ঈমানের অন্যতম বিষয় আল্লাহর রাসূলগণে বিশ্বাস করা। অর্থাৎ এ বিশ্বাস পোষণ করা যে, আল্লাহ যুগে-যুগে মানব জাতির সঠিক পথের দিশা দানের জন্য মানুষদের মধ্য থেকে অসংখ্য মানুষকে মনোনীত করে তাঁদেরকে তাঁর বাণী দান করেন এবং মানুষদেরকে সত্য ও কল্যাণের পথে আহবানের দায়িত্ব তাঁদেরকে দান করেন। এরা সবাই মহান চরিত্রের অধিকারী ও কল্যাণময় মানুষ ছিলেন। এরা সবাই তাঁদের দায়িত্ব যথাযত পালন করেন। এদের অধিকাংশের নাম বা বিবরণ আমরা জানিনা। শুধু যাদের নাম কুরআন কারীমে উল্লেখ করা হয়েছে তাঁদেরকে আমরা নির্দিষ্টভাবে নবী বা রাসূলরূপে বিশ্বাস করি। অন্য কাউকে আমরা নিশ্চিতরূপে আল্লাহর রাসূল বলে মনে করতে পারিনা, যদিও আমরা বিশ্বাস করি যে, সকল যুগে সকল দেশে আল্লাহ নবী রাসূল প্রেরণ করেছেন। আমরা এদের সবাইকে বিশ্বাস করি, শ্রদ্ধা করি এবং ভালবাসি। আর সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ট নবী মুহাম্মদ (ﷺ)-এর আমরা অনুসরণ করি এবং তাঁর শরীয়ত মত জীবন পরিচালনা করি। আমরা এ অধ্যায়ে মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর রিসালাতের প্রতি ঈমানের অর্থ আলোচনা করব। পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা ঈমানের অবশিষ্ট রুকনগুলি আলোচনা প্রসঙ্গে অন্যান্য নবী ও রাসূলের প্রতি ঈমানের অর্থ আলোচনা করব।
৩. ১. রিসালাতের সাক্ষ্য
৩. ১. ১. শাহাদাতের তিনটি শব্দ
আমরা দেখেছি যে, শাহাদাতাইনের দ্বিতীয় অংশে (মুহাম্মাদান আব্দুল্লাহ ওয়ারাসূলুহু) বলে সাক্ষ্য দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এখানে তিনটি শব্দ আছে: মুহাম্মাদ, আবদ ও রাসূল। রিসালাতের বিশ্বাসের অর্থ আলোচনা করার আগে আমরা এই তিনটি শব্দের অর্থ ও ব্যাখ্যা অনুধাবনের চেষ্টা করব।
প্রথমে আমাদের জানা দরকার মহানবী মুহাম্মাদ (ﷺ) কে ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে আমরা সবাই কমবেশী রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জীবন ও চরিত্র সম্পর্কে অবগত আছি। তা সত্ত্বেও তার জীবনী আলোচনার মধ্যে রয়েছে অনেক কল্যাণ। এখানে আমরা সংক্ষেপে তাঁর পরিচয় উল্লেখ করব।
৩. ১. ২. ১. দেশ ও বংশ
আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বৎসর আগে মহানবী মুহাম্মাদ (ﷺ) আরব দেশের প্রাণ কেন্দ্র পবিত্র মক্কা শহরে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ছিল আব্দুল্লাহ, আব্দুল্লাহর পিতা আব্দুল মুত্তালিব, তার পিতা হাশিম। হাশিম ছিলেন কুরাইশ বংশের, কুরাইশ একটি আরব গোত্র, যারা ইব্রাহীম (আঃ)-এর পুত্র ইসমাঈল (আঃ)-এর বংশধর।
কুরাইশ বংশ ছিল আরবের শ্রেষ্ঠ বংশ। এ বংশের মধ্যে হাশিমের পরিবার ছিল অত্যন্ত সম্মানিত পরিবার। মক্কাবাসীরা তাদেরকে ধর্মীয় ও সামাজিক নেতৃত্বের আসনে স্থান দেন। এই হাশিম পরিবারের অন্যতম নেতা ছিলেন আব্দুল মুত্তালিব। তিনি তার পুত্র আব্দুল্লাহকে মক্কার কুরাইশ বংশের অপর শাখা বানূ যুহ্রার নেতা ওয়াহ্ব ইবনু আব্দু মানাফ বিন যুহরার কন্যা আমিনার সাথে বিবাহ দেন। বিবাহের কয়েক মাস পরে, মহানবী মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর জন্মের কয়েক মাস পূর্বে আব্দুল্লাহ খেজুর আনার জন্য মদীনায় (ইয়াসরিবে) তার মাতুলালয়লে গমন করেন। সেখানে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মৃত্যু বরণ করেন। মৃত্যুর সময় তার বয়স ছিল মাত্র ২৫ বৎসর।
৩. ১. ২. ২. জন্ম
আব্দুল্লাহর মৃত্যুর কয়েক মাস পরে মহানবী মুহাম্মাদ (ﷺ) জন্মগ্রহণ করেন। হাদীস শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ‘আমুল ফীল’ (عام الفيل) বা হাতির বৎসরে জন্মগ্রহণ করেন।[1] হাতীর বছর অর্থাৎ যে বৎসর আবরাহা হাতি নিয়ে কাবা ঘর ধ্বংসের জন্য মক্কা শরীফ আক্রমণ করেছিল। ঐতিহাসিকদের মতে এ বছর ৫৭০ বা ৫৭১ খ্রিষ্টাব্দ ছিল।[2]
সহীহ হাদীস থেকে স্পষ্টরূপে জান যায় যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সোমবার জন্মগ্রহণ করেছেন।[3] হাদীসে নববী থেকে তাঁর জন্মমাস ও জন্মতারিখ সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। সাহাবীগণের মাঝেও এ বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট মত প্রচলিত ছিল না। একারণে পরবর্তী যুগের আলিম ও ঐতিহাসিকগণ তাঁর জন্মতারিখ সম্পর্কে অনেক মতভেদ করেছেন। এ বিষয়ে ১২টিরও বেশি মত রয়েছে। ইবনু হিশাম, ইবনু সা’দ, ইবনু কাসীর, কাসতালানী ও অন্যান্য ঐতিহাসিক এ বিষয়ে নিম্নলিখিত মতামত উল্লেখ করেছেন:
(১). কারো মতে তাঁর জন্মতারিখ অজ্ঞাত, তা জানা যায়নি এবং জানা সম্ভব নয়। তিনি সোমবারে জন্মগ্রহণ করেছেন এটুকুই শুধু জানা যায়, জন্ম মাস বা তারিখ জানা যায় না। এ বিষয়ে কোনো আলোচনা তারা অবান্তর মনে করেন।
(২). কারো কারো মতে তিনি মুহাররাম মাসে জন্মগ্রহণ করেছেন।
(৩). অন্য মতে তিনি সফর মাসে জন্মগ্রহণ করেছেন।
(৪). কারো মতে তিনি রবিউল আউআল মাসের ২ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। দ্বিতীয় হিজরী শতকের অন্যতম ঐতিহাসিক মুহাদ্দিস আবু মা’শার নাজীহ বিন আব্দুর রাহমান আস-সিনদী (১৭০ হি.) এই মতটি গ্রহণ করেছেন।
(৫). অন্য মতে তাঁর জন্মতারিখ রবিউল আউয়াল মাসের ৮ তারিখ। আল্লামা কাসতালানী ও যারকানীর বর্ণনায় এই মতটিই অধিকাংশ মুহাদ্দিস গ্রহণ করেছেন। এই মতটি দুইজন সাহাবী ইবনু আববাস (রা) ও জুবাইর বিন মুতয়িম (রা) থেকে বর্ণিত। অধিকাংশ ঐতিহাসিক ও সীরাত বিশেষজ্ঞ এই মতটি গ্রহণ করেছেন বলে তারা উল্লেখ করেছেন।
(৬). অন্য মতে তাঁর জন্মতারিখ ১০-ই রবিউল আউয়াল। এ মতটি ইমাম হুসাইনের পৌত্র মুহাম্মাদ ইবনু আলী আল বাকের (১১৪ হি) থেকে বর্ণিত। প্রসিদ্ধ তাবিয়ী আমির ইবনু শারাহিল আশ শাবী (১০৪ হি.) থেকেও মতটি বর্ণিত। ঐতিহাসিক মুহাম্মাদ ইবনু উমর আল-ওয়াকিদী (২০৭ হি) এই মত গ্রহণ করেছেন। ইবনু সা’দ তার বিখ্যাত ‘‘আত-তাবাকাতুল কুবরা’’-য় শুধু দুইটি মত উল্লেখ করেছেন, ২ তারিখ ও ১০ তারিখ।[4]
(৭). কারো মতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর জন্মতারিখ ১২ রবিউল আউয়াল। এই মতটি দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দীর প্রখ্যাত ঐতিহাসিক মুহাম্মাদ ইবনু ইসহাক (১৫১ হি) গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেছেন: ‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হাতির বছরে রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন।’’[5] এখানে লক্ষণীয় যে, ইবনু ইসহাক সীরাতুন্নবীর সকল তথ্য সাধারণত সনদসহ বর্ণনা করেছেন, কিন্তু এই তথ্যটির জন্য কোনো সনদ উল্লেখ করেননি। কোথা থেকে তিনি এই তথ্যটি গ্রহণ করেছেন তাও জানাননি বা সনদসহ প্রথম শতাব্দীর কোনো সাহাবী বা তাবেয়ী থেকে মতটি বর্ণনা করেননি। এ জন্য অনেক গবেষক এই মতটিকে দুর্বল বলে উল্লেখ করেছেন[6]। তা সত্ত্বেও পরবর্তী যুগে এই মতটিই প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। ইবনু কাসীর উল্লেখ করেছেন যে ২ জন সাহাবী জাবির (রা) ও ইবনু আববাস (রা) থেকে এই মতটি বর্ণিত।
(৮). অন্য মতে তাঁর জন্মতারিখ ১৭-ই রবিউল আউয়াল।
(৯). অন্য মতে তাঁর জন্ম তারিখ ২২-শে রবিউল আউয়াল।
(১০). অন্য মতে তিনি রবিউস সানী মাসে জন্মগ্রহণ করেছেন।
(১১). অন্য মতে তিনি রজব মাসে জন্মগ্রহণ করেছেন।
(১২). অন্য মতে তিনি রমযান মাসে জন্মগ্রহণ করেন। ৩য় হিজরী শতকের প্রখ্যাত ঐতিহাসিক যুবাইর ইবনু বাক্কার (২৫৬ হি) থেকে এ মতটি বর্ণিত। তাঁর মতের পক্ষে যুক্তি হলো যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সর্বসম্মতভাবে রমযান মাসে নুবুওয়াত পেয়েছেন। তিনি ৪০ বৎসর পূর্তিতে নুবুয়্যত পেয়েছেন। তাহলে তাঁর জন্ম অবশ্যই রমযানে হবে। এছাড়া কোনো কোনো হাদীসে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হজ্বের পবিত্র দিনগুলিতে মাতৃগর্ভে আসেন। সেক্ষেত্রেও তাঁর জন্ম রমযানেই হওয়া উচিত। এ মতের সমর্থনে আব্দুল্লাহ ইবনু উমর (রা) থেকে একটি বর্ণনা আছে বলে কেউ কেউ উল্লেখ করেছেন।[7]
৩. ১. ২. ৩. শৈশব ও কৈশর
জন্মের পরে তাঁর মাতা তাঁর নাম রাখেন ‘‘আহমাদ’’, আর তার দাদা আব্দুল মুত্তালিব তার নাম রাখেন ‘‘মুহাম্মদ’’। মক্কার আধিবাসীরা তাদের নবজাতক সন্তানদেরকে সাধারণত শহরের বাইরে বেদুইন গোত্রদের মধ্যে কিছুদিন লালান পালন করতেন, যেন তারা শহরের মিশ্র পরিবেশের বাইরে বেদুইনদের মাঝে পরিপূর্ণ মানসিক ও দৈহিক পূর্ণতা ও স্বাবলম্বিতা নিয়ে গড়ে ওঠে এবং তাদের ভাষা বিশুদ্ধ হয়। এ নিয়মে জন্মের কিছুদিন পরে মক্কার বাইরে, মক্কা ও তায়েফের মধ্যবর্তী এলাকার বেদূইন গোত্র বনু সা’দের হালীমা বিনতু আবু যু‘আইব নামক এক মহিলা শিশু মুহাম্মদ (ﷺ)-এর লালন পালনের ভার গ্রহণ করেন। তিনি সেখানে ৫ বৎসর কাটান।
এরপর তিনি মক্কায় তাঁর মাতার কাছে ফিরে আসেন। প্রায় এক বৎসর পর তাঁর মাতা মৃত্যুবরণ করেন। তখন তাঁর দাদা আব্দুল মুত্তালিব তাঁর লালন পালনের ভার গ্রহন করেন। আব্দুল মুত্তালিব তার এই এতিম পৌত্রকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। ২ বৎসর পরে, ৮ বৎসর বয়সে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর দাদাকেও হারান। মৃত্যুর সময় আব্দুল মুত্তালিব তার পুত্র আবূ তালিবের উপর দায়িত্ব দেন এতিম বালক মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর লালন পালনের। পরবর্তী প্রায় ১৭ বৎসর তিনি তাঁর চাচা আবু তালিবের পরিবারেই অবস্থান করেন।
এসময়ে তিনি মাঝেমাঝে তার চাচার ও অন্যান্য মক্কাবাসীদের ছাগল- ভেড়া চরাতেন মক্কার প্রান্তরে। কখনো চাচার সাথে ব্যবসায়ের ভ্রমণে অংশ নিয়েছেন। তিনি সাধারণ যুবকদের মত গল্পগুজব পছন্দ করতেন না। তিনি কখন কোনো মূর্তিকে স্পর্শ করেন নি । মক্কায় প্রচলিত বিাভন্ন কুসংস্কার ও সামাজিক অনাচারকে তিনি অত্যন্ত ঘৃণা করতেন। ৫৯১ খৃষ্টাব্দের দিকে, যখন তার বয়স প্রায় ২০ বৎসর, মক্কার কিছু সৎ ও সাহসী যুবক একত্রিত হয়ে শপথ গ্রহণ করেন যে, তারা সমাজের অত্যাচার রোধ করবেন। শক্তের অত্যাচার থেকে দুর্বলকে রক্ষা করবেন এবং দুর্বলের অধিকার আদায় করে দেবেন। যুবক মুহাম্মদ (ﷺ) এই শপথে অংশ গ্রহণ করেন।
৩. ১. ২. ৪. বিবাহ ও নুবুওয়াত-পূর্ব জীবন
২৫ বৎসর বয়সে তিনি খাদীজা বিনতু খুয়াইলিদ নামক মক্কার একজন ধনী ব্যবসায়ী মহিলার ব্যবসায়ের সামগ্রী নিয়ে সিরিয়ায় গমন করেন। খাদীজা তার সততা ও চারিত্রিক পবিত্রতায় খুবই মুগ্ধ হন। তিনি তার সাথে বিবাহের আগ্রহ প্রকাশ করেন। উভয়পক্ষের অভিভাবকদের সম্মতি ও মধ্যস্থতায় বিবাহ সম্পন্ন হয়। এসময়ে খাদিজার বয়স ছিল প্রায় ৪০ বৎসর, এবং মহানবীর বয়স ছিল ২৫ বৎসর।
বিবাহের পরে খাদিজা তার সকল সম্পদ স্বামীর হাতে সমর্পন করেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর সম্পদ বিভিন্ন জনহিতকর কাজে ব্যয় করতেন। তিনি অনাথদের লালন পালন, অসহায ও দুস্থদের সেবা, মুসাফিরদের আতিথেয়তা, আত্মীয়-স্বজনের দেখাশুনা, বিপদগ্রস্তদের সাহায্য ইত্যাদি কর্মে ব্যস্ত থাকতেন। এ সময়ে তিনি তাঁর সেবা, সততা, অমায়িক ব্যবহার ও চারিত্রিক পবিত্রতার জন্য সমাজে এতই প্রসিদ্ধ হন যে, সমাজের লোকেরা তাঁকে আল আমীন (বিশ্বস্ত) ও আস সাদিক (সত্যবাদী) ইত্যাদী বিশেষণে আখ্যায়িত করত। বিভিন্ন সামাজিক বিরোধিতায় তারা তাঁর সিদ্ধান্ত ও মধ্যস্থতা মেনে নিত।
এ বিষয়ে কাবাঘর নির্মাণকালে হাজার আসওয়াদ বা কাল পাথর পুনস্থাপন বিষয়ক ঘটনাটি উল্লেখযোগ্য। কাবাঘরের সংস্কার ও পুনর্নিমাণের পরে পবিত্র হাজ্র আসওয়াদকে কাবাগৃহের দেওয়ালে নির্দিষ্ট স্থানে পুনস্থাপন করার বিষয়ে মক্কার প্রতিটি গোত্র নিজেদের অগ্রাধিকার দাবি করে। প্রত্যেকে তার দাবিতে অনড় থাকে এবং অধিকার রক্ষার্থে যুদ্ধের প্রতিজ্ঞা করে। মক্কাবাসীরা এক ভয়ঙ্কর গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়। একপর্যায়ে নেতৃবৃন্দ একমত হন যে, প্রথম যে ব্যক্তি গিরিপথের মধ্য থেকে তাদের সামনে আগমন করবেন সকলেই তার সিদ্ধান্ত মেনে নিবেন। এ সময়ে মুহাম্মাদ (ﷺ) তথায় উপস্থিত হন। তারা সকলেই আনন্দিত হয়ে বলে উঠেন, আল-আমিন এসেছেন! তখন তিনি নিজের চাদরটি বিছিয়ে নিজ হাতে পাথরটি তুলে চাদরের উপর রাখেন। এরপর বিবাদমান সকল গোত্রকে আহবান করেন চাদরটি চারিদিক থেকে ধরে পাথরটি কাবাগৃহের নিকটে নিয়ে যাওয়ার। এরপর তিনি নিজ হাতে পাথরটি কাবার প্রাচীরে পুনস্থাপন করেন। এভাবে মক্কাবাসী ভয়ঙ্কর গৃহযুদ্ধ থেকে রক্ষা পায়। এ ঘটনায় নবুয়তের পূর্বেই মক্কাবাসীর মধ্যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর গ্রহণযোগ্যতা, বিশ্বস্ততা ও তাঁর তীক্ষ্ণ বুদ্ধির প্রমাণ পাওয়া যায়। অধিকাংশ ঐতিহাসিক একমত যে, এ ঘটনাটি ঘটেছিল নুবুওয়াতের ৫ বৎসর পূবে, যখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বয়স ছিল ৩৫ বৎসর। কোনো কোনো ঐতিহাসিক উল্লেখ করেছেন যে, এ ঘটনার সময় তাঁর বয়স ছিল ২৫ বৎসর। কেউ কেউ বলেছেন যে, তাঁর কিশোর বয়সে এ ঘটনাটি ঘটেছিল।[8]
৩. ১. ২. ৫. নুবুওয়াত ও মাক্কী জীবন
৪০ বৎসর বয়সে তিনি ক্রমান্বয়ে আল্লাহর ইবাদত ও ধ্যানে আগ্রহী হয়ে পড়েন। তিনি মক্কার বাইরে হেরা পাহাড়ের গুহায় বসে রাতদিন আল্লাহর স্মরণে মগ্ন থাকতেন। এ বছরেই, অর্থাৎ ৬১০ খৃষ্টাব্দে রমযান মাসে সোমবার (ইংরেজী আগস্ট মাসে), ৪০ বৎসর বয়সে তিনি নবুয়ত প্রাপ্ত হন। আল্লাহর পক্ষ থেকে ফিরিশতাগনের নেতা জিবরীল আল- আমীন (আঃ) ওহী নিয়ে হেরা পাহাড়ের গুহায় আসেন এবং তাকে কুরআন কারীমের সূরা ইকরার প্রথম কয়েক আয়াত শিক্ষা দান করেন।
এর পরে তিনি আল্লাহর নির্দেশে গোপনে মানুষদেরকে একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করার জন্য এবং আল্লাহ ছাড়া সকল উপাস্যকে পরিত্যাগ করার জন্য আহবান জানাতে থাকেন। এভাবে তিন বৎসর তিনি গোপনে ইসলাম প্রচার করেন। এ সময়ে মক্কার কিছু সৎ ও নীতিবান যুবক ইসলাম গ্রহণ করেন।
এর পর আল্লাহ তাকে প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচারের নির্দেশ দেন। তার নবুয়ত প্রাপ্তির ৪র্থ বৎসর থেকে তিনি প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। পরবর্তী প্রায় দশ বৎসর তিনি মক্কায় ইসলাম প্রচারে রত থাকেন।
এসময়ে মূলত তিনি মুলত তাওহীদুল ইবাদাত বা ইবাদতের তাওহীদের দাওয়াত প্রচার করেন। পাশাপাশি সততা, নৈতিকতা, মানবতা, মানবসেবা ইত্যাদি মৌলিক বিষয় পালনের এবং শির্ক, হত্যা, হানাহানি অত্যাচার ইত্যাদি অমানবিক কর্ম বর্জনের জন্য আহবান করতেন। ইসলামের অন্যান্য বিধান যেমন, পাঁচ ওয়াক্ত সালাত, রমযানের সিয়াম, হজ্জ, যাকাত ইত্যাদি তখনো প্রবর্তিত হয়নি। এগুলি কিছু মক্কী জীবনের একেবারে শেষে এবং বাকি সকল বিধান মদীনায় হিজরতের পরে অবতীর্ণ হয়।
কুরাইশ নেতৃবৃন্দ কঠোরভাবে তাঁর এ আহবান প্রত্যাখ্যান করে। আমরা দেখেছি যে, তারা আল্লাহকে একমাত্র স্রষ্টা, সর্বশক্তিমান ও প্রতিপালক হিসাবে বিশ্বাস করতেন এবং আল্লাহর ইবাদত করত। পাশাপাশি তারা আল্লাহর প্রিয় ও আল্লাহর সাথে বিশেষ সম্পর্কযুক্ত বান্দা হিসেবে ফিরিশতা, কোনো কোনো নবী, কোনো কোনো কল্পিত ব্যক্তিত্ব ও অন্যান্য দেবদেবীর ইবাদত করত। তারা এদের ইবাদত করাকে পিতাপিতামহদের মাধ্যমে প্রাপ্ত ইবরাহীম-ইসামাঈল (আঃ)-এর সঠিক ধর্ম বলে বিশ্বাস করত। এজন্য এদের ইবাদত পরিত্যাগ করে একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করতে অস্বীকার করে। আল্লাহ ছাড়া কেউই ইবাদতের যোগ্য নন এ কথাকে তারা উদ্ভট ও অবন্তর কথা এবং যুগযুগ ধরে প্রচলিত পিতা পিতামহের আচরিত ধর্মের অবমাননা বলে মনে করে। তারা বিভিন্ন ভাবে মহানবী মুহাম্মদ (ﷺ)-কে অপমান ও অত্যাচার করতে থাকেন। তাঁর দাওয়াতের যৌক্তিকতা খন্ডন করার কোনো ক্ষমতা তাদের ছিল না। তারা বুঝতে পারে যে, তাঁর বক্তব্য শুনলে যে কোনো বিবেকবান মানুষ তার বক্তব্য গ্রহণ করবেই। এজন্য তারা মানুষদেরকে তার থেকে দূরের রাখার জন্য চেষ্টা করে। তাকে ধর্মত্যাগী, ধর্মের অবমাননাকারী, যাদুকর, কবি ইত্যাদি বলে মানুষদের মনে তাঁর প্রতি ঘৃণা সৃষ্টির জন্য তারা সর্বতোভাবে চেষ্টা করে।
তাদের শত অপপ্রচার ও বাধা সত্ত্বেও ক্রমে ইসলামের বাণী মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। বেশ কিছু সংখ্যক মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেন। তখন কুরাইশ নেতৃবৃন্দ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। তারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ডাকে সাড়া দানকারী নও মুসলিমদের উপর অকথ্য অত্যচার নির্যাতন শুরু করে। কোনো অত্যাচার নির্যাতন বা অপমান-লাঞ্ছনাই মহানবীকে সত্যের আহবান থেকে সরাতে পারে না। তিনি তার সকল অত্যচারের মধ্যেও একমাত্র আল্লাহর ইবাদতের দিকে মানুষদেরকে আহবান করতে থাকেন এবং মুসলিমদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। কাফিরদের সীমাহীন অত্যাচারের কারণে শতাধিক মুসলিম নারী ও পুরুষ আফ্রিকার ইথিওপিয়ায় হিজরত করেন। অবশিষ্ট অধিকাংশ মুসলিম তাওহীদ আকড়ে ধরে মক্কাবাসীদের অত্যাচার নীরবে সহ্য করতে থাকেন।
এত অত্যাচারের মাধ্যমেও ইসলামের অগ্রযাত্রা রোধ করতে অক্ষম হয়ে মক্কার সকল গোত্র একত্রিত হয়ে সকল মুসলিম এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বংশের মানুষদের সামাজিকভাবে বয়কট ও অবরুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। নুবুয়তের ৭ম থেকে ১০ম সন পর্যন্ত দীর্ঘ তিন বৎসর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর বংশের মানুষদের এবং মুসলিমদের নিয়ে পাহাড়ের উপত্যাকায় অবরুদ্ধ হয়ে অবর্ণনীয় কষ্টে অবস্থান করেন। এ সময়েও তিনি সাধ্যমত দীনের দাওয়াত অব্যাহত রাখেন।
নবুয়তের ১০ম বৎসরে অবরোধ থেকে মুক্তির কিছু দিন পরে, তাঁর চাচা আবু তালিব ও তার প্রিয়তমা স্ত্রী খাদিজা কিছু দিনের ব্যবধানে ইন্তেকাল করেন। তাঁর জন্য এ ছিল খুবই বেদনাময় বৎসর। স্ত্রীর মৃত্যুতে তিনি তাঁর ব্যাথ্যা-বেদনার প্রিয়তম সাথীকে হারান। অপর দিকে চাচার মৃত্যুতে তিনি সামাজিকভাবে অসহায় হয়ে পড়েন। কারণ আবু তালিব ছিলেন কুরাইশদের মধ্যে বিশেষ সম্মানিত নেতা। তিনি নিজে ইসলাম গ্রহণ না করলেও রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে অত্যন্ত ভালোবাসতেন এবং কুরাইশদের অত্যাচার থেকে তাকে রক্ষা করার চেষ্টা করতেন। তার কারণে অনেক সময় কুরাইশ নেতারা মহানবীকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করতে সাহস পেত না। আবু তালিবের মৃত্যুর পরে কুরাইশদের অত্যাচার শতগুণে বৃদ্ধি পায়। তারা তাকে কোনোভাবেই কথা বলতে দিত না। তেমনিভাবে তার ডাকে সাড়া দিয়ে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তাদের প্রতিও অত্যাচর শতগুণে বৃদ্ধি পায়।
এমতবস্থায় তিনি মক্কার বাইরে ইসলাম প্রচারের কথা চিন্তা করেন। তিনি এ বছরের শেষ দিকে (শাওয়াল মাসে, ৬১৯ খৃষ্টাব্দে মে/জুন মাসে) মক্কার প্রায় ১০০ কিলোমিটার পূর্বে তায়েফ শহরে গমণ করেন। তিনি তাঁর প্রিয় খাদিম যায়িদ বিন হারিসাকে সঙ্গে নিয়ে পায়ে হেঁটে তায়েফে গমণ করেণ। পথিমধ্যে যে সকল বেদুইন গোত্রকে তিনি দেখতে পান, তাদেরকে তিনি তাওহীদের আহবান জানান। তারা কেউই তার আহবানে কর্ণপাত করে না। তিনি তায়েফে প্রায় দশদিন যাবৎ তাওহীদের আহবান জানান। তিনি তায়েফের সকল গোত্রপ্রধান ও সাধারণ মানুষের কাছে ইসলামের আহবান জানান। তারা কেউই তার ডাকে সাড়া দেয় না। বরং তারা তায়েফের দুষ্টু ছেলেদেরকে তার পিছনে লেলিয়ে দেয়। ছেলেরা তায়েফের পথে পথে গালাগালি করে তাঁকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। উপরন্তু তারা তাঁকে পাথর ছুড়ে মারতে থাকে। তিনি রক্তাক্ত দেহে তায়েফ থেকে বেরিয়ে আসেন এবং ভগ্নহৃদয়ে মক্কায় ফিরে আসেন। সকল কষ্ট ও ব্যথা মেনে নিয়ে তিনি ইসলাম প্রচারের চেষ্টা করতে থাকেন, যদিও মক্কায় তাঁর অবস্থান বা ইসলাম প্রচার প্রায় অসম্ভব ছিল।
ইব্রাহিম (আঃ)-এর সময় থেকে মক্কায় কাবাঘরের হজ্জ প্রচলিত হয়। তখন থেকে আরবের বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষেরা যুলহাজ্জ মাসে মক্কায় এসে হজ্জ আদায় করত। যদিও পরবর্তীকালে তাদের মধ্যে শিরক, মূর্তিপূজা ও বিভিন্ন সামাজিক অন্যায় অনাচার ছড়িয়ে পড়ে, তবুও হজ্জ ও হাজীদের সম্মান ছিল তাদের বিশ্বাসের অংশ। তারা হজ্জের সময়ে সকল প্রকার মারামারি, দৈহিক অত্যাচারকে নিষিদ্ধ মনে করত। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হজ্জের এই সুযোগে গোপনে মক্কায় আগত বিভিন্ন এলাকার হাজীদের মধ্যে ইসলাম প্রচারের চেষ্টা করতে থাকেন। নবুয়তের ১১শ বৎসরের হজ্জ মাওসুমে (৬২০ খৃষ্টাব্দের জুলাই মাসে) মক্কার প্রায় ৪৫০ কিলোমিটার উত্তরের ইয়াসরীব (মদীনা) শহরে থেকে আগত ৬ জন যুবক হাজী রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ডাকে সাড়া দিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁরা হজ্জের পরে দেশে ফিরে গিয়ে সেখানে ইসলাম প্রচার করতে থাকেন।
পরবর্তী বৎসরে, নবুয়তের ১২শ বৎসরের হজ্জ মওসুমে (৬২১ খৃষ্টাব্দের জুলাই মাসে) মদীনার আরো কয়েকজন ইসলাম গ্রহণ করেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁদের সাথে তার প্রিয় সাহাবী মুস‘আাব বিন উমাইরকে মদীনায় প্রচারক হিসেবে প্রেরণ করেন। তাঁর প্রচেষ্টায় মদীনার অধিকাংশ মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেন। পরবর্তী হজ্জ মওসুমে (নবুয়তের ১৩শ বৎসরে, ৬২২ খৃষ্টাব্দে জুন মাসে) মদীনা থেকে হাজীদের যে কাফেলা আসে তার মধ্যে ৭০ জনেরও বেশি ছিলেন মুসলিম। তাঁরা গোপনে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে মিলিত হয়ে তাঁকে মক্কা ত্যাগ করে মদীনায় গিয়ে অবস্থান করার আহবান জানান। তাঁরা তাঁকে সার্বিক সহযোগিতা ও প্রাণের বিনিময়ে হলেও তাঁকে রক্ষা করার প্রতিজ্ঞা করেন।
৩. ১. ২. ৬. মদীনায় হিজরত ও মাদানী জীবন
এ ঘটনার পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মক্কার নির্যাতিত মুসলিমদেরকে মদীনায় গমন করার (হিজরত করার) অনুমতি দেন। মক্কার কুরাইশ নেতাগণ মদীনায় ইসলামের সাফল্যে বিচলিত হন। তারা যে কোনো মূল্যে ইসলামের অগ্রগতি রোধ করার জন্য এক আলোচনায় মিলিত হন। আলেচনায় তারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন।
এসময়ে মহান আল্লাহ তার রাসূল (ﷺ)-কে মদীনায় হিজরতের নির্দেশ দেন। কুরাইশদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে তিনি মক্কা থেকে বেরিয়ে পড়েন। কাফিররা তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করে তাকে খুজে বের করে হত্যা করার জন্য, কিন্তু তার ব্যর্থ হয়। তিনি তাঁর সঙ্গী আবু বকরের সাথে তিন দিন সাওর পাহাড়ের চূড়ার গুহার মধ্যে লুকিয়ে থাকার পর মদীনায় রওয়ানা দেন। নুবুওয়তের ১৪শ বৎসরের সফর মাসের ২৭ তারিখে (১৩ই সেপ্টেম্বর ৬২২ খৃষ্টাব্দে) রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও আবু বকর মক্কা ত্যাগ করেন। প্রায় দশ দিন পথ চলার পরে রবিউল আউয়াল মাসের ৮ তারিখে (২৩শে সেপ্টেম্বর, ৬২২ খৃষ্টাব্দে) তিনি মদীনায় পৌঁছান।
তিনি মদীনার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের সিদ্ধান্তে মদীনার প্রশাসনিক নেতৃত্ব বা মদীনা রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মদীনার সংখ্যাগরিষ্ট মুসলিম জনগণ এবং অমুসলিম ও ইহূদীদের সাথে নাগরিক চুক্তির মাধ্যমে তিনি রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের শান্তি, নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করেন। তিনি মদীনায় তিনি অত্যন্ত শান্তির সাথে মুসলমানদের ইসলাম শিক্ষা দিয়ে থকেন। এ সময় থেকে মহান আল্লাহ ইসলামের বিভিন্ন বিধিবিধান নাযিল করেন।
মক্কার কাফিররা তাঁর সাফল্যে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। তারা বিভিন্ন ভাবে মদীনার মুসলমানদের ধ্বংসের চেষ্টা করতে থাকে এবং মুসলিমদের উপর বিভিন্নভাবে আক্রমন করতে থাকে। ফলে আল্লাহ মুুসলমানদেরকে জিহাদের বা যুদ্ধ করার অনুমতি দান করেন। কাফিরদের তুলনায় সংখ্যায়, অস্ত্রে ও ক্ষমতায় নগণ্য হওয়া সত্ত্বেও মহানবী তার প্রিয় সাহাবীদেরকে নিয়ে কাফিরদের মুকাবিলা করেন। পরবর্তী ৮ বৎসরে উভয় পক্ষের মধ্যে কয়েকটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। কাফিররা পরাজিত হতে থাকে। সর্বশেষে ৮ম হিজরী সালে (৬৩০ খৃ) রামাদান মাসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মুসলিম বাহিনী নিয়ে বিনা রক্তপাতে মক্কা বিজয় করেন। মক্কার কাফিরদেরকে তিনি ক্ষমা করে দেন। এরপর আরব উপদ্বীপের মানুষেরা দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে। তিনি আরদেশের বাইরে পারস্য, রোম, মিসর, আবিসিনিয়া ইত্যাদি দেশের শাসকদেরকে ইসলাম গ্রহণের আহবান জানিয়ে চিঠি লেখেন।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মদীনায় হিজরতের ১০ বৎসরের মধ্যে সমস্ত আরব উপদ্বীপ ইসলামের ছায়াতলে স্থানলাভ করে। আরবের বাইরেও ইসলামের আলো ছড়িয়ে পড়ে। এই বৎসরে (৬৩২ খৃ) রাসূলুল্লাহ (ﷺ) লক্ষাধিক সঙ্গীকে নিয়ে হজ্জ আদায় করেন, যা বিদায় হজ্জ নামে পরিচিত।
