পূর্ববর্তী আলোচনা থেকে আমরা ইসলামী বিশ্বাস বা ঈমানের পরিচিতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পেরেছি। ঈমান বা বিশ্বাসের বিপরীত ‘অবিশ্বাস’। ‘অবিশ্বাস’ সামগ্রিক বা ব্যাপক হতে পারে এবং আংশিকও হতে পারে। আমরা দেখেছি যে, ঈমান বা বিশ্বাসের বিভিন্ন রুকন ও বিষয় রয়েছে। কোনো অবিশ্বাসী এ সকল রুকন বা বিশ্বাসের সকল বিষয় ‘অবিশ্বাস’ করতে পারে। আবার অবিশ্বাস বা বিশ্বাসের বিভ্রান্তি আংশিকও হতে পারে। এমন অনেক দেখা যায় যে, কোনো কোনো অবিশ্বাসী ঈমানের কিছু বিষয় বিশ্বাস করেন এবং কিছু বিষয় অবিশ্বাস করেন। সামগ্রিক বা আংশিক উভয় প্রকার অবিশ্বাসেরই বিভিন্ন কারণ ও প্রকার রয়েছে।
কুরআনে বিভিন্ন স্থানে মহান আল্লাহ পূর্ববর্তী বিভ্রান্ত সম্প্রদায়সমূহের বিভ্রান্তি ও অবিশ্বাসের কারণ উল্লেখ করেছেন। কুরআন ও হাদীসের বর্ণনা থেকে আমরা জানতে পারি যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাওহীদ, রিসালাত ও আরকানুল ঈমানের বিশুদ্ধ বিশ্বাস থেকেই অবিশ্বাস বা কুফর ও শিরক জন্ম নিয়েছে। ঈমান থেকেই কুফরী জন্মেছে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঈমানের নামেই কুফরী প্রচারিত হয়েছে। ইহূদী, খৃস্টান ও আরবের অবিশ্বাসীগণ মূলত আসমানী কিতাব বা ওহী এবং আল্লাহর মনোনীত নবী-রাসূলদের অনুসারী ছিলেন। কিন্তু বিভিন্ন কারণে তারা সত্য পথ থেকে বিচ্যুত হন। কুরআন কারীমে এদের বিভ্রান্তির কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন জাতির অবিশ্বাসের কারণ কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। হাদীস শরীফে এ বিষয়ক অনেক ব্যাখ্যা রয়েছে। এ অধ্যায়ে আমরা অবিশ্বাসের ধরন, কারণ, প্রকরণ ও প্রকাশগুলি আলোচনা করব। মহান আল্লাহর নিকট তাওফীক প্রার্থনা করছি।
৫. ১. কুফর
৫. ১. ১. অর্থ ও পরিচিতি
আরবী ‘কুফর’ (الكُفْرُ) শব্দটি অবিশ্বাস, অস্বীকার, অকৃতজ্ঞতা ইত্যাদি অর্থে ব্যবহৃত হয়। শব্দটির মূল অর্থ ‘আবৃত করা’। ৪র্থ হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ ভাষাবিদ ও অভিধান প্রণেতা আবুল হুসাইন আহমদ ইবনু ফারিস (৩৯৫হি) বলেন: ‘‘(কাফ, রা ও ফা) তিন অক্ষরের ক্রিয়ামূলটি একটি বিশুদ্ধ অর্থ প্রকাশ করে, তা হলো: ‘আবৃত করা বা গোপন করা’। কোনো ব্যক্তি যদি তার পরিহিত বর্মকে তার কাপড় দিয়ে আবৃত করেন তবে বলা হয় তিনি তার বর্ম ‘কুফর’ করেছেন। চাষীকে ‘কাফির’ (আবৃতকারী) বলা হয়, কারণ তিনি শষ্যদানাকে মাটি দ্বারা আবৃত করেন। ঈমান বা বিশ্বাসের বিপরীত অবিশ্বাসকে ‘কুফর’ বলা হয়; কারণ অবিশ্বাস অর্থ সত্যকে অবৃত করা। অকৃতজ্ঞতা বা নিয়ামত অস্বীকার করাকে কুফর বলা হয়; কারণ এতে নিয়ামত লুকানো হয় এবং আবৃত করা হয়।’’[1]
ইসলামী পরিভাষায় বিশ্বাসের অবিদ্যমানতাই কুফর বা অবিশ্বাস। আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের উপর এবং ঈমানের রুকনগুলিতে বিশ্বাস না থাকাকেই ইসলামের পরিভাষায় ‘কুফর’ বলে গণ্য। অস্বীকার, সন্দেহ, দ্বিধা, হিংসা, অহঙ্কার, ইত্যাদি যে কোনো কারণে যদি কারো মধ্যে ‘ঈমান’ বা দৃঢ় প্রত্যয়ের বিশ্বাস অনুপস্থিত থাকে তবে তাকে ইসলামী পরিভাষায় ‘কুফর’ বলে গণ্য করা হয়। অনুরূপভাবে মহান আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে কোনো বিষয়ে তাঁর সমতুল্য বা সমকক্ষ বা তাঁর সাথে তুলনীয় বলে বিশ্বাস করার মাধ্যমে আল্লাহর একত্ব ও অতুলনীয়ত্ব অস্বীকার করাও কুফর। তবে এ পর্যায়ের কুফরকে ইসলামী পরিভাষায় শির্ক বলা হয়।
৫. ১. ২. কুফর আকবার ও কুফর আসগার
কুরআন ও হাদীসের আলোকে কুফরকে দু ভাগে ভাগ করা হয়: (১) কুফর আকবার বা বৃহত্তর কুফর এবং (২) কুফর আসগার বা ক্ষুদ্রতর কুফর। কুফর আকবার বলতে প্রকৃত অবিশ্বাস বঝানো হয় যা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ইসলাম থেকে বের করে দেয় এবং প্রকৃত অবিশ্বাসী বা কাফিরে পরিণত করে। এর পরিণতি চিরস্থায়ী জাহান্নামের শাস্তিভোগ। আর কুফর আসগার বলতে বুঝানো হয় কঠিন পাপসমূহকে যা অবিশ্বাসেরই নামান্তর, তবে এরূপ পাপে লিপ্ত মানুষদেরকে ইসলাম ত্যাগকারী বা প্রকৃত কাফির বলে গণ্য করা হয় না। তাদেরকে অনন্ত জাহান্নামবাসী বলেও বিশ্বাস করা হয় না। বরং তাদেরকে পাপী ও শাস্তিযোগ্য মুসলিম বলে গণ্য করা হয়। কুফর আসগারকে কুফর মাজাযী বা রূপক কুফরও বলা হয়।
৫. ১. ৩. কুফর আকবার -এর প্রকারভেদ
কুফর আকবার বা ‘বৃহত্তর কুফর’-ই প্রকৃত কুফর বা অবিশ্বাস। তাওহীদ ও আরকানুল ঈমানের আলোকে আমরা কুফর বা অবিশ্বাসকে আমরা নিম্নের পাঁচটি পর্যায়ে ভাগ করতে পারি:
৫. ১. ৩. ১. ‘প্রতিপালনের একত্বে’ অবিশ্বাস
আমরা দেখেছি যে, তাওহীদের প্রথম পর্যায় তাওহীদুর রুবূবিয়্যাত। এ বিষয়ে কোনো প্রকার অবিশ্বাস, অস্বীকার, দ্বিধা, সন্দেহ বা আংশিক বিশ্বাস ‘কুফর’ বলে গণ্য। আল্লাহর অস্তিত্বে অবিশ্বাস, তাঁর স্রষ্টাত্বে অবিশ্বাস, অন্য কোনো স্রষ্টা আছে বলে বিশ্বাস, তার প্রতিপানের ক্ষমতায় অবিশ্বাস, অন্য কারো বিশ্ব পরিচালনা, প্রতিপালন বা মঙ্গল-অমঙ্গলের ক্ষমতা আছে বলে বিশ্বাস, তার রিয্ক দানের ক্ষমতায় অবিশ্বাস, অন্য কোনো রিযিকদাতা আছে বলে বিশ্বাস, ইত্যাদি সবই এ পর্যায়ের কুফর। অনুরূপভাবে কিছু বিষয়ে আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস ও কিছু বিষয়ে তা অবিশ্বাস করাও একইরূপ কুফর।
৫. ১. ৩. ২. নাম ও গুণাবলির একত্বে অবিশ্বাস
‘তাওহীদুল আসমা ওয়াস সিফাত’ বা আল্লাহর নাম ও গুণাবলির একত্ব আমরা তাওহীদ অধ্যায়ে আলোচনা করেছি। আল্লাহ তা‘আলার নাম ও গুণাবলির কিছু বা সব অস্বীকার করা এ পর্যায়ের কুফর। এ কুফর দু প্রকারের:
প্রথমত: কুফরুন নাফই (كفر النفي) বা অস্বীকারের কুফর
এর অর্থ আল্লাহ যে সকল নাম ও গুণ তাঁর আছে বলে জানিয়েছেন তার সব বা যে কোনো একটি অবিশ্বাস বা অস্কীকার করা। যেমন আল্লাহর ইলম (জ্ঞান), কুদরত (ক্ষমতা), কালাম (কথা), রাহমাত... ইত্যাদি যে কোনো এক বা একাধিক নাম বা গুণ অস্বীকার করা, বা তার পূর্ণতা অস্বীকার করা। আল্লাহর কোনো কর্ম বা গুণ তার সৃষ্টির মত বা তুলনীয় বলে বিশ্বাস করাও একই পর্যায়ের কুফর বা অবিশ্বাস।
দ্বিতীয়ত: কুফরুল ইসবাত (كفر الإثبات) বা দাবির কুফর
এর অর্থ আল্লাহ নিজের জন্য যা অস্বীকার করেছেন তাঁর তা আছে বলে দাবি করা। যেমন আল্লাহর জন্য ঘুম, তন্দ্রা, সন্তান, স্ত্রী ... ইত্যাদি দাবি করা।
আল্লাহ তাঁর নিজের জন্য যে সকল বিশেষণ, গুণ ও বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন, কেউ যদি নিজের জন্য বা অন্য কোনো সৃষ্টির জন্য সে সকল বৈশিষ্ট্যের মধ্য থেকে এক বা একাধিক গুণ বা বিশেষণ দাবি করে তবে তাও এ প্রকারের কুফরী বলে গণ্য হবে। যেমন আল্লাহর মত ইলম, হিকমত, রহমত... ইত্যাদি অন্য কারো আছে বলে দাবি করা। এরূপ দাবি স্বীকার বা বিশ্বাস করাও একইরূপ কুফর।
আমরা দেখেছি যে, তাওহীদের চূড়ান্ত পর্যায় তাওহীদুল উলূহিয়্যাত বা তাওহীদুল ইবাদাত। সকল নবী-রাসূল ইবাদতের তাওহীদের দাওয়াত দিয়েছেন। তাঁরা সকলেই বলেছেন, একমাত্র আল্লাহর ইবাদত কর এবং আল্লাহ ছাড়া যাদের ইবাদত করা হয় তাদের ইবাদত বর্জন কর।
আল্লাহর ইবাদতের একত্বে অস্বীকার করা, তাঁর মা‘বূদ হওয়ার বিষয়ে সন্দেহ বা অবিশ্বাস পোষণ করা বা অন্য কেউ কোনোরূপ ইবাদত পাওয়ার যোগ্য আছে বলে বিশ্বাস করা এ পর্যায়ের কুফর। আমরা দেখেছি যে, যুগে যুগে অধিকাংশ কাফিরই এ প্রকারের কুফরে নিপতিত হয়েছে।
মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর রিসালাতে বিশ্বাসের অর্থ ও বিষয়বস্ত্ত আমরা পূর্ববর্তী অধ্যায়ে আলোচনা করেছি। মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর ব্যক্তিত্ব, মর্যাদা, মহত্ব, রিসালাত, নুবুওয়াত, নুবুওয়াতের পূর্ণতা, প্রচার ও তাবলীগের পূর্ণতা, নুবুওয়াতের বিশ্বজনীনতা, স্থায়িত্ব, সমাপ্তি, মুক্তির একমাত্র পথ ইত্যাদি কোনো বিষয়ে অস্বীকার, অবিশ্বাস বা সন্দেহ এ পর্যায়ের কুফর। মুহাম্মাদ (ﷺ) যা কিছু বলেছেন তার কোনো বিষয়কে মিথ্যা বা সন্দেহযুক্ত বলে মনে করাও একই পর্যায়ের কুফর।
এ পর্যায়ের কুফর-এর দুটি দিক রয়েছে:
প্রথমত, মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর ব্যক্তিত্বে সন্দেহ, দ্বিধা বা অভিযোগ
কেউ যদি মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর সত্যবাদিতায়, নিষ্কলুষ চরিত্রে, নিষ্পাপ ব্যক্তিত্বে, ইসলাম প্রচারে তাঁর পূর্ণতায়, তাঁর ধার্মিকতায়, তাঁর পূর্ণ জ্ঞান ও বুদ্ধিতে বা অনুরূপ কোনো বিষয়ে সন্দেহ, আপত্তি বা অভিযোগ করে তবে তা এ পর্যায়ের কুফরী।
দ্বিতীয়ত, মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর কথা বা শিক্ষায় অবিশ্বাস বা সন্দেহ
মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর নুবুওয়াতের বিশ্বাসের অর্থই হলো তিনি যা বলেছেন বা শিক্ষা দিয়েছেন তা সবই সন্দেহাতীতভাবে সত্য বলে বিশ্বাস করা। তিনি বলেছেন বলে প্রমাণিত কোনো সংবাদ, শিক্ষা, কথা বা বক্তব্যকে অসত্য বলে মনে করা বা সন্দেহ করা এ পর্যায়ের কুফ্রী। মুহাম্মাদ (ﷺ) বলেছেন কিনা তা প্রমাণিত হওয়ার বিষয়ে সন্দেহ হতে পারে। প্রমাণিত হওয়ার পরে কোনো মুমিন তার সত্যতায় সন্দেহ বা দ্বিধা করতে পারেন না।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কুরআন হিসেবে যা কিছু শিক্ষা দিয়েছেন বা কুরআন কারীমে যা কিছু বলা হয়েছে তা সবই মুতাওয়াতির পর্যায়ে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। অনুরূপভাবে মুতাওয়াতির হাদীসে যা কিছু বর্ণিত হয়েছে তা সন্দেহাতীতভাবে তাঁর বক্তব্য বা শিক্ষা হিসেবে প্রমাণিত। আরকানুল ঈমান ও তৎসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলি সবই এই পর্যায়ের। খাবারু ওয়াহিদ হিসেবে বর্ণিত বিষয়গুলি বিশুদ্ধ সনদে প্রমাণিত হলে তাও সাধারণভাবে বিশ্বাসের বিষয়বস্ত্ততে পরিণত হয়। তবে সাধারণভাবে খাবারু ওয়াহিদ পর্যায়ের সহীহ হাদীসে প্রমাণিত বিষয় অস্বীকার করলে তাকে বিভ্রান্ত বলা হয়, তবে কাফির বলা হয় না। এ বিষয়ে আমরা এ পুস্তকের প্রথম অধ্যায়ে আলোচনা করেছি।
কুরআন অথবা সুন্নাত দ্বারা, বিশেষত মুতাওয়াতিরভাবে প্রমাণিত কোনো বিধান অস্বীকার করাও একই পর্যায়ের কুফ্রী। সালাত, যাকাত, সিয়াম ইত্যাদির ফরয হওয়া অস্বীকার করা, ব্যভিচার, চুরি, হত্যা ইত্যাদির হারাম হওয়া অস্বীকার করা, সালাতের, তাহারাত, রাক‘আত, সময়, সাজদা, রুকু ইত্যাদির পদ্ধতি অস্বীকার, ব্যতিক্রম করা ইত্যাদি সবই এ পর্যায়ের কুফর। তবে অজ্ঞতার কারণে অস্বীকার করলে তা ওযর বলে গণ্য হতে পারে। কোনো ইজতিহাদী বা ইখতিলাফী বিষয় অস্বীকার করলে তা কুফর বলে গণ্য হবে না।
কোনো প্রকার কুফ্রে সন্তুষ্ট থাকা কুফর। অনুরূপভাবে ইসলামের প্রতি অসন্তুষ্ট থাকাও কুফর। এ প্রকারের কুফরের মধ্যে রয়েছে:
(ক) আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অপছন্দ করা বা আল্লাহর যিক্র, কুরআন, ইসলাম বা ইসলামের বিধান বলে সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণিত কোনো কিছু প্রতি বিরক্তি বা ঘৃণা পোষণ করা, ইসলামের কোনো নির্দেশ বা শিক্ষা অচল, সেকেলে বা অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করা। মহান আল্লাহ বলেন:
وَالَّذِينَ كَفَرُوا فَتَعْسًا لَهُمْ وَأَضَلَّ أَعْمَالَهُمْ ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ كَرِهُوا مَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأَحْبَطَ أَعْمَالَهُمْ
‘‘যারা কুফরী করেছে তাদের জন্য রয়েছে দুর্ভোগ এবং তিনি তাদের কর্ম ব্যর্থ করে দিবেন। তা এজন্য যে, আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তারা তা অপছন্দ করে। সুতরাং আল্লাহ তাদের কর্ম নিষ্ফল করে দিবেন।’’[1]
(খ) ইসলামের কোনো প্রমাণিত বিষয় নিয়ে হাসি-তামাশা, মস্করা বা উপহাস করা অথবা যার এরূপ করে তাদের সাথে অবস্থান করা বা তাদের সাথে আন্তরিক সম্পর্ক রাখা। মহান আল্লাহ বলেন:
وَإِذَا رَأَيْتَ الَّذِينَ يَخُوضُونَ فِي آَيَاتِنَا فَأَعْرِضْ عَنْهُمْ حَتَّى يَخُوضُوا فِي حَدِيثٍ غَيْرِهِ وَإِمَّا يُنْسِيَنَّكَ الشَّيْطَانُ فَلا تَقْعُدْ بَعْدَ الذِّكْرَى مَعَ الْقَوْمِ الظَّالِمِينَ
‘‘তুমি যখন দেখ, তারা আমার আয়াত সম্বন্ধে উপহাসমূলক আলোচনায় মগ্ন হয় তখন তুমি দূরে সরে পড়বে, যে পর্যন্ত না তারা অন্য প্রসংগে প্রবৃত্ত হয়। এবং শয়তান যদি তোমাকে ভ্রমে ফেলে তবে স্মরণ হওয়ার পরে জালিম সম্প্রদায়ের সাথে বসবে না।’’[2]
(খ) মুশরিক, নাস্তিক, মুরতাদ বা ধর্মত্যাগীদের, যারা সুস্পষ্টভাবে ঈমানের কোনো রূকন বা কুরআন-হাদীসের কোনো সুস্পষ্ট বিষয় অস্বীকার করেছে, আপত্তিকর বলে বিশ্বাস করেছে বা উপহাস করেছে, যাদের কুফর সন্দেহাতীতভাবে কুরআন ও হাদীসের আলোকে প্রমাণিত এবং যাদের কুফর-এর বিষয়ে মুসলিম উম্মাহর সকল আলিম একমত পোষণ করেছেন তাদেরকে কাফির বলতে অস্বীকার করা, কাফির বলে গণ্য না করা, তাদেরকে কাফির বলতে সন্দেহ বা দ্বিধা করা। অথবা এরূপ কাফিরগণকে আন্তরিক বন্ধু, সহযোগী ও অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করা। তবে তাদের সাথে সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক রাখা ও মানবীয় সহযোগিতা নিষিদ্ধ নয়।
কুরআনে এ বিষয়ে বারংবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন:
لا يَتَّخِذِ الْمُؤْمِنُونَ الْكَافِرِينَ أَوْلِيَاءَ مِنْ دُونِ الْمُؤْمِنِينَ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ فَلَيْسَ مِنَ اللَّهِ فِي شَيْءٍ إِلا أَنْ تَتَّقُوا مِنْهُمْ تُقَاةً
‘‘মুমিনগণ যেন মুমিনগণ ব্যতীত কাফিরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করে। যে কেউ এরূপ করবে তার সাথে আল্লাহর কোনো সম্পর্ক থাকবে না। তবে ব্যতিক্রম, যদি তোমরা তাদের নিকট হতে আত্মরক্ষার জন্য সতর্কতা অবলম্বন কর।’’[3]
অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لا تَتَّخِذُوا الْكَافِرِينَ أَوْلِيَاءَ مِنْ دُونِ الْمُؤْمِنِينَ أَتُرِيدُونَ أَنْ تَجْعَلُوا لِلَّهِ عَلَيْكُمْ سُلْطَانًا مُبِينًا
‘‘হে মুমিনগণ, মুমিনগণের পরিবর্তে কাফিরগণকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তোমরা কি আল্লাহকে তোমাদের বিরুদ্ধে স্পষ্ট প্রমাণ দিতে চাও?’’[4]
অন্যত্র তিনি বলেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لا تَتَّخِذُوا الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى أَوْلِيَاءَ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ وَمَنْ يَتَوَلَّهُمْ مِنْكُمْ فَإِنَّهُ مِنْهُمْ إِنَّ اللَّهَ لا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ
‘‘হে মুমিনগণ, ইয়াহূদী ও খৃস্টানদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না, তারা পরস্পর পরস্পরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে কেউ তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করলে সে তাদেরই একজন হয়ে যাবে। আল্লাহ জালিম সম্প্রদায়কে সৎপথে পরিচালিত করেন না।’’[5]
