدُّعَ وَإِيَّاكُمْ وَالتَّنَطُّعَ وَإِيَّاكُمْ وَالتَّعَمُّقَ وَعَلَيْكُمْ بِالْعَتِيقِ
‘‘তোমরা অবশ্যই ইল্ম শিক্ষা করবে। আর খবরদার! তোমর কখনো বিদ‘আতের মধ্যে লিপ্ত হবে না, খবরদার! তোমরা বাড়াবাড়িতে লিপ্ত হবে না। খবরদার! তোমরা অতি গভীরতার চেষ্টা করবে না। বরং তোমরা প্রাচীনকে আঁকড়ে ধরে থাকবে।’’[2]
তিনি আরো বলেন :
اتَّـبِـعُوا وَلا تَـبْـتَـدِعُوا فَقَـدْ كُـفِـيتُـمْ
‘‘তোমরা অনুসরণ কর, উদ্ভাবন করো না, কারণ দীনের মধ্যে যা আছে তা-ই তোমাদের জন্য যথেষ্ঠ।’’[3]
অন্য হাদীসে তিনি বলেন :
اَلاِقْتِصَادُ فِيْ السُّنَّةِ أَحْسَنُ مِنَ الاِجْتِهَادِ فِيْ الْبِدْعَةِ
‘‘বিদ‘আত পদ্ধতিতে বেশি আমল করার চেয়ে সুন্নাতের উপর অল্প আমল করা উত্তম।’’[4]
উসমান বিন হাদির বলেন: আমি ইবনু আববাস (রাঃ)-এর নিকট গমন করি এবং তাঁকে বলি: আমাকে কিছু উপদেশ দিন। তিনি বলেন:
نَعَمْ، عَلَيْكَ بِتَقْوَى اللَّهِ وَالاسْتِقَامَةِ، اتَّبِعْ وَلا تَبْتَدِعْ
‘‘হাঁ, তুমি আল্লাহকে ভয় করবে, ইসলামের বিধিবিধান সুদৃঢ়ভাবে পালন করবে। তুমি অনুসরণ বা ইত্তিবা করবে, বিদ‘আত উদ্ভাবন করবে না।’’[5]
অন্য হাদীসে আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন:
مَا أَتَى عَلَى النَّاسِ عَامٌ إِلاَّ أَحْدَثُوْا فِيْهِ بِدْعَةً وَأَمَاتُوا فِيْهِ سُنَّةً، حَتَّى تَحْيَا الْبِدَعُ وَتَمُوْتَ السُّنَنُ
‘‘প্রতি বৎসরই মানুষ কিছু বিদ‘আত উদ্ভাবন করতে থাকবে এবং সুন্নাত মেরে ফেলবে, এক পর্যায়ে শুধু বিদ‘আতই বেঁচে থাকবে আর সুন্নাতসমূহ বিলীন হয়ে যাবে।’’[6]
ইমাম সূয়ূতী (রাহ) বর্ণনা করেছেন, হুযাইফা (রাঃ) বলেন:
كُلُّ عِبَادَةٍ لَمْ يَتَعَبَّدْ بِهَا أَصْحَابُ رَسُولِ اللهِ (ﷺ) فَلاَ تَتَعَبَّدُوْا بِهَا؛ فَإِنَّ الأَوَّلَ لَمْ يَدَعْ لِلآخِرِ مَقَالاً، فَاتَّقُوا اللهَ يَا مَعْشَرَ الْقُرَّاءِ، خُذُوا طَرِيْقَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ
‘‘সাহাবায়ে কেরামগণ যে ইবাদত করেননি, তোমরা কখনো সে ইবাদত করবে না। কারণ পূর্ববর্তীরা পরবর্তীদের জন্য কথা বলার (কোনো নতুন কথা বলার বা নতুন কর্ম উদ্ভাবন করার) কোনো সুযোগ রেখে যাননি। হে আল্লাহর পথের পথিকগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় করে চল এবং তোমাদের পূর্ববর্তীগণের পথ অবলম্বন করে চল।’’[7]
হুযাইফাহ (রা.) দুটি পাথর নিয়ে একটিকে অপরটির উপরে রাখেন এবং সহচর তাবেয়ীগণকে প্রশ্ন করেন: তোমরা কি দুটি পাথরের মাঝখানে কোনো আলো দেখতে পাচ্ছ? তাঁরা বলেন: খুব সামান্য আলোই পাথর দুটির মধ্য থেকে দেখা যাচ্ছে। তখন তিনি বলেন:
وَالّذِيْ نَفْسِيْ بِيَدِهِ، لَتَظْهَرَنَّ الْبِدَعُ، حَتَّى لاَ يُرَى مِنَ الْحَقِّ إِلاَّ قَدْرُ مَا بَيْنَ هَذَيْنِ الْحَجَرَيْنِ مِنَ النُّوْرِ، وَاللهِ لَتَفْشُوَنَّ الْبِدَعُ حَتَّى إِذَا تُرِكَ مِنْهَا شَيْءٌ قَالُوْا: تُرِكَتِ السُّنَّةُ
‘‘যার হাতে আমার প্রাণ তাঁর কসম করে বলছি: বিদ‘আত এমনভাবে প্রসার লাভ করবে যে, সত্য ও সঠিক মত এই দুটি পাথরের মধ্য থেকে আসা আলোর মতো ক্ষীণ হয়ে যাবে। আল্লাহর কসম, বিদ‘আত এমনভাবে প্রসার লাভ করবে যে, যদি কোনো বিদ‘আত বর্জন করা হয়, তাহলে সবাই বলবে : সুন্নাত বর্জন করা হয়েছে (বিদ‘আতকেই সুন্নাত মনে করা হবে বা বিদ‘আত পালনই সুন্নী হওয়ার আলামত বলে গণ্য হবে)।[8]
গুদাইফ ইবনুল হারিস আস-সিমালী (রাঃ) বলেন:
بَعَثَ إِلَيَّ عَبْدُ الْمَلِكِ بْنُ مَرْوَانَ فَقَالَ يَا أَبَا أَسْمَاءَ إِنَّا قَدْ أَجْمَعْنَا النَّاسَ عَلَى أَمْرَيْنِ قَالَ وَمَا هُمَا قَالَ رَفْعُ الأَيْدِي عَلَى الْمَنَابِرِ يَوْمَ الْجُمُعَةِ، وَالْقَصَصُ بَعْدَ الصُّبْحِ وَالْعَصْرِ. فَقَالَ أَمَا إِنَّهُمَا أَمْثَلُ بِدْعَتِكُمْ عِنْدِي وَلَسْتُ مُجِيبَكَ إِلَى شَيْءٍ مِنْهُمَا. قَالَ لِمَ؟ قَالَ لأَنَّ النَّبِيَّ (ﷺ) قَالَ مَا أَحْدَثَ قَوْمٌ بِدْعَةً إِلا رُفِعَ مِثْلُهَا مِنَ السُّنَّةِ فَتَمَسُّكٌ بِسُنَّةٍ خَيْرٌ مِنْ إِحْدَاثِ بِدْعَة
‘‘উমাইয়া খলীফা আব্দুল মালিক ইবনু মারওয়ান (খিলাফাত ৬৫-৮৬ হি./ ৬৮৪-৭০৩ খ্রি.) আমার কাছে দূত প্রেরণ করে ডেকে পাঠান এবং বলেন যে, হে আবু আসমা, আমরা দুটি বিষয়ের উপর মানুষদেরকে সমবেত করেছি (এ বিষয়ে আপনার সহযোগিতা চাচ্ছি)। গুদাইফ বললেন: বিষয় দুটি কী কী? খলীফা বললেন: বিষয় দুটি হলো: (১). শুক্রবারের দিন (জুমআর খুত্বার মধ্যে) মিম্বরে ইমামের খুৎবা প্রদানের সময় হাত তুলে দু‘আ করা এবং (২). ফজর এবং আসরের সালাতের পরে গল্প কাহিনীর মাধ্যমে ওয়াজ করা। তখন গুদাইফ বললেন: নিঃসন্দেহে এই দুটি বিষয় আমার মতে তোমাদের বিদ‘আতগুলির মধ্য থেকে সবথেকে ভালো বিদ‘আত, তবে আমি এ দুই বিদ‘আতের একটি বিষয়েও আপনার ডাকে সাড়া দিয়ে তাতে অংশগ্রহণ বা সহযোগিতা করব না। খলীফা বললেন: কেন আপনি আমার কথা রাখবেন না? গুদাইফ বলেন: কারণ নবীয়ে আকরাম (ﷺ) বলেছেন: ‘‘যখনই কোনো সম্প্রদায় কোনো বিদ‘আতের উদ্ভাবন ঘটায় তখনই সেই পরিমাণ সুন্নাত তাদের মধ্য থেকে বিদায় নেয়; কাজেই একটি সুন্নাত আঁকড়ে ধরে থাকা একটি বিদ‘আত উদ্ভাবন করার থেকে উত্তম।’’[9]
এখানে লক্ষণীয় যে, যে দুটি বিষয় গুদাইফ বিদ‘আত বলেছেন দুটি বিষয়ই শরীয়ত-সম্মত। জুমআর খুৎবা প্রদানের সময় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) দু‘আ করতেন বলে হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। অন্যদিকে দু‘আর সময় দু হাত তুলার কথাও প্রমাণিত। খুত্বা চলাকালীন সময়ে বৃষ্টির জন্য দু‘আ করতে তিনি দুহাত উঠিয়েছেন বলেও হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। কাজেই, যে কোনো যুক্তি তর্কে আমরা বলতে পারি খুৎবার সময় দু‘আ করা জায়েয, দু‘আর সময় দু’হাত তোলাও জায়েয এবং খুৎবা চলাকালীন সময়ে সমবেতভাবে দু’হাত তুলে দু‘আ করাও জায়েয। কিন্তু সাহাবী একে বিদ‘আত বললেন কেন? কারণ বৃষ্টির জন্য দু‘আ ছাড়া খুৎবার মধ্যে অন্য কোনো দু‘আতে তিনি দুহাত উঠাতেন না, বরং শাহাদত আঙ্গুলের ইশারা করে দু‘আ করতেন। আর তিনি শুধু একাই হাত তুলতেন বা ইশারা করতেন, সমবেতভাবে তা করতেন এমন কোনো ঘটনা পাওয়া যায় না। তাই তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর সুন্নাতের উপরেই থাকতে চাচ্ছেন। তিনি যতটুকু করেছেন তাঁর একবিন্দু বাইরে যেতে চাচ্ছেন না।
মুয়ায ইবনু জাবাল (রা.) একদিন বলেন:
إِنَّ مِنْ وَرَائِكُمْ فِتَنًا يَكْثُرُ فِيهَا الْمَالُ وَيُفْتَحُ فِيهَا الْقُرْآنُ حَتَّى يَأْخُذَهُ الْمُؤْمِنُ وَالْمُنَافِقُ وَالرَّجُلُ وَالْمَرْأَةُ وَالصَّغِيرُ وَالْكَبِيرُ وَالْعَبْدُ وَالْحُرُّ، فَيُوشِكُ قَائِلٌ أَنْ يَقُولَ: مَا لِلنَّاسِ لا يَتَّبِعُونِي وَقَدْ قَرَأْتُ الْقُرْآنَ، مَا هُمْ بِمُتَّبِعِيَّ حَتَّى أَبْتَدِعَ لَهُمْ غَيْرَهُ، فَإِيَّاكُمْ وَمَا ابْتُدِعَ! فَإِنَّ مَا ابْتُدِعَ ضَلالَةٌ.
‘‘তোমাদের সামনে অনেক ফিতনা আসছে, যখন মানুষের সম্পদ বৃদ্ধি পাবে এবং কুরআন শিক্ষার পথ খুলে যাবে। মুমিন-মুনাফিক, নারী-পুরুষ, ছোট-বড়, মনিব-চাকর সবাই কুরআন শিখবে। তখন হয়ত কোনো ব্যক্তি বলবে : মানুষের কী হলো, আমি কুরআন শিক্ষা করলাম অথচ তারা আমার অনুসরণ করছে না? কুরআন ছাড়া কোনো নতুন মত বা কাজ উদ্ভাবন না করলে মানুষেরা আমার অনুসরণ করবে না। (আমি এত আলেম হলাম কিন্তু আমার সঠিক মূল্যায়ন হচ্ছে না, আমার ভক্তবৃন্দের সংখ্যা বাড়ছে না। কাজেই, মানুষের মধ্যে আমার সঠিক মূল্যায়নের উপায় হলো নতুন কোনো মতামত বা পদ্ধতি উদ্ভাবন করা) খবরদার! তোমরা বিদ‘আতের কাছেও যাবে না। নিঃসন্দেহে যা কিছু বিদ‘আত তাই পথভ্রষ্ঠতা।’’[10]
এ হাদীসের আলোচনায় আল্লামা শাতিবী উল্লেখ করেছেন যে, বিদ‘আতের উদ্দেশ্যই আল্লাহর ইবাদতে আধিক্য অর্জন। বিদ‘আতী আল্লাহর ইবাদতের দিকেই মূল দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন, ইবাদতের জন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পদ্ধতির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা জরুরী মনে করেন না। এছাড়া মানবীয় প্রকৃতি পুরাতন ও নিয়মিত কর্মে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। নতুন নিয়ম পদ্ধতির মধ্যে অতিরিক্ত উদ্দীপনা ও কর্মপ্রেরণা লাভ করা যায় যা পুরাতনের মধ্যে থাকে না। এজন্য বলা হয় ‘প্রত্যেক নতুনের মধ্যেই মজা’। বিদ‘আতীদের তত্ত্ব এই যে, মানুষের মধ্যে অপরাধ বেড়ে গেলে যেমন অপরাধ ধরা ও বিচার করার জন্য পদ্ধতিও বেড়ে যায়, অনুরূপভাবে মানুষের মধ্যে ইবাদতে অবহেলা প্রসার লাভ করলে তাদের অবহেলা কাটাতে নতুন নতুন নিয়ম পদ্ধতি উদ্ভাবন করা প্রয়োজন। মু‘আয (রাঃ) এ বিষয়েই সাবধান করেছেন। শাতিবী বলেন, এদ্বারা বুঝা যায় যে, ইবাদতের বাইরে জাগতিক বিষয়াদির ক্ষেত্রে নতুন উদ্ভাবনা শরীয়তের পরিভাষায় বিদ‘আত বলে গণ্য নয়।[11]
[2] দারিমী, আস-সুনান ১/৬৬।
[3] দারিমী, আস-সুনান ১/৮০
[4] হাকিম, আল-মুসতাদরাক ১/১৮৪। হাকিম ও যাহাবী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।
[5] দারিমী, আস-সুনান ১/৬৫।
[6] হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১/১৮৮, ইবনু ওয়াদ্দাহ, আল-বিদাউ ৩৮-৩৯।
[7] সুয়ূতী, আল-আমরু বিল ইত্তিবা, ১৭ পৃ।
[8] ইবনু ওয়াদ্দাহ আল কুরতুবী, আল-বিদাউ ওয়ান নাহইউ আনহা, পৃ: ৫৮।
[9] আহমদ ইবনু হাম্মাল, আল-মুসনাদ ৪/১০৫; ইবনু হাজার, ফতহুল বারী ১৩/১৫৩-১৫৪, ইবনু হাজার বলেছেন: হাদীসটির সনদ শক্তিশালী, তবে হায়সামী মাজমাউয যাওয়ায়িদ ১/১৮৮ হাদীসটির সনদে দুর্বলতা আছে বলে উলেলখ করেছেন।
[10] আবু দাউদ, আস-সুনান ৪/২০২; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ৪/৫০৭। হাদীসটি সহীহ।
[11] শাতিবী, আল-ই’তিসাম ১/৫৪-৫৬।
উপরের হাদীসগুলি থেকে আমরা বিদ‘আতের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারছি। আমরা দেখছি যে, সাহাবীগণ দ্বিতীয় প্রজন্মের মুসলিমদেরকে বারংবার সুন্নাতের অনুসরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে উৎসাহ দিচ্ছেন এবং বিদ‘আত, উদ্ভাবন বা সুন্নাতের ব্যতিক্রম করতে নিষেধ করছেন। সুন্নাত পদ্ধতিতে অল্প ইবাদত বিদ‘আত পদ্ধতিতে বেশি ইবাদতের চেয়ে উত্তম বলে জানাচ্ছেন।
এথেকে আমরা বুঝতে পারছি যে, দ্বিতীয় প্রজন্মের মুসলিমদের মধ্যে দীনের বিষয়ে উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে বিদ‘আতের উৎপত্তি হয়। সাহাবীদের সাহচার্য বঞ্চিত আবেগী ধার্মিক মানুষেরা দীন পালনের বা অনুধাবনের ক্ষেত্রে সুন্নাতের ব্যতিক্রম মত, বিশ্বাস বা কর্মের মধ্যে নিপতিত হতে থাকে। সাহাবীগণ এ সকল ব্যতিক্রম প্রতিরোধে সচেষ্ট ছিলেন। এরপরও ক্রমান্বয়ে বিদ‘আত প্রসার লাভ করতে থাকে।
এ সকল বিদ‘আত দু ভাগে বিভক্ত: (১) আকীদা বা বিশ্বাসের বিদ‘আত (البدعة العقدية) এবং কর্মের বিদ‘আত (البدعة العملية)। আমাদের আলোচনা আকীদার বিদ‘আতের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখছি, কারণ ইফতিরাক মূলত আকীদার বিদ‘আতকে কেন্দ্র করে। কর্ম বিষয়ক বিদ‘আত সম্পর্কে আমি ‘এহইয়উস সুনান’ গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।
আমরা ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, ৩০-৩৫ হিজরীর দিকে আব্দুল্লাহ ইবনু সাবা ও তার অনুসারীগণ নবী-বংশের ভালবাসা ও ভক্তির নামে বিভিন্ন বিদ‘আতী আকীদা প্রচলন করে, যা কুরআনে, হাদীসে বা সাহাবীদের মধ্যে বিদ্যমান ছিল না। তাদের এ সকল বিদ‘আতী বিশ্বাসের মধ্যে রয়েছে:
(১) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পরে আলীর (রাঃ) রাষ্ট্রপ্রধান বা ইমাম হওয়ার বিষয়টি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (ﷺ) সুস্পষ্ট নির্দেশ এবং ইসলামী আকীদার মৌলিক ও অবিচ্ছেদ্য অংশ।
(২) আলী (রাঃ) ও তাঁর বংশের ইমামগণ মা’সূম বা নিষ্পাপ।
(৩) আলী (রাঃ) তাঁর মৃত্যুর পরে আবার ফিরে আসবেন।
(৪) রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আলী (রাঃ)-কে বিশেষ কিছু গোপন ইলম দান করেছেন এবং আলীর (রাঃ) নিকট গুপ্ত ইলমের ভান্ডার রয়েছে।
(৫) আলী (রাঃ)-এর মধ্যে আল্লাহর বিশেষ ক্ষমতা, সম্পর্ক বা বিশেষত্ব রয়েছে বা তিনি অবতার।
(৭) সাহাবীগণের প্রতি কুধারণা পোষণ করা, তাঁদেরকে ধর্মচ্যুত বা মুরতাদ মনে করা ও তাঁদের সকলকে বা অধিকাংশকে গালি দেওয়া।
প্রথম হিজরী শতকের মাঝামাঝি থেকে এ সকল বিদ‘আতের উৎপত্তি ঘটে এবং ক্রমান্বয়ে তা কিছু মানুষের মধ্যে প্রসার লাভ করতে থাকে। আলী (রাঃ) নিজে এদের বিভ্রান্তি দূর করতে বিশেষভাবে সচেষ্ট ছিলেন। যারা তাঁর উলূহিয়্যাত বা ‘আল্লাহর সাথে বিশেষ সম্পর্ক’ দাবি করত বা তাকে সাজদা করত তাদের কঠোর হস্তে দমন করেন। সর্বশেষ যারা তার কথা মানতে অস্বীকার করে তাদের কয়েকজনকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করেন।
আলী (রাঃ)-এর সময় থেকে (৩৫-৪০হি) খারিজীগণের বিদ‘আতী আকীদার উন্মেষ ঘটে। তাদের বিদ‘আতী আকীদার মধ্যে রয়েছে:
(১) কবীরা গোনাহে লিপ্ত মুসলিম কাফির বলে গণ্য।
(২) পাপী রাষ্ট্রপ্রধানের ইমামত অবৈধ এবং তার বিরুদ্ধে জিহাদ করা ফরয।
প্রথম হিজরীর শেষভাগ থেকে কাদারীয়াদের বিদ‘আতের উন্মেষ ঘটে। এসময়ে ক্রমান্বয়ে মুরজিয়া, জাবারিয়া, মুতাযিলা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের আকীদাগত বিদ‘আতসমূহ প্রকাশ পেতে থাকে। আমরা এদের বিদ‘আতী আকীদাগুলি ফিরকাসমূহের আলোচনার সময় উল্লেখ করব, ইনশা আল্লাহ।
এখানে উল্লেখ্য যে, প্রত্যেক বিদ‘আতী ফিরকা নিজেদেরকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (ﷺ) প্রকৃত অনুসারী এবং কুরআন-সুন্নাহর সঠিক অনুধাবনকারী বলে দাবি করেছে। প্রত্যেকেই নিজেদেরকে একমাত্র নাজাত-প্রাপ্ত ফিরকা বলে দাবি করেছে। প্রত্যেকেই কুরআন ও হাদীস থেকে তাদের মতের পক্ষে অনেক ‘অকাট্য (!) দলীল প্রদান করেছে। এ সকল দাবির যথার্থতা বুঝতে হলে সুন্নাতের সঠিক পরিচয় বুঝতে হবে। আমরা দেখব যে, কথায় ও কর্মে কুরআন ও সুন্নাহর বা ওহীর হুবহু অনুসরণই সুন্নাত। এখানে একটি উদাহরণ পেশ করছি সুন্নাত ও বিদ‘আতের পার্থক্য অনুধাবনের জন্য।
সাহাবীগণ সম্পর্কে শীয়া আকীদা ও নাসিবী আকীদা
শীয়গণের একটি বিদ‘আতী মত এই যে, হাতে গোনা অল্প কয়েকজন সাহাবী ছাড়া আবূ বাকর (রাঃ), উমার (রাঃ), উসমান (র) ও অন্যান্য সকল সাহাবী () ধর্মত্যাগ করেছিলেন বা মুরতাদ হয়ে গিয়েছিলেন (নাউযূ বিল্লাহ!)। এর বিপরীতে ‘নাসিবাহ’ (الناصبة) সম্প্রদায়ের বিদ‘আতী আকীদা এই যে, আলী (রাঃ) সত্য-বিচ্যুত ছিলেন, তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে তাঁর আত্মীয়তার সম্পর্ককে ব্যবহার করে ক্ষমতা দখল করতে চেষ্টা করেন এবং তিনি ক্ষমতার লোভে হাজার হাজার মানুষের রক্তপাতের ব্যবস্থা করেন। তার সময়ের সকল গৃহযদ্ধের জন্য তিনি দায়ী। (নাউযূ বিল্লাহ!)
এরা কয়েকটি হাদীসকে তাদের মতের পক্ষে অকাট্য (!) দলীল হিসেবে পেশ করেন। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:
َأَوَّلُ مَنْ يُكْسَى يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِبْرَاهِيمُ وَإِنَّ أُنَاسًا مِنْ أَصْحَابِي يُؤْخَذُ بِهِمْ ذَاتَ الشِّمَالِ فَأَقُولُ أَصْحَابِي أَصْحَابِي فَيَقُولُ إِنَّهُمْ لَمْ يَزَالُوا مُرْتَدِّينَ عَلَى أَعْقَابِهِمْ مُنْذُ فَارَقْتَهُمْ فَأَقُولُ كَمَا قَالَ الْعَبْدُ الصَّالِحُ وَكُنْتُ عَلَيْهِمْ شَهِيدًا مَا دُمْتُ فِيهِمْ فَلَمَّا تَوَفَّيْتَنِي إِلَى قَوْلِهِ الْعَزِيزُ الْحَكِيم
‘‘কিয়ামতের দিন প্রথম কাপড় পরানো হবে ইবরাহীম (আঃ)-কে। আমার সাহাবীদের কিছু মানুষকে ধরে বামে নিয়ে যাওয়া হবে। তখন আমি বলব, আমার সাহাবীগণ! আমার সাহাবীগণ! তখন তিনি বলবেন: আপনি এদেরকে ছেড়ে চলে আসার পর থেকে তারা অবিরত পিছিয়ে যেতেই (ধর্মত্যাগ করতেই) থেকেছে। তখন আমি আল্লাহর নেক বান্দা (ইসা আ.) যে কথা কলেছেন সে কথাই বরব, আমি বলব[1]: ‘আমি যতদিন তাদের মধ্যে ছিলাম ততদিন আমি তাদের সাক্ষী ছিলাম। যখন আপনি আমাকে ফেরত নিলেন তখন থেকে আপনিই তাদের পর্যবেক্ষক, আর আপনি তো সর্ব-বিষয়ে সাক্ষী।’’[2]
অন্য হাদীসে আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ বলেন:
أَنَا فَرَطُكُمْ عَلَى الْحَوْضِ وَلأُنَازِعَنَّ أَقْوَامًا ثُمَّ لأُغْلَبَنَّ عَلَيْهِمْ فَأَقُولُ يَا رَبِّ أَصْحَابِي أَصْحَابِي فَيُقَالُ إِنَّكَ لا تَدْرِي مَا أَحْدَثُوا بَعْدَكَ
‘‘আমি হাউযের নিকট তোমাদের অগ্রবর্তী থাকব। কিছু মানুষের বিষয়ে আমি বিতর্ক করে শেষ পর্যন্ত পরাভূত হব। তখন আমি বলব, হে আমার প্রতিপালক, আমার সাহাবীগণ, আমার সাহাবীগণ! তখন বলা হবে: ‘আপনার পরে এরা কি নব-উদ্ভাবন বা পরিবর্তন করেছে তা আপনি জানেন না।’’[3]
অন্য হাদীসে আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
لَيَرِدَنَّ عَلَيَّ نَاسٌ مِنْ أَصْحَابِي الْحَوْضَ حَتَّى عَرَفْتُهُمْ اخْتُلِجُوا دُونِي فَأَقُولُ أَصْحَابِي فَيَقُولُ لا تَدْرِي مَا أَحْدَثُوا بَعْدَكَ
‘‘আমার সাহাবীগণের মধ্য থেকে কিছু মানুষ হাউযে আমার নিকট আগমন করবে। আমি যখন তাদের চিনতে পারব তখন তাদেরকে আমার থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হবে। আমি তখন বলব: আমার সাহাবীগণ! তখন তিনি বলবেন: ‘‘আপনার পরে এরা কি নব-উদ্ভাবন বা পরিবর্তন করেছে তা আপনি জানেন না।’’[4]
উভয় সম্প্রদায় দাবি করে যে, এ সকল হাদীস তাদের মতের অকাট্য (!) দলিল। নাসিবীদের মতে এ সকল হাদীস আলী (রাঃ) ও তাঁর অনুসারীদের বিষয়ে বলা হয়েছে। আর শীয়াগণ দাবি করেন যে, এগুলি আলী (রাঃ) ও তাঁর একান্ত সঙ্গী কতিপয় সাহাবী বাদে সকল সাহাবীর বিষয়ে বলা হয়েছে। তাদের মতে এ সকল হাদীস প্রমাণ করে, যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পরে আলী (রাঃ)-কে ক্ষমতা প্রদান না করে সকল সাহাবী মুরতাদ হয়ে যান (নাঊযু বিল্লাহ!)
