“হে আল্লাহ! তুমি দুই উমর, উমর ইবনুল খাত্তাব অথবা আমর ইবন হিশাম এই দুজনের একজন দ্বারা ইসলামকে শক্তিশালী কর।”
ইসলামের চরম শত্রু উমর ইবনুল খাত্তাব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উদ্দেশ্যে কা‘বায় গেলেন। তার সামনেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সূরা হাজ্জ তিলাওয়াত করছিলেন, উমর ছিলেন তাঁর পিছনেই। কুরআনের অপূর্ব ভাষা ও অলৌকিকতা তাঁকে মোহাচ্ছন্ন করল। তিনি মনে মনে ভাবলেন, কুরাইশরা যে এঁকে কবি বলেছে, তা তো ঠিকই।
তখনই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাঠ করলেন: ‘‘নিশ্চয়ই এই কুরআন এক সম্মানিত রাসূলের বাহিত বার্তা। এটা কোনো কবির রচনা নয়, তোমরা অল্পই বিশ্বাস করে থাকে।”
তখন তাঁর মনে হলো যে কবি না হলেও নিশ্চয়ই ইনি জাদুকর। তখনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাঠ করলেন: ‘‘এটা কোন জাদুকর বা গণকের কথাও না, এটা জগতসমূহের প্রতিালকের নিকট হতে অবতীর্ণ।”
এভাবে ইসলাম উমরের অন্তরে গভীরভাবে গেঁথে যায়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তাঁর জন্য দো‘আ করেছিলেন। তারপর উমর ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁর ইসলাম গ্রহণ তখনকার মুষ্টিমেয় মুসলিম সমাজে সাহস ও উৎসাহের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
দৃঢ়তা ও সাহসই শুধু তাঁর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ছিল তা নয়। তিনি তাঁর বিজ্ঞতা, সুবিচার ও আল্লাহভীরুতার জন্যও সুপরিচিত ছিলেন। ইসলামের ইতিহাসের অনেক বড় বড় কাজ তাঁর পরামর্শে সম্পন্ন হয়েছে। তাঁর জীবন ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনেরই অংশবিশেষ। সকল পরামর্শ, সকল যুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করেন। বড় বড় সবকিছুতেই তিনি রাসূলের সাথে ছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর পর আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে খলিফা নির্বাচিত করার ব্যাপারে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। আবু বকরের খিলাফতের সময়ও তিনি ছিলেন তাঁর পরামর্শদাতা এবং সাহায্যকারী। কুরআন সংকলনের ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে তিনি আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে রাজী করান।
পরবর্তীতে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁকে খলিফা নির্বাচিত করে যান। তিনি তাঁর খিলাফতকালে বহু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। নিয়মিত চিঠি-পত্র, খবরাখবর আদান-প্রদান, সৈনিকদের তালিকাভুক্ত করণ-ইত্যাদি।
নানা ভাবেই তাঁর খিলাফত ছিল দৃষ্টান্তস্বরূপ। কারণ এতে ছিল ইসলামের শিক্ষার কঠোর অনুসরণ, দয়ার সাথে দৃঢ়তার মিশ্রণ, কঠোরতার সাথে সুবিচারের সমতাবিধান এবং মানুষের প্রতি দায়িত্বশীলতা। তাঁর সময়ে বিরাট এক এলাকা মুসলিম সাম্রাজ্যের অধীনে এসেছিল। ১০ বছরের কিছু বেশি সময় তিনি এই সাম্রাজ্যের খলিফা ছিলেন।
দু’টি সারি বেঁধে মুসলমানরা কা‘বায় প্রবেশ করল, একটির নেতৃত্বে ছিলেন উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু, অপরটির নেতৃত্বে হামযা রাদিয়াল্লাহু আনহু, কুরাইশরা যখন তাঁদের দেখল, তাদের চোখে-মুখে চরম বিষন্নতা ও হতাশার ছাপ ফুটে উঠল যা আগে কখনো দেখা যায় নি।
সেদিন আল্লাহর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে ‘আল ফারুক’ উপাধি দিলেন; কারণ সেদিন ইসলাম প্রকাশ্যে আত্মপ্রকাশ করেছিলো এবং সত্য ও মিথ্যার মাঝে পার্থক্য সৃষ্টি হয়েছিল।
একবার খলিফা উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে জিজ্ঞাসা করা হয় যে, ‘‘আল্লাহর মাল থেকে আপনি কতটুকু গ্রহণ করা নিজের পক্ষে বৈধ মনে করেন?’’