৩. ১. ২. ৭. সর্বশেষ ওসীয়ত ও ওফাত
হজ্জ থেকে ফেরার পরে ১১শ হিজরীর (৬৩২ খৃ) প্রথম দিকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি জ্বর ও মাথা ব্যথায় আক্রান্ত হন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সফর বা রবিউল আউয়াল মাসের কত তারিখ থেকে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং কত তারিখে ইন্তিকাল করেন সে বিষয়ে হাদীস শরীফে কোনোরূপ উল্লেখ বা ইঙ্গিত নেই। বস্ত্তত, সাহাবায়ে কেরাম ও তাবিয়ীগণ তারিখের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করতেন না। এজন্য তাঁরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জীবনের অত্যন্ত ছোটখাট ঘটনাও গুরুত্বের সাথে বর্ণনা ও সংরক্ষণ করেছেন, কিন্তু এ সকল ঘটনার তারিখ কোনো হাদীসে উল্লেখ করেন নি। অগণিত হাদীসে তাঁর অসুস্থতা, অসুস্থতা- কালীন অবস্থা, কর্ম, উপদেশ, তাঁর ইন্তিকাল ইত্যাদির ঘটনা বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু কোথাও কোনো ভাবে কোনো দিন, তারিখ বা সময় বলা হয় নি। কবে তাঁর অসুস্থতা শুরু হয়, কতদিন অসুস্থ ছিলেন, কত তারিখে ইন্তিকাল করেন সে বিষয়ে কোনো হাদীসেই কিছু উল্লেখ করা হয় নি।
২য় হিজরী শতক থেকে তাবিয়ী ও তাবি-তাবিয়ী আলিমগণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর জীবনের ঘটনাবলি ঐতিহাসিকভাবে দিন তারিখ সহকারে সাজাতে চেষ্টা করেন। তখন থেকে মুসলিম আলিমগণ এ বিষয়ে বিভিন্ন মত পেশ করেছেন।
তাঁর অসুস্থতার শুরু সম্পর্কে অনেক মত রয়েছে। কেউ বলেছেন সফর মাসের শেষ দিকে তাঁর অসুস্থতার শুরু। কেউ বলেছেন রবিউল আউয়াল মাসের শুরু থেকে তাঁর অসুস্থতার শুরু। দ্বিতীয় হিজরী শতকের প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনু ইসহাক (১৫১ হি/৭৬৮ খৃ) বলেন: ‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যে অসুস্থতায় ইন্তিকাল করেন, সেই অসুস্থতার শুরু হয়েছিল সফর মাসের শেষে কয়েক রাত থাকতে, অথবা রবিউল আউয়াল মাসের শুরু থেকে।’’[9]
কি বার থেকে তাঁর অসুস্থতার শুরু হয়েছিল, সে বিষয়েও মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছেন শনিবার, কেউ বলেছেন বুধবার এবং কেউ বলেছেন সোমবার তার অসুস্থতার শুরু হয়।[10]
কয়দিনের অসুস্থতার পরে তিনি ইন্তিকাল করেন, সে বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছেন, ১০ দিন, কেউ বলেছেন, ১২ দিন, কেউ বলেছেন ১৩ দিন, কেউ বলেছেন, ১৪ দিন অসুস্থ থাকার পরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইন্তিকাল করেন।[11]
তাঁর ওফাতের তারিখ সম্পর্কেও অনুরূপ মতভেদ রয়েছে। বিভিন্ন সহীহ হাদীস থেকে জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সোমবার ইন্তিকাল করেন।[12] কিন্তু এই সোমবারটি কোন্ মাসের কোন্ তারিখ ছিল তা কোনো হাদীসে বলা হয় নি। সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রামাদান মাসের ১১ তারিখে ইন্তিকাল করেন।[13] এই একক বর্ণনাটি ছাড়া মুসলিম উম্মাহর সকল ঐতিহাসিক ও মুহাদ্দিস একমত যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) রবিউল আউয়াল মাসে ইন্তিকাল করেন। কিন্তু কোন্ তারিখে তিনি ইন্তিকাল করেছেন তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। ইন্তিকালের তারিখ সম্পর্কে দ্বিতীয় হিজরীর তাবেয়ী ঐতিহাসিকগণ এবং পরবর্তী ঐতিহাসিকগণের ৪টি মত রয়েছে: ১লা রবিউল আউয়াল, ২রা রবিউল আউয়াল, ১২ই রবিউল আউয়াল ও ১৩ই রাবিউল আউয়াল।[14]
আমরা ১২ই রবিউল আউয়ালকেই রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ওফাত দিবস ধরে নিয়ে তাঁর ওফাতের পূর্ববর্তী ঘটনাবলি সহীহ হাদীসের আলোকে উল্লেখ করছি। হাদীস শরীফে সাহাবীগণ তারিখ উল্লেখ না করলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁরা বার ও প্রাসঙ্গিক পূর্বাপর ঘটনাদি উল্লেখ করেছেন। আমরা এ সকল বর্ণনার ভিত্তিতেই ঘটনাবলি উল্লেখ করব।
অসুস্থতা বৃদ্ধি পেলে তিনি মসজিদ-সংলগ্ন আয়েশা (রা)-র ঘরে অবস্থান করতে থাকেন। ওফাতের ৫ দিন আগে (রবিউল আউয়াল মাসের ৮ তারিখ) বৃহস্পতিবার[15] তিনি গোসল করেন এবং কিছুটা সুস্থ বোধ করেন। তখন তিনি মসজিদে গিয়ে মিম্বরে বসেন এবং সাহাবীদেরকে অন্তিম উপদেশ নসীহত দান করেন। এছাড়াও তিনি অসুস্থ অবস্থায় বারংবার বিভিন্ন বিষয়ে ওসীয়ত করেন। এ সকল ওসীয়তে তিনি তাওহীদ, সালাত ও বান্দার হক্ক সম্পর্কে সতর্ক করেন। আয়েশা (রা), আবূ হুরাইরা (রা) জুনদুব (রা), আবূ উবাইদাহ ইবনুল জার্রাহ (রা) প্রমুখ সাহাবী বিভিন্ন হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ইন্তেকালের ৫ দিন পূর্বে এবং সর্বশেষ ওসীয়তের বর্ণনায় বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
أَلا وَإِنَّ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ كَانُوا يَتَّخِذُونَ قُبُورَ أَنْبِيَائِهِمْ وَصَالِحِيهِمْ مَسَاجِدَ أَلا فَلا تَتَّخِذُوا الْقُبُورَ مَسَاجِدَ إِنِّي أَنْهَاكُمْ عَنْ ذَلِكَ. ... لَعَنَ اللَّهُ الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى اتَّخَذُوا قُبُورَ أَنْبِيَائِهِمْ مَسْجِدًا. ... يُحَذِّرُ مَا صَنَعُوا ... وَاعْلَمُوا أَنَّ شِرَارَ النَّاسِ الَّذِينَ اتَّخَذُوا قُبُورَ أَنْبِيَائِهِمْ مَسَاجِدَ. ... لا تَتَّخِذُوا قَبْرِي عِيدًا وَلا تَجْعَلُوا بُيُوتَكُمْ قُبُورًا وَحَيْثُمَا كُنْتُمْ فَصَلُّوا عَلَيَّ فَإِنَّ صَلاتَكُمْ تَبْلُغُنِي... اللَّهُمَّ لا تَجْعَلْ قَبْرِي وَثَنًا يُعْبَدُ اشْتَدَّ غَضَبُ اللَّهِ عَلَى قَوْمٍ اتَّخَذُوا قُبُورَ أَنْبِيَائِهِمْ مَسَاجِدَ
‘‘তোমরা মনোযোগ দিয়ে শোন! তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিসমূহের মানুষেরা তাদের নবীগণ ও ওলীগণের কবরকে মসজিদ (ইবাদতগাহ) বানিয়ে নিত। তোমরা সাবধান! তোমরা কখনো কবরকে মসজিদ বানিয়ে নেবে না, নিশ্চয়ই আমি তোমাদেরকে নিষেধ করছি এই কাজ থেকে।’’ ...
‘‘আল্লাহ লানত-অভিশাপ প্রদান করেন ইহুদী ও খৃস্টানদের উপর, তারা তাদের নবীগণের কবরকে মসজিদ বানিয়ে নিয়েছিল।’’ একথা বলে তিনি তাঁর উম্মতকে অনুরূপ কর্ম থেকে সাবধান করছিলেন। .... ‘‘তোমরা জেনে রাখ, নিশ্চয় সবচেয়ে খারাপ মানুষ তারাই যারা তাদের নবীদের কবর মসজিদ বানিয়ে নেয়।’’ ... ‘‘তোমরা আমার কবরকে ইদ (ইদগাহ বা নিয়মিত সমাবেশের স্থান) বানিও না, আর তোমাদের আবাসস্থলকে কবর বানিয়ে নিওনা। তোমরা যেখানেই থাক না কেন আমার উপর সালাত (দরুদ) পাঠ করবে, কারণ তোমাদের সালাত আমার কাছে পৌঁছে যাবে।’’ ‘‘হে আল্লাহ, আমার কবরকে পূজিত দ্রব্য বা পূজ্য-স্থানের মত বানিয়ে দিবেন না যার ইবাদত করা হবে, আল্লাহর ক্রোধ কঠিনতর হোক সে সকল মানুষের উপর যারা তাদের নবীগণের কবরগুলিকে মসজিদ বানায়।’’[16]
এতদিন পর্যন্ত অসুস্থতা সত্ত্বেও তিনি নিয়মিত জামাতে সালাতের ইমামতি করছিলেন। বৃহস্পতিবার (৮ই রবি. আউয়াল) মাগরিবের সালাতেও তিনি ইমামতি করেন। এরপর তাঁর অসুস্থতা বৃদ্ধি পায়। তিনি মসজিদে যেতে সক্ষম হন না। তখন তিনি আবু বকর (রা)-কে ইমামতি করার নির্দেশ দেন।
তাঁর অসুস্থতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। তিনি এ সময়ে বারবার বলছিলেন:
الصَّلاةَ (الصَّلاةَ) وَمَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ
‘‘সালাত! সালাতের বিষয়ে সাবধান! (কোনোরূপ অবহেলা করবে না) এবং তোমাদের দাস-দাসীদের (অধীনস্থগণের) বিষয়ে সাবধান!’’[17]
সোমবার দিন (১২ই রবিউল আউয়াল, ৬৩২ খৃস্টাব্দের জুন মাসের ৫/৬ তারিখ) দিবসের প্রথম দিকে- দিপ্রহরের পূর্বে- তিনি তাঁর স্ত্রী আয়েশার (রা) কোলে মাথা রেখে শুয়ে ছিলেন। এ সময়ে তিনি মেসওয়াক করেন এবং মৃদুস্বরে কিছু বলতে থাকেন। আয়েশা তার মুখের কাছে কান নিয়ে শুনতে পান তিনি বলছেন: ‘‘তাদের সাথে, যাদেরকে আপনি নেয়ামত দান করেছেন, নবী-রাসূলগণ, সিদ্দিকগণ, শহীদগণ, সৎকর্মশীলগণ। হে আল্লাহ, আপনি আমাকে ক্ষমা করুন, আমাকে রহমত করুন, সর্বোচ্চ সুমহান সঙ্গীদের সাথে আমাকে মিলিত করে দিন। হে আল্লাহ সুমহান সঙ্গীদের সাথে আমাকে মিলিত করে দিন। হে আল্লাহ সুমহান সঙ্গীদের সাথে আমাকে মিরিত করে দিন।’’ এরপর তিনি ইন্তেকাল করেন। ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মৃত্যুর সময় তার বয়স ছিল ৬৩ বৎসর।
তার মৃত্যুর সংবাদে শোকে বিহবল হয়ে পড়েন সাহাবীরা। প্রচন্ড শোকে স্বাভাবিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন কেউ কেউ। তাঁর ওফাত হতে পারে- এ কথা মানতে কেউ কেউ অস্বীকার করেন। এ বিষয়ে আয়েশা (রা) বলেন:
إنَّ رَسُولَ اللَّهِ (ﷺ) مَاتَ وَأَبُو بَكْرٍ بِالسُّنْحِ فَقَامَ عُمَرُ يَقُولُ: وَاللَّهِ مَا مَاتَ رَسُولُ اللَّهِ (ﷺ)، قَالَتْ: وَقَالَ عُمَرُ: وَاللَّهِ مَا كَانَ يَقَعُ فِي نَفْسِي إِلا ذَاكَ وَلَيَبْعَثَنَّهُ اللَّهُ فَلَيَقْطَعَنَّ أَيْدِيَ رِجَالٍ وَأَرْجُلَهُمْ فَجَاءَ أَبُو بَكْرٍ فَكَشَفَ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ (ﷺ) فَقَبَّلَهُ قَالَ بِأَبِي أَنْتَ وَأُمِّي طِبْتَ حَيًّا وَمَيِّتًا وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لا يُذِيقُكَ اللَّهُ الْمَوْتَتَيْنِ أَبَدًا ثُمَّ خَرَجَ فَقَالَ أَيُّهَا الْحَالِفُ عَلَى رِسْلِكَ فَلَمَّا تَكَلَّمَ أَبُو بَكْرٍ جَلَسَ عُمَرُ فَحَمِدَ اللَّهَ أَبُو بَكْرٍ وَأَثْنَى عَلَيْهِ وَقَالَ أَلا مَنْ كَانَ يَعْبُدُ مُحَمَّدًا (ﷺ) فَإِنَّ مُحَمَّدًا قَدْ مَاتَ وَمَنْ كَانَ يَعْبُدُ اللَّهَ فَإِنَّ اللَّهَ حَيٌّ لا يَمُوتُ وَقَالَ: (إِنَّكَ مَيِّتٌ وَإِنَّهُمْ مَيِّتُونَ)، وَقَالَ: (وَمَا مُحَمَّدٌ إِلا رَسُولٌ قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِهِ الرُّسُلُ أَفَإِنْ مَاتَ أَوْ قُتِلَ انْقَلَبْتُمْ عَلَى أَعْقَابِكُمْ وَمَنْ يَنْقَلِبْ عَلَى عَقِبَيْهِ فَلَنْ يَضُرَّ اللَّهَ شَيْئًا وَسَيَجْزِي اللَّهُ الشَّاكِرِينَ). قَالَ فَنَشَجَ النَّاسُ يَبْكُونَ
‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন মৃত্যুবরণ করেন তখন আবূ বাক্র (রা) (মদীনার প্রান্তরে) সুন্হ নামক স্থানে ছিলেন। তখন উমার (রা) দাঁড়িয়ে বলেন: আল্লাহর কসম, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মৃত্যুবরণ করেন নি।, আয়েশা (রা) বলেন, উমার (রা) বলেন, আল্লাহর কসম, আমার মনে এ ছাড়া অন্য কিছুই আসে নি। নিশ্চিয় আল্লাহ তাকে উঠাবেন এবং তিনি (যারা তাঁর মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করছে) সে সকল মানুষের হস্তপদ কর্তন করবেন। তখন আবূ বাক্র (রা) আগমন করেন। তিনি (আয়েশার ঘরের মধ্যে রক্ষিত) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মুবারক দেহের উপর থেকে কাপড় সরিয়ে তাঁকে চুমু খান এবং বলেন: আমার পিতামাতা আপনার জন্য কুরবানি হোন, আপনি জীবিত ও মৃত উভয় অবস্থায় পবিত্র ও মহান। যার হাতে আমার জীবন তাঁর কসম, আল্লাহ আপনাকে কখনোই দু বার মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করাবেন না। এরপর তিনি বাইরে বেরিয়ে এসে (উমারকে সম্বোধন করে) বলেন, হে কসমকারী, একটু শান্ত হও! যখন আবূ বাক্র (রা) কথা বলতে শুরু করলেন, তখন উমার (রা) বসে পড়লেন। তখন আবূ বাক্র আল্লাহর প্রশংসা এবং গুণবর্ণনা করলেন এবং বললেন, শুনে রাখ! যারা মুহাম্মাদের (ﷺ) ইবাদত করত (তারা জানুক যে,) মুহাম্মাদ (ﷺ) মৃত্যুবরণ করেছেন। আর যারা আল্লাহর ইবাদত করত (তারা জানুক যে,) আল্লাহ চিরঞ্জীব, তিনি মৃত্যুবরণ করেন না। এবং তিনি (কুরআনের আয়াত উদ্ধৃত করে) বলেন[18]: ‘‘তুমি তো মরণশীল এবং তারাও মরণশীল’’, এবং বলেন[19]: ‘‘মুহাম্মাদ একজন রাসূল মাত্র; তার পূর্বে বহু রাসূল গত হয়েছে। সুতরাং যদি সে মারা যায় অথবা নিহত হয় তবে কি তোমরা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে? এবং কেউ পৃষ্ঠ প্রদর্শন করলে সে কখনো আল্লাহর ক্ষতি করবে না, বরং আল্লাহ শীঘ্রই কৃতজ্ঞদিগকে পুরস্কৃত করবেন।’’ তখন মানুষেরা আবেগাপ্লুত হয়ে কেঁদে উঠেন।’’[20]
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নির্দেশনা অনুসারে আয়েশা (রা)-এর ঘরের মধ্যে যেখানে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইন্তেকাল করেন সেখানেই তাঁকে দাফন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। পরদিন মঙ্গলবার (১৩ই রবিউল আউয়াল) উক্ত ঘরের মধ্যে তাঁকে গোসল করান হয় এবং কাফন পরান হয়। এরপর সাহাবীগণ তাঁর জানাযার নামায আদায় করেন। একক বৃহৎ জামাতে জানাযা হয় নি। সাহাবীগণ ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে উক্ত গৃহের মধ্যে প্রবেশ করে জানাযার সালাত আদায় করে বেরিয়ে যান। এভাবে মঙ্গলবার সারাদিন কেটে যায়। মঙ্গলবার দিনগত রাতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে দাফন করা হয়।আয়েশার (রা) এই বাড়িটির আয়তন ছিল কমবেশি ১৬ হাত X ৮ হাত। অর্থাৎ ,তাঁর পুরো বাড়িটি ছিল ৩০০ বর্গফুটেরও কম জায়গা। উচ্চতা ছিল প্রায় ৪/৫ হাত। বাড়িটি দুই অংশে বিভক্ত ছিল। মসজিদ সংলগ্ন ৬/৭ হাত প্রশস্ত অংশটুকু বসার স্থান হিসাবে ব্যবহৃত হতো। পিছনের অংশটুকু (১০ হাত X ৮ হাত) শয়ন ও অবস্থানের ঘর বা বেডরুম। এই ঘরের মধ্যে (১০ হাত লম্বা ও ৮ হাত চওড়া) রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -কে দাফন করা হয়। দাফনের পরেও আয়েশা (রা.) সেখানে বসবাস করতেন। আর কোনো বসতবাড়ি তাঁর ছিল-না। পরবর্তী কালে আবূ বাকর (রা) ও উমার (রা)-কেও এই ঘরের মধ্যেই দাফন করা হয়। এই ঘরের মধ্যে কবরগুলির পাশেই আয়েশা (রা.) প্রায় ৫০ বৎসর জীবনযাপনের পর ৫৮ হিজরীতে মুয়াবিয়ার (রা.) শাসনামলে ইন্তেকাল করেন।[21]
[2] আকরাম যিয়া আর-উমারী, আস-সীরাতুন নাবাবীয়্যাহ আস-সহীহা ১/৯৬-৯৮, মাহদী রেজকুল্লাহ আহমদ, আস-সীরাতুন নাবাবীয়াহ, ১০৯-১১০ পৃ।
[3] মুসলিম, আস-সহীহ ২/৮১৯; আহমাদ, আল-মুসনাদ ৪/১৭২-১৭৩, নং ২৫০৬।
[4] ইবনু সা’দ, আত-তাবাকাতুল কুবরা ১/৮০-৮১।
[5] ইবনু হিশাম, আস-সীরাতুন নাবাবীয়্যাহ ১/১৮৩।
[6] মাহদী রেজকুল্লাহ আহমদ, আস-সীরাতুন নাবাবীয়াহ, ১০৯ পৃ।
[7] ইবনু সা’দ, আত-তাবাকাতুল কুবরা ১/১০০-১০১, ইবনু কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া ২/২১৫, আল-কাসতালানী, আহমদ বিন মুহাম্মাদ, আল-মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়্যা ১/৭৪-৭৫, আল-যারকানী, শরহুল মাওয়াহিব আল-লাদুন্নিয়্যা ১/২৪৫-২৪৮, ইবনু রাজাব, লাতায়েফুল মায়ারেফ ১/১৫০।
[8] ড. মাহদী রিযকুল্লাহ, আস-সীরাতুন্নাবাবীয়্যাহ ফী দাওইল মাসাদিরিল আসলিয়্যাহ, পৃ. ১৩৮-১৩৯।
[9] ইবনু হিশাম, আস-সীরাহ আন-নববিয়্যাহ ৪/২৮৯।
[10] কাসতালানী, আল-মাওয়াহিব আল-লাদুন্নিয়া ৩/৩৭৩; যারকানী, শারহুল মাওয়াহিব ১২/৮৩।
[11] কাসতালানী, আল-মাওয়াহিব আল-লাদুন্নিয়া ৩/৩৭৩; যারকানী, শারহুল মাওয়াহিব ১২/৮৩।
[12] বুখারী, আস-সহীহ ১/২৬২, ৪/১৬১৬; মুসলিম, আস-সহীহ ১/৩১৫; আবূ নুআইম ইসপাহানী, আল-মুসনাদ আল-মুসতাখরাজ আলা সাহীহ মুসলিম ২/৪৩-৪৪।
[13] ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ৮/১২৯।
[14] ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ৮/১২৯।
[15] ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ৮/১৪২।
[16] বিস্তারিত বর্ণনাগুলির জন্য দেখুন: বুখারী, আস-সহীহ ১/১৬৫, ১৬৮, ৪৪৬, ৪৬৮, ৩/১২৭৩, ৪/১৬১৪, ৪/১৬১৫, ৫/২১৯০; মুসলিম, আস-সহীহ ১/৩৭৫-৩৭৮; মালিক, আল-মুআত্তা ১/১৭২; আহমদ, আল-মুসনাদ ১/১৯৫, ২/২৪৬, ৩৭৬; ইবনু হাজার আসকালানী, ফাতহুল বারী ১/৫২৩-৫২৪, ৫৩১, ৩/২০০, ২০৮, ২৫৫।
[17] ইবনু মাযাহ, আস-সুনান ১/৫১৮; আলবানী, সহীহ সুনান ইবনি মাজাহ ১/২৭১।
[18] সূরা (৩৯) যুমার: ৩০ আয়াত।
[19] সূরা (৩) আল-ইমরান: ১৪৪ আয়াত।
[20] বুখারী, আস-সহীহ ৩/১৩৪১; ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ৭/২৯-৩০। আরো দেখুন, বুখারী, আস-সহীহ ১/৪১৮, ৪/১৬১৮; ফাতহুল বারী ৩/১১৩; ৭/১৪, ৮/১৪৫।
[21] বিস্তারিত দেখুন, খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, এহইয়াউস সুনান, পৃ. ৩৭৪-৩৭৮।
মহান আল্লাহ তাঁর প্রেরিত নবী ও রাসূলগণের মাধ্যমে কিছু অলৌকিক বা অস্বাভাবিক কর্ম সম্পাদন করাতেন যা সাধারণ মানুষের সাধ্যের বাইরে। এ সকল কর্ম তাদের নবুয়তের দাবীর সত্যতা প্রমাণ করত। কোনো নবী মৃতকে জীবিত করেছেন, কেউ জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে নিরাপদে থেকেছেন। কুরআন ও হাদীসে এ সকল কর্মকে আয়াত, নিদর্শন বা চিহ্ন বলা হয়েছে। পরবর্তী যুগের পরিভাষায় এগুলিকে মু’জিযা বলা হয়। এবিষয়ে আমরা পরবর্তীতে বিস্তারিত আলোচনা করব, ইনশা আল্লাহ।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে আল্লাহ অনেক ‘আয়াত’ বা মুজিযা দান করেছিলেন। অন্যান্য সকল নবীর মুজিযা ছিল তাৎক্ষণিক। অর্থাৎ তাঁর সময়ের মানুষেরা তা প্রত্যক্ষ করেছেন, কেউ কেউ ঈমান এনেছে, কেউ অবিশ্বাস করেছেন। পরবর্তী যামানার মানুষেরা তা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পান নি। তাঁরা শুধুমাত্র এ সকল মুজিযার কথা পড়েছেন বা শুনেছেন।
যেহেতু মুহাম্মাদ (ﷺ) সর্বকালের সকল মানুষের জন্য নবী হিসেবে প্রেরিত হয়েছেন, তাই আল্লাহ তাঁকে একটি চিরস্থায়ী মুজিযা দান করেছেন, তা হলো পবিত্র কুরআন। আল্লাহ কুরআন নাযিল করে তৎকালীন আরবদেরকে কুরআনের ছোট একটি সূরার অনুকরণে একটি সূরা লিখে পেশ করতে আহবান করেন। তারা তাতে অক্ষম হয়।
আমরা দেখেছি যে, মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে স্তব্দ করতে এবং ইসলামের অগ্রযাত্রা রোধ করতে মক্কার কাফিরগণ নিজেদের জীবন ও সম্পদ বাজি রেখেছে। অথচ তাদের জন্য খুবই সহজ ছিল যে, কুরআনের এই চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করে কুরআনের একটি ছোট্ট সূরার অনুরূপ সূরা রচনা করে জনসমক্ষে উপস্থিত করে দাবি করা যে, এই দেখ আমরা মুহাম্মাদের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে তার জবাব দিয়েছি। যেহেতু জনমত ছিল তাদের পক্ষে এবং অধিকাংশ মানুষই তাদের মতের ছিল সেহেতু মোটামুটি কাছাকাছি একটি সূরা তৈরি করেই তার হৈ চৈ করতে পারত এবং তাদের পক্ষের মানুষদের মনোবল জোরদার করতে পারত। কিন্তু কখনোই তার এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে নি। কারণ তারা জানত যে, এতে তাদের পক্ষের আরবদের সামনেই তাদের অসহায়ত্ব ও অক্ষমতা প্রকাশ পেয়ে যাবে এবং ইসলামের প্রচার বৃদ্ধি পাবে।
কুরআনের ভাষার ন্যায় এর জ্ঞানও মুজিযা। বৈজ্ঞানিক নতুন নতুন আবিষ্কারের সাথে সাথে প্রতি যুগেই মানব জাতি কুরআনের নতুন নতুন মুজিযা জানতে পেরেছেন। আধুনিক যুগেও যে সকল অমুসলিম বৈজ্ঞানিক, গবেষক বা পন্ডিত কুরআন অধ্যয়ন করছেন তারও স্বীকার করছেন যে এই গ্রন্থ কোনো মানুষের রচিত নয়, বরং তা মহান স্রষ্টা আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত। কেউ তাতে ঈমান এনেছেন, কেউ এড়িয়ে গিয়েছেন। এ ভাবে কিয়ামত পর্যন্ত সকল যুগের মানুষ নতুনভাবে এই চিরস্থায়ী মুজিযার মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নবুয়তের সত্যতা বুঝতে পারবে।
এছাড়া মহান আল্লাহ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে আরো অনেক মুজিযা দান করেছিলেন যা তাঁর সমসময়িক মানুষেরা প্রত্যক্ষ করেছেন। এ সকল মুজিযার মধ্যে কিছু মুজিযার বিবরণ কুরআনে রয়েছে। অন্যান্য মুজিযার বিবরণ হাদীস থেকে জানা যায়। কুরআনে উল্লিখিত মুজিযাগুলির মধ্যে অন্যতম দুটি মুজিযা:
(১) ইসরা ও মি’রাজ: অলৌকিকভাবে রাত্রিভ্রমন ও ঊর্ধ্বগমন
মহান আল্লাহ কুরআনে সূরা বনী ইসরাঈলে বলেছেন:
سُبْحَانَ الَّذِي أَسْرَى بِعَبْدِهِ لَيْلا مِنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ إِلَى الْمَسْجِدِ الأَقْصَى الَّذِي بَارَكْنَا حَوْلَهُ لِنُرِيَهُ مِنْ آَيَاتِنَا إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ
‘‘পবিত্র ও মহিমাময় তিনি যিনি তাঁর বান্দাকে রজনীযোগে ভ্রমন করিয়েছেন মসজিদুল হারাম (মক্কার মসজিদ) থেকে মসজিদুল আকসা (যিরূশালেমের মসজিদ) পর্যন্ত, যার পরিবেশ আমি করেছিলাম বরকতময়, তাকে আমার নিদর্শন দেখাবার জন্য।’’[1]
অন্যত্র সূরা নাজমে আল্লাহ বলেছেন:
أَفَتُمَارُونَهُ عَلَى مَا يَرَى وَلَقَدْ رَآَهُ نَزْلَةً أُخْرَى عِنْدَ سِدْرَةِ الْمُنْتَهَى عِنْدَهَا جَنَّةُ الْمَأْوَى إِذْ يَغْشَى السِّدْرَةَ مَا يَغْشَى مَا زَاغَ الْبَصَرُ وَمَا طَغَى لَقَدْ رَأَى مِنْ آَيَاتِ رَبِّهِ الْكُبْرَى
‘‘সে (মুহাম্মাদ (ﷺ)) যা দেখেছে তোমরা কি সে বিষয়ে তার সাথে বিতর্ক করবে? নিশ্বয়ই সে তাকে (জিবরীলকে) আরেকবার দেখেছিল। সিদরাতুল মুনতাহা-র (প্রান্তবর্তী বদরী বৃক্ষের) নিকট। যার নিকট অবস্থিত জান্নাতুল মা‘ওয়া (অবস্থানের জান্নাত)। যখন বৃক্ষটি যদ্বারা আচ্ছাদিত হবার তদ্বারা ছিল আচ্ছাদিত। তার দৃষ্টি বিভ্রম হয় নি, দৃষ্টি লক্ষ্যচ্যুতও হয় নি। সে তো তার প্রতিপালকের মহান নিদর্শনাবলি দেখেছিল।’’[2]
এ সকল আয়াত এবং বহুসংখ্যক সহীহ হাদীস প্রমাণ করে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জাগ্রত অবস্থায় সশরীরে মিরাজে গমন করেন। বিভিন্ন সহীহ হাদীস থেকে তা সুস্পষ্টভাবেই প্রমাণিত। আর ‘বান্দা’ বলতে আত্মা ও দেহের সমন্বিত মানুষকেই বুঝানো হয়। মহান আল্লাহ বলেন: ‘‘তুমি কি তাকে দেখেছ, যে বাধা দেয় এক বান্দাকে, যখন সে সালাত আদায় করে?’’[3] অন্যত্র সূরা জিন্ন-এর মধ্যে তিনি বলেন: ‘‘আর এই যে, যখন আল্লাহর বান্দা তাঁকে ডাকার জন্য দন্ডায়মান হলো তখন তারা তার নিকট ভিড় জমালো।’’[4] নিঃসন্দেহে উপরের দুই স্থানেই ‘বান্দা’ বলতে দেহ ও আত্মার সমন্বিত ব্যক্তিকে বুঝানো হয়েছে। এথেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, এখানেও ‘বান্দা’ বলতে দেহ ও আত্মার সমন্বিত ব্যক্তিকেই রজনীযোগে ভ্রমন করানোর কথা বলা হয়েছে।
এছাড়া আমরা জানি যে, কাফিরগণ ইসরা ও মি’রাজ (নৈশভ্রমন ও ঊর্ধ্বারোহন) অস্বীকার করে এবং একে অসম্ভব বলে দাবি করে। এছাড়া রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন মিরাজের কথা বললেন তখন কতিপয় দুর্বল ঈমান মুসলিম একে অসম্ভব মনে করে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নবুয়তের বিষয়ে সন্দীহান হয়ে ইসলাম পরিত্যাগ করে। এ থেকে নিশ্চিতরূপে জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জাগ্রত অবস্থায় দৈহিকভাবে মিরাজ সংঘটিত হওয়ার কথাই বলেছিলেন। নইলে কাফিরদের অস্বীকার করার ও দুর্বল ঈমান মুসলিমদের ঈমান হারানোর কোনো কারণই থাকে না। স্বপ্নে এরূপ নৈশভ্রমন বা স্বর্গারোহণ কোনো অসম্ভব বা অবাস্তব বিষয় নয় এবং এরূপ স্বপ্ন দেখার দাবি করলে তাতে অবাক হওয়ার মত কিছু থাকে না। যদি কেউ দাবি করে যে, ঘুমের মধ্যে সে একবার পৃথিবীর পূর্বপ্রান্তে এবং একবার পৃথিবীর পশ্চিম প্রান্তে চলে গিয়েছে, তবে তার দেহ স্বস্থানেই রয়েছে এবং দৈহিক অবস্থার পরিবর্তন হয় নি, তবে কেউ তার এরূপ স্বপ্ন দেখার সম্ভাবনা অস্বীকার করবে না বা এতে অবাকও হবে না।
আধুনিক বিজ্ঞান সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণ করেছে যে, জাগ্রত অবস্থায় সশরীরের এরূপ অলৌকিক নৈশভ্রমন ও ঊর্ধ্বারোহণ অসম্ভব নয়। মি’রাজের ঘটনাবালির মধ্যে আরো অনেক বৈজ্ঞানিক মুজিযার সন্ধান পেয়েছেন আধুনিক বিজ্ঞানীরা।
(২) চন্দ্র খন্ডিত করা
মক্কার কাফিরগণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কাছে অলৌকিক নিদর্শন দাবি করে। তখন রত্রি বেলায় তাঁর ইশারায় পূর্ণিমার চাঁদ দ্বিখন্ডিত হয়ে যায়। কিছু পরে আবার তা একত্রিত হয়। এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন:
اقْتَرَبَتِ السَّاعَةُ وَانْشَقَّ الْقَمَرُ وَإِنْ يَرَوْا آَيَةً يُعْرِضُوا وَيَقُولُوا سِحْرٌ مُسْتَمِرٌّ
‘‘কিয়ামত নিকটবর্তী হয়েছে এবং চন্দ্র বিদীর্ণ হয়েছে। তারা কোনো নিদর্শন (অলৌকিক চিহ্ন) দেখলে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং বলে, এ তো চিরাচরিত যাদু।’’[5]
বিভিন্ন সহীহ হাদীসে চন্দ্র বিদীর্ণ হওয়ার ঘটনাটি বর্ণিত হয়েছে। বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য সহীহ হাদীসের গ্রন্থে আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রা), আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রা), আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রা), আনাস ইবনু মালিক (রা), জুবাইর ইবনু মুতয়িম (রা) ও হুযাইফা ইবনুল ইয়ামান এই ৬ জন সাহাবী থেকে প্রায় ২০টি পৃথক সনদে এ বিষয়ক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। আলিমগণ এ বিষয়ক হাদীসগুলিকে মুতাওয়াতির বলে গণ্য করেছেন।
এ ছাড়া আরো অগণিত আয়াত বা মুজিযা মুতাওয়াতির ও আহাদ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। সেগুলির বিস্তারিত তালিকার জন্যই পৃথক পুস্তকের প্রয়োজন। তাঁর দু‘আয় খাদ্যে অলৌকিক বরকতের ঘটনা ঘটেছে অগণিতবার। সামান্য কয়েকটি রুটি দ্বারা শতাধিক মানুষ তৃপ্তির সাথে আহার করেছেন। সামান্য আধ আজলা পানির মধ্যে তিনি হাত রাখলে আঙুলের মধ্য থেকে পানির ঝর্ণা বের হয় যাতে কয়েক হাজার মানুষের এক বিশাল বাহিনীর সকলেই ওযু-গোসল ও পানি পান করেন। তাঁর দু‘আয় মৃত ঝর্ণায় পানির সঞ্চার হয়, মাত্র দু পাত্র পানি থেকে হাজার হাজার পাত্র পূর্ণ করা হয়, অলৌকিকভাবে বৃষ্টিপাত হয়, ফসল অলৌকিকভাবে বৃদ্ধি পায়। বৃক্ষ তাঁর নির্দেশে পালন করে, কথা বলে ও সাক্ষ্য দেয়। শুষ্ক খেজুরের গুড়ি তাঁর জন্য মানব শিশুর ন্যায় ক্রন্দন করে। তাঁর দু‘আয় অন্ধ দৃষ্টিশক্তি প্রাপ্ত হয়, মৃত্যুপথযাত্রী রোগী আরোগ্য লাভ করেব, বাকশক্তিহীন কথা বলে, পাগল সুস্থ হয়।
তাঁর অলৌকিক নিদর্শন বা মুজিযার মধ্যে অন্যতম তাঁর ভবিষ্যদ্বাণীসমূহ। তিনি তাঁর নিজের সম্পর্কে, তাঁর বিভিন্ন সাহাবী সম্পর্কে, মানবজাতির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অসংখ্য ভবিষ্যৎবাণী করেছেন, যা তার জীবদ্দশায় ও তার পরে পরিপূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হয়েছে।[6]
[2] সূরা (৫৩) নাজ্ম: ১২-১৮।
[3] সূরা (৯৬) আলাক, ৯-১০ আয়াত।
[4] সূরা (৭২) জিন্ন, ১৯ আয়াত।
[5] সূরা (৫৪) কামার, ১-২ আয়াত।
[6] রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জীবনী ও মুজিযা সম্পর্কিত উপরের তথ্যাদি ও বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন: ইবনু হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবীয়াহ; ইবনু হিববান, আস সিরাতুন নাবাবীয়াহ; যাহাবী, আস সিরাতুন নাবাবীয়াহ, বাইহাকী, দালাইলুন নুবুওয়াহ, আহমদ ইবনু মুহাম্মাদ কাসতালানী, আল-মাওয়াহিবুল্লাদুন্নিয়াহ; মুহাম্মাদ ইবনু ইউসূফ শামী, আস-সীরাহ আশ-শামিয়্যাহ সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ; মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল বাকী যারকানী, শারহুল মাওয়াহিব; সাফিউদ্দীন মুবারাকপূরী, আর রাহীকুল মাখতুম; ড. মাহাদী রিযকুল্লাহ, আস সীরাতুন নাবাবীযা ফী দাওয়িল মাসাদিরিল আসলিয়্যাহ, ড. আকরাম দিয়া আর উমারী, আস সীরাতুন নাবাবীয়াহ আস সহীহাহ ও অন্যান্য সিরাত ও হাদীসের গ্রন্থ।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মাঝারি আকৃতির ছিলেন। তিনি বেঁটে ছিলেন না, আবার অতিরিক্ত লম্বাও ছিলেন ন। তাঁর কাঁধ প্রশস্ত, মাথা বড়, হাত-পায়ের আঙ্গুলগুলো পৌরুষ প্রকাশক ও শক্ত এবং মুখ বড় ছিল। তাঁর চক্ষু ছিল আকর্ষণীয়ভাবে বড় এবং ফাড়া। তাঁর শরীরের রং ছিল ফরসা, সুন্দর কিছুটা লালচে মিশ্রিত সাদা। তাঁর চেহারা মোবারক ছিল পূর্ণিমার চাঁদের মত সুন্দর ও মনেমুগ্ধকর।
তাঁর মাথা ভরা কাল চুল ছিল। তাঁর চুল বেশী কোঁকড়ান বা একবারে সোজা ছিল না, সামান্য কোঁকড়ান ছিল। তাঁর সুবিন্যস্ত চুল সাধারণত তাঁর কান পর্যন্ত লম্বা নেমে আসত। তিনি হজ্জ-ওমরা ছাড়া কখনো মাথা মুন্ডন করতেন না। ইন্তেকালের পূর্বেও তার চুল ও দাড়ি কাল ছিল। সামান্য ১৫/২০টি চুল সাদা হয়েছিল।
তিনি দৃঢ় পায়ে বড় বড় পদক্ষেপে দ্রুত হাঁটতেন, এমনভাবে যে তাকে দেখে মনে হত তিনি ঢালু যমিনের উঁচু থেকে নীচুতে নামছেন এবং পদক্ষেপের সাথে সাথে সামনে ঝুকে পড়ছেন।
তিনি জাগতিক চাকচিক্য ও বিলাসিতা থেকে নিজেকে দূরে রাখতেন। খুব সামান্য খাদ্য খেতেন। কখনো কখনো মাসের পর মাস তাঁর ঘরে কিছুই রান্না হত না। শুধুমাত্র ২/১টি খেজুর ও পানি খেয়েই দিন কাটাতেন। মেহমানদের সাথে তিনি কখনো পেটভরে খান নি। তিনি খাওয়ার সময়ে সাধারণত তিনটি আঙ্গুল ব্যবহার করতেন এবং খাওয়ার পরে আঙ্গুলগুলো চেটে নিতেন। তিনি সাধারণ খেজুরের ছোবড়ার বিছানায় শুতেন। তিনি ডান দিকে কাত হয়ে, ডান হাতের তালু তার ডান গালের নীচে রেখে ঘুমাতেন।
মদীনার জীবনে তিনি ছিলেন মুসলিম রাষ্ট্রের প্রধান। সকল যুদ্ধলব্ধ সম্পদের এক-পঞ্চমাংশ আল্লাহ তাঁর জন্য নির্ধারণ করে দেন। ফলে আল্লাহর নির্দেশ অনুসারেই প্রচুর সম্পদ তাঁর মালিকানায় আসত। কিন্তু তিনি নিজের জন্য টাকা পয়সা নিজের কাছে রাখতেন না। সবই তিনি বিলিয়ে দিতেন। তার ইন্তেকালের আগে তার কাছে মাত্র ৭টি দিরহাম ছিল যা তিনি বিলিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। তার ব্যবহারের বর্মটিও তিনি ইন্তেকালের কিছুদিন পূর্বে এক ইহুদীর কাছে ৩০ সা (প্রায় ৯০ কিলোগ্রাম) গমের বিনিময়ে বন্ধক রাখেন, যা তিনি ইন্তেকালের আগে আর ছাড়িয়ে আনতে পারেন নি। ইন্তেকালের সময় তিনি কোনো নগদ টাকা পয়সা রেখে যান নি। সামান্য কিছু খেজুরের বাগান তার ছিল। তিনি ওসিয়ত করেন যে তার মৃত্যুর পরে তার পরিত্যক্ত সম্পত্তি সাদকাহ বা ওয়াকফ দান বলে হণ্য হবে, তা ওয়ারিশদের মধ্যে বণ্টিত হবে না।
তিনি সুগন্ধি খুবই পছন্দ করতেন। তিনি সর্বদা সুগন্ধি ব্যবহার করতেন। কেউ তাঁকে সুগন্ধি উপহার দিলে তা কখনো ফেরত দিতেন না।
তিনি কথা বলতেন ধীরে এবং প্রতিটি শব্দ সুস্পষ্টভাবে উচ্চারণ করতেন। তিনি কখনো উচ্চশব্দে হাসতেন না। সর্বদা তিনি মৃদু হাসতেন। তিনি সবার সাথে হাসিমুখে মিলিত হতেন। কারো সাথে কথা বললে তিনি তাঁর দেহ ও মুখমণ্ডল পুরোপুরি তার দিকে ফিরিয়ে এমনভাবে মনোযোগ ও সম্মানের সাথে কথা বলতেন যে, তাঁর সাথে যেই কথা বলত সেই অনুভব করত যে, সে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট অত্যন্ত সম্মানিত ও প্রিয়।
তিনি অনাবিল হাসি তামাশা পছন্দ করতেন। কিন্তু কখনোই তিনি হাসি তামাশার জন্য এমন কথা বলতেন না যার মধ্যে মিথ্যার লেশমাত্র রয়েছে। পারিবারিক জীবনে তিনি তাঁর স্ত্রী-পরিজনদেরকে অত্যন্ত ভালবাসতেন। পারিবারিক মতভেদে কথা কাটাকাটিতে তাদের প্রতিবাদ, আপত্তি হাসিমুখে নীরবে শুনতেন। তিনি নিজের কাপড় নিজে পরিস্কার করতেন, নিজের ছাগল নিজে দোহন করতেন, নিজের কাজ নিজে করতেন।
তিনি কখনো তার কোনো খাদেম বা স্ত্রীকে ধমক দেন নি। তিনি কখনো চিৎকার করে কথা বলতেন না বা ঝগড়া বা গালিগালাজ করতেন না, কখনো অশ্লীল কথা বলতেন না। একমাত্র ইসলামের বিরোধিতা দেখলেই তিনি রাগান্বিত হতেন। এছাড়া কখনো তাকে রাগতে দেখা যায়নি। ব্যক্তিগত কারণে তিনি কারো উপর রাগ করেন নি, কোনো প্রতিশোধ নেন নি। কেউ তার প্রতি ব্যক্তিগত কোনো অপরাধ করলে বা তাঁকে কেউ কষ্ট দিলে, তিনি তা ক্ষমা করে দিতেন।
তিনি অত্যন্ত বিনয়ী ছিলেন। মদীনায় তিনি ছিলেন একছত্র অধিপতি, শাসক, সামাজিক ও ধর্মীয় প্রধান। কিন্তু কখনো তাঁর আচরণে শক্তি বা প্রতিপত্তির সামান্যতম প্রভাব ছিল না। মদীনার দরিদ্রতম বা নগণ্যতম ব্যক্তিকেও তিনি পরিপূর্ণ সম্মান দান করতেন, ডাকলে তার বাড়ীতে যেতেন, তার কাছে বসে তার কথা শুনতেন। তিনি সর্বদা অতি সাধারণ পোষাক ও বাসস্থান ব্যবহার করতেন। তাঁর বিনয়ের একটি দিক ছিল যে, কেউ তার সম্মানে উঠে দাঁড়াক এটা তিনি পছন্দ করতেন না। তাঁর সাহাবীগণ তাকে প্রাণের চেয়েও ভালবাসতেন, কিন্তু তাঁকে আসতে দেখলে তার সম্মানে উঠে দাঁড়াতেন না, কারণ তাঁরা জানতেন যে, তিনি তা পছন্দ করতেন না। তবে তিনি মাজলিস ছেড়ে প্রস্থান করার সময় যখন উঠে দাঁড়াতেন তখন উপস্থিত সাহাবীগণও তাঁর সাথে উঠে দাঁড়াতেন।[1]
এখানে দুটি শব্দ রয়েছে ‘আব্দ’ ও ‘হু’, অর্থাৎ তাঁহার আব্দ বা আল্লাহর আব্দ। আরবী ‘আব্দ’ (عَبْد) শব্দের ফার্সী ভাষায় অর্থ (বান্দা)। সাধারণভাবে বাংলাভাষায় এই ফার্সী শব্দটি প্রচলিত। আবদ বা বান্দার বাংলা অর্থ ‘‘দাস’’, ‘‘ক্রীতদাস’’ বা ‘‘চাকর’’। আরবী ভাষায় সাধারণভাবে (আব্দ) বলতে সৃষ্টি বা মানুষ বুঝানো হয়, কারণ প্রতিটি মানুষই আল্লাহর দাস বা বান্দা। আবূ সাঈদ খুদরী (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) রুকু থেকে উঠে দাঁড়ানো অবস্থায় দু‘আর মধ্যে বলতেন:
أَحَقُّ مَا قَالَ الْعَبْدُ وَكُلُّنَا لَكَ عَبْدٌ اللَّهُمَّ لا مَانِعَ لِمَا أَعْطَيْتَ وَلا مُعْطِيَ لِمَا مَنَعْتَ وَلا يَنْفَعُ ذَا الْجَدِّ مِنْكَ الْجَدُّ
‘‘আমরা সবাই তো আপনার দাস, আর একজন দাসের সবচেয়ে বড় সত্য ও সঠিক কথা হলো: হে আল্লাহ, আপনি যা দান করেন তা কেউ রোধ করতে পারে না, আর আপনি যা রোধ করেন তা কেউ দিতে পারে না এবং কোনো ক্ষমতাবান বা ধনবানের ক্ষমতা বা ধন আপনার কাছে তার কোনো উপকারে আসে না।’’[1]
আমরা পঞ্চম অধ্যায়ে শিরকের আলোচনায় দেখব যে, যুগে যুগে মানুষের বিশ্বাসের বিভ্রান্তি ও শির্কে নিপতিত হওয়ার মূল কারণ ছিল, ফিরিশতা, জিন, নবী, নেককার মানুষ, তাঁদের স্মৃতি বিজড়িত স্থান, দ্রব্য গাছ, পাথর বা প্রাকৃতিক শক্তির মধ্যে ইশ্বরত্ব বা ঐশ্বরিক শক্তি কল্পনা করে বা এদের সাথে মহান আল্লাহর বিশেষ সুপারিশ বা লেনদেনের সম্পর্ক আছে বলে বিশ্বাস করে জাগতিক বিপদ, আপদ, সমস্যা, অনাবৃষ্টি, অসুস্থতা, ফসলহীনতা ইত্যাদি থেকে মুক্তির জন্য এদের কাছে ধর্না দেওয়া, প্রার্থনা করা এবং এরা যেন তুষ্ট হয়ে ডাকে সাড়া দেয় সে জন্য এদের নামে বা এদের কবর, মূর্তি বা স্মৃতি বিজড়িত স্থানে মানত, ভেট, ফুল, সাজদা ইত্যাদি প্রদান।
নবী-রাসূলগণকে নিয়ে তাঁদের পরবর্তী উম্মতগণ এভাবে শির্কের মধ্যে নিপতিত হয়েছে। যে নবী রাসূলগণ মানবজাতিকে শির্কের অন্ধকার থেকে তাওহীদের আলোয় আনতে জীবনপাত করেছেন, তাঁদেরই উম্মতেরা তাঁদের তিরোধানের পরে তাঁদের মধ্যে ‘‘ইশ্বরত্ব’’ কল্পনা করে তাঁদের ইবাদত শুরু করে। তাঁদের মু’জিজা ও অলৌকিক নিদর্শনাবলীকে তারা তাঁদের ঐশ্বরিক শক্তির প্রমাণ হিসাবে পেশ করে আল্লাহর পরিবর্তে তাঁদের কাছেই প্রার্থনা, সাহায্য, বিপদমুক্তি ইত্যাদি চাওয়া, তাঁদের খুশি করতে ভেট, মানত ইত্যাদি প্রদান করা শুরু করে।
সৃষ্টির মধ্যে ‘‘ইশ্বরত্ব’’ কল্পনার প্রধান দুটি দিক: প্রথমত, সৃষ্টির সাথে স্রষ্টার বিশেষ সম্পর্ক দাবী করা। তাকে ইশ্বরের পুত্র, কন্যা বা বংশধর বলে দাবী করা। খ্রীষ্টানগণ আল্লাহর মহান রাসূল ঈসা (আঃ)-কে ‘‘আল্লাহর পুত্র’’ রূপে দাবী করে। তারা ‘‘পুত্রত্ব’’ বলতে জাগতিক পিতাপুত্র সম্পর্ক বুঝায় না। তাদের কাছে পুত্রতব অর্থ স্রষ্টা ঈসাকে (আ.) তার নিজের জাত বা সত্তা (Same Substance) থেকে সৃষ্টি করেছেন। কাজেই তাঁর মধ্যে ইশ্বরত্ব রয়েছে। অগণিত বিভ্রান্তি ও জঘন্য মিথ্যা কথা দিয়ে তারা বাইবেলের তাওহীদমূলক অসংখ্য নির্দেশনা ও উক্তিকে অপব্যাখ্যার মাধ্যমে বাতিল করে এই মত প্রতিষ্ঠা করেছেন। অনুরূপভাবে আরবের কাফিরগণ ফিরিশতাগণকে আল্লাহর সন্তান বা কন্যাসন্তান বলে বিশ্বাস করব।
সৃষ্টির মধ্যে ইশ্বরত্ব দাবীর দ্বিতীয় দিক হলো অবতারত্ব (Incarnation) দাবী। অমুকের মধ্যে স্র্ষ্ঠা বা তাঁর বিশেষ কোনো গুণ বা শক্তি মিশে গিয়েছে বা স্রষ্ঠার সাথে তার মিলন হয়েছে বা তিনি তাঁর সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছেন।
এ ধরনের সকল শিরকে মূলোৎপাটন করতে এবং সেগুলির দরজা বন্ধ করতে ইসলামী ঈমানের মধ্যে ‘‘মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূুলূহু’’ ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। তিনি আল্লাহর মনোনিত রাসূল, তাঁর মহত্তম সৃষ্টি ও তাঁর প্রিয়তম। কিন্তু সর্বাবস্থায় তিনি তাঁর বান্দা, দাস ও মানুষ। তিনি স্রষ্টার অবতার নন, স্রষ্টার সত্তার অংশ নন, স্রষ্টা বা তাঁর কোনো গুণের সাথে মিলে মিশে তিনি একাকার হয়ে যান নি। কোনো ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারী তিনি নন। তাঁর মর্যাদা আল্লাহর পূর্ণতম বান্দা ও উপাসক হওয়ার মধ্যে। তাঁকে পরিপূর্ণ ভক্তি, ভালবাসা, শ্রদ্ধা ও মর্যাদা প্রদানের সাথে সাথে সকল প্রকার শিরক মূলত বাড়াবাড়ি ও অতিভক্তি থেকে মুসলিম জাতিকে রক্ষা করার জন্য এই বিশ্বাস রক্ষা কবজ।
পূর্ববর্তী নবীগণও তাঁদের উম্মতকে ‘‘আল্লাহর বান্দা ও রাসূল’’ বিশ্বাস করতে শিখিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের উম্মতের পরবর্তীতে ভক্তিকে আনুগত্যের উপরে স্থান দিয়ে তাদেরকে পুত্র বা অবতার বলে দাবী করেছে। এভাবে তাঁদের শিক্ষা, ধর্ম ও শরীয়ত বিকৃত ও নষ্ট হওয়ার পরে আল্লাহ সর্বশেষ নবীর মাধ্যমে এভাবে তাওহীদের হেফাযত করেছেন।
এখনেও দুটি শব্দ রয়েছে: ‘রাসূল’ ও ‘হূ’, অর্থাৎ তাঁর (আল্লাহর) রাসূল। আরবী ‘রাসূল’ (رَسُول) শব্দের আভিধানিক অর্থ প্রেরিত, প্রেরণকৃত, দূত, প্রতিনিধি, বার্তাবাহক (Messenger, emissary, envoy, delegate, apostle) ইত্যাদি। ইসলামী পরিভাষায় রাসূল অর্থ আল্লাহর মনোনিত ও নির্বাচিত ব্যক্তি যাকে আল্লাহ ওহীর মাধ্যমে তাঁর বাণী ও নির্দেশনা প্রদান করেছেন এবং তা মানুষের কাছে প্রচারের নির্দেশ দিয়েছেন। এ সকল মনোনিত মানুষকে আল্লাহ দুটি নামে আখ্যায়িত করেছেন ‘নবী’ ও ‘রাসূল’। উভয় শব্দের আভিধানিক ও পারিভাষিক অর্থ ও পার্থক্য আমরা পরবর্তী অধ্যায়ে ‘আরকানুল ঈমান’-এর মধ্যে আলোচনা করব, ইনশা আল্লাহ।
এখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে আল্লাহর রাসূল হিসেবে বিশ্বাসের সাক্ষ্য প্রদান করা ঈমানের ভিত্তি। কুরআন কারীমের অসংখ্য আয়াত ও অগণিত হাদীস থেকে আমরা জানতে পারি যে, মুহাম্মাদ (ﷺ) আল্লাহর রাসূল এবং নবী। উভয় পদমর্যাদাই তাঁর জন্য প্রযোজ্য।
নবী-রাসূলগণের প্রেরণে উদ্দেশ্য সম্পর্কে আমরা পরবর্তী অধ্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। আমরা দেখব যে, নবী-রাসূলগণের প্রেরণ মানব জাতির প্রতি আল্লাহর প্রেম ও করুণার মহান নিদর্শন। আর এই করুণার সর্বশেষ প্রকাশ মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে রাসূল ও নবী হিসেবে প্রেরণ।
তাহলে আমরা দেখতে পাই যে, একজন মানুষকে মুসলিম হতে হলে তাকে তাওহীদের বিশ্বাসের সাথে সাথে সর্বান্তকরণে বিশ্বাস করতে হবে এবং সাক্ষ্য দিতে হবে যে, মুহাম্মাদ (ﷺ) আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। তিনি তাঁর মনোনিত ও নির্বাচিত বার্তাবাহক।
মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে রাসূল বলে বিশ্বাস করার অর্থ তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে যা কিছু শিক্ষা দিয়েছেন, যা কিছু বলেছেন সবকিছুকে সন্দেহাতীত বলে সত্য বিশ্বাস করা। কুরআন কারীম ও হাদীস শরীফে তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে এ বিশ্বাসের যে সকল দিক শিক্ষা দিয়েছেন তা আমরা নিম্নের কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ করতে পারি:
(১) তাঁর নুবুওয়াতের বিশ্বাস। অর্থাৎ তিনি নুবুওয়াত পেয়েছেন, তাঁর নুবুওয়াত সর্বজনীন, তাঁর মাধ্যমে নুবুওয়াতের সমাপ্তি ঘটেছে, তিনি নুবুওয়াতের দায়িত্ব পরিপুর্ণ ভাবে আদায় করেছেন, তিনি নুবুওয়াতের দায়িত্ব হিসেবে যা কিছু শিক্ষা দিয়েছেন সবই সন্দেহাতীতভাবে নির্ভুল।
(২) তাঁর আনুগত্য ও অনুসরণে বিশ্বাস। অর্থাৎ তাঁর আনুগত্য অপরিহার্য, তাঁর অনুসরণ মুক্তির পর্থ এবং তাঁর রীতির ব্যতিক্রম ঈমান বিধ্বংসী।
(৩) তাঁর মর্যাদা ও ভালবাসায় বিশ্বাস। অর্থাৎ তাঁর পরিপূর্ণ মর্যাদায় বিশ্বাস, মর্যাদার ক্ষেত্রে তাঁর শিক্ষার পূর্ণতায় বিশ্বাস, তাঁকে ভালবাসার অপরিহার্যতা এবং তাঁর কারণে তাঁর বংশধর, সাহাবীগণ এবং তাঁর আনুগত্যে-অনুসরণে অগ্রগামীদের ভালবাসা।
নিম্নে রিসালাতের বিশ্বাসের এ বিষয়গুলি ব্যাখ্যা করব। মহান আল্লাহর তাওফীক প্রার্থনা করছি।
৩. ২. ১. তাঁর নুবুওয়াত ও রিসালাত
একজন মুসলিম সন্দেহাতীতরূপে বিশ্বাস করেন যে, মুহাম্মাদ (ﷺ) আল্লাহর মনোনীত নবী ও রাসূল। মানবজাতির মুক্তির পথের নির্দেশনা দিতে, তাদের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক সকল কল্যাণ শিক্ষা দিতে এবং অকল্যাণ থেকে সতর্ক করতে আল্লাহ তাঁকে মনোনীত করেছেন। মানবজাতির মুক্তির পথ, কল্যাণ ও অকল্যাণের সকল বিষয় আল্লাহ তাঁকে জানিয়েছেন এবং তা মানুষদেরকে শিক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব তাঁকে দান করেছেন। আল্লাহ বলেছেন:
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ شَاهِدًا وَمُبَشِّرًا وَنَذِيرًا وَدَاعِيًا إِلَى اللَّهِ بِإِذْنِهِ وَسِرَاجًا مُنِيرًا
‘‘হে নবী, আমি আপনাকে প্রেরণ করেছি, সাক্ষীরূপে, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে এবং আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাঁর দিকে আহবানকারীরূপে এবং উজ্জ্বল প্রদীপরূপে।’’[1]
অন্যত্র আল্লাহ বলেন:
يَا أَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ وَإِنْ لَمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ وَاللَّهُ يَعْصِمُكَ مِنَ النَّاسِ
‘‘হে রাসূল, তোমার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তোমার উপর যা অবতীর্ণ করা হয়েছে তা প্রচার কর। যদি তা না কর তবে তুমি আল্লাহর বার্তা প্রচার করলে না। আল্লাহ তোমাকে মানুষদের থেকে রক্ষা করবেন।[2]
৩. ২. ২. তাঁর নুবওয়াতের সর্বজনীনতা
‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ বিশ্বাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে একজন মুসলিমকে অবশ্যই বিশ্বাস করতে হবে যে, মুহাম্মাদ (ﷺ) বিশ্বের সকল দেশের সকল জাতির সব মানুষের জন্য আল্লাহর মনোনীত রাসূল। তাঁর আগমনের দ্বারা পূর্ববর্তী সকল ধর্ম রহিত হয়ে গিয়েছে। তাঁর রিসালাতে বিশ্বাস করা ছাড়া কোনো মানুষ মুক্তির দিশা পাবে না। আল্লাহ বলেছেন:
وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلاَّ كَافَّةً لِلنَّاسِ بَشِيرًا وَنَذِيرًا
‘‘আমি তো আপনাক সমগ্র মানবজাতির জন্য সুসংবাদ প্রদানকারী ও ভয়প্রদর্শনকারী হিসাবে প্রেরণ করেছি।’’[3]
মহান আল্লাহ আরো বলেছেন:
قُلْ يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنِّي رَسُولُ اللَّهِ إِلَيْكُمْ جَمِيعًا الَّذِي لَهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ لا إِلَهَ إِلا هُوَ يُحْيِي وَيُمِيتُ فَآَمِنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ النَّبِيِّ الأُمِّيِّ الَّذِي يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَكَلِمَاتِهِ وَاتَّبِعُوهُ لَعَلَّكُمْ تَهْتَدُونَ
‘‘বল: হে মানবজাতি, নিশ্চয় আমি তোমাদের সকলের প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত রাসূল, যিনি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সার্বভৌমত্বের অধিকারী, তিনি ব্যতীত অন্য কোনো ইলাহ নেই, তিনিই জীবিত করেন ও মৃত্যু ঘটান; সুতরাং তোমরা ঈমান আন আল্লাহর প্রতি ও তাঁর বার্তাবাহক রাসূল উম্মী নবীর প্রতি, যিনি আল্লাহ ও তাঁর বাণীতে ঈমান আনেন এবং তোমরা তার অনুসরণ কর যাতে তোমরা পথ পাও।’’[4]
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেছেন:
تَبَارَكَ الَّذِي نَزَّلَ الْفُرْقَانَ عَلَى عَبْدِهِ لِيَكُونَ لِلْعَالَمِينَ نَذِيرًا
‘‘তিনিই মহিমাময় যিনি তাঁর বান্দার উপরে ফুরকান নাযিল করেছেন, যেন তিনি সমস্ত সৃষ্টি জগতের জন্য ভয় প্রদর্শনকারী হন।’’[5]
অন্যত্র ঘোষণা করা হয়েছে:
وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلا رَحْمَةً لِلْعَالَمِينَ
‘‘নিশ্চয় আমি আপনাকে সমস্ত সৃষ্টি জগতের জন্য করুণা বা রহমত-স্বরূপ প্রেরণ করেছি।’’[6]
আবূ হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,
فُضِّلْتُ عَلَى الأَنْبِيَاءِ بِسِتٍّ أُعْطِيتُ جَوَامِعَ الْكَلِمِ وَنُصِرْتُ بِالرُّعْبِ وَأُحِلَّتْ لِيَ الْغَنَائِمُ وَجُعِلَتْ لِيَ الأَرْضُ طَهُورًا وَمَسْجِدًا وَأُرْسِلْتُ إِلَى الْخَلْقِ كَافَّةً وَخُتِمَ بِيَ النَّبِيُّونَ
‘‘ছয়টি বিষয়ের মাধ্যমে আমাকে নবীগণের (সকল নবীর) উপরে মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য প্রদান করা হয়েছে: (১) আমাকে ব্যাপক অর্থবোধক উচাঙ্গের ভাব ও ভাষাময় বাক্য প্রদান করা হয়েছে, (২) আমাকে ভীতি দিয়ে সাহায্য করা হয়েছে, (৩) আমার জন্য যুদ্ধলব্ধ গনীমত বৈধ করা হয়েছে, (৪) পৃথিবীকে আমার জন্য পবিত্রার উপাদান ও মসজিদ বানিয়ে দেওয়া হয়েছে, (৫) আমাকে সকল সৃষ্টির প্রতি প্রেরণ করা হয়েছে এবং (৬) আমার দ্বারা নবীগণ সমাপ্ত হয়েছেন।[7]
অন্য হাদীসে জাবির ইবনু আব্দুল্লাহ (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
أُعْطِيتُ خَمْسًا لَمْ يُعْطَهُنَّ أَحَدٌ مِنْ الأَنْبِيَاءِ قَبْلِي نُصِرْتُ بِالرُّعْبِ مَسِيرَةَ شَهْرٍ وَجُعِلَتْ لِي الأَرْضُ مَسْجِدًا وَطَهُورًا وَأَيُّمَا رَجُلٍ مِنْ أُمَّتِي أَدْرَكَتْهُ الصَّلاةُ فَلْيُصَلِّ وَأُحِلَّتْ لِي الْغَنَائِمُ وَكَانَ النَّبِيُّ يُبْعَثُ إِلَى قَوْمِهِ خَاصَّةً وَبُعِثْتُ إِلَى النَّاسِ كَافَّةً وَأُعْطِيتُ الشَّفَاعَةَ
‘‘আমাকে পাঁচটি বিষয় প্রদান করা হয়েছে যা আমার পূর্বে কোনো নবীকে প্রদান করা হয় নি: (১) এক মাসের পথের দূরত্ব থেকে ভীতি দ্বারা আমাকে সাহায্য করা হয়েছে, (২) আমার জন্য পৃথিবীকে মাসজিদ ও পবিত্রতার উপাদান করে দেওয়া হয়েছে, আমার উম্মাতের যে কোনো মানুষ যেখানেই তার সালাতের সময় উপস্থিত হবে সেখানেই সে সালাত আদায় করবে, (৩) আমার জন্য যুদ্ধলব্ধ গনীমতের সম্পদ বৈধ করা হয়েছে, (৪) পূর্ববর্তী নবীদেরকে পাঠানো হতো বিশেষভাবে তাঁর নিজের সম্প্রদায়ের জন্য আর আমাকে পাঠানো হয়েছে সকল মানুষের জন্য এবং (৫) আমাকে শাফা‘আত প্রদান করা হয়েছে।[8]
কাজেই যদি কেউ বিশ্বাস করে যে মুহাম্মাদ (ﷺ) কোনো নির্দিষ্ট যুগের বা বিশেষ জাতির জন্য প্রেরিত নবী তবে তিনি ইসলামের গন্ডিতে প্রবেশ করতে পারবেন না, যদিও তিনি তাঁকে সর্বশ্রেষ্ঠ নবী বলে বিশ্বাস করেন। কারণ মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে রাসূল বলে বিশ্বাস করার অর্থ তার সকল কথা ও শিক্ষাকে সত্য বলে বিশ্বাস করা। তাঁর কিছু কথাকে অবিশ্বাস করার অর্থ তাঁকে অবিশ্বাস করা।
৩. ২. ৩. খাতমুন নুবুওয়াত বা নুবুওয়াতের সমাপ্তি
একজন মুসলিম আরো বিশ্বাস করেন যে, মুহাম্মদ (ﷺ) আল্লাহর মনোনীত সর্বশেষ নবী ও রাসূল, তাঁর পরে আর কোনো ওহী নাযিল হবে না এবং কোনো নবী বা রাসূল আসবেন না। বস্ত্তত, কুরআন ও হাদীসের এ বিষয়ক কোনো ঘোষণা না থাকলেও কয়েকটি কারণে মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে শেষ নবী হিসেবে বিশ্বাস করতে আমরা বাধ্য হতাম।
প্রথমত, সকল নবীই সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন তাঁর পরে অন্য নবী, রাসূল বা বার্তাবাহক আগমন করবেন, যিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে বাণী গ্রহণ করে মানুষদেরকে জানাবেন। পক্ষান্তরে মহান আল্লাহ কুরআন কারীমে বা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হাদীস শরীফে কখনো কোনোভাবে জানান নি যে, তাঁর পরে মানব জাতির মধ্যে কোনো নবী, রাসূল বা বার্তাবাহক আসবেন। এ বিষয়টিই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে যে, তাঁর পরে কোনো নবী আসবে না।
দ্বিতীয়ত, পূর্ববর্তী নবী-রাসূলদের দাওয়াত ছিল সাময়িক এবং নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর জন্য। এজন্য তাঁদের প্রতি প্রেরিত ওহী চূড়ান্তভাবে সংরক্ষিত হতো না। কাজেই তাঁদের পরে নতুন নবীর প্রয়োজনীয়তা দেখা দিত। মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর দীনের সর্বজনীনতা ও পরিপূর্ণতার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে কুরআন ও হাদীসে বারংবার এবং তাঁর দীনকে পরিপূর্ণভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে। কাজেই এরপর আর কোনো নতুন নবীর আগমন নিষ্প্রয়োজন।
কিন্তু বিষয়টি এখানেই শেষ হয় নি। উপরন্তু কুরআন কারীমে স্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়েছে যে, মুহাম্মাদ (ﷺ) শেষ নবী। অসংখ্য হাদীসে এ বিষয়ে বারংবার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেছেন:
مَا كَانَ مُحَمَّدٌ أَبَا أَحَدٍ مِنْ رِجَالِكُمْ وَلَكِنْ رَسُولَ اللَّهِ وَخَاتَمَ النَّبِيِّينَ وَكَانَ اللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمًا
‘‘মুহাম্মাদ তোমাদের মধ্যে কোনো পুরুষের পিতা নন, বরং তিনি আল্লাহর রাসূল এবং শেষ নবী। আল্লাহ সর্ব বিষয়ে সর্বজ্ঞ।’’[9]
মুতাওয়াতির পর্যায়ে বর্ণিত অর্ধশতাধিক সহীহ হাদীসে খাতমুন নুবুওয়াত বা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মাধ্যমে নুবুওয়াতের পরিসমাপ্তির বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। উপরে উল্লিখিত হাদীসে আমরা দেখেছি যে, আবূ হুরাইরা (রা) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: ‘‘ছয়টি বিষয়ের মাধ্যমে আমাকে নবীগণের (সকল নবীর) উপরে মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য প্রদান করা হয়েছে: ... (৬) আমার দ্বারা নবীগণ সমাপ্ত হয়েছেন।’’
অন্য হাদীসে আবূ হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,
كَانَتْ بَنُو إِسْرَائِيلَ تَسُوسُهُمْ الأَنْبِيَاءُ كُلَّمَا هَلَكَ نَبِيٌّ خَلَفَهُ نَبِيٌّ وَإِنَّهُ لا نَبِيَّ بَعْدِي وَسَيَكُونُ خُلَفَاءُ فَيَكْثُرُونَ قَالُوا فَمَا تَأْمُرُنَا قَالَ: فُوا بِبَيْعَةِ الأَوَّلِ فَالأَوَّلِ أَعْطُوهُمْ حَقَّهُمْ فَإِنَّ اللَّهَ سَائِلُهُمْ عَمَّا اسْتَرْعَاهُمْ.