তৃতীয় অধ্যায়ে আমরা সাহাবীগণের বিষয়ে কুরআন ও হাদীসের নির্দেশনা আলোচনা করেছি। আমরা দেখেছি যে,
(১) কুরআনে অনেক স্থানে সাহাবীগণের প্রশংসা ও তাঁদের ধার্মিকতার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। কয়েক স্থানে স্পষ্টত তাদের জান্নাতের সুসংবাদ প্রদান করা হয়েছে।
(২) বিশেষ করে প্রথম অগ্রবর্তী মুহাজির ও আনসারগণের জন্য মহান আল্লাহ জান্নাত প্রস্ত্তত রেখেছেন বলে ঘোষণা করা হয়েছে। নিষ্ঠার সাথে তাঁদের অনুসরণ করাই অন্যদের জন্য জান্নাতের পথ বলে জানানো হয়েছে।
(৩) বাইয়াতুর রিদওয়ান ও তাবূক যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের জান্নাতের বিষয়ে সুস্পষ্ট সুসংবাদ প্রদান করা হয়েছে।
(৪) অগণিত হাদীসে সাহাবীগণের মর্যাদা বর্ণনা করা হয়েছে এবং জান্নাতের সুসংবাদ প্রদান করা হয়েছে।
(৫) কুরআনে স্পষ্টত উল্লেখ করা হয়েছে যে, মদীনার সমাজে কিছু মুনাফিক বাস করত, তারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাহাবীগণের মধ্যেই মিশে থাকত এবং বাহ্যত তাঁদের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এরা সংখ্যায় অল্প ছিল। এদের অধিকাংশই তাবুক যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে নি। এদের বিষয়ে কুরআনে বলা হয়েছে:
وَمِمَّنْ حَوْلَكُمْ مِنَ الأَعْرَابِ مُنَافِقُونَ وَمِنْ أَهْلِ الْمَدِينَةِ مَرَدُوا عَلَى النِّفَاقِ لا تَعْلَمُهُمْ نَحْنُ نَعْلَمُهُمْ سَنُعَذِّبُهُمْ مَرَّتَيْنِ ثُمَّ يُرَدُّونَ إِلَى عَذَابٍ عَظِيمٍ
‘‘মরুবাসীদের মধ্যে যারা তোমাদের আশে-পাশে আছে তাদের মধ্যে কেউ কেউ মুনাফিক এবং মদীনবাসীদের মধ্যেও কেউ কেউ, তারা কপটতায় সিদ্ধ। তুমি তাদেরকে জান না, আমি তাদেরকে জানি। আমি তাদেরকে দুবার শাস্তি দিব ও পরে তারা প্রত্যাবর্তিত হবে মহা-শাস্তির দিকে।’’[5]
(৬) এ কথা ঐতিহাসিক সত্য যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ওফাতের পরে তাঁর কাছে ইসলামগ্রহণকারী কিছু মানুষ ও আরবের অন্যান্য অনেক মানুষ ইসলাম পরিত্যাগ করে। কেউ ভন্ডনবীদের অনুসারী হয়ে যায় এবং কেউ যাকাত অস্বীকার করে।
এ সকল দ্ব্যর্থহীন আয়াত ও হাদীসের বিপরীতে দ্ব্যর্থবোধক কয়েকটি হাদীসকে তারা তাদের মতের দলিল হিসেবে গ্রহণ করেছে। এ সকল হাদীসে কোনো সাহাবীর নাম উল্লেখ করা হয় নি, অধিকাংশ সাহাবীর কথাও বলা হয় নি, বরং বলা হয়েছে যে, সাহাবী বলে পরিচিত কতিপয় মানুষ। শীয়াগণ ও নাসিবীগণ এ সকল হাদীসের শাব্দিক বক্তব্যকে গ্রহণ করে তার মধ্যে নিজেদের আকীদা সীমাবদ্ধ রাখে নি। এ হাদীসকে তাদের মতের ‘বাহন’ হিসেবে ব্যবহার করেছে। তারা নিজেদের মর্জি, পছন্দ ও অভিরুচি মত একটি মত বা আকীদা উদ্ভাবন করেছে যা তারা যেভাবে বলে সেভাবে কখনোই কুরআন কারীমে বা হাদীসে পাওয়া যায় না। এখানেই বিদ‘আত ও সুন্নাতের পার্থক্য।
কুরআন-সুন্নাহ নির্দেশিত আকীদা: সকল সাহাবীর মর্যাদা, মক্কা বিজয়ের পূর্বে ইসলাম গ্রহণকারীদের বিশেষ মর্যাদা, তাবূকযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের বিশেষ মর্যাদা, বাইয়াতে রিদওয়ানে অংশগ্রহণকারীদের বিশেষ মর্যাদা এবং সর্বোপরি প্রথম অগ্রবর্তী মুহাজির ও আনসারদের সর্বোচ্চ মর্যাদা। তাঁদের মধ্যে জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত দশ সাহাবীর বিশেষ মর্যাদা। পাশাপাশি এ বিশ্বাস যে, সাহাবী নামধারী বা সাহাবী বলে পরিচিত কিছু মানুষ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আদর্শ বা পথ থেকে বিচ্যুত হওয়ার কারণে সাহাবীর মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হন। তাঁরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সমকালীন মদীনার বা আশেপাশে অবস্থানরত মুনাফিকগণ, যাদের কথা আল্লাহ কুরআনে বলেছেন, অথবা তাঁর ওফাতের পরে ভন্ড নবীদের কারণে বা যাকাত অস্বীকার করার কারণে যারা ইসলাম থেকে বিচ্যুত হন।
বিদ‘আতী আকীদা: প্রায় সকল সাহাবীই সুপথ থেকে বিচ্যুত হন (নাউযূ বিল্লাহ!) কেবলমাত্র কয়েকজন সুপথে ছিলেন। তাঁদের মর্যাদার মাপকাঠি আলী (রাঃ) ইমামতের পক্ষে কথা বলা।
দ্বিতীয় বিদ‘আতী আকীদা: আলী (রাঃ) ও তাঁর সাথী সাহাবীগণ সুপথ থেকে বিচ্যুত ছিলেন।
উভয় সম্প্রদায়ই এ বিষয়ে উপরের হাদীসগুলির মত আরো অনেক সাধারণ অর্থবোধক আয়াত বা হাদীস প্রমাণ হিসেবে পেশ করেন এবং এর বিপরীতে সাহাবীগণের মর্যাদা বিষয়ক সকল আয়াত ও হাদীসকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করে বাতিল করে দেন।
এখানে আমরা সুন্নাতপন্থী ও বিদ‘আতপন্থীদের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারছি। সুন্নাতপন্থীগণ কুরআন কারীম ও হাদীস শরীফে বর্ণিত সকল বিষয় সমানভাবে গ্রহণ ও বিশ্বাস করেন। কোনোরূপ বৈপরীত্য সন্ধান করেন না। বাহ্যিক কোনো বৈপরীত্য দেখা গেলে তা কুরআন ও হাদীসের আলোকেই সমাধান করেন।
এখানে কুরআনের অনেক আয়াতে সাহাবীগণের মর্যাদা প্রমাণিত। এর বিপরীতে কুরআনের একটি আয়াতেও সাহাবীগণের বিচ্যুতির বিষয়ে কিছু বলা হয় নি। অগণিত হাদীসে সাধারণভাবে এবং নাম উল্লেখ করে সাহাবীগণের মর্যাদা উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলির বিপরীতে কোনো একটি হাদীসেও সাহাবীগণের অমর্যাদা বা বিচ্যুতির কথা বলা হয় নি। এখানে কয়েকটি হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, কিয়ামতের দিন সাহাবী হিসেবে পরিচিত কতিপয় ব্যক্তিকে হাউয থেকে সরিয়ে নেওয়া হবে এবং তাদের বিষয়ে বলা হবে যে, এরা আপনার পরে পশ্চাদপসরণ করেছিল বা নব-উদ্ভাবন করেছিল।
মূলত এগুলির মধ্যে কোনো বৈপরীত্য নেই। আর কোনো বৈপরীত্য থাকলে তাও সুন্নাতের আলোকে সমাধান করতে হবে। কুরআনের নির্দেশনা, মুতাওয়াতির হাদীসের নির্দেশনা অগ্রবর্তী থাকবে। এছাড়া অস্পষ্ট বা দ্ব্যর্থবোধক আয়াত বা হাদীসের কারণে সুস্পষ্ট, দ্ব্যর্থহীন, সুনির্দিষ্ট নাম বা বৈশিষ্ট্যসহ মর্যাদা প্রকাশক হাদীসগুলি ব্যাখ্যা করা যাবে না। বরং প্রয়োজনে অস্পষ্ট বা দ্ব্যর্থবোধক আয়াত বা হাদীসকে সুস্পষ্ট আয়াত বা হাদীসের বিপরীতে ব্যাখ্যা করতে হবে। কোনো তাফসীর, ব্যাখ্যা বা ব্যক্তিগত মতামতকে ওহীর বিপরীতে দাঁড় করানো যায় না বা এরূপ কিছুর ভিত্তিতে ওহীর সুস্পষ্ট নির্দেশ ব্যাখ্যা করা যায় না। কেউ এর বিপরীত করলে বুঝতে হবে যে, সে নিজের মতকে ওহীর অনুসারী ও অনুগামী করতে রাযি নয়, বরং সে ওহীকে তার মতের অনুগামী ও অনুসারী বানতে ইচ্ছুক। পরবর্তী বিভিন্ন আলোচনায় আমরা দেখব যে, সকল বিদ‘আতী আকীদা ও সুন্নী আকীদা একইরূপ।
উপরের আলোচনা থেকে আমরা সুন্নাত ও বিদ‘আতের পার্থক্য বুঝতে পারি। সুন্নাত হলো ওহীর বা কুরআন-হাদীসের হুবহু অনুসরণ। রাসূলুললাহ (ﷺ) যা যতটুক যেভাবে বলেছেন তা ততটুকু সেভাবেই বলা এবং যা বলেননি তা বলা না বলা। কুরআন ও হাদীসের বক্তব্যের মধ্যে ঈমান-আকীদা সীমাবদ্ধ রাখা। কুরআন বা হাদীসের সাথে নিজেদের ব্যাখ্যা, মতামত বা যুক্তি যোগ করে তা আকীদার অংশ না বানান। কুরআন ও হাদীসের সকল কথা সমানভাবে বিশ্বাস করা। কোনো কথা গ্রহণ ও বাকি কথা বাতিল না করা। ব্যাখ্যা করে কোনো ওহী বাতিল না করা, বরং ব্যাখ্যা করে সকল ওহী গ্রহণ করা।
পক্ষান্তরে বিদ‘আত অর্থ ওহীর সাথে কোনো কিছু সংযোজন, বিয়োজন বা ব্যতিক্রম করে তা বিশ্বাস বা আকীদার অংশে পরিণত করা। যে বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কিছু বলেন নি তা বলা, অথবা ব্যাখ্যা বা সমন্বয়ের নামে ওহীর অতিরিক্ত কিছু আকীদার মধ্যে সংযোজন করা অথবা ওহীর কিছু অংশ ব্যাখ্যার নামে বাদ দেওয়া। বিদ‘আতপন্থীগণ সুন্নাতের অনুসরণ দাবি করেন। কিন্তু তাদের আকীদা বা বিশ্বাসগুলি হুবহু সুন্নাতের মধ্যে নেই। বরং তাদের আকীদা বা বিশ্বাস সুন্নাতের ব্যাখ্যার নামে সুন্নাতের সাথে কিছু সংযোজন বা বিয়োজন।
[2] বুখারী, আস-সহীহ ৩/১২২৩; মুসলিম, আস-সহীহ ৪/১৭৯৩-১৮০০।
[3] বুখারী, আস-সহীহ ৪/১৬৯১, ১৭৬৬, ৫/২৩৯১, ২৪০৪, ২৪০৬, ৬/২৫৮৭; মুসলিম, আস-সহীহ ১/২১৭, ৪/১৭৯৩-১৮০০, ২১৯৪।
[4] বুখারী, আস-সহীহ ৫/২৪০৬, ৬/২৫৮৭; মুসলিম, আস-সহীহ ৪/১৭৯৩-১৮০০।
[5] সূরা (৯) তাওবা, ১০১ আয়াত।
ইফতিরাক বা মুসলিম উম্মাহর আকীদাগত বিভাজন ইসলামী আকীদার অন্যতম বিষয়। সুন্নাত থেকে বিচ্যুতি ও বিদ‘আতের উদ্ভাবনই ইফতিরাকের মূল কারণ। ইফতিরাক বা বিভক্তি ও ফিরকাসমূহের প্রকৃতি না বুঝলে ইসলামের বিশুদ্ধ বিশ্বাস এবং আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আকীদা হৃদয়ঙ্গম করা কষ্টকর।
৬. ২. ১. ইফতিরাক
ইফতিরাক (الافتراق) শব্দটি আরবী ‘ফারক’, ‘ফারাকা’ (فرق) শব্দ থেকে গৃহীত। এর অর্থ পার্থক্য করা, বিভক্ত করা, বিচ্ছিন করা ইত্যাদি। ইফতিরাক (الافتراق) অর্থ বিচ্ছিন্ন হওয়া, দলাদলি করা, বিভক্ত হওয়া ইত্যাদি। ফির্কা (الفرقة) অর্থ দল, সংগঠন।
ইফ্তিরাক (الافتراق) শব্দটি ‘ইজতিমা’ (الاجتماع) শব্দটির বিপরীত। মহান আল্লাহ বলেন:
وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلا تَفَرَّقُوا
‘‘তোমরা আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধারণ কর সমবেতভাবে, এবং পরস্বপর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।’’[1]
এখানে আল্লাহ জামা‘আত (الجماعة) বা ইজতিমা (الاجتماع)-এর বিপরীতে ‘ইফতিরাক’ ও ‘তাফার্রুক’ উল্লেখ করেছেন। ইজতিমা অর্থ ঐক্যবদ্ধ হওয়া, অবিভক্ত হওয়া, দলবিহীন হওয়া ইত্যাদি।
৬. ২. ২. ইফতিরাক বনাম ইখতিলাফ
ইফতিরাকের নিকটবর্তী আরেকটি শব্দ ‘ইখতিলাফ’। ইফতিরাক অর্থ বিচ্ছিন্ন হওয়া বা দলে দলে বিভক্ত হওয়া। আর ইখতিলাফ অর্থ মতভেদ করা। ইফতিরাক ও ইখতিলাফ-এর মধ্যে পার্থক্য সুস্পষ্ট। মতভেদ বা মতবিরোধিতা সাধারণভাবে বিচ্ছিন্নতা বা দলাদলি নয়। মতভেদকারী ব্যক্তিগণ যখন নিজের মতকেই একমাত্র ‘হক্ক’ ও অন্যমতকে বাতিল মনে করেন এবং অন্যমতের অনুসারীদের ‘অন্যদল’ মনে করেন তখনই তা ইফতিরাক বা ‘বিচ্ছিন্নতা’-য় পরিণত হয়।