তিনি উত্তরে বলেন, ‘‘শীত ও গ্রীষ্মের জন্য দু’ খান কাপড়, হজ্জ-ওমরার জন্য সওয়ারীর জন্তু এবং কুরাইশের কোনো মাঝারি পরিবারের সমমানের খাদ্য আমার ও পরিবারবর্গের জন্য। এরপরে আমি সাধারণ মুসলিমের মতই একজন মুসলিম। তারা যা পাবে আমিও তাই পাব।”
সাধারণত এরকমই তাঁর জীবন ছিল। কখনো কখনো বরং তিনি বৈধ বিষয়েও নিজের উপর কঠোরতা আরোপ করতেন। একদিন তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তাঁকে চিকিৎসার জন্য মধূ ব্যবহার করতে বলা হলো। বাইতুল মালে প্রচুর মধু ছিল। তিনি মিম্বরে আরোহণ করে মুসলিমদের বললেন, ‘‘তোমরা অনুমতি দিলে মধু ব্যবহার করতে পারি, তা না হলে এটা আমার জন্য হারাম।” তৎক্ষণাৎ উপস্থিত সবাই অনুমতি দিয়ে দিল।
মুসলিমরা উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর এই কঠোরতা দেখে তাঁর কন্যা হাফসা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে বললেন যে, তিনি যেন তাঁর পিতাকে এই কৃচ্ছতাসাধন থেকে বিরত থাকতে অনুরোধ করেন। কারণ এখন মুসলমানরা সচ্ছল ও তাদের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে পূর্ণ অনুমোদন রয়েছে। হাফসা রাদিয়াল্লাহু আনহা যখন পিতাকে একথা বললেন, তখন তিনি জবাব দিলেন, ‘‘হাফসা, তুমি তোমার জাতির পক্ষপাতিত্ব করছো আর নিজের পিতার সাথে অহিতাকাংখী আচরণ করছো। আমার পরিবারের লোকদের আমার জানে ও মালে অধিকার রয়েছে, কিন্তু আমার ধর্ম ও আমানতদারীতে কোনো অধিকার নেই।”
উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু এর সময়ে একবার দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। তখন তিনি শপথ করেন যে যতদিন স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে না আসবে, ততদিন তিনি ঘি ও মাংস স্পর্শ করবেন না। তিনি এই প্রতিজ্ঞা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন। ফলে তেল খেতে খেতে তাঁর শরীরের চামড়া শুকিয়ে কালো হয়ে যায়। এর কিছুদিন পরে বাজারে দুটো পাত্রে দুধ ও ঘি বিক্রি হতে দেখা গেল। ওমরের ভৃত্য চল্লিশ দিরহাম দিয়ে তা কিনে এলো। সে এসে তাঁকে বলল, ‘এখন আল্লাহ আপনার প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করে দিয়েছেন। বাজারে দুধ ও ঘি বিক্রির জন্য এসেছে, আমি তা কিনে এনেছি।” কিন্তু যখন তিনি তার দাম জানতে পারলেন তখন বললেন, ‘‘খুব চড়া দামে কিনেছ, দুটোই সাদাকা করে দাও। আমি অপব্যয় পছন্দ করি না।” তারপর কিছুক্ষণ তিনি মাথা নিচু করে চিন্তা করলেন। তারপর বললেন, ‘‘জনগণের যে দূরবস্থা হয়, তা যদি আমারও না হয়, তাহলে তাদের সমস্যার গুরুত্ব আমি বুঝব কি দিয়ে?’’
