ঈসায়ী ধর্ম ও পলীয় ধর্মের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য শরীয়ত পালন। ঈসা মাসীহ কঠোরভাবে শরীয়ত পালন করতেন, করতে নির্দেশ দিয়েছেন এবং শরীয়ত পালন ছাড়া মুক্তি পাওয়া যাবে না বলে প্রচার করেছেন। পক্ষান্তরে দ্রুত অধিক সংখ্যক মুরিদ যোগাড় করার লক্ষ্যে সাধু পল শরীয়ত বর্জন করতে উৎসাহ দেন এবং শরীয়ত পালনের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে সকল পাপাচারের পথ উন্মুক্ত করে দেন। শরীয়তের বিরুদ্ধে তাঁর অনেক ঘৃণ্য বক্তব্য রয়েছে। ইঞ্জিলের মধ্যে বিদ্যমান প্রেরিত পুস্তকটি এবং পরবর্তী পত্রগুলি পাঠ করলে পাঠক দেখবেন যে, তাঁর এ সকল বক্তব্য হাওয়ারী ও প্রকৃত খৃস্টানদের (Judio Christians) মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া ও প্রতিরোধ তৈরি করে। তাঁরা তার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেন। তিনিও হাওয়ারীদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার ও অপপ্রচার করতে থাকেন। ফিলিস্তিন ও পার্শবতী এলাকার শিক্ষিত মানুষদের মধ্যে ভাল ফল না পেয়ে তিনি দ্রুত এশিয়া মাইনর ও ইউরোপের গ্রীক-রোমান পৌত্তলিকদের মধ্যে তাঁর শরীয়তমুক্ত মারফতী ধর্মের দাওয়াত দিতে থাকেন। হাওয়ারী ও শরীয়ত পালনকারী খৃস্টানদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান গ্রহণের জন্য তিনি অতিভক্তিমূলক অনেক নতুন নতুন আকীদা আবিষ্কার করেন। যেহেতু নতুন আকীদাও তাদের পুরাতন পৌত্তলিক আকীদার মতই এবং নতুন কোনো বিধিবিধান মানতে হবে না, শুধু বিশ্বাসই যথেষ্ট, সেহেতু দলে দলে মুর্খ ও পাপ-প্রেমিক মানুষেরা তার মুরিদ হতে লাগলেন।
‘ব্যবস্থা’ বা ‘শরীয়তের’ বিরুদ্ধে সাধু পলের দার্শনিক ও ‘মারফতী” বক্তব্য অনেক। মন শুদ্ধ হলেই হলো। নামায বা শরীয়ত তো বিশ্বাস ঠিক করার জন্য; বিশ্বাস ঠিক হলে আর কিছুই লাগে না। শরীয়তই পাপ করো না বলে পাপের কথা মনে করিয়ে দেয়; শরীয়ত তুলে দিলে আর পাপ থাকবে না!!! ইত্যাদি। সাধুর কয়েকটি বচন শুনুন:
“শরীয়ত পালনের জন্য আল্লাহ্ মানুষকে ধার্মিক বলে গ্রহণ করেন না, বরং ঈসা মসীহের উপর ঈমানের জন্যই তা করেন। ... শরীয়ত পালন করবার ফলে কাউকেই ধার্মিক বলে গ্রহণ করা হবে না।” (গালাতীয় ২/১৬) “ব্যবস্থার কার্য ব্যতিরেকে বিশ্বাস দ্বারাই মনুষ্য ধার্মিক গণিত হয়” (রোমীয় ৩/২৮। পুনশ্চ রোমীয় ১০/১০)। “ব্যবস্থা খৃস্টের কাছে আনিবার জন্য আমাদের স্কুল মাস্টার (our schoolmaster) যেন আমরা বিশ্বাস হেতু ধার্মিক গণিত হই।” (গালাতীয় ৩/২৪)। “শাস্ত্র সকলই পাপের অধীনতায় রুদ্ধ (the scripture hath concluded all under sin) (গালাতীয় ৩/২২)। “ব্যবস্থার কার্য দ্বারা কোন প্রাণী তাঁহার সাক্ষাতে ধার্মিক গণিত হইবে না; কেননা ব্যবস্থা দ্বারা পাপের জ্ঞান জন্মে” (রোমীয় ৩/২০)। “বাস্তবিক যাহারা ব্যবস্থার (শরীয়তের) ক্রিয়াবলম্বী, তাহারা সকলে শাপের অধীন।” (গালাতীয় ৩/১০-১৩)।
তাহলে শুধু মনের বিশ্বাস ও মুখের স্বীকারোক্তি মুক্তির জন্য যথেষ্ট, শরীয়ত শুধু বিশ্বাস পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য। শরীয়ত সকলকে পাপের মধ্যে আবদ্ধ করে, শরীয়তই পাপের উৎস, শরীয়ত পালন করে কেউ ধার্মিক হতে পারে না; বরং পাপী ও অভিশপ্ত হয়। অর্থাৎ ঈসা মাসীহ -সহ সকল নবী ও তাঁদের অনুসারীরা পাপী ও অভিশপ্ত!
তিনি দাবি করেন যে, শরীয়তই সকল শত্রুতা ও হানাহানির কারণ এবং যীশু শরীয়ত বিলোপ করতে এসেছিলেন: “শত্রুতাকে, অর্থাৎ বিধিবদ্ধ আজ্ঞাকলারূপ ব্যবস্থাকে, নিজ মাংসে লুপ্ত করিয়াছেন (abolished in his flesh the enmity, even the law of commandments contained in ordinances)।” (ইফিষীয় ২/১৫)
বিধিবদ্ধ আজ্ঞা বা শরীয়ত কী? শির্ক করিও না, ব্যভিচার করিও না, হত্যা করিও না... । পলীয় খৃস্টধর্মে এগুলি মান্য করা পাপ ও অভিশাপ! তাহলে শির্ক করা, ব্যভিচার করা, হত্যা করা... ইত্যাদিই পাপ ও অভিশাপ থেকে মুক্তির উপায়!
মাসীহের বক্তব্য সাধুর বচনের সাথে সাংঘর্ষিক। শুধু বিশ্বাসে মুক্তি মিলবে তা কখনোই মাসীহ বলেন নি। শত বিশ্বাস থাকলেও সামান্যতম শরীয়ত লঙ্ঘন করলে জান্নাত মিলবে না বলে তিনি প্রচার করেছেন। তিনি বলেন: “মনে করো না আমি তৌরাত কিতাব আর নবীদের কিতাব বাতিল করতে এসেছি। আমি সেগুলো বাতিল করতে আসি নি বরং পূর্ণ করতে এসেছি। ... মূসার শরীয়তের মধ্যে ছোট একটা হুকুমও যে কেউ অমান্য করে এবং লোককে তা অমান্য করতে শিক্ষা দেয় তাকে বেহেশতী রাজ্যে সবচেয়ে ছোট বলা হবে। কিন্তু যে কেউ শরীয়তের হুকুমগুলো পালন করে ও শিক্ষা দেয় তাকে বেহেশতী রাজ্যে বড় বলা হবে। আমি তোমাদের বলছি, আলেম ও ফরীশীদের ধার্মিকতার চেয়ে তোমাদের যদি বেশী কিছু না থাকে তবে তোমরা কোনমতেই বেহেশতী রাজ্যে ঢুকতে পারবে না।” (মথি ৫/১৭-২০)
সাধু পলের দাবি: যীশু শরীয়ত লোপ করতে এসেছিলেন। কিন্তু যীশু বললেন তিনি লোপ করতে নয়, পূর্ণ করতে এসেছিলেন। সাধু পল বললেন, শরীয়ত পালনকারী পাপী ও অভিশপ্ত। আর যীশু বললেন শরীয়তের ক্ষুদ্রতম বিধান লঙ্ঘনকারী পাপী ও অভিশপ্ত। খৃস্টান ভাইগণের প্রতি সবিনয় প্রশ্ন: আপনি কাকে বিশ্বাস ও মান্য করবেন?
মাসীহ বলেন: “যারা আমাকে ‘প্রভু প্রভু’ বলে তারা প্রত্যেকে যে বেহেশতী রাজ্যে ঢুকতে পারবে তা নয়। কিন্তু আমার বেহেশতী পিতার ইচ্ছা যে পালন করে সে-ই ঢুকতে পারবে। সেই দিন অনেকে আমাকে বলবে, ‘প্রভু প্রভু, তোমার নামে কি আমরা নবী হিসাবে কথা বলি নি? তোমার নামে কি ভূত ছাড়াই নি? তোমার নামে কি অনেক অলৌকিক কাজ করি নি? তখন আমি সোজাসুজিই তাদের বলব ‘আমি তোমাদের চিনি না। দুষ্টের দল! (হে অধর্মচারীরা: ye that work iniquity) আমার কাছ থেকে তোমরা দূর হও।’ (মথি ৭/২১-২৩)।
যারা তাকে ‘হে প্রভু হে প্রভু’ বলেন তারা অবশ্যই তাকে অন্তরে বিশ্বাস করেছেন এবং মুখে এভাবে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। উপরন্তু তার নামে পবিত্রআত্মার প্রেরণা লাভের দাবি করেছেন, ধর্মপ্রচার করেছেন এবং কারামতি দেখিয়েছেন। কিন্তু তারপরও তারা জান্নাত লাভ করবেন না; কারণ শত বিশ্বাস ও অতিভক্তি সত্ত্বেও যদি আল্লাহর শরীয়ত পালন বা “ধর্মাচারণ” না থাকে তাহলে মুক্তি মিলবে না।
ঈসা মাসীহ বারংবার বলেছেন যে, আজ্ঞা, বিধান বা শরীয়ত পালনই জান্নাতের একমাত্র পথ। “যে কেহ আমার এই সকল বাক্য শুনিয়া পালন করে... বুদ্ধিমান..। আর যে কেহ আমার এই সকল বাক্য শুনিয়া পালন না করে.. নির্বোধ (মথি ৭/২৪, ২৬)। “এক ব্যক্তি আসিয়া তাঁহাকে বলিল, ... অনন্ত (আখেরী) জীবন পাইবার জন্য আমি কিরূপ সৎকর্ম করিব? তিনি তাহাকে কহিলেন: ... তুমি যদি (আখেরী) জীবনে প্রবেশ করিতে ইচ্ছা কর তবে আজ্ঞা সকল পালন কর (মথি ১৯/১৬-১৭; লূক ১৮/১৮-১৯)
সাধু পল যীশুর এ সকল বক্তব্য প্রচারকারীদেরকে অভিশপ্ত বলে ঘোষণা করেছেন; কারণ তারা তার ইঞ্জিলের বিপরীত ইঞ্জিল প্রচার করেন (গালাতীয় ১/৮-৯)। এরপরও যীশুর অনেক বক্তব্য মানুষদের কাছে পৌঁছাত। এজন্য তিনি ও তাঁর অনুসারীরা অপব্যাখ্যার আশ্রয় নেন। যেমন, তিনি ইয়াহূদীদের ভয়ে বা মানুষে বুঝবে না বলে এগুলি বলেছিলেন। এভাবেই তাঁরা ঈসা মাসীহকে বুঝাতে অক্ষম বা মুনাফিক হিসেবে চিত্রিত করেন (নাউযূ বিল্লাহ)। এমনকি সাধু পল যীশুর শিক্ষাকে প্রাথমিক, আদিম ও পূর্ণতার পরিপন্থী বলে ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেন: “(RSV: let us leave the elementrary doctrine (teachings) of Christ and go on to maturity): অতএব আইস, আমরা খৃস্টের আদিম-প্রাথমিক নীতিমালা (শিক্ষা) পশ্চাতে ফেলিয়া পরিপক্কতার দিকে ধাবিত হই।” (ইব্রীয় ৬/১, বাংলা অনুবাদে কারসাজি বিদ্যমান)
ঈসা মাসীহের শিক্ষা প্রাথমিক ও অপরিপক্ক! তাঁর শিক্ষা প্রাইমারি আর পলের শিক্ষা হাইস্কুল! অবশ্য ত্রিত্ববাদীদের জন্য মাসীহের শিক্ষাকে অপরিপক্ক বলা ছাড়া উপায়ও নেই। তাদের ধর্মের একটি আকীদাও মাসীহের শিক্ষার মধ্যে সুস্পষ্ট নেই। কাজেই তাকে অপূর্ণ এবং সাধু পলকে পূর্ণ বলা ছাড়া তাদের উপায় নেই।
আগেই বলেছি যে, প্রেরিত পুস্তকটি ও পরবর্তী পত্রগুলি থেকে জানা যায় যে, সাধু পলের এ মতবাদ হাওয়ারী এবং শরীয়ত পালনকারী খৃস্টানদের প্রচণ্ড প্রতিরোধের মুখে পড়ে। আত্মরক্ষার জন্য তিনি অতিভক্তির আশ্রয় গ্রহণ করেন। এতকাল সকলেই জানত যে বিশ্বাস ও শরীয়ত পালনের মাধ্যমেই মানুষ নাজাত পায়। এখন তিনি বলছেন শরীয়ত পালন মুক্তির পথে প্রতিবন্ধক। এটি প্রমাণের জন্য তিনি বললেন: যীশু তো আর সাধারণ কোনো নবী নন; যে তাকে হত্যা করাতে শুধু হত্যাকারীদের পাপ হয়েছে। বরং তিনি ঈশ্বর; তিনি ক্রুশে মরে সকলের পাপ মোচন করেছেন। কাজেই শরীয়ত পালনের আর প্রয়োজন নেই। তিনি প্রচার করতে থাকেন: “ব্যবস্থা (শরীয়ত) দ্বারা যদি ধার্মিকতা হয়, তাহা হইলে খৃস্ট অকারণে মরিলেন” (গালাতীয় ২/২১)। তিনি বলেন: “খৃস্ট যীশুতে জীবনের আত্মার যে ব্যবস্থা, তাহা আমাদেরকে পাপের ও মৃত্যুর ব্যবস্থা (শরীয়ত) হইতে মুক্ত করিয়াছে (রোমীয় ৮/২) অর্থাৎ শরীয়ত আছে বলেই পাপ এবং পাপ আছে বলেই অনন্ত মৃত্যু বা নরকবাস। যীশুতে বিশ্বাস করলে আর শরীয়ত থাকে না; আর শরীয়ত না থাকলে তো কোনো কিছুই আর পাপ বলে গণ্য হবে না।
সাধু পলের এ উদ্ভাবন সফল হয়েছিল। এ অতিভক্তির আকীদা তাকে ও তাঁর মতবাদকে চিরস্থায়ী করে; নইলে হাওয়ারী ও শরীয়তপন্থীদের প্রতিরোধে তার মতবাদ বিলুপ্ত হয়ে যেত। যেভাবে আমাদের সমাজে শরীয়ত-মুক্ত তরিকত-মারিফত পন্থীগণ সর্বদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও ওলীগণের প্রতি অতিভক্তি প্রকাশ করেন এবং শরীয়ত-পন্থীদেরকে বেয়াদব বানিয়ে সাধারণ মানুষদের সমর্থন লাভ করেন ও টিকে থাকেন।
সাধু পলের উদ্ভাবিত ‘অতিভক্তির’ মূল বিষয় ত্রিত্ববাদ। মাসীহ আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস এবং প্রচার করতেন। তিনি হিব্রু ভাষার রীতিতে ইয়াহূদী নবীগণ ও সকল ইয়াহূদীর মতই ‘রব্ব’ অর্থে আল্লাহকে পিতা বলতেন। তিনি সর্বদা বলেছেন, পিতাই একমাত্র ঈশ্বর। পিতার পাশাপাশি পুত্র ও পবিত্র আত্মাও ঈশ্বর-এ কথা ঘুণাক্ষরেও তিনি বলেন নি। পক্ষান্তরে সাধু পলের ধর্মের মূল বিশ্বাস যে, আল্লাহ তিনজন সম্পূর্ণ পৃথক ব্যক্তি। এরূপ জঘন্য কথা ঈসা মাসীহ কখনোই বলেন নি।
মার্ক ১২/২৮-৩৪: “একজন আলেম জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তৌরাত শরীফের মধ্যে সবচেয়ে দরকারী হুকুম কোনটা’? জবাবে ঈসা বললেন, ‘সবচেয়ে দরকারী হুকুম হল, বনি-ইস্রাইলরা, শোন, আমাদের মাবুদ আল্লাহ্ এক। তোমরা প্রত্যেকে তোমাদের সমস্ত দিল, সমস্ত প্রাণ, সমস্ত মন এবং সমস্ত শক্তি দিয়ে তোমাদের মাবুদ আল্লাহকে মহব্বত করবে। তার পরের দরকারী হুকুম হল এই, ‘তোমার প্রতিবেশীকে নিজের মত মহব্বত করবে’। এই দু‘টা হুকুমের চেয়ে বড় হুকুম আর কিছুই নেই”। তখন সেই আলেম বললেন, “... আপনি সত্যি কথাই বলেছেন যে, আল্লাহ্ এক এবং তিনি ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই। আর সমস্ত দিল, সমস্ত বুদ্ধি ও সমস্ত শক্তি দিয়ে তাঁকে মহববত করা এবং প্রতিবেশীকে নিজের মত মহববত করা পশু ও অন্য সব কোরবানীর চেয়ে অনেক বেশী দরকারী”। ঈসা যখন দেখলেন সেই আলেমটি খুব বুদ্ধিমানের মত জবাব দিয়েছেন তখন তিনি তাঁকে বললেন “আল্লাহর রাজ্য থেকে আপনি বেশী দূরে নন”।
সাধু পলের অনুসারীরা বলেন, আল্লাহকে একমাত্র মাবূদ বলে বিশ্বাস করলেও নাজাত হবে না; বরং ত্রিত্বে, যীশুর ঈশ্বরত্বে ও যীশুর রক্তের মাধ্যমে পাপমোচনে বিশ্বাস করতে হবে। যদি ত্রিত্ববাদী এ আকীদা সঠিক হতো, তবে নিশ্চয়ই ভাববাদীগণের গ্রন্থে প্রথম আজ্ঞা হিসেবে সুস্পষ্টরূপে তা উল্লেখ করা হতো এবং যীশু বলতেন: ‘প্রথম আজ্ঞাটি এই, ‘ঈশ্বর প্রভু এক, যিনি তিনটি প্রকৃত ও সম্পূর্ণ পৃথক সত্তার সমন্বয় এবং আমিই ঈশ্বরের দ্বিতীয় ব্যক্তি ও ঈশ্বরের পুত্র।’ যেহেতু যীশু তা বলেন নি এবং কোনো নবীর পুস্তকে বা ইঞ্জিলেও তা বলা হয় নি, সেহেতু আমরা সুনিশ্চিতরূপে জানতে পারছি যে, সাধু পলের খৃস্টধর্ম একটি ভ্রান্ত মতবাদ।
আরো লক্ষণীয় যে, এ অধ্যাপক ত্রিত্বে বিশ্বাস করতেন না। উপরন্তু কেউ ত্রিত্বের কথা বললে বা যীশু নিজেকে ঈশ্বরের এক অংশ বলে দাবি করলে তাকে নির্দ্বিধায় হত্যা করতেন। অথচ যীশু সুস্পষ্ট উক্ত অধ্যাপককে জান্নাতী বললেন।
সাধু পলের অনুসারীরা বলেন, ইয়াহূদীদের ভয়ে বা মানুষেরা বুঝবে না বলে যীশু মিথ্যা বলেছিলেন! তাঁরা নিজেদের মিথ্যাচার বৈধ করতে তাঁকে অপারগ ও মুনাফিক রূপে চিত্রিত করেন। সত্য বুঝানোর ক্ষমতা ও সাহস পলের ছিল কিন্তু যীশুর ছিল না!
আল্লাহর কাছে মুনাজাতে যীশু বলেন: “আর ইহাই অনন্ত জীবন যে, তাহারা তোমাকে, একমাত্র সত্যময় ঈশ্বরকে এবং তুমি যাঁহাকে পাঠাইয়াছ, তাঁহাকে, যীশু খ্রীষ্টকে, জানিতে পায়। (And this is life eternal, that they might know thee the only true God, and Jesus Christ, whom thou hast sent.)” (যোহন ১৭/৩)
এ কথাটি তিনি একান্তে আল্লাহর সাথে বলেছেন; কাজেই ইয়াহূদীদের ভয়ে বা কেউ বুঝবে না বলে দাবি করার সুযোগ নেই। এখানেও তিনি বলছেন যে, জান্নাত লাভ করতে বিশ্বাস করতে হবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবূদ নেই এবং ঈসা মাসীহ তাঁর প্রেরিত অর্থাৎ রাসূল। ঈশ্বরের ত্রিত্বে বিশ্বাস করা, আদি পাপ বা পাপ মোচনে বিশ্বাস করা ... ইত্যাদি কিছুই জান্নাত লাভের শর্ত নয়। একটিবারের জন্য গোপন মুনাজাতেও তিনি বললেন না যে, ‘ইহাই অনন্ত জীবন যে, তাহারা জানিবে তোমার সত্ত্বা তিনটি সম্পূর্ণ পৃথক সত্ত্বার সমন্বয় এবং ঈসা মাসীহ মনুষ্য ও ঈশ্বর বা মাংসে প্রকাশিত ঈশ্বর।’ পক্ষান্তরে পলীয় ধর্মের বিশ্বাস হলো কেউ যদি যীশুর উপরের কথাটি সর্বান্তকরণে ও আক্ষরিকভাবে বিশ্বাস করার কথা এক কোটি বার ঘোষণা করে, কিন্তু স্পষ্টভাবে ত্রিত্ববাদের ঘোষণা না দেয় তবে কাফির (heretic)। তাকে জীবন্ত আগুনে পুড়িয়ে মারা (Inquisition) খৃস্টধর্মের সুপরিচিত বিধান।
উপরের বক্তব্যে ঈসা মাসীহ বললেন যে, তিনি আল্লাহর প্রেরিত, অর্থাৎ রাসূল। অন্যত্র তিনি বলেন: “আর পৃথিবীতে কাহাকেও ‘পিতা’ বলিয়া সম্বোধন করিও না, কারণ তোমাদের পিতা এক জন, তিনি সেই স্বর্গীয়। তোমরা ‘আচার্য’ বলিয়া সম্ভাষিত হইও না, কারণ তোমাদের আচার্য এক জন, তিনি খ্রীষ্ট।” (মথি ২৩/৯-১০)
এ কথারও একই অর্থ: আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবূদ নেই এবং ঈসা তাঁর রাসূল, যাকে একমাত্র আচার্য বা শিক্ষক হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। অথচ পলীয় ধর্মে তাঁকে আচার্য, উস্তাদ বা রাসূল মানলে নাজাত তো দূরের কথা অনন্ত জাহান্নাম ছাড়া কিছুই মিলবে না। নাজাত লাভ করতে তাঁকে ঈশ্বরের অবতার ও মানবদেহধারী ঈশ্বর বলে বিশ্বাস করতে হবে (যোহন ১/১, ১৪: ১ তিমথীয় ৩/১৬)।
উল্লেখ্য যে, প্রচলিত ইঞ্জিলের মধ্যে ঈসা মাসীহ বারংবার নিজেকে আল্লাহর নবী (prophet) বলে ঘোষণা করেছেন। (মার্ক ৬/৩-৬; লূক ১৩/৩৩)
ঈসা মাসীহ উপরের বক্তব্যে বলেছেন যে, আল্লাহ ছাড়া কাউকে পিতা বলা যাবে না। কিন্তু সাধু পল বলেন, তিনিই উম্মাতের একমাত্র পিতা: “মসীহের বিষয়ে শিক্ষা দিবার লোক হয়ত তোমাদের অনেক হইতে পারে, কিন্তু পিতা তোমাদের অনেক নাই; আমিই সুখবরের মধ্য দিয়া মাসীহী জীবনে তোমাদের পিতা হইয়াছি। (have ye not many fathers: for in Christ Jesus I have begotten you through the gospel) (১-করিন্থীয় ৪/১৫)
আল্লাহকে পিতা বলা এবং বান্দাকে ‘ইবনুল্লাহ’ বা ‘আল্লাহর পুত্র’ বলা হিব্রু ভাষার রীতি। পিতা অর্থ জগৎপিতা বা প্রতিপালক। আর ‘ইবন’ বা পুত্র (son) অর্থ বান্দা। এজন্য কিতাবুল মোকাদ্দসে সকল আদম-সন্তানকে ‘ইবনুল্লাহ’ বা “আল্লাহর পুত্র” বলা হয়েছে। (আদিপুস্তক ৬/২-৪; ইয়োব ৩৮/৭; গীতসংহিতা ৬৮/৫)। আবার অনেক স্থানে বিশেষ বান্দা হিসেবে সকল ইস্রায়েল-সন্তানকে “আল্লাহর পুত্র” বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। (দ্বিতীয় বিবরণ ১৪/১, ৩২/১৯; যিশাইয় ১/২, ৩০/১, ৬৩/৮; হোশেয় ১/১০)। বিশেষ করে আল্লাহর অনুগত বান্দাদেরকে ‘ইবনুল্লাহ’ বা ‘আল্লাহর পুত্র’ বলা হয়েছে: “যত লোক ঈশ্বরের আজ্ঞা দ্বারা চালিত হয়, তাহারাই ঈশ্বরের পুত্র।” (রোমীয় ৮/১৪)। বিপরীতে পাপী লোকদেরকে শয়তানের পুত্র বলা হয়েছে। (মথি ৫/৯, ৪৪, ৪৫; যোহন ৩/৮-১০, ৮/৪১-৪৪)। আবার খাস বান্দা হিসেবে ইয়াকূব (আঃ) এবং তাঁর পৌত্র ইফ্রিমিয়কে আল্লাহর প্রথমজাত পুত্র বা বড় ছেলে বলা হয়েছে। (যাত্রাপুস্তক ৪/২২ এবং যিরমিয় ৩১/৯)। দায়ূদ (আঃ)-কে আল্লাহর পুত্র, প্রথমজাত পুত্র ও ‘জন্ম-দেওয়া’ বা ‘ঔরসজাত’ পুত্র বলা হয়েছে (গীতসংহিতা ২/৭)।
হিব্রুভাষী ইয়াহূদীগণ জানতেন যে, ইবনুল্লাহ: ‘আল্লাহর পুত্র’ অর্থ আল্লাহর বান্দা এবং যে যত বেশি আল্লাহর অনুগত তাকে তত প্রিয় বান্দা হিসেবে একমাত্র পুত্র, ঔরসজাত পুত্র ইত্যাদি বলা হয়েছে। এজন্যই তারা দাঊদ (আঃ)-কে ‘ইবনুল্লাহ’, আল্লাহ পুত্র, মাসীহুল্লাহ: আল্লাহর মাসীহ ও জন্মদেওয়া পুত্র বলার কারণে তাকে অলৌকিক সত্তা বলে দাবি করেন নি। বরং তাকে ‘আল্লাহর বান্দা দায়ূদ (Servant David) বলেই আখ্যায়িত করেছেন (২-শ্যমুয়েল ৩/১৮, ৭/৫, ৭/৮, ৭/২৬, ১-রাজাবলি ৩/৬, ৮/২৪, ৮/২৫, ৮/২৬, ১১/৩২, ১৪/৮, ২-রাজাবলি ১৯/৩৪, ২০/৬, ১-বংশাবলি ১৭/৭, ২-বংশাবলি ৬/১৫, ৬/১৬, ৬/১৭; গীতসংহিতা ১৩২/১০; যিশাইয় ৩৭/৩৫; যিহিষ্কেল ৩৪/২৩, ৩৪/২৪, ৩৭/২৫; লূক ১/৬৯; প্রেরিত ৪/২৫)।
ইয়াহূদীদের সাথে কথোপকথনে যীশু বলেন: “তোমাদের পিতার কার্য তোমরা করিতেছ। তাহারা তাঁহাকে কহিল, আমরা ব্যভিচারজাত নহি; আমাদের একমাত্র পিতা আছেন, তিনি ঈশ্বর। যীশু তাহাদিগকে কহিলেন, ঈশ্বর যদি তোমাদের পিতা হইতেন, তবে তোমরা আমাকে প্রেম করিতে ... তোমরা তোমাদের পিতা দিয়াবলের, এবং তোমাদের পিতার অভিলাষ সকল পালন করাই তোমাদের ইচ্ছা; ... কেননা সে মিথ্যাবাদী ও তাহার (মিথ্যাবাদীর) পিতা।” (যোহন ৮/৪১-৪২)
প্রচলিত ইঞ্জিলে ঈসা মাসীহ ঠিক এ অর্থেই নিজেকে আল্লাহর পুত্র এবং আল্লাহকে পিতা বলতেন। পাশাপাশি প্রচলিত চারটি ইঞ্জিলের মধ্যে শতশতবার তিনি নিজেকে মনুষ্যপুত্র (son of man) বলে আখ্যায়িত করেছেন। কিতাবুল মোকাদ্দসে মনুষ্যপুত্র বলতে ‘মরণশীল মানুষ’ ও ‘আল্লাহর বান্দা’ বুঝানো হয়েছে। নবীগণকে বিশেষভাবে মানুষের পুত্র বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে যেন কেউ অলৌকিক কার্যাদি দেখে তাদেরকে ঈশ্বরের সাথে সম্পৃক্ত মনে না করে। বিভিন্ন স্থানে বলা হয়েছে যে, ঈশ্বর কখনোই মনুষ্যপুত্র নন, মনুষ্যপুত্র কখনো ঈশ্বর হতে পারে না এবং কোনো মনুষ্যপুত্রের কোনো ক্ষমতা নেই; সকল ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর। (গণনাপুস্তক ২৩/১৯; ইয়োব ২৫/৬; গীতসংহিতা ১৪৬/২-৫; যিশাইয় ৫১/১২-১৩)।
বাইবেলের বর্ণনানুসারে কবর থেকে বেরিয়ে মগ্দলীনী মরিয়মকে মাসীহ বলেন: “তুমি আমার ভ্রাতৃগণের কাছে গিয়া তাহাদিগকে বল, যিনি আমার পিতা ও তোমাদের পিতা এবং আমার ঈশ্বর ও তোমাদের ঈশ্বর, তাঁহার নিকটে আমি ঊর্ধ্বে যাইতেছি (I ascend unto my Father, and your Father; and to my God, and your God)।” (যোহন ২০/১৭) তাহলে শিষ্যগণ যে অর্থে ইবনুল্লাহ বা আল্লাহর পুত্র যীশুও ঠিক সে অর্থেই ইবনুল্লাহ বা আল্লাহর পুত্র। আবার আল্লাহ যে অর্থে অন্য সকল মানুষের মাবুদ, অবিকল সে অর্থেই তিনি ঈসা মাসীহেরও মাবুদ। এ তাঁর জীবনের শেষ শিক্ষা। কুরআন জানায় যে, ঈসা মাসীহ বলেন: “নিশ্চয় আল্লাহ আমার প্রভু ও তোমাদের প্রভু (আল-ইমরান ৫১), “তোমরা আমার প্রভু ও তোমাদের প্রভু আল্লাহর ইবাদত কর... (মায়িদা ৭২ ও ১১৭), “নিশ্চয় আল্লাহ আমার প্রভু ও তোমাদের প্রভু, অতএব তোমরা তার ইবাদত কর” (মরিয়ম ৩৬ এবং যুখরুফ ৬৪)। এভাবেই কুরআন প্রকৃত ইঞ্জিল সংরক্ষণ করেছে।
আমরা দেখেছি যে, তিনি নিজেকে একজন রাসূল ও শিক্ষক হিসেবে প্রচার করেছেন। ঈশ্বরত্বে আল্লাহর সমকক্ষ বলে নিজেকে দাবি করা তো দূরের কথা কোনো ঐশ্বরিক ক্ষমতা-ই তাঁর নেই বলে তিনি প্রচার করেছেন। কিয়ামত বিষয়ে তিনি বলেন: “কিন্তু সেই দিনের বা সেই দণ্ডের তত্ত্ব কেহই জানে না; স্বর্গস্থ দূতগণও জানেন না, পুত্রও জানেন না, কেবল পিতা জানেন।” (মার্ক ১৩/৩২) অর্থাৎ অলৌকিক ঐশ্বরিক ক্ষমতা তো দূরের কথা, অলৌকিক জ্ঞানও তার নেই।
পিতার সমকক্ষ ঈশ্বরত্ব দাবি করা তো দূরের কথা নিজেকে ভালো বলতেও তিনি রাজি হন নি। এক ব্যক্তি তাঁকে প্রশ্ন করে, “হে সৎ গুরু (Good Master), অনন্ত জীবন পাইবার জন্য আমি কিরূপ সৎকর্ম করিব? তিনি তাহাকে কহিলেন, (Why callest thou me good? there is none good but one, that is, God: KJV/AV) আমাকে কেন সৎ (good) কহিতেছ? একজন ব্যতীত আর কেউই সৎ নন, তিনি ঈশ্বর।” (মথি ১৯/১৬-১৭: বাংলা বাইবেলের অনুবাদ অস্পষ্ট)
মাসীহের শিষ্যগণও আল্লাহর পুত্র বা ‘জাত (begotten জন্মদেওয়া) পুত্র’ বলতে আল্লাহর নেককার বান্দা বুঝিয়েছেন। যোহন বলেন: “যে কেহ বিশ্বাস করে যে, যীশুই সেই খ্রীষ্ট, সে ঈশ্বর হইতে জাত (born of God); এবং যে কেহ জন্মদাতাকে প্রেম করে; সে তাঁহা হইতে জাত ব্যক্তিকেও প্রেম করে (every one that loveth him that begat loveth him also that is begotten of him) ইহাতে আমরা জানিতে পারি যে, ঈশ্বরের সন্তানগণকে প্রেম করি, যখন ঈশ্বরকে প্রেম করি ও তাঁহার আজ্ঞা সকল পালন করি। ... আমরা জানি, যে কেহ ঈশ্বর হইতে জাত, সে পাপ করে না; কিন্তু যে ঈশ্বর হইতে জাত সে নিজেকে (আপনাকে) রক্ষা করে (he that is begotten of God keepeth himself) এবং সেই পাপাত্মা (শয়তান) তাহাকে স্পর্শ করে না।” (১- যোহন ৫/১-২ ও ১৮)
এ অর্থেই তাঁরা মাসীহকে আল্লাহর পুত্র বলেছেন। মার্ক ১৫/৩৯: “সত্যই এ মানুষটি ঈশ্বরের পুত্র ছিলেন (this man was the Son of God)” এবং লূক ২৩/৪৭: সত্য, এই ব্যক্তি ধার্মিক ছিলেন (this was a righteous man)।”
যে অর্থে তাঁরা তাঁকে আল্লাহর পুত্র বলেছেন, সে অর্থেই তাঁরা তাঁকে আল্লাহর বান্দা বলেছেন। পিতর বলেন: “অব্রাহামের, ইসহাকের ও যাকোবের ঈশ্বর, আমাদের পিতৃপুরুষদের ঈশ্বর আপনার বান্দা যীশুকে গৌরবান্বিত করিয়াছেন (glorified his servant Jesus)।” (প্রেরিত ৩/১৩)
অন্যত্র শিষ্যগণ আল্লাহর কাছে প্রার্থনায় বলেন: “তুমি তোমার দাস (thy servant David) আমাদের পিতা দায়ূদের মুখ দিয়া... কেননা সত্যই তোমার পবিত্র দাস যীশু (thy servant Jesus)..।” (প্রেরিত ৪/২৪-২৭)।
এর বিপরীতে সাধু পল ‘আল্লাহর পুত্র’ কথাকে গ্রীক-রোমান পৌত্তলিকদের পরিভাষায় ব্যবহার করে আক্ষরিক অর্থে তাঁকে “আল্লাহর পুত্র” বলে দাবি করেন। তিনি ও তাঁর অনুসারীরা যীশুকে আক্ষরিক অর্থে আল্লাহর একজাত বা একমাত্র ঔরসজাত পুত্র (only begotten Son), পিতা আল্লাহর মতই পরিপূর্ণ আল্লাহ, আল্লাহর অবতার বা মানবরূপী আল্লাহ (God incarnate/ God in flesh) এবং আল্লাহর যাতের অংশ (of the same substance) বলে প্রচার করেন। (যোহন ১/১, ১৪, ১৮ ৩/১৬, ৩/১৮; ইব্রীয় ১১/১৭, কলসীয় ১/১৬, ২/৯; ফিলিপীয় ২/৬, ১-তিমথীয় ৩/১৬)।
এভাবে সাধু পল ও তাঁর অনুসারিগণ ঈসা মাসীহের তাওহীদী দীনকে ত্রিত্ববাদী শির্কী ধর্মে পরিণত করেন। এ কথা মুসলিমদের বানানো কথা নয়। যে কোনো এনসাইক্লোপিডিয়া বা ইন্টারনেটে খৃস্টান গবেষকদের লেখা পড়লেই আপনি এ সত্য জানতে পারবেন। মাইক্রোসফট এনকার্টা (Microsoft ® Encarta ® 2008, article (God)) থেকে একটি মাত্র উদ্ধৃতি দিচ্ছি:
Christianitybeganas a Jewish sect and thus took over the Hebrew God, the Jewish Scriptures eventually becoming, for Christians, the Old Testament. During his ministry, Jesus Christ was probably understood as a prophet of God, but by the end of the 1st century Christians had come to view him as a divine being in his own right, and this created tension with the monotheistic tradition of Judaism. The solution of the problem was the development of the doctrine of the triune God, or Trinity, which, although it is suggested in the New Testament, was not fully formulated until the 4th century.
“খৃস্টধর্ম ইয়াহূদী ধর্মের একটি ফির্কা হিসেবেই যাত্রা শুরু করে। কাজেই ঈশ্বর বা আল্লাহর বিষয়ে ইয়াহূদীদের বিশ্বাস নিয়েই তার শুরু। ক্রমান্বয়ে ইয়াহূদীদের ধর্মগ্রন্থ খৃস্টানদের নিকট ‘পুরাতন নিয়ম’ বলে গণ্য হয়। যীশু খৃস্ট তার জীবদ্দশাতে আল্লাহর একজন নবী বলেই স্বীকৃত বা গৃহীত হয়েছিলেন বলে প্রতীয়মান হয়। কিন্তু প্রথম শতাব্দীর শেষ প্রান্তে এসে খৃস্টানগণ তাঁর বিষয়ে মনে করতে লাগলেন যে, তিনি নিজেই একজন ঐশ্বরিক সত্ত্বা। এ ধারণা ইয়াহূদী ধর্মের একত্ববাদ-এর সাথে সংঘাত সৃষ্টি করে। এ সমস্যার সমাধানের জন্য ত্রিত্ববাদ বা তিন ব্যক্তির ঈশ্বর মতবাদের উৎপত্তি ঘটে। যদিও নতুন নিয়মের মধ্যে এ মতের কিছু ধারণা আছে, তবে ত্রিত্ববাদ মতটি ৪র্থ খৃস্টীয় শতকের আগে পূর্ণরূপ লাভ করে নি।”
এভাবে ঈসা মাসীহের একত্ববাদী ধর্ম একশত বৎসরের মাথায় ত্রিত্ববাদী শির্কী ধর্মে পরিণত হলো, শুধু ঈসা মাসীহের “ঐশ্বরিক ব্যক্তিত্ব” কল্পনা করার কারণে। আর এ কল্পনার মূল কারণ ছিল হিব্রু ভাষার সম্মানসূচক “ঈশ্বরের পুত্র” পরিভাষাটির অর্থ গ্রীক ভাষায় ‘আক্ষরিক’ অর্থে ব্যবহার করা।
এ মহা ধ্বংসের জন্য দায়ী ছিলেন সাধু পল ও তাঁর অনুসারীরা। যীশু বলেছেন যে, তিনি শুধু ইস্রায়েল বংশের নবী হিসেবে প্রেরিত। তাদের জন্য “ঈশ্বরের পুত্র” পরিভাষাটির ব্যবহারে কোনো অসুবিধা ছিল না। এজন্য তিনি অ-ইস্রায়েলীদের কাছে তাঁর ধর্ম প্রচার করতে কঠিনভাবে নিষেধ করেন। (মথি ৭/৬, ১০/৫-৮; ১৫/২২-২৮) কিন্তু সাধু পল ও তাঁর অনুসারীরা নিজেরা গ্রীক দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যীশুর ঈশ্বরত্ব দাবি করতে থাকেন এবং এ ধর্মকে এশিয়া মাইনর ও ইউরোপের রোমান অঞ্চলে প্রচার করেন। এ সকল এলাকার মানুষেরা ঈশ্বরের পুত্র পরিভাষাকে আক্ষরিক অর্থেই বুঝতো এবং তাদের দেবদেবীদেরকে ঈশ্বরের পুত্র বা কন্যা হিসেবেই পূজা করত। তারা ঈসা মাসীহকেও এ অর্থেই বুঝে। এভাবে ১০০ বৎসরের মধ্যে ঈসা মাসীহের ধর্ম নষ্ট হয়ে যায়। এজন্য বিশ্বধর্ম ইসলামে “আল্লাহর প্রিয়পাত্র” হিসেবেও কাউকে ‘ইবনুল্লাহ’ বা ‘আল্লাহর পুত্র’ বলতে নিষেধ করা হয়েছে। (৫-মায়িদা ১৮ আয়াত)।
সাধু পল ও তাঁর অনুসারীরা এ শির্কী বিশ্বাস প্রমাণের জন্য জালিয়াতি ও অপব্যাখ্যার আশ্রয় নেন। আমরা দেখেছি, কিভাবে তাঁরা বান্দার স্থানে পুত্র লিখে, কিছু কথা মুছে এবং কিছু কথা যোগ করে ত্রিত্ব ও যীশুর ঈশ্বরত্ব প্রমাণের চেষ্টা করেছেন।
আমরা জেনেছি যে, ‘মতানুসারে ইঞ্জিলগুলিও’ পলীয় ধর্মের প্রাধান্য লাভের পর তাঁর অনুসারীদের দ্বারা গ্রীক ভাষায় সংকলিত ‘বেনামী’ ইঞ্জিল। এরপরও এ সকল ইঞ্জিলের মধ্যে ঈসা মাসীহের আল্লাহর রাসূল ও আল্লাহর বান্দা হওয়ার পক্ষে, ঈশ্বর বা ঈশ্বরের সমতুল্য না হওয়ার পক্ষে অগণিত প্রমাণ বিদ্যমান। উপরে আমরা সামান্য কিছু উল্লেখ করলাম। এর বিপরীতে প্রচলিত ‘মতানুসারে ইঞ্জিলগুলি’-র মধ্যে যীশুর ঈশ্বরত্বের পক্ষে তাঁর একটিও সুস্পষ্ট বক্তব্য নেই। তবে চতুর্থ ইঞ্জিলের মধ্যে বিদ্যমান তাঁর কিছু কথাকে ত্রিত্ববাদীরা তার ঈশ্বরত্বের প্রতি ‘ইঙ্গিত’ বলে প্রচার করেন। এক্ষেত্রে নিম্নের বিষয়গুলি লক্ষ্য করুন:
প্রথমত: মহান আল্লাহ সকল মানুষের প্রেমময় স্রষ্টা। দুনিয়ায় যে যেমনই হোক না কেন সকলেই যেন সহজে মুক্তির পথ বুঝতে ও মানতে পারে এজন্য তিনি নবী-রাসূল প্রেরণ করেন। যে বিশ্বাসের উপর মানুষের মুক্তি নির্ভর করে সে বিশ্বাস যদি ধর্ম প্রচারক বুদ্ধিমান-নির্বোধ প্রত্যেক মানুষের সহজে বুঝার মত সহজবোধ্য ও দ্ব্যর্থহীনভাবে না বলেন তাহলে বুঝতে হবে যে, তিনি ভণ্ড প্রচারক। তিনি মানুষকে সত্যের সন্ধান দেন নি; বরং সত্যকে অস্পষ্ট ও দুর্বোধ্য করেছেন। ঈমান ও নাজাতের বিষয় ছাড়া অন্যান্য উপদেশের ক্ষেত্রে হয়ত কোনো নবী-রাসূল অলঙ্কার-এর আশ্রয় নিতে পারেন; কিন্তু মুক্তির দিশাকে তিনি অস্পষ্ট করতে পারেন না।
দ্বিতীয়ত: কোনো মহাপুরুষের কোনো কথা যদি তার সুস্পষ্ট বক্তব্যের বিপরীত হয় তাহলে তা জাল বলে গণ্য হবে অথবা তাঁর সুস্পষ্ট বক্তব্যের আলোকে ব্যাখ্যা করতে হবে। প্রচলিত ইঞ্জিলের মধ্যে মাসীহ মানুষের মুক্তির যে মূলমন্ত্র বারংবার উল্লেখ করেছেন, তা হলো ‘আল্লাহর প্রকৃত ও ব্যাখ্যাবিহীন একত্বে বিশ্বাস করা’। কিতাবুল মোকাদ্দসেও তাই বলা হয়েছে। কাজেই এ কথার উল্টা কোনো কথা যদি পাওয়া যায় তবে তাকে এ সুস্পষ্ট মূলনীতির ভিত্তিতেই ব্যাখ্যা করতে হবে।
তৃতীয়ত: চতুর্থ ইঞ্জিল বা যোহনের ইঞ্জিলের বিষয়ে আমরা দেখেছি যে, গ্রন্থটি মূলতই জাল। এর গ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে খৃস্টান পণ্ডিতদের মধ্যেও মতভেদ রয়েছে। তবে তারা সকলেই একমত যে, এ গ্রন্থটি আলঙ্কারিক গ্রীকভাষায় লেখা এবং এতে ব্যাপকভাবে রূপক ব্যবহার করা হয়েছে। কাজেই এগুলির ব্যাখ্যা অন্য তিন ইঞ্জিলের সুস্পষ্ট বক্তব্যের আলোকে করতে হবে।
চতুর্থত: সবচেয়ে বড় কথা, পলীয় খৃস্টানগণ যীশুর যে বক্তব্যগুলি তাঁর ‘ঈশ্বরত্বের ইঙ্গিত’ বলে প্রচার করেন, ইঞ্জিলের মধ্যে বিদ্যমান যীশুর অন্যান্য বক্তব্য প্রমাণ করে যে, সেগুলো অন্য বিষয়ের ইঙ্গিত। ত্রিত্ববাদীদের প্রমাণগুলি দেখুন:
(১) “তিনি তাহাদিগকে কহিলেন, তোমরা অধঃস্থানের, আমি ঊর্ধ্বস্থানের; তোমরা এ জগতের, আমি এ জগতের নহি।” (যোহন ৮/২৩)। পলীয়গণ প্রচার করেন যে, এখানে যীশু তাঁর ঈশ্বরত্বের প্রতি “ইঙ্গিত” করেছেন। অথচ যীশু ঠিক একই কথা শিষ্যদেরকেও বলেছেন: “তোমরা যদি জগতের হইতে, তবে জগৎ আপনার নিজস্ব বলিয়া ভালোবাসিত; কিন্তু তোমরা ত জগতের নহ..” (যোহন ১৫/১৯)। “আমি তাহাদিগকে তোমার বাক্য দিয়াছি; আর জগৎ তাহাদিগকে দ্বেষ করিয়াছে, কারণ তাহারা জগতের নয়, যেমন আমিও জগতের নই। ... তাহারা জগতের নয়, যেমন আমিও জগতের নই।” (যোহন ১৭/১৪-১৬)
প্রথম বক্তব্য যদি যীশুর ঈশ্বরত্বের প্রমাণ হয় তবে পরের দুটি বক্তব্য প্রমাণ করে যে, ঈশ্বর দুই বা তিনজন নন; বরং অন্তত ১৪/১৫ জন!
(২) যীশু বলেন: “আমি ও পিতা, আমরা এক (I and my Father are one)।” (যোহন ১০/৩০)। খৃস্টানগণ দাবি করেন, এ কথাটি তাঁর ঈশ্বরত্ব প্রমাণ করে। অথচ যীশু ঠিক একই কথা বলেছেন শিষ্যদের বিষয়ে। তিনি বলেন: “যেন তাহারা সকলে এক হয়; পিতঃ, যেমন তুমি আমাতে ও আমি তোমাতে, তেমনি তাহারাও যেন আমাদের মধ্যে এক থাকে (That they all may be one; as thou, Father, art in me, and I in thee, that they also may be one in us)... আর তুমি আমাকে যে মহিমা দিয়াছ, তাহা আমি তাহাদিগকে দিয়াছি; যেন তাহারা এক হয়, যেমন আমরা এক (that they may be one, even as we are one); আমি তাহাদের মধ্যে ও তুমি আমাতে, যেন তাহারা একের মধ্যে পরিপূর্ণতা লাভ করে (যেন তাহারা সিদ্ধ হইয়া এক হয়) (I in them, and thou in me, that they may be made perfect in one)।” (যোহন: ১৭/২১-২৩)
তাহলে কি প্রমাণিত হলো যে, যীশুকে যে ঈশ্বরত্ব প্রদান করেছিলেন পিতা ঈশ্বর সে ঈশ্বরত্ব তিনি শিষ্যদেরকে প্রদান করলেন এবং পিতা ঈশ্বর, পুত্র ঈশ্বর ও শিষ্য ঈশ্বরগণ সকলে মিলে ১৫ ঈশ্বর!
(৩) যীশু বলেন: “যে আমাকে দেখিয়াছে, সে পিতাকে দেখিয়াছে; তুমি কেমন করিয়া বলিতেছ, পিতাকে আমাদের দেখাউন? ... আমি পিতাতে আছি এবং পিতা আমাতে আছেন আমি তোমাদিগকে যে সকল কথা বলি, তাহা আপনা হইতে বলি না; কিন্তু পিতা আমাতে থাকিয়া আপনার কার্য সকল সাধন করেন।”(যোহন ১৪/৯-১০)। পলীয় খৃস্টানগণ দাবি করেন যে, এটি তাঁর ঈশ্বরত্বের প্রমাণ; কারণ তিনি বলেছেন যে, তাঁকে দেখলেই পিতাকে দেখা হয় এবং পিতা তার মধ্যে রয়েছেন। মজা হলো, তিনি শিষ্যদের ক্ষেত্রেও একই কথা বলেছেন। তিনি বলেন: “সেই দিন তোমরা জানিবে যে, আমি আমার পিতাতে আছি, ও তোমরা আমাতে আছ, এবং আমি তোমাদের মধ্যে আছি।” (যোহন ১৪/২০)। আরো বলেন: “পিতঃ, যেমন তুমি আমাতে ও আমি তোমাতে, তেমনি তাহারাও যেন আমাদের মধ্যে থাকে (that they also may be one in us)।” (যোহন ১৭/২১)
তাহলে কি প্রমাণিত হলো যে, শিষ্যগণও ঈশ্বর ছিলেন? উপরন্তু প্রচলিত ইঞ্জিলে বলা হয়েছে, সকলের মধ্যেই ঈশ্বর বসত করেন (১-করিন্থীয় ৬/১৯-২০; ২-করিন্থীয় ৬/১৬; ইফিষীয় ৪/৬)। তাহলে কি সকলেই ঈশ্বর?
বাইবেলে মানুষদেরকে god বলা হয়েছে। যাত্রাপুস্তক ৭/১: “সদাপ্রভু মোশিকে কহিলেন, দেখ, আমি ফরৌনের (ফেরাউনের) কাছে তোমাকে একজন আল্লাহ করিয়া (I have made thee a god to Pharaoh: বাংলায় “ঈশ্বর স্বরূপ”, “আল্লাহর মত”) নিযুক্ত করিলাম; আর তোমার ভ্রাতা হারোণ (হারুন) তোমার ভাববাদী (নবী) হইবে”। (গীতসংহিতা/যাবূর ৮২/৬: (I have said, Ye are gods; and all of you are children of the Most High): আমি বলেছিলাম: তোমরা আল্লাহ, তোমরা সবাই আল্লাহ তা‘আলার সন্তান” (কিতাবুল মোকাদ্দসে: তোমরা যেন আল্লাহ’: ‘যেন’ শব্দটি সংযোজিত) । শুধু আল্লাহর পুত্র নয়, মূসা (আঃ) এবং সকল মানুষই আল্লাহ! এগুলি কি আক্ষরিক অর্থে বুঝতে হবে? না কিতাবুল মোকাদ্দসের অন্যান্য বক্তব্যের আলোকে বুঝতে হবে?
ঈসা মাসীহের উপরের কথাও তাঁর ও নবীগণের সুস্পষ্ট কথার আলোকেই ব্যাখ্যা করতে হবে। কিতাবুল মোকাদ্দস বারংবার বলেছে যে, ঈশ্বরকে দেখা যায় না; যা দেখা যায় তা ঈশ্বর নয়; তিনি কারো মধ্যে থাকেন না; তিনি কারো মত নয়; তিনি এক, অদ্বিতীয় ও অতুলনীয়। কাজেই উপরের কথাগুলি এ মূলনীতির আলোকেই ব্যাখ্যা করতে হবে। বস্তুত, কারো মধ্যে আল্লাহর অবস্থান, কারো সাথে আল্লাহর এক হওয়া, কাউকে দেখলে আল্লাহকে দেখা ইত্যাদির অর্থ তার সাথে আল্লাহর ঘনিষ্ঠতা, প্রেম, তাঁর কর্মকাণ্ডের মধ্যে আল্লহর নিদর্শন প্রত্যক্ষ করা ইত্যাদি।
মজার বিষয় হলো ত্রিত্ববাদী পলীয় খৃস্টানগণও এগুলি বাহ্যিক অর্থে বিশ্বাস করেন না। তারা কখনোই বিশ্বাস করেন না যে পিতা ঈশ্বর ও পুত্র ঈশ্বর এক বা যীশুর দেহ দেখলে প্রকৃতই পিতা ঈশ্বরকে দেখা হয়। বরং তারা বিশ্বাস করেন পিতা পুত্র নন এবং পুত্রও পিতা নন; তারা উভয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন দুজন ব্যক্তি। এরপরও তাঁরা এ সকল কথাকে দলীল হিসেবে পেশ করেন।
পলীয়গণ যীশুর অলৌকিক কর্মগুলোকে তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা বা ঈশ্বরত্বের প্রমাণ হিসেবে পেশ করেন। যেমন, পিতা ব্যতিরেকে জন্ম ও মৃতকে জীবিত করা। বাইবেলের আলোকে এগুলি অলৌকিক ক্ষমতা বা ঈশ্বরত্বের প্রমাণ নয়। আদম পিতামাতা ব্যতিরেকে জন্মগ্রহণ করেন। ইবরাহীম (আঃ)-এর সমসাময়িক যাজক মল্কীষেদক (Melchisedec) পিতামাতা ব্যতিরেকেই জন্ম গ্রহণ করেন (ইব্রীয় ৭/১-৩)। মৃতকে জীবিত করাও যীশুর কোনো বিশেষত্ব নয়। ইঞ্জিলের বর্ণনানুসারে যীশু মাত্র তিন ব্যক্তিকে জীবিত করেছিলেন। পক্ষান্তরে যিহিষ্কেল ভাববাদী হাজার হাজার মৃত মানুষকে জীবিত করেন (যিহিষ্কেল ৩৭/১-১৪)। মৃতকে জীবিত করা যদি ঈশ্বরত্বের প্রমাণ হয় তবে যিহিষ্কেল ভাববাদীই ঈশ্বর হওয়ার অধিকতর যোগ্যতা রাখেন। এছাড়া এলিয় (Elijah) একটি মৃত শিশুকে পুনর্জীবিত করেন (১ রাজাবলি ১৭/১৭-২৪)। ইলীশায় (Elisha) একজন মৃত বালককে পুনর্জীবিত করেন (২ রাজাবলি ৪/৮-৩৭)। ইলীশায় কুষ্ঠরোগীকে আরোগ্য করেন (২ রাজাবলির ৫/১-১৪)। মূসার (আঃ) অলৌকিক কার্যাদি প্রসিদ্ধ। অলৌকিক কার্য ঈশ্বরত্বের প্রমাণ হলে এরা সকলেই ঈশ্বর বলে গণ্য হতেন।
খৃস্টানগণ দাবি করেন যে, ঈসা মাসীহ আল্লাহকে পিতা বলেছেন এবং নিজেকে আল্লাহর পুত্র বলেছেন, কাজেই তিনি প্রকৃতই আল্লাহর পুত্র। আল্লাহকে পিতা বলা এবং মানুষকে পুত্র বলার প্রকৃত অর্থ আমরা উপরে আলোচনা করেছি। আমরা দেখেছি যে, আল্লাহকে পিতা বললে বা কাউকে ‘ইবনুল্লাহ’ বা আল্লাহর পুত্র বললে যদি তার ঈশ্বরত্ব প্রমাণিত হয় তাহলে হাওয়ারীগণ, সকল ধার্মিক মানুষ, বরং বিশ্বের সকল মানুষই ‘ইবনুল্লাহ’ ও ‘আল্লাহ’ বলে প্রমাণিত হবে!! এখানে আরো কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয়:
প্রথমত: কিতাবুল মোকাদ্দস প্রমাণ করে যে, পুত্র হিসেবে ঈসা মাসীহ অতি সাধারণ পুত্র। তার কোনো বিশেষত্বের কথা বলা হয় নি। পক্ষান্তরে ইয়াকূব (আঃ), তাঁর পৌত্র ইফ্রমিয় ও দায়ূদ (আঃ)-কে “আল্লাহর প্রথমজাত পুত্র” (firstborn) বলা হয়েছে (যাত্রাপুস্তক ৪/২২, যিরমিয় ৩১/৯, গীতসংহিতা ৮৯/২৭) তাহলে কী ইয়াকূব (আঃ), ইফ্রিমিয় ও দায়ূদ (আঃ) ঈসা মাসীহের চেয়েও বড় ঈশ্বর!
দ্বিতীয়ত: দায়ূদকে (আঃ) আল্লাহ বলেন: “(Thou art my Son; this day have I begotten thee) তুমি আমার পুত্র, অদ্য আমি তোমাকে জন্ম দিয়াছি।” (গীতসংহিতা ২/৭)। ইংরেজি (beget) অর্থ পিতা কর্তৃক সন্তান জন্ম দেওয়া, অর্থাৎ ঔরসে জন্ম দেওয়া। বাইবেলে অসংখ্যবার শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন (Abraham begat Isaac) ইবরাহীম ইসহাককে জন্ম দিলেন। দায়ূদ নবীকে আল্লাহ তার পুত্র বানিয়েই ক্ষান্ত হন নি; উপরন্তু তিনি জানালেন যে, দায়ূদ তার জন্ম দেওয়া বা ঔরসজাত (begotten) সন্তান। দায়ূদ মানবসন্তান হয়ে জন্মলাভের প্রায় ৫০ বৎসর পরে ঈশ্বরের সন্তান হিসেবে জন্মলাভ করলেন! এরূপ কোনো বৈশিষ্ট্য যীশুর বিষয়ে বলা হয় নি। তাহলে প্রমাণ হলো যে, দায়ূদ যীশুর চেয়ে অনেক বড় ঈশ্বর!
তৃতীয়ত: পলীয়গণ যীশুকে আল্লাহর একমাত্র ‘জন্মদেওয়া’ বা ঔরসজাত: ‘একজাত’ পুত্র (only begotten Son of God) বলে প্রচার করেন। সাধু পল ও তার অনুসারীরা চতুর্থ ইঞ্জিলে ও একটি পত্রে এ পরিভাষা ব্যবহার করেছেন, তবে যীশুর বক্তব্যে ঢুকাতে পারেন নি ( যোহন ১/১৮, ৩/১৬, ৩/১৮; ১-যোহন ৪/৯)।
কথাটি অসত্য। বাইবেল অনুসারে যীশু নন; বরং দায়ূদই আল্লাহর ‘একজাত’ বা একমাত্র জন্ম দেওয়া পুত্র। প্রচলিত ইঞ্জিলের মধ্যে মাসীহ কোথাও বলেন নি যে, তিনি ‘আল্লাহর জন্ম দেওয়া পুত্র (begotten Son)’। যদি তা থাকতো তবে আমরা বলতাম: দায়ূদ আল্লাহর প্রথম এবং যীশু দ্বিতীয় ‘জন্ম-দেওয়া’ পুত্র। কিন্তু তা নেই!
চতুর্থত: তাঁরা দাবি করেন, আল্লাহ যখন দায়ূদ (আঃ)-কে বলেন: ‘অদ্য আমি তোমাকে জন্ম দিয়াছি” তখন তিনি দায়ূদকে বুঝান নি, ঈসা মাসীহকে বুঝিয়েছেন, কারণ তিনি দায়ূদের সন্তান বা দায়ূদের বংশধর!!!
কী উদ্ভট কথা! ইঞ্জিলে আল্লাহ যীশুকে যে মর্যাদার কথা বলেছেন কেউ যদি বলেন যে, কথাটি যীশুর জন্য নয়; বরং ইস্রাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর জন্য, কারণ তিনি যীশুর বংশের, অথবা বারাক ওবামার জন্য, কারণ তিনি যীশুর অনুসারী- তাহলে আপনি তাকে কী বলবেন? পাগলের সাথে কি বিতর্ক হয়?
আর যীশু দায়ূদের সন্তানই বা কিভাবে? পিতার দিক থেকে? না মাতার দিক থেকে? মরিয়মের স্বামী ইউসূফ দায়ূদের বংশধর ছিলেন। তবে ইঞ্জিল স্পষ্টত বলেছে যে, যীশু কোনোভাবেই ইউসুফের সন্তান নন। তার দেহে ইউসুফের রক্ত নেই। আর তার মাতা মরিয়ম দায়ূদের বংশধর ছিলেন বলে কোনো প্রমাণ নেই। বরং চতুর্থ শতকের শ্রেষ্ঠ খৃস্টান ধর্মগুরু অগাস্টিন (St. Augustine: 354-430) লিখেছেন যে, তার যুগে প্রচলিত কোনো কোনো গ্রন্থে স্পষ্টত উল্লেখ করা হয়েছে যে, মরিয়ম লেবির বংশধর। (ইযহারুল হক্ক: বঙ্গানুবাদ ১/১৬৪) ইয়াকূব (আঃ)-এর ১২ ছেলের একজন লেবি এবং অন্যজন যিহূদা। দায়ূদ যিহূদার বংশধর। আর মরিয়ম লেবির বংশধর। কাজেই যীশুর দায়ূদ-বংশের হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই।
পঞ্চমত: ‘আজ আমি তোমাকে জন্ম দিলাম’ কথাটির উদ্দেশ্য যদি মাসীহ হন তাহলে ত্রিত্ববাদী খৃস্টধর্ম বাতিল হয়ে যায়। কারণ এতে প্রমাণিত হয় যে, দায়ূদের শাসনামলে খৃস্টপূর্ব ১০০০ সালের দিকে পুত্র ঈশ্বরের জন্ম! অথচ ত্রিত্ববাদীদের বিশ্বাস লক্ষ কোটি বৎসর পূর্বে পুত্র ঈশ্বরের জন্ম! তিনি পিতারই মত অনাদি।
ষষ্ঠত: সম্মানিত পাঠক, এ অনুচ্ছেদের শুরুতে আমরা বলেছি যে, ঈসা মাসীহের ঈশ্বরত্ব প্রমাণ করতে পলের অনুসারিগণ জালিয়াতির আশ্রয় নিতেন। এরূপ জালিয়াতির একটি প্রমাণ, বিগত প্রায় দু হাজার বৎসর যাবৎ নতুন নিয়মের যত স্থানে (only begotten Son) লেখা ছিল ১৯৫২ খৃস্টাব্দে প্রকাশিত রিভাইযড স্টান্ডার্ড ভার্শনে সকল স্থান থেকে (begotten) শব্দটি ফেলে দিয়ে (only Son) লেখা হয়েছে; কারণ নতুন নিয়মের প্রাচীন পাণ্ডুলিপিগুলিতে এ শব্দটি নেই। ইংরেজি KJV ও RSV দুটি সংস্করণে যোহন ১/১৮, ৩/১৬, ৩/১৮; ১-যোহন ৪/৯ মিলিয়ে দেখলেই পাঠক তা জানতে পারবেন।
সপ্তমত: ঈসা মাসীহ আল্লাহর একমাত্র পুত্র (only Son) একথা বিশ্বাস করতে হলে পুরো কিতাবুল মোকাদ্দস ও ঈসা মাসীহকে মিথ্যাবাদী বলে বিশ্বাস করা জরুরী। কারণ আমরা দেখেছি যে, কিতাবুল মোকাদ্দসে ও ইঞ্জিল শরীফে আল্লাহর আরো লক্ষ কোটি পুত্র ও কন্যার কথা সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে।
পবিত্র আত্মা: পাক রূহ (Holy Spirit), পবিত্র ভূত (Holy Ghost), ঈশ্বরের আত্মা (Spirit of God/ Spirit of the LORD) শব্দগুলি বাইবেলের পুরাতন ও নতুন নিয়মে অনেক স্থানে ব্যবহৃত হয়েছে। কোথাও একে ‘ঈশ্বর’ বা ‘ঈশ্বরের তিন ব্যক্তির এক ব্যক্তি’ বলে উল্লেখ করা হয় নি। বরং কখনো মানুষ, কখনো নবী, কখনো ফিরিশতা এবং কখনো আল্লাহর প্রেরণা বুঝানো হয়েছে। যেমন: “সদাপ্রভু কহিলেন, আমার আত্মা মনুষ্যদের মধ্যে নিত্য অধিষ্ঠান করিবে না; কারণ সেও তো মাংস মাত্র (My Spirit shall not always strive with man, for that he also is flesh) পরন্তু তাহাদের সময় এক শত বিংশতি বৎসর হইবে। (আদিপুস্তক ৬/৩) এখানে আল্লাহর আত্মা বলতে সুস্পষ্টত আল্লাহর সৃষ্ট মানবাত্মা বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহর রূহ বা মানবাত্মা অমর হবে না; বরং সীমিত বৎসর- ১২০ বৎসর!- আয়ু লাভ করবে।
অন্যত্র আল্লাহ মৃতদেরকে জীবন দান প্রসঙ্গে বলেন: “আর আমি তোমাদের মধ্যে আপন আত্মা দিব (And shall put my spirit in you)।” (যিহিষ্কেল ৩৭/১৪)। এখানেও “আল্লাহর রূহ” বলতে ‘মানবীয় আত্মা’ বা জীবন বুঝানো হয়েছে।
প্রচলিত ইঞ্জিলগুলির মধ্যে বিদ্যমান ঈসা মাসীহের বক্তব্যে পবিত্র আত্মা ও পবিত্র ভূতের কথা কয়েকবার এসেছে। কোথাও তিনি তাকে আল্লাহ বা আল্লাহর তিন ব্যক্তির একব্যক্তি বলে উল্লেখ করেন নি। বরং বাহ্যত তিনি তাঁকে আল্লাহর ওহীর বাহক হিসেবেই উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন: “আমি তোমাদিগকে বলিতেছি, মনুষ্যদের সকল পাপ ও নিন্দার ক্ষমা হইবে, কিন্তু পবিত্র আত্মার নিন্দার ক্ষমা হইবে না। আর যে কেহ মনুষ্যপুত্রের (ঈসা মাসীহের) বিরুদ্ধে কোনো কথা কহে সে ক্ষমা পাইবে, কিন্তু যে কেহ পবিত্র আত্মার বিরুদ্ধে কথা কহে সে ক্ষমা পাইবে না, ইহকালেও নয়, পরকালেও নয়।” (মথি ১২/৩১-৩২)
এখানে পবিত্র আত্মা অর্থ ওহীর বাহক। পবিত্র আত্মার মাধ্যমেই নবীগণ ওহী লাভ করেন। এজন্য যীশু বললেন, যদি কেউ সত্য নবীর ওহী লাভের দাবি অবিশ্বাস করে অথবা ওহীর নামে মিথ্যা বলে তবে দুনিয়া ও আখিরাতে তাকে শাস্তি পেতে হবে। এজন্যই বাইবেলের বিধান: ওহীর নামে মিথ্যা বললে দুনিয়াতেই নিহত হতে হবে।
সাধু পলই সর্বপ্রথম পবিত্র আত্মা বা ঈশ্বরের আত্মা বলতে পৃথক ঐশ্বরিক সত্ত্বা ও স্বয়ং সম্পূর্ণ ঈশ্বর বলে দাবি করেন। (রোমীয় ৮/২)
সাধু পল উদ্ভাবিত ধর্মের অন্যতম বিশ্বাস আদিপাপ ও প্রায়শ্চিত্ত, যার মূল কথা:
“আদম নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণ করে মহাপাপ করেন। এজন্য কিয়ামত পর্যন্ত সকল আদমসন্তানের শাস্তি ও অনন্ত মৃত্যু পাওনা হয়। ‘পিতার অপরাধে সকল সন্তানের নরক-গমনের’ এ “দয়াময়” ব্যবস্থায় দয়াময় স্রষ্টা অত্যন্ত ব্যথিত হয়ে পড়েন। বিনা রক্তপাতে মানুষকে ক্ষমা করতে অক্ষম হয়ে তিনি নিজের পুত্রকে কুরবানি করার সিদ্ধান্ত নেন। কারণ, পাপের জন্য পাপী নিজের বা পাপীর সন্তানগণ রক্তপাত করলে হবে না! বরং নিরপরাধ-নিষ্পাপ কাউকে ধরে কুরবানি দিতে হবে। এজন্য স্রষ্টা নিজের আপন পুত্রকে কুরবানি হিসেবে পৃথিবীতে পাঠান। তিনি ক্রুশে মরে অভিশপ্ত হয়ে নরকে প্রবেশ করেন। তিনদিন নরক ভোগ করেন এবং শয়তানের হাত থেকে নরকের চাবি কেড়ে নিয়ে মানুষদেরকে চিরতরে মুক্ত করে দেন। এখন মানুষ যত পাপই করুক না কেন যীশুর ঈশ্বরত্বে ও কুরবানীতে বিশ্বাস করলেই নরক থেকে চিরমুক্তি!”
চিন্তা করুন! আল্লাহ একের অপরাধে অন্যকে শাস্তি দিবেন! পাপী ক্ষমা চাইলেও ক্ষমা করতে পারবেন না! পাপী বা তার সন্তানগণ কাফ্ফারা-কুরবানী দিলে হবে না, পাপীর অপরাধে নিষ্পাপকে কুরবানী দিতে হবে! একজন খৃস্টান লেখক লিখেছেন:
"No heathen tribe has conceived so grotesque an idea, involving as it does the assumption, that man was born with a hereditary stain uopn him, and that this stain (for wihch he was not personally responsible) was to be atoned for, and that the creator of all things had to sacrifice His only begotten son to neutralise this mysterious curse."
“কোনো নাস্তিক জংলী উপজাতিও এরূপ উদ্ভট বিশ্বাস পোষণ করে না যে, মানুষ বংশগতভাবে পাপের কলঙ্ক নিয়ে জন্মগ্রহণ করে এবং এ কলঙ্ক, যার জন্য সে নিজে কোনোরূপ দায়ী নয়, তার জন্য কাফ্ফারা দিতে হবে এবং এ রহস্যময় অভিশাপকে অকার্যকর করতে সকল কিছুর স্রষ্টা নিজের একমাত্র ঔরসজাত সন্তানকে কুরবানী দিতে বাধ্য হলেন।” (Ahmed Deedat, The Choice, Volume 2, page 165.)
ইঞ্জিলের মাসীহ মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য গ্রেফতারের আগের রাতে মাটিতে মাথা ঠুকে কেঁদেছিলেন ও প্রার্থনা করেছিলেন। মৃত্যুর সময় তিনি চিৎকার করে বলেন: “আল্লাহ তুমি কেন আমাকে পরিত্যাগ করলে!” (মথি ২৬/৩৬-৪৬, ২৭/৪৬)। অপরাধীর মুক্তির জন্য একজন অনিচ্ছুক নিরাপরাধীকে জোর করে হত্যা করতে হবে!
এ আকীদার সবচেয়ে বড় দিক ঈশ্বরের মহানুভবতা! শাস্তির ক্ষেত্রে অকৃপণ ও মহানুভব হলেও মুক্তির ক্ষেত্রে কৃপণ! (নাঊযু বিল্লাহ) আদমের পাপের কারণে শাস্তি পেতে কোনো মানুষের কোনো বিশ্বাস বা স্বীকারোক্তির প্রয়োজন নেই। ফ্রি শাস্তি! তবে যীশুর ত্যাগের কারণে মুক্তিটা ফ্রি নয়! বরং বিশ্বাস ও স্বীকারোক্তি লাগবে!
সাধু পলের ভাষায়: “একটা পাপের মধ্য দিয়া যেমন সমস্ত মানুষকেই আজাব পাইবার যোগ্য বলিয়া ধরা হইয়াছে, তেমনি একটি ন্যায্য কাজের মধ্য দিয়া সমস্ত মানুষকেই নির্দোষ বলিয়া গ্রহণ করিবার ব্যবস্থাও করা হইয়াছে। যেমন একজন মানুষের অবাধ্যতার মধ্য দিয়া অনেকেই পাপী হইয়াছিল, তেমনি একজন মানুষের বাধ্যতার মধ্য দিয়া অনেকেই নির্দোষ বলিয়া গ্রহণ করা যাইবে।” (রোমীয় ৫/১৭-১৮)... “রক্তসেচন (রক্তপাত) না হইলে পাপমোচন হয় না।” (ইব্রীয়: ৯/২২) পুনশ্চ: (রোমীয় ৪/২৫, ৫/১২, ১৪, ১০/৯; গালাতীয় ৩/১০-১৩; ইফিষীয় ১/৭; করিন্থীয় ১৫/২১-২২)।
এ উদ্ভট আকীদার দুটি বিষয়ই ভিত্তিহীন অসত্য (১) একের পাপে অন্যের শাস্তি ও একের ত্যাগে অন্যের মুক্তি এবং (২) রক্তপাত ছাড়া পাপমুক্তি হয় না।
কিতাবুল মোকাদ্দসের বিধান: “প্রত্যেক জন আপন আপন অপরাধ প্রযুক্ত মরিবে” (যিরমিয় ৩১/৩০)। “যে প্রাণী পাপ করে সে-ই মরিবে।” (যিহিষ্কেল ১৮/৪)। পুনশ্চ: দ্বিতীয় বিবরণ ২৪/১৬, ২-রাজাবলি ১৪/৬; ২-বংশাবলি ২৫/৪।
যিহিস্কেল ১৮/১৯-২৩: “তবুও তোমরা বলছ, ‘বাবার দোষের জন্য কেন ছেলে শাস্তি পাবে না?’ সেই ছেলে তো ন্যায় ও ঠিক কাজ করেছে এবং আমার সমস্ত নিয়ম কানুন যত্নের সংগে পালন করেছে, তাই সে নিশ্চয়ই বাঁচবে। যে গুনাহ করবে সে-ই মরবে। ছেলে বাবার দোষের জন্য শাস্তি পাবে না আর বাবাও ছেলের দোষের জন্য শাস্তি পাবে না। সৎ লোক তার সততার ফল পাবে এবং দুষ্ট লোক তার দুষ্টতার ফল পাবে। কিন্তু একজন দুষ্ট লোক তার সব গুনাহ থেকে ফিরে আমার সব নিয়ম-কানুন পালন করে আর ন্যায় ও ঠিক কাজ করে তবে সে নিশ্চয়ই বাঁচবে, মরবে না। সে যেসব অন্যায় করেছে তা আমি আর মনে রাখব না। সে যেসব সৎ কাজ করেছে তার জন্যই সে বাঁচবে। দুষ্ট লোকের মরণে কি আমি খুশী হই? বরং সে যখন কুপথ থেকে ফিরে বাঁচে তখনই আমি খুশী হই।
এতে প্রমাণ হয় (১) একের পাপে যেমন অন্যের শাস্তি এবং একের ত্যাগে অন্যের মুক্তির দাবি শতভাগ মিথ্যা এবং আল্লাহর নামে বে-ইনসাফির অপবাদ, (২) পাপীর মুক্তির জন্য কাফ্ফারা বা রক্তপাত নিষ্প্রয়োজন; তাওবা ও ধর্মপালনই যথেষ্ঠ। আর এটিই তো আল্লাহর ইনসাফ, দয়া ও মমতার প্রকাশ।
এভাবে বাইবেলে আল্লাহ বারংবার বলেছেন যে, পাপীর মুক্তির জন্য তিনি কাফ্ফারা বা কুরবানী চান না; বরং পাপীর ঈমান, তওবা ও নেক কর্ম চান: “আমি বিশ্বস্ততা চাই, পশু-কোরবানী নয়: পোড়ানো-কোরবানীর চেয়ে আমি চাই যেন মানুষ সত্যিকারভাবে আল্লাহ্কে চেনে। (হোশেয় ৬/৬। মথি ৯/১৩ ও ১২/৭)
ইঞ্জিলে বলা হয়েছে যে, আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস, সকল মনপ্রাণ দিয়ে তাঁকে ভালবাসা এবং প্রতিবেশীকে নিজের মত ভালবাসা- সকল কাফ্ফারার চেয়ে অধিক শক্তিশালী এবং এরূপ বিশ্বাস ও কর্ম থাকলেই সে জান্নাতী (মার্ক ১২/৩২-৩৪)
যীশু বলেন: “মনুষ্যদের সকল পাপ ও নিন্দার ক্ষমা হইবে, কিন্তু পবিত্র আত্মার নিন্দার ক্ষমা হইবে না। আর যে কেহ মনুষ্যপুত্রের (যীশুর) বিরুদ্ধে কোনো কথা কহে সে ক্ষমা পাইবে, কিন্তু যে কেহ পবিত্র আত্মার বিরুদ্ধে কথা কহে সে ক্ষমা পাইবে না, ইহকালেও নয়, পরকালেও নয়।” (মথি ১২/৩১-৩৩)।
সাধু পলের মতবাদ সত্য হলে ঈসা মাসীহের কথা মিথ্যা বলতেই হবে! কারণ মাসীহ বলছেন যে, পাপ ক্ষমার জন্য অন্য কোনো বিষয় ধর্তব্য নয়, শুধু পাপের বড়ত্ব ও ভয়ঙ্করত্বই বিবেচ্য; এজন্য পবিত্র আত্মার বিরুদ্ধে অপরাধ, অর্থাৎ ওহীর নামে জালিয়াতি, কোনো সত্য নবীর প্রতি অবিশ্বাস বা শির্ক-কুফর-এর পাপ ক্ষমা করা হবে না, অন্যান্য পাপ ক্ষমা করা হবে। এর বিপরীতে সাধু পল বলছেন, পাপের গভীরতা বা বড়ত্ব বিবেচ্য নয়; বরং কাফ্ফারা তত্বে পাপীর বিশ্বাসই বিবেচ্য। কাফ্ফারা ছাড়া কোনো পাপই ক্ষমা হবে না। আর যীশুর রক্তে কাফ্ফারা তত্ত্বে বিশ্বাস করলে পবিত্র আত্মার নিন্দা-সহ সকল পাপই ক্ষমা হবে।
ইঞ্জিলে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মানুষেরা কয়েকজন শিশুকে ঈসা মাসীহের নিকট দো‘আর জন্য নিয়ে আসে। কিন্তু শিশুদের তাঁর নিকট আনয়নকে অন্যায় মনে করে শিষ্যগণ লোকগুলির উপর রাগ করেন। এতে মাসীহ অসন্তুষ্ট হয়ে বলেন: “শিশুদেরকে আমার নিকট আসিতে দেও, বারণ করিও না; কেননা ঈশ্বরের রাজ্য এই মত লোকদেরই (for of such is the kingdom of God/ kingdom of heaven.। (মার্ক ১০/১৪) আরো দেখুন: মথি ১৯/১৪; লূক ১৮/১৬
তাহলে ঈসায়ী আকীদায় আদিপাপ বলে কিছুই নেই। কোনো মানুষই পাপ নিয়ে জন্মায় না বরং নিষ্পাপ জন্মগ্রহণ করে। বড় হয়ে মানুষ পাপ করে। কাজেই কেউ যদি বড় হয়ে করা পাপগুলি বর্জন করে শিশুদের মত হতে পারে তবে জান্নাত পাবে। পক্ষান্তরে পলীয় আকীদায় প্রত্যেক মানুষই আদিপাপ নিয়ে জন্মায়; শুধু পিতা-পুত্র-পবিত্র বিশ্বাসের মাধ্যমে মুক্তি পায়। এ বিশ্বাস ছাড়া পাপ বর্জন করে শিশুর মত হলেও কোনো লাভ নেই; আর এ বিশ্বাস থাকলে পাপ করলেও তেমন অসুবিধা নেই!