‘ইখতিলাফ’ ও ‘ইফতিরাক’-এর পাথ্যর্কের মধ্যে রয়েছে:
(১) ইফতিরাক বা ফিরকাবাজি ইখতিলাফ বা মতভেদের চূড়ান্ত ও নিন্দনীয় পর্যায়।
(২) সকল ইফতিরাকই (দলাদলি) ইখতিলাফ (মতভেদ), তবে সকল ইখতিলাফ (মতভেদ) ইফতিরাক (দলাদলি) নয়। ইখতিলাফ ছাড়া ইফতিরাকের অস্তিত্ব নেই তবে ইফতিরাক ছাড়াও ইখতিলাফ থাকতে পারে। এজন্য ইফতিরাককে ইখতিলাফ বলা যায়, তবে ইখতিলাফকে ইফতিরাক বলা যায় না।
(২) ইখতিলাফ সর্বদা ইফতিরাক বা দলাদলি সৃষ্টি করে না। সাহাবীগণের যুগ থেকে মুসলিম উম্মার ইমাম ও আলিমদের মধ্যে ‘মতভেদ’ বা ইখতিলাফ ছিল, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁদের মধ্যে দলাদলি-বিচ্ছিন্নতা বা ইফতিরাক ছিল না।
(৩) শরীয়তের দৃষ্টিতে ইখতিলাফ বা মতভেদ নিষিদ্ধ, নিন্দনীয় বা আপত্তিকর নয়, বরং অনেক সময় তা প্রশস্ততা সৃষ্টি করে। পক্ষান্তরে ইফতিরাক বা দলাদলি ও বিচ্ছিন্নতা সকল ক্ষেত্রেই নিষিদ্ধ ও নিন্দনীয়।
(৪) ইখতিলাফকারী আলিম নিন্দিত নয়, বরং তিনি ইখলাস ও ইজতিহাদের ভিত্তিতে প্রশংসিত ও পুরস্কার-প্রাপ্ত। মুজতাহিদ ভুল করলে একটি পুরস্কার ও সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছালে দুটি পুরস্কার লাভ করেন।
(৫) ইখতিলাফের ভিত্তি অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইলম বা জ্ঞান ও দলিল। আর ইফতিরাকের ভিত্তি সর্বদাই ব্যক্তিগত পছন্দ বা প্রবৃত্তির অনুসরণ, জিদ ও ইখলাসের অনুপস্থিতি। ইখতিলাফের ক্ষেত্রে আলিমগণ প্রত্যেকে নিজের মতকে সঠিক, অধিকতর শুদ্ধ বলে মনে করলেও অন্য মতটিকে বিভ্রান্তি ও অন্যমতের আলিমকে ‘বিভ্রান্ত’ বলে মনে করেন না, বরং তার দলিলকে দুর্বল বলে গণ্য করেন। পক্ষান্তরে ইফতিরাকের ক্ষেত্রে প্রত্যেক আলিম নিজের মতকে একমাত্র সত্য এবং অন্য মতকে বিভ্রান্তি বলে গণ্য করেন।
(৬) ইলম, ইখলাস, ইসলামী ভ্রাতৃতবোধ ও ভালবাসার সাথে ইখতিলাফ থাকতে পারে। কিন্তু এগুলির সাথে ‘ইফতিরাক’ থাকতে পারে না। কেবলমাত্র এগুলির অনুপস্থিতিতেই ইফতিরাক জন্ম নেয়।
(৭) ইখতিলাফ অনেক ক্ষেত্রেই রহমত, পক্ষান্তরে ইফতিরাক সকল ক্ষেত্রেই আযাব ও ধ্বংস।
কুরআন কারীম ও হাদীস শরীফ থেকে আমরা জানতে পারি যে, যুগে যুগে আসমানী হেদায়াত প্রাপ্ত বিভিন্ন জাতি ও সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভিন্ন কারণে দলাদলি ও বিভক্তি দেখা দিয়েছে। হাদীস শরীফে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর উম্মাতের মধ্যেও বিভক্তি ও দলাদলি দেখা দেবে বলে জানিয়েছেন। এ সকল আয়াত ও হাদীস থেকে জানা যায় যে, বিভক্তি ও দলাদলির মূল কারণ ছিল ওহীর শিক্ষার ব্যতিক্রম করা বা ওহীর কিছু শিক্ষা ভুলে যাওয়া, ব্যক্তিগত বিদ্বেষ, হিংসা ইত্যাদির বশবর্তী হওয়া, ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দের উপর নির্ভর করা, অতিভক্তি, পূর্ববর্তী গুরুদের অন্ধভক্তি ও অনুকরণ ইত্যাদি।
ইহূদী-খৃস্টানদের বিভক্তি ও দলাদলি সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন:
وَمِنَ الَّذِينَ قَالُوا إِنَّا نَصَارَى أَخَذْنَا مِيثَاقَهُمْ فَنَسُوا حَظًّا مِمَّا ذُكِّرُوا بِهِ فَأَغْرَيْنَا بَيْنَهُمُ الْعَدَاوَةَ وَالْبَغْضَاءَ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ وَسَوْفَ يُنَبِّئُهُمُ اللَّهُ بِمَا كَانُوا يَصْنَعُونَ
‘‘যারা বলে ‘আমরা খৃস্টান’ তাদেরও অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলাম; কিন্তু তাদেরকে যা শিক্ষা দেওয়া হয়েছিল তার এক অংশ তার ভুলে গিয়েছে। সুতরাং আমি কিয়ামত পর্যন্ত তাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ জাগরূক রেখেছি। তারা যা করত আল্লাহ তাদেরকে তা জানিয়ে দিবেন।’’[1]
এ আয়াতে আমরা দেখছি যে, খৃস্টানদের বিভক্তির মূল কারণ ছিল তাদেরকে যা শিক্ষা দেওয়া হয়েছিল বা তাদের উপর নাযিলকৃত ওহীর কিছু অংশ ভুলে যাওয়া। আমরা দেখেছি যে, তাদের এ ভুলে যাওয়ার প্রকৃতি ছিল বিভিন্ন। তারা আল্লাহর কিতাব সাধারণ মানুষদের পড়তে দিত না, অনেক অবহেলা ও অযন্তে কিতাবের অনেক অংশ হারিয়ে ফেলে, অনেক কিছু পরিবর্তন করে এবং মনগড়া কথা রচনা করে তা দিয়ে মূল কিতাবের শিক্ষা ভুলিয়ে দেয়।
অন্যান্য আয়াত থেকে আমরা জানতে পারি যে, ধর্মীয় ভ্রাতৃত্বের অভাব, মতভেদকে শত্রুতার পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া, নিজের মতকে চূড়ান্ত সত্য মনে করে পরিতৃপ্ত ও আনন্দিত হওয়া ইত্যাদি ছিল পূর্ববর্তী উম্মাতদের ইফতিরাকের কারণ ও প্রকাশ। এক আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন:
وَأَلْقَيْنَا بَيْنَهُمُ الْعَدَاوَةَ وَالْبَغْضَاءَ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ كُلَّمَا أَوْقَدُوا نَارًا لِلْحَرْبِ أَطْفَأَهَا اللَّهُ
‘‘তাদের মধ্যে আমি কিয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী শত্রুতা ও বিদ্বেষ সঞ্চার করে দিয়েছি। যতবার তারা যুদ্ধের অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করে ততবার আল্লাহ তা নির্বাপিত করেন।’’[2]
কুরআন কারীমে বারংবার বলা হয়েছে যে, ইফতিরাক ও দলাদলির কারণ অজ্ঞতা ছিল না, বরং জ্ঞান আসার পরেও জিদ, হিংসা, ঔদ্ধত্য, নিজ মত পরিত্যাগকে অপমান বলে গণ্য করা এবং সর্বোপরি ইখলাস ও তাকওয়ার অনুপস্থিতিই ছিল ইফতিরাক বা দলাদলির কারণ। মহান আল্লাহ বলেন:
وَمَا تَفَرَّقُوا إِلا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْعِلْمُ بَغْيًا بَيْنَهُمْ
‘‘তাদের নিকট জ্ঞান আসার পর কেবলমাত্র পারস্পরিক বিদ্বেষবশত তারা নিজদের মধ্যে বিভেদ-দলাদলি করে।’’[3]
অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন:
وَإِنَّ هَذِهِ أُمَّتُكُمْ أُمَّةً وَاحِدَةً وَأَنَا رَبُّكُمْ فَاتَّقُونِ فَتَقَطَّعُوا أَمْرَهُمْ بَيْنَهُمْ زُبُرًا كُلُّ حِزْبٍ بِمَا لَدَيْهِمْ فَرِحُونَ
‘‘এবং তোমাদের এ জাতি একই জাতি এবং আমিই তোমাদের প্রতিপালক; অতএব আমাকে ভয় কর। কিন্তু তারা নিজদের মধ্যে তাদের দীনকে বহুধা বিভক্ত করেছে, প্রত্যেক দলই তাদের নিকট যা আছে তা নিয়ে আনন্দিত।’’[4]
আহলু কিতাবের বিভ্রান্তির অন্যতম কারণ অতিভক্তির কারণে ওহীর অতিরিক্ত মতামত উদ্ভাবন। এ বিষয়ে অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন:
يَا أَهْلَ الْكِتَابِ لا تَغْلُوا فِي دِينِكُمْ وَلا تَقُولُوا عَلَى اللَّهِ إِلا الْحَقَّ إِنَّمَا الْمَسِيحُ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ رَسُولُ اللَّهِ وَكَلِمَتُهُ أَلْقَاهَا إِلَى مَرْيَمَ وَرُوحٌ مِنْهُ فَآَمِنُوا بِاللَّهِ وَرُسُلِهِ وَلا تَقُولُوا ثَلاثَةٌ
‘‘হে কিতাবীগণ, দীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করো না এবং আল্লাহ্ সম্বন্ধে সত্য ব্যতীত বলো না। মরিয়ম তনয় ঈসা মাসীহ আল্লাহর রাসূল, এবং তাঁর বাণী, যা তিনি মরিয়মের নিকট প্রেরণ করেছিলেন এবং তাঁর থেকে (আগত) আত্মা (আদেশ)। সুতরাং তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলে উপর ঈমান আন এবং বলিও না ‘তিন’...।[5]
আমরা দেখেছি যে, খৃস্টানগণ ওহীর শব্দগুলির অতিভক্তিমূলক ব্যাখ্যা করে এরূপ ব্যাখ্যার উপর আকীদা বা ধর্মবিশ্বাসের ভিত্তি স্থাপন করে। খৃস্টধর্মের ইতিহাসের সাথে পরিচিত সকলেই জানেন যে, ঈসা (আঃ) কেন্দ্রিক বাড়াবাড়িই তাদের মধ্যকার সকল দলাদলি ও ফিরকাবাজির মূল বিষয় ছিল। ত্রিত্ববাদ নামক মনগড়া মতবাদ এবং ঈসা (আঃ)-এর প্রকৃতি ব্যাখ্যা নিয়েই তাদের যত ফিরকাবাজি।
বিশ্বাসের মধ্যে ওহীর সাথে ব্যাখ্যার নামে মানবীয় মতামত, দর্শন ইত্যাদি যোগ করে তাকে ধর্মে বা ধর্মবিশ্বাসে পরিণত করাকে কুরআন কারীমে ‘হাওয়া’ বা প্রবৃত্তির অনুসরণ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ইহূদী-খৃস্টানগণের বিভ্রান্তি ও বিভক্তির আরেকটি দিক ছিল কতিপয় ‘পন্ডিতের’ প্রতি পরবর্তীদের অন্ধ ভক্তি ও তাদের মনগড়া মতামতের অন্ধ অনুকরণ। আল্লাহ বলেন:
قُلْ يَا أَهْلَ الْكِتَابِ لا تَغْلُوا فِي دِينِكُمْ غَيْرَ الْحَقِّ وَلا تَتَّبِعُوا أَهْوَاءَ قَوْمٍ قَدْ ضَلُّوا مِنْ قَبْلُ وَأَضَلُّوا كَثِيرًا وَضَلُّوا عَنْ سَوَاءِ السَّبِيلِ
‘‘বল, হে কিতাবীগণ, তোমরা তোমাদের দীনের বিষয়ে বাড়াবাড়ি করো না এবং যে সম্প্রদায় ইতোপূর্বে পথভ্রষ্ট হয়েছে ও অনেককে পথভ্রষ্ট করেছে এবং সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে তাদের ‘হাওয়া’ অর্থাৎ প্রবৃত্তি, মনগড়া মত বা খেয়াল-খুশির অনুসরণ করো না।’’[6]
[2] সূরা (৫) মায়িদা: ৬৪ আয়াত।
[3] সূরা (৪২) শূরা: ১৩ আয়াত। আরো দেখুন: সূরা (২) বাকারা ২১৩ আয়াত, সূরা (৩) আল-ইমরান: ১৯ আয়াত, সূরা (৪৫) জাসিয়াহ: ১৭ আয়াত।
[4] সূরা (২৩) মুমিনূন: ৫২-৫৩ আয়াত। আরো দেখুন: সূরা (৩০) রূম: ৩২ আয়াত।
[5] সূরা : ৪ নিসা, ১৭১ আয়াত।
[6] সূরা (৫) মায়িদা: ৭৭ আয়াত।
কুরআন কারীমে মহান আল্লাহ বারংবার এ উম্মাতকে বিচ্ছিন্নতা ও দলাদলি থেকে নিষেধ করেছেন। যারা ধর্মকে বিভক্ত করে তাদের নিন্দা করেছেন এবং তাদের সাথে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সম্পর্ক থাকবে না বলে উল্লেখ করেছেন। এ বিষয়ক একটি আয়াত এ অধ্যায়ের শুরুতে আমরা দেখেছি। যে আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন: ‘‘তোমরা আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধারণ কর সমবেতভাবে, এবং পরস্বপর বিচ্ছিন্ন হয়ো না বা দলাদলি করো না।’’ অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন:
وَلا تَكُونُوا كَالَّذِينَ تَفَرَّقُوا وَاخْتَلَفُوا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْبَيِّنَاتُ وَأُولَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ
‘‘তোমরা তাদের মত হয়ো না, যারা তাদের নিকট স্পষ্ট নিদর্শন আসার পরে বিচ্ছিন্ন হয়েছে এবং মতভেদ করেছে, এদের জন্য রয়েছে মহা শাস্তি।’’[1]