একবার তিনি এক ব্যক্তির সাথে একটি ঘোড়ার দরদস্তুর করেন। তারপর পরীক্ষা করে দেখার জন্য সেটায় সওয়ার হয়ে দৌড়াদৌড়ি করেন। হঠাৎ সেটা ঠোকর খেয়ে পড়ে যায় এবং আহত হয়। তিনি ঘোড়া ফিরিয়ে দিতে চাইলেন। কিন্তু মালিক ঘোড়া ফেরত নিতে অসম্মতি জানালো। শেষ পর্যন্ত দুজনে মামলা নিয়ে কাজী শুরাইহের আদালতে গিয়ে হাজির হলেন। শুরাইহ উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনে রায় দিলেন, ‘‘আমিরুল মুমিনীন, আপনি যে জিনিস কিনেছেন তা নিয়ে নিন। অথবা যে অবস্থায় ওটা নিয়েছিলেন সে অবস্থায় ফেরত দিন।” উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলে উঠলেন, ‘‘একেই বলে ন্যায়বিচার।” তারপর তিনি শুরাইহকে কুফার বিচারপতি নিযুক্ত করেন।
অন্যদের মত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু চুপি চুপি হিজরত করেন নি। মক্কা থেকে মদীনায় যাত্রার পূর্বে তিনি প্রথমে কাবা তাওয়াফ করলেন। তারপর সমবেত কুরাইশদের সামনে গিয়ে ঘোষণা করলেন: আমি মদীনায় যাচ্ছি। কেউ যদি তার মাকে পুত্রশোক দিতে চায়, সে যেন এ উপত্যকার অপর প্রান্তে আমার মুখোমুখি হয়। তারপর তিনি মদীনার পথ ধরলেন প্রকাশ্যে। কিন্তু কেউ তাঁকে বাঁধা দেয়ার দুঃসাহস করলো না।
আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, ওমরের ইসলাম গ্রহণ ইসলামের বিজয়। তাঁর হিজরত আল্লাহর সাহায্য এবং তাঁর খিলাফত আল্লাহর রহমত।
এক শীতের রাতে উমর তাঁর নিয়মিত টহল দিচ্ছিলেন মদীনার পথে পথে, তখন তিনি বাচ্চাদের কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলেন। শব্দ অনুসরণ করে কারণ খুঁজতে গেলেন তিনি, দেখলেন একজন বিধবার চারপাশ ঘিরে কয়েকটি বাচ্ছা কাঁদছে। কারণ জিজ্ঞাসা করতেই মহিলাটি বললেন যে, ক্ষুধার জ্বালায় তারা কাঁদছে। চুলায় তখন হাঁড়িতে কি যেন টগবগ করে ফুটছিল।ওমর জিজ্ঞাসা করলেন: চুলার উপর হাঁড়িটিতে কি আছে? মহিলাটি উত্তর দিলেন যে ওতে কয়েকটি নুড়ি পাথর ছাড়া আর কিছুই নেই। বাচ্চাদের এভাবে ভুলিয়ে রাখা হচ্ছে যতক্ষণ না তারা ঘুমিয়ে যায়। মহিলাটি খলিফার বিরুদ্ধে অবহেলার অভিযোগ তুললেন। ওমরের দুচোখ বেয়ে পানির ধারা নেমে এলো। তিনি বায়তুল মালে ছুটে গেলেন এবং সেখান থেকে আটার বস্তা ও তেল পিঠে করে বয়ে নিয়ে এলেন। নিজে ফুঁ দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে খাবার তৈরি করে বাচ্চাদের খাওয়ালেন। তারপর তিনি মহিলাটিকে বললেন বায়তুল মাল থেকে সে যেন তার প্রতিদিনের চাহিদা অনুযায়ী খাবার নিয়ে আসে।
তাঁর খিলাফতের এলাকায় কোথায় কার কি অবস্থা তার সবকিছু জানার কথা নয় তাঁর, তবু তিনি নিজেকে জনগণের জন্য দায়িত্বশীল মনে করতেন এবং আল্লাহর কাছে এজন্য জবাবদিহি করতে হবে সে ভয় করতেন।
কয়েকজন ক্রীতদাস একটি উট চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছিল। খলিফা দেখলেন লোকগুলো একেবারেই হাড্ডিসার। তিনি বুঝলেন যে ক্ষুধার তাড়নায় তারা চুরি করেছে। তাদের শাস্তি দেয়ার বদলে তিনি তাদের মালিককে ভৎর্সনা করলেন তাদেরকে যথেষ্ট পরিমাণে খেতে না দেওয়ার জন্য। তারপর তিনি ক্রীতদাসদের মালিকদের চুরি যাওয়া উটের মালিককে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আদেশ দিলেন। আর ক্রীতদাসদের সতর্ক করে দিলেন যে তারা যেন আর চুরি না করে।
আমর ইবনুল ‘আসের পুত্রের বিরুদ্ধে জনৈক মিশরীয় লোককে প্রহার করার অভিযোগ আনা হল। উমর তখন মিশরীয় লোকটিকে বললেন চাবুক দিয়ে তাকে প্রহার করে প্রতিশোধ নিতে। তখন আমর ইবনুল আস ছিলেন গভর্ণর।
একবার মুসলমানরা গণিমতের মাল হিসাবে কিছু ইয়ামানী কাপড় পেয়েছিলেন। সকলকে এক টুকরো করে কাপড় বন্টন করে দেওয়া হল। উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু সেই কাপড় দিয়ে জামা তৈরি করলেন। তিনি যেহেতু লম্বা-চওড়া ছিলেন, এক টুকরো কাপড়ে তাঁর জামা হতো না, তাই তাঁর পুত্র আব্দুল্লাহ নিজের কাপড়টিও তাঁকে দিয়ে দিয়েছিলেন।
মিম্বরে উঠে খুতবা দেওয়ার সময় একজন লোক উঠে দাঁড়িয়ে বলল: আপনি যে জামা পরেছেন, তা এক টুকরো কাপড়ে বানানো সম্ভব নয়। এর উত্তর না দেওয়া পর্যন্ত আমরা আপনার খুতবা শুনব না। যখন আব্দুল্লাহ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন যে তিনি তাঁর ভাগের কাপড়টিও পিতাকে দিয়ে দিয়েছেন জামা বানানোর জন্য, তখন লোকটি মেনে নিল।
খলিফা হওয়ার পর ভাষণ দিতে গিয়ে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছিলেন যে: যদি তোমরা আমার মধ্যে কোন বক্রতা দেখ, তবে আমাকে সোজা করে দিও। সমবেত মুসলিমদের মধ্য থেকে একজন বলে উঠল: তোমার মধ্যে কোনো বক্রতা দেখলে আমরা তোমাকে তীক্ষ্ণধার তরবারী দিয়ে সোজা করে দেব। শুনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন: আল্লাহর কাছে হাজারো শুকরিয়া যে তিনি ওমরের খিলাফতের মধ্যে এমনতর ব্যক্তিও সৃষ্টি করেছেন, যে তাকে তীক্ষ্ণধার তরবারী দিয়ে সোজা করতে পারে।
উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন নিতান্তই দরিদ্র। খয়বরে তিনি এক টুকরো জমি পেয়েছিলেন। তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বললেন, ‘‘আমি খয়বরে খানিকটা জমি পেয়েছি। এত মূল্যবান সম্পত্তি আমি কোনো দিন পাই নি। এ সম্পর্কে আপনার নির্দেশ কি?’’
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বললেন: যদি তোমার মন চায়, তবে আসল জমি নিজের অধিকারে রেখে তার লভ্যাংশ দান করে দিও।”
ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু সেটা গরীব-দুঃখী, অভাবী আত্মীয়-স্বজনদের জন্য এবং দুর্বল -অক্ষম লোকদের সাহায্য ও জনকল্যাণমূলক কার্যাবলীর জন্য ওয়াক্ফ করে দেন। এটাই ছিল ইসলামের প্রথম ওয়াক্ফ। এভাবে তিনি নিজের সবচেয়ে প্রিয় সম্পদ আল্লাহর পথে দান করে কুরআনের নিম্নোক্ত উক্তির সার্থকতা প্রমাণ করেন:
﴿لَن تَنَالُواْ ٱلۡبِرَّ حَتَّىٰ تُنفِقُواْ مِمَّا تُحِبُّونَۚ وَمَا تُنفِقُواْ مِن شَيۡءٖ فَإِنَّ ٱللَّهَ بِهِۦ عَلِيمٞ ٩٢ ﴾ [ال عمران: ٩٢]
‘‘তোমরা যতক্ষণ নিজেদের প্রিয় সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় না করবে, ততক্ষণ প্রকৃত কল্যাণ অর্জনে সক্ষম হবে না”। [সূরা আলে ইমরান: ৯২]
উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর সুচারু ও বিজ্ঞ নেতৃত্ব তাঁকে জেরুজালেমের বিজয় এনে দিয়েছিল। তিনি ছিলেন এমন এক রাজ্যের খলিফা যা সে সময়কার সবচেয়ে শক্তিশালী সাম্রাজ্য পারস্য ও পূর্ব বাইজান্টাইনের অধিকারী ছিল। কিন্তু অন্যদিকে তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী এবং প্রজাবৎসল মানুষ।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: কার্যতই আল্লাহ ওমরের জিহ্বায় এবং অন্তরে সত্য প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তিনি আরও বলেছেন যে শয়তানও ওমরকে ভয় করে।
ইবনু উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন: কখনো লোকেরা একটি মত পোষণ করতো আর উমর ভিন্নমত পোষণ করতেন, তারপর দেখা যেত সে সম্পর্কে কুরআনের আয়াত নাযিল হয়েছে এবং তা ওমরের মতের সাথে মিলে গেছে। এর মধ্যে কয়েকটি হচ্ছে: মাকামে ইবরাহিমকে সালাতের স্থান হিসেবে গ্রহণ করা, হিজাব গ্রহণ করা, বদরের যুদ্ধবন্দীদের হত্যা করা ইত্যাদি।
উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু এক অন্ধ বৃদ্ধকে ভিক্ষা করতে দেখতে পেলেন। সে ছিল যিম্মী বা সন্ধিবদ্ধ কাফির নাগরিক। তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন সে কোন বংশের। সে বলল যে সে ইয়াহূদী। তিনি তাকে ভিক্ষা করার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। সে উত্তর দিল: আমি বৃদ্ধ, কোনো কাজ করতে পারি না। নিজের খরচ ছাড়াও আমাকে জিজিয়া করের জন্য টাকা ভিক্ষা করে তুলতে হয়। উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু তার হাত ধরে তাকে নিয়ে এলেন, যথা সম্ভব দান করলেন। তারপর বায়তুল মালের দায়িত্বশীলকে নির্দেশ দিলেন, এই বৃদ্ধ অন্ধ ইয়াহূদী এবং তার মত অন্যান্য আহলে কিতাবদের প্রতি যথেষ্ট খেয়াল রাখবে। আল্লাহর কসম! আমরা এই বৃদ্ধের প্রতি ইনসাফ করছি না, অথচ তার যৌবনকালে তার কাছ থেকে কর নিয়েছি আর বৃদ্ধ বয়সে কষ্ট দিচ্ছি।
﴿إِنَّمَا ٱلصَّدَقَٰتُ لِلۡفُقَرَآءِ وَٱلۡمَسَٰكِينِ﴾ [التوبة: ٦٠]
“নিশ্চয়ই দান-খয়রাত ফকির-মিসকিনদের জন্য”। [সূরা আত-তাওবা: ৬০]
এরপর খলিফা বৃদ্ধ যিম্মীদের উপর থেকে জিজিয়া কর মাফ করে দিলেন।
একবার রোমের সম্রাট ওমরের কাছে একজন দূত পাঠালেন। তাঁর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার জন্য ও কাজকর্ম স্বচক্ষে দেখার জন্য। দূত মদীনায় প্রবেশ করে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে পেল না। লোকজনকে সে জিজ্ঞাসা করল যে, ‘‘তোমাদের বাদশাহ কোথায়?’’
লোকেরা বলল ‘‘আমাদের কোনো বাদশাহ নেই। বরং একজন আমীর আছেন যিনি মদীনার বাইরে গেছেন।”
দূত তাঁর খোঁজে মদীনার বাইরে গেল। খুঁজতে খুঁজতে সে তাঁকে পেল এক গাছের তলায়, মরুভূমির বালুরাশির উপর নিজের হাতের ছোট লঠিটি মাথার নিচে রেখে গুমিয়ে আছেন। যে লাঠি দিয়ে তিনি কোনো অন্যায় কাজ হতে দেখলে তা বন্ধ করতেন। উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে এ অবস্থায় দেখে তার অন্তরে সম্ভ্রম সৃষ্টি হলো। সে মনে মনে ভাবল: তিনি এমন একজন লোক যাঁর ভয়ে সমস্ত রাজা-বাদশাহরা সন্ত্রস্ত, ভীত। অথচ তিনি নির্ভাবনায় একাকী ঘুমিয়ে আছেন। তিনি ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তাই এমন স্বস্তিতে ঘুমাচ্ছেন। আর আমাদের রাজা-বাদশাহরা অত্যাচার-অবিচারে লিপ্ত। যার ফলে তারা সবসময় ভয়ে ভয়ে দিনযাপন করে। বিনিদ্র রাত কাটায়।
হিজরী ১৫ সালে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু, আমর ইবন আস রাদিয়াল্লাহু আনহু, শুরাহবিল ইবন হাসানা রাদিয়াল্লাহু আনহু এবং আবু উবাইদা রাদিয়াল্লাহু আনহুকে পবিত্র ভূমি ফিলিস্তীনের শাসকদের কাছে পাঠান- যাতে তাঁরা ঐ শহরের চাবি তাদের কাছ থেকে নিয়ে আসেন। কিন্তু সেখনকার পাদ্রী জাফর ইউনুস শহরের চাবি দিতে অস্বীকার করে বলল: আমরা চাবি ঐ ব্যক্তির হাতে দেব যার গুণাবলী সম্পর্কে আমরা তাওরাতে জানতে পেরেছি। তার সাথে তোমাদের মিল নেই।
একথা শুনে মুসলিম সেনানায়কগণ খলিফাকে চাবি নিতে আসার অনুরোধ করলেন। উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁর খাদেমকে নিয়ে সফরে বের হলেন। তাঁদের সাথে মাত্র একটি উট ছিল। পালা করে তাঁরা একজন উটে চড়তেন, অপরজন পায়ে হেঁটে চলতেন।
শামের সীমান্ত অঞ্চলের কাছে অনেক দূর পর্যন্ত রাস্তা ছিল কর্দমাক্ত। এ পথে খলিফাকে সাহায্য করার জন্য আবু উবাইদা রাদিয়াল্লাহু আনহু এলেন। দেখলেন উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু কাদাযুক্ত পথ দেখে উট থেকে নেমে জুতা খুলে কাঁধে রেখে উটের লাগাম ধরে চললেন। দেখে তিনি বললেন, আমীরুল মুমিনীন, আপনি এ কি করছেন? এভাবে শামদেশের অধিবাসীদের কাছে আপনি উপস্থিত হবেন আমার তা ভাল লাগছে না।
শুনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন: হে উবায়দা! তুমি না হয়ে যদি অন্য কেউ একথা বলত, তাহলে তাকে আমি উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য শিক্ষার বস্তুতে পরিণত করতাম। আমরা লাঞ্ছিত, অপমানিত ছিলাম, আল্লাহ ইসলামের মাধ্যমে আমাদের সম্মান দিয়েছেন। আবার যদি আমরা ইসলাম ছাড়া অন্য কিছুর মাধ্যমে সম্মান চাই, তাহলে আবার আমরা লাঞ্ছিত, অপমানিত হব।
এভাবে সফর শেষ হল। তখন খলিফার পায়ে হেঁটে চলার পালা ছিল। সেভাবেই তিনি শহরের দরজায় উপস্থিত হলেন। তাঁর পোশাক ছিল ১৭টি তালি লাগানো।
ইয়াহূদী শাসকরা যখন বুঝতে পারল যে ইনিই খলিফা, তারা আনন্দের সাথে শহরের চাবি তাঁর কাছে হস্তাস্তর করল, কারণ খলিফার এই বর্ণনাই তারা তাদের কিতাবে পেয়েছিল।
চাবি হাতে পেয়ে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু সিজদায় লুটিয়ে পড়ে দীর্ঘসময় কাঁদলেন। তাঁকে কান্নার কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন: আমি এজন্য কাঁদছি যে আমার ভয়ে হচ্ছে যে পৃথিবী তোমাদের সামনে খুলে দেওয়া হবে। তখন তোমরা একে অপরকে ভুলে যাবে। তোমাদের মাঝে কোনো ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধ থাকবে না। তখন আল্লাহ তা‘আলাও তোমাদের দূরে ঠেলে দেবেন।
উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু এর সাথে দেখা করার জন্য সুহাইল ইবন আমর, হারেস ইবন হিশাম, আবু সুফিয়ান ইবন হারব সহ কুরাইশদের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা দরজার বাইরে অপেক্ষা করছিলেন। সে সময় সুহাইব রূমী, বিলাল ইবন রাবাহ রাদিয়াল্লাহ আনহুমা সহ বদরী সাহাবী, যারা ক্রীতদাস ছিলেন, তারাও উপস্থিত হয়েছিলেন।
উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু প্রথমে তাদেরকে ডেকে পাঠালেন। এতে আবু সুফিয়ান রাদিয়াল্লাহু আনহু উচ্চস্বরে বলতে লাগলেন যে তাদের উপরে এই ক্রীতদাসরা কিভাবে প্রাধান্য পেল? সুহাইল ইবন আমর ছিলেন সুবক্তা ও বুদ্ধিমান। তিনি সাথীদের লক্ষ্য করে বললেন: আমি তোমাদের চেহারায় রাগ ও অসন্তুষ্টির পরিচয় পাচ্ছি। রাগ উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর উপর না করে বরং নিজেদের উপর কর। কারণ সত্যের দাওয়াত তারাও পেয়েছে, তোমরাও পেয়েছ; কিন্তু দুর্বল লোকেরাই সাথে সাথে দাওয়াত কবুল করেছিল অথচ তোমরা তা প্রত্যাখ্যান করেছিলে। আর তাদের তুলনায় পিছিয়ে পড়েছিলে। যে ঈমানী মর্যাদার মাধ্যমে এ ক্রীতদাসেরা তোমাদের উপর প্রাধান্য লাভ করেছে, তা হাতছাড়া হয়ে যাওয়া আজকে তোমাদের এ দরজা দিয়ে প্রথমে প্রবেশের সুযোগ না পাওয়া থেকেও আফসোসজনক, যেখানে প্রবেশের জন্য তোমরা প্রতিযোগিতা করছ। হে লোকেরা! এ ক্রীতদাসেরা যে নিয়ামত পেয়ে তোমাদের উপর প্রাধান্য লাভ করেছে তা তোমরা জান। আল্লাহর কসম! তারা তোমাদেরকে যে বিষয়ে অতিক্রম করে গেছে সেখানে তোমাদের পৌঁছা অসম্ভব। তোমরা এখন থেকে জিহাদকে তোমাদেরকে নিত্য সাথী হিসাবে গ্রহণ কর, হয়তো বা আল্লাহ তোমাদের শাহাদাতের মর্যাদা দেবেন আর তোমরাও উচ্চ মর্যাদার অধিকারী হবে।
একবার আবু ওবায়দা ইবনুল জাররাহ রাদিয়াল্লাহু আনহুকে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু ৪ শত বা ৪ হাজার দিনার পাঠিয়ে দিয়ে বাহককে বললেন যে ঐ টাকা তিনি কোন খাতে খরচ করবেন তা দেখতে।
আবু ওবায়দা রাদিয়াল্লাহু আনহু সব বিলিয়ে দিলেন। আবারও উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু ঐ পরিমাণ দিনার মু‘আয ইবন জাবাল রাদিয়াল্লাহু আনহুর কাছে পাঠালেন। তিনিও সব বিলিয়ে দিলেন। শেষ মুহূর্তে তাঁর স্ত্রী এসে কিছু চাইলেন মাত্র ২ দিনার তখন অবশিষ্ট ছিল, তিনি তাই পেলেন।
ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু এই ঘটনা শুনে খুশি হয়ে বললেন: তাঁরা একে অপরের ভাই। আল্লাহ তাঁদের সকলের উপর সন্তষ্ট থাকুন।
উমর এক অভিযানে পাঠালেন এক সেনাদলকে যার অধিপতি ছিলেন সারিয়া নামক এক ব্যক্তি। একদিন উমর খুতবা দিচ্ছিলেন, হঠাৎ তিনি খুতবার মাঝেই বলে উঠলেন: সারিয়া পাহাড়ের দিকে লক্ষ্য কর। দু’বার বললেন। লোকেরা এ ওর দিকে তাকাল, কিছুই বুঝল না। খুতবা শেষ হওয়ার পর তাঁকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন: আমি দেখলাম আমার সৈন্যদল একটি পাহাড়ের কাছে যুদ্ধ করছে এবং তারা সম্মুখ ও পিছন দিক থেকে আক্রান্ত হতে যাচ্ছে। তখন আমি চিৎকার করে উঠলাম যাতে তারা পাহাড়ের কাছে পৌঁছে যায়।
কিছুদিন পর সারিয়ার বার্তাবাহক খবর নিয়ে এল যে ঐ দিন জুমু‘আর সময় পর্যন্ত তারা যু্দ্ধ করে যাচ্ছিল, হঠাৎ সে সময় তারা চিৎকার শুনতে পেল: সারিয়া, পাহাড়ের দিকে লক্ষ্য কর। দু’বার শোনার পর আমরা পাহাড়ে পৌঁছে গেলাম আর আল্লাহর ইচ্ছায় বিজয় লাভ করলাম।
যখন মিশর বিজিত হলে, লোকজন ‘আমর ইবনু আল ‘আসের কাছে এল মাসের প্রথম দিন। তারা তাকে বলল যে, কোনো কোনো বছর নীল নদে পানি থাকে না। তখন তারা কোনো সুন্দরী মেয়েকে সাজিয়ে নদীর গর্ভে নিক্ষেপ করে মাসের একটি বিশেষ দিনে, তখন নীল নদে পানি প্রবাহিত হয়। শুনে আমর ইবন আল আস বললেন: এটা কখনো ইসলামে হতে পারে না, ইসলাম এসব রীতি-নীতিকে নিশ্চিহ্ন করতে এসেছে।
তারপর তিনি উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে চিঠি লিখে সব জানালেন। উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁকে একটি চিঠি দিলেন। আর নির্দেশ দিলেন চিঠিটি যেন আমর নীল নদে ফেলেন। সেখানে লেখা ছিল: আল্লাহর বান্দা উমর ইবনুল খাত্তাবের পক্ষ থেকে মিশরের নীল নদের প্রতি-
‘যদি তুমি নিজেই প্রবাহিত হয়ে থাক, তবে আর প্রবাহিত হয়ো না। আর আল্লাহ যদি তোমাকে প্রবাহিত করে থাকেন, তাহলে আমি সর্বশক্তিমানের কাছে দু‘আ করছি যেন তিনি তোমাকে প্রবাহিত করেন।’
বিশেষ সেই দিনটির পূর্বেই চিঠিটি নীল নদে ফেলা হল। সকালে সবাই দেখল আল্লাহর ইচ্ছায় এক রাতে নীল নদ পানিতে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে।