ইতোপূর্বে দ্বিতীয় অধ্যায়ে তাওহীদের প্রসঙ্গে আমরা ‘শিরক’ শব্দটির অর্থ আলোচনা করেছি। আমরা দেখেছি যে, আরবীতে শির্ক (شِرْك) অর্থ অংশীদার হওয়া (to share, participate, be partner, associate)। ইশরাক (إشراك) ও তাশ্রীক (تَشْرِيك) অর্থ অংশীদার করা বা বানানো। সাধারণভাবে ‘শির্ক’ শব্দটিকেও আরবীতে ‘অংশীদার করা’ বা ‘সহযোগী বানানো’ অর্থে ব্যবহার করা হয়। ইসলামী পরিভাষায় আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে আল্লাহর কোনো বিষয়ে আল্লার সমকক্ষ মনে করা বা আল্লাহর প্রাপ্য কোনো ইবাদত আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য পালন করা বা আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ডাকাকে শিরক বলা হয়। এক কথায় ‘আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট কোনো বিষয় অন্য কাউকে অংশী বানানোই শির্ক।’
কুরআনের ভাষায় শিরক হলো কাউকে ‘আল্লাহর সমতূল্য’ করা। মহান আল্লাহ বলেন:
فَلا تَجْعَلُوا لِلَّهِ أَنْدَادًا وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ
অতএব তোমরা জেনেশুনে কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ বানাবে না।’’[1]
অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন:
وَجَعَلُوا لِلَّهِ أَنْدَادًا لِيُضِلُّوا عَنْ سَبِيلِهِ
‘‘এবং তারা আল্লাহর সমতুল্য উদ্ভাবন করে তাঁর পথ থেকে বিভ্রান্ত করার জন্য।’’[2]
আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন,
سَأَلْتُ أَوْ سُئِلَ رَسُولُ اللَّهِ (ﷺ) أَيُّ الذَّنْبِ عِنْدَ اللَّهِ أَكْبَرُ قَالَ أَنْ تَجْعَلَ لِلَّهِ نِدًّا وَهُوَ خَلَقَكَ
‘‘আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে প্রশ্ন করলাম, আল্লাহর নিকট সবচেয়ে কঠিন পাপ কী? তিনি বলেন: সবচেয়ে কঠিন পাপ এই যে, তুমি আল্লাহর সমকক্ষ বানাবে অথচ তিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।’’[3]
এভাবে আমরা দেখছি যে কাউকে মহান আল্লাহর ‘নিদ্দ’ মনে করাই শিরক। আরবীতে ‘নিদ্দ’’ (الندّ) অর্থ সমতুল্য, মত, সমকক্ষ, তুলনীয় ইত্যাদি। কাউকে মহান আল্লাহর রুবূবিয়্যাত, আসমা, সিফাত বা ইলাহিয়্যাত-এর ক্ষেত্রে তাঁর সমতুল্য মনে করা, অথবা আল্লাহকে যে ভক্তি প্রদর্শন করা হয় বা আল্লাহর জন্য যে ইবাদত করা হয় তা অন্য কাউকে প্রদান করাই শিরক।[4]
এখানে কয়েকটি বিষয় প্রনিধানযোগ্য:
প্রথমত, কুফর ও শিরক পরস্পর অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। কাউকে কোনোভাবে কোনো বিষয়ে মহান আল্লাহর সমকক্ষ বা তুলনীয় মনে করার অর্থই তাঁর একত্বে অবিশ্বাস বা কুফরী করা। আল্লাহর তাওহীদ ও রাসূলগণের দাও‘আতে অবিশ্বাস না করে কেউ শির্ক করতে পারে না। কাজেই শি্রকের অর্থই তাওহীদ ও রিসালাতে অবিশ্বাস করা। অপরদিকে কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ না মেনে ঈমানের কোনো রুকন অবিশ্বাস করলে তা শুধু কুফর বলে গণ্য। যেমন যদি কেউ আল্লাহর অস্তিত্বে বা তাঁর প্রতিপালনের একত্বে অবিস্বাস করেন বা মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর রিসালাত, খাতমুন নুবুওয়াত ইত্যাদি অস্বীকার করেন তবে তা কুফর হলেও বাহ্যত তা শিরক নয়। কারণ এরূপ ব্যক্তি সুস্পষ্ট কাউকে আল্লাহর সাথে তুলনীয় বলে দাবি করছে না। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এরূপ কুফরের সাথেও শিরক জড়িত। কারণ এরূপ ব্যক্তি কোনো না কোনোভাবে এ ক্ষয়িষ্ণু জড় বিশ্বকে মহান আল্লাহ মত অনাদি-অনন্ত বলে বিশ্বাস করছে, বিশ্ব পরিচালনায় প্রকৃতি বা অন্য কোনো শক্তিকে বিশ্বাস করছে।
দ্বিতীয়ত, কুফর বা অবিশ্বাসের অন্যতম প্রকাশ শিরক। সাধারণভাবে যুগে যুগে অবিশ্বাসীগণ মহান আল্লাহর অস্তিত্ব, তাঁর গুণাবালি বা তাঁর মা’বুদিয়্যাত বা উপাস্যত্ব অস্বীকার করে কুফরী করে নি, বরং এগুলিতে তার সাথে অন্য কাউকে শরীক বা অংশীদার বলে বিশ্বাস করেই কুফরী করেছে। এজন্য কুরআন ও হাদীসে কুফরের বর্ণনায় শিরকের কথাই বেশি বলা হয়েছে।
তৃতীয়ত, মহান আল্লাহর কোনো সমকক্ষ কল্পনা করা বা শিরকের বিভিন্ন প্রকার ও প্রকরণের দিকে দৃষ্টি দিলে আমরা বুঝতে পারি যে, দুভাবে শিরক হয়ে থাকে: (১) মহান আল্লাহর কোনো সৃষ্টির প্রতি অতি-সুধারণা অথবা (২) মহান আল্লাহর প্রতি কু-ধারণা বা অব-ধারণা।
শিরকে নিপতিত মানুষেরা কখনো ফিরিশতা, নবী, ওলী, নেককার মানুষ, কারামত-প্রাপ্ত মানুষ, তাদের স্মৃতিবিজড়িত স্থান, পাহাড়, সূর্য, চন্দ্র ইত্যাদি কোনো সৃyুষ্টর বিষয়ে ভক্তি ও মর্যাদা প্রদানে অতিরঞ্জন করে তাদের মধ্যে ‘অলৌকিক শক্তি’ বা ঐশ্বরিক ক্ষমতা কল্পনা করেছে। অথবা মহান আল্লাহর পূর্ণতার গুণের প্রতি কু-ধারণা পোষণ করে তাকে সৃষ্টির মত কল্পনা করেছে এবং তাঁর সন্তান, পরিষদ, ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা ইত্যাদি কল্পনা করেছে।
কুরআন-হাদীসে উল্লিখিত শিরক এবং বিশ্বের বিভিন্ন জাতির শিরক পর্যালোচনা করলে আমরা মূলত এ দুটি বিষয়ই দেখতে পাই। এবং এদুটি বিষয়ও পরস্পর অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। কারো প্রতি ভক্তির অতিরঞ্জর অর্থই আল্লাহর ক্ষমতা, রুবূবিয়্যাত ও উলূহিয়্যাতের প্রতি কু-ধারণা পোষণ করা।
[2] সূরা (১৪) ইবরাহীম: ৩০ আয়াত। আরো দেখুন: সূরা (২) বাকারা: ১৬৫, সূরা (৩৪) সাবা: ৩৩, সূরা (৩৯) যুমার: ৮; সূরা (৪১) ফস্সিলাত (হামীম): ৯ আয়াত।
[3] বুখারী, আস-সহীহ ৪/১৬২৬, ৫/২২৩৬, ৬/২৪৯৭, ২৭৩৯; মুসলিম, আস-সহীহ ১/৯০-৯১।
[4] তাবারী, তাফসীর (জামিউল বায়ান) ১/১৬৩-১৬৪।