লগইন করুন
সাধু পল উদ্ভাবিত ধর্মের অন্যতম বিশ্বাস আদিপাপ ও প্রায়শ্চিত্ত, যার মূল কথা:
“আদম নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণ করে মহাপাপ করেন। এজন্য কিয়ামত পর্যন্ত সকল আদমসন্তানের শাস্তি ও অনন্ত মৃত্যু পাওনা হয়। ‘পিতার অপরাধে সকল সন্তানের নরক-গমনের’ এ “দয়াময়” ব্যবস্থায় দয়াময় স্রষ্টা অত্যন্ত ব্যথিত হয়ে পড়েন। বিনা রক্তপাতে মানুষকে ক্ষমা করতে অক্ষম হয়ে তিনি নিজের পুত্রকে কুরবানি করার সিদ্ধান্ত নেন। কারণ, পাপের জন্য পাপী নিজের বা পাপীর সন্তানগণ রক্তপাত করলে হবে না! বরং নিরপরাধ-নিষ্পাপ কাউকে ধরে কুরবানি দিতে হবে। এজন্য স্রষ্টা নিজের আপন পুত্রকে কুরবানি হিসেবে পৃথিবীতে পাঠান। তিনি ক্রুশে মরে অভিশপ্ত হয়ে নরকে প্রবেশ করেন। তিনদিন নরক ভোগ করেন এবং শয়তানের হাত থেকে নরকের চাবি কেড়ে নিয়ে মানুষদেরকে চিরতরে মুক্ত করে দেন। এখন মানুষ যত পাপই করুক না কেন যীশুর ঈশ্বরত্বে ও কুরবানীতে বিশ্বাস করলেই নরক থেকে চিরমুক্তি!”
চিন্তা করুন! আল্লাহ একের অপরাধে অন্যকে শাস্তি দিবেন! পাপী ক্ষমা চাইলেও ক্ষমা করতে পারবেন না! পাপী বা তার সন্তানগণ কাফ্ফারা-কুরবানী দিলে হবে না, পাপীর অপরাধে নিষ্পাপকে কুরবানী দিতে হবে! একজন খৃস্টান লেখক লিখেছেন:
"No heathen tribe has conceived so grotesque an idea, involving as it does the assumption, that man was born with a hereditary stain uopn him, and that this stain (for wihch he was not personally responsible) was to be atoned for, and that the creator of all things had to sacrifice His only begotten son to neutralise this mysterious curse."
“কোনো নাস্তিক জংলী উপজাতিও এরূপ উদ্ভট বিশ্বাস পোষণ করে না যে, মানুষ বংশগতভাবে পাপের কলঙ্ক নিয়ে জন্মগ্রহণ করে এবং এ কলঙ্ক, যার জন্য সে নিজে কোনোরূপ দায়ী নয়, তার জন্য কাফ্ফারা দিতে হবে এবং এ রহস্যময় অভিশাপকে অকার্যকর করতে সকল কিছুর স্রষ্টা নিজের একমাত্র ঔরসজাত সন্তানকে কুরবানী দিতে বাধ্য হলেন।” (Ahmed Deedat, The Choice, Volume 2, page 165.)
ইঞ্জিলের মাসীহ মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য গ্রেফতারের আগের রাতে মাটিতে মাথা ঠুকে কেঁদেছিলেন ও প্রার্থনা করেছিলেন। মৃত্যুর সময় তিনি চিৎকার করে বলেন: “আল্লাহ তুমি কেন আমাকে পরিত্যাগ করলে!” (মথি ২৬/৩৬-৪৬, ২৭/৪৬)। অপরাধীর মুক্তির জন্য একজন অনিচ্ছুক নিরাপরাধীকে জোর করে হত্যা করতে হবে!
এ আকীদার সবচেয়ে বড় দিক ঈশ্বরের মহানুভবতা! শাস্তির ক্ষেত্রে অকৃপণ ও মহানুভব হলেও মুক্তির ক্ষেত্রে কৃপণ! (নাঊযু বিল্লাহ) আদমের পাপের কারণে শাস্তি পেতে কোনো মানুষের কোনো বিশ্বাস বা স্বীকারোক্তির প্রয়োজন নেই। ফ্রি শাস্তি! তবে যীশুর ত্যাগের কারণে মুক্তিটা ফ্রি নয়! বরং বিশ্বাস ও স্বীকারোক্তি লাগবে!
সাধু পলের ভাষায়: “একটা পাপের মধ্য দিয়া যেমন সমস্ত মানুষকেই আজাব পাইবার যোগ্য বলিয়া ধরা হইয়াছে, তেমনি একটি ন্যায্য কাজের মধ্য দিয়া সমস্ত মানুষকেই নির্দোষ বলিয়া গ্রহণ করিবার ব্যবস্থাও করা হইয়াছে। যেমন একজন মানুষের অবাধ্যতার মধ্য দিয়া অনেকেই পাপী হইয়াছিল, তেমনি একজন মানুষের বাধ্যতার মধ্য দিয়া অনেকেই নির্দোষ বলিয়া গ্রহণ করা যাইবে।” (রোমীয় ৫/১৭-১৮)... “রক্তসেচন (রক্তপাত) না হইলে পাপমোচন হয় না।” (ইব্রীয়: ৯/২২) পুনশ্চ: (রোমীয় ৪/২৫, ৫/১২, ১৪, ১০/৯; গালাতীয় ৩/১০-১৩; ইফিষীয় ১/৭; করিন্থীয় ১৫/২১-২২)।
এ উদ্ভট আকীদার দুটি বিষয়ই ভিত্তিহীন অসত্য (১) একের পাপে অন্যের শাস্তি ও একের ত্যাগে অন্যের মুক্তি এবং (২) রক্তপাত ছাড়া পাপমুক্তি হয় না।
কিতাবুল মোকাদ্দসের বিধান: “প্রত্যেক জন আপন আপন অপরাধ প্রযুক্ত মরিবে” (যিরমিয় ৩১/৩০)। “যে প্রাণী পাপ করে সে-ই মরিবে।” (যিহিষ্কেল ১৮/৪)। পুনশ্চ: দ্বিতীয় বিবরণ ২৪/১৬, ২-রাজাবলি ১৪/৬; ২-বংশাবলি ২৫/৪।
যিহিস্কেল ১৮/১৯-২৩: “তবুও তোমরা বলছ, ‘বাবার দোষের জন্য কেন ছেলে শাস্তি পাবে না?’ সেই ছেলে তো ন্যায় ও ঠিক কাজ করেছে এবং আমার সমস্ত নিয়ম কানুন যত্নের সংগে পালন করেছে, তাই সে নিশ্চয়ই বাঁচবে। যে গুনাহ করবে সে-ই মরবে। ছেলে বাবার দোষের জন্য শাস্তি পাবে না আর বাবাও ছেলের দোষের জন্য শাস্তি পাবে না। সৎ লোক তার সততার ফল পাবে এবং দুষ্ট লোক তার দুষ্টতার ফল পাবে। কিন্তু একজন দুষ্ট লোক তার সব গুনাহ থেকে ফিরে আমার সব নিয়ম-কানুন পালন করে আর ন্যায় ও ঠিক কাজ করে তবে সে নিশ্চয়ই বাঁচবে, মরবে না। সে যেসব অন্যায় করেছে তা আমি আর মনে রাখব না। সে যেসব সৎ কাজ করেছে তার জন্যই সে বাঁচবে। দুষ্ট লোকের মরণে কি আমি খুশী হই? বরং সে যখন কুপথ থেকে ফিরে বাঁচে তখনই আমি খুশী হই।
এতে প্রমাণ হয় (১) একের পাপে যেমন অন্যের শাস্তি এবং একের ত্যাগে অন্যের মুক্তির দাবি শতভাগ মিথ্যা এবং আল্লাহর নামে বে-ইনসাফির অপবাদ, (২) পাপীর মুক্তির জন্য কাফ্ফারা বা রক্তপাত নিষ্প্রয়োজন; তাওবা ও ধর্মপালনই যথেষ্ঠ। আর এটিই তো আল্লাহর ইনসাফ, দয়া ও মমতার প্রকাশ।
এভাবে বাইবেলে আল্লাহ বারংবার বলেছেন যে, পাপীর মুক্তির জন্য তিনি কাফ্ফারা বা কুরবানী চান না; বরং পাপীর ঈমান, তওবা ও নেক কর্ম চান: “আমি বিশ্বস্ততা চাই, পশু-কোরবানী নয়: পোড়ানো-কোরবানীর চেয়ে আমি চাই যেন মানুষ সত্যিকারভাবে আল্লাহ্কে চেনে। (হোশেয় ৬/৬। মথি ৯/১৩ ও ১২/৭)
ইঞ্জিলে বলা হয়েছে যে, আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস, সকল মনপ্রাণ দিয়ে তাঁকে ভালবাসা এবং প্রতিবেশীকে নিজের মত ভালবাসা- সকল কাফ্ফারার চেয়ে অধিক শক্তিশালী এবং এরূপ বিশ্বাস ও কর্ম থাকলেই সে জান্নাতী (মার্ক ১২/৩২-৩৪)
যীশু বলেন: “মনুষ্যদের সকল পাপ ও নিন্দার ক্ষমা হইবে, কিন্তু পবিত্র আত্মার নিন্দার ক্ষমা হইবে না। আর যে কেহ মনুষ্যপুত্রের (যীশুর) বিরুদ্ধে কোনো কথা কহে সে ক্ষমা পাইবে, কিন্তু যে কেহ পবিত্র আত্মার বিরুদ্ধে কথা কহে সে ক্ষমা পাইবে না, ইহকালেও নয়, পরকালেও নয়।” (মথি ১২/৩১-৩৩)।
সাধু পলের মতবাদ সত্য হলে ঈসা মাসীহের কথা মিথ্যা বলতেই হবে! কারণ মাসীহ বলছেন যে, পাপ ক্ষমার জন্য অন্য কোনো বিষয় ধর্তব্য নয়, শুধু পাপের বড়ত্ব ও ভয়ঙ্করত্বই বিবেচ্য; এজন্য পবিত্র আত্মার বিরুদ্ধে অপরাধ, অর্থাৎ ওহীর নামে জালিয়াতি, কোনো সত্য নবীর প্রতি অবিশ্বাস বা শির্ক-কুফর-এর পাপ ক্ষমা করা হবে না, অন্যান্য পাপ ক্ষমা করা হবে। এর বিপরীতে সাধু পল বলছেন, পাপের গভীরতা বা বড়ত্ব বিবেচ্য নয়; বরং কাফ্ফারা তত্বে পাপীর বিশ্বাসই বিবেচ্য। কাফ্ফারা ছাড়া কোনো পাপই ক্ষমা হবে না। আর যীশুর রক্তে কাফ্ফারা তত্ত্বে বিশ্বাস করলে পবিত্র আত্মার নিন্দা-সহ সকল পাপই ক্ষমা হবে।
ইঞ্জিলে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মানুষেরা কয়েকজন শিশুকে ঈসা মাসীহের নিকট দো‘আর জন্য নিয়ে আসে। কিন্তু শিশুদের তাঁর নিকট আনয়নকে অন্যায় মনে করে শিষ্যগণ লোকগুলির উপর রাগ করেন। এতে মাসীহ অসন্তুষ্ট হয়ে বলেন: “শিশুদেরকে আমার নিকট আসিতে দেও, বারণ করিও না; কেননা ঈশ্বরের রাজ্য এই মত লোকদেরই (for of such is the kingdom of God/ kingdom of heaven.। (মার্ক ১০/১৪) আরো দেখুন: মথি ১৯/১৪; লূক ১৮/১৬
তাহলে ঈসায়ী আকীদায় আদিপাপ বলে কিছুই নেই। কোনো মানুষই পাপ নিয়ে জন্মায় না বরং নিষ্পাপ জন্মগ্রহণ করে। বড় হয়ে মানুষ পাপ করে। কাজেই কেউ যদি বড় হয়ে করা পাপগুলি বর্জন করে শিশুদের মত হতে পারে তবে জান্নাত পাবে। পক্ষান্তরে পলীয় আকীদায় প্রত্যেক মানুষই আদিপাপ নিয়ে জন্মায়; শুধু পিতা-পুত্র-পবিত্র বিশ্বাসের মাধ্যমে মুক্তি পায়। এ বিশ্বাস ছাড়া পাপ বর্জন করে শিশুর মত হলেও কোনো লাভ নেই; আর এ বিশ্বাস থাকলে পাপ করলেও তেমন অসুবিধা নেই!