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন:
فَأَقِمْ وَجْهَكَ لِلدِّينِ حَنِيفًا فِطْرَةَ اللَّهِ الَّتِي فَطَرَ النَّاسَ عَلَيْهَا لا تَبْدِيلَ لِخَلْقِ اللَّهِ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لا يَعْلَمُونَ مُنِيبِينَ إِلَيْهِ وَاتَّقُوهُ وَأَقِيمُوا الصَّلاةَ وَلا تَكُونُوا مِنَ الْمُشْرِكِينَ مِنَ الَّذِينَ فَرَّقُوا دِينَهُمْ وَكَانُوا شِيَعًا كُلُّ حِزْبٍ بِمَا لَدَيْهِمْ فَرِحُونَ
‘‘তুমি একনিষ্ঠ হয়ে নিজকে দীনে প্রতিষ্ঠিত কর। আল্লাহর প্রকৃতির অনুসরণ কর, যে প্রকৃতি অনুযায়ী তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সৃষ্টির কোনো পরিবর্তন নেই। এই সরল দীন। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না। বিশুদ্ধচিত্তে তার অভিমুখী হয়ে তাকে ভয় কর, সালাত কায়েম কর এবং অন্তর্ভুক্ত হয়ো না মুশরিকদের, যারা নিজেদের দীনে মতভেদ সৃষ্টি করেছে এবং বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে। প্রত্যেক দলই নিজ নিজ মতবাদ নিয়ে উৎফুল্ল।’’[2]
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন:
إِنَّ الَّذِينَ فَرَّقُوا دِينَهُمْ وَكَانُوا شِيَعًا لَسْتَ مِنْهُمْ فِي شَيْءٍ إِنَّمَا أَمْرُهُمْ إِلَى اللَّهِ ثُمَّ يُنَبِّئُهُمْ بِمَا كَانُوا يَفْعَلُونَ
‘‘যারা দীন সম্বন্ধে নানা মতের সৃষ্টি করেছে এবং বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে তাদের কোনো দায়িত্ব তোমার নয়; তাদের বিষয় আল্লাহর ইখতিয়ারভুক্ত। আল্লাহ তাদেরকে তাদের কৃতকর্ম সম্বন্ধে অবহিত করবেন।’’[3]
মহান আল্লাহ আরো বলেন:
وَأَنَّ هَذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ وَلا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيلِهِ ذَلِكُمْ وَصَّاكُمْ بِهِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ
‘‘এবং এ পথই আমার সরল পথ, সুতরাং এরই অনুসরণ কর এবং অন্যান্য পথ অনুসরণ করো না, করলে সেগুলি তোমাদেরকে তাঁর পথ হতে বিচ্ছিন্ন করবে। এভাবে আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিলেন, যেন তোমরা সাবধান হও।’’[4]
বিভিন্ন হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) উল্লেখ করেছেন যে, যেভাবে পূর্ববর্তী উম্মাতগুলির মধ্যে বিভক্তি এসেছিল ঠিক সেভাবেই তাঁর উম্মাতের মধ্যেও বিভক্তি ও দলাদলি প্রবেশ করবে। ‘যাতু আনওয়াত’ বৃক্ষ বিষয়ক হাদীসটি আমরা ‘তাবার্রুক বিষয়ক শিরকের অনুচ্ছেদে উল্লেখ করেছি। আমরা দেখেছি যে, এ হাদীসে ‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: ‘‘যাঁর হাতে আমার জীবন তাঁর কসম, তোমরা তোমাদের পূর্ববর্তীদের সুন্নাত অনুসরণ করবে।’’
অন্য হাদীসে আবূ সাঈদ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
لَتَتَّبِعُنَّ سَنَنَ مَنْ قَبْلَكُمْ شِبْرًا بِشِبْرٍ وَذِرَاعًا بِذِرَاعٍ حَتَّى لَوْ سَلَكُوا جُحْرَ ضَبٍّ لَسَلَكْتُمُوهُ قُلْنَا يَا رَسُولَ اللَّهِ الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى قَالَ فَمَنْ؟
‘‘তোমরা অবশ্যই (বিভ্রান্তির ক্ষেত্রে) পূর্ববর্তী জাতিদের সুন্নাত (রীতি) পদে পদে অনুসরণ করবে: বিঘতে বিঘতে ও হাতে হাতে। এমনকি তারা যদি কোনো গুইসাপের গর্তে প্রবেশ করে তবে তোমরাও তথায় প্রবেশ করবে।’’ আমরা বললাম: পূর্ববর্তীগণ বলতে কি ইহূদী-খৃস্টানরা?’’ তিনি বলেন: ‘তবে আর কারা?’’[5]
অন্য হাদীসে আবূ হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
لا تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى تَأْخُذَ أُمَّتِي بِأَخْذِ الْقُرُونِ قَبْلَهَا شِبْرًا بِشِبْرٍ وَذِرَاعًا بِذِرَاعٍ فَقِيلَ يَا رَسُولَ اللَّهِ كَفَارِسَ وَالرُّومِ فَقَالَ وَمَنْ النَّاسُ إِلا أُولَئِكَ
‘‘কিয়ামত আগমনের আগেই আমার উম্মাত পূর্ববর্তী জাতিগুলি রীতি গ্রহণ করবে, বিঘতে বিঘতে এবং হাতে হাতে। তখন বলা হলো, ‘হে আল্লাহর রাসূল, পারস্যবাসী এবং রোমবাসীদের মত?’ তিনি বলেন: ‘তাদেরকে বাদ দিলে আর মানুষ কারা?’’[6]
অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যে ব্যাধির কারণে বিভক্তি ঘটে তা উল্লেখ করেছেন। যুবাইর ইবনুল আওয়াম (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
دَبَّ إِلَيْكُمْ دَاءُ الأُمَمِ قَبْلَكُمْ الْحَسَدُ وَالْبَغْضَاءُ هِيَ الْحَالِقَةُ لا أَقُولُ تَحْلِقُ الشَّعَرَ وَلَكِنْ تَحْلِقُ الدِّينَ وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لا تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ حَتَّى تُؤْمِنُوا وَلا تُؤْمِنُوا حَتَّى تَحَابُّوا ...
‘‘পূর্ববর্তী উম্মাতগণের ব্যাধি তোমাদের মধ্যে ধীরে ধীরে প্রবেশ করছে, সে ব্যাধি হলো হিংসা ও বিদ্বেষ। বিদ্বেষ মুন্ডনকারী। আমি বলি না যে, তা মাথার চুল মুন্ডন করে, বরং তা দীন মুন্ডন করে।’’[7]
প্রথম অধ্যায়ে সাহাবীগণের মতামতের গুরুত্ব আলোচনাকালে আমরা দেখেছি যে, একটি হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন: ‘‘তোমাদের মধ্যে যারা আমার পরে বেঁচে থাকবে তারা অনেক মতবিরোধ দেখতে পাবে। এক্ষেত্রে তোমাদের উপর দায়িত্ব হলো আমার সুন্নাত ও সুপথপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশিদীনের সুন্নাত অনুসরণ করা। তোমরা দৃঢ়ভাবে তা অাঁকড়ে ধরবে, কোন প্রকারেই তার বাইরে যাবে না। আর তোমরা (আমার ও খুলাফায়ে রাশিদীনের সুন্নাতের বাইরে) নতুন উদ্ভাবিত সকল বিষয় সর্বতোভাবে পরিহার করবে; কারণ সকল নতুন উদ্ভাবিত বিষয়ই বিদআত এবং সকল বিদআতই বিভ্রান্তি ও পথভ্রষ্টতা।’’
এ হাদীসে তিনি বিভক্তি থেকে আত্মরক্ষার পথ জানিয়েছেন, তা হলো, তাঁর ও খুলাফায়ে রাশিদীনের সুন্নাতের উপর অটল থাকা। অন্য হাদীসে তিনি বিভক্তি সৃষ্টিকারীদের প্রকৃতি ও বিভক্তির সময় উল্লেখ করেছেন। আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
مَا مِنْ نَبِيٍّ بَعَثَهُ اللَّهُ فِي أُمَّةٍ قَبْلِي إِلا كَانَ لَهُ مِنْ أُمَّتِهِ حَوَارِيُّونَ وَأَصْحَابٌ يَأْخُذُونَ بِسُنَّتِهِ وَيَقْتَدُونَ بِأَمْرِهِ ثُمَّ إِنَّهَا تَخْلُفُ مِنْ بَعْدِهِمْ خُلُوفٌ يَقُولُونَ مَا لا يَفْعَلُونَ وَيَفْعَلُونَ مَا لا يُؤْمَرُونَ فَمَنْ جَاهَدَهُمْ بِيَدِهِ فَهُوَ مُؤْمِنٌ وَمَنْ جَاهَدَهُمْ بِلِسَانِهِ فَهُوَ مُؤْمِنٌ وَمَنْ جَاهَدَهُمْ بِقَلْبِهِ فَهُوَ مُؤْمِنٌ وَلَيْسَ وَرَاءَ ذَلِكَ مِنْ الإِيمَانِ حَبَّةُ خَرْدَلٍ
‘‘আমার পূর্বে যে উম্মাতের মধ্যেই আল্লাহ কোনো নবী প্রেরণ করেছেন সে নবীরই উম্মাতের মধ্যে তাঁর ঘনিষ্ঠ শিষ্য ও সাহাবী ছিলেন, তাঁরা তাঁর সুন্নাত অাঁকড়ে ধরতেন এবং তাঁর নির্দেশ অনুসরণ করতেন। অতঃপর তাদের পরে এমন একদল উত্তরসূরির আবির্ভাব ঘটে যারা যা বলে তা করে না এবং যা তাদের করতে নির্দেশ দেওয়া হয় নি তা তারা করে। কাজেই যে ব্যক্তি এদের সাথে হাত দিয়ে জিহাদ করবে সে মুমিন, যে ব্যক্তি তাদের সাথে মুখ দিয়ে জিহাদ করবে সেও মুমিন এবং যে ব্যক্তি এদের সাথে অন্তর দিয়ে জিহাদ করবে সেও মুমিন। এর পরে আর শরিষা পরিমাণ ঈমানও অবশিষ্ট থাকে না।’’[8]
এখানে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জানিয়েছেন যে, সাহাবীগণের পরের যুগে বিভক্তি আসবে। এছাড়া তিনি সাহাবীগণের দুটি বৈশিষ্ট্য ও বিভক্তি সৃষ্টিকারীদের দুটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন। অন্য অনেক হাদীসে এ ধরনের কিছু বৈশিষ্ট্য তিনি উল্লেখ করেছেন।
আলী এবং ইবনু মাসঊদ () থেকে বিভিন্ন সহীহ সনদে বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,
يَأْتِي فِي آخِرِ الزَّمَانِ قَوْمٌ حُدَثَاءُ (أَحْدَاثُ) الأَسْنَانِ سُفَهَاءُ الأَحْلامِ يَقُولُونَ مِنْ خَيْرِ قَوْلِ الْبَرِيَّةِ (يَتَكَلَّمُوْنَ بِالْحَقِّ) (يَقْرَءُونَ الْقُرْآنَ لا يُجَاوِزُ حَنَاجِرَهُمْ) يَمْرُقُونَ مِنْ الإِسْلامِ (مِنَ الْحَقِّ) كَمَا يَمْرُقُ السَّهْمُ مِنْ الرَّمِيَّةِ لا يُجَاوِزُ إِيمَانُهُمْ حَنَاجِرَهُمْ فَأَيْنَمَا لَقِيتُمُوهُمْ فَاقْتُلُوهُمْ فَإِنَّ قَتْلَهُمْ أَجْرٌ لِمَنْ قَتَلَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
‘‘শেষ যুগে এমন একটি সম্প্রদায় আগমন করবে যারা বয়সে তরুণ এবং তাদের বুদ্ধিজ্ঞান অপরিপক্কতা, বোকামি ও প্রগভতায় পূর্ণ। মানুষ যত কথা বলে তন্মধ্যে সর্বোত্তম কথা তারা বলবে। তারা সত্য-ন্যায়ের কথা বলবে। তারা কুরআন পাঠ করবে কিন্তু তা তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে না। কিন্তু তারা সত্য, ন্যায় ও ইসলাম থেকে তেমনি ছিটকে বেরিয়ে যাবে, যেমন করে তীর শিকারের দেহ ভেদ করে ছিটকে বেরিয়ে যায়। তাদের ঈমান তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে না। তোমরা যখন যেখানেই তাদেরকে পাবে তখন তাদেরকে হত্যা করবে; কারণ তাদেরকে যারা হত্যা করবে তাদের জন্য কিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট পুরস্কার থাকবে।[9]
এই অর্থে ১৭ জন সাহাবী থেকে প্রায় ৫০টি পৃথক সূত্রের হাদীস বর্ণিত হয়েছে। এ সকল হাদীস প্রমাণ করে যে, বাহ্যিক আকর্ষণীয় ধার্মিকতা, সততা ও ঐকান্তিকতা সত্ত্বেও অনেক মানুষ উগ্রতার কারণে ইসলাম থেকে বিচ্যুত হবে। এ সকল হাদীস যদিও সর্বজনীন এবং সকল যুগেই এরূপ মানুষের আবির্ভাব হতে পারে, তবে সাহাবীগণের যুগ থেকে মুসলিম উম্মাহর আলিমগণ একমত যে, এ ভবিষ্যদ্বানীর প্রথম বাস্তবায়ন হয়েছিল খারিজীদের আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে।[10]
উপরের সহীহ হাদীসগুলি সামগ্রিকভাবে মুতাওয়াতির পর্যায়ের। এসকল হাদীস থেকে আমরা উম্মাতের মধ্যে বিভক্তি ও বিভক্তির কারণ সম্পর্কে জানতে পারি। অনুরূপভাবে বিভক্তি ও মতভেদের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও মুক্তির পথও আমরা জানতে পারি। অন্য কিছু হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) উম্মাতের মধ্যে বিভক্ত দলের সংখ্যা এবং মুক্তিপ্রাপ্ত দলের পরিচয় জানিয়েছেন। আবূ হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
تَفَرَّقَتْ الْيَهُودُ عَلَى إِحْدَى وَسَبْعِينَ أَوْ اثْنَتَيْنِ وَسَبْعِينَ فِرْقَةً وَالنَّصَارَى مِثْلَ ذَلِكَ وَتَفْتَرِقُ أُمَّتِي عَلَى ثَلاثٍ وَسَبْعِينَ فِرْقَةً
‘‘ইহূদীরা ৭১ বা ৭২ দলে বিভক্ত হয়ে যায় এবং খৃস্টানগণও অনুরূপ দলে বিভক্ত হয়ে যায়। আর আমার উম্মাত ৭৩ দলে বিভক্ত হবে।’’[11]
অন্য হাদীসে মু‘আবিয়া (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
أَلا إِنَّ مَنْ قَبْلَكُمْ مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ (الكتابين) افْتَرَقُوا عَلَى ثِنْتَيْنِ وَسَبْعِينَ مِلَّةً وَإِنَّ هَذِهِ الْمِلَّةَ سَتَفْتَرِقُ عَلَى ثَلاثٍ وَسَبْعِينَ ثِنْتَانِ وَسَبْعُونَ فِي النَّارِ وَوَاحِدَةٌ فِي الْجَنَّةِ وَهِيَ الْجَمَاعَةُ
‘‘তোমরা জেনে রাখ! তোমাদের পূর্ববর্তী কিতাবীগণ (ইহূদী ও খৃস্টানগণ) ৭২ দলে বিভক্ত হয়েছিল। আর এ উম্মাত ৭৩ দলে বিভক্ত হয়ে যাবে। এদের মধ্যে ৭২ দল জাহান্নামে এবং একটি দলই জান্নাতে। এ দলটি হলো জামা‘আত।’’[12]
অন্য হাদীসে আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ বলেন:
إِنَّ بَنِي إِسْرَائِيلَ تَفَرَّقَتْ عَلَى ثِنْتَيْنِ وَسَبْعِينَ مِلَّةً وَتَفْتَرِقُ أُمَّتِي عَلَى ثَلاثٍ وَسَبْعِينَ مِلَّةً كُلُّهُمْ فِي النَّارِ إِلا مِلَّةً وَاحِدَةً قَالُوا وَمَنْ هِيَ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ مَا أَنَا عَلَيْهِ (الْيَوْمَ) وَأَصْحَابِي
‘‘ইসরায়েল সন্তানগণ ৭২ দলে বিভক্ত হয়েছিল। আর আমার উম্মাত ৭৩ দলে বিভক্ত হবে। এদের মধ্যে সকলেই জাহান্নামী, একটিমাত্র দল বাদে। সাহাবীগণ প্রশ্ন করেন: হে আল্লাহর রাসূল, এ মুক্তিপ্রাপ্ত দলটি কারা? তিনি বলেন: ‘আমি এবং আমার সাহাবীগণ এখন যার উপর আছি।’’[13]
এভাবে আমরা দেখছি যে, মানবীয় দুর্বলতার সাথে শয়তানের প্ররোচনা একত্রিত হয়ে যুগে যুগে মানুষ আল্লাহর দীন ও হেদায়াত লাভ করার পরেও বিভ্রান্ত ও বিচ্ছিন্ন হয়েছে। প্রাকৃতিক ও জাগতিকভাবে মুসলিম উম্মাহর মধ্যেও এরূপ বিভক্তি আসবে বলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জানিয়েছেন। তবে এখানে লক্ষণীয় যে, বিভক্তদের দল-উপদল অনেক হলেও অনুসারী কম। কারণ আমরা দেখব যে, বিভক্তির মূল কারণ আকীদার উৎস হিসেবে ওহীর মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে ওহীর সাথে মানবীয় যুক্তি বিচার দিয়ে কিছু কথা সংযোজন করা। আর এ পথ খুললেই বিভক্তির পথ খুলে যায়। এজন্য ফিরকাগুলির মধ্যে আভ্যন্তরীন বিভক্তি খুবই বেশি। এতে ফিরকার সংখ্যা বাড়লেও অনুসারীদের সংখ্যা বাড়ে না।
দ্বিতীয় যে বিষয়টি লক্ষণীয় তা হলো, উপরের কোনো কোনো হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বিভক্ত ৭৩ দলের ৭২ দলই জাহান্নামী। এর অর্থ এই নয় যে, এরা সকলেই কাফির বা চিরস্থায়ী জাহানণামবাসী। বরং এরা বিশ্বাসগত পাপের কারণে বা বিশ্বাসের ক্ষেত্রে বিদ‘আতে লিপ্ত হওয়ার কারণে জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করবে। পরবর্তী আলোচনায় আমরা দেখব যে, সাহাবীগণ এবং তাঁদের অনুসারী আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআত আকীদাগত বিভ্রান্ত ফিরকাগুলিকে কাফির বলে গণ্য করেন নি। তাদেরকে বিভ্রান্ত বা বিভ্রান্তিতে নিপতিত মুসলিম বলে গণ্য করেছেন। তবে বিভ্রান্ত দল ও সম্প্রদায়গুলি তাদের নিজেদের ছাড়া সকলকেই কফির বলে গণ্য করত ও করে।
[2] সূরা (৩০) রূম: ৩০-৩২ আয়াত।
[3] সূরা (৬) আন‘আম: ১৫৯ আয়াত।
[4] সূরা (৬) আন‘আম: ১৫৩ আয়াত।
[5] বুখারী, আস-সহীহ ৩/১২৭৪, ৬/২৬৬৯; মুসলিম, আস-সহীহ ৪/২০৫৪।
[6] বুখারী, আস-সহীহ ৬/২৬৬৯।
[7] তিরমিযী, আস-সুনান ৪/৬৬৪।
[8] মুসলিম, আস-সহীহ ১/৬৯।
[9] বুখারী, আস-সহীহ ৩/১৩২১, ৪/১৯২৭; মুসলিম, আস-সহীহ ২/৭৪৬; তিরমিযী, আস-সুনান ৪/৪৮১; নাসাঈ, আস-সুনানুল কুবরা ৫/১৬১।
[10] ইবনু কাসীর, আল-বিদায়া ৫/৩৯৩-৪১১।
[11] তিরমিযী, আস-সুনান ৫/২৫। তিনি বলেন: হাদীসটি হাসান সহীহ।
[12] আবূ দাউদ ৪/১৯৮; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ১/২১৮। হাকিম ও যাহাবী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। ইবনু হাজার হাদীসটিকে হাসান বলেছেন। আলবানী, সিলসিলাতুস সাহীহাহ ১/৪০৪-৪১৪।
[13] তিরমিযী, আস-সুনান ৫/২৬; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ১/২১৮। তিরমিযী হাদীসটিকে হাসান গরীব বলেছেন। অন্যান্য মুহাদ্দিস হাদীসটিকে হাসান বলেছেন।
উপরের আয়াত ও হাদীসসমূহ থেকে আমরা দেখি যে, পূর্ববর্তী উম্মাত এবং এ উম্মাতের মধ্যে ইফতিরাক বা বিভক্তির কারণগুলি নিম্নরূপ:
৬. ৩. ৩. ১. ওহী ভুলে যাওয়া
কুরআন কারীমে আল্লাহ পূর্ববর্তী উম্মাতের বিভক্তি ও বিভ্রান্তির কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন যে, তারা তাদেরকে প্রদত্ত ওহীর একটি অংশ ভুলে গিয়েছিল, ফলে তাদের মধ্যে বিভক্তি, শত্রুতা ও দলাদলি সৃষ্টি হয়। এ বিষয়ে একটি আয়াত আমরা একটু আগে দেখেছি। অন্যত্র আল্লাহ বলেন:
فَبِمَا نَقْضِهِمْ مِيثَاقَهُمْ لَعَنَّاهُمْ وَجَعَلْنَا قُلُوبَهُمْ قَاسِيَةً يُحَرِّفُونَ الْكَلِمَ عَنْ مَوَاضِعِهِ وَنَسُوا حَظًّا مِمَّا ذُكِّرُوا بِهِ
‘‘তাদের অঙ্গীকার ভঙ্গের জন্য তাদেরকে লানত করেছি এবং তাদের হৃদয় কঠিন করেছি, তারা শব্দগুলিকে স্বস্থান থেকে বিকৃত করে এবং তাদেরকে যা শিক্ষা দেওয়া হয়েছিল তার এক অংশ ভুলে গিয়েছে।’’[1]
ওহী ভুলে যাওয়ার বিভিন্ন দিক রয়েছে। অবহেলার মাধ্যমে ওহীর কিছু অংশ বিলুপ্ত হওয়া, ব্যাখ্যার নামে মূল ওহী বাদ দিয়ে ব্যাখ্যাকেই ওহীর স্থলাভিষিক্ত করা, আহবার-রুহবানদের মাসূম বা নিষ্পাপ-নির্ভুল বলে বিশ্বাস করে তাদের মতামতকে ওহীর সমতূল্য বলে গণ্য করা, ওহীর নামে বানোয়াট বা মিথ্যা কথা প্রচার করা, দর্শন, যুক্তি ইত্যাদির মাধ্যমে ওহীর কিছু অংশ বাদ দেওয়া, জাগতিক স্বার্থের কারণে ওহীর নির্দেশনা বিকৃত করা ইত্যাদি। পূর্ববর্তী জাতিগুলির ন্যায় মুসলিম উম্মাহর মধ্যেও বিকৃতি, বিভ্রান্তি ও বিভক্তির এটি মূল কারণ। বিভিন্নভাবে এরা ওহী ভুলেছে বা ভুলাতে চেষ্টা করেছে। যেমন:
(ক) ওহী বা কুরআন ও হাদীস সাধারণ মানুষ বুঝতে পারবে না বা বিশেষ জ্ঞান সম্পন্ন ব্যক্তি ছাড়া এর নির্দেশনা ব্যাখ্যার অধিকার কারো নেই বলে জনগণকে কুরআন ও হাদীস অনুধাবন করা থেকে সরিয়ে রাখা। বিশেষ করে শীয়া সম্প্রদায়ের বাতিল আকীদাগুলির এটি অন্যতম।
(খ) ওহীর ব্যাখ্যায় কোনো আলিম, মা’সূম ইমামের বা অন্য কারো বিশেষ অধিকার আছে বলে দাবি করে তার ‘ইলম লাদুন্নী’, কাশফ, ব্যাখ্যা বা মতামতকে ওহীর অংশ বানিয়ে দেওয়া। এটিও শীয়া সম্প্রদায়ের মৌলিক বিভ্রান্তিসমূহের অন্যতম।
(গ) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পরে অন্য কোনো মানুষের নিষ্পাপত্ব বা নির্ভুলত্বে বা তাঁর ইলম লাদুন্নী, কাশফ বা ইলহামের অভ্রান্ততায় বিশ্বাস করে তার মতামতকে ওহীর সমতূল্য বা ওহীর একমাত্র ব্যাখ্যা বলে গণ্য করা। এতে মূল ওহীর আর কোনোই মূল্য থাকে না। কেবলমাত্র ওহীর ব্যাখ্যা নামে কথিত ইমামের মতামতই আকীদার একমাত্র ভিত্তি হয়ে যায়। এটিও শীয়াদের বিভ্রান্তির মৌলিক দিক।
(ঘ) ওহীর পাশাপাশি দর্শন, বৃদ্ধিবৃত্তিক যুক্তি ইত্যাদিকে ওহীর মতই আকীদার উৎস হিসেবে গ্রহণ করা। সকল বিভ্রান্ত দলেরই এটি বৈশিষ্ট্য।
(ঙ) ওহীর তাফসীর বা ব্যাখার নামে নিজেদের বা কোনো আলিম বা বুজুর্গের মতামতকে ওহীর সাথে আকীদার অংশ বানিয়ে দেওয়া। সকল বিভ্রান্ত ফিরকারই এটি বৈশিষ্ট্য।
(চ) তাবীল-ব্যাখ্যার নামে ওহীর কিছু বিষয় বাতিল করে তার একটি বিশেষ অর্থ আকীদার মধ্যে গণ্য করা। এতে ওহীর মূল ভাষা আকীদা থেকে ‘ভুলে যাওয়া’ হয়। সকল বিভ্রান্ত ফিরকারই এটি বৈশিষ্ট্য।
(ছ) বানোয়াট কথা বানিয়ে ওহীর নামে চালানো বা জাল হাদীস তৈরি করা বা জাল বা অনির্ভরযোগ্য হাদীস, তাফসীর বা ঘটনার উপরে আকীদার ভিত্তি স্থাপন করা। এটি শীয়া ও অন্যান্য অনেক ফিরকার বৈশিষ্ট্য।
৬. ৩. ৩. ২. হাওয়া (الهوى) বা মনগড়া মতামতের অনুসরণ
হা, ওয়াও ও ইয়া তিনটি বর্ণের সমন্বয়ে গঠিত শব্দটির মূল অর্থ শূন্য হওয়া, খালি হওয়া বা নিপতিত হওয়া। এ ক্রিয়ামূল থেকে দু প্রকারের ক্রিয়া ব্যবহৃত হয়: (ضرب يضرب) বাব থেকে ক্রিয়াটি ব্যবহৃত হলে বলা হয় হাওয়া-ইয়াহবী (هَوَى، يَهْوِي) এবং এক্ষেত্রে অর্থ হয় নিপতিত হওয়া। এ ক্রিয়ার মাসদার: হুবিয়্যান (هُوِيّاً)। আর (سمع يسمع) বাব থেকে ক্রিয়াটি ব্যবহৃত হলে বলা হয় হাবিয়া-ইয়াহবা (هَوِيَ يَهْوَى) অর্থাৎ ভালবাসা, প্রেম করা, পছন্দ করা, ইত্যাদি। এ ক্রিয়ার মাসদার ‘হাওয়ান’ (هَوَى)। এভাবে আমরা দেখছি যে, হাওয়া (الهوى) শব্দের অর্থ প্রেম, ভাললাগা, পছন্দ করা (love, passion, wish, desire, pleasure) ইত্যাদি। বহু বচন: আহওয়া (الأهواء)।[2]
কুরআনে বারংবার উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘হাওয়ান নাফস’ (هوى النفس) বা ব্যক্তি মনের পছন্দ-অপছন্দ অনুসরণ করা বিভ্রান্তি ও বিভক্তির অন্যতম কারণ। হাদীস শরীফে মুসলিম উম্মাহর বিভক্তিকে ‘আহওয়া’ (أهواء) বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। মু‘আবিয় (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ বলেছেন:
إِنَّ أَهْلَ الْكِتَابَيْنِ افْتَرَقُوا فِي دِينِهِمْ عَلَى ثِنْتَيْنِ وَسَبْعِينَ مِلَّةً وَإِنَّ هَذِهِ الأُمَّةَ سَتَفْتَرِقُ عَلَى ثَلاثٍ وَسَبْعِينَ مِلَّةً يَعْنِي الأَهْوَاءَ كُلُّهَا فِي النَّارِ إِلا وَاحِدَةً وَهِيَ الْجَمَاعَةُ وَإِنَّهُ سَيَخْرُجُ فِي أُمَّتِي أَقْوَامٌ تَجَارَى بِهِمْ تِلْكَ الأَهْوَاءُ كَمَا يَتَجَارَى الْكَلْبُ بِصَاحِبِهِ لا يَبْقَى مِنْهُ عِرْقٌ وَلا مَفْصِلٌ إِلا دَخَلَهُ
‘‘তোমাদের পূর্ববর্তী কিতাবীগণ (ইহূদী ও খৃস্টানগণ) ৭২ দলে বিভক্ত হয়েছিল। আর এ উম্মাত ৭৩ দলে বিভক্ত হয়ে যাবে, তারা পছন্দ বা মনগড়া মতের (أهواء) অনুসরণ করবে। এরা সকলেই জাহান্নমী, কেবলমাত্র একটি দল বাদে, যারা ‘আল-জামা‘আত’। আর আমার উম্মাতের মধ্যে এমন কিছু দল বের হবে যাদের মধ্যে মনগড়া মত বা পছন্দের অনুসরণ এমনভাবে প্রবেশ করবে যেমনভাবে জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে তার রোগ প্রবেশ করে। তার দেহের সকল শিরা, উপশিরা ও অস্তিসন্ধিতে তা প্রবেশ করে।’’[3]
এভাবে আমরা দেখছি যে, বিভ্রান্তি ও বিভক্তির অন্যতম কারণ ‘ইত্তিবাউল হাওয়া’ বা পছন্দের অনুসরণ বা মনগড়া মতের অনুসরণ। বস্ত্তত ধর্ম ও বিশ্বাসের মূল হলো ওহীর নিকট আত্মসমর্পণ। এর স্বরূপ হলো কোনো শিক্ষা বা নির্দেশনা ওহী বলে প্রমাণিত হলে নিজের মত বা পছন্দ-অপছন্দকে তার অধীন করে দেওয়া। প্রয়োজনে নিজের মত বা নিজের মনোনীত ব্যক্তির মত ব্যাখ্যা করে বাদ দিয়ে ওহীর মত ব্যাখ্যাতীতভাবে গ্রহণ করা।
এর বিপরীত হলো ইত্তিবাউল হাওয়া বা নিজের মনমর্যি বা পছন্দ-অপছন্দের উপর নির্ভর করা। এর স্বরূপ হলো, একটি মত বা কর্ম মানুষের কোনো কারণে ভাল লাগবে বা সঠিক বলে মনে হবে। এরপর সে এই মতটি প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা করবে। ওহীর যে বিষয়টি তার মতের পক্ষে থাকবে সেটি সে গ্রহণ করবে। আর যে বিষয়টি তার মতের বিরুদ্ধে যাবে তা সে প্রত্যাখ্যান করবে বা ব্যাখ্যা করবে।
আমরা দেখেছি যে, বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীগণ পূর্ববর্তী ধর্ম, প্রচলিত দর্শন, সামাজিক রীতি বা বিশ্বাসের প্রভাবে বা পূর্বপুরুষদের মতামতের প্রভাবে একটি বিশ্বাস বা কর্মকে ভালবেসে ফেলেন। এরপর তার কাছে ওহীর বিষয় প্রমাণিত হলেও তা গ্রহণ করতে পারেন না। বরং ওহীর বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বা না করে উড়িয়ে দেন এবং পছন্দনীয় মতটিই ধরে থাকেন। ইহূদী-খৃস্টানগণ এবং আরবের কাফিরদের বিভ্রান্তি ও বিভক্তির এটি ছিল অন্যতম কারণ। মুসলিম উম্মাহর বিভ্রান্ত ও বিভক্ত দলগুলিরও এটি মূল বৈশিষ্ট্য।
৬. ৩. ৩. ৩. হিংসা-বিদ্বেষ
কুরআন ও হাদীসে বারংবার উল্লেখ করা হয়েছে যে, হিংসা, বিদ্বেষ, জিদ ও উগ্রতা বিভক্তি বা ইফতিরাকের অন্যতম কারণ। বস্ত্তত মতভেদ মানুষের স্বাভাবিক বিষয়। মানুষের মধ্যে অন্যান্য সকল বিষয়ের ন্যায় ধর্মীয় বিষয়েও মতভেদ হতেই পারে। দুটি বিষয় বিদ্যমান থাকলে এরূপ মতভেদ নিরসন হয়ে যায় অথবা মতভেদসহ-ই অবিচ্ছিন্ন থাকা যায়: (১) ওহীর প্রতি পরিপূর্ণ আত্মসমর্পন এবং (২) পরিপূর্ণ ভালবাসা ও ভ্রাতৃত্ববোধ।
ওহীর প্রতি পরিপূর্ণ আত্মসমর্পন মতভেদ নিরসন করে বা মতভেদের গুরুত্ব কমিয়ে আনে। মতভেদকারী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীবর্গ যদি ওহীর মাধ্যমে যা জানা যায় সেটুকু মূল ধরে ওহীর অতিরিক্ত বিষয়কে অমৌলিক সহ্যযোগ্য বিষয় হিসেবে গণ্য করেন তবে মতভেদের তীব্রতা কমে যায়। পাশাপাশি আন্তরিক ভালবাসা ও ভ্রাতৃৃত্ববোধ অপরের মতের প্রতি সহনশীলতা বাড়িয়ে দেয় এবং বিভক্তি ও বিচ্ছিন্নতা থেকে রক্ষা করে।
মতভেদীয় সকল বিষয়কেই এখানে উদাহরণ হিসেবে পেশ করা যায়। সাহাবীগণের সকলের মর্যাদার স্বীকারোক্তিসহ তাঁদের পারস্পরিক তারতম্য নির্ধারণের বিষয়ে, ঈমানের প্রকৃতি ও কবীরা গোনাহকারী বিধানের বিষয়ে, তাকদীর ও মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার বিষয়ে, আল্লাহর বিশেষণসমূহের বিষয়ে বিভিন্ন ফিরকার জন্ম হয়েছে। এক্ষেত্রে যদি সকলে এ বিষয়ে একমত হতেন যে, ওহীর মাধ্যমে বা কুরআন ও হাদীস থেকে যতটুক জানা যায় তা আমরা গ্রহণ করব। বাকি সমন্বয় ও ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে মানবীয় বুদ্ধি দিয়ে যা বলব তা ওহীর মত চূড়ান্ত বলে গণ্য করব না। বরং এগুলিকে ইজতিহাদী ব্যাখ্যা কাজেই এগুলির সমাধান না হলেও আমরা একে অপরের মত সহ্য করব। কারণ আমরা সকলেই একই ধর্মের অনুসারী ও পরস্পরে ভ্রাতৃত্বের কঠিন বন্ধনে আবদ্ধ।
আমরা পরবর্তী আলোচনা থেকে দেখতে পাব সাহাবীগণের মধ্যে এদুটি বিষয়ে প্রগাঢ় বিদ্যমানতার কারণে তাঁদের মতভেদ কখনো বিভক্তির পর্যায়ে যায় নি। অনুরূপভাবে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আলিম ও ইমামগণও এদুটি বিষয়ের গুরুত্ব দিয়েছেন। ফলে একদিকে তাঁরা তাঁদের আভ্যন্তরীন মতভেদগুলি সহজভাবে নিয়েছেন এবং তাঁদের মতভেদ বিচ্ছিন্নতায় পর্যবসিত হয় নি। অপরদিকে তারা বিচ্ছিন্ন ফিরকাসমূহের মতভেদ ও বিচ্ছিন্নতাও যথাসম্ভব সহজ করে দেখেছেন। তাদেরকে ভুলের মধ্যে নিপতিত ও বিভ্রান্তির শিকার বললেও ওহীর কোনো বিষয় সুস্পষ্ট অস্বীকার না করা পর্যন্ত তাঁরা তাদেরকে কাফির বলেন নি। আল্লামা আলাউদ্দীন হাসকাফী (১০৮৮ হি) তাঁর আদ-দুর্রুল মুখতার গ্রন্থে বিদ‘আতী ও বিভ্রান্ত সম্প্রদায়ের বিষয়ে আহলুস সুন্নাতের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করে বলেন:
لا يكفر بها حَتَّى الْخَوَارِجُ الَّذِينَ يَسْتَحِلُّونَ دِمَاءَنَا وَأَمْوَالَنَا وَسَبَّ الرَّسُولِ، وَيُنْكِرُونَ صِفَاتِهِ تَعَالَى وَجَوَازَ رُؤْيَتِهِ لِكَوْنِهِ عَنْ تَأْوِيلٍ وَشُبْهَةٍ بِدَلِيلِ قَبُولِ شَهَادَتِهِمْ ، إلا الْخَطَّابِيَّةِ ... وَإِنْ أَنْكَرَ بَعْضَ مَا عُلِمَ مِنْ الدِّينِ ضَرُورَةً كَفَرَ بِهَا
‘‘এমনকি খারিজীগণ, যারা আমাদের রক্তপাত ও ধনসম্পদ বৈধ বলে গণ্য করে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর গালি প্রদান করে, মহান আল্লাহর বিশেষণসমূহ অস্বীকার করে এবং আখিরাতে তাঁর দর্শন অস্বীকার করে তাদেরও এগুলির কারণে কাফির বলা হয় না। কারণ তাদের এ সকল মতামতের কারণ ব্যাখ্যা ও কুরআন-সুন্নাহর প্রমাণ বুঝতে অস্পষ্টতা বা ভুল বুঝা। এর প্রমাণ যে, মুসলিমদের আভ্যন্তরীন মামলা-মুকাদ্দামায় তাদের সাক্ষ্য কবুল করা হয়। তবে খাত্তাবিয়্যাহ[4] ফিরকাকে কাফির বলা হয়েছে। আর কোনো ফিরকা যদি দীনের কোনো অত্যাবশ্যকীয় সর্বজন অবজ্ঞাত বিশ্বাস অস্বীকার করে তবে এরূপ বিদ‘আতের কারণে সে কাফির বলে গণ্য হবে।’’[5]
৬. ৩. ৩. ৪. সুন্নাত থেকে বিচ্যুতি
আমরা দেখেছি যে, মুসলিম উম্মাহর বিভক্তির ক্ষেত্রে ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ‘সুন্নাত’ এবং সাহাবীগণের ‘সুন্নাত’ অনুসরণ করাকে নাজাত, সফলতা ও হিদায়াতের মাপকাঠি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে বিভিন্ন হাদীসে। বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সুন্নাত শব্দের অর্থ, ও সুন্নাত অনুসরণের প্রকৃতি সম্পর্কে আমরা পরবর্তীকালে আলোচনা করব। বস্ত্তত সুন্নাত থেকে বিচ্যুতিই সকল বিভ্রান্তির দরজা খুলে দেয়। ইসলামের প্রথম বৃহৎ বিভক্তি খারিজী ফিরকার ইতিহাসে আমরা তা ভালভাবে দেখতে পাই। খারিজীগণ কুরআনের নির্দেশনা বুঝার ক্ষেত্রে ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নিজেদের বুঝকেই চূড়ান্ত মনে করত। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আজীবনের সহচর ও দীন সম্পর্কে অধিক জ্ঞানী সাহাবীগণের মতামতকে অবজ্ঞা করত এবং তাদের পরামর্শ গ্রহণকে তারা অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করত। তাদের বুঝের বাইরে মতপ্রকাশকারীদেরকে ঢালাওভাবে তারা অবজ্ঞা করত।[6]
এছাড়া তারা কুরআন বুঝার জন্য সুন্নাতের গুরুত্ব অস্বীকার করে। তারা হাদীস অস্বীকার করত না। সাহাবীদের কাছে বিভিন্ন বিষয়ে তারা হাদীস শিক্ষার জন্য গমন করত ও প্রশ্ন করত। কিন্তু তারা ‘সুন্নাত’-এর গুরুত্ব অস্বীকার করত। অর্থাৎ যে বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক, বিভ্রন্তি ও বিভক্তি সৃষ্টি হচ্ছে ঠিক সে বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যা বলেছেন তার মধ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখা জরুরী মনে করত না। বরং কুরআন বা হাদীস থেকে সাধারণভাবে তারা যা বুঝেছে সেটিকেই চূড়ান্ত মনে করত।[7]
বস্ত্তত সুন্নাত-ই মুমিনের মুক্তির পথ। যতক্ষণ মুমিন সুন্নাতের মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখে ততক্ষণ তার কোনো ভয় থাকে না। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যা যেভাবে যতটুকু বলেছেন মুমিন যদি তা ততটুকু সেভাবেই বলেন এবং তিনি যা বলেন নি মুমিন যদি তা বলা বর্জন করে তবে তার কোনো ভয় থাকে না। সুন্নাতের বাইরে গেলেই বিচ্যুতির সম্ভাবনা খুলে যায়। কারণ সুন্নাতের ব্যাখ্যার নামে যে সংযোজন বা বিয়োজন সে করে তা সঠিক না ভুল না নিশ্চিত জানার কোনো উপায় তার নেই। সর্বোপরি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যা বলেন নি বা বলা বর্জন করেছেন তা না বললে দীনের কোনো ক্ষতি হবে সে চিন্তা করাও ভাল নয়।
৬. ৩. ৩. ৫. যা করতে নির্দেশ দেওয়া হয় নি তা করা
উপরের হাদীসে আমরা দেখেছি যে, বিভ্রান্ত মানুষদের বৈশিষ্ট্য হিসেবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন যে, ‘যা করতে বলা হয় নি তা তারা করবে।’ অর্থাৎ ওহীর মাধ্যমে যে সকল কাজের নির্দেশ দেওয়া হয় নি, ওহীর বিভিন্ন ব্যাখ্যা বা যুক্তির মাধ্যমে সে সকল কাজকে দীনের বা আকীদার অংশ বানিয়ে নেওয়া।
