কুরআন কারীমে মহান আল্লাহ বারংবার এ উম্মাতকে বিচ্ছিন্নতা ও দলাদলি থেকে নিষেধ করেছেন। যারা ধর্মকে বিভক্ত করে তাদের নিন্দা করেছেন এবং তাদের সাথে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সম্পর্ক থাকবে না বলে উল্লেখ করেছেন। এ বিষয়ক একটি আয়াত এ অধ্যায়ের শুরুতে আমরা দেখেছি। যে আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন: ‘‘তোমরা আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধারণ কর সমবেতভাবে, এবং পরস্বপর বিচ্ছিন্ন হয়ো না বা দলাদলি করো না।’’ অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন:
وَلا تَكُونُوا كَالَّذِينَ تَفَرَّقُوا وَاخْتَلَفُوا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْبَيِّنَاتُ وَأُولَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ
‘‘তোমরা তাদের মত হয়ো না, যারা তাদের নিকট স্পষ্ট নিদর্শন আসার পরে বিচ্ছিন্ন হয়েছে এবং মতভেদ করেছে, এদের জন্য রয়েছে মহা শাস্তি।’’[1]
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন:
فَأَقِمْ وَجْهَكَ لِلدِّينِ حَنِيفًا فِطْرَةَ اللَّهِ الَّتِي فَطَرَ النَّاسَ عَلَيْهَا لا تَبْدِيلَ لِخَلْقِ اللَّهِ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لا يَعْلَمُونَ مُنِيبِينَ إِلَيْهِ وَاتَّقُوهُ وَأَقِيمُوا الصَّلاةَ وَلا تَكُونُوا مِنَ الْمُشْرِكِينَ مِنَ الَّذِينَ فَرَّقُوا دِينَهُمْ وَكَانُوا شِيَعًا كُلُّ حِزْبٍ بِمَا لَدَيْهِمْ فَرِحُونَ
‘‘তুমি একনিষ্ঠ হয়ে নিজকে দীনে প্রতিষ্ঠিত কর। আল্লাহর প্রকৃতির অনুসরণ কর, যে প্রকৃতি অনুযায়ী তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সৃষ্টির কোনো পরিবর্তন নেই। এই সরল দীন। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না। বিশুদ্ধচিত্তে তার অভিমুখী হয়ে তাকে ভয় কর, সালাত কায়েম কর এবং অন্তর্ভুক্ত হয়ো না মুশরিকদের, যারা নিজেদের দীনে মতভেদ সৃষ্টি করেছে এবং বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে। প্রত্যেক দলই নিজ নিজ মতবাদ নিয়ে উৎফুল্ল।’’[2]
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন:
إِنَّ الَّذِينَ فَرَّقُوا دِينَهُمْ وَكَانُوا شِيَعًا لَسْتَ مِنْهُمْ فِي شَيْءٍ إِنَّمَا أَمْرُهُمْ إِلَى اللَّهِ ثُمَّ يُنَبِّئُهُمْ بِمَا كَانُوا يَفْعَلُونَ
‘‘যারা দীন সম্বন্ধে নানা মতের সৃষ্টি করেছে এবং বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে তাদের কোনো দায়িত্ব তোমার নয়; তাদের বিষয় আল্লাহর ইখতিয়ারভুক্ত। আল্লাহ তাদেরকে তাদের কৃতকর্ম সম্বন্ধে অবহিত করবেন।’’[3]
মহান আল্লাহ আরো বলেন:
وَأَنَّ هَذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ وَلا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيلِهِ ذَلِكُمْ وَصَّاكُمْ بِهِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ
‘‘এবং এ পথই আমার সরল পথ, সুতরাং এরই অনুসরণ কর এবং অন্যান্য পথ অনুসরণ করো না, করলে সেগুলি তোমাদেরকে তাঁর পথ হতে বিচ্ছিন্ন করবে। এভাবে আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিলেন, যেন তোমরা সাবধান হও।’’[4]
বিভিন্ন হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) উল্লেখ করেছেন যে, যেভাবে পূর্ববর্তী উম্মাতগুলির মধ্যে বিভক্তি এসেছিল ঠিক সেভাবেই তাঁর উম্মাতের মধ্যেও বিভক্তি ও দলাদলি প্রবেশ করবে। ‘যাতু আনওয়াত’ বৃক্ষ বিষয়ক হাদীসটি আমরা ‘তাবার্রুক বিষয়ক শিরকের অনুচ্ছেদে উল্লেখ করেছি। আমরা দেখেছি যে, এ হাদীসে ‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: ‘‘যাঁর হাতে আমার জীবন তাঁর কসম, তোমরা তোমাদের পূর্ববর্তীদের সুন্নাত অনুসরণ করবে।’’
অন্য হাদীসে আবূ সাঈদ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
لَتَتَّبِعُنَّ سَنَنَ مَنْ قَبْلَكُمْ شِبْرًا بِشِبْرٍ وَذِرَاعًا بِذِرَاعٍ حَتَّى لَوْ سَلَكُوا جُحْرَ ضَبٍّ لَسَلَكْتُمُوهُ قُلْنَا يَا رَسُولَ اللَّهِ الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى قَالَ فَمَنْ؟
‘‘তোমরা অবশ্যই (বিভ্রান্তির ক্ষেত্রে) পূর্ববর্তী জাতিদের সুন্নাত (রীতি) পদে পদে অনুসরণ করবে: বিঘতে বিঘতে ও হাতে হাতে। এমনকি তারা যদি কোনো গুইসাপের গর্তে প্রবেশ করে তবে তোমরাও তথায় প্রবেশ করবে।’’ আমরা বললাম: পূর্ববর্তীগণ বলতে কি ইহূদী-খৃস্টানরা?’’ তিনি বলেন: ‘তবে আর কারা?’’[5]
অন্য হাদীসে আবূ হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
لا تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى تَأْخُذَ أُمَّتِي بِأَخْذِ الْقُرُونِ قَبْلَهَا شِبْرًا بِشِبْرٍ وَذِرَاعًا بِذِرَاعٍ فَقِيلَ يَا رَسُولَ اللَّهِ كَفَارِسَ وَالرُّومِ فَقَالَ وَمَنْ النَّاسُ إِلا أُولَئِكَ
‘‘কিয়ামত আগমনের আগেই আমার উম্মাত পূর্ববর্তী জাতিগুলি রীতি গ্রহণ করবে, বিঘতে বিঘতে এবং হাতে হাতে। তখন বলা হলো, ‘হে আল্লাহর রাসূল, পারস্যবাসী এবং রোমবাসীদের মত?’ তিনি বলেন: ‘তাদেরকে বাদ দিলে আর মানুষ কারা?’’[6]
অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যে ব্যাধির কারণে বিভক্তি ঘটে তা উল্লেখ করেছেন। যুবাইর ইবনুল আওয়াম (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
دَبَّ إِلَيْكُمْ دَاءُ الأُمَمِ قَبْلَكُمْ الْحَسَدُ وَالْبَغْضَاءُ هِيَ الْحَالِقَةُ لا أَقُولُ تَحْلِقُ الشَّعَرَ وَلَكِنْ تَحْلِقُ الدِّينَ وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لا تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ حَتَّى تُؤْمِنُوا وَلا تُؤْمِنُوا حَتَّى تَحَابُّوا ...
‘‘পূর্ববর্তী উম্মাতগণের ব্যাধি তোমাদের মধ্যে ধীরে ধীরে প্রবেশ করছে, সে ব্যাধি হলো হিংসা ও বিদ্বেষ। বিদ্বেষ মুন্ডনকারী। আমি বলি না যে, তা মাথার চুল মুন্ডন করে, বরং তা দীন মুন্ডন করে।’’[7]
প্রথম অধ্যায়ে সাহাবীগণের মতামতের গুরুত্ব আলোচনাকালে আমরা দেখেছি যে, একটি হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন: ‘‘তোমাদের মধ্যে যারা আমার পরে বেঁচে থাকবে তারা অনেক মতবিরোধ দেখতে পাবে। এক্ষেত্রে তোমাদের উপর দায়িত্ব হলো আমার সুন্নাত ও সুপথপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশিদীনের সুন্নাত অনুসরণ করা। তোমরা দৃঢ়ভাবে তা অাঁকড়ে ধরবে, কোন প্রকারেই তার বাইরে যাবে না। আর তোমরা (আমার ও খুলাফায়ে রাশিদীনের সুন্নাতের বাইরে) নতুন উদ্ভাবিত সকল বিষয় সর্বতোভাবে পরিহার করবে; কারণ সকল নতুন উদ্ভাবিত বিষয়ই বিদআত এবং সকল বিদআতই বিভ্রান্তি ও পথভ্রষ্টতা।’’
এ হাদীসে তিনি বিভক্তি থেকে আত্মরক্ষার পথ জানিয়েছেন, তা হলো, তাঁর ও খুলাফায়ে রাশিদীনের সুন্নাতের উপর অটল থাকা। অন্য হাদীসে তিনি বিভক্তি সৃষ্টিকারীদের প্রকৃতি ও বিভক্তির সময় উল্লেখ করেছেন। আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
مَا مِنْ نَبِيٍّ بَعَثَهُ اللَّهُ فِي أُمَّةٍ قَبْلِي إِلا كَانَ لَهُ مِنْ أُمَّتِهِ حَوَارِيُّونَ وَأَصْحَابٌ يَأْخُذُونَ بِسُنَّتِهِ وَيَقْتَدُونَ بِأَمْرِهِ ثُمَّ إِنَّهَا تَخْلُفُ مِنْ بَعْدِهِمْ خُلُوفٌ يَقُولُونَ مَا لا يَفْعَلُونَ وَيَفْعَلُونَ مَا لا يُؤْمَرُونَ فَمَنْ جَاهَدَهُمْ بِيَدِهِ فَهُوَ مُؤْمِنٌ وَمَنْ جَاهَدَهُمْ بِلِسَانِهِ فَهُوَ مُؤْمِنٌ وَمَنْ جَاهَدَهُمْ بِقَلْبِهِ فَهُوَ مُؤْمِنٌ وَلَيْسَ وَرَاءَ ذَلِكَ مِنْ الإِيمَانِ حَبَّةُ خَرْدَلٍ
‘‘আমার পূর্বে যে উম্মাতের মধ্যেই আল্লাহ কোনো নবী প্রেরণ করেছেন সে নবীরই উম্মাতের মধ্যে তাঁর ঘনিষ্ঠ শিষ্য ও সাহাবী ছিলেন, তাঁরা তাঁর সুন্নাত অাঁকড়ে ধরতেন এবং তাঁর নির্দেশ অনুসরণ করতেন। অতঃপর তাদের পরে এমন একদল উত্তরসূরির আবির্ভাব ঘটে যারা যা বলে তা করে না এবং যা তাদের করতে নির্দেশ দেওয়া হয় নি তা তারা করে। কাজেই যে ব্যক্তি এদের সাথে হাত দিয়ে জিহাদ করবে সে মুমিন, যে ব্যক্তি তাদের সাথে মুখ দিয়ে জিহাদ করবে সেও মুমিন এবং যে ব্যক্তি এদের সাথে অন্তর দিয়ে জিহাদ করবে সেও মুমিন। এর পরে আর শরিষা পরিমাণ ঈমানও অবশিষ্ট থাকে না।’’[8]
এখানে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জানিয়েছেন যে, সাহাবীগণের পরের যুগে বিভক্তি আসবে। এছাড়া তিনি সাহাবীগণের দুটি বৈশিষ্ট্য ও বিভক্তি সৃষ্টিকারীদের দুটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন। অন্য অনেক হাদীসে এ ধরনের কিছু বৈশিষ্ট্য তিনি উল্লেখ করেছেন।
আলী এবং ইবনু মাসঊদ () থেকে বিভিন্ন সহীহ সনদে বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,
يَأْتِي فِي آخِرِ الزَّمَانِ قَوْمٌ حُدَثَاءُ (أَحْدَاثُ) الأَسْنَانِ سُفَهَاءُ الأَحْلامِ يَقُولُونَ مِنْ خَيْرِ قَوْلِ الْبَرِيَّةِ (يَتَكَلَّمُوْنَ بِالْحَقِّ) (يَقْرَءُونَ الْقُرْآنَ لا يُجَاوِزُ حَنَاجِرَهُمْ) يَمْرُقُونَ مِنْ الإِسْلامِ (مِنَ الْحَقِّ) كَمَا يَمْرُقُ السَّهْمُ مِنْ الرَّمِيَّةِ لا يُجَاوِزُ إِيمَانُهُمْ حَنَاجِرَهُمْ فَأَيْنَمَا لَقِيتُمُوهُمْ فَاقْتُلُوهُمْ فَإِنَّ قَتْلَهُمْ أَجْرٌ لِمَنْ قَتَلَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
‘‘শেষ যুগে এমন একটি সম্প্রদায় আগমন করবে যারা বয়সে তরুণ এবং তাদের বুদ্ধিজ্ঞান অপরিপক্কতা, বোকামি ও প্রগভতায় পূর্ণ। মানুষ যত কথা বলে তন্মধ্যে সর্বোত্তম কথা তারা বলবে। তারা সত্য-ন্যায়ের কথা বলবে। তারা কুরআন পাঠ করবে কিন্তু তা তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে না। কিন্তু তারা সত্য, ন্যায় ও ইসলাম থেকে তেমনি ছিটকে বেরিয়ে যাবে, যেমন করে তীর শিকারের দেহ ভেদ করে ছিটকে বেরিয়ে যায়। তাদের ঈমান তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে না। তোমরা যখন যেখানেই তাদেরকে পাবে তখন তাদেরকে হত্যা করবে; কারণ তাদেরকে যারা হত্যা করবে তাদের জন্য কিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট পুরস্কার থাকবে।[9]
এই অর্থে ১৭ জন সাহাবী থেকে প্রায় ৫০টি পৃথক সূত্রের হাদীস বর্ণিত হয়েছে। এ সকল হাদীস প্রমাণ করে যে, বাহ্যিক আকর্ষণীয় ধার্মিকতা, সততা ও ঐকান্তিকতা সত্ত্বেও অনেক মানুষ উগ্রতার কারণে ইসলাম থেকে বিচ্যুত হবে। এ সকল হাদীস যদিও সর্বজনীন এবং সকল যুগেই এরূপ মানুষের আবির্ভাব হতে পারে, তবে সাহাবীগণের যুগ থেকে মুসলিম উম্মাহর আলিমগণ একমত যে, এ ভবিষ্যদ্বানীর প্রথম বাস্তবায়ন হয়েছিল খারিজীদের আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে।[10]
উপরের সহীহ হাদীসগুলি সামগ্রিকভাবে মুতাওয়াতির পর্যায়ের। এসকল হাদীস থেকে আমরা উম্মাতের মধ্যে বিভক্তি ও বিভক্তির কারণ সম্পর্কে জানতে পারি। অনুরূপভাবে বিভক্তি ও মতভেদের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও মুক্তির পথও আমরা জানতে পারি। অন্য কিছু হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) উম্মাতের মধ্যে বিভক্ত দলের সংখ্যা এবং মুক্তিপ্রাপ্ত দলের পরিচয় জানিয়েছেন। আবূ হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
تَفَرَّقَتْ الْيَهُودُ عَلَى إِحْدَى وَسَبْعِينَ أَوْ اثْنَتَيْنِ وَسَبْعِينَ فِرْقَةً وَالنَّصَارَى مِثْلَ ذَلِكَ وَتَفْتَرِقُ أُمَّتِي عَلَى ثَلاثٍ وَسَبْعِينَ فِرْقَةً
‘‘ইহূদীরা ৭১ বা ৭২ দলে বিভক্ত হয়ে যায় এবং খৃস্টানগণও অনুরূপ দলে বিভক্ত হয়ে যায়। আর আমার উম্মাত ৭৩ দলে বিভক্ত হবে।’’[11]
অন্য হাদীসে মু‘আবিয়া (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
أَلا إِنَّ مَنْ قَبْلَكُمْ مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ (الكتابين) افْتَرَقُوا عَلَى ثِنْتَيْنِ وَسَبْعِينَ مِلَّةً وَإِنَّ هَذِهِ الْمِلَّةَ سَتَفْتَرِقُ عَلَى ثَلاثٍ وَسَبْعِينَ ثِنْتَانِ وَسَبْعُونَ فِي النَّارِ وَوَاحِدَةٌ فِي الْجَنَّةِ وَهِيَ الْجَمَاعَةُ
‘‘তোমরা জেনে রাখ! তোমাদের পূর্ববর্তী কিতাবীগণ (ইহূদী ও খৃস্টানগণ) ৭২ দলে বিভক্ত হয়েছিল। আর এ উম্মাত ৭৩ দলে বিভক্ত হয়ে যাবে। এদের মধ্যে ৭২ দল জাহান্নামে এবং একটি দলই জান্নাতে। এ দলটি হলো জামা‘আত।’’[12]
অন্য হাদীসে আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ বলেন:
إِنَّ بَنِي إِسْرَائِيلَ تَفَرَّقَتْ عَلَى ثِنْتَيْنِ وَسَبْعِينَ مِلَّةً وَتَفْتَرِقُ أُمَّتِي عَلَى ثَلاثٍ وَسَبْعِينَ مِلَّةً كُلُّهُمْ فِي النَّارِ إِلا مِلَّةً وَاحِدَةً قَالُوا وَمَنْ هِيَ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ مَا أَنَا عَلَيْهِ (الْيَوْمَ) وَأَصْحَابِي