তিনি আরো বলেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لا تَتَّخِذُوا الَّذِينَ اتَّخَذُوا دِينَكُمْ هُزُوًا وَلَعِبًا مِنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ مِنْ قَبْلِكُمْ وَالْكُفَّارَ أَوْلِيَاءَ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ
‘‘হে মুমিনগণ, তোমাদের পূর্বে যাদেরকে কিতাব দেওয়া হয়েছে যারা তোমাদের দীনকে হাসি-তামাশা ও ক্রীড়ার বস্ত্তরূপে গ্রহণ করে তাদেরকে এবং কাফিরদেরকে তোমারা বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না এবং তোমরা যদি মুমিন হও তবে আল্লাহকে ভয় কর।’’[6]
তিনি আরো বলেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لا تَتَّخِذُوا آَبَاءَكُمْ وَإِخْوَانَكُمْ أَوْلِيَاءَ إِنِ اسْتَحَبُّوا الْكُفْرَ عَلَى الإِيمَانِ وَمَنْ يَتَوَلَّهُمْ مِنْكُمْ فَأُولَئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ
‘‘হে মুমিনগণ, তোমাদের পিতাগণ ও ভ্রাতাগণ যদি ঈমান অপেক্ষা কুফ্রীকে শ্রেয় জ্ঞান করে, তবে তাদেরকে অন্তরঙ্গরূপে গ্রহণ করো না। তোমাদের মধ্যে যারা তাদেরকে অন্তরঙ্গরূপে গ্রহণ করে তারাই জালিম।’’[7]
অন্যত্র ইরশাদ করা হয়েছে:
بَشِّرِ الْمُنَافِقِينَ بِأَنَّ لَهُمْ عَذَابًا أَلِيمًا الَّذِينَ يَتَّخِذُونَ الْكَافِرِينَ أَوْلِيَاءَ مِنْ دُونِ الْمُؤْمِنِينَ أَيَبْتَغُونَ عِنْدَهُمُ الْعِزَّةَ فَإِنَّ الْعِزَّةَ لِلَّهِ جَمِيعًا وَقَدْ نَزَّلَ عَلَيْكُمْ فِي الْكِتَابِ أَنْ إِذَا سَمِعْتُمْ آَيَاتِ اللَّهِ يُكْفَرُ بِهَا وَيُسْتَهْزَأُ بِهَا فَلا تَقْعُدُوا مَعَهُمْ حَتَّى يَخُوضُوا فِي حَدِيثٍ غَيْرِهِ إِنَّكُمْ إِذًا مِثْلُهُمْ إِنَّ اللَّهَ جَامِعُ الْمُنَافِقِينَ وَالْكَافِرِينَ فِي جَهَنَّمَ جَمِيعًا
‘‘মুনাফিকগণকে শুভ সংবাদ দাও যে, তাদের জন্য মর্মন্তুদ শাস্তি রয়েছে! মুমিনগণের পরিবর্তে যারা কাফিরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে, তারা কি তাদের নিকট ইয্যত-ক্ষমতা চায়? সমস্ত ইয্যত-ক্ষমতা তো আল্লাহরই। কিতাবে তোমাদের প্রতি তিনি অবতীর্ণ করেছেন যে, যখন তোমরা শুনবে আল্লাহর আয়াত প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে এবং তার প্রতি বিদ্রূপ করা হচ্ছে, তখন, যে পর্যন্ত তারা অন্য প্রসংগে লিপ্ত না হয় তোমরা তাদের সাথে বসবে না। অন্যথায় তোমরাও তাদের মতই হবে। মুনাফিক ও কাফির সকলকেই আল্লাহ জাহান্নামে একত্রিত করবেন।’’[8]
অন্যত্র বলা হয়েছে:
لا تَجِدُ قَوْمًا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الآَخِرِ يُوَادُّونَ مَنْ حَادَّ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَلَوْ كَانُوا آَبَاءَهُمْ أَوْ أَبْنَاءَهُمْ أَوْ إِخْوَانَهُمْ أَوْ عَشِيرَتَهُمْ
‘‘তুমি পাবে না আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাসী এমন কোনো সম্প্রদায়, যারা ভালবাসে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধচারিগণকে, হোক না কেন এ সকল বিরুদ্ধচারী তাদের পিতা, পুত্র, ভ্রাতা অথবা তাদের জ্ঞাতি-গোত্র।’’[9]
অন্যত্র আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা বলেন:
لا يَنْهَاكُمُ اللَّهُ عَنِ الَّذِينَ لَمْ يُقَاتِلُوكُمْ فِي الدِّينِ وَلَمْ يُخْرِجُوكُمْ مِنْ دِيَارِكُمْ أَنْ تَبَرُّوهُمْ وَتُقْسِطُوا إِلَيْهِمْ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُقْسِطِينَ
‘‘দীনের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে নি এবং তোমারেদকে স্বদেশ হতে বহিষ্কৃত করে নি তাদের প্রতি মহানুভবতা প্রদর্শন ও ন্যায়বিচার করতে আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করেন না। আল্লাহ তো ন্যায়পরায়ণদিগকে ভালবাসেন।’’[10]
(গ) ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম বা বিশ্বাসের অনুসরণ করে কেউ মুক্তিলাভ করতে, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করতে বা আখেরাতে জান্নাত লাভ করতে পারে বলে মনে করা। মহান আল্লাহ বলেন:
إِنَّ الدِّينَ عِنْدَ اللَّهِ الإِسْلامُ
‘‘ইসলাম আল্লাহর নিকট একমাত্র দীন।’’[11]
وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الإِسْلامِ دِينًا فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الأخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ
‘‘কেউ ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনো দীন গ্রহণ করতে চাইলে তা কখনো কবুল করা হবে না এবং সে হবে পরকালে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত।’’[12]
৫. ১. ৪. কুফর আকবার-এর বিভিন্ন প্রকাশ
কুরআনের আলোকে কুফর আকবার-এর নিম্নরূপ প্রকাশ রয়েছে:
৫. ১. ৪. ১. কুফর তাকযীব বা মিথ্যা মনে করার কুফর
অর্থাৎ ওহীর নির্দেশনাকে মিথ্যা বলে মনে করা করা। এ হলো যুগে যুগে কুফর বা অবিশ্বাসের প্রধান প্রকার। নবী-রাসূলগণের দাও‘আতের মাধ্যমে, অথবা অন্যান্য প্রচারকদের মাধ্যমে, অথবা আসমানী কিতাব পাঠের মাধ্যমে যখন মানুষের কাছে ওহীর শিক্ষা উপস্থিত হয় তখন এরূপ অবিশ্বাসী ওহীর শিক্ষাকে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেয়। মহান আল্লাহ বলেন:
وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرَى عَلَى اللَّهِ كَذِبًا أَوْ كَذَّبَ بِالْحَقِّ لَمَّا جَاءَهُ أَلَيْسَ فِي جَهَنَّمَ مَثْوًى لِلْكَافِرِينَ
‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহ সম্বন্ধে মিথ্যা রচনা করে অথবা তাঁর নিকট থেকে আগত সত্যকে অস্বীকার করে তার চেয়ে অধিক জালিম আর কে? জাহান্নামই কি কাফিরদের আবাস নয়?’’[13]
৫. ১. ৪. ২. কুফর ইসতিকবার বা অহঙ্কারের অবিশ্বাস
অর্থাৎ অহঙ্কার বশত ঈমানের কোনো বিষয়ের সত্যতা অনুভব করার পরেও তা অস্বীকার করা। অনেক অবিশ্বাসীই এরূপ কুফরে লিপ্ত হয়। এরূপ অহঙ্কারের কুফরে সর্বপ্রথম লিপ্ত হয় ইবলীস। মহান আল্লাহ বলেন:
وَإِذْ قُلْنَا لِلْمَلائِكَةِ اسْجُدُوا لآدَمَ فَسَجَدُوا إِلا إِبْلِيسَ أَبَى وَاسْتَكْبَرَ وَكَانَ مِنَ الْكَافِرِينَ
‘‘যখন ফিরিশতাদের বললাম ‘আদমকে সাজদা কর’, তখন ইবলীস ব্যতীত সকলেই সাজদা করল; সে অমান্য করল এবং অহংকার করল, সুতরাং সে কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হলো।’’[14]
অন্যত্র মহান আল্লাহ ফিরাউন ও অন্যান্য কাফিরদের বিষয়ে বলেন:
وَجَحَدُوا بِهَا وَاسْتَيْقَنَتْهَا أَنْفُسُهُمْ ظُلْمًا وَعُلُوًّا فَانْظُرْ كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الْمُفْسِدِينَ
‘‘তারা অন্যায় ও উদ্ধতভাবে নিদর্শনগুলি প্রত্যাখ্যান করল, যদিও তাদের অন্তর এগুলিকে সত্য বলে গ্রহণ করেছিল। দেখ, বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের পরিণাম কী হয়েছিল!’’[15]
৫. ১. ৪. ৩. কুফ্রু শাক্ক বা সন্দেহের অবিশ্বাস
ঈমানের কোনো বিষয়ে হৃদয়ে দ্বিধা বা সন্দেহ থাকাকে সন্দেহের কুফর বলা হয়। ঈমানের অর্থ সন্দেহাতীত প্রত্যয়ের সাথে বিশ্বাস করা। কাজেই কোনো বিষয়ে যদি মনে কিছু বিশ্বাস ও কিছু সন্দেহ থাকে বা দৃঢ় প্রত্যয়ের বদলে অস্পষ্ট ধারণা থাকে তবে তাকে কুফর বলে গণ্য করা হয়।
একজন কাফির ও একজন মুমিনের কথোপকথন সম্পর্কে আল্লাহ বলেন:
وَدَخَلَ جَنَّتَهُ وَهُوَ ظَالِمٌ لِنَفْسِهِ قَالَ مَا أَظُنُّ أَنْ تَبِيدَ هَذِهِ أَبَدًا وَمَا أَظُنُّ السَّاعَةَ قَائِمَةً وَلَئِنْ رُدِدْتُ إِلَى رَبِّي لأَجِدَنَّ خَيْرًا مِنْهَا مُنْقَلَبًا قَالَ لَهُ صَاحِبُهُ وَهُوَ يُحَاوِرُهُ أَكَفَرْتَ بِالَّذِي خَلَقَكَ مِنْ تُرَابٍ ثُمَّ مِنْ نُطْفَةٍ ثُمَّ سَوَّاكَ رَجُلا
‘‘এভাবে নিজের প্রতি জুলুম করে সে তার উদ্যানে প্রবেশ করল। সে বলল, আমি মনে করি না যে, এ কখনো ধ্বংস হয়ে যাবে। আমি মনে করি না যে, কিয়ামত হবে, আর যদি আমি আমার প্রতিপালকের নিকট প্রত্যাবৃত্ত হই-ই (কিয়ামত যদি হয়-ই) তবে আমি নিশ্চয় এর চেয়ে উৎকৃষ্ট স্থান লাভ করব।’ তদুত্তরে তার বন্ধু তাকে বলল, ‘তুমি কি কুফরী করছ তাঁর সাথে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন মৃত্তিকা ও পরে শুক্র হতে এবং তার পর পূর্ণাংগ করেছেন তোমাকে মনুষ্য আকৃতিতে?’’[16]
৫. ১. ৪. ৪. কুফর ই’রায বা অবজ্ঞার কুফর
দীন ও ঈমানের বিষয়ে গুরুত্বারোপ না করে নির্লিপ্ত থাকা, বা ঈমানের বিষয়কে অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করাকে কুফরু ই’রায বা অবজ্ঞার কুফর বলা হয়। মহান আল্লাহ বলেন:
وَالَّذِينَ كَفَرُوا عَمَّا أُنْذِرُوا مُعْرِضُونَ
‘‘যারা কাফির তারা তাদেরকে যে বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে তা থেকে বে-খেয়াল বা মুখ ফিরিয়ে থাকে।’’[17]
৫. ১. ৪. ৫. কুফ্রু নিফাক বা মুনফিকীর কুফর
অন্তরে অবিশ্বাস লুকিয়ে রেখে মুখে ঈমানের দাবি করাকে কুফরু নিফাক বলে। নিফাক বা মুনাফিকী কুফর এর একটি বিশেষ দিক যা কুরআন ও হাদীসে বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছে। এছাড়া বিশ্বাসের নিফাক ছাড়াও কর্মের নিফাকের একটি পর্যায় রয়েছে।
[2] সূরা (৬) আন‘আম: ৬৮ আয়াত।
[3] সূরা (৩) আল-ইমরান: ২৮ আয়াত।
[4] সূরা (৪) নিসা: ১৪৪ আয়াত।
[5] সূরা (৫) মায়িদা: ৫১ আয়াত।
[6] সূরা (৫) মায়িদা: ৫৭ আয়াত।
[7] সূরা (৯) তাওবা: ২৩ আয়াত।
[8] সূরা (৪) নিসা: ১৩৮-১৪০ আয়াত।
[9] সূরা (৫৮) মুজাদালা: ২২ আয়াত।
[10] সূরা (৬০) মুমতাহিনা: ৮ আয়াত।
[11] সূরা (৩) আল-ইমরান: ১৯ আয়াত।
[12] সূরা (৩) আল-ইমরান: ৮৫ আয়াত।
[13] সূরা (২৯) আনকাবূত: ৬৮ আয়াত।
[14] সূরা (২) বাকারা: ৩৪ আয়াত।
[15] সূরা (২৭) নামল: ১৪ আয়াত।
[16] সূরা (১৮) কাহফ: ৩৫-৩৮ আয়াত।
[17] সূরা (৪৬) আহকাফ: ৩ আয়াত।
৫. ১. ৫. নিফাক: পরিচিতি ও প্রকারভেদ
আরবীতে ‘নিফাক’ শব্দের অর্থ কপটতা (hypocrisy)। শব্দটির মূল অর্থ খরচ করা, চালু করা, গোপন করা, অস্পষ্ট করা ইত্যাদি।[1] নিফাকে লিপ্ত মানুষকে ‘মুনাফিক’ বলা হয়। ইসলামী পরিভাষায় নিফাক দুই প্রকার: (১) বিশ্বাসের নিফাক ও (২) কর্মের নিফাক।
৫. ১. ৫. ১. বিশ্বাসের নিফাক (النفاق الاعتقادي)
অন্তরের মধ্যে অবিশ্বাস গোপন রেখে মুখে বিশ্বাসের প্রকাশকে বিশ্বাসের নিফাক বা নিফাক ই’তিকাদী বলা হয়। এরূপ নিফাকের স্বরূপ নিম্নরূপ: (১) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সকল শিক্ষা বা দাও‘আত বা তাঁর শিক্ষার কোনো দিককে মিথ্যা বলে মনে করা, (২) তাঁকে ঘৃণা করা বা তাঁর প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করা (৩) তাঁর কোনো শিক্ষাকে ঘৃণা করা, (৪) তাঁর দীনের অবমাননায় আনন্দিত হওয়া অথবা (৫) তাঁর দীনের সাহায্য করতে অপছন্দ করা। মূলত কুরআন-হাদীসে এরূপ নিফাকের কথাই বলা হয়েছে। এরূপ নিফাক কুফরেরই একটি প্রকার; কারণ এরূপ নিফাকে লিপ্ত ব্যক্তির অন্তরে অন্যান্য কাফিরের মতই অবিশ্বাস বিদ্যমান, যদিও সে জাগতিক স্বার্থে মুখে ঈমানের দাবি করে। এদের বিষয়ে মহান আল্লাহ বলেন:
ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ آمَنُوا ثُمَّ كَفَرُوا فَطُبِعَ عَلَى قُلُوبِهِمْ فَهُمْ لا يَفْقَهُونَ
‘‘তা এ জন্য যে, তারা ঈমান আনার পর কুফরী করেছে, ফলে তাদের হৃদয়ে মোহর করে দেওয়া হয়েছে, পরিণামে তারা বোধশক্তি হরিয়ে ফেলেছে।’’[2]
৫. ১. ৫. ২. কর্মের নিফাক (النفاق العملي)
আমরা জানি যে, বিশ্বাসই মানুষের কর্ম নিয়ন্ত্রণ করে এবং বাহ্যিক কর্ম মানুষের আভ্যন্তরীন বিশ্বাসের প্রতিফলন। যার অন্তরে বিশ্বাস নেই কিন্তু বাইরে বিশ্বাস দাবি করে স্বভাবতই তার অন্তরের অবিশ্বাস তার কর্মে প্রকাশিত হয়, যেগুলি প্রমাণ করে যে, সে ঈমান ও তাকওয়ার দাবি করলেও বস্ত্তত তার মধ্যে ঈমান ও তাকওয়া অনুপস্থিত। হাদীস শরীফে এ জাতীয় কিছু কর্মের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। আব্দুল্লাহ ইবনু আম্র (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
أَرْبَعٌ مَنْ كُنَّ فِيهِ كَانَ مُنَافِقًا خَالِصًا وَمَنْ كَانَتْ فِيهِ خَصْلَةٌ مِنْهُنَّ كَانَتْ فِيهِ خَصْلَةٌ مِنْ النِّفَاقِ حَتَّى يَدَعَهَا إِذَا اؤْتُمِنَ خَانَ وَإِذَا حَدَّثَ كَذَبَ وَإِذَا عَاهَدَ غَدَرَ وَإِذَا خَاصَمَ فَجَرَ
‘‘চারটি বিষয় যার মধ্যে বিদ্যমান থাকবে সে নির্ভেজাল মুনাফিক। আর যার মধ্যে এগুলির মধ্য থেকে কোনো একটি স্বভাব বিদ্যমান থাকবে তার মধ্যে নিফাক বা কপটতার একটি দিক বিদ্যমান থাকবে, যতক্ষণ না সে তা পরিত্যাগ করে: (১) যখন তার কাছে কিছু আমানত রাখা হয় সে তা খিয়ানত করে, (২) যখন সে কথা বলে তখন মিথ্যা বলে, (৩) যখন সে চুক্তি বা প্রতিজ্ঞা-বদ্ধ হয় তখন তা ভঙ্গ করে এবং (৪) যখন সে ঝগড়া করে তখন সে অশ্লীল কথা বলে।’’[3]
এ সকল কর্ম বাহ্যত অন্তরে বিশ্বাসের অনুপস্থিতি প্রমাণ করে। তবে যদি অন্তরে প্রকৃত অবিশ্বাস না থাকে তবে এ সকল কর্ম ‘কুফর’ বা অবিশ্বাসের নিফাক বলে গণ্য হবে না। বরং কুফর আসগারের ন্যায় নিফাক আমালী বা কর্মের নিফাক বলে গণ্য হবে।
৫. ১. ৬. কুফর আস্গার বা ক্ষুদ্রতর অবিশ্বাস
কুফর মূলত হৃদয়ের অবিশ্বাসের নাম, অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কর্মের নাম নয়। এজন্য কুরআন ও হাদীসে যে সকল ‘পাপ কর্ম’-কে কুফর বলা হয়েছে কিন্তু যেগুলির সাথে হৃদয়ের অবিশ্বাস জড়িত নয় সেগুলিকে ‘কুফর আসগার’ বা ‘কুফরুন নি’মাহ (كفر النعمة) অর্থাৎ নিয়ামতের অস্বীকার বা কুফর মাজাযী (الكفر المجازي) বা রূপকার্থে কুফর বলে অভিহিত করা হয়।[4]
কুরআনে অবিশ্বাসের পাশাপাশি অকৃতজ্ঞতাকেও কুফর বলা হয়েছে। এক আয়াতে আল্লাহ বলেন:
وَضَرَبَ اللَّهُ مَثَلا قَرْيَةً كَانَتْ آمِنَةً مُطْمَئِنَّةً يَأْتِيهَا رِزْقُهَا رَغَدًا مِنْ كُلِّ مَكَانٍ فَكَفَرَتْ بِأَنْعُمِ اللَّهِ فَأَذَاقَهَا اللَّهُ لِبَاسَ الْجُوعِ وَالْخَوْفِ بِمَا كَانُوا يَصْنَعُونَ
‘‘আল্লাহ দৃষ্টান্ত দিচ্ছেন এক জনপদের, যা ছিল নিরাপদ ও নিশ্চিত, যেথায় আসত সর্বদিক থেকে তার প্রচুর রিয্ক, অতঃপর তা আল্লাহর নিয়ামতের কুফ্রী করল, ফলে তারা যা করত তজ্জন্য আল্লাহ তাদেরকে আস্বাদ গ্রহণ করালেন ক্ষুধা ও ভীতির আচ্ছদনের।’’[5]
এছাড়া আমরা বুঝতে পারি যে, প্রকৃত ও পরিপূর্ণ ঈমানের সাথে পাপ ও অবাধ্যতার সহ-অবস্থান না হওয়াই ঈমানের দাবি। বস্ত্তত বিশ্বাসের ঘাটতি ছাড়া কেউ পাপে লিপ্ত হতে পারে না। আল্লাহর প্রতি, তাঁর সিফাতসমূহের প্রতি, আখিরাতের প্রতি ও আখিরাতের শাস্তি ও পুরস্কারের প্রতি বিশ্বাস পরিপূর্ণ থাকলে কেউ পাপে লিপ্ত হতে পারে না। এজন্য পাপে লিপ্ত হওয়া বিশ্বাসের ঘাটতি বা অপূর্ণতা নির্দেশ করে। তবে যতক্ষণ এরূপ অপূর্ণতা পূর্ণ অবিশ্বাসে পরিণত না হয় ততক্ষণ একে ‘কুফর্ আসগার’ বা কুফর মাজাযী (রূপক কুফর) বলে অভিহিত করা হয়।
