বিভিন্ন সময়ে রাসূল (ছাঃ)-এর মোট ১১ জন স্ত্রী ছিলেন। তন্মধ্যে হযরত খাদীজা ও যয়নব বিনতে খুযায়মা (রাঃ) রাসূল (ছাঃ)-এর জীবদ্দশায় মৃত্যুবরণ করেন। বাকী ৯ জন স্ত্রী রেখে তিনি মারা যান। যারা হ’লেন যথাক্রমে হযরত সওদা, আয়েশা, হাফছাহ, উম্মে সালামাহ, যয়নব বিনতে জাহশ, জুওয়াইরিয়াহ, উম্মে হাবীবাহ, ছাফিইয়াহ ও মায়মূনা বিনতুল হারেছ (রাঃ)।
এতদ্ব্যতীত আরও দু’জন মহিলার সাথে তাঁর বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু সহবাসের পূর্বেই তারা পরিত্যক্ত হন। প্রথমজন আসমা বিনতে নু‘মান আল-কিনদিয়াহ। যিনি ‘জাউনিয়াহ’ (الْجَوْنِيَّةُ) বলেও পরিচিত (ফাৎহুল বারী হা/৫২৫৫-এর ব্যাখ্যা)। তাকে কিছু মাল-সম্পদ দিয়ে বিদায় করা হয়। দ্বিতীয়জন ‘আমরাহ বিনতে ইয়াযীদ আল-কিলাবিয়াহ।[1]
এছাড়াও তাঁর দু’জন দাসী ছিল। একজন খ্রিষ্টান কন্যা মারিয়া ক্বিবত্বিয়াহ। যাকে মিসররাজ মুক্বাউক্বিস হাদিয়াস্বরূপ পাঠিয়েছিলেন। অন্যজন ইহূদী কন্যা রায়হানা বিনতে যায়েদ আল-কুরাযিয়াহ। ইনি বনু কুরায়যার যুদ্ধে বন্দী হন। আবু ওবায়দাহ আরও দু’জন দাসীর কথা বলেছেন। যাদের একজন জামীলা। যিনি কোন এক যুদ্ধের বন্দীনী ছিলেন। অন্যজন তাঁর স্ত্রী যয়নব বিনতে জাহ্শ (রাঃ) কর্তৃক হেবাকৃত।[2]
তাঁর স্ত্রীগণের মধ্যে কুরায়শী ছিলেন ৬ জন। যারা ছিলেন বিভিন্ন কুরায়েশ গোত্রের। যেমন খাদীজা বিনতে খুওয়াইলিদ আল-আসাদী, আয়েশা বিনতে আবুবকর আত-তামীমী, হাফছাহ বিনতে ওমর আল-‘আদাভী, উম্মে হাবীবাহ রামলাহ বিনতে আবু সুফিয়ান আল-উমুভী, উম্মু সালামাহ বিনতে আবু উমাইয়া মাখযূমী ও সাওদা বিনতে যাম‘আহ আল-‘আমেরী (রাযিয়াল্লাহু ‘আনহুন্না)।[3] স্ত্রীদের মধ্যে একমাত্র ইহূদী কন্যা ছিলেন ছাফিইয়াহ বিনতে হুয়াই বিন আখত্বাব। ইহূদী ও খ্রিষ্টান কন্যারা সবাই ইসলাম কবুল করেন।
[2]. আর-রাহীক্ব ৪৭৩-৭৫ পৃঃ; যাদুল মা‘আদ ১/১০২।
[3]. ইবনু হিশাম ২/৬৪৮। সুহায়লী আরও ৫জন স্ত্রীর নাম বলেছেন। যা প্রসিদ্ধ নয় (ঐ, টীকা)।
১. পবিত্র কুরআনে তাঁদেরকে يَا نِسَاءَ النَّبِيِّ ‘হে নবীপত্নীগণ’ বলে সম্বোধন করে সর্বোচ্চ মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে (আহযাব ৩৩/৩০, ৩২)। অন্যত্র أَزْوَاجِكَ ‘তোমার স্ত্রীগণ’ (আহযাব ৩৩/২৮, ৫৯; তাহরীম ৬৬/১-২) বলা হয়েছে। ‘যাওজ’ (زَوْجٌ) অর্থ জোড়া, সমতুল্য, সমপর্যায়ভুক্ত বস্ত্ত। যেমন বলা হয়, زَوْجَا خُفٍّ ‘মোযার দু’টি জোড়া’। রাসূল (ছাঃ)-এর স্ত্রীগণকে তাঁর أَزْوَاج বলার মাধ্যমে তাঁদেরকে সর্বোচ্চ মর্যাদায় ভূষিত করা হয়েছে। অথচ امْرَأَةٌ (স্ত্রী) শব্দ বলা হয়নি, যা অন্যান্য নবী এবং নবী নন এমন সকলের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে (তাহরীম ৬৬/১০)। যেমন- হযরত নূহ ও লূত (আঃ)-এর স্ত্রীদের ক্ষেত্রে امْرَأَتَ نُوْحٍ وَامْرَأَتَ لُوْطٍ ‘নূহের স্ত্রী, লূত্বের স্ত্রী’ বলা হয়েছে। অন্যদিকে ফেরাঊনের স্ত্রীর ক্ষেত্রে, امْرَأَتَ فِرْعَوْنَ (তাহরীম ৬৬/১১) এবং আবু লাহাবের স্ত্রীর ক্ষেত্রে امْرَأَتُهُ (লাহাব ১১১/৪) বলা হয়েছে। ইবরাহীমের স্ত্রীর ক্ষেত্রে امْرَأَتُهُ বা ‘তার স্ত্রী’ (যারিয়াত ৫১/২৯) এবং أَهْلَ الْبَيْتِ বা ‘পরিবার’ (হূদ ১১/৭৩) বলে দু’ধরনের শব্দ এসেছে। তবে যাকারিয়ার স্ত্রীর ক্ষেত্রে امْرَأَتِيْ (মারিয়াম ১৯/৫) এবং زَوْجَهُ (আম্বিয়া ২১/৯০) দু’টি শব্দ এসেছে। কিন্তু শেষনবীর স্ত্রীগণের ক্ষেত্রে কেবল أَزْوَاج শব্দ খাছ করার মাধ্যমে তাঁদের মর্যাদাকে অন্য সকলের উপর বিশেষভাবে উন্নীত করা হয়েছে।
২. নবীপত্নীগণের মর্যাদা পৃথিবীর সকল মহিলার উপরে। যেমন আল্লাহ বলেন, لَسْتُنَّ كَأَحَدٍ مِنَ النِّسَاءِ ‘তোমরা অন্য কোন মহিলার মত নও’ (আহযাব ৩৩/৩২)। এখানে كَأَحَدٍ শব্দ ব্যবহার করায় নবী ও নবী নন, সকলের স্ত্রী ও সকল মহিলাকে বুঝানো হয়েছে। নবীপত্নীগণের উচ্চ মর্যাদায় স্বয়ং আল্লাহ প্রদত্ত এই অনন্য সনদ নিঃসন্দেহে গৌরবের এবং একই সাথে মুসলিম উম্মাহর জন্য নিঃসন্দেহে ঈর্ষণীয় বিষয়।
৩. আল্লাহ নবীপত্নীগণকে নিষ্কলংক ঘোষণা করেছেন এবং তাদের গৃহকে সকল প্রকারের আবিলতা ও পংকিলতা হ’তে মুক্ত বলেছেন। যেমন আল্লাহ বলেন,إِنَّمَا يُرِيدُ اللهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا ‘হে নবী পরিবার! আল্লাহ তো কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পূত-পবিত্র করতে’ (আহযাব ৩৩/৩৩)।
৪. আল্লাহ নবীপত্নীগণের গৃহগুলিকে ‘অহীর অবতরণ স্থল’ (مَهْبِطُ الْوَحْيِ) হিসাবে ঘোষণা করেছেন। যা তাঁদের মর্যাদাকে শীর্ষ স্থানে পৌঁছে দিয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন, وَاذْكُرْنَ مَا يُتْلَى فِي بُيُوتِكُنَّ مِنْ آيَاتِ اللهِ وَالْحِكْمَةِ إِنَّ اللهَ كَانَ لَطِيفًا خَبِيرًا ‘আল্লাহর আয়াতসমূহ এবং হিকমতের (হাদীছের) কথাসমূহ, যা তোমাদের গৃহে পঠিত হয়, সেগুলি তোমরা স্মরণ রাখ। নিশ্চয়ই আল্লাহ অতীব সূক্ষ্মদর্শী ও সকল বিষয়ে অবহিত’ (আহযাব ৩৩/৩৪)।
৫. নবীর মৃত্যুর পরে তাঁরা সকলের জন্য ‘হারাম’ এবং তাঁরা ‘উম্মতের মা’(وَأَزْوَاجُهُ أُمَّهَاتُهُمْ) হিসাবে চিরদিনের জন্য বরণীয় হয়েছেন (আহযাব ৩৩/৫৩; ৩৩/৬)। সরাসরি আল্লাহ কর্তৃক ঘোষিত এই মর্যাদা পৃথিবীর কোন মহিলার ভাগ্যে হয়নি। অতএব সত্যিকারের মুমিন সেই ব্যক্তি যিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে নিজের জীবনের চাইতে ভালবাসেন এবং তাঁর স্ত্রীগণকে মায়ের মর্যাদায় সম্মান প্রদর্শন করেন।
৬. প্রথমা স্ত্রী খাদীজা (রাঃ) ছিলেন বিশ্বসেরা চারজন সম্মানিতা মহিলার অন্যতম। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,أَفْضَلُ نِسَاءِ أَهْلِ الْجَنَّةِ خَدِيجَةُ بِنْتُ خُوَيْلِدٍ وَفَاطِمَةُ بِنْتُ مُحَمَّدٍ وَمَرْيَمُ بِنْتُ عِمْرَانَ وَآسِيَةُ بِنْتُ مُزَاحِمٍ امْرَأَةُ فِرْعَوْنَ ‘জান্নাতী মহিলাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হ’লেন খাদীজা বিনতে খুওয়াইলিদ, ফাতেমা বিনতে মুহাম্মাদ, মারিয়াম বিনতে ইমরান ও ফেরাঊনের স্ত্রী আসিয়া বিনতে মুযাহিম’।[1]
(ক) খাদীজা (রাঃ) ছিলেন সেই মহীয়সী মহিলা যাকে জিব্রীল নিজের পক্ষ হ’তে ও আল্লাহর পক্ষ হ’তে রাসূল (ছাঃ)-এর মাধ্যমে সালাম দেন এবং জান্নাতে তাঁর জন্য বিশেষভাবে নির্মিত মুক্তাখচিত প্রাসাদের সুসংবাদ দেন।[2] (খ) স্ত্রী আয়েশা (রাঃ)-কে জিব্রীল (আঃ) রাসূল (ছাঃ)-এর মাধ্যমে সালাম পাঠান এবং তিনিও তার সালামের জওয়াব দেন (বুখারী হা/৬২০১)। তিনি ছিলেন রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে সর্বাধিক প্রিয় (বুখারী হা/৩৬৬২)।
[2]. বুখারী হা/১৭৯২, ৩৮২০; মুসলিম হা/২৪৩৩; মিশকাত হা/৬১৭৬।
(ক) আলী (রাঃ) সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,أَنْتَ مِنِّى بِمَنْزِلَةِ هَارُونَ مِنْ مُوسَى إِلاَّ أَنَّهُ لاَ نَبِىَّ بَعْدِى ‘তুমি আমার নিকট মূসার নিকটে হারূনের ন্যায়। কেবল এটুকুই যে, আমার পরে কোন নবী নেই (মুসলিম হা/২৪০৪)। তিনি বলেন, مَنْ كُنْتُ مَوْلاَهُ فَعَلِىٌّ مَوْلاَهُ ‘আমি যার বন্ধু, আলী তার বন্ধু’ (তিরমিযী হা/৩৭১৩)। নাজরানের খ্রিষ্টান নেতাদের সাথে মুবাহালার জন্য রাসূল (ছাঃ) আলী, ফাতেমা ও হাসান-হোসায়েনকে সাথে নিয়ে বের হন এবং বলেন, اللَّهُمَّ هَؤُلاَءِ أَهْلِى ‘হে আল্লাহ! এরাই আমার পরিবার’ (মুসলিম হা/২৪০৪)।
(খ) কন্যা ফাতেমা (রাঃ) ছিলেন বিশ্বসেরা চারজন সম্মানিতা মহিলার অন্যতম (তিরমিযী হা/৩৮৭৮)। তাঁকে রাসূল (ছাঃ) سَيِّدَةُ نِسَاءِ أَهْلِ الْجَنَّةِ ‘জান্নাতী মহিলাদের নেত্রী’ বলেছেন (বুখারী হা/৩৬২৪)।
(গ) দুই নাতি হাসান ও হোসাইন (রাঃ)-কে রাসূল (ছাঃ) رَيْحَانَتَاىَ مِنَ الدُّنْيَا ‘দুনিয়াতে আমার সুগন্ধি’ (বুখারী হা/৩৭৫৩) এবং سَيِّدَا شَبَابِ أَهْلِ الْجَنَّةِ ‘জান্নাতী যুবকদের নেতা’ বলেছেন (তিরমিযী হা/৩৭৮১)।
বস্ত্ততঃ নবীগণ বেঁচে থাকেন তাঁদের উম্মতের মধ্যে। সন্তানদের মাধ্যমে বেঁচে থাকাটা আবশ্যক নয়। শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর জীবনেও আমরা সেটাই দেখতে পাই। বিশ্বের সর্বত্র তাঁর উম্মত রয়েছে এবং ক্বিয়ামতের দিন তাঁর উম্মত সংখ্যাই হবে সর্বাধিক।[1] এমনকি তারা জান্নাতবাসীদের অর্ধেক হবে। আর তাদের তুলনা হবে সমস্ত মানুষের মধ্যে কালো বলদের দেহে একটি সাদা লোমের ন্যায়’।[2]
[2]. বুখারী হা/৩৩৪৮; মুসলিম হা/২২১; মিশকাত হা/৫৫৪১।
নবী পরিবারের মর্যাদা সর্বোচ্চ হ’লেও তাঁদের মৃত্যুর পরে তাঁদের অসীলায় আল্লাহর নিকটে রোগমুক্তি কামনা করা শিরক। যে বিষয়ে কুরআন ও হাদীছে কঠিনভাবে নিষেধ করা হয়েছে। শী‘আরা পাঁচ জনের অসীলায় বিপদমুক্তি কামনা করে থাকেন। যেমন তারা বলেন,لِىْ خَمْسةٌ أُطْفِئُ بِهَا البَلاءَ القَاتِمَةَ + الْمُصْطَفَى والْمُرْتَضَى وإِبنَاهِمَا والفَاطِمَةَ ‘আমার জন্য পাঁচজন ব্যক্তি রয়েছেন। যাদের মাধ্যমে আমি কঠিন বিপদ সমূহ নির্বাপিত করি। মুছত্বফা, মুর্তাযা, তাঁর দুই পুত্র এবং ফাতেমা’। সুন্নী নামধারী বহু কবরপূজারী তাদের ভক্তি ভাজন কবরস্থ ব্যক্তির নাম ধরে তার অসীলায় অনুরূপ বিপদমুক্তি কামনা করে থাকেন। যেগুলি পরিষ্কারভাবে শিরক। কুরায়েশ কাফেররাও এরূপ করত। যার প্রতিবাদে আল্লাহ বলেন, ‘যারা আল্লাহর পরিবর্তে অন্যকে অভিভাবক রূপে গ্রহণ করে, (তারা যুক্তি দেখায় যে,) আমরা ওদের পূজা করিনা কেবল এজন্য যে ওরা আমাদেরকে আল্লাহর নৈকট্যে পৌঁছে দিবে’ (যুমার ৩৯/৩)। ‘তারা বলে, ওরা আমাদের জন্য আল্লাহর নিকট সুফারিশকারী’ (ইউনুস ১০/১৮)।
১. খাদীজা বিনতে খুওয়াইলিদ (خَدِيجَةُ بِنْتُ خُوَيْلِدٍ) : বিবাহকালে রাসূল (ছাঃ)-এর বয়স ছিল ২৫ ও তাঁর বয়স ৪০; মৃত্যুসন- রামাযান ১০ম নববী বর্ষ; দাফন- মক্কার ‘হাজূনে’; মৃত্যুকালে বয়স ৬৫। রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে তাঁর দাম্পত্যকাল- ২৪ বছর ৬ মাস বা প্রায় ২৫ বছর। তিনি বেঁচে থাকা অবধি রাসূল (ছাঃ) দ্বিতীয় বিয়ে করেননি।
জ্ঞাতব্য : পূর্বে তিনি দুই স্বামী হারান। প্রথম স্বামী ছিলেন উতাইয়িক্ব বিন ‘আবেদ বিন আব্দুল্লাহ মাখযূমী। তাঁর ঔরসে এক ছেলে আব্দুল্লাহ ও এক মেয়ে জন্ম নেয় (ইবনু হিশাম ২/৬৪৩-৪৪)। তার মৃত্যুর পর ২য় স্বামী আবু হালাহ বিন মালেক তামীমী-এর ঔরসে হালাহ, তাহের ও হিন্দ নামে ৩ পুত্র ছিল। যারা সবাই পরে ছাহাবী হন’ (আল-ইছাবাহ ক্রমিক ১১০৮৬, ৮৯১৯, ৪২৩৮, ৯০১৩)। মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছিলেন তাঁর তৃতীয় স্বামী এবং তিনি ছিলেন তাঁর প্রথমা স্ত্রী। রাসূল (ছাঃ)-এর ঔরসে তাঁর দুই ছেলে ক্বাসেম ও আব্দুল্লাহ ও চার মেয়ে যয়নব, রুক্বাইয়াহ, উম্মে কুলছূম ও ফাতেমা জন্মগ্রহণ করেন। প্রথম সন্তান ক্বাসেমের নামেই তাঁর উপনাম ছিল আবুল ক্বাসেম। পুত্র আব্দুল্লাহর লক্বব ছিল ত্বাইয়িব ও ত্বাহের’ (ইবনু হিশাম ১/১৯০)। জাহেলী যুগে খাদীজা ‘ত্বাহেরাহ’ (طَاهِرَةٌ) অর্থ ‘পবিত্রা’ নামে এবং ইসলামী যুগে ‘ছিদ্দীক্বাহ’ (صِدِّيْقَةٌ) অর্থ ‘নবুঅতের সত্যতায় প্রথম বিশ্বাস স্থাপনকারিণী’ নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন।[1] প্রথমা ও বড় স্ত্রী হিসাবে তিনি ‘খাদীজাতুল কুবরা’ নামেও পরিচিত।
২. সওদা বিনতে যাম‘আহ (سَوْدَةُ بِنْتُ زَمْعَةَ) : রাসূল (ছাঃ)-এর বয়স ৫০, তাঁর বয়স ৫০, বিবাহ সন- শাওয়াল ১০ম নববী বর্ষ, মৃত্যুসন- ১৯ হি.; দাফন- মদীনা; বয়স ৭২। রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে দাম্পত্য জীবন- ১৪ বছর। রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পর স্ত্রীদের মধ্যে তিনিই প্রথম মৃত্যুবরণ করেন।
জ্ঞাতব্য : ইনি প্রথমদিকে ইসলাম কবুল করেন। পরে তাঁর উৎসাহে স্বামী সাকরান বিন ‘আমর মুসলমান হন। অতঃপর উভয়ে হাবশায় হিজরত করেন। সাকরান সেখান থেকে মক্কায় ফিরে এসে মুসলিম অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। তখন সন্তানদের নিয়ে তার বিধবা স্ত্রী সওদা চরম বিপাকে পড়েন। একই সময়ে খাদীজাকে হারিয়ে বিপদগ্রস্ত রাসূল (ছাঃ) বাধ্য হয়ে সংসারে পটু সওদাকে বিয়ে করেন ও তার হাতে সদ্য মাতৃহারা সন্তানদের দায়িত্ব অর্পণ করেন। তাঁর বর্ণিত হাদীছের সংখ্যা ৫টি। তন্মধ্যে ১টি বুখারীতে ও ৪টি সুনানে আরবা‘আহতে।
উল্লেখ্য যে, সাকরান হাবশায় গিয়ে ইসলাম ত্যাগ করে নাছারা হন ও সেখানে মৃত্যুবরণ করেন মর্মে ত্বাবারী ও ইবনুল আছীর যে বর্ণনা করেছেন, তা ছহীহ বা যঈফ কোনভাবেই প্রমাণিত নয় (মা শা-‘আ পৃঃ ৪৪-৪৫)।
৩. আয়েশা বিনতে আবুবকর (عَائِشَةُ بِنْتُ أَبى بَكْرٍ) : রাসূল (ছাঃ)-এর বয়স ৫৪, বিবাহ সন- শাওয়াল ১১ নববী বর্ষ। বিয়ের সময় বয়স ৬, স্বামীগৃহে আগমনের বয়স ৯, শাওয়াল ১ হিজরী, মৃত্যুসন- ৫৭ হি.; দাফন- মদীনা; বয়স- ৬৩। দাম্পত্য জীবন-১০ বছর।
জ্ঞাতব্য : ইনিই একমাত্র কুমারী স্ত্রী ছিলেন। কোন সন্তানাদি হয়নি। নবীপত্নীগণের মধ্যে তিনিই ছিলেন সর্বাধিক জ্ঞানী, বুদ্ধিমতী ও হাদীছজ্ঞ মহিলা। জ্যেষ্ঠ ছাহাবীগণ বিভিন্ন ফাৎওয়ায় তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন করতেন ও তাঁর সিদ্ধান্তকে অগ্রাধিকার দিতেন (যাদুল মা‘আদ ১/১০৩)। আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ) বলেন, আমরা কোন বিষয়ে আটকে গেলে আয়েশা (রাঃ)-এর নিকটে গিয়ে তার সমাধান নিতাম (তিরমিযী হা/৩৮৮৩)। তাঁর বর্ণিত হাদীছের সংখ্যা ২২১০টি। তন্মধ্যে ১৭৪টি মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, ৫৪টি এককভাবে বুখারী ও ৯টি এককভাবে মুসলিম। বাকী ১৯৭৩টি মুসনাদে আহমাদ সহ অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থে।[2]
উল্লেখ্য যে, আয়েশা (রাঃ)-এর পিতা আবুবকর (রাঃ) ছিলেন একমাত্র ছাহাবী, যাঁর পরিবারে চারটি স্তরের সবাই মুসলমান ছিলেন। যা অন্য কোন ছাহাবীর মধ্যে পাওয়া যায় না’ (রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ২/১৫৯)। অর্থাৎ আবুবকর (রাঃ) নিজে, তাঁর পিতা-মাতা ও পুত্র-কন্যাগণ এবং তাদের সন্তানগণ।
৪. হাফছাহ বিনতে ওমর(حَفْصَةُ بِنْتُ عُمَرَ) : রাসূল (ছাঃ)-এর বয়স ৫৫, তাঁর বয়স ২২, বিবাহ শা‘বান ৩ হিজরী; মৃত্যুসন-৪১হি.; দাফন- মদীনা; বয়স-৫৯। দাম্পত্য জীবন- ৮ বছর।
জ্ঞাতব্য : তাঁর পূর্ব স্বামী খুনায়েস বিন হুযাফাহ সাহ্মী প্রথমে হাবশা ও পরে মদীনায় হিজরত করেন। বদর ও ওহোদ যুদ্ধে শরীক ছিলেন। ওহোদে যখমী হয়ে মারা যান। পরে রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে হাফছার বিয়ে হয়। তিনি মোট ৬০টি হাদীছ বর্ণনা করেন। তন্মধ্যে মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ ৪টি, এককভাবে মুসলিম ৬টি। বাকী ৫০টি অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থে। প্রখ্যাত ছাহাবী আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) ছিলেন তাঁর সহোদর ভাই।
৫. যয়নব বিনতে খুযায়মা (زَيْنَبُ بِنْتُ خُزَيْمَةَ) : রাসূল (ছাঃ)-এর বয়স ৫৫; তাঁর বয়স প্রায় ৩০; বিবাহ সন ৩ হিজরী; মৃত্যুসন ৩ হি., বয়স ৩০; দাফন- মদীনা; দাম্পত্য জীবন ২ অথবা ৩ মাস।
জ্ঞাতব্য : পরপর দুই স্বামী হারিয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর ফুফাতো ভাই আব্দুল্লাহ বিন জাহশের সাথে তৃতীয় বিবাহ হয়। কিন্তু তিনি ওহোদ যুদ্ধে শহীদ হলে রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে চতুর্থ বিবাহ হয়। অধিক দানশীল ও গরীবের দরদী হিসাবে তিনি ‘উম্মুল মাসাকীন’ বা ‘মিসকীনদের মা’ নামে খ্যাত ছিলেন। তিনি কোন হাদীছ বর্ণনা করেননি।
৬. উম্মে সালামাহ হিন্দ বিনতে আবু উমাইয়াহ (أُمُّ سَلَمَةَ هِنْدٌ بِنْتُ أَبِي أُمَيَّةَ) : রাসূল (ছাঃ)-এর বয়স ৫৬; তাঁর বয়স ২৬; বিবাহ সন ৪ হি.; মৃত্যুসন ৬০ হি.; দাফন- মদীনা; বয়স ৮০ বছর। দাম্পত্য জীবন- ৭ বছর। স্ত্রীদের মধ্যে তিনি সবশেষে মৃত্যুবরণ করেন।
জ্ঞাতব্য : রাসূল (ছাঃ)-এর আপন ফুফাতো ভাই ও দুধভাই আবু সালামাহর স্ত্রী ছিলেন। স্বামী-স্ত্রী উভয়ে হাবশায় হিজরত করেন। আবু সালামাহ বদর ও ওহোদ যুদ্ধে শরীক হন। ওহোদে যখমী হয়ে শাহাদাত বরণ করেন। দুই ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে উম্মে সালামাহ রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে বিবাহিতা হন। তাঁর দূরদর্শিতাপূর্ণ পরামর্শ হোদায়বিয়ার সন্ধিকালে খুবই ফলপ্রসু প্রমাণিত হয় (বুখারী হা/২৭৩২)। তাঁর বর্ণিত হাদীছের সংখ্যা ৩৭৮। তন্মধ্যে মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ ১৩, এককভাবে বুখারী ৩টি, মুসলিম ১৩টি। বাকী ৩৪৯টি অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থে।
৭. যয়নব বিনতে জাহশ (زَيْنَبُ بِنْتُ جَحْشٍ) : রাসূল (ছাঃ)-এর বয়স ৫৭; তাঁর বয়স ৩৬; বিবাহ সন ৫হি. মৃত্যুসন ২০হি.; দাফন- মদীনা; বয়স ৫১ বছর। দাম্পত্য জীবন- ৬ বছর।
জ্ঞাতব্য : রাসূল (ছাঃ)-এর ফুফাতো বোন ছিলেন। প্রথমে রাসূল (ছাঃ)-এর পোষ্যপুত্র যায়েদ বিন হারেছাহর সাথে বিবাহ হয়। পরে যায়েদ তালাক দিলে আল্লাহর হুকুমে তিনি তাকে বিয়ে করেন প্রচলিত দু’টি কুসংস্কার দূর করার জন্য। এক- সে যুগে পোষ্যপুত্রকে নিজ পুত্র এবং তার স্ত্রীকে নিজ পুত্রবধু মনে করা হ’ত ও তার সাথে বিবাহ নিষিদ্ধ মনে করা হ’ত। দুই- ইহূদী ও নাছারাগণ ওযায়ের ও ঈসাকে আল্লাহর পুত্র গণ্য করত (তওবা ৯/৩০)। অথচ সৃষ্টি কখনো সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর সন্তান হ’তে পারে না। যেমন অপরের ঔরসজাত সন্তান কখনো নিজের সন্তান হ’তে পারে না।
তিনি মোট ১১টি হাদীছ বর্ণনা করেন। তন্মধ্যে মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ ২টি। বাকী ৯টি অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থে (সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ২/২১৮)।
৮. জুওয়াইরিয়া বিনতুল হারেছ (جُوَيْرِيَةُ بِنْتُ الْحَارِثِ) : রাসূল (ছাঃ)-এর বয়স ৫৭; তাঁর বয়স ২০; বিবাহ শা‘বান ৫হি.; মৃত্যু সন ৫৬হি.; দাফন- মদীনা; বয়স ৭১। দাম্পত্য জীবন- ৬ বছর।
জ্ঞাতব্য : ইনি বনু মুছত্বালিক্ব নেতা হারেছ বিন আবু যাররাবের কন্যা ছিলেন। ৫ম হিজরীতে বনু মুছত্বালিক্ব যুদ্ধে বন্দী হয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে বিবাহিতা হন এবং রাসূল (ছাঃ)-এর শ্বশুরকুল হওয়ার সুবাদে একশ’-এর অধিক যুদ্ধবন্দীর সবাইকে মুক্তি দেওয়া হয়। ফলে তারা সবাই মুসলমান হয়ে যায়। জুওয়াইরিয়ার প্রথম স্বামী ছিলেন মুসাফিহ বিন সুফিয়ান মুছতালিক্বী। তিনি মোট ৭টি হাদীছ বর্ণনা করেন। তন্মধ্যে বুখারী ২টি, মুসলিম ২টি। বাকী ৩টি অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থে।
৯. উম্মে হাবীবাহ রামলাহ বিনতে আবু সুফিয়ান (أُمُّ حَبِيبَةَ رَمْلَةُ بِنْتِ أبي سُفْيَانَ) : রাসূল (ছাঃ)-এর বয়স ৫৮; তাঁর বয়স ৩৬; বিবাহ মুহাররম ৭হি.; মৃত্যু সন- ৪৪হি.; দাফন- মদীনা; বয়স ৭২। দাম্পত্য জীবন- ৪ বছর।
জ্ঞাতব্য : কুরায়েশ নেতা আবু সুফিয়ানের কন্যা ছিলেন। ওবায়দুল্লাহ বিন জাহশ আসাদী তার প্রথম স্বামী ছিলেন। উভয়ে মুসলমান হয়ে হাবশায় হিজরত করেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে স্বামী মারা যান। তিনি একটি কন্যা সন্তান নিয়ে বিধবা হন। রাসূল (ছাঃ) তার চরম বিপদের কথা জানতে পেরে ৭ম হিজরীর মুহাররম মাসে ‘আমর বিন উমাইয়া যামরীর মাধ্যমে বাদশাহ নাজাশীর নিকট পত্র প্রেরণ করেন ও তার সাথে বিবাহের পয়গাম পাঠান। নাজাশী স্বয়ং তার বিবাহের খুৎবা পাঠ করেন। তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর পক্ষে ৪০০ দীনার মোহরানা পরিশোধ করেন ও সবাইকে দাওয়াত খাওয়ান। পরে তাঁকে রাসূল (ছাঃ)-এর প্রেরিত দূত শুরাহবীল বিন হাসানাহ (রাঃ)-এর মাধ্যমে মদীনায় পাঠিয়ে দেন (আল-ইছাবাহ, রামলাহ ক্রমিক ১১১৮৫)। তিনি ৬৫টি হাদীছ বর্ণনা করেন। তন্মধ্যে মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ ২টি ও মুসলিম ১টি। বাকী ৬২টি অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থে।
উল্লেখ্য যে, ওবায়দুল্লাহ বিন জাহশ হাবশায় গিয়ে ‘মুরতাদ’ ও ‘নাছারা’ হয়ে গিয়েছিলেন ও উক্ত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছিলেন’ বলে যে ঘটনা প্রসিদ্ধ আছে, তা প্রমাণিত নয়। এ বিষয়ে ইবনু সা‘দ যে বর্ণনা এনেছেন তা ‘মুরসাল’ বা যঈফ (মা শা-‘আ পৃঃ ৩৭-৪৩)। মুবারকপুরীও তার ‘মুরতাদ’ ও ‘নাছারা’ হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন, যা যঈফ (আর-রাহীক্ব ৪৭৪ পৃঃ, ঐ, তা‘লীক্ব ১৮৬-৯২ পৃঃ)।
১০. ছাফিইয়াহ বিনতে হুয়াই বিন আখত্বাব (صَفِيَّةُ بِنْتُ حُيَىِّ بنِ أَخْطَبَ) : রাসূল (ছাঃ)-এর বয়স ৫৯; তাঁর বয়স ১৭; বিবাহ ছফর ৭হি.; মৃত্যুর সন ৫০ হি.; বয়স ৬০; দাফন- মদীনা; দাম্পত্য জীবন- ৪ বছর।
জ্ঞাতব্য : খায়বর যুদ্ধে বন্দী হন। পরে ইসলাম কবুল করে রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে বিবাহিতা হন। মদীনা থেকে বিতাড়িত ইহূদী বনী নাযীর গোত্রের সর্দার হুয়াই বিন আখত্বাব-এর কন্যা এবং অন্যতম সর্দার কেনানাহ বিন আবুল হুক্বাইক্ব-এর স্ত্রী ছিলেন। উভয়ে নিহত হন। হযরত হারূণ (আঃ)-এর বংশধর ছিলেন। তিনি ১০টি হাদীছ বর্ণনা করেন। তন্মধ্যে মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ ১টি। বাকী ৯টি অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। স্ত্রীদের মধ্যে ইনিই ছিলেন একমাত্র ইহূদী কন্যা।
১১. মায়মূনা বিনতুল হারেছ (مَيْمُونَةُ بِنْتُ الْحَارِثِ) : রাসূল (ছাঃ)-এর বয়স ৫৯; তাঁর বয়স ৩৬; বিবাহ যুলক্বা‘দাহ ৭ হি.; মৃত্যুর সন ৫১ হি.; দাফন মক্কার নিকটবর্তী ‘সারিফে’; বয়স ৮০। দাম্পত্য জীবন- সোয়া তিন বছর।
জ্ঞাতব্য : ইনি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) ও খালেদ বিন অলীদ (রাঃ)-এর আপন খালা ছিলেন এবং উম্মুল মুমিনীন হযরত যয়নব বিনতে খুযায়মার সহোদর বৈপিত্রেয় বোন ছিলেন। যিনি ইতিপূর্বে ৩ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর পূর্বের দুই স্বামী মারা গেলে ভগ্নিপতি হযরত আববাস (রাঃ) রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে তার বিবাহের প্রস্তাব দেন। ফলে ৭ম হিজরীতে ক্বাযা ওমরাহ শেষে ফেরার সময় মক্কা থেকে ৬ কি.মি. উত্তরে তান‘ঈম-এর নিকটবর্তী ‘সারিফ’ (السَرِف) নামক স্থানে উক্ত বিবাহ সম্পন্ন হয়। এটিই ছিল রাসূল (ছাঃ)-এর সর্বশেষ বিবাহ। তিনি মোট ৭৬টি হাদীছ বর্ণনা করেন। তন্মধ্যে মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ ৭টি, এককভাবে বুখারী ১টি, মুসলিম ৫টি। বাকী ৬৩টি অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থে স্থান পেয়েছে।[3]
[2]. প্রসিদ্ধ আছে যে, রাসূল (ছাঃ) বলতেন, خُذُوا شَطْرَ دِينِكُمْ عَنِ الْحُمَيْرَاءِ ‘তোমরা দ্বীনের অর্ধাংশ আয়েশার নিকট থেকে গ্রহণ করো’ (আল-বিদায়াহ ৩/১২৮)। হাদীছটি মওযূ‘ বা জাল (আলবানী, ইরওয়াউল গালীল ১/১০)।
[3]. মানছূরপুরী, রহমাতুল্লিল ‘আলামীন, নকশা ২/১৮২, বিস্তারিত ২/১৪৪-৮১; ইবনু হিশাম ২/৬৪৩-৪৮; শাযাল ইয়াসমীন ফী ফাযায়েলে উম্মাহাতিল মুমিনীন, (কুয়েত : ওয়াক্ফ মন্ত্রণালয়, তাবি) ৩১-৩৪ পৃঃ।
ক্রমিক |
নাম |
মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ |
এককভাবে বুখারী |
এককভাবে মুসলিম |
অন্যান্য হাদীছগ্রন্থ |
মোট |
১. |
সওদাহ বিনতে যাম‘আহ |
** |
১ |
** |
৪ |
৫ |
২. |
আয়েশা বিনতে আবুবকর |
১৭৪ |
৫৪ |
৯ |
১৯৭৩ |
২২১০ |
৩. |
হাফছাহ বিনতে ওমর |
৪ |
** |
৬ |
৫০ |
৬০ |
৪. |
উম্মে সালামাহ |
১৩ |
৩ |
১৩ |
৩৪৯ |
৩৭৮ |
৫. |
যয়নব বিনতে জাহশ |
২ |
** |
** |
৯ |
১১ |
৬. |
জুওয়াইরিয়া |
** |
২ |
২ |
৩ |
৭ |
৭. |
উম্মে হাবীবাহ |
২ |
|
১ |
৬২ |
৬৫ |
৮. |
ছাফিইয়াহ |
১ |
|
|
৯ |
১০ |
৯. |
মায়মূনাহ |
৭ |
১ |
৫ |
৬৩ |
৭৬ |
|
সর্বমোট |
২০৩ |
৬১ |
৩৬ |
২৫২২ |
২৮২২ |
বি.দ্র. খাদীজা (রাঃ) থেকে কোন হাদীছ বর্ণিত হয়নি। যাহাবী মায়মূনা বিনতুল হারেছ (রাঃ) বর্ণিত হাদীছের সংখ্যা ১৩টি বলেছেন (সিয়ারু আ‘লাম ২/২৪৫)। মানছূরপুরী আয়েশা (রাঃ) কর্তৃক মুসলিমে বর্ণিত হাদীছের সংখ্যা ৬৭টি সহ মোট ২৩১২টি লিখেছেন (রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ২/১৫৫)। আমরা অধিকাংশ বিদ্বানের গৃহীত সংখ্যাগুলি উল্লেখ করলাম।
মুসলিম উম্মাহর জন্য উম্মাহাতুল মুমিনীন-এর সবচাইতে বড় অবদান এই যে, তাঁদের মাধ্যমে আল্লাহর এই শ্রেষ্ঠ জাতি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পারিবারিক জীবন সম্পর্কে জানতে পেরেছে। সেই সাথে পেয়েছে অন্যূন ২৮২২টি হাদীছ। সেগুলির মধ্যে একা আয়েশা (রাঃ) ২২১০টি হাদীছ বর্ণনা করেছেন। যা মুসলিম উম্মাহর জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে দিক নির্দেশিকা ধ্রুবতারার ন্যায় সর্বদা পথ দেখিয়ে থাকে। ফালিল্লাহিল হাম্দ।
জানা আবশ্যক যে, ২৫ বছরের টগবগে যৌবনে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বিবাহ করেন পরপর দুই স্বামী হারা বিধবা ও কয়েকটি সন্তানের মা ৪০ বছরের একজন প্রৌঢ়া মহিলাকে। এই স্ত্রীর মৃত্যুকাল অবধি দীর্ঘ ২৫ বছর তিনি তাকে নিয়েই সংসার করেছেন। অতঃপর ৬৫ বছর বয়স্কা বৃদ্ধা স্ত্রী খাদীজার মৃত্যু হ’লে তিনি নিজের ৫০ বছর বয়সে দ্বিতীয় বিয়ে করলেন আর এক ৫০ বছর বয়সী কয়েকটি সন্তানের মা একজন বিধবা মহিলা সাওদাকে নিতান্তই সাংসারিক প্রয়োজনে। এরপর মক্কা হ’তে হিজরত করে তিনি মদীনায় চলে যান। যেখানে শুরু হয় ইসলামী সমাজ গঠনের জীবন-মরণ পরীক্ষা। ফলে মাদানী জীবনের দশ বছরে বিভিন্ন বাস্তব কারণে ও ইসলামের বিধানসমূহ বাস্তবায়নের মহতী উদ্দেশ্যে আল্লাহর হুকুমে তাঁকে আরও কয়েকটি বিবাহ করতে হয়। উল্লেখ্য যে, চারটির অধিক স্ত্রী একত্রে রাখার অনুমতি আল্লাহপাক স্রেফ তাঁর রাসূলকে দিয়েছিলেন। অন্য কোন মুসলিমের জন্য নয় (আহযাব ৩৩/৫০)।
আরও উল্লেখ্য যে, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) নিজেই নিজের সম্পর্কে বলেছিলেন যে, مَا لِى فِى النِّسَاءِ مِنْ حَاجَةٍ ‘আমার জন্য মহিলার কোন প্রয়োজন নেই’ (বুখারী হা/৫০২৯)। প্রশ্ন হ’ল, তাহ’লে কেন তিনি এতগুলো বিয়ে করলেন? এর জওয়াবে আমরা নিম্নোক্ত বিষয়গুলি পেশ করব।-
(১) শত্রু দমনের স্বার্থে (لدفع الأعداء) : গোঁড়া ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন আরবীয় সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন রীতির মধ্যে একটি রীতি ছিল এই যে, তারা জামাতা সম্পর্ককে অত্যন্ত গুরুত্ব দিত। জামাতার সঙ্গে যুদ্ধ করা কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ব্যাপারটি ছিল তাদের নিকটে দারুণ লজ্জা ও অসম্মানের ব্যাপার। তাই আল্লাহ পাক স্বীয় নবীকে একাধিক বিবাহের অনুমতি দেন বর্বর বিরুদ্ধবাদী শক্তিকে ইসলামের সহায়ক শক্তিতে পরিণত করার কৌশল হিসাবে। যা দারুণ কার্যকর প্রমাণিত হয়। উদাহরণ স্বরূপ।-
(ক) ৪র্থ হিজরীতে উম্মে সালামাহকে বিবাহ করার পর তাঁর গোত্র বনু মাখযূমের স্বনামধন্য বীর খালেদ বিন অলীদের যে দুর্ধর্ষ ভূমিকা ওহোদ যুদ্ধে দেখা গিয়েছিল, তা পরিবর্তিত হয়ে যায় এবং ৭ম হিজরীর শুরুতে তিনি মদীনায় এসে ইসলাম কবুল করেন।
(খ) ৫ম হিজরীতে জুওয়াইরিয়া বিনতুল হারেছকে বিবাহ করার ফলে বনু মুছত্বালিক্ব গোত্রের যুদ্ধবন্দী একশত জন ব্যক্তি সঙ্গে সঙ্গে মুসলমান হয়ে যান এবং চরম বিরুদ্ধবাদী এই গোত্রটি মিত্রশক্তিতে পরিণত হয়। জুওয়াইরিয়া (রাঃ) তার কওমের জন্য বড় ‘বরকত মন্ডিত মহিলা’ (كَانَتْ أَعْظَمَ بَرَكَةً) হিসাবে বরিত হন এবং তাঁর গোত্র রাসূল (ছাঃ)-এর শ্বশুর গোত্র (أَصْهَارُ رَسُولِ اللهِ) হিসাবে সম্মানজনক পরিচিতি লাভ করে’ (আবুদাঊদ হা/৩৯৩১)।
(গ) ৭ম হিজরীর মুহাররম মাসে উম্মে হাবীবাহকে বিবাহ করার পর তাঁর পিতা কুরায়েশ নেতা আবু সুফিয়ান আর রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতিদ্বন্দ্বী থাকলেন না। বরং ৮ম হিজরীর রামাযান মাসে মক্কা বিজয়ের পূর্বরাতে তিনি ইসলাম কবুল করেন।
(ঘ) ৭ম হিজরীর ছফর মাসে ছাফিয়াকে বিবাহ করার ফলে রাসূল (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধে ইহূদীদের যুদ্ধ তৎপরতা বন্ধ হয়ে যায়। রাসূল (ছাঃ)-এর সঙ্গে সন্ধি করে তারা খায়বরে বসবাস করতে থাকে।
(ঙ) ৭ম হিজরীর যুলক্বা‘দাহ মাসে সর্বশেষ মায়মূনা বিনতুল হারেছকে বিবাহ করার ফলে নাজদবাসীদের অব্যাহত শত্রুতা ও ষড়যন্ত্র থেকে অব্যাহতি পাওয়া যায়। কেননা মায়মূনার এক বোন ছিলেন নাজদের সর্দারের স্ত্রী। এরপর থেকে উক্ত এলাকায় ইসলামের প্রচার ও প্রসার বাধাহীনভাবে চলতে থাকে। অথচ ইতিপূর্বে এরাই ৪র্থ হিজরীতে ৭০ জন ছাহাবীকে দাওয়াত দিয়ে ডেকে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। যা ‘বি’রে মা‘ঊনার ঘটনা’ নামে প্রসিদ্ধ।
২য় কারণ : ইসলামী বন্ধন দৃঢ়করণ (تقوية صلة الإسلام) :
আয়েশা ও হাফছাকে বিবাহ করার মাধ্যমে হযরত আবুবকর ও ওমরের সঙ্গে ইসলামী ভ্রাতৃত্ব দৃঢ়তর ভিত্তি লাভ করে। ওছমান ও আলীকে জামাতা করার পিছনেও রাসূল (ছাঃ)-এর অনুরূপ উদ্দেশ্য থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। এর ফলে ইসলাম জগত চারজন মহান খলীফা লাভে ধন্য হয়।
৩য় কারণ : কুপ্রথা দূরীকরণ (إزالة الرسم الجاهلى) :
পোষ্যপুত্র নিজের পুত্রের ন্যায় এবং তার স্ত্রী নিজের পুত্রবধুর ন্যায় হারাম- এ মর্মে যুগ যুগ ধরে চলে আসা সামাজিক কুপ্রথার অপনোদনের জন্য আল্লাহর হুকুমে তিনি স্বীয় পালিত পুত্র যায়েদ বিন হারেছাহর তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী যয়নব বিনতে জাহশকে বিবাহ করেন। এ বিষয়ে সূরা আহযাবের ৩৭ ও ৪০ আয়াত দু’টি নাযিল হয়। বস্ত্ততঃ এ বিষয়গুলি এমন ছিল যে, এসব কুপ্রথা ভাঙার জন্য কেবল উপদেশই যথেষ্ট ছিল না। তাই আল্লাহর হুকুমে স্বয়ং নবীকেই সাহসী পদক্ষেপে এগিয়ে আসতে হয়েছিল।
৪র্থ কারণ : মহিলা সমাজে ইসলামের বিস্তার (انتشار الإسلام بين النساء) :
শিক্ষা-দীক্ষাহীন জাহেলী সমাজে মহিলারা ছিল পুরুষের তুলনায় আরো পশ্চাদপদ। তাই তাদের মধ্যে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা যোরদার করার জন্য মহিলা প্রশিক্ষকের প্রয়োজনীয়তা ছিল সর্বাধিক। পর্দা ফরয হওয়ার পর এর প্রয়োজনীয়তা আরও বেড়ে যায়। ফলে রাসূল (ছাঃ)-এর স্ত্রীগণ তাঁর সহযোগী হিসাবে একাজে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। অধিক স্ত্রী অর্থই ছিল অধিক প্রশিক্ষিকা। কেবল মহিলারাই নন, পুরুষ ছাহাবীগণও বহু বিষয়ে পর্দার আড়াল থেকে তাঁদের নিকট হ’তে হাদীছ জেনে নিতেন। রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পরেও মা আয়েশা, হাফছাহ, উম্মে সালামাহ প্রমুখের ভূমিকা ছিল এ ব্যাপারে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