‘‘ইসরায়েল সন্তানগণ ৭২ দলে বিভক্ত হয়েছিল। আর আমার উম্মাত ৭৩ দলে বিভক্ত হবে। এদের মধ্যে সকলেই জাহান্নামী, একটিমাত্র দল বাদে। সাহাবীগণ প্রশ্ন করেন: হে আল্লাহর রাসূল, এ মুক্তিপ্রাপ্ত দলটি কারা? তিনি বলেন: ‘আমি এবং আমার সাহাবীগণ এখন যার উপর আছি।’’[13]
এভাবে আমরা দেখছি যে, মানবীয় দুর্বলতার সাথে শয়তানের প্ররোচনা একত্রিত হয়ে যুগে যুগে মানুষ আল্লাহর দীন ও হেদায়াত লাভ করার পরেও বিভ্রান্ত ও বিচ্ছিন্ন হয়েছে। প্রাকৃতিক ও জাগতিকভাবে মুসলিম উম্মাহর মধ্যেও এরূপ বিভক্তি আসবে বলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জানিয়েছেন। তবে এখানে লক্ষণীয় যে, বিভক্তদের দল-উপদল অনেক হলেও অনুসারী কম। কারণ আমরা দেখব যে, বিভক্তির মূল কারণ আকীদার উৎস হিসেবে ওহীর মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে ওহীর সাথে মানবীয় যুক্তি বিচার দিয়ে কিছু কথা সংযোজন করা। আর এ পথ খুললেই বিভক্তির পথ খুলে যায়। এজন্য ফিরকাগুলির মধ্যে আভ্যন্তরীন বিভক্তি খুবই বেশি। এতে ফিরকার সংখ্যা বাড়লেও অনুসারীদের সংখ্যা বাড়ে না।
দ্বিতীয় যে বিষয়টি লক্ষণীয় তা হলো, উপরের কোনো কোনো হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বিভক্ত ৭৩ দলের ৭২ দলই জাহান্নামী। এর অর্থ এই নয় যে, এরা সকলেই কাফির বা চিরস্থায়ী জাহানণামবাসী। বরং এরা বিশ্বাসগত পাপের কারণে বা বিশ্বাসের ক্ষেত্রে বিদ‘আতে লিপ্ত হওয়ার কারণে জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করবে। পরবর্তী আলোচনায় আমরা দেখব যে, সাহাবীগণ এবং তাঁদের অনুসারী আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআত আকীদাগত বিভ্রান্ত ফিরকাগুলিকে কাফির বলে গণ্য করেন নি। তাদেরকে বিভ্রান্ত বা বিভ্রান্তিতে নিপতিত মুসলিম বলে গণ্য করেছেন। তবে বিভ্রান্ত দল ও সম্প্রদায়গুলি তাদের নিজেদের ছাড়া সকলকেই কফির বলে গণ্য করত ও করে।
[2] সূরা (৩০) রূম: ৩০-৩২ আয়াত।
[3] সূরা (৬) আন‘আম: ১৫৯ আয়াত।
[4] সূরা (৬) আন‘আম: ১৫৩ আয়াত।
[5] বুখারী, আস-সহীহ ৩/১২৭৪, ৬/২৬৬৯; মুসলিম, আস-সহীহ ৪/২০৫৪।
[6] বুখারী, আস-সহীহ ৬/২৬৬৯।
[7] তিরমিযী, আস-সুনান ৪/৬৬৪।
[8] মুসলিম, আস-সহীহ ১/৬৯।
[9] বুখারী, আস-সহীহ ৩/১৩২১, ৪/১৯২৭; মুসলিম, আস-সহীহ ২/৭৪৬; তিরমিযী, আস-সুনান ৪/৪৮১; নাসাঈ, আস-সুনানুল কুবরা ৫/১৬১।
[10] ইবনু কাসীর, আল-বিদায়া ৫/৩৯৩-৪১১।
[11] তিরমিযী, আস-সুনান ৫/২৫। তিনি বলেন: হাদীসটি হাসান সহীহ।
[12] আবূ দাউদ ৪/১৯৮; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ১/২১৮। হাকিম ও যাহাবী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। ইবনু হাজার হাদীসটিকে হাসান বলেছেন। আলবানী, সিলসিলাতুস সাহীহাহ ১/৪০৪-৪১৪।
[13] তিরমিযী, আস-সুনান ৫/২৬; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ১/২১৮। তিরমিযী হাদীসটিকে হাসান গরীব বলেছেন। অন্যান্য মুহাদ্দিস হাদীসটিকে হাসান বলেছেন।