হে মুক্তির পথের পথিক বান্দা! জেনে রাখুন, তাওবা হলো ইসলামের মূলনীতিসমূহের অন্যতম একটি; আর তা হলো মহাশক্তিধর মালিকের নিকট নিশ্চিত অবস্থানের দিকে ভ্রমণকারীদের প্রথম মানযিল এবং পরকালের দিকে অভিযাত্রীদের দীর্ঘ পথের সূচনা।
তা সত্ত্বেও এটা যেমনিভাবে সূচনা, ঠিক অনুরূপভাবে এটা মাঝামাঝি ও শেষও বটে; সুতরাং তা থেকে কোনো নৈতিকতা সম্পন্ন বান্দা বিচ্ছিন্ন হতে পারে না এবং মৃত্যু পর্যন্ত সে তা অব্যাহত রাখবে। আর তাওবার সূচনা হল এমনভাবে লজ্জিত বা অনুশোচনা করা, যা এ দৃঢ়তা, সঠিক ইচ্ছাশক্তি ও প্রকৃত জ্ঞানবোধ জন্ম দিবে যে, পাপরাশি হলো বান্দা ও তার প্রতিপালকের মাঝখানে পর্দা বা অন্তরায়; কেননা, তা অন্তরের ময়লা বা কালিমা; সুতরাং সে দ্রুত মুক্তি ও শান্তির দিকে চলবে; আর আল্লাহর দিকে ফিরে যাওয়া ছাড়া তাঁর থেকে মুক্তির কোনো উপায় নেই; আর যে ব্যক্তি তার রবের নিকট আশ্রয় নেয়, সে এমন আশ্রয়ে চলে যায়, যেখানে সে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না এবং কখনও সে ফিরে আসবে না শূন্য হাতে। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ تُوبُوٓاْ إِلَى ٱللَّهِ تَوۡبَةٗ نَّصُوحًا عَسَىٰ رَبُّكُمۡ أَن يُكَفِّرَ عَنكُمۡ سَئَِّاتِكُمۡ
“হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর কাছে তাওবা কর---বিশুদ্ধ তাওবা; সম্ভবত তোমাদের রব তোমাদের পাপসমূহ মোচন করে দেবেন।”[1]
আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
« التَّائِبُ مِنْ الذَّنْبِ كَمَنْ لَا ذَنْبَ لَهُ » . ( رواه ابن ماجه ) .
“গুনাহ্ থেকে তাওবাকারী ব্যক্তি ঐ ব্যক্তির মত, যার কোনো গুনাহ্ নেই।”[2]
অতএব, হে আমার ভাই! তাওবা ও তোমার মাঝে প্রতিবন্ধকতার দেয়াল রচিত হওয়ার পূর্বেই তুমি তাওবার কাজটি দ্রুত সম্পন্ন কর; কারণ, কোনো ব্যক্তিই জানে না যে, আল্লাহ তার সাথে কেমন আচরণ করবেন।
জনৈক কবির কবিতা:
قَدِّمْ لِنَفْسِكَ تَوْبَةً مَرْجُوَّةً
قَبْلَ المَمَاتِ وَقَبْلَ حَبْسِ الأَلْسُنِ
(তুমি তোমার নিজের জন্য প্রত্যাশিত তাওবা পেশ কর
মৃত্যুর পূর্বে এবং কথা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগেই)।
بادِر بها غَلقَ النّفوس فإنَّها
ذُخرٌ وغُنم للمُنيب المحسِنِ
(সুযোগ নষ্ট হয়ে যাওয়ার আগেই তুমি তা সম্পন্ন কর; কারণ, তা হলতাওবাকারী সৎকর্মশীল ব্যক্তির জন্য সঞ্চিত ধন ও গনীমত)।
>[2] ইবনু মাজাহ, হাদিস নং- ৪২৫০ এবং অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ হাদিসটি আবদুল্লাহ আবন মাস‘উদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন। আমি বলি: হাদিসটি হাসান পর্যায়ের।
ইসলামের প্রত্যেকটি আদেশ ও নিষেধের মধ্যে সূক্ষ্ম ও স্থূলভাবে উদারতার বিষয়টি সুস্পষ্ট; সুতরাং বাস্তবেই নতুনভাবে সেটার পুনরুত্থান ঘটেছে ইসলামের মূলবস্তুতে এবং তার প্রত্যেকটি কর্মপদ্ধতি, নিয়মনীতি ও শাসনব্যবস্থার মধ্যে।
ইসলামের মধ্যে উদারতার বিষয়টি স্বর্ণের এমন প্রলেপের মত নয় যে, মানুষ কোনো মরুভূমির মরীচিকায় ঝাঁপিয়ে পড়বে, পিপাসা কাতর ব্যক্তি তাকে পানি মনে করবে, কিন্তু যখন সে সেটার কাছে আসে, তখন দেখে সেটা আসলে কিছুই নয়।
উদারতা মানে বদান্যতা ও দানশীলতার মাধ্যমে মনের তৃপ্তি,
স্বচ্ছতা ও দীনদারীর দ্বারা হৃদয়ে আনন্দ উপভোগ করা,
সহজ ও সরল করার মাধ্যমে নম্রতা প্রদর্শন করা,
আনন্দময় ও সুসংবাদ নিয়ে হাস্যোজ্জ্বল চেহারা প্রদর্শন,
কোনো প্রকার অপদস্থতা ছাড়াই মুমিনগণের প্রতি বিনয় প্রদর্শন,
কোনো প্রকার ধোকা ও প্রতারণা ছাড়াই লেনদেনে ছাড় প্রদান,
কোনো প্রকার খাতির ও তোষামোদ ছাড়াই আল্লাহর দিকে আহ্বান করার ক্ষেত্রে সহজ পন্থা অবলম্বন,
কোনো প্রকার দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও গড়িমসি ছাড়াই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার দীনের আনুগত্য করা।
বস্তুত উদারতা হচ্ছে ইসলামের দরজা,
নৈতিক চরিত্রের উচ্চ সোপান
এবং ঈমানের সর্বোত্তম বস্তু।
এটাই হলো সে উদারতা, যা পাপরাশিকে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে দেয়; আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
﴿ وَلَا يَأۡتَلِ أُوْلُواْ ٱلۡفَضۡلِ مِنكُمۡ وَٱلسَّعَةِ أَن يُؤۡتُوٓاْ أُوْلِي ٱلۡقُرۡبَىٰ وَٱلۡمَسَٰكِينَ وَٱلۡمُهَٰجِرِينَ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِۖ وَلۡيَعۡفُواْ وَلۡيَصۡفَحُوٓاْۗ أَلَا تُحِبُّونَ أَن يَغۡفِرَ ٱللَّهُ لَكُمۡۚ وَٱللَّهُ غَفُورٞ رَّحِيمٌ ٢٢ ﴾ [النور: ٢٢]
“আর তোমাদের মধ্যে যারা ঐশ্বর্য ও প্রাচুর্যের অধিকারী, তারা যেন শপথ গ্রহণ না করে যে, তারা আত্মীয়-স্বজন, অভাবগ্রস্তকে ও আল্লাহর রাস্তায় হিজরতকারীদেরকে কিছুই দেবে না; তারা যেন ওদেরকে ক্ষমা করে এবং ওদের দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা করে। তোমরা কি চাও না যে, আল্লাহ্ তোমাদেরকে ক্ষমা করুন? আর আল্লাহ্ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।”[1]
আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
« تَلَقَّتِ الْمَلائِكَةُ رُوْحَ رَجُلٍ مِمَّنْ كَانَ قَبْلَكُمْ ، قَالُوا لَهُ : عَمِلْتَ مِنَ الْخَيْرِ شَيْئًا ؟ قَالَ : لا ، قَالُوا : تَذَكَّرْ ، قَالَ : كُنْتُ أُدَايِنُ النَّاسَ ، فَآمُرُ فِتْيَانِي أَنْ يُنْظِرُوا الْمُوسِرَ ، وَيَتَجَاوَزُوا عَنِ الْمُعْسِرِ ، قَالَ قَالَ اللَّهُ : تَجَاوَزُوا عَنْهُ » . ( رواه البخاري و مسلم ) .
“তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মাতের এক ব্যক্তির রূহের সাথে ফিরিশ্তাগণ সাক্ষাৎ করে (অর্থাৎ তার মৃত্যুকালে) জিজ্ঞাসা করলেন: তুমি (বিশেষ) কোনো সৎকাজ করেছ কি? সে বলল: না, তারা বললেন: স্মরণ করে দেখ; সে বলল: আমি মানুষের সাথে লেনদেন করতাম; তারপর অসচ্ছল ব্যক্তিদের অবকাশ দিতে ও সচ্ছল ব্যক্তিদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করতে আমি আমার লোকদেরকে নির্দেশ দিতাম। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: এরপর মহান আল্লাহ তা‘আলা বললেন: “তাকে দায়মুক্ত করে দাও।”[2]
[2] বুখারী, হাদিস নং- ১৯৭১; মুসলিম, হাদিস নং- ৪০৭৬
আমি বলি: হাদিসটি হাসান পর্যায়ের।
মানুষ প্রবৃত্তি ও লোভ-লালসার কাছে দুর্বল; সুতরাং বান্দা যখন কোনো অন্যায় ও অপরাধ করে ফেলে, তখন সে যেন দ্রুত তার মোকাবিলায় একটি ভাল কাজ করে ফেলে; যেমন— কর্কশ ব্যবহারের মোকাবিলা করবে কোমল ব্যবহার দ্বারা, ক্রোধের মোকাবিলা করবে সংযম প্রদর্শন করার দ্বারা এবং এভাবে করে প্রতিটি মন্দের মোকাবিলায় ভালো অভ্যাস গড়ে তুলবে এবং সমস্যার সমাধান করবে; আর এটাই সবচেয়ে লাগসই পদ্ধতি কিন্তু এটা হওয়া এমন শর্ত নয় যে প্রয়োজনে তার অন্যথা করা যাবে না; কারণ, রোগের চিকিৎসা করা হয় তার বিপরীত বস্তুর দ্বারা; আর প্রতিটি অপরাধই অন্তরকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে ফেলে, যা তার বিপরীতে ভালকাজের মত নূর বা আলো ছাড়া দূর করতে পারে না।
আর যে ব্যক্তি এ অবস্থানের অনুসন্ধান করবে, সে দেখবে যে সবচেয়ে সুন্দর ও দ্রুত কার্যকরী পন্থা হলো পুরাতন গুনাহের জন্য নতুন করে ভালকাজ করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
إِنَّ ٱلۡحَسَنَٰتِ يُذۡهِبۡنَ ٱلسَّئَِّاتِۚ ذَٰلِكَ ذِكۡرَىٰ لِلذَّٰكِرِينَ
“নিশ্চয় সৎকাজ অসৎকাজকে মিটিয়ে দেয়। উপদেশ গ্রহণকারীদের জন্য এটা এক উপদেশ।”[1]
আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
« اتَّقِ اللَّهَ حَيْثُ مَا كُنْتَ ، وَأَتْبِعِ السَّيِّئَةَ الْحَسَنَةَ تَمْحُهَا ، وَخَالِقِ النَّاسَ بِخُلُقٍ حَسَنٍ » . ( رواه الترمذي ) .
“তুমি যেখানেই থাক, আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর এবং অসৎকাজ করলে সাথে সাথেই সৎকাজ কর, তাহলে ভাল কাজ মন্দ কাজকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে; আর মানুষের সাথে উত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে মেলামেশা কর।”[2]
>[2] তিরমিযী, হাদিস নং- ১৯৮৭; হাদিসটি অন্যান্য হাদিসের সমর্থনের কারণে সহীহ, যেমনটি আমি ‘তাখরীজু আহাদিসিল অসিয়্যাতিস সুগরা’ ( تخريج أحاديث الوصية الصغرى ) নামক গ্রন্থে বর্ণনা করেছি, হাদিস নং- ৩
আমি বলি: হাদিসটি হাসান পর্যায়ের।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
« إن من موجبات المغفرة بذل السلام وحسن الكلام » .
“ক্ষমা নিশ্চিতকরণের অন্যতম উপায় হলো সালাম বিনিময় করা এবং উত্তম কথা বলা।”[1]
>রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
« مَا مِنْ مُسْلِمَيْنِ يَلْتَقِيَانِ فَيَتَصَافَحَانِ إِلَّا غُفِرَ لَهُمَا قَبْلَ أَنْ يَفْتَرِقَا » . (رواه أبو داود و الترمذي و ابن ماجه) .
“দুই মুসলিমের যখন সাক্ষাৎ হয় এবং তারা পরস্পর মুসাফাহা করে, তখন তাদের বিচ্ছিন্ন হওয়ার আগেই আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে ক্ষমা করে দেন।”[1]
>রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
« بَيْنَمَا رَجُلٌ يَمْشِي بِطَرِيقٍ ، إِذْ اشْتَدَّ عَلَيْهِ الْعَطَشُ ، فَوَجَدَ بِئْرًا ، فَنَزَلَ فِيهَا فَشَرِبَ ، ثُمَّ خَرَجَ ، فَإِذَا كَلْبٌ يَلْهَثُ يَأْكُلُ الثَّرَى مِنَ الْعَطَشِ ، فَقَالَ الرَّجُلُ : لَقَدْ بَلَغَ هَذَا الْكَلْبَ مِنَ الْعَطَشِ مِثْلُ الَّذِي بَلَغَ مِنِّيْ ، فَنَزَلَ الْبِئْرَ ، فَمَلأَ خُفَّهُ ، ثُمَّ أَمْسَكَهُ بِفِيهِ حَتَّى رَقِيَ ، فَسَقَى الْكَلْبَ ، فَشَكَرَ اللَّهُ لَهُ ، فَغَفَرَ لَهُ ، فَقَالُوا : يَا رَسُولَ اللَّهِ ، إِنَّ لَنَا مِنَ الْبَهَائِمِ لأَجْرًا ؟ فَقَالَ : « فِي كُلِّ ذَاتِ كَبِدٍ رَطْبَةٍ أَجْرٌ» . ( رواه البخاري و مسلم و أبو داود و أحمد ) .
“একদা এক ব্যক্তি পথে হেঁটে যাচ্ছিল, এক পর্যায়ে তার তীব্র পিপাসা লাগে; তারপর সে একটি কূপ পেয়ে গেল, তারপর সে তাতে অবতরণ করল এবং পানি পান করল; অতঃপর সে উঠে এলো; হঠাৎ করে দেখল, একটি কুকুর হাপাচ্ছে, পিপাসায় কাতর হয়ে কাদ চাটছে; অতঃপর লোকটি বলল: এ কুকুরটি পিপাসায় সেরূপ কষ্ট পাচ্ছে, যেরূপ কষ্ট আমার হয়েছিল। অতঃপর সে কূপে অবতরণ করল এবং তার মোজার মধ্যে পানি ভরল, তারপর তা মুখ দিয়ে তা (কামড়িয়ে) ধরে উপরে উঠে এলো। তারপর সে কুকুরটিকে পানি পান করাল। তারপর আল্লাহ তাকে তার প্রতিদান দিলেন এবং তাকে ক্ষমা করে দিলেন। সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন: হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম! জীব-জন্তুর জন্যও কি আমাদের পুরস্কার আছে? জবাবে তিনি বললেন: হ্যাঁ, প্রত্যেক সতেজ হৃদয়ের (সাথে ভালো ব্যবহারের) জন্যে পুরস্কারের ব্যবস্থা রয়েছে।”[1]
এই হলো জীবজন্তুর প্রতি দয়া ও কোমল ব্যবহারের ব্যাপারে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতের কতিপয় দৃষ্টিভঙ্গি।
আর এই বর্ণনার মধ্যে কতিপয় ইউরোপীয় কাফিরদের দ্বারা প্রভাবিত জ্ঞানপাপীদের জন্য সত্য সুন্দর ও সুস্পষ্ট বক্তব্য রয়েছে যে, ইসলাম এসব ইউরোপীয় কাফিরদের অনেক আগেই জীবজন্তুর প্রতি দয়া ও কোমল আচরণের নিয়মকানুন প্রণয়ন করেছে, যা তারা মুসলিমগণের কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করেছে, তাতে ব্যাপক প্রসার করেছে এবং তাকে বিধিবদ্ধ করেছে, এমনকি ঐসব জ্ঞানপাপীরা ধারণা করে নিয়েছে যে, তা ইউরোপীয়দের বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
এই ইসলামী মূলনীতির মূলবস্তু হলো দয়া, সহানুভূতি, সেগুলোর উপর সাধ্যের বাইরে বোঝা চাপিয়ে না দেওয়া এবং সেগুলোকে খেল ও তামাশার উদ্দেশ্য হিসেবে গ্রহণ না করা।
কিন্তু যেসব কাফির জীবজন্তুর প্রতি দয়া করার নীতিতে বিশ্বাসী এবং এই উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থা গড়ে তুলেছে, তাদের নিকট জীবজন্তুর প্রতি দয়া করার বিষয়টি এমন নিম্ন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, তারা তাকে মানুষের উপর মর্যাদা দিয়ে ফেলেছে।আর তাদের কোনো কোন দেশে তারা বিষয়টিকে খেল-তামাশার বস্তু হিসেবে গ্রহণ করেছে; উদাহরণস্বরূপ সাবেক মুসলিম স্পেন বর্তমান খ্রিষ্টান স্পেন রাজ্যে বিস্তৃত বলদ বা ষাড়ের মধ্যকার লড়াইয়ের কথা বলা যায় (!)।
>আল্লাহ আপনার প্রতি রহম করুন, জেনে রাখবেন যে, পরিপূর্ণ মুমিনগণ যাবতীয় কবীরা গুনাহ্ ও অশ্লীল কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকে। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
﴿ وَلِلَّهِ مَا فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَمَا فِي ٱلۡأَرۡضِ لِيَجۡزِيَ ٱلَّذِينَ أَسَٰٓـُٔواْ بِمَا عَمِلُواْ وَيَجۡزِيَ ٱلَّذِينَ أَحۡسَنُواْ بِٱلۡحُسۡنَى ٣١ ٱلَّذِينَ يَجۡتَنِبُونَ كَبَٰٓئِرَ ٱلۡإِثۡمِ وَٱلۡفَوَٰحِشَ إِلَّا ٱللَّمَمَۚ إِنَّ رَبَّكَ وَٰسِعُ ٱلۡمَغۡفِرَةِۚ هُوَ أَعۡلَمُ بِكُمۡ إِذۡ أَنشَأَكُم مِّنَ ٱلۡأَرۡضِ وَإِذۡ أَنتُمۡ أَجِنَّةٞ فِي بُطُونِ أُمَّهَٰتِكُمۡۖ فَلَا تُزَكُّوٓاْ أَنفُسَكُمۡۖ هُوَ أَعۡلَمُ بِمَنِ ٱتَّقَىٰٓ ٣٢ ﴾ [النجم: ٣١، ٣٢]
“আর আসমানসমূহে যা কিছু আছে ও যমীনে যা কিছু আছে তা আল্লাহরই। যাতে তিনি তাদের কাজের প্রতিফল দিতে পারেন, যারা মন্দ কাজ করে এবং তাদেরকে তিনি উত্তম পুরস্কার দিতে পারেন, যারা সৎকাজ করে; যারা বিরত থাকে গুরুতর পাপ ও অশ্লীল কাজ থেকে, ছোটখাট অপরাধ ব্যতীত। নিশ্চয় আপনার রবের ক্ষমা অপরিসীম; তিনি তোমাদের সম্পর্কে সম্যক অবগত---যখন তিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছিলেন মাটি হতে এবং যখন তোমরা মাতৃগর্ভে ভ্রূণরূপে ছিলে। অতএব তোমরা আত্মপ্রশংসা করো না, তিনিই সম্যক জানেন তার সম্পর্কে, যে তাকওয়া অবলম্বন করেছে।”[1]
কিন্তু বান্দা অপরাধে জড়িয়ে যাওয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করতে সমর্থ হয় না; আর এ জন্যেই আল্লাহ তা‘আলা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং তাঁর প্রতিশ্রুতি সত্য; সুতরাং তিনি বলেছেন আর তার বাণী সত্য:
إِن تَجۡتَنِبُواْ كَبَآئِرَ مَا تُنۡهَوۡنَ عَنۡهُ نُكَفِّرۡ عَنكُمۡ سَئَِّاتِكُمۡ وَنُدۡخِلۡكُم مُّدۡخَلٗا كَرِيمٗا
“তোমাদেরকে যা নিষেধ করা হয়েছে, তার মধ্যে যা কবীরা গোনাহ্ তা থেকে বিরত থাকলে আমরা তোমাদের ছোট পাপগুলো ক্ষমা করব এবং তোমাদেরকে সম্মানজনক স্থানে প্রবেশ করাব।”[2]এখানে উদ্দেশ্য হলো পাপ মোচন ও গুনাহ্ ক্ষমার বর্ণনা করা, যখন কবীরা গুনাহসমূহ থেকে বিরত থাকা হয় .... আর এখানে এটাই হলো আল্লাহ তা‘আলার ওয়াদা এবং মুমিনদের জন্য তাঁর পক্ষ থেকে সুসংবাদ।
>[2] সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৩১
মনের বেদনা, শরীরের অসুস্থতা, প্রিয়জনকে হারানো এবং সম্পদের ক্ষয়-ক্ষতি থেকে কোনো ব্যক্তিই নিরাপদ নয়। আর এর থেকে মুক্ত নয় সৎকর্মশীল ও অসৎকর্মশীল ব্যক্তি এবং মুমিন ও কাফির কেউই; কিন্তু মুমিন ব্যক্তি এই বিপদ-মুসিবতগুলোকে সন্তুষ্ট চিত্তে গ্রহণ করে; এমন চিত্ত যা তার চালিকা শক্তিকে আল্লাহর হাতে ন্যস্ত করেছে। কারণ, সে নিশ্চিত জ্ঞানে জানে যে, সে যে বিপদে আক্রান্ত হয়েছে, তা তাকে ছেড়ে যেতো না, আর যে বিপদ তাকে পায় নি তা তার উপর আপতিত হবে না।
আর এই বিপদগুলো মুমিন বান্দাকে তার পাপরাশি থেকে এমনভাবে পবিত্র করে দেয়, যেমনিভাবে সাদা কাপড়কে পানি, বরফ ও শিশির দ্বারা ধৌত করা হয়; ফলে সে বালা-মুসিবত থেকে ঐ দিনের মত (পাপমুক্ত হয়ে) বের হয়, যেদিন তার মা তাকে নিষ্পাপ অবস্থায় প্রসব করেছে।
আর এই অপরাধের বিষয়টি মানুষের জন্য একটি অপরিহার্য বিষয়; কেননা, আল্লাহর বান্দাদের প্রতি তাঁর রহমতের ব্যাপারটি হল— তিনি তাদেরকে একের পর এক বিপদ-মুসিবতের প্রতিশ্রুতি দেন যাতে তিনি তাদেরকে পরিশুদ্ধ ও পবিত্র করেন; আর তাদের থেকে শয়তানের কুমন্ত্রণা দূর করেন, তাদের হৃদয়সমূহ দৃঢ় রাখেন এবং এর মাধ্যমে তাদের পা-সমূহ সুস্থির রাখেন।
এই বিপদ-মুসিবতগুলো আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে তাঁর বান্দাদের প্রতি সন্তুষ্টি ও ভালবাসার প্রমাণস্বরূপ; কারণ, আল্লাহ তা‘আলা যখন কোনো বান্দাকে ভালবাসেন, তখন তিনি তাকে বিপদ-মুসিবত দ্বারা পরীক্ষা করেন; আর যখনই ব্যক্তির ঈমান ও বিশ্বাস মজবুত ও শক্তিশালী হবে, তখনই তার পরীক্ষা কঠিন থেকে কঠিনতর হবে; সুতরাং এই অবস্থায় যে সন্তুষ্ট থাকবে, তারা জন্য রয়েছে (আল্লাহর) সন্তুষ্টি; আর যে অধৈর্য হবে, তার জন্য রয়েছে (আল্লাহর) অসন্তুষ্টি।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
« أَشَدُّ النَّاسِ بَلاءً الأَنْبِيَاءُ ، ثُمَّ الأَمْثَلُ فَالأَمْثَلُ ، يُبْتَلَى الرَّجُلُ عَلَى حَسَبِ دِينِهِ ، فَإِنْ كَانَ فِي دِينِهِ صُلْبًا اشْتَدَّ بَلاؤُهُ ، وَإِنْ كَانَ فِي دِينِهِ رِقَّةٍ ابْتُلِيَ عَلَى حَسَبِ دِينِهِ ، فَمَا يَبْرَحُ الْبَلَاءُ بِالْعَبْدِ حَتَّى يَتْرُكَهُ يَمْشِي عَلَى الْأَرْضِ مَا عَلَيْهِ مِنْ خَطِيئَةٍ » . ( رواه الترمذي و ابن ماجه ) .
“মানুষের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন মুসিবতের শিকার হয়েছেন নবীগণ; অতঃপর ক্রমানুসারে পরবর্তী ধাপের সৎব্যক্তিগণ, ব্যক্তি পরীক্ষা বা কষ্টের সম্মুখীন হবে তার দীনদারী অনুসারে; সুতরাং সে যদি তার দীনের ব্যাপারে দৃঢ়তার সাথে অটল থাকে, তাহলে তার বিপদ-আপদও কঠোর থেকে কঠোরতর হবে; আর যদি সে তার দীনের ব্যাপারে আপোষকামী হয়, তাহলে সে পরীক্ষা বা কষ্টের সম্মুখীন হবে তার দীনদারী অনুসারে; সুতরাং বান্দা বালা-মুসিবতে আক্রান্ত হতেই থাকবে যতক্ষণ না তা তাকে যমীনের উপরে গুনাহ বিহীন অবস্থায় চলাফেরা করাতে পারবে।”[1]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন:
« إِذَا ابْتَلَى اللَّهُ الْعَبْدَ الْمُسْلِمَ بِبَلَاءٍ فِي جَسَدِهِ قَالَ اللَّهُ : اكْتُبْ لَهُ صَالِحَ عَمَلِهِ الَّذِي كَانَ يَعْمَلُهُ ، فَإِنْ شَفَاهُ غَسَلَهُ وَطَهَّرَهُ ، وَإِنْ قَبَضَهُ غَفَرَ لَهُ وَرَحِمَهُ » . (رواه أحمد ) .
“যখন আল্লাহ তা‘আলা কোনো মুসলিম বান্দাকে তার শারীরিক দুঃখ-কষ্ট বা রোগ-ব্যাধির দ্বারা পরীক্ষা করেন, তখন আল্লাহ বলেন: তার সৎকাজগুলো লিখ, যে কাজগুলো সে (সুস্থ অবস্থায়) করত; অতঃপর তিনি যদি তাকে রোগমুক্ত করেন, তাহলে তিনি (রহমতের পানি দ্বারা) ধুয়ে মুছে তাকে পবিত্র করে দেন; আর যদি তাকে মৃত্যুর মাধ্যমে উঠিয়ে নেন, তাহলে তিনি তাকে ক্ষমা করে দেন এবং তার প্রতি রহম করেন।”[2]
আবূ শা‘ছা আস-সান‘আনী থেকে বর্ণিত:
তিনি একদা দামেস্কের একটি মাসজিদে গমন করেন এবং এক পর্যায়ে সন্ধ্যায় ভ্রমণ করতে লাগলেন, অতঃপর তার সাথে সাক্ষাৎ হয়ে গেল সাদ্দাদ ইবন আউস ও আস-সুনাবেহী’র। অতঃপর আমি (আবূ শা‘ছা আস-সানা‘আনী) বললাম: আল্লাহ তোমাদের প্রতি রহম করুন, তোমরা কোথায় যাওয়ার পরিকল্পনা করেছ? জবাবে তারা বলল: আমরা সেখানে আমাদের এক অসুস্থ ভাইকে দেখতে যাচ্ছি; অতঃপর আমিও তাদের সাথে চললাম, তারপর তারা ঐ ব্যক্তির নিকট উপস্থিত হয়ে বলল: তোমার সকাল কেমন কেটেছে? জবাবে সে বলল: আমার সকাল নেয়ামতের উপর কেটেছে। অতঃপর তাকে উদ্দেশ্য করে সাদ্দাদ ইবন আউস বললেন: আমি তোমাকে গুনাহ মাফ ও পাপ মোচনের সুসংবাদ দিচ্ছি; কারণ, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি:
« إِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ يَقُولُ : إِنِّي إِذَا ابْتَلَيْتُ عَبْدًا مِنْ عِبَادِي مُؤْمِنًا فَحَمِدَنِي عَلَى مَا ابْتَلَيْتُهُ ، فَإِنَّهُ يَقُومُ مِنْ مَضْجَعِهِ ذَلِكَ كَيَوْمِ وَلَدَتْهُ أُمُّهُ مِنْ الْخَطَايَا ، وَيَقُولُ الرَّبُّ عَزَّ وَجَلَّ : أَنَا قَيَّدْتُ عَبْدِي وَابْتَلَيْتُهُ ، وَأَجْرُوا لَهُ كَمَا كُنْتُمْ تُجْرُونَ لَهُ وَهُوَ صَحِيحٌ » . ( رواه أحمد ) .
“নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আমি যখন আমার বান্দাগণের মধ্য থেকে কোনো মুমিন বান্দাকে কোনো বিপদ-মুসিবত দ্বারা পরীক্ষা করি, অতঃপর সে আমার দুঃখ-কষ্টের পরীক্ষা করা অবস্থায় আমার প্রশংসা করে, তখন সে তার শয্যা থেকে ঐ দিনের মত নিষ্পাপ অবস্থায় উঠবে, যেদিন তার মা তাকে নিষ্পাপ অবস্থায় প্রসব করেছে; আর মহান রব বলবেন: আমি আমার বান্দাকে আটক করেছি এবং তাকে দুঃখ-কষ্ট দ্বারা পরীক্ষা করেছি, তোমরা তার জন্য সাওয়াব লিখবে, যেমনিভাবে তোমরা তার সুস্থ অবস্থায় তার জন্য সাওয়াব লিখতে।”[3]
>আমি বলি: হাদিসটি সহীহ এবং এর সমর্থনে আরও একটি হাদিস বর্ণিত আছে, যা ইবনু মাজাহ: (৪০২৪), হাকেম: (৪/৩০৭) এবং অন্যান্য মুহাদ্দিস প্রমুখ আবূ সা‘ঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন; হাকেম রহ. বলেন: ইমাম মুসলিম রহ. এর শর্তে হাদিসটি সহীহ এবং ইমাম যাহাবী রহ.ও হাদিসটিকে সহীহ বলেন; আমি বলি: হাদিসটি সহীহ, তাঁর উভয়ে যেমনটি বলেছেন।
[2] আহমাদ: (৩/১৪৮, ২৩৮, ২৫৮); তিনি হাদিসটি হাম্মাদ ইবন সালামা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি সিনান ইবন রবি‘আ থেকে বর্ণনা করেন, তিনি আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেন।
আমি বলি: এই সনদটি হাসান পর্যায়ের— ইনশাআল্লাহ; কেননা, সিনান ইবন রবি‘আ সত্যবাদী।
[3] আহমাদ: (৪/১২৩); আমি বলি: এই সনদটি হাসান পর্যায়ের।