কুরআন ও হাদীসে অনেক কঠিন পাপকে কুফর বলে অভিহিত করা হয়েছে, আবার অন্যত্র এ সকল ‘কুফ্রী'তে লিপ্ত মানুষদেরকে মুমিন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ সকল আয়াত ও হাদীসের সমন্বয়ে সাহাবীগণ ও পরবর্তী যুগের আলিমগণ মত প্রকাশ করেছেন যে, এ সকল অপরাধ ‘কুফর আসগার’ বা ক্ষুদ্রতর কুফর বলে গণ্য। এগুলি কঠিন পাপ, তবে যদি কেউ এগুলিকে পাপ ও নিষিদ্ধ জেনে, নিজেকে অপরাধী বলে বিশ্বাস করে শয়তানের প্ররোচনায় বা জাগতিক কোনো স্বার্থে এরূপ পাপে লিপ্ত হয় তবে সে পাপী মুমিন বলে গণ্য হবে, ইসলাম ত্যাগকারী বা পারিভাষিক কাফির বলে গণ্য হবে না। পক্ষান্তরে যদি কেউ এরূপ কর্ম বৈধ মনে করে, অথবা আল্লাহর নির্দেশ মান্য করা ঐচ্ছিক মনে করে, বা আল্লাহর এ সকল নির্দেশ বা যে কোনো নির্দেশ মান্য করা তার নিজের জন্য বা অন্য কারো জন্য বা কোনো যুগের জন্য অনাবশ্যক বা অপ্রয়োজনীয় মনে করে বা অন্য কোনো ধর্মের বা সমাজের বিধান অধিকতর উপযোগী বলে মনে করে তবে সে ধর্মত্যাগী ও কাফির বলে গণ্য হবে।
মহান আল্লাহ বলেন:
وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ
‘‘আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তদনুসারে যারা বিধান দেয় না তারাই কাফির।’’[6]
এখানে বাহ্যত বুঝা যায় যে আল্লাহর বিধানের বাইরে চলা বা যে কোনো পাপ করাই কুফরী, কারণ যে ব্যক্তি আল্লাহর বিধানের বাইরে চলে বা পাপে লিপ্ত হয় সে মুলত তার নিজের জন্য বা অন্যের জন্য আল্লাহর বিধানের বাইরে বাইরে ফয়সালা করল। আর আল্লার নাযিলকৃত বিধানাবলির অন্যতম যে, মুসলিম অন্য মুসলিমের সাথে হানাহানি বা যুদ্ধে রত হবে না। ইবনু আববাস (রাঃ), আবূ বাক্রাহ সাকাফী (রাঃ), ইবনু উমার (রাঃ), ইবনু মাসঊদ (রাঃ) প্রমুখ সাহাবী থেকে বিভিন্ন সনদে বর্ণিত প্রায় মুতাওয়াতির হাদীসে তাঁরা বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বিদায় হজ্জে বলেন:
لا تَرْجِعُوا بَعْدِي كُفَّارًا يَضْرِبُ بَعْضُكُمْ رِقَابَ بَعْضٍ
‘‘তোমরা আমার পরে কাফির হয়ে যেও না, যে একে অপরকে হত্যা করবে।’’[7]
এখানে স্পষ্টতই পরস্পরে যুদ্ধ করাকে কুফরী বলা হয়েছে। অন্য হাদীসে আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
سِبَابُ الْمُسْلِمِ فُسُوقٌ وَقِتَالُهُ كُفْرٌ
‘‘মুসলিমকে গালি দেওয়া পাপ এবং তার সাথে যুদ্ধ করা কুফরী।’’[8]
কিন্তু অন্য আয়াতে এরূপ কর্মে রত মানুষদেরকে মুমিন বলা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন:
وَإِنْ طَائِفَتَانِ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ اقْتَتَلُوا فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا فَإِنْ بَغَتْ إِحْدَاهُمَا عَلَى الأخْرَى فَقَاتِلُوا الَّتِي تَبْغِي حَتَّى تَفِيءَ إِلَى أَمْرِ اللَّهِ فَإِنْ فَاءَتْ فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا بِالْعَدْلِ وَأَقْسِطُوا إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُقْسِطِينَ إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ فَأَصْلِحُوا بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ وَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ
‘‘মুমিনগণের দুই দল যুদ্ধে লিপ্ত হলে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেবে। অতঃপর তাদের একদল অপর দলের উপর অত্যাচার বা সীমলঙ্ঘন করলে তোমরা জুলুমকারী দলের সাথে যুদ্ধ কর, যতক্ষণ না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে। যদি তারা ফিরে আসে তাদের মধ্যে ন্যায়ের সাথে ফয়সালা করবে এবং সুবিচার করবে। নিশ্চয় আল্লাহ সুবিচারকারীদেরকে ভালবাসেন। মুমিনগণ পরস্পর ভাই; সুতরাং তোমরা ভ্রাতৃগণের মধ্যে শান্তি স্থাপন কর, যাতে তোমরা অনুগ্রহ প্রাপ্ত হও।’’[9]
এখানে আমরা দেখছি যে, পরস্পকের যুদ্ধে রত মানুষদেরকে সুস্পষ্টভাবেই মুমিন বলা হয়েছে। কারণ এরূপ কর্ম কুফর আসগার বা কুফর মাজাযী হওয়ার কারণে তা ঈমানের সাথে একত্রিত হতে পারে।
[2] সূরা (৬৩) মুনাফিকূন: ৩ আয়াত।
[3] বুখারী, আস-সহীহ ১/২১, ৩/১১৬০; মুসলিম, আস-সহীহ ১/৭৮।
[4] ইবনু আবিল ইয্য, শারহুল আকীদা আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ৩২০-৩২৪।
[5] সূরা (১৬) নাহ্ল: ১১২ আয়াত।
[6] সূরা (৫) মায়িদা: ৪৪ আয়াত।
[7] বুখারী, আস-সহীহ ১/৫৬, ২/৬১৯, ৬২০, ৪/১৫৯৮, ১৫৯৯, ৫/২২৮২; মুসলিম, আস-সহীহ ১/৮১-৮২।
[8] বুখারী, আস-সহীহ ১/২৭, ৫/২২৪৭, ৬/২৫৯২; মুসলিম, আস-সহীহ ১/৮১।
[9] সূরা (৪৯) হুজুরাত: ৯-১০ আয়াত।
ইতোপূর্বে দ্বিতীয় অধ্যায়ে তাওহীদের প্রসঙ্গে আমরা ‘শিরক’ শব্দটির অর্থ আলোচনা করেছি। আমরা দেখেছি যে, আরবীতে শির্ক (شِرْك) অর্থ অংশীদার হওয়া (to share, participate, be partner, associate)। ইশরাক (إشراك) ও তাশ্রীক (تَشْرِيك) অর্থ অংশীদার করা বা বানানো। সাধারণভাবে ‘শির্ক’ শব্দটিকেও আরবীতে ‘অংশীদার করা’ বা ‘সহযোগী বানানো’ অর্থে ব্যবহার করা হয়। ইসলামী পরিভাষায় আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে আল্লাহর কোনো বিষয়ে আল্লার সমকক্ষ মনে করা বা আল্লাহর প্রাপ্য কোনো ইবাদত আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য পালন করা বা আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ডাকাকে শিরক বলা হয়। এক কথায় ‘আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট কোনো বিষয় অন্য কাউকে অংশী বানানোই শির্ক।’
কুরআনের ভাষায় শিরক হলো কাউকে ‘আল্লাহর সমতূল্য’ করা। মহান আল্লাহ বলেন:
فَلا تَجْعَلُوا لِلَّهِ أَنْدَادًا وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ
অতএব তোমরা জেনেশুনে কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ বানাবে না।’’[1]
অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন:
وَجَعَلُوا لِلَّهِ أَنْدَادًا لِيُضِلُّوا عَنْ سَبِيلِهِ
‘‘এবং তারা আল্লাহর সমতুল্য উদ্ভাবন করে তাঁর পথ থেকে বিভ্রান্ত করার জন্য।’’[2]
আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন,
سَأَلْتُ أَوْ سُئِلَ رَسُولُ اللَّهِ (ﷺ) أَيُّ الذَّنْبِ عِنْدَ اللَّهِ أَكْبَرُ قَالَ أَنْ تَجْعَلَ لِلَّهِ نِدًّا وَهُوَ خَلَقَكَ
‘‘আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে প্রশ্ন করলাম, আল্লাহর নিকট সবচেয়ে কঠিন পাপ কী? তিনি বলেন: সবচেয়ে কঠিন পাপ এই যে, তুমি আল্লাহর সমকক্ষ বানাবে অথচ তিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।’’[3]
এভাবে আমরা দেখছি যে কাউকে মহান আল্লাহর ‘নিদ্দ’ মনে করাই শিরক। আরবীতে ‘নিদ্দ’’ (الندّ) অর্থ সমতুল্য, মত, সমকক্ষ, তুলনীয় ইত্যাদি। কাউকে মহান আল্লাহর রুবূবিয়্যাত, আসমা, সিফাত বা ইলাহিয়্যাত-এর ক্ষেত্রে তাঁর সমতুল্য মনে করা, অথবা আল্লাহকে যে ভক্তি প্রদর্শন করা হয় বা আল্লাহর জন্য যে ইবাদত করা হয় তা অন্য কাউকে প্রদান করাই শিরক।[4]
এখানে কয়েকটি বিষয় প্রনিধানযোগ্য:
প্রথমত, কুফর ও শিরক পরস্পর অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। কাউকে কোনোভাবে কোনো বিষয়ে মহান আল্লাহর সমকক্ষ বা তুলনীয় মনে করার অর্থই তাঁর একত্বে অবিশ্বাস বা কুফরী করা। আল্লাহর তাওহীদ ও রাসূলগণের দাও‘আতে অবিশ্বাস না করে কেউ শির্ক করতে পারে না। কাজেই শি্রকের অর্থই তাওহীদ ও রিসালাতে অবিশ্বাস করা। অপরদিকে কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ না মেনে ঈমানের কোনো রুকন অবিশ্বাস করলে তা শুধু কুফর বলে গণ্য। যেমন যদি কেউ আল্লাহর অস্তিত্বে বা তাঁর প্রতিপালনের একত্বে অবিস্বাস করেন বা মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর রিসালাত, খাতমুন নুবুওয়াত ইত্যাদি অস্বীকার করেন তবে তা কুফর হলেও বাহ্যত তা শিরক নয়। কারণ এরূপ ব্যক্তি সুস্পষ্ট কাউকে আল্লাহর সাথে তুলনীয় বলে দাবি করছে না। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এরূপ কুফরের সাথেও শিরক জড়িত। কারণ এরূপ ব্যক্তি কোনো না কোনোভাবে এ ক্ষয়িষ্ণু জড় বিশ্বকে মহান আল্লাহ মত অনাদি-অনন্ত বলে বিশ্বাস করছে, বিশ্ব পরিচালনায় প্রকৃতি বা অন্য কোনো শক্তিকে বিশ্বাস করছে।