যেমন, ওহীর মাধ্যমে সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, কিন্তু অসৎকাজে লিপ্তকে হত্যা করতে, শাস্তি দিতে বা আইন নিজের হাতে তুলে নিতে নির্দেশ দেওয়া হয় নি বা রাষ্ট্রদ্রোহিতার নির্দেশ দেওয়া হয় নি, কিন্তু খারিজীগণ ওহীর অনুসরণের নামে তা করেছে। অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বংশধরদের ভালবাসতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, কিন্তু ভালবাসার নামে আলী (রাঃ)-কে সাজদা করতে, তাঁর বিশেষ গাইবী জ্ঞান আছে বলে মনে করতে, তাকে নিষ্পাপ বলে দাবি করতে বা অন্যান্য সাহাবীকে ঘৃণা করতে নির্দেশ দেওয়া হয় নি, কিন্তু শীয়াগণ তা করেছে।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও তাঁর বংশধরদেরকে ভালবাসা, তাঁদের আনন্দে আনন্দে আনন্দিত হওয়া ও তাদের বেদনায় ব্যথিত হওয়া ইসলামের নির্দেশ। কিন্তু বেদনায় ব্যথিত হওয়ার নামে মাতম বা তাযিয়া বের করা, শোক-সমাবেশ করা, নিজেকে আঘাত করে রক্তাক্ত করা ইত্যাদি ইসলামের নির্দেশ নয়। অনুরূপভাবে তাঁদের জন্মদিনে বা অন্য কোনো দিনে তাঁদের ভালবাসা বা আনন্দের নামে মিছিল, উৎসব ইত্যাদি করাও ইসলামের নির্দেশ নয়। কিন্তু বিভিন্ন ব্যাখ্যা করে এবং বিভিন্ন জাল দলিল তৈরি করে শীয়াগণ এরূপ করে থাকে।
সকল বিভ্রান্ত সম্প্রদায়ই এরূপ করেছে। ওহীর ব্যাখ্যার নামে তারা এমন কথা বলেছে বা এমন কাজ করেছে যা করতে তাদেরকে সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ দেওয়া হয় নি।
৬. ৩. ৩. ৬. অন্যান্য জাতি দ্বারা প্রভাবিত হওয়া
উপরের বিভিন্ন হাদীসে আমরা দেখেছি যে, মুসলিম উম্মাহ পূর্ববর্তী জাতিসমূহের অনুসরণ করবে বলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) উল্লেখ করেছেন। এর একটি নমুনা দেখেছি যে, মুশরিকদের ‘যাতু আনওয়াত’ দেখে কেউ কেউ অনুরূপ কিছু নিজেদের মধ্যেও প্রচলন করার আগ্রহ দেখিয়েছিলেন।
মুসলিম উম্মাহর বিভক্তি ও ফিরকাবাজির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমর দেখি যে, এ বিষয়টি ছিল সকল বিভক্তির অন্যতম কারণ। দ্বিতীয় প্রজন্মের নতুন মুসলিমগণ তাদের পূর্ববর্তী ধর্মের প্রভাব, লোকাচার, প্রচলিত দর্শন, সমাজের পন্ডিতদের বক্তব্য ইত্যাদির কারণেই বিভিন্ন বিদ‘আতের মধ্যে নিপতিত হয়।
৬. ৩. ৩. ৭. মুহকাম রেখে মুতাশাবিহ অনুসরণ
কুরআন ও হাদীসে বিভ্রান্তি ও বিভক্তির আরো কিছু বিষয় নির্দেশ করা হয়েছে। এগুলির মধ্যে রয়েছে ওহীর সুস্পষ্ট দ্ব্যর্থহীন নির্দেশনার বিপরীতে দ্ব্যর্থবোধক বা একাধিক অর্থের সম্ভাবনাময় বক্তব্যকে গ্রহণ করা বা আকীদার ভিত্তি বানানো। মহান আল্লাহ বলেন:
هُوَ الَّذِي أَنْزَلَ عَلَيْكَ الْكِتَابَ مِنْهُ آَيَاتٌ مُحْكَمَاتٌ هُنَّ أُمُّ الْكِتَابِ وَأُخَرُ مُتَشَابِهَاتٌ فَأَمَّا الَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ زَيْغٌ فَيَتَّبِعُونَ مَا تَشَابَهَ مِنْهُ ابْتِغَاءَ الْفِتْنَةِ وَابْتِغَاءَ تَأْوِيلِهِ وَمَا يَعْلَمُ تَأْوِيلَهُ إِلا اللَّهُ وَالرَّاسِخُونَ فِي الْعِلْمِ يَقُولُونَ آَمَنَّا بِهِ كُلٌّ مِنْ عِنْدِ رَبِّنَا وَمَا يَذَّكَّرُ إِلا أُولُو الأَلْبَابِ
‘‘তিনিই তোমার প্রতি এ কিতাব অবতীর্ণ করেছেন যার কতক আয়াত সুস্পষ্ট দ্ব্যর্থহীন, এগুলি কিতাবের মূল অংশ; আর অন্যগুলি দ্ব্যর্থবোধক-একাধিক অর্থের সম্ভাবনাময়-। যাদের অন্তরে সত্য-লঙ্ঘন প্রবণতা রয়েছে শুধু তারাই ফিতনা এবং ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যে দ্ব্যর্থবোধক বিষয়গুলির অনুসরণ করে।’’[8]
আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি যে, খৃস্টানদের বিভ্রান্তি ও বিভক্তির এটি একটি দিক ছিল। তাদের নিকট বিদ্যমান ‘কিতাবে’ আল্লাহর একত্ব, ঈসা (আঃ)-এর মানবত্ব, রাসূলত্ব ইত্যাদি সম্পর্কে দ্ব্যর্থহীন সুস্পষ্ট নির্দেশনা বিদ্যমান। পাশাপাশি ‘আল্লাহর রূহ’, ‘আল্লাহর কালিমা’ ইত্যাদি কিছু বিশেষণ তাঁর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে যার অর্থও পরিষ্কার, তবে তা একাধিক অর্থের সম্ভাবনা রাখে। এ সকল দ্ব্যর্থবোধক শব্দগুলিকে তারা একটি বিশেষ অর্থে ব্যাখ্যা করে সেই ব্যাখ্যাকে তারা তাদের বিশ্বাসের মূল ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করে এবং এর ভিত্তিতে দ্ব্যর্থহীন সুস্পষ্ট নির্দেশনাগুলি ব্যাখ্যা করে বাতিল করে।
মুসলিম উম্মাহর বিভ্রান্ত ফিরকাগুলিরও একই অবস্থা। পরবর্তী আলোচনায় আমরা এ জাতীয় অনেক নমুনা দেখতে পাব, ইনশা আল্লাহ।
৬. ৩. ৩. ৮. কর্মহীন তাত্ত্বিক বিতর্ক ও ওহীর মধ্যে বৈপরীত্য সন্ধান
ওহীর মূল উদ্দেশ্য মানুষকে আল্লাহর সন্তুষ্টির পথ প্রদর্শন করা। মুমিনের দায়িত্ব ওহীর নির্দেশ মত নিজের বিশ্বাস ও কর্ম পরিচালনা কর। ওহীর অনুসরণ ও পালনই মূল বিষয়, ওহী নিয়ে বিতর্ক নয়। কিন্তু সাধারণত মানবীয় প্রকৃতি কর্মের চেয়ে কর্মহীন বিতর্ককে ভালবাসে। আর এরূপ বিতর্ক বিভ্রান্তির উৎস। কারণ ওহী মূলত গাইবী বিষয়, এ বিষয়ে মানবীয় বুদ্ধি ও যুক্তি নির্ভর বিতর্ক কোনো চূড়ান্ত সমাধান আনতে পারে না। এজন্য হাদীস শরীফে ওহীর পালন ও বাস্তবায়নে মনোযোগ দিতে এবং তা নিয়ে বিতর্ক পরিহার করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এখানে আরো লক্ষণীয় যে, জ্ঞানবৃত্তিক আলোচনা জ্ঞানের পথ সুগম করে। মতবিমিয়ের মাধ্যমে আলোচকদের অজ্ঞতা বা ভুল দূর হয় এবং নতুন অনেক বিষয় জানা যায়। কিন্তু বিতর্ক তা নয়। বিতর্কের সময় প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের একটি মত গঠন করে এবং যে কোনো ভাবে তার মতটি প্রমাণ করতে চেষ্টা করে। নিজ মতের দুর্বলতা ধরা পড়লেও তা স্বীকার করতে রযি হয় না, কারণ তা তার পরাজয় বলে গণ্য হয়। এজন্য হাদীস শরীফে কুরআন নিয়ে আলোচনা ও পারস্পরিক পাঠের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, কিন্তু বিতর্ক করতে নিষেধ করা হয়েছে। আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রাঃ) বলেন,
هَجَّرْتُ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ (ﷺ) يَوْمًا قَالَ فَسَمِعَ أَصْوَاتَ رَجُلَيْنِ اخْتَلَفَا فِي آيَةٍ فَخَرَجَ عَلَيْنَا رَسُولُ اللَّهِ (ﷺ) يُعْرَفُ فِي وَجْهِهِ الْغَضَبُ فَقَالَ إِنَّمَا هَلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ بِاخْتِلافِهِمْ فِي الْكِتَابِ
‘‘আমি একদিন দুপুরের আগে আগে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট গমন করি। তিনি কুরআনের একটি আয়াত নিয়ে মতভেদ ও বিতর্কে রত দুব্যক্তির কণ্ঠস্বর শুনতে পান। তখন তিনি আমাদের নিকট বেরিয়ে আসেন। তাঁর পবিত্র মুখমণ্ডলে ক্রোধ পরিলক্ষিত হচ্ছিল। তিনি বলেন, তোমাদের পূর্ববর্তী মানুষেরা কিতাবের বিষয়ে মতভেদ করার কারণেই ধ্বংস হয়েছে।’’[9]
আব্দুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল আস (রাঃ) বলেন:
إنَّ نَفَرًا كَانُوا جُلُوسًا بِبَابِ النَّبِيِّ (ﷺ) فَقَالَ بَعْضُهُمْ أَلَمْ يَقُلْ اللَّهُ كَذَا وَكَذَا وَقَالَ بَعْضُهُمْ أَلَمْ يَقُلْ اللَّهُ كَذَا وَكَذَا فَسَمِعَ ذَلِكَ رَسُولُ اللَّهِ (ﷺ) فَخَرَجَ كَأَنَّمَا فُقِئَ فِي وَجْهِهِ حَبُّ الرُّمَّانِ فَقَالَ بِهَذَا أُمِرْتُمْ أَنْ تَضْرِبُوا كِتَابَ اللَّهِ بَعْضَهُ بِبَعْضٍ إِنَّمَا ضَلَّتْ الأُمَمُ قَبْلَكُمْ فِي مِثْلِ هَذَا إِنَّكُمْ لَسْتُمْ مِمَّا هَاهُنَا فِي شَيْءٍ انْظُرُوا الَّذِي أُمِرْتُمْ بِهِ فَاعْمَلُوا بِهِ وَالَّذِي نُهِيتُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا
‘‘কিছু মানুষ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দরজায় বসে ছিলেন। তাদের কেউ বলেন, আল্লাহ কি একথা বলেন নি? আবার কেউ বলেন: আল্লাহ কি একথা বলেন নি? রাসূলুল্লাহ (ﷺ) একথা শুনতে পান। তিনি বেরিয়ে আসেন। তাঁর পবিত্র মুখমণ্ডল ক্রোধে লাল হয়ে যায়, যেন তাঁর মুখমণ্ডলে বেদানার রস ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, তোমাদের কি এরূপ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে আল্লাহর কিতাবের এক অংশকে অন্য অংশের বিপরীতে দাঁড় করাবে? তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মাতগুলি এরূপ করার কারণেই বিভ্রান্ত হয়েছে। তোমাদের কাজ এটি নয়। তোমাদেরকে কি করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তা দেখ এবং তা পালন কর। যা তোমাদের নিষেধ করা হয়েছে তা বর্জন কর।’’[10]
অন্য হাদীসে আবূ উমামা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
مَا ضَلَّ قَوْمٌ بَعْدَ هُدًى كَانُوا عَلَيْهِ إِلا أُوتُوا الْجَدَلَ
‘‘কোনো জাতি হেদায়াত প্রাপ্ত হওয়ার পরে বিভ্রান্ত হওয়ার একটিই কারণ তা হলো তারা বিতর্কের লিপ্ত হয়।’’[11]
[2] ইবনু ফারিস, মু’জামু মাকাঈসিল লুগাহ ৬/১৫; ড. ইবরাহীম আনীস, আল-মু’জামুল ওয়াসীত ২/১০০১।
[3] আবূ দাউদ ৪/১৯৮; আহমদ, আল-মুসনাদ ৪/১০২; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ১/২১৮। হাকিম ও যাহাবী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। ইবনু হাজার হাদীসটিকে হাসান বলেছেন। আলবানী, সিলসিলাতুস সাহীহাহ ১/৪০৪-৪১৪।
[4] খাত্তাবিয়্যাহ সম্প্রদায় বিশ্বাস করত যে, আলী (রাঃ) ও তাঁর বংশের ইমামগণ আল্লাহর সন্তান ও প্রিয়পাত্র, তাদের মধ্যে ‘উলূহিয়্যাত’ বা আল্লাহর সাথে বিশেষ সম্পর্কের কারণে ইলাহ হওয়ার বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান ছিল। আল্লাহর সাথে সুস্পষ্ট শির্ক করার কারণে এদেরকে মুসলিম উম্মাহর ইমামগণ একবাক্যে কাফির বলে ঘোষণা করেন। দেখুন: বাগদাদী, আব্দুল কাহির, আল-ফারকু বাইনাল ফিরাক, পৃ. ২৪৭।
[5] ইবনু আবেদীন, রাদ্দুল মুহতার ১/৫৬১।
[6] ইবনুল জাওযী, তালবীসু ইবলীস, পৃ ৮১-৮৭।
[7] মুসলিম, আস-সহীহ ৩/১৪৪৪-১৪৪৬; হাকিম নাইসাপূরী, আল-মুসতাদরাক ২/৪০৪, ৪৪০, ৪৪৫, ৪/৬১৭; ইবনু হাজার আসকালানী, ফাতহুল বারী ৮/৩১০, ৫৫৭, ৬৮৬।
[8] সূরা (৩) আল-ইমরান: ৭ আয়াত।
[9] মুসলিম, আস-সহীহ ৪/২০৫৩।
[10] আহমদ, আল-মুসনাদ ২/১৯৫।
[11] তিরমিযী, আস-সুনান ৫/৩৭৮। তিরমিযী বলেন: হাদীসটি হাসান সহীহ।