রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, সে দিন আল্লাহ সাত ব্যক্তিকে নিজের ছায়ার নিচে ছায়া দিবেন, যে দিন তার ছায়া ব্যতীত কোনো ছায়া থাকবে না, তাদের ভেতর তিনি উল্লেখ করেন:
«وَرَجُلٌ تصدق بصدقة فأخفاها، حتى لا تعلمَ شمالُهُ ما تُنْفِقُ يَمِينِه».
“এবং ঐ ব্যক্তি, যে কোনও সদকা করে গোপন করল, যেন তার বাম হাত জানতে না পারে ডান হাত কি সদকা করেছে”।[1]
অত্র হাদীস বলে, সদকা প্রকাশ করা অপেক্ষা গোপন করাই উত্তম, কারণ এতে রিয়া বা লোক দেখানোর আশঙ্কা নেই, তবে যদি কোন ফায়দা থাকে, যার দাবি সদকা প্রকাশ করা, তাহলে প্রকাশ করা বৈধ, যেমন অন্যদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য কেউ প্রকাশ্যে সদকা করল। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿إِن تُبۡدُواْ ٱلصَّدَقَٰتِ فَنِعِمَّا هِيَۖ وَإِن تُخۡفُوهَا وَتُؤۡتُوهَا ٱلۡفُقَرَآءَ فَهُوَ خَيۡرٞ لَّكُمۡۚ وَيُكَفِّرُ عَنكُم مِّن سَئَِّاتِكُمۡۗ ٢٧١﴾ [البقرة: 271]
“যদি তোমরা সদকা প্রকাশ কর, তবে তা উত্তম। আর যদি তা গোপন কর ও ফকীরকে দাও, তাহলে তাও তোমাদের জন্য উত্তম এবং তিনি তোমাদের পাপসমূহ মুছে দিবেন”। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৭১]
>রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«اليَدُ العُليَا خيرٌ مِن اليَدِ السُفلَى، وابدأ بمَنْ تَعُول، وخيرُ الصدقة ما كانَ عَن ظَهر غِنَى، وَمَن يستعفِف يُعِفُّهُ الله، وَمَن يَستَغنَ يُغنِهِ الله».
“উপরের হাত নীচের হাত থেকে উত্তম, যার ভরণ-পোষণ তোমার ওপর রয়েছে তার থেকে তোমরা সদকা শুরু কর। স্বাবলম্বিতা থেকে যে সদকা করা হয় তাই উত্তম। আর যে পবিত্র থাকতে চায়, আল্লাহ তাকে পবিত্র রাখেন, আর যে অমুখাপেক্ষী হতে চায়, আল্লাহ তাকে অমুখাপেক্ষী করেন”।[1]
এ হাদীস বলে, নিজের ও পরিবারের হক এবং ঋণ পরিশোধ ও অন্যান্য জরুরি খরচ শেষে যে সদকা করা হয় তাই উত্তম, অর্থাৎ সদকা করার পর স্বাবলম্বী থাকবে, নিঃস্ব হবে না, নিজের ও পরিবারের প্রয়োজন মোতাবেক জরুরি সম্পদ কাছে রাখবে, কারও মুখাপেক্ষী হবে না। সহীহ হাদীসে এসেছে:
«إنك إنْ تَذَرْ وَرَثَتَكَ أغنياء، خيرٌ لك مِن أنْ تَذَرَهُم عالَة يتكففون الناس أي فقراء يسألون الناس».
“তুমি যদি তোমার ওয়ারিশদের ধনী রেখে যাও, তাই তোমার জন্য উত্তম, তাদের গরীব রাখা অপেক্ষা যে, মানুষের ধারেধারে ঘুরবে”।[2]
>[2] সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম।
নিজের ওপর, নিজের পরিবার ও সন্তানের ওপর ব্যয় করাকে ইসলাম সদকা বলেছে। অতএব, যাদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব ব্যক্তির ওপর রয়েছে সর্বাগ্রে উচিৎ তাদের জন্য খরচ করা। তারাই সদকার বেশি হকদার। তাদেরকে এমনভাবে রেখে যাবে না যে, তারা মানুষের ধারেধারে ঘুরবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«كفى بالمرءِ إثماً أن يُضَيِّعَ مَن يَقوت».
“একজন মানুষের পাপ হিসেবে এতটুকু যথেষ্ট যে, যার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব তার ওপর রয়েছে তাকে বিনষ্ট করবে”।[1]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেছেন:
«دينارٌ أنفقتَهُ في سبيل الله، ودينارٌ أنفقتَهُ في رقبة (أي: في عِتق رقبة)، ودينارٌ تصدقتَ به على مسكين، ودينارٌ أنفقتَهُ على أهلِك، أعظمُها أجراً: الذي أنفقتَهُ على أهلِك».
“এক দিনার তুমি আল্লাহর রাস্তায় খরচ করেছে, অপর দিনার তুমি গোলাম আজাদ করতে গিয়ে খরচ করেছে, অপর দিনার তুমি মিসকিনের ওপর খরচ করেছ এবং অপর দিনার তোমার পরিবারের ওপর খরচ করেছ, অপেক্ষাকৃত বেশি সাওয়াব: তোমার পরিবারের ওপর যা খরচ করেছ তাতেই”।[2]
>[2] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৩৫৮
জেনে রাখ যে, (আল্লাহ তোমার ওপর রহম করুন) স্বামীর অনুমতি ব্যতীত তার সম্পদ থেকে স্ত্রীর সদকা করা বৈধ নয়, যদি স্বামী গরীব অথবা কৃপণ হয় অথবা স্ত্রী অনুমতি ব্যতীত সদকা করেছে স্বামী জানলে অসন্তুষ্ট হয়। আর যদি স্বামী গরীব বা কৃপণ না হয় অথবা স্ত্রী অনুমতি ব্যতীত সদকা করেছে জানলে অসন্তুষ্ট না হয়, তবে স্ত্রীর জন্য তার সম্পদ থেকে সদকা করা বৈধ। এই অবস্থায় স্ত্রী সদকার অর্ধেক সাওয়াব পাবে, কারণ স্বামীর অনুমতি নেই, তবে স্বামীর সম্পদ অপচয় করে তাকে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা যাবে না। আর স্বামীর অনুমতি নিয়ে যদি স্ত্রী সদকা করে, সে সদকার পূর্ণ সাওয়াব পাবে। আল্লাহ ভালো জানেন।
আমরা আরও বলতে পারি, স্বামী স্ত্রীকে যেসব সম্পদে কর্তৃত্ব করার পূর্ণ ইখতিয়ার দিয়েছে সেখান থেকে যদি সে সদকা করে পূর্ণ সাওয়াব পাবে, যেমন খাবার। এ জাতীয় সম্পদ স্বামীর অনুমতি ব্যতীত খরচ করলে দোষ নেই, তবে শর্ত হচ্ছে সদকার কারণে যেন বাড়ির ব্যয়-নির্বাহ ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এবং স্ত্রীকে বুঝতে হবে যে, সদকার ফলে স্বামী অভাব বা সংকীর্ণতা বোধ করবেন না। আরেকটি বিষয়, স্ত্রী নিজের সম্পদ স্বামীর অনুমতি ছাড়া খরচ করতে পারবে। এটি অধিকাংশ আলেমের কথা এবং সর্বাপেক্ষা বিশুদ্ধ।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন কিয়ামতের দিন আল্লাহ সাত ব্যক্তিকে নিজের ছায়ার নিচে ছায়া দিবেন, তাদের ভেতর:
«ورجلٌ تصدق بصدقةٍ فأخفاها، حتى لا تَعلمَ شِمالُهُ ما أنفقتْ يمينه».
“এবং ঐ ব্যক্তি যে কোনও সদকা করে গোপন করেছে যে, তার বাম হাত জানতে পারেনি ডান হাত কি খরচ করেছে”। এ কথার অর্থ বাম হাতে সদকা করা নিষেধ তা নয়। তবে সাদকা ডান হাতে হওয়াই মুস্তাহাব।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تُبۡطِلُواْ صَدَقَٰتِكُم بِٱلۡمَنِّ وَٱلۡأَذَىٰ ٢٦٤﴾ [البقرة: 264]
“হে মুমিনগণ, তোমরা খোঁটা ও কষ্ট দেওয়ার মাধ্যমে তোমাদের সদকা বাতিল কর না”। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৬৪]
আবু যর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«ثلاثة لا يكلمهم الله يوم القيامة، ولا ينظر إليهم، ولا يزكيهم، ولهم عذاب أليم» قال أبو ذر: فقرأها - أي: فكَرَّرَها رسول الله صلى الله عليه وسلم ثلاث مرات، فقال أبو ذر: خابوا يا رسول الله، مَن هم؟ قال: «المُسْبِل (وهو الذي يُطِيلُ إزارَهُ عن الكَعب)، والمَنَّان، والمُنفِق سِلْعَتَهُ بالحَلِف الكاذب».
“কিয়ামতের দিন আল্লাহ তিন ব্যক্তির সাথে কথা বলবেন না, তাদের দিকে তাকাবেন না এবং তাদেরকে পবিত্রও করবেন না, বরং তাদের জন্য থাকবে কঠিন শাস্তি। আবু যর বললেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কথাগুলো তিনবার বললেন। আবু যর বললেন: হে আল্লাহর রাসূল, তারা ধ্বংস হয়েছে, তারা কে? তিনি বললেন: টাখনুর নিচে কাপড় পরিধানকারী, খোঁটা দাতা ও মিথ্যা কসম করে সম্পদ বিক্রয়কারী”।[1]
>আল্লাহ তা‘আলা কারও সদকা তুচ্ছ জ্ঞান করেন না, যদিও সদকার পরিমাণ কম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«اتقوا النار ولو بِشِقّ تمرة».
“একটি খেজুর দিয়ে হলেও জাহান্নাম থেকে বাঁচ”।[1] অনুরূপ সদকার পরিমাণ কম হলে কাউকে তিরস্কার করা বৈধ নয়। আবার কেউ বেশি সদকা করলে তাকে রিয়ার দোষে দুষ্ট জ্ঞান করা যাবে না।
>সদকা যদি হালাল মাল থেকে হয়, আশা করা যায় আল্লাহ গ্রহণ করবেন। কারণ, তিনি হারাম মালের সদকা গ্রহণ করনে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«إنَّ الله طَيِّبٌ لا يقبلُ إلا طيباً».
“নিশ্চয় আল্লাহ পবিত্র, তিনি পবিত্র ব্যতীত গ্রহণ করেন না”।[1]
দাতার জন্য বৈধ আল্লাহর রাস্তায় সদকার মূল সম্পদ বিক্রি না করে তার থেকে উৎপন্ন মুনাফা সদকা করা। শরী‘আতের পরিভাষায় এ জাতীয় সদকাকে ওয়াকফ লিল্লাহ বলা হয়। যেমন, দাতার নির্দিষ্ট জমি আছে, সে জমি ভাড়া দেয় ও তার ভাড়ার টাকা সদকা করে। এই জমি আল্লাহর জন্য ওয়াকফ। অথবা কারও দুধেল গাভী রয়েছে, সে গাভী রেখে তার দুধ আল্লাহর রাস্তায় সদকা করে। এই গাভী আল্লাহর জন্য ওয়াকফ। অনুরূপ মৃত ব্যক্তির পক্ষে সদকা করা বৈধ, যদিও তিনি ওসিয়ত না করেন।
কতক সদকা এমনও রয়েছে, যা সকল শ্রেণির মানুষ করতে পারে, যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«على كل مسلم صدقة» فقالوا: يا نبي الله، فمَن لم يجد؟، قال: «يعمل بيده، فينفع ويتصدق» قالوا: فإن لم يجد؟، قال: «يُعِينُ ذا الحاجة الملهوف» (وهو المحتاج احتياجاً شديداً)، قالوا فإن لم يجد؟، قال: «فليعمل بالمعروف، وليُمسك عن الشر فإنَّ له صدقة».
“প্রত্যেক মুসলিমের ওপর সদকা করা জরুরি, তারা বলল: হে আল্লাহর নবী, যার সদকা করার মত কিছু নেই? তিনি বললেন: নিজের হাত দিয়ে কাজ করে উপকৃত হবে ও সদকা করবে। তারা বলল: যার এই ক্ষমতা নেই? তিনি বললেন: কষ্টে থাকা লোককে সাহায্য করবে। তারা বলল: যার এই ক্ষমতা নেই? তিনি বললেন: তার উচিৎ ভালো কাজ করা ও অনিষ্ট থেকে দূরে থাকা। কারণ, এটিও তার জন্য সদকা”।[1]
«على كل نفسٍ فى كل يومٍ طَلَعَتْ فيه الشمس صدقة على نفسه» قلتُ: يا رسول الله مِن أينَ أتصدق وليس لنا أموال؟، قال: «لأن مِن أبواب الصدقة: التكبير، وسبحان الله، والحمد لله، ولا إله إلا الله، وأستغفرُ الله، وتأمرُ بالمعروف، وتنهَى عن المنكر، وتَعْزِلُ الشوكة عن طريق الناس، والعظْمة، والحَجَر، وتَهدِي الأعمى، وَتُسمِعُ الأصَمّ والأبْكَم حتى يَفقه، وَتَدُلّ المستدل على حاجةٍ لَهُ قد عَلِمْتَ مكانها، وتسعَى بشدة ساقيْك إلي اللهفان المستغيث، وترفع بشدة ذراعيْك مع الضعيف، كل ذلك من أبواب الصدقة منك على نفسك، وَلَكَ في جِمَاعِكَ زوجتِكَ أجر».
“প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য সূর্য উঠা প্রতি দিন নিজের নফসের ওপর সদকা করা ওয়াজিব। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল কোত্থেকে সদকা করব, অথচ আমাদের সম্পদ নেই? তিনি বললেন: সদকার বিভিন্ন শাখা রয়েছে: আল্লাহু আকবার, সুবহানাল্লাহ, আল-হামদুলিল্লাহ, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আস্তাগফিরুল্লাহ এবং সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করা, মানুষের রাস্তা থেকে কাঁটা, হাড্ডি ও পাথর দূর করা, অন্ধকে রাস্তা দেখানো, বধির ও বোবাকে শ্রবণ করানো, যেন তারা বুঝতে সক্ষম হয়। সন্ধান প্রার্থীকে সন্ধান দাও, যদি তার সঠিক স্থান জান। তোমার শক্ত পা দিয়ে সাহায্যপ্রার্থীর সাহায্যে এগিয়ে যাও, দুর্বলের সাহায্যে তোমার বাহুকে দৃঢ়ভাবে উত্তোলন কর। এসব তোমার নফসের ওপর তোমার সদকার শাখা-প্রশাখা। তোমার স্ত্রীর সাথে সহবাসেও রয়েছে সাওয়াব”।[2]
>[2] সিলসিলাহ সহীহাহ ৫৭৫