‘‘ইস্রায়েল সন্তানগণকে (বনী ইসরাঈলকে) শাসন করতেন নবীগণ। যখনই কোনো নবী মৃত্যুবরণ করতেন তখন অন্য একজন নবী তাঁর স্থলাভিষিক্ত হতেন। আর আমার পরে কোনো নবী নেই, কিন্তু খলীফাগণ থাকবেন এবং তারা সংখ্যায় অনেক হবেন। উপস্থিত সাহাবীগণ বলেন: আপনি আমাদেরকে তাদের বিষয়ে কি নির্দেশ দিচ্ছেন। তিনি বলেন: ধারাবাহিকভাবে প্রথম ব্যক্তির পরে পরবর্তী ব্যক্তি এভাবে তাদের বাইয়াত বা আনুগত্যের প্রতিজ্ঞা রক্ষা করবে এবং তাদেরকে তাদের প্রাপ্য (আনুগত্য) প্রদান করবে। আল্লাহ তাদেরকে তাদের অধীনস্থ জনগণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন।’’[10]
সা’দ ইবনু আবী ওয়াক্কাস বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আলীকে (রা) বলেন:
أَنْتَ مِنِّي بِمَنْزِلَةِ هَارُونَ مِنْ مُوسَى إِلاَّ أَنَّهُ لا نَبِيَّ بَعْدِي
‘‘মূসার সাথে হারূনের মর্যাদা যেরূপ ছিল আমার সাথে তোমার মর্যাদা সেরূপ, ব্যতিক্রম এই যে, আমার পরে কোনো নবী নেই।’’[11]
আবূ হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
مَثَلِي وَمَثَلُ الأَنْبِيَاءِ مِنْ قَبْلِي كَمَثَلِ رَجُلٍ بَنَى بُنْيَانًا فَأَحْسَنَهُ وَأَجْمَلَهُ إِلا مَوْضِعَ لَبِنَةٍ مِنْ زَاوِيَةٍ مِنْ زَوَايَاهُ فَجَعَلَ النَّاسُ يَطُوفُونَ بِهِ وَيَعْجَبُونَ لَهُ وَيَقُولُونَ هَلا وُضِعَتْ هَذِهِ اللَّبِنَةُ قَالَ فَأَنَا اللَّبِنَةُ وَأَنَا خَاتَمُ النَّبِيِّينَ
‘‘আমার ও আমার পূর্ববর্তী নবীদের উদাহরণ এক ব্যক্তির মত যিনি একটি খুবই সুন্দর ও মনোরম ইমারত তৈরী করেছে, কিন্তু ইমারতের এক দিকে একটি ইটের জায়গা খালি রেখেছেন। মানুষেরা আশ্চর্য হয়ে এই মনোরম ইমরতটির চারিদিকে ঘুরতে থাকে এবং বলতে থাকে: এ ইটটি যদি স্থাপন করা হতো! তিনি বলেন: আমিই এই সর্বশেষ ইট, আমিই সর্বশেষ নবী।’’[12]
অন্য হাদীসে জাবির ইবনু আব্দুল্লাহ (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
مَثَلِي وَمَثَلُ الأَنْبِيَاءِ كَمَثَلِ رَجُلٍ بَنَى دَارًا فَأَتَمَّهَا وَأَكْمَلَهَا إِلا مَوْضِعَ لَبِنَةٍ فَجَعَلَ النَّاسُ يَدْخُلُونَهَا وَيَتَعَجَّبُونَ مِنْهَا وَيَقُولُونَ لَوْلا مَوْضِعُ اللَّبِنَةِ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ (ﷺ) فَأَنَا مَوْضِعُ اللَّبِنَةِ جِئْتُ فَخَتَمْتُ الأَنْبِيَاءَ
‘‘আমার ও অন্যান্য সকল নবীর উদাহরণ একজন ব্যক্তির ন্যায়, যিনি একটি বাড়ি তৈরি করেছেন এবং তাকে পূর্ণতা দান করেছেন, কিন্তু একটি ইটের স্থান অপূর্ণ রেখেছেন। মানুষেরা এ বাড়িতে প্রবেশ করতে লাগল এবং অবাক হতে লাগল। তারা বলতে লাগল, এই ইটের স্থানটি যদি অপূর্ণ না থাকত! রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, আমিই সেই ইটের স্থান, আমি এসে নবীগণের সমাপ্তি টেনেছি।’’[13]
অন্য হাদীসে জুবাইর ইবনু মুতয়িম (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
إِنَّ لِي أَسْمَاءً أَنَا مُحَمَّدٌ وَأَنَا أَحْمَدُ وَأَنَا الْمَاحِي الَّذِي يَمْحُو اللَّهُ بِيَ الْكُفْرَ وَأَنَا الْحَاشِرُ الَّذِي يُحْشَرُ النَّاسُ عَلَى قَدَمَيَّ وَأَنَا الْعَاقِبُ الَّذِي لَيْسَ بَعْدَهُ أَحَدٌ (نَبِيٌّ)
‘‘আমার অনেক নাম আছে। আমি মুহাম্মাদ, এবং আমি আহমদ, এবং আমি ‘মাহী’ (উচ্ছেদকারী), আমার মাধ্যমে আল্লাহ কুফ্র উচ্ছেদ করবেন, এবং আমি ‘হাশির’ (একত্রিতকারী), আমার পদদ্বয়ের নিকটেই মানুষেরা কিয়ামতের দিন একত্রিত হবে, এবং আমি ‘আকিব’ (সর্বশেষ), যার পরে আর কোনো নবী নেই।’’[14]
অন্য হাদীসে আনাস ইবনু মালিক (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
إِنَّ الرِّسَالَةَ وَالنُّبُوَّةَ قَدْ انْقَطَعَتْ فَلا رَسُولَ بَعْدِي وَلا نَبِيَّ
‘‘রিসালাত বা রাসূলের পদ এবং নুবুওয়াত বা নবীর পদ শেষ হয়ে গিয়েছে, কাজেই আমার পরে কোনো রাসূল নেই এবং কোনো নবীও নেই।’’[15]
এভাবে বিভিন্ন হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) অত্যন্ত পরিস্কারভাবে ঘোষণা করেছেন যে, তিনি আল্লাহর সর্বশেষ নবী ও রাসূল, তাঁর আগমনের সাথে সাথে নুবুওয়াত ও রিসালাতের সমাপ্তি ঘটেছে। তাঁর পরে আর কোনো নবী বা রাসূল আসবেন না। তিনি একথাও স্পষ্ট জানিয়েছেন যে, তাঁর পরে যদি কেউ নুবুওয়াতের দাবী করে তবে সে অবশ্যই একজন ঘোর মিথ্যাবাদী ভন্ড। বিভিন্ন হাদীসে তিনি তাঁর উম্মতকে ভন্ড নবীদের আবির্ভাবের সংবাদ দান করে তাদের থেকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। এক হাদীসে জাবির ইবনু সামুরাহ (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,
إِنَّ بَيْنَ يَدَيْ السَّاعَةِ كَذَّابِينَ فَاحْذَرُوهُمْ
‘‘নিশ্চয় কিয়ামতের পূর্বেই অনেক ঘোর মিথ্যাবাদীর (ভন্ড নবীর) আবির্ভাব ঘঠবে। তোমরা তাদের থেকে সাবধান থাকবে।’’[16]
গবেষকগণ উল্লেখ করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মাধ্যমে নুবুওয়াতের সমাপ্তির বিষয়ে ৩৭ জন সাহাবী থেকে সহীহ সনদে ৬৫টি হাদীস বর্ণিত হয়েছে।[17] এভাবে আমরা দেখছি যে, কুরআন কারীমের সুস্পষ্ট নির্দেশনার পাশাপাশি মুতাওয়াতির হাদীসের মাধ্যমে বিষয়টি সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণিত। বরং প্রকৃত বিষয় যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নবুয়ত ও খাতমুন-নুবুওয়াত একইভাবে বর্ণিত ও প্রমাণিত। যারা তাঁর নুবুওয়াতের বিষয় বর্ণনা করেছেন তাঁরাই তাঁর খাতমুন নুবুওয়াতের বিষয়ও বর্ণনা করেছেন। সাহাবীগণ সর্বসম্মতভাবে নবুওয়তের দাবিদার এবং তাদের অনুসারীদেরকে ধর্মত্যাগী মুরতাদ বলে গণ্য করেছেন।
যদি রসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পরে কেউ নিজেকে নবী বলে দাবি করে বা কেউ এরূপ দাবিদারের কথা সত্য বলে মনে করে তবে সে নিঃসন্দেহে ভন্ড ও মিথ্যাবাদী দাজ্জাল বা এরূপ ভন্ডের অনুসারী। যদি কোনো মুসলিম নামধারী এরূপ দাবি করে বা এরূপ দাবিদারের কথা বিশ্বাস করে তবে সে ধর্মত্যাগী মুরতাদ বলে গণ্য হবে।
উপরন্তু যদি কেউ বিশ্বাস করে যে মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর পরে কোনো নবী বা রাসূল এসেছেন, আসতে পারেন, আসার সম্ভাবনা আছে বা আসা অসম্ভব নয় তবে সে ব্যক্তিও অমুসলিম কাফির ও ধর্মত্যাগী মুরতাদ বলে গণ্য হবে, যদিও সে মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -কে একজন নবী ও রাসূল বলে মানে, অথবা তাঁকে শ্রেষ্ঠ নবী বলে মানে, অথবা তাঁর শরীয়তের বিধান মেনে চলে। এই ব্যক্তি মূলত ‘‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’’-য় বিশ্বাস করে নি। কারণ কুরআনের মাধ্যমে এবং অগণিত মুতাওয়াতির হাদীসের মাধ্যমে প্রমাণিত তাঁর দ্ব্যর্থহীন শিক্ষাকে অস্বীকার ও অমান্য করলে আর তাঁর নুবুওয়াতের স্বীকৃতি দেওয়ার অর্থ থাকে না।
এখানে উল্লেখ্য যে, ইসলামের সোনালী দিনগুলিতে নুবুওয়াতের দাবি করে কেউ ইসলামের ক্ষতিসাধন করতে পারে নি। কারণ এ বিষয়ে মুসলিম সমাজ ও রাষ্ট্রের সচেতনতা ছিল সুস্পষ্ট। কিন্তু গত কয়েক শতাব্দী যাবত অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। বিশেষত ইসলামের মৌলিক বিষয়াদি সম্পর্কে মুসলিমদের অজ্ঞতা এবং সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক শাসকগণের কূটকৌশলের কারণে এ সকল ভন্ড মুসলিম সমাজের বিশেষ ক্ষতি সাধন করতে এবং অসংখ্য মুসলিমকে ধর্মচ্যুত করতে সক্ষম হয়েছে। এ সকল ভন্ডের অন্যতম পাঞ্জাবের গোলাম আহমদ কাদিয়ানী (১৮৪০-১৯০৮ খৃ)।
এখানে উল্লেখ্য যে, গোলাম আহমদ ও তার মত ভন্ড নবীরা সরাসরি নুবুওয়াত দাবি করে নি; কারণ তাহলে কোনো মুসলিমই তার দাবি গ্রহণ করবে না। বরং তারা প্রথমে বেলায়াত, কাশফ, ইলহাম, ইলকা ইত্যাদি দাবি করে। এরপর তারা নিজেদেরকে মুজাদ্দিদ বলে দাবি করে। এগুলি সবই ইসলামী পরিভাষা ও ইসলাম স্বীকৃত বিষয়। কিন্তু এগুলির অর্থ ও মর্ম না জানার কারণে অনেকেই এ সকল কথা দ্বারা বিভ্রান্ত হয়। এভাবে তারা যখন কিছু মানুষকে তাদের একান্ত ভক্ত হিসেবে পেয়ে যায়, তখন বিভিন্ন কৌশলে নুবুওয়াত দাবি করে। আর তার অনুসারী ভক্তরা বিভিন্ন অজুহাত ও ব্যাখ্যা দিয়ে তার দাবি মেনে নেয়।
এ সকল বিষয় বিস্তারিত আলোচনা আমাদের গ্রন্থের পরিসরে সম্ভব নয়। তবে সংক্ষেপে এতটুকু বলা যায় যে, খাতমুন নুবুওয়াতের একটি দিক এই যে, ইসলামকে জানতে, বুঝতে, ব্যাখ্যা করতে বা বিধান দিতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পরে আর কোনো ‘ব্যক্তির’ কোনো ‘ইসমাত’ (অভ্রান্ততা), কাদাসাত (পবিত্রতা) বা বিশেষ পদমর্যাদা নেই।
ইসলামকে জানার জন্য কুরআন হাদীসের আলোকে মুসলিম উম্মাহর আলিমগণ ইজতিহাদ করবেন, কিন্তু কোনো মুজতাহিদ দাবি করতে পারবেন না যে, তাঁর মতটি কোনোভাবে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত এবং সেটিই ইসলামের একমাত্র অভ্রান্ত ব্যাখ্যা, অথবা মহান আল্লাহ তাকে বিশেষ কোনো পদমর্যাদা প্রদান করেছেন। উম্মাতের মধ্যে আলিম-মুজতাহিদগণ থাকবেন। তাঁদের যোগ্যতা তাঁদের ইলম ও ইখলাসে, আল্লাহর বা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পক্ষ থেকে সরাসরি কোনো বাণী বা নির্দেশনা গ্রহণের মাধ্যমে নয়। কাজেই কোনো আলিম বা বুজুর্গ বলে পরিচিত ব্যক্তি যদি এরূপ কোনো ‘পদমর্যাদা’, ‘ইসমাত’ বা ‘অভ্রান্ততা’ দাবি করেন, বা নিজের মতটি সরাসরি আল্লাহ বা তাঁর রাসূলের (ﷺ) নিকট থেকে প্রাপ্ত এবং অন্যান্য আলিমদের মতামত এদিক থেকে অধিকতর মর্যাদাময় ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বলে দাবি করেন তবে তিনি ভন্ড প্রতারক মিথ্যাবাদী অথবা শয়তান কর্তৃক প্রতারিত।
ইসলামে কাশফ, ইলহাম, ইলকা ও সত্য স্বপ্ন রয়েছে। তবে এগুলি একান্তই আল্লাহর পক্ষ থেকে দেওয়া ব্যক্তিগত সম্মান, কারামত ও নিয়ামত মাত্র। এগুলি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা অন্য কোনো মানুষের জন্য দীন বুঝার বা দীনের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে প্রমাণ বা ভিত্তি নয়। যদি কেউ নিজেকে এরূপ কাশফ, ইলকা বা ইলহাম-ধারী বলে দাবি করেন বা এই দাবির ভিত্তিতে নিজের মতটির নির্ভুলতা, অভ্রান্ততা (ইসমাত) বা বিশেষত্ব দাবি করেন তবে তিনিও ভন্ড, প্রতারক মিথ্যাবাদী অথবা শয়তান কর্তৃক প্রতারিত।
যুগে যুগে মুসলিম সমাজে মুজাদ্দিদ বা সংস্কারক আসবেন বলে আবূ দাউদ সংকলিত একটি হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে কেউ কখনোই নিজেকে মুজাদ্দিদ দাবি করেন নি। আলিমদের কর্ম বিবেচনা করে সাধারণত তাঁদের মৃত্যুর অনেক পরে পরবর্তী যুগের আলিমগণ কাউকে কাউকে মুজাদ্দিদ বলে মনে করেছেন। এ-ই ‘মনে করা’ বা ধারণা করাও একান্তই ব্যক্তিগত ইজতিহাদ। কোন যুগে কে বা কারা মুজাদ্দিদ ছিলেন সে বিষয়ে আলিমদের অনেক মতভেদ রয়েছে।
গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর পূর্বে কেউ কখনো নিজেকে মুজাদ্দিদ বলে দাবি করেন নি। যদি কেউ নিজেকে মুজাদ্দিদ বলে দাবি করে, অথবা তার অনুসারীগণ তার জীবদ্দশাতেই তাকে মুজাদ্দিদ বলে দাবি ও প্রচার করে আর তিনি তা সমর্থন করেন এবং তার এই ‘পদমর্যাদা’-র কারণে তার মতের বিশেষত্ব, অভ্রান্ততা বা পবিত্রতা দাবি করেন তবে তিনিও অনুরূপভাবে মিথ্যাবাদী ভন্ড প্রতারক বা শয়তান কর্তৃক প্রতারিত।
এগুলি সবই নুবুওয়াত দাবি করার বিভিন্ন পর্যায় ও পদক্ষেপ। এগুলির পরে কেউ যদি সরাসরি নুবুওয়াত দাবি করে তবে সে নিঃসন্দেহে প্রতারক ভন্ড ও ধর্মত্যাগী মুরতাদ কাফির।
[2] সূরা (৫) মায়িদা: ৬৭ আয়াত।
[3] সূরা (৩৪) সাবা: ২৮ আয়াত।
[4] সূরা (৭) আ’রাফ: ১৫৮ আয়াত।
[5] সূরা (২৫) ণফুরকান: ১ আয়াত।
[6] সূরা (২১) আনবিয়া: ১০৭ আয়াত।
[7] মুসলিম, আস-সহীহ ১/৩৭১।
[8] বুখারী, আস-সহীহ ১/১৬৮।
[9] সূরা (৩৩) আহযাব: ৪০ আয়াত।
[10] বুখারী, আস-সহীহ ৩/১২৭৩; মুসলিম, আস-সহীহ ৩/১৪৭১; ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ৬/৪৯৫, ৮/১১০, ১০/৫৭৭।
[11] বুখারী, আস-সহীহ ২/৯৬০, ৩/১৩৫৭, ৪/১৫৫১; মুসলিম, আস-সহীহ ৪/১৮৭০।
[12] বুখারী, আস-সহীহ ৩/১৩০০; মুসলিম, আস-সহীহ ৪/১৭৯০-১৭৯১; ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ৬/৫৫৮।
[13] বুখারী, আস-সহীহ ৩/১৩০০; মুসলিম, আস-সহীহ ৪/১৭৯১।
[14] বুখারী, আস-সহীহ ৩/১২৯৯, ৪/১৫৯২, ১৮৫৮; মুসলিম, আস-সহীহ ৪/১৮২৮।
[15] তিরমিযী, আস-সুনান ৪/৫৩৩; আহমদ, আল-মুসনাদ ৩/২৬৭; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ৪/৪৩৩। হাদীসটি ইমাম মুসলিমের শর্তানুসারে সহীহ।
[16] মুসলিম, আস-সহীহ ৩/১৪৫৪, ৪/২২৩৯।
[17] মুতয়িব ইবনু মুকবিল আশ-শাস্সান, খাতমুন নুবুওয়াত, পৃ. ২২-২৩।
একজন মুসলিম সর্বান্তঃকরণে বিশ্বাস করেন যে, মুহাম্মদ (ﷺ) পরিপূর্ণ বিশ্বস্ততার সাথে আল্লাহর সর্বশেষ ও সর্বজনীন নবী ও রাসূল হিসাবে তার নুবুওয়াতের ও রিসালাতের দায়িত্ব পালন করেছেন। আল্লাহর সকল বাণী, শিক্ষা ও নির্দেশ তিনি পরিপূর্ণভাবে তাঁর উম্মতকে শিখিয়ে দিয়েছেন, কোনো কিছুই তিনি গোপন করেন নি। আমরা দেখেছি আল্লাহ তাকে প্রচারের দায়িত্ব দান করে বলেছেন:
يَا أَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ وَإِنْ لَمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ
‘‘হে রাসূল, তোমার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তোমার উপর যা অবতীর্ণ করা হয়েছে তা প্রচার কর। যদি তা না কর তবে তুমি আল্লাহর বার্তা প্রচার করলে না।’’[1]
নিঃসন্দেহে তিনি আল্লাহর বার্তা প্রচার করেছেন এবং তাঁর প্রচারের দায়িত্ব পুরোপুরি পালন করেছেন। আল্লাহ বলেছেন:
فَإِنْ أَعْرَضُوا فَمَا أَرْسَلْنَاكَ عَلَيْهِمْ حَفِيظًا إِنْ عَلَيْكَ إِلا الْبَلاغُ
‘‘আর (কাফিরেরা) যদি আপনার আহবানে সাড়া না দিয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে আপনাকে আমি তাদের রক্ষাকর্তারূপে প্রেরণ করি নি। আপনার উপরে তো শুধু প্রচারের দায়িত্ব।’’[2]
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বিদায় হজ্জের সময় তার সাহাবীদের সামনে প্রশ্ন করেন: আমি কি আল্লাহ বাণী সকল প্রচার করেছি? সাহাবীগণ একবাক্যে বলেন, হ্যাঁ। তিনি বলেন:
وَأَنْتُمْ تُسْأَلُونَ عَنِّي فَمَا أَنْتُمْ قَائِلُونَ قَالُوا نَشْهَدُ أَنَّكَ قَدْ بَلَّغْتَ وَأَدَّيْتَ وَنَصَحْتَ
‘‘তোমাদেরকে আমার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হবে। তোমরা কি বলবে? তার বলেন: ‘‘আমরা সাক্ষ্য দিব যে, আপনি প্রচার করেছেন, রিসালাতের দায়িত্ব পুরোপুরি পালন করেছেন এবং উম্মতের কল্যাণ কামলায় তাদের মঙ্গলের সকল উপদেশ তাদেরকে জানিয়েছেন।’’[3]
এরপর আল্লাহ ইসলামের পূর্ণতার ঘোষণা দিয়ে নিম্নের আয়াত নাযিল করেন:
الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الإِسْلامَ دِينًا
‘‘আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দীন (ধর্ম) পূর্ণাঙ্গ করলাম, তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দীন মনোনীত করলাম।’’[4]
ইরবাদ ইবনু সারিয়া (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
قَدْ تَرَكْتُكُمْ عَلَى الْبَيْضَاءِ لَيْلُهَا كَنَهَارِهَا لا يَزِيغُ عَنْهَا بَعْدِي إِلا هَالِكٌ
‘‘আমি তোমাদেরকে আলোকোজ্জ্বল পরিস্কার চকচকে ধবধবে রাস্তার উপর রেখে গেলাম, যেখানে রাতও দিনের মত আলোকিত উজ্জ্বল। শুধুমাত্র ধ্বংসপ্রাপ্তরাই আমার পরে এই রাস্তা থেকে সরে অন্য পথে যাবে।’’[5]
আব্দুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল আস (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন;
إِنَّهُ لَمْ يَكُنْ نَبِيٌّ قَبْلِي إِلا كَانَ حَقًّا عَلَيْهِ أَنْ يَدُلَّ أُمَّتَهُ عَلَى خَيْرِ مَا يَعْلَمُهُ لَهُمْ وَيُنْذِرَهُمْ شَرَّ مَا يَعْلَمُهُ لَهُمْ
‘‘আমার পূর্বের প্রত্যেক নবীরই দায়িত্ব ছিল যে, তিনি তাঁর উম্মতের জন্য যত ভালো বিষয় জানেন সে বিষয়ে তাদেরকে নির্দেশনা দান করবেন, এবং তিনি তাদের জন্য যত খারাপ বিষয়ের কথা জানেন সেগুলি থেকে তাদেরকে সাবধান করবেন।’’[6]
আবূ যার গিফারী (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
مَا بَقِيَ شَيْءٌ يُقَرِّبُ إلى الجَنَّةِ وَيُبَاعِدُ مِنَ النَّارِ إلا وَقَدْ بُيِّنَ لَكُمْ
‘‘জান্নাতের নিকটে নেওয়ার ও জাহান্নাম থেকে দূরে নেওয়ার সকল বিষয়ই তোমাদেরকে বর্ণনা করে দেওয়া হয়েছে।’’[7]
এভাবে আমরা দেখতে পাই যে, পবিত্র কুরআনে এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হাদীসে বিশেষভাবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর রিসালাতের দায়িত্ব পরিপূর্ণভাবে পালন করেছেন। উম্মাতের মুক্তি ও কল্যাণের সকল তথ্য সুস্পষ্টরূপে জানিয়ে দিয়েছেন। এরপরেও যদি কেউ বিশ্বাস করেন যে, তিনি কোনো শিক্ষা গোপন রেখে গিয়েছেন, গোপনে কাউকে জানিয়ে গিয়েছেন অথবা ইসলামের যে শিক্ষা তিনি সবাইকে দান করেছেন তাতে অপূর্ণতা আছে, অথবা তার পরে কেউ ইসলামের পূর্ণতা দান করতে পারে, তাহলে তিনি (মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ) এই কথা বিশ্বাস করেন নি। বরং তিনি দাবি করেছেন যে, মুহাম্মাদ (ﷺ) আল্লাহর রাসূল হিসাবে তাঁর দায়িত্ব পালন করেন নি (নাউযুবিল্লাহ!)।
[2] সূরা (৪২) শূরা: ৪৮ আয়াত। আরো দেখুন: সূরা আল ইমরান: ২০; মাইদা: ৯২, ৯৯; রা’দ: ৪০; ইব্রাহীম: ৫২; নাহল: ৩৫, ৮২; নূর: ৫৪; আনকাবুত: ১৮; তাগাবূন: ১২।
[3] মুসলিম, আস-সহীহ ২/৮৯০।
[4] সূরা (৫) মায়িদা: ৩ আয়াত।
[5] ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ১/৪; ইবনু আবী আসিম, আস-সুন্নাহ ১/২৬।
[6] মুসলিম, আস-সহীহ ৩/১৪৭২।
[7] তাবারানী, আল-মু’জাম আল-কাবীর ২/১৫৫-১৫৬; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৮/২৬৩; হাদীসটির সনদ সহীহ।
একজন মুসলিম বিশ্বাস করেন যে, মহানবী মুহাম্মাদ (ﷺ) আল্লাহর মনোনীত সর্বশ্রেষ্ঠ, সর্বজনীন ও সর্বশেষ নবী ও রাসূল হিসাবে আল্লাহর পক্ষ থেকে যা কিছু উম্মতকে শিখিয়েছেন ও জানিয়েছেন সবকিছুই তিনি সত্য বলেছেন। তার সকল শিক্ষা, সকল কথা সন্দেহাতীতভাবে সত্য। উম্মতের দায়িত্ব হলো, কথাটি তিনি বলেছেন কিনা, কর্মটি তিনি করেছেন কিনা বা শিক্ষাটি তিনি দিয়েছেন কিনা তা যাচাই করা। কোনো কথা, শিক্ষা বা কর্ম তাঁর বলে প্রমাণিত হলে তা সত্য বলে গ্রহণ করায় কোনো মুমিন দ্বিধা করতে পারেন না। এ হলো তাঁকে রাসূল বলে বিশ্বাস করার অর্থ। মহান আল্লাহ বলেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَآَمِنُوا بِرَسُولِهِ يُؤْتِكُمْ كِفْلَيْنِ مِنْ رَحْمَتِهِ وَيَجْعَلْ لَكُمْ نُورًا تَمْشُونَ بِهِ وَيَغْفِرْ لَكُمْ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ
‘‘হে মু’মিনগণ তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং তার রাসূলের উপর বিশ্বাস স্থাপন কর, তিনি তাঁর রহমত থেকে তোমাদেরকে দ্বিগুণ পুরস্কার দান করবেন এবং তোমাদেরকে তিনি নুর (আলো বা জ্যোতি) দান করবেন, যার সাহায্যে তোমরা চলবে এবং তোমাদেরকে তিনি ক্ষমা করবেন। এবং আল্লাহ ক্ষমাশীল করুণাময়।’’[1]
অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
فَآَمِنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَالنُّورِ الَّذِي أَنْزَلْنَا وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ
‘‘অতএব তোমরা আল্লাহর উপর এবং তার রাসূলের উপর এবং যে নূর (আলো বা জ্যোতি) আমি নাযিল করেছি তার (কুরআনের) উপর বিশ্বাস স্থাপন কর। এবং আল্লাহ তোমাদের কর্ম সম্পর্কে সবিশেষ অবহিত।’’[2]
অন্যত্র আল্লাহ বলেন:
فَلا وَرَبِّكَ لا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا
‘‘তোমার প্রতিপালকের শপথ, তারা কখনোই মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ না তারা তাদের মধ্যে বিরাজিত সকল বিষয়ে তোমার বিধানের স্মরণাপন্ন হবে, তোমার দেওয়া বিধানের ব্যাপারে তাদের মনের গভীরে কোনো আপত্তি অনুভব করবে না এবং সর্বান্তঃকরণে আপনার বিধান মেনে নেবে।’’[3]
কাজেই কোনো বিধান রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বলে কুরআন বা সহীহ হাদীসের মাধ্যমে প্রমাণিত হলে সে বিষয়ে আর কোনো মুমিনের হৃদয়ে দ্বিধা বা আপত্তি থাকতে পারে না। অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন:
وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَمْرًا أَنْ يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ وَمَنْ يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلالا مُبِينًا
‘‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোনো বিধান দান করলে সে ব্যাপারে কোনো মুমিন পুরুষ বা নারীর আর কোনো পছন্দ করার বা বাছাই করার অধিকার থাকে না। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্যতা করল সে স্পষ্ট বিভ্রান্তি ও পথভ্রষ্টতার মধ্যে নিপতিত হল।’’[4]
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন:
وَمَا آَتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا
‘‘রাসূল তোমাদেরকে যা দিয়েছেন তোমরা তা গ্রহণ করো, আর তিনি যা নিষেধ করেছেন তা থেকে তোমরা বিরত থাক।’’[5]
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপর বিশ্বাস আনয়ন না করলে, তাঁর সকল শিক্ষা ও সকল কথাকে সত্য বলে না মানলে আল্লাহকে মানা বা আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপন করার কোনো মূল্য থাকে না। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বা তাঁর কোনো প্রমাণিত শিক্ষাকে অবিশ্বাস বা অবজ্ঞা করার অর্থ চূড়ান্ত কুফ্রী এবং তার পরিণতি ভয়ংকর। আল্লাহ বলেছেন:
وَمَنْ لَمْ يُؤْمِنْ بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ فَإِنَّا أَعْتَدْنَا لِلْكَافِرِينَ سَعِيرًا
‘‘আর যদি কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন না করে, তবে আমি কাফিরদের জন্য জ্বলন্ত অগ্নি প্রস্ত্তত করে রেখেছি।’’[6]
কাজেই কোনো কথা বা শিক্ষা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বলে প্রমাণিত হলে তা অবিশ্বাস করা, অবহেলা করা, অবজ্ঞা করা বা বিকৃত করা কোনো মুসলিমের কর্ম নয়। আমরা জানি আল্লাহর পক্ষ থেকে তিনি যে শিক্ষা দিয়েছেন তা দুটি সূত্র থেকে আমরা পাই: কুরআন কারীম ও হাদীস শরীফ। যদি কোনো কথা বা শিক্ষা পবিত্র কুরআনে আছে বা সহীহ হাদীসে আছে বলে আমরা জানতে পারি, তবে তাকে সর্বান্তঃকরণে মেনে নেওয়া ও বিশ্বাস করাই মুসলিমের দায়িত্ব।
[2] সূরা (৬৪) তাগাবুন: ৮ আয়াত।
[3] সূরা (৪) নিসা: ৬৫ আয়াত।
[4] সূরা (৩৩) আহযাব: ৩৬ আয়াত।
[5] সূরা হাশর ৭ আয়াত।
[6] সূরা (৪৮) আল-ফাতহ: ১৩ আয়াত।
‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’- এ বিশ্বাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো জীবনের সকল ক্ষেত্রে সার্বিকভাবে তার আনুগত্য করা। জীবনের সকল বিষয়ে, সকল ক্ষেত্রে মহানবীর শিক্ষা, বিধান ও নির্দেশ দ্বিধাহীন চিত্তে মেনে নেওয়া। সকল মানুষের কথা ও সকল মতের উর্দ্ধে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কথাকে স্থান দেওয়া।
তাঁর আনুগত্যই ঈমানের আলামত। মহান আল্লাহ বলেন:
وَأَطِيعُوا اللَّهَ وَرَسُولَهُ إِنْ كُنتُمْ مُؤْمِنِينَ
‘‘আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের হুকুম মান্য কর- যদি ঈমানদার হয়ে থাক।’’[1]
মহান আল্লাহ আরো বলেন:
وَأَطِيعُوا اللَّهَ وَالرَّسُولَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ
‘‘আর তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহ ও রাসূলের, যাতে তোমাদেরকে রহমত করা হয়।’’[2]
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন,
وَمَنْ يُطِعْ اللَّهَ وَرَسُولَهُ يُدْخِلْهُ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا وَذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ
‘‘যে কেউ আল্লাহ ও রাসূলের আদেশমতো চলে, তিনি তাকে জান্নাতসমূহে প্রবেশ করাবেন, যেগুলোর তলদেশ দিয়ে স্রোতস্বিনী প্রবাহিত হবে। তারা সেখানে চিরকাল থাকবে। এ হলো বিরাট সাফল্য।’’[3]
আল্লাহ আরো বলেন,
وَمَنْ يُطِعْ اللَّهَ وَالرَّسُولَ فَأُوْلَئِكَ مَعَ الَّذِينَ أَنْعَمَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ مِنْ النَّبِيِّينَ وَالصِّدِّيقِينَ وَالشُّهَدَاءِ وَالصَّالِحِينَ وَحَسُنَ أُوْلَئِكَ رَفِيقًا
‘‘আর যদি কেউ আল্লাহর হুকুম এবং তাঁর রসূলের হুকুম মান্য করে, তবে যাদের প্রতি আল্লাহ নিয়ামত দান করেছেন সে তাদের সঙ্গী হবে। তারা নবী, সিদ্দীক, শহীদ ও সৎকর্মশীল ব্যক্তিবর্গ। আর সাথী হিসেবে তারাই উত্তম।’’[4]
অন্যত্র আল্লাহ বলেন:
وَمَنْ يُطِعِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَيَخْشَ اللَّهَ وَيَتَّقْهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الْفَائِزُونَ
‘‘যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে, আল্লাহকে ভয় করে ও তাঁর শাস্তি থেকে আত্মরক্ষা করে তারাই কৃতকার্য।’’[5]
এভাবে কুরআন কারীমে বারংবার আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (ﷺ) আনুগত্যকে ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং মুমিনের জাগতিক সফলতা ও পারলৌকিক মুক্তির শর্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে লক্ষণীয় যে, আল্লাহর আনুগত্য মূলত তাঁর রাসূলের (ﷺ) আনুগত্যের মাধ্যমেই সম্ভব। কারণ আল্লাহর আনুগত্য করতে হলে তার আদেশ নিষেধ জানতে হবে। আর আল্লাহর আদেশ নিষেধ একমাত্র রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রাপ্ত ওহীর মাধ্যম ছাড়া কোনোভাবেই জানা সম্ভব নয়। এভাবে আমরা বুঝতে পারি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আনুগত্যই আল্লাহর আনুগত্য। বিষয়টি কুরআন কারীমে স্পষ্টভাবেই বলা হয়েছে:
مَنْ يُطِعْ الرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ اللَّهَ وَمَنْ تَوَلَّى فَمَا أَرْسَلْنَاكَ عَلَيْهِمْ حَفِيظًا
‘‘যে ব্যক্তি রাসূলের হুকুম মান্য করল সে আল্লাহরই হুকুম মান্য করল। আর যে লোক বিমুখতা অবলম্বন করল, আমি আপনাকে, তাদের জন্য রক্ষণাবেক্ষণকারী নিযুক্ত করে পাঠাইনি।’’[6]
অন্যত্র আল্লাহ বলেন:
قُلْ أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ فَإِنْ تَوَلَّوا فَإِنَّمَا عَلَيْهِ مَا حُمِّلَ وَعَلَيْكُمْ مَا حُمِّلْتُمْ وَإِنْ تُطِيعُوهُ تَهْتَدُوا وَمَا عَلَى الرَّسُولِ إِلا الْبَلاغُ الْمُبِين
‘‘বল, আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসূলের আনুগত্য কর। অতঃপর যদি তোমরা তাঁর (রাসূল) থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে তার উপর ন্যস্ত দায়িত্বের জন্যে সে দায়ী এবং তোমাদের উপর ন্যস্ত দায়িত্বের জন্যে তোমরা দায়ী। তোমরা যদি তাঁর আনুগত্য কর, তবে সঠিক পথ পাবে। রাসূলের দায়িত্ব তো কেবল সুস্পষ্টরূপে পৌঁছে দেয়া।’’[7]
এখানেও আমরা দেখছি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়াই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া।
জাগতিক বিষয়ে সামাজিক, রাষ্ট্রীয় বা ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ বা ‘আদেশ-নিষেধের অধিকারীদের’ আনুগত্য প্রয়োজনীয়। তবে এ বিষয়ে যে কোনো মতভেদ বা সমস্যা নিষ্পত্তি করতে অবশ্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বা তাঁর শিক্ষার কাছে ফিরে আসতে হবে। মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে আল্লাহর রাসূল বলে বিশ্বাসকারী প্রতিটি মুসলিমের অন্যতম দায়িত্ব হলো তাদের মধ্যকার সকল মতবিরোধের নিস্পত্তি করা তার নির্দেশ ও শিক্ষা অনুসারে, অর্থাৎ কুরআন-হাদীসের নির্দেশ অনুসারে। কুরআনে বা হাদীসে যে নির্দেশ থাকবে তা সর্বান্তঃকরণে মেনে নিতে হবে। নিজেদের মতামতের উর্দ্ধে স্থান দিতে হবে তাঁর সিদ্ধান্তকে। এ বিষয়ে একটি আয়াত আমরা উপরে দেখেছি। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন:
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُوْلِي الأَمْرِ مِنْكُمْ فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ
‘‘হে ঈমানদারগণ! আনুগত্য কর আল্লাহর, আনুগত্য কর রাসূলের এবং তোমাদের মধ্যে যারা ‘আদেশের মালিক’ তাদের। তারপর যদি তোমরা কোনো বিষয়ে বিবাদে প্রবৃত্ত হয়ে পড়, তাহলে তা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি প্রত্যর্পণ কর, যদি তোমরা আল্লাহ ও শেষ দিবসের উপর বিশ্বাসী হয়ে থাক।’’[8]
[2] সূরা (৩) আল-ইমরান: ১৩২ আয়াত।
[3] সূরা (৪) নিসা : ১৩ আয়াত।
[4] সূরা (৪) নিসা: ৬৯ আয়াত।
[5] সূরা (২৪) নুর: ৫২ আয়াত।
[6] সূরা (৪) নিসা : ৮০ আয়াত।
[7] সূরা (২৪) নুর: ৫৪ আয়াত।
[8] সূরা (৪) নিসা: ৫৯ আয়াত।