পরিশেষে আমরা বলতে চাই যে, একাধিক বিবাহ ব্যবস্থাকে যারা কটাক্ষ করতে চান, তাদের জানা উচিত যে, ইসলাম তার অনুসারীদের জন্য সবার প্রতি সমান ব্যবহারের শর্তে সর্বোচ্চ চার জন স্ত্রী রাখার অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু বাধ্য করেনি। পক্ষান্তরে আধুনিক সভ্যতার দাবীদার পাশ্চাত্যের ফ্রি ষ্টাইল যৌন জীবনে অভ্যস্ত হতাশাগ্রস্ত সমাজ জীবনের গভীরে দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে যে, সেখানে অশান্তির আগুন আর মনুষ্যত্বের খোলস ব্যতীত কিছুই নেই। অথচ প্রকৃত মুসলিমের পারিবারিক জীবন পরকালীন কল্যাণ লাভের উদ্দেশ্যে পারস্পরিক সহানুভূতি ও নিষ্কাম ভালোবাসায় আপ্লুত থাকে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পারিবারিক জীবন যার বাস্তব দৃষ্টান্ত।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, خَيْرُكُمْ خَيْرُكُمْ لأَهْلِهِ وَأَنَا خَيْرُكُمْ لأَهْلِى ‘তোমাদের মধ্যে সেই-ই উত্তম, যে তার পরিবারের নিকটে উত্তম। আর আমি আমার পরিবারের নিকটে তোমাদের চেয়ে উত্তম’।[1] এখানে পরিবার বলতে স্ত্রী বুঝানো হয়েছে।
‘সতীনের সংসার জাহান্নামের শামিল’ বলে একটা কথা সাধারণ্যে চালু আছে। কথাটি কমবেশী সত্য এবং বাস্তব। তবে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভে নিবেদিতপ্রাণ পরিবারে তা কিভাবে শান্তির বাহনে পরিণত হয়, রাসূল-পরিবার ছিল তার অনন্য দৃষ্টান্ত। অন্য সকল ক্ষেত্রের ন্যায় পারিবারিক জীবনেও আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ছিলেন উম্মতের জন্য উত্তম আদর্শ। কিছু দৃষ্টান্তের মাধ্যমে সংক্ষিপ্ত পরিসরে আমরা নিম্নে তা তুলে ধরার চেষ্টা পাব।-
১. স্ত্রীগণের সাথে সমান ব্যবহার (تسوية السلوك مع الزوجات) :
খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান সহ যাবতীয় আচার-আচরণে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তাঁর সকল স্ত্রীর সঙ্গে সমান ব্যবহার করতেন। সাধারণতঃ আছর ছালাতের পর তিনি প্রত্যেক স্ত্রীর ঘরে গিয়ে তাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় বিষয় সমূহ জেনে নিতেন।[2]
২. স্ত্রীদের পালা নির্ধারণ (القسم بين الزوجات) : তিনি স্ত্রীদের মধ্যে তাদের সম্মতিক্রমে সমভাবে পালা নির্ধারণ করতেন।[3] তিনি বলতেন, কারু নিকট দু’জন স্ত্রী থাকলে যদি তাদের মধ্যে সে ন্যায় বিচার না করে, তাহ’লে ক্বিয়ামতের দিন ঐ ব্যক্তি এক অঙ্গ পতিত অবস্থায় আগমন করবে’।[4]
৩. সফরকালে লটারি করণ (القرعة عند السفر) : কোন অভিযানে বা সফরে যাওয়ার সময় লটারীর মাধ্যমে স্ত্রী বাছাই করে একজনকে সাথে নিতেন।[5]
৪. স্ত্রীর বান্ধবীদের সাথে উত্তম আচরণ (المعاملة الحسنة مع صديقات الزوجات) : স্ত্রীগণের বান্ধবী ও আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সদ্ব্যবহার করতেন ও তাদের নিকট উপঢৌকনাদি প্রেরণ করতেন।[6]
৫. স্ত্রীদের কক্ষ পৃথককরণ (فصل غرفات الزوجات) : স্ত্রীগণের প্রত্যেকের কক্ষ পৃথক ছিল। যেগুলিকে আল্লাহ পাক ‘হুজুরাত’ (কক্ষ সমূহ) ‘বুয়ূত’ (ঘর সমূহ) ইত্যাদি নামে অভিহিত করেছেন (হুজুরাত ৪৯/৪; আহযাব ৩৩/৩৩)।
৬. অল্পে তুষ্ট থাকার নীতি অবলম্বন (اةخاذ مبدأ القناعة) : স্ত্রীগণের অধিকাংশ বড় বড় ঘরের মেয়ে হ’লেও রাসূল (ছাঃ)-এর শিক্ষাগুণে তাঁরা সবাই হয়ে উঠেছিলেন অল্পে তুষ্ট ও সহজ-সরল জীবন যাপনে অভ্যস্ত।
৭. দানশীলতায় অভ্যস্তকরণ (التعويد على السخاء) : অন্যের স্বার্থকে নিজের স্বার্থের উপরে স্থান দেওয়ার অনন্য গুণে গুণান্বিতা ছিলেন এই সকল মহিয়সী নারীগণ। সম্পদ পায়ে লুটালেও তাঁরা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করতেন না। দানশীলতায় তারা ছিলেন উদারহস্ত। উম্মুল মুমিনীন হযরত যয়নব বিনতে খুযায়মা (রাঃ) তো ‘উম্মুল মাসাকীন’ (মিসকীনদের মা) হিসাবে অভিহিত ছিলেন (মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ হা/১৫৩৫৭)। খায়বর বিজয়ের পর বিপুল গণীমত হস্তগত হয়। তখন রাসূল (ছাঃ)-এর প্রাপ্য অংশ হ’তে প্রত্যেক স্ত্রীর জন্য বছরে ৮০ অসাক্ব খেজুর এবং ২০ অসাক্ব যব বরাদ্দ করা হয়।[7] সেই সাথে একটি করে দুগ্ধবতী উষ্ট্রী প্রদান করা হয়। কিন্তু দেখা গেল যে, পবিত্রা স্ত্রীগণ যতটুকু না হ’লে নয়, ততটুকু রেখে বাকী সব দান করে দিয়েছেন।[8]
৮. স্ত্রীগণের মধ্যে পারস্পরিক সহমর্মিতা (التعاطف بين الزوجات) : সপত্নীগণের মধ্যে পরস্পরের ভালোবাসা ছিল গভীর ও নিঃস্বার্থ। প্রত্যেকেই প্রত্যেকের প্রতি ছিলেন সহানুভূতিশীল ও দয়ার্দ্রচিত্ত। এরপরেও যদি কখনো কারু প্রতি কারু কোন রূঢ় আচরণ প্রকাশ পেত, তাহ’লে দ্রুত তা মিটিয়ে ফেলা হ’ত। যেমন (ক) একবার রাসূল (ছাঃ)-এর একমাত্র ইহূদীজাত স্ত্রী ছাফিয়াকে কুরায়শী স্ত্রী যয়নব বিনতে জাহ্শ ‘ইহূদী’ বলে সম্বোধন করেন, যার মধ্যে তাচ্ছিল্যের ভাব ছিল। এতে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) এতই ক্ষুব্ধ হন যে, যয়নব তওবা করে অনুতপ্ত না হওয়া পর্যন্ত তার গৃহে পা রাখেননি।[9] (খ) আরেকদিন রাসূল (ছাঃ) ঘরে এসে দেখেন যে, ছাফিয়া কাঁদছেন। কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন যে, হাফছা আমাকে ‘ইহূদীর মেয়ে’ বলেছেন। একথা শুনে রাসূল (ছাঃ) ছাফিয়াকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, বরং তুমি নিশ্চয়ই নবী (ইসহাকের) কন্যা। তোমার চাচা (ইসমাঈল) একজন নবী এবং তুমি একজন নবীর স্ত্রী। তাহ’লে কিসে তোমার উপরে সে গর্ব করছে? অতঃপর তিনি হাফছাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আল্লাহকে ভয় কর হে হাফছা’![10]
(গ) আয়েশা (রাঃ) বলেন, লোকেরা আয়েশার পালার দিন ঠিক রাখত। ঐদিন তারা রাসূল (ছাঃ)-কে খুশী করার জন্য নানাবিধ হাদিয়া পাঠাতো। স্ত্রীগণ দু’দলে বিভক্ত ছিলেন। সওদা, আয়েশা, হাফছা. ও ছাফিয়া এক দলে এবং উম্মে সালামাহ ও বাকীগণ আরেক দলে। শেষোক্ত দলের স্ত্রীগণের অনুরোধে উম্মে সালামাহ রাসূল (ছাঃ)-কে একদিন বললেন, আপনি লোকদের বলে দিন, তারা যেন আপনি যেদিন যে স্ত্রীর কাছে থাকেন, সেদিন সেখানে হাদিয়া পাঠায়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, হে উম্মে সালামাহ! তুমি আমাকে আয়েশার ব্যাপারে কষ্ট দিয়ো না। উম্মে সালামা তওবা করলেন। পরে তারা উক্ত বিষয়ে ফাতেমাকে রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে পাঠালেন। সেখানেও রাসূল (ছাঃ) একই জবাব দিলেন এবং বললেন, ফাতেমা! আমি যা পসন্দ করি, তুমি কি তা পসন্দ করো না? তাহ’লে তুমি আয়েশাকে ভালোবাস।[11]
৯. যুহদ ও দুনিয়াত্যাগী জীবন (الزهد والتعبد فى العائلة) : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) অত্যন্ত সরল-সহজ ও সাধাসিধা জীবন যাপন করতেন। তিনি স্বেচ্ছায় দরিদ্রতা অবলম্বন করেছিলেন। তিনি বলতেন, اللَّهُمَّ أَحْيِنِىْ مِسْكِيْنًا وَأَمِتْنِىْ مِسْكِيْنًا وَاحْشُرْنِىْ فِىْ زُمْرَةِ الْمَسَاكِيْنِ ‘হে আল্লাহ! তুমি আমাকে মিসকীনী হালে বাঁচিয়ে রাখো ও মিসকীনী হালে মৃত্যু দান কর এবং আমাকে মিসকীনদের সাথে পুনরুত্থিত কর’।[12] তিনি বলতেন, اللَّهُمَّ ارْزُقْ آلَ مُحَمَّدٍ قُوتًا ‘হে আল্লাহ! তুমি মুহাম্মাদের পরিবারকে পরিমিত আহার দান কর। যা ক্ষুধা নিবৃত্ত করে’ (বুখারী হা/৬৪৬০)। অভাবে-অনটনে, দুঃখে-বেদনায়, সর্বাবস্থায় তিনি কঠিন ধৈর্য অবলম্বন করতেন। এমনকি ক্ষুধার যন্ত্রণা হ্রাস করার জন্য তিনি কখনো কখনো পেটে পাথর বেঁধে রাখতেন’ (ছহীহাহ হা/১৬১৫)। তিনদিন না খেয়ে পেটে পাথর বেঁধে সৈন্যদের সাথে অবর্ণনীয় কষ্টে খন্দক খোঁড়ার কাজে তিনি অংশ নিয়েছেন (বুখারী হা/৪১০১)। রাসূল (ছাঃ)-এর খাদেম হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, فَمَا أَعْلَمُ النَّبِىَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رَأَى رَغِيْفًا مُرَقَّقًا حَتَّى لَحِقَ بِاللهِ، وَلاَ رَأَى شَاةً سَمِيْطًا بِعَيْنِهِ قَطُّ ‘আমি জানি না, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আল্লাহর সাথে মিলিত হওয়ার আগ পর্যন্ত কখনো কোন পাতলা নরম রুটি দেখেছেন কিংবা কোন আস্ত ভুনা বকরী দেখেছেন’।[13] আয়েশা ছিদ্দীকা (রাঃ) বলেন, মদীনায় আসার পর থেকে রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যু পর্যন্ত মুহাম্মাদের পরিবার কখনো তিনদিন একটানা রুটি খেতে পায়নি।[14] অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘পরপর দু’মাস অতিবাহিত হয়ে তৃতীয় মাসের চাঁদ উদিত হ’ত, অথচ নবীগৃহে কোন (চুলায়) আগুন জ্বলতো না’ (অর্থাৎ মাসভর চুলা জ্বলতো না)। ভগিনীপুত্র উরওয়া বিন যুবায়ের (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, খালাম্মা! مَا كَانَ يُعِيشُكُمْ ‘তাহ’লে কি খেয়ে আপনারা জীবন ধারণ করতেন? তিনি বলেন, الْأَسْوَدَانِ التَّمْرُ وَالْمَاءُ ‘দু’টি কালো বস্ত্ত দিয়ে- খেজুর ও পানি’।[15] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলতেন, قَدْ أَفْلَحَ مَنْ أَسْلَمَ وَرُزِقَ كَفَافًا وَقَنَّعَهُ اللهُ بِمَا آتَاهُ ‘ঐ ব্যক্তি সফলকাম, যে মুসলমান হ’ল। যে পরিমিত আহার পেল এবং তাকে আল্লাহ যা দিয়েছেন, তাতে সন্তুষ্ট থাকল’।[16]
একবার আবু হুরায়রা (রাঃ) একদল লোকের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। যাদের সামনে একটা ভুনা বকরী ছিল। তারা তাঁকে খাওয়ার জন্য দাওয়াত দিলেন। কিন্তু তিনি অস্বীকার করে বললেন, خَرَجَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم مِنَ الدُّنْيَا وَلَمْ يَشْبَعْ مِنَ الْخُبْزِ الشَّعِيرِ ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দুনিয়া থেকে বিদায় হয়ে গেছেন। অথচ কখনো একটি যবের রুটি দিয়েও পরিতৃপ্ত হননি’।[17] আনাস (রাঃ) বলেন, ‘রাসূল (ছাঃ)-এর পরিবারের নিকট কোন সন্ধ্যাতেই এক ছা‘ গম বা কোন খাদ্য দানা (&আগামীকালের জন্য) অবশিষ্ট থাকত না। অথচ তাঁর স্ত্রী ছিলেন নয় জন’ (অর্থাৎ যা পেতেন সবই দান করে দিতেন। জমা রাখতেন না)।[18] মৃত্যুর সময় রাসূল (ছাঃ)-এর লৌহবর্মটি এক ইহূদীর নিকটে ৩০ ছা‘ (৭৫ কেজি) যবের বিনিময়ে বন্ধক ছিল।[19] নবীজীবনের সর্বশেষ রাতেও স্ত্রী আয়েশাকে চেরাগ জ্বালাতে তার সতীনদের নিকট থেকে তৈল চেয়ে নিতে হয়েছিল।[20]
ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) বলেন, ‘আমি একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে দেখলাম, তিনি একটা খেজুর পাতার চাটাইয়ের উপর শুয়ে আছেন। যাতে কোন ফরাশ বা চাদর নেই। তাঁর দেহে চাটাইয়ের দাগ বসে গিয়েছিল। তাঁর মাথার নীচে খেজুর গাছের ছোবড়া ভর্তি একটি চামড়ার বালিশ। তাঁর দেহে চাটাইয়ের দাগ দেখে আমি কাঁদতে লাগলাম। তিনি বললেন, তুমি কেন কাঁদছ? আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! পারসিক ও রোমকরা কোন অবস্থায় আছে। আর আপনি কোন অবস্থায়? তখন তিনি বললেন, أَمَا تَرْضَى أَنْ تَكُونَ لَهُمُ الدُّنْيَا وَلَنَا الآخِرَةُ ‘তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, তাদের জন্য দুনিয়া এবং আমাদের জন্য আখেরাত? (বুখারী হা/৪৯১৩)। আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একটি চাটাইয়ের উপরে শুতেন। অতঃপর যখন দাঁড়াতেন, তখন তাঁর পার্শ্বদেশে ঐ চাটাইয়ের দাগ পড়ে যেত। আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা কি আপনার জন্য একটি তোষক বানিয়ে দেব না? জবাবে তিনি বললেন, مَا لِى وَمَا لِلدُّنْيَا مَا أَنَا فِى الدُّنْيَا إِلاَّ كَرَاكِبٍ اسْتَظَلَّ تَحْتَ شَجَرَةٍ ثُمَّ رَاحَ وَتَرَكَهَا ‘আমার জন্য বা দুনিয়ার জন্য কি প্রয়োজন? দুনিয়াতে আমি একজন সওয়ারীর ন্যায়। যে একটি গাছের ছায়ায় বিশ্রাম করছে। অতঃপর রওয়ানা হবে এবং ঐ গাছটিকে ছেড়ে যাবে’ (তিরমিযী হা/২৩৭৭)। মূলতঃ এসবই ছিল তাঁর যুহ্দ বা দুনিয়াত্যাগী চরিত্রের অনন্য পরিচয়।
ইবাদত (التعبد): তিনি ফরয ছালাত ছাড়াও নফল ছালাতে গভীরভাবে নিমগ্ন হ’তেন। শেষ রাত্রিতে তাহাজ্জুদ ছালাত তাঁর জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত ছিল (মুযযাম্মিল ৭৩/২-৩; ইসরা ১৭/৭৯)। দীর্ঘক্ষণ ছালাতে দাঁড়ানোর ফলে তাঁর দুই পা ফুলে যেত। তা দেখে তাঁকে বলা হ’ল, হে আল্লাহর রাসূল! غَفَرَ اللهُ لَكَ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِكَ وَمَا تَأَخَّرَ ‘আল্লাহ আপনার আগে-পিছের সকল গোনাহ মাফ করে দিয়েছেন। জবাবে তিনি বলতেন, أَفَلاَ أَكُونُ عَبْدًا شَكُورًا ‘আমি কি আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দা হব না? (বুখারী হা/১১৩০)। এছাড়া যখনই তিনি কোন কষ্টে পড়তেন, তখনই নফল ছালাতে রত হ’তেন (আবুদাঊদ হা/১৩১৯)।
তিনি নিয়মিত নফল ছিয়াম রাখতেন। যেমন প্রতি সোম ও বৃহস্পতিবার,[21] প্রতি চান্দ্রমাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ আইয়ামে বীযের নফল ছিয়াম (তিরমিযী হা/৭৬১), আরাফাহ ও আশূরার ছিয়াম (মুসলিম হা/১১৬২), শা‘বানের প্রায় পুরা মাস (মুসলিম হা/১১৫৬) এবং রামাযানের এক মাস ফরয ছিয়াম শেষে শাওয়ালের ৬টি নফল ছিয়াম (মুসলিম হা/১১৬৪)। তিনি বলতেন, مَنْ صَامَ يَوْمًا فِى سَبِيلِ اللهِ بَعَّدَ اللهُ وَجْهَهُ عَنِ النَّارِ سَبْعِينَ خَرِيفًا ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় একদিন ছিয়াম রাখে, আল্লাহ তার চেহারাকে জাহান্নামের আগুন থেকে ৭০ বছরের পথ দূরে রাখেন’।[22] তিনি বলতেন, তুমি ঘুমাও ও ইবাদত কর। নিশ্চয় তোমার উপর তোমার দেহের হক রয়েছে। চোখের হক রয়েছে। স্ত্রীর হক রয়েছে। সাক্ষাৎপ্রার্থীর হক রয়েছে। আর যে ব্যক্তি প্রতিদিন ছিয়াম রাখে, সেটি কোন ছিয়ামই নয়’। অর্থাৎ তার ছিয়াম কবুল হয় না।[23] এর মধ্যে সন্ন্যাসবাদের প্রতিবাদ রয়েছে। যা খ্রিষ্টানদের আবিষ্কার (হাদীদ ৫৭/২৭)।
উপরের বিস্তারিত আলোচনায় রাসূল (ছাঃ)-এর দুনিয়াত্যাগী চরিত্র এবং অতুলনীয় সংযম সাধনার পরিচয় পাওয়া যায়।
১০. পারিবারিক কিছু শিক্ষণীয় ঘটনাবলী (بعض الوقائع العائلية الاعةبارية) :
কঠিন সংযম ও কৃচ্ছতা সাধনের মধ্যে জীবন যাপন করেও পবিত্রা স্ত্রীগণ কখনো অসন্তুষ্টি ভাব প্রকাশ করতেন না। বরং সর্বদা মহান স্বামীর সাহচর্যে হাসিমুখে দাম্পত্য জীবন যাপন করতেন। তবে দু’একটি ঘটনা এমন ছিল যা রাসূল (ছাঃ)-এর ইচ্ছার বিরুদ্ধে ছিল এবং তাতে তিনি দুঃখিত হয়েছিলেন। শরী‘আতী বিধান চালু করার লক্ষ্যে আল্লাহর বিশেষ ইচ্ছায় এরূপ ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। যার মধ্যে রয়েছে উম্মতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ। যেমন-
(১) ৫ম হিজরীতে খন্দক যুদ্ধের পর বনু কুরায়যার বিজয় এবং গণীমতের বিপুল মালামাল প্রাপ্তির ফলে মুসলমানদের মধ্যে স্বাচ্ছন্দ্য ফিরে আসে। এ প্রেক্ষিতে পবিত্রা স্ত্রীগণ রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে তাদের ভরণ-পোষণের পরিমাণ বৃদ্ধির আবেদন জানান। এতে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) মর্মাহত হন এবং তাদেরকে তালাক গ্রহণের এখতিয়ার প্রদান করেন। উক্ত মর্মে আয়াতে ‘তাখয়ীর’ (آية التخيير) নাযিল হয় (আহযাব ৩৩/২৮-২৯)।
উক্ত আয়াত নাযিলের পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আয়েশাকে তার পিতা-মাতার সঙ্গে পরামর্শ করতে বললে তিনি বলে ওঠেন, فَفِى أَىِّ هَذَا أَسْتَأْمِرُ أَبَوَىَّ فَإِنِّى أُرِيدُ اللهَ وَرَسُولَهُ وَالدَّارَ الآخِرَةَ، قَالَتْ ثُمَّ فَعَلَ أَزْوَاجُ النَّبِىِّ- صلى الله عليه وسلم- مِثْلَ مَا فَعَلْتُ- ‘এজন্য পিতা-মাতার সাথে পরামর্শের কি আছে? আমি তো আল্লাহ ও তাঁর রাসূল এবং আখেরাতকে কবুল করে নিয়েছি’। তিনি বলেন, অতঃপর অন্যান্য স্ত্রীগণ সকলেই আমার পথ অনুসরণ করলেন’।[24]
(২) একবার দু’জন স্ত্রীর উপর কোন কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে রাসূল (ছাঃ) কসম করেন যে, তাদের থেকে একমাস বিরত থাকবেন এবং তা যথারীতি কার্যকর হয়। যা ঈলা-র ঘটনা (قصة الإيلاء) নামে প্রসিদ্ধ।[25]
(৩) একবার মধু খাওয়ার ঘটনায় স্ত্রীদের কাউকে খুশী করার জন্য তা আর খাবেন না বলে কসম করেন। এভাবে হালালকে হারাম করায় আল্লাহপাক তাকে সতর্ক করে দিয়ে সূরা তাহরীম ১ম আয়াতটি (آية التحريم) নাযিল করেন।[26]
উপরোক্ত ঘটনাবলীতে পুণ্যবতী স্ত্রীগণের এই বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়েছে যে, তারা সুখে-দুঃখে সর্বাবস্থায় পুণ্যবান স্বামীর একনিষ্ঠ অনুসারী হয়ে থাকেন। এর দ্বারা আরেকটি বিষয় প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) মানুষ হিসাবে মানবীয় রাগ-অভিমান ও দুঃখ-বেদনার অধিকারী ছিলেন। স্বামী-স্ত্রীর প্রেমের সম্পর্ক এসবের মাধ্যমে ঝালাই হয়ে আরও দৃঢ়তর হয়। রাসূল (ছাঃ) ও তাঁর পবিত্রা স্ত্রীগণের মধ্যকার এ ধরনের ঘটনা তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। ভবিষ্যতে কোন মুমিন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এরূপ ঘটনা ঘটলে তারা যেন রাসূল-পত্নীদের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করেন এবং সংসার ভেঙ্গে না দিয়ে আরও মযবুত করেন, সেদিকে পথপ্রদর্শনের জন্যই দৃষ্টান্ত হিসাবে আল্লাহর ইচ্ছায় উক্ত ঘটনা সমূহ সংঘটিত হয়।
বস্ত্ততঃ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও তাঁর পুণ্যবতী স্ত্রীগণের মধ্যকার সম্পর্ক ছিল উন্নত আদর্শ চেতনার উপরে প্রতিষ্ঠিত। দুনিয়া ও আখেরাতে সর্বাবস্থায় তাঁরা নবীপত্নী হিসাবে বরিত।[27] তাই দুনিয়াবী ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য তাঁরা কখনোই আখেরাতের বৃহত্তর স্বার্থ বিকিয়ে দিতে পারেন না। দুনিয়াতে তাঁরা ছিলেন রাসূল (ছাঃ)-এর পারিবারিক জীবনের বিশ্বস্ততম সাক্ষী এবং তাদের মাধ্যমেই উম্মতে মুহাম্মাদী ইসলামের পারিবারিক ও অন্যান্য বিধানসমূহ জানতে পেরে ধন্য হয়েছে। এদিক দিয়ে বিবেচনা করলে তাঁরা কেবল নবীপত্নী ছিলেন না, বরং তারা ছিলেন উম্মতের শিক্ষিকা ও নক্ষত্রতুল্য দৃষ্টান্ত। নিঃসন্দেহে নবীর সঙ্গে নবীপত্নীগণের সম্পর্ক ও আচার-আচরণ ছিল অতীব মধুর এবং আখেরাতের চেতনায় উজ্জীবিত।
[2]. বুখারী হা/৫২১৬; মুসলিম হা/১৪৭৪।
[3]. হাকেম হা/২৭৬০; আবুদাঊদ হা/২১৩৪-৩৫; ইরওয়া হা/২০১৮-২০; বুখারী হা/৫২১২; মুসলিম হা/১৪৬৩ (৪৭); তিরমিযী তুহফাসহ হা/১১৪০; মিশকাত হা/৩২২৯-৩০, ৩২৩৫ ‘বিবাহ’ অধ্যায় ‘পালা বণ্টন’ অনুচ্ছেদ।
[4]. (جَاءَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَشِقُّهُ سَاقِطٌ) তিরমিযী হা/১১৪১; ইবনু মাজাহ হা/১৯৬৯; মিশকাত হা/৩২৩৬।
[5]. বুখারী হা/২৫৯৩; মুসলিম হা/২৭৭০; মিশকাত হা/৩২৩২।
[6]. বুখারী হা/৩৮১৮; মুসলিম হা/২৪৩৫; মিশকাত হা/৬১৭৭।
[7]. মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক হা/১৪৪৬৯; মুসলিম হা/১৫৫১ (২); আড়াই কেজিতে এক মাদানী ছা‘ এবং ৬০ ছা‘-তে এক অসাক্ব। যার পরিমাণ ১৫০ কেজি।
[8]. রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ২/১৪২।
[9]. আবুদাঊদ হা/৪৬০২; মিশকাত হা/৫০৪৯; ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব হা/২৮৩৫, সনদ হাসান।
[10]. তিরমিযী হা/৩৮৯৪; নাসাঈ হা/৩২৫২; মিশকাত হা/৬১৮৩, সনদ ছহীহ।
[11]. বুখারী হা/২৫৮১; মুসলিম হা/২৬০৩; মিশকাত হা/৬১৮০ ‘মর্যাদা সমূহ’ অধ্যায়-৩০, ‘নবীপত্নীগণের মর্যাদা’ অনুচ্ছেদ-১১।
[12]. তিরমিযী হা/২৩৫২; বায়হাক্বী-শু‘আবুল ঈমান হা/১৪৫৩; মিশকাত হা/৫২৪৪; ছহীহাহ হা/৩০৮।
[13]. বুখারী হা/৫৪২১; মিশকাত হা/৪১৭০ ‘খাদ্য সমূহ’ অধ্যায়।
[14]. বুখারী হা/৫৪১৬ ‘খাদ্য সমূহ’ অধ্যায়-৭০ অনুচ্ছেদ-২৩; মুসলিম হা/২৯৭০।
[15]. বুখারী হা/৬৪৫৯ ‘রিক্বাক্ব’ অধ্যায় ‘রাসূল ও ছাহাবীদের জীবন যাপন কেমন ছিল’ অনুচ্ছেদ-১৭।
[16]. মুসলিম হা/১০৫৪; মিশকাত হা/৫১৬৫।
[17]. বুখারী হা/৫৪১৪; মিশকাত হা/৫২৩৮।
[18]. বুখারী হা/২০৬৯; মিশকাত হা/৫২৩৯।
[19]. বুখারী হা/২৯১৬; মিশকাত হা/২৮৮৫ ‘বন্ধক’ অনুচ্ছেদ।
[20]. ত্বাবারাণী কাবীর হা/৫৯৯০; ছহীহ আত-তারগীব হা/৯২৭।
[21]. তিরমিযী হা/৭৪৫; নাসাঈ হা/২৩৬৪; মিশকাত হা/২০৫৫।
[22]. বুখারী হা/২৮৪০; মিশকাত হা/২০৫৩।
[23]. বুখারী হা/১৯৭৫; মিশকাত হা/২০৫৪।
[24]. বুখারী হা/৪৭৮৫-৮৬; মুসলিম হা/১৪৭৫; মিশকাত হা/৩২৪৯; আহযাব ৩৩/২৮-২৯।
[25]. বুখারী হা/১৯১১; মুসলিম হা/১০৮৩, ১৪৭৯; মিশকাত হা/৩২৪৮; বাক্বারাহ ২/২২৬; তাহরীম ৬৬/৪।
[26]. তাহরীম ৬৬/১; বুখারী হা/৪৯১২।
[27]. আহযাব ৩৩/৩৩, ৫৩; যুখরুফ ৪৩/৭০ আয়াতের মর্মার্থ।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর দেহাবয়ব ছিল (১) মধ্যম গড়নের অতীব সুন্দর ও সুঠাম এবং গায়ের রং ছিল উজ্জ্বল ও গৌর-গোলাপী।[1] (২) প্রশস্ত মুখমণ্ডল এবং ঘন পাপড়িযুক্ত কিঞ্চিত রক্তাভ পটলচেরা সুরমা চক্ষু।[2] (৩) দীর্ঘ গ্রীবাবিশিষ্ট বড় আকৃতির মাথা।[3] যা ছিল ঘনকৃষ্ণ কেশশোভিত। যা না অধিক কোঁকড়ানো, না অধিক খাড়া।[4] যা বাবরী ছিল।[5] (৪) মৃত্যু অবধি মাথার মাঝখানের কিছু চুল, ঠোটের নিম্ন দেশের এবং চোখ ও কানের মধ্যবর্তী দাড়ির ও কানের মধ্যকার কিছু চুল শ্বেতবর্ণ ধারণ করেছিল।[6] সেকারণ তিনি চুলে খেযাব লাগাতেন না।[7] আনাস (রাঃ) বলেন, মৃত্যুকালে রাসূল (ছাঃ)-এর চুল ও দাড়ির বিশটি চুলও পাকেনি’।[8] তিনি নিয়মিত চিরুনী ব্যবহার করতেন এবং মাথার চুল দু’দিকে ভাগ করে দিতেন (তাতে মাঝখানে সিঁথি হয়ে যেত)[9] (৫) গোফ ছোট ও দাড়ি ছিল দীর্ঘ ও ঘন সন্নিবেশিত।[10] (৬) তিনি ছিলেন প্রশস্ত কাঁধ বিশিষ্ট।[11] যার বাম স্কন্ধমূলে ছিল কবুতরের ডিম্বাকৃতির ছোট্ট মাংসপিন্ড, যা ‘মোহরে নবুঅত’ বলে খ্যাত। যা ছিল গাত্রবর্ণ থেকে পৃথক সবুজ বা কালচে চর্মতিল সমষ্টি।[12] (৭) প্রসারিত বক্ষপুট হতে নাভিদেশ পর্যন্ত ছিল স্বল্প লোমের প্রলম্বিত রেখা।[13] (৮) দেহের জোড় সমূহ ছিল বড় আকারের এবং পায়ের পাতা ও হস্ত তালুদ্বয় ছিল মাংসল।[14] (৯) এছাড়া হাতের তালুদ্বয় ছিল প্রশস্ত ও মোলায়েম।[15] আর পায়ের গোড়ালি ছিল পাতলা।[16] চলার সময় সামনের দিকে সামান্য ঝুঁকে চলতেন। যেন কোন ঢালু স্থানে অবতরণ করছেন।[17] (১১) দেহ নিঃসৃত স্বেদবিন্দু সমূহ মুক্তার ন্যায় পরিদৃষ্ট হ’ত। যা ছিল মিশকে আম্বরের চাইতে সুগন্ধিময়।[18] (১২) প্রফুল্ল অবস্থায় তাঁর মুখমণ্ডল চন্দ্রের ন্যায় চমকিত হ’ত।[19] রাগান্বিত হ’লে তাঁর চেহারার গন্ডদ্বয় ডালিমের ন্যায় রক্তিম বর্ণ ধারণ করত।[20] (১৩) শক্ত, সমর্থ ও শক্তিশালী দেহ সৌষ্ঠবের অধিকারী এই সুন্দর মানুষটির দেহ বৃদ্ধ বয়সে কিছুটা ভারি হয়ে গিয়েছিল।[21]
(ক) রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্দর চেহারার প্রশংসায় আবুবকর ছিদ্দীক (রাঃ) বলতেন,
أَمِينٌ مُصْطَفًى لِلْخَيْرِ يَدْعُو + كَضَوْءِ الْبَدْرِ زَايَلَهُ الظَّلاَمُ
‘বিশ্বস্ত, মনোনীত, কল্যাণের দিকে যিনি সদা আহবান করেন। পূর্ণচন্দ্রের জ্যোতির ন্যায় যা অন্ধকার দূরীভূত করে’।[22]
(খ) ওমর ফারূক (রাঃ) রাসূল (ছাঃ)-এর চেহারা দেখে মু‘আল্লাক্বাখ্যাত জাহেলী কবি যুহায়ের বিন আবু সুলমার নিম্নোক্ত কবিতা পাঠ করতেন, যা কবি তার নেতা হারাম বিন সেনানের প্রশংসায় বলেছিলেন।-
لَوْ كُنْتَ مِنْ شَيْءٍ سِوَى بَشَرٍ + كُنْتَ الْمُضِيَّ لِلَيْلَةِ الْبَدْرِ
‘যদি আপনি মানুষ ব্যতীত অন্য কিছু হ’তেন, তাহ’লে আপনিই পূর্ণিমার রাত্রির জন্য আলো দানকারী হ’তেন’।[23]
(গ) কা‘ব বিন মালেক (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন আনন্দিত হ’তেন, তখন তাঁর চেহারা উজ্জ্বল হয়ে যেন চন্দ্রের টুকরা (قِطْعَةُ قَمَرٍ) হয়ে যেত’।[24]
(ঘ) হযরত আলী (রাঃ) এবং অন্যান্য প্রশংসাকারীর ভাষায় রাসূল (ছাঃ) ছিলেন, لَمْ أَرَ قَبْلَهُ وَلاَ بَعْدَهُ مِثْلَهُ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ‘তাঁর পূর্বে ও পরে তাঁর ন্যায় সুন্দর কাউকে আমি দেখিনি’।[25] ফারসী কবির ভাষায়,
حسن يوسف دم عيسى يد بيضا دارى + آنچہ خوبہ ہم دارند توتنها دارى
‘ইউসুফের রূপ, ঈসার ফুঁক ও মূসার শুভ্র তালু
সবই আছে তোমার মাঝে হে প্রিয় রাসূল’।
[2]. মুসলিম হা/২৩৩৯; মিশকাত হা/৫৭৮৪। জাবের (রাঃ) হ’তে। বায়হাক্বী, ছহীহুল জামে‘ হা/৪৬২১। আলী (রাঃ) হ’তে।
[3]. তিরমিযী হা/৩৬৩৭, মিশকাত হা/৫৭৯০। আনাস (রাঃ) হ’তে।
[4]. বুখারী হা/৩৫৪৭; মুসলিম হা/২৩৪৭। আনাস (রাঃ) হ’তে।
[5]. মুসলিম হা/২৩৩৮, মিশকাত হা/৫৭৮২। জাবের (রাঃ) হ’তে।
[6]. বুখারী হা/৩৫৪৫, মুসলিম হা/২৩৪১, নাসাঈ হা/৫০৮৭। আনাস (রাঃ) হ’তে।
[7]. আহমাদ হা/১৩৩৯৬, সনদ ছহীহ। আনাস (রাঃ) হ’তে।
[8]. বুখারী হা/৩৫৪৭; মুসলিম হা/২৩৪৭। আনাস (রাঃ) হ’তে।
[9]. বুখারী হা/৩৫৫৮; মুসলিম হা/২৩৩৬; মিশকাত হা/৪৪২৫, ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে।
[10]. মুসলিম হা/২৩৪৪, নাসাঈ হা/৫২৩২, মিশকাত হা/৫৭৭৯। জাবের (রাঃ) হ’তে।
[11]. বুখারী হা/৩৫৫১, মুসলিম হা/২৩৩৭, মিশকাত হা/৫৭৮৩। বারা বিন ‘আযেব (রাঃ) হ’তে।
[12]. মুসলিম হা/২৩৪৪, ২৩৪৬, মিশকাত হা/৫৭৮০, আব্দুল্লাহ বিন সারজিস (রাঃ) হ’তে।
[13]. তিরমিযী হা/৩৬৩৭, মিশকাত হা/৫৭৯০। আলী (রাঃ) হ’তে।
[14]. তিরমিযী হা/৩৬৩৭, মিশকাত হা/৫৭৯০। আলী (রাঃ) হ’তে।
[15]. বুখারী হা/৩৫৬১, ৫৯০৭। আনাস (রাঃ) হ’তে।
[16]. মুসলিম হা/২৩৩৯। জাবের (রাঃ) হ’তে।
[17]. তিরমিযী হা/৩৬৩৭, মুসলিম হা/২৩৩০; মিশকাত হা/৫৭৮৭, ৫৭৯০। আলী ও আনাস (রাঃ) হ’তে।
[18]. বুখারী হা/১৯৭৩, মুসলিম হা/২৩৩০, মিশকাত হা/৫৭৮৭। আনাস (রাঃ) হ’তে।
একবার গ্রীষ্মের দুপুরে ঘুমন্ত রাসূল (ছাঃ)-এর দেহনিঃসৃত ঘর্মসমূহ বাটিতে জমা করেছিলেন খালা উম্মে সুলায়েম (রাঃ)। রাসূল (ছাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আমি এগুলি আমাদের সুগন্ধির সাথে মিশাবো। কেননা এগুলি অধিক সুগন্ধিময়’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, তিনি বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! এর ব্যবহারের দ্বারা আমরা আমাদের বাচ্চাদের জন্য বরকত আশা করি। রাসূল (ছাঃ) বললেন, তুমি ঠিকই করেছ’ (মুসলিম হা/২৩৩১, মিশকাত হা/৫৭৮৮, উম্মে সুলায়েম (রাঃ) হ’তে)।
[19]. বুখারী হা/৩৫৫৬, মুসলিম হা/২৭৬৯, মিশকাত হা/৫৭৯৮।
[20]. তিরমিযী হা/২১৩৩, মিশকাত হা/৯৮।
[21]. মুসলিম হা/৭৩২, মিশকাত হা/১১৯৮।
[22]. বায়হাক্বী, দালায়েলুন নবুঅত হা/২৩৮, ১/২৭০ পৃঃ।
[23]. বায়হাক্বী, দালায়েলুন নবুঅত ১/৩০১; কানযুল ‘উম্মাল হা/১৮৫৭০; ছাখাবী, আল-ওয়াফী বিল অফায়াত ২৯ পৃঃ।
[24]. বুখারী হা/৩৫৫৬; মিশকাত হা/৫৭৯৮ ‘ফাযায়েল ও শামায়েল’ অধ্যায় ২ অনুচ্ছেদ।
[25]. তিরমিযী হা/৩৬৩৭; মিশকাত হা/৫৭৯০; ইবনু হিশাম ১/৪০২।
শায়খ ছফিউর রহমান মুবারকপুরী (রহঃ) আলী (রাঃ)-এর বরাতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর দেহ সৌষ্ঠব বর্ণনায় যে দীর্ঘ হাদীছটি এনেছেন, সেটি যঈফ (তিরমিযী হা/৩৬৩৮; আর-রাহীক্ব ৪৭৯-৮০ পৃঃ; ঐ, তা‘লীক্ব ১৯৩ পৃঃ)। (২) একইভাবে আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে ‘রাসূল (ছাঃ)-এর চেহারায় যেন সূর্য খেলা করত’ মর্মে যে হাদীছ এনেছেন, সেটিও যঈফ (তিরমিযী হা/৩৬৪৮, আর-রাহীক্ব ৪৮১; ঐ, তা‘লীক্ব ১৯৩-৯৪ পৃঃ)। (৩) জাবের বিন সামুরাহ (রাঃ) থেকে ‘তাঁর পায়ের নলা সরু ছিল’... বলে যে হাদীছ এনেছেন, তা যঈফ (তিরমিযী হা/৩৬৪৫, আর-রাহীক্ব ৪৮২ পৃঃ, ঐ, তালীক্ব ১৯৪ পৃঃ)। (৪) জাবের (রাঃ) থেকে ‘তিনি রাস্তায় চলার সময় পিছনের ব্যক্তি তার দেহ থেকে সুগন্ধি পেত’... বলে যে হাদীছটি এনেছেন, তা যঈফ (দারেমী হা/৬৬; আর-রাহীক্ব ৪৮২ পৃঃ; ঐ, তালীক্ব ১৯৪ পৃঃ)। তবে রাসূল (ছাঃ) যখন সামনে আসতেন, তখন তাঁর দেহ থেকে সুগন্ধি বের হ’ত, মর্মে বর্ণিত হাদীছটি ‘হাসান’ (আলবানী, সিলসিলা ছহীহাহ হা/২১৩৭)। (৫) ইবনু আববাস (রাঃ) থেকে ‘তার সামনের উপরস্থ দু’টি দাঁতের মাঝে ফাঁক ছিল। কথা বলার সময় সেখান থেকে নূর চমকাতো, মর্মে বর্ণিত হাদীছটি ‘খুবই যঈফ’ (দারেমী, মিশকাত হা/৫৭৯৭, যঈফাহ হা/৪২২০; আর-রাহীক্ব ৪৮২ পৃঃ; ঐ, তালীক্ব ১৯৫ পৃঃ)। (৬) হিন্দ বিন আবু হালাহ (রাঃ) থেকে রাসূল (ছাঃ)-এর গুণাবলী বর্ণনায় যে দীর্ঘ হাদীছ এনেছেন, সেটিও যঈফ (আলবানী, মুখতাছার শামায়েলে তিরমিযী হা/৬; আর-রাহীক্ব ৪৮৬-৮৭ পৃঃ; ঐ, তা‘লীক্ব ১৯৬-৯৭ পৃঃ)।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছিলেন সকল প্রকার মানবিক গুণে গুণান্বিত এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। বন্ধু ও শত্রু সকলের মুখে সমভাবে তাঁর অনুপম চরিত্র মাধুর্যের প্রশংসা বর্ণিত হয়েছে। কঠোর প্রতিপক্ষ আবু সুফিয়ান সম্রাট হেরাক্লিয়াসের সম্মুখে অকুণ্ঠ চিত্তে তাঁর সততা, আমানতদারী ও সচ্চরিত্রতার উচ্চ প্রশংসা করেছেন (বুখারী হা/৭)। আল্লাহপাক নিজেই স্বীয় রাসূলের প্রশংসায় বলেন, وَإِنَّكَ لَعَلَى خُلُقٍ عَظِيْمٍ ‘নিশ্চয়ই তুমি মহান চরিত্রের অধিকারী’ (ক্বলম ৬৮/৪)। রাসূল (ছাঃ) বলেন, بُعِثْتُ لأُتَمِّمَ مَكَارِمَ الأَخْلاَقِ ‘আমি প্রেরিত হয়েছি সর্বোত্তম চরিত্রের পূর্ণতা দানের জন্য’।[1] তাই দেখা যায়, নবুঅত-পূর্ব জীবনে সকলের নিকটে প্রশংসিত হিসাবে তিনি ছিলেন ‘আল-আমীন’ (বিশ্বস্ত, আমানতদার) এবং নবুঅত পরবর্তী জীবনে চরম শত্রুতাপূর্ণ পরিবেশেও তিনি ছিলেন ধৈর্য ও সহনশীলতা, সাহস ও দৃঢ়চিত্ততা, দয়া ও সহমর্মিতা, পরোপকার ও পরমত সহিষ্ণুতা, লজ্জা ও ক্ষমাশীলতা প্রভৃতি অনন্য গুণাবলীর জীবন্ত প্রতীক। আল্লাহ বলেন, لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِيُ رَسُوْلِ اللهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو اللهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللهَ كَثِيْرًا ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসূলের মধ্যে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ নিহিত রয়েছে, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিবসকে কামনা করে ও অধিকহারে আল্লাহকে স্মরণ করে’ (আহযাব ৩৩/২১)। তাঁর অনুপম চরিত্রমাধুর্য ও অতুলনীয় বৈশিষ্ট্যসমূহ পূর্ণভাবে বর্ণনা করা ঐরূপ অসম্ভব, যেরূপ পূর্ণচন্দ্রের সৌন্দর্য বর্ণনা করা এবং খালি চোখে আকাশের তারকারাজি গণনা করা অসম্ভব। তবুও দৃষ্টান্ত স্বরূপ কিছু চারিত্রিক নমুনা ও বৈশিষ্ট্য নিম্নে তুলে ধরা হ’ল।-
(১) বাকরীতি (تعبير الكلام) : তিনি হাসিমুখে বিশুদ্ধ, মার্জিত ও সুন্দরভাবে কথা বলতেন। যা দ্রুত শ্রোতাকে আকৃষ্ট করত। আর একেই লোকেরা ‘জাদু’ বলত। তাঁর উন্নত ও শুদ্ধভাষিতায় মুগ্ধ হয়েই ইয়ামনের যেমাদ আযদী মুসলমান হয়ে যান।[2] নিরক্ষর হওয়া সত্ত্বেও ‘তিনি ছিলেন আরব ও অনারবের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ভাষাবিদ’।[3] এমনকি ‘হাদীছ জাল হওয়ার অন্যতম নিদর্শন হ’ল তার শব্দসমূহের উচ্চ মানবিশিষ্ট না হওয়া’ (ফাৎহুল মুগীছ)। একারণেই আরবী সাহিত্যে কুরআন ও হাদীছের প্রভাব সবার উপরে। বরং বাস্তব কথা এই যে, এই ভাষার বুকে কুরআন ও হাদীছের অবস্থানের কারণেই তা বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। আর কুরআন ও হাদীছের সর্বোচ্চ বাকরীতি ও আলংকরিক বৈশিষ্ট্যের কারণেই আরবী ভাষা ও সাহিত্য সর্বোচ্চ মর্যাদায় আসীন হ’তে পেরেছে এবং ক্রমোন্নতির দিকে এগিয়ে চলেছে। অথচ হিব্রু, খালেদী, ল্যাটিন, সংস্কৃত প্রভৃতি পৃথিবীর প্রাচীন ভাষা সমূহ বিলুপ্ত হয়ে গেছে অথবা বিলুপ্তির পথে।
(২) ক্রোধ দমন শৈলী (أسلوب كظم الغيظ) : ক্রোধ দমনের এক অপূর্ব ক্ষমতা ছিল তাঁর মধ্যে। তিনি বলতেন, প্রকৃত বীর সেই, যে ক্রোধের সময় নিজেকে দমন করতে পারে।[4] আয়েশা (রাঃ) বলেন, তিনি কখনো কাউকে নিজের স্বার্থে নিজ হাতে মারেননি। কোন মহিলা বা খাদেমকে কখনো প্রহার করেননি’।[5]
(৩) হাসি-কান্না (الضحك والبكاء) : তিনি মৃদু হাস্য করতেন। কখনোই অট্টহাস্য করতেন না। সদা প্রফুল্ল থাকতেন। কখনোই গোমড়ামুখো থাকতেন না। তবে দুশ্চিন্তায় পড়লে তার ছাপ চেহারায় পড়ত এবং তখন তিনি ছালাতে রত হ’তেন।[6] ছোটখাট হালকা রসিকতা করতেন। যেমন, (ক) একদিন স্ত্রী আয়েশার নিকটে এসে তার এক বৃদ্ধা খালা রাসূল (ছাঃ)-কে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমার জন্য আল্লাহর নিকটে দো‘আ করুন যেন তিনি আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করান। জবাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, হে অমুকের মা! কোন বৃদ্ধা জান্নাতে প্রবেশ করবে না। একথা শুনে উক্ত মহিলা কাঁদতে শুরু করল। তখন আয়েশা বললেন, তাদের কি দোষ? জবাবে রাসূল (ছাঃ) বললেন, তুমি কি কুরআনে পড়োনি যে আল্লাহ বলেছেন,إِنَّا أَنْشَأْنَاهُنَّ إِنْشَاءً- فَجَعَلْنَاهُنَّ أَبْكَارًا- عُرُبًا أَتْرَابًا- لِأَصْحَابِ الْيَمِينِ ‘আমরা জান্নাতী নারীদের বিশেষরূপে সৃষ্টি করেছি’। ‘অতঃপর তাদের চিরকুমারী করেছি’। সদা সোহাগিনী, সমবয়স্কা’। ‘ডান সারির লোকদের জন্য’ (ওয়াক্বি‘আহ ৫৬/৩৫-৩৮)।[7] অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘জান্নাতবাসী নারী-পুরুষ সবাই ৩০ থেকে ৩৩ বছর বয়সী হবে’।[8]
(খ) এক সফরে তিনি দেখেন যে, মহিলাদের নিয়ে তাঁর কৃষ্ণকায় উষ্ট্রচালক গোলাম আনজাশাহ দ্রুত গতিতে উট হাঁকিয়ে চলেছে। তখন রাসূল (ছাঃ) তাকে বললেন,رُوَيْدَكَ يَا أَنْجَشَةُ، لاَ تَكْسِرِ الْقَوَارِيرَ ‘ধীরে চালাও হে আনজাশা! কাঁচের পাত্রগুলি ভেঙ্গে ফেল না’।[9] (গ) আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) আমাদের সঙ্গে মিশতেন। এমনকি আমার ছোট ভাই আবু ওমায়ের একটি ‘নুগায়ের’ অর্থাৎ লাল ঠোট ওয়ালা চড়ুই জাতীয় পাখি পুষত। যা নিয়ে সে খেলা করত। রাসূল (ছাঃ) যখন এসে তাকে খেলতে দেখতেন, তখন বলতেন, يَا أَبَا عُمَيْرٍ مَا فَعَلَ النُّغَيْرُ ‘হে আবু ওমায়ের! কি করছে তোমার নুগায়ের?[10]
ছালাতের মধ্যে বিশেষ করে তাহাজ্জুদের ছালাতে তিনি আল্লাহর ভয়ে কাঁদতেন। অভাবগ্রস্ত ব্যক্তিকে দেখলে তার অন্তর কেঁদে উঠতো এবং তার অভাব দূরীকরণে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। চাচা হামযা, কন্যা যয়নব ও পুত্র ইবরাহীমের মৃত্যুতে তিনি শিশুর মত হু হু করে কেঁদেছিলেন। তিনি অন্যের মুখে কুরআন শুনতে পসন্দ করতেন। একবার ইবনু মাসঊদের মুখে সূরা নিসা শুনে তাঁর চোখ বেয়ে অবিরল ধারে অশ্রু প্রবাহিত হয়। অতঃপর ৪১ আয়াতে পৌঁছলে তিনি তাকে থামতে বলেন।[11]
(৪) বীরত্ব ও ধৈর্যশীলতা (الشجاعة والصبر) : কঠিন বিপদের মধ্যেও তিনি দৃঢ় হিমাদ্রির ন্যায় ধৈর্যশীল থাকতেন। মাক্কী জীবনের আতংকময় পরিবেশে এবং মাদানী জীবনের প্রতি মুহূর্তে জীবনের হুমকির মধ্যেও তাঁকে কখনো ভীত-বিহবল ও অধৈর্য হ’তে দেখা যায়নি। হযরত আলী (রাঃ) বলেন, ঘনঘোর যুদ্ধের বিভীষিকার মধ্যে আমরা রাসূল (ছাঃ)-এর পিছনে গিয়ে আশ্রয় নিতাম। তিনিই সর্বদা শত্রুর নিকটবর্তী থাকতেন (আহমাদ হা/৬৫৪, সনদ ছহীহ)। শত্রুর ভয়ে যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে যাবার কোন ঘটনা তাঁর জীবনে নেই। অভাবে-অনটনে, দুঃখে-বেদনায়, সর্বাবস্থায় তিনি কঠিন ধৈর্য অবলম্বন করতেন। এমনকি তিনদিন না খেয়ে পেটে পাথর বেঁধে সৈন্যদের সাথে অবর্ণনীয় কষ্টে খন্দক খোঁড়ার কাজে অংশ নিলেও চেহারায় তার প্রকাশ ঘটতো না। বরং সৈন্যদের সাথে আখেরাতের কবিতা পাঠের মধ্য দিয়েই খুশীমনে নিজ হাতে খন্দক খুঁড়েছেন। শত্রুদের শত্রুতা যতই বৃদ্ধি পেত তাঁর ধৈর্যশীলতা ততই বেড়ে যেত। ওহোদ ও হোনায়েন যুদ্ধে তাঁর বীরত্ব ও অসম সাহসিকতা ছিল অচিন্তনীয়।
আনাস (রাঃ) বলেন, আমি একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে চলছিলাম। এসময় তাঁর উপর মোটা জরিদার একটি নাজরানী চাদর শোভা পাচ্ছিল। হঠাৎ এক বেদুঈন এসে তাঁর চাদর ধরে এমন হেচকা টান দিল যে, তিনি বেদুঈনের বুকে গিয়ে পড়েন। এতে আমি দেখলাম যে, জোরে টান দেওয়ার কারণে রাসূল (ছাঃ)-এর ঘাড়ের উপর চাদরের দাগ পড়ে গেল। অতঃপর লোকটি বলল, হে মুহাম্মাদ! আল্লাহর মাল যা তোমার কাছে আছে, তা থেকে আমাকে দেবার নির্দেশ দাও (يَا مُحَمَّدُ مُرْ لِى مِنْ مَالِ اللهِ الَّذِيْ عِنْدَكَ)। তখন রাসূল (ছাঃ) তার দিকে তাকালেন ও হাসলেন। অতঃপর তাকে কিছু দান করার জন্য আদেশ দিলেন’।[12]
উক্ত ঘটনায় রাসূল (ছাঃ)-এর অতুলনীয় ধৈর্য ও দানশীলতার প্রমাণ পাওয়া যায়। এরূপ অসংখ্য ঘটনা তাঁর জীবনে রয়েছে।
(৫) সেবা পরায়ণতা (عيادة المرضى) : কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি তার বাড়ীতে গিয়ে সেবা করতেন ও সান্ত্বনা দিতেন। তার জন্য দো‘আ করতেন। কি খেতে মন চায় শুনতেন। ক্ষতিকর না হ’লে তা দেবার ব্যবস্থা করতেন। নিজের ইহূদী কাজের ছেলেটি অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি তার বাড়ীতে গিয়ে তাকে সান্ত্বনা দেন ও পরিচর্যা করেন। এ সময় তিনি বলেন, তুমি ইসলাম কবুল কর। তখন ছেলেটি তার বাপের দিকে তাকাল যে তার নিকটে বসা ছিল। বাপ তাকে বলল, أَطِعْ أَبَا الْقَاسِمِ ‘তুমি আবুল ক্বাসেম-এর কথা মেনে নাও। তখন ছেলেটি কালেমা শাহাদাত পাঠ করে ইসলাম কবুল করল। অতঃপর মারা গেল। এরপর রাসূল (ছাঃ) বের হবার সময় বললেন الْحَمْدُ للهِ الَّذِى أَنْقَذَهُ بِىْ مِنَ النَّارِ ‘আল্লাহর জন্য সকল প্রশংসা, যিনি তাকে আমার মাধ্যমে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিলেন’।[13]
(৬) সহজ পন্থা অবলম্বন (اةخاذ الطريقة السهلة) : হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ)-কে যখনই দু’টি কাজের এখতিয়ার দেওয়া হ’ত, তখন তিনি সহজটি বেছে নিতেন। যদি তাতে গুনাহের কিছু না থাকত। তিনি নিজের জন্য কোন অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতেন না। কিন্তু আল্লাহর জন্য হ’লে প্রতিশোধ না নিয়ে ছাড়তেন না’।[14] ওয়ায-নছীহত করতেন, যতক্ষণ না মানুষ বিব্রতবোধ করে।[15] নফল ছালাত চুপে চুপে আদায় করতেন, যাতে অন্যের কষ্ট না হয়। তিনি বলতেন, فَاكْلَفُوْا مِنَ الْعَمَلِ مَا تُطِيْقُوْنَ ‘তোমরা এমন আমল কর, যা তোমাদের সাধ্যে কুলায়’।[16]
(৭) দানশীলতা (الجود) : যতক্ষণ তাঁর কাছে কিছু থাকত, ততক্ষণ তিনি দান করতেন। রামাযান মাসে তা হয়ে যেত كَالرِّيْحِ الْمُرْسَلَةِ ‘প্রবহমাণ বায়ুর মত’। তিনি ছাদাক্বা গ্রহণ করতেন না। কিন্তু হাদিয়া নিতেন। অথচ তা নিজের প্রয়োজনে যৎসামান্য ব্যয় করে সবই দান করে দিতেন। তিনি বলতেন,لاَ يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى يُحِبَّ لأَخِيْهِ مَا يُحِبُّ لِنَفْسِهِ ‘কেউ অতক্ষণ প্রকৃত মুমিন হ’তে পারবে না, যতক্ষণ না সে অপরের জন্য তাই-ই ভালবাসবে, যা সে নিজের জন্য ভালবাসে’।[17] তিনি বলতেন,وَلاَ يَجْتَمِعُ الشُّحُّ وَالإِيْمَانُ فِيْ قَلْبِ عَبْدٍ أَبَدًا ‘একজন বান্দার হৃদয়ে ঈমান ও কৃপণতা কখনো একত্রিত হ’তে পারে না’।[18]
(৮) লজ্জাশীলতা (الحياء) : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সর্বদা দৃষ্টি অবনত রাখতেন। কখনোই অন্যের উপরে নিজের দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেন না। তিনি কারু মুখের উপর কোন অপছন্দনীয় কথা বলতে লজ্জা পেতেন। আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, كَانَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَشَدَّ حَيَاءً مِنَ الْعَذْرَاءِ فِى خِدْرِهَا وَكَانَ إِذَا كَرِهَ شَيْئًا عَرَفْنَاهُ فِى وَجْهِهِ- ‘তিনি পর্দানশীন কুমারী মেয়েদের চাইতে অধিক লজ্জাশীল ছিলেন। যখন তিনি কিছু অপছন্দ করতেন, তখন তাঁর চেহারা দেখে আমরা বুঝে নিতাম’।[19] কারু কোন মন্দ কাজ দেখলে সরাসরি তাকে মন্দ না বলে সাধারণভাবে নিষেধ করতেন, যাতে লোকটি লজ্জা না পায়। অথচ বিষয়টি বুঝতে পেরে সে নিজেই সংশোধন হয়ে যায়।
(৯) বিনয় ও নম্রতা (التواضع والتذلل) : তিনি ছিলেন বিনয়ী ও নিরহংকার চরিত্রের মানুষ। তিনি সবাইকে মানুষ হিসাবে সমান জ্ঞান করতেন। উঁচু-নীচু ভেদাভেদ করতেন না। তাঁকে দেখে সম্মানার্থে দাঁড়াতে ছাহাবীগণকে নিষেধ করতেন।[20] দাস-দাসীদের নিকটে কখনোই অহংকার প্রকাশ করতেন না। তাদের কোন কাজে অসন্তুষ্ট হয়ে উহ্ শব্দটি করতেন না। বরং তাদের কাজে নিজে সাহায্য করতেন। আনাস (রাঃ) বলেন, আমি ১০ বছর রাসূল (ছাঃ)-এর খিদমত করেছি। কিন্তু তিনি কখনো আমাকে কোন কাজের জন্য কৈফিয়ত তলব করেননি।[21] অবশ্য তার অর্থ এটা নয় যে, অন্যায় কথা বা কাজের জন্য তিনি কাউকে ধমকাতেন না বা ভৎর্সনা করতেন না। যেমন তিনি উসামা ও খালেদকে ধমকিয়েছেন এবং তাদের ব্যাপারে তিনি দায়ী নন বলে আল্লাহর নিকট ক্ষমা চেয়েছেন।[22] তিনি সর্বদা আগে সালাম দিতেন ও মুছাফাহার জন্য আগে হাত বাড়িয়ে দিতেন। ছাহাবীগণকে সম্মান করে অথবা আদর করে কখনো কখনো তাদের উপনামে ডাকতেন। যেমন আব্দুল্লাহ বিন ওছমানকে তার উপনামে ‘আবুবকর’, আব্দুর রহমান বিন ছাখারকে ‘আবু হুরায়রা’ (ছোট বিড়ালের বাপ), আলীকে ‘আবু তোরাব’ (ধূলি ধুসরিত), হুযায়ফাকে ‘নাওমান’ (ঘুম কাতর), অতি সতর্ক ও সাবধানী হওয়ার কারণে আনাসকে ‘যুল উযনাইন’ (দুই কান ওয়ালা), সফরে অধিক বোঝা বহনকারী হিসাবে মুক্তদাস মিহরান বিন ফার্রূখ-কে ‘সাফীনাহ’ (নৌকা) বলে ডাকতেন।[23] উল্লেখ্য যে, খুশী অবস্থায় উপনামে ডাকা আরবীয় রীতি হিসাবে প্রসিদ্ধ।
(ক) দুগ্ধদায়িনী মা, রোগী, বৃদ্ধ, মুসাফির ইত্যাদি বিবেচনায় তিনি জামা‘আতে ছালাত সংক্ষেপ করতেন।[24]
(খ) রাসূল (ছাঃ)-এর ‘আযবা’ (الْعَضْبَاءُ) নাম্নী একটা উষ্ট্রী ছিল। সে এতই দ্রুতগামী ছিল যে, কোন বাহন তাকে অতিক্রম করতে পারত না। কিন্তু একদিন এক বেদুঈনের সওয়ারী আযবা-কে অতিক্রম করে গেল। বিষয়টি মুসলমানদের কাছে কষ্টদায়ক মনে হ’ল। তখন রাসূল (ছাঃ) তাদের সান্ত্বনা দিয়ে বলেন,إِنَّ حَقًّا عَلَى اللهِ أَنْ لاَ يَرْفَعَ شَيْئًا مِنَ الدُّنْيَا إِلاَّ وَضَعَهُ ‘দুনিয়াতে আল্লাহর নীতি এটাই যে, কাউকে উঁচু করলে তাকে নীচুও করে থাকেন’।[25]
(গ) জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে خَيْرُ الْبَرِيَّةِ (সৃষ্টির সেরা) বলে সম্বোধন করলে তিনি তাকে বলেন, ذَاكَ إِبْرَاهِيْمُ عَلَيْهِ السَّلاَمُ ‘তিনি হ’লেন ইবরাহীম (আঃ)’।[26]
(ঘ) একবার এক ব্যক্তি রাসূল (ছাঃ)-এর সামনে এসে ভয়ে বিহবল হয়ে পড়ে। তখন তিনি তাকে বলেন,هَوِّنْ عَلَيْكَ فَإِنِّىْ لَسْتُ بِمَلِكٍ إِنَّمَا أَنَا ابْنُ امْرَأَةٍ مِنْ قُرَيْشٍ تَأْكُلُ الْقَدِيْدَ ‘স্থির হও! আমি কোন বাদশাহ নই। আমি একজন কুরায়েশ মহিলার সন্তান মাত্র। যিনি শুকনা মাংস ভক্ষণ করতেন’।[27] উল্লেখ্য যে, আরবের গরীব লোকেরা শুকনা মাংস খেতেন। এ সকল ঘটনায় বাস্তব জীবনে রাসূল (ছাঃ)-এর বিনয় ও নম্রতা অবলম্বনের ও নিরহংকার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে।
(১০) সংসার জীবনে (فى حياته العائلية) : হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) নিজের জুতা নিজেই সেলাই করতেন ও কাপড়ে তালি লাগাতেন। নিজের কাপড় নিজেই সেলাই করতেন, সংসারের কাজ নিজ হাতে করতেন, নিজে বকরী দোহন করতেন, কাপড় ছাফ করতেন ও নিজের কাজ নিজে করতেন’।[28]
স্ত্রীদের মধ্যে আয়েশা (রাঃ) ছিলেন কুমারী ও সবচেয়ে কম বয়স্কা। তাই রাসূল (ছাঃ) কখনো কখনো সাথীদের এগিয়ে দিয়ে নিজে তার সাথে দৌড়ে পাল্লা দিতেন। তাতে আয়েশা জিতে যেতেন। আবার আয়েশা ভারী হয়ে গেলে প্রতিযোগিতায় তিনি হেরে যান’।[29] তাকে নিয়ে বিয়ে বাড়ীতে বেদুঈন মেয়েদের নাচ-গান শুনেছেন।[30] রাসূল (ছাঃ) যে কত বাস্তববাদী ও সংস্কৃতিমনা ছিলেন, এতে তার প্রমাণ মেলে। খায়বর যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে নব পরিণীতা স্ত্রী ছাফিইয়াকে উটে সওয়ার করার জন্য তিনি নীচু হয়ে নিজের হাঁটু পেতে দেন। অতঃপর ছাফিইয়াহ নবীর হাঁটুর উপরে পা রেখে উটে সওয়ার হন’।[31]
(১১) সমাজ জীবনে (فى حياةه الإجةماعية) : বন্ধুদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতেন। নিজের ও স্ত্রী সম্পর্কিত আত্মীয়-স্বজনের সাথে দৃঢ় সম্পর্ক রক্ষা করতেন। কারু ক্ষতি হতে পারে এমন কাজ হ’তে দূরে থাকতেন। পরনিন্দা ও পরচর্চা হতে বেঁচে থাকতেন। সঙ্গী-সাথীদের খোঁজ-খবর নিতেন। তিনি শত্রুদের দেওয়া কষ্টে ও মূর্খদের বাড়াবাড়িতে ধৈর্য ধারণ করতেন। তিনি মন্দকে মন্দ বলতেন ও ভালকে ভাল বলতেন। কিন্তু সর্বদা মধ্যপন্থী আচরণ করতেন।[32] তিনি সকলের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকতেন। তাঁর নিকটে লোকেদের মর্যাদার ভিত্তি ছিল তাক্বওয়া বা আল্লাহভীরুতা (আহমাদ হা/২৩৫৩৬)। সমাজের দুর্বল শ্রেণীর প্রতি তাঁর করুণা ছিল সর্বাধিক। তিনি বলতেন,اَبْغُونِىْ فِي الضُّعَفَاءِ فَإِنَّمَا تُرْزَقُوْنَ وَتُنْصَرُوْنَ بِضُعَفَائِكُمْ ‘তোমরা আমাকে দুর্বল শ্রেণীর মধ্যে তালাশ করো। কেননা তোমরা রূযিপ্রাপ্ত হয়ে থাক এবং সাহায্যপ্রাপ্ত হয়ে থাক দুর্বল শ্রেণীর মাধ্যমে’।[33] অর্থাৎ তাদের প্রতি সদাচরণের মাধ্যমে তোমরা আমার সন্তুষ্টি তালাশ কর।
সমাজ সংস্কারে তিনি জনমতের মূল্যায়ন করতেন। যেমন-
(১) কুরায়েশদের নির্মিত কা‘বাগৃহে ইবরাহীম (আঃ) নির্মিত কা‘বাগৃহ থেকে কিছু অংশ ছেড়ে রাখা হয়েছিল। ছাড়া অংশটিকে ‘রুকনে হাত্বীম’ বলা হয়। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) চেয়েছিলেন ওটাকে ইবরাহীমী ভিতের উপর কা‘বাগৃহের মধ্যে শামিল করতে এবং কা‘বাগৃহের দু’টো দরজা করতে। কিন্তু জনমত বিগড়ে যাবার ভয়ে তিনি তা করেননি। এবিষয়ে তিনি একদিন আয়েশা (রাঃ)-কে বলেন,لَوْلاَ قَوْمُكِ حَدِيْثٌ عَهْدُهُمْ بِكُفْرٍ لَنَقَضْتُ الْكَعْبَةَ فَجَعَلْتُ لَهَا بَابَيْنِ بَابٌ يَدْخُلُ النَّاسُ وَبَابٌ يَخْرُجُوْنَ، ‘যদি তোমার কওম নওমুসলিম না হ’ত, তাহ’লে আমি কা‘বা ভেঙ্গে দিতাম এবং এর দু’টি দরজা করতাম। একটি দিয়ে মুছল্লীরা প্রবেশ করত এবং অন্যটি দিয়ে বেরিয়ে যেত। কিন্তু কুরায়েশরা তা না করে অনেক উঁচুতে দরজা নির্মাণ করে। যাতে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কেউ সেখানে প্রবেশ করতে না পারে। পরবর্তীতে আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের (৬৪-৭৩ হি.) সেটি করেন’।[34]
(২) তিনি সাধ্যপক্ষে উম্মতের ঐক্য রক্ষার চেষ্টা করতেন। যেমন মুনাফিকদের অপতৎপরতা সীমা ছাড়িয়ে গেলে ওমর ফারূক (রাঃ) রাসূল (ছাঃ)-কে বলেন, আমাকে অনুমতি দিন এই মুনাফিকটাকে (ইবনু উবাইকে) শেষ করে দিই। জবাবে রাসূল (ছাঃ) বলেন, না। তাতে লোকেরা বলবে যে, মুহাম্মাদ তার সাথীদের হত্যা করছেন’।[35]
(৩) তিনি লোকদের সাথে নম্র আচরণ করতেন। বৈঠকে তিনি কোনরূপ অহেতুক ও অপ্রয়োজনীয় কথা বলতেন না। বেদুঈনদের রূঢ় আচরণে তিনি ধৈর্য অবলম্বন করতেন। বলা চলে যে, তাঁর এই বিনয়ী ব্যবহার ও অতুলনীয় ব্যক্তি মাধুর্যের প্রভাবেই রুক্ষ স্বভাবের মরুচারী আরবরা দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করেছিল। আল্লাহ বলেন, فَبِمَا رَحْمَةٍ مِّنَ اللهِ لِنْتَ لَهُمْ وَلَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِيْظَ الْقَلْبِ لَانْفَضُّوْا مِنْ حَوْلِكَ ‘আর আল্লাহর রহমতেই তুমি তাদের প্রতি (অর্থাৎ স্বীয় উম্মতের প্রতি) কোমলহৃদয় হয়েছ। যদি তুমি কর্কশভাষী ও কঠোর হৃদয়ের হ’তে, তাহ’লে তারা তোমার পাশ থেকে সরে যেত’ (আলে ইমরান ৩/১৫৯)। রাসূল (ছাঃ)-এর এই অনন্য চরিত্র মাধুর্য ছিল নিঃসন্দেহে আল্লাহর বিশেষ দান।
[2]. মুসলিম হা/৮৬৮ (৪৬); মিশকাত হা/৫৮৬০।
[3]. মুক্বাদ্দামা ফাৎহুল মুলহিম শারহু মুসলিম ১৬ পৃঃ।
[4]. বুখারী হা/৬১১৪; মুসলিম হা/২৬০৯ (১০৭); মিশকাত হা/৫১০৫ ‘শিষ্টাচার’ অধ্যায় ২০ অনুচ্ছেদ।
[5]. মুসলিম হা/২৩২৮ (৭৯); মিশকাত হা/৫৮১৮।
[6]. আবুদাঊদ হা/১৩১৯; ছহীহুল জামে‘ হা/৪৭০৩; মিশকাত হা/১৩২৫।
[7]. ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা ওয়াক্বি‘আহ ৩৫-৩৮ আয়াত; রাযীন, মিশকাত হা/৪৮৮৮, সনদ ছহীহ ‘শিষ্টাচার সমূহ’ অধ্যায় ‘ঠাট্টা করা’ অনুচ্ছেদ।
[8]. তিরমিযী হা/২৫৪৫; আহমাদ হা/২২১৫৯; ছহীহাহ হা/২৯৮৭; মিশকাত হা/৫৬৩৯।
[9]. বুখারী হা/৬২১১; মুসলিম হা/২৩২৩; মিশকাত হা/৪৮০৬।
[10]. বুখারী হা/৬১২৯; মুসলিম হা/২১৫০ (৩০); মিশকাত হা/৪৮৮৪ ‘ঠাট্টা করা’ অনুচ্ছেদ।
[11]. বুখারী হা/৫০৫০; মুসলিম হা/৮০০; মিশকাত হা/২১৯৫।
[12]. বুখারী হা/৬০৮৮; মুসলিম হা/১০৫৭; মিশকাত হা/৫৮০৩ ‘ফাযায়েল ও শামায়েল’ অধ্যায় ১ অনুচ্ছেদ।
[13]. আবুদাঊদ হা/৩০৯৫; বুখারী হা/১৩৫৬; মিশকাত হা/১৫৭৪ ‘জানায়েয’ অধ্যায় ১ অনুচ্ছেদ।
[14]. বুখারী হা/৬১২৬; মুসলিম হা/২৩২৭; মিশকাত হা/৫৮১৭ ‘ফাযায়েল ও শামায়েল’ অধ্যায় ৩ অনুচ্ছেদ।
[15]. বুখারী হা/৬৪১১; মুসলিম হা/২৮২১; মিশকাত হা/২০৭।
[16]. বুখারী হা/১৯৬৬ ‘ছওম’ অধ্যায়-৩০ ‘ছওমে বেছালে বাড়াবাড়ির শাস্তি’ অনুচ্ছেদ-৪৯।
[17]. বুখারী হা/১৩; মুসলিম হা/৪৫ (৭২); মিশকাত হা/৪৯৬১ ‘শিষ্টাচার সমূহ’ অধ্যায় ১৫ অনুচ্ছেদ।
[18]. তিরমিযী হা/১৬৩৩; নাসাঈ হা/৩১০৮; মিশকাত হা/৩৮২৮ ‘জিহাদ’ অধ্যায়।
[19]. বুখারী হা/৬১০২; মুসলিম হা/২৩২০; মিশকাত হা/৫৮১৩ ‘ফাযায়েল ও শামায়েল’ অধ্যায় ৩ অনুচ্ছেদ।
[20]. তিরমিযী হা/২৭৫৪; মিশকাত হা/৪৬৯৮।
[21]. বুখারী হা/৬০৩৮; মুসলিম হা/২৩০৯; মিশকাত হা/৫৮০১।
[22]. মুসলিম হা/৯৬; বুখারী হা/৪৩৩৯।
[23]. আবু হুরায়রা (তিরমিযী হা/৩৮৪০); আবু তোরাব (বুখারী হা/৬২০৪); নাওমান (মুসলিম হা/১৭৮৮ (৯৯); যুল-উযনাইন (আবুদাঊদ হা/৫০০২; তিরমিযী হা/১৯৯২; মিশকাত হা/৪৮৮৭); সাফীনাহ (আহমাদ হা/২১৯৭৮, সনদ হাসান; হাদীছের প্রথমাংশ মিশকাত হা/৫৩৯৫)।
[24]. বুখারী হা/৭০৩; মুসলিম হা/৪৬৭ (১৮৩); মিশকাত হা/১১৩১, ৩৪, ২৯।
[25]. বুখারী হা/৬৫০১ ‘রিক্বাক্ব’ অধ্যায়-৮১ ‘নম্রতা’ অনুচ্ছেদ-৩৮।
[26]. মুসলিম হা/২৩৬৯; মিশকাত হা/৪৮৯৬ ‘শিষ্টাচারসমূহ’ অধ্যায় ১৩ অনুচ্ছেদ।
[27]. ইবনু মাজাহ হা/৩৩১২; ছহীহাহ হা/১৮৭৬।
[28]. আহমাদ হা/২৬২৩৭; মিশকাত হা/৫৮২২ সনদ ছহীহ ‘ফাযায়েল ও শামায়েল’ অধ্যায়।
[29]. ইবনু মাজাহ হা/১৯৭৯; ছহীহাহ হা/১৩১।
[30]. বুখারী হা/৫১৯০; মুসলিম হা/৮৯২ (১৮); মিশকাত হা/৩২৪৪; বুখারী হা/৫১৪৭; মিশকাত হা/৩১৪০।
[31]. বুখারী হা/৪২১১ ‘খায়বর যুদ্ধ’ অনুচ্ছেদ ।
[32]. বুখারী হা/৩৯; মিশকাত হা/১২৪৬।
[33]. আবুদাঊদ হা/২৫৯৪; মিশকাত হা/৫২৪৬; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৭৭৯।
[34]. বুখারী হা/১২৬ ‘ইলম’ অধ্যায়-৩, অনুচ্ছেদ-৪৮; ঐ, হা/১৫৮৪ ‘হজ্জ’ অধ্যায়-২৫, অনুচ্ছেদ-৪২।
[35]. তিরমিযী হা/৩৩১৫ সনদ ছহীহ ।