শির্ক কী ও কেন? চতুর্থ পরিচ্ছেদ ড. মুহাম্মদ মুয্‌যাম্মিল আলী
৪. কবরে অব্দুল কাদির জীলানীর হস্তক্ষেপে বিশ্বাস:

মানুষের ইহকালীন জীবনে মৃত অলিগণের হস্তক্ষেপ করার বিশ্বাসের পাশাপাশি কিছু জনমনে এ বিশ্বাসও রয়েছে যে, তারা প্রয়োজনে মানুষের কবরেও হস্তক্ষেপ করতে পারেন। এ প্রসঙ্গে বড়পীর আব্দুল কাদির জীলানীর ব্যাপারে একটি চমকপ্রদ ঘটনা তাঁর ভক্তদের মাঝে আলোচিত হতে দেখা যায়। তা হলো- একদা তাঁর এক ভক্ত মৃত্যুর পর কবরে নাকির-মুনকার ফেরেশতার প্রশ্নের জবাব দিতে অপারগ হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় সে তার পীর আব্দুল কাদির জীলানীকে সাহায্যের জন্য স্মরণ করতে থাকে। তিনি তাঁর ভক্তের দো‘আ শুনে সে লোকের কবরে আগমন করেন এবং ফেরেশতাদের হাত থেকে তাঁর ভক্তের আমলনামা নিজ হাতে নিয়ে তাদেরকে লক্ষ্য করে বলেন- তোমরা কি জান না, এ লোকটি আমার ভক্ত। এতে ফেরেশতাগণ নির্বাক হয়ে ফিরে যান।[1]

১. আব্দুল কাদির জীলানীকে দস্তগীর নামে অভিহিতকরণ :

মহান আল্লাহ হলেন এ জগতের পরিচালক। এ-জগতকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য তাঁকে সর্বদাই জাগ্রত থাকতে হয়। কখনও তাঁকে মানবীয় কোনো প্রকার দুর্বলতা যেমন- তন্দ্রা, নিদ্রা ও পদস্খলন স্পর্শ করতে পারে না। তাঁর একটি গুণগত নাম হচ্ছে (قَيُّوْمْ), এ গুণের কারণে তিনি সমগ্র জগতকে ধারণ করে রয়েছেন। তিনি পায়চারি করেন, হাঁটতে হাঁটতে তাঁর পা মুবারক পিছলে যায়- নাউজু বিল্লাহ! এ জাতীয় কথা আল্লাহর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে না। তিনি যদি পা পিছলে পড়ে যান, তা হলে তিনি কী করে এ মহাজগত ধারণ করে থাকবেন। কিন্তু বড়পীর ‘আব্দুল কাদির জীলানী (রহ.)-এর ভক্তদের মধ্যে আল্লাহর ব্যাপারে এ জাতীয় বিশ্বাস রয়েছে।

‘আব্দুল কাদির জীলানী (রহ.)-এর ব্যাপারে তাঁর ভক্তদের মাঝে যে- সব রূপকথা ও কল্প-কাহিনী রয়েছে, তন্মধ্যে সবচেয়ে অদ্ভূত একটি কাহিনী হচ্ছে- ‘একদা তিনি অদৃশ্য হয়ে আকাশে আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করেন এবং দুই বন্ধুর ন্যায় তিনি সেখানে আল্লাহর হাত ধরে চলতে থাকেন। এক সময় হঠাৎ করে আল্লাহর পা পিছলে যায় (নাউজু বিল্লাহ)। তখন ‘আব্দুল কাদির জীলানী আল্লাহকে তাঁর হাত ধরে সোজা করে দাঁড় করান।’[2] এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই ‘আব্দুল কাদির জীলানী দস্তগীর (আল্লাহর হাত পাকড়াওকারী) নামে অভিহিত হন। যারা এ জাতীয় কল্প-কথায় বিশ্বাস করে তারা যেন প্রকারান্তরে ‘আব্দুল কাদির জীলানীকেই আল্লাহর ধারক হিসেবে গণ্য করে থাকে এবং তাঁকে আল্লাহর পরিচালনাকারীর মর্যাদা দিয়ে থাকে, অথচ এমন ধারণা করা সুস্পষ্ট শির্ক।

রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে দেশের জনগণকে সকল ক্ষমতার মালিক বলে মনে করা :

সকল ক্ষমতার মালিক ও উৎস হলেন আল্লাহ। কারো ক্ষমতায় যাওয়া বা ক্ষমতা থেকে অপসারিত হওয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে তাঁরই ইচ্ছা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। সে অনুযায়ী যখন তিনি কোনো দলকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসাবার ইচ্ছা করেন, তখন জনগণের অন্তরকে সে দলের প্রতি তিনি আকৃষ্ট করে দেন। তাই তারা স্বেচ্ছায় অথবা কোনো কিছুর বিনিময়ে হলেও তাদেরকে ভোট দেয় এবং এ প্রক্রিয়ায়ই সে দল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা লাভ করে। আল্লাহর ইচ্ছা না হলে যেহেতু জনগণ কোনো দলকে ক্ষমতায় বসাবার জন্য ভোট দিতে পারে না, সেহেতু ক্ষমতার মূল মালিক হলেন তিনিই, জনগণ নয়।

সে-জন্য কেউ যদি এ কথা এ বিশ্বাসের ভিত্তিতে বলে যে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা লাভের পিছনে আল্লাহর কোনো হাত নেই এবং জনগণই এর সব কিছুর মালিক, তবে তার এ ধারণা শির্কে আকবার হিসেবে গণ্য হবে। এমন ধারণা না নিয়ে বললে বাহ্যিক দৃষ্টিতে তার কথাটি আপত্তিকর হওয়ায় তা শির্কে আসগার হিসেবে গণ্য হবে। এ ধরনের কথা বলার বিষয়টি শর‘য়ী দৃষ্টিতে গর্হিত হওয়া সত্ত্বেও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৭ম ধারার প্রথম প্যারাতে এ জাতীয় সিদ্ধান্তই গৃহীত রয়েছে। সিদ্ধান্তটি নিম্নরূপ :

‘All powers in the Republic belong to the people and their exercise on behalf of the people shall be effective only under, and by the authority of this Constitution.’[3]

জনগণকে এ ধরনের ক্ষমতার স্বীকৃতি প্রদানের বিষয়টি কুরআনুল কারীমের নিম্নোক্ত আয়াত দু’টির সাথে সাংঘর্ষিক বলে প্রতীয়মান হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

﴿أَنَّ ٱلۡقُوَّةَ لِلَّهِ جَمِيعٗا ﴾ [البقرة: ١٦٥]

‘‘সকল ক্ষমতার মালিক কেবল আল্লাহ।’’[4]

অপর আয়াতে বলেন :

﴿ قُلِ ٱللَّهُمَّ مَٰلِكَ ٱلۡمُلۡكِ تُؤۡتِي ٱلۡمُلۡكَ مَن تَشَآءُ وَتَنزِعُ ٱلۡمُلۡكَ مِمَّن تَشَآءُ وَتُعِزُّ مَن تَشَآءُ وَتُذِلُّ مَن تَشَآءُۖ بِيَدِكَ ٱلۡخَيۡرُۖ إِنَّكَ عَلَىٰ كُلِّ شَيۡءٖ قَدِيرٞ ٢٦ ﴾ [ال عمران: ٢٦]

‘‘বল হে আল্লাহ! হে ক্ষমতার মালিক, তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা দান কর, যাকে ইচ্ছা সম্মান দান কর, আবার যাকে ইচ্ছা অসম্মানিত কর, তোমার হাতেই সকল কল্যাণের চাবিকাঠি, তুমি সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান।’’[5]

>
[1]. দেখুন: অধ্যাপক আব্দুন্নুর সালাফী, তৌহিদ বনাম শির্ক; (রংপুর: সালাফিয়া প্রকাশনী, সংস্করণ বিহীণ, ১৯৮৪ খ্রি.), পৃ. ৭৭।

[2]. তদেব; পৃ. ৭৪-৭৫।

[3]. গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান; পৃ. ৬।

[4]. আল-কুরআন, সূরা বাকারাহ : ১৬৫।

[5]. আল-কুরআন, সূরা আলে ইমরান : ২৬।