ইসলামের বিধান মহান আল্লাহ প্রদত্ত একটি অতুলনীয় নে‘আমত। যারা তা লাভ করতে সক্ষম হয়েছে তারা বড়ই সৌভাগ্যবান। একজন মানুষের পক্ষে মুসলিম হওয়া তার জন্য অত্যন্ত গৌরবের ব্যাপার। সে জন্য বাংলাদেশের একজন সাধারণ মুসলিমও এ জন্য গর্ববোধ করে। এমনকি কেউ ইসলাম বিরোধী বা ইসলাম বিনষ্টকারী কোনো কাজ করলেও এ-জন্য কেউ তাকে অমুসলিম বলুক, এমন কথা তারা বরদাশত করতে পারেন না। তবে আসল কথা হচ্ছে মুসলিম হওয়ার বিষয়টি প্রকৃত আনন্দ ও গর্বের বিষয় হচ্ছে কেবল সে ব্যক্তির জন্যেই যে ইসলামকে সঠিকভাবে বুঝতে সক্ষম হয়েছে এবং ইসলাম বিরোধী যাবতীয় চিন্তা, চেতনা, কর্ম ও অভ্যাসকে চুড়ান্তভাবে পরিহার করে পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ করেছে এবং এর মধ্যে থেকেই তার জীবন অতিবাহিত করেছে।
বাংলাদেশের মুসলিমরা যদিও নিজেদেরকে সত্যিকারের মুসলিম বলে দাবী করে থাকেন, তবে তাদের অধিকাংশের চিন্তা, চেতনা, কর্ম, বক্তব্য ও অভ্যাস এ কথারই সাক্ষ্য দেয় যে, আদম সন্তানদেরকে বিভ্রান্ত করার জন্য শয়তান বিতাড়িত হওয়ার সময় যে প্রতিজ্ঞা করেছিল এবং তা বাস্তবায়নের জন্যে পরবর্তীতে সে যে সব পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল, তাদের উপর শয়তান তার সে প্রতিজ্ঞা ও পরিকল্পনা বাস্তবেরূপ দিতে সক্ষম হয়েছে। তাদেরকে তাদের অজান্তেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সময়কার আরবের মুশরিকদের অবস্থার শিকারে পরিণত করেছে, যাদের ব্যাপারে আল্লাহ বলেছিলেন :
﴿ وَمَا يُؤۡمِنُ أَكۡثَرُهُم بِٱللَّهِ إِلَّا وَهُم مُّشۡرِكُونَ ١٠٦ ﴾ [يوسف: ١٠٦]
‘‘এদের অধিকাংশই মুশরিক অবস্থায় আল্লাহর উপর বিশ্বাস করে।’’[1]
বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশের অধিকাংশ মুসলিমদের মাঝে যে শির্কের ছড়াছড়ি রয়েছে, এ বিষয়ে শরী‘আত বিশেষজ্ঞদের সাক্ষ্য প্রমাণ আমরা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে উপস্থাপন করেছি। নিম্নে আমরা তাদের বাস্তব কিছু শির্কী আক্বীদা-বিশ্বাস, কর্ম ও অভ্যাসের উদাহরণ উপস্থাপন করবো ইন-শাআল্লাহ, যা এ কথারই উত্তম সাক্ষ্য বহন করবে যে, তারা নিজেদেরকে একেকজন মুসলিম বলে দাবী করলেও তাদের অধিকাংশরাই এর বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছেন।
তারা তাদের বিভিন্ন বিশ্বাস, কর্ম ও অভ্যাসের দ্বারা যে শুধুমাত্র আরবের মুশরিকদের সমতুল্যই হয়েছেন তা নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রে তারা তাদের চেয়েও অগ্রগামী হয়েছেন।আমাদের দেশের মুসলিমদের ধর্মীয় ও সামাজিক অবস্থা পর্যালোচনা করে আমার কাছে প্রমাণিত হয়েছে যে, তাদের অধিকাংশের বিশ্বাস, কর্ম ও অভ্যাসে যে সকল শির্কের প্রচলন রয়েছে, তা শির্কে আকবার এর চার প্রকারকেই শামিল করে। নিম্নে তা এক এক করে বর্ণনা করা হলো :
>১. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অদৃশ্য বা গায়েব সম্পর্কে জানতেন বলে বিশ্বাস করা :
আমাদের দেশে এমন বহু মুসলিম রয়েছেন যারা নিজেদেরকে প্রকৃত সুন্নী বলে দাবী করে থাকেন। তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জ্ঞান ও তাঁর মান মর্যাদা বাড়ানোর জন্য তাঁর ব্যাপারে এ বিশ্বাস পোষণ করেন যে, তিনি তাঁর জীবদ্দশায় যাবতীয় অদৃশ্য সম্পর্কে অবগত ছিলেন, বর্তমানেও তিনি সর্বত্র হাজির ও নাজির আছেন। সুদূর মদীনায় থেকেও তিনি সর্বত্র বিরাজমান ও সব কিছু অবলোকন করছেন। দেশের চট্রগ্রাম, কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ ও ময়মনসিংহ জেলার অনেক মুসলিম এ চিন্তাধারা লালন করে থাকেন। কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ উপজেলার আবু বকর সিদ্দিক নামের জনৈক পীর সাহেবও এ ধরনের দাবী করেন বলে পত্রিকান্তরে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।[1]
অনুরূপভাবে এ বিশ্বাস সিলেট জেলার জকিগঞ্জ উপজেলার ফুলতুলী পীর সাহেব এবং তাঁর সকল ভক্ত অনুরক্তরাও পোষণ করে থাকেন। এ ধরনের বিশ্বাস যে জ্ঞানগত শির্কের অন্তর্গত, এর প্রমাণ আমরা প্রথম অধ্যায়ে যাবতীয় তথ্য প্রমাণাদিসহ উপস্থাপন করেছি। সেখানে প্রমাণ করে দেখিয়েছি যে, কারো পক্ষেই নিজ থেকে গায়েব সম্পর্কে জানার কোনো সুযোগ নেই। এ বিষয়টি সম্পূর্ণভাবেই আল্লাহ তা‘আলার অধিকারভুক্ত বিষয়। আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে তাঁর রেসালতের দায়িত্ব যথাযথভাবে আদায় করার প্রয়োজনে আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে কিছু অদৃশ্য সম্পর্কে অবগত করেছিলেন, এর বাইরে তিনি নিজ থেকে আর কিছুই জানতেন না বা জানতে পারতেন না।
গায়েব সম্পর্কে জানার যেমন তাঁর জন্মগত কোনো বৈশিষ্ট্য ছিল না, তেমনি রেসালত লাভের পরেও তাঁর মধ্যে এমন কোনো বৈশিষ্ট্য দান করা হয় নি। তা না দেয়ার কারণ হলো : এটি আল্লাহ তা‘আলার রুবূবিয়্যাতের সাথে সম্পর্কিত স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টিকারী তাঁর একটি বিশেষ গুণ, যা তিনি (আল্লাহ) ব্যতীত তাঁর কোনো সৃষ্টির জন্য শোভা পায় না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর জীবদ্দশায় যে বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হতে পারেন না, তাঁর তিরোধানের পরেও তিনি সে বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হতে পারেন না।
যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্য এমন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হওয়ার চিন্তাধারা লালন করেন তারা নিজেদেরকে ‘আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’ এর দল বলে দাবী করে থাকেন। অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যে সকল সাহাবীগণ সর্বপ্রথম নিজেদেরকে এ নামে পরিচয় দান করেছিলেন, তাঁরাতো তাঁর জন্য এ জাতীয় কোনো বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হওয়ার ধারণায় আদৌ বিশ্বাসী ছিলেন না। এ ভ্রান্ত শির্কী বিশ্বাস পোষণকারীগণ হয়তোবা এর দ্বারা রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে অসীম জ্ঞানের অধিকারী ও মর্যাদাবান বলে তাঁর মর্যাদা বৃদ্ধি করতে চান; কিন্তু তাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, এ জাতীয় বিশ্বাসের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে অধিক সম্মান প্রদর্শন করার অর্থ হচ্ছে- অধিক মাত্রায় শির্কে নিমজ্জিত হওয়া ও ইসলাম থেকে পূর্ণমাত্রায় বেরিয়ে যাওয়ার শামিল।[2] এ জাতীয় শির্ককারীদের ব্যাপারে মাওলানা রশীদ আহমদ গাংগুহী বলেন :
‘‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-গায়েব জানতেন এ জাতীয় বিশ্বাস পোষণ করা প্রকাশ্য শির্ক।’’[3]
মাওলানা শাহ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিসে দেহলভী এ জাতীয় চিন্তাধারা সম্পর্কে বলেন :
‘‘আল্লাহ তা‘আলার উলূহিয়্যাতের সাথে সম্পর্কিত বিষয়াদির ক্ষেত্রে এ ধারণা পোষণ করা যে, নবীগণ গায়েব জানেন, তাঁরা সকল স্থান থেকে মানুষের আহ্বান শ্রবণ করেন, এ জাতীয় আক্বীদা-বিশ্বাস ভ্রান্ত ও শির্ক।’’[4]
আমাদের দেশে এ-জাতীয় শির্কী চিন্তাধারা ও বিশ্বাস ভ্রান্ত তরীকত পন্থী এবং আহমদ রেজা ব্রেলভী (১৮৫৬-১৯২১ খ্রি.) এর অনুসারীদের মাধ্যমে অনুপ্রবেশ করেছে; কেননা, মা‘রিফাতের দাবীদার ভ্রান্ত তরীকতপন্থীরা এ জাতীয় ধারণা শুধু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ব্যাপারেই পোষণ করে না, তারা ওলিদের ব্যাপারেও উপর্যুক্ত ধারণা পোষণ করে। আহমদ রেজা ব্রেলভীও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ব্যাপারে এ জাতীয় শির্কী চিন্তাধারা পোষণ করত এবং তার ও তার অনুসারীদের দ্বারাই এ চিন্তাধারা পাকিস্তান, ভারত ও আমাদের দেশে অধিকমাত্রায় অনুপ্রবেশ করেছে। সে কারণেই ভারত মহাদেশের বিশিষ্ট আলেমগণকে আহমদ রেজা ব্রেলভী এর ভ্রান্ত চিন্তাধারার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মুখর দেখতে পাওয়া যায়। তার চিন্তাধারার মুখোশ উন্মোচন কল্পেই লিখিত হয়েছে بريلوي مذهب أور إسلام এবং بريلوي مذهب كي نيا روب এ নামের দু’টি কিতাব।[5]
২. ভাগ্য সম্পর্কে জানার জন্য জ্যোতির্বিদদের নিকট গমন করা এবং তাদের কথায় বিশ্বাস করা :আমাদের দেশে বর্তমানে প্রফেসর হাওলাদারসহ[6] আরো অনেক জ্যোতির্বিদ রয়েছেন যারা তারকার গতিবিধি লক্ষ্য করে এর ফলাফল দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রিকায় প্রকাশ করে থাকেন। এর দ্বারা তারা জনগণকে তাদের ভাগ্য সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করে আগাম সতর্ক করেন। রাশি ফলের এ জাতীয় প্রচারণা আমাদের দেশে এখন একটি সাধারণ ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। রাজধানী ঢাকাতে তাদের অনেকের চেম্বার রয়েছে। সাধারণ লোকেরা তাদের নিকট নিজ নিজ ভাগ্যে ভাল বা মন্দ কী অপেক্ষা করছে, তা আগাম জানার জন্য গমন করে।
যারা ভাগ্য বিড়ম্বনার শিকার হয়েছে, তারা ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য পরামর্শ নেয়ার উদ্দেশ্যে তাদের নিকট গমন করে। অথচ তারা জানে না যে, ইসলাম জ্যোতির্বিদদের মানুষের ভাগ্য সম্পর্কিত ভবিষ্যদ্বাণীকে স্বীকার করে না এবং নিম্নজগতের প্রাণীর ভাগ্যে উর্ধ্ব জগতের গ্রহ, নক্ষত্র ও তারকার প্রভাব আছে বলে দীর্ঘকাল থেকে মানুষের মাঝে যে বিশ্বাস গড়ে উঠেছে, সেটাকে ইসলাম শির্কী চিন্তাধারা হিসেবে গণ্য করে; কেননা, বিশ্বজগত এককভাবে মহান আল্লাহর নির্দেশ ও তাঁর পরিকল্পনানুযায়ী পরিচালিত হয়ে থাকে। আমাদের ন্যায় সকল গ্রহ, নক্ষত্র ও তারকারাজী আল্লাহরই সৃষ্টি। এগুলোকে আমাদের ভাগ্যের ভাল বা মন্দের উপর প্রভাব বিস্তার করার জন্য সৃষ্টি করা হয় নি। এ সব একান্তই আবহমান কালের মানুষের কল্পনা ও ধারণাপ্রসূত কথা বৈ আর কিছুই নয়। এ সব বিশ্বাসের ফলেই একবার মানুষ তারকার কাল্পনিক মূর্তি বানিয়ে এর পূজা করতে অভ্যস্ত হয়েছিল।
>[2]. শেখ সুলাইমান ইবন আব্দুল্লাহ ইবন মুনি‘, প্রাগুক্ত; পৃ. ২৩১।
[3]. দেখুন : রশীদ আহমদ গাংগুহী, ফতাওয়া রশীদিয়্যাহ; ২/১০।
[4]. শাহ ‘আব্দুল ‘আযীয আদ-দেহলভী, তাফসীরে ফাতহুল আযীয; পৃ. ৫৩।
[5]. মাওলানা নূর কেলীম কর্তৃক উর্দু ভাষায় লিখিত ‘ব্রেলভী মাযহাব আওর ইসলাম’ কিতাবটি পাকিস্তানের ফয়সলাবাদ থেকে প্রকাশিত হয়েছে। এবং মাওলানা মোঃ ‘আরিফ সম্বহলী কর্তৃক লিখিত ‘ব্রেলভী ফিৎনা কি নয়া রূপ’ কিতাবটি পাকিস্তানের লাহোর থেকে ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত হয়েছে।
[6]. প্রফেসর হাওলাদার দেশের একজন প্রখ্যাত জ্যোতিষ। প্রত্যেক সপ্তাহে তার রাশিচক্রের বর্ণিত ফলাফল পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়।
আমরা মহাশুন্যে কতক ঘুর্ণমান ও কতক স্থির গ্রহ, নক্ষত্র ও তারকারাজি দেখতে পাই। এরা সবাই আল্লাহর সুনির্দিষ্ট বিধানের অধীনে মহাশুন্যে অবস্থান করছে। এদের সৃষ্টির পিছনে মহান আল্লাহর আসল উদ্দেশ্য কী, সে সম্পর্কে তিনি কুরআনুল কারীমের কোথাও বিস্তারিতভাবে কোনো তথ্য প্রদান না করে থাকলেও সংক্ষেপে এ সব সৃষ্টির কিছু উদ্দেশ্য ও উপকারিতার কথা বর্ণনা করেছেন। যেমন এ সম্পর্কে বলেছেন :
﴿وَلَقَدۡ زَيَّنَّا ٱلسَّمَآءَ ٱلدُّنۡيَا بِمَصَٰبِيحَ وَجَعَلۡنَٰهَا رُجُومٗا لِّلشَّيَٰطِينِۖ﴾ [الملك: ٥]
‘‘আমি পৃথিবীর নিকটতম আকাশকে প্রদীপমালা দ্বারা সুসজ্জিত করেছি, সেগুলোকে শয়তানের জন্য ক্ষেপনাস্ত্রস্বরূপ তৈরী করেছি।’’[1]
এ আয়াত দ্বারা তারকা সৃষ্টির পিছনে আল্লাহর একটি উদ্দেশ্য ও তা সৃষ্টির একটি উপকারিতার সন্ধান পাওয়া যায় : এ সব সৃষ্টির উদ্দেশ্য হচ্ছে- পৃথিবী সংলগ্ন আকাশকে সাজানো। আর এর উপকারিতা হচ্ছে- যে সকল জিন শয়তান উর্ধ্বজগতে গিয়ে ফেরেশতাদের কথোপকথন শ্রবণ করতে চায়, সে সব শয়তানদের উপর তারকারাজি থেকে কোনো আগ্নেয় উপাদান নিক্ষেপ করার কাজে এ সব তারকাকে ব্যবহার করা হয়।[2]
মানব জীবনে তারকা সৃষ্টির পিছনে কী উপকারিতা রয়েছে সে সম্পর্কে অন্যত্র বলা হয়েছে :
﴿ وَعَلَٰمَٰتٖۚ وَبِٱلنَّجۡمِ هُمۡ يَهۡتَدُونَ ١٦ ﴾ [النحل: ١٦]
‘‘এবং তিনি পথ নির্ণায়ক অনেক নিদর্শনাদি সৃষ্টি করেছেন, আর তারকা দ্বারা তারা পথের নির্দেশনা লাভ করে।’’[3]
অপর আয়াতে বলা হয়েছে:
﴿وَهُوَ ٱلَّذِي جَعَلَ لَكُمُ ٱلنُّجُومَ لِتَهۡتَدُواْ بِهَا فِي ظُلُمَٰتِ ٱلۡبَرِّ وَٱلۡبَحۡرِۗ﴾ [الانعام: ٩٧]
‘‘তিনি হলেন সেই সত্তা যিনি তোমাদের জন্য তারকারাজি সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা এর দ্বারা স্থল ও সমুদ্রের অন্ধকারে পথ প্রাপ্ত হও।’’[4]এ দুটি আয়াত দ্বারা বুঝা যায় যে, তারকা সৃষ্টির পিছনে মানব জীবনে যে প্রত্যক্ষ উপকারিতা রয়েছে তা হলো- সমুদ্র বা স্থল পথে রাতের বেলা চলার সময় তাদের সাথে দিকদর্শনের জন্য যদি কোনো যন্ত্রপাতি না থাকে, তা হলে তারা তারকার প্রতি লক্ষ্য করে পথের নির্দেশনা লাভ করবে। এই হচ্ছে নক্ষত্রপুঞ্জ সৃষ্টির পিছনে আল্লাহ তা‘আলার কী উদ্দেশ্য রয়েছে এবং মানব জীবনে এর প্রত্যক্ষ কী উপকারিতা, তার একটি বর্ণনা।
এর বাইরে যদি আমরা বিজ্ঞানের আলোকে তারকা সৃষ্টির উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলতে যাই তা হলে এটুকু বলতে পরি যে, বিশ্বজগত সুষ্ঠুভাবে একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা পর্যন্ত পরিচালিত হওয়ার জন্য মহান আল্লাহ মহাশূন্যে এ সব গ্রহ, নক্ষত্র ও তারকারাজি সৃষ্টি করেছেন। বর্তমানে বিজ্ঞানের উন্নতি হয়েছে বলেই আমাদের পক্ষে এ সব সৃষ্টির এ উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবগত হওয়া সম্ভব হয়েছে। কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার সময়ে মহাশূন্য সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান এতদূর অগ্রসর হয় নি বলেই কুরআনে এ উদ্দেশ্যের কথা স্পষ্টভাবে বর্ণিত না হয়ে যে উদ্দেশ্য ও উপকারের কথা তৎকালীন মানুষের বোধগম্য হয় কেবল সে উদ্দেশ্য ও উপকারের কথাই তাতে বর্ণনা করা হয়েছে।
>[2]. মুফতি মুহাম্মদ শফী‘ ইমাম কুরত্ববী থেকে বর্ণনা করেন : নক্ষত্ররাজিকে শয়তান বিতাড়িত করার জন্যে নিক্ষেপ করার অর্থ এরূপ হতে পারে যে, নক্ষত্ররাজি থেকে কোন আগ্নেয় উপাদান শয়তানের দিকে নিক্ষেপ করা হয় এবং নক্ষত্ররাজি স্বস্থানেই থেকে যায়। সাধারণ দর্শকের দৃষ্টিতে এই অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নক্ষত্রের ন্যায় গতিশীল দেখা যেতে পারে। এই দৃষ্টিকোণ থেকেই এটাকে তারকা খসে যাওয়া বলা হতে পারে। দেখুন : মুফতি মুহাম্মদ শফী‘, প্রাগুক্ত; পৃ. ১৩৯২।
[3]. আল-কুরআন, সূরা নাহাল : ১৬।
[4] . আল-কুরআন, সূরা আল-আন‘আম : ৯৭।
কুরআন অবতীর্ণকালীন সময়ে সমাজে যারা কাহিন বা জ্যোতির্বিদ নামে পরিচিত ছিল, তারা মোট দু’টি মাধ্যমের উপর নির্ভর করে ভবিষ্যদ্বাণী করতো :
এক . তারকারাজির গতিবিধির প্রতি লক্ষ্য করে আবহমান কাল থেকে জ্যোতির্বিদরা আন্দাজ ও অনুমানের উপর নির্ভর করে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিল, সে অভিজ্ঞতার আলোকে তাদের মাঝে ভবিষ্যদ্বাণী করার যে রীতি চলে আসছিল, সে রীতি অনুযায়ী তারা কিছু ভবিষ্যদ্বাণী করতো।
দুই. জিনরা উর্ধ্বাকাশে গিয়ে ফেরেশতারা পৃথিবীর কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা করলে গোপনে তা শ্রবণ করে তাদের কাছে এসে এর সাথে আরো অসংখ্য মিথ্যা মিশ্রণ করে সংবাদ দিতো এবং সে সংবাদের আলোকেই তারা কিছু ভবিষ্যদ্বাণী করতো। ফলে তাদের কিছু কথা বাস্তবের সাথে মিলে যেতো। এ জাতীয় ভবিষ্যৎ প্রবক্তাদের উত্তরসূরীরা এখনও সকল দেশেই কম-বেশী রয়েছে। তবে এদেরকে আর আধুনিক জ্যোতির্বিদদেরকে একপাল্লায় বিচার করা যায় না; কারণ, পুরাতন জ্যোতিষ ও তাদের উত্তরসূরীগণ পুরাতন নিয়মানুযায়ী তারকার গতিবিধি লক্ষ্য করে আন্দাজ ও অনুমান করে মানুষের ভাগ্যের ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী করেন। তারা একদিকে যেমন বাস্তবে সত্যিকার অর্থেই কিছু ঘটতে যাচ্ছে এমন কিছু জেনে কোনো কথা বলতে পারেন না, অপরদিকে তেমনি তারা যা বলেন এর দু’একটি কথা ঘটনাক্রমে সত্য বলে প্রমাণিত হলেও বাদবাকী সবই মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়। যেমন ২০০৪ সনে অনুষ্ঠিত আমেরিকার নির্বাচনের ফলাফল দ্বারা তাদের মিথ্যাবাদিতা প্রমাণিত হয়েছে। তথাকথিত জ্যোতির্বিদরা বলেছিল
এবারের নির্বাচনে জন কেরি জয়ী হবেন, কিন্তু বাস্তবে তা হয় নি। পক্ষান্তরে আধুনিক জ্যোতির্বিদগণ যা বলেন তা কোনো অদৃশ্য সম্পর্কিত বিষয় নয়। তারা আধুনিক বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে সৌরজগত সম্পর্কে নিত্য নতুন যে সব আবিষ্কারের কথা বলেন, তাদের সে সব কথা সত্য হোক আর না হোক তা যেমন মানুষের ভাগ্যের সাথে সম্পৃক্ত কোনো অদৃশ্য সম্পর্কিত কথা নয়, তেমনি তা মিথ্যা হলেও এতে মানুষের ব্যক্তি জীবনেও এর কোনো বিরূপ প্রভাব নেই। জ্যোতিষরা মানুষের ভাগ্য সম্পর্কে জানে এবং এ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে এ মর্মে জনমনে যে বিশ্বাস রয়েছে ইসলামী শরী‘আতে এ বিশ্বাসের কোনো স্থান নেই। বরং নিম্ন জগতের ঘটনা প্রবাহের উপর উর্ধ্ব জগতের তারকার প্রভাবে বিশ্বাস করাকে ইসলামে শির্কী বিশ্বাস বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এমন বিশ্বাসীকে হাদীসে কুদসীতে কাফির বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।[1]
১. জিন ও জিন সাধকরা গায়েব সম্পর্কে জানতে পারে বলে বিশ্বাস করা :
আমাদের দেশের অনেক লোকেরা জিনসাধকদের ব্যাপারে এ বিশ্বাস রাখেন যে, এরা ইচ্ছা করলে গায়েব সম্পর্কে জানতে পারে। সে-জন্য দেখা যায় কারো কিছু চুরি হলে বা কেউ কোনো সমস্যায় পতিত হলে, তারা দ্রুত কোনো জিনসাধকের শরণাপন্ন হন। সেখানে যেয়ে চুরি হওয়া দ্রব্য এবং চোর সম্পর্কে জানতে চান। দ্রব্যটি এখনও অক্ষত অবস্থায় আছে কি না এবং কিভাবে তা পাওয়া যেতে পারে, সে সম্পর্কেও জানতে চান। বিভিন্ন রোগীরাও তাদের নিকট গিয়ে তাদের রোগটা কী এবং কিভাবে তা আরোগ্য হতে পারে, তা জানতে যান।
জিনসাধকেরা মানুষের সমস্যার সমাধান কল্পে যে সব কথা বলে, অনেক সময় তা বাস্তবের সাথেও মিলে যায়, সে জন্যেই সাধারণ মানুষের মাঝে তাদের সম্পর্কে উক্ত ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। জিনসাধকদের কোনো কোন কথার সত্যতা বাস্তবে প্রমাণিত হলেও এর দ্বারা তারা গায়েব সম্পর্কে জানে বা জানতে পারে, এ কথা বলার কোনো যৌক্তিকতা নেই; কেননা, জিনসাধকেরা বাড়ীতে বসে থাকলেও তারা জিনের সহযোগিতায়ই তাদের অসাক্ষাতে ঘটিত ঘটনা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে থাকে। তারা তাদের বশ্যতা স্বীকারকারী বন্ধু জিনকে সর্বাগ্রে এ কাজে ব্যবহার করে।
যে সব বিষয়াদি তাদের কাছে আসে তা যদি তাদের বন্ধু জিনের উপস্থিতিতে ঘটে থাকে, তা হলে সে তার নিজের দেখানুযায়ী এ ঘটনা সম্পর্কে তথ্য দান করে। আর তার অসাক্ষাতে ঘটে থাকলে ঘটনাস্থলে গিয়ে সেখানকার জিনদের সহযোগিতা নিয়ে ঘটনা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে ফিরে এসে তার বন্ধুকে সংবাদ দান করে। অনেক সময় কোনো সঠিক তথ্য সংগ্রহ করতে না পারলে আন্দাজ ও অনুমান করে কিছু বলে দেয়। ইসলাম পূর্ব যুগেও এ ধরনের জিনসাধকরা ছিল। তখন তাদেরকে ‘কাহিন’ বলা হতো। জিনদের সহযোগিতায়ই তারা জনগণকে বিভিন্ন তথ্য ও পথ্য দিতো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে উক্ত বিশ্বাসের আলোকে লোকেরা জিনসাধক ‘কাহিনদের’ কাছে যেতো, সে জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে বিশ্বাস করতে নিষেধ করেছিলেন।
এ নিষেধ সংক্রান্ত দলীল আমরা প্রথম অধ্যায়ে বর্ণনা করেছি। জিনরা যে অদৃশ্য বা গায়েব সম্পর্কে কিছুই জানতে পারে না, তাও কুরআনুল কারীম দ্বারা প্রমাণিত। সুলায়মান (আ.) বায়তুল মাক্বদিস নির্মাণের সময় জিনদেরকে নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজে লাগিয়েছিলেন। গৃহ নির্মাণ শেষ হওয়ার পূর্বে লাঠির উপর নির্ভর করে দাড়িয়ে থাকা অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়ে গেলে জিনরা তাঁর মৃত্যুর কথা বুঝতে না পেরে যথারীতি নির্মাণ কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল, নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার পর ঘুণ পোকায় লাঠি খেয়ে ফেলার ফলে তিনি পড়ে গেলে তারা বুঝতে পারলো যে, তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। তখন তারা আফসোসের সাথে বলেছিল যে, যদি তারা তা পূর্বে বুঝতে পারতো তা হলে এ কঠিন কাজে তারা এতদিন লেগে থাকতো না। এ ঘটনা বর্ণনা প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
﴿فَلَمَّا قَضَيۡنَا عَلَيۡهِ ٱلۡمَوۡتَ مَا دَلَّهُمۡ عَلَىٰ مَوۡتِهِۦٓ إِلَّا دَآبَّةُ ٱلۡأَرۡضِ تَأۡكُلُ مِنسَأَتَهُۥۖ فَلَمَّا خَرَّ تَبَيَّنَتِ ٱلۡجِنُّ أَن لَّوۡ كَانُواْ يَعۡلَمُونَ ٱلۡغَيۡبَ مَا لَبِثُواْ فِي ٱلۡعَذَابِ ٱلۡمُهِينِ ١٤ ﴾ [سبا: ١٤]
‘‘যখন আমি সুলায়মানের মৃত্যু ঘটালাম, তখন ঘুণ পোকাই জিনদেরকে তাঁর মৃত্যু সম্পর্কে অবহিত করল। সোলায়মানের লাঠি খেয়ে যাচ্ছিল। যখন তিনি মাটিতে পড়ে গেলেন, তখন জিনেরা বুঝতে পারল যে, অদৃশ্য বিষয়ের জ্ঞান থাকলে তারা এই লাঞ্ছনাপূর্ণ শাস্তিতে আবদ্ধ থাকতো না।’’[2]
আজও যারা জিন সাধক ও জিনরা গায়েব জানে, এ বিশ্বাসের ভিত্তিতে তাদের কাছে যাবে, তাদের পরিণতিও ইসলাম পূর্ববর্তী সময়ের লোকদের মতই হবে।
৪. পাখি বা বানরের মাধ্যমে ভাগ্য জানার চেষ্টা করা :
ঢাকা শহরের গুলিস্তান এলাকার ফুটপাতে বসে কোনো কোন ব্যক্তিকে একটি টিয়া (Parot) বা বানরের মাধ্যমে ভাগ্যাহত মানুষের ভাগ্যের ভাল-মন্দ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে দেখা যায়। তারা তাদের সম্মুখে সাজিয়ে রাখেন কিছু খাম। খামের ভিতরে থাকে ভবিষ্যৎ জীবনে ভাগ্যের ভাল-মন্দ সম্পর্কে বিভিন্ন কথা। ভাগ্য বিড়ম্বনার শিকার হয়ে কেউ তাদের কাছে ভাগ্য সম্পর্কে জানতে গেলে লোকটির নির্দেশে সে টিয়া পাখি বা বানর তার সামনে সাজিয়ে রাখা খামগুলো থেকে একটি খাম উত্তোলন করে লোকটির হাতে তুলে দেয়। এবার লোকটি খামের ভিতরের কাগজটি বের করে তাতে যা লিখা রয়েছে তা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে পড়ে শুনায় বা তাকে পড়তে দেয়।
এভাবেই সাধারণ লোকেরা টিয়া পাখি বা বানরের মাধ্যমে নিজেদের ভাগ্য সম্পর্কে জানার চেষ্টা করে। খামের লিখা ভাল হলে এর দ্বারা তারা সাময়িকের জন্য হলেও আনন্দ উপভোগ করে, আর খারাপ হলে আরো হতাশাগ্রস্ত হয়। টিয়া পাখি বা বানরের মাধ্যমে সাধারণ লোকেরা নিজেদের ভাগ্য সম্পর্কে জানতে চাওয়ার কারণ হলো- তারা এদের ব্যাপারে এ ধারণা পোষণ করে যে, এরা অদৃশ্য সম্পর্কে অবগত থাকে। জাহেলী যুগে আরবের মুশরিকদের মাঝেও পাখির ডানে বা বামে উড়ে যাওয়া থেকে কোথাও ভ্রমণে যাওয়ার শুভ অশুভ জানার রেওয়াজ ছিল। এটি একটি শির্কী চিন্তাধারা হওয়াতে রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- তা এই বলে রহিত করেন যে, [.. وَلاَ طِيَرَةَ ..] ‘‘...পাখি ডানে বা বামে উড়ে যাওয়ার সাথে ভাগ্যের ভাল বা মন্দের কোনো সম্পর্ক নেই...’’।[3] অপর হাদীসে তিনি বলেন: [ الطِّيَرَةُ شِرْكٌ الطِّيَرَةُ شِرْكٌ ثَلاَثاً.]‘‘পাখি উড়িয়ে বা উড়ে যাওয়া থেকে ভাগ্যের শুভ বা অশুভ নির্ধারণ করা শির্ক। (এ কর্মটি যে শির্ক তা গুরুত্বের সাথে বুঝাবার জন্য) তিনি এ কথাটি তিন বার বলেন’’।[4]
১. আল্লাহর ওলিগণ গায়েব সম্পর্কে জানেন :
আমাদের দেশের সাধারণ মানুষদের মাঝে বিশেষ করে পীর ভক্তদের মাঝে এ ধারণা বদ্ধমূল হয়ে রয়েছে যে, পৃথিবীতে যা কিছু ঘটছে তা আল্লাহর ওলিগণ তাঁদের রূহানী শক্তিবলে জানতে পারেন। এ ধারণার ভিত্তিতেই তারা দূর-দূরান্ত থেকে ওলিগণ কে ‘ইয়া গাউস’ ‘ইয়া খাজা’ ইত্যাদি বলে সাহায্যের জন্য আহ্বান করে থাকেন। এমনকি ভক্তির আতিশয্যে তাদের কাউকে আল্লাহর যাবতীয় গুলাবলী দ্বারা খাজা মঈনুদ্দিন চিশতীকে গুণান্বিত করতেও দেখা যায়। যেমন এক ব্যক্তি খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রহ.)-কে গুণান্বিত করতে গিয়ে বলেছে : সাত্তারুন মঈনুদ্দিন, ওয়াহিদুন মঈনুদ্দিন, সামী‘উন মঈনুদ্দিন, আলীমুন মঈনুদ্দিন, আন-নাজিরু মঈনুদ্দিন ইত্যাদি।[5] যার অর্থ হচ্ছে : মঈনুদ্দিন একাধারে মানুষের সকল দোষ-ত্রুটি গোপনকারী, একক, সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ ও সর্বদ্রষ্টা। না‘উজু বিল্লাহ
খাজা মঈনুদ্দিন চিশতীকে এভাবে গুণান্বিত করার অর্থ দাঁড়ায়-তিনি যেন আল্লাহর অবতার ছিলেন। সে জন্যই তিনি তাঁর ভক্তদের যাবতীয় বিষয়ের ব্যাপারে সম্যক অবহিত রয়েছেন। তিনি তাদের আহ্বান শ্রবণ করে থাকেন। এ সব ধারণার ভিত্তিতেই বিপদের সময়ে হোক আর স্বাভাবিক সময়ে হোক সর্বাবস্থায়ই তারা তাঁদেরকে এ সব নামে আহ্বান করে থাকেন। এমনকি নামাযের মুসল্লায় দাঁড়িয়েও তাদেরকে ‘ইয়া গাউছ’ বলে বড়পীর আব্দুল কাদির জীলানী (রহ.)-কে আহ্বান করতে দেখা যায়।[6]
[2]. আল-কুরআন, সূরা সাবা : ১৪।
[3]. বুখারী, প্রাগুক্ত, ৫/২২৭৭, মুসলিম, প্রাগুক্ত; ৪/১৭৪২।
[4]. আবু দাউদ, প্রাগুক্ত; কিতাবুত ত্বিব, বাব : পাখি উড়িয়ে ভাগ্য যাচাই করার বর্ণনা; ৪/২৩০।
[5]. এ কথাগুলো মঈনুদ্দিন চিশতী (রহ.)-এর বার্ষিক ওরস উপলক্ষে তাঁর জনৈক ভক্তের দ্বারা প্রচারিত একটি দাওয়াতী হ্যান্ডবিল থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।
[6]. মাদ্রাসা-ই-আলীয়া, ঢাকাতে কামিল মুহাদ্দিস শ্রেণীতে ১৯৭৯-১৯৮১ সালে অধ্যয়ন করার সময় মোঃ আব্দুল মান্নান আ‘জমী নামে চট্রগ্রাম জেলার আমার এক সহপাঠি ছিল। একদিন যোহরের সালাতের জন্য মুসল্লায় দাঁড়িয়ে ‘ইয়া গাউস’ বলে বড়পীর আব্দুল কাদির জীলানীকে আহবান করতে শুনলাম। তাকে বললাম- নামাযের মুসল্লায় দাঁড়িয়ে গাউসকে আহবান করছো? জবাবে সে বললো- গাউস আমার আহ্বান শ্রবণ করতে পারেন, তাই তাঁকে আহ্বান করলাম।
ব্যবহার বা পরিচালনাগত শির্কের পরিচিতি সম্পর্কে প্রথম অধ্যায়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে। এখানে এর পরিচিতি সম্পর্কে সংক্ষেপে শুধু এটুকু বলতে চাই যে, এ বিশ্বজগতের মালিকানাতে যেমন আল্লাহর কোনো শরীক নেই, তেমনি গাউছ, কুতুব ও আবদাল নামে এর ছোট থেকে বড় কোনো কিছু পরিচালনার ক্ষেত্রেও তাঁর কোনো শরীক বা সাহায্যকারী নেই। তিনি যেমন বিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞার সাথে তাঁর এ জগতের সবকিছু পরিচালনা করেন, ঠিক তেমনিভাবে তিনি পরজগতও পরিচালনা করবেন। এ সৃষ্টিজগতের কারো পক্ষে তাঁর পরিচালনা কর্মে তাঁর পূর্ব অনুমতি ব্যতীত কারো ব্যাপারে শাফা‘আত করারও কোনো অধিকার নেই। এ জগতে মানুষ তাঁরই সৃষ্ট একটি সম্মানিত জীব। তাদের ভাগ্যের ভাল-মন্দ সব কিছুই তিনি নিয়ন্ত্রণ করেন। হিকমতের ভিত্তিতে যাকে ইচ্ছা প্রভূত কল্যাণ বা অকল্যাণ দিয়ে থাকেন।
তাই অবস্থা পরিবর্তনের জন্য অপর কোনো মানুষের মধ্যস্থতা পরিহার করে সরাসরি কেবল তাঁরই নিকট বিনয়ের সাথে চাইতে হবে। মানুষেরা পরস্পরের পূর্ব অনুমতি ছাড়াই একে অপরের কাছে অন্যের জন্য শাফা‘আত করতে পারে, তারা পারস্পরিক প্রয়োজনে একে অপরের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে একে অপরের সুপারিশ অনুযায়ী কাজও করে; কিন্তু আল্লাহর বিষয়টি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন, তাঁর সামনে তাঁর পূর্ব অনুমতি ব্যতীত শাফা‘আত করারও কেউ নেই, কারো নাম শুনেও তিনি প্রভাবিত হন না। তাঁর কাছে কিছু চাইতে হলে তাঁর উত্তম নামাবলীর মাধ্যমে বা ওসীলার অন্যান্য বৈধ পন্থায় তা চাইতে হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বা অপর কোনো ওলিদের নামের ওসীলায় নয়; কেননা, তাঁর নিকট কারো নামের ওসীলায় কিছু চাওয়া তাঁর সাথে মানবীয় আচরণ ও তাঁকে তাঁর সৃষ্টির দ্বারা প্রভাবিত করার শামিল।
কোনো মানুষ বা কোনো বস্তু আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছার বাইরে কারো কোনো উপকার বা অপকার করতে পারে না; সে-জন্য জীবিত কোনো মানুষ বা কোনো বস্তুর দ্বারা কোনো উপকার বা অপকার অর্জিত হলে সে উপকার বা অপকারের কৃতিত্ব সে মানুষ বা সে বস্তুকে দেয়া যাবে না। কেউ যদি এর পূর্ণ কৃতিত্ব সে মানুষ বা সে বস্তুর বলে মনে করে, তবে এতে সে আল্লাহর রুবূবিয়্যাতে সে মানুষ বা সে বস্তুকে শরীক করে নিল বলে গণ্য হবে এবং তার এ মনে করাটি শর‘য়ী দৃষ্টিতে শির্কে আকবার হিসাবে গণ্য হবে।
আল্লাহর পরিচালনা কর্মে কোনো হস্তক্ষেপকারী এ ধরাতে না থাকা সত্ত্বেও এবং তাঁর ইচ্ছার বাইরে কারো কোনো উপকার বা অপকার করার মত কেউ না থাকা সত্ত্বেও আমাদের মুসলিম সমাজে এমন সব চিন্তা, চেতনা ও কর্ম রয়েছে যা এ কথা প্রমাণ করে যে, আল্লাহর পরিচালনা কর্মে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -সহ বিভিন্ন ওলিগণ হস্তক্ষেপ করতে পারেন। তিনি (আল্লাহ) তাঁর নবী ও অলিগণের নামের দ্বারা প্রভাবিত হন। তাঁরা মরে গেলেও তাঁদের রূহানী শক্তি বলে তাঁরা ইচ্ছা করলেই মানুষের যে কোনো উপকার করতে পারেন। না‘উজু বিল্লাহ।
মুসলিম সমাজে প্রচলিত এ ধরনের কিছু পরিচালনাগত শির্কের উদাহরণ নিম্নে বর্ণিত হলো।
১. বিপদ মুক্তির জন্য দরূদ বা খতমে নারী পাঠ করা:
বিপদ মুক্তির জন্য ওসীলা করার শরী‘আত নির্দেশিত বৈধ পন্থা রয়েছে, যার কিছু ইঙ্গিত একটু আগেই দেয়া হয়েছে। তবে এর বিস্তারিত বর্ণনা আমরা এ বই এর তৃতীয় অধ্যায়ে প্রদান করবো ইন-শাআল্লাহ। কিন্তু আমাদের দেশে ওসীলার নামে শরী‘আত অনুমোদিত পন্থার বাইরে সূফীদের কর্তৃক উদ্ভাবিত দুরূদে নারী বা খতমে নারী নামে সাধারণত মাদ্রাসার শিক্ষকদের মাঝে অপর একটি ওসীলার বহুল প্রচলন রয়েছে। দরূদটি নিম্নরূপ :
"اللَّهُمَّ صَلِّ صَلاَةً كَامِلَةً وَسَلِّمْ تَسْلِيْمًا تَامًّا عَلٰى سَيِّدِنَا مُحَمَّدِ الَّذِيْ تَنْحَلُّ بِهِ الْعُقَدُ وَ تَنْفَرِجُ بِهِ الْكُرَبُ ، وَتُقْضٰى بِهِ الْحَوَائِجُ ، وَتُنَالُ بِهِ الرَّغَائِبُ وَحُسْنُ الْخَوَاتِمَ، وَ يُسْتَسْقَى الغَمَامُ بِوُجْهِهِ الْكَرِيْمِ...."
‘‘হে আল্লাহ! আমাদের নেতা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর অনেক অনেক রহমত ও শান্তি বর্ষণ করুন, যার দ্বারা যাবতীয় সমস্যার গিঁট খুলে যায়, বিপদাপদ দূরীভূত হয়, সকল প্রয়োজন পূর্ণ হয় এবং সকল কামনা, বাসনা ও ভাল পরিণতি অর্জিত হয়। যার মর্যাদাপূর্ণ মুখমণ্ডল অথবা তাঁর জাতের ওসীলা করে বৃষ্টি কামনা করা হয়।’’
এ দরূদকে এ নামে নামকরণ করার কারণ হিসেবে বলা হয়ে থাকে যে, আগুন যেমন তাতে নিক্ষিপ্ত বস্তুকে পুড়ে ছাই করে দেয়, তেমনিভাবে এ দরূদটি ৪৪৪৪ বার পাঠ করলে নাকি তাও সকল বিপদাপদকে আগুনের মত পুড়ে ছাই করে দেয়। এ দুরূদের বাক্যগুলোর মধ্যে আমরা বাহ্যতই দেখতে পাচ্ছি যে, তাতে বিপদ মুক্তির জন্য আল্লাহ তা‘আলার বদলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহায্য গ্রহণ করা হয়েছে। আর রাসূলের ব্যাপারে এ ধারণা পোষণ করা হচ্ছে যে, তাঁর দ্বারা যাবতীয় উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়ে যায়। অথচ তিনি বা কারো ব্যাপারে এ জাতীয় ধারণা করা আল্লাহর পরিচালনা কর্মে হস্তক্ষেপ করার শামিল। সে জন্য আল্লামা জাযাইরী[1] (মৃত ১৯৯৯ খ্রি.) এ দরূদ প্রসঙ্গে বলেন :
"إن هذه الصلاة لا تجوز؛لأن فيها إسناد حل العقد ...إلى آخره إلى الرسول r ، وهذا شرك أو كفر"
‘‘এ দরূদ পাঠ করা জায়েয নয়। কারণ; এতে সমস্যার গিঁট খোলাসহ দো‘আয় বর্ণিত অন্যান্য বিষয়াদিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে সম্পর্কযুক্ত করা হয়েছে। আর এ ধরনের কথা শির্ক অথবা কুফর এর অন্তর্গত’’।[2]
ইবনে আব্দিল হাদী (৭০৪-৭৪৪ হি:) বলেন: ‘‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সম্মান ও মর্যাদার ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করার মানসে তাঁর ব্যাপারে এ বিশ্বাস পোষণ করা যে, তিনি গায়েব সম্পর্কে জানেন, কিছু দিতেও পারেন এবং দিতে বারণও করতে পারেন, যারা বিপদের সময় আল্লাহকে ব্যতীত তাঁকে আহ্বান করে তিনি তাদের কল্যাণার্জন ও অকল্যাণ দূরীকরণের ক্ষমতা রাখেন, আল্লাহ তা‘আলার পূর্ব অনুমতি ছাড়াই তিনি যে কারো ব্যাপারে শাফা‘আত করতে পারেন এবং যাকে ইচ্ছা জান্নাতে প্রবেশ করাতে পারবেন, তাঁর সম্মানের ক্ষেত্রে এ ধরনের বাড়াবাড়ি করা অতি মাত্রায় শির্ক করা ও গোটা দ্বীন থেকে বেরিয়ে যাওয়ারই শামিল।’’[3]
২. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রশংসা ও স্তুতি বর্ণনা করে তাঁকে আল্লাহর অবতারে পরিণত করা :
আমাদের দেশে এমনও কিছু মানুষ রয়েছেন যারা রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অতি সম্মান দেখাতে গিয়ে তাঁর প্রশংসায় এমন সব কথা-বার্তা বলেন যা তাঁকে আল্লাহ ও প্রতিপালকের মর্যাদায় উন্নীত করে। মনে হয় যেন তিনি আর আল্লাহর মধ্যে কোনো পার্থক্যই নেই। আল্লাহ নিজেই যেন মুহাম্মদ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আকৃতিতে এ পৃথিবীতে নিজেকে প্রকাশ করেছেন এবং তিনিই যেন আল্লাহর হয়ে এ-জগত পরিচালনা করেন। তাদের এ-জাতীয় শির্কী কথা-বার্তার কিছু উদাহরণ নিম্নে প্রদত্ত হলো:
ক)
جوتها عرش پرمستوي خدا هو كر** وه أتر يرا زمين مين مصطفى هو كر
‘যিনি খোদারূপে আরশের উপর ছিলেন, তিনি পৃথিবীতে মুস্তাফারূপে অবতরণ করেন’।
খ) ‘আরশে যিনি আহাদ ছিলেন, ফরশে (যমিনে) তিনি আহমদ হলেন’’।
গ) ‘আহাদ আর আহমদের মাঝে শুধু মীম অক্ষরের পার্থক্য রয়েছে, মীমকে মাঝ থেকে সরিয়ে দিলে আহাদ আর আহমদকে একই দেখতে পাবে’।
ঘ) ‘আহমদের ঐ মীমের পর্দা উঠিয়ে দে রে মন
দেখবি সেথা বিরাজ করেছে আহাদ নিরঞ্জন’।
ঙ)
محمد با شكل عرب آمده است ** عين را حذف كن كه رب آمده است
‘মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-একজন আরবী মানুষের আকৃতিতে আগমন করেছেন, আরব শব্দের ‘আইন’ অক্ষরকে বিলুপ্ত করে দিলে দেখতে পাবে প্রকৃতপক্ষে রবই আগমন করেছেন’।
চ) ‘بظاهر محمد بباطن خدا’ মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাহ্যত মুহাম্মদ হয়ে থাকলেও গোপনে তিনি খোদা।’
ছ) محمد گرچہ خدا نهين وليكن خدا سے جدا بهى نهين ‘‘মুহাম্মদ যদিও খোদা নন, তবে তিনি খোদা থেকে পৃথকও নন।’’
জ) رسول خدا خود خدا بنكے آيا “আল্লাহর রাসূল স্বয়ং খোদা হয়ে আগমন করেছিলেন।’’
ঝ) خالق كل نے آپكو مالك كل بنا ديا ‘‘সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা আপনাকে সব কিছুর মালিক বানিয়ে দিয়েছেন।’’[4]
মাইজভাণ্ডারের অনুসারীগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে আল্লাহ বলে বিশ্বাস করার পাশাপাশি তাদের পীর আহমদুল্লাহ ভাণ্ডারীকেও তারা আল্লাহ বলে বিশ্বাস করেন। তাই তাকে লক্ষ্য করে তারা বলেন : ‘‘একের ভিতরে তিনের খেলা বুঝব কী করে, তুমি আল্লাহ, তুমি রাসূল, তুমি ভাণ্ডারী।’’
তাদের ধারণা মতে, আল্লাহ নিজেই একবার রাসূল হিসেবে আবার ভাণ্ডারী হিসেবে আগমন করেছিলেন। নাউজুবিল্লাহ।
উল্লেখ্য যে, উর্দু ও ফার্সী ভাষায় লিখিত কবিতাগুলোর লেখকগণ পরদেশী হলেও আমাদের দেশের ভ্রান্ত তরীকতপন্থীগণ এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর স্তুতি বর্ণনার ক্ষেত্রে সীমালঙ্ঘনকারীগণ কবিতার এ পংক্তিগুলো খুব ভালো করেই রপ্ত করে থাকেন এবং সাধারণত ১২ ই রবীউল আউয়াল উপলক্ষ্যে আয়োজিত ঈদে মিলাদুন্নবী উৎসবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ভালবাসা প্রকাশার্থে তারা এ সব গাইতে থাকেন। ইসলামের দৃষ্টিতে অবতারবাদ একটি শির্ক ও কুফরি বিশ্বাস হয়ে থাকলেও তাদের এ সব ধ্যান-ধারণা ও কথা বার্তার দ্বারা মনে হয় যে, তারা খ্রিস্টান ও হিন্দুদের ন্যায় অবতারবাদে বিশ্বাসী। তাদের মাঝে এ জাতীয় ধারণা ও বিশ্বাস যে হিন্দু ও খ্রিস্টানদের মধ্য থেকে অনুপ্রবেশ করেছে, তা সহজেই অনুমান করা যায়।
৩. অলিগণের মধ্যে যারা গউছ ও কুতুব তারা পৃথিবী পরিচালনা করেন বলে বিশ্বাস করা :
আমাদের দেশে ভ্রান্ত তরীকত ও মা‘রিফাতপন্থীদের মাঝে এমন একটি অদ্ভূত বিশ্বাস রয়েছে যে, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর অলিগণের মধ্য থেকে কতিপয় লোকদেরকে পৃথিবীর বিভিন্ন কর্ম পরিচালনা জন্য গউছ, কুতুব ও আব্দাল ইত্যাদি পদে নিয়োগ দিয়ে থাকেন। সরকারী ক্ষমতা লাভ, প্রশাসনের বিভিন্ন পদের নিয়োগ, বদলী ও অপসারণ তাঁদেরই ইশারায় নাকি হয়ে থাকে। আল্লাহ তা‘আলা তাঁদের হাতে কাউকে কিছু দেয়া বা না দেয়া, কারো কল্যাণ বা অকল্যাণ করার ক্ষমতা দান করে থাকেন। ‘দেওয়ানুস সালেহীন’ নামে তাঁদের নাকি একটি পরামর্শ পরিষদও রয়েছে।
সেখানে বসেই তাঁরা যাবতীয় বিষয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং সে অনুযায়ী ফরমান জারী করেন। এমনকি তাঁদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই নাকি আদালতের যাবতীয় রায়সমূহ জারী হয়ে থাকে।[5] এ-জাতীয় ধারণার পরিপ্রেক্ষিতেই বড় পীর আব্দুল কাদির জীলানীকে ‘গউছে আ‘যম’ (বড় উদ্ধারকারী) বলে নামকরণ করা হয়েছে। এ ধারণার ভিত্তিতেই পীরদের ভক্তগণ তাদের পীর সাহেবদেরকে ‘যামানার কুতুব’ নামে খেতাব দিয়ে থাকেন। গাউছ ও কুতুব সম্পর্কিত এ বিশ্বাস যে শুধু সাধারণ মানুষের মধ্যেই রয়েছে, তা নয়; এ ধরনের বিশ্বাস অনেক আলেমদের মাঝেও রয়েছে। যার জ্বলন্ত প্রমাণ হলেন জমঈয়াতুল মুদাররিছীনের সভাপতি ও ইনকিলাব পত্রিকার মালিক মাওলানা আব্দুল মান্নান।
তিনি তাঁর পত্রিকায় এ মর্মে একটি প্রবন্ধ বিগত ২৮/৯/১৯৯৭ সালে প্রকাশ করেছিলেন। যার উদ্ধৃতি প্রথম অধ্যায়ে প্রদান করা হয়েছে। গউছ ও কুতুব সম্পর্কিত এ জাতীয় চিন্তাধারা ভারতবর্ষের মুসলিম সমাজ ব্যতীত অন্যান্য মুসলিম দেশের মুসলিমদের মাঝে নেই। এ-জাতীয় চিন্তাধারা তাদের মধ্যে প্রসারিত হওয়ার পিছনে কিছু হাদীস রয়েছে; যে-গুলো দুর্বল অথবা মাওযু‘ হওয়ার ব্যাপারে হাদীস বিশেষজ্ঞগণের মাঝে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।[6] ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাঃ এ-জাতীয় বিশ্বাস সম্পর্কে বলেন,
’’وهذا كله باطل لا أصل له في كتاب الله ولا سنة رسوله، ولا قاله أحد من سلف الأمة، ولا أئمتها، ولا من المشايخ الكبار المتقدمين الذين يصلحون للاقتداء بهم ...‘‘
‘‘এ সব বাতিল বিশ্বাস। আল্লাহর কিতাব এবং তাঁর রাসূলের সুন্নাতে এ সবের কোনই ভিত্তি নেই, মুসলিম উম্মাহের অগ্রবর্তীদের মধ্যকার কেউ তা বলেন নি। তাদের ইমামগণও তা বলেন নি এবং অনুসরণীয় অগ্রবর্তী বড় বড় পীর-মাশায়েখগণও এ সব বলেন নি...’’।[7]
এ সম্পর্কে আল্লামা সুন‘উল্লাহিল হালাবী হানাফী বলেন :[8]
إن مثل هذا الاعتقاد من موضوعات إفك المسلمين
‘‘গউছ, কুতুব ও আব্দাল ইত্যাদি সম্পর্কিত বিশ্বাস মুসলিমদের মিথ্যা রচিত বিশ্বাসের অন্তর্গত।’’[9]
আমাদের দেশে এমন সব লোকও রয়েছেন যারা এ বিশ্বাস করেন যে, মহান আল্লাহ অলিগণের আকৃতিতে আত্মপ্রকাশ করে থাকেন বিধায়, অলিগণের পরিচালনাগত শক্তি সীমাহীন হয়ে থাকে। তারা আরো বিশ্বাস করেন যে, ইতোপূর্বে আল্লাহ তা‘আলা বাগদাদ, আজমীর ও মাইজভাণ্ডারে নিজের আত্মপ্রকাশ ঘটিয়েছিলেন। সে জন্য মাইজভাণ্ডারের ভক্তদেরকে এ জাতীয় ধারণা প্রকাশ করে কবিতা লিখতেও দেখা যায়। যেমন মাইজভাণ্ডারের এক হিন্দু ভক্ত লিখেছে:
হায়রে দয়াল ভাণ্ডারী।
দোজাহানের মালিক আমার জগতের কাণ্ডারী।
(মাওলারে) তোমার নাম নিয়ে দিলাম ভব সাগরে পাড়ি।
পুলসেরাতে পার করিও দিয়ে চরণ তরী।
(মাওলারে) মানুষরূপে এলে চিনতে না পারি।
তুমি যদি দয়া কর এক পলকে তরি।
(মাওলারে) মদিনা, বাগদাদ, আজমিরের খেলা সাঙ্গ করি
চট্রগ্রামে রোশন করিলা হইয়া ভাণ্ডারী।
(মাওলারে) নাম শুনে তোমার দরজায় হয়েছি ভিখারী।
রমেশ বলে দোহাই তোমার এক নজরে চাও ফিরি।’’[10]
কী আশ্চর্য যে, এ লোকটি একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও আহমদুল্লাহ মাইজভাণ্ডারীর একজন প্রথম শ্রেণীর উপাসকে পরিণত হয়েছে। হিন্দুরা যেমন তাদের রাম, কৃষ্ণ ও শিব ইত্যাদি দেবতাদের ব্যাপারে এরা আল্লাহর অবতার বলে বিশ্বাস করে, ঠিক তেমনি এ ব্যক্তি মাইজভাণ্ডারীর বেলায়ও একই ধারণা পোষণ করছে। সে তার অপর এক কবিতায় বলেছে : ভাণ্ডারীর পা নিয়ে সর্বদা চিন্তা করলে কখনও বিপদ হয় না। মানুষের পাপ মোচনের জন্যই মাইজভাণ্ডারে তাঁর শুভাগমন হয়েছিল। ভাণ্ডারীর পায়ের কথা চিন্তা করলে কা‘বা, কাশী ও বৃন্দাবন সবই পাওয়া যায়। তাঁর প্রতি ভক্তি রেখে মুখে ভাণ্ডারী নাম জপ করলে আখেরাতে মুক্তি পাওয়া যাবে; কেননা, আখেরাতে ভাণ্ডারী ব্যতীত পার পাবার কোনো উপায় নেই। নিম্নে বর্ণিত তার কবিতার দ্বারা তার এ সব বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে। যেমন সে বলেছে :
ভাব অবোধ মন হরদমে ভাণ্ডারী চরণ।
ঐ চরণে শরণ নিলে বিপদ হয় না কদাচন।
মাইজভাণ্ডারীর জোর কদমে কী ফল আছে জান না,
পাপীর ভাগ্যে দেখা দিল ভাণ্ডারেতে মাওলানা;
ঐ কদম বরকতে পাবি কা‘বা কাশী বৃন্দাবন।
মাওলার প্রতি ভক্তি রাখ মুখে ডাক ভাণ্ডারী,
মাওলা বিনে আর কেহ নেই নিতে যাবে পার করি,’’।[11]
শুধু এখানেই শেষ নয়, সে আরো দূর অগ্রসর হয়ে ভাণ্ডারীকে মানুষের ভাগ্যের উপর হস্তক্ষেপকারী ও তাদের যাবতীয় সুখ-দুঃখের মালিক বানিয়ে দিয়েছে। এ পর্যায়ে সে বলেছে:
কালি তোমার কলম তোমার, সুখ-দুঃখ লিখা সকল তোমার,
কে খন্ডাবে তুমি না খন্ডালে।[12]
মাইজভাণ্ডারের মুসলিম ভক্তরা হয়তো উপর্যুক্ত সকল বিষয়ে এ ব্যক্তির চিন্তাধারার সাথে একমত নাও হতে পারেন। তবে একজন মানুষের পথভ্রষ্টতার জন্য তো তার একটি ভ্রান্ত ধারণাই যথেষ্ট। মাইজভাণ্ডারের বার্ষিক ওরসে যে সকল মুসলিমরা তাদের ভাগ্য পরিবর্তন ও সমস্যাদির সমাধান পাবার জন্য মানতের জীব, জন্তু ও নগদ টাকা অকাতরে বিলিয়ে দেন, সে সবই তাদের শির্কী কর্মে লিপ্ত থাকার দলীল হওয়ার জন্য যথেষ্ট। সেখানকার বার্ষিক ওরসে যে হারে হিন্দু, মুসলিম নির্বিশেষে সবাই ভিড় জমায়, তাতে মনে হয় মাইজভাণ্ডার যেন সকল ধর্মাবলম্বী লোকদের জন্য একটি মহামিলন কেন্দ্র। এ সম্পর্কে সে ব্যক্তির ভাষ্য নিম্নরূপ:
‘‘‘আয়রে আয় রহমান’ মনজেলে মাইজভাণ্ডার,
ঔরস মেলা প্রেমের খেলা দেখবি আশেকের গোলজার।
দুই দিকে দুই রওজা বাত্তি জ্বলে অনিবার,
হালকা তালে আশেক নাচে আল্লাহু জিকির সার,
উট, গরু, গয়াল, মৈষ সংখ্যা নাই ছাগল ভেড়ার,
মাঝে মাঝে নলকুপ আছে পিঁপাসী লোক পানি খায়।
কেহ ছিটে আতর গোলাপ বাবাজানের হুজুরায়,
বাবাজানের পশ্চিম পার্শ্বে রওজা শাজাদার,
কেহ রান্ধে কেহ খাওয়ায় খেদমতে আছে মশগুল,
নানা রকম বাদ্য বাজে হক ভাণ্ডারী শব্দমূল,
হিন্দু, মুসলিম, খৃষ্টান, বৌদ্ধ মিলন কেন্দ্র প্রেম দরবার।’’[13]
ওলিগণ কি মানুষের কল্যাণ করতে পারেন?
বস্তুত আমাদের দেশের অধিকাংশ মুসলিমদের কবরে যাওয়ার কারণ ও উদ্দেশ্য নিয়ে গবেষণা করে আমার কাছে যা প্রতীয়মান হয়েছে তা হলো-আউলিয়া, পীর ও দরবেশদের অধিকাংশ ভক্তরা এ বিশ্বাসের ক্ষেত্রে একমত যে, আউলিয়া ও দরবেশগণের জীবন আর মৃত্যু সবই সমান। কেননা, প্রকৃতপক্ষে তাঁরা মরেন না। বাহ্যিক দৃষ্টিতে মৃত্যুর মাধ্যমে তাঁরা ইহজগত থেকে ইন্তেকাল করেন বা স্থানান্তরিত হয়ে আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যান। এ সময়ে তাঁদের রূহানী শক্তি পূর্বের তুলনায় বৃদ্ধি হয়, যার ফলে পৃথিবীর যে কোনো স্থান থেকে তাঁদেরকে আহ্বান করলে তাঁরা তা শুনতে পারেন এবং মানুষের যে কোনো কল্যাণার্জন বা অকল্যাণ দূরীকরণ করতে পারেন। এ ধারণার পরিপ্রেক্ষিতেই তারা তাদের কাছে তাদের পার্থিব ও পরকালীন যাবতীয় প্রয়োজনাদি নিয়ে আগমন করেন। রোগীরা যায় রোগ মুক্তির জন্য, সন্তানহীনরা যায় সন্তান লাভের জন্য, বিপন্নরা যায় বিপদ মুক্তির জন্য, চাকুরীহীনরা যায় চাকরী লাভের জন্য, অপরাধীরা যায় ক্ষমা প্রাপ্তির জন্য; নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীরা নির্বাচনে জয়ী হওয়ার জন্য। তাদের কবরে যাওয়ার পার্থিব উদ্দেশ্য বিভিন্ন রকমের হলেও সকলের পরকালীন উদ্দেশ্য তাঁদের শাফা‘আতের মাধ্যমে পরকালীন মুক্তি।
অনেকে মনে করে খাজা মঈনুদ্দিন চিশতির কবর থেকে ফয়েজ ও বরকত উপচে পড়ছে। সেখানে যে যে উদ্দেশ্যেই তাঁকে আহ্বান করে, তাদের সকলের জন্যেই তাঁর দু’হাত প্রশস্ত হয়ে রয়েছে। এভাবে ‘‘কেউ ফিরে না খালি হাতে খাজা তোমার দরবার হতে’’ এ বাক্যটি তাঁর ভক্তদের নিকট একটি শ্লোগানে পরিণত হয়েছে। তারা ওরস উপলক্ষে তাদের দাওয়াতী চিঠি-পত্রে এ জাতীয় শ্লোগান লিখে থাকেন। যেমন জনৈক কাজী মাহবুবুল আলম তার এক দাওয়াতী পত্রে লিখেছেন : ‘‘তাহার এতই দয়া কেহ তাহার দরবার হইতে খালি হাতে ফেরে না। ওলি আল্লাহর নেক দৃষ্টি বিদ্যুতের ন্যায় মুহূর্তেই আপনার ভাগ্য পরিবর্তন করিতে পারে এবং আপনাকে শত বৎসর এবাদতের উর্ধ্বে তুলে দিতে পারে। আপনি খাজা সাহেবের নেক দৃষ্টি লাভ করুন।’’[14]
খাজা মঈনুদ্দিন চিশতির ব্যাপারে তাঁর ভক্তদের ধারণা হচ্ছে-এক সময় আল্লাহ তাঁর নবীকে সব কিছু পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন। এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর এ দায়িত্ব অর্পণ করেছেন খাজা মঈনুদ্দিন চিশতিকে। তাদের এ জাতীয় ধারণা প্রকাশিত হয়েছে তাঁর প্রশংসায় নির্মিত বাজারজাতকৃত গানের কেসেটে। যেমন তারা বলে থাকে :
খোদার ধন নবীকে দিয়া খোদা গেলেন খালি হইয়া
নবীর ধন খাজাকে দিয়া নবী গেলেন খালি হইয়া
খাজারে তোর দরবার হতে কেউ ফিরে না খালি হাতে।
অলিগণের ব্যাপারে তাদের আরো ধারণা হচ্ছে-তাঁরা সকল অসাধ্যকে সাধন করতে পারেন। সে-জন্যে তাদেরকে আল্লাহর রহমতের উপর ভরসা করার পরিবর্তে ওলিদের করুণার উপর ভরসা করতে দেখা যায়। যেমন এক ব্যক্তি তার মনের এ-জাতীয় অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে গিয়ে বলেছে : ‘‘খোদারই পেয়ারা ওলি যে জন সংসারে, অসাধ্য সাধন করিতে সে পারে, তোমার দয়া না হলে বাবা আমার হবে কী উপায়।’’
অপর এক ব্যক্তি খাজা মঈনুদ্দিন চিশতির বার্ষিক ওরসে শরীক হওয়ার জন্য সাধারণ জনগণকে আহ্বান করতে গিয়ে বলেছে : ‘‘গরীব নেওয়াজ যাহার দরবারে সর্বদা ফয়েজের সমুদ্র উছলিয়া পড়ে, সেই দয়ালু খাজা বাবার দরবারে আপনিও আসুন আল্লাহর রহমত পাইতে ও রোগ শোক দুঃখ দারিদ্রতা হইতে মুক্তি পাইতে। দীন ও দুনিয়ার পরম শান্তি লাভ করিতে ওরস মোবারকে শরীক হইয়া আপনিও ফয়েজ হাসিল করুন।’’[15]
ওরস উপলক্ষে আজমীর হতে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত এক দাওয়াতী পত্রে ওরসের মাহাত্ম্য বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে: ‘‘উরশ মোবারক এক সৌন্দর্য্য ও রহমতের দৃশ্য জানিবেন। এই রহমতের সময় আউলিয়া একরাম হইতে ফয়েজ বরকত হাসিল করার সময় ঐ পবিত্র সময় খাজা বাবার রূহানী ফয়েজ অগণিত ভাবে বিতরণ হইয়া থাকে, সকল আশেকীনরা ঐ নেক সময়ে সকল মনো কামনা পূরা করিয়া থাকেন এবং নেক সময়ে বাবার দরবার হইতে কেহ খালী হাতে ফেরেন না।’’[16]
নোয়াখালী জেলার মহীউদ্দিন এখলাসপুরীর ভক্তরা তার ব্যাপারে যে ধারণা পোষণ করে, তা যেন অতীতের সকল ওলিগণ কে অতিক্রম করে গেছে। তারা তার ব্যাপারে যে সব ধারণা পোষণ করে তা তাদের ওরস উপলক্ষে প্রকাশিত এক দাওয়াতী পোস্টারে এ ভাবে লিখিত রয়েছে: ‘‘...তিনি (মহীউদ্দিন) তাঁর জীবদ্দশায় জনগণের কল্যাণ সাধন করে গেছেন, এখনও (মৃত্যুর পরও) তিনি মানুষের কল্যাণ করে যাচ্ছেন। তিনি মানুষের দুঃখ দূরীকারী (গউছ) ছিলেন। তার হাতে দেশের বিচার ও শাসন ক্ষমতা ছিল। চট্রগ্রাম, নোয়াখালী, বরিশাল ও খুলনা জেলার উপকূলীয় এলাকায় সমুদ্রকে তার তাণ্ডবলীলা থেকে তিনি বারণ করেছিলেন। যার ফলে সে সব জেলার উপকূলীয় এলাকা ধীরে ধীরে বর্ধিত হয়েছে। তার নিকট ৮৬ হাজার গউছ, কুতুব, আবদাল, নজীব ও আখইয়ার ইত্যাদির নেতৃত্বদানের রূহানী ও বাতেনী যোগ্যতা ছিল। কমপক্ষে আট হাজার ধনী, ব্যবসায়ী, সমাজের নেতৃত্বদানকারী ও শিল্পপতিরা তার মাধ্যমে তাদের জীবনে শান্তি লাভ করেছেন।’’
কবর যিয়ারতের উদ্দেশ্য পরিবর্তন : পীর, অলি, দরবেশ ও সাধারণ মানুষ নির্বিশেষে বিনা সফরে যাদের কবর যিয়ারত করা যায়, তাদের কবর যিয়ারতের অনুমতি প্রদানের পিছনে শরী‘আতের উদ্দেশ্য হচ্ছে কবরস্থ ব্যক্তির জন্য মাগফেরাত কামনা করে দো‘আ করা এবং নিজের শেষ পরিণতি ও আখেরাতকে স্মরণ করা। মানুষেরা কবর যিয়ারতে গিয়ে শরী‘আত বিরোধী কর্ম করে বিধায়, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক সময় কবর যিয়ারত নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন। কবর যিয়ারতের পিছনে শরী‘আতের যে উদ্দেশ্য রয়েছে সে সম্পর্কে জনগণের অবগতির পর পরবর্তী এক সময়ে তিনি পুনরায় তা যিয়ারতের অনুমতি প্রদান করেন। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন:
«كُنْتُ نَهَيْتُكُمْ عَنْ زِيَارَةِ الْقُبُورِ فَزُورُوهَا فَإِنَّهَا تُذَكِّرُكُمِ الْآخِرَةَ»
‘‘আমি তোমাদেরকে কবর যিয়ারত করতে (এক সময়) নিষেধ করেছিলাম, এখন তোমরা তা যিয়ারত করো; কেননা, তা তোমাদেরকে আখেরাত স্মরণ করিয়ে দেয়।’’[17]
কিন্তু পীর ও ওলীদের ভক্তদের অবস্থা বিচার করলে দেখা যায়, তারা কবর যিয়ারতের মূল উদ্দেশ্যকে সম্পূর্ণভাবে ভিন্ন উদ্দেশ্যে প্রবাহিত করে দিয়েছে। তারা কবরবাসী ওলির প্রয়োজন পূরণের বদলে তাঁদের কবরকে নিজেদের প্রয়োজন পূরণের স্থানে পরিণত করেছে। তারা মনে করছে- ওলীদের জন্য মাগফিরাত কামনা ও তাঁদের জন্য দো‘আ করার কোনো প্রয়োজন নেই; কেননা, তারাতো আল্লাহর নৈকট্য লাভে ধন্য হয়ে গেছেন! অথচ কুরআন ও হাদীস দ্বারা এ কথা প্রমাণিত রয়েছে যে, মানুষ সে যে-ই হোক না কেন, মৃত্যুর পর তার সকল কর্ম বন্ধ হয়ে যায়, সে জীবিতদের দো‘আর প্রতি আশান্বিত হয়ে থাকে। আমাদের পক্ষ থেকে তারা কোনো উপকার পেলে তারা আমাদের কল্যাণের জন্য দো‘আ করলেও তাদের এ দো‘আর কোনো কার্যকারিতা নেই বলে তা আমাদের কোনো কল্যাণে আসে না; কারণ, তারা মৃত, আর মৃত মানুষের এমন কোনো কর্ম নেই, যার দ্বারা তিনি নিজে বা অপর কেউ উপকৃত হতে পারে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেখানে বলেছেন :
«إِذَا مَاتَ الْإِنْسَانُ انْقَطَعَ عَنْهُ عَمَلُهُ...»
‘‘মানুষ যখন মরে যায় তখন তার যাবতীয় আমল বন্ধ হয়ে যায়...।’’[18] এরপরও সাধারণ মানুষেরা যেমন ওলিদের ব্যাপারে এ হাদীসের বিপরীত চিন্তা করে, তেমনি আমাদের দেশের কোনো কোন নামধারী ওলি বা পীরদেরকেও অনুরূপ চিন্তা করতে দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ সাতক্ষীরা জেলার বশিরহাটের পীর জনাব মুহাম্মদ রুহুল আমিন সাহেবের কথা বলা যায়। তিনি তার জীবনের শেষ প্রহরে তার ভক্তদের উদ্দেশ্যে এ উপদেশ দিয়ে গেছেন যে, ‘‘আমার কবরে সাওয়াব পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে তোমরা যেখানেই ইসালে ছওয়াবের মাহফিল করো না কেন, তা আল্লাহ গ্রহণ করবেন, আমার ইসালে ছওয়াবের জন্য যারাই হাদিয়া পেশ করবে আমি আমার কবরে শুয়ে তার জন্য দো‘আ করতে থাকবো।’’[19]
[2]. আবু বকর জাবির আল-জাযাইরী, ওয়া জা-উ ইয়ারকুদুনা!!! মাহলান ইয়া দু‘আতাদ দলালাহ; পৃ. ৬০।
[3]. শেখ সুলাইমান ইবন আব্দুল্লাহ ইবন মুনী‘, প্রাগুক্ত; পৃ. ২৩১।
[4]. মুহাম্মদ ফজলুল করীম, তৌহীদ-রেসালত ও নূরে মুহাম্মদী (সা.)-এর সৃষ্টি রহস্য; (কুমিল্লা : জমইয়াতু উলামাই আহলিস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত, ১ম সংস্করণ, ১৯৯১ খ্রি.), পৃ. ৪৮-৫০।
[5]. মাওলানা ফজলুল হক নামে ‘ফাজিলে দেওবন্দ’ ডিগ্রী অর্জনকারী মাদ্রাসা-ই- আলীয়া, ঢাকা’র একজন বিশিষ্ট শিক্ষক ছিলেন। দেওবন্দে অধ্যয়নকালে তিনি এ সম্পর্কিত কিছু ঘটনা শ্রবণ করেছিলেন। তন্মধ্যকার একটি ঘটনা নিম্নরূপ: একদা এক ব্যক্তি খুনের দায়ে অভিযুক্ত হলে তার বিরুদ্ধে মকদ্দমা হয়। লোকটিকে নির্দোষ সাব্যস্ত করে খালাস করে আনার জন্য তার আত্মীয়-স্বজনরা মকদ্দমা চলাকালীন সময়ে একজন বিশিষ্ট আলেমের মাধ্যমে সে সময়ে যিনি দিল্লীর গাউছ ছিলেন, তাঁর শরণাপন্ন হয়। গাউছ বিষয়টি তাঁদের দেওয়ানে আলোচনা করেন এবং লোকটিকে নির্দোষভাবে খালাসের সিদ্ধান্ত পাশ করেন। পরবর্তীতে আদালতের বিচারকও সে অনুযায়ী তাকে নির্দোষ বলে রায় প্রদান করেন। [গাঁজাখুরী গল্প (সম্পাদক)]
[6]. কেউ কেউ মুগীরাহ ইবনে শু‘বাহ রাদিয়াল্লাহু আনহুর দাস হেলাল এর ব্যাপারে এ সম্পর্কিত হাদীস বর্ণনা করেছেন, সে হাদীসে রয়েছে : তিনি কুতুবদের মধ্যকার একজন ছিলেন। এ হাদীসটি হাদীস বিশেষজ্ঞদের ঐকমত্যের ভিত্তিতে বাতিল বলে গৃহীত হয়েছে। আবু নাঈম তাঁর ‘হিলয়াতুল আউলিয়া’ গ্রন্থে এবং শেখ আব্দুর রহমান আস-সুলামী তাঁর কোনো কোনো গ্রন্থে এ সম্পর্কিত কিছু হাদীস বর্ণনা করেছেন, তা দেখে কারো ধোঁকায় পড়ার কোন অবকাশ নেই; কারণ, তাদের কিতাবাদিতে সহীহ, হাসান, যয়ীফ ও মাওদু‘ তথা মিথ্যা হাদীসের সমাহার রয়েছে যেগুলো মিথ্যা হওয়ার ব্যাপারে হাদীস বিশারদদের মধ্যে কোনো মতবিরোধ নেই। এ ছাড়া আবুস শেখ নামক মুহাদ্দিস এর বর্ণিত হাদীসসমূহের মধ্যে এমন সব বর্ণনাকারীদের হাদীস রয়েছে, যারা হাদীসের মধ্যে বিশুদ্ধ আর বাতিল বলে কোনো পার্থক্য না করে যা-ই শ্রবণ করেছেন তা-ই বর্ণনা করার নীতি অবলম্বনকারী ছিলেন, যদিও প্রকৃত হাদীস বেত্তাগণ এ ধরনের হাদীস বর্ণনা করতেন না, এ কারণে যে, রাসূল-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-থেকে বিশুদ্ধ সনদে প্রমাণিত হয়েছে তিনি বলেছেন :
«مَنْ حَدَّثَ بِحَدِيْثٍ وَهُوَ يَرَى أَنَّهُ كَذِبٌ فَهُوَ أَحَدُ الكَاذِبِيْن»
‘‘একটি হাদীস মিথ্যা জানা সত্ত্বেও যে আমার পক্ষ থেকে তা বর্ণনা করলো, সে মিথ্যুকদের মধ্যকারই একজন।’’ দেখুন: ইবনে তাইমিয়্যাহ, যিয়ারাতুল কুবূরি ওয়াল ইস্তেনজাদি বিল মাকবূর; (রিয়াদ : আর রিয়াসাতুল আ-ম্মাহ..., দারুল ইফতা, ১ম সংস্করণ, ১৪১০হি:), পৃ.৬৫।
[7]. ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (রহ.)-কে গাউছ ও কুতুব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন : কোনো কোনো দলের লোকেরা এ সব কথা বলে থাকে, এবং ইসলাম ধর্মের মধ্যে বাতিল বিষয়ে এ সবের ব্যাখ্যা করে, যেমন কেউ কেউ বলে : গাউছ হলেন তিনি যার মাধ্যমে সমগ্র সৃষ্টির সাহায্য ও জীবিকা এসে থাকে, এমনকি তারা আরো বলে যে, ফেরেশতা ও সমুদ্রের মাছের সাহায্য ও গাউছের মাধ্যমে হয়ে থাকে। এ জাতীয় ধারণা ঈসা আলাইহিস সালাম-এর ব্যাপারে খ্রিষ্টানরা এবং ‘আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর ব্যাপারে বাড়াবাড়িকারীরা তাঁর ব্যাপারে যা বলে, সে সব কথারই অনুরূপ। এ জাতীয় ধারণা ও কথা প্রকাশ্য কুফরী। যারা এ সব বলবে তাদেরকে তাওবা করাতে হবে। তাওবা না করলে এদেরকে (মুরতাদ হওয়ার কারণে) হত্যা করা হবে; কেননা, সৃষ্টির মাঝে এমন কোনো ফেরেশতা বা মানুষ নেই যার মাধ্যমে সকল সৃষ্ট জীবের সাহায্য এসে থাকে ...। ‘গাউছ’ শব্দের দ্বারা আমি এটাই উদ্দেশ্য করেছি যা এদের কেউ কেউ বলে যে, পৃথিবীতে ৩১৩ জনেরও অধিক ব্যক্তি রয়েছেন যাদেরকে ‘নুজাবা’ বলা হয়, তাঁদের মধ্য থেকে পুনরায় ৭০ জনকে বাছাই করা হয়, যাদেরকে বলা হয় ‘নুক্বাবা’। এদের মধ্য থেকে ৪০ জনকে বাছাই করা হয়, তাঁদেরকে বলা হয় ‘আবদাল’’। এদের মধ্য থেকে আবার সাত জনকে বাছাই করা হয়, তাঁদেরকে বলা হয় ‘আকতাব’। এদের মধ্য থেকে আবার চার জনকে বাছাই করা হয়, তাঁদেরকে বলা হয় ‘আওতাদ’। এদের মধ্য থেকে আবার একজনকে বাছাই করা হয়, যাকে বলা হয় ‘গাউছ’।... এরপর তিনি বলেন: এ সম্পর্কে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত যা বলা হলো, এর সবই বাতিল। প্রাগুক্ত; পৃ. ৬৩-৬৪।
[8]. তিনি ১৭০৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর সময়ে তিনি মক্কা শরীফে হানাফী মাযহাবের একজন প্রখ্যাত ‘আলিম ছিলেন। একজন বিশিষ্ট ওয়াইয, ফক্বীহ ও মুহাদ্দিস ছিলেন। দেখুন: ‘উমার রেজা কাহহা-লাহ, মু‘যামুল মুআল্লিফীন; (বৈরুত : মুআসসাসাতুর রিছালাহ, ১ম সংস্করণ, ১৯৯৩ খ্রি.), ১/৮৪৩।
[9]. এ জাতীয় বিশ্বাস প্রত্যাখ্যান উপলক্ষে তিনি বলেন : ‘‘মুসলিমদের মাঝে এমন কিছু দলের আবির্ভাব ঘটেছে যারা এ দাবী করে যে, ওলিগণ জীবিত হোন আর মৃত হোন সর্বাবস্থায় জগত পরিচালনার ক্ষেত্রে তাঁদের দায়িত্ব রয়েছে, বিপদাপদে তাঁদের নিকট সাহায্য কামনা করা যায়,... তাঁদের মাঝে রয়েছেন আব্দাল, নুকাবা, আওতাদ ও নুজাবা..., কুতুবই হলেন সমগ্র মানুষের বিপদে সাহায্যকারী...। তিনি বলেন : এ জাতীয় কথার মধ্যে বাড়াবাড়ি রয়েছে, বরং এর মধ্যেই চিরস্থায়ী ধ্বংস ও শাস্তি অনিবার্য হয়ে রয়েছে। কেননা; এতে নিশ্চিতভাবে শির্ক রয়েছে। কুরআনের সাথে রয়েছে এর বিরোধ, সকল ইমাম ও মুসলিম উম্মাহের ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত আক্বীদার সাথেও এর বিরোধ ও বৈপরিত্য রয়েছে...। মুত্যুর পরেও ওলিগণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারেন, এ জাতীয় বিশ্বাস সবচেয়ে জঘন্যতম বিশ্বাস...। আব্দাল ও গাউছ সম্পর্কে লোকেরা যা বলে তা তাদের মিথ্যা বানানো গল্প বৈ আর কিছুই নয়। দেখুন : শেখ সুলই্মান ইবন আব্দুল্লাহ ইবন মুনী‘, প্রাগুক্ত; পৃ. ২৩২-২৩৪।
[10]. স্বর্গীয় রমেশ চন্দ্র সরকার, মুক্তির দরবার; (চট্রগ্রাম: শ্রী পুলিন বিহারী শীল, সংস্করণ বিহীন, ১৯৯২ খ্রি.), পৃ. ৮।
[11]. তবেদ; পৃ. ২।
[12]. তদেব; পৃ. ১১।
[13]. তদের; পৃ. ৮।
[14]. কাজী মাহবুবুল আলম এর ঠিকানা : লিংক ইন্টারন্যাশনাল, আল-চেম্বার নং ১২২/১২৪, মতিঝিল , ঢাকা।
[15]. এ দাওয়াত দাতার নাম : সৈয়দ আলমগীর চিশতী, এম. রহমান এন্ড কোং, ৩৭/ কে. বি.আব্দুস সাত্তার রোড, রহমতগঞ্জ, চট্রগ্রাম, বাংলাদেশ।
[16]. ১৯৭৮ সালে পীরজাদা মৌলভী সৈয়দ ফজলুর রহমান বোরাকী হতে সে বছরের ওরস উপলক্ষে প্রচারিত দাওয়াতী পত্র থেকে গৃহীত।
[17]. মুসলিম, প্রাগুক্ত; কিতাবুল জানাইয, বাব নং ৩৬, হাদীস নং ৯৭৭;২/৬৭২; নাসাঈ, প্রাগুক্ত; ৮/৩১০; তিরমিযী, প্রাগুক্ত; কিতাবুল জানাইয, বাব নং ৬০, হাদীস নং ১০৫৪;৩/৩৭০।
[18]. মুসলিম, প্রাগুক্ত; কিতাবুল ওয়াসিয়্যাহ, বাব নং ৩, হাদীস নং ১৬৩১, ৩/১২৫৫; তিরমিযী, প্রাগুক্ত; কিতাবুল আহকাম ..., বাব নং ৩৬, হাদীস নং ১৩৭৬;৩/৬৬০; আবু দাউদ, প্রাগুক্ত; ৩/১১৭; আদ-দা-রিমী, আব্দুল্লাহ ইবন আব্দুর রহমান, আবু মুহাম্মদ, সুনানিদ দারিমী; সম্পাদনা : ফওয়ায আহমদ ও গং, (বৈরুত : দারুল কিতাবিল আরবী, ১ম সংস্করণ, ১৪০৭হি:), ১/১৪৮; সহীহ ইবনে হিববান; ৭/২৬৬।
[19]. এ উপদেশের কথাটি সাতক্ষিরা জেলার কুলিয়া মাদ্রাসার সেক্রেটারী ক্বারী মুহাম্মদ আশরাফুল আলম পীর রুহুল আমিন সাহেবের ইসালে ছওয়ার উপলক্ষে অনুষ্ঠিত একটি ইসলামী সভায় জনগণকে শরীক হওয়ার জন্য দাওয়াতী পত্রে উল্লেখ করেছেন।
যারা ওলীদেরকে সাধারণ মানুষের ইহ-পরকালীন কল্যাণের ক্ষেত্রে অনেক কিছু করতে পারেন বলে মনে করে, তাঁদেরকে নিকট ও দূর থেকে আহ্বান করে এবং মনে করে যে, তাঁরা তাদের এ সব আহ্বান শ্রবণ করতে পারেন। কিন্তু মহান আল্লাহ তাদের এ ভ্রান্ত ধারণা খণ্ডন পূর্বক বলেন :
﴿ وَٱلَّذِينَ يَدۡعُونَ مِن دُونِ ٱللَّهِ لَا يَخۡلُقُونَ شَيۡٔٗا وَهُمۡ يُخۡلَقُونَ ٢٠ أَمۡوَٰتٌ غَيۡرُ أَحۡيَآءٖۖ وَمَا يَشۡعُرُونَ أَيَّانَ يُبۡعَثُونَ ٢١ ﴾ [النحل: ٢٠، ٢١]
‘‘আল্লাহকে ব্যতীত তারা যাদেরকে আহ্বান করে তারা কিছুই সৃষ্টি করে না অথচ তাদের সৃষ্টি করা হয়। তারা মৃত, জীবিত নয়, আর তারা কবে পুনরুজ্জীবিত হবে তা অনুধাবন করতে পারে না।’’[1]আরবের মুশরিকরা উপর্যুক্ত ধারণার ভিত্তিতে ওয়াদ, সুয়া‘, ইয়াগুস, উয়া‘উক, নসর ও অন্যান্য যে সব ওলিদেরকে সাহায্যের জন্য আহ্বান জানাতো, সে সব অলিগণের বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে এ আয়াতে আলোকপাত করা হয়েছে এবং তাদেরকে এ কথা বলা হচ্ছে যে, তোমরা যাদেরকে উক্ত ধারণার ভিত্তিতে আহ্বান করছো, তারাতো তোমাদের সাহায্য করতে পারে না; কেননা, তারাতো মৃত। আর মৃতরা কিছুই শ্রবণ করতে পারে না। পৃথিবীতে কে কী করছে, এখানে কখন কী ঘটছে, কখন মহাপ্রলয় ঘটার পর তাঁরা পুনরুজ্জীবিত হবে, এ সব ব্যাপারে তাঁদের কোনই অনুভূতি নেই।
এই যদি হয় মুশরিকদের আহ্বানকৃত অলিগণের অবস্থা, তা হলে সাধারণ মুসলিমরা যে সব ওলিগণ কে উক্ত ধারণার ভিত্তিতে আহ্বান করে থাকে, তাঁদের অবস্থা যে এর ব্যতিক্রম হবে না, তা বলা-ই বাহুল্য। বস্তুত মরে যাবার পর তাঁদের রূহের দ্বারা তাঁরা নিজেরা এবং অপর কেউ উপকৃত হতে পারবে না কেননা, রূহের দ্বারা রূহ নিজের বা অপর কারো উপকার করার জন্য রূহের সাথে জীবন্ত দেহের সহঅবস্থান একান্ত প্রয়োজন। দেহ যখন মরে যায় তখন রূহের জীবিত থাকা আর না থাকা উভয়ই সমান হয়ে যায়। দেহ মরে যাওয়ার ফলে রূহকে হাজারো আহ্বান করলেও তা স্বাভাবিক নিয়মানুযায়ী কিছুই শ্রবণ করতে পারে না। তখন তা কারো কোনো উপকারও করতে পারে না।
والله أعلم
আমাদেরকে মুসলিম হিসেবে মনে রাখতে হবে যে, প্রত্যেক কর্ম সম্পাদিত হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় বৈধ কাজকর্ম করা হচ্ছে শরী‘আতের নির্দেশ। যে ব্যক্তি তা গ্রহণ করে আল্লাহর উপর ভরসা করলো এবং এর সাথে সাথে আল্লাহর রহমত ও দয়া কামনা করলো, আল্লাহ সে ব্যক্তির কামনা কখনও দ্রুত পূর্ণ করেন, কখনও সে ব্যক্তির ঈমান ও ধৈর্যের পরীক্ষা গ্রহণের জন্য তা পূর্ণ করতে বিলম্ব করেন। যাকে ইচ্ছা দ্রুত রোগ থেকে আরোগ্য দান করেন, যাকে ইচ্ছা দ্রুত সন্তান দেন, যাকে ইচ্ছা তা দিতে বিলম্ব করেন।
এ ক্ষেত্রে নবী, রাসূল আর সৎ ও অসৎ বলে কোনো পার্থক্য নেই। এইতো নবীবর আইউব এর বিষয়ই লক্ষ্য করা যায়। তিনি দীর্ঘ দিন যাবৎ মহামারীতে আক্রান্ত ছিলেন। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর ঈমান ও ধৈর্যের পরীক্ষা গ্রহণের জন্য তাঁর রোগ মুক্তিতে বিলম্ব করেন। অবশেষে তাঁকে যে অনিষ্টতা পেয়ে বসেছে সে অনিষ্টের কথা আল্লাহকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে এর ওসীলায় তাঁর রহমতের প্রত্যাশী হয়ে সে রোগ থেকে আরোগ্য লাভের জন্য এ মর্মে দো‘আ করেন :
﴿ أَنِّي مَسَّنِيَ ٱلضُّرُّ وَأَنتَ أَرۡحَمُ ٱلرَّٰحِمِينَ ٨٣ ﴾ [الانبياء: ٨٣]
‘‘আমাকে অনিষ্টতা পেয়ে বসেছে, অথচ তুমি দয়ার সাগর’’।[1]
এই দো‘আ করার পর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর মনস্কামনা পূর্ণ করেন। ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম-এর অবস্থা দেখুন, জীবনের শেষ প্রহরে পৌঁছার পরও তাঁর কোনো সন্তান হচ্ছিল না। দেখতে দেখতে তাঁর স্ত্রীও বৃদ্ধা এবং বন্ধা হয়ে গেছেন। দীর্ঘ পরীক্ষা গ্রহণের পর যখন আল্লাহ তাঁদেরকে সন্তান প্রদানের সংবাদ দিলেন, তখন তাঁর স্ত্রী হতবাক হয়ে বলেন :
﴿ءَأَلِدُ وَأَنَا۠ عَجُوزٞ وَهَٰذَا بَعۡلِي شَيۡخًاۖ إِنَّ هَٰذَا لَشَيۡءٌ عَجِيبٞ ٧٢ ﴾ [هود: ٧٢]
‘‘আমি সন্তান প্রসব করবো অথচ আমি একজন বৃদ্ধা ও বন্ধা এবং আমার স্বামী একজন বৃদ্ধ মানুষ ! নিশ্চয় এ ঘটনাটি একটি অদ্ভূত ব্যাপার।’’[2]
অনুরূপভাবে নবীবর যাকারিয়া আলাইহিস সালাম-এর বিষয়টিও লক্ষ্য করা যায়। তিনিও সন্তান প্রাপ্তির আশায় থাকতে থাকতে বৃদ্ধ হয়ে গেছেন। পরিশেষে আল্লাহর কাছে এই বলে দো‘আ করেন :
﴿رَبِّ إِنِّي وَهَنَ ٱلۡعَظۡمُ مِنِّي وَٱشۡتَعَلَ ٱلرَّأۡسُ شَيۡبٗا وَلَمۡ أَكُنۢ بِدُعَآئِكَ رَبِّ شَقِيّٗا ٤ وَإِنِّي خِفۡتُ ٱلۡمَوَٰلِيَ مِن وَرَآءِي وَكَانَتِ ٱمۡرَأَتِي عَاقِرٗا فَهَبۡ لِي مِن لَّدُنكَ وَلِيّٗا ٥ يَرِثُنِي وَيَرِثُ مِنۡ ءَالِ يَعۡقُوبَۖ ﴾ [مريم: ٤، ٦]
‘‘হে আমার পালনকর্তা! আমার অস্থি বয়স-ভারাবনত হয়েছে, বার্ধ্যক্যের ফলে মাথার চুল শুভ্র হয়ে গেছে, প্রভু হে! তোমাকে আহ্বান করে আমি তো কখনও হতভাগা হইনি। আমার পর আমার স্বগোত্রের লোকদের (অবস্থা) নিয়ে আমি আতঙ্কিত আছি, আমার স্ত্রী বন্ধা হয়ে গেছে, কাজেই আপনি আপনার পক্ষ থেকে আমাকে এমন একজন কর্তব্য পালনকারী দান করুন, যে আমার ও ইয়া‘কুবের উত্তরাধিকারী হবে।’’[3]
এবার লক্ষ্য করে দেখুন : রোগ মুক্তি আর সন্তান দান যদি ওলি ও দরবেশগণের আয়ত্বে বা সামর্থ্যের মধ্যে থাকতো, তা হলে নবীগণ আল্লাহর বড় ওলি হওয়ার সুবাদে অন্যান্যদের চেয়ে অধিক সুবিধাভোগ করতেন। তাঁদের কোনো রোগই হতো না, বা হলেও তা দ্রুত আরোগ্য করে নিতেন। সন্তানাদি যথা সময়ে পেয়ে যেতেন; কিন্তু বাস্তবতা এর সম্পূর্ণ বিপরীত বলেই আমরা দেখতে পাই। তাঁদেরকে রোগ মুক্তি ও সন্তান লাভের জন্য হতাশ না হয়ে অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে অপেক্ষা করতে দেখা যায় এবং অপর কোনো বিকল্প ব্যবস্থার চিন্তা না করে শুধুমাত্র আল্লাহ তা‘আলার কাছেই বিনয়ের সাথে তা কামনা করতে দেখা যায়।
এ ক্ষেত্রে আমাদের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবনেও আমাদের জন্য শিক্ষার বিষয় রয়েছে। তিনি আল্লাহর এতো প্রিয়ভাজন হয়েও একজন ইয়াহূদীর জাদু মন্ত্রের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলেন, অথচ তিনি বুঝতেও পারেন নি যে তাঁর কী হয়েছে, কী ভাবেই বা তিনি এত্থেকে পরিত্রাণ পাবেন? অবশেষে আল্লাহই তাঁকে এ ব্যাপারে সংবাদ দিলেন এবং সূরায়ে নাস ও ফালাক্ব অবতীর্ণ করে এর দ্বারা ঝাড়ফুঁকের মাধ্যমে তা নষ্ট করার ব্যবস্থা করেন। যদি বিপদ দূর করার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিজস্ব কোনো উপায় থাকতো, তা হলে তিনি জাদুতে আক্রান্তই হতেন না, বা হলেও মুহূর্তের মধ্যেই তাত্থেকে আরোগ্য লাভ করতে সক্ষম হতেন; কিন্তু তাঁর পক্ষে তা করা সম্ভব হয় নি।
এতে প্রমাণিত হয় যে, আমাদের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যদি তাঁর উপরে পতিত বিপদ নিজ থেকে দূর করতে না পারেন, তবে এ জগতে এমন কোনো ওলি ও দরবেশ থাকতে পারেন না, যিনি নিজের বা অপর কোনো মানুষের বিপদ দূর করতে পারেন। বা যার কোনো সন্তান হবার নয় তাকে সন্তান দেবার ব্যবস্থা করতে পারেন। সে জন্য মাওলানা ক্বাযী সানাউল্লাহ পানিপথী বলেন:
‘‘যে বস্তুর কোনো অস্তিত্ব নেই সে বস্তুর অস্তিত্ব দান করা বা যে বস্তুর অস্তিত্ব রয়েছে সেটাকে অস্তিত্বহীন করার মত সামর্থ্য ওলীদের নেই। অতএব কারো প্রতি এ ধারণা পোষণ করা যে, তিনি কোনো বস্তুকে অস্তিত্ব দিতে পারেন, বা সেটাকে অস্তিত্বহীন করতে পারেন, কাউকে জীবিকা দিতে পারেন, রোগ থেকে মুক্তি দিতে পারেন, কিংবা বিপদাপদ ও অকল্যাণ দূর করতে পারেন, তবে তা কুফরী বিশ্বাসে পরিণত হবে।’’[4]কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, আমাদের দেশের সাধারণ মুসলিমগণ ওলীদের কবরে শয়তানের পাতানো কিছু অদ্ভূত কর্মকাণ্ড দেখে, বা অদ্ভূত কোনো ঘটনার কথা লোক মুখে শুনে শয়তানের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে গেছেন।
যার ফলে তারা আল্লাহর ক্ষমতাকে ওলীদের হাতে ন্যস্ত করে দিয়েছেন। সে জন্যই তারা তাদের জীবনের যাবতীয় অভাব ও অভিযোগের কথা আল্লাহর পরিবর্তে ওলীদের কাছেই জানিয়ে থাকেন, বিপদে পড়লে তাঁদেরকেই স্মরণ করে থাকেন, তাঁদের কবরের নিকতম গাছ-পালা, কূপ ও পুকুরের পানি এবং জীব-জন্তু থেকেও কল্যাণ ও বরকত গ্রহণ করে থাকেন। এগুলোর সম্মান ও তা‘যীম করে থাকেন। এতে তারা নিজেদের অজান্তেই আরবের মুশরিকদের ন্যায় শির্কে নিমজ্জিত হচ্ছেন; কেননা ওরাও তাদের অলি, দেবতা, গাছ-পালা ও পাথরের ব্যাপারে এ জাতীয় ধারণা করার ফলেই শির্কে নিমজ্জিত হয়েছিল।
>[2]. আল-কুরআন, সূরা হূদ : ৭২।
[3]. আল-কুরআন, সূরা মারয়াম : ৪-৭।
[4]. মাওলানা মুহাম্মদ আরিফ সম্বহলী, প্রাগুক্ত; ৯৩।
মানুষের ইহকালীন জীবনে মৃত অলিগণের হস্তক্ষেপ করার বিশ্বাসের পাশাপাশি কিছু জনমনে এ বিশ্বাসও রয়েছে যে, তারা প্রয়োজনে মানুষের কবরেও হস্তক্ষেপ করতে পারেন। এ প্রসঙ্গে বড়পীর আব্দুল কাদির জীলানীর ব্যাপারে একটি চমকপ্রদ ঘটনা তাঁর ভক্তদের মাঝে আলোচিত হতে দেখা যায়। তা হলো- একদা তাঁর এক ভক্ত মৃত্যুর পর কবরে নাকির-মুনকার ফেরেশতার প্রশ্নের জবাব দিতে অপারগ হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় সে তার পীর আব্দুল কাদির জীলানীকে সাহায্যের জন্য স্মরণ করতে থাকে। তিনি তাঁর ভক্তের দো‘আ শুনে সে লোকের কবরে আগমন করেন এবং ফেরেশতাদের হাত থেকে তাঁর ভক্তের আমলনামা নিজ হাতে নিয়ে তাদেরকে লক্ষ্য করে বলেন- তোমরা কি জান না, এ লোকটি আমার ভক্ত। এতে ফেরেশতাগণ নির্বাক হয়ে ফিরে যান।[1]
১. আব্দুল কাদির জীলানীকে দস্তগীর নামে অভিহিতকরণ :
মহান আল্লাহ হলেন এ জগতের পরিচালক। এ-জগতকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য তাঁকে সর্বদাই জাগ্রত থাকতে হয়। কখনও তাঁকে মানবীয় কোনো প্রকার দুর্বলতা যেমন- তন্দ্রা, নিদ্রা ও পদস্খলন স্পর্শ করতে পারে না। তাঁর একটি গুণগত নাম হচ্ছে (قَيُّوْمْ), এ গুণের কারণে তিনি সমগ্র জগতকে ধারণ করে রয়েছেন। তিনি পায়চারি করেন, হাঁটতে হাঁটতে তাঁর পা মুবারক পিছলে যায়- নাউজু বিল্লাহ! এ জাতীয় কথা আল্লাহর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে না। তিনি যদি পা পিছলে পড়ে যান, তা হলে তিনি কী করে এ মহাজগত ধারণ করে থাকবেন। কিন্তু বড়পীর ‘আব্দুল কাদির জীলানী (রহ.)-এর ভক্তদের মধ্যে আল্লাহর ব্যাপারে এ জাতীয় বিশ্বাস রয়েছে।
‘আব্দুল কাদির জীলানী (রহ.)-এর ব্যাপারে তাঁর ভক্তদের মাঝে যে- সব রূপকথা ও কল্প-কাহিনী রয়েছে, তন্মধ্যে সবচেয়ে অদ্ভূত একটি কাহিনী হচ্ছে- ‘একদা তিনি অদৃশ্য হয়ে আকাশে আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করেন এবং দুই বন্ধুর ন্যায় তিনি সেখানে আল্লাহর হাত ধরে চলতে থাকেন। এক সময় হঠাৎ করে আল্লাহর পা পিছলে যায় (নাউজু বিল্লাহ)। তখন ‘আব্দুল কাদির জীলানী আল্লাহকে তাঁর হাত ধরে সোজা করে দাঁড় করান।’[2] এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই ‘আব্দুল কাদির জীলানী দস্তগীর (আল্লাহর হাত পাকড়াওকারী) নামে অভিহিত হন। যারা এ জাতীয় কল্প-কথায় বিশ্বাস করে তারা যেন প্রকারান্তরে ‘আব্দুল কাদির জীলানীকেই আল্লাহর ধারক হিসেবে গণ্য করে থাকে এবং তাঁকে আল্লাহর পরিচালনাকারীর মর্যাদা দিয়ে থাকে, অথচ এমন ধারণা করা সুস্পষ্ট শির্ক।
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে দেশের জনগণকে সকল ক্ষমতার মালিক বলে মনে করা :
সকল ক্ষমতার মালিক ও উৎস হলেন আল্লাহ। কারো ক্ষমতায় যাওয়া বা ক্ষমতা থেকে অপসারিত হওয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে তাঁরই ইচ্ছা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। সে অনুযায়ী যখন তিনি কোনো দলকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসাবার ইচ্ছা করেন, তখন জনগণের অন্তরকে সে দলের প্রতি তিনি আকৃষ্ট করে দেন। তাই তারা স্বেচ্ছায় অথবা কোনো কিছুর বিনিময়ে হলেও তাদেরকে ভোট দেয় এবং এ প্রক্রিয়ায়ই সে দল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা লাভ করে। আল্লাহর ইচ্ছা না হলে যেহেতু জনগণ কোনো দলকে ক্ষমতায় বসাবার জন্য ভোট দিতে পারে না, সেহেতু ক্ষমতার মূল মালিক হলেন তিনিই, জনগণ নয়।
সে-জন্য কেউ যদি এ কথা এ বিশ্বাসের ভিত্তিতে বলে যে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা লাভের পিছনে আল্লাহর কোনো হাত নেই এবং জনগণই এর সব কিছুর মালিক, তবে তার এ ধারণা শির্কে আকবার হিসেবে গণ্য হবে। এমন ধারণা না নিয়ে বললে বাহ্যিক দৃষ্টিতে তার কথাটি আপত্তিকর হওয়ায় তা শির্কে আসগার হিসেবে গণ্য হবে। এ ধরনের কথা বলার বিষয়টি শর‘য়ী দৃষ্টিতে গর্হিত হওয়া সত্ত্বেও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৭ম ধারার প্রথম প্যারাতে এ জাতীয় সিদ্ধান্তই গৃহীত রয়েছে। সিদ্ধান্তটি নিম্নরূপ :
‘All powers in the Republic belong to the people and their exercise on behalf of the people shall be effective only under, and by the authority of this Constitution.’[3]
জনগণকে এ ধরনের ক্ষমতার স্বীকৃতি প্রদানের বিষয়টি কুরআনুল কারীমের নিম্নোক্ত আয়াত দু’টির সাথে সাংঘর্ষিক বলে প্রতীয়মান হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
﴿أَنَّ ٱلۡقُوَّةَ لِلَّهِ جَمِيعٗا ﴾ [البقرة: ١٦٥]
‘‘সকল ক্ষমতার মালিক কেবল আল্লাহ।’’[4]
অপর আয়াতে বলেন :
﴿ قُلِ ٱللَّهُمَّ مَٰلِكَ ٱلۡمُلۡكِ تُؤۡتِي ٱلۡمُلۡكَ مَن تَشَآءُ وَتَنزِعُ ٱلۡمُلۡكَ مِمَّن تَشَآءُ وَتُعِزُّ مَن تَشَآءُ وَتُذِلُّ مَن تَشَآءُۖ بِيَدِكَ ٱلۡخَيۡرُۖ إِنَّكَ عَلَىٰ كُلِّ شَيۡءٖ قَدِيرٞ ٢٦ ﴾ [ال عمران: ٢٦]
‘‘বল হে আল্লাহ! হে ক্ষমতার মালিক, তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা দান কর, যাকে ইচ্ছা সম্মান দান কর, আবার যাকে ইচ্ছা অসম্মানিত কর, তোমার হাতেই সকল কল্যাণের চাবিকাঠি, তুমি সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান।’’[5]
>[2]. তদেব; পৃ. ৭৪-৭৫।
[3]. গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান; পৃ. ৬।
[4]. আল-কুরআন, সূরা বাকারাহ : ১৬৫।
[5]. আল-কুরআন, সূরা আলে ইমরান : ২৬।
মহান আল্লাহর ইচ্ছায় এ পৃথিবীর অনেক কিছুই মানুষের অনেক অসুখ-বিসুখের ক্ষেত্রে উপকারী হয়ে থাকে। এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে কোনো ওলির কবর বা কবরের মাটি, এর নিকটস্থ গাছ, পুকুরের মাছ, কচ্ছপ ও কুমির ইত্যাদির প্রতি তা সে ওলির সাথে সংশ্লিষ্ট হওয়ার কারণে উপকারী হওয়ার ধারণা করা শির্কের অন্তর্গত। কিন্তু তা সত্ত্বেও অনেক মুসলিমদের মনে এ সব উপকারী হওয়ার দৃঢ় বিশ্বাস রয়েছে। সে কারণে তাদেরকে অলিগণের কবরের মাটি, কবর বা কবরের উপর পুড়ানো মোম সংগ্রহ করতে দেখা যায়।
কূপ ও পুকুরের পানি ময়লা হলেও তা যমযমের পানির মত আগ্রহের সাথে পান করতে ও তা ক্রয় করতে দেখা যায়। এমনকি শাহ জালাল (রহ.)-এর কূপের সাথে যমযম কূপের গোপন সম্পর্ক রয়েছে বলেও ধারণা করতে দেখা যায়।[1] কবরের কবুতর, পুকুরের মাছ, কচ্ছপ ও কুমিরকে যত্নের সাথে খাবার দিতে দেখা যায়। অনিষ্টের ভয়ে কবুতর ও মাছ খাওয়া থেকে বিরত থাকতে দেখা যায়। বিভিন্ন রোগ মুক্তি ও সন্তান লাভের আশায় কোনো কোনো কবর বা কবরের নিকটস্থ গাছে তারকাঁটা মারতে ও লাল সুতা বেঁধে রাখতে দেখা যায়। এ জাতীয় গাছ শির্ক চর্চার কেন্দ্র হওয়াতে তা স্বমূলে উৎপাটন করা প্রসঙ্গে মালিকী মাযহাবের একজন প্রসিদ্ধ আলেম ইমাম ত্বরত্বুশী বলেন :
"فانظروا رحمكم الله ! أينما وجدتم سدرة أو شجرة يقصدها الناس و يعظمونها و يرجون منه البرء الشفاء من قبلها ويضربون بها المسامير و الخرق فهي ذات أنواط ، فاقطعوها."
‘‘ওহে মুসলিম জনতা লক্ষ্য কর! আল্লাহ আপনাদের উপর রহম করুণ! যেখানেই তোমরা এমন কোনো কুল গাছ বা অন্য কোনো গাছ পাবে, যার নিকটে লোকেরা (দূর-দূরান্ত থেকে) উদ্দেশ্য করে আগমন করে, এর সম্মান করে ও তাত্থেকে রোগ মুক্তি কামনা করে, তাতে তারকাঁটা মারে ও কাপড়ের টুকরা ঝুলিয়ে রাখে, তা হলে তোমরা বুঝে নিবে যে, এটি (কাফিরদের) সেই যাতে আনওয়াত (এরই অনুরূপ গাছ, যাকে কাফিররা দূর-দূরান্ত থেকে উদ্দেশ্য করে আসতো)। সুতরাং তোমরা তা কেটে ফেলো।’’[2]
আল্লামা আহমদ রূমী কবর ও কবরের নিকটতম গাছের কাছে লোকেরা যা করে সে সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন:
‘‘কবরের কাছে যিয়ারতকারীদের নামায পড়া, কবরের হজ্জ করার সময় বিভিন্ন নিয়ম-কানুন মেনে চলা, এর পার্শ্বে পশু যবাই ও কান্নাকাটি করা, প্রয়োজনের কথা কবরবাসীকে জানানো, তাদের নিকট কষ্ট, অভাব ও বিপদ থেকে মুক্তি ইত্যাদি কামনা করে যিয়ারতকারীরা যে সব কর্ম করে, এর কোনটিই আল্লাহর জন্য নয়, বরং তা শয়তানের জন্যেই করে থাকে।’’[3]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সহচরগণ তাঁর নিকট মুশরিকদের ‘যাতে আনওয়াত’ নামের কুল গাছের অনুরূপ একটি গাছ নির্ধারণ করে দেয়ার আবেদনের হাদীসটি[4] বর্ণনা পূর্বক তিনি বলেন : ‘‘লক্ষ্য করুন! যখন (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাহাবীদের পক্ষ থেকে) কোনো প্রকার এবাদত বা এর নিকট কোনো প্রয়োজন পূরণের কথা জানানো ছাড়াই, শুধুমাত্র এতে অস্ত্রশস্ত্র ঝুলিয়ে রাখা এবং এর পার্শ্বে অবস্থান গ্রহণ করার উদ্দেশ্যে এ ধরনের গাছকে নির্ধারণ করে দেয়ার আবদার করা-ই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দৃষ্টিতে এ গাছকে ইলাহ বা উপাস্যে পরিণত করার নামান্তর হয়ে গেল, তখন সেই সমস্ত লোকদের ব্যাপারে আমরা কী ধারণা করতে পারি, যারা কোনো কবর, গাছ ও পাথরের কাছে আগমন করে এটাকে সম্মান করে, এর দ্বারা রোগমুক্তি কামনা করে, এর উদ্দেশ্যে মানত করে, এ ধারণার বশবর্তী হয়ে যে, এটি তাদের মানত গ্রহণ করে।
এটিকে তারা হাত দিয়ে স্পর্শ করে, মুখ দ্বারা চুম্বন করে, অথচ আল্লাহ তা‘আলা ‘মাকামে ইব্রাহীমকে’ নামাযের স্থান হিসেবে নির্ধারণের জন্য আমাদেরকে নির্দেশ প্রদান করা সত্ত্বেও সলফগণ তা হাত দ্বারা স্পর্শ করতে নিষেধ করেছেন। যেমন আযরক্বী ইমাম কাতাদাহ (রহ.) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি
﴿وَٱتَّخِذُواْ مِن مَّقَامِ إِبۡرَٰهِۧمَ مُصَلّٗىۖ ﴾ [البقرة: ١٢٥][5]
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন :
(إن الله أمر الناس بالصلاة في هذا المكان و لم يأمرهم بلمسه)
‘‘আল্লাহ তা‘আলা জনগণকে এ স্থানে নামায পড়তে আদেশ করেছেন, তাদেরকে তা স্পর্শ করতে আদেশ করেন নি।’’[6]
বাস্তবিক অর্থে যারা কোনো কবর, কবর, গাছ, পাথর, মাটি, কূপ ও পুকুর এবং ওলীদের নিদর্শনাদিকে বিভিন্ন রোগমুক্তির হাসপাতাল ও বিপদের আশ্রয়স্থল বানিয়ে নিয়েছে, সন্তান লাভ ও বিভিন্ন মনস্কামনা পূরণের স্থান বানিয়ে নিয়েছে, তারা যেন ওলীদের কবর ও কবরসমূহকে মুশরিকদের ‘হুবল’ ও ‘মানাত’ দেবতার স্থানে বসিয়েছে এবং গাছ, কূপ, পুকুর ও ওলীদের নিদর্শনাদিকে মুশরিকদের ‘যাতে আনওয়াত’, ‘উয্যা’ ও ‘লাত’ নামের দেবীতে পরিণত করেছে। এসবকে কেন্দ্র করে তারা যা কিছু করে এর দ্বারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সে ভবিষ্যদ্বাণীরই সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে, তিনি বলেছিলেন :‘‘তোমরা অবশ্যই তোমাদের পূর্বেকার জাতির (মুশরিকদের) রীতিনীতির অনুসরণ করবে।’’[7]
>[2]. মুহাম্মদ আব্দুর রহীম, ফতাওয়া রহীমিয়্যাহ; (গুজরাট : মকতবা-ই- রহীমিয়্যাহ, সংস্করণ বিহীন, তারিখ বিহীন), ১/২০৩-২০৪।
[3]. আহমদ রূমী, প্রাগুক্ত; পৃ. ১৫৯।
[4] হাদীসটি নিম্নরূপ : আবু ওয়াক্বিদ আল-লায়ছী রাদিয়াল্লাহু আনহ থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন খয়বর অভিযানের বের হলেন, তখন মুশরিকদের একটি গাছের পার্শ্ব দিয়ে অতিক্রম করেন, যাকে ‘যাতে আনওয়াত’ বলা হতো, এর উপর তারা তাদের অস্ত্রশস্ত্র ঝুলিয়ে রাখতো। সাহাবীগণ বললেন- হে রাসূল! ওদের ন্যায় আমাদের জন্যেও একটি ‘যাতে আনওয়াত’ নির্ধারণ করে দিন। সাহাবীদের এ আবেদন শুনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন : সুবহানাল্লাহ! তোমাদের এ কথাটি মূসা (আ.) এর জাতির কথার মতই হয়ে গেল, তারা বলেছিল- মুশরিকদের ইলাহের ন্যায় আমাদের জন্যে একটি ইলাহ বানিয়ে দিন। যার হাতের মধ্যে আমার আত্মা তাঁর শপথ করে বলছি- তোমরা অবশ্যই তোমাদের অতীতের লোকদের রীতিনীতি অনুসরণ করবে।’’ দেখুন : আবু ঈসা আত- তিরমিযী, প্রাগুক্ত; ৪/৪৭৫। কোনো কোনো বর্ণনায় খয়বার যুদ্ধের পরিবর্তে হুনায়ন যুদ্ধের কথা বর্ণিত হয়েছে।
[5]. অনুবাদ : ‘‘তোমরা মাকামে ইব্রাহীমকে নামাযের স্থান বানাও।’’ আল-কুরআন, সূরা : বাক্বারাহ : ১২৫।
[6]. আহমদ রূমী, প্রাগুক্ত; পৃ.১৬১।
[7]. দেখুন : তিরমিযী, প্রাগুক্ত; কিতাবুল কদর, বাব নং ১৮, হাদীস নং ২১৮০; ৪/৪৭৫; ইবনে মাজাহ, প্রাগুক্ত; ২/১৩২২; ইবনে আবী শায়বাহ, ৭/৪৭৯।
এ পৃথিবীতে মানুষ যদি নিজ থেকে আপনা-আপনি সৃষ্টি হয়ে থাকতো, তা হলে তারা যেমন খুশী চলতে পারতো। তাদের জীবনের যাবতীয় দিক ও বিভাগ শাসন ও পরিচালনা করার জন্য নিজেরাই স্বাধীনভাবে আইন ও বিধান রচনা করতে পারতো। কিন্তু মানুষ আল্লাহর সৃষ্ট জীব হওয়ায় তাদের এ স্বাধীনতা নেই; কেননা, তিনি নিজেই তাদের এ প্রয়োজন পূরণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। এ জন্য দিয়েছেন সর্বকাল ও সর্বস্থানে প্রয়োগের উপযোগী সর্বশেষ অহীর বিধান আল-কুরআন ও তাঁর শেষ নবীর সহীহ সুন্নাহ। এ দু’য়ের মাঝে বর্ণিত যাবতীয় বিধি-বিধান মানুষের ব্যক্তি, পরিবার, ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনে বাস্তবায়ন করা বা না করার ব্যাপারে আল্লাহ তাদেরকে সৃষ্টিগত স্বাধীনতা দিয়ে থাকলেও শরী‘আতগত দিক থেকে তা পালন করা বা না করার ব্যাপারে তিনি তাদেরকে কোনো স্বাধীনতা দান করেন নি।
বরং এ কথা বলে দিয়েছেন যে, যারা স্বেচ্ছায় তা তাদের জীবনে বাস্তবায়ন করবে বা এ জন্য চেষ্টা করবে, তারা আল্লাহর আইনের কাছে আত্মসমর্পণকারী ও তাঁর দাস হিসেবে গণ্য হবে। তারা আল্লাহকেই তাদের জীবনের পরিচালনাকারী ও রব হিসেবে স্বীকৃতি দানকারী হবে। আর যারা তা করবে না, তারা আল্লাহর অবাধ্য হয়ে তাঁর দাসত্বকে অস্বীকারকারী হয়ে নিজেদেরকে নিজেদের ইলাহ ও রব হিসেবে স্বীকৃতি দানকারী হবে। কুরআন ও হাদীসের দ্বারা এ বিষয়টি অত্যন্ত পরিষ্কার থাকা সত্ত্বেও দেখা যায়- আমাদের দেশে যারা নিজেদেরকে মুসলিম বলে দাবী করেন, তাদের অধিকাংশই তাদের জীবনের সকল ক্ষেত্রে সে ওহীর বিধান বাস্তবায়ন করতে রাজি নন।
তারা এটাকে সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ বলে আখ্যায়িত করেন। দেশের অধিকাংশ জনগণ ইসলামী রাজনীতির পরিবর্তে পাশ্চাত্য রাজনীতির অনুসরণ ও অনুকরণ করার ফলে দেশে যেমন ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম হচ্ছে না, তেমনি শুধুমাত্র বিবাহ, তালাক, উত্তরাধিকার ও পারিবারিক আইন ব্যতীত মানব জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে অহীর যে সব বিধান রয়েছে, তা রাষ্ট্রীয়ভাবে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ যেখানে যাবতীয় আইনের মূল উৎস হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার কথা, সেখানে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা নিজেই আইনের উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশ পরিচালনার জন্য সংবিধান রচনা করে আমরা এ সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছি যে, এ সংবিধানে বর্ণিত বিধানের সাথে অপর কোনো বিধানের বিরোধিতা করার কোনো আইনগত অধিকার নেই এবং করলে তা অপনিতেই বাতিল বলে গণ্য হবে। যেমন সংবিধানের ৭ম ধারার দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে আমরা এ সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছি যে,
“This Constitution is, as the solemn expresson of the will of the people, the supreme law of the Republic, and if any other law is inconsistent with this Constitution that other law shall, to the extent of the inconsistency, be void.”[1]এ সিদ্ধান্তের দ্বারা আমরা নিজেদের রচিত সংবিধানের আইন ও বিধানকে কুরআন ও সুন্নাহের আইন ও বিধানের উপর মর্যাদা দান করেছি। বিচার কার্য অহীর বিধানানুযায়ী পরিচালিত না করে তা পাশ্চাত্য বা নিজেদের রচিত বিধানানুযায়ী করছি। এভাবে আমরা সৃষ্টি হওয়া সত্ত্বেও নিজেদেরকে স্রষ্টার আসনে বসিয়ে দিয়েছি এবং এ জাতীয় কর্ম করে নিজেদের অজান্তেই নিজেদেরকে আল্লাহর রুবূবিয়্যাতে শরীক করে নিয়েছি।
এ হেন অভিযোগ থেকে কেবল তারাই মুক্তি পেতে পারেন যারা আল্লাহর আইন ও বিধানকে কোনো প্রকার অবজ্ঞা না করে সর্বকালে তা বাস্তবায়নের যোগ্য বলে মনে করেন, ক্ষমতায় যেতে না পারলে ইসলাম বিরোধী দেশীয় ও আন্তর্জাতিক যাবতীয় ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে কোনো প্রকার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ছাড়াই শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতায় যেয়ে তা বাস্তবায়নের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা ও তদবীর করেন।
কিন্তু যারা শুধু সেমিনার, সেম্মোজিয়াম ও বক্তৃতায় দাঁড়িয়ে ইসলামী বিধানের মৌখিকভাবে প্রশংসা করেন এবং শুধুমাত্র সমস্যাদির কথা ভেবে তা বাস্তবায়ন করার জন্য কোনো প্রকার বাস্তব উদ্যোগ গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকেন, তারা আল্লাহর রুবূবিয়্যাতে শির্ক করা থেকে বাঁচতে পারলেও কোনো অবস্থাতেই তারা কবীরা গুনাহ থেকে মুক্ত হতে পারবেন না কেননা, একজন মুসলিম বা একটি মুসলিম রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ ও অনুসারীদের ঈমানী দায়িত্ব হচ্ছে- ক্ষমতায় গিয়ে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী দেশ ও বিচার কার্য পরিচালনার জন্য সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করা, যারা তা চায় তাদের সহযোগিতা গ্রহণ করা। নিজে চাইবো না বা যারা তা চায় তাদের সহযোগিতাও করবো না, এমন মুনাফিকী চরিত্র নিজের আখেরাত সম্পর্কে সচেতন কোনো মুসলিমের কশ্মিনকালেও হতে পারে না।
>