দ্বিতীয়ত, কুফর বা অবিশ্বাসের অন্যতম প্রকাশ শিরক। সাধারণভাবে যুগে যুগে অবিশ্বাসীগণ মহান আল্লাহর অস্তিত্ব, তাঁর গুণাবালি বা তাঁর মা’বুদিয়্যাত বা উপাস্যত্ব অস্বীকার করে কুফরী করে নি, বরং এগুলিতে তার সাথে অন্য কাউকে শরীক বা অংশীদার বলে বিশ্বাস করেই কুফরী করেছে। এজন্য কুরআন ও হাদীসে কুফরের বর্ণনায় শিরকের কথাই বেশি বলা হয়েছে।
তৃতীয়ত, মহান আল্লাহর কোনো সমকক্ষ কল্পনা করা বা শিরকের বিভিন্ন প্রকার ও প্রকরণের দিকে দৃষ্টি দিলে আমরা বুঝতে পারি যে, দুভাবে শিরক হয়ে থাকে: (১) মহান আল্লাহর কোনো সৃষ্টির প্রতি অতি-সুধারণা অথবা (২) মহান আল্লাহর প্রতি কু-ধারণা বা অব-ধারণা।
শিরকে নিপতিত মানুষেরা কখনো ফিরিশতা, নবী, ওলী, নেককার মানুষ, কারামত-প্রাপ্ত মানুষ, তাদের স্মৃতিবিজড়িত স্থান, পাহাড়, সূর্য, চন্দ্র ইত্যাদি কোনো সৃyুষ্টর বিষয়ে ভক্তি ও মর্যাদা প্রদানে অতিরঞ্জন করে তাদের মধ্যে ‘অলৌকিক শক্তি’ বা ঐশ্বরিক ক্ষমতা কল্পনা করেছে। অথবা মহান আল্লাহর পূর্ণতার গুণের প্রতি কু-ধারণা পোষণ করে তাকে সৃষ্টির মত কল্পনা করেছে এবং তাঁর সন্তান, পরিষদ, ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা ইত্যাদি কল্পনা করেছে।
কুরআন-হাদীসে উল্লিখিত শিরক এবং বিশ্বের বিভিন্ন জাতির শিরক পর্যালোচনা করলে আমরা মূলত এ দুটি বিষয়ই দেখতে পাই। এবং এদুটি বিষয়ও পরস্পর অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। কারো প্রতি ভক্তির অতিরঞ্জর অর্থই আল্লাহর ক্ষমতা, রুবূবিয়্যাত ও উলূহিয়্যাতের প্রতি কু-ধারণা পোষণ করা।
[2] সূরা (১৪) ইবরাহীম: ৩০ আয়াত। আরো দেখুন: সূরা (২) বাকারা: ১৬৫, সূরা (৩৪) সাবা: ৩৩, সূরা (৩৯) যুমার: ৮; সূরা (৪১) ফস্সিলাত (হামীম): ৯ আয়াত।
[3] বুখারী, আস-সহীহ ৪/১৬২৬, ৫/২২৩৬, ৬/২৪৯৭, ২৭৩৯; মুসলিম, আস-সহীহ ১/৯০-৯১।
[4] তাবারী, তাফসীর (জামিউল বায়ান) ১/১৬৩-১৬৪।
আল্লাহ ছাড়া কাউকে ক্ষমতায় ও সৃষ্টিতে বা সকল দিক থেকে আল্লাহর সমতুল্য মনে করা যেমন শিরক, তেমনি মহান আল্লাহ কাউকে নিজের শরীক বানিয়ে নিয়েছেন, বা কাউকে কিছু অলৌকিক ক্ষমতা, ‘উলূহিয়্যাত’ বা ঐশ্বরিক ক্ষমতা ও ইবাদত পাওয়ার যোগ্যতা প্রদান করেছেন বলে বিশ্বাস করাও শিরক। তবে সাধারণত কোনো মুশরিকই কাউকে সকল দিক থেকে বা স্বকীয় ভাবে আল্লাহর সমতুল্য বলে শিরক করেনি, বরং দ্বিতীয় পর্যায়ের শিরকই সর্বদা ব্যাপক।
ইতোপূর্বে প্রথম ও দ্বিতীয় অধ্যায়ে কুরআন কারীমের বিভিন্ন আয়াতের আলোকে দেখেছি যে, আরবের মুশরিকগণ কাউকে আল্লহর মত বা আল্লাহর সমতূল্য স্রষ্টা, প্রতিপালক, সর্বশক্তিমান বা স্বকীয় ক্ষমতায় ইলাহ বা মাবূদ হিসেবে আল্লাহর সমকক্ষ বা সমতুল্য বলে মনে করত না। বরং মহান আল্লাহকেই একমাত্র স্রষ্টা, প্রতিপালক, সর্বশক্তিমান, মহাবিশ্বের একমাত্র সার্বভৌম মালিক, রিয্কদাতা, মৃত্যুদাতা ও সকল কিছুর পরিচালক বলে বিশ্বাস করত। তারা বিশ্বাস করত যে সকলেই আল্লাহর বান্দা। তবে তারা বিশ্বাস করত যে, আল্লাহর কিছু বান্দা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করে সাধারণ বান্দাদের চেয়ে উর্ধ্বে উঠেন, যাদেরকে আল্লাহ খুশি হয়ে নিজের কর্মে ও ক্ষমতায় শরীক করেছেন। এদের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য ও এদের শাফা‘আত দ্বারা উপকৃত হওয়ার জন্য তারা এদের ইবাদত করত। এভাবে আমরা দেখি যে, কিছু ‘‘অলৌকিক ক্ষমতায়’’ এবং ‘‘ইবাদত পাওয়ার যোগ্যতায়’’ তারা আল্লাহর কিছু বান্দাকে আল্লাহর সমকক্ষ বা সমতুল্য বলে বিশ্বাস করত। আর এরূপ করাকেই কুরআন ও হাদীসে ‘আল্লাহর সমকক্ষ বা সমতুল্য নির্ধারণ করা বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রাহ) বলেন: ‘‘শিরকের হাকীকত এই যে, কোনো মানুষ কোনো কোনো সম্মানিত মানুষের ক্ষেত্রে ধারণা করবে যে, উক্ত ব্যক্তি দ্বারা যে সকল অলৌকিক কার্য সংঘটিত বা প্রকাশিত হয় তা উক্ত ব্যক্তির পূর্ণতার গুণে গুণান্বিত হওয়ার কারণে। এ সকল অলৌকিক কার্য প্রমাণ করে যে, সাধারণ মানুষের মধ্যে পাওয়া যায় না এরূপ কিছু বিশেষ গুণ উক্ত ব্যক্তির মধ্যে বিদ্যমান। এরূপ গুণ মূলত একমাত্র আল্লাহরই আছে। আল্লাহ যাকে ‘উলূহিয়্যত’ বা এরূপ বিশেষত্ব প্রদান করেন, অথবা ‘আল্লাহ’ যে ব্যক্তির সত্তার সাথে সংমিশ্রিত হন, অথবা যে ব্যক্তি আল্লাহর যাত বা সত্তার মধ্যে ‘ফানা’ বা বিলুপ্তি লাভ করে এবং আল্লাহ সত্তার সাথে ‘বাকা’ বা অস্তিত্ব লাভ করেন, বা অনুরূপ কোনো ভাবে যে ব্যক্তিকে আল্লাহ এরূপ ক্ষমতা বা পূর্ণতা প্রদান করেন তিনিই কেবল তা প্রাপ্ত হন। এভাবে মানুষের উলূহিয়্যাত বা ঐশ্বরিক ক্ষমতা বা গুণ লাভের পদ্ধতি ও প্রকার সম্পর্কে মুশরিকদের মধ্যে অনেক ভিত্তিহীন কুসংস্কার বিদ্যমান। এ বিষয়ে হাদীস শরীফে বলা হয়েছে যে, আরবের কাফিরগণ হজ্জের ‘তালবিয়া’র মধ্যে ও কাবাঘর তাওয়াফের সময় বলত:
لَبَّيْكَ لا شَرِيكَ لَكَ إِلا شَرِيكًا هُوَ لَكَ تَمْلِكُهُ وَمَا مَلَكَ
লাববাইকা আল্লাহুম্মা লাববাইক.... আপনার কোনো শরীক নেই, তবে আপনি নিজে যাকে আপনার শরীক বানিয়েছেন সে ছাড়া। এরূপ শরীকও আপনারই মালিকানাধীন, আপনারই বান্দা, উক্ত শরীক ও তার সকল কর্তৃত্ব ও রাজত্ব আপনারই অধীন ...।[1]
অন্যত্র তিনি আরবের মুশরিকদের ইবরাহীম (আঃ)-এর দীন থেকে বিচ্যুতি ও শিরকের মধ্যে নিপতিত হওয়ার কারণ প্রসঙ্গে তাদের শিরকের প্রকৃতি ব্যাখ্যা করে বলেন: ‘‘এ সকল মুশরিক বিশ্বসৃষ্টির ব্যাপারে এবং বিশ্বের বিৃহৎ বিষয়গুলি পরিচালনার ব্যপারে আল্লাহর কোনো শরীক আছে বলে বিশ্বাস করত না। তারা একথাও স্বীকার করত যে, আল্লাহ যদি কোনো কিছুর সিদ্ধান্ত নেন বা কোনো বিষয় নির্ধারণ করেন তবে তা পরিবর্তন বা রোধ করার ক্ষমতাও কারোরই নেই। তারা কেবলমাত্র বিশেষ কিছু বিষয়ে কিছু বান্দাকে শরীক করত। কারণ তারা মনে করত যে, একজন মহারাজ তার দাসদেরকে এবং তার নিকটবর্তী প্রিয় মানুষদেরকে তার রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় কিছু ছোটখাট দায়িত্ব পালনের জন্য প্রেরণ করেন এবং পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এসকল ছোটখাট বিষয় নিজেদের ইচ্ছামত পরিচালনা করার ক্ষমতা তাদেরকে প্রদান করেন। তারা আরো ধারণা করত যে, একজন মহারাজ তার প্রজাগণের খুটিনাটি বিষয় নিজে সম্পন্ন বা পরিচালনা করেন না, বরং অধীনস্থ প্রশাসক ও কর্মকর্তাদেরকে এ সকল বিষয় পরিচালনার দায়িত্ব দেন। এ সকল কর্মকর্তার অধীনে যারা কর্ম করেন বা তাদের সাথে সুসম্পর্ক রাখেন তাদের বিষয়ে এ সকল কর্মকর্তার সুপারিশ তিনি গ্রহণ করেন। সকল রাজার মহারাজা রাজাধিরাজ মহান আল্লাহও অনুরূপভাবে তাঁর কিছু নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দাকে উলূহ্যিায়ের উপঢৌকন প্রদান করেছেন এবং এদের বিরক্তি ও সন্তুষ্টিকে তার অন্যান্য বান্দাদের ক্ষেত্রে প্রভাবময় করে দিয়েছেন।
এ জন্য তারা মনে করত যে, এ সকল নৈকট্যপ্রাপ্ত বানদার নৈকট্যলাভের চেষ্টা করা জরুরী, যেন তা প্রকৃত মহারাজের নিকট তাদের কবুলিয়্যাতের ওসীলা হতে পারে। আর হিসাব ও প্রতিফলের সময় এদের শাফা‘আত মহান আল্লাহর দরবারে কবুল্যিয়াত ও গ্রহণযোগ্যতা পাবে। এ ধারণা তাদের মনের মধ্যে গভীরভাবে প্রেথিত হয়ে যায়। এজন্য তাদের মন বলে যে, এ সকল নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দাদের সামনে সাজদা কর, তাদের জন্য জবাই-উৎসর্গ কর, তাদের নামে কসম কর, তাদের অলৌকিক ক্ষমতার কারণে তাদের কাছে ত্রান ও সাহায্য প্রার্থনা কর, পাথরে, তামায়, পিতলে বা অন্য কিছুতে তাদের ছবি ও প্রতিকৃতি একে রাখ, এদের এ সকল প্রতিৃকতি সামনে রেখে এদের রূহের (আত্মার) প্রতি মুতাওয়াজ্জাহ হও। ক্রমান্বয়ে পরবর্তী প্রজন্মগুলির মানুষেরা মুর্খতার কারণে এদের এ সকল মুর্তি ও প্রতিকৃতিকেই প্রকৃত ইলাহ বা মা‘বূদ বলে বিশ্বাস করতে থাকে।’’[2]
