একজন মানুষকে মুমিন বলে গণ্য হতে কি কি বিষয়ে বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে তা কুরআন কারীমে বিভিন্ন স্থানে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন হাদীসেও তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ইসলামের পরিভাষায় এগুলিকে ‘আরকানুল ঈমান’ বলা হয়।
মহান আল্লাহ বলেন:
لَيْسَ الْبِرَّ أَنْ تُوَلُّوا وُجُوهَكُمْ قِبَلَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ وَلَكِنَّ الْبِرَّ مَنْ آَمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الآَخِرِ وَالْمَلائِكَةِ وَالْكِتَابِ وَالنَّبِيِّينَ وَآَتَى الْمَالَ عَلَى حُبِّهِ ذَوِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ وَالسَّائِلِينَ وَفِي الرِّقَابِ وَأَقَامَ الصَّلَاةَ وَآَتَى الزَّكَاةَ وَالْمُوفُونَ بِعَهْدِهِمْ إِذَا عَاهَدُوا وَالصَّابِرِينَ فِي الْبَأْسَاءِ وَالضَّرَّاءِ وَحِينَ الْبَأْسِ أُولَئِكَ الَّذِينَ صَدَقُوا وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُتَّقُونَ
‘‘পূর্ব এবং পশ্চিম দিকে তোমাদের মুখ ফেরানোর মধ্যে কোনো পূণ্য নেই। কিন্তু পুণ্য তার যে বিশ্বাস স্থাপন করেছে আল্লাহে, পরকালে, মালাকগণে (ফিরিশতাগণে), গ্রন্থসমূহে এবং নবীগণে, এবং ধন সম্পদের প্রতি মনের টান থাকা সত্ত্বেও আত্মীয়-স্বজন, পিতৃহীন-অনাথ, অভাবগ্রস্ত, পথিক, সাহায্যপ্রার্থনাকারিগণকে এবং দাসমুক্তির জন্য অর্থ প্রদান করে, এবং সালাত কায়েম করে, যাকাত প্রদান করে, প্রতিশ্রুতি দিলে তা পূর্ণ করে এবং অর্থ-সংকটে, দুঃখ ক্লেশে ও সংগ্রাম-সংকটে ধৈর্য ধারণ করে। এরাই প্রকৃত সত্যপরায়ণ এবং এরাই মুত্তাকী।’’[1]
এখানে আল্লাহ তা‘আলা জানিয়েছেন যে, শুধু আনুষ্ঠানিকতার নাম ইসলাম নয়, প্রাণহীন আনুষ্ঠানিকতায় কোনো পূণ্য নেই। ইসলাম বিশ্বাস ও কর্মের সমন্বয়। এখানে আল্লাহ মুমিনের বিশ্বাসের মৌলিক পাঁচটি বিষয় এবং তার মৌলিক কর্ম ও চরিত্রের বর্ণনা দান করেছেন। অন্যত্র আল্লাহ বলেন:
آَمَنَ الرَّسُولُ بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْهِ مِنْ رَبِّهِ وَالْمُؤْمِنُونَ كُلٌّ آَمَنَ بِاللَّهِ وَمَلائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ لا نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِنْ رُسُلِهِ
‘‘রাসূল তাঁর প্রতি তাঁর প্রতিপালকের পক্ষ থেকে যা অবতীর্ণ করা হয়েছে তাতে ইমান এনেছেন এবং মুনিগণও। তারা সকলেই আল্লাহে, তাঁর ফিরিশতাগণে, তাঁর গ্রন্থসমূহে এবং তাঁর রাসূলগণে ইমান আনয়ন করেছেন। আমরা তাঁর রাসূলগণের মধ্যে তারতম্য করি না।’’[2]
এখানে ঈমানের স্তম্ভগুলির মধ্য থেকে ৪টি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। অন্য আয়াতে ৫টি বিষয়ের উল্লেখ করে আল্লাহ বলেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا آَمِنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَالْكِتَابِ الَّذِي نَزَّلَ عَلَى رَسُولِهِ وَالْكِتَابِ الَّذِي أَنْزَلَ مِنْ قَبْلُ وَمَنْ يَكْفُرْ بِاللَّهِ وَمَلائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ وَالْيَوْمِ الآَخِرِ فَقَدْ ضَلَّ ضَلالا بَعِيدًا
‘‘হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহে, তাঁর রাসূলে, তাঁর রাসূলের উপর যে গ্রন্থ অবতীর্ণ করেছেন তাতে এবং যে গ্রন্থ তিনি পূর্বে অবতীর্ণ করেছেন তাতে ঈমান আন। এবং কেউ আল্লাহ, তাঁর ফিরিশতাগণ, তাঁর গ্রন্থসমূহ, তাঁর রাসূলগণ এবং পরকালকে অবিশ্বাস করলে সে ভীষণভাবে পথভ্রষ্ট হয়ে পড়বে।’’[3]
এভাবে কুরআন কারীমের বিভিন্ন স্থানে উপরের বিষয়গুলি একত্রে বা পৃথকভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। বিভিন্ন হাদীসেও ঈমানের রুক্নগুলি উল্লেখ করা হয়েছে। এই পুস্তকের শুরুতে আবূ হুরাইরা বর্ণিত একটি হাদীসে আমরা দেখেছি যে, ঈমানের পরিচয় দিয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: ‘‘(ঈমান এই যে,) তুমি বিশ্বাস করবে আল্লাহয়, তাঁর ফিরিশতাগণে, তাঁর পুস্তকসমূহে, তাঁর সাক্ষাতে, তাঁর রাসূলগণে এবং তুমি বিশ্বাস করবে শেষ পুনরুত্থানে এবং তুমি বিশ্বাস করবে তাকদীর বা নির্ধারণের সবকিছুতে।’’[4]
এই ঘটনারই বর্ণনা করেছেন উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) অন্য হাদীসে। তিনি বলেন, একদিন আমরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট বসে ছিলাম। এমতাবস্থায় এক ব্যক্তি তথায় আসলেন। তাঁর পোশাক-পরিচ্ছদ অত্যন্ত ধবধবে সাদা এবং মাথার চুলগুলো অত্যন্ত পরিপাটি ও কাল। .... তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে প্রশ্ন করে বলেন: ‘‘ঈমান সম্পর্কে প্রশ্ন করে বলেন, ঈমান কী তা আমাকে বলুন। উত্তরে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
أَنْ تُؤْمِنَ بِاللَّهِ وَمَلائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ وَتُؤْمِنَ بِالْقَدَرِ خَيْرِهِ وَشَرِّه
‘‘ঈমান হলো এই যে, তুমি বিশ্বাস করবে আল্লাহে, তাঁর ফিরিশতাগণে, তাঁর গ্রন্থসমূহে, তাঁর রাসূলগণে এবং পরকালে, এবং বিশ্বাস করবে আল্লাহর পূর্ব নির্ধারণে (ভাগ্যে), তাঁর ভাল এবং মন্দে।’’[5]
এভাবে বিভিন্ন আয়াত ও হাদীসের আলোকে আমরা জানতে পারি যে, ইসলামী ঈমানের বা ‘আল-আকীদাহ আল ইসলামিয়্যাহ’-র ছয়টি মৌলিক স্তম্ভ রয়েছে: (১) আল্লাহর উপর ঈমান, (২) আল্লাহর মালাকগণের (ফিরিশতাগণের) প্রতি ঈমান (৩) আল্লাহর গ্রন্থসমূহের প্রতি ঈমান, (৪) আল্লাহর রাসূলগণের উপর ঈমান, (৫) পুনরুত্থান, কিয়ামত, পরকাল বা আখিরাতের উপর ঈমান, এবং (৬) তাকদীর বা আল্লাহর নির্ধারণ ও সিদ্ধান্তের উপর ঈমান। এ বিষয়গুলোকে আরকানে ঈমান, অর্থাৎ ঈমানের স্তম্ভসমূহ, ভিত্তিসমূহ বা মূলনীতিসমূহ বলা হয়।
[2] সূরা (২) বাকারা: ২৮৫ আয়াত।
[3] সূরা (৪) নিসা: ১৩৬ আয়াত।
[4] বুখারী, আস-সহীহ ১/২৭, ৪/১৭৩৩; মুসলিম, আস-সহীহ ১/৩৯, ৪০, ৪৭।
[5] মুসলিম, আস-সহীহ ১/৩৫-৩৬।
আল্লাহর প্রতি ঈমানের অর্থ আল্লাহর একত্বে বা তাওহীদে বিশ্বাস করা। বিভিন্ন হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আল্লাহর প্রতি ঈমানের বর্ণনা দিয়েছেন। আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
بُنِيَ الإِسْلامُ عَلَى خَمْسٍ شَهَادَةِ أَنْ لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ- وفي رواية: شَهَادَةِ أَنْ لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ، وفي رواية ثالثة: أَنْ يُوَحَّدَ اللَّهُ، وفي أخرى: أَنْ يُعْبَدَ اللَّهُ وَيُكْفَرَ بِمَا دُونَهُ- وَإِقَامِ الصَّلاةِ وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ وَالْحَجِّ وَصَوْمِ رَمَضَانَ، وفي رواية: صيام رمضان والحج
‘‘ইসলামকে পাঁচটি বিষয়ের উপর প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে, তা হলো: বিশ্বাসের সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ বা উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ (ﷺ) আল্লাহর বান্দা ও রাসুল, (অন্য বর্ণনায়: একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করা এবং আল্লাহ ছাড়া যা কিছু (উপাস্য) আছে সবকিছুকে অবিশ্বাস করা), সালাত কায়েম করা, যাকাত প্রদান করা, রামাদান মাসের সিয়াম (রোযা) পালন করা, বাইতুল্লাহর হজ্জ আদায় করা।’’[1]
আনাস ইবনু মালিক (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,
مَا مِنْ عَبْدٍ يَشْهَدُ أَنْ لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ إِلا حَرَّمَهُ اللَّهُ عَلَى النَّارِ
‘‘যে কোনো ব্যক্তি যদি সাক্ষ্য প্রদান করে যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ বা উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ (ﷺ) তাঁর বান্দা ও রাসূল, তবে তাঁর জন্য আল্লাহ জাহান্নামের আগুন হারাম বা নিষিদ্ধ করে দেবেন।’’[2]
[2] মুসলিম, আস-সহীহ ১/৬১।
’তাওহীদ’ শব্দটি আরবী ‘ওয়াহাদা (وَحَدَ) ক্রিয়ামূল থেকে গৃহীত, যার অর্থ ‘এক হওয়া’, ‘একক হওয়া’ বা ‘অতুলনীয় হওয়া’ (to be alone, unique, singular, unmatched, without equal, incomparable)। তাওহীদ অর্থ ‘এক করা’, ‘এক বানানো’, ‘একত্রিত করা’, ‘একত্বের ঘোষণা দেওয়া’ বা ‘একত্বে বিশ্বাস করা’। তাওহীদের ব্যবহারিক অর্থের ব্যাখ্যা প্রদান করে কুরআন কারীমে ও হাদীস শরীফে অগণিত নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে, যেগুলি আমরা এ অধ্যায়ে আলোচনা করব। প্রথমেই আমরা পূর্ববর্তী হাদীসে উল্লিখিত তাওহীদের পরিচিতি আলোচনা করব।
আমরা দেখেছি যে, উপরের হাদীসগুলিতে তাওহীদের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে: (لا إله إلا الله) ‘‘আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ বা উপাস্য নেই।’’ বিভিন্ন বর্ণনায় এর সাথে যুক্ত করা হয়েছে: (وحده لا شريك له) ‘‘তিনি একক, তাঁর কোনো শরীক নেই।’’ আমরা প্রথমে এ বাক্যটির বিভিন্ন শব্দের অর্থ বুঝার চেষ্টা করব।
আরবীতে (لا) শব্দের অর্থ হলো নেই, মোটেও নেই বা একেবারে নেই। এই বাক্যে শব্দটি (نفي الجنس) বা মোটেও নেই বা একেবারেই নেই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
(إله) শব্দের অর্থ হলো ‘‘মাবুদ’’, অর্থাৎ উপাস্য বা পূজ্য, যার কাছে মনের আকুতি পেশ করা হয়, প্রয়োজন মেটানোর জন্য সাহায্য প্রার্থনা করা হয়। ৪র্থ হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ ভাষাবিধ ও অভিধান-প্রণেতা আবুল হুসাইন আহমদ ইবনু ফারিস (৩৯৫ হি) বলেন:
الهمزة واللام والهاء أصل واحد، وهو التعبد. فالإله الله تعالى، وسمي بذلك لأنه معبود
‘‘হামযা, লাম ও হা=ইলাহ: ধাতুটির একটিই মূল অর্থ, তা হলো ইবাদত করা। আল্লাহ ইলাহ কারণ তিনি মাবুদ বা ইবাদতকৃত।’’[1]
আরবী ভাষায় সকল পূজিত ব্যক্তি, বস্ত্ত বা দ্রব্যকেই ‘ইলাহ’ বলা হয়। এজন্য সূর্যের আরেক নাম ‘ইলাহাহ’ (الإلاهة); কারণ কোনো কোনো সম্প্রদায় সূর্যের উপাসনা বা পূজা করত।[2] মহান আল্লাহ বলেন:
وَقَالَ الْمَلأُ مِنْ قَوْمِ فِرْعَوْنَ أَتَذَرُ مُوسَى وَقَوْمَهُ لِيُفْسِدُوا فِي الأَرْضِ وَيَذَرَكَ وَآَلِهَتَكَ
‘‘ফিরাউন সম্প্রদায়ের প্রধানগণ বলল, আপনি কি মূসাকে এবং তার সম্প্রদায়কে রাজ্যে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে এবং আপনাকে এবং আপনার উপাস্যদেরকে বর্জন করতে দিবেন?’’[3]
ইবনু আববাস (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি এখানে ‘আলিহাতাকা (آلِهَتَكَ) স্থলে ‘ইলাহাতাকা’ (إلاهَتَك) পড়তেন। ‘ইলাহাত’ অর্থ ইবাদত, অর্থাৎ আপনি কি তাদেরকে আপনাকে এবং আপনার ইবাদত করা বর্জন করতে দিবেন?’’[4]
এভাবে আমরা দেখছি যে, (ইলাহাহ্) শব্দটি আরবীতে (ইবাদাহ্) শব্দের সমার্থক[5]। এই ‘ইবাদাত’ বা ‘ইবাদাহ’ (العبادة) শব্দের অর্থ আমরা বাংলায় সাধারণভাবে উপাসনা বা পূজা বলতে পারি। তবে ইসলামের পরিভাষায় ‘ইবাদাত’ অত্যন্ত ব্যাপক অর্থবহ এবং এর বিভিন্ন প্রকার ও স্তর রয়েছে। পরবর্তী অনুচ্ছেদে আমরা এ বিষয়ে কিছু আলোচনা করব। আমরা আমাদের আলোচনায় সাধারণভাবে উপাসনা, পূজা, ইত্যাদি শব্দের পরিবর্তে ‘ইবাদাত’ ব্যবহার করব, যেন আমরা এই ইসলামী গুরুত্বপূর্ন শব্দটির সকল অর্থ ও ব্যবহার ভালভাবে বুঝতে পারি।
(إلا) শব্দের অর্থঃ ব্যতীত, ছাড়া বা ভিন্ন।
উপরের আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারছি যে, (لا إله إلا الله) বাক্যটির অর্থ: ‘‘আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই’’। অর্থাৎ যদিও আল্লাহ ছাড়া অন্য অনেক কিছুকেই ইবাদত, উপাসনা, পূজা বা আরাধনা করা হয়, তবে সত্যিকারভাবে ইবাদত করার যোগ্য বা মাবুদ হওয়ার অধিকার একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কারোরই নেই। আল্লাহই সকল প্রকার ইবাদাতের তিনিই একমাত্র অধিকারী। ইসলামের পরিভাষায় ইবাদাত বলা হয় এমন সব কিছই একমাত্র তাঁর জন্য।
বিভিন্ন হাদীসে এই বাক্যের সাথে যোগ করা হয়েছে: (وحده لا شريك له)। আমরা দেখেছি যে, আরবীতে (وَحَدَ) ক্রিয়াপদটির অর্থ: এক হওয়া বা অতুলনীয় হওয়া।
(لا) শব্দটি মোটেও নেই বা কিছুই নেই অর্থ প্রকাশ করছে।
(شريك) অর্থ অংশীদার বা সহযোগী। শব্দটি আরবী থেকে বাংলায় প্রবেশ করেছে এবং ‘অংশীদার’ অর্থে ‘শরিক’ এখন বাংলা ভাষায় অতি পরিচিত শব্দ। আরবীতে শির্ক (شِرْك) অর্থ অংশীদার হওয়া (to share, participate, be partner, associate)। ইশরাক (إشراك) ও তাশ্রীক (تَشْرِيك) অর্থ অংশীদার করা বা বানানো। সাধারণভাবে ‘শির্ক’ শব্দটিকেও আরবীতে ‘অংশীদার করা’ বা ‘সহযোগী বানানো’ অর্থে ব্যবহার করা হয়।[6]
(له) অর্থ ‘তাঁর’ বা ‘তাঁর জন্য’।
এভাবে দেখছি যে, তাওহীদের ঘোষণা বা সাক্ষ্যের এই অংশের অর্থ: মহান আল্লাহ একক ও অতুলনীয়, তাঁর কোনো অংশীদার বা সহযোগী নেই।
[2] ইবনু ফারিস, মু’জামু মাকাইসিল্লুগাহ ১/১২৭; রাগিব ইসপাহানী, আল-মুফরাদাত, পৃ. ২১।
[3] সূরা (৭) আ’রাফ: ১২৭ আয়াত।
[4] তাবারী, তাফসীর (জামিউল বায়ান) ১/৫৪।
[5] ইবনু মানযূর, লিসানুল আরব ১৩/৪৬৮-৪৬৯।
[6] আল-ফাইয়ূমী, আল-মিসবাহুল মুনীর, পৃ. ৩১০।
আকীদার উৎসের বিচ্যুতির কারণে, অর্থাৎ কুরআন-হাদীসের গভীর অধ্যয়ন পরিত্যাগ করে, আভিধানিক অর্থ, নিজের বুদ্ধি-বিবেক, দর্শন ইত্যাদির উপর নির্ভর করে তাওহীদের ব্যাখ্যা করতে যেয়ে অনেক পন্ডিত মনে করেছেন যে, ‘তাওহীদ’ অর্থ মহান আল্লাহকে একমাত্র অনাদি সত্তা বা একামত্র স্রষ্টা ও সর্বশক্তিমান হিসেবে বিশ্বাস করা। তাদের এ চিন্তা কুরআন ও হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক। কুরআনের অগণিত বর্ণনা থেকে আমরা জানতে পারি যে, আরবের ও অন্যান্য জাতির কাফিরগণ আল্লাহর অস্তিত্বের একত্বে বিশ্বাস করত এবং তাঁকেই একমাত্র স্রষ্টা ও সর্বশক্তিমান প্রতিপালন হিসেবে বিশ্বাস করত। এতটুকুতেই যদি তাওহীদ পরিপূর্ণ হয়, তবে তো আর তাদেরকে কাফির বলার বা তাদের হেদায়াতের জন্য নবী-রাসূলগণের আগমনের প্রয়োজন থাকত না।
কুরআন ও হাদীসের অগণিত বিবরণের আলোকে আমরা বুঝতে পারি যে, তাওহীদ বা আল্লাহর একত্বে বিশ্বাসের একাধিক পর্যায় বা স্তর রয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,
وَمَا يُؤْمِنُ أَكْثَرُهُمْ بِاللَّهِ إِلا وَهُمْ مُشْرِكُونَ
‘‘তাদের অধিকাংশ আল্লাহতে বিশ্বাস করে, কিন্তু তাঁর সাথে শরীক করে।’’[1]
এ আয়াত থেকে স্পষ্টতই জানা যায় যে, আল্লাহর প্রতি ঈমানের পর্যায় রয়েছে, যে কারণে ঈমানের সাথে সাথে শিরক্ একত্রিত হতে পারে। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় সাহাবী ইবনু আববাস (রা) বলেন,
من إيمانهم إذا قيل لهم من خلق السماء ومن خلق الأرض ومن خلق الجبال قالوا الله وهم مشركون .... وهم مع ذلك يشركون به ويعبدون غيره ويسجدون للأنداد دونه
‘‘তাদের ঈমান হলো, যদি তাদের বলা হয়, আকাশ কে সৃষ্টি করেছে? পৃথিবী কে সৃষ্টি করেছে? পাহাড় কে সৃষ্টি করেছে? তারা বলে: আল্লাহ, অথচ তারা শিরক করে ... এরপরও তারা আল্লাহর সাথে শির্ক করে, আল্লাহকে ছাড়া অন্যের ইবাদত করে, আল্লাহ ব্যতীরেকে অন্যদের সাজদা করে।’’[2]
প্রসিদ্ধ তাবিয়ী মুফাস্সির মুজাহিদ ইবনু জাবর (১০৪ হি) বলেন:
إيمانهم قولهم الله خالقنا ويرزقنا ويميتنا فهذا إيمان مع شرك عبادتهم غيره
‘‘তাদের ঈমান হলো তারা বলে, (একমাত্র) আল্লাহই আমাদের সৃষ্টিকর্তা, তিনিই আমাদের রিযক দেন এবং তিনিই আমাদের মৃত্যুদেন। এ হলো তাদের ঈমান, এর সাথে তারা তাদের ইবাদতে গাইরুল্লাহর ইবাদত করে শিরক করে।’’[3]
অনুরূপভাবে সাঈদ ইবনু জুবাইর (৯৫হি), আমির ইবনু শারাহীল শা’বী (১০৪ হি), ইকরিমাহ মাওলা ইবনু আববাস (১০৫ হি), আতা ইবনু আবী রাবাহ (১১৫ হি), কাতাদাহ ইবনু দি‘আমাহ (১১৭ হি), আব্দুর রাহমান ইবনু যাইদ ইবনু আসলাম (১৭০ হি) ও অন্যান্য তাবিয়ী ও তাবি-তাবিয়ী মুফাস্সির বারংবার উল্লেখ করেছেন যে, সকল কাফিরই আল্লাহকে একমাত্র স্রষ্টা, প্রতিপালক, রিয্কদাতা ও সর্বশক্তিমান বলে বিশ্বাস করতো, কিন্তু তারা ইবাদতের ক্ষেত্রে আল্লাহর সাথে অন্যকে শরীক করতো।[4]
এ ভাবে আমরা দেখছি যে, তাওহীদের অন্তত দুটি পর্যায় রয়েছে এবং কাফিরগণ একটি বিশ্বাস করতো এবং একটি অস্বীকার করত। কুরআন কারীমের এজাতীয় অগণিত নির্দেশনা ও সাহাবী-তাবিয়গণের এ সকল তাফসীরের আলোকে পরবর্তী যুগের আলিমগণ ‘তাওহীদ’-কে দুভাগে ভাগ করেছেন। কেউ কেউ দুটি পর্যায়কে আরো বিস্তারিতভাবে তিনটি বা চারটি পর্যায়ে বিভক্ত করেছেন।
হানাফী মাযহাবের প্রসিদ্ধ ইমাম আল্লামা সাদরুদ্দীন মুহাম্মাদ ইবনু আলাউদ্দীন আলী ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু আবিল ইয্য দিমাশকী (৭৩১-৭৯২ হি) তাঁর রচিত ‘শরাহুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ’ পুস্তকে তাওহীদকে প্রথমত দু পর্যায়ে বিভক্ত করেছেন: (১) তাওহীদুল ইসবাত ওয়াল মা'রিফাহ (توحيد الإثبات والمعرفة) বা জ্ঞান পর্যায়ের তাওহীদ এবং (২) তাওহীদুত তালাবি ওয়াল কাসদি (توحيد الطلب والقصد) বা কর্ম পর্যায়ের তাওহীদ।[5] অন্যত্র তিনি উক্ত প্রথম পর্যায়ের তাওহীদকে দুটি পর্যায়ে বিভক্ত করে তাওহীদকে তিন পর্যায়ে বিভক্ত করেছেন: (১) তাওহীদুল আসমা ওয়াস সিফাত, (২) তাওহীদুর রুবূবিয়্যাত ও (৩) তাওহীদুল ইলাহিয়্যাহ।[6]
প্রসিদ্ধ আলিম ও সংস্কারক শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী (১১৭৬হি) প্রথম পর্যায়ের তাওহীদকে তিন পর্যায়ে বিভক্ত করেন এবং এভাবে তিনি তাওহীদকে চার পর্যায়ে বিভক্ত করেছেন:
(১) আল্লাহকে একমাত্র অনাদি অনন্ত সত্তা বলে বিশ্বাস করা
(২) আল্লাহকে মহাবিশ্বের একমাত্র স্রষ্টা হিসেবে বিশ্বাস করা
(৩) আল্লাহকে মহাবিশ্বের একমাত্র পরিচালক হিসেবে বিশ্বাস করা।
(৪) আল্লাহকে একমাত্র মা‘বুদ বা উপাস্য হিসেবে বিশ্বাস করা।[7]
এভাবে আমরা দেখছি যে, তাওহীদের মূলত দুটি পর্যায় রয়েছে এবং প্রথম পর্যায়টির একাধিক পর্যায় রয়েছে। এখানে আমরা কুরআন ও হাদীসের আলোকে তাওহীদের প্রকারভেদ ব্যাখ্যা করব।
২. ৪. ১. জ্ঞান পর্যায়ের তাওহীদ
আমরা দেখেছি যে, এ পর্যায়ের তাওহীদকে তাওহীদুল ইসবাত ওয়াল মা’রিফাহ বা জ্ঞান পর্যায়ের তাওহীদ বলা হয়। কখনো বা (التوحيد العلمي الخبري) অর্থাৎ ‘জ্ঞান ও সংবাদের একত্ব’ বলা হয়।[8] জ্ঞান পর্যায়ের তাওহীদের দুইটি মূল বিষয় রয়েছে: ১) সৃষ্টি ও প্রতিপালনের একত্ব, ও ২) নাম ও গুণাবলীর একত্ব।
২. ৪. ১. ১. সৃষ্টি ও প্রতিপালনের একত্ব
আরবীতে একে ‘তাওহীদুর রুবূবিয়্যাহ্’ (توحيد الربوبية) ‘‘প্রতিপালনের একত্ব’’ বলা হয়।[9] এর অর্থ বিশ্বের সকল কিছুর সৃষ্টি, প্রতিপালন, সংহার ইত্যাদির বিষয়ে আল্লাহর একত্ব। তাওহীদুর রুবূবিয়্যাহ বা সৃষ্টি ও প্রতিপালনের একত্বে বিশ্বাস করার অর্থ এ কথা বিশ্বাস করা যে, মহান আল্লাহই এ মহাবিশ্বের একমাত্র স্রষ্টা, প্রতিপালক, পরিচালক, সংহারক, রিযিকদাতা, পালনকর্তা, নিয়ন্ত্রক ও সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী।
কুরআন কারীমে বিভিন্ন আয়াতে ‘তাওহীদুর রুবূবিয়্যাহ’ বা সৃষ্টি ও প্রতিপালনের একত্বের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন:
الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ
‘‘প্রশংসা আল্লাহর নিমিত্ত যিনি জগৎসমূহের প্রতিপালক।’’[10]
তিনি আরো বলেছেন:
أَلا لَهُ الْخَلْقُ وَالأَمْرُ تَبَارَكَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ
‘‘জেনে রাখ! সৃষ্টি ও নির্দেশনা (পরিচালনা) একমাত্র তাঁরই, জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহ মহিমাময়।’’[11]
তিনি আরো বলেছেনঃ
إِنَّ اللَّهَ هُوَ الرَّزَّاقُ ذُو الْقُوَّةِ الْمَتِينُ
‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহই মহাশক্তিময় রিয্ক-দাতা।’’[12]
অন্যত্র তিনি বলেছেনঃ
وَخَلَقَ كُلَّ شَيْءٍ فَقَدَّرَهُ تَقْدِيرًا
‘‘তিনি সকল কিছু সৃষ্টি করেছেন এবং প্রত্যেককে পরিমিত করেছেন যথাযথ অনুপাতে।’’[13]
এভাবে কুরআন কারীমে বিভিন্ন স্থানে আল্লাহর সৃষ্টি ও প্রতিপালনের একত্বের কথা বলা হয়েছে।
[2] তাবারী, তাফসীর (জামিউল বায়ান) ১৩/৭৭-৭৮।
[3] তাবারী, তাফসীর (জামিউল বায়ান) ১৩/৭৮।
[4] তাবারী, তাফসীর (জামিউল বায়ান) ১৩/৭৭-৭৯।
[5] ইবনু আবিল ইযয, শারহুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ৮৯।
[6] ইবনু আবিল ইযয, শারহুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ৭৮।
[7] শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলবী, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা ১/১৭৬।
[8] মোল্লা আলী কারী, শারহুল ফিকহিল আকবার, পৃ ১৫।
[9] মোল্লা আলী কারী, শারহুল ফিকহিল আকবার, পৃ ১৫।
[10] সূরা (১) ফাতিহা: ১ আয়াত।
[11] সূরা (৭) আরাফ: ৫৪ আয়াত।
[12] সূরা (৫১) যারিয়াত: ৫৮ আয়াত।
[13] সূরা (২৫) ফুরকান: ২ আয়াত।
কুরআন ও হাদীসের বিবরণ থেকে জানা যায় যে, এ পর্যায়ের তাওহীদের বিষয়ে কাফির-মুশরিকদের মধ্যে তেমন কোনো আপত্তি বা মতভেদ ছিল না। সাধারণভাবে কাফিরগণ বিশ্বাস করত যে, আল্লাহই এ বিশ্বের একমাত্র স্রষ্টা, প্রতিপালক, রিয্কদাতা, জীবনদাতা, একক সার্বভৌমত্ব ও সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। এ বিশ্বাসের ভিত্তিতে তারা আল্লাহর ইবাদত করত। তারা আল্লাহর ইবাদাত করার সাথে সাথে ফিরিশতাগণ, কোনো কোনো নবী-রাসূল, সত্য বা কল্পিত আল্লাহর প্রিয় বান্দা, তাঁদের মুর্তি, স্মৃতিবিজড়িত স্থান, দ্রব্য বা পাথরের ‘ভক্তি’ করত। ‘ভক্তি’-র প্রকাশ হিসেবে তারা এ সকল দ্রব্য বা স্থানে ‘সাজদা’ করত, মানত করত বা প্রার্থনা করত, যে সকল কর্ম ইসলামের পরিভাষায় ‘ইবাদত’ বলে গণ্য। তারা কখনোই দাবি করত না যে, এ সকল ‘উপাস্য’ এ বিশ্বের কোনো কিছু সৃষ্টি করেছে বা প্রতিপালন করে, বরং তারা আল্লাহকেই একমাত্র স্রষ্টা, রব্ব, প্রতিপালক, সর্বশক্তিমান ও সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক বলে বিশ্বাস করত।
কুরআন কারীমে বিভিন্ন স্থানে বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। এক স্থানে মহান আল্লাহ বলেছেন:
قُلْ مَنْ يَرْزُقُكُمْ مِنَ السَّمَاءِ وَالأَرْضِ أَمْ مَنْ يَمْلِكُ السَّمْعَ وَالأَبْصَارَ وَمَنْ يُخْرِجُ الْحَيَّ مِنَ الْمَيِّتِ وَيُخْرِجُ الْمَيِّتَ مِنَ الْحَيِّ وَمَنْ يُدَبِّرُ الأَمْرَ فَسَيَقُولُونَ اللَّهُ فَقُلْ أَفَلا تَتَّقُونَ
‘‘বল, আসমান এবং জমিন থেকে কে তোমাদেরকে রিয্ক দান করেন? কে দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তির মালিক? কে মৃত থেকে জীবিতকে নির্গত করেন এবং জীবিত থেকে মৃতকে নির্গত করেন? বিশ্ব পরিচালনা করেন কে? তারা উত্তরে বলবে: আল্লাহ। বল: তাহলে কেন তোমরা আল্লাহকে ভয় করছ না।’’[1]
অতঃপর আল্লাহ বলছেন:
قُلْ هَلْ مِنْ شُرَكَائِكُمْ مَنْ يَبْدَأُ الْخَلْقَ ثُمَّ يُعِيدُهُ قُلِ اللَّهُ يَبْدَأُ الْخَلْقَ ثُمَّ يُعِيدُهُ فَأَنَّى تُؤْفَكُونَ
‘‘বল, তোমরা যাদেরকে আল্লাহর সাথে শরীক বানিয়েছ তাদের কেউ কি সৃষ্টি করতে পারে এবং ধ্বংসের পরে পুনরায় সৃষ্টি করতে পারে? একমাত্র আল্লাহই সৃষ্টি করেন এবং পুনরায় সৃষ্টি করেন। তোমরা কোথায় যাচ্ছ?’’[2]
অন্যত্র আল্লাহ বলেছেন:
قُلْ لِمَنِ الأَرْضُ وَمَنْ فِيهَا إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ. سَيَقُولُونَ لِلَّهِ قُلْ أَفَلا تَذَكَّرُونَ. قُلْ مَنْ رَبُّ السَّمَاوَاتِ السَّبْعِ وَرَبُّ الْعَرْشِ الْعَظِيمِ. سَيَقُولُونَ لِلَّهِ قُلْ أَفَلا تَتَّقُونَ. قُلْ مَنْ بِيَدِهِ مَلَكُوتُ كُلِّ شَيْءٍ وَهُوَ يُجِيرُ وَلا يُجَارُ عَلَيْهِ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ. سَيَقُولُونَ لِلَّهِ قُلْ فَأَنَّى تُسْحَرُونَ.
‘‘(কাফিরদেরকে) বল, তোমাদের যদি জ্ঞান থাকে তবে বল, এই পৃথিবী এবং এর মধ্যে যারা রয়েছে তারা কার? তারা বলবে: আল্লাহর। বল, তবুও কি তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করবে না? বল, সপ্ত আকাশের রব্ব-প্রতিপালন ও মহান আরশের রব্ব-প্রতিপালক কে? তারা বলবে: আল্লাহ। বল, তবুও কি তোমরা সাবধান হবে না? বল, তোমরা যদি জান তবে বল, সকল কিছুর সার্বভৌমত্ব ও কর্তৃত্ব কার হাতে? যিনি ত্রাণের ক্ষমতা রাখেন, যার উপর ত্রাণ দাতা বা রক্ষাকর্তা নেই? তারা বলবে: আল্লাহ। বল, তবুও তোমরা কেমন করে বিভ্রান্ত হচ্ছ?’’[3]
এভাবে আমরা দেখছি যে, কাফিররা মহান আল্লাহকে মহাবিশ্বের একমাত্র স্রষ্টা, প্রতিপালক, সকল ক্ষমতা, রাজত্ব ও সার্বভৌমত্বের অধিকারী ও সর্বশক্তিমান বলে বিশ্বাস করত। এ বিষয়ে মহান আল্লাহ আরো বলেছেন,
وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ مَنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضَ وَسَخَّرَ الشَّمْسَ وَالْقَمَرَ لَيَقُولُنَّ اللَّهُ فَأَنَّى يُؤْفَكُونَ. اللَّهُ يَبْسُطُ الرِّزْقَ لِمَنْ يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ وَيَقْدِرُ لَهُ إِنَّ اللَّهَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ. وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ مَنْ نَزَّلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَأَحْيَا بِهِ الأَرْضَ مِنْ بَعْدِ مَوْتِهَا لَيَقُولُنَّ اللَّهُ قُلِ الْحَمْدُ لِلَّهِ بَلْ أَكْثَرُهُمْ لا يَعْقِلُونَ.
‘‘তুমি যদি তাদেরকে প্রশ্ন কর, কে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং চন্দ্র-সুর্যকে নিয়ন্ত্রিত করেছেন? তারা অবশ্যই বলবে, আল্লাহ। তাহলে তারা কোথায় চলেছে? আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মধ্যে যার জন্য ইচ্ছা তার রিয্ক বর্ধিত করেন আর যার জন্য ইচ্ছা তা সীমিত করেন। নিশ্চয় আল্লাহ সর্ব বিষয়ে মহাজ্ঞানী। আপনি যদি তাদেরকে প্রশ্ন করেন, ভূমি মৃত হওয়ার পর আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করে কে তাকে সঞ্জীবিত করেন? তারা অবশ্যই বলবে, আল্লাহ। আপনি বলুন, প্রশংসা আল্লাহরই নিমিত্ত, কিন্তু তাদের অধিকাংশই অনুধাবন করে না।’’[4]
অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন:
وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ مَنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضَ لَيَقُولُنَّ اللَّهُ قُلِ الْحَمْدُ لِلَّهِ بَلْ أَكْثَرُهُمْ لا يَعْلَمُونَ
‘‘যদি তাদেরকে প্রশ্ন কর, আকাশমন্ডলী এবং ভূমন্ডল সৃষ্টি করেছেন? তারা অবশ্যই বলবে: ‘আল্লাহ।’ আপনি বলুন, প্রশংসা আল্লাহর নিমিত্ত, কিন্তু তাদের অধিকাংশই জানে না।’’[5]
মহান আল্লাহ আরো বলেন:
وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ مَنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضَ لَيَقُولُنَّ خَلَقَهُنَّ الْعَزِيزُ الْعَلِيمُ
‘‘যদি তাদেরকে জিজ্ঞাসা কর, কে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন? তারা অবশ্যই বলবে এগুলি তো সৃষ্টি করেছেন পরাক্রমশালী সর্বজ্ঞ আল্লাহ।’’[6]
অন্যত্র ইরশাদ করা হয়েছে:
وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ مَنْ خَلَقَهُمْ لَيَقُولُنَّ اللَّهُ فَأَنَّى يُؤْفَكُونَ
‘‘যদি জিজ্ঞাসা কর, কে তাদেরকে সৃষ্টি করেছে? তারা অবশ্যই বলবে, ‘আল্লাহ।’ তবুও তারা কোথায় ফিরে যাচ্ছে?’’[7]
অন্যত্র আল্লাহ বলেছেনঃ
وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ مَنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضَ لَيَقُولُنَّ اللَّهُ قُلْ أَفَرَأَيْتُمْ مَا تَدْعُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ إِنْ أَرَادَنِيَ اللَّهُ بِضُرٍّ هَلْ هُنَّ كَاشِفَاتُ ضُرِّهِ أَوْ أَرَادَنِي بِرَحْمَةٍ هَلْ هُنَّ مُمْسِكَاتُ رَحْمَتِهِ قُلْ حَسْبِيَ اللَّهُ عَلَيْهِ يَتَوَكَّلُ الْمُتَوَكِّلُونَ
‘‘যদি তাদেরকে জিজ্ঞাসা কর, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী কে সৃষ্টি করেছেন? তারা অবশ্যই বলবে, ‘আল্লাহ।’ বল, তোমরা ভেবে দেখেছ কি, আল্লাহ আমার অনিষ্ট চাইলে তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাকো তারা কি সে অনিষ্ট দূর করতে পারবে? অথবা তিনি আমার প্রতি অনুগ্রহ করতে চাইলে তারা কি সে অনুগ্রহ রোধ করতে পারবে? বল, ‘আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।’ নির্ভরকারিগণ আল্লাহর উপরেই নির্ভর করে।’’[8]
এ সকল আয়াত থেকে আমরা জানছি যে, কাফিররা এক বাক্যে স্বীকার করত যে, মহান আল্লাহই বিশ্বের সকল কিছুর একমাত্র স্রষ্টা, পরিচালক, প্রতিপালক, বৃষ্টিদাতা, ফসলদাতা, রিয্কদাতা, সকল ক্ষমতার মালিক, সর্বশক্তিমান, তাঁর উপরে কেউ আশ্রয়দাতা নেই, মানুষের সকল শক্তি তাঁর নিয়ন্ত্রণে, তিনি অনিষ্ট চাইলে কেউ তা দূর করতে পারেনা এবং তিনি কল্যাণ চাইলে কেউ তা রোধ করতে পারেনা। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বিরোধিতা করা সত্ত্বেও এ কথা তার অকপটে স্বীকার করতো।
পরবর্তী আলোচনা থেকে আমরা দেখব যে, তারা এভাবে মহান আল্লাহর রুবূবিয়্যাতের একত্বের সুস্পষ্ট ঘোষণা দিলেও অস্পষ্ট একটি ধারণা তাদের মধ্যে ছিল যে, আমাদের উপাস্যগণ আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে কিছু করতে সক্ষম না হলেও, বা আল্লাহ চূড়ান্ত ফয়সালা দিলে তা পরিবর্তনের ক্ষমতা না রাখলেও সাধারণভাবে কিছু অলৌকিক নিষ্ট-অনিষ্টের ক্ষমতা তাদের আছে, যা আল্লাহই তাদের দিয়েছেন।
[2] সূরা (১০) ইউনূস: ৩৪ আয়াত।
[3] সূরা (২৩) মুমিনূন: ৮৪-৮৯ আয়াত।
[4] সুরা (২৯) আনকাবুত: ৬১- ৬৩ আয়াত।
[5] সূরা (৩১) লুকমান: ২৫ আয়াত।
[6] সূরা (৪৩) যুখরূফ: ৯ আয়াত।
[7] সূরা (৪৩) যুখরূফ: ৮৭ আয়াত।
[8] সূরা (৩৯) যুমার: ৩৮ আয়াত।
‘তাওহীদুল আসমায়ি ওয়াস সিফাত’ (توحيد الأسماء والصفات) বা ‘নাম ও গুনাবলীর তাওহীদ’ অর্থ: দৃঢ়ভাবে এ বিশ্বাস করা যে, মহান আল্লাহ সকল পূর্ণতার গুণে গুণান্বিত। আল্লাহ পবিত্র কুরআনে এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বিভিন্ন হাদীসে আল্লাহর বিভিন্ন নাম ও বিশেষণের উল্লেখ করেছেন। এ সকল নাম ও বিশেষণের উপর দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে হবে, সকল প্রকার বিকৃতি, অপব্যাখ্যা থেকে মুক্ত থাকতে হবে এবং বিশ্বাস করতে হবে যে, আল্লাহর কোনো কর্ম, গুণ বা বিশেষণ কোনো সৃষ্টজীবের কর্ম, গুণ বা বিশেষণের মত নয়, তুলনীয় নয় বা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
আমরা ইতোপূর্বে বলেছি যে, মহান আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলি গাইবী বিষয়। মানুষ যুক্তি ও বুদ্ধি দিয়ে আল্লাহর অস্তিত্বের বাস্তবতা অনুভব করতে পারে, কিন্তু যুক্তি বা বুদ্ধি দিয়ে তাঁর সত্তা ও গুণাবলির খুটিনাটি বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। প্রাচীন কাল থেকেই মানুষ এ বিষয়ে দর্শন, যুক্তি ও মানবীয় পছন্দ-অপছন্দের উপর নির্ভর করে বিভ্রান্তির মধ্যে নিপতিত হয়েছে। বিভিন্ন যুক্তিতর্কের ভিত্তিকে কেউ বলেছেন, আল্লাহর কোনো গুণ বা বিশেষণ থাকতে পারে না। কেউ বলেছেন, তাঁর অমুক গুণ থাকতে পারে, কিন্তু তমুক গুণ থাকতে পারে না বা অমুক নামে তাঁকে ডাকা যায় না। কুরআন কারীমে কাফিরদের এরূপ কিছু বিভ্রান্তির উল্লেখ করা হয়েছে। মক্কার কাফিরগণ আল্লাহকে একমাত্র স্রষ্টা ও প্রাতিপালক হিসেবে বিশ্বাস করলেও তাকে ‘রাহমান’ বা করুণাময় বলে বিশ্বাস করতে বা এ নামে ডাকতে অস্বীকার করত। এ বিষয়ে মহান আল্লাহ বলেন:
وَإِذَا قِيلَ لَهُمُ اسْجُدُوا لِلرَّحْمَنِ قَالُوا وَمَا الرَّحْمَنُ أَنَسْجُدُ لِمَا تَأْمُرُنَا وَزَادَهُمْ نُفُورًا
‘‘যখন তাদেরকে বলা হয় ‘সাজ্দাবনত হও রহমান-এর প্রতি’, তখন তারা বলে, ‘রাহমান আবার কি? তুমি কাউকে সাজদা করতে বললেই কি আমরা তাকে সাজদা করব?’ এতে তাদের বিমুখতাই বৃদ্ধি পায়।’’[1]
এ বিভ্রান্তি থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় এ বিষয়ে ওহীর উপরে পরিপূর্ণ নির্ভর করা। কুরআন কারীমে বা সহীহ হাদীসে আল্লাহর বিষয়ে যে সকল বিশেষণ বা কর্মের গুণ আরোপ করা হয়েছে সেগুলিকে কোনোরূপ বিকৃতি, ব্যাখ্যা, তুলনা বা পরিবর্তন ছাড়াই বিশ্বাস করা।
আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন:
وَلِلَّهِ الأَسْمَاءُ الْحُسْنَى فَادْعُوهُ بِهَا وَذَرُوا الَّذِينَ يُلْحِدُونَ فِي أَسْمَائِهِ سَيُجْزَوْنَ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ
‘‘এবং আল্লাহরই নিমিত্ত উত্তম নামসমূহ, তোমরা তাঁকে সে সকল নামেই ডাকবে। যারা তাঁর নামসমূহ বিকৃত করে বা নামসমূহের বিষয়ে বক্রতা অবলম্বন করে তাদেরকে তোমরা বর্জন করবে। শীঘ্রই তাদেরকে তাদের কৃতকর্মের ফল প্রদান করা হবে।’’[2]
قُلِ ادْعُوا اللَّهَ أَوِ ادْعُوا الرَّحْمَنَ أَيًّا مَا تَدْعُوا فَلَهُ الأَسْمَاءُ الْحُسْنَى
‘‘বল, তোমরা ‘আল্লাহ’ নামে আহবান কর বা ‘রহমান’ নামে আহবান কর, তোমরা যে নামেই আহবান কর সকল সুন্দর নামই তো তাঁর।’’[3]
অন্য আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন:
اللَّهُ لا إِلَهَ إِلا هُوَ لَهُ الأَسْمَاءُ الْحُسْنَى
‘‘আল্লাহ, তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, সমস্ত উত্তম নাম তাঁরই।’’[4]
অন্য আয়াতে আল্লাহ ইরশাদ করেছেনঃ
لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ
‘‘কোনো কিছুই তাঁর সাথে তুলনীয় নয়, তিনি সর্বশ্রোতা সর্বদ্রষ্টা।’’[5]
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেছেন:
فَلَا تَضْرِبُوا لِلَّهِ الأَمْثَالَ إِنَّ اللَّهَ يَعْلَمُ وَأَنْتُمْ لا تَعْلَمُونَ
‘‘তোমরা আল্লাহর জন্য উপমা বা তুলনা স্থাপন করবে না। নিশ্চয় আল্লাহ জানেন আর তোমরা জান না।’’[6]
[2] সূরা (৭) আরাফ: ১৮০ আয়াত।
[3] সূরা (১৭) বানী ইসরাঈল: ১১০ আয়াত।
[4] সূরা (২০) তাহা: ৮ আয়াত।
[5] সূরা (৪২) শূরা: ১১ আয়াত।
[6] সূরা (১৬) নাহল: ৭৪ আয়াত।
তাওহীদুল আসমা ওয়াস সিফাত বা মহান আল্লাহর নাম ও গুণাবলির একত্বের বিষয়ে দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দী থেকে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে বিভিন্ন বিভ্রান্তির উদ্ভব ঘটে। এ বিষয়ে একমাত্র ওহীর উপর নির্ভর না করে মানবীয় পছন্দ, যুক্তি, দর্শন ইত্যাদির মাধ্যমে বিভিন্ন মতবাদ প্রচার করা হয়। ইফতিরাক অধ্যায়ে আমরা এ বিষয়ে আলোচনা করব।
আরবীতে একে ‘তাওহীদুল উলুহিয়্যাহ্’ (توحيد الألوهية) অর্থাৎ ‘ইবাদত বা উপাসনার একত্ব’ বা ‘আত-তাওহীদুল ইরাদী আত-তালাবী’ (التوحيد الإرادي الطلبي) অর্থাৎ ‘ইচ্ছাধীন নির্দেশিত একত্ব’ বলা হয়।[1]
ইবাদত শব্দটি আভিধানিকভাবে ‘আবদ’ বা ‘দাস’ শব্দ থেকে গৃহীত। দাসত্ব বলতে ‘উবূদিয়্যাত’ ও ‘ইবাদত’ দুটি শব্দ ব্যবহৃত হয়। উবূদিয়্যাত ব্যবহৃত হয় লৌকিক বা জাগতিক দাসত্বের ক্ষেত্রে। আর ‘ইবাদত’ বুঝানো হয় অলৌকিক, অজাগতিক বা অপার্থিব দাসত্বের ক্ষেত্রে। সকল যুগে সকল দেশের মানুষই জীবন, মৃত্যু ইত্যাদি অতিপরিচিত শব্দের মতই ‘ইবাদত’, উপাসনা, worship, veneration ইত্যাদি শব্দের অর্থ স্বাভাবিকভাবেই বুঝে। মানুষ অন্য মানুষের দাস হতে পারে বা দাসত্ব করতে পারে, তবে সে অন্য যে কোনো সত্তার ‘ইবাদত’ বা উপাসনা করে না। শুধু মাত্র যার মধ্যে অলৌকিক বা অপার্থিব ক্ষমতা আছে, ইচ্ছা করলেই মঙ্গল করার বা অমঙ্গল করার বা তা রোধ করার অলৌকিক শক্তি বা অতিপ্রাকৃতিক ক্ষমতা আছে বলে বিশ্বাস করে তারই ‘ইবাদত’ করে।
প্রসিদ্ধ ভাষাবিদ রাগিব ইস্পাহানী হুসাইন ইবনু মুহাম্মাদ (৫০২ হি) বলেন:
العبودية إظهار التذلل والعبادة أبلغ منها لأنها غاية التذلل ولا يستحقها إلا من له غاية الأفعال (الإفضال)
‘‘‘উবূদিয়াত’ (slavery, serfdom, bondage) হলো বিনয়-ভক্তি প্রকাশ করা। আর ‘ইবাদত’ (worship, veneration) এর চেয়েও অধিক গভীর অর্থজ্ঞাপক। কারণ ইবাদত হলো চূড়ান্ত বিনয়-ভক্তি-অসহায়ত্ব প্রকাশ, যিনি চূড়ান্ত কর্ম-ক্ষমতা ও দয়ার মালিক তিনি ছাড়া কেউ এই চূড়ান্ত বিনয়-ভক্তি পাওয়ার যোগ্যতা রাখে না।’’[1]
অন্যান্য আলিমও অনুরূপ সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। তাদের ভাষায়:
العبادة على المعنى اللغوي غاية التذلل والافتقار والاستكانة
‘‘ইবাদতের আভিধানিক অর্থ হলো, চূড়ান্ত বিনয়-ভক্তি, অসহায়ত্ব ও মুখাপেক্ষিত্ব।’’[2]
আল্লামা ইবনু কাসীর (৭৭৪ হি) বলেন:
والعبادة في اللغة من الذلة ... وفي الشرع عبارة عما يجمع كمال المحبة والخضوع والخوف
‘‘আভিধানিকভাবে ইবাদত অর্থ ভক্তি-বিনয় বা অসহায়ত্ব। ... আর শরীয়তের পরিভাষায় পরিপূর্ণ ভালবাসা, ভক্তি, বিনয় ও ভীতির সমন্বিত অবস্থাকে ইবাদত বলা হয়।’’[3]
এভাবে আমরা দেখছি যে, পরিপূর্ণ ভালোবাসা ও ভীতিময় চূড়ান্ত ভক্তিই ইবাদত। আর চূড়ান্ত বিনয়, অসহায়ত্ব ভক্তি প্রকাশ করে চূড়ান্ত ক্ষমতা ও করুণার অধিকারীর জন্য যে কর্ম করা হয় তা বিভিন্ন পর্যায়ের। তার কাছে যেমন প্রার্থনা করা হয় তেমনি তার প্রশংসাও করা হয়। সবই ইবাদত। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য মানুষ যা কিছু করে সবই ইবাদত বলে গণ্য। এজন্য ইবাদতের ব্যাখ্যায় বলা হয়:
اسم جامع لكل ما يحبه الله ويرضاه من الأقوال والأعمال الظاهرة والباطنة
‘‘আল্লাহ ভালবাসেন এরূপ সকল কথা, বাহ্যিক কর্ম ও হার্দিক বা মানসিক কর্ম সব কিছুই ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত।’’[4]
[2] আযীম আবাদী, আউনুল মা’বূদ ৪/২৪৭; মুবারকপূরী, তুহফাতুল আহওয়াযী ৯/২২০; মুনাবী, আব্দুর রাউফ, ফাইদুল কাদীর ৩/৫৪০।
[3] ইবনু কাসীর, তাফসীর ১/২৬।
[4] উসাইমীন, মুহাম্মাদ ইবনু সালিহ, আল-কাওলুল মুফীদ ১/১৬।