ইমেইলে পাঠাতে নিচের ফর্মটি পূরণ করুন
security code
শির্ক কী ও কেন? চতুর্থ পরিচ্ছেদ ড. মুহাম্মদ মুয্‌যাম্মিল আলী
৬. ওলীদের কবর ও কবরের মাটি, গাছ, নিকটস্থ কূপের পানি ও জীব-জন্তুর দ্বারা উপকারে বিশ্বাস করা

মহান আল্লাহর ইচ্ছায় এ পৃথিবীর অনেক কিছুই মানুষের অনেক অসুখ-বিসুখের ক্ষেত্রে উপকারী হয়ে থাকে। এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে কোনো ওলির কবর বা কবরের মাটি, এর নিকটস্থ গাছ, পুকুরের মাছ, কচ্ছপ ও কুমির ইত্যাদির প্রতি তা সে ওলির সাথে সংশ্লিষ্ট হওয়ার কারণে উপকারী হওয়ার ধারণা করা শির্কের অন্তর্গত। কিন্তু তা সত্ত্বেও অনেক মুসলিমদের মনে এ সব উপকারী হওয়ার দৃঢ় বিশ্বাস রয়েছে। সে কারণে তাদেরকে অলিগণের কবরের মাটি, কবর বা কবরের উপর পুড়ানো মোম সংগ্রহ করতে দেখা যায়।

কূপ ও পুকুরের পানি ময়লা হলেও তা যমযমের পানির মত আগ্রহের সাথে পান করতে ও তা ক্রয় করতে দেখা যায়। এমনকি শাহ জালাল (রহ.)-এর কূপের সাথে যমযম কূপের গোপন সম্পর্ক রয়েছে বলেও ধারণা করতে দেখা যায়।[1] কবরের কবুতর, পুকুরের মাছ, কচ্ছপ ও কুমিরকে যত্নের সাথে খাবার দিতে দেখা যায়। অনিষ্টের ভয়ে কবুতর ও মাছ খাওয়া থেকে বিরত থাকতে দেখা যায়। বিভিন্ন রোগ মুক্তি ও সন্তান লাভের আশায় কোনো কোনো কবর বা কবরের নিকটস্থ গাছে তারকাঁটা মারতে ও লাল সুতা বেঁধে রাখতে দেখা যায়। এ জাতীয় গাছ শির্ক চর্চার কেন্দ্র হওয়াতে তা স্বমূলে উৎপাটন করা প্রসঙ্গে মালিকী মাযহাবের একজন প্রসিদ্ধ আলেম ইমাম ত্বরত্বুশী বলেন :

"فانظروا رحمكم الله ! أينما وجدتم سدرة أو شجرة يقصدها الناس و يعظمونها و يرجون منه البرء الشفاء من قبلها ويضربون بها المسامير و الخرق فهي ذات أنواط ، فاقطعوها."

‘‘ওহে মুসলিম জনতা লক্ষ্য কর! আল্লাহ আপনাদের উপর রহম করুণ! যেখানেই তোমরা এমন কোনো কুল গাছ বা অন্য কোনো গাছ পাবে, যার নিকটে লোকেরা (দূর-দূরান্ত থেকে) উদ্দেশ্য করে আগমন করে, এর সম্মান করে ও তাত্থেকে রোগ মুক্তি কামনা করে, তাতে তারকাঁটা মারে ও কাপড়ের টুকরা ঝুলিয়ে রাখে, তা হলে তোমরা বুঝে নিবে যে, এটি (কাফিরদের) সেই যাতে আনওয়াত (এরই অনুরূপ গাছ, যাকে কাফিররা দূর-দূরান্ত থেকে উদ্দেশ্য করে আসতো)। সুতরাং তোমরা তা কেটে ফেলো।’’[2]

আল্লামা আহমদ রূমী কবর ও কবরের নিকটতম গাছের কাছে লোকেরা যা করে সে সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন:

‘‘কবরের কাছে যিয়ারতকারীদের নামায পড়া, কবরের হজ্জ করার সময় বিভিন্ন নিয়ম-কানুন মেনে চলা, এর পার্শ্বে পশু যবাই ও কান্নাকাটি করা, প্রয়োজনের কথা কবরবাসীকে জানানো, তাদের নিকট কষ্ট, অভাব ও বিপদ থেকে মুক্তি ইত্যাদি কামনা করে যিয়ারতকারীরা যে সব কর্ম করে, এর কোনটিই আল্লাহর জন্য নয়, বরং তা শয়তানের জন্যেই করে থাকে।’’[3]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সহচরগণ তাঁর নিকট মুশরিকদের ‘যাতে আনওয়াত’ নামের কুল গাছের অনুরূপ একটি গাছ নির্ধারণ করে দেয়ার আবেদনের হাদীসটি[4] বর্ণনা পূর্বক তিনি বলেন : ‘‘লক্ষ্য করুন! যখন (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাহাবীদের পক্ষ থেকে) কোনো প্রকার এবাদত বা এর নিকট কোনো প্রয়োজন পূরণের কথা জানানো ছাড়াই, শুধুমাত্র এতে অস্ত্রশস্ত্র ঝুলিয়ে রাখা এবং এর পার্শ্বে অবস্থান গ্রহণ করার উদ্দেশ্যে এ ধরনের গাছকে নির্ধারণ করে দেয়ার আবদার করা-ই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দৃষ্টিতে এ গাছকে ইলাহ বা উপাস্যে পরিণত করার নামান্তর হয়ে গেল, তখন সেই সমস্ত লোকদের ব্যাপারে আমরা কী ধারণা করতে পারি, যারা কোনো কবর, গাছ ও পাথরের কাছে আগমন করে এটাকে সম্মান করে, এর দ্বারা রোগমুক্তি কামনা করে, এর উদ্দেশ্যে মানত করে, এ ধারণার বশবর্তী হয়ে যে, এটি তাদের মানত গ্রহণ করে।

এটিকে তারা হাত দিয়ে স্পর্শ করে, মুখ দ্বারা চুম্বন করে, অথচ আল্লাহ তা‘আলা ‘মাকামে ইব্রাহীমকে’ নামাযের স্থান হিসেবে নির্ধারণের জন্য আমাদেরকে নির্দেশ প্রদান করা সত্ত্বেও সলফগণ তা হাত দ্বারা স্পর্শ করতে নিষেধ করেছেন। যেমন আযরক্বী ইমাম কাতাদাহ (রহ.) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি

﴿وَٱتَّخِذُواْ مِن مَّقَامِ إِبۡرَٰهِ‍ۧمَ مُصَلّٗىۖ ﴾ [البقرة: ١٢٥][5]

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন :

(إن الله أمر الناس بالصلاة في هذا المكان و لم يأمرهم بلمسه)

‘‘আল্লাহ তা‘আলা জনগণকে এ স্থানে নামায পড়তে আদেশ করেছেন, তাদেরকে তা স্পর্শ করতে আদেশ করেন নি।’’[6]

বাস্তবিক অর্থে যারা কোনো কবর, কবর, গাছ, পাথর, মাটি, কূপ ও পুকুর এবং ওলীদের নিদর্শনাদিকে বিভিন্ন রোগমুক্তির হাসপাতাল ও বিপদের আশ্রয়স্থল বানিয়ে নিয়েছে, সন্তান লাভ ও বিভিন্ন মনস্কামনা পূরণের স্থান বানিয়ে নিয়েছে, তারা যেন ওলীদের কবর ও কবরসমূহকে মুশরিকদের ‘হুবল’ ও ‘মানাত’ দেবতার স্থানে বসিয়েছে এবং গাছ, কূপ, পুকুর ও ওলীদের নিদর্শনাদিকে মুশরিকদের ‘যাতে আনওয়াত’, ‘উয্‌যা’ ও ‘লাত’ নামের দেবীতে পরিণত করেছে। এসবকে কেন্দ্র করে তারা যা কিছু করে এর দ্বারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সে ভবিষ্যদ্বাণীরই সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে, তিনি বলেছিলেন :‘‘তোমরা অবশ্যই তোমাদের পূর্বেকার জাতির (মুশরিকদের) রীতিনীতির অনুসরণ করবে।’’[7]

>
[1]. সৈয়দ মোস্তফা কামাল, শাহ জালাল ও তাঁর কারামত; (সিলেট : নিউ এমদাদিয়া লাইব্রেরী, ১০ম ষংস্করণ, ১৯৯৬ খ্রি.), পৃ. ২২।

[2]. মুহাম্মদ আব্দুর রহীম, ফতাওয়া রহীমিয়্যাহ; (গুজরাট : মকতবা-ই- রহীমিয়্যাহ, সংস্করণ বিহীন, তারিখ বিহীন), ১/২০৩-২০৪।

[3]. আহমদ রূমী, প্রাগুক্ত; পৃ. ১৫৯।

[4] হাদীসটি নিম্নরূপ : আবু ওয়াক্বিদ আল-লায়ছী রাদিয়াল্লাহু আনহ থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন খয়বর অভিযানের বের হলেন, তখন মুশরিকদের একটি গাছের পার্শ্ব দিয়ে অতিক্রম করেন, যাকে ‘যাতে আনওয়াত’ বলা হতো, এর উপর তারা তাদের অস্ত্রশস্ত্র ঝুলিয়ে রাখতো। সাহাবীগণ বললেন- হে রাসূল! ওদের ন্যায় আমাদের জন্যেও একটি ‘যাতে আনওয়াত’ নির্ধারণ করে দিন। সাহাবীদের এ আবেদন শুনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন : সুবহানাল্লাহ! তোমাদের এ কথাটি মূসা (আ.) এর জাতির কথার মতই হয়ে গেল, তারা বলেছিল- মুশরিকদের ইলাহের ন্যায় আমাদের জন্যে একটি ইলাহ বানিয়ে দিন। যার হাতের মধ্যে আমার আত্মা তাঁর শপথ করে বলছি- তোমরা অবশ্যই তোমাদের অতীতের লোকদের রীতিনীতি অনুসরণ করবে।’’ দেখুন : আবু ঈসা আত- তিরমিযী, প্রাগুক্ত; ৪/৪৭৫। কোনো কোনো বর্ণনায় খয়বার যুদ্ধের পরিবর্তে হুনায়ন যুদ্ধের কথা বর্ণিত হয়েছে।

[5]. অনুবাদ : ‘‘তোমরা মাকামে ইব্রাহীমকে নামাযের স্থান বানাও।’’ আল-কুরআন, সূরা : বাক্বারাহ : ১২৫।

[6]. আহমদ রূমী, প্রাগুক্ত; পৃ.১৬১।

[7]. দেখুন : তিরমিযী, প্রাগুক্ত; কিতাবুল কদর, বাব নং ১৮, হাদীস নং ২১৮০; ৪/৪৭৫; ইবনে মাজাহ, প্রাগুক্ত; ২/১৩২২; ইবনে আবী শায়বাহ, ৭/৪৭৯।