[2] শাহ ওয়ালি উল্লাহ, আল-ফাওযুল কাবীর, পৃ. ২৪-২৫।
কুরআন কারীমের প্রায় এক তৃতীয়াংশ তাওহীদ ও শিরক বিষয়ক আলোচনা। হাদীস শরীফেও শিরকের আলোচনা ব্যাপক। স্বভাবতই মুসলিম উম্মাহর আলিমগণও শিরক-কুফর নিয়ে ব্যাপক আলোচনা করেছেন। শিরকের প্রকৃতি অনুধাবন করার জন্য তারা শিরককে বিভিন্নভাবে ভাগ করেছেন। শিরকের ভয়াবহতা অনুসারে শিরকে দুভাগে ভাগ করা হয়েছে: (১) শিরক আকবার অর্থাৎ বৃহত্তর শিরক বা প্রকৃত শিরক এবং (২) শিরক আসগার অর্থাৎ ক্ষুদ্রতর শিরক। তাওহীদের বৈপরীত্যের ভিত্তিতে শিরককে তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে। আবার কুরআন ও হাদীসে উল্লেখিত শিরকী কর্মসমূহের ভিত্তিতে শিরককে অনেকভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। আমরা প্রথমে তাওহীদের বৈপরীত্যের ভিত্তিতে শিরক আকবারের প্রকারভেদ ও শিরক আসগারের পরিচয় ও প্রকারভেদ আলোচনা করব। এরপর শিরক প্রতিরোধে কুরআন-সুন্নাহর পদক্ষেপ আলোচনা প্রসঙ্গে কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত বিভিন্ন প্রকারের শিরক আলোচনা করব, ইনশা আল্লাহ।
৫. ২. ৩. ১. তাওহীদের বৈপরীত্যে শিরকের প্রকারভেদ
আমরা দেখেছি যে, তাওহীদের তিনটি পর্যায় রয়েছে। তাওহীদের বিপরীতই শিরক। এজন্য শিরককেও তিনভাগে ভাগ করা হয়:
৫. ২. ৩. ১. ১. প্রতিপালনের শিরক্ (الشرك في الربوبية)
আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে সৃষ্টি বা প্রতিপালনের বিষয়ে আল্লাহর সাথে শরীক করা। যেমন আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো মধ্যে সৃষ্টি, সংহার, প্রতিপালন, রিয্ক দান, জীবন দান, মৃত্যু দান, বিশ্ব পরিচালনা, মঙ্গল-অমঙ্গল ইত্যাদি ক্ষমতা আছে বলে বিশ্বাস করা। এখানে উল্লেখ্য যে, মহান আল্লার রুবূবিয়্যাত বা রুবূবিয়্যাতের কোনো বিষয় অস্বীকার করাও এ পর্যায়ের শিরক। কারণ এরূপ বিশ্বাস পোষণকারী প্রকৃতি বা অন্য কোনো জাগতিক শক্তিকে রুবূবিয়্যাতের ক্ষমতাসম্পন্ন বলে বিশ্বাস করে।
৫. ২. ৩. ১. ২. নাম ও গুণাবলির শির্ক (الشرك في الأسماء والصفات)
আমরা দেখেছি যে, মহান আল্লাহর পূর্ণতার গুণাবলি ও মহাসম্মানিত পবিত্র নামসমূহ রয়েছে। এসকল গুণ বা নামের ক্ষেত্রে কোনো সৃষ্টিকে আল্লাহর সমকক্ষ মনে করা এ পর্যায়ের শিরক। মহান আল্লাহকে কোনোভাবে মানুষ বা সৃষ্টির সাথে তুলনা করা অথবা মানুষ বা অন্য কোনো সৃষ্টিকে কোনোভাবে মহান আল্লাহর সাথে তুলনীয় মনে করা এ পর্যায়ের শিরক।
৫. ২. ৩. ১. ৩. ইবাদতের শিরক (الشرك في الألوهية)
‘ইবাদত’-এর ক্ষেত্রে আল্লাহ ছাড়া কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ বলে বিশ্বাস করা বা আল্লাহ ছাড়া কাউকে ইবাদত করাকে ‘ইবাদতের শির্ক’ বলা হয়। ইবাদতের অর্থ আমরা ইতোপূর্বে আলোচনা করেছি। আমরা দেখেছি যে, ইবাদত অর্থ প্রগাঢ় ভয় ও আশা-মিশ্রিত চূড়ান্ত ভক্তি-বিনয় ও অসহায়তব প্রকাশ। মহান আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো প্রতি এরূপ অলৌকিক ভক্তি ও অসহায়ত্ব প্রকাশই ইবাদতের শিরক।
৫. ২. ৩. ২. শির্ক আস্গার (الشرك الأصغر)
যে বিশ্বাস, কথা বা কর্ম শিরকের মত হলেও প্রকৃত শিরকের পর্যায়ে পৌঁছে নি তাকে শিরক আসগার বলা হয়। যেমন আল্লাহর ইবাদত করার ক্ষেত্রে মানুষদের থেকে প্রশংসা, সুনাম বা জাগতিক কোনো কিছু আশা করা, অথবা এমন কথা বলা যাতে বাহ্যত আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে আল্লাহর সাথে তুলনীয় বলে মনে হতে পারে, যদিও বক্তার উদ্দেশ্য তা নয়।
আমরা দেখেছি যে, প্রকৃত শির্ক হলো আল্লাহ ছাড়া কাউকে আল্লাহর প্রিয়পাত্র হওয়ার বা আল্লাহর সাথে বিশেষ সম্পর্ক থাকার যুক্তিতে বা অন্য কোনো যুক্তিতে বিশ্ব পরিচালনায় কিছু অধিকার এবং ইবাদত লাভের অধিকার আছে বলে বিশ্বাস করা, এবং তার নিকট থেকে অলৌকিক সাহায্য, দয়া, বর, আশীর্বাদ বা নেকদৃষ্টি লাভের জন্য বা তার অলৌকিক ক্রোধ, অভিশাপ বা বিরক্তি থেকে আত্মরক্ষা করার জন্য তার নিকট চূড়ান্ত বা অলৌকিক ভক্তি ও বিনয় প্রকাশ করা। পক্ষান্তরে শির্ক আসগারের ক্ষেত্রে ইবাদতকারী কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ, রুবূবিয়্যাত বা উলূহিয়্যাতের অধিকারী বলে বিশ্বাস করে না, তবে তার কর্ম ও কথা এরূপ বিশ্বাসের কাছাকাছি চলে যায়। যে কোনো শিরক আসগর শিরক আকবরে পরিণত হতে পারে। কারণ মূল বিষয়টি নির্ভর করে উদ্দেশ্য ও বিশ্বাসের উপরে। শিরক আসগারের বিভিন্ন প্রকার আলোচনা করলে উভয় পর্যায়ের শিরকের মধ্যে পার্থক্য আরো সুস্পষ্ট হবে।
শিরক আসগারের প্রকার ও প্রকাশগুলির মধ্যে অন্যতম:
রিয়া (الرياء) অর্থ দেখানো, প্রদর্শন করা (To act ostentatiously, make a show before people, attitudinize, to do eyeservice)। আল্লাহর জন্য করণীয় ইবাদত পালনের মধ্যে মানুষের দর্শন, প্রশংসা বা বাহবার ইচ্ছা পোষণ করাকে রিয়া বলে।
মুমিনের ইবাদত ধ্বংস করার জন্য শয়তানের অন্যতম ফাঁদ এই ‘রিয়া’। কুরআন ও হাদীসে রিয়া বা প্রদর্শনেচ্ছার ভয়াবহতা সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন যে, কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম যাদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে তাদের মধ্যে থাকবে একজন বড় আলিম, একজন প্রসিদ্ধ শহীদ ও একজন বড় দাতা। তারা আজীবন আল্লাহর ইবাদত বন্দেগিতে কাটালেও রিয়ার কারণে তারা ধ্বংসগ্রস্ত হয়।[1]
বিভিন্ন হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) রিয়াকে ‘শিরক আসগার’ অর্থাৎ ‘ছোট শিরক’ বা ‘শিরক খাফী’ অর্থাৎ ‘লূক্কয়িত শিরক’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। কারণ, বান্দা আল্লাহর জন্য ইবাদত করলেও অন্য সৃষ্টি থেকেও সেজন্য কিছু ‘পুরস্কার’ বা প্রশংসা আশা করে আল্লাহর সাথে অন্যকে শরিক করে। এ শিরকের কারণে মুসলিম কাফির বলে গণ্য না হলেও তার ইবাদত কবুল হবে না। মাহমূদ ইবনু লাবীদ বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:
إِنَّ أَخْوَفَ مَا أَخَافُ عَلَيْكُمْ الشِّرْكُ الأَصْغَرُ قَالُوا وَمَا الشِّرْكُ الأَصْغَرُ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ الرِّيَاءُ يَقُولُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ لَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِذَا جُزِيَ النَّاسُ بِأَعْمَالِهِمْ اذْهَبُوا إِلَى الَّذِينَ كُنْتُمْ تُرَاءُونَ فِي الدُّنْيَا فَانْظُرُوا هَلْ تَجِدُونَ عِنْدَهُمْ جَزَاءً
‘‘আমি সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টি তোমাদের ব্যাপারে ভয় পাই তা হলো শিরক আসগার বা ক্ষুদ্রতর শিরক। সাহাবীগণ প্রশ্ন করেন: হে আল্লাহর রাসূল, শিরক আসগার কী? তিনি বলেন: রিয়া বা প্রদর্শনেচ্ছা। কিয়ামতের দিন যখন মানুষদের তাদের কর্মের প্রতিফল দেওয়া হবে তখন মহান আল্লাহ এদেরকে বলবেন, তোমরা যাদের দেখাতে তাদের নিকট যাও, দেখ তাদের কাছে তোমাদের পুরস্কার পাও কি না!’’[2]
অন্য হাদীসে আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
أَلا أُخْبِرُكُمْ بِمَا هُوَ أَخْوَفُ عَلَيْكُمْ عِنْدِي مِنْ الْمَسِيحِ الدَّجَّالِ قَالَ قُلْنَا بَلَى فَقَالَ الشِّرْكُ الْخَفِيُّ أَنْ يَقُومَ الرَّجُلُ يُصَلِّي فَيُزَيِّنُ صَلاتَهُ لِمَا يَرَى مِنْ نَظَرِ رَجُلٍ
‘‘দাজ্জালের চেয়েও যে বিষয় আমি তোমাদের জন্য বেশি ভয় পাই সে বিষয়টি কি তোমাদেরকে বলব না? আমরা বললাম, হ্যাঁ, অবশ্যই বলুন। তিনি বলেন, বিষয়টি গোপন শির্ক। তা এই যে, একজন সালাতে দাঁড়াবে এরপর যখন দেখবে যে মানুষ তার দিকে তাকাচ্ছে তখন সে সালাত সুন্দর করবে।[3]
এখানে লক্ষণীয় যে, বান্দা যদি ইবাদতের ভক্তি ও বিনয় প্রকাশ একমাত্র আল্লাহর জন্যই মনে করে, কেবল মানুষের কিছু প্রশংসা আশা করে তবে তা রিয়া বলে গণ্য হবে। আর যদি বান্দা কেবল মানুষের দেখানোর জন্যই ইবাদতটি করে তবে তা শিরক আকবার বলে গণ্য হবে। উভয়ের পার্থক্য এই যে, প্রথম পর্যায়ে বান্দা লোক না দেখলেও ইবাদতটি পালন করবে। পক্ষান্তরে দ্বিতীয় পর্যায়ে বান্দা লোক না দেখলে ইবাদতটি পালনই করবে না।
[2] আহমদ, আল-মুসনাদ ৫/৪২৮-৪২৯; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১/১০২। হাদীসটির সনদ সহীহ।
[3] ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ২/১৪০৬; আলবানী, সহীহুুত তারগীব ১/৮৯। হাদীসটি হাসান।
মহান আল্লাহ এ বিশ্বের সবকছি একটি নির্ধারিত নিয়মের অন্তর্ভুক্ত করে সৃষ্টি করেছেন, যাকে ‘সুন্নাতুল্লাহ’ বলা হয়। যেমন আগুনে পোড়া, বিষে মৃত্যু হওয়া, রৌদ্রে গরম হওয়া, পানিতে ভিজলে ঠান্ডা লাগা, ঝড়ে বা প্রবল বাতাসে গাছপালা বা বাড়িঘর ভেঙ্গে যাওয়া ইত্যাদি। এরূপ কার্য-কারণ বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী সকলেই জানেন। মুমিন বিশ্বাস করেন যে, সব কিছুর মূল কারণ মহান আল্লাহর ইচ্ছা ও দয়া। জাগতিক এ নিয়ম আল্লাহরই সৃষ্টি এবং তাঁরই নিয়ন্ত্রণে তা কাজ করে। আল্লাহ ইচ্ছা করলে নিয়মের কার্যকারিত স্থগিত বা নষ্ট করতে পারেন। এরূপ বিশ্বাস সহ মুমিন বলতে পারেন, বৃষ্টিতে ভিজে ঠান্ডা লেগেছে, বৃষ্টির কারণে ফসল ভাল হয়েছে, বিষের প্রভাবে তার মৃত্যু ঘটেছে, ঝড়ের কারণে গাছগুলি ভেঙ্গে গিয়েছে, পচাবাসি খেয়ে পেট নষ্ট হয়েছে, ঔষধ খেয়ে শরীরটা ভাল লাগছে ... ইত্যাদি। এরূপ বলা কোনোরূপ অন্যায় বলে বিবেচিত হয় না, যদিও মুমিন এ সকল ক্ষেত্রেও মহান আল্লাহর ইচ্ছার কথা সুস্পষ্ট বলতে ভালবাসেন। তবে যদি কেউ বিশ্বাস করেন যে, আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়াই ঔষধ রোগ সারায়, বিষ মানুষ মারে, ঝড় গাছ ভাঙ্গে বা অনুরূপ কোনো বিশ্বাস যদি তিনি পোষণ করেন তবে তা ‘শিরক আকবার’ বলে গণ্য হবে।
আরেক প্রকার উপকরণ-ওসীলা আছে যা জাগতিক নয়, বরং বিশ্বাসের বিষয় মাত্র। বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাসের মাধ্যমে বিশ্বাসীদের মধ্যে বিশ্বাস জন্মে যে, বিশ্বের সকল বা বিশেষ কোনো কার্যের পিছনে অমুক কারণটি বিদ্যমান। অমুক কারণটি না হলে কার্যটি হতো না। যেমন একজন খৃস্টান বলতে পারেন, যীশুর ইচ্ছায় কাজটি হয়েছে, একজন হিন্দু বলতে পারেন, অমুক দেবী বা দেবতার করণে অমুক কাজটি হয়েছে। রাশির প্রভাবে বিশ্বাসী বলতে পারেন, অমুক রাশির প্রভাবে এ কাজটি হয়েছে।
জাগতিক উপকরণ এবং বিশ্বাসের উপকরণের মাধ্যমে পার্থক্য খুবই স্পষ্ট। জাগতিক উপকরণাদির ক্ষেত্রে বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী এবং সকল ধর্মের মানুষই একমত। কেউ যদি বলেন, খাদ্যে বিষক্রিয়ায় লোকটির পেট নষ্ট হয়েছে তবে কেউ কথাটিকে অবাস্তব বলে উড়িয়ে দিবেন না, তবে বিশ্বাসী বিশ্বাস করেন যে, মহান আল্লাহর ইচ্ছাতেই তা ঘটেছে। পক্ষান্তরে বিশ্বাস ভিত্তিক উপকরণ-ওসীলাগুলি অন্য বিশ্বাসের মানুষের পাগলামি বলে হেসে উড়িয়ে দিবেন।
একজন মুমিন তার বিশ্বাসভিত্তিক উপকরণাদি জানা ও বলার ক্ষেত্রে অবশ্যই কুরআন ও হাদীসের সুস্পষ্ট শিক্ষার উপর নির্ভর করবেন। জাগতিক ভাবে যা কারণ, উপকরণ বা ওসীলা নয় এবং কুরআন বা হাদীসে যাকে এরূপ উপকরণ বা কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয় নি তাকে কোনো কিছুর কারণ বা উপকরণ বলে উল্লেখ করলে তা বিশ্বাসের অবস্থা অনুসারে শির্ক আকবার বা শির্ক আসগার হতে পারে।
যেমন একজন মুমিন বলতে পারেন যে, যাকাত প্রদান না করার কারণে অনাবৃষ্টি হয়েছে, ওযনে, পরিমানে কম বা ভেজাল দেওয়ার কারণে জীবনযাত্রার কাঠিন্য ও অশান্তি ছড়িয়ে পড়েছে, ন্যায় বিচার না থাকাতে দেশের উপর বিদেশী শক্তির প্রাধান্য বেড়েছে... যিক্র-ইসতিগফারের কারণে রিযকে বরকত এসেছে, ঈমান ও তাকওয়ার প্রসারতার কারণে দেশে শান্তি ও বরকত এসেছে....। মুমিন এগুলি বলেন এবং বিশ্বাস করেন যে, এগুলি সত্যিকার কারণ ও উপকরণ-ওসীলা। কুরআন ও হাদীসে সুস্পষ্টত এগুলিকে এ সকল বিষয়ের কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
কিন্তু মুমিন বলতে পারেন না যে, অমুক রাশির প্রভাবে বৃষ্টি হয়েছে বা সুনামি হয়েছে বা অমুক রাশিতে চন্দ্র বা সূর্যগ্রহণের ফলে অমুক বিষয়টি ঘটেছে। কারণ এগুলি কখনোই জাগতিক বৈজ্ঞানিক কার্যকরণের অন্তর্ভুক্ত নয় এবং কুরআন-হাদীস নির্দেশিত কারণও নয়। বিশেষত প্রাচীন যুগের তারকা পূজারী বা গ্রহ-নক্ষত্রের পূজারিগণ রশি বা গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাবে বিশ্বাসী ছিলেন। এ কথাগুলি তাদেরই কথা। যদি কেউ প্রকৃতই বিশ্বাস করেন যে, রাশিচক্র ইত্যাদির নিজস্ব প্রভাব আছে বিশ্ব পরিচালনা ও বিশ্বের বিভিন্ন বিষয় সংঘটনের ক্ষেত্রে তবে তিনি শিরক আকবারে লিপ্ত প্রকৃত মুশরিক বলে গণ্য।
অনুরূপভাবে যদি কেউ মনে করেন আল্লাহর ইচ্ছাতেই এরূপ হয়, তবে আল্লাহ অমুক রাশি উপলক্ষে এরূপ করেন তবে তা শিরক আসগার পর্যায়ের কঠিন কবীরা গোনাহ বলে গণ্য হবে। কারণ তিনি বাহ্যত শিরকী কথা বলেছেন এবং আল্লাহর নেয়ামত অন্য কিছুর প্রতি আরোপ করেছেন। উপরন্তু তা আল্লাহর নামে কঠিন মিথ্যচার বলে গণ্য হবে। কারণ কখনো কোথাও অল্লাহ ওহীর মাধ্যমে জানান নি যে, এগুলি এরূপ বিষয়ের কারণ।
আর যদি কেউ পূর্ববর্তী ধর্মের প্রভাবে কথার মধ্যে এরূপ বলে ফেলেন কিন্তু তিনি বিশ্বাস করেন যে, এগুলির একমাত্র পরিচালক আল্লাহ, রাশিচক্র বা অনুরূপ কোনো কিছু এক্ষেত্রে কোনোরূপ দখল নেই, তবে তা ‘শিরক আসগার’ বলে গণ্য হবে, যা কঠিন কবীরা গোনাহ। কারণ তিনি মহান আল্লাহর দেওয়া একটি নিয়ামতকে এমন বিষয়ের সাথে সংযুক্ত করেছেন যার সাথে এর কোনোরূপ সম্পর্ক নেই। তিনি তার কথায় আল্লাহর নিয়ামত অস্বীকার করেছেন।
যাইদ ইবনু খালিদ আল-জুহানী (রাঃ) বলেন, হুদাইবিয়ায় অবস্থানকালে রাত্রিকালে কিছু বৃষ্টিপাত হয়। প্রত্যুষে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদের নিয়ে সালাতুল ফাজর আদায় করেন। সালাত শেষ করে তিনি সমবেত মানুষদের দিকে মুখ করে বলেন, তোমরা কি জান, তোমাদের রবব কি বলেছেন? তাঁরা বলেন, ‘আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল উত্তম জানেন’। তিনি বলেন, মহান আল্লাহ বলেছেন,
قَالَ أَصْبَحَ مِنْ عِبَادِي مُؤْمِنٌ بِي وَكَافِرٌ فَأَمَّا مَنْ قَالَ مُطِرْنَا بِفَضْلِ اللَّهِ وَرَحْمَتِهِ فَذَلِكَ مُؤْمِنٌ بِي كَافِرٌ بِالْكَوْكَبِ وَأَمَّا مَنْ قَالَ مُطِرْنَا بِنَوْءِ كَذَا وَكَذَا فَذَلِكَ كَافِرٌ بِي مُؤْمِنٌ بِالْكَوْكَبِ
‘‘আমার বান্দাদের মধ্যে কেউ সকালে আমার প্রতি ঈমান এনেছে এবং কেউ আমার প্রতি কুফ্রী করেছে। যে ব্যক্তি বলেছে, আমরা আল্লাহর মহানুভবতা ও দয়ার কারণে বৃষ্টি পেয়েছি সে আমার প্রতি ঈমানদার এবং গ্রহনক্ষত্রের প্রতি কাফির। আর যে ব্যক্তি বলেছে, আমরা অমুক অমুক রাশির ফলে বৃষ্টি পেয়েছি তারা আমার প্রতি কুফরী করেছে এবং গ্রহনক্ষত্রে ঈমান এনেছে।’’[1]