খৃস্টানগণ দাবি করেন যে, ঈসা মাসীহ আল্লাহকে পিতা বলেছেন এবং নিজেকে আল্লাহর পুত্র বলেছেন, কাজেই তিনি প্রকৃতই আল্লাহর পুত্র। আল্লাহকে পিতা বলা এবং মানুষকে পুত্র বলার প্রকৃত অর্থ আমরা উপরে আলোচনা করেছি। আমরা দেখেছি যে, আল্লাহকে পিতা বললে বা কাউকে ‘ইবনুল্লাহ’ বা আল্লাহর পুত্র বললে যদি তার ঈশ্বরত্ব প্রমাণিত হয় তাহলে হাওয়ারীগণ, সকল ধার্মিক মানুষ, বরং বিশ্বের সকল মানুষই ‘ইবনুল্লাহ’ ও ‘আল্লাহ’ বলে প্রমাণিত হবে!! এখানে আরো কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয়:
প্রথমত: কিতাবুল মোকাদ্দস প্রমাণ করে যে, পুত্র হিসেবে ঈসা মাসীহ অতি সাধারণ পুত্র। তার কোনো বিশেষত্বের কথা বলা হয় নি। পক্ষান্তরে ইয়াকূব (আঃ), তাঁর পৌত্র ইফ্রমিয় ও দায়ূদ (আঃ)-কে “আল্লাহর প্রথমজাত পুত্র” (firstborn) বলা হয়েছে (যাত্রাপুস্তক ৪/২২, যিরমিয় ৩১/৯, গীতসংহিতা ৮৯/২৭) তাহলে কী ইয়াকূব (আঃ), ইফ্রিমিয় ও দায়ূদ (আঃ) ঈসা মাসীহের চেয়েও বড় ঈশ্বর!
দ্বিতীয়ত: দায়ূদকে (আঃ) আল্লাহ বলেন: “(Thou art my Son; this day have I begotten thee) তুমি আমার পুত্র, অদ্য আমি তোমাকে জন্ম দিয়াছি।” (গীতসংহিতা ২/৭)। ইংরেজি (beget) অর্থ পিতা কর্তৃক সন্তান জন্ম দেওয়া, অর্থাৎ ঔরসে জন্ম দেওয়া। বাইবেলে অসংখ্যবার শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন (Abraham begat Isaac) ইবরাহীম ইসহাককে জন্ম দিলেন। দায়ূদ নবীকে আল্লাহ তার পুত্র বানিয়েই ক্ষান্ত হন নি; উপরন্তু তিনি জানালেন যে, দায়ূদ তার জন্ম দেওয়া বা ঔরসজাত (begotten) সন্তান। দায়ূদ মানবসন্তান হয়ে জন্মলাভের প্রায় ৫০ বৎসর পরে ঈশ্বরের সন্তান হিসেবে জন্মলাভ করলেন! এরূপ কোনো বৈশিষ্ট্য যীশুর বিষয়ে বলা হয় নি। তাহলে প্রমাণ হলো যে, দায়ূদ যীশুর চেয়ে অনেক বড় ঈশ্বর!
তৃতীয়ত: পলীয়গণ যীশুকে আল্লাহর একমাত্র ‘জন্মদেওয়া’ বা ঔরসজাত: ‘একজাত’ পুত্র (only begotten Son of God) বলে প্রচার করেন। সাধু পল ও তার অনুসারীরা চতুর্থ ইঞ্জিলে ও একটি পত্রে এ পরিভাষা ব্যবহার করেছেন, তবে যীশুর বক্তব্যে ঢুকাতে পারেন নি ( যোহন ১/১৮, ৩/১৬, ৩/১৮; ১-যোহন ৪/৯)।
কথাটি অসত্য। বাইবেল অনুসারে যীশু নন; বরং দায়ূদই আল্লাহর ‘একজাত’ বা একমাত্র জন্ম দেওয়া পুত্র। প্রচলিত ইঞ্জিলের মধ্যে মাসীহ কোথাও বলেন নি যে, তিনি ‘আল্লাহর জন্ম দেওয়া পুত্র (begotten Son)’। যদি তা থাকতো তবে আমরা বলতাম: দায়ূদ আল্লাহর প্রথম এবং যীশু দ্বিতীয় ‘জন্ম-দেওয়া’ পুত্র। কিন্তু তা নেই!
চতুর্থত: তাঁরা দাবি করেন, আল্লাহ যখন দায়ূদ (আঃ)-কে বলেন: ‘অদ্য আমি তোমাকে জন্ম দিয়াছি” তখন তিনি দায়ূদকে বুঝান নি, ঈসা মাসীহকে বুঝিয়েছেন, কারণ তিনি দায়ূদের সন্তান বা দায়ূদের বংশধর!!!
কী উদ্ভট কথা! ইঞ্জিলে আল্লাহ যীশুকে যে মর্যাদার কথা বলেছেন কেউ যদি বলেন যে, কথাটি যীশুর জন্য নয়; বরং ইস্রাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর জন্য, কারণ তিনি যীশুর বংশের, অথবা বারাক ওবামার জন্য, কারণ তিনি যীশুর অনুসারী- তাহলে আপনি তাকে কী বলবেন? পাগলের সাথে কি বিতর্ক হয়?
আর যীশু দায়ূদের সন্তানই বা কিভাবে? পিতার দিক থেকে? না মাতার দিক থেকে? মরিয়মের স্বামী ইউসূফ দায়ূদের বংশধর ছিলেন। তবে ইঞ্জিল স্পষ্টত বলেছে যে, যীশু কোনোভাবেই ইউসুফের সন্তান নন। তার দেহে ইউসুফের রক্ত নেই। আর তার মাতা মরিয়ম দায়ূদের বংশধর ছিলেন বলে কোনো প্রমাণ নেই। বরং চতুর্থ শতকের শ্রেষ্ঠ খৃস্টান ধর্মগুরু অগাস্টিন (St. Augustine: 354-430) লিখেছেন যে, তার যুগে প্রচলিত কোনো কোনো গ্রন্থে স্পষ্টত উল্লেখ করা হয়েছে যে, মরিয়ম লেবির বংশধর। (ইযহারুল হক্ক: বঙ্গানুবাদ ১/১৬৪) ইয়াকূব (আঃ)-এর ১২ ছেলের একজন লেবি এবং অন্যজন যিহূদা। দায়ূদ যিহূদার বংশধর। আর মরিয়ম লেবির বংশধর। কাজেই যীশুর দায়ূদ-বংশের হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই।
পঞ্চমত: ‘আজ আমি তোমাকে জন্ম দিলাম’ কথাটির উদ্দেশ্য যদি মাসীহ হন তাহলে ত্রিত্ববাদী খৃস্টধর্ম বাতিল হয়ে যায়। কারণ এতে প্রমাণিত হয় যে, দায়ূদের শাসনামলে খৃস্টপূর্ব ১০০০ সালের দিকে পুত্র ঈশ্বরের জন্ম! অথচ ত্রিত্ববাদীদের বিশ্বাস লক্ষ কোটি বৎসর পূর্বে পুত্র ঈশ্বরের জন্ম! তিনি পিতারই মত অনাদি।
ষষ্ঠত: সম্মানিত পাঠক, এ অনুচ্ছেদের শুরুতে আমরা বলেছি যে, ঈসা মাসীহের ঈশ্বরত্ব প্রমাণ করতে পলের অনুসারিগণ জালিয়াতির আশ্রয় নিতেন। এরূপ জালিয়াতির একটি প্রমাণ, বিগত প্রায় দু হাজার বৎসর যাবৎ নতুন নিয়মের যত স্থানে (only begotten Son) লেখা ছিল ১৯৫২ খৃস্টাব্দে প্রকাশিত রিভাইযড স্টান্ডার্ড ভার্শনে সকল স্থান থেকে (begotten) শব্দটি ফেলে দিয়ে (only Son) লেখা হয়েছে; কারণ নতুন নিয়মের প্রাচীন পাণ্ডুলিপিগুলিতে এ শব্দটি নেই। ইংরেজি KJV ও RSV দুটি সংস্করণে যোহন ১/১৮, ৩/১৬, ৩/১৮; ১-যোহন ৪/৯ মিলিয়ে দেখলেই পাঠক তা জানতে পারবেন।
সপ্তমত: ঈসা মাসীহ আল্লাহর একমাত্র পুত্র (only Son) একথা বিশ্বাস করতে হলে পুরো কিতাবুল মোকাদ্দস ও ঈসা মাসীহকে মিথ্যাবাদী বলে বিশ্বাস করা জরুরী। কারণ আমরা দেখেছি যে, কিতাবুল মোকাদ্দসে ও ইঞ্জিল শরীফে আল্লাহর আরো লক্ষ কোটি পুত্র ও কন্যার